০১. একটি নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে

একটি নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বজ্ঞ কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমি যে বিশ্বাস করি না, তার কারণ কি আমার আত্মম্ভরিতা? আমি কখনও কল্পনা করিনি যে আমাকে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে আমার মনে হচ্ছে যে আমার বন্ধুদের কয়েকজন (তাঁদের বন্ধু বলে ভেবে যদি না আমি অনেক বেশি দাবি করে থাকি) আমার সঙ্গে তাঁদের স্বল্প পরিচিতির ফলে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা আমার দিক থেকে খুবই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এবং কিছুটা আত্মম্ভরিতাই আমার এ অবিশ্বাসের হেতু! এমন অহংকার আমার নেই যে আমি এই সমস্ত মানবিক বৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে। আমি একজন মানুষ এবং তার চেয়ে বেশি কিছু নই। এর অধিক দাবি কেউ করতেও পারেন না। আমার কমরেডদের মধ্যে আমাকে একজন স্বেচ্ছাচারী বলা হতো। এমন কি আমার বন্ধু বি কে দত্তও কখনও কখনও আমাকে এই সব বলেন। কোনো কোনো সময় স্বেচ্ছাচারী বলে আমাকে ধিক্কারও দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বন্ধু খুব গুরুত্বের সঙ্গেই অভিযোগ করেন যে আমি, নাকি আমার মতামত ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের উপর চাপিয়ে দিই এবং আমার প্রস্তাব পাশ করিয়ে নিই। এ যে কিছুটা পরিমাণে সত্য তা আমি অস্বীকার করি না। এ আত্মশ্লাঘা হতে পারে। অন্যান্য জনপ্রিয় মতাদর্শের পাশাপাশি আমার মধ্যে এবং আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও আত্মম্ভরিতা আছে, কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত কিছু নয়। হয়তো আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে এ আমার ন্যায়সঙ্গত গর্ব, দম্ভ নয়। কারও মধ্যে অহেতুক গর্বের আতিশয্যই হলো দম্ভ অথবা সঠিকভাবে বলতে গেলে অহংকার। এই রকমই কোনো অহেতুক গর্ব আমাকে নাস্তিকতার দিকে টেনে এনেছে না কি এ-বিষয়ে সযত্ন অধ্যয়নের ফলে এবং যথেষ্ট বিবেচনার পরই আমি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি, সে কথাই আমি এখানে আলোচনা করতে চাই। প্রথমেই আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই যে আত্মশ্লাঘা এবং দত্ত দুটি আলাদা জিনিস।

প্রথমত, আমি একেবারেই বুঝতে পারি না যে কি করে অহেতুক গর্ব বা আত্মশ্লাঘাবোধ কোনো মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের অন্তরায় হতে পারে। বিখ্যাত হওয়ার উপযুক্ত না হয়েও বা প্রয়োজনীয় গুণাবলীর অধিকারী না হয়েও কিছুটা খ্যাতি যদি আমি অর্জন করে ফেলি তাহলে প্রকৃতই মহৎ এমন কোনো ব্যক্তির মহত্ত্বকে আমি অস্বীকার করতে পারি। এটুকু বোঝা যায়। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দম্ভের জন্য কিভাবে একজন ঈশ্বর-বিশ্বাসী অবিশ্বাসীতে, পরিণত হতে পারে? কেবলমাত্র দুটি উপায় আছে। সেই ব্যক্তিকে নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবতে হবে, নয়ত তাকে নিজেকেই ঈশ্বর বলে ভাবতে হবে। কিন্তু এর কোনোভাবেই সে যথার্থ নাস্তিক হতে পারছে না। প্রথম ক্ষেত্রে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্বই অস্বীকার করছে না। দ্বিতীয়। ক্ষেত্রেও সে প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়ন্ত্রণকারীরূপে পর্দার আড়ালে কোনো সচেতন সত্তার উপস্থিতিকে স্বীকার করছে। সে নিজেকেই ওই পরম সত্তা মনে করে কিনা কিংবা পরম সত্তাকে তার থেকে স্বতন্ত্র কোনো কিছু ভাবে কিনা আমাদের কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই। মূল কথাটা ঐখানে। তার বিশ্বাসও ঐখানেই। কোনো মতেই সে নাস্তিক নয়। তাহলে, প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কোনো দলেই আমি পড়ি না। ঐ সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্বকেই আমি অস্বীকার করি। কেন করি সে আলোচনা পরে করা যাবে। এখানে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই, তা হলো আমার দম্ভ আমাকে নাস্তিকতার তত্ত্ব গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছে এটা ঠিক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী অবতার বা স্বয়ং সেই পরম সত্তা ইত্যাদি কোনো কিছুই আমি নই। একটা বিষয় তাহলে স্থির হয়ে গেছে যে এমন একটা চিন্তাধারায় পৌঁছানোর কারণ আমার দম্ভ নয়। এই অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য ঘটনাগুলোর বিচার করা যাক। আমার এই বন্ধু-বান্ধবদের মতে আমার অসার আত্মশ্লাঘার কারণ সম্ভবত দিল্লির বোমা মামলা এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে আমার অহেতুক জনপ্রিয়তা অর্জন। বেশ তাহলে তাদের যুক্তি সঠিক কিনা দেখা যাক। আমার নাস্তিকতার জন্ম খুব সাম্প্রতিককালে নয়। আমি যখন আমার ঈশ্বর বিশ্বাস পরিত্যাগ করি তখন আমি একজন অজ্ঞাত নবীন যুবক যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার এই বন্ধুরা এমনকি সচেতনও ছিলেন না। একজন কলেজ ছাত্র কি এমন অহেতুক কোনো দম্ভ পোষণ করতে পারে না যা তাকে নাস্তিকতার পথে ঠেলে দিতে পারে। যদিও আমি কিছু অধ্যাপকের প্রিয় ছিলাম, কয়েকজনের অপ্রিয় ছিলাম, ছাত্র হিসেবে কিন্তু কখনই পরিশ্রমী বা মনোযোগী ছিলাম না। দম্ভের মতো কোনো অনুভূতি পোষণ করার সুযোগই আমি পাইনি। বরং বলা যায় আমি ছিলাম বেশ লাজুক স্বভাবের ছেলে, ভবিষ্যৎ জীবনধারা সম্পর্কে যার মনোভাব ছিল নৈরাশ্যজনক। ঐ সময়ে আমি পরিপূর্ণ নাস্তিক ছিলাম না। আমার ঠাকুর্দা, যার প্রভাবে আমি লালিত পালিত, তিনিই ছিলেন একজন গোঁড়া আর্য সমাজী। একজন আর্য সমাজী আর যাই হোক নাস্তিক নন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আমি লাহোরের ডি এ ভি স্কুলে ভর্তি হই এবং পুরো এক বছর ওখানকার ছাত্রাবাসে ছিলাম। সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনা ছাড়াও আমি ঘন্টার পর ঘন্টা গায়ত্রী জপ করতাম। ঐ সময় আমি পুরো ভক্ত ছিলাম। পরবর্তীকালে আমি আমার বাবার সঙ্গে বাস করতে আরম্ভ করি। ধর্মীয় গোঁড়ামি সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদারচেতা। স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করার জন্য আমার যে ইচ্ছা জাগে তা তাঁরই শিক্ষার ফলশ্রুতি। কিন্তু তিনি নাস্তিক নন। তিনি একজন দৃঢ় আস্তিক, প্রত্যহ পূজার্চনা করতে তিনি আমাকে উৎসাহিত করতেন। সুতরাং, আমি এভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম। অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমি ন্যাশনাল কলেজে যোগদান করি। সেখানেই আমি চিন্তার ক্ষেত্রে উদার হতে থাকি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যা, এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা সমালোচনা করতে থাকি। কিন্তু তখনও আমি ঘোরতর আস্তিক। ঐ সময় আমি আ-ছাঁটা অবিন্যস্ত লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদে আমি কখনও আস্থা রাখতে পারিনি। তবুও, ঈশ্বরের অস্তিত্বে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

পরবর্তীকালে আমি বিপ্লবী দলে যোগদান করি। প্রথমে আমি যে নেতার সংস্পর্শে আসি তিনি দৃঢ় ঈশ্বর-বিশ্বাসী না হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে সাহস পাননি। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার বারংবার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেন, যখন তোমার ইচ্ছা হয়, প্রার্থনা কর। এ-হলো নাস্তিকতাবাদের তত্ত্ব গ্রহণ করতে যে সাহসের প্রয়োজন, তা ছাড়াই নাস্তিক হওয়া। দ্বিতীয় যে নেতার সংস্পর্শে আমি আসি, তিনি ছিলেন পরম ঈশ্বর-বিশ্বাসী, নামটা বলি–শ্রদ্ধেয় কমরেড শচীন্দ্রলাল সান্যাল, যিনি এখন করাচী ষড়যন্ত্র মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর বিখ্যাত ও একমাত্র বই বন্দী জীবন-এর একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই প্রচণ্ডভাবে ঈশ্বরের মহিমা গীত হয়েছে। ঐ চমৎকার বইটির দ্বিতীয় অংশের শেষ পৃষ্ঠায় বেদান্তবাদজনিত চিন্তা থেকে ঈশ্বরের প্রতি যে অতীন্দ্রিয় প্রশংসাবাণী বর্ষিত হয়েছে তা তাঁর চিন্তার একটি বিশিষ্ট অংশ। ১৯২৫ সালের ২৮শে জানুয়ারি সমগ্র ভারতবর্ষে যে বিপ্লবী প্রচারপত্র বিতরণ করা হয় মামলার বাদীপক্ষের বক্তব্য অনুসারে তা তাঁরই চিন্তার ফসল। গোপন কাজকর্মে যা অবশ্যম্ভাবী বিশিষ্ট কোনো নেতা নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করেন যা তাঁর নিজের কাছে খুবই প্রিয় এবং মতের ভিন্নতা থাকলেও অন্য কর্মীদের তাতে মৌন সম্মতি দিতে হয়। ঐ প্রচারযন্ত্রের পুরো একটা প্যারাগ্রাফ সর্বশক্তিমান এবং তাঁর লীলা ও কর্মের প্রশংসায় মুখরিত। এ সবই অতীন্দ্রিয়বাদ, আমি যা দেখাতে চাইছি তা হলো নাস্তিকতার ধারণা বিপ্লবী দলে অঙ্কুরিতই হয়নি। বিখ্যাত কাকোরি শহীদদের সকলেই তাদের শেষ দিনগুলো প্রার্থনা করে কাটিয়েছেন। রামপ্রসাদ বিসমিল ছিলেন একজন গোঁড়া আর্যসমাজী। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা থাকা সত্ত্বেও রাজেন লাহিড়ী উপনিষদ ও গীতার শ্লোক আবৃত্তি করার স্পৃহা চেপে রাখতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনকেই আমি জানি যিনি কখনও প্রার্থনা করেননি। তিনি বলতেন, দর্শন হলো মানুষের দুর্বলতা এবং জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফল। তিনি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বাসের শাস্তি ভোগ করছেন। কিন্তু তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মতো সাহস দেখাননি।

ঐ সময় পর্যন্ত আমি ছিলাম শুধুই একজন কল্পনাপ্রবণ ভাববাদী বিপ্লবী বিশেষ। তখনও পর্যন্ত আমরা কেবল অনুসরণই করতাম। তারপর এলো সমস্ত দায়িত্ব বহন করার সময়। অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ার ফলে কিছুদিনের জন্য দলের অস্তিত্ব রক্ষাই অসম্ভব হয়ে উঠল। শুধু নেতারা নন অতি উৎসাহী কমরেডরাও আমাদের প্রতি বিদ্রুপ বাক্য বর্ষণ শুরু করলেন। কিছুদিনের জন্য আমি ভীত হয়ে পড়লাম যে কোনোদিন হয়তো আমিই আমাদের কর্মসূচীর অসারতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ব। ঐ সময়টা আমার বিপ্লবী জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ। অধ্যয়নের ডাক আমার মনের আনাচে-কানাচে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। প্রতিপক্ষের যুক্তিগুলি খণ্ডন করার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হলে অধ্যয়ন করো। তোমার বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দ্বারা নিজেকে তৈরি করার জন্য অধ্যয়ন করো। আমি পড়তে আরম্ভ করলাম। আমার পূর্বতন বিশ্বাস ও প্রত্যয়সমূহের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল। সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে ফাঁকা কল্পনা যা আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে প্রধান ছিল, গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শ তাকে স্থানচ্যুত করল। আর অতীন্দ্রিয়বাদ নয়, অন্ধ বিশ্বাসও নয়। বাস্তববাদ (realism) আমাদের আদর্শ হয়ে দাঁড়াল। ভয়ঙ্কর রকম প্রয়োজনের সময়ই শক্তি প্রয়োগ সমর্থনযোগ্য। নীতি হিসাবে সমস্ত রকমের গণ-আন্দোলনের অহিংসা অপরিহার্য, পদ্ধতি সম্পর্কে এ পর্যন্তই। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা যার জন্য সংগ্রাম করছি সেই আদর্শ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। কাজকর্মের ক্ষেত্রে যেহেতু তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, বিশ্ব বিপ্লবের বিভিন্ন আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করার বিস্তর সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিন, সাম্যবাদের জনক মার্কসের কিছু এবং লেনিন ও ট্রটস্কি এবং অন্যান্যদের অনেক লেখা পড়লাম যাঁরা তাঁদের দেশে সাফল্যের সঙ্গে বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। এরা সকলেই ছিলেন নাস্তিক। বাকুনিনের ঈশ্বর ও রাষ্ট্র টুকরো টুকরো হলেও ঐ বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা, আরও পরে নিরালম্ব স্বামী কর্তৃক লিখিত সাধারণ জ্ঞান নামক একখানা পুস্তক পেলাম, এ ছিল একরকম অতীন্দ্রিয় নাস্তিকতাবাদ, আমার নিকট বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন এমন সর্বশক্তিমান পরম সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কিত তত্ত্বের অসারতায় আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল ১৯২৬ সালের শেষাশেষি, আমার অবিশ্বাস আমি প্রকাশ করলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করলাম এবং আমি একজন সুস্পষ্ট নাস্তিক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাতে অবস্থাটা কিরকম দাঁড়াল তা আমি আলোচনা করছি।

১৯২৭ সালের মে মাসে আমি লাহোরে গ্রেপ্তার হলাম। গ্রেপ্তারটা ছিল আকস্মিক, পুলিস যে আমায় খুঁজছে তা আমি একেবারেই জানতাম না। আমি যাচ্ছিলাম একটা বাগানের মধ্য দিয়ে, হঠাৎ দেখি পুলিস আমায় ঘিরে ফেলেছে, খুব অবাক লাগে ঐ সময় আমি খুব শান্ত ছিলাম। কোনোরকম অনুভূতি বা উত্তেজনাও আমার হচ্ছিল না। আমাকে পুলিস হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হলো। পরদিন আমাকে পাঠানো হলো রেলওয়ে পুলিশের হেফাজতে। সেখানে আমাকে পুরো একমাস কাটাতে হয়। পুলিস অফিসারদের সঙ্গে অনেকদিনের আলাপ-আলোচনায় আমি বুঝতে পারলাম যে কাকোরি পার্টির সঙ্গে আমার যোগাযোগ সম্পর্কে ও বিপ্লবী আন্দোলনে আমার অন্যান্য কার্যকলাপ সম্পর্কে তাদের নিকট কিছু তথ্য আছে। তারা বললেন যে, লক্ষ্ণৌতে যখন বিচার চলছিল তখন আমি সেখানে ছিলাম, বন্দীদের মুক্তি সম্পর্কে আমি কয়েকটি পরিকল্পনা এঁটেছিলাম, তাদের সমর্থন পাওয়ার পরই আমরা কিছু বোমা সংগ্রহ করেছিলাম এবং পরীক্ষামূলকভাবে সেগুলির একটি ১৯২৬ সালে দশহরা উৎসবের ভিড়ের মধ্যে আমরা ঘুড়েছি। আমার স্বার্থে তারা আমায় আরও বলছেন যে বিপ্লবী দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোকপাত করে যদি আমি কোন বিবৃতি দিই তাহলে আমায় বন্দী তো করা হবেই না, বরং ছেড়ে দেওয়া হবে এবং রাজসাক্ষীরূপে কোর্টে না দাঁড় করিয়ে আমায় পুরস্কৃত করা হবে। এ প্রস্তাব আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, এ সমস্তই ছিল বাগাড়ম্বর। আমাদের মতো আদর্শ যারা পোষণ করেন তারা কখনই নিজেদের নির্দোষ দেশবাসীর উপর বোমা ছুঁড়তে পারেন না। একদিন সকালে তখনকার সি আই ডি-র সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট মি: নিউম্যান এলেন। অনেক সহানুভূতিসূচক কথাবার্তার পর তিনি খুব দুঃখজনক খবরটি দিলেন যে, তাঁরা যেমন চাইছেন তেমন কোনো বিবৃতি যদি আমি না দিই তাহলে কাকোরি মামলায় যুদ্ধ বাধানোর যড়যন্ত্রে ও দশহরার দিন বোমা ছুঁড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত থাকার জন্য আমাকে বিচারের জন্য পাঠাতে তারা বাধ্য হবেন। তিনি আমায় আরও জানালেন যে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার ও ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ তাঁর হাতে আছে। ঐ সময় আমি বিশ্বাস করতাম যে আমি নির্দোষ হলেও পুলিস আমাকে ফাঁসি দিতে পারত। ঐদিনই কয়েকজন পুলিস অফিসার দুবেলাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য আমায় প্ররোচিত করতে লাগলেন, তখন আমি একজন নাস্তিক। আমি চাইছিলাম নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। শুধু কি শান্তি ও আনন্দের সময়ই আমি নিজেকে নাস্তিক বলে জাহির করার ক্ষমতা রাখি, না কি এই রকম দুঃসময়েও আমি আমার আদর্শে অবিচল থাকতে পারব। অনেক বিবেচনার পর আমি ঠিক করলাম যে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে ও প্রার্থনা করতে আমি পারব না। আমি কখনও করিনি। এটাই ছিল আসল পরীক্ষা এবং তাতে আমি উত্তীর্ণ হলাম। মুহূর্তের জন্য অন্য কিছুর পরিবর্তে নিজের গর্দান বাঁচানোর ইচ্ছা আমি পোষণ করিনি। সুতরাং আমি ছিলাম একজন একনিষ্ঠ নাস্তিক এবং তারপর থেকে তা-ই রয়ে গেছি। ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশ্বাস কষ্টকে লঘু করে দেয়, এমন কি কখনও কখনও তাকে আনন্দদায়কও করে তুলতে পারে। ভগবানের মধ্যে মানুষ জোরালো সান্ত্বনা ও সমর্থন পেতে পারে। তাকে ছাড়লে মানুষকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে হয়। ঝড়-ঝঞার মাঝে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ানো ছেলেখেলা নয়। যদি কোনো দম্ভ থাকে, ঐ রকম পরীক্ষার মুহূর্তে তা উবে যায় ও প্রচলিত বিশ্বাসকে অবহেলা করতে মানুষ সাহস পায়। যদি তা করে তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে শুধু দম্ভ ছাড়াও অন্য কোনো না কোনো শক্তি তার আছে। এখন হচ্ছে ঠিক সেই অবস্থা। রায় সকলেরই জানা, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তা ঘোষিত হবে। একটা আদর্শের জন্যই যে আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি এছাড়া আমার আর কি সান্ত্বনা থাকতে পারে? ঈশ্বর-বিশ্বাসী একজন হিন্দু রাজা হিসাবে পুনর্জন্মের আশা করতে পারেন। একজন মুসলমান অথবা খ্রীষ্টান স্বর্গের বিলাসিতা উপভোগ করার ও দুঃখ-কষ্ট ত্যাগের জন্য পুরস্কৃত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু আমি কি প্রত্যাশা করতে পারি? আমি জানি যে-মুহূর্তে আমার গলায় দড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে এবং আমার পায়ের তলা থেকে আড়কাঠ সরিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই হবে চরম মুহূর্ত এবং শেষ মুহূর্ত। আমি বা অধিবিদ্যার ভাষ্য অনুযায়ী আমার আত্মা, সব সেইখানেই শেষ হয়ে যাবে। আর কিছুই থাকবে না। মহৎ কোনো পরিণতিহীন স্বল্পকালীন সংগ্রামশীল একটি জীবনই হবে আমার পুরস্কার–যদি আমি সেভাবে তা গ্রহণ করার সাহস রাখি। এই হলো সার কথা। ইহজগতে কিংবা পরজগতে পুরস্কৃত হওয়ার স্বার্থের ইচ্ছা বা কামনা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন সমর্পণ করেছি কারণ আমি অন্য কিছু করতে পারতাম না। যেদিন আমরা বহুসংখ্যক নারী ও পুরুষ পাবো যাদের মনোবৃত্তি হচ্ছে এইরকম যে তারা মানুষের সেবা ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে না সেদিনই শুরু হবে মুক্তির দিন। তারা যে উৎপীড়ক, শোষক ও অত্যাচারীদের মোকাবিলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ হবে তা রাজা হওয়ার জন্য কিংবা ইহজন্মে বা পরজন্মে মৃত্যুর পর স্বর্গে পুরস্কৃত হওয়ার জন্য নয় বরং মানবজাতির স্কন্ধ থেকে দাসত্বের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলার জন্য ও স্বাধীনতা এবং শান্তির জন্য তারা এ পথ অবলম্বন করবে–তাদের ব্যক্তিসত্তার জন্য যে পথ বিপজ্জনক, তাদের মহান আত্মার কাছে যা একমাত্র গৌরবজনক ও কল্পনীয় পথ। এ মহৎ কাজের জন্য তাদের যে গর্ব তা কি আত্মম্ভরিতা বলে ভুলভাবে ব্যাখ্যাত হবে? এমন একটা জঘন্য বিশেষণ উচ্চারণ করতে সাহস পাবে কে? তাকে আমি বলি হয় সে নির্বোধ, না হলে প্রতারক। তাকে আমরা ক্ষমা করতে পারি। কারণ যে উচ্ছ্বাস, আবেগ, গভীরতা এবং মহান অনুভূতি হৃদয়ে টগবগ করছে তা বুঝতে সে অক্ষম। তার হৃদয় কেবলই প্রাণহীন এক মাংসপিণ্ড, তার দৃষ্টি দুর্বল, অন্য স্বার্থের কুফল তাদের ওপর বিস্তৃত। আত্মনির্ভরতা সব সময়েই দম্ভ বলে ব্যাখ্যাত হতে পারে, ব্যাপারটা দুঃখজনক, কিন্তু কোন উপায় নেই।

প্রচলিত বিশ্বাসের বিরোধিতা করুন। কোনো নায়কের, কোনো মহান ব্যক্তির, যাকে সাধারণত সমালোচনার উর্ধ্বে বলে ধরা হয়, কারণ মনে করা হয় তিনি অভ্রান্ত –তাঁর সমালোচনা করুন, আপনার যুক্তি-তর্কের শক্তি সাধারণ মানুষকে বাধ্য করবে আপনাকে অসার আত্মম্ভরী বলে নিন্দা করতে। সমালোচনা ও স্বাধীন চিন্তা একজন বিপ্লবীর পক্ষে দুটি অত্যাবশ্যকীয় গুণ। যেহেতু মহাত্মাজী মহান, সেহেতু কারও উচিত নয় তাঁর সমালোচনা করা। যেহেতু তিনি উর্ধ্বে উঠেছেন, সেজন্য রাজনীতি বা ধর্ম, অর্থনীতি বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে যা কিছু তিনি বলেন সবই ঠিক। আপনি বিশ্বাস করুন বা করুন আপনাকে বলতেই হবে, তাঁ, এটাই ঠিক। এ মানসিকতা প্রগতির পথে নিয়ে যায় না। বরং এ স্পষ্টতই প্রতিক্রিয়াশীল।

যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষরা এক পরম সত্তার, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে, বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, সে জন্য যে-ব্যক্তি ঐ বিশ্বাসের যথার্থ কিংবা সেই সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলতে সাহস করেন, তাকে স্বধর্ম ত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক বলতেই হবে। যদি তার যুক্তিতর্কগুলি এমন জোরালোও হয় যে পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাকে খণ্ডন করা যাচ্ছে না এবং তার সাহসও যদি এমন প্রচণ্ড হয় যে: সর্বশক্তিমানের ক্রোধের ফলে তার দুর্দশা হবে এ ভয় দেখিয়েও তাকে অবদমিত করা যাচ্ছে না তখন তাকে আত্মম্ভরী বলে নিন্দা করা হবে, তার চেতনাকে দম্ভ বলে খাটো করা হবে। তাহলে এ বৃথা আললাচনায় সময় নষ্ট করা কেন? কেন সমগ্র ব্যাপারটাকে যুক্তিতর্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা? এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রথম আসছে এবং এই প্রথম বাস্তব পথে এর মীমাংসার চেষ্টা হচ্ছে–সে জন্যই এ দীর্ঘ আলোচনা।

প্রথম প্রশ্ন সম্পর্কে মনে হয় আমি পরিষ্কার করতে পেরেছি যে দম্ভ আমায় নাস্তিকতার দিকে পরিচালিত করেনি। আমার যুক্তিতর্ক বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কিনা তা আমার বিচার্য নয়–সে বিচার করবেন পাঠকবর্গ। আমি জানি ঈশ্বরে বিশ্বাস বর্তমান অবস্থায় আমার জীবনকে সহজতর করতে পারত,। গুরুভার কমাতে পারত। আমি জানি আমার নাস্তিকতা সমস্ত পারিপার্শ্বিককে। অত্যন্ত শুষ্ক করে তুলেছে এবং অবস্থা কঠিনতর রূপ গ্রহণ করতে পারে। একটুখানি অতীন্দ্রিয়তা হয়তো এই অবস্থাকে কাব্যময় করে তুলতে পারত, কিন্তু পরিণতির মুখোমুখি হতে কোনোরকম মাদক দ্রব্য আমার প্রয়োজন। নেই। আমি একজন বাস্তববাদী। আমি চাই যুক্তির সাহায্যে আমার ভিতরকার, প্রবণতাকে জয় করতে, এই উদ্দেশ্য সাধনে আমি সব সময় সফল হইনি। কিন্তু মানুষের উচিত হলো চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সফলতা নির্ভর করে ঘটনাচক্র এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি দম্ভ না হয়, তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে পুরনো অথচ এখনও প্রচলিত বিশ্বাসে আস্থা না রাখার কিছু কারণ তো থাকতেই হবে। হ্যাঁ, আমি এখন ঐ প্রশ্নে আসছি। কারণ নিশ্চয়ই আছে। আমার মতে যুক্তিতর্কের ক্ষমতা কিছু পরিমাণে করায়ত্ত করেছে এমন যে কোনো ব্যক্তি যুক্তির সাহায্যে তার পারিপার্শ্বিককে বুঝতে চান। যেখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব সেখানে দর্শনই মুখ্য স্থান গ্রহণ করে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আমার কোনো বিপ্লবী বন্ধু বলতেন যে, দর্শন হচ্ছে মানুষের দুর্বলতার ফলশ্রুতি। যখন আমাদের পূর্ব পুরুষদের এ জগতের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এর কেন কোথা থেকে ইত্যাদি প্রশ্নগুলির রহস্য উদঘাটন করার মতো প্রচুর অবকাশ ছিল তখন প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রচণ্ড অভাবের জন্য প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব উপায়ে এই সমস্যাগুলির সমাধানের চেষ্টা করতেন। এজন্য বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় যা কোনো কোনো সময় শত্রুতামূলক ও বিরুদ্ধ আকার ধারণ করে। পার্থক্য কেবল প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শনগুলির মধ্যে নয়, পার্থক্য রয়েছে একই গোলার্ধের বিভিন্ন রকম চিন্তার মধ্যেও, প্রাচ্য ধর্মগুলির মধ্যে হিন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে মুসলমান বিশ্বাস আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেবল ভারতবর্ষেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের থেকে কোনো কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যেই আবার রয়েছে আর্য সমাজ ও সনাতন ধর্মের মতো বিরুদ্ধ মতবাদ। চার্বাক অতীত দিনের আরেকজন স্বাধীন চিন্তাবিদ। প্রাচীনকালে তিনি ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। মৌলিক প্রশ্নে এ সকল ধর্মের প্রত্যেকটি একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেকেই ভাবে যে সে নিজে সঠিক, ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রাচীন ঋষি ও চিন্তাবিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাণীকে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ সংগ্রামের ভিত্তিরূপে গ্রহণ না করে এবং এ রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে অলসের মতো আমরা বিশ্বাস নিয়ে চেঁচামেচি করেছি, তাদের বক্তব্যের প্রতি অনড় অচল আস্থা প্রদর্শন করেছি এবং এভাবে আমরা মানব প্রগতির পথে বাধা হওয়ার অপরাধে অপরাধী।

যে মানুষ প্রগতির পক্ষে, পুরনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে তাঁকে সমালোচনা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস করতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের প্রত্যেকটি উপাদানকে ধরে ধরে পরীক্ষা করতে হয়। প্রভূত যুক্তিতর্কের পরে কেউ যদি ব্রাহ্মণ্য তত্ত্ব বা দর্শনে আস্থা রাখতে বাধ্য হন তাহলে তার ঐ বিশ্বাসকে স্বাগত জানানো যায়। যুক্তিতর্ক ত্রুটিপূর্ণ, বিপথগামী, ভান্ত এবং কোনো কোনো সময় প্রতারণামূলক হতে পারে কিন্তু তার সংশোধন সম্ভবপর, কারণ যুক্তিই হচ্ছে তার জীবনের ধ্রুবতারা, কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বাস, অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক। এ অস্তিত্বকে নিস্তেজ করে এবং মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। যে মানুষ নিজেকে বাস্তববাদী বলে দাবি করে তাকে প্রাচীন বিশ্বাসের সবটাকেই অস্বীকার করতে হবে। যুক্তি-তর্কের তোড়ের মুখে দাঁড়াতে পারলে তা ভেঙে পড়বে, তখন তার প্রথম কাজ হবে সবটাকেই চুরমার করা এবং নতুন দর্শন সৃষ্টির পথ পরিষ্কার করা। এ হলো নেতিবাচক দিক। এরপর আরম্ভ ইতিবাচক কাজ–পুরননা বিশ্বাসের কোনো বিষয় যখন নতুনভাবে পুনর্গঠনের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। আমার নিজের প্রসঙ্গে যতদূর বলতে পারি, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে এ বিষয়ে আমি বেশি কিছু অধ্যয়ন করতে পারিনি। প্রাচ্য দর্শন অধ্যয়ন করার খুব ইচ্ছা আমার ছিল। কিন্তু কোনো সুযোগ-সুবিধাই আমি পেলাম না। কিন্তু নেতিবাচক অধ্যয়নের কথা যতদূর বলা যায়, পুরনো বিশ্বাসের যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে আমি স্থির নিশ্চিত। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন এমন কোনো পরম সত্তার অনস্তিত্ব সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। আমরা প্রকৃতিকে বিশ্বাস করি এবং সকল রকম প্রগতিশীল আন্দোলনের সাক্ষ্য হলো নিজের কাজে লাগানোর জন্য প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা, একে পরিচালনা করার জন্য পেছনে কোনো শক্তি নেই, এই হলো আমাদের দর্শন।

নেতিবাচক দিক থেকে আমি আস্তিকদের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করছি।

আপনারা যেমন বিশ্বাস করেন, যদি সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞ তেমন কোনো ঈশ্বর থেকে থাকেন যিনি পৃথিবী বা জগতকে সৃষ্টি করেছেন তাহলে আমাকে বলুন কেন তিনি এর সৃষ্টি করেছেন? দুঃখ ও দুর্দশাপূর্ণ এ জগৎ যথার্থই অসংখ্য দুঃখদায়ক কাহিনীর শাশ্বত সমবায়; একটি প্রাণীও পরিপূর্ণ সুখী নয়।

বলবেন না এ তাঁরই বিধান–অনুরোধ করছি। যদি তিনি কোনে বিধান-দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি সর্শক্তিমান নন। তিনি আমারে মতোই আর একজন ক্রীতদাস। অনুগ্রহ করে এ-ও বলবেন না যে ও তাঁর লীলা। নিরো এক রোম নগরী জ্বালিয়েছিল। খুবই সীমিত সংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছিল সে। তার পরিপূর্ণ আনন্দের জন্য সে অতি স্বল্পসংখ্যক বিয়োগান্ত কাহিনীর অবতারণা করেছিল। ইতিহাসে তার স্থান কি? ঐতিহাসিকগণ কি নামে তাকে চিহ্নিত করেন? সমস্ত রকমের বিদ্বেষপূর্ণ বিশেষণ তার ওপর বর্ষিত। অত্যাচারী হৃদয়হীন নিষ্ঠুর নিরোর প্রতি তীব্র নিন্দাসূচক ভর্ৎসনাবাক্যে পাতার পর পাতা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এক চেঙ্গিস খাঁ কয়েক সহস্র জীবন নষ্ট করেছিল নিজের আনন্দের জন্য এবং আমরা এ নামটাকে পর্যন্ত ঘৃণা করি। তাহলে কিভাবে আপনারা আমাদের সর্বশক্তিমান শাশ্বত নিরোকে সমর্থন করছেন যিনি প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় প্রতি মিনিটে সংখ্যাহীন বিয়োগান্ত কাহিনী তৈরি করেছেন ও করছেন? কিভাবে আপনারা তার দুষ্কর্মকে সমর্থন করার কথা ভাবেন যা প্রত্যেক মুহূর্তে চেঙ্গিস খাঁর দুষ্কর্মকে অতিক্রম করে যায়? আমার কথা হলো কেন তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে গেলেন যা যথার্থই নরক, যা প্রতিনিয়ত তীব্র অশান্তির ক্ষেত্র? কেন এই সর্বশক্তিমান মানুষকে সৃষ্টি করতে গেলেন যখন তার তা না করার ক্ষমতাও ছিল? এ সবের যৌক্তিকতা কোথায়? আপনারা কি পরজন্মে নির্দোষ ভুক্তভোগীদের পুরস্কারের কথা এবং দুমকারীদের শাস্তিবিধানের কথাও বলতে চান? ভাল, ভাল, যে ব্যক্তি আপনার দেহে প্রথমে আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করতে এবং পরে অত্যন্ত কোমল ও আরামদায়ক মূলমের প্রলেপ দেওয়ার সাহস পায় তাকে আপনারা কতদূর সমর্থন করবেন? গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিষ্ঠানগুলির সংগঠকরা অর্ধভুক্ত হিংস্র সিংহের সামনে মানুষকে নিক্ষেপ করত, আর সেই মানুষ যদি কোনক্রমে ঐ জন্তুর হাতে মৃত্যুর থেকে রক্ষা পেত তবে তাদের পরবর্তীকালে ভালভাবে দেখাশোনা করা হতো। এ ব্যাপারটাই বা কতটা ন্যায্য ছিল? এ জন্যই আমার প্রশ্ন কেন সেই সচেতন পরম সত্তা এই পৃথিবী ও তার অন্তর্গত মানুষগুলিকে সৃষ্টি করলেন? আনন্দ পাওয়ার জন্য? তাহলে তাঁর ও নিরোর মধ্যে প্রভেদটা কোথায়।

মুসলমান ও খ্রীষ্টানগণ; হিন্দু দর্শন আরও একটা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমি জিজ্ঞাসা করি, উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে আপনারা কি বলেন? আপনারা পূর্বজন্মে বিশ্বাস করেন না। হিন্দুদের মতো, আপাত নির্দোষ দুর্দশাগ্রস্তদের পূর্বজন্মে কৃত কোন দুষ্কর্মের যুক্তি আপনারা দেখাতে পারবেন না। আমি আপনাদের জিজ্ঞাসা করি কথার মাধ্যমে জগৎ সৃষ্টি করার জন্য কেন সর্বশক্তিমান ছয়দিন ধরে পরিশ্রম করলেন এবং প্রতিদিন কেন সব কিছুই ভাল আছে বললেন। আজ তাঁকে ডাকুন। অতীত ইতিহাস তাকে দেখান, বর্তমান অবস্থা নিরীক্ষণ করতে দিন। দেখা যাক তিনি বলতে সাহস পান কিনা, সব কিছুই ভাল আছে।

অন্ধকার কারাকক্ষ থেকে, কুঁড়ে ঘরে ও বস্তিতে বস্তিতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কুরে কুরে খাওয়া অনাহারের গহুর থেকে, রক্তচোষা পুঁজিপতিদের দ্বারা নিজেদের রক্ত চুষে নেওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে অত্যন্ত ধৈর্যশীল অথবা উদাসীন শ্রমিকদের থেকে, সামান্যতম বোধশক্তি আছে এমন মানুষও শিউরে উঠবে মনুষ্য শক্তির যে অপচয় দেখে সেখান থেকে এমন কি অতিরিক্ত উৎপাদন বন্টন করার পরিবর্তে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো পছন্দ থেকে তাকে দেখানো মানুষের হাড়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধনীর প্রাসাদ, তিনি বলুন সব ঠিক আছে। আমার প্রশ্ন, কেন? কোন কারণে? আপনারা নীরব, ঠিক আছে, তাহলে আমি এগিয়ে যাই।

হিন্দুরা, আপনারা বলেন, বর্তমানের দুর্দশাগ্রস্তরা সকলেই পূর্ব জন্মের পাপী। ভাল কথা। আপনারা বলেন, এখনকার অত্যাচারীরা তাদের পূর্বজন্মে সৎ মানুষ ছিলেন এবং এ জন্য তারা এখন ক্ষমতা ভোগ করেন। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনাদের পূর্ব পুরুষরা বেশ চতুর ব্যক্তি ছিলেন। যুক্তি ও অবিশ্বাসের সকল তত্ত্বকে চুরমার করার জন্য যথেষ্ট মজবুত তত্ত্ব বের করার চেষ্টা তারা করেছিলেন। কিন্তু এ যুক্তি কতটা ধোপে টেকে তা বিশ্লেষণ করা যাক।

খুব বিখ্যাত আইনজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কেবল তিন বা চারটি দিক থেকে অন্যায়কারীদের যে শাস্তি প্রদান করা হয় তা সঠিক বলে সমর্থিত হতে পারে। এগুলো হলো, প্রতিশোধাত্মক, প্রতিরোধাত্মক ও সংশোধনাত্মক। অগ্রগামী সকল চিন্তাবিদ কর্তৃকই এখন প্রতিশোধাত্মক তত্ত্বে নিন্দিত। প্রতিরোধাত্মক তত্ত্বেরও একই দশা। সংশোধনাত্মক তত্ত্বই একমাত্র মানব প্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো দুষ্কৃতকারীকে অত্যন্ত যোগ্য ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকরূপে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নিই যে সেই মানুষেরা দুষ্কৃতকারী তাহলে তাদের উপর ঈশ্বর যে শাস্তিবিধান করেন তার প্রকৃতি কি রকম? আপনারা বলেন তিনি তাদের গোরু, বিড়াল, গাছ, লতাপাতা অথবা পশুরূপে জন্মগ্রহণ করার জন্য পাঠান। আপনারা মনে করেন যে এ সকল শাস্তি চুরাশী লক্ষ রকমের। আমি জিজ্ঞাসা করি, মানুষের ওপর এর সংশোধনাত্মক প্রতিক্রিয়া কি রকম? কতজন লোকের সন্ধান আপনারা পেয়েছেন যারা স্বীকার করে যে কৃত দুষ্কর্মের জন্য তারা পূর্বজন্মে গাধা হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিল? কেউ না। পুরাণ উদ্ধৃত করতে যাবেন না। আপনাদের পৌরাণিক গল্প স্পর্শ করার সুযোগ আমার নেই। অধিকন্তু, আপনারা কি জানেন যে দরিদ্র হওয়া এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় পাপ? দারিদ্র্য একটা পাপ–একটা শাস্তি! আমি জিজ্ঞাসা করি, কোন অপরাধতাত্ত্বিক, আইনজ্ঞ অথবা আইনসভা সদস্য যদি এমন শাস্তি বিধানের প্রস্তাব আনেন যা অনিবার্যভাবেই মানুষকে আরও বেশি রকমের গর্হিত কাজ করতে বাধ্য করে তাহলে তাদের মূল্য বিচার করবেন? এ চিন্তা কি আপনাদের ভগবান করেননি, নাকি তাকেও ঐ সব জিনিস শিখতে হয়েছে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, মানুষের অকথিত দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে। দরিদ্র এবং অশিক্ষিত চামার কিংবা মেথর পরিবারে জন্মেছে এমন একজন মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? সে দরিদ্র, সুতরাং লেখাপড়া করতে পারে না। তার পাশের মানুষদের দ্বারাই সে ঘৃণিত ও বর্জিত, তথাকথিত উঁচু জাতে জন্মেছে বলে যারা নিজেদের মানুষ বলে মনে করে। তার অজ্ঞতা, তার দারিদ্র্য এবং তার প্রতি যে ব্যবহার করা হয়, সব মিলিয়ে সমাজের প্রতি তার হৃদয় কঠিন হয়ে উঠবে। ধরুন সে একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, কে তার ফল ভোগ করবে? ভগবান সে নিজে অথবা সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিরা? উদ্ধত এবং আত্মম্ভরি ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে যে সব লোককে অজ্ঞানতায় রাখা হয়েছে এবং আপনাদের পবিত্র জ্ঞানগ্রন্থ বেদের কয়েকটি বাক্য শ্রবণ করে পরিচালিত হওয়ার দলে পড়ে যাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাদের শাস্তি সম্পর্কে কী হবে? যদি তারা কোন অপরাধ করে থাকে, কাদের তার জন্য দায়ী হওয়া উচিত ছিল এবং কাদের আসল ধাক্কা সামাল দেওয়া উচিত? প্রিয় বন্ধুগণ, এ তত্ত্বগুলো সুবিধাভোগীদের আবিষ্কার। এই সব তত্ত্বের দ্বারা তারা তাদের দখলীকৃত ক্ষমতা, সম্পদ ও কৌলিন্য সমর্থন করে। সম্ভবত আপটন সিনক্লেয়ারই কোথাও লিখেছিলেন যে, কোনো মানুষকে একবার শুধু অমরতায় বিশ্বাসী করে তোলো এবং তারপর তার সমস্ত ধন ও সম্পদ অপহরণ করো। সে তোমায় নির্দ্বিধায় সাহায্য করবে। ধর্মবাহক ও ক্ষমতার অধিকারীদের মধ্যে যোগসাজশই কয়েদখানা, ফাঁসিকাঠ, চাবুক ও এ ধরনের তত্ত্বগুলির আমদানি করেছে।

যখন কোনো মানুষ কোনো পাপ বা অপরাধমূলক কাজ করছে, তখন কেন আপনাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাদের প্রত্যেককে নিবৃত্ত করেন না? তিনি তো খুব সহজেই এটা করতে পারেন, কেন তিনি যুদ্ধবাজদের তা তাদের অন্তরের যুদ্ধোন্মাদনাকে নিঃশেষ করেন না এবং মহাযুদ্ধ মানবতার ওপর যে দুর্যোগ নিয়ে আসে, কেন এভাবে তিনি তা পরিহার করেন না? কেন তিনি ব্রিটিশ জাতির অন্তরে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করে দেওয়ার প্রবৃত্তি সৃষ্টি করেন না? কেন তিনি পুঁজিপতিদের অন্তঃকরণে এমন পরার্থবাদী উদ্দীপনা সঞ্চালিত করেন না যাতে তারা উৎপাদনের হাতিয়ারসমূহের ওপর তাদের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার পরিত্যাগ করে ও এভাবে সমগ্র শ্রমজীবী মানুষকে–না, সমগ্র মানবসমাজকেই পুঁজিবাদী বন্ধন থেকে মুক্তিদান করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা সম্পর্কে আপনারা আলোচনা করতে চান, আমি আপনাদের সর্বশক্তিমানের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিলাম। সামগ্রিক মঙ্গলসাধন যখন বিবেচ্য তখন সমাজতন্ত্রের গুণাবলী সবাই স্বীকার করেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয় এ অজুহাতে তারা এর বিরোধিতা করেন। সেই সর্বশক্তিমানকে এসে সব কিছু সুশৃঙ্খলভাবে সাজাতে বলুন। উল্টো-পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না–কাজ হবে না। আমি বলতে চাই ঈশ্বর ইচ্ছা করেন বলেই ব্রিটিশ রাজ এখানে আছে এমন নয়। বরং বলা যায় তারা এখানে আছে কারণ তাদের ক্ষমতা আছে, এবং তাদের বিরুদ্ধাচরণ করার মতো সাহস আমাদের নেই, ঈশ্বরের সাহায্যে নয়, বন্দুক ও রাইফেল, বোমা, গুলি, পুলিস ও সেনাবাহিনীর সাহায্যেই তারা আমাদের অধীন রাখছে এবং আমাদের অনীহার জন্যই এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির জঘন্য রকমের শোষণের মতো একটি নগ্ন সমাজ বিরোধী পাপ তারা সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে পারছে। কোথায় ঈশ্বর? কি করছেন তিনি? মানবজাতির এই দুর্দশা কি তিনি উপভোেগ করছেন? তিনি এক নিরো, তিনি এক চ্যাঙ (চেঙ্গিস), নিপাত যান তিনি।

এই পৃথিবীর উৎপত্তি, মানবজাতির উৎপত্তি আমি কিভাবে ব্যাখ্যা করি সে সম্পর্কে কি আপনারা প্রশ্ন করছেন? ঠিক আছে, আমি আপনাদের বলি, চার্লস ডারউইন এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন, তাঁর লেখা পড়ুন। সোহম স্বামীর সাধারণ জ্ঞান পড়ুন। কতক পরিমাণে তাতে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর মিলবে। এ হলো প্রাকৃতিক ঘটনা। বিভিন্ন রকমের নীহারিকাবৎ পদার্থের আকস্মিক সংমিশ্রণের ফলে এ জগতের উদ্ভব হয়েছে। কখন? ইতিহাস পড়ুন। একই প্রক্রিয়ায় জন্ম হয়েছে জীবজন্তুর এবং দীর্ঘদিন পরে মানুষের। ডারউইনের Origin of Species পড়ুন। প্রকৃতির সঙ্গে। মানুষের অবিরাম দ্বন্দ্ব ও তাকে উত্তরণ করা প্রচেষ্টা থেকেই পরবর্তীকালে সমস্ত রকমের প্রগতি, এ ঘটনার এই হলো সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সম্ভবপর ব্যাখ্যা।

আপনাদের আর একটা যুক্তি থাকতে পারে। যদি পূর্বজন্মকৃত কাজের জন্য না হয়, তাহলে কেন কোনো কোনো শিশু অন্ধ বা খোঁড়া হয়ে জন্মায়? এ সমস্যাটির ব্যাখ্যায় জীবনবিজ্ঞানীরা ব্যাপারটাকে নিতান্তই জৈবিক ঘটনা বলেছেন। তাঁদের মতে এর সব দায়িত্বই বর্তায় মাতা-পিতার ওপর যাঁরা জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে এমন কিছু করেন যাতে জন্মের পূর্বে শিশুর অঙ্গহানি ঘটে।

আপনারা আর একটা প্রশ্ন তুলতে পারেন যা কিন্তু আসলে শিশুসুলভ, যদি ঈশ্বর না-ই থাকেন তাহলে মানুষ কি করে তাকে বিশ্বাস করে? আমার উত্তর সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার। যেভাবে তারা ভূত ও দুষ্ট আত্মায় বিশ্বাস করতে শিখেছে, সেভাবেই তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেও শিখেছে। কেবলমাত্র পার্থক্য হলো এই যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রায় সর্বজনীন এবং দর্শনটি বেশ উন্নত অন্য কিছু প্রগতিপন্থীর মতো এ কথা আমি বলি না যে ঈশ্বরের আবির্ভাবের কারণ হচ্ছে শোষকদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা যারা এক পরম সত্তার অস্তিত্ব প্রচার করে মানুষকে নিজেদের তাঁবে রাখতে চেয়েছিল ও দাবি করেছিল যে তাদের সুবিধাভোগী অবস্থানের পেছনে সেই পরম সত্তার অনুমতি বা সম্মতি আছে। মৌল প্রশ্নে এই মতের সঙ্গে আমার পার্থক্য নেই যে সমস্ত, ঈশ্বর বিশ্বাস, ধর্ম, ধর্মমত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরবর্তীকালে অত্যাচারী ও শশাষক প্রতিষ্ঠানও মানুষের সমর্থকে রূপান্তরিত হয়। প্রত্যেক ধর্ম অনুযায়ী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সব সময়ই পাপ।

ঈশ্বরের উৎপত্তি সম্পর্কে আমার মত হলো এই যে মানুষের সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করে এবং তার দুর্বলতা ও অক্ষমতা বিবেচনা করে কল্পনায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহসের সঙ্গে বিপজ্জনক সমস্ত ঘটনার সম্মুখীন হতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য এবং প্রতিপত্তি ঐশ্বর্যে তার যে বিস্ফোরণ তাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য। তার ব্যক্তিগত বিধিনিয়ম ও পৈত্রিক ঔদার্য সহ ভগবানের চিত্রটি বিশেষভাবে কল্পিত ও চিত্রিত হয়েছে। তাঁর ক্রোধ ও ব্যক্তিগত বিধিনিয়মের আলোচনাকে প্রতিরোধাত্মক উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে মানুষ সমাজের কাছে বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে। যখন তাঁর পিতৃসুলভ গুণাবলীর আলোচনা হচ্ছে তখন তাঁকে পিতা, মাতা, ভাই, বোন, বন্ধু সহায়ক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সুতরাং যখন কোনো মানুষ সমস্ত বন্ধু-বান্ধবের বিশ্বাসযোগ্যতায় পরিত্যক্ত হয়, তখন এই ভেবে সে সান্ত্বনা পেতে পারে যে তাকে সাহায্য করার জন্য, সমর্থন করার জন্য চিরবিশ্বস্ত একজন বন্ধু এখনও আছেন এবং তিনি সর্বশক্তিমান ও সব কিছুই করতে পারেন। সমাজের আদিম যুগে এটা কাজে লাগত। ঈশ্বর বিশ্বাসী দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করে।

মূর্তি পূজা ও সঙ্কীর্ণ ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই রয়েছে, এই বিশ্বাসকেও তেমনই লড়াই করেই শেষ করতে হবে। অনুরূপভাবে, মানুষ যখন তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে ও বাস্তববাদী হয়, তখন তাকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে এই সব বিশ্বাস। পরিস্থিতি তাকে যে বাধা ও বিপদের

মধ্যে নিক্ষেপ করবে, পৌরুষের সঙ্গে সেগুলির সম্মুখীন হতে হবে। আমার এখন ঠিক সেই অবস্থা। বন্ধুগণ, এ আমার দম্ভ নয়। আমার চিন্তাধারাই আমাকে নাস্তিক করেছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং প্রাত্যহিক প্রার্থনা আমার মতে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত স্বার্থপর ও নিম্নস্তরের কাজ। আমি জানি না আমার ক্ষেত্রে এ কাজ সহায়ক হবে, না পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে। আমি এমন নাস্তিক্যবাদের কথা পড়েছি যারা বেশ সাহসের সঙ্গে সমস্ত রকম বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং আমিও শেষ পর্যন্ত, এমন কি ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত মানুষের মতো উন্নত শির হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।

দেখা যাক আমার আচার-আচরণ কেমন হয়। একজন বন্ধু আমাকে প্রার্থনা করতে উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বললেন, তোমার শেষ দিনগুলোতে তুমি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করবে। আমি বলেছি, না মশাই, পারব না। আমার পক্ষে এ হবে অধঃপতন ও আত্মবিশ্বাসহীনতা, স্বার্থপর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা আমি করব না। পাঠক ও বন্ধুগণ, এ কি দম্ভ? যদি তাই হয় তাহলে বলি, আমি এর পক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *