০১. সরকার লজের সারদা সরকার

সরকার লজের সারদা সরকার নাকি নিহত হয়েছেন।

বিখ্যাত জুয়েলার সারদাচরণ সরকার ইদানীং বয়স হওয়ায় ব্যবসা আর দেখাশোনা করতেন না।

বীরভূম জেলাতেই একটি স্বাস্থ্যকর নির্জন স্থানে প্রায় এক বিঘে জমির উপর যে চমৎকার বাড়িটি সরকার-ভিলা, ইদানীং বৎসরখানেক যাবৎ সেইখানেই কর্মক্লান্ত জীবনের শেষকটা বছর শান্তিপূর্ণ বিশ্রামের অবসরে কাটাবেন বলে এসেছিলেন সারদাচরণ সরকার।

কলকাতায় বিরাট জুয়েলারী ফার্ম সরকার ব্রাদার্স এবং দিল্লী ও বোম্বাইয়ে তার ব্রাঞ্চ। ঐ অঞ্চলের সরকার-ভিলা ছাড়াও কলকাতায় ভবানীপুর অঞ্চলে বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকা আছে।

কলকাতার বাড়িতে বর্তমানে সারদাবাবুর ভাইপো মৃতদার বৃন্দাবন সরকার সকন্যা বসবাস করছিলেন। তবে প্রায়ই তাঁকেও সপ্তাহে অন্ততঃ দুবার তো বটেই, সারদাবাবুর কাছে আসা-যাওয়া করতে হত ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে ও পরামর্শ নিতে। এবং কখনও কখনও বৃন্দাবন সরকারকে এখানে এসে থাকতেও হত সরকার-ভিলায় ব্যবসাসংক্রান্ত ব্যাপারে দুচারদিন।

সারদাবাবুর স্ত্রী-বিয়োগ অনেক আগেই হয়েছিল এবং তাঁর কোন সন্তান-সন্ততি ছিল না।

ভাইপো বৃন্দাবন ও তাঁর একমাত্র কন্যা রেখাই যে হবেন অদূর ভবিষ্যতে সমস্ত সম্পত্তির মালিক সে কথা সকলেই জানত।

সারদাবাবু ভাইপো বৃন্দাবনকে স্নেহও করতেন খুব বেশী।

সারদাবাবুর বয়স ষাট উত্তীর্ণ হলেও কিন্তু শরীরের বাঁধুনি বেশ ভালই ছিল এবং মাথার চুলগুলো পেকে অধিকাংশই সাদা হয়ে গেলেও শরীরে যেন বার্ধক্য বা জরা দাঁত বসাতে পারেনি তখনও।

বৎসরখানেক ধরে সারদাবাবু সরকার ভিলায় বসবাস করছিলেন এবং সরকার-ভিলাতে তাঁকে ঐ বয়সে আত্মীয়পরিজনদের থেকে দূরে থাকতে হবে বলেই তাঁকে দেখাশোনা করবার জন্য প্রৌঢ় পুরাতন ভৃত্য দশরথ তো ছিলই, মাস আষ্টেক পূর্বে একটি মহিলাকেও নিযুক্ত করেছিলেন তিনি।

শুকুন্তলা ত্রিবেদী।

ইউনিভার্সিটির দরজাটা সায়েন্স ইন্টারমিডিয়েটের বেশী ডিঙোবার অবকাশ না হলেও সারদাবাবুর পড়াশুনা করবার কিন্তু একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল।

সরকার-ভিলায় তাঁর নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার ছিল এবং সেই গ্রন্থাগারে ইংরেজী ও বাংলা নানাবিধ পুস্তকের চমৎকার একটি সংগ্রহও ছিল।

আর ছিল তাঁর একটি নেশা বা শখ, ফুলগাছের। উক্ত দুটি নেশা নিয়েই প্রৌঢ় সারদা সরকারের অবসর যাপনের দিনগুলো একপ্রকার ভালই কেটে যাচ্ছিল।

শকুন্তলার কাজ ছিল দ্বিপ্রহরে ও রাত্রে সারদাবাবুকে বই পড়ে পড়ে শোনানো ও তাঁর নির্দেশমত মধ্যে মধ্যে হিসাবের টুকিটাকিগুলো দেখা এবং তাঁর চিঠিপত্র লিখে দেওয়া ও তাঁকে সঙ্গ দেওয়া।

কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে শকুন্তলাকেই মনোনীত করেছিলেন সারদা সরকার।

শকুন্তলা মানে মিস্ শকুন্তলা ত্রিবেদী।

বয়স শকুন্তলার ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে এবং বেঁটে রোগাটে ছিমছাম চেহারা। ঈষৎ মঙ্গোলিয়ান টাইপের মুখখানা ও গাত্রবর্ণ হরিদ্রাভ।

শকুন্তলার মুখেই শুনেছিলেন সারদা সরকার, প্রথমে অফানেজে ও পরে রেঙ্গুনের এক কনভেন্টে সে নাকি মানুষ হয়েছে ও লেখাপড়া শিক্ষা করেছে।

এক ইংরাজ মিলিটারী বাপের ঔরসে ও বর্মী মার গর্ভে তার জন্ম।

বরাবর রেঙ্গুন শহরেই সে ছিল, তারপর কিছুদিন এক বিলাতী জাহাজ কোম্পানীতে স্টুয়াড্রেসের কাজও করেছিল। তারপর সে চাকরি ভাল না লাগায় কলকাতায় এসে উঠেছিল অন্য কোন জীবিকার অন্বেষণে।

ঐসময় কাগজে সারদাবাবুর বিজ্ঞাপন দেখে সে একটা দরখাস্ত করে দেয়।

ইন্টারভিউর সময় শকুন্তলার চেহারা দেখে ও তার কথাবার্তা শুনে সারদা সরকার প্রীত হয়েই তাকে দুইশত টাকা মাহিনায় নিযুক্ত করেছিলেন আট মাস পূর্বে।

সেই থেকেই শকুন্তলা ত্রিবেদী সরকার-ভিলাতেই আছে।

 

ঘটনার সময় শকুন্তলা ত্রিবেদী ও ভৃত্য দশরথ ছাড়াও সরকার-ভিলাতে আরও ছয়জন প্রাণী ছিল।

ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন, ভৃত্য নকুল, দাসী পিয়ারী ও মালী জগন্নাথ এবং সম্প্রতি নিযুক্ত বেয়ারা কেতু।

আগেই বলা হয়েছে বই পড়ার নেশা ছাড়াও সারদা সরকারের আর একটি নেশা ছিল, সেটা হচ্ছে ফুলগাছের।

সরকার-ভিলার চৌহদ্দির মধ্যে পশ্চাতের অংশে বিরাট একটি বাগান নিজ হাতেই প্রায় বলতে গেলে তৈরি করেছিলেন তিনি।

নানাজাতীয় দুষ্প্রাপ্য ফল ও ফুলের গাছ তো ছিলই, তবে বিশেষ করে তার মধ্যে বেশী ছিল নানাবিধ ফুলের গাছ এবং তার মধ্যে আবার বেশীর ভাগ হচ্ছে নানা জাতীয় গোলাপের

গাছ বাগানটির মধ্যে।

প্রত্যহ ভোরে উঠে বেলা আটটা পর্যন্ত প্রায় ঐ বাগানের মধ্যেই মালীকে নিয়ে কেটে যেত সারদা সরকারের এবং সঙ্গে শকুন্তলাও থাকত প্রায় ঐ সময়টা।

তারপর ঘরে এসে স্নান করে চা পান করতেন।

দ্বিপ্রহর ও রাতটা কাটত তাঁর পড়াশুনা নিয়ে, সে সময় সঙ্গে থাকত শকুন্তলা সর্বক্ষণই প্রায়।

সারদা সরকার বাড়ি থেকে কখনই বড় একটা বেরুতেন না। এবং স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিশতেন না।

সেই কারণেই গত এক বৎসর ধরে তিনি সরকার-ভিলায় থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে সারদা সরকার একপ্রকার অপরিচিতই যেন রয়ে গিয়েছিলেন।

তথাপি সারদা সরকারের আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটা হাওয়ার বেগেই যেন ভোরবেলা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল ছোট শহরটির সর্বত্র।