০২. ধানমণ্ডির একটা বড় রাস্তা

ধানমণ্ডির একটা বড় রাস্তার কোল ঘেঁষে খোকাদের বাড়ি। মোহাম্মদপুরগামী বাসে ঈদগা অথবা মধুবাজার স্টপেজে নামলেই কয়েক পা হেঁটে তাদের বাড়িতে পৌঁছানো যায়।

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নিজেদের বাড়ির গাড়ি বারান্দার ছাদে হুমড়ি খেয়ে পড়া বোগেনভিলিয়ার খুনখারাবি দেখতে পায় খোকা। ইউলিসিসের সমুদ্রগামী জাহাজ, মাস্তুলের মতো খাড়া ইউক্যালিপটাস গাছটা দেখে তাই মনে হয় এখন। কাতানের ফুরফুরে পাঞ্জাবি আর ধবধবে পায়জামায় ফিটফাট বাবুটি সেজে বেবিট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সবকিছু কেমন নির্ভার মনে হলো খোকার।

আজ চারদিন পর ঘর থেকে বের হয়েছে সে। হয়তো বহু কিছুই ঘটে গিয়েছে সারাদেশে। রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছে, তার ওপর চতুর্দিকে হাজার রকমের ডামাডোল। জাহাজ বোঝাই সৈন্য চট্টগ্রামের দিকে ছুটে আসছে, বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের ওপর বোমা দাগানো কসাই টিক্কা খান আসছে নতুন লাট-বাহাদুর হয়ে; দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, ছবি, তবু এসবের কোনো গুরুত্ব খোকার কাছে নেই। রাজনীতির ব্যাপারটাই আগাপস্তলা একটা জমকালো ছেনালি; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলে নি। রাজনীতির ব্যাপারটা তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাশের মতো।

কিন্তু যাওয়া যায় এখন কোন্ দিকে? কাজের অছিলায় তো বের হওয়া গেল, খোকা লক্ষ্য স্থির করতে করতে ভাবলো…আপদ আর কি, ভরা দুপুর এখন, রেক্সে গেলে একটা আডডা চলতে পারে, আডডা চলতে পারে গোপীবাগে ইয়াসিনের ওখানে। ইছাপুরায় তার কলেজ বন্ধ থাকায়। দেদার মিটিং শুনে বেড়াচ্ছে ছোকরা; কথা বলার মানুষ পেলে ভরদুপুরে একটা হিল্লে হবে ওর। আর যাওয়া যায় রাজীব ভাইয়ের ওখানে, অবশ্য রাজীব ভাইকে এই সময় পাওয়া দুষ্কর; কুমিরের চামড়ার একটি ব্যাগ বগলদাবা করে রাজীব ভাই নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে। আর কেউ না থাকুক নীলাভাবী আছে; শোরগোলের পর আর ওদিকে যাওয়াই হয় নি খোকার।

মুরাদের ওখানে গেলে কি হয়! মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে তারপর ইয়াসিনের ওখানে ঢু মারা চলে।

খোকা স্পষ্ট বুঝতে পারে এই মুহূর্তে নীলাভাবীর দখলে চলে গিয়েছে। সে, হাত-পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই তার। সত্যি, আশ্চর্যের কথা, নীলাভাবীর জন্যে আজকাল আর অকারণে তার মন আকুল হয় না; যেন অভাবনীয় একটি বই, প্রথম কয়েকটি পাতা পড়ার পরই দুর্মদ কৌতূহল সামলাতে না পেরে অধৈর্য পাঠকের মতো সে শেষটা পড়ে ফেলেছে।

অনেকদিন পর নতুন করে খোকার আবার মনে হলো কারো জন্যে মন খারাপ করার এই বিশ্রী ব্যাপারটা না থাকলে দুনিয়াটা সত্যিই একেবারে ফিকে পানসে হয়ে যেত, এই এখন যেমন রঞ্জুর জন্যে তার ভারি খারাপ লাগছে। সে যখন বের হয় তখন মুখ আঁধার ছিলো রঞ্জুর।

না, রেক্সে যাওয়া চলবে না। ইদানীং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র, আইনগত কাঠামো, চীনের চাবি ভুট্টোর খেল-তামাশা, এইসব নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে ওখানে। আর আহামরি এক লেখক পেয়েছে গোরভিদাল, তাই নিয়েও কতো মতবিনিময়ের ছড়াছড়ি; এক একটা নিরেট মাল সব। বরং নীলাভাবী অনেক ভালো। কথার প্যাঁচে ফেলে একে অপরকে অহেতুক হেনস্তা করার কোনো অপপ্রয়াসই নেই ওখানে। আড্ডা আর তর্কের মুখোশ এঁটে বন্ধুরা যখন মাঝে মাঝে হীন মনোবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে একে অপরের। নামে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, জারিজুরি ফাঁসের ব্যাপারে পরস্পর নোংরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার মন বিশ্রীরকম তেতো হয়ে যায়। নীলাভাবীর ওখানে আর যাই হোক এইসব কদর্য ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয় না তাকে; কখনো কুঁজো বামন অস্কারের মতো টিন ড্রাম বাজায় না কেউ, বরং ঘুমের ভিতর বালকের পেচ্ছাবের মতো অলক্ষ্যে সময় কেটে যায়।

শোরগোল,–হ্যাঁ, একটা শোরগোল ক্রমশ জোরালো হয়ে অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে বাতাসে। খোকা কান পাতলো, দ্রুত ফুসে উঠছে হৈহল্লা, একটা মিছিল রায়ের বাজারের দিক থেকে ক্রুদ্ধ অজগরের মতো এঁকেবেঁকে সদর রাস্তায় উঠে ই.পি.আর-এর দিকে এগিয়ে চলেছে; কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে ঢাকা শহর, কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষ, কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে লোহার রড, কালো পতাকা, বর্শা, তরোয়াল, বৈঠা, কোদাল, শাবল, কাঁধে নিয়েছে যে যা পেরেছে। কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট, বদলে যাচ্ছে মুখের আদল, দ্রুত দ্রুত, দ্রুত এবং ধাবমান, গ্লেসিয়ারের মতো ধাবমান; দুর্মদ মৃত্যুর মতো দরগলমান গ্লেসিয়ার। মানুষ! মানুষ! মানুষ আর মানুষ! আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়, কারা অলক্ষ্যে পথ মাড়ায়… গা ছমছম করতে থাকে খোকার। কবিতার একটি পুরোনো পঙক্তি, অথচ আজ কেন যেন সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো, একটা অভূতপূর্ব অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চের ঝাপটা লাগলো তার সর্বাঙ্গে। বাঁধভাঙা বন্যার তুমুল জলস্রোতের মতো অবিরাম অবিশ্রান্ত মানুষ; শস্যক্ষেত খামার উইঢিবি বাশঝাড় সাকো শহর-বন্দর গণিকালয় সবকিছু সেই অপ্রতিরোধ্য জলরাশির বিমর্দিত তোড়ের মুখে অকাতরে ভেসে চলেছে। এ কোন নূহের প্লাবন, ভিতরে ভিতরে খোকা টাল খায়, তার মাথা দপদপ করে।

বেরুবোর আগে মুখ কালো করে ফেলেছিল রঞ্জু। বলেছিলো, না বেরুলে চলে না?

তোর অসুবিধেটা কি?

আমার ভয় করে। পাড়াটা কেমন থমথমে হয়ে আছে…

একবার মনে হলো খোকার, থাক, কোথাও গিয়ে কাজ নেই; কিন্তু ঘরে ফেরাও এই মুহূর্তে তার পক্ষে অসম্ভব। সমস্ত ব্যাপারটা খোকার কাছে নিছক খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার মতো কিছু একটা মনে হয়, মিছিলের মানুষগুলোর মুখে দুরারোগ্য অসুস্থতার অক্ষর পড়তে থাকে সে। কোনো স্তরের মানুষের সঙ্গেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কেমন একটু ভিন্নধাতে গড়া আমি খোকা মনে মনে নিজেকে সামাল দিতে থাকে, কি ঘটছে না ঘটছে আমি তার কোনো তোয়াক্কাই করি না, অথচ ফুটপাতের পানওয়ালা থেকে মাটিকাটা কামলারাও কমবেশি কিছু না কিছু বলতে সক্ষম; সময় বদলে দেয় মানুষকে, অথবা মানুষই কান মুচড়ে চাঙ্গা করে তোলে প্রাণশক্তি-বিবর্জিত নির্জীব সময়কে, এবং আমি কোনো কিছুর ভিতর নেই। দেশ, দেশের কল্যাণ, দেশের ভবিষ্যৎ, দেশপ্রেম, এসবের মাথামুণ্ড কিছুই তার মগজে ঢোকে না। এইসব ভজকট ব্যাপারে নিরর্থক অপচয়িত না হয়ে বরং শিথিল আলসেমির ভিতর ডুবে থাকা ঢের ভালো, অন্তত নিরাপদ তো বটেই। রিকশার হাওয়া ছেড়ে দেয়া, বাসে আগুন ধরানো, পুলিশের গায়ে ইট মারা, দেশের প্রতি নিজের প্রগাঢ় অনুরাগকে তুলে ধরার এতো অসংখ্য তীব্র ও আকর্ষণীয় পথ চারপাশে ছড়ানো থাকলেও কখনোই সে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না, আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা তার হাত-পা। পঁয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় চোর-ছ্যাচড় গাঁটকাটারাও ফৌত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলো, দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলো ব্যাটারা; কেউ কারো পকেট কাটে নি, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বিলকুল বন্ধ ছিলো, সময় গিয়েছে একটা। রাজনৈতিক সঙ্কট কি নতুন কোনো ব্যাপার, শয়তানি আর বজ্জাতি কবে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। মানুষ! মানুষ, অর্থাৎ শয়তানের সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, সে কখনো তোমাকে বাছা বলে হাতে তুলে খাটি ছানার রসগোল্লা খাওয়াবে না; যদি গেলাতে চায়, তার আগেই সাবধান হতে হবে।

খোকার ভিতরে একটা বিশাল মাঠ ধু-ধু করে জেগে উঠলো, সেখানে লোলচর্ম নীতিবাগীশদের চিড়-খাওয়া কবর; কিংবা ঠিক তাও নয়, সে স্বস্তি পায় বিরোধিতায়, এটা তার এমনই একটি আত্মনিমগ্ন স্বভাব যার মর্মোদ্ধার কোনোদিনই সে করবে না। খোকা জানে আর পাঁচজনের মতো গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয়। ট্যানারি শ্রমিকরা রাজনীতির বোঝেটা কি, গিনিপিগ এক একটা। হাতের কবজিতে যারা সর্দি মোছে, এখনো যাদের পা গড়িয়ে পেচ্ছাব পড়ে, সেইসব হাফপ্যান্ট পরা ইস্কুলের গালটেপা ছেলেরাও চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে দীক্ষা দিচ্ছে। কোথায় আমেরিকা কোথায় চীন আর কোথায় ফৈজুদ্দিন ব্যাপারি প্রাইমারি স্কুলের লালট-মার্কা ছেলে; কোন অন্ধকারে বসে কে বিধাতার মতো কলকাঠি নাড়ছে ওরা তার সবকিছু বোঝে। ধর্ম আর রাজনীতি ব্যবসার রাঘব-বোয়ালরা ভেজাল ওষুধের কারবারি কিংবা পচা মাছ বিক্রেতার চেয়েও জাতে নিকৃষ্ট—এই জ্ঞান যখন টনটনে হয় ততোদিনে সংগ্রামী ছাত্রজীবনের আয়ুও শেষ, অতএব কোমরে গামছা বেঁধে সি.এস.এস. অথবা ঐ জাতীয় একটা কিছুতে ঝপাং করে লাফ না দিলে পাপস্খলনের সুযোগ তাদের জন্যে বারবার ফিরে আসে না। অন্ধের পায়ের পাতার চেয়েও সন্ধানী আর সতর্ক প্রগতিশীল অথবা বামপন্থী গণ্যমান্যদের অনেকেই এখন ইন্টারকনের লোলুপ নিভৃতে বসে কাটিশার্কব্যালেন্টাইনের মাহাত্ম্যের প্রসঙ্গে দূর থেকে নমস্কার করে স্কটল্যান্ডকে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, পুঁজি, মুনাফা, শ্রেণীসংগ্রাম, রিয়েলিটি, গণতন্ত্রের গ্যাঁড়াকল, নিও হ-য, আলট্রা ব-র-ল, এসবও যথারীতি মোচড় মেরে স্থান পায়, এবং পিয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো অতি সহজে সিল্ক খুলে ফেলে মেয়েদের—রাত যখন গভীর হয় কিংবা দিন যখন রাত্রিকালের গভীরতম প্রদেশ বলে ভ্রম হয়; অর্থাৎ বামপন্থী হওয়াই সব কথার শেষ কথা। আইজেনস্টাইনের ছবির প্রসঙ্গ তুলে মুগুর ভাজাভাজি, পাবলো নেরুদার কবিতার চচচ্চডি খাবলানো, পিকাসোর দেয়ালচিত্র নিয়ে গাবাগাবি, এখন আর তেমন দানা বাঁধে না; কেমন যেন স্যাতসেঁতে, মাটি মাটি, ফাঙ্গাস ধরেছে এইসবে, বরং ভেনেসা রেদগ্রেভের নির্ভার স্বপ্ন মঞ্জরিত হয়ে ওঠে, অধিকার করে সবকিছু। সংগঠনের বস্তাপচা কামড়া-কামড়ি খামচা খামচির খবরের মাঝখানে জাব্দা দেয়ালের ফুটো দিয়ে আসা এলসা মার্টিনেলির পায়ের গড়ন আরো বাতাস বৃষ্টির ঝাপটার কাজ করে, সোফিয়া লোরেনের বুকের মাপ বিদ্যুতের অলৌকিক চাবুক হয়ে লেজ নাড়তে শেখায় রিং মাস্টারের নাকের ডগায়; বালকের বিধ্বংসী হাতে রবারের লাল বেলুনের মতো অমন বুক হাতে এলে বিপ্লবকে তিনকুড়ি বছর বস্তাবন্দি করে গুদামে পুরে রাখা যায়।

টনটনে রৌদ্রে হাবার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে এসব কি ভাবছি—খোকা মনে মনে কতকটা কাদা মেখে উঠে এলো। একটা নির্বোধ উত্তেজনা স্নায়ুতন্ত্রীকে আচ্ছামতো কাবু করে ফেলেছে। কিসের প্রত্যাশায় খুঁটিগাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এখানে, নূহের নৌকো আসন্ন কোনো দিগন্ত-প্রবাহী সর্বনাশা জলস্রোত থেকে শস্যবীজের মতো তুলে নেবে বলে, কেন দাঁড়িয়ে আছি, খোকা নিজের ওপর বিরক্ত হয়। সবকিছু সহজভাবে নিতে

পারাটা একটা বিদকুটে মানসিক দুরবস্থা, জটিলতাজর্জর অস্বাচ্ছন্দ্য; এইসব নচ্ছার এলোমেলোমির কোনো হাত-পা নেই–হিজিবিজিকাটা একটা দলামোচড়া কাগজ মনের ভিতরের পকেটে ফস করে হাত চালিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়।

বেবিট্যাক্সি থেমেছিলো হাত তোলা দেখে, তাতে চড়ে বসলো সে। আপাতত সুনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, পালে যখন হাওয়া লেগেছে কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিকই ভিড়বে।

রমনা গ্রিন আর রেসকোর্সের মাঝের রাস্তার সেগুনবীথিতে মড়ক লেগেছে, পাতাগুলো ঝলসে যাচ্ছে, ন্যাতাকুড়নি পাতা-কুড়নি ফ্যালনা মেয়েরা জাফরিকাটা ছায়ায় কেউ আসন-পিড়ি হয়ে কেউ ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে চুলে বিলি কেটে উঁকুন খোঁটাখুঁটিতে মশগুল। মাঠটাকে খোকার মনে হয় দুপুরবেলায় ঝলসে ওঠা সবুজপানায় ভরা একটা মস্ত দিঘি। কালিবাড়ি যেন শিয়ালমুখো আনুবিস; দিঘির দাম কুঁড়ে মুখ তুলে রেখেছে, পারলৌকিক যাত্রায় গোটা শহরের আত্মাকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটুট পার হয়ে ডানে বাঁক নেওয়ার পর খোকার মনে হয় সারিবদ্ধ অশ্বথের বিপন্ন ডালগুলো ঝা-ঝ রৌদ্রে হাহাকার করছে। পিচ গলছে। সারা রাস্তার গায়ে ঝরাপাতা আঠার মতো লেপ্টে আছে, যেন অতিকায় চিতাবাঘের গায়ে উ উ করে উঠছে এক প্রবল পরাক্রান্ত ক্রোধান্ধ দুপুর।

গণ্ডারের মতো দুপুর, ছ্যাকড়ামার্কা ঝরঝরে বেবিট্যাক্সির ঝাঁকুনি, চরম মানসিক বিশৃঙ্খলা, সবকিছু একজোট হয়ে ভিতরে ভিতরে রহস্যময় দিগদর্শনের কাজ করে, বেবি, সেগুনবাগিচা ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে যায় খোকার।

আবার সেই সেগুনবাগিচা। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছি ক্রমাগত, আমি খোকা, কতো কুকাণ্ডের যে পাণ্ডা, একজন পাজির পা ঝাড়া; স্রেফ বাইরেই মনোরম প্লাস্টিক পেন্ট, ভিতরের সব দেয়াল নোনাধরা, চটা ওঠা, খাস্তা, উত্তাল তরঙ্গময় সামুদ্রিক বিছানায় উপুড় হয়ে পড়েছিলাম, ফেননিভ একটি শরীর মুহুর্মুহু তোলপাড় করছিলো বিছানায়,—এইভাবে খোকার যাবতীয় স্মৃতি মাংসাশী হয়ে যায়, সেখানে আতশবাজির ধুম শুরু হয়,—উত্তেজনা যত তীব্র ততো মধুর, যত মধুর ততো অপবিত্র, অপবিত্রতা ইহলোকে যৌবনদান করে আমাদের, জাহাজের মতো বন্দর থেকে বন্দরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই যৌবন।

এইসব মনে হয় খোকার। খোকা এও জানে, টাইটানিক যে জাহাজ, একদিন ভরাডুবি হয় তারও।

ভিজে কুকুরের মতো গা থেকে কাদা ঝাড়তে থাকে এক ধরনের অনুভূতি; অপরাধবোধ সম্পর্কে তার ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ নয়, কেবল এই অনুভূতির আলগা স্পর্শে অল্পবিস্তর সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে সে। আমাদের ভিতরে যে কতো প্রবল মানুষের আস্তানা পাতা, যারা প্রায় সকলেই অচেনা, কখন যে কার করায়ত্ত আমরা, ইহকালে তা জানা যাবে কখনো, আগেও ভেবেছে খোকা এসব। যে স্তন দৃপ্ত খেলোয়াড়ের হাতের বল হতে চায়, দন্তক্ষতের মালা জড়াতে চায়, নির্বোধ শিশুর ঠোঁটে তা অমন উগ্র অথচ মধুর হয় কিভাবে, খোকার মাথায় তা খেলে  না; তার শুধু মনে হয়, একা নই, কেউ-ই আমরা একা নই।

দুপুরে সামান্য একটা গা ঢেলে দিয়ে বিছানায় নিছক আরাম করে বসার সূত্র থেকে কত বড় অঘটনই না ঘটতে পারে। ঝপ করে, যেন কারো হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিলো এক সুগোল স্বপ্নের ইঁদারায়, যেখানে নিজের কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা-হিম পলেস্তারার গায়ে পাক খেয়ে শঙ্খিল গতিতে ব্যর্থই প্রতিধ্বনিত হয়। হাঁসফাঁস করতে থাকে খোকা। বহুদিন আগে গাছ থেকে খসে পড়া একটা ঝুনো নারকেল সে, গরু-ছাগল মুতে ভাসানো মাটিতে পড়ে আছে, একটা ফোঁপল সন্তর্পণে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিপুণতায় চাপ দিচ্ছে ভিতরে। খোকা যেন একটা নিরেট জগদ্দল গুণ্ডার নাম। বডি বিল্ডার খোকা, ইয়ার্স ডে-তে বলরুমের শ্যান্ডেলিয়ার ওয়ালথার পিপিকের গুলিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে হোটেল ইন্টারকন কালো র‍্যাপারে ঢেকে দিয়েছিলো খোকা, খোকা গুণ্ডা, গুণ্ডা আর কোল্ড ব্লাড মার্ডারার। রাক্ষুসে আকাশ থেকে বস্তার মুখ খুলে রাশি রাশি ধাতব মুদ্রা ঢেলে দিচ্ছে কেউ মাথার উপর, কানের পাশে বৃষ্টির মর্মান্তিক কলরোল, ভয়ঙ্কর এবং প্রচণ্ড, কানে তালা লেগে যায় খোকার। কি বিশ্রী কি জঘন্য এই নামটা! তার আসল নাম অর্থাৎ জাহেদুল কবির খোকা নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বারবার। ভোজবাজির মতো এমনভাবে শিকড় গেড়ে গঁাট হয়ে আছে নামটা, যে, কখনো তার মূলোচ্ছেদ সম্ভব নয়। তলে তলে বজ্জাতি আর নষ্টামির শক্ত বর্মের কাজ করে এই নামটা। নাম তো নয়, একটা বিষের ভড়। ক্ষুদ্র মাকড়সা নিজ হইতে সুতা ও জাল সৃষ্টি করিতে সমর্থ, সৎ সেরূপটি পারেন না, যদি সৎ নিজেকে বিকৃত না করেন তবে সৃষ্টি হয় না খোকার ভিতরের ঘোঁট পাকানো ঝড়ে ভুশ ভুশ করে ধুলো উড়তে থাকে; জোড়া ঘোড়ার চালে পড়ে মার খাচ্ছে এবার। ছেঁড়া কাগজের মতো ফরফর করে উড়তে থাকে খোকা; যৌবন এমন ক্ষমাহীন কেন, সে শুধু তার আপন অধিকার খুঁজে বেড়ায়, এক অসতর্ক মুহূর্তে অন্যায়েরও একটা অধিকার আবিষ্কার করে ফেলে সে। কি ভাবে নীলাভাবী এখন, জেনে দেখলে কি হয়, নীলাভাবীর উত্তরটা কি ধরনের হবে? আর যদি ধরে নেয় একজন লম্পট কামাচারী নিছক কূট উদ্দেশ্য হাসিল করার ফিকির এঁটে নতুন করে উস্কে দিচ্ছে, তাহলে উল্টো বিপদ। ঠিক সেইদিন থেকে তার মানসিক স্থৈর্যের। পাট ভাঙা লাট খাওয়া অবস্থা যেদিন সামান্য একটু আস্কারা পেয়ে নীলাভাবীর সারা বয়েস দুহাতে ঘাঁটাঘাঁটির পর একেবারে তছনছ করে দিয়েছিল সে, এবং খোকা খুব ভালো করেই জানে, এসব অন্য কারো বোঝার ব্যাপার নয়; যেমন নীলাভাবী। সেদিন সেই আকস্মিক ছন্দপতনের পরও বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটেনি নীলাভাবীর চলনে-বলনে, খোকার মনে হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত নিপুণতায় সমানে সূক্ষ্মতর ভারসাম্যও রক্ষা করে চলেছে নীলাভাবী। নিজেকে লাগসই করে মানিয়ে নেওয়া, নিজেকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নেওয়ার ভিতর আড়ষ্টতা না থাকাটাই সম্ভবত বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা, নিদেনপক্ষে এই ধরনের একটা হালকা সাদা প্রবোধ খাড়া করে স্বস্তির উৎসমুখের দিকে যায় খোকা; জেলিফিশের মতো এই থলথলে মেরুদণ্ডহীন স্বস্তির গায়ে থুথু ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই, দুর্গন্ধময় হাজতের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় খোকা, তোমরা যারা আমার পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের উদ্দেশ্যেই বলা : পৃথিবীর সকল নীলাভাবীরাই এক একটি জ্বলন্ত কামকুণ্ড, ফুটন্ত টগবগে আগ্নেয়গিরি, যার নিদারুণ লাভাস্রোতে পীত ধবল কালো বাদামি রাশি রাশি খোকার দগ্ধাবশেষ গড়ান খেয়ে চলে।

ভিতরের সব বনকার থেমে যায় এক সময়, খোকা বললে, ব্যাস ব্যাস, থামো থামো–মিউজিক কলেজের কাছে নেমে গেল খোকা।

কিছুক্ষণ কড়া নাড়ানাড়ির পর দরোজা খুলে দিলো সিদ্দিকাভাবী, নীলাভাবীর সতীন। বয়েস গড়িয়েছে ঢের, প্রায় রাজীব ভাইয়ের সমবয়েসী মনে হয়।

কে খোকা নাকি? ভিতরে এসো। দরোজা বন্ধ করে সিদ্দিকাভাবী বললে, অসুখ-বিসুখ ছিলো বুঝি?

কই না তো?

অনেকদিন এমুখো হওনি, তাই বলছি—

সময় পাই নি।

চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়েছো বুঝি?

কই আর!

বোনটাকে তো একবারও নিয়ে এলে না?

আনবো আনবো করে হয়ে ওঠে না আর কি!

হবেও না কোনোদিন, তোমরা সব এক রসুনের গোড়া।

একটা টুলের উপর টেবিলফ্যান চড়িয়ে সেটাকে চালিয়ে দিলো সিদ্দিকাভাবী। কাজের ভিতর থেকে কথা বলাটা সিদ্দিকাভাবীর পুরানো অভ্যেস; নিছক কথার প্রয়োজনে কখনও সময় খরচ করতে চায় না। খাটের তলা থেকে একটা পিকদান টেনে বের করতে করতে কিছুক্ষণ পর বললে, খেয়েছো?

হ্যাঁ।

সত্যি তো?

হ্যাঁ, সোজা বাড়ি থেকেই আপনাদের এখানে আসছি।

বোবো তাহলে, তোমার নীলাভাবী কুয়োতলায়–

উঠোনের দিকের দরোজার পর্দাটা ভালো করে টেনে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সিদ্দিকাভাবী। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে খোকা। সিদ্দিকাভাবীর সামনে সবসময় সন্ত্রস্ত থাকে সে, মনে হয় অতি অল্পকালের মধ্যেই তাকে শিউরে উঠতে হবে। এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় হাঁড়ির ভাত টিপছে, তারপর মাড় গালবে।

একজাতের স্ত্রীলোক আছে যারা কেবল একজন পুরুষের স্ত্রী হবার মানসেই জন্মায়। উচ্ছে ভাজা, মিষ্টি কুমড়োর ঘন্ট, শজনে ডাটার ঝোল, এসবে তাদের হাত পাকানো থাকে। সেলাই-ফেঁড়, পুরানো শাড়ি কাপড়ের বদলে কাপ-ডিশ কেনা, বছর না ফুরোতেই বাচ্চা বিয়ানো, দিব্যি ডুবে থাকে এইসবের ভিতর। ঠিক এই গ্রপে পড়ে না সিদ্দিকাভাবী। বরং বলা যায়, একটা জলজ্যান্ত হেঁয়ালি; মাড়িচাপা এবং ভিতরগোঁজা কিসিমের। সাতেও নেই পাঁচেও নেই, উপর থেকে কতকটা এই রকমই, অথচ গোটা সংসারটাকে অতি সহজে শক্ত মুঠোর ভিতর পুরে রেখেছে।

ঘরটা থমথমে। ছোট্ট একটা মেয়ে ঘামে চাবচুব হয়ে খাটের একপাশে ন্যাতার মতো পড়ে আছে, নাল গড়াচ্ছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। খুব সম্ভব পড়শিদের কোনো মেয়ে, নীলাভাবীদের কারো কোনো সন্তানাদি নেই। ঝুপঝাপ পানি ঢালার শব্দ আসছে কুয়োতলা থেকে। থেমে থেমে আবার গুনগুনিয়ে উঠছে নীলাভাবী। কাচের চুড়ি বাজছে। দুহাত ভরা কাচের চুড়ি নীলাভাবীর। কাচের চুড়ি পরার বেজায় শখ; হামেশাই কুটকাট করে ভাঙে আর মন খারাপ হয়, সেই জন্যেই এতো অনুরাগ নীলাভাবীর।

রঞ্জুকে আনতে হবে একদিন। বলেও দেখেছে একবার রঞ্জুকে; গায়ে মেখে সে উড়িয়ে দিয়েছে। তোর খাতিরের জায়গা, আমাকে নিয়ে আবার টানাটানি কেন মুখের ওপর বলেছিলো রঞ্জু।

কেমন যেন রুদ্ধশ্বাস, মুখোশপরা এই বাড়িটা; সবসময় গুমোট, ভ্যাপসা গরম। চাপা অসন্তোষের অনচ্ছ আচ্ছাদনের ভার সহ্য করতে না পেরে থেকে থেকে কাতরাচ্ছে বাড়িটা, অহরহ তুলতুলে ভয় হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে; ভালোও লাগবে না হয়তো রঞ্জুর। এ বাড়িতে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো নীলাভাবী। নীলাভাবী না থাকলে শুশানপুরী হয়ে যেত। বাড়িটা।

খোকাবাবু যে, কখন এলে?

এই তো, কিছুক্ষণ!

পথ ভুলে বুঝি?

কতকটা তাই–

মাথায় সপসপে চুলে লাল গামছা জড়িয়ে রোদ থেকে তোলা গুচ্ছের কাপড় পাঁজা করে নীলাভাবী ঘরে ঢুকতেই সবকিছু বদলে গেল। কি স্নিগ্ধ নীলাভাবীর মুখ! নাকি গোসল করার পর সবাইকেই অমন মনে হয়। দেশটাকে খোলামকুচির মতো হাতে পেলে পুরো ঢাকা শহরটাকেই একটা হামামখানা বানিয়ে দেওয়া যায়, মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে খোকা।

খুব বুঝি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছো?

কই আর—

কেন, এখন তো সকলের ঐ একই কাজ!

তুমি তো জানোই নীলাভাবী, আমি সকলের দলে পড়ি না–

পড়ো ঠিকই, জানতে পারো না! সারা দেশ কিভাবে গজরাচ্ছে! রান্নাঘর থেকে সিদ্দিকাভাবীর গলা শোনা গেল, এক গ্লাস শরবত তৈরি করে দাও ওকে—

একটু বোসো, চটপট গোছগাছ করে নি, তারপর তোমার শরবত–

খোকা খচে উঠলো। বললে, নিকুচি করি তোমার শরবতের, দিনটাই আজ মাঠে মারা গেল। এই এক জঞ্জালে জীব মেয়েলোক! আজ বরং চলি!

একেবারে ঘোড়ায় চড়ে এসেছো দেখছি, ব্যাপার কি?

কোথায় একটু ফ্রি থাকবে, আড্ডা মেরে ঘচাং করে কেটে পড়বো, তা নয়, যত্তোসব উড়ো ঝক্কি। চুড়ি বাজিয়ে গোসল করা, শুকনো কাপড় ভাঁজ করা, চুলঝাড়া, রাবিশ রাবিশ!

নীলাভাবী হেসে বললে, তুমি এসেছো বুঝেই চুড়ি বাজাচ্ছিলাম, কি বুঝলে?

বুঝেছি–

কচু বুঝেছো, যা একখানা মাথা তোমার! যাও, আমার ঘরে গিয়ে পাখা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বোসোগে, চটপট সব সেরে আমি এই এলাম বলে–

শালার বাড়িটা যেন পাখার একটা জীবন্ত বিজ্ঞাপন খটটাই মেজাজে বললে খোকা।

নীলাভাবীর ঘরটা এ বাড়ির ভিতর একেবারেই স্বতন্ত্র। কোথাও কোনো খুঁত নেই, পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো, চকচকে-তকতকে, সামান্য একটু আঁচড়ও পড়ে নি দেয়ালের কোথাও। মনে হয় এই ঘরটার সঙ্গে বমকে থাকা বাড়িটার কোনো সম্বন্ধ নেই: থাকলেও তা এমনই জটিল এমনই গোলমেলে যে সে সম্পর্ক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বরং ঘুরিয়ে বললে বাড়িটাই একটি স্ববিরোধ হয়ে যায়।

এ ঘরে অধিষ্ঠান যার, সে যেন সহসা কোনো সুদূর নক্ষত্রালোক থেকে রহস্যময় কারণে পৃথিবীতে আবির্ভূত; বিলকিলে থুথুকে নোংরা আশ্রয়কে সে স্বপ্নের ভিতরে নিয়ে যায়। বিছানাটা দেখলে বোদলেয়রের সেই প্রবল-মধুর আলস্যময় বিড়াল কবিতাগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

ধরো–পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে নীলাভাবী। বললে, খালি চিনি কিন্তু, ঘরে লেবু নেই–

নিকুচি করি আমি লেবুর! এবার থেকে টিকিট কেটে দেখা করতে আসবো তোমার সঙ্গে!

এতোদিন বিনা টিকিটে আসছিলে, না পাশে?

খচড়ামি রেখে খাওয়াটা সেরে এলেই খুশি হতাম!

তবে কি? নীলাভাবী একগাল হেসে বললে, তোমার জন্যে বসে আছি নাকি পেটে পাথর বেঁধে? পুরুষ মানুষের গোসল করা আর মেয়ে মানুষের খাওয়া—সময় বেশি নিলেই অখ্যাতি। পাঁচ মিনিটের বেশি কখনোই আমার লাগে না!

কথা না বাড়িয়ে গিলে এসো না বাবা!

নীলাভাবী হেসে বললে, হুবহু নকল তোমার রাজীব ভাইয়ের, কথা বলার ঢংটি পর্যন্ত!

সত্যিই বলছো খেয়ে এসেছো?

সত্যিই! তুমি তো আমার গুর নও, তোমায় ফেলে খেতে দোষ নেই–

গুরু আবার কি?

আচ্ছা আচ্ছা, সে একদিন শিখিয়ে দেওয়া যাবে–

বলো কি, শেখারও আছে আবার, গ্যাঁড়াকল তো মন্দ নয়।

শেখার আছে বৈ কি, সব ব্যাপারেই শেখার আছে। সব ব্যাপারেই রীতিমতো সুশিক্ষা দরকার, বুঝলে?

এতোক্ষণ ঠিকই বুঝছিলাম, কিন্তু ঐ যে জোর দিয়ে বুঝলে বলেই সব কাঁচিয়ে দিলে!

এক একটা ব্যাপারে এক একজনের কাছে শিক্ষা নিতে হয়। অনেক ব্যাপারে তোমার হাতেখড়ি ভালো মাস্টারের কাছে হয় নি। তরল?

তরল।

কিন্তু ফিক ফিক করে হাসিটা কেন?

সন্দেহটা কেটে গেছে এই আর কি। অনেক ব্যাপারে কথাটা এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে–

বুঝেছি এই জন্যেই তোমার সরেস মাথাটার এতো প্রশংসা করি সবসময়। ব্যাপারটা কি রকম হলো জানো, পানের ভিতরে চুন খয়ের সুপুরির সঙ্গে একটিপ আসল জিনিস—মানে কোকেনও চালান করে দেওয়া হলো গালে–

রাজীব ভাইয়ের বোধহয় দেদার চলে ওইসব?

আগে চলতো, এখন বদভ্যাসটা ছেড়ে গেছে।

মানে তুমি ছাড়িয়ে দিয়েছ?

কি করে বুঝলে?

ঐ যে অভ্যেস না বলে বদভ্যাস বললে!

মাঝে মাঝে তোমার বুদ্ধিটা এমন খোলতাই হয়ে যায়!

তোমার কাছে এলেই দারুণ কাজ করতে থাকে আমার বেন, তুমি হচ্ছে যাকে বলে একেবারে খাটি ব্রেন-টনিক।

নীলাভাবী হঠাৎ কেমন যেন মনমরা হয়ে যায়। চোখমুখে গাম্ভীর্য ছায়া ফেলে। নীলাভাবীর চেহারায় কোথায় একটা ধার আছে মনে হতে থাকে খোকার।

একটা কথা জিগ্যেস করবো?

ভড়কে দেয়ার কোনো মানে হয় না–

আজকাল ইচ্ছে করেই তুমি এ বাড়ি মাড়ানো ছেড়ে দিচ্ছো। খুব হিশেব করে পা বাড়াচ্ছো সবসময়, ধীরে ধীরে একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছো নিজেকে–

স্রেফ বাজে কথা!

এ বাড়ির কেউ তোমাকে কিছু বলেছে নাকি?

বলেছে। খোকা কিটকিট করে হেসে বললে, বলেছে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে যাকে বলে একেবারে তুলোধোনো করে ছাড়বে!

মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মানে? একরোখা জেদি ভঙ্গিতে জিগ্যেস করলে নীলাভাবী।

লেব্বাবা, এ-যে দেখি উকিলের জেরারও কান কাটে!

কি ব্যাপার খুলে বলে–নীলাভাবী হাত চেপে ধরলো।

মারবে নাকি? গ্যাঁড়াকল তো মন্দ নয়! খোকা একটু থেমে তারপর বললে, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, বুঝতে পারছি। ইচ্ছে করেই আসি না, আসা হয়ে ওঠে না–

তবে আগে যে বলতে আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, না দেখে থাকতে পারো না?

আসলে তোমার মনের কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম–

চালাকি মারছো?

বুঝলে না–খোকা বললে, ওটা ছিলো তোমাকে ফাসাবার একটা কায়দা, যাকে বলে স্রেফ ধাপ্পা!

বিশ্বাস করি না, বুজরুকিটা মারছো এখন!

বিশ্বাস না করার কি এমন আছে এতে? অসহিষ্ণু হয়ে খোকা বললে।

আমি খুব ভালো করেই জানি সেসব কথা নিছক বুজরুকির ছিলো। তোমার মুখে আমি কষ্টের ছাপ দেখতে পেতাম সে সময়, কোনো লাভ নেই অস্বীকার করে। এখন তোমার সে চেহারা আর নেই। এতো অল্প সময়ের মধ্যে তুমি কতো বদলে গিয়েছে, আশ্চর্য!

খোকা মটমট করে আঙুল মটকে বললে, আমার চর্বি হয়েছে, ভরাপেটে শুধু ঢেকুর উঠছে–

এতো চাপা স্বভাব তোমার! আজ আমি উত্তর না নিয়ে তোমাকে ছাড়ছি না, মনে রেখো!

ঘাট মানছি বাবা! আসলে কি জানো, আমার মেটামরফসিস হয়েছে; আমি শালা গ্রে গর স্যামসার মতো বিটকেল পোকা বনে গিয়েছি। সবই ওই ব্রেনটনিকের গুণ, যে রেটে ঝেড়ে টনিক চালাও তুমি

তোমার মগজে নতুন একটা কিছু ভর করেছে, আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।

অত-ই যখন বোঝো তখন ঘটা করে এতো বাজিয়ে দেখার কি আছে! তোমার চোখ তো আর চোখ নয়, এক্স-রে মেশিন, মগজ এস্তেক দেখতে পাও।

তোমার ওই কূটকচালে ভাবনা-চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করো, তাতে তোমার নিজেরই উপকার হবে, জীবনে আনন্দের দাম নিছক কম নয়। নিজের সম্পর্কে মনের ভিতর কোনো গ্লানি পুষে রাখতে নেই, তুমি মূখ হলে এসব কথা তুলতাম না। নিজেকে, নিজের চিন্তা-ভাবনাকে, নিজের অভিরচিকে কারা বোকার মতো ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত তা জানো? যারা অগোচরে নিজের সর্বনাশ চায়

থট রিডিং-এ মাস্টার হয়ে উঠেছে দেখছি। থামলে কেন চালিয়ে যাও–

সব কথায় বাগড়া মারো কেন?

তুমি যখন এক নিশ্বাসে কথা বলতে থাকো–খোকা নরোম করে বললে, তখন অদ্ভুত দেখায় তোমাকে, তোমার ভিতর থেকে তখন অন্য কেউ কথা বলে। এরপর থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে স্টাডি করতে হবে তোমাকে। এখানে একটা কথা আছে, আমি রাক্ষুস-খোক্ষস নই, আমার হার্ট একটা চড়ইপাখির চেয়েও হালকা, পালকের চেয়েও পলকা, এতো বেশি করে সত্যের ব্যবচ্ছেদ না করাই ভালো, আমার ভিতর কেঁপে ওঠে, টলে যায়–

তোমার কাছে বোধহয় সিগ্রেট নেই, আনিয়ে দেবো?

সিগ্রেট আছে।

আছে তো টানছো না কেন?

দরকার মনে করি নি এতোক্ষণ! কথাটা শেষ করেই যন্ত্রচালিতের মতো সিগ্রেট ধরায় খোকা। ফুল স্পিডে পাখা চলছিলো বলে তেরোটা কাঠি খরচ হলো দেশলাইয়ের।

কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শুরু করলে নীলাভাবী, তোমার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক, আর কেনই বা তা, খুলে বলতে হবে আজ তোমাকে। তোমার মাথার ভিতরে বহুৎ আবর্জনা জমে আছে, সাফ করা দরকার–

বাধা দিয়ে খোকা বললে, বুঝেছি, আজ শালার গলা পানিতে না চুবিয়ে তুমি ছাড়বে না, রয়ে রয়ে স্রেফ প্যাচের ভিতরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যাচ্ছেতাই! তোমার যা খুশি অনর্গল বকে যেতে থাকো, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু কোনো জবাব পাবে না।

জবাব দেয়ার মুরোদ থাকলে তো জবাব দেবে! আমি জানি এসবের কোনো একটারও জবাব তোমার নিজের জানা নেই। নীলাভাবী কোমর বেঁধে শুরু করলে এবার, সত্যি, এক একটা আকস্মিক ঘটনায় এমনভাবে চোখ খুলে যায়, ভাগ্যিশ তোমার দেখা পেয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো, তা না হলে যথেষ্ট বিপদ ছিলো। আমার নিজেকে নিয়ে। তোমার হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস হবে না, নিজেকে নিয়ে নিজের কাছে এখন কোনো সমস্যাই নেই আমার। এসব সহজে বিশ্বাস করতে কেউ বড় একটা চায়ও না। কেন চাইবে, অকারণে রাজ্যির যতো জঞ্জাল জড়ো করাটা যখন মানুষের জন্মগত দোষ, সেখানে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি খুব ভালো করেই জানি, নিজের সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো কড়ায়-ক্রান্তিতে নির্ভুল। নিজেকে জটিল অঙ্কের শামিল করে ফল মেলাতে না পারার মতো মর্মান্তিক আর কিছু নেই; ঘৃণা করি আমি এইসব বানোয়াট জটিলতাকে। দৈব-দুর্বিপাকেও যদি আমাকে তার ধারালো খপ্পরে পড়তে হয়, আমি গা বাঁচিয়ে, নিজের শরীরে একটি আঁচড়ও না লাগিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করবো। বুঝি না, সংসারের সবাই সবকিছুকে সহজে নিতে পারে না কেন। সহজভাবে নিতে না পারলেই সবকিছু দুর্ভার মনে হতে থাকে—

এই পর্যন্ত এসে থামলো নীলাভাবী। যতদূর আন্দাজ করতে পারে। খোকা তাতে তার মনে হয় এটা একটা ভূমিকা মাত্র। নীলাভাবীর চোখমুখ চলকে উঠছে, একটা কিছু প্রবলভাবে তোলপাড় করে চলেছে। ভিতরে ভিতরে; অসংখ্য পলকাটা একটা নীলকান্ত মণির মতোই রহস্যময় দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে অন্তস্তল থেকে।

খোকা, তুমি জানো না বা জানো, আজ মুখ ফুটে একটা কথা তোমার কাছে অকপটে স্বীকার করবো, সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি–

একথায় বড় বড় চোখে তাকালো খোকা; তার ধারণা ছিলো একমাত্র বইপত্রেই এইসব কথা স্থান পায়, কিংবা যখন মুদ্রণপ্রমাদ ঘটে তখন ব্লাউসের বোতাম খুলতে ভালোবাসির স্থলে ওই কথা ছাপা হয়।

কবে থেকে জানো? মনে করো না একেবারে সেই প্রথমদিন থেকে। প্রথম যেদিন তুমি তোমার রাজীব ভাইয়ের সাথে এ বাড়িতে এলে, তখন তো আমি তোমাকে দেখে প্রায় হেসেই ফেলেছিলাম। এককালে ওনার কোকেন খাওয়ার মতো বড়শিতে মাছ ধরারও বেজায় নেশা ছিলো। আমার মনে হলো নেশাটা আবার চাগান দিয়েছে, সঙ্গে তাই অমন একটা লিকলিকে ছিপ–

বাধা দিলে খোকা। বললে, ছিপই-তো! ছিপ না হলে কি আর মাছ গাঁথে?

নীলাভাবী গায়ে মাখে না। স্বপ্নের ভিতর ঢিল খেয়ে হঠাৎ ঝটপট উড়ে যাওয়া পায়রার ঝাঁক আবার এসে বসে। নীলাভাবী বলতে থাকে, যেদিন তুমি প্রথম অকপটে বললে, আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, আমাকে না দেখে তুমি থাকতে পারো না, সেদিন আমার মনে গভীর একটা দাগ কেটে দিলে তুমি। মুগ্ধ হয়ে গেলাম তোমার স্বীকারোক্তিতে; যেন অনেকদিন থেকেই এমন একটা কিছুর জন্যে ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করছিলাম। এতো দ্রুত ঘটে গেল সবকিছু! এক সময় আমি জিগ্যেস করলাম নিজেকে, এটা কি আমার পক্ষে ঠিক হচেছ? আমার আছে স্বামীর দায়ভাগ। নিজেকে অবিশ্বাসিনী স্ত্রী ভাবতেও ঘৃণা হয় আমার। পরস্পরকে ভালোবেসেই আমরা বিয়ে করেছিলাম, এখনো ভাবতে পারি না তাতে চিড় খেয়েছে। তোমাকে নিয়ে এইভাবে আমি অনেক ভাবলাম। যতোই ভাবি, তুমি আমাকে নেশার মতো পেয়ে বসতে থাকো, সে এক নিদারুণ করুণ অবস্থা আমার। শেষে জিদ ধরলাম নিজের সঙ্গে, একান্তই যদি তোমার উপরে আমার একটু টান পড়ে থাকে, কি এমন অপরাধ তাতে! আর আগুন যখন আমার নিজেরই হাতে, গোটা সংসার ছারখার হবার ভয়টা কোথায়! নিজের হাতে, মানে, নিজের আয়ত্তে। সুবিধে এখানে এই, তোমাকে আমার এমন কিছুও দিতে হবে না যাতে করে দ্বিতীয় কারো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিছুই নেই আমার দেয়ার মতো, পক্ষান্তরে এমন কিছু ও তুমি আমাকে কোনোদিন দিতে পারবে না যাতে করে আমার স্বামীর এই বয়েসে প্রাণান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার সম্ভাবনা দেখা দেবে। আমাকে দেয়ার মতো তোমার কিছুই নেই একথা কেন বলছি তুমি নিশ্চয়ই তা বুঝবে…

একটু থেমে, ঢোক গিলে নীলাভাবী বললে, অনেক কিছুই আছে, কিন্তু নিজের যোগ্যতা বিচার করলে দেখা যায়, যাকে বলে সত্যিকারের নেবার যোগ্যতা, এখন আর তা আমার নেই। এই যোগ্যতার মাপকাঠিতে ফেলে নিজেকে যাচাই করে দেখতে পেরেছিলাম বলেই সবকিছুর এমন সহজ মীমাংসা সম্ভব হয়েছিলো। মনে করে বসো না আবার স্রেফ বিনয়ের ব্যভিচার হচ্ছে। অনেক রকমে ঘাঁটাঘাঁটি ওলটপালট করে দেখলাম, এক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেবার নেই আমার। ক্ষণিকের তাড়নায় কিংবা ভুলক্রমে যা কিছু ঘটে ঘটুক, আমি তাকে হিসেবের মধ্যেই ফেলি না। অসম্ভব দুর্বলচিত্ত ছেলে তুমি। কোনো কিছুই তোমার সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাধীন নয়। ইচ্ছে করলে লুট করতে পারতাম; ফতুর করে ছেড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু কি লাভ, কি লাভ হতো তাতে? তোমার কিংবা আমার? লুটের মাল দিয়ে নিজেকে সাজাতে চাই না, ঐশ্বর্য মনে করি উপহারকে। এসব কথা হেঁয়ালির মতো মনে হতে পারে তোমার, এটাই স্বাভাবিক। যে-কোনো একটা ব্যাপারকে উল্টোভাবে খতিয়ে দেখার মতো মনের জোর সকলের থাকে না। দুঃখে আমার ভয় নেই। জীবনে দুঃখ পেতে হয়। দুঃখের এই একটা চরিত্র, সে সুযোগ পেলে পিষে ফ্যালে বটে, শেখায়ও প্রচুর; সাহস করে, মাথা উঁচু রেখে, বুক টান করে যারা তার মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা কেউ কখনো খালি হাতে ফেরে না। এসব কথা আর একদিন হবে। সত্যি, আমি ওর জীবনটা ফতুর করে ছেড়েছি। এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বুঝলে তো, তোমার রাজীব ভাইয়ের কথা বলছি। লোকে জানে ছেলেপিলে না হওয়ায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে লোকটা; আমরা নিজেরাও কতকটা ওই গাবাজি! প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিলাম দুজনে, তল পাচ্ছিলাম না, কূল পাচ্ছিলাম না; ডুবে মরতে মরতে কোনো রকমে ডাঙায় এসে ভেড়া–মানে বিয়ে করা। তা না হলে মরেই যেতাম, কি, খুব যে কিটকিটিয়ে হাসা হচ্ছে?

হাসবো না তো কি কাঁদবো?

বিশ্বাস হচ্ছে না নিশ্চয়ই?

বিশ্বাস হবে না কেন? আগাগোড়া একটা ব্যাপারকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে যেভাবে কসরত করে চলেছে তাতে বিশ্বাস না করলে রক্ষে থাকবে! বলিহারি বাহাদুরি তোমার! খোকা পা লম্বা করে বললে, থামলে কেন, চালিয়ে যাও, নিদেনপক্ষে টেকনিকটা তো রপ্ত হবে।

ভেঁপোমি করবে না বলে দিচ্ছি। আমার কথা শেষ করতে দেওয়া তোমার ইচ্ছে নয়, ভেবেছো আমি তা বুঝি না?

ঠিক হায়, ঘাট মানছি–

যা বলছিলাম। হ্যাঁ, আমাদের বিয়েটা ছিলো সত্যিকারের প্রেমের। ও তখন এক বিদেশি ফার্মে চাকরি করছে। পাথর হাতড়ায় আর বই পত্তরের ভিতর মশগুল হয়ে থাকে। একটু দাঁড়াও, গুলিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু–

দাঁড়াতে হবে?

হ্যাঁ, তেরো বছর আগেকার কথা সেসব। আমার বয়েস তখন আঠারো, ওনার ছত্রিশ কি সাঁইত্রিশ

মানে ফরিন স্টাইলের লাভ আর কি!

যা বলো তাই। সুন্দর গাইতে পারতো ও, ক্লাসিক্যাল চর্চা করতো ও; এস্রাজও বাজাতে পারতো

হুঁ, ক্লাসিক্যাল বেজায় সুবিধে বাধা দিয়ে খোকা বললে, ঘোড়েল লোক!

শুধু তাই নয়, দুদ্দাড় করে মুখে মুখে এমন সব গল্প বানাতে পারতো যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত।

হাইজাম্প, লংজাম্প, এসব?

না ওসব নয়, তবে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো হাত সাফাইয়ের খেলা, ম্যাজিক, এসব জানতো।

ব্রাদার আমার জাত ম্যাজিশিয়ান!

ওর মতো প্রানোচ্ছল স্পষ্ট তেজি মানুষ আমার আর চোখে পড়ে নি।

চোখে যে তুলি লাগিয়েছিলে, তা না হলে আসল ব্যাপারটাই ধরা পড়লো না কেন? সবকিছু ছিলো নিছক ভাঁড়ামি, ছুকরি পটাবার কায়দা।

হিংসে হচ্ছে বুঝি? ওই নোংরা জিনিসটার বালাই ওর ভিতরে একদম নেই। ওকে পাবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠছিলাম আমি নিজেই। তুমি বিশ্বাস করবে না খোকাবাবু, ওর এক একটা কথায় কিভাবে চলকে উঠতাম। এতো অদ্ভুত এতো সুন্দর কথা বলতো ও! ওর মুখের কথা শুনে শুনে আশ মিটতো না আমার!

দেদার কোটেশান ঝাড়তো নিশ্চয়ই?

কক্ষোনো না—

বলছো কি, তাহলে দৃষ্টিপাত পড়ে নি বলতে চাও?

ওকে তুমি চেনোই না—

বাধা দিয়ে খোকা বললে, ও ও না করে সরাসরি নাম ধরেই বলো না কেন! আধুনিকরা তো তাই করে। খোকাবাবু খোকাবাবু ডাকটাও ছাড়তে হবে, ওটা গালাগালির মতো শোনায়

নীলাভাবীর চোখজোড়া স্বপ্নালু হয়ে এলো। বললে, আমি আর এখন আধুনিকাদের দলে পড়ি না। সত্যিই কি ছিলো মানুষটা, আর আজ কি দশা হয়েছে। কিছুদিন থেকেই চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না, বড় স্বার্থপর নিচ মনে হচ্ছিলো নিজেকে: আমি জানি মানুষটার ওই ধসে যাওয়া, হুমড়ি খেয়ে পড়া ইতশার জন্যে আমিই দায়ী। ওর সবকিছু আমিই সাবাড় করে দিয়েছি। ফতুর করে দিয়েছি ওকে। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেই খাড়া একরোখা মানুষটার; যেন একটা পুরানো থলে, ভিতরটা শূন্য, ফেঁসে যাওয়া, পড়ে আছে একপাশে–

চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠলো নীলাভাবীর। রানী অশ্রুমতি সহসা এমন উতরোল হয়ে উঠলো কেন, খোকা ভাবতে চেষ্টা করে। আর এতো কিছু থাকতে থলের উপমাটাই বা ঠোঁটে এলো কেন, তারও হদিস পায় না সে; ফেঁসে যাওয়া, পড়ে আছে একপাশে, কুচ্ছিত শোনায়।

মানুষটার দিকে তাকালে কষ্টে বুক ভেঙে যায়। অথচ ইচ্ছে করলে, সময় থাকতে সতর্ক হলে, আমি ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম। প্রথম থেকেই ওকে আনতাবড়ি খরচ করার ব্যাপারে সাবধানী হওয়া উচিত ছিলো। তা না করে দুহাতে কেবল উড়িয়েছি ওকে বাপ-দাদার জমিদারির মতো। বেমালুম ফুকে দিয়েছি সব। কোনোদিন টেরও পেলো না দিনের পর দিন আমার বেহিসেবি হাতে খুচরো পয়সার মতো কিভাবে ফৌত হয়ে যাচেছ। এখন যদি বলি, একটা গল্প শোনাও, সাধ্যমতো চেষ্টা করবে, কিন্তু পারবে না, বলবে আজকাল আর ওসব মাথায় আসে না, মাথার ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সব; আসলে বুড়িয়ে গিয়েছি, বয়েস তো আর কম হয় নি। বললে কি হয়, আমি খুব ভালো করেই জানি ওটা একটা অজুহাত মাত্র। ওর মন এখনো যথেষ্ট সতেজ, তোমার চেয়েও। এস্রাজের অভ্যেসটা টেনেটুনে কোনোরকমে বজায় রেখেছিলো অনেকদিন পর্যন্ত, কিন্তু বাগড়া পড়লো সেখানেও। একটা গৎ ধরার পর কাছে গিয়ে বসতাম, বলতাম নতুন কিছু একটা বাজিয়ে শোনাতে; কখনো ভেবে দেখিনি নতুন কিছু ও শোনাবে কোত্থেকে! যতটুকু অবসর পায় তার সবটুকুই থাকে আমার দখলে, আর এই লোভেই আমি সংসারের মোহ গায়ে মাখিনি, মনের আনন্দে সংসারের দখলদারি ঠেলে দিয়েছিলাম আরেক দিকে। অবসর সময়ে আমি ওকে পানদোক্তার মতো মুঠোর ভিতর পুরে রাখি, আমার হাতের তালুর চাপে ও ঘেমে ওঠে, কিছু বলতে পারে না কখনো মুখ ফুটে, আমার খুশিতেই ওর আনন্দ, অতএব বলবেই বা কেন। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বেচে এলো একদিন এস্রাজটা। বললে, ভালোই হলো, ওই একঘেঁয়ে কো কা আর কাহাতক ভালো লাগে, নতুন কিছু হাতেই আসে না। ল্যাঠা চুকলো যা হোক। সেদিন সারারাত আমি বালিশে মুখ গুঁজে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। আর কিছু রইলো না মানুষটার, শুধু আমার জন্যে, কেবল আমার জন্যে–

অঝোরে কাঁদতে লাগলো নীলাভাবী, সে কান্না কিছুতেই আর থামতে। চায় না।

এই হাস্যকর নাটুকেপনার কি সত্যি কোনো মানে হয়?

খোকা মনে মনে খতিয়ে দেখলে, এই মুহূর্তে তার কিছুই করণীয় নেই। কোলের দিকে মুখ নিচু করে আকাশ ভেঙে কেঁদে চলেছে নীলাভাবী; কখন যে কার ভিতর কোন রোগ চাড়া দেয় বোঝা দুঃসাধ্য। জাপটে ধরে একটা চুমু খেলেও এখন ভাবান্তর হবে না; কান্না ছাড়া পৃথিবীতে এই মুহূর্তে আর কিছু ভালো নেই, নীলাভাবীর ভাবখানা এখন এমন। বন্ধুদের কেউ হলে নির্ঘাত চুমু খেতো এবং আদর করতো। ইয়াসিন তো খোলাখুলি বলেই অনেক সময়, বুড়ো বয়েসের আগে মেয়েমানুষকে যে শ্রদ্ধা করে কিংবা ধর্মকর্ম নিয়ে চাগিয়ে ওঠে সে ব্যাটা এক রামপঠা, তাকে লৌড়ানো দরকার; মানুষের বুড়ো হয়ে না জন্মানোর পিছনে উপরওয়ালার বহুৎ খেয়ালখুশি কাজ করে।

পাখার বাতাস গরম হয়ে উঠেছে। বাইরের রোদ একটু একটু করে বিকেলের দিকে গড়াচ্ছে। এক সময় শান্ত হয়ে এলো নীলাভাবী। বললে, তোমার মনটাই আজ খারাপ করে দিলাম। কি আর করবো। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে বলবো এসব, সত্যিই ভিতরে ভিতরে দারুণ হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ভালোই হলো একরকম, বুকের ওপর থেকে পাথরটা খানিক সরে গিয়েছে। আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তোমার রাজীব ভাইয়ের; এস্রাজ ম্যাজিক গল্প সবই এখন অন্য এক গল্প হয়ে গিয়েছে, অথচ একদিন শুতে যাবার আগে হাত নিশপিশ করতো মানুষটার, কিছুতেই ঘুম আসতো না, এস্রাজে ছড় বুলানো চাই, মানুষ খুঁজে বেড়াতো গল্প জমাবে বলে। যে অভ্যেসগুলোকে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো অলক্ষ্যে সেইগুলোই ওকে ছেড়ে চলে গেছে। তবু বেচে আছে মানুষটা। টিকে আছে। কিন্তু টিকে আছে কি করে তা জানো? ভালোবাসাটা ওর স্বভাব, এখনো মরে নি সেটা। সব ওকে ছেড়ে গেছে, কিসের একটা ভারে দিন দিন ও ন্যুজ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওর ওই ভালোবাসার স্বভাব এখনো ছেড়ে যায় নি ওকে।

একটু থেমে খোকাকে একবার নিখুঁতভাবে জরিপ করে নিলো নীলাভাবী; তারপর খুব আচ্ছন্নভাবে বললে, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো তো?

কিছু কিছু–খোকার উত্তরে প্রচ্ছন্ন বিরাগ।

এতোসব কথার পর তোমার ঠিক বিশ্বাস হবে কি না জানি না–এস্রাজের চেয়ে, গল্পের চেয়ে, গানের চেয়ে ও আমাকে আলাদা করে কখনো ভালোবাসতে পারে নি, বেশ কিছুদিন পরে আমি একথা বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি বলবে তাহলে অন্য সবকিছুই যখন ছেড়ে দিলো। মানুষটা, সেখানে তুমি টিকে গেলে কি করে! আমি তো আর ছিটের খোলে মোড়া কঙ্কালের মতো একটা এস্রাজ কিংবা ম্যাজিক দেখানো জারিজুরি করা তাসের প্যাকেট নই, যে ছেড়ে দিলেই অমনি ল্যাঠা চুকে যাবে। ও ছাড়লেও আমি তো আর ওকে ছাড়ছিনে; এস্রাজ কিংবা তাসের প্যাকেটের সঙ্গে আমার তফাতটা শুধু এইখানেই। এখন যে ও সেই আগের মতো গল্প জমাতে পারে না, গান গাইতে পারে না, তার জন্যে ওর কিন্তু কোনো খেদ নেই। দেখলাম এই নিয়ে যা কিছু মাথাব্যথা সব একা আমার। রাজ্যির সব গ্রহরত্নের মধ্যে ডুবে আছে। ওই গ্রহরত্ব গ্রহরত্ন করে ছেড়ে দিলো চাকরিটাও। তুমি শুনতে চাও আর না চাও পাথরের গল্প শোনাতে শোনাতে রাত ভোর করে দিতে পারে ও এখন।

একেবারে ওই জগতে তলিয়ে গেছে বলতে পারো। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় রেখে এক একটা পাথরের দিকে তাকিয়ে প্রায় সারারাত কাবার করে ফ্যালে এখন। বলে মানুষের তৈরি জিনিস নিয়ে অনেকেই তো নাড়াচাড়া করে, এ হচ্ছে প্রকৃতির জিনিস, স্বয়ং খোদার হাতে তৈরি, এর চেয়ে মহার্ঘ আর কি হতে পারে। আসলে এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করার নেশা করে দিনরাত রুজির ধান্ধায় বুদ হয়ে আছে। চাকরিতে কটা টাকারই-বা সংস্থান হয় বরং এটা একটা স্বাধীন ব্যবসা; বাইরে থেকে ওর এই পেশাটাকে তাই ভীষণ একটা লাভজনক ব্যাপার বলে মন হয়। কিন্তু আমি জানি, লাভের কথা ভেবে, অঢেল কামাই করার লোভে ও এ পথে পা বাড়ায় নি। টাকা-পয়সার জন্যে মাতলামি ওর স্বভাবে কখনো দেখি নি, বরং উল্টোটাই সবসময় মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে একটু বেশি রকমেরই উদাসীন। অষ্টপ্রহর এই যে, গ্রহরত্ব গ্রহরত্ন করে কুঁদ হয়ে আছে, মানুষটা সেটা আর কিছু নয়, মদের মতো একটা নেশা। যা একদিন ওর স্বভাবে ছিলো গান গাওয়া, এস্রাজ বাজানো, সেই নেশারই অন্য চেহারা, যেমন একদিন ভালোবাসতো আমাকেও। উৎস একটাই। মন উঠে গেছে বলে নিছক আত্মপক্ষ সমর্থন করার ফন্দি এঁটে পেটবানান্তি কথার রাশ মেলে। ধরছি, তুমি নিশ্চয়ই এই ধরনের একটা কিছু ভাবছো। বিশ্বাস করো, এসব কথার পিঠে স্রেফ কথা নয়, হঠাৎ কোনো মন কচলানির জেরও নয়। যা কষ্ট দেয়, যা খিচড়ে দেয় আমার মনকে, নষ্ট করে মনের শান্তি, তার মুখোমুখি দাঁড়াতে আমি ভালোবাসি: চিরকেলে স্বভাব ওটা আমার। আগেই তো বলেছি, জীবনের জটিলতাকে আমি ঘৃণা করি, মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। দরকার হলে জট ছাড়িয়ে নিই, না পারলে চেষ্টা করি পাশ কাটিয়ে যাবার। পুরানো কথায় ফেরা যাক। নিজের টিকে থাকার প্রয়োজনেই ধরে নিতে পারো, শেষ পর্যন্ত স্বামীর সবকিছুর এইভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে হলো। যেটা আমার স্বভাব জিগ্যেস। করলাম নিজেকে, স্পষ্ট জবাব চাইলাম নিজের কাছে। উত্তরও পেলাম। গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এস্রাজ থেকে আমি, শেষে গ্রহরত্ব; আমি ভেবে দেখলাম ও ঠিকই আছে, ওর পিছনের দিকে তাকাবার অবসরই নেই। ওর প্রাণশক্তি আছে, একটা ছেড়ে আরেকটায় যাবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমার? সবকিছু একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার মনে হলো আমার। ভিতরের সব কষ্ট, সব খোদ, গ্লানি, যা এতোদিন ঘোঁট পাকাচ্ছিলো কেবল স্বামীকে ঘিরে সহসা তা ঝলমল করে ঝলসে উঠলো; এইবার নিজেকে নিয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন পর নিজের জন্যে স্বার্থপরের মতো ব্যাকুল হয়ে পড়লাম, নিরাকার ভূতুড়ে আয়নার সামনে মেলে ধরলাম নিজেকে। রীতিমতো উল্টো ব্যাপার। এতোদিন স্বামীর কথা ভেবে যতো খেদ স্তূপাকার করেছি, তা কেবল নিজের জন্যে, নতুন করে জীবনের দিকে তাকাবার জন্যে! কি অবস্থায় এসে ঠেকেছি, আমি ভাবলাম, এ আমি কোথায়, দুর্দশার ভিতরে একেবারে গলা পর্যন্ত জুবড়ে পড়ে আছি; এমন কি অবশিষ্ট আছে আমার? উচ্ছিষ্ট! কারো পাতে দেয়ার মতো নয়, উল্টেপাল্টে দেখলাম যতো রকমে পারা যায়। পাগলের মতো অবস্থা আমার। হেঁশেলের কোণে পড়ে থাকা শিলনোড়া, কিংবা উঠোনের একপাশে ফেলে রাখা মুড়োঝাঁটা, আমি তো এই-ই! নচেৎ একটা পুরানো আমলের সুখপাঠ্য বই, যা খুব যত্ন করে আর কোনোদিন পড়া হবে না এমন এক ভঙ্গিতে ঠেসে দেওয়া হয়েছে দেয়ালের নোনাধরা তাকে; বৃষ্টিতে ভিজে পচার কিংবা অক্ষরগুলো ধুয়েমুছে যাবার কোনো ভয় নেই ঠিকই, কিন্তু ভাঁজে ভাঁজে আস্তানা গাড়বে কীট, দিনের পর দিন কুরে কুরে খেয়ে খাস্তা ঝরঝরে করে দেবে। এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঢের ভালো; গরল ঘুলিয়ে উঠলো আমার ভিতরে। হাঁসফাঁস করতে লাগলাম, এমন একটা সাইক্লোন কি টর্নেডো আসে না কেন যা বাড়িটাকে গুঁড়িয়ে দেবে, তাক থেকে উড়িয়ে দেবে বইটিকে, প্রতিটি অনুচ্ছেদ খসিয়ে নিয়ে ছিড়ে কুটি কুটি করে উড়িয়ে দেবে রাজ্যময়, হাততালি দিয়ে হো হো করে হাসবে। তুমি এলে ঠিক এই সময়–

বাধা দিয়ে খোকা বললে, সিকোয়েন্সগুলো একেবারে সিনেমার মতো!

শুধু এলে বললে ছোট্টো করে বলা হবে, তোমার আবির্ভাব হলো; আমার জীবনে একটা অসাধারণ অভ্যুদয় ঘটলো। অভ্যুদয় কেন বলছি জানো?

নিছক ওজন বাড়াবার জন্যে। দাঁত দিয়ে কুটুস করে একটা নখ কেটে খোকা উত্তর দিলো।

তার মানে?

ওজন? ওজন এক ধরনের গ্যাস।

মানেটা এই, তুমি আমার কথা মোটেই ধরতে পারো নি!

না পারার কি আছে এতে–খোকা বাধা দিয়ে বললে, না পারার কি আছে এমন? সোজা কথা তোমার যেমন দেবা, তেমনি দেবী; আমি তো কোনো ফারাক দেখতে পাইনে। রাজীব ভাই যেমন–গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এস্রাজ থেকে তুমি, শেষে হীরা-জহরৎ, তুমিও তেমনি! প্রথমে শিলনোড়া, শিলনোড়া থেকে মুড়োঝাঁটা, মুড়োঝাঁটা থেকে সুখপাঠ্য বই, শেষে এক্কেবারে মক্ষিরানী!

আমি বলছিলাম তোমার কথা। তোমার রাজীব ভাই যেমন ভাগ্যকে বদলে দেয়ার গ্রহরত্ন নিয়ে ঘরে ঢোকে, তেমনি করে নিয়ে এলো তোমাকে। ঝলঝল করে উঠলো বাড়িটা। কি বিশ্রী, স্তৃপাকার ধুলো আর আবর্জনা ভরা ঘরের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম! সব আবর্জনা দুহাতে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম, তুমি যেন এক অপ্রত্যাশিত দুর্লভ উপহার, এ উপহার যেন আমাকে মানায়, যেন বেমানান না হয় আমার ঘর—

তবে যে এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে বললে মাছমার ছিপ? বাধা দিয়ে জিগ্যেস করলো খোকা।

জ্বালিও না, কথা বলতে দাও! তোমাকে দেখে আমি বদলে গেলাম। সাজ সাজ রব পড়ে গেল ভিতরে। বাঁচবার জন্যে আমি হাবাগোবার মতো দৈব-দুর্বিপাককে আশ্রয় করতে চেয়েছিলাম; তার বদলে বিনা চেষ্টায় বিনা প্ররোচনায় তুমি আমাকে উৎসাহিত করলে ভিতরের প্রাণশক্তিকে যাচাই করার। আমি আমার স্বামীর কথা ভাবলাম। এই প্রশ্ন তুলে মনে মনে যাচেছতাই ক্ষেপে উঠলাম, এখনো ওর যা আছে আমার তা থাকবে না কেন। ঠিক প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রশ্নটা একেবারে নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে। এখনো কি অগাধ আমার ক্ষমতা, কি প্রচণ্ড আমার শক্তি! যতোই বুঝতে পারি ততোই হাততালি দিয়ে উপচে পড়তে থাকি খুশিতে। ইচ্ছে করলেই আমি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি তোমাকে, ডুবিয়ে দিতে পারি কাদায়; আমি চাই সানন্দে তুমি আমার ক্রীতদাস হবে। তোমাকে ঘুঙুরের মতো পায়ে বেঁধে রাজ্যময় নেচে বেড়াতে পারি এখনো। ও যেমন বেঁচে আছে, আমিও মরি নি, বেঁচে আছি আমিও। কি নির্লজ্জ সে উল্লাস, তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না!

হীরার মতো জুলজুল করে জলছিলো নীলাভাবী। খোকা হাবার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে নীলাভাবীর দুচোখ দিয়ে। মাঝখানে দুটি বিন্দুর মতো দুজনকে বসিয়ে অকারণ আনন্দে চারটি দেয়াল যেন হাত ধরাধরি করে শিশুর মতো নেচে নেচে ঘুরপাক খাচ্ছে; দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান। লেসের কাজে মোড়া টিপয়ের ছাউনি দুলছে, দুলছে ফুলদানি, দুলছে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রজনীগন্ধাগুচ্ছ, ট্রানজিস্টার যেন বনবিড়াল, খাড়া করে মৃদু মৃদু নাড়ছে। এরিয়েললেজ; হাওয়া, এতো হাওয়া আসে কোথা থেকে, সমুদ্রের খুব কাছে তারা, কিংবা একটা জাহাজের ভিতর, হাওয়ায় মাছের ফিসফিসানি, হাওয়ার গভীর গোপনে সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে।

এ যাত্রা তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আজ আর দুজনের কাউকে নিয়ে মনের ভিতর কোনো গ্লানি নেই।

খোকা কোনো কথা তুললো না। বসে রইলো নিঃশব্দে।

বিকেলছোঁয়া নিভন্ত দুপুর, সেগুনবাগিচার প্রাচীন হলদে কোঠাবাড়ির বিড়ালের মতো আলস্যময় কোমল কামরা, এক আঁটি নির্দোষ। রজনীগন্ধা, রজনীগন্ধার মতো ধবধবে অঢেল বিছানা, নরোম নিরুদ্বিগ্ন হাওয়া, এবং একটি নারীদেহ যা পরিচিত হলেই মোমের মমি হয়ে যায়, সবকিছু আড়াল করে যাচ্ছে তাকে, আড়াল করে যাচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতো নিরলস সহজ অভ্যাসে, স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ভাসা ভাসা মনে হয় খোকার। ঝালরের মতো বিছানার একটা প্রান্ত দুলছে, যেন একটা ভিজে হাওয়ার ঝাপটা, এবং কম্পমান, দুর্বিনীত গ্রীবা তুলে উদ্বেল বিশুদ্ধ রজনীগন্ধাগুচ্ছ থরথর কম্পমান।

ঘুরেফিরে একটা ঝাপসা ছবি, যা দীপ্র পাপবোধের চেয়ে মোহন, তার নিজের দিকে বিবসনা নারীর মতো প্রবলভাবে টানতে লাগলো খোকাকে; ছবিটি ক্রমশই মায়াবিনীর মতো রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। বর্ণাঢ্য উজ্জ্বলতায় :

স্বপ্নের গভীর সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলো খোকা ঘরের চারটি দেয়াল তীব্র–মধুর মরনোলাসে পরম্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ, এক; পরস্পরবিরোধী অমসূণ রঙ আর রেখার অনিবার্য অভিঘাতে–এক। কোথাও হলুদ, কোথাও বেগুনি, কোথাও সবুজ, টুকরো টুকরো, গোছা গোছা; দীর্ঘ অন্বেষণে পরিশ্রান্ত লাল-নীল-কমলার সন্ধানী রেখার প্রপাত। বিপর্যস্ত বিস্রস্ত স্নায়ুর মতোই দেয়ালময় একাকার এবং নিঃশব্দ মৃত্যুর মতো দাঁতাল গহ্বরের প্রতিভাসে আপতিত উদ্দেশ্যহীনতা আশ্চর্যভাবে পুনঃসংগঠিত। কোথাও লাল এমন প্রবল তা যেন নিজেরই মাংস নিংড়ানো, কোথাও নীল এমন বিশৃঙ্খল যেন তা আকাশ থেকে করাতে কাটা। একপাশে বৃন্তচ্যুত ফলের মতো বিচ্ছিন্ন। স্তন, নির্মম নখরাঘাতে যা ছিন্নভিন্নপ্রায়। সন্নিকটে একজোড়া সুগঠিত উরু, যার সন্ধিতে দক্ষ কারুশিল্পীর চিৎকার খোদিত। এই চিৎকার নিঃসৃত তুমুল রক্তস্রোত যেন নিদারুণ প্রয়োজনেই রহস্য শোভিত অনড় ডলফিনের মতো। শিলাখণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে খুবলে খাওয়া শূন্যতার স্তম্ভেও আকার নিয়েছে, সেখানে এক অনৈসর্গিক নিস্তব্ধতা আপন পক্ষপুটে অচঞ্চল।

খোকা তুমি কিছু বলো—

কি বলবো–স্বপ্নের ভিতর থেকে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলো খোকা; তার গলার স্বর ঘড়ঘড়ে।

কিছু বলার নেই তোমার?

দেয়ালের রঙ ততোক্ষণে অপসৃত; চার দেয়ালের সেই অবিশ্বাস্য আলিঙ্গন শৈথিল্যে ভেঙে পড়েছে, স্বপ্নের ভিতরে যেন এইমাত্র একটি কাক ইলেকট্রিক তারে আটকে গিয়েছে, অজস্র চিৎকার এখন কানের চারপাশে।

আমার নিজের কথা এখনো শেষ হয় নি, ভালো না লাগলে আজ থাক–

ভালো লাগছে, তুমি বলতে থাকো–খোকা চেষ্টা করলো স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়ার, কিন্তু প্রবল বিতৃষ্ণা তার কথাগুলোকে অগোচরে দুমড়ে দিলো।

যেদিন তুমি বললে, আমার জন্যে তোমার মন কাঁদে, না দেখে থাকতে পারো না, সেদিন দুলে উঠলো আমার ভিতরটা, সেকথা তো আগেই বলেছি। সত্যি বলছি, তোমার ওই স্বীকারোক্তিতে আমার মনের সব বাঁধন একেবারে আলগা হয়ে খসে পড়েছিলো। একটা স্রোত এসে ধাক্কা দিচ্ছিলো সেখানে। মনে হচ্ছিলো সেই গোয়ার স্রোতের মুখে আমার ঘরবাড়ি বাগান সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, প্রাণপণে চেষ্টা করেও নিজেকে সামাল দিতে পারবো না। কিন্তু কেন, কেন এমন হলো আমার? বিশ্বাস করবে, আজ থেকে সেই তেরো বছর আগে তোমার রাজীব ভাইও ওই একই কথা বলেছিলো আমাকে, এবং তার যে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তা-তো বুঝতেই পারছো আমাকে এই সংসারে দেখে!

একেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি—

একই কথায় যখন তেরো বছর বাদে ঠিক একই প্রতিক্রিয়া হলো আমার, তখন বুঝলাম আমি মোটেই ওর পিছনে পড়ে নেই। সংসার কেন, কোনো কিছুই আমাকে ছোবল দিতে পারে নি। নিজেকে নতুন করে আবার আবিষ্কার করলাম। একটা সোনার প্রদীপ হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিলো দিঘির গভীরে, তুমি আমার সেই রাজকুমার ব্যাঙ, তুলে দিয়েছো তুমি; এখন আর শুধু শুধু ঘর অন্ধকার করে বসে থাকা কেন?

শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ বানিয়ে তবে ছাড়লে, একেই বলে সামরিক শাসনের কুফল! তা থামলে কেন? আরো কিছু?

আজ এই পর্যন্ত—

অর্থাৎ খেল খতম, পয়সা হজম, এই গানের বই গানের বই গানের বই!

কিছুটা আছে আরো। এতোক্ষণ যা যা বললাম এর সবই তোমার রাজীব ভাইয়ের জানা। ও সবই বোঝে, সবই আন্দাজ করতে পারে। আর পারবে না-ই-বা কেন, আজ তেরো বছর এক সঙ্গে ঘর করলাম, হাবা কালা তো আর নয়! তোমার কথা শুনে কি বলেছে জানো? বলেছে, খোকার ভিতরে নিজের অগোচরে আমার অতীতকে খুঁজে বেড়াচ্ছো তুমি, ওটা আর কিছু নয়, আজীবন আমাকে ভালোবেসে যাবার একটা পাগলামি তোমার; শুনে আমি হেসেছি।

হাসবেই তো, অমন হাসির কথায় না হেসে পারা যায়!

চটেছো মনে হচ্ছে?

ছেড়ে দেওয়া গরু যখন পরের ক্ষেতে ধান খাচ্ছে, তখন ক্ষেতটাকে পৈতৃক সম্পত্তি ধরে নিতে পারলে আপদ চুকে যায়। এতো বকতেও পারো। প্রার্থনা করি নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে ফঁাৎ ফোৎ করে এতোক্ষণ যত কথা বললে তার বিন্দু-বিসর্গও যেন আমার বিশ্বাস হয়। মুখ ব্যথা করে না তোমার, এতো কপচাও কি করে? আজ আর আমার ধৈর্য নেই, আমি উঠবো–

অত তড়িঘড়ি করার কি আছে, চা খেয়ে তবে উঠবো।

গুলি মারো! চুলোয় যাক তোমার চা! আমার মাথা দপদপ করছে। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা কোনো একটা সেলুনে যাবো, আধঘণ্টা ধরে শিরমালিশ চালাবো, তারপর অন্য কথা, বাপস!

ঠিক এই সময় হুড়মুড় করে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ঢুকলো রাজীব ভাই; পা থেকে মাথা ধুলায় ধূসর, দুশ্চিন্তাকাতর মুখাবয়ব। খোকা দেখলো, রাজীব ভাইয়ের চোখে জটিল চাঞ্চল্য; মনে হলো ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে গিয়েছে, তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ঘরে এসে পৌঁছেছে।

খোকাকে দেখে হাতের ব্যাগটা রাখতে রাখতে রাজীব ভাই বললে, কতোক্ষণ?

তা অনেকক্ষণ, প্রায় সারাদুপুর–

বলো কি! কথাটা সংক্ষেপে শেষ করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নীলাভাবীর দিকে তাকালো রাজীব ভাই, বললে, তোয়ালে সাবান সব দাও, গোসল করবো, গলার ভিতর পর্যন্ত ধুলোবালি কিচকিচ করছে।

খোকা বিছানা থেকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলে, ব্যাপার কি রাজীব ভাই, এমন হন্তদন্ত হয়ে কোত্থেকে?

শহর খুব গরম।

তার মানে?

বাইরে তুমুল গণ্ডগোল!

হঠাৎ?

হঠাৎ নয়, আমি তো জানতাম-ই এই ধরনের একটা কিছু হবে। দুটোর সময় প্রেসিডেন্টের কি এক ছাতার স্পিচ ব্রডকাস্ট হয়েছে, ব্যাস, সারা শহর ফেটে পড়েছে বারুদের মতো। স্টেডিয়ামে চেয়ার ভাঙাভাঙি, দোকানপাট সব দুদ্দাড় করে বন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় কেবলি মানুষ আর মানুষ লাঠিসোটা, লোহার রড, পাইপ, হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সব উন্মত্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। সব বন্ধ। গাড়ি-ঘোড়া থেকে হাওয়া-বাতাস, গাছের পাতা পর্যন্ত পড়া বন্ধ। কি বলবো, পথে-ঘাটে হাঁটার উপায় নেই, থৈ-থৈ করছে মানুষ। বাবারে বাবা, এতো মানুষ সব ছিলো কোথায়!

খোকা রসিকতা করে বললে, এখন বুঝলেন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর মালকড়ি কিভাবেই না গুবলেট হয়!

রাজীব ভাই সহজ গলায় বললে, আসলে ওইসব দপ্তরে আমার মতো একজন কনফর্মড বিশেষজ্ঞ দরকার, কি বলো? সে যাক, তুমি কিন্তু আর মোটেও দেরি কোরো না, এখনই বেরিয়ে পড়ো। গাড়ি ঘোড়া তো আর নেই, পায়দলই মারতে হবে। যে-কোনো মুহূর্তে খুন খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে যেতে পারে, শহরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

অনেকক্ষণ পর বাড়ির কথা মনে পড়লো খোকার, ছাৎ করে উঠলো বুকের ভিতর। অতোবড় বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে সে।

সামান্য একটু এগোলেই রাস্তা। কেবল ধুলো আর ধুলো, চারিদিক ধুলোয় অন্ধকার। অল্পক্ষণের মধ্যেই খোকা মিছিল দেখতে পায়, মহা আক্রোশে ফেটে পড়ছে মিছিলের মানুষ।

ঢল নেমেছে রাস্তায়। মানুষের এমন রুদ্রমূর্তি সে আর কখনো দেখে। নি। পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে, দিগ্বিদিক ঝাপসা, অবলুপ্ত; চতুর্দিকে বোমার মতো ফেটে পড়ছে স্লোগান।

এতোক্ষণ পর হুঁশ হয় খোকার, বাড়ি থেকে বের হবার পরপরই মিছিলের স্রোত বয়ে যেতে দেখেছিলো সে, গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো তখনই।

খোকা ছোটা শুরু করে।

প্রতিটি রাজপথই এখন ভয়ানকভাবে পদপিষ্ট। মুহুর্মুহু বজ্র-নির্ঘোষে উপর্যুপরি কেঁপে উঠছে সবকিছু কাছেপিঠে কোথাও কোনো এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি শতবর্ষ পর রুদ্ররোষে উদ্‌গিরিত হচ্ছে, ভস্মাচ্ছাদনে মুড়ে দিয়েছে চিৎপাত শহরকে; সংহারপিপাসু উত্তুঙ্গ অগ্নিময় লাভাস্রোতে ধীর অথচ প্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসরমান।

মানুষের ভিড় কেটে বেরুতে পারছে না খোকা। বারবার ধাক্কা খাচ্ছে। আসন্ন ত্রাস তাড়া করছে তাকে; মুহূর্তের সামান্য ব্যবধানে একটা আবশ্যিক প্রতিক্রিয়ায় সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, ভেঙে পড়বে বিচারালয়, ভেঙে পড়বে মিলনায়তন, ভেঙে পড়বে পানশালা, স্টেডিয়াম। এতোদিন তার চোখে যা ছিলো সামান্য মানুষ, এখন তা সংগঠিত অবিচ্ছিন্ন মিছিলে। খোকা শিউরে উঠলো, এতোদিন তার কাছে যা ছিলো দয়িতা যামিনী মদিরার মতো তিন অক্ষরের হাল্কা পালকে মোড়া পাখির মতো নিছক একটি রোগা শব্দ, এখন তা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়, জনতা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *