১.২ মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ

মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিকোণ
প্রথম খণ্ড । ভাগ ১ – নিয়তি । পরিচ্ছেদ ২

মনোদেহতত্ত্বের থেকে মনোবিশ্লেষণ যে প্রচণ্ড অগ্রগতি লাভ করেছে তা এ-দৃষ্টিতে যে মানবিক তাৎপর্য গ্রহণ না করে কোনো কারণই মানসিক জীবনে জড়িত হয় না; জীববিজ্ঞানীরা যে-দেহ-বস্তু বর্ণনা করেন, তা যে আসলেই অস্তিত্বশীল, এমন নয়, আছে সেই দেহটি বিষয়ী যা যাপন করে। নারী ততোখানি নারী যতোখানি সে নিজেকে নারী মনে করে। তার আছে জৈবিকভাবে অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য, তবে সেগুলো তার সত্য, অভিজ্ঞ পরিস্থিতির অংশ নয় : তাই এতে প্রতিফলিত হয় না ডিমের গঠন, বরং জৈবিকভাবে বিশেষ গুরুতপূর্ণ নয় এমন একটি প্র্ত্যঙ্গ, যেমন ভগাঙ্কুর, এতে পালন করে প্রধান পর্যায়ের ভূমিকা। প্রকৃতি নারীকে সংজ্ঞায়িত করে না; তার আবেগগত জীবনে প্রকৃতির সাথে নিজের মতো করে কাজ করতে গিয়ে সে নিজেই সংজ্ঞায়িত করে নিজেকে।

এ-পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে একটি সম্পূর্ণ সংশ্রয়, যার পুরোটাকে আমি সমালোচনা করতে চাই না, শুধু দেখতে চাই নারীবিশ্লেষণে এর অবদানটুকু। মনোবিশ্লেষণবিদ্যাকে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা সহজ কাজ নয়। সব ধর্মের মতোই–যেমন খ্রিস্টধর্ম বা মার্কবাদ–কিছু অনড় ধারণার ভিত্তির ওপর এটা প্রদর্শন করে থাকে এক বিব্রতকর নমনীয়তা। বহু শব্দ অনেক সময় ব্যবহৃত হয় চরম আক্ষরিক অর্থে, যেমন ফ্যালাস (শিশ্ন) শব্দটি বুঝিয়ে থাকে মাংসের সে-উত্থান, যা নির্দেশ করে পুরুষকে; তারপর এগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয় সীমাহীনভাবে এবং দেয়া হয়। প্রতীকী অর্থ, তাই শিশ্ন এখন বুঝিয়ে থাকে পৌরুষ ও তার পরিস্থিতি। যদি আপনি এ-মতবাদকে আক্রমণ করেন, তাহলে মনোবিশ্লেষক প্রতিবাদ করেন যে আপনি ভুল বুঝেছেন এর মূলচেতনাকে; আর আপনি যদি প্রশংসা করেন এর মূলচেতনার, তাহলে তিনি তৎক্ষণাৎ আপনাকে বন্দী করতে চান ওই মতবাদে। মতবাদের কোনো গুরুত্ব নেই, কেউ কেউ বলেন, মনোবিশ্লেণ হচ্ছে একটি পদ্ধতি; কিন্তু পদ্ধতির সাফল্য মতবাদীর বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করে তোলে। সব সত্ত্বেও কোথায় পাওয়া যাবে মনোবিশ্লেষণের প্রকৃত মুখাবয়ব যদি না পাওয়া যায় মনোবিশ্লেষকদের মধ্যে? কিন্তু এঁদের মধ্যেও আছেন বিরুদ্ধ মতাবলম্বী, যেমন আছেন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও মার্ক্সবাদীদের মধ্যে; এবং একাধিক মনোবিশ্লেষক ঘোষণা করেছেন মনোবিশ্লেষণের নিকৃষ্টতম শত্রু হচ্ছে মনোবিশ্লেষকেরা। মধ্যযুগীয় বিদ্যাধর্মীয় যথাযথতা সত্ত্বেও যা প্রায়ই হয়ে ওঠে পণ্ডিতিসুলভ, রয়ে যায় বহু অস্পষ্টতা, যেগুলো দূর করা দরকার। সার্ত্র ও মারলিউ-পোন্তি যেমন লক্ষ্য করেছেন যে যৌনতা অস্তিত্বের সাথে সমবিস্তৃত, এ-প্রস্তাবটিকে দুটি অত্যন্ত ভিন্ন উপায়ে বোঝা সম্ভব; এটা বোঝাতে পারে যে অস্তিত্বশীলের প্রতিটি অভিজ্ঞতারই রয়েছে একটি যৌন তাৎপর্য, বা প্রতিটি যৌন প্রপঞ্চেরই আছে একটি আস্তিত্বিক তাৎপর্য। এ-দুটি বিবৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব, তবে প্রায়ই আমরা একটি থেকে পিছলে গিয়ে পড়ি আরেকটিতে। এছাড়াও, যখনই যৌনকে ভিন্ন করা হয় যৌনাঙ্গীয় থেকে, তখনই যৌনতার ধারণাটি হয়ে ওঠে খুবই অস্পষ্ট।

ফ্রয়েড নারীর নিয়তির প্রতি কখনো বেশি আগ্রহ দেখান নি; তিনি পুরুষের নিয়তি সম্পর্কে তার বিশ্লেষণকে সামান্য সংশোধন করে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন নারীর নিয়তির সাথে। এর আগে যৌনবিজ্ঞানী মারানো বলেছিলেন যে বিশেষ শক্তি হিশেবে, আমরা বলতে পারি লিবিডো পুরুষধর্মী শক্তি। আমরা পুলক সম্পর্কেও একথাই বলবো। তাঁর মতে, যে-সব নারী পুলক অনুভব করে, তারা পুরুষধর্মী নারী; কামপ্রণোদনা একমুখি আর নারী এগিয়েছে এর মাত্র অর্ধেক পথে। ফ্রয়েড কখনো এতোটা চরমে যান নি; তিনি স্বীকার করেন যে পুরুষের মতো নারীর কামও পুরোপুরি বিকশিত; তবে তিনি বিশেষভাবে এ নিয়ে কাজ করেনি। তিনি লিখেছেন : সারসত্তায় লিবিডো অবিরত ও নিয়মিতভাবে পুরুষ, তা পুরুষের মধ্যেই দেখা যাক বা দেখা যাক নারীর মধ্যে। তিনি স্বীকার করেন না যে নারী-লিবিডোর আছে নিজস্ব মৌলিক স্বভাব, তাই তাঁর কাছে একে মনে হবে সাধারণ মানবলিবিডোর এক জটিল বিকৃতি বলে। তার মতে এটা শুরুতে দু-লিঙ্গে অভিন্নভাবে বিকশিত হয়। প্রতিটি শিশু প্রথমে যায় মুখগহ্বর পর্বের ভেতর দিয়ে, যা তাকে নিবদ্ধ করে মায়ের স্তনের প্রতি, এবং তারপর যায় পায়ু পর্বের ভেতর দিয়ে; পরিশেষে পৌঁছে কামপ্রত্যঙ্গ পর্বে, যখন ভিন্ন হয়ে ওঠে দুটি লিঙ্গ।

ফ্রয়েড এছাড়াও প্রকাশ করেছেন একটি তথ্য, যার গুরুত্ব এখনো ভালোভাবে অনুধাবন করা হয় নি : সেটা হচ্ছে পুরুষের কাম যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে স্থিত শিশ্নে, সেখানে নারীর রয়েছে দুটি সুস্পষ্ট পৃথক কামসংশ্রয় : একটি ভগাঙ্কুরীয়, যা বিকশিত হয় শৈশবে, আরেকটি যোনীয়, যার বিকাশ ঘটে বয়ঃসন্ধির পর। কোনো ছেলে যখন পৌঁছে তার কামপ্রত্যঙ্গ পর্বে, তখন সম্পূর্ণ হয় তার বিকাশ; তবে তাকে পেরিয়ে যেতে হয় তার স্বতঃকামী প্রবণতা, যাতে সুখ আত্মগত, থেকে বিষমকামী প্রবণতার দিকে, যাতে সুখ জড়িত হয় অন্য কোনো বস্তুর সাথে, যা সাধারণত নারী। বয়ঃসন্ধির কালে একটি আত্মপ্রেমমূলক পর্বের ভেতর দিয়ে ঘটে এ-উত্তরণ। কিন্তু শিশ্ন থাকে, যেমন শৈশবে ছিলো, কামের সুনির্দিষ্ট প্রত্যঙ্গ। নারীর লিবিডোও আত্মপ্রেমমূলক একটি পর্ব পেরিয়ে এগোয় বস্তুর দিকে, সাধারণত পুরুষের দিকে; তবে এ-প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি জটিল, কেননা নারীকে ভগাঙ্কুরীয় সুখ থেকে পৌঁছোতে হয় যোনীয় সুখের দিকে। পুরুষের আছে মাত্র একটি কামপ্রত্যঙ্গ পর্ব, কিন্তু নারীর আছে দুটি; তার একটি বড়ো ঝুঁকি আছে যে সে তার কামবিকাশের শেষ পর্যায়ে নাও পৌঁছোতে পারে, থেকে যেতে পারে শিশুপর্বে, এবং তার মধ্যে দেখা দিতে পারে মনোবিকলন।

স্বতঃকামী পর্বে থাকা অবস্থায় শিশু কমবেশি জড়িত হয় কোনো বস্তুর সাথে। বালক জড়িত হয় তার মায়ের সাথে এবং নিজেকে অভিন্ন করে তুলতে চায় পিতার সাথে; এ-ধৃষ্টতা তাকে ভীত করে, সে ভয় পেতে থাকে যে শাস্তি হিশেবে পিতা। হয়তো তার অঙ্গচ্ছেদ করবে। এভাবে ইডিপাসগূঢ়ৈষা থেকে তার মধ্যে দেখা দেয়। খোজাগূঢ়ৈষা। পিতার প্রতি বাড়ে তার হিংস্রতা, তবে একই সময়ে বালক আত্মস্থ করে নেয় পিতার কর্তৃত্ব; এভাবে বালকের মধ্যে গড়ে ওঠে সুপার ইগো, অধি অহং, যা দমন করে তার অজাচারী প্রবণতা। এগুলো দমিত হয়, গূঢ়ৈষাটি ধ্বংস হয়, এবং পুত্র মুক্তি পায় পিতার ভীতি থেকে। এ-সময় সে নৈতিক উপদেশের সাহায্যে মনের মধ্যে অধিষ্ঠিত করে পিতাকে। সুপার ইগো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কেননা ইডিপাসগূঢ়ৈষাকে প্রতিরোধ করা হয় কঠোরভাবে।

ফ্রয়েড প্রথমে বালিকার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন পুরোপুরি একইভাবে, পরে বিকাশের এ-নারীরূপের নাম দিয়েছেন তিনি ইলেক্টাঢ়ৈষা; তবে এটা স্পষ্ট যে তিনি একে এর নিজের ওপর ভিত্তি করে সংজ্ঞায়িত করার বদলে বর্ণনা করেছেন পুংলিঙ্গের বিন্যাসের অনুকরণে। তিনি এ-দুয়ের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য : বালিকা প্রথমে বোধ করে মায়ের প্রতি সংবন্ধন, কিন্তু বালক কখনোই তার পিতার প্রতি কামানুরাগ বোধ করে না। বালিকার এ সবন্ধন নির্দেশ করে যে তার ভেতরে টিকে আছে মুখ-পর্ব। তারপর বালিকা পিতার সাথে অভিন্ন ভাবতে শুরু করে নিজেকে; তবে পাঁচ বছর বয়সের দিকে সে আবিষ্কার করে দু-লিঙ্গের দেহসংস্থানের পার্থক্য; তার শিশ্ন নেই বলে সে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, এবং অর্জন করে খোজাগূঢ়ৈষাসে কল্পনা করতে থাকে যে তার অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে, এবং এ-ভাবনা তাকে পীড়িত করতে থাকে। তখন সে পুরুষসুলভ অভিমান ছেড়ে দিয়ে মায়ের সঙ্গে অভিন্ন করে তোলে নিজেকে এবং কামে প্রলুব্ধ করতে চায় পিতাকে। এভাবে খোজাগূঢ়ৈষা ও ইলেক্টাগূঢ়ৈষা পরস্পরকে করে শক্তিশালী। তার হতাশার অনুভূতি হয় তীব্র, কেননা পিতাকে ভালোবেসে বৃথাই সে চায় পিতার মতো হতে; আবার, তার মনস্তাপ বাড়িয়ে তোলে তার প্রেম, কেননা পিতার ভেতরে জাগিয়ে তোলা প্রীতির সাহায্যেই শুধু সে ক্ষতিপূরণ করতে পারে নিজের নিকৃষ্টতার। ছোটো বালিকা তার মায়ের প্রতি পোষণ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বৈরিতার বোধ। তারপর তার মধ্যেও গড়ে ওঠে সুপার ইগো, দমিত হয় অজাচারী প্রবণতাগুলো; তবে তার সুপার ইগো বেশি শক্তিশালী নয়। তার কামপ্রত্যঙ্গগুলোর বিকাশের মতোই বালিকার সম্পূর্ণ কামনাট্যটি তার ভাইদের থেকে অনেক বেশি জটিল। এর পরিণতিতে সে বিরূপ হয়ে উঠতে পারে খোজাগূঢ়ৈষার প্রতি এবং অস্বীকার করতে পারে তার নারী, ধারাবাহিকভাবে কামনা করতে পারে একটি শিশ্ন, নিজেকে অভিন্ন বোধ করতে পারে পিতার সাথে। এ-প্রবণতা তাকে রেখে দেয় ভগাঙ্কুরীয় পর্বে, তাকে করে তোলে কামশীতল, বা লিপ্ত করতে পারে সমকামে।

এ-দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধে যে-দুটি অত্যাবশ্যক আপত্তি তোলা যেতে পারে, তার উৎস হচ্ছে এ-ঘটনা যে ফ্রয়েড একে দাঁড় করিয়েছেন এক পুরুষভিত্তিক কাঠামোর ওপর। তিনি ধরে নিয়েছেন যে নারী অনুভব করে সে একটি অঙ্গচ্ছেদ-করা পুরুষ। তবে অঙ্গচ্ছেদের ধারণাটি জ্ঞাপন করে তুলনা ও মূল্যায়ন। অনেক মনোবিশ্লেষক। আজকাল স্বীকার করেন যে অনেক মেয়ে শিশ্ন নেই বলে মনস্তাপে ভুগতে পারে, তবে তারা বিশ্বাস করে না শিশ্নটি কেটে নেয়া হয়েছে তাদের শরীর থেকে; আবার এমনস্তাপও সকলের নয়। একটা সরল দেহসংস্থানগত তুলনা থেকে এর উৎপত্তি ঘটতে পারে না; আসলে বহু বালিকাই অনেক দেরিতে আবিষ্কার করে পুরুষের দেহসংগঠন। ছোটো ছেলে তার শিশ্ন দিয়ে অর্জন করে জীবন্ত অভিজ্ঞতা, এটা তার কাছে হয়ে ওঠে গর্বের বস্তু; তবে এ-গর্ব বোঝায় না যে তার বোনেরা এতে বোধ করে অপমান, কেননা তারা পুরুষাঙ্গটিকে চেনে শুধু তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে–এ-উপবৃদ্ধি, মাংসের এই ছোটো দণ্ডটি শুধু তাদের মনে জাগাতে পারে ঔদাসীন্য, এমনকি ঘেন্না। বালিকার লালসা, যখন থাকে, জন্ম নেয় পৌরুষের এক পূর্ববর্তী মল্যায়ন থেকে। ফ্রয়েড একে ধরে নিয়েছেন স্বতঃসিদ্ধ বলে। অন্যদিকে, ইলেক্টাগূঢ়ৈষা ধারণাটি খুবই অস্পষ্ট, কেননা নারী লিবিডোর কোনো প্রাথমিক বর্ণনা দিয়ে এটাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন নি। এমনকি ছেলেদের মধ্যেও সুস্পষ্ট কোনো কামপ্রত্যঙ্গগত ইডিপাসগূঢ়ৈষা সাধারণ ঘটনা নয়; আর কিছু ব্যতিক্রম বাদে একথা বলা যায় না যে ব্ৰিহাই হচ্ছে শিশুকন্যার কামোত্তেজনার উৎস। নারীকামের একটি বড়ো সমস্যা হচ্ছে যে ভগাঙ্কুরীয় সুখ সীমাবদ্ধ বিশেষ স্থানে; আর বয়ঃসন্ধির কাছাকাছি সময়েই শুধু যোনীয় অনুভূতির সাথে শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিতে থাকে কয়েকটি কামোত্তেজক এলাকা। তাই দশ বছর বয়সের কন্যাকে পিতা চুমো খেলে ও আদর করলে তার ভেতর জেগে ওঠে ভগাঙ্কুরীয় সুখ, এটা হচ্ছে বাজে কথা। পিতার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটি উদ্ভূত হয়েছে সমাজ থেকে, যা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন ফ্রয়েড।

অ্যাডলার বিতর্কে লিপ্ত হন ফ্রয়েডের সাথে, কেননা তিনি তত্ত্বটির সীমাবদ্ধতা দেখতে পান এখানে যে এটি মানুষের জীবন ব্যাখ্যা করতে চায় শুধু কাম ভিত্তি করে; তিনি মনে করেন কামকে সমন্বিত করতে হবে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের সাথে। ফ্রয়েডের কাছে মানুষের সমস্ত আচরণই তার কামনাবাসনার ফল–অর্থাৎ সুখান্বেষণের ফল–কিন্তু অ্যাডলারের কাছে মানুষের আছে কিছু লক্ষ্য; যৌন কামনার বদলে তিনি দেখতে পান অভিপ্রায়, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা। তিনি বুদ্ধিমত্তাকে এতো বড়ো জায়গা দেন যে তার চোখে কাম লাভ করে শুধু একটা প্রতীকী মূল্য। তার মতে মানবনাট্যকে সংহত করে আনা যায় তিনটি মৌল উপাদানে : প্রতিটি ব্যক্তির রয়েছে ক্ষমতার ঈপ্সা, যার সঙ্গে থাকে এক হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা, এর ফলে যে-বিরোধ বাধে তাতে বাস্তবতা থেকে পলায়নের জন্যে ব্যক্তিটিকে প্রয়োগ করতে হয় হাজারো কৃটচাল। নারীর মধ্যে হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষা এমন রূপ নেয় যে লজ্জায় সে প্রত্যাখ্যান করে তার নারীত্ব। শিশ্নের অভাবে ঘটে না এ-গূঢ়ৈষা, ঘটে নারীর সমগ্র পরিস্থিতির ফলে; বালিকা যদি শিশ্নের প্রতি ঈর্ষা বোধ করে, তাহলে সে এটিকে ঈর্ষা করে বালকদের লাভ করা সুযোগসুবিধার প্রতীক হিশেবে। পরিবারে পিতা অধিকার করে থাকে যে-স্থান, পুরুষদের সর্বজনীন আধিপত্য, তার নিজের শিক্ষা–সব কিছু তার মনে সৃষ্টি করে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বোধ। পরে, সে যখন অংশ নেয় যৌন সম্পর্কে, সঙ্গমের আসনের মধ্যে সে দেখতে পায় এক নতুন অবমাননা যে নারী শোয় পুরুষের নিচে। সে প্রতিক্রিয়া জানায় পুরুষালি প্রতিবাদ-এর সাহায্যে : হয়তো সে নিজেকেই পুরুষায়িত করে তুলতে চায়, বা সে তার নারীসুলভ অস্ত্রগুলো দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে পুরুষের বিরুদ্ধে। মাতৃত্বে সে তার সন্তানের মধ্যে পায় একটা কিছু, যা শিশ্নের সমতুল্য। কিন্তু এটা স্বীকার করতে হলে ধরে নিতে হয় যে নারী হিশেবে সে সম্পূর্ণরূপে মেনে নিয়েছে তার ভূমিকা; এবং স্বীকার করে নিয়েছে নিজের নিকৃষ্টতা। পুরুষের তুলনায় সে অনেক গভীরভাবে নিজের বিরুদ্ধে বিভক্ত।

যে-তাত্ত্বিক ভিন্নতা পার্থক্য নির্দেশ করে অ্যাডলার ও ফ্রয়েডের মধ্যে, এখানে আমি সে-সম্পর্কে আর বিস্তৃত আলোচনায় যাবো না, তাঁদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের সম্ভবপরতাগুলোও আলোচনা করবো না; তবে একথা বলা যেতে পারে যে যৌন কামনাভিত্তিক ব্যাখ্যা আর অভিপ্রায়ভিত্তিক ব্যাখ্যার কোনোটিই যথেষ্ট নয়, কেননা প্রতিটি কামনাই নির্দেশ করে কোনো অভিপ্রায়, কিন্তু কামনার মধ্য দিয়েই বোঝা সম্ভব অভিপ্রায়কে–তাই অ্যাডলারীয়বাদ ও ফ্রয়েডীয়বাদের একটা সমন্বয় সম্ভবত সম্ভব। সব মনোবিশ্লেষকই সাধারণভাবে গ্রহণ করে থাকেন যে-স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাবটি, সেটি হচ্ছে : কিছু নির্ধারিত উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার সাহায্যেই ব্যাখ্যা করতে হবে মানবোপাখ্যান। এবং সব মনোবিশ্লেষকই নারীর জন্যে নির্দিষ্ট করে একই ভাগ্য। তার নাটক রূপায়িত হয় তার পুরুষধর্মী ও নারীসুলভ প্রবণতার সংঘাতের মধ্য দিয়ে, প্রথমটি প্রকাশ পায় ভগাঙ্কুরীয় সংশ্রয়ে, দ্বিতীয়টি যোনীয় কামে। শৈশবে সে নিজেকে অভিন্ন করে তোলে পিতার সঙ্গে; তারপর পুরুষের তুলনায় বোধ করে এক ধরনের হীনম্মন্যতা এবং মুখোমুখি হয় এক উভয়-সংকটের : তাকে জ্ঞাপন করতে হয় তার স্বাধীনতা এবং হয়ে উঠতে হয় পুরুষধর্মী; এটা তার হীনম্মন্যতা গূঢ়ৈষার সঙ্গে মিলেমিশে তার মধ্যে তৈরি করে স্নায়ুবিক চাপ, ফলে দেখা দেয় বিকলন, অথবা তাকে প্রণয়াকুল অধীনতার মধ্যে লাভ করতে হয় সুখী পরিপূর্ণতা। এ-সমাধান সহজ হয়ে ওঠে সার্বভৌম পিতার প্রতি তার ভালোবাসার ফলে। প্রেমিক বা স্বামীর মধ্যে সে খোঁজে পিতাকেই, তাই তার যৌন প্রেম মিলেমিশে যায় তার পরাধীন হওয়ার বাসনার সাথে। মাতৃত্বে সে লাভ করে এর ক্ষতিপূরণ, কেননা এটা তাকে দেয় এক নতুন ধরনের স্বাধীনতা। এ-নাটক যেনো ধারণ করে নিজের এক ধরনের শক্তি, এক ধরনের গতিশীলতা; প্রতিটি ও সমস্ত বিকৃতিসাধক ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ধীরভাবে এগোয় নিজের যাত্রাপথে, এবং প্রতিটি নারী অক্রিয়ভাবে ভেসে যায় এর সাথে।

নিজেদের তত্ত্বের পক্ষে উপাত্তগত প্রমাণ পেতে মনোবিশ্লেষকদের সামান্যও কষ্ট হয় নি। আমরা জানি যে বহু কাল ধরে টলেমীয় পদ্ধতি অনুসারে গ্রহগুলোর অবস্থান ব্যাখ্যা করা গেছে সহজেই, শুধু ব্যাখ্যা করার জন্যে যখন-তখন কোনো-না-কোনো সূক্ষ্ম জটিলতা যোগ করতে হয়েছে; এবং ইডিপাস গূঢ়ৈষার ওপর আরেকটি বিপ্রতীপ ইডিপাস গূঢ়ৈষা চাপিয়ে দিয়ে, সব উদ্বেগের মধ্যে কামনা আরোপ করে সে-সব তথ্যকে সমন্বিত করা হয়েছে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে, যেগুলো সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করে তঁার তত্ত্বের বৈধতার। সব মনোবিশ্লেষকই সুশৃঙ্খলভাবে প্রত্যাখ্যান করেন বাছাই-এর ধারণাটি এবং এর সাথে সম্পর্কিত মূল্যের ধারণাটি, এবং এখানেই নিহিত এসংশ্রয়ের সহজাত দুর্বলতা। অস্তিত্বশীলের স্বাধীন বাছাই থেকে বাধ্যবাধকতা ও নিষিদ্ধকরণকে বিচ্ছিন্ন করে ফ্রয়েড তাদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন। তিনি সেগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গণ্য করেন। তিনি মূল্যের ধারণাটির বিকল্পে চেষ্টা করেছেন কর্তৃত্বের ধারণাটি গ্রহণ করতে; তবে তিনি মোজেস অ্যান্ড মনোথিজম-এ স্বীকার করেছেন যে কর্তৃত্বের ব্যাপারটির কোনো ব্যাখ্যা তার নেই। অজাচার, উদাহরণস্বরূপ, নিষিদ্ধ, কেননা পিতা একে নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু তিনি কেননা একে নিষিদ্ধ করলেন? এটা এক রহস্য। সুপার ইগো আত্মস্থ করে নেয় এক স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচার থেকে উদ্ভূত বিধান ও নিষেধ, এবং সেখানে আছে প্রবৃত্তিগত প্রেষণাগুলো, কেননা আছে তা অবশ্য আমরা জানি না : এ-বাস্তবতা দুটি সম্পর্কহীন, কেননা নৈতিকতাকে মনে করা হয় কামের প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে। মানুষের ঐক্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ব্যক্তি থেকে সমাজে ঢোকার কোনো পথ নেই; তাদের মিলন ঘটানোর জন্যে ফ্রয়েড বাধ্য হয়েছিলেন কিছু অদ্ভুত গল্প বানাতে, যেমন বানিয়েছেন তিনি টোটেম ও ট্যাবুতে। অ্যাডলার স্পষ্ট দেখেছেন যে শুধু সামাজিক পরিস্থিতিতে খোজাগূঢ়ৈষা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; তিনি মূল্যায়নের সমস্যার মধ্যে খুঁজেছিলেন এর সমাধান, কিন্তু তিনি সমাজস্বীকৃত মূল্যবোধের উৎস খোঁজেন নি ব্যক্তির মাঝে, যার ফলে তিনি ভুল করেন কামের গুরুত্ব বিচারে।

জীবনে কাম নিশ্চিতভাবেই পালন করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; বলা যেতে পারে কাম থাকে জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পরিব্যাপ্ত করে। শারীরবিজ্ঞান থেকে আমরা জেনেছি যে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের সক্রিয়তা সাধারণতভাবে সমন্বিত হয় শরীরের সক্রিয়তার সাথে। মানুষ কামজ, মানুষ এক যৌন শরীর, এবং অন্যান্য মানুষ, যারা নিজেরাও যৌন শরীর, এর পরিণতিরূপে তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কে সব সময়ই জড়িয়ে থাকে কাম। কিন্তু শরীর ও কাম যদি হয় অস্তিত্বের মূর্ত প্রকাশ, তাহলে অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত করেই আবিষ্কার করা যেতে পারে এদের তাৎপর্য। এ-পরিপ্রেক্ষিতের অভাবে মনোবিশ্লেষণ অব্যাখ্যাত সত্যকে গ্রহণ করে স্বতঃসিদ্ধ বলে। উদাহরণস্বরূপ, বলা হয় যে পাছার কাপড় তুলে উবু হয়ে বসে প্রস্রাব করতে বালিকা লজ্জা পায়–কিন্তু কোথা থেকে আসে এ-লজ্জা? এবং পুরুষ তার শিশ্নের জন্যে গর্বিত কি না বা তার গর্ব শিশ্নে প্রকাশিত হয় কি না, এ প্রশ্ন করার আগে জেনে নেয়া দরকার যে গর্ব কী এবং কারো উচ্চাকাঙ্গ কীভাবে মূর্ত হতে পারে কোনো বস্তুতে। মনোবিশ্লেষকেরা মনে করেন মানুষ সম্বন্ধে প্রধান সত্য হচ্ছে তার নিজের শরীর এবং তার গোষ্ঠির সহবাসীদের শরীরের সাথে তার সম্পর্ক; কিন্তু যে-প্রাকৃতিক বিশ্ব তাকে ঘিরে আছে, তার বন্ধুরাশির প্রতি মানুষের রয়েছে এক আদিম ঔৎসুক্য এবং তাকে সে আবিষ্কার করতে চায় কাজে, খেলায়, এবং গতিময় কল্পনার সমস্ত অভিজ্ঞতায়। মানুষ বস্তুগতভাবে একাত্ম হতে চায় সম্পূর্ণ বিশ্বের সাথে, তাকে বুঝতে চায় সব দিকে। মাটি কেটে বাঁধ বাঁধা, গর্ত খোড়া প্রভৃতি আলিঙ্গন, সঙ্গমের মতোই মৌলিক কাজ; এবং তাঁরা প্রতারিত করেন নিজেদের যারা এগুলোতে যৌন প্রতীক ছাড়া আর কিছু দেখতে পান না। গর্ত, নরম পিচ্ছিল কাদা, গভীর ক্ষত, কাঠিন্য, শুদ্ধতা প্রভৃতি হচ্ছে প্রধান বাস্তবতা; এবং এগুলোর প্রতি মানুষের যে-আগ্রহ, তা লিবিডোর আদেশে ঘটে না। শুদ্ধতা নারীর কুমারীত্বের প্রতীক বলে পুরুষ শুদ্ধতার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে; বরং শুদ্ধতার প্রতি তার অনুরাগের ফলেই সে মূল্যবান মনে করে কুমারীত্বকে। কাজ, যুদ্ধ, খেলা, শিল্পকলা নির্দেশ করে বিশ্বের সাথে জড়িত হওয়ার উপায়, যাকে অন্য কিছুতে পর্যবসিত করা সম্ভব নয়; এগুলো প্রকাশ করে সে-সব গুণ, যেগুলো সংঘর্ষে আসে যৌনতার প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যের সাথে। যুগপৎ ওগুলোর আলোকে ও এসব যৌন অভিজ্ঞতার আলোকেই প্রতিটি ব্যক্তি প্রয়োগ করে তার বাছাই করার। ক্ষমতা। তবে শুধু অস্তিত্বের স্বরূপবিষয়ক একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ, সত্তাসম্পর্কিত একটি সাধারণ বোধ, আমাদের সাহায্য করে এ-বাছাইয়ের ঐক্য পুনরুদ্ধার করতে।

এ-বাছাইয়ের ধারণাটিকেই, বস্তুত, মনোবিশ্লেষণ প্রচণ্ডভাবে প্রত্যাখ্যান করে নিয়ন্ত্ৰণবাদ ও যৌথ অচৈতন্য-এর নামে; এবং ধারণা করা হয় যে এ-অচৈত্যনই মানুষকে সরবরাহ করে প্রাকগঠিত চিত্রকল্প ও একটা সর্বজনীন প্রতীক। এভাবেই এটা ব্যাখ্যা করে স্বপ্নের, উদ্দেশ্যহীন কার্যকলাপের, চিত্তবৈকল্যজাত স্বপ্নবিভাবের, রূপকের, এবং মানুষের নিয়তির পর্যবেক্ষিত সাদৃশ্যগুলো। শরীরসংস্থানই নিয়তি, বলেছেন ফ্রয়েড; আর এ-পদটিকেই প্রতিধ্বনিত করে মারলিউ-পোন্তির এ-পদটি :

শরীর হচ্ছে সাধারণত্ব।

প্রতীক স্বর্গ থেকে নেমে আসে নি আবার রসাতলের গভীরতা থেকেও উঠে আসে নি–একে, ভাষার মতোই, বিশদভাবে নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের সে-বাস্তবতা দ্বারা যা যুগপৎ মিটজাইন ও বিচ্ছিন্নতা; এবং এটাই ব্যাখ্যা করে কেননা ব্যক্তিক উদ্ভাবনেরও একটি স্থান আছে, যা মতবাদের কথা বিবেচনা না করে বাস্তবিকভাবে মেনে নিতে হয় মনোবিশ্লেষণকে। শিশ্নের ওপর যে-ব্যাপক মূল্য আরোপ করা হয়ছে, আমাদের পরিপ্রেক্ষিত সাহায্য করে সেটা বুঝতে। অস্তিত্বের একটি সত্য থেকে প্রস্থান না করে এটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব : সেটি হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার প্রতি বিষয়ীর প্রবণতা। তার স্বাধীনতা তার মধ্যে সঞ্চার করে যে-উদ্বেগ, তা তাকে পরিচালিত করে বস্তুর মধ্যে নিজেকে খুঁজে দেখতে, এটা নিজের থেকে এক ধরনের পলায়ন। এ-প্রবণতা এতো মৌলিক যে মারের দুধ ছাড়ার সাথেসাথেই, যখন সে পৃথক হয়ে যায় অখণ্ড থেকে, শিশু বাধ্য হয় নিজের বিচ্ছিন্ন সত্তাকে দর্পণে এবং পিতামাতার দৃষ্টিপাতের মধ্যে দেখতে। আদিম মানুষেরা বিচ্ছিন্নতা বোধ করে মানায়, টোটেমে; সভ্য মানুষেরা তাদের স্বতন্ত্র আত্মায়, তাদের অহংয়ে, তাদের নামে, তাদের সম্পত্তিতে, তাদের কাজে। শিশুর বেলা শিশ্ন নিজের অবিকল নকল হিশেবে কাজ করতে সমর্থ এটা তার কাছে একই সঙ্গে এক পৃথক জিনিশ ও সে নিজে; এটা একটি খেলনা, একটি পুতুল, এবং তার নিজের মাংস; আত্মীয়রা আর সেবিকারা এটির প্রতি এমন আচরণ করে যে মনে হয় এটি এক ছোট্ট মানুষ। তাই দেখা সহজ কীভাবে এটি শিশুর জন্যে হয়ে ওঠে একটি বিকল্প সত্তা সাধারণত বেশি চতুর, বেশি বুদ্ধিমান, এবং বেশি ধূর্ত (এলিস বালিঁ, লা ভি এঁতিম দ্য ল’আঁফাঁ: শিশুর অন্তরঙ্গ জীবন, প ১০১)। শিশ্নধারী শিশ্নকে একই সাথে গণ্য করে নিজেকে বলে এবং অন্য কেউ বলে, কেননা প্রস্রাব ও পরে শিশ্নের দাঁড়ানোর ব্যাপারগুলো স্বেচ্ছাকৃত ও অস্বেচ্ছাকৃত কর্মের মাঝামাঝি প্রক্রিয়া, এবং যেহেতু এটিকে মনে হয় চপল এবং আনন্দের এক বাহ্যিক উৎস বলে। ব্যক্তির বিশেষ সীমাতিক্ৰমণতা মূর্ত হয় শিশ্নে এবং এটা গর্বের এক উৎস। শিশ্নকে এভাবে পৃথক করে রেখে পুরুষ তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সাথে। সমন্বিত করতে পারে এটির থেকে উৎসারিত জীবনকে। এটা দেখা সহজ যে শিশ্নের দৈর্ঘ্য, প্রস্রাবের বেগ, দাঁড়ানোর ও বীর্যপাতের শক্তি শিশ্নধারীর কাছে হয়ে ওঠে তার নিজের মোগ্যতার মানদণ্ড।

এভাবে শিশের মধ্যে সীমাতিক্ৰমণতা মূর্ত হয়ে ওঠা একটি ধ্রুবক; এবং নিজের সীমাতিক্ৰমণতা অনুভব করার জন্যে শিশুর কাছেও এটা যেহেতু একটি ধ্রুবক–যার সীমাতিক্ৰমণতা খর্ব করে পিতা–তাই আমরা ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করি। খোজাগুঢ়ৈষা নামের ফ্রয়েডীয় ধারণাটিকে। কোনো বিকল্প সত্তা নেই বলে বালিকা কোনো বস্তুতে বোধ করে না বিচ্ছিন্নতা এবং সে তার সংহতি পুনরুদ্ধার করতে পারে

। এজন্যে সে তার সমস্ত সত্তাকে পরিণত করে একটি বস্তুতে, নিজেকেই প্রতিষ্ঠিত করে অপর রূপে। সে বালকের সাথে তুলনার যোগ্য কি অযোগ্য, তা সে জানুক বা না জানুক, সেটা গৌণ; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যদি সে তা নাও জানে, তবু শিশ্নের অভাব তাকে বাধা দেয় নিজেকে একটি যৌনসত্তা হিশেবে ভাবতে। এর পরিণাম অনেক। কিন্তু যেধ্রুবকগুলোর কথা আমি বলেছি, এজন্যে সেগুলো কোনো চিরস্থির নিয়তি প্রতিষ্ঠা করে না–শিশ্ন যে এতো মহিমা ধারণ করে, তার কারণ হচ্ছে এটি হয়ে ওঠে অন্যান্য। এলাকায় প্রয়োগ করা আধিপত্যের প্রতীক। নারী যদি নিজেকে কর্তা হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো, তাহলে সেও উদ্ভাবন করতো শিশ্নের সমতুল্য কিছু; আসলে, পুতুল, যা হচ্ছে ভবিষ্যতে যে শিশু আসবে, সে-প্রতিশ্রতির প্রতিমূর্তি, তাও হয়ে উঠতে পারে শিশ্নের থেকে বেশি মূল্যবান সম্পদ। সত্য হচ্ছে শুধু মোট পরিস্থিতির ফলেই একটি দেহগত সুবিধার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সত্যিকার মানবিক সুবিধা। মনোবিশ্লেষণ তার সত্যগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে পারে শুধু ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে।

সে একটি নারী, একথা বলে নারীকে যতোটা সংজ্ঞায়িত করা যায়, তার থেকে নিজের নারীত্ব সম্পর্কে নারীর চেতনা দিয়ে নারীকে বেশি সন্তোষজনকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, কেননা সে এ-চেতনা অর্জন করে নিজের সমাজের পরিস্থিতি থেকে, যে-সমাজের সে একজন সদস্য। অবচেতনা ও সম্পূর্ণ মনোজীবনকে আত্মস্থ করে মনোবিশ্লেষণের বিশেষ ভাষাই নির্দেশ করে যে ব্যক্তির নাটকটি উনন্মাচিত হয় তারই ভেতরে–গূঢ়ৈষা, প্রবণতা প্রভৃতি শব্দ এ-ই জ্ঞাপন করে। কিন্তু জীবন হচ্ছে বিশ্বের সাথে একটি সম্পর্ক, এবং প্রতিটি ব্যক্তি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে চারপাশের বিশ্বে নিজের বাছবিচার দিয়ে। আমরা যে-সব প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত, সেগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্যে তাই আমাদের তাকাতে হবে বিশ্বের দিকে। মনোবিশ্লেষণ বিশেষভাবে ব্যর্থ নারী কেনো অপর, তা ব্যাখ্যা করতে। কেননা ফ্রয়েড নিজেই স্বীকার করেছেন যে। শিশ্নের মর্যাদা ব্যাখ্যা করা হয় পিতার সার্বভৌমত্ব দিয়ে, এবং, আমরা দেখেছি, তিনি স্বীকার করেছেন পুংলিঙ্গের আধিপত্যের উদ্ভব সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ।

সুতরাং আমরা মনোবিশ্লেষণপদ্ধতিকে মেনে নিতে অস্বীকার করি, তবে এবিজ্ঞানের সব অবদান আমরা অস্বীকার করি না, বা অস্বীকার করি না এর কিছু অন্তদৃষ্টির উর্বরতাকে। প্রথমে, কামকে বিদ্যমান কিছু বলে গণ্য করে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ করতে চাই না। এ-দৃষ্টিভঙ্গির দারিদ্র্য ধরা পড়ে নারীলিবিডো বর্ণনায়; আমি আগেই বলেছি মনোবিশ্লেষকেরা একে কখনো সরাসরি বিচার করেন নি, শুধু পুরুষ লিবিডো থেকে একটু সরে এসে বর্ণনা করেছেন একে। অক্রিয় লিবিডোর ধারণাটি বিভ্রান্তিকর, কেননা পুরুষ ভিত্তি করে লিবিডোর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে একটি প্রেষণা, একটি শক্তি হিশেবে। আমরা বাস্তবতাকে আরো বেশি করে ধারণ করতে পারবো যদি লিবিডোকে শক্তির মতো অস্বচ্ছ শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত না করে কামের তাৎপর্যকে সম্পর্কিত করি মানুষের অন্যান্য প্রবণতা–নেয়া, ধরা, খাওয়া, তৈরি করা, আনুগত্য স্বীকার করা প্রভৃতির সাথে। কামসামগ্রিগুলোর গুণাবলি শুধু সঙ্গমের সময় নয়, সাধারণভাবেও বিচার করা আমাদের দায়িত্ব। এমন অনুসন্ধান ছাড়িয়ে যাবে মনোবিশ্লেষণের কাঠামো, যার বিবেচনায় কাম অপর্যসেয়।

উপরন্তু, নারীনিয়তির সমস্যাটি আমি তুলবো সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে : আমি নারীকে স্থাপন করবো এক মূল্যবোধের বিশ্বে, এবং তার আচরণকে দেবো এক স্বাধীনতার মাত্রা। আমি বিশ্বাস করি নিজের সীমাতিক্ৰমণতা জ্ঞাপন ও বস্তু হিশেবে তার বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে কোনটিকে নিতে হবে, তা বাছাই করার শক্তি তার আছে; সে পরম্পবিরোধী উদ্যমের খেলার পুতুল নয়; সে নৈতিক মানদণ্ডে সমাধান করে বিচিত্র মূলবোধের সমস্যা। মূল্যবোধের বদলে আধিপত্যকে বাছাইয়ের বদলে উদ্যমকে গ্রহণ করে মনোবিশ্লেষণ উপহার দিয়েছে এক এরসাট্‌জ্‌–নৈতিকতার এক বিকল্পস্বাভাবিকতার ধারণা। এ-ধারণা বিশেষ কার্যকর চিকিৎসাবিদ্যায়, কিন্তু মনোবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এক উদ্বেগজাগানো মাত্রায় এটি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বর্ণনামূলক ছককে প্রস্তাব করা হচ্ছে সূত্ররূপে; এবং এটা সুনিশ্চিত যে একটি যান্ত্রিকতাবাদী মনোবিজ্ঞান স্বীকার করে নিতে পারে না নৈতিক উদ্ভাবনের ধারণাকে; কড়াকড়ির মধ্যে এটা বিবরণ দিতে পারে শুধু কম-এর এবং কখনোই বিবরণ দিতে পারে না বেশির; কড়াকড়ির মধ্যে এটা স্বীকার করতে পারে শুধু নিয়ন্ত্রণকে, কখনোই স্বীকার করে নিতে পারে না সৃষ্টিকে। যদি কোনো বিষয়ী তার সমগ্রতার মধ্যে সে-বিকাশ দেখাতে না পারে, যাকে গণধকার স্বাভাবিক বলে, তাহলে বলা হবে যে তার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেছে, এবং এ-রুদ্ধতাকে ব্যাখ্যা করা হবে একটি ন্যূনতারূপে, একটি নেতিরূপে, কখনোই একে ইতিবাচক সিদ্ধান্তরূপে ব্যাখ্যা করা হবে না। এটাই, আরো বহু কিছুর সঙ্গে, মহাপুরুষদের মনোবিশ্লেষণকে করে তোলে মর্মান্তিক : আমাদের বলা হয় যে এই-এই সংক্রম, এই-ওই উগতি তাঁদের মধ্যে সংঘটিত হয় নি; জ্ঞাপন করা হয় না যে হয়তো নিজেদের জন্যে যথাযথ কারণবশত তাঁরা এ-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে রাজি হন নি। তাই মনোবিশ্লেষকেরা কখনোই একটি অসত্য চিত্রের বেশি কিছু দেন না; এবং অসত্যের জন্যে স্বাভাবিকতা ছাড়া আর কোনো মানদণ্ড পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। নারীনিয়তি সম্পর্কে তাদের বিবৃতি এর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। মনোবিশ্লেষকেরা যে-অর্থে বুঝে থাকেন পরিভাষাটি, এক কাঠামোতে মাতা বা পিতার সাথে নিজেকে অভিন্ন বোধ করা হচ্ছে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা, এটা হচ্ছে কারো নিজের অস্তিত্বের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশের থেকে বাইরের কোনো মূর্তিকে বেশি পছন্দ করা, এটা হচ্ছে সত্তা সত্তা খেলা। আমাদের কাছে নারীদের দেখানো হয় দু-ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ দ্বারা প্ররোচিতরূপে। স্পষ্টত পুরুষ পুরুষ খেলা নারীর জন্যে হবে এক হতাশার উৎস; তবে নারী নারী খেলাও এক মতিবিভ্রম : নারী হওয়ার অর্থ বস্তু হওয়া, অপর হওয়া–এ-সত্ত্বেও তার হালছাড়া ভাবের মধ্যেও অপর থেকে যায় কর্তা।

নারীর জন্যে সত্যিকার সমস্যা হচ্ছে বাস্তবতা থেকে এসব পলায়নকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সীমাতিক্ৰমণতার মধ্যে আত্মসিদ্ধি খোজা। তাই যা করতে হবে, তা হচ্ছে দেখতে হবে যাকে বলা হয় পুরুষসুলভ ও মেয়েলি প্রবণতা, তার ভেতর দিয়ে তার জন্যে খোলা আছে কী কী পথ। এমনকি অ্যাডলারও মনে করেন ক্ষমতা লাভের ঈপ্সা একটা উদ্ভট ধরনের শক্তি; সীমাতিক্ৰমণতার সবগুলো পরিকল্পনাকে তিনি বলেন। পুরুষসুলভ প্রতিবাদ। যখন কোনো বালিকা গাছে চড়ে, অ্যাডলারের মতে সে দেখাতে চায় যে সে বালকদের সমকক্ষ; এটা তার মনে পড়ে না যে বালিকাটি গাছে চড়তে পছন্দ করে। মায়ের কাছে তার শিশু শিশ্নের সমতুল্য কিছুর থেকে ভিন্ন। জিনিশ। ছবি আঁকা, লেখা, রাজনীতি করা–এগুলো হচ্ছে নিতান্তই উদাতি; আমরা মনে করি এসব কাজ করা হয় এসব কাজ করার জন্যেই। এটা অস্বীকার করা হচ্ছে। মানবিক সব ইতিহাসের অসত্যীকরণ।।

পাঠক এ-বিবরণ ও মনোবিশ্লেষকদের বিবরণের মধ্যে এক ধরনের সমান্তরলতা লক্ষ্য করবেন। সত্য হচ্ছে যে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে–পুরুষ ও নারী মনোবিশ্লেষকেরা উভয় শ্ৰেণীই যা গ্রহণ করেছেন–বিচ্ছিন্নতার সাথে সংশ্লিষ্ট আচরণকে গণ্য করা হয় নারীধর্মী বলে, আর বিষয়ী যে-আচরণের সাহায্যে জ্ঞাপন করে তার সীমাতিক্ৰমণতা, তাকে গণ্য করা হয় পুরুষধর্মী বলে। ডোনাল্ডসন, নারীর এক ঐতিহাসিক, মন্তব্য করেছেন যে : পুরুষ  হচ্ছে একজন পুংলিঙ্গ মানুষ, নারী হচ্ছে একজন স্ত্রীলিঙ্গ মানুষ, এ-সংজ্ঞাগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে বিষমরূপে; এবং বিশেষভাবে মনোবিশ্লেষকদের মধ্যেই পুরুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় একজন মানুষ হিশেবে এবং নারীকে স্ত্রীলিঙ্গ হিশেবে–যখনই সে মানুষরূপে আচরণ করে তখনই বলা হয় যে সে পুরুষের অনুকরণ করছে। আমাদের কাছে নারী হচ্ছে এমন একজন মানুষ, যে মূল্যবোধের বিশ্বে খুঁজছে মূল্যবোধ, এবং এ-বিশ্বটির আর্থ ও সামাজিক সংগঠন জানা অত্যাবশ্যক। আমরা নারীর সমগ্র পরিস্থিতির ওপর যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে নারীকে বিচার করবো অস্তিত্ববাদী পরিপ্রেক্ষিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *