০৩. পিঠেপিঠি কয়েকটা দিন

পিঠেপিঠি কয়েকটা দিন এইভাবে কাটলো। ঘর থেকে বের হয় নি খোকা। সম্বল বলতে কেবল খবরের কাগজ, অথচ এ জিনিসটা দুচোখে দেখতে পারে না সে, দারণ বিতৃষ্ণা। সাধারণত সে কাগজ পড়ে না, কিন্তু কিছুদিন যাবৎ তাকে পড়তে হচ্ছে।

এ কয়দিনের ভিতর সবকিছু বেজায় রকমের বদলে গিয়েছে। কাগজ হাতে নিলে মনে হয় সদ্য অস্ত্র কারখানা থেকে বারুদ মেখে এসেছে। ছিটেফোঁটা দুর্ঘটনার খবর আসছে যখন-তখন। পরস্পরবিরোধী রাজ্যির যত উড়ো খবরে বাজার সরগরম। কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু অচল; দিনরাত ঘোঁট পাকাচেছ মানুষজন।

মোড়ে মোড়ে জটলা, প্রায় সর্বক্ষণ প্রতিটি রাস্তাতেই বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিটি ময়দানেই জনসভা। সর্বত্র একই কানাকানি, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার উদ্দেশ্য কি, নাকি আসলে সবটাই আগাগোড়া একটা ধাপ্পা; আবার সেই বুটজুতো আর রাইফেলের বাটের গুঁতো!

ক্ষেপে উঠেছে মানুষজন; একটু স্বতন্ত্র এবারের এই ক্ষ্যাপামির চরিত্র। আয়ত্তের বাইরেও চলে যাচ্ছে কোথাও কোথাও। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো হবে এবার, এইসবে বিশ্বাসী অতি সাধারণ মানুষও। অবাঙালি পজিপতিরা বস্তা বস্তা টাকা পাচার করে ফেলছে, রুই কাতলারা ভাগছে, গা ঢাকা দিয়েছে অনেকেই, একটা কালো পরিণতি ধীরে ধীরে তার ক্ষেত্র তৈরি করছে।

সাত-সকালে ময়নার বাবা এসে এক ঝঞাট বাধালো। সে ড্রাম ফ্যাক্টরির শ্রমিক, রায়পুরের লোক। এখন আর ঢাকা শহর নাকি মোটেই নিরাপদ নয়, ময়নাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে চায়।

খোকা বিরক্ত হয়ে বললে, আমাদের ফেলে বাছাই করে তোমার মেয়েকে কেউ মারতে আসবে না।

লোকটা নাছোড়বান্দা ধরনের। বললে, আপনাদের আবার কিসের ভয়? আপনাদের কেউ মারতে আসবে না। চিরকাল যত গজব সব আমাদের মতো ফুটোকপালে গরিব-দুঃখীদের উপরই; গায়েও আঁচড় লাগবে না আপনাদের

খোকা পষ্টাপষ্টি বলেই ফেললে শেষ পর্যন্ত, ও চলে গেলে অসুবিধে। হবে আমাদের!

ময়নার বাবা বললে, লোকে যা বলাবলি করছে তাতে শহরে থাকা চলে না। পারলে কিছুদিনের জন্যে আপনারাও একদিকে চলে যান। আল্লা করুক, জয়বাংলা যদি হয়েই যায় তাহলে আর মেয়েটাকে ঝিগিরি করায় কে।

খোকার মেজাজ খিচড়ে উঠলো এইসব কথায়। বুঝলো কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না, খামোকা, পাগল ক্ষেপেছে; ময়নার বাবার এমন একরোখা চেহারা এর আগে আর কখনো চোখে পড়ে নি তার। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু ওকে নাড়া দিচ্ছে, খোকা বুঝতে পারে, ফলে বিশ্বাসে যত না জ্বলজ্বলে তার চেয়ে বেশি উদ্ধত এখন লোকটা, ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।

কি রে ময়না যাবি নাকি? ভিতরে গিয়ে সে জিগ্যেস করলো ময়নাকে। বললে, যাবি তো যা, সৎ মায়ের কাছে আগের মতো আরামেই থাকবি!

ময়না বললে, আগে বলে দিয়েছি, যাব না আমি—

তোর মর্জি!

ময়না বললে, আমার জন্যে অত ভাবতে হবে না, বলে দিন।

তাহলে যা, বিদায় করে আয়–

ময়নাকে গররাজি দেখে গালাগাল শুরু করলো লোকটা। বললে, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার? চুল ধরে হিড় হিড় করে টেনে বার করবো এখান থেকে। বড়লোকের বাড়িতে ফ্যানের বাতাস খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে যাওয়া দেখাচ্ছি তোকে, এইবেলা গোছগাছ করে নে, নইলে মেরে তক্তা বানাবো?

মেয়ে নিয়ে যেতে এসেছো, মেয়ে নিয়ে যাবে; বাজে কথা বললে অসুবিধেয় পড়বে বলে দিলাম–খোকা তেড়ে উঠলো।

আমি আমার মেয়েকে বলছি, আপনি গায়ে মাখছেন কেন? ঘোত ঘোত করে উঠলো লোকটা, ওটা একটা কুত্তি, কুত্তিটাকে এইবার চেন দিয়ে বাঁধবো, ওর রস মেরে গুড় করবো

ফোঁস ফোঁস করে কান্না শুরু করলো ময়না।

শেষ পর্যন্ত দুদিন পরে তার যাওয়া সাব্যস্ত হলো।

রঞ্জু মুখ কালো করে বললে, এখন উপায়?

সেলফ-হেল্প!

নিজে তো বলেই খালাস!

কেন, ঠিকে ঝি আর লেবুকে দিয়ে চলবে না?

ঠিকে ঝি তো কদিন থেকে ঝক্কি শুরু করেছে, ও নাকি আর কাজ করবে না, দেশে যাবে। এতোদিন আমরা ফাঁকি দিয়ে ইচ্ছেমতো ঠকিয়েছি ওদের, মানুষ বলে গ্রাহ্যই করি নি, কাজে এলেই প্যান প্যান করে এইসব তোলে–

এক কাজ করা যাক বরং–খোকা হাসতে হাসতে বললে, আয় দুজনে মিলে আমাদের আগা মোহম্মদের কাছে একটা পয়েন্ট পিটিশান করি, কামের লোকের খুব অভাব, তোমার ওই দস্তানাগ গাওয়া কিছু বুগতি-টুগতি এদেশে পাঠাও।

কিছুটা আনমনা হয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে র ঞ বললে, কি সব অলক্ষুণে কাণ্ডকারখানা শুরু হয়েছে বলতো, একরত্তিও ভালো লাগছে।

আমার! তোদের কলেজের মেয়েরা পাকাঠির গোছা হাতে নিয়ে সমানে রাস্তায় রাস্তায় ডান-বাম ডান-বাম করে বেড়াচ্ছে, খবর রাখিস?

দুর, আমার ওসব ভালো লাগে না!

কলেজে যে ফাটাফাটি চলছে রঞ্জু তা জানে। কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে; ক্লাস হয় না, স্রেফ মিটিং আর মিছিল।

যা না, ঘুরে আয়, নিদেনপক্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোকরা তো দেখা হবে–

রঞ্জু বললে, এই একটু আগেই তো পাড়ার কয়েকজন ডাকতে এসেছিলো। ওরা হেঁটে কলেজে গেল। বহু মেয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে!

তোদের আবার ট্রেনিং লাগে নাকি! তোরা তো পেটে থাকতেই হাফেজ বনে যাস!

রঞ্জু বললে, রাইফেল ট্রেনিং রাইফেল ট্রেনিং

কচু হবে ওতে, শালার এটা একটা ফ্যাশন; যা নড়য়ে তোমরা এক একখান, এহ!

রঞ্জু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। বললে, শেষ পর্যন্ত কি হবে বলতো?

কি আবার হবে, হয় দুপাঁচশো লোক মেরে সব ঠাণ্ডা করে দেবে না হয়–

বাধা দিয়ে রঞ্জু অসহিষ্ণু হয়ে বললে, সব মেনে নিলেই তো পারে, শুধু শুধু হই হই রক্তারক্তি করে লাভটা কি?

তুই বরং ঘচাং করে একটা খত ঝেড়ে দে, কাজ হলেও হতে পারে, লোকটা নাকি মেয়েলোকের কথায় ওঠে-বসে।

ঠাট্টা রাখ, একটু বুঝিয়ে বল্ না ছাই! আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার সময় তো মুখ দিয়ে কথার তুবড়ি ছোটে।

রঞ্জুর বিনুনি ধরে একটা টান মেরে খোকা বললে, তুই যা বুঝিস অন্তত সেটুকুও যদি ওদের মগজে ঢুকতো তাহলে তো আর কোনো ল্যাঠাই ছিলো না।

আচ্ছা ধর, শেষ পর্যন্ত যদি কোনোরকম মীমাংসা না হয়?

হবে কে বললে?

ধর হলো না, তখন?

কেন প্লেন বোঝাই বোরখা পরা সৈন্য নামছে রোজ এয়ারপোর্টে শুনিস নি?

বাপি যে কেন আগেই চলে আসছে না!

রাওয়ালপিন্ডির পিন্ডি চটকাবে কে, তুই?

যাই বলিস, চাকরি জিনিসটা এতো বাজে—

এ্যাঁ, পথে এসো বাবা, পথে এসো। সেই জন্যেই তো বেকার বসে আছি।

তুই একটা কুড়ের ডিম, চাকরি কেন, তোকে দিয়ে কিছুই হবে না কখনো।

লম্বা হাই তুলে পটাপট দুটো আঙুল মটকে খোকা আউ আউ করে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, বেশ আছি শালার, কি বল? আহারে, চিরটা কাল যদি এইভাবে আরামসে পিপুফিশু করে কেটে যেতো!

শরীরে ঘুণ ধরতো, উইপোকা ধরতো—

শরীরে উইপোকা না ধরলে কি আর মুনি-ঋষি হওয়া যায় রে, তুই একটা ইপিস্ট, ষাঁড়ের গোবর, গোমুখ্য!

একটু পরেই জয়বাংলা বলে মুরাদ ঘরে ঢুকলো।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছে একগ্লাস পানি চেয়ে খেলো সে। বললে, কদিন থেকে হাঁটতে হাঁটতে শালার পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছে।

বলিস কি, ফোস্কা আবার কি তোর পা জোড়াই তো ফোস্কা।

তার মানে?

একে বেকার, তায় শালা আবার মাঝে মাঝে কবিতে সঙ্কলন বের করার ঘোড়ারোগ আছে, তোর পা আবার কবে পা ছিলো শুনি?

একটু লাগলো মুরাদের এই কথাটা। খোকার মতোই সে বেকার। তফাতটা শুধু এই, গোটা দুয়েক মাস্টারি করে সে আর চাকরির চেষ্টা তদবিরের জন্যে ঢালাও সুপারিশমামা ছুঁড়ে বেড়ায়।

মুরাদ আলগোছে বললে, বাপের টাকা থাকলে তো ধ্বংস করবো। সে যাক, কি করিস কোথায় থাকিস, প্রায় সারাদিনই আজকাল রেক্সে আড্ডা চলে, একদিনও পাওয়া যায় না তোকে, নাকি সব ছেড়ে-ছুড়ে একেবারে যোগী হয়ে গেলি!

ধরেছিস ঠিকই।

আমি তো ভাবলাম নির্ঘাৎ অসুখ-বিসুখ একটা কিছু বাধিয়ে বসে আছিস, তা না হলে এই সময় কোনো পাগলেও ঘরে বসে থাকে বলে আমার মনে হয় না। এই তো সময় চুটিয়ে আড্ডা মারার। গরম বাজার, অফুরন্ত সময়, স্রেফ চা মারো আর গুলতানি।

ব্যাস্, তাতেই দেশ স্বাধীন? আলবৎ তাই! স্রেফ চায়ের কাপে চুমুক মেরে আর গুলতানি ঝেড়ে স্বাধীনতা নিয়ে আসবো এবার, দেখে নিস। এবারে শালার স্বাধীনতা রোখে কে?

খাতায় নাম লিখিয়েছিস নাকি, যে টোনে কথা বলছিস।

ওসব বুঝি না–মুরাদ চঞ্চল হয়ে বললে, এখানে-ওখানে। বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ উড়তে দেখা যাচ্ছে, এখন পিছনে ফেরার আর কোনো পথ নেই চাঁদ।

সর্বনাশ! তুইও কি ট্রেনিং নিচ্ছিস?

ট্রেনিং? ট্রেনিং আবার কি। নে নে খচড়ামি রেখে চা-টা খাওয়াবি তো। খাওয়া।

যথাসময়েই চা আসবে। অপেক্ষাকৃত বিমর্ষ মুখে খোকা বললে, সত্যি করে বলতো, এইসব হৈহল্লা দা-কুড়ল-লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পায়তারা, এখানে-ওখানে লুটতরাজ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এসব ভালো। লাগছে তোর?

মুরাদের চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে সহসা।

বললে, এটা ঠিক ব্যক্তিগত ভালো লাগালাগির ব্যাপার নয়, তুই ছোট করে দেখছিস বলে তোর কাছে অমন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা সমগ্র দেশকে নিয়ে, একটা গোটা জাতিকে নিয়ে। ঘরের কোণায় বসে তুই কি ভাবলি, কিংবা রেক্সের আড্ডায় বসে নিছক ভাবাবেগের খাতিরে আমি কি বললাম, এইসবে কিছু যাবে আসবে না। তাকিয়ে দেখ সারা দেশটার দিকে; একটা ক্ষুব্ধ বাঘ, থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে তার গর্জন। যে কোনো মুহূর্তে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আজ তো শুনলাম কুমিরার কাছাকাছি দুহাজার সৈন্য এসে পৌঁছেছে, যে-কোনো মুহূর্তে তারা নেমে পড়বে–

তার মানে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের দিকেই মোড় নিচ্ছে সবকিছু, এই তো বলতে চাস?

আমার তো তাই মনে হয়। এই শালার রাসপুটিনের চেহারা মার্কা বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড় দেখলেই আমার হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়; একটা সাংঘাতিক কিছুর আচ করতে না পারলে ব্যাটারা এমনভাবে চাক বাঁধতো না ঢাকা শহরে। টিক্কা খানকে পাঠানোর ব্যাপারটাও যে নিছক একটা ব্লাফ আমি তা মনে করি না। পুরোদমে একটা ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে, দেখা যাক কি হয় আগামীকাল!

রেসকোর্সের মিটিংয়ের কথা বলছিস?

হ্যাঁ। সবাই কানাঘুষো করছে কালকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে। বেশ লাগছে যাই বলিস। জীবনে এই রকমেরই উত্তেজনা চাই! স্বাধীনতা-টাধিনতা বুঝি না, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি দেশটা একটা বৈপ্লবিক পরিণতির দিকে লেজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে।

পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিস তুই?

পরিষ্কার–

ধর বেধড়ক মার দিয়ে যদি সবকিছু আবার ঠাণ্ডা করে দেয়, তখন?

একটু ভেবে নিয়ে মুরাদ বললে, এখন যে পরিস্থিতি তাতে সেটাই স্বাভাবিক। যতই ট্রেনিং নিক, কুচকাওয়াজ করুক, দেশের লোকের হাতে আছেটা কি? বাঁশের লাঠি আর পায়খানা ঘরের ঝাড়. ব্যাস্! এই কিছু না থাকাটাই মারমুখী হতে প্রলুব্ধ করবে সামরিক শক্তিকে, আর সত্যি কথা বলতে কি এই মারটাই আমাদের ভয়ঙ্কর রকম দরকার। চিন্তা করে দেখ, সামুদ্রিক বান আর ঝড়-ঝাপটায় যেখানে এক কথায় ঝট করে পনেরো-বিশ লাখ লোক গরু-ছাগলের মতো বেঘোরে মারা পড়ে সেখানে দেশের আমূল পরিবর্তনের খাতিরে দুদশ হাজার লোকের আত্মাহুতি তেমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। মোদ্দা কথা, ওরা যদি ভুল করে সামরিক শক্তি প্রয়োগের টিকাই বড় করে দেখে থাকে তাহলে বিপ্লবের জন্যে এটাই হবে সোনায় সোহাগা; তখন কোন্ শালা আর ঠেকিয়ে রাখে বিপ্লব। খ্যাংরাকাঠি আর মচকানো বংশদণ্ড ফেলে ঠিক তখনই হবে সশস্ত্র সংঘর্ষ। চেগুয়েভারার মতো ধরে নিতে পারিস বিপ্লবের জন্যে তখন আর মাথা কুটে মরতে হবে না আমাদের, বিপ্লব নিজেই কলকাঠি নেড়ে দুদ্দাড় করে টেনে নিয়ে যাবে মানুষকে। সামরিক শক্তি প্রয়োগ হবে সব কথার শেষ কথা, মানে নির্লজ্জ শেষ চেষ্টা, মরণ কামড়। সেটা যদি কোনোক্রমে একটু চিড় খায়, তাহলে ব্যাস্, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, গানের বই গানের বই গানের বই–খোকা দাঁত দিয়ে বুড়ো আঙুলের নখ কাটতে লাগলো কুট কুট করে। অসম্ভব দুশ্চিন্তাকাতর মনে হয় তাকে। অকূল পাথারে ভাসছে, থৈ পাচ্ছে না।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুরাদ বললে, এই চান্সে আমি কি করেছি জানিস, আড়াইখানা কবিতার পত্রিকায় হাত দিয়েছি। এইবার সব লীশা হিজড়েগুলোর পিলে ফাটিয়ে দেবো। যা একখানা মাল ছাড়বো না, দেখে নিস! একটা তো বেরিয়েই গেছে–

লীশা কি রে?

শালী থেকে লী, শালা থেকে শা, বুঝলে চাঁদ?

তুই এখনো সেই আগের মতো ঈশ্বর অন্ধকার চিৎকার কবোষ্ণ টবোষ্ণ চালাচ্ছিস নাকি?

তোর শালা সেই পাঁচ বছর আগেকার কথা তুলে খোঁচা দেওয়াটা একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে! নিজে শালা এ পর্যন্ত কি এমন হাতি ঘোড়া, বাঘ-ভালুক মেরেছিস শুনি?

মুরাদকে চটে উঠতে দেখে খোকা হেসে ফেললো।

বললে, অমন দাঁতমুখ সিটকে হাত-পা ছুড়িস না, তোকে উল্লুকের মতো দেখায়! আমার তো বারোটা বেজেই গেছে, এ আর নতুন কথা কি–

মুরাদ বললে, বাজে কথা রাখ, রেসকোর্সে যাচ্ছিস তো কাল?

কালকের কথা কাল হবে, তুই কি এখন উঠছিস?

যেতে হবে না? চোখ নামিয়ে মুরাদ বললে, তোর কি, তুই শালা দিনের পর দিন ঢালাও বিছানায় বুদ্ধের শয়ান হয়ে থাকবি, আর পায়দল মেরে মেরে অন্যেরা তোর চেহারা মুবারক দেখে যাবে, আছিস বেশ! যাচ্ছিস তো? প্রত্যেকটা দিন এখন ইতিহাসের এক একটি পাতা; আমরা এক একজন এক একটা সাক্ষী হয়ে থাকবো। চলে আয় রেক্সে, এক সঙ্গে দল বেঁধে বের হওয়া যাবে।

চেষ্টা করে দেখবো।

দিন দিন তুই শালার একটা কুনোব্যাঙ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাচ্ছিস!

যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো মুরাদ, তারপর কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললে, দোহাই তোর, কালকে আয়–

খোকাকে খুব অসহায় মনে হয় এই সময়। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু ছুরির মতো কাটছে তাকে, সুস্থির হতে পারছে না কিছুতেই; হাতের মুঠোয় এমন একটা কিছু চায় খুব ধারেকাছে যা নেই, কিংবা কোনোদিন আর তা পাওয়া যাবে না।

জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সে। রাস্তায় মিছিল; স্লোগান ফেটে পড়ছে, রক্ত চাই রক্ত চাই! দুপুরের ঝিলমিলে রোদ, বাতাস এবং যাবতীয় নিঃশব্দ চারুময়তা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। জ্বরাক্রান্ত সময়ের গা থেকে ভাপ উঠছে, ঝাঝালো তাতানো দস্যুর মতো আকাশ রোষ কষায়িত নেত্রে অপলক চেয়ে আছে, যে-কোনো মুহূর্তে ছুড়ে মারবে ঝনঝনে থালা, খোকা তার নিজের ভিতরে একটা অদ্ভুত ধরনের ভাঙন অনুভব করে।

আসাদের কথা তোর মনে আছে মুরাদ?

দূরাগত ধ্বনির মতো মুরাদের কানে বাজলো কথাটা। বেরুতে গিয়ে সে আবার ঘুরে দাঁড়ালো। বললে, মনে থাকবে না কেন, সেই যে–

আপদ বালাই উল্টো হাঁটে
দুরমুশ খাঁ ঠোকে জুতো,
আসাদ শুধু ম্যাজিক দেখায়–
ফুস-মন্তর দেখলি তো?

খোকা বললে, আমি ভাবতেই পারি না আসাদ নেই। খুব কষ্ট হয় আমার। এই যে ও নেই, তার জন্যে কার কি এমন ক্ষতি হয়েছে, কি এমন যাচ্ছে আসছে? নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই–এসব একেবারেই বানোয়াট কথা, কানে খুব ভালো শোনায়, এইটুকুই! অন্যকে মরতে উৎসাহিত করাটা পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে সহজে একটা কাজ। মরণ রে, তুহু মম শ্যাম সমান, শ্যাম সমানই যদি হবে তবে নাভিশ্বাস ওঠার পর কবরেজ-বদ্যি করার কি দরকারটা এমন? নিছক একটা ধাপ্পা, একটা জঘন্য প্রচারণা, বাবু বিলাসিতা

মুরাদ বললে, অনেক সময় আসাদের জন্যে আমার নিজেরও নানান কথা মনে হয়; কষ্ট দেয় ওর স্মৃতি। অন্যদের চেয়ে আমাদের কষ্টটা বোধহয় একটু বেশিই। কিন্তু কেন জানিস? ও আমাদের খুব কাছের একজন ছিলো বলে, চিনতাম বলে, জানতাম বলে। আসাদ ছিলো আমাদের কাছে বাতাসের ঝাপটার মতো হঠাৎ দেখা পাওয়া বন্ধু; এই জন্যেই কষ্টটা। অত্যন্ত ব্যক্তিগত এ কষ্ট। যারা তাকে চিনতো না বা যাদের সঙ্গে তার কখনো পরিচয় ছিলো না, তাদের কাছ থেকেও কি তুই এটা আশা করিস? যদি করিস, তাহলে সেটা নিছক পাগলের পাগলামি। চোখটা নিজের দিক থেকে ফিরিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থের মাপকাঠিতে ফেলার চেষ্টা কর, দেখবি আজ আর এটা নিছক একটা নাম নয়, ঝকঝকে সোনার তরোয়ালের একটা প্রতীক, বিশাল দেশের ওপর স্থির বিদ্যুতের মতো যা ঝুলে রয়েছে। এভাবে দেখতে পারলেই বুঝবি তোর ওই বন্ধুর জন্যে শোক হা-হুতাশ তরতর করে একেবারে পানসে হয়ে গিয়েছে। দেশের কষ্টিপাথরে যদি এভাবে সবকিছু ঘষে নেবার চেষ্টা করিস তাহলে দেখবি আমাদের এইসব ব্যক্তিগত শোক আর কিছু নয়, এক ধরনের গোপন সুখ, আর সুখ বলেই দিনের পর দিন এমনভাবে তা বুকের ভিতর লালন করে চলি। কিংবা ধর ঠিক তাও নয়; ওটা একটা শোকই। শোক হলেও ফ্লু কিংবা চোখ ওঠার চেয়ে, কিংবা টনসিলের ব্যামোর চেয়ে তেমন কোনো মারাত্মক কিছু নয়।

ডাকাতের মতো কথা বলছিস! অনেক বদলে গেছিস কদিনে, জঘন্য!

আমি বলে দিলাম, তুই দেখে নিস, তোর কপালে ঢের বিপদ আছে খোকা! তুই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখিস নি। দেশ হয়তো ক্ষমা করে, কিন্তু সময়, ভ্যাট!

দেশ দেশ করে চাষার মতো অমন চিত্তার জুড়েছিস কেন? দেশ বলতে কি বুঝিস তুই? একটা আধপাতা বয়সের ছোকরা, কতোটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর? কবিতা লেখার নামে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করছিস পাঁচ বছর; যখন দেখছিস কিছু হচ্ছে না তখন ষাঁড়ের মতো গায়ের জোর ফলিয়ে বলছিস এক্সপেরিমেন্টাল। ডিপার্টমেন্টাল হেডদের মোট বয়ে বয়ে নাড়ু বাবুটি সেজে কোনো রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিস, কিন্তু ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। নিজের বেকারত্ব নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এখন হঠাৎ দেশ দেশ করে পাগলা হয়ে উঠেছিস, আমাদের ময়নার বাপ যেমনভাবে বলে জয়বাংলা কায়েম হলেই আর কাজ করাতে হবে না তার মেয়েকে! এটা আর কিছু নয়, ক্লাস পাবার জন্যে হেডস্যারদের ঝকামুটে সাজা যেমন, বিজ্ঞাপনের টাকা মারার জন্যে সঙ্কলন বের করা যেমন, ঠিক তেমনি একটা কিছু! দেশের তুই কি বুঝিস?

মুরাদ ফিরে এসে বসলো। বসার সময় হাতের বইগুলো ডিভানের ওপর ছুড়ে দিলো; বই ছুড়ে ডিভানটাকে সজোরে মারলো সে। তারপর আচমকা সেন্টার টেবিলে দুম করে প্রচণ্ড কিল বসিয়ে বললে, তুই একটা ইতর, জঘন্য তোর মন! কিসের জোরে কোন্ অধিকারে এতো সহজ তুই এসব কথা বলতে পারিস?

ড়ের মতো চিৎকার করবি না। এটা রেক্স নয়, ভদ্রলোকের বাড়ি! আমি চিৎকার করছি, না চিৎকার করছিস তুই? তুই একটা বদ্ধোন্মাদ!

দাদা!

দরোজার ভারি পর্দার গা ধরে রঞ্জু এসে দাঁড়িয়েছে, খোকা দেখতে পেল। বললে, ও কিছু না, তুই ভিতরে যা—

একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সে আবার আগের জায়গাতেই এসে বসলো। বললে, তোর সম্পর্কে কতগুলো বাজেকথা উচ্চারণ করতে হয়েছে, এজন্যে দুঃখিত। কিন্তু যা সত্যি তা বলতে আমি কারো চোখ রাঙানোর পরোয়া করি না। অধিকার আবার কিসের, সাহস লাগে নাকি এতে?

মুরাদ ততোক্ষণে বন্য পশুর মতো হিংস্র উত্তেজনাকে ঝেড়ে ফেলে অনেকটা সংযত হয়ে এসেছে। সে কতকটা সহজ হওয়ার অভিপ্রায়েই আহত কণ্ঠে বললে, আমি তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে আসি নি–

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, কিন্তু দরকার হলে মারামারিও তুই করতে পারিস!

তোর আত্মম্ভরিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তুই কি ভাবছিস না ভাবছিস তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি শুধু গোটা সমস্যাকে দুজনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে দেখতে চাই নি, যেটা তুই চাস। কথা হচ্ছিলো দেশ নিয়ে; তার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিলি তুই। নিছক মাতলামি ছাড়া আর কি বলবো একে! দেশ বলতে তোদের ধানমণ্ডির এই বাড়ি নয়, যা ঘুসের পয়সায় তোর বাবা তৈরি করেছে। দেশ মানে খান। সাহেবদের দালালি নয়। দেশ মানে ভক্ত কুকুরের মতো প্রভুদের পা চাটা নয়। এই যে হারামির পয়সায় থরে থরে সাজানো তোর ঘর, চারপাশের রাশি রাশি বই, আলস্য আরাম ঘুম, দেশের চেহারাটা ঠিক এর উল্টোটাই!

খোকা মরিয়া হয়ে বললে, তুই তাহলে নিশ্চয়ই একথা বোঝাতে চাচ্ছিস আমাকে, দেশ মানে তোর বাবার রেশন শপের যাবতীয় সেদ্ধ চাল বাজারে ব্ল্যাক করে গম আর আতপ চাল গেলানো। দেশ মানে তোর ম্যাট্রিক ফেল চোগা-চাপকান চাপানো বড় ভাইয়ের ফোরকানি কেতাব চড়াদামে বি, এন, আর-এর কাছে গচানো। দেশ মানে তোর বড়বোনের জীবন বীমার দালালি করা, ব্ল্যাকডগ গিলে চুর হয়ে লাল নীল-সাদা-কালো টয়োটা-ইম্পালায় মাঝরাতে ঘরে ফেরা। ঠিক আছে। আমি মেনে নিচ্ছি। আর এই সঙ্গে এও মেনে নিচ্ছি এই দেশটা একা তোর, আমি কেউ নই, হতে পারি না এই দেশের। দেশ বলতে যদি এই সবই হয় তাহলে দেশদ্রোহী হতেও রাজি আছি আমি।

এগুলো কোনো তর্কই নয়, নোংরা কাদা মাখামাখি। এর কোনো মানে হয় না–অপেক্ষাকৃত ঝিমিয়ে পড়ে মুরাদ, নিষ্প্রভ হয়ে আসে।

কেন তোর বোনের প্রসঙ্গ উঠেছে বলে?

তোর যা খুশি বলে যা, এসব যখন তোর ভালো লাগছে। আমি বাধা দেয়ার কে?

কেন ড্যাফোডিলে বসে বিয়ার গিলতে গিলতে হাউ হাউ করে আমার কাছে এসব কাঁদুনি গাইবার সময় তো খারাপ লাগে নি! নাকি বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছিলি সেদিন?

বাজে কথা রাখ! সিগ্রেট ধরিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে বসলো মুরাদ, তেমন কিছুই ঘটে নি এই রকমের একটা ভঙ্গি করে সে বললে, দেশ বলতে আমি কি বুঝি তাই জানতে চাস তুই, বলছি শোন! কখনো বন উপবন, খাল-বিল, নদ-নদী, পশু-পাখি, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-মানুষ রাজ্যের যাবতীয় জিনিস নিয়ে যে ভৌগোলিক সীমা, তাই হলো দেশ। এক্ষেত্রে পদ্মার ইলিশ কিংবা মাঠের একটা ঘাসফড়িং সুন্দরবনের একটা চিতল হরিণ কিংবা মানিকছড়ি, পাতাছড়ি, হিমছড়ির মোটা মোটা শিশির বিন্দু কোনো কিছুই বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই। কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। এমন কি স্মৃতি, অর্থাৎ অতীতে এই সীমার আওতায় যা ছিলো তাও কখনো মহাস্থানগড় হয়ে কখনো শালবন বিহার হয়ে দেশ শব্দটির মধ্যে। গ্রথিত হয়ে যায়।

থামলি কেন, চালা–পা লম্বা করে দিলো খোকা।

কিছুক্ষণের জন্যে থেমে, সিগ্রেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া উদ্ভগরণ করে কুণ্ডলির ভিতর থেকে গলা তুলে, আমি তোমাকে বধ করতে চাই না। আমি তোমাকে বাধ্য করবো শুনতে–এই রকম একটা ভঙ্গিতে পুনরায় শুরু করে মুরাদ, আবার কখনো লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সমষ্টিবদ্ধ মানুষ মিলেমিশে এমনভাবে পৃথিবীর একটি পৃষ্ঠদেশ তৈরি করে যে দেশ শব্দটির রোমান্টিকতা পদপিষ্ট হবার ভয়ে সমষ্টির ওই লৌহবন্ধনীর ভিতর প্রবিষ্ট হয়ে ইচ্ছেমতো হারিয়ে যায়। আর তখন, এমন একটা মূর্তিমান অবস্থার দরুন পদ্মার ইলিশ, ইস্টিমার, পুরানো পল্টনের বুড়ো অশথ গাছ, আলস্যকুঞ্জ, মায়াবন, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়। শারদ আকাশ, বিনম্র কুঞ্জলতা, দিঘির পাড়ের বিলোল বিকেল, কালো কুচকুচে নৌকোর মতো বেদেনীর তীক্ষ্ণ শরীর, কিছুই আর মনে থাকে না তখন। অথচ এইসব যে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় তাও নয়—

থামলি কেন চালা–পা লম্বা করে দিলো খোকা।

খোকা নীরবে শুনছিলো। তার ঘাড়গোঁজা মূর্তি দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো মুরাদ খাঁচায় পুরে খোঁচা দিলেও টু শব্দটি করবে না সে এখন। খোকার এই ধরনের নাটুকেপনাময় মতিগতির সঙ্গে তার অল্পবিস্তর পরিচয় আছে।

পদপিষ্ট হবার ভয়ে কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো খোকা। নিছক খুশি করার জন্যে বলা, নাকি অগোচরে ঠোঁট গলে টুপ করে ঝরে পড়েছে! হয়তো ঘোলাটে পরিস্থিতির পাগলা ঘোড়ার ঘাড় অন্যদিকে ফেরাবার লাগাম হিসেবেই অঙ্ক কষে ব্যবহার করলো মুরাদ কথাটা। কিন্তু এতো প্যাচের ভিতর যাবার কথা নয় মুরাদের; সৎসাহস আছে ওর, খোকা জানে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে লতা-গুল্ম, ফল-ফুল, জলবায়ু, জন্তু-জানোয়ার মানুষ সবকিছুর এক আবশ্যিক সমীকরণ হলো দেশ, যা প্রতিনিয়তই পর্যায়ক্রমে এক একটি চূড়ান্ত বাস্তব অবস্থার ভিতর দিয়ে অনিবার্যভাবেই ছুটে চলেছে মহাকাল তথা ধ্রুবের দিকে–

খোকার দিকে তাকালো মুরাদ। তার চোখমুখের ঘুটঘুটে সেই মেঘটা সম্পূর্ণ বিদূরিত এখন; রুগ্ন অপ্রকৃতিস্থতা কেটে গিয়ে আলো ঝলমল করছে।

একটু আগেই কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে ঘরের ভিতরে নাটকের যে তুলকালাম দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিলো দুজনের কারো মুখ দেখেই এখন তা অনুমান করা শক্ত।

ভুল বলেছি কিছু?

কি জানি! গা ছেড়ে দিয়ে জবাব দিলো খোকা।

বুঝতে পারছিস তো, দেশ কতোগুলো অবস্থারও নাম–

বুঝতে পারছি–খোকা হেসে বললে–তুই কবিতা লিখিস খিস্তির ভাষায়, আর কথা বলিস কেতাবী ভাষায়, ব্যাপারটা কিন্তু অদ্ভুত!

মুরাদ সংযম বজায় রেখেই বললে, তোর সমস্যাটা কি আমি তা জানি। তোর সমস্যা হলো দেশ আগে না মানুষ আগে; দেশ বড় না মানুষ বড়। আসলে মানুষ নিয়েই যে দেশ এই সহজ সরল সমাধানটা তোর মগজে ঢোকে না, কেননা তোর ধড়ের উপর যে কাঁধ, কাঁধের উপর যে মাথা, তা একটা নয় গোছা গোছা। একটার জায়গায় দশটা মাথা হলে সে আর মানুষ থাকে না, সে হয় গাছ। গাছের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে কোনো লাভ নেই!

বাদানুবাদ হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতো, কিন্তু বাইরে দাপাদাপি আর হৈ-হল্লার শব্দ পেয়ে মুখ বন্ধ করে উভয়েই উৎকীর্ণ হয়ে রইলো সেদিকে। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, এইসব কানে আসে। একটা বিক্ষুব্ধ মিছিল দারুণ চিৎকারে দিগ্বিদিক তোলপাড় করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দেবো দেবো দেবো দেবো–রক্ত রক্ত রক্ত দেবো, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত; দ্রুত চেহারা বদলে যাচ্ছে শ্লোগানের।

হঠাৎ ফটাশ করে একটা শব্দ হলো।

কি ব্যাপার?

খোকা আর মুরাদ উভয়েই ছুটলো বারান্দায়। একটা চলন্ত রিকশায় মাইক বসানো ছিলো, টায়ার ফাটলো সেটার।

খোকা বললে, বুকটা একেবারে ধড়াশ করে উঠেছিলো!

আমি তো ভেবেছিলাম মলোটভ ককটেল–মুরাদ উৎসাহিত হয়ে বললে, গভর্নর হাউসের গেটের কাছে কালই তো ছুড়েছিলো দুটো।

মিছিলের কিছু লোক রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের দুএকটিতে কাঠবিড়ালীর মতো তরতরিয়ে উঠে পড়েছিলো এক ফাঁকে, ডাল ভেঙে ঝুপঝাপ করে নামিয়ে দিচ্ছিলো তারা। প্রথমে হুটোপুটি, তারপর কাড়াকাড়ি; অল্পক্ষণের মধ্যে প্রায় ন্যাড়ামুড়া দশা দাঁড়ালো গাছগুলোর। বিজয়কেতনের মতো ডাল গুলো খাড়া করে মিছিলের অগ্রভাগে ছুটলো আবার।

কার যে কি ঘটবে! সাংঘাতিক একটা কিছু হয়ে যেতে পারে কালকের মিটিং-এ! খুব চিন্তিত মুখে মুরাদ বললে, বলা নেই কওয়া নেই আচমকা কামান দেগে জেনারেল ডায়ারের মতো মানুষ মারতে পারে টিক্কা খান। শালারা মাল যা এক একখানা। ঘটে অন্য কিছু থাকুক আর নাই থাকুক একটা ব্যাপারে মালগুলোর বেজায় মিল, সব ব্যাটার শুয়োরের গো! আমি চলি!

চলি মানে? খোকা ওর হাত চেপে ধরলো।

এই মিছিলের সঙ্গেই চলে যাই বরং, হাঁটার কষ্টটা টের পাওয়া যাবে না। একটু থেমে বিচিত্র হেসে মুরাদ বললে, আর কিছু সঙ্কলনেরও সদ্গতি হবে এই সুযোগে। ভিতরে যাই থাকুক ঝোঁকের মাথায় ঝটাঝট কিনে নেবে অনেকে–

তুই একটা চিটার! দেশপ্রেমিকরা সবাই যদি তোর মতো চান্স মোহাম্মদ হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত সবাইকে মুলো চুষতে হবে!

তোর কথা আগে বলেছি–বেরিয়ে যেতে যেতে মুরাদ বললে, তুই খোকাগাছ শিকড়সুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়ে যাবি, আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবি না, করাতের টানে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে তোর গুড়ি, তোর সব পাতা শুকিয়ে ঝরে যাবে, সামনে ঝড়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *