০২. সময়টা পূজার ছুটির অব্যবহিত পরেই

সময়টা পূজার ছুটির অব্যবহিত পরেই। অর্থাৎ অগ্রহায়ণের শুরু সবে।

সুশান্ত, বিনয় ও ফ্যাটি গুপ্ত, দি ফেমাস্ ট্রায়ো জায়গাটা স্বাস্থ্যকর বলে এবং বিশেষ করে নির্জন ও নিরিবিলি বলে বিনয়ের বাবার যে ছোট বাড়িটি সরকার-ভিলার প্রায় কাছাকাছি ছিল সেই বাড়িতে এসে মাসখানেক ধরে বাস করছিল।

সুশাস্তর একটু বেলা করে ওঠাই অভ্যাস।

কিন্তু বিনয়ের ডাকাডাকিতে অসময়েই ঘুমজড়িত চক্ষু দুটি রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল সুশান্ত, কি হল, ডাকাত পড়েছে নাকি? ভোরবেলাতেই ষাঁড়ের মত চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেন?

ব্যাপার শুনেছিস, ওদিকে যে হুঁলুস্থুল কাণ্ড!

কেন, কি আবার হল?

সরকার-ভিলার সেই যে বুড়ো সারদা সরকার, কাল রাতে কে নাকি তাকে শেষ করে দিয়েছে।

মানে?

মানে আর কি–খতম!

সে কি!

হ্যাঁ, একটু আগে দেখলাম বিমল দারোগা সরকার-ভিলার দিকে গেল। যাবি নাকি ব্যাপারটা দেখতে?

নিশ্চয়ই। উৎসাহে উঠে পড়ে সুশান্ত।

বিমল মানে ওদেরই কলেজের সহপাঠী ঐ জায়গার থানা ইনচার্জ বিমল সেন, ওদের ভাষায় বিমল দারোগা।

এখানে আসা অবধি প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে বিমল থাকলে ওরা থানায় তার কোয়ার্টারে গিয়ে আড্ডা জমাতো। কাজেই বিমল যখন এখানখার থানা ইনচার্জ, মানে সে-ই এখানকার হতাকা সরকার পক্ষের, তখন সরকার-ভিলাতে তাদের প্রবেশের ব্যাপারে কেউ বাধাদান করতে সাহস করবে না এটা ওরা জানত। এবং এমন একটা উত্তেজনার ব্যাপার যখন, তখন সুশান্ত আর বিনয় দেরি করে না। তারা সরকার-ভিলার উদ্দেশ্যে চটপট তৈরী হয়ে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।

ফ্যাটি গুপ্তর ওসব সত্যিকারের খুনখারাপীর ব্যাপারে কোনদিনই কোন ইন্টারেস্ট নেই, বরং তার চাইতে তার গ্রন্থে বর্ণিত কল্পনার খুনখারাপীর ওপরেই বেশী আকর্ষণ বরাবর–অথাৎ ডিটেকটিভ সাহিত্যে।

অতএব সে ভৃত্য রামহরিকে আর এক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা রোমাঞ্চ সাহিত্য নিয়ে বসল।

সুশান্ত, বিনয় ও ফ্যাটি অভিন্নহৃদয় বন্ধু বহুদিনের।

যদিও তিনটি বন্ধুর প্রকৃতি ও আকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন একে অন্যের থেকে, তথাপি কি করে যে তিনজনের মধ্যে বিচিত্র একটি ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল সেটাই আশ্চর্য!

সুশান্তর বলিষ্ঠ পেশল উঁচু লম্বা চেহারা। একমাথা কটা চুল, চোখ দুটি নীল ও বুদ্ধির দীপ্তিতে ঝকঝক করে। এম. এ. পাস করে বর্তমানে কলকাতার কোন একটি বেসরকারী কলেজের অধ্যাপক। সংসারে এক বিধবা মা ব্যতীত অন্য কোন বন্ধন নেই।

বিনয় রোগাটে লম্বা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল-শ্যাম, কবিজনোচিত ভাবুক প্রকৃতি এবং যেমন দিলখোলা তেমনি আমুদে। ব্যবসায়ী ধনী পিতার একমাত্র ছেলে। এম. এ. পাস করার পর কি একটা থিসিস্ নিয়ে ব্যস্ত বর্তমানে।

আর ফ্যাটি গুপ্ত-আসলে ওর নাম বিপিন গুপ্ত। বাপ-পিতামহের কেশতৈলের বিরাট একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সারাটা বৎসর ধরে সে ব্যবসা থেকে প্রচুর অথাগম হয়।

বৎসর দুই হল ডাক্তারী পাস করে কলকাতা শহরেই কোন এক বড় রাস্তার উপর বিরাট এক ডিসপেন্সরী করে শখের প্র্যাকটিস শুরু করেছে।

দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় সমান চেহারা, থলথলে চর্বিবহুল। মাথাটা ছোট, কুতকুতে চোখ। আবলুশ কাঠের মত গাত্রবর্ণ। ঐ বিচিত্র আকৃতির জন্যই বিনয় ওর নামকরণ একদা কলেজ লাইফেই করেছিল : ফ্যাটি গুপ্ত।

ক্রমে সেই নামটিই বন্ধুমহলে বিশেষরকম প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। আসল নামটি যেন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের দল একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল।

ফ্যাটির স্বভাবটি কিন্তু আমুদে ও হাসিখুশি।

তিন বন্ধুই অদ্যাবধি ব্যাচিলর অর্থাৎ অবিবাহিত। তবে মনোমত জীবনসঙ্গিনী পেলে বিবাহে তিনজনেই নাকি প্রস্তুত-ওরা তিনজনেই এই কথা বলে থাকে।

সুশান্ত ও বিনয় যখন সরকার-ভিলার গেটের সামনে এসে পৌঁছল, সেখানে তখন শহরবাসীর বেশ একটি ছোটখাটো ভিড় জমে উঠেছে। তবে প্রহরারত লালপাগড়ির রুলের গুতোর ভয়ে গেট থেকে একটা ব্যবধান রেখেই তারা দাঁড়িয়ে ছিল সরকার ভিলার সামনে। যে লালপাগড়ি প্রহরীটি গেটের পাশেই প্রহরারত ছিল, বিনয় ও সুশান্তকে সে চিনতে পেরে ভিতরে প্রবেশে বাধা দিল না।

দুজনে গেট দিয়ে সরকার-ভিলাতে প্রবেশ করল।

গত মাসখানেক ধরে এখানে আসা অবধি নিয়মিত যাতায়াতের পথে দুর থেকে সুন্দর ঝকঝকে সাদা রঙের দোতলা সরকার-ভিলাটি বহুবারই ওদের দৃষ্টিপথে পড়েছে ইতিপূর্বে।

কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার বেশী কিছু নয়। কারণ বিনয়ের মুখেই শুনেছিল সরকার-ভিলার মালিক সারদা সরকার কারও সঙ্গেই নাকি মেশেন না।

একটি বিচিত্র টাইপের ব্যক্তিবিশেষ নাকি।

এগিয়ে চলে দুজনে গেট থেকে যে কাঁকর-ঢালা রাস্তাটি বরাবর গিয়ে সরকার-ভিলার বারান্দার সামনে শেষ হয়েছে সেই রাস্তাটি অতিক্রম করে।

রাস্তার দুপাশে নানাজাতীয় স্যভুরক্ষিত ও বর্ধিত দেশী-বিলাতী পাতাবাহার ও ফুলের গাছ।

বারান্দাটির সামনে লোহার গ্রীল বসানো।

বারান্দায় পিতল, চীনা-মাটি ও সাধারণ মাটির টবের মধ্যে নানাজাতীয় মরশুমী ফুলের বর্ণ-বৈচিত্র্যের মনোরম সমারোহ।

একপাশে একটি খাঁচায় অনেকগুলো মনুয়া পাখী কিচিরমিচির শব্দ করছে।

বারান্দায় পা দিতেই আর একজন সমৃ লালপাগড়ির সঙ্গে ওদের চোখাচোখি হল, সেও ভাগ্যক্রমে ওদের অপরিচিত নয়।

সুশান্তই প্রশ্ন করে সেই লালপাগড়িকে, দারোগা সাব কাহা পাঁড়েজী?

জি অন্দরমে—

ভিতর যানে সেকতা?

কিউ নেই-যাইয়ে না! অভয় দিল লালপাগড়ি।

দুজনে আবার অগ্রসর হয়।

বারান্দার সামনেই পারলার।

দরজার ভারী পর্দা তুলে দুজনে ভিতরে পা দিল।

ঘরটি আধুনিক রুচিসম্মত আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। ঘরের মধ্যে কেউ তখন ছিল না।

কোন্ দিকে অগ্রসর হবে এরা ভাবছে, কারণ ঘরের দুদিকে দুটি দরজা ওদের নজরে পড়েছে। ঐসময় একজন ভৃত্য এসে ঘরে প্রবেশ করল।

কাকে চান?

দারোগা সাহেবের লোক আমরা। সুশান্ত বললে।

ও, ভিতরের ডানদিককার ঘরে যান, দাদাবাবুর ঘরে আছেন তিনি।

দুজনে আবার নির্দিষ্ট ঘরের দিকে অগ্রসর হল।

সে ঘরটিও আকারে বেশ প্রশস্তই। এবং রুচিমাফিক দামী আসবাবে সুসজ্জিত। বলা বাহুল্য বিমল ঐ ঘরের মধ্যেই ছিল।

তার অ্যাসিস্টেন্ট শ্ৰীমন্ত চৌধুরী এ. এস. আই-য়ের সঙ্গে নিম্নকণ্ঠে কি যেন আলোচনা করছিল ঐ সময়ে ঘরের মধ্যে।

বিমল ওদের ঐ সময় ঐখানে দেখে প্রশ্ন করে, এ কি, তোমরা! কি ব্যাপার?

এই এলাম।

বিমলই হেসে বলে, তোদর সাহস তো কম নয়, খুনখারাপীর ব্যাপার দেখতে এসেছিস।

সত্যি-সত্যিই তাহলে সারদাবাবু খুন হয়েছেন?

সঙ্গে সঙ্গে যেন বিমল দারোগা চাপাকণ্ঠে সুশান্তকে সতর্ক করে দিয়ে এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হচ্ছে-সুইসাইড নয়, এ কেস অফ হোমিসাইড বা পয়েজনিং হবে।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সুশান্ত বিমলের দিকে।

পয়েজনিং হবে–বিষ!

তাই তো মনে হচ্ছে। তা দেখবি নাকি?

সেইজন্যই তো এলাম। সুশান্ত বলে।

দেখে আবার ভয় পাবি না তো?

সুশান্ত মৃদু হাসে প্রত্যুত্তরে।