০১. একটি সুন্দর সকাল

একটি সুন্দর সকাল।

বুড়ো রাত বিদায় নেবার আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু তার শেষ চিহ্নটুকু এখানে সেখানে ছড়ানো। চিকন ঘাসের ডগায় দু একটি পানির ফোঁটা সূর্যের সোনালি আভায় চিকচিক করছে।

চারপাশে রবিশস্যের ক্ষেত। হলদে ফুলে ভরা। তারপর এক পূর্ণ-যৌবনা নদী। ওপাড়ে তার কাশবন। এপাড়ে অসংখ্য খড়ের গাদা।

ছেলেটির বুকে মুখ রেখে, খড়ের কোলে দেহটা এলিয়ে দিয়ে, মেয়েটি ঘুমোচ্ছে। ওর মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। ঠোঁটের শেষ সীমানায় শুধু একটুখানি হাসি চিবুকের কাছে এসে হারিয়ে গেছে। ওর হাত ছেলেটির হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা। দুজনে ঘুমোচ্ছে ওরা।

ছেলেটিও ঘুমিয়ে।

তার মুখে দীর্ঘ পথ চলার ক্লান্তি। মনে হয় অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলো ওরা। চুলের প্রান্তে এখনো তার কিছু রেশ জড়ানো রয়েছে।

সহসা গাছের ডালে বুনো পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেলো। মটরশুটির ক্ষেত থেকে একটা সাদা ধবধবে খরগোশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেলো কাছের অরণ্যের দিকে।

খড়ের কোলে জেগে উঠলো অনেকগুলো পায়ের ঐক্যতান। সমতালে এগিয়ে এলো ওরা। যেখানে ছেলেটি আর মেয়েটি এই পৃথিবীর অনেক চড়াই উৎরাই আর অসংখ্য পথ মাড়িয়ে এসে অবশেষে এই স্নিগ্ধ সকালের সোনা-রোদে পরস্পরের কাছে অঙ্গীকার করে ছিলো।

ভালোবাসি।

বলেছিলো। এই রাত যদি চিরকালের মতো এমনি থাকে। এই রাত যদি আর কোনদিন ভোর না হয় আমি খুশি হব।

বলেছিলো। ওই যে দূরের তারাগুলো, যারা মিটিমিটি জ্বলছে তারা যদি হঠাৎ ভুল করে নিভে যেতো, তাহলে খুব ভালো হতো।

আমরা অন্ধকারে দুজনে দুজনকে দেখতাম।

বলেছিলো। হয়তো কিছুই বলে নি ওরা।

শুধু শুয়েছিলো।

আঠার জোড়া আইনের পা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে এসে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়ালো ওদের।

ওরা তখনো ঘুমুচ্ছে।

তারপর।

আমার কোন জাত নেই।

মাংসল হাতজোড়া ভেজা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বুড়ো আহমদ হোসেন বললো। আমার কোন জাত নেই। আমি না হিন্দু, না মুসলমান, না ইহুদি, না খৃষ্টান। আমার জাত তুলে কেউ ডেকেছে কি এক ঘুষিতে নাক ভেঙ্গে দেবো বলে দিলাম।

আশেপাশের টেবিলে যারা ছিলো তারা বিরক্তির সঙ্গে এক নজর তাকালো ওর দিকে।

ছোকরা গোছের একজন দূর থেকে চিৎকার করে বললো, বুড়ো ব্যাটার ভীমরতি হয়েছে। রোজ এক কথা। বলি এ পর্যন্ত কটা লোকের নাক ভেঙ্গেছো শুনি?

আহমদ হোসেনের কানে সে কথা পৌঁছলো না। কপালে জেগে ওঠা ঘামের ফোঁটাগুলো বাঁ হাতে মুছে নিয়ে সে আবার বলতে লাগলো। আমি কিছু জানি না। না জাত না ধর্ম। না তোমাদের আইন-কানুন। এর সবটুকুই ফাঁকি। চোখে ধুলো মেরে মানুষ ঠকানোর কারসাজি। শুনতে যদি ভালো না লাগে, নিষেধ করে দাও তোমাদের এই আস্তাকুঁড়ে আর আসবো না। এখানে চা খেতে না এলেও আমার দিন কাটবে।

আহা চটছেন কেন, আমি কি আপনাকে আসতে বারণ করেছি কোন দিন। না, করছি। চা-খানার মালিক নওশের আলী তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

কিন্তু, বুড়ো চুপ করলো না।

কাপ থেকে খানিকটা চা পিরিচে ঢেলে নিয়ে মুখের কাছে এনে আবার পিরিচটা নামিয়ে রাখলো সে। হয়েছে, ওসব মিষ্টি কথায় মন ভোলাতে চেও না। ছেলেটাকে যখন কুড়ি বছর ইকে দিলো তখন কোথায় ছিলে সব? পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একটি মাত্র ছেলে আমার। কোর্ট শুদ্ধ লোক বললো, বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে, আর হাকিম কিনা সাজা দিয়ে দিলে আঁ।

পনের বছর আগে সাজা পাওয়া এবং একমাত্র ছেলের চিন্তায় আহমদ হোসেনের চোখজোড়া সজল হয়ে এলো। বার্ধক্যের চাপে কুঞ্চিত মাংসের বেষ্টনী ভেদ করে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। বাদামি চায়ের ঈষৎ উষ্ণ লিকারে।

বুড়ো কাঁদছে।

শওকত তার চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো। ওর ইচ্ছে হলো এ মুহূর্তে একবার বুড়ো আহমদ হোসেনের পাশে বসতে। চায়ের কাপটা এক পাশে সরিয়ে দিয়ে দুটো কথা বলতে ওর সঙ্গে।

কিন্তু থাক।

যে কাঁদছে সে কাঁদুক। কান্নার সাগরে সান্ত্বনার সীমা খুঁজে নেবে বুড়ো আহমদ হোসেন।

শওকত জানে, এই দিন যখন শেষ হয়ে যাবে, যখন কালো বোরখায় ঢাকা রাত আসবে, তখন আর এমনি করে কাঁদবে না আহমদ হোসেন। তখন এই শহরের প্লাস্টার ঝরা সরু আঁকাবাঁকা গলিতে নামহীন অসংখ্য ছেলেমেয়ের জন্ম-মৃত্যুর হিসেব লিখে বেড়াবে সে।

কত হলো?

একান্ন লক্ষ বত্রিশ হাজার চুরানব্বই জন।

কোনো রাতে সহসা কোনো রাস্তার মোড়ে দেখা হয়ে গেলে বুক পকেট থেকে হিসেবের খাতাটা বের করে বলবে। একান্ন লক্ষ বত্রিশ হাজার চুরানব্বই জন ক্ষয়ে যাওয়া গুটিকয় কালচে দাঁতের ফাঁকে বিকৃত এক হাসির আমেজ ছড়িয়ে সে বলবে। যাবে একদিন। চলো না কাল রাতে।

না।

ভয় হচ্ছে বুঝি? ওখানে গেলে কেউ তোমাকে চিনে ফেলবে।

বদনামের ভয়, তাই না? কিন্তু কি জানো, ওখানে যারা যায় তারা কারো কথা মনে রাখে না! এটাই ও জায়গায় বিশেষত্ব। আজ পনেরো বছর ধরে দেখে আসছি। আগে আর যায়। বামুন কায়েখ বলো, আর মোল্লা মৌলভী বলো, সব বাটাকে চিনে রেখেছি। দিনের বেলা কোট-প্যান্ট পরে সাহেব সেজে অফিসে যায় আর যেই না সন্ধে হলো, অমনি বাবু মুখে রুমাল খুঁজে চট করে ঢুকে পড়ে গলিতে! বলে আবার হাসবে আহমদ হোসেন। একটা আধপোড়া বিড়িতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে আবার সে শুরু করবে, এই শহরের নাম না জানা অসংখ্য দেহপসারিণীয় গল্প।

দিন যত যাচ্ছে পিঁপড়ের মতো বাড়ছে ওরা বুঝলে? বাদামতলীর নাম শুনলে তো নাক সিটকাও। আর এই যে নিওন বাতির শহর রমনা ভাবছো এটা একেবারে পিঁপড়ে শূন্য তাই না? খোদার কছম বলছি এখানকার পিঁপড়েগুলো আরো বেশি পাজী। শালার সাহেবের বাচ্চারা ওদের গা গার্ল বলে ডাকে। যেন, নাম পাল্টে দিলেই ধর্ম পাল্টে গেলো আর কি? বলে বিকট শব্দে হেসে উঠবে বুড়ো আহমদ হোসেন। তারপর হিসেবের খাতাটা বুক পকেটে রেখে দিয়ে আর কোন কথা নাবলৈ হঠাৎ সে আবার চলতে শুরু করবে। এক পথ থেকে আরেক পথ। অন্য পথের মোড়ে।

বুড়ো আহমদ হোসেন তখনো কাঁদছে।

চায়ের দাম চুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে বাইরে বেরিয়ে এলো শওকত।

 

লম্বা দেহ। ছিপছিপে শরীর। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বাতাসের ভার সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু কাছে এসে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শুকনো শরীরের মাংসপেশীগুলো অত্যন্ত সবল এবং সজীব। ময়লা রঙের চামড়ার গায়ে সংবা লোমের অরণ্য। হাতে-পায়ে, বুকে এবং কণ্ঠনালীর সীমানা পর্যন্ত সে অরণ্যের বিস্তৃতি। রুক্ষ হাতের তালু। খসখসে। অগুনিত রেখায় ভরী। চোখজোড়া বড় বড়। মণির রঙ বাদামি। কিন্তু তার মধ্যে কোন মাধুর্য নেই। আছে এক তীক্ষ্ণ তীব্র জ্বালা! মণির চারপাশে যে সাদা অংশটুকু রয়েছে তার মাঝে ছিটেফোঁটা লাল ছড়ানো। কখনো সেটা বাড়ে। কখনো কমে। চোখের খুব কাছাকাছি ভ্রূ-জোড়ার অবস্থিতি। মোটা। মিশকালো। ধনুর মতো বাঁকা কিন্তু লম্বায় ছোট চলতে চলতে হঠাৎ যেন থেমে গেছে ওটা। সহসা দেখলে মনে হয়, সারা মুখে কোথাও কোন লাবণ্য নেই। কিন্তু সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে যাচাই করলে ধীরে ধীরে একটা অজ্ঞ সৌন্দর্য ধরা পড়ে। যার সঙ্গে আর কারো তুলনা করা যেতে পারে না। মাঝারি নাক। মাংসল। আর ঠিক নাকের মাঝখানটায় একটা কাটা দাগ। চওড়া কপাল বয়সের সঙ্গে তাল রেখে সামনের অনেকখানি চুল ঝরে পড়ায় সেটাকে আরো প্রশস্ত দেখায়। মুখের গড়নটা ডিম্বাকৃক্তি পুরু ঠোঁট জামের মুতো কালো। তেমনি মসৃণ আর তেলতেলে। যখন ও হাসে, তখন মুক্তোর মতো দাঁতগুলো ঝলমল করে উঠে। চিবুকের হাড়জোড় সুস্পষ্টভাবে উঁচু আর তার নিচের অংশটুকু হঠাৎ যেন একটা খাদের মধ্যে নেমে গেছে। খাদের শেষ প্রান্তে একটা বড় তিল। মার্থাভরা একরাশ ঘন চুল। অমসৃণ এবং অনাদৃত। রাস্তায় বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকালো শওকত? একখানা যাত্রীবাহী বিমান প্রচণ্ড শব্দ করে উড়ে চলেছে পোতাশ্রয়ের দিকে। এক্ষুণি নামবে। তার মা বিলীন হয়ে যাওয়ার আগেই কে যেন পাশ থেকে ডাকলো। বাড়ি যাবেন নাকি?

শওকত চেয়ে দেখলো, মার্থা গ্রাহাম!

মার্থা একটা রিক্সায় বসে। শওকতকে দেখে ওটা ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়েছে সে। ওর হাতে একটা পাউরুটি আর ছোট একটা চায়ের পাকেট।

মার্থা ডাকলো, ব্যাপার কি, এই রাস্তার ওপরে একঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাসায় যাবেন শা, আসুন।

শওকত সহসা হেসে উঠলো। আশ্চর্য!

কি?

মনে হচ্ছে আমাকে বাসায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে রোজ আপনি এখানে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

লজ্জায় মার্থার কালো মুখখানা বেগুনি হয়ে গেলো। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, আমিও কিন্তু এর উল্টোটি বলতে পারতাম। কিন্তু বলবো না। তাহলে আপনি রাগ করবেন। মার্থার গলার স্বরে কোথায় যেন এক টুকরো ব্যথা ঈষৎ উঁকি দিয়ে গেলো।

শওকত ততক্ষণে উঠে বসেছে রিক্সায়।

গলির মোড়ে কামারের দোকানের সামনে কয়েকটা লম্বা টুলের ওপরে যারা হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলো, তারা দেখলো। আজও একখানা রিক্সা থেকে নামলো আধা আর শওকত।

আড়চোখে একবার ওদের দিকে তাকালো শওকত। ওরা দেখছে। ইশারায় দেখাচ্ছে অন্যদের। যাক, ভালোই হলো। আজ রাতটার জন্যেও কিছু মুখরোচক খোরাক পেলো ওরা। তাসের আড়া কথার কাকলিতে ভরে উঠবে। উষ্ণ চায়ের লিকার আর নয়া পয়সায় কেলা নোনতা বিস্কিটের সঙ্গে জমবে ভালো। মার্থা গ্রাহামকে নিয়ে অনেক রাত পর্যন্তু গল্প করবে ওরা।

কিন্তু কেন? আমি তো ওদের সাতপাঁচে থাকিনে? আমি তো সেই সকালে কাজে বেরিয়ে যাই, আবার রাতে ফিরি। আমি তো কাউকে নিয়ে মার্থা ঘামাইনে! কারো পাকা ধানে মই দেইনে। তবু কেন ওরা আমাকে নিয়ে অত হল্লা করে?

বলতে গিয়ে ওর নিকৃষ্ট কালো চোখের মণি জোড়ায় দুফোঁটা পানি ছলছল করে উঠেছিলো। সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেলে শওকতের দিকে তাকিয়েছিলো মার্থা গ্রাহাম।

সহসা কোন উত্তর দিতে পারে নি শওকত। ওর শুধু বুড়ো আহমদ হোসেনের কথা বার বার মনে পড়ছিলো। মার্থা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একদিন বলেছিলো, ওটা একটা রোগ। ওটাও এক রকমের ক্ষুধা, বুঝলে? আজ পনেরো বছর ধরে এই শহরের অলিতে গলিতে পইপই করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওদের খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। বাদামতলীর ঘাট বলো, ছক্কু মিয়ার চা-খানা কিম্বা খান সাহেবের কাফে হংকং বলল আর তোমাদের ওই বিলেতি ঢঙের যত দিশি ক্লাব সব ব্যাটার ধর্ম এক, বুঝলে। সবাই এক রোগে ভুগছে, এক ক্ষুধায় জ্বলছে। শোন, কাছে এসো, কানে কানে একটা মোক্ষম কথা বলে রাখি তোমায়, বয়সকালে কাজে দেবে। শোন, কোনদিন যদি কোনখানে কোন ছেলে কিম্বা বুড়োকে দেখো কোন মেয়ের নামে বদনাম রটাচ্ছে, তাহলে জানবে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন কিন্তু রয়েছে। বলতে গিয়ে বিকট শব্দে হেসে উঠেছিলো বুড়ো আহমদ হোসেন। দাড়ির জঙ্গলে আঙুলের চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে পরক্ষণে আবার বলেছিলো। সেই ছেলে কিম্বা বুড়ো বুঝলে? তারা যদি কোনদিন একান্ত নিরালায় সে মেয়েটিকে হঠাৎ কাছে পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে তার পায়ের গোড়ালি জোড়ায় ব্যথা ধরিয়ে দেবে। গুলতানী নয় বাবা, নিজ চোখে দেখা সব। এই শহরের কোন্ বুড়ো কোন্ মেয়েকে নিয়ে কোন রেস্তোরাঁয় যায় আর কোন মাঠে হাওয়া খায়, সব জানা আছে আমার। বলতে গিয়ে একরাশ থুথু ছিটিয়েছে আহমদ হোসেন।

মার্থাকে নিয়ে রিক্সা থেকে নামলো শওকত। পকেটে হাত দিতে যেতে মার্থা থামিয়ে দিয়ে বললো। দাঁড়ান, আমি দিচ্ছি।

বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ব্যাগটা থেকে কয়েক আনা খুচরা পয়সা বের করলো মার্থা। সামনের লাল রকটার ওপরে একটা কুষ্ঠ রোগী কবে এসে ঠাঁই নিয়েছে কেউ জানে না। হাত পায়ের নখগুলো তার ঝরে গেছে অনেক আগে। সারা গায়ে দগদগে ঘা। চোয়াল। জোড়া ফুটো হয়ে সরে গেছে ভেতরে। আর সেই ছিদ্র বেয়ে লাবাস্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। কাঁধে। বুকে। উরুতে। চারপাশে অসংখ্য মাছির বাসা। ভনভন করে উড়ছে। বসছে। আবার উড়ছে।

রিক্সা বিদায় দিয়ে মার্থা আর শওকত ভেতরে এলো। দেড় হাত চওড়া অপরিসর বারান্দার মুখে কে যেন একটা কয়লার চুলো জ্বালিয়ে রেখেছে। তার ধুয়োয় চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। স্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ওদের। সহসা দুজন মহিলা দুপাশের করিডোর থেকে বেরিয়ে চিৎকার করতে করতে উঠোনের দিকে এগিয়ে গেলো।

আরে, মেরে ফেললো তো।

ক্যায়া হুঁয়া?

কি অইছে আঁ?

মার, মার। মার না।

আরে ছাড়, ছেড়ে দে বলছি, নইলে মেরে হাড্ডি মাংস গুঁড়ো করে দেবো বলে দিলাম।

আরে আয়ি বড়ি মারনে ওয়ালী।

ত্রিকোণ উঠোনোর মাঝখানে মহিলারা প্রচণ্ড কলহে মেতে উঠেছে। এ ওর চুল ধরে টানছে। এ ওর পিঠের ওপর একটানা কিল-ঘুষি মারছে।

দুটো নেড়ি কুত্তা ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বার বার লাফাচ্ছে আর ঘেউ ঘেউ করছে।

মাওলানা সাহেব বারান্দায় নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ থামিয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। জাহান্নামে যাবে সব। হাবিয়া দোজখে যাবে।

এর চেয়ে বড় দোজখ আর কোথাও আছে নাকি? কে যেন জবাব দিলো জটলার ভেতর থেকে। বাইরের এই হট্টগোল শুনে মাওলানা সাহেবের তৃতীয় স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে মুখ বের করে তাকিয়েছিলো। সেদিকে চোখ পড়তে মাওলানা সাহেব গর্জে উঠলেন। তু ক্যায়া দেখতি হ্যায় আঁ? আন্দার যা।

মেয়েটি সভয়ে পর্দার নিচে আত্মগোপন করলো। উঠোনের কোলাহল চরমে উঠেছে।

মার্থা এক নজর তাকালো শওকতের দিকে। তারপর আরো দুটো সরু করিডোর পেরিয়ে আরো অনেক দরজা পেছনে ফেলে ঘরে এসে ভেতর থেকে খিল এঁটে দিলো সে।

শওকত এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে।

জায়গাটা একেবারে অন্ধকার। আলো থেকে এলে পাশের মানুষটাকেও ভালো করে দেখা যায় না। পকেট থেকে একটা দিয়াশলাই বের করে জ্বালালো সে, আর তার আলোতে যেন ভূত দেখলো শওকত। সিঁড়ির নিচে জড়ো করে রাখা একগাদা আবর্জনার মাঝখানে জুয়াড়িদের একজন লোক খলিল মিস্ত্রীর বউকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রয়েছে। অভাবিত আলোর স্পর্শে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো ওরা। তারপর ছুটে পালিয়ে গেলো দুজন দুদিকে।

বুড়ো আহমদ হোসেন আজ এখানে থাকলে হয়তো পকেট থেকে হিসেবের খাতাটা বের করে তাতে আরো একটা নাম যোগ করতো আর বলতো এ আর এমন কি দেখলে ভায়া। শোন, এক সাহেবের গল্প বলি। ব্যাটা দিশি সাহেব। বিলিতি নয়। সেই সাত বছর আগের কথা বলছি, তখন পঞ্চাশের ঘরে বয়স ছিলো ওর। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। তাদের ঘরে নাতি-পুতিও হয়েছে। একদিন এক স্বদেশী মদের দোকানে বিদেশী মদ খেতে খেতে ব্যাটা বললে, দেখো আহমেদ, আমরা কি রোজ এক রেস্তোরাঁয় বসে খানা খাই? মোটেই না। আজ কাফে হংকংয়ে। কাল লা-শানীতে। পার কসবায়। রোজ মুখের স্বাদ পাল্টাচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণ বদলে যাচ্ছে। সেখানেই তো আনন্দ। তুমি কি মনে করো মানুষ কি চিরকাল এক রকম খাবার খেয়ে সুখে থাকতে পারে?

এখানে এসে একবার থামবে বুড়ো আহমদ হোসেন। বার্ধক্যের চাপে কুঞ্চিত চোখজোড়া আরো ছোট করে এনে, দাঁড়িয়ে অরণ্যে এক বন্য হাসি ছড়িয়ে সে আবার বলবে। ওর কথার গূঢ় অর্থ কিছু বুঝলে? আরে ভায়া, চোর যে চুরি করে, তারও একটা দর্শন আছে। খুনি যে খুন করে সেও জানে বিনা কারণে সে খুন করে নি। হাতের কাঠিটা মাটিতে পড়ে যেতে আবার অন্ধকার ঘনিয়ে এলো চারপাশে। আর আলো জ্বালতে সাহস পেলো না শওকত। দিয়াশলাইটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলো সে। বারান্দায় পাটি পেতে বসে আজমল আলীর বুড়ো মা নাতি-পুতিদের ডালিম কুমারের গল্প বলছে।

তারপর ডালিম কুমার সাদা ধবধবে একটা ঘোড়ায় চড়ে, ছুটছে তো, ছুটছে তো ছুটছে। হঠাৎ সামনে পড়লো একটা বিরাট নদী। আর তার মধ্যে ইয়া বড় বড় ঢেউ। দেখে তো ডালিম কুমার মহাভাবনায় পড়ে গেলো।

আরো দুটো সরু বারান্দা পেছনে ফেলে নিজের ঘরে এসে ঢুকলো শওকত। তারপর একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ্ করে বসে পড়লো।

 

এ বাড়িতে কত ভাড়াটে আছে কেউ বলতে পারবে না। কটা ঘর হিসেব করে দেখতে গেলে একটা লোক হয়তো একদিন ধরেও কোন খেই পাবে না। এক করিডোর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বার বার সে ওই একই করিডোরে ফিরে আসবে। কিম্বা ঘর গুনতে গুনতে সে কোথায় গিয়ে হারিয়ে যাবে, আর ফিরে আসার পথ পাবে না।

অনেকের সঙ্গে এ কবছরে আলাপ হয়েছে শওকতের। কারো নাম জানে। কারো জানে না। কারো সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে স্মরণশক্তির বরাত ফ্লোরে হয়তো চেহারা দেখে চিনে ফেলে। এ বাড়ির ভাড়াটে। দু একটা কুশল সংবাদ বিনিময়। তারপর দুমাস নমাস আবার চার চক্ষুর মিলন হলো। তখন হয়তো চেনার চেষ্টা করেও বার বার ভুল হয়?

দুয়ারে পায়ের শব্দ হতে ঘুরে তাকালো শওকত। মার্থা গ্রাহাম ভেতরে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরে রাখা পিরিচে এক টুকরো পাউরুটি।

ব্যাপার কি, অন্ধকারে বসে আছেন? মার্থা অবাক হলো। ঘরের কোণে রাখা হ্যারিকেনটা তুলে এনে শওকতের কাছ থেকে কাকি চেয়ে নিয়ে ঘরে আলো জ্বালালো মার্থা।

হারিকেনটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে বললো, রুটিটা খেয়ে নিন।

হাতমুখ ধুয়ে অনেকটা সজীব হয়ে এসেছে মার্থা। পায়ের রঙটা কালো তেলতেলে। টানা টানা একজোড়া চোখ, হাল্কা ছিমছাম দেহ। তাকালে মনেই হয় না যে ওর বয়স তিরিশের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে কালো মুখের ওপরে পাউডারের হাল্কা প্রলেপ বুলিয়েছে সে। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ লাল লিপিস্টিক। হাত কাটা একটা গাউন পরেছে মার্থা। সোনালি চুলগুলো কাঁধের দুপাশে ছড়ানো। প্লেট থেকে রুটির টুকরোটা ওর হাতে তুলে দিয়ে মার্থা আর বললো চাকুরির কোন খোঁজ পেলেন?

না।

সেই ওষুধের কোম্পানিতে যাওয়ার কথা ছিলো আজ দুপুরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

ওরা কি বলো?

বললো, লোক নিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। শওকত এক দৃষ্টিতে হ্যারিকেনটার সলতেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মার্থা তার হাতের নখগুলো চেয়ে চেয়ে দেখলো। বাইরে বারান্দায় খুক করে শব্দ হতে সেদিকে ফিরে তাকালো মার্থা।

কয়েক জোড়া সন্ধানী দৃষ্টি জানালার পাশ থেকে অন্ধকারে আত্মগোপন করলো। হারিকেনের আলোয় দাঁড়ানো মার্থা মৃদু হাসলো। তারপর সামনে ঝুঁকে পড়ে চাপা স্বরে বললো। একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন নাতো?

শওকত মুখ তুলে তাকালো এর দিকে, বলুন।

মার্থা ইতস্তত করে বললো। যতদিন চাকরি না পান, আমার ওখানে খাবেন। কি দরকার শুধু শুধু দুটো চুলো জ্বালিয়ে?

শওকত সহসা কোন জবাব দিতে পারলো না।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মার্থা আবার বললো, আমি এখন চলি, দেরি হলে আবার রাতকানা লোকটা বেঁকিয়ে উঠবে। আপনি কি বাইরে বেরুবেন?

না, শওকত আস্তে করে জবাব দিলো।

একটু পরে শূন্য পিরিচটা হাতে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মার্থা। বলে গেলো, ওই কথা রইলো কিন্তু। শেষে ভুলে যাবেন না।

ও চলে যাবার পর অনেকক্ষণ একঠায় বসে রইলো শওকত। মার্থাকে নিয়ে চিন্তে করলো। সেই কবে, কতদিন আগে আজ মনেও নেই। হয়তো সাত-আট বছর হবে। কিন্তু এগারো-বারো দেখতে তখন আরো অনেক সুন্দরী ছিলো মার্থা। রোজ সন্ধেবেলা বেকারিতে রুটি কিনতে আসতো। তখন থেকে ওকে চেনে শওকত। সেই সময় ওর সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। মাঝে মাঝে মাকে সঙ্গে নিয়ে আসতো মার্থা। সে এক দজ্জাল শহিলা। মার্থা কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। বলে, না মায়ের মনটা ছিলো ভীষণ নরখ। আপনারা তাকে খুব কাছে থেকে দেখেন নি কিনা তাই চিনতে ভুল করেছেন। আসলে কি জানেন, আমার মায়ের জীবনটা বড় দুঃখ কেটেছে। ভরা যৌবনে, মানে সেই যুদ্ধের শেষের দিকে মা হঠাৎ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে এক নিগ্রোকে বিয়ে করে বসলেন। আমার বয়স তখন বারোতে পড়ি পড়ি করছে। মা আমাকে ত্যাগ করলেন না। সঙ্গে নিয়ে রাখলেন। আর এই নিগ্রোটা, বুঝলেন? অদ্ভুত লোক ছিলো সে। মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। দূর থেকে কতদিন আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। মাঝে মাঝে মনে হতো, মার বয়স বুঝি আমার চেয়েও কমে গেছে। মা ঘরময় ছুটোছুটি করতো। গলা ছেড়ে হাসভা। অকারণে বিছানায় গড়াগড়ি দিতো আর হঠাৎ কখনো কি খেয়াল হতো জানি না, দৌড়ে এসে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় সারা মুখ ভরে দিতো আমার। একদিন একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিলো। এখনো বেশ স্পষ্ট মনে আছে আমার। সেদিন, জানি না কি একটা সুখবর ছিলো। আমি বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, সেই নিগ্রোটা মাকে দুহাতে কোলে তুলে নিয়ে ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে। আমাকে দোরগোড়ায় দেখতে পেয়ে মা ভীষণ লজ্জা পেলো। চাপা স্বরে বললো, আহ কি করছো। ছেড়ে দাও? মার্থা দেখছে সব। আহ, ছাড়ো না! মার্থা।

নিগ্রোটার কিন্তু কোন ভাবান্তর হলো না। সে একবার শুধু ফিরে তাকালো আমায় দিকে, তারপর মাকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। মা তার কোলের মধ্যে চটি করে বসে লজ্জায় রাঙা মুখখানা আমার থেকে আড়াল করে বললো, ছিঃ মেয়েটা কি ভাবছে বলতো।

নিগ্রোটা কিছু বলালো না। শুধু ভেতর থেকে দরাটা অঙ্ক করে দিলো।

তারপর।

কি আশ্চর্য। একদিন সকালে নিগ্রোটা তার কাজে বেরিয়ে গেলো। আর ফিরলো না।

একদিন। দুদিন এমনি করে একটি মাস, একটা বছর কেটে গেলো। যে গেলো সে আর এলো না। মা কান্নাকাটি করলেন। গির্জায় গিয়ে কতবার কত নামে যিশুকে ডাকলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। পরে একদিন শুনলাম, সেই নিগ্রোটা তার দেশে, তার ছেলেমেয়ে আর বৌয়ের কাছে ফিরে গেছে।

সেই থেকে মা যেন কেমন বদলে গেছেন। আর সব কিছুতেই আমাকে সন্দেহ করতে লাগলেন তিনি। আমি কোন ছেলের সঙ্গে একটু হেসে কথা বলতে গেলে তিনি ভীষণ রাগ করতেন। যেন আমি মস্ত বড় একটা অন্যায় কাজ করে ফেলছি এমনি একটা ভাব করতেন তিনি।

হ্যাঁ, তাই যেদিন ওর মা সঙ্গে আসতো, সেদিন একেবারে চুপটি করে থাকতো মার্থা। কারো সঙ্গে কথা বলতো না। কোনদিকে তাকাতো না। আর যেদিন সে একা আসতো, সেদিন ওকে দেখে অবাক হতো সবাই। হাসছে। কথা বলছে। গুনগুন করে গানের কলি ভজছে। আর দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক।

তারপর একদিন এক অক্সেন ওয়ালার ছেলে পিটার গোমেসের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলো ওর। ভিক্টোরিয়া পার্কে গির্জায় অনেক আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে পিটারের হাতে বিয়ের আংটি পরিয়ে দিলো মার্থা গ্রাহাম।

তখন ওর চেহারায় অন্য এক জীবনের চমক এসেছে। স্বামীকে নিয়ে মার্কেটিংয়ে বেরোয় মার্থা। সিনেমায় যায়, রেস্তোরাঁয় খায়। রাতে বল নাচে।

কিছুদিনের মধ্যে বেশ মুটিয়ে গেলো মার্থা। তারপর অনেকদিন ওর কোন খোঁজ পায়নি শওকত মাঝে একবার শুনেছিলো, একটা মৃত সন্তান প্রসব করেছে সে। ঢাকা ছেড়ে চাটগয়ে আছে স্বামীর সঙ্গে।

এর মধ্যে একদিন বেকারিতে রুটি কিনতে এসে হু হু করে কেঁদে উঠলেন মার্থার মা। হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে রেখে বোকার মতো ওর দিকে চেয়েছিলো শওকত। মার্থা মারা গেছে।

আমার মেয়ে মার্থা, ও আর বেঁচে নেই। ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে চোখ মুছলেন তিনি। রুমাল ভিজে গেলো কিন্তু অর অবাঞ্ছিত বন্যা থামলো না।

হারিকেনের সলতেটা আরো কমিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো শওকত।

নিচের সেই কলহ এখন থেমে গেছে। যার যার ঘরে ফিরে গেছে ওরা। নেড়ি কুত্তা দুটো উঠোনের এক কোণে যেখানে কয়েক জন জুয়াড়ি তাসের আসর জমিয়ে বসেছে সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

একটা চোখ বন্ধ করে দিয়ে আরেক চোখের খুব কাছে এগিয়ে এনে সাবধানে তাস দেখছে খলিল মিস্ত্রী। কেউ যদি দেখে ফেলে সেই ভয়ে। সব কিছুতে অমনি সাবধানতা গ্রহণ করে সে। রোজ সকালে যখন কাজে বেরিয়ে যায় তখন বাইরে থেকে ঘরে তালা দিয়ে যায় খলিল মিস্ত্রী। বউ ভিতরে থাকে। রাতে বাইরে থেকে আসার সময় ঠোঙায় করে বউয়ের জন্যে সন্দেশ নিয়ে আসে খলিল। ওর চোখেমুখে আনন্দের চমক। তালা খুলে ঘরে ঢুকে বউকে অনেক আদর করে খলিল মিস্ত্রী। কাছে বসিয়ে সন্দেশ খাওয়ায়।

বুড়ো আহমদ হোসেন বলে, এটাও একটা রোগ, বুঝলে? এক রকমের ক্ষুধা। একজনকে অনন্তকাল ধরে একান্ত আপন করে পাওয়ার অশান্ত ক্ষুধা। ঈর্ষা থেকে এর জন্ম। ঈর্ষার এর মৃত্যু। এ ব্যাটারা কবিতা পড়ে না বলেই এদের এই অধঃগতি। মনে নেই সেই কবিতাটা? সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। আবার সেই হাসি। কালচে দাঁতের ফাঁকে হাসছে বুড়ো আহমদ হোসেন।

শওকত দেখলো, তিনটে তাসকে পরম যত্নে হাতের চেটোর মধ্যে আঁকড়ে ধরে খুঁটিয়ে দেখছে খলিল মিস্ত্রী। সে যদি জানতো, যে লোকটি তার পাশে বসে তাস খেলেছে; যার সঙ্গে দিনের পর দিন সে হাসি-ঠাট্টা আর কৌতৃকে মশগুল হয়ে পড়েছে, সে লোকটা আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে সিঁড়ির নিচে তার বউকে নিয়ে শুয়েছিলো। সে যদি জানতো, যে। তালা দিয়ে সে তার বউকে রোজ বন্ধ করে যায় তার আরেকটা চাবি এর মধ্যে তৈরি হয়ে। গেছে, তাহলে?

খলিল মিস্ত্রী এর কিছু জানে না। হয়তো কোনদিন জানবেও না। তার অজ্ঞানতা তাকে শান্তি দিক।

নিচে, থিয়েটার কোম্পানির ছেলেমেয়েরা গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজিয়ে নাচের মহড়া দিচ্ছে। কয়েকটা ছেলে-বুড়ো-মেয়ে এসে জুটেছে সেখানে। মহড়া দেখছে। হাসছে। কথা বলছে।

বেশ আছে ওরা। শওকত ভাবলো।

বউ-মারা কেরানিটা উঠোন পেরিয়ে উপরে আসছে। রোজকার মতো আজও দেশি মদ গিলে এসেছে সে। পা টলছে। ঠোঁট নড়ছে। পরনের পাঞ্জাবিটা পানের পিকে ভরা। শওকতের গা ঘেঁষে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর পরের-অনুচ্ছেদটুকু অনায়াসে অনুমান করে নিতে পারে শওকত।

বউ-মারা কেরানিটা ধীরে ধীরে তার ঘরে ঢুকবে। কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া যাবে। তারপর হঠাৎ তার রুগ্ন বউটির কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে। বালিশে মুখ চেপে কাঁদবে সে।

তাসের জুয়ো যেমনি চলছিলো, তেমনি চলবে।

নাচের মহড়া থামবে না।

মাওলানা সাহেব বারান্দায় বসে একমনে তছবি পড়ে যাবেন।

শুধু উঠোনে বসে থাকা নেড়ি কুত্তা দুটো উপরের দিকে ঘেউ ঘেউ করবে। আর বাইরের রকে বসা কুষ্ঠ রোগীটার দু চোয়ালের ছিদ্র দিয়ে একটানা লাভা ঝরবে।

নির্লিপ্ত রাত্রির নীরবতায় শিহরণ তুলে রুগ্ন বউটি আরো অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে। তারপর যখন তার কান্না বন্ধ হয়ে যাবে, তখন রাতকানা লোকটার দোকান-ঘরে তালা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে মার্থা। মার্থা গ্রাহাম। মায়ের দেয়া নাম।

আলনা থেকে ময়লা জামাটা নামিয়ে নিয়ে পরলো শওকত। শুকনো চুলের ভেতরে আঙ্গুলের চিরুনি বুলিয়ে নিলো। বাইরে বেরুবে সে। গন্তব্যের কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।

হয়তো একবার সেই পুরানো বেকারিতে যাবে। কিম্বা, লঞ্চ কোম্পানির অফিসে না হয় গুজরাটী সাহেবের ওষুধের দোকানে।

একটা চাকুরি ওর বড় দরকার। ভাবতে গিয়ে নিজের মনে স্নান হাসলো শওকত। গত উনিশ বছর ধরে অনেক চড়াই উত্রাই পেরিয়েও এখনো জীবনের একটা স্থিতি এলো না। প্রথমে খিদিরপুরের জাহাজ ঘাটে, তারপর এক বাঙালি বাবুর আটা-কলে। মাঝে কিছুকাল একটা রেলওয়ে অফিসে! হাইল ক্লার্ক। তারপর কোন এক নামজাদা রেস্তোরাঁ কাউন্টারে। ছমাস। সেটা ছেড়ে এক মলম কোম্পানির দালালি করেছে অনেক দিন। এক শহরে থেকে অন্য শহরে। ট্রেনে, টমাৱে। এরপর বছর দুয়েক জনৈক সূতো ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাজ করেছে শওকত। তারপর আগাখানী আহমদ ভাইয়ের আধুনিক বেকারিতে। ওখানে বেশ ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে পারলো না। ছেড়ে দিয়ে একটা আধা সরকারী ফার্মে টাইম ক্লার্কের চাকুরি নিলো শওকত। দশটা-পাঁচটা অফিস। মন্দ লাগতো না। কিন্তু ফাটা কপাল। বেতন বাড়ানোর ব্যাপার নিয়ে একদিন বড় সাহেবের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেলো। আর তার খেসারত দিতে গিয়ে সাত দিনের নোটিশে সে অফিস ছাড়তে হলো। সেই থেকে আবার বেকার।

ঘর থেকে বারান্দায় পা দিতেই একজন মোটা মহিলা ঝাড় হাতে চিৎকার করতে করতে সামনে দিয়ে জুটে গেলো। একটা বাচ্চা ছেলেকে তাড়া করছে সে। একটা বিড়াল ওদের পিছু পিছু দৌড়চ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার বাকে তিন হাত উঁচুতে দুপাশে দুটো জানালা। একটা জানালা থেকে আরেকটা জানালায় কে যেন এক টুকরো কাগজ ছুঁড়ে দিলো। সেটা যথাস্থানে না পোঁছে শওকতের সামনে এসে পড়লো। একেবারে পায়ের কাছে।

মুখ তুলে উপরে তাকালো শওকত।

স্কুল মাস্টার মতিন সাহেবের মেয়ে জাহানারা জানালার পেছন থেকে মুখ বের করে তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মুখটা সরিয়ে নিলো।

আড়চোখে অন্য জানালার দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শওকত।

আজমল আলীর ছেলে হারুন ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে দিলো।

সিঁড়ি থেকে কাগজের টুকরোটা হাতে তুলে নিলো শওকত! খুলে দেখলো একখানা চিঠি।

মেয়েলী হাতের গুটি গুটি লেখা। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ছাদে এলো। অনেক কথা আছে। দেখা হলে সব বলবো।

চিঠিখানা ধীরে ধীরে আবার বন্ধ করলো শওকত। উপরে চেয়ে দেখলো, জাহানারার অর্ধেকটা মুখ আর একজোড়া ভয়ার্ত চোখ অধীর আগ্রহে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে!

চিঠিটা বন্ধু জানালার কার্নিশে রেখে দিয়ে নিচে নেমে গেল শওকত। করিডোরে একটা বাচ্চা ছেলে টা টা করে কাঁদছে। ঝাড়ু হাতে মহিলা গজ গজ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে উপরের দিকে। বিড়ালটা এখনো ওর পিছু পিছু চলেছে।

মার্থার ঘরের দরজায় ছোট্ট একটা তালা ঝুলছে। সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সে। আজ দু বছর ধরে রাতকানা লোকটার ওষুধের দোকানে কাজ করছে সে। চাটগাঁয়ের খালেদ খান যেদিন তাকে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ফেলে পালিয়ে গেলো সেদিন চারপাশে অন্ধকার দেখেছিলো মার্থা।

এ চাকুরিটা পেয়ে বেঁচে গেছে সে।

মৃত মার্থা। তাকে দেখে প্রথম দিন চমকে উঠেছিলো শওকত।

কুড়ি একুশ বছরের একটা সুদর্শন ছেলের সঙ্গে এ বাড়িতে এসে উঠলো মার্থা। ঘর ভাড়া নিলো। স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দিলো সবার কাছে। বেশ ছিলো ওরা।

একদিন ওকে একা পেয়ে শওকত জিজ্ঞেস করলো। মার কাছ থেকে শুনেছিলাম আপনি মারা গেছেন। সামনে এখন ভূত দেখছি নাতো?

মা মার কথা বলবেন না। মার্থা ঐ কুকে বললো। নিজের ব্যাপারে সবাই অমন অন্ধ হয়। মা যখন বাবাকে ছেড়ে সেই নিগ্রোটার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো, তখন কোন অন্যায় হয়নি আর আমি গোমেসকে ছেড়ে মস্ত বড় পাপ করে ফেলেছি, তাই না?

ও! শওকত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো। তাহলে লোকে যা বলছে সব সত্যি।

কি?

আপনি এই ছেলেটিকে বিয়ে করেছেন।

না, বিয়ে এখনো হয়নি। হাবে। এখানে এসে থামলো না মার্থা! যেন তার মনের অনেক জমে থাকা কৃথা কারো কাছে ব্যক্ত করে হাল্কা হতে চাইছিলো সে। তাই বললো, মায়ের ইচ্ছেকে সম্মান দিতে গিয়ে গোমেসকে বিয়ে করেছিলাম আমি। মিথ্যে বলবো না, ওর সঙ্গে আমি সুখেই ছিলাম। আমি খা চাইতাম সব দিতো সে। যা বলতাম সব করতো। স্বামী হিসেবে ওর কোন দোষ আমি এখনো দিইনে। খালেদের সঙ্গে গোমেস নিজে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। একদিন রাতে এটা বল নাচের আসরে। বলতে গিয়ে থামলো মার্থা, মুহূর্ত কয়েকের জন্যে কি যেন চিন্তা করলো সে। তারপর হঠাৎ করে বললো। কি আশ্চর্য দেখুন তো, আপনারা সবাই আমাকে কালো বলে ক্ষ্যাপাতেন। মা বলতেন, আমার গায়ের রঙটা নাকি রীতিমত কুৎসিত। গোমেস অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুই বলতো না। আর খালেদ, ওর কথা কি বলবো আপনাকে, ও অতি বড় ভালোবাসে আমায়, নইলে আমার গায়ের এই কালো রঙের কেউ এত প্রশংসা করতে পারে? আমার চোখের মধ্যে ও কি পেয়েছিলো জানি না। বলতে গিয়ে ঈষৎ প্রজ্জা পেলো মার্থা। মুখখানা নামিয়ে নিয়ে বললো। ও বলতে। এত সুন্দর চোখ ও নাকি এ জীবনে দেখেনি। জানেন? রোজ একটা করে ও চিঠি দিতো আমায়, আর কোনদিল আমাকে একা কাছে পেলে এমন বাড়াবাড়ি করতো যে, আমি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম।

এরপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মার্থা বললো। আজ বিকালে এ আসুক আপনার সঙ্গে আলাপ করে দেবো।

তারপর। একমাস। দুমাস তিন মাস।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে সত্যি। কিন্তু মার্থার জীবনে তার মায়ের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অমন অবিকলভাবে ঘটে যাবে সে কথা মার্থা কেন শওকতও কোনদিন কল্পনা করতে পারে নি।

করিডোর পেরিয়ে উঠোন, গিজ গিজ করছে লোকে।

কেউ কাঠ কাটছে। কেউ থালাবাসন মাজছে। কেউ জুলো ধরিয়েছে। কেউ চান করছে।

বউ-মারা কেরানির মার খাওয়া বউটি কলের পাশে দাঁড়িয়ে। মাথায় একটা লম্বা ঘোমটা। যেন তার ক্ষতভরা মুখখানা সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখার জন্যে এটা অত লম্বা করে টেনে দিয়েছে সে।

থিয়েটার পার্টির একটি মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। ঘরের মধ্যে একটা পুরানো গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজাচ্ছে ওর সঙ্গীরা ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী। উঠোন পেরিয়ে সামনের করিডোরে এসে পড়লো শওকত।

বউ-মারা কেরানিটা বাজার থেকে ফিরছে।

জুয়াড়িদের একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো। মাছ কত দিয়ে কিনেছেন?

কেরানি জবাব দিলো, বারো আনা।

জুয়াড়ি বললো। খুব সস্তায় পাইলেন দেখি।

বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে নেমে এলো শওকত।

এক ফালি রোদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগীটা চুপচাপ বসে। হাত পায়ের নখ খুঁটছে আর পিটপিট করে তাকাচ্ছে চারপাশে। অদূরে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে মার্বেল নিয়ে খেলছে।

শওকত রাস্তায় নেমে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে তাতে আগুন ধরালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *