কলাবতী ও খয়েরি (১৯৯৯)

কলাবতী ও খয়েরি (১৯৯৯) – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৯৯ / আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ পৃ. ১১৮ / মূল্য ৪৫.০০। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় / উৎসর্গ: সুলেখক ডাঃ অনিরুদ্ধ ঘোষ স্নেহাস্পদে

খয়েরির সঙ্গে কলাবতীর পরিচয় হয় রাস্তায়। সেদিন স্কুল থেকে সে প্রতিদিনের মতো হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পিঠে স্কুলব্যাগ, তার মধ্যে টিফিন বক্স, কাঁধে ঝুলছে ওয়াটার বটল। সেদিন টিফিন বক্সটা খোলার তার দরকার হয়নি, খাবার যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। তাদের ক্লাসের মিঞ্চুর মা এন্তার পাটিসাপটা বাড়িতে তৈরি করেছিলেন, তারই অনেক পলিথিন ব্যাগে ভরে মিঞ্চু নিয়ে এসেছিল তাই খেয়েই কলাবতীর টিফিন করা হয়ে যায়।

দুপুরে টিফিনে পাউরুটি চিবোতে তার একদমই ভাল লাগে না। জেলি আর মাখন লাগানো রুটির স্লাইস সে প্রায় রোজই মিঞ্চুকে দিয়ে দেয়। পাউরুটি খেতে মিঞ্চুর খুব ভাল লাগে, স্কুল থেকে বাড়ি আসার পথে স্কুটার—মোটরবাইক সারাবার দোকানটার পাশে পাঁঠার মাংসের একটা দোকান, তার পেছনে টিনের এবং টালির চালের অনেক বাড়ি। মাংসের দোকানের সামনে ফুটপাথে কয়েকটা ষণ্ডামার্কা কুকুরকে কলাবতী রোজই দু’বেলা দেখে, ওরা রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকজনের দিকে ফিরেও তাকায় না। বেশ নিরীহ বলেই মনে হয়। তবে দোকান থেকে হাড় বা মাংসের ছাল ছুড়ে দিলে সেটা খাওয়ার জন্য ওরা নিজেদের মধ্যে তুলকালাম ঝগড়া ও কামড়াকামড়ি শুরু করে দেয়।

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় কলাবতী ওই কুকুরগুলোর থেকে একটু তফাতে নতুন একটি কুকুরকে বসে থাকতে দেখল। তার রং খয়েরি কিন্তু মাথার তালুর লোম সাদা, খুবই রুগণ, কোমরের ও বুকের হাড় প্রকট। মাংসওলা একটা ছোট হাড় ওর দিকে দয়াপরবশ হয়ে ছুড়ে দিল। সে হাড়টা মুখে নিতে যাচ্ছে তখন দুটো ষণ্ডা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। তাকে ফুটপাথে ফেলে একটা কুকুর ঘাড় কামড়ে দিতেই সে পরিত্রাহি আর্তনাদ তুলে লেজটা দু’পায়ের ফাঁকে গুটিয়ে ছুটে পালাল সেইদিকে যেদিকে কলাবতী যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে কলাবতী সব লক্ষ করল। তার মনে হল, কুকুরটা বোধ হয় অন্য এলাকার, খিদের জ্বালায় এই এলাকায় খাবার খুঁজতে এসেছিল। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে কুকুরটিকে আবার দেখতে পেল সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে ফেলে দেওয়া মালসা থেকে দই চেটে খাচ্ছে। বেচারা! নিশ্চয় সারাদিন খাওয়া জোটেনি।

কলাবতী দাঁড়িয়ে পড়ল। স্কুলব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বার করে তাই থেকে মাখন লাগানো পাউরুটির দুটো স্লাইস নিয়ে হাতে ধরে ওকে ডাকল, ”আয় আয়” বলে জিভ দিয়ে ”চুক চুক” শব্দ করল। কুকুরটি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। কলাবতীর মনে হল, ও বিশ্বাস করতে পারছে না মাখন লাগানো রুটি নেওয়ার জন্য তাকেই ডাকা হচ্ছে। কলাবতী আবার ডাকল। এবার সে ছোট্ট করে ল্যাজ নাড়ল। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা ‘কুঁই’ শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বোধ হয় বুঝতে পেরেছে তাকেই খেতে ডাকছে। কিন্তু তাই বলে মাখন—রুটি! তার অবিশ্বাসের ঘোর তখনও কাটেনি। কলাবতী দু’পা এগিয়ে গেল। ”আয়, আয়,” মিষ্টি নরম স্বরে সে আবার ডাকল।

কয়েকজন পথিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চলে গেল। একজন যেতে যেতে মন্তব্য করে গেল, ”মানুষ খেতে পায় না, কুকুরকে খাওয়াচ্ছে!” কথাটা কানে যেতেই তার মাথা গরম হয়ে উঠল। লোকটা দূরে চলে গেছে নইলে সে বলত, ”মানুষ তো তার নিজের খাবার ভিক্ষে করেও জোগাড় করে নিতে পারে। কিন্তু কুকুর কি তা পারে?”

কলাবতী আরও দু’পা এগিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। কুকুরটি দুটো কান ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে মুখটা নামিয়ে ঘন ঘন লেজ নাড়তে লাগল! কলাবতী একটা স্লাইস ওর মুখে ঠেকাল। কপ করে সেটা কামড়ে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে ফেলল এবং দুই ঢোকে গিলে নিল। অন্য স্লাইসটারও একই অবস্থা হল। টিফিন বক্সে আছে আপেল আর ছানা। কুকুর আপেল খায় কিনা কলাবতীর জানা নেই। ছানা বোধ হয় খেতে পারে, এই ভেবে সে মুঠোয় ছানা নিয়ে খয়েরির মুখের সামনে ধরল। একবার গন্ধটা শুঁকে নিয়ে তার তালু থেকে ছানা খেয়ে তালুটা চেটেও দিল। সুড়সুড়ি লাগতে কলাবতী মজা পেয়ে হাত বাড়িয়ে রইল, খয়েরি আরও তিন—চারবার চাটল। টিফিন বক্স কিছুটা হালকা করতে পেরে সে স্বস্তি পেল। বক্স খুলে অপুর মা যদি দেখে সে টিফিন খায়নি তা হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার গজগজানি থামবে না।

কুকুরটিকে পাউরুটি আর ছানা খাইয়ে কলাবতী বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন রেকর্ডে ছাপমারা কুকুরটির মতো দুটো পা সামনে রেখে উবু হয়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কলাবতীকে তাকাতে দেখে সে লেজ নেড়ে উঠে দাঁড়াল, কিছুটা গিয়ে কলাবতী আবার মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল কুকুরটি তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু আসছে। বাড়ির ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাগান পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলাবতী ফটকের দিকে তাকিয়ে রইল, সাত—আট সেকেন্ড পরে কুকুরটি ফটকের সামনে এসে হাজির হয়ে ভেতর দিকে তাকিয়ে কলাবতীকে দেখতে পেয়ে লেজ নেড়ে যেতে লাগল কিন্তু ভেতরে ঢুকল না।

”ভাগো এবার।” চেঁচিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত নেড়ে চলে যেতে বলল, ”অনেক দিয়েছি, আর দিতে পারব না।”

কলাবতী বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল, দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মুরারি। সে বলল, ”কাকে কী দিতে পারবে না কালুদি?” কলাবতী বলল, ”একটা কুকুরকে, খাবার।… দ্যাখো তো মুরারিদা, এখনও গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিনা, খয়েরি রঙের।” উঁকি দিয়ে দেখে মুরারি বলল, ”কই কেউ নেই তো!”

”খয়েরি” শব্দটি মুখ থেকে বেরোতে তখনই কলাবতী মনে মনে নামকরণ করে ফেলে— খয়েরি!

এইভাবেই খয়েরির সঙ্গে কলাবতীর প্রথম আলাপ। পরদিন স্কুলে টিফিন খাওয়ার সময় কলাবতীর মনে ভেসে উঠেছিল খয়েরির ক্ষুধার্ত চাহনি। আর খাবার পেয়ে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকার ছবিটা। সে পাউরুটির দুটো স্লাইস না খেয়ে রেখে দেয় যদি আবার দেখা হয় রাস্তায় তা হলে খেতে দেবে।

আবার তাদের দেখা হল সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে। উবু হয়ে বসে ছিল খয়েরি, তাকে দেখেই লেজ নাড়ল। কলাবতী ওকে না—দেখার ভান করে পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। মুখটা সামান্য ফিরিয়ে আড়চোখে দেখল খয়েরি বসেই আছে এবং তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। কলাবতী ঘুরে তাকাল। খয়েরিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এগোবে কি এগোবে না, ইতস্তত করছে। তারপর অনুভূতি থেকে কী বুঝল খয়েরি প্রায় পা টিপে টিপে কলাবতীর দিকে এগিয়ে এল। কলাবতীর ভাল লাগল ওর কাছে আসাটা। একটা পশু তাকে ভাল লোক হিসেবে বুঝেছে বলেই তো তার কাছে আসছে। ওরা মানুষ চেনে। স্বার্থপর, নিষ্ঠুর লোক দেখলে পশুপাখি দূরে সরে যায়। দাদুর কাছে শুনেছে মানুষের থেকে ওদের নাকি একটা বাড়তি ইন্দ্রিয় আছে, খয়েরিরও তা হলে আছে।

খয়েরি কলাবতীর কাছে এসে মুখ তুলে লেজ নাড়তে লাগল। তার মনে হল খয়েরি যেন বলছে, ”তোমার ওই ব্যাগের মধ্যে কৌটোটায় কিছু আছেটাছে নাকি? থাকলে বার করো না, খুব খিদে পেয়েছে।” কলাবতী বলল, ”এখানে দেব না, আয় আমার সঙ্গে।” এই বলে কলাবতী বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার পিছু নিল খয়েরি।

কলাবতীর মজা লাগল একটা কথা ভেবে, তার মনে হচ্ছে, কুকুরের মনে মনে বলা কথা সে বোধ হয় বুঝতে পারে। নয়তো ”এখানে দেব না’ বলে হাঁটতে শুরু করামাত্র খয়েরি তার পিছু নিল কেন! সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল, খয়েরিও তার কথা বুঝতে পারে। বোঝাপড়াটা হল খাওয়ার অর্থাৎ পেটের টানে।

ফটকের কাছে এসে কলাবতী রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাড়ির দিকে তাকাল কেউ তাকে দেখছে কিনা দেখার জন্য। অপুর মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফটকের দিকে আসছে, হাতে ঝুলছে বাজার করার প্লাস্টিকের ব্যাগ।

কলাবতী বলল, ”চললে কোথায় অপুর মা?”

ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অপুর মা দশাসই মাঝবয়সী বিধবা। অপু তার একমাত্র ছেলে। কলাবতীদের আটঘরাতেই দেশ। দেশের বাড়িতে অপু থাকে মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে। অপুর মার ভাগের পুকুর, সামান্য জমিজমা তারাই ভোগ করে। এই বাড়িতে সে যা মাইনে পায় সবই দেশে পাঠিয়ে দেয়। মাতৃহারা কলাবতীকে কোলেপিঠে না হোক যত্নে ও যতদূর সম্ভব শাসনে সে দেখাশোনা করে। রান্নাঘরটা অপুর মা’র নিজস্ব সাম্রাজ্য। অসম্ভব সুস্বাদু তার রান্নার হাত। প্রথম প্রথম মুরারি রান্নার বিষয়ে তাকে অযাচিত পরামর্শ দিতে গিয়ে এমন দাবড়ানি খেয়েছিল যে, সঙ্গে সঙ্গে রাজশেখরের কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে নালিশও করেছিল।

”কত্তাবাবু আপনার দেশের এই মেয়েটার জিভ বড্ড খরখরে। বললুম ধোঁকায় অত লঙ্কাবাটা দিস না। তা কী বলল জানেন, এ—বাড়ির লোকের কার কেমন জিভের তার আমার জানা আছে। এই বলে আরও এক খাবলা লঙ্কাবাটা দিয়ে বলল, এটা ছোটবাবুর জন্য। কর্তাবাবু আজ রাতে আপনাদের কিন্তু ঝালের চোটে বাপরে মারে বলে টেবিল থেকে উঠে পড়তে হবে। রসগোল্লা কিনে এনে রেখে দেব?”

”কিনবি?” রাজশেখর সেকেন্ড দশেক চিন্তা করে বললেন, ”আটঘরার মেয়ে, ঝালের হাত একটু বেশি তো হবেই, তবে কি জানিস আটঘরার লোকেরা ঝাল একটু বেশিই খায়, তেমনই মিষ্টিটাও। ঠিক আছে, রসগোল্লা এনে রাখ।”

”কতটা আনব?”

”আমার আর কালুর জন্য গোটা আষ্টেক আর সতুর জন্য কুড়িটা হলেই চলে যাবে।”

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবলে রান্না করা খাবার রেখে অপুর মা ঘরের বাইরে সিঁটিয়ে থেকে দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইল। মুরারিদা তাকে রসগোল্লাভরা মালসা দেখিয়ে বলেছে, ”এই দ্যাখ, তোর ধোঁকা খেয়ে সবাই যখন বাবাগো—মাগো করবে তখন এটার দরকার হবে।”

ধোঁকার ডালনার বাটি থেকে চৌকো একটা খণ্ড তুলে প্রথমে সত্যশেখর দাঁতে একটা টুকরো ভেঙে মুখে পুরল। কয়েকবার চিবোল। দুটো চোখ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। রাজশেখর তার মুখের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, মুরারি এবং কলাবতীও।

রাজশেখর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ”সতু খুব ঝাল কি? রসগোল্লা আছে খাবি?”

সত্যশেখর ধোঁকার বাকিটুকু মুখে পুরে চোখ বুজে চিবোতে—চিবোতে মাথা নাড়তে লাগল, ”ফাসক্লাস, ফাসক্লাস, কালু খেয়ে দ্যাখ। বাবা একটা মুখে দাও, ডিলিসাস। কতদিন পর যে রান্নার মতো একটা রান্না খাচ্ছি।” বলতে বলতে সত্যশেখর একটা আস্ত ধোঁকা মুখে চালান করল।

কলাবতী তখন খুবই ছোট, কাকার দেখাদেখি সেও ধোঁকায় কামড় দিয়ে মন্তব্য করল, ”ঝাল কোথায়! এ তো আমাদের বিরিঞ্চির ঘুগনি আর লালু প্রসাদের আলুকাবলির মতোই।” কথাটা শুনে সত্যশেখর ভাইঝির দিকে সপ্রশংস চোখে তাকায়।

মুরারি ব্যাজার মুখে খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়েই পড়ল অপুর মা’র সামনে। উদ্বিগ্ন স্বরে সে জানতে চাইল, ”হ্যাঁগো মুরারিদা, ছোটবাবু যে ফাসক্লাস ফাসক্লাস বলল, কথাটার মানে কী?”

”মানে, জঘন্য জঘন্য।” মুরারি মুখবিকৃত করে মানেটা আরও স্বচ্ছ করে বুঝিয়ে দিল।

অপুর মা ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল, ”ওম্মা ছোটবাবু তো সবটাই খেয়ে নিল।”

সিংহি বাড়িতে লোকজন কম, কেউ গলা চড়িয়ে কথা বলে না তাই শান্ত শব্দহীন থাকে কিন্তু এর পর থেকে অপুর মার দাপুটে গলা একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত মাঝে মাঝে পৌঁছতে লাগল।

.

এহেন অপুর মা সেদিন প্লাস্টিকের বাজার করার ব্যাগ হাতে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় স্কুল—ফেরত কলাবতীর মুখোমুখি হয়ে পড়ল। কলাবতী একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিল খয়েরি কোথায়, তারপর বলল, ”অপুর মা, এমন সময় কোথায় যাচ্ছ?”

”ছোটবাবু টেলিফোন করে বলল, অপুর মা কাবলে ছোলার ঘুগনি খাব, বিরিঞ্চির থেকেও বেশি ঝাল দিয়ে। ঘরে তো কাবলে ছোলা নেই, মুরারিদা যে কোথায় গেছে দুপুর থেকে, যাই আমিই কিনে আনি। ওম্মা এ কুকুরটা কোথা থেকে এল!” কলাবতীর পাশে এসে দাঁড়ানো খয়েরিকে দেখে অপুর মা বলল। তার স্বরে প্রশয়ের আভাস পেয়ে কলাবতী উৎসাহিত হয়ে বলল, ”দ্যাখো না, কাল ওকে আমার টিফিনটা খাইয়েছি, আজও আমার পিছু নিয়েছে, আজও ওর চাই।”

”টিফিনটা খাইয়েছ মানে? তুমি খাওনি?”

অপুর মার স্বরে ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে কলাবতী ঢোক গিলে বলল, ”অত অত টিফিন দিলে কি সব খাওয়া যায়, একটু পড়ে ছিল সেটাই দিয়েছি। রোজ রোজ পাউরুটি—মাখন কি ভাল লাগে? কাল বরং ঘুগনি দিও।”

”তা দেব, এখন এটাকে কী খেতে দেবে?”

”কিচ্ছু না। অ্যাই ভাগ ভাগ।” কলাবতী ফুটপাথে’ক্রুদ্ধভাবে পা ঠুকে এগিয়ে গেল খয়েরির দিকে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে খয়েরি দাঁড়িয়ে রইল। লেজটা নড়ছে। জেনে ফেলেছে কলাবতীর রাগটা নকল।

”ও এখন তোমায় ছাড়বেনি। রান্নাঘরে বাসী রুটি আছে, তাই দুটো এনে দাও।” এই বলে অপুর মা মুদির দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

অপুর মা একটু দূরে যেতেই কলাবতী ”আয়।” বলে ফটক পার হয়ে পাঁচিলের ধারে লুকিয়ে দাঁড়াল। খয়েরি ফটকের সামনে এসে ভেতর দিকে তাকিয়ে কলাবতীকে দেখতে না পেয়ে মৃদু স্বরে ”ভুক ভুক” শব্দ করে উবু হয়ে বসে পড়ল। মিনিটখানেক পরে কলাবতী উঁকি দিল। খয়েরি তাকে দেখতে পেয়েই ”ঘৌওউওউ” করে ডেকে উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে শুরু করে দিল।

”ভেতরে আয়।” কলাবতীর ডাক শুনেও খয়েরি ইতস্তত করল। ”আয় আয়, ভয় কী। এই দ্যাখ,” কলাবতী স্কুলব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বার করে বাগানের চাঁপা গাছের তলায় ঘাসে বসল।

মাথা নিচু করে পায়ে পায়ে খয়েরি এই প্রথম ফটক পার হল। গুটি গুটি সে কলাবতীর সামনে এল। মাখন লাগানো পাউরুটি খপ করে কামড়ে ধরে কোঁৎ কোঁৎ করে দুই ঢোকে পেটে চালান করে দিল। পরের পাউরুটির টুকরোটা কামড়ে ধরে ঘাসে উপুড় হয়ে পা দুটো সামনে ছড়িয়ে টুকরোটা দুই থাবায় চেপে ধরে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে খেল।

জিভটা দুই ঠোঁটে চাটাচাটি করে খয়েরি আরও কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল। কলাবতী বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল, ”আর তো কিছু নেই, এবার কেটে পড়ো, তবে বাসী রুটি যদি খেতে চাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকো, আমি এনে দিচ্ছি। তার আগে তুমি আমার আপেল খাওয়া দ্যাখো।”

টিফিন বক্সে ছিল চার টুকরো করে কেটে রাখা একটা আপেল। এই ফলটি খেতে একদমই তার ভাল লাগে না। কিন্তু দাদুর নির্দেশ, ”আপেল মাস্ট। দারুণ ভিটামিন আছে।” কলাবতী আমতা আমতা করে বলেছিল, ”বড়দি বলেছেন ডাঁসা পেয়ারায় আপেলের থেকেও ভিটামিন বেশি আছে।”

বড়দি অর্থাৎ আটঘরার সিংহিদের বংশপরম্পরা প্রতিদ্বন্দ্বী (এবং এখনও) পাশের গ্রাম বকদিঘির জমিদার হরিশঙ্কর মুখুজ্জের একমাত্র মেয়ে মলয়া, যে ডক্টরেট করতে অক্সফোর্ডে যায়। (তখন সত্যশেখরও ব্যারিস্টার হতে লন্ডনে ছিল), যে ডক্টর হয়ে ফিরে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজে অধ্যাপনা না করে কাঁকুড়গাছি উচ্চচ বালিকা বিদ্যালয়ে হেডমিস্ট্রেসের চাকরি নেয়। মাতৃহীনা কলাবতীকে অবিবাহিতা মলয়াই রাজশেখরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নিজের স্কুলে ভর্তি করায়।

কলাবতী সিংহকে হেডমিস্ট্রেস একটু বেশি স্নেহ করেন, শিক্ষিকা মহলে এমন একটা কথা চাউর হয়। কথাটা মলয়ার কানে পৌঁছতেই সে স্কুলে কলাবতীর যাবতীয় ব্যাপারে এত কড়া হয়ে যায় যে অ্যানুয়াল পরীক্ষার খাতা আনিয়ে নিজে স্ক্রুটিনি করে প্রতি সাবজেক্টে পাঁচ নম্বর কমিয়ে দিয়েছিল। গতবছর মলয়ার স্কুলের বিরাশিটি মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়, আশিজন ফার্স্ট ডিভিশন, একজনও ফেল হয়নি। পঞ্চাশটি স্টার পাওয়া স্কুলের বড়দির রংচটা অ্যাম্বাসাডার মোটরটা যখন কাঁকুড়গাছির মোড়ের আইল্যান্ডটা ঘোরে তখন ট্র্যাফিক হোমগার্ডও গাড়িটাকে স্যালিউট ঠুকে দেয়।

এহেন বড়দি বলেছে আপেলের থেকে পেয়ারায় ভিটামিন বেশি আছে। রাজশেখর কথাটার প্রতিবাদ না করে দোতলায় লাইব্রেরিতে চলে যান। খাদ্যের গুণাগুণ সম্পর্কিত গোটাদুয়েক বই খুলে পড়ে, কলাবতীকে জানান, ”হরির মেয়েটা অ্যাত সব জানল কী করে বল তো? ওদের তো মুখ্যুর বংশ।” রাজশেখর দু’চক্ষে হরিশঙ্করকে দেখতে পারেন না বটে কিন্তু মলয়া বা মলুকে স্নেহ করেন নিজের মেয়ের মতো।

কলাবতী আপেলের একটা টুকরোয় কামড় দিয়ে মুখবিকৃত করল, টক। মুখ থেকে টুকরোটা বার করে ঘাসে ছুড়ে ফেলতেই খয়েরি এগিয়ে গিয়ে সেটা মুখে পুরে চিবিয়ে খেয়ে নিল। কলাবতী তো অবাক। কুকুর মাংসাশী প্রাণী বলেই সে জানে। এরা যে নিরামিষভোজীও সেটা এবার জানল, আপেলের বাকি টুকরোগুলো সে ছুড়ে ছুড়ে দিল। খয়েরি চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিল।

দোতলার গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজশেখর যে অনেকক্ষণ ধরেই তাদের লক্ষ করে যাচ্ছিলেন, কলাবতী সেটা দেখেনি।

”কালু ওকে কোথায় পেলে?” রাজশেখরের গম্ভীর গলার প্রশ্নে কলাবতীর বুক দুরদুর করে উঠল। নিশ্চয় বকুনি দেবেন।

”আমার সঙ্গে সঙ্গে এল দাদু। ওর খুব খিদে পেয়েছিল তাই খেতে দিলুম। এই এবার ভাগ।” কলাবতী হাত তুলল। খয়েরি এক—পা পিছিয়ে গিয়ে আড়চোখে কলাবতীর দিকে দু’বার তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কলাবতী দোতলায় উঠে আসতেই রাজশেখর বললেন, ”এ বাড়িতে এই দ্বিতীয়বার কুকুর ঢুকল। তোর জন্মের আগে সতুর একটা আলসেশিয়ান ছিল, হিটলার। নামের মতো মেজাজটাও ছিল হিটলারি। সারারাত বাগানে ঘুরে বেড়াত। একবার একটা চোরের পিঠ থেকে কামড়ে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছিল। দিনের বেলায় একতলার সিঁড়ির নীচে চেন দিয়ে বাঁধা থাকত। তবু বাইরের লোক ঢুকতে ভয় পেত। সতু ছাড়া কাউকে গায়ে হাত দিতে দিত না। সেই চোরটার দলের লোকেরা, এই আমাদের পেছনেই মালোপাড়া বস্তিতে থাকে, প্রতিশোধ নিতে একদিন রাতে বিষমাখা মাংস খাইয়ে হিটলারকে মেরে ফেলল। সতু সাতদিন কিছু মুখে দেয়নি, বিছানায় শুয়ে ছিল। তারপর থেকে বছর পঁচিশ এ—বাড়িতে আর কুকুর পোষা হয়নি। হিটলারের এক বোন ছিল লিজা, এলিজাবেথ। তাকে নিয়েছিল মলয়া। এখন লিজার নাতনি আছে মুখুজ্জে বাড়িতে।”

কলাবতী বলল, ”হ্যাঁ দেখেছি, মঙ্গলা, খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের। ওকে আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু ওর দিদিমা না ঠাকুমা, হিটলারের বোন ছিল এটা তো জানতুম না।”

একটু পরেই অপুর মা ফিরল।

”কালুদি কুকুরটাকে রুটি দিয়েছ? দেখলুম ফটকের বাইরে পাঁচিল ঘেঁষে শুয়ে রয়েছে। বাব্বা, কী মেঘ করেছে! পশ্চিমের আকাশটা মোষের মতো কালো হয়ে গেছে।”

”সে কী!” কলাবতী ছুটে বারান্দায় ঘিরে আকাশ দেখে এসে বলল, ”পাঁচ মিনিট আগেও তো আকাশ পরিষ্কার ছিল। খুব ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। জানলাগুলো বন্ধ করে দাও শিগগির।”

মুরারি, অপুর মা, কলাবতী তিনজনে মিলে গোটা তিরিশ জানলা ও দরজা বন্ধ করতে—না—করতেই প্রবল ঝড় আছড়ে পড়ল বাড়িটার ওপর। মিনিটদশেক হাওয়ার মাতামাতি চলার পরই নামল তোড়ে বৃষ্টি। মিনিট কুড়ি পর হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট কমে এলে কলাবতী ছাতা মাথায় গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চাঁপাগাছের কচি ডালগুলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে আছে। রাস্তার ওপারে ডেকরেটরের দোকানের সাইনবোর্ড আর দুটো লাইট পোস্টে বাঁধা ওয়ান ডে নক আউট ফুটবল প্রতিযোগিতার ফেস্টুন ঝুলে রয়েছে। একটা পুরনো টিনের চালা কোথা থেকে উড়ে এসে বাগানে পড়েছে। টগরগাছটা পাঁচিলে ঠেস দিয়ে কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে।

কলাবতী গাড়ি বারান্দার পশ্চিম দিকে সরে গেল। বাগানের এই দিকটা বহু বছর ধরে অবহেলিত। একসময় রাজশেখরের একটা ফিটন ছিল। প্রায়ই তিনি স্ত্রী আর দুই ছেলে, কলাবতীর বাবা দিব্যশেখর ও সত্যশেখরকে নিয়ে বিকেলে গঙ্গার ধারে ফিটনে চড়ে হাওয়া খেতে যেতেন। বাগানের পশ্চিম দিকে ফিটন ও ঘোড়া রাখার জন্য পাকা একটা ঘর তৈরি করেছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ফিটন ও ঘোড়া বিক্রি করে দেন। ঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকতে থাকতে ওর অস্তিত্বটাই সবাই ভুলে যায়। বাগানের ওদিকটায় বহু বছর কেউ না যাওয়ায় বড় বড় ঘাস আর ঝোপ গজিয়ে গেছে। বাগানের পাঁচিল ফিটনের ঘরটার পেছনের দেওয়াল আর দু’ধারের দেওয়ালে দুটো মাত্র জানলা। এখন তার কোনও পাল্লা নেই, গরাদও নেই, আছে শুধু জীর্ণ দুটো কাঠের ফ্রেম। ঘরের সামনের দিকে ছিল দুই পাল্লার চওড়া দরজা, যা দিয়ে ফিটনটা ঢুকত, ও বেরোত। পাল্লা দুটোর একটা নেই, অন্যটার থেকে অর্ধেক কাঠ খসে পড়েছে। মেঝের সিমেন্ট ভেঙেচুরে ইট ও মাটি বেরিয়ে রয়েছে।

আকাশে ঘোলাটে মেঘ, আলো খুবই কম, সন্ধ্যা নামার সময় এগিয়ে আসছে। বারান্দা থেকে কলাবতী আলতো দৃষ্টিতে তাকাল ফিটন রাখার ঘরটার দিকে। ঘরের দরজার ভাঙা পাল্লার কাছে কী যেন একটা নড়ে উঠল বলে তার মনে হল। কৌতূহলী চোখে সে তাকিয়ে রইল। ঘরের মধ্যে আলো এত কম, যে সে কিছুই বুঝতে পারল না। কাকার ঘর থেকে বায়নাকুলার এনে চোখে লাগিয়ে সে খয়েরিকে দেখতে পেল। ঝাঁকুনি দিয়ে গা থেকে জল ঝরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছে।

কলাবতীর এতক্ষণ ওর কথা মনেই ছিল না। অপুর মা বলেছিল ফটকের বাইরে পাঁচিল ঘেঁষে শুয়ে আছে। ঝড়—বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় খুঁজতে ফিটনের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তার মনে হল, ভালই করেছে। বৃষ্টি ধরার কোনও লক্ষণ নেই সারারাত যদি ওখানেই থাকে তো থাকুক।

মাস্টারমশাই ক্ষুদিরামবাবুর কাছে কলাবতী অঙ্ক বুঝে নিচ্ছিল যখন সত্যশেখর বাড়ি ফিরল। কাকার সেরেস্তার পাশেই তার পড়ার ঘর। হঠাৎ তার কানে এল কাকা সদর দিয়ে ঢুকেই চেঁচাচ্ছে, ”আরে আরে এটা আবার এল কোত্থেকে। মুরারি, মুরারি শিগগির এটাকে তাড়া, অ্যাই ভাগ, ভাগ।” এর পরই ‘কেঁউ, কেঁউ’ শব্দ উঠল আর্তনাদের। কলাবতী বুঝল কাকা কিছু একটা দিয়ে আঘাত করেছে খয়েরিকেই।

”আসছি সার।” কলাবতী ক্ষুদিরামবাবুর অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই ছুটে ঘর থেকে বেরোল। সদর দরজায় পৌঁছে দেখল ফটক দিয়ে খয়েরি ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ডাকল, ”আয়, আয়।” খয়েরি থমকে পেছন ফিরে তাকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কলাবতী ছুটে গেল। ততক্ষণে খয়েরি ফটক পার হয়ে গেছে।

বিষণ্ণ মনে ফিরে এল কলাবতী। অপুর মার দেওয়া কাবলি ছোলার ঘুগনি সে মুখে দিল না। ক্ষুদিরামবাবু এক চামচ মুখে দিয়েই ”উহহ, কী ঝাল।” বলে প্লেটটা সরিয়ে রাখলেন। একটু পরে খালি প্লেট নিতে এল মুরারি। ”এ কী! কেউই তো খাননি, খুব ঝাল হয়েছে বুঝি। অপুর মা’র হাতের রান্না তো!”

মুরারি প্লেট দুটো তুলে মুচকি হেসে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কলাবতী বলল, ”কাকা খেয়েছে।”

চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মুরারি বলল, ”খেয়েছে মানে! চেয়ে চেয়ে দু’বার খেয়েছে। তারপরই ”আঃ উঃ’ করতে করতে সেরেস্তায় দৌড়ল, এক ঘণ্টা ধরে মক্কেল বসে।”

ক্ষুদিরামবাবু চলে যাওয়ার পর অপুর মা’র কাছ থেকে দুটি রুটি চেয়ে নিয়ে কলাবতী ফটকের বাইরে এসে দু’দিকে তাকাল, কাদা আর গাছের পাতায় ফুটপাথ নোংরা হয়ে রয়েছে। ঝড়ের দাপটে রাস্তার আলো জ্বলছে না। সে খয়েরির কোনও চিহ্ন খুঁজে না পেয়ে, ”আয় আয় আয়, চুক চুক” করে ডাকল দু—তিনবার। হঠাৎ দেখল অন্ধকার ফুটপাথ ধরে খয়েরি এগিয়ে আসছে। কলাবতী উবু হয়ে বসে রুটি ছিঁড়ে ওর মুখের সামনে ধরল। খয়েরি ল্যাজ নাড়তে লাগল কিন্তু রুটি কামড়াল না। ”খুব হয়েছে আর রাগ করতে হবে না। কাকাটা খুব পাজি, আমি বকে দেব, এখন খা।”

রুটির টুকরোটা সে খয়েরির মুখে ঠেকাল। খয়েরি কামড়ে ধরে সামনে দু’পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেল। ”এই তো লক্ষ্মী মেয়ে।” রুটি দুটো খাইয়ে কলাবতী খয়েরিকে জিজ্ঞেস করল, ”রাতে থাকবি কোথায়? যদি আবার বৃষ্টি আসে!” খয়েরি কী বুঝল কে জানে, ল্যাজ নেড়ে যেতে লাগল।

”আয় আমার সঙ্গে, যে ঘরটায় বিকেলে শেল্টার নিয়েছিলি সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিবি, তারপর সকালে যেখানে তোর ইচ্ছে সেখানে চলে যাবি। আয়।”

কলাবতী ফটক দিয়ে বাড়িতে ঢুকল, তার সঙ্গে খয়েরিও। বাগানটা অন্ধকার। পশ্চিমে ফিটন রাখার ঘরটা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা হাতি দাঁড়িয়ে আছে। সে খয়েরির কোমরে চাপ দিয়ে ঠেলে দিল। ”যা এবার কোনও ভয় নেই।” খয়েরি দু—তিন পা গিয়ে ফিরে তাকাল। ”যা, যা, ভয় কী?”

গাড়ি বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল। আলোয় বাগানের অনেকখানিই দেখা যাচ্ছে। রাজশেখরের গলা শোনা গেল, ”কালু কী করছিস বাগানে এই অন্ধকারে?”

”ওর থাকার ব্যবস্থা করছি দাদু।”

”ও—টা কে?”

”দেখতে পাচ্ছ না, ওই তো দাঁড়িয়ে।” আঙুল তুলে কলাবতী দেখাল। রাজশেখর দেখতে পেলেন।

”ওর থাকার কথা তোকে ভাবতে হবে না, চলে আয়।” গলার স্বর একটু কঠিন করে রাজশেখর বললেন। কলাবতী বার দুই খয়েরির দিকে তাকিয়ে ফিরে এল বাড়ির মধ্যে। খয়েরি মিনিটখানেক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে পায়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

কলাবতী পরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় খয়েরিকে যেখানে দেখবে ভেবেছিল, সেই সত্যানন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার এপার—ওপার চোখ বোলাল। দেখতে পেল না। টিফিন বক্সে জেলি মাখানো দু’স্লাইস পাউরুটি রাখা আছে। মিনিট দুই অপেক্ষা করে সে বাড়ির দিকে রওনা হল। পথে যত গলি পড়ল সে থমকে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় গলির মধ্যে তাকাল। দেখতে পেল না। বাড়ির ফটকে পৌঁছে পাউরুটির স্লাইস দুটো ফটকের ধারে রেখে দিল। যদি খয়েরি আসে!

পরদিন ভোরে কলাবতী ছুটে গিয়ে দেখল পাউরুটির স্লাইস দুটো যে ভাবে রাখা ছিল তেমনই রয়েছে। এইভাবে পাঁচটি দিন কেটে গেল। সে খয়েরির দেখা আর পেল না। তখন সে মনে মনে বলল, রাস্তার কুকুর তো, কত আর ভাল হবে! আঁস্তাকুড়ের খাবার না পেলে ওদের পেট ভরে না। ভেবেছিলুম দাদুকে বলে খালি ফিটনের ঘরটায় ওকে থাকতে দেব। তা তো পছন্দ নয়। যাকগে, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াক। আর কখনও দেখা হলে ওকে কিছু খেতে দেব না।

.

শুক্রবার রথযাত্রা, স্কুলের ছুটি। তার আগের দিন ছুটির পর কলাবতী যখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছে, গেটে তাকে ধরল ধূপছায়া ওরফে ধুপু।

”এই কালু, তোর জন্যই দাঁড়িয়ে, কথা আছে। চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি।” ধুপু একই ক্লাসের, তবে অন্য সেকশনে পড়ে। একটু মোটাসোটা কিন্তু অসম্ভব চটপটে, সবসময় হাসিখুশি মুখ। স্কুলে ছোট—বড় সবার সঙ্গে ওর ভাব। স্কুলের স্পোর্টসে ১০০, ২০০ মিটার দৌড়ে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান ওর বাঁধা। দড়ি—টানাটানি আর ক্রিকেট বল ছোড়ায় ধুপু ছাড়া প্রথম আর কাউকে ভাবাই যায় না। ওর গায়ে যেমন জোর মনটিও তেমনই নরম।

”তুই জানিস পূর্ব কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবে আমি খেলি।” হাঁটতে হাঁটতে ধুপু বলল।

কলাবতী বলল, ”শুনেছি, তবে কখনও খেলতে দেখিনি।”

”এবার আমাদের পাড়ায় মেয়েদের নিয়ে একটা ক্রিকেট টিম তৈরি করা হবে, তুই খেলবি?”

কলাবতী দাঁড়িয়ে গেল, অবাক হয়ে বলল, ”আমি! আমি তো জীবনে ব্যাটই ধরিনি, টিভিতে শুধু ওয়ান—ডে দেখেছি।”

”তার মানে ক্রিকেটে তোর ইন্টাররেস্ট আছে, ওতেই হবে। এবার খেলাটা শিখে নে, তারপর খেলতে খেলতে ক্রিকেটার হয়ে যাবি। আমিও তো কিছু জানতুম না। এখন আমি ব্যাটে ওপেন করি, লেগব্রেকও দিতে পারি। তবে গুগলিটা এখনও পারি না, চেষ্টা করছি।”

শুনে ধুপুর প্রতি সমীহ জাগল কলাবতীর। স্কার্টের পকেট থেকে চুইংগাম বার করে ধুপুকে একটা দিয়ে নিজে একটা মুখে পুরল।

”তুই গুগলির চেষ্টা করছিস! আমার দাদুও দিত। দেওয়া নাকি খুব শক্ত।”

ধুপু গম্ভীর মুখে বলল, ”ভীষণ শক্ত। গাদা গাদা অফব্রেক বোলার পাবি কিন্তু ভাল লেগব্রেক গুগলি বোলার মেরেকেটে একটা—দুটো। বেঙ্গলে একটাও মেয়ে নেই, যে গুগলি দিতে পারে।”

”তুই কবে পারবি?” কলাবতী খুবই সম্ভ্রমভরে জানতে চাইল।

ধুপু আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”পাঁচ বছর যদি একনাগাড়ে প্র্যাকটিস করি তা হলে পারব।”

”তোদের ক্লাবের মাঠটা কোথায়?”

”মানিকতলা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাঠে প্র্যাকটিস হত। ওরা আর বাইরের ক্লাবকে মাঠ দেবে না তাই আমরা সল্ট লেকের একটা মাঠে এবার থেকে খেলব। তবে এই যে নতুন ক্রিকেট সেন্টারটা নভিসদের জন্য করা হবে সেটা রেল লাইনের ধারে সি আই টি কোয়ার্টারের ভেতরের মাঠে। ওটা তুই চিনিস?” ধুপু প্রশ্ন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে গেলে তার বাড়ি।

কলাবতী বলল, ”হ্যাঁ চিনি। খুব আলোয় সাজিয়ে দুর্গাপুজো হয় মাঠে।”

”ওখানে প্রগতি সঙ্ঘ বলে কোয়ার্টারের একটা ক্লাব আছে, ফুটবল ক্রিকেট খেলে। ফণীদা ওদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে মেয়েদের শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমাকে বলেছেন কিছু মেয়ে জোগাড় করে দিতে। স্কুলে অনেককে বললুম, কেউ রাজি নয়।”

কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা কে?”

ধুপু চুইংগাম মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বলল, ”একজন রিটায়ার্ড লোক, দেখে বয়স বোঝা যায় না। পঞ্চাশ হতে পারে, আবার সত্তরও। কোয়ার্টারেই চারতলায় থাকেন, শুধু বউ আছে। ছেলেপুলে নেই। অনেক ক্লাবে খেলেছেন, শেষ খেলেছেন সান স্পোর্টিংয়ের হয়ে ফিফটি নাইনে। চল তোর সঙ্গে আর একটু হাঁটি।”

কলাবতী বলল, ”আমার দাদুও তো ওই সময়ে টাউন ক্লাবে খেলতেন। দেখেছিস আমার দাদুকে? গায়ের রং ঠিক আমার উলটো, খুব ফর্সা, সাড়ে ছফুট, তেমনই স্বাস্থ্য, ভীষণ খাইয়ে কিন্তু ভুঁড়ি নেই, রোজ জগ করেন। খুব মজা করে কথা বলেন।”

কথা বলতে বলতে দু’জনে কলাবতীদের ফটকের সামনে পৌঁছল। কলাবতী বলল, ”ভেতরে আয় না, দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।”

ধুপু বলল, ”আজ থাক, এখন যাব রাধারানীদের বাড়ি। ওর খুব ক্রিকেট শেখার ইচ্ছে কিন্তু মা পারমিশন না দিলে খেলতে পারবে না। মাসিমার সঙ্গে কথা বলব। উনি চান মেয়ে মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে যেন থাকে। তাঁর ধারণা খেলাধুলো করলে পড়ার ক্ষতি হবে। রাধু আমায় ধরেছে ওর মাকে গিয়ে বোঝাতে। কী বোঝাব বল তো? বছর বছর ফার্স্ট হয়ে রাধু তো নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছে। মা বলেছে দশজনের মধ্যে না থাকলে বিষ খেয়ে মরবে, বাবা বলেছে ঝি ছাড়িয়ে ওকে দিয়ে বাসন মাজাবে, ঘর মোছাবে। আমি বলেছি, এখনও মাধ্যমিকের জন্য তিন বছর হাতে আছে, তুই রেজাল্ট খারাপ করতে শুরু কর, বাবা—মার পাগলামিটাকে আস্তে আস্তে নর্মাল করে দে।”

কলাবতী বলল, ”আমার দাদু কি কাকা ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য একটুও চাপ দেন না। দাদু বলেন, ভালমতন একটা মানুষ হয়ে ওঠো আগে, সেজন্য খেলাধুলোটা খুবই জরুরি। ক্রিকেট খেলতে চাই শুনলে দাদু খুশিই হবেন। আমি কাল যাব। আচ্ছা ধুপু এই জুন মাসের গরমে কেউ ক্রিকেট খেলে? এখন তো ফুটবল সিজন!”

”হোক না ফুটবল সিজন। মেয়েরা তো দুপুরে ম্যাচ খেলতে মাঠে নামছে না। ফণীদা বলেছেন, এখন শুধু সকালে এক ঘণ্টা ব্যাট বল নিয়ে নাড়াচাড়া করা, একটা ধারণা পাইয়ে দেওয়া। এজন্য ক্রিকেট সিজনের অপেক্ষায় থাকার কোনও দরকার নেই।”

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবলে বসেই কলাবতী ঘোষণা করে দিল, ”দাদু, কাকা, আমি কাল থেকে ক্রিকেট শিখব।”

সত্যশেখর ডিমের কালিয়ার বাটিতে তর্জনী ডুবিয়ে ঝোল চাখবার জন্য আঙুলটা মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, থমকে গেল। ”কী বললি, ক্রিকেট? কেন পৃথিবীতে কি আর খেলা নেই? স্নুকার আছে, বিলিয়ার্ডস আছে, রাইফেল শুটিং আছে, শেখার আরও কতরকমের খেলা রয়েছে, তা নয়—” সত্যশেখর আঙুলটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে চুষতে শুরু করল।

”নিশ্চয় নিশ্চয় আরও কতরকমের খেলা রয়েছে—ব্যাগাটেলি, লুডো, তাস, দাবা, ক্যারম।” রাজশেখর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ”সতু, এগুলোতেও তো ছোটাছুটি করে ঘাম ঝরাবার দরকার হয় না, বেশ আরামেই খেলা যায়।” রাজশেখর চোখ পিটপিট করে হাসি চেপে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সত্যশেখর কালিয়ার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি মুখটা বাটির ওপর নামাল।

”কোথায় শিখবি?” রাজশেখর জিজ্ঞেস করলেন কলাবতীকে।

কলাবতী এর পর দুপুর কাছে যা যা শুনেছে সবিস্তারে দাদুকে বলল।

”ফণীদাটা কে?” সত্যশেখর জানতে চাইল।

”দাদু তুমি বোধ হয় চিনতে পারো। নাইনটিন ফিফটি নাইনে উনি সান স্পোর্টিংয়ে শেষবার খেলেছেন, তখন তো তুমি টাউন ক্লাবে।”

”ফণী ঘোষ!” রাজশেখর টেবলে জোরে থাবড়া মেরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। ”ফণীদা যদি সেই ফণী ঘোষ হয় তা হলে চিনি। বাপস কী ছয় হাঁকাত। আমার ছ’টা বলে ছ’টা ওভার বাউন্ডারি মেরেছিল গ্রিয়ার মাঠে। এই রোগা লম্বা চেহারা।” রাজশেখর ডান হাতের তর্জনীটা নাড়ালেন। ”অদ্ভুত টাইমিং ছিল আর ব্যাটের ঠিক শাঁসে বল লেগে বুলেটের মতো যেত বাউন্ডারিতে। আর সেই এক ওভারে ছত্রিশ রান নেওয়ার খবর কী করে যেন তোর বড়দির বাবা হরিশঙ্করের কানে পৌঁছে যায়। কানে ঠিক নয়, চোখে পড়ে যায়, পরদিন সব কাগজে খবরটা বেরিয়েছিল। অবশ্য বেরোবার মতোই খবর—একটা ছোট ম্যাচে ব্র্যাডম্যান বাইশ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। আর ফণী ঘোষ সেদিন বাইশ বলে নিরানব্বুই করে বোল্ড হয়।”

”কে বোল্ড করল?”

”আর, সিনহা।” রাজশেখর নিস্পৃহ স্বরে নামটা বলে মুখ নিচু করে রুটি ছিঁড়ে কালিয়ার বাটিতে ডোবালেন।

”তারপর হরিকাকা কী করল? নিশ্চয় বাড়িতে কেত্তন লাগিয়ে দিল।” সত্যশেখর দ্বিতীয় ডিম শেষ করে তৃতীয়টা হাতে নিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল।

”না, কেত্তন বসায়নি। চারটে খবরের কাগজের কাটিং একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেয়, সঙ্গে একবাক্স ভীমনাগের সন্দেশ। বাক্সের মধ্যে ছিল একটা চিরকুট, তাতে লেখা : ”সার ডনের তরফ থেকে এই উপহার।”

”উফফ কী সাঙ্ঘাতিক লোক এই মলয়ার বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্জে।” সত্যশেখর দাঁতে দাঁত চেপে বলল। ”আমার সঙ্গে যখনই দেখা হয় খালি খাওয়ার কথা তোলে—সতু ফুচকার ইনিংসে হায়েস্ট স্কোর তোমার কত? সতু আলুর চপের ম্যারাথনে তোমার বেস্ট টাইম কত? সতু মিহিদানার পাওয়ার লিফটিংয়ে কত কেজি তুলেছ?”

”যাকগে হরির কথা।…কালু আমি তোর সঙ্গে সকালে গিয়ে দেখব লোকটা সেই ফণী ঘোষ কি না। কিন্তু তোর তো ক্রিকেটের ড্রেস নেই, ব্যাট প্যাড গ্লাভসও নেই। ওগুলো তো কিনতে হবে।” রাজশেখর উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন কলাবতীর দিকে।

”কেন, আমার তো জিনস আর টপ রয়েছে, তাই পরেই নেট প্র্যাকটিস চলে যাবে, যাবে না?” কলাবতী যতটা হালকা সুরে বলল, ততটাই গম্ভীর স্বরে রাজশেখর বললেন, ”একদম নয়। ওয়ান ডে ক্রিকেট দেখে দেখে তোর রুচিটা বদলে গেছে। ট্র্যাডিশনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে কখনওই সেটা ক্লাসিক হয়ে উঠতে পারে না। লাল নীল হলুদ ট্রাউজার্স, চকরাবকরা জামা, সাদা বল দিয়ে ধুমধড়াক্কা ব্যাট চালিয়ে কি ক্রিকেট খেলা হয়? পা থেকে গলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা, সেটাই হল ক্রিকেটারের পোশাক, হ্যাঁ নেটেতেও ওই পোশাকে প্র্যাকটিস করতে হয়।”

”দাদু, ফণী ঘোষের বাইশ বলে নিরানব্বইটা কোন ধরনের ক্রিকেট ছিল?” কলাবতী চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল।

রাজশেখরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল শান্ত হাসি। ”ক্লিন অ্যান্ড ক্ল্যাসিকাল হিটিং। প্রত্যেকটা স্ট্রোকে ছিল ব্যাটিংয়ের গ্রামার। এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফণী ঘোষের লম্বা রোগা শরীরটা এক পা বেরিয়ে এসে গুডলেংথ বলটা তুলে দিচ্ছে একস্ট্রা কভারের মাথার ওপর দিয়ে। মার খেয়েছি বটে, কিন্তু ওর ব্যাটিং দেখে সুখও পেয়েছি।”

পরদিন সকালে জগ করতে করতে দাদু আর নাতনি প্রগতি সঙ্ঘের মাঠে পৌঁছল। মাঠটির তিনদিকে টানা বারান্দার তিনটি চারতলা বাড়ি। বারান্দার সঙ্গেই পাশাপাশি এক কামরার ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট আছে মোট আশিটি। মাঠের আর একদিক পাঁচিল ঘেরা, তারপরই রেল লাইন। কলাবতীদের বাড়ি থেকে মাঠটি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। মাঠের একধারে একটা ছোট ঘর তাতে ট্যাঙ্কে জল তোলার জন্য পাম্প আছে। তার পাশে কম্যুনিটি হল। এটাই ক্লাবঘর। নাটক হলে এখানেই হয় রিহার্সাল। দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে এই হলঘরে টেবল পেতে আশিটি ফ্ল্যাটের লোক খিচুড়ি খায়। মাঠটিতে সিক্স—আ—সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় প্রতি বছর।

কোয়ার্টারের দুই লোহার পাল্লার চওড়া বড় একটা প্রধান দরজা আছে। অধিকাংশ সময়ই সেটা বন্ধ থাকে। বাইরে থেকে মাঠে আসার জন্য আছে ছোট্ট লোহার গেট, যা দিয়ে একজন মানুষ ঢুকতে বা বেরোতে পারে। ওরা দু’জন মাঠে এসে দেখল লম্বা রোগা মাথাভরা পাকা চুল, সাদা ট্রাউজার্সে গোঁজা সাদা টি শার্ট, সাদা কেডস, কুচকুচে কালো গায়ের রং, একটি লোক তাকে ঘিরে জনাপনেরো কিশোরী। বেশিরভাগ মেয়ের পরনে স্কার্ট ব্লাউজ। দু—তিনজন পরেছে সালোয়ার কামিজ। লোকটির হাতে একটি ক্রিকেট ব্যাট। তিনি মেয়েদের কী যেন বলছেন। কলাবতী ধুপুকে দেখতে পেল না।

রাজশেখর উত্তেজিত চাপা গলায় বললেন, ”কালু, এই লোকটাই ফণী ঘোষ। ” বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন।

”তোমরা কেউ কি কখনও ক্রিকেট খেলেছ।” ফণী ঘোষ মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন।

সবাই চুপ। শুধু একজন বলল, ”বারান্দায় ছোট ভাইকে গড়িয়ে গড়িয়ে বল করেছি।”

ফণী ঘোষ সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ”আগে সবাই ব্যাট হাতে নিয়ে ফিল করে দ্যাখো জিনিসটা কেমন। তারপর শিখবে কেমন করে ব্যাট ধরতে হয়, কেমন করে ব্যাট হাতে দাঁড়াতে হয়, কিন্তু সবার আগে দৌড়নোটা শিখতে হবে, একটু ব্যায়াম করে নিতে হবে।” ফণী ঘোষ ব্যাটটা সামনের মেয়েটির হাতে তুলে দিলেন।

”আরে ফণী। তুমি এখানে?” রাজশেখর এগিয়ে মুখোমুখি হলেন ফণী ঘোষের।

”দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল লোকটাকে ঠিক যেন রাজুর মতো দেখতে। তুমি কিন্তু মোটা হয়ে গেছ।” ফণী ঘোষ দু’হাত দিয়ে রাজশেখরের ডান হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন।

”তুমি দেখছি আর একটু রোগা হয়েছ।”

”কত বছর পর দেখা হল!” ফণী ঘোষ আপ্লুত গলায় বললেন, ”ভাবতেই পারছি না সত্যি সত্যিই দেখা হয়ে গেল।”

কলাবতী অবাক হয়ে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েদের হাত ঘুরে ঘুরে ব্যাটটা তার হাতে এল। জীবনে এই প্রথম সে ক্রিকেট—ব্যাট হাতে নিল। বেশ ভারী ভারী লাগল। পুরনো ব্যাট তাতে দু—তিনটে লাল ছোপ। হ্যান্ডেলের রাবারটা জীর্ণ হয়ে গেছে। ব্লেডের তলার দিকটায় সামান্য চকলা ওঠা। ব্যাটটা দাদুর হাতে তুলে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ”ধুপুকে দেখছি না যে?”

ফণী ঘোষ বললেন, ”ধুপু কাল সন্ধেবেলা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকেছে। বিছানায় শুয়ে। আজ এক্স—রে হবে, ওর যমজ ভাই ধুজু রাতে জানিয়ে গেছে।”

”ফণী এটা কি সেই ব্যাট, যেটা দিয়ে ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছিলে?”

ফণী ঘোষ হেসে মাথাটা হেলালেন শুধু। ”তুলে রেখেছিলুম আজ বার করলুম।”

রাজশেখর ব্যাটটা কলাবতীর হাত থেকে নিয়ে কপালে ঠেকালেন। ফণী ঘোষ পকেট থেকে পুরনো একটা ক্রিকেট বল বার করলেন।

”এবার তোমরা এটা হাতে নিয়ে দ্যাখো কেমন লাগে।”

বলটা হাতে হাতে ঘুরল।

”কেমন লাগল?”

”বড্ড শক্ত ফণীদা,” একজন বলল। ”গায়ে লাগলে হাড় ভেঙে যাবে।”

”গায়ে লাগবে কেন? লাগার আগে সরে যাবে নয়তো লুফে নেবে। সেজন্য আগে লোফাটা শিখে নিতে হবে। প্রথমে শুরু করবে রাবারের বল দিয়ে। সবাই একটা করে রাবারের বল কিনে নাও। দেওয়ালে বল মেরে সেটা ক্যাচ করো। কীভাবে ধরবে সেটা তোমাদের দেখিয়ে দেব। আচ্ছা, এবার তোমরা মাঠটায় চক্কর দিয়ে চারপাক দৌড়ও দেখি, আস্তে—আস্তে, বেশি জোরে নয়। তারপর কিছু এক্সারসাইজ, এসব কিন্তু রোজ তোমাদের করতে হবে।” বলেই ফণী ঘোষ নিজে প্রথম দৌড় শুরু করলেন তাকে অনুসরণ করে মেয়েরা ছুটতে শুরু করল, তার মধ্যে কলাবতীও আছে। ওরা যখন প্রায় চল্লিশ মিটার এগিয়েছে তখন রাজশেখর আর থাকতে পারলেন না। চনমন করে উঠে দৌড়তে শুরু করলেন। দৌড় মানে জগিংই প্রায়।

বাড়ি থেকে জগ করে মাঠে এসেছেন তারপর আবার এই পরিশ্রম, রাজশেখর দু’পাকের পর দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফণী ঘোষ একই তালে পা ফেলে, ছোটার গতি একটুও না কমিয়ে চারপাক শেষ করে রাজশেখরের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

”তোমার ছোটা দেখে মনে হচ্ছে তোমার অভ্যেস আছে।” রাজশেখর প্রশংসামেশানো গলায় বললেন বুকে বাতাস টানতে টানতে। শুনে ফণী ঘোষ শুধু বললেন,

”রাজু এই মেয়েরা কিন্তু একদমই দৌড়তে জানে না। দৌড়নোটা শেখার জিনিস। এমনকী হাঁটাও। প্রায়ই চোখে পড়ে লোকে কী বিশ্রীভাবে হাঁটছে। কেউ ঝুঁকে, কেউ বেঁকে, কেউ ডাইনে—বাঁয়ে দুলে দুলে, কেউ থপ থপ করে। এজন্য দশ—বিশ বছর পর হাড়ের রোগ হয় সেটা কেউ ভেবে দেখে না। দৌড়নো কি হাঁটা, সে আবার শিখতে হবে নাকি; এই হচ্ছে মনোভাব!” ফণী ঘোষ বললেন একটু গলা তুলে, যাতে মেয়েরা শুনতে পায়।

রাজশেখর বললেন, ”ঠিক একই ব্যাপার আমাদের বাংলা শেখার ক্ষেত্রেও ঘটে। বাঙালি আমরা, জন্ম থেকেই বাংলায় কথা বলি, বাংলা বই পড়ি, আমাদের আবার এটা শিখতে হবে নাকি? অথচ কী গাদা গাদা ভুল বাংলায় যে লিখি, কত যে বানান ভুল করি তার ঠিকঠিকানা নেই। ব্যাকরণটাও ভাল করে পড়ি না। যাক গে এসব কথা, তোমায় বলি এই মেয়েদের মধ্যে আমার নাতনিও আছে তবে সে কোনজন তা কিন্তু তোমায় বলব না।”

”না বললেও আমি জানি, তোমার সঙ্গে যে কালো মেয়েটি এল, সেই তো? ওর চালচলন অ্যাথলিটদের মতো, সবার মধ্যে আগে চোখে পড়ে যায়।”

এই সময় একটি মেয়ে ফণী ঘোষকে জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা নেট তো লাগানো হয়নি। আমাদের প্র্যাকটিস কখন শুরু হবে?”

”আগে দৌড়তে শেখো, এক্সারসাইজ করে মাসলগুলোকে চাঙ্গা করে তোলো, দু’হাতে বল ধরতে শেখো, থামাতে শেখো, ছুড়তে শেখো, ধৈর্য ধরতে শেখো, তারপর বল করতে ব্যাট করতে শিখবে, তারপর নয় নেটের কথা ভাবা যাবে। আজ তোমাদের শুধু দেখে নিলাম, কাল ঠিক ছ’টায় আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব, তোমরা আসবে, দৌড় শেখাব। যা বলেছি, সঙ্গে একটা রবারের বল আনবে। কেডস পরে আসবে। সালোয়ার কামিজ চলবে না।”

একটি ছোট্ট মেয়ে বলে উঠল, ”ফণীদা, ছবিতে দেখেছি ইন্ডিয়ান টিম হাফপ্যান্ট পরে দৌড়চ্ছে। আমি হাফপ্যান্ট পরে আসব?”

”বাড়িতে আপত্তি না থাকলে সবাই পরে আসতে পারো। গরমে সেটাই তো ভাল। আপত্তি থাকলে স্কার্ট পরবে। আজ তোমরা বাড়ি যাও। মনে রেখো কাল ছ’টায়।”

.

মেয়েরা সবাই চলে যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে ফণী ঘোষ রাজশেখরকে বললেন, ”বাচ্চচাদের উৎসাহটা দেখলে, এখনই নেট চাই! গাছে না উঠেই এককাঁদি, এই মনোভাবটা বদলানো দরকার। ক্রিকেট ধৈর্যের খেলা, গাওস্করের একটা ইনিংস যদি এদের দেখাতে পারতুম।” ফণী ঘোষ আফসোসে মাথা নাড়ালেন।

রাজশেখর বললেন, ”এই মনোভাবটাই শেষ করে দিয়েছে একদিনের ক্রিকেট। ক্রিকেট এখন দেড় ঘণ্টার ফুটবল ম্যাচের মতো খেলা হচ্ছে। আরে বাবা বিজয় হাজারের হাত জমাতেই তো দেড় ঘণ্টা লেগে যেত।”

দুই বৃদ্ধ যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরনো আমলের গৌরব রোমন্থনে ব্যস্ত তখন কলাবতীর চোখ পড়ল কমিউনিটি হল ও পাম্পঘরের মাঝে তিন হাত চওড়া গলির মতো ফাঁকা জায়গাটার দিকে। মিশরের পিরামিডের পাশে দুটি পা সামনে রেখে বসে থাকা সিংহের দেহ আর মানুষের মাথাওলা স্ফিংসের মতো বসে কিছু একটা মুখে নিয়ে চিবোবার চেষ্টা করছে যে কুকুরটি তাকে সে দূর থেকেই চিনতে পারল মাথার সাদা টুপিটি দেখে—খয়েরি। খয়েরিকে যে সে আবার দেখতে পাবে কখনও মনে হয়নি। তাই সে খুব অবাক হল। তার মনে হল এটা যেন ভাগ্যের লুকোচুরি খেলা।

সে দ্রুত হেঁটে খয়েরির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখ নিচু করে খয়েরি সাদা একটা হাড় কামড়ে ভাঙার চেষ্টা করছে। হাড়টা একটা পাঁঠার টেংরি, তাতে এককণাও মাংস লেগে নেই। কলাবতী বুঝল খিদের জ্বালায় ওই হাড়টাই ভেঙে খাওয়ার চেষ্টা করছে। হাড়টা মোটা তাই পারছে না। হঠাৎ একজনকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে খয়েরি চোখ কপালের দিকে তুলে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড পর চিনতে পেরে ল্যাজ নাড়ল, উঠে বসল। কলাবতী দেখল খুব রোগা হয়ে গেছে খয়েরি। কোমরের দুটো হাড় প্রকট হয়ে উঠেছে। বুকের পাঁজরের হাড়ও দু—তিনটে গোনা যায়।

খয়েরির সামনে উবু হয়ে হাঁটু ভেঙে বসল কলাবতী। ডান হাত ওর মাথায় রাখতেই আহ্লাদে কান দুটো ঘাড়ের সঙ্গে মিশিয়ে জোরে জোরে ল্যাজটা নাড়তে লাগল। মুখ দিয়ে ”কুঁই—কুঁই’ শব্দ বেরিয়ে এল। তারপর সে মাথায় রাখা কলাবতীর হাত চাটার জন্য মুখটা এপাশ—ওপাশ করতে লাগল।

”খুব খিদে পেয়েছে।” কলাবতী জানতে চাইল। ”আয় আমার সঙ্গে। বাড়িতে রুটি আছে। মাখন, জেলি, ডাল, ভাত, মাছ, দুধ সব আছে। খাবি তো আমার সঙ্গে আয়।” এই বলে সে হাঁটতে শুরু করল দাদুকে লক্ষ করে। কয়েক পা গিয়ে সে ফিরে তাকিয়ে দেখল খয়েরি আসছে না।

”আয়, আয়” বলে সে কয়েকবার ডাকল। খয়েরি ল্যাজ নাড়ল কিন্তু এগিয়ে এল না। কলাবতী দাদুর কাছে এসে বলল, ”দুটো টাকা দাও তো।”

”কী হবে টাকা?” রাজশেখর বললেন।

”দাও না, দেখতেই পাবে।” বায়নাধরা আদুরে গলায় কলাবতী বলল।

রাজশেখর ট্রাউজার্সের পকেট থেকে কয়েকটা নোট বার করে তার থেকে একটা নোট নাতনির হাতে দিলেন। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে কলাবতী তীরবেগে কোয়ার্টারের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। এখানে আসার সময় সে দেখেছে কোয়ার্টারের পাঁচিলের লাগোয়া একটা ছোট্ট স্টেশনারি দোকানের কাউন্টারে থাক দিয়ে পাউরুটি সাজানো।

যাওয়ার মতোই তীরবেগে সে ফিরে এল। খয়েরি আবার হাড়টা নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করেছে।

”থাক ওটা আর খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে না, এবার এটা খা।” মোড়ক থেকে পাউরুটি বার করে আধখানা ভেঙে সে খয়েরির মুখের সামনে ধরল। সঙ্গে—সঙ্গে সেটা পেটের মধ্যে চালান হয়ে গেল। বাকি আধখানারও একই হাল হল। এর পর খয়েরি জুলজুল করে তাকিয়ে আছে দেখে কলাবতীর মন কষ্টে ভরে গেল। বেচারা, এখনও খিদে যায়নি। সে ভাবল, আবার একটা পাউরুটি কিনে আনবে কি?

তখনই রাজশেখর চেঁচিয়ে ডাকলেন, ”কালু এবার বাড়ি চল।”

”আয় আমার সঙ্গে, কিনে দেব আর একটা”—কলাবতী চাপাস্বরে বলল খয়েরিকে। খয়েরি বুঝতে পারল কলাবতীর মমতাভরা কথার মানেটা। তাকে অনুসরণ করে সে রাজশেখরের কাছে এসে কলাবতীর পেছনে দাঁড়িয়ে রইল।

”আবার এসো রাজু। বাচ্চচাদের সঙ্গে দৌড়লে ওরা উৎসাহ পাবে, সিরিয়াস হবে, তোমারও উপকার হবে।” ফণী ঘোষ বললেন।

”উপকার মানে তো খিদে বাড়বে।” রাজশেখর বললেন, ”আসব, তবে রোজ আসতে পারব না।”

ফণী ঘোষ কলাবতীকে বললেন, ”তুমি কিন্তু রোজ আসবে। বাড়িতে এমন এক দাদু থাকতে তোমাকে আমি আর কী ক্রিকেট শেখাব। গোড়ার ব্যাপারগুলো ওর কাছেই শিখে নিও। কীগো রাজু, শেখাতে পারবে না?”

রাজশেখর হাসলেন, ”চল কালু, বেলা বাড়ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।”

ওরা কোয়ার্টারের গেট থেকে বেরোচ্ছে, তখন খয়েরি ছুটে এল। রাজশেখর আগেই খয়েরিকে লক্ষ করেছিলেন, বললেন, ”সেই কুকুরটা মনে হচ্ছে। ওকে তো খাওয়ালি, এবার আর তোকে ছাড়বে না। ও তোকে বুঝে গেছে।”

”কী বুঝে গেছে?” কলাবতী জানতে চাইল।

”তুই ওকে ভালবাসিস। জন্তু—জানোয়ার, পাখিরা মানুষ চেনে। কে ভাল, কে দুষ্টু ওরা ঠিক বুঝতে পারে।” রাজশেখরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ”তুই পাশ করে গেছিস।”

দাদুর কথায় কলাবতীর মন আনন্দে ভরে গেল। খয়েরি জানিয়ে দিয়েছে সে ভাল লোক। ”দাদু ওকে আর একটা পাউরুটি কিনে দাও না! একটা খেয়ে ওর খিদে যায়নি। দেখছ কী রোগা হয়ে গেছে না খেতে পেয়ে।”

নাতনির চোখেমুখে দয়া করুণা মমতা উপচে উঠছে দেখে রাজশেখর মনে—মনে অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি এটাই তো দেখতে চান, কলাবতী সুন্দর একটা মন পাক, চমৎকার স্বাস্থ্য পাক।

বাড়ি ফেরার পথে আর একটা দোকান থেকে রাজশেখর বড় সাইজের একটা পাউরুটি কিনলেন।

”রাস্তায় নয়, বাড়ি গিয়ে ওকে খেতে দেব।”

”ওকে বাড়ি নিয়ে যাব?” অবিশ্বাসের সুর কলাবতীর প্রশ্নে গোপন রইল না।

”ওকে পুষতে তোর ইচ্ছে করছে?”

”হ্যাঁ।” কলাবতী মাথাটা হেলিয়ে কাঁধে ছুঁইয়ে দাদুর হাত ধরল।

ক্ষুধার্ত খয়েরি ওদের দু’জনের সঙ্গে এবং পাউরুটির পিছু নিয়ে সিংহিবাড়ির ফটক পেরিয়ে ঢুকল। বাড়ির সদর দরজার সামনে পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

”বাড়ির মধ্যে ঢোকাসনি, গায়ে ভীষণ নোংরা। এখানেই খেতে দে।” রাজশেখর মোড়কে মোড়া পাউরুটিটা কলাবতীর হাতে দিয়ে বললেন, ”সবটা খাইয়ে দিসনি।”

”দাদু ওকে চান করাব?” কলাবতী মোড়ক খুলে পাউরুটির খানিকটা ছিঁড়ে খয়েরির মুখের সামনে ধরে বলল।

”রাস্তার কুকুর, চান করার অভ্যেস তো নেই। গায়ে জল ঢাললেই ছুটে পালাবে। ধরেবেঁধে করাতে গেলে চেঁচামেচি করবে, কামড়ে দিতেও পারে। বাচ্চচা কুকুর তো নয়।”

পাউরুটির আর একটা টুকরো ছিঁড়ে কলাবতী বলল, ”বড়দির মঙ্গলার মতো একটা বকলেস আর চেন কিনে দেবে দাদু?”

”চেন দিয়ে বেঁধে রাখার মতো কুকুর তো এরা নয়, এরা ছাড়া থাকলেই ভাল থাকে। তবে একটা বকলেস পরালে লোকে জানবে ও বাড়ির পোষা কুকুর, আচ্ছা কিনে এনে দেব।” এই বলে রাজশেখর বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেলেন। ”আর একটা রবারের বল।”

সত্যশেখর সকালে একবার সেরেস্তায় বসে কোর্টে বেরোনোর আগে। সেদিন যার মামলা পড়েছে এমন দু—তিনজন মক্কেল তখন আসে। দোতলা থেকে নেমে সেরেস্তায় ঢোকার সময় খোলা সদর দরজার দিকে তার চোখ পড়ল।

”আরে কালু, ওটা আবার এসেছে আর তুই ওকে খাওয়াচ্ছিস?”

”আমি নয়, দাদু খাওয়াচ্ছে। দাদুই তো পাউরুটি কিনে ওকে ডেকে আনল।” কলাবতী জানে চুলে পাক ধরলেও কাকা এখনও ভয় পায় দাদুকে। সে তাই বর্মের মতো দাদুকে সামনে রেখে খয়েরিকে আড়াল করল।

”বাবা, ডেকে আনল।” সত্যশেখর ভ্রূ কুঁচকে সেরেস্তায় ঢুকে গেল।

মুরারি বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। কলাবতী তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ”চললে কোথায় মুরারিদা?”

”মুদির দোকানে। আজ রথযাত্রা, ছোটবাবু তেলেভাজা খাবে। পাঁপড় আর ব্যাসম কিনতে যাচ্ছি।” মুরারির চোখমুখ কুঁচকে গেল খয়েরিকে দেখে। ”রথের দিন প্রাণীকে খাওয়ালে পুণ্যি হয়। খাওয়াও। জগন্নাথ বাবা খুশি হবেন।”

”শুধু আজ নয়, খয়েরি রোজ দু’বেলা খাবে। ও এবার থেকে এখানেই থাকবে, আমি ওকে পুষব।”

”য়্যা!” মুরারি প্রায় বজ্রাহতের মতো সাত—আট সেকেন্ড তাকিয়ে রইল খয়েরির দিকে। ”এই চিমড়ে রাস্তার নেড়ি কুকুরাকে পুষবে তুমি? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার! কত ভাল—ভাল লোমওলা সুন্দর—সুন্দর বিলিতি কুকুর থাকতে শেষে কিনা—কত্তাবাবু জানে?”

”জানে মানে। দাদুই তো ওকে নিয়ে এল। খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে দেব। দেখবে তখন বিলিতি কুকুরের থেকেও সুন্দর হয়ে যাবে, তাই না রে খয়েরি?” কলাবতী ওর মাথার হাত বুলিয়ে দিল, খয়েরি লেজ নাড়ল।

”ও বাব্বা, নামকরণও হয়ে গেছে, খয়েরি!” আকাশের দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, ”বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে, যাই দোকানটা সেরে আসি।”

”এখানে বোস। জল এনে দিচ্ছি।”

খয়েরিকে বসতে বলে কলাবতী ভেতরে গেল। অপুর মা রান্নাঘরে।

”একটা বাটিতে জল দাও তো, খয়েরি খাবে।”

 অপুর মা অবাক হয়ে বলল, ”খয়েরি কে?”

”সেই কুকুরটা, যাকে সেদিন তুমি গেটের কাছে দেখেছিলে।”

”আবার এসেছে। জানতুম আসবে। ডেকে খাইয়েছ যখন, তখন রোজ আসবে। পেলাসটিকের ওই মগটায় করে জল দাও।”

”খয়েরি মোটেই হ্যাংলা নয়। ও তো আসতেই চাইছিল না। দাদুই তো ওকে সঙ্গে করে আনতে বলল।”

”কত্তাবাবু বলেচেন! ভালই হল। বাগানটা ফাঁকা পড়ে থাকে। রেতে পাহারা দেবে। আটঘরায় আমাদের ময়রা পাড়ায় এই কুঁদো কুঁদো পাঁচ—ছ’টা কুকুর আছে। দিনের বেলা ঘুমোয় আর রেতে জেগে ঘোরাঘুরি করে। চোর—ছ্যাঁচোড় ভয়ে ও পাড়ার ধারেকাছে ঘেঁষে না। কিন্তু পাড়ায় মানুষকে ঠিক চেনে। কিচ্ছু বলে না। কালু দিদি তোমার মতো বয়সে আমার একটা সাদা কুকুর ছিল, নাম রেখেছিনু সায়েব। আমার হাতে ছাড়া কারুর হাতে ভাত খেতনি।” হঠাৎ অপুর মা’র গলা ধরে এল। ”বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে গেনু। সায়েব আমাকে দেখতে না পেয়ে খাওয়া বন্দো করে দিল। তিনদিন খায়নি।” অপুর মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ”বুঝলে গো বড্ড মায়া পড়ে যায়।”

”তারপর ভাতটাত খেত?” কলাবতীর স্বরে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল।

”খাবেনি কেন। তবে আগের মতো আর ছেল না। লাপানি—ঝাঁপনি, চিৎকার চেঁচামেচি কমে গেছল। আমি বাপের বাড়ি এলে তখন সবসময় আমার কাছে কাছে থাকত। বুড়ো হয়ে দু’দিনের অসুখে সায়েব মরে গেল। খবর পেয়ে আমি দু’দিন খেতে পারিনি।” অপুর মা আবার চোখে আঁচল দিল।

”এবার তুমি আমার খয়েরিকে দেখো।”

”দেখব।”

.

নাতনিকে ক্রিকেটের অ আ ক খ শেখাতে গিয়ে রাজশেখরের বয়স যেন পঞ্চাশ বছর কমে গেল। প্রতিদিন কলাবতীর সঙ্গে প্রগতি সঙ্ঘের মাঠে যান। মেয়েদের সঙ্গে থপ থপ করে একপাক দৌড়েই হাঁফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ফণী ঘোষকে ঘিরে মেয়েরা দশ মিটার দূরত্বে গোল হয়ে দাঁড়ায়, তাদের সঙ্গে রাজশেখরও থাকেন। ফণী ঘোষ এক—একজনকে রবারের বল ছুড়ে দেন। প্রথম প্রথম বেশিরভাগ মেয়েরই হাতে লেগে বল ছিটকে যেত, রাজশেখরেরও তাই হত। পরে মেয়েরা ক্যাচ ধরাটা রপ্ত করে ফেলে, এমনকী তিনতলা উঁচু বল ছুড়ে দিলে এখন প্রায় সব মেয়েই লুফতে পারে। যারা পারে না ফণী ঘোষ তাদের দেখিয়ে দেন দুটো তালু ক্যাচ ধরার সময় কেমনভাবে রাখতে হবে, শরীরের অবস্থান তখন কেমন হবে আর বারবার বলে দেন বলের থেকে একদম নজর সরাবে না।

বল লোফা, জোরে গড়িয়ে দেওয়া বল ছুটে এসে কুড়িয়ে তুলে ছুড়ে ফেরত দেওয়া আর ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম কিছুদিন করার পর একটি মেয়ে সবার হয়ে একদিন বলল, ”ফণীদা, আমরা কবে ব্যাট করব?”

ফণী ঘোষ ওদের আশ্বস্ত করে বললেন, ”হবে হবে। আগে ব্যাট ধরা, ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়ানো, ব্যাট তোলা, এগিয়ে পিছিয়ে বল থামানো এগুলো না শিখলে ব্যাট করা যায় না। তোমাদের কারুর ব্যাট আছে?”

সবাই চুপ, কলাবতীও। দাদুর ছিল পঞ্চাশ বছর আগে। এক বন্ধুর ছেলেকে সেটি দিয়ে দেন খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর।

একটি ছোট্ট মেয়ে বলল, ”আমার দাদার ব্যাট আছে। আমাকে একদম হাত দিতে দেয় না। ছাদে একা—একাই ব্যাট চালায় আর বলে এই দ্যাখ শাস্ত্রীর চাপাটি শট, এই দ্যাখ কপিলদেবের নটরাজ শট।”

ফণী ঘোষ বললেন, ”তুমি যেন এখনি চাপাটি—নটরাজ করতে যেও না। আগে অ—য় অজগর আসছে তেড়ে, তারপর রাখাল অতি সুবোধ বালক, তারপর ঐক্য বাক্য মাণিক্য—এইভাবে ধাপে ধাপে শিখতে হবে।”

কমিউনিটি হলের সামনেটা সিমেন্ট করা একটা চাতালের মতো। ফণী ঘোষ একদিন একটা টেনিস বল আর নিজের ব্যাটটা নিয়ে শুরু করলেন সেই চাতালে ব্যাটিং শেখানো। কয়েক মিনিটেই হতাশ হয়ে পড়লেন। ব্যাটটা ওদের পক্ষে বড়। লম্বা কলাবতী এবং আর একটি মেয়ে ছাড়া আর একজনও ব্যাট সোজা রেখে খেলতে পারছে না। অনেকের পক্ষে ব্যাটটা ভারীও।

ব্যাটিং শেখানো বন্ধ করে ফণী ঘোষ বললেন, ”রবারের বল খেলার জন্য কম দামি ছোট সাইজের চল্লিশ—পঞ্চাশ টাকার ব্যাট দোকানে পাওয়া যায়। তোমরা তাই কিনে আনো।”

তিনদিন পরে একটিমাত্র মেয়ে ব্যাট হাতে এল। একজন জানাল, ”বাবা বলেছে এই তো জুতো, প্যান্ট কিনে দিলুম, এখন আর ব্যাট কিনে দিতে পারবে না।” অন্যরা প্রায় একই ধরনের কথা বলল।

একদিন রাজশেখরের খেয়াল হল শুধু ব্যাট, বল, ফিল্ডিং করে তো একটা টিম খেলতে পারে না, একজন উইকেটকিপারও তো চাই। কথাটা ফণী ঘোষকে বলতে, তারও ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ”এটা আমি অনেকদিন আগেই ভেবেছি।” ফণী ঘোষ বললেন, ”গোলকিপারের মতো উইকেটকিপারও জন্মায়। ওদের তৈরি করা যায় না। আমি লক্ষ করেছি তোমার নাতনিটির মধ্যে উইকেটকিপার হওয়ার গুণগুলো আছে, ওকে উইকেটকিপিং প্যাড আর গ্লাভস কিনে দাও আর বাড়িতে প্র্যাকটিস করাও আলাদা ভাবে।”

রাজশেখর অসহায়ভাবে বললেন, ”কিন্তু আমি তো উইকেট কিপিংয়ের বিন্দুবিসর্গও জানি না।”

ফণী ঘোষ বললেন, ”কালীঘাটের মনা ভটচাযকে মনে আছে? গোটা দশেক রঞ্জি ম্যাচে উইকেটকিপ করেছে। এখন লাঠি নিয়ে হাঁটে, বাতে পঙ্গু। টেকনিক্যালি সাউন্ড ছিল। ফিফটি নাইনে পুনা ক্যাম্পে একটা ট্রায়াল ম্যাচে সুভাষ গুপ্তের বলে দাত্তু গায়কোয়াড়ের স্টাম্পিং মিস করে ওর ইংল্যান্ড ট্যুরে যাওয়া হয়নি, গেল নানা জোশি। মনার টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, ওর সঙ্গে কথা বলে নাতনিকে নিয়ে ওর কাছে যাও। খুব খুশি হবে।”

সেদিনই সন্ধ্যায় রাজশেখর ফোন করলেন মনা ভটচাযকে।

”আমি রাজশেখর সিংঘি বলছি। মনে পড়ছে, টাউন ক্লাবের রাজু সিংঘি।”

মনা ভটচায উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, ”হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। ফণী আজ দুপুরে ফোন করেছিল। তোমার নাতনিকে উইকেট—কিপার করতে চাও। এটা তো একটা থ্যাঙ্কলেস জব, তাও আবার মেয়েদের ক্রিকেট! মাঠে খেলা দেখার লোক হয় না, কাগজে রিপোর্টও করে না, আমি তো ভাল করে হাঁটতে পারি না, ওকে নিয়ে কাল বিকেলে আমার বাড়িতে এসো, যা বলার বলে দেব, করে দেখাতে তো পারব না। হাঁটু মুড়তে পারি না, আমার ঠিকানাটা লিখে নাও।”

রাজশেখর ঠিকানা লিখে নিয়ে বললেন, ”কাল বিকেলেই যাচ্ছি। খুঁজে বার করতে অসুবিধে হবে না, পার্ক সার্কাসের ওদিকটা আমার চেনা। আমার ছেলে সতু ডন বস্কোয় পড়ত।”

পরদিন কলাবতী স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদল করেই বেরিয়ে পড়ল। ১৯২৮ সালে তার ঠাকুর্দার বাবার কেনা হুড খোলা লম্বা পাদানি থাকা নিয়মিত ঝাড়মোছ করা ফোর্ড গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে রাজশেখর, তার পাশে গিয়ে বসল কলাবতী।

রাজশেখর ”পঁক পঁক” শব্দে বল হর্ন বাজাতেই মুরারি ছুটে গিয়ে ফটকের দুটো পাল্লা খুলে দিল। গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে থামল। মুরারি আবার ফটক বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সিটে এসে বসল। মানিকতলার মোড়ের কাছে রাজশেখর মোটর থামিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে কলাবতীর হাতে দিয়ে বললেন, ”ওই যে ছোট্ট মিষ্টির দোকানটা দেখছিস, কড়াপাক নিয়ে আয়, মুরারি সঙ্গে যা।”

কলাবতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”একশো টাকার?”

জবাব দিল মুরারি, ”তবে না তো কী?”

দোকানের দিকে যাওয়ার সময় মুরারি চাপা গলায় চলল, ”কত্তাবাবু যখন বলে দেননি কত টাকার কিনতে হবে তখন ধরে নেবে সব টাকারই কিনতে হবে।”

দোকানটা সত্যিই ছোট্ট। একটা লম্বা কাচের শো—কেস। ওপরের তাকে স্টিলের ট্রেতে থরে থরে সাজানো সন্দেশ। নীচের তাকে গামলায় রসগোল্লা, রাজভোগ, ছোট একটা ক্যাশবাক্স নিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে চেয়ারে বসে শীর্ণকায়, সাদা কদমছাঁট চুল, ফতুয়া গায়ে এক প্রৌঢ় বসে।

মুরারি তাকে বলল, ”নমস্কার ঘোষমশাই, কত্তাবাবু পাঠালেন। কড়াপাক দিন একশো টাকার। উনি গাড়িতে বসে। এই ওঁর নাতনি, দোকানটা চেনাতে পাঠালেন।”

ঘোষমশাই দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন শশব্যস্ত। গাড়ির কাছে এসে দু’হাত জোড় করে দাঁড়ালেন।

রাজশেখর বললেন, ”কেমন আছো গো ফেলু।”

ফেলু ঘোষ জানালেন, ”ভগবান আর আপনাদের দয়ায় ভালই আছি। আপনি ভাল তো? ছোটকর্তার বিয়ে হয়েছে?”

”হলে তো তুমিই আগে জানতে পারতে।”

”সন্দেশটা আজ নেবেন না বড়কর্তা। ছানাটা টিউকলের জলের কাটানো, বরং ক্ষীরের চন্দ্রপুলি আছে, সেটাই দিয়ে দিই।”

”চন্দ্রপুলি! এ আবার জিজ্ঞেস করে? দাও দিয়ে দাও, সন্দেশ থাক।”

এক—একটা পাঁচ টাকা। কুড়িটা চন্দ্রপুলির বাক্স একটা পলিথিন ব্যাগে হাতে ঝুলিয়ে মুরারি কলাবতীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরল। মনা ভটচাযের বাড়ি খুঁজে নিতে ওদের অসুবিধে হল না। কোলাপসিবল গেটের পাশে কলিং বেলের বোতাম। গাড়ি থেকে নেমে মুরারি সেটা টিপতেই ভেতর থেকে ভারী গম্ভীর গলায়, ”ঘৌ ঘৌ ঘৌ” শব্দ উঠল। শুনলেই বোঝা যায় বড় বিদেশি কুকুরের ডাক। কেউ একজন চুপ করতে বলছে ওকে। আর কুকুরের ডাক শোনা গেল না।

মুরারি বলল, ”নির্ঘাত বিলিতি কুকুর। তাই এত সভ্য, চুপ করতে বললে চুপ মেরে যায়।”

কলাবতী বুঝল কথাটা খয়েরিকে ঠেস দিয়ে বলা হল। রাতে এক—একদিন ফটকের কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে খয়েরি তারস্বরে চিৎকার করে রাস্তার কুকুরদের বাড়ির সামনে থেকে তাড়ায়। মুরারির ধমকানিকে সে তখন গ্রাহ্য করে না।

ভেতর থেকে গেটে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখেই বোঝা যায় সে এই বাড়ির মুরারি। গাড়িতে বসেই রাজশেখর ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ”এটা কি মণীন্দ্র ভটচাযের বাড়ি?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ।”

”আছেন?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ। অপেক্ষা করছেন।”

কলাবতী বুঝল, তারা যে আসবে সেটা বলে রাখা আছে। মুরারি পলিব্যাগটা হাতে নিয়ে দু’জনের পেছনে থেকে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বৈঠকখানায় দরজা পর্যন্ত এসে ব্যাগটা কলাবতীর হাতে দিয়ে গাড়িতে ফিরে গেল।

”এসো, রাজু, এসো, কতকাল পরে—” মনা ভটচায সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন লাঠিতে ভর দিয়ে, দু’হাত বাড়ালেন। মাঝারি উচ্চচতা, টাক মাথা, বড় ভুঁড়ি, থলথলে চেহারা। কলাবতী হতাশ হল প্রাক্তন উইকেটকিপারের বপু দেখে। রাজশেখর ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ”তা তিরিশ—পঁয়ত্রিশ বছর তো হল।”

কলাবতী চন্দ্রপুলির বাক্স ভরা ব্যাগটা টেবলে রেখে মনা ভটচাযকে প্রথমে তারপর দাদুকে প্রণাম করল।

”এই বুঝি নাতনি, কী নাম গো তোমার?”

”কলাবতী সিংহ।”

”উইকেটকিপিং শিখবে? কিন্তু আমি তো ভাই, দেখছই, নড়াচড়া করতে পারি না লাঠি ছাড়া। এটা কী আনলে?”

পলিব্যাগ থেকে বাক্সটা বার করে রাজশেখর বললেন, ”তোমাকে কালুর প্রণামী—চন্দ্রপুলি। খেয়ে দেখো।”

”চন্দ্রপুলি! ওহহ, এ তো আজকাল চোখেই দেখা যায় না। খোঁজ করেছি, আমাদের এদিককার একটা দোকানেও নেই। নারকেলের মিষ্টি খাওয়ার লোক নাকি এখন আর পাওয়া যায় না।”

গলায় চাপা গর্ব মাখিয়ে রাজশেখর বললেন, ”থাকবে কী করে, এসব পুরনো কলকাতার আদি জিনিস। সকালবেলায় মাথায় হাঁড়িতে চন্দ্রপুলি, তিলকূট নিয়ে হাজির হত কেশবচরণ। বাবা খুব খেতেন। তাঁর কাছ থেকেই খাওয়াটা শিখেছি।”

”পুরনো কলকাতা, আমাদের ছোটবেলার দিনকালের কথা, রাজু, মাঝে মাঝে ভাবি। আর অবাক হয়ে যাই। তোমার কি মনে আছে ইডেন গার্ডেনস আগে কীরকম ছিল? দেবদারু গাছে ঘেরা খোলা মাঠ। গঙ্গা থেকে বয়ে আসত বাতাস, কাঠের প্যাভিলিয়ন, বিরাট একা গোল ঘড়ি, তার তলা দিয়ে প্লেয়াররা মাঠে নামত। একটা কাঠের দোতলা স্কোর বোর্ড, তার একতলায় ছোট একটা ট্রেডল মেশিন নিয়ে ছাপাখানা, সেখানে স্কোর কার্ড ছাপা হত খেলা শুরুর আগে, লাঞ্চের সময় আর টি—এর সময় স্কোর ছাপা কার্ড বিক্রি হত। মোটা কাছির রোপ—এর ধারে ঘাসে হাত—পা ছড়িয়ে বসে আমি জীবনে প্রথম রঞ্জি ট্রফি ম্যাচ দেখি। মেজোকাকা নিয়ে গেছলেন তখন আমার বয়স বারো বছর।” একটানা বলতে বলতে মনা ভটচায ষাট বছর পিছিয়ে গিয়ে তার প্রথম দেখা রঞ্জি ম্যাচটাকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টায় চোখ মুছলেন। কলাবতী লক্ষ করল তার দাদুর চোখ অন্যমনস্কের মতো মনা ভটচাযের হাতের লাঠিতে তাকিয়ে।

”মনা, সেটায় বেঙ্গল খেলেছিল কার সঙ্গে বলো তো?”

”সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার সঙ্গে।”

”আরে আমিও তো ম্যাচটা দেখেছি। তিনদিনের ম্যাচ আড়াই দিনেই শেষ, থার্ড ডে লাঞ্চের পর। মুস্তাক আলির ওভারের শেষ বলে এক রান নিয়ে কার্তিক বোস এ—ধারে এল। বেঙ্গলের তখন জিততে দুটো রান দরকার, হাতে আটটা উইকেট। ক্যাপ্টেন ওয়াজির আলি বল করতে এল। কার্তিক বোস পুল করলে শর্ট স্কোয়্যার লেগে বিজয় হাজারে বলটা থামাল। পরের বলেই লেট কাট—বল থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে যাচ্ছিল, ভায়া পয়েন্ট থেকে ছুটে গিয়েছিল বলটা ধরতে। অ্যালেক হোসি চিৎকার করে বলছিল, ‘বোস রান।’ ছুটে ওরা দুটো রান নেয়। ভায়া বলটা উইকেটকিপারের হাতে ছুড়ে দেওয়ার আগেই।” বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজশেখরের মুখ। কলাবতী ভাবল, ছোটবেলা কী অদ্ভুত সময়, এত বছর পরও দুই বুড়ো হুবহু সব মনে রেখেছে। তাকেও সব মনে রাখতে হবে, এদের কথাবার্তাও। কে হাজারে, কে মুস্তাক আর ওয়াজির আলি সে জানে না তবে দাদু যেরকম সম্ভ্রম করে নামগুলো উচ্চচারণ করলেন তাতে তার মনে হল তিনজন খুবই বড় খেলোয়াড় ছিলেন।

”জানো রাজু, এই ম্যাচ দেখেই আমার ইচ্ছে হয়, উইকেটকিপার হব। বাংলার কিপার ছিল ভ্যান্ডারগুচ সাহেব। রোগা, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা। মনে হত একটা সারস উইকেটের পেছনে উবু হয়ে বসে। ফার্স্ট ইনিংসে সুঁটে ব্যানার্জির বলে হাজারের যে ক্যাচটা ডান দিকে ঝাঁপিয়ে নিল, দেখে মনে হয়েছিল সারস উড়ল। সেকেন্ড ইনিংসে হাজারেকে স্টাম্পড করল টম লংফিল্ডের মিডিয়াম পেস বলে, ভাবতে পারো! আর একটা স্টাম্পড করল কমল ভটচাযের বলে ওয়াজির আলিকে।” বৃদ্ধ মনা ভটচায উৎসাহে উঠে দাঁড়ালেন লাঠি না ধরেই। রাজশেখর তাকে টেনে বসালেন।

”বোসো তো, মনা তোমার স্মৃতিশক্তি কেমন এবার তার পরীক্ষা নেব। বলো তো ওই ম্যাচে ক’টা বাঙালি খেলেছিল? বাংলা আট উইকেটে জিতে পরে কার সঙ্গে খেলে?”

মনা ভটচায মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন, ”এ আর বলতে পারব না, ম্যাচটা হয়েছিল জানুয়ারির গোড়ায় আর পরের ম্যাচ জানুয়ারির শেষে ইডেনেই হায়দরাবাদের সঙ্গে, সেটা রঞ্জি সেমিফাইনাল। আর সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচে তো বাঙালি ছিল। কার্তিক বোস, কমল ভটচায আর সুঁটে ব্যানার্জি, তিনজন। এ কামাল নামে একজন ছিল, তবে বাঙালি নয়। পরের ম্যাচেও ছিল এই তিন বাঙালি, আর এক সাহেবকে বাদ দিয়ে এল সুশীল বোস, চারজন।”

”এই হায়দরাবাদ ম্যাচেই বাংলার পক্ষে প্রথম একটা ব্যাপার হয়েছিল, বলতে পারো সেটা কী? আমার অবশ্য তখন অতশত বোঝার মতো বয়স ছিল না, পরে বাবার কাছে শুনি।” রাজশেখর মিটমিট হেসে তাকিয়ে রইলেন মনা ভটচাযের দিকে। তিনি চোখ কুঁচকে মুখ তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। দশ সেকেন্ড পর মুখ নামিয়ে আনলেন চন্দ্রপুলির বাক্সে। আনমনে বাক্সের ঢাকনা রাবার ব্যান্ড থেকে মুক্ত করে খুললেন। কিশমিশ বসানো আধফালি চাঁদের মতো থাক দেওয়া পুলির একটা তুলে তিনি রাজশেখরের দিকে এগিয়ে ধরলেন। রাজশেখর আড়চোখে লাজুক ভাবে নাতনির দিকে তাকিয়ে চন্দ্রপুলিটা হাতে নিলেন। কলাবতী আগে কখনও এইভাবে কারও হাত থেকে দাদুকে খাবার জিনিস নিতে দেখেনি।

বাক্সটা কলাবতীর সামনে ধরে মনা ভটচায বললেন, ”নাও।” সে দাদুর দিকে তাকাল।

রাজশেখর তখন চন্দ্রপুলিতে কামড় দিচ্ছেন। মাথা নেড়ে বললেন, ”তুলে নে। ফেলু ঘোষ দারুণ বানিয়েছে। মনা তুমিও তোলো।”

কলাবতী চন্দ্রপুলি তুলে নিয়ে তার একটা কোণ দাঁতে কাটল। মিহি করে বাটা নারকেল, ছানা আর ক্ষীর দিয়ে তৈরি পুলি মুখের মধ্যে দিয়ে চুষতেই মিলিয়ে গেল। কলাবতী অবাক হয়ে ভাবল, এমন একটা জিনিস আগে কখনও কেন খাইনি! সে অন্য দু’জনের দিকে তাকাল। মনা ভটচাযের হাতেরটা আধখানা, দাদুর হাত শূন্য।

”রাজু বসে আছ কেন, হাত চালাও।” নিজেরটা শেষ করে মনা ভটচায বাক্সের দিকে হাত বাড়ালেন। ”আমি কিন্তু আর খাব না, ডায়বিটিসটা একটু বেশির দিকেই।”

”মনা, আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু এখনও পেলাম না।”

”দেব, দেব, একটু ভাবতে দাও। নাও, আর একটা তোলো। কলাবতী লজ্জা কোরো না। আর একটা নাও। এত চন্দ্রপুলি খাবে কে? বাড়িতে তো আমি আর আমার বউ, তিনি তো মেয়ের বাড়ি গেছেন।…নাহ মনে পড়ছে না, তুমিই বলো।” মনা ভটচায হাল ছেড়ে দিলেন।

”ওই এ কামাল একটা সেঞ্চুরি করেছিল, ন’নম্বরে ব্যাট করতে নেমে। বাংলার পক্ষে ওটাই প্রথম রঞ্জি সেঞ্চুরি।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে রাজু। সুঁটে ব্যানার্জি ছিল দশ নম্বরে। দারুণ একটা স্ট্যান্ড দিয়েছিল কামালকে। সুঁটেদা নট আউট ছিল, তিন রানের জন্য হাফ সেঞ্চুরিটা হয়নি। কী, ঠিক বলেছি?” মনা ভটচাযের মুখ ঝলমল করে উঠল নিজের স্মৃতিকে আবার সবল করে তুলতে পেরে। ”আরও বলছি, বাংলা সেই প্রথম ফাইনালে উঠে খেলতে গেল বোম্বাইয়ে নওনগরের সঙ্গে। ভিনু মানকাদ তখন অল্পবয়সী ছেলে। কী মারটাই না দিল বেঙ্গলের বোলারদের। প্রথম দিনেই একশো পঁচাশি করে কমল ভটচাযের বলে ক্যাচ আউট হল। কাগজে মানকাদের ছবি দেখেছি। ব্লেজার পরা, গলায় সিল্কের স্কার্ফ। তখন ওটাই স্টাইল ছিল।” কথা শেষ করে মনা ভটচায বাক্সের দিকে হাত বাড়ালেন, রাজশেখরও পিছিয়ে রইলেন না।

”রোজ সকালে কাগজ এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তুম। চারদিনের ম্যাচটা যেন চার ঘণ্টায় শেষ হল বলে তখন মনে হয়েছিল।” রাজশেখর স্মৃতি এবং চন্দ্রপুলি রোমন্থন করতে করতে বললেন। ”মনা, তোমার ভ্যান্ডারগুচ ফাইনালে ছিল বাংলার ক্যাপ্টেন, আর নওনগরের ক্যাপ্টেন ছিল আর এক সাহেব, যার কাছে মানকাদ বোলিং শিখেছিল, বার্টি ওয়েন্সলি। ফার্স্ট ইনিংসে ভ্যান্ডারগুচ দারুণ ব্যাট করে প্রায় আশি রান করেছিল। তবু বাংলা একশোরও বেশি রানে পিছিয়ে পড়েছিল। সেটা খানিকটা সামলায় সেকেন্ড ইনিংসে স্কিনার সাহেব একটা সেঞ্চুরি করায়। তবু আড়াইশোর মতো রানে বাংলা হেরেছিল।”

মনা ভটচাযের সঙ্গে রাজশেখরেরও চোখে বিষাদের ছায়া পড়ল। কলাবতীর মনে হল দু’জনে যেন বোম্বাইয়ে মাঠের ধারে বসে এই মাত্র বাংলাকে হেরে মাঠ থেকে ফিরতে দেখছেন।

রাজশেখর বললেন, ”সুঁটে ব্যানার্জি খেললে অবশ্য শেষ পর্যন্ত কী হত বলা যায় না। নওনগর ওকেই ভয় পাচ্ছিল তাই জামসাহেব ভাল চাকরির টোপ দিয়ে ওকে ফাইনালের ঠিক আগেই তুলে নিয়ে গেল। সুঁটে বলল ফাইনালে বাংলার এগেনস্টে খেলব না। জামসাহেব বলল, ঠিক আছে তবে বাংলার পক্ষেও খেলতে পারবে না। তখন তো এখনকার মতো আইনের বাঁধাবাঁধি ছিল না। যখন—তখন স্টেট বদল করা যেত।”

ওদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে কলাবতী একঘেয়ে বোধ করল। দু’জনে যেসব ঘটনার কথা বলে যাচ্ছে তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না। কে মানকাদ, কে স্কিনার, কে সুঁটে, তারা কেমন খেলত তার বিন্দুবিসর্গ সে জানে না। তাদের কথা শুনতে তার একটুও আগ্রহ হচ্ছে না। বরং যেজন্য তার এখানে আসা সেই উইকেটকিপিং নিয়ে তো একটা কথাও এখন পর্যন্ত হল না।

এই সময় বাইরের দরজায় বেল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ”ঘৌ ঘৌ” ডাক শোনা গেল। মনা ভটচায ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”কোয়ায়েট, কোয়ায়েট।” ডাক থেমে গেল।

কৌতূহলে কলাবতী বলল, ”মনাদাদু, আপনার কুকুরটা কোন জাতের।”

”ডোবারম্যান।” মনা ভটচায ভারী গলায় জানালেন।” ”এক বছর বয়স, দেখতে চাও যদি দেখে এসো, এই পাশের প্যাসেজেই বাঁধা আছে।”

কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে উঠোন, তার ধার ঘেঁষে সাদা পাথরের একটা রোয়াকে ভেতর দিকে চলে গেছে দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত। তার মনে হল সিঁড়ির পেছনে অন্ধকারপ্রায় জায়গাটায় কুকুরটা বোধ হয় বাঁধা রয়েছে। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। একটা ”গরর গরর” আওয়াজ শুনেই সে আর এগোল না। উঁকি দিতেই চোখাচোখি হল কুকুরটার সঙ্গে। লম্বা পা, ছিপছিপে কিন্তু স্বাস্থ্যবান, চকোলেট রঙের শরীর, লোম মখমলের মতো ঝকঝকে, ল্যাজটা কারা। দুটো চোখের ঠাণ্ডা চাহনির আড়ালে যেন ভর করে রয়েছে নিষ্ঠুরতা। ভয়ে গা শিরশির করল কলাবতীর। মোটা চেন দিয়ে বাঁধা থাকলেও সে আর কাছে গেল না।

তার মনে পড়ল খয়েরিকে। কাকার কাছে তো কত মক্কেলই আসে, সবাই খয়েরির অচেনা। গেট থেকে বাড়ির সদরের মধ্যের রাস্তাটায় ও বসে বা শুয়ে থাকে। অচেনা লোকেরা ওর পাশ দিয়ে নির্ভয়ে যাতায়াত করে। একদিন সকালে সে গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল এক মক্কেল গেট দিয়ে ঢুকে ওকে দেখে অস্বস্তিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। খয়েরি এখন অপুর মার যত্নে নাদুসনুদুস তাগড়াই হয়ে উঠেছে। নতুন কেউ ওকে প্রথম দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা। কিন্তু আশ্চর্য ওর বোধশক্তি, ঠিক বুঝে যায় কে ভাল আর কে দুষ্টু লোক। সেদিন মক্কেলটি আড়ষ্ট হয়ে যেতে খয়েরি একটু একটু ল্যাজ নেড়ে জানিয়ে দিল, ভয় নেই গো আমি কামড়াব না। লোকটি তারপর সদর দরজার দিকে এগোলে খয়েরি তার পিছু নিয়ে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে।

কলাবতী ঘরে ফিরে আসতেই মনা ভটচার্য জিজ্ঞেসা করলেন, ”কেমন দেখলে?”

”দারুণ। এত ভাল কুকুর আমি আগে দেখিনি।” কলাবতী গলায় আন্তরিকতা ঢেলে দিয়ে বলল।

”সে কী দেখোনি! কলকাতায় বহু লোকই তো পুষছে। যেমন ইন্টেলিজেন্ট তেমনই ফেরোসাস আবার ডিসিপ্লিনডও। দেখলে তো, বেল বাজতেই ডেকে উঠল, আবার ‘কোয়ায়েট’ বলতেই চুপ করে গেল। আমি খুব সস্তায়ই পেয়েছি, তিন হাজারে।”

”আপনি ওকে আদর করেন?”

 ”আমি! না না, আমার কাজের লোক মৃত্যুঞ্জয় ওকে দেখাশোনা করে, খেতেটেতে দেয়। অ্যাঞ্জেলার গায়ে ও ছাড়া আর কেউ হাত দেয় না, দিতে দেয় না।”

কলাবতীর মনে পড়ল পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করার জন্য মুরারিদা একটা লোককে ডেকে এনেছিল। তার পিঠে ছিল থলি। ওজন করে সেগুলো থলিতে ভরে, মুরারিদার হাতে টাকা দিয়ে লোকটি থলি কাঁধে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে খয়েরি ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল লোকটার দিকে। ভয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। খয়েরিও তার তিন হাত দূরে থেমে গিয়ে হিংস্রভাবে ডেকে যেতে লাগল। মুরারিদা চেঁচিয়ে লোকটিকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ”ভয় পেও না, এ হচ্ছে নেড়িকুত্তা, এরা থলে হাতে লোক দেখলেই অমন করে ছুটে আসবে। আস্তে আস্তে গেটের দিকে এগিয়ে দাও।” লোকটি তাই করল। খয়েরি চিৎকার করতে করতে গেট পর্যন্ত গেল কামড়াবার ভয় দেখাতে দেখাতে, কিন্তু কামড়ায়নি।

কলাবতী একতলার ঘরের জানলা থেকে সব দেখছিল। মুরারির তাচ্ছিল্যে বলা ‘এ হচ্ছে নেড়িকুত্তা’ শুনে তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল। ছুটে বেরিয়ে এসে সে খয়েরির গলার বকলস ধরে তাকে এলোপাতাড়ি চড়চাপড় মারতে মারতে ‘নেড়ি, নেড়িকুত্তা’ বলে চেঁচিয়ে যেতে লাগল। খয়েরি প্রথমে অকারণ প্রহারে হকচকিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ‘আঁউ আঁউ’ শব্দ করে কলাবতীর হাত ছাড়িয়ে পালাতে চাইল। কিন্তু এত শক্ত করে কলাবতী বকলসটা ধরে ছিল যে, সে পারল না। এক্ষেত্রে অন্য কুকুর হলে মুখ ঘুরিয়ে কলাবতীর কবজির কাছে হাতটায় কামড় দিত। তা না করে খয়েরি তার পা মাটিতে ছড়িয়ে বসে পড়ে মাথায় পিঠে চড় খেয়ে যেতে লাগল আর ”উঁ উঁ” আওয়াজ করে গেল। মুরারি ছুটে এসে কলাবতীর হাত চেপে ধরে বলল, ”করছ কী কালুদিদি, থামো।” কলাবতী তখন বকলস ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়েই ছুটে ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায় রাস্তায়।

রাত্রে অপুর মা ফটকের বাইরে থেকে খয়েরিকে বকলস ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে।

”কালুদিদি এই নাও তোমার খয়েরিকে। রাগ করে ফটকের বাইরে বসে ছিল। ওকে তুমি নিজে হাতে খেতে দাও। মুরারিদা বলল, তুমি নাকি ওকে চোরের মার মেরেছ। করেছিল কী?”

”কিছু নয়। ও কেন বিলিতি কুকুর হয়ে জন্মাল না। তা হলে সবাই ওকে খাতির করত, ভয় পেত, ওকে ‘নেড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করার সাহস পেত না।” কলাবতী ঝাঁঝালো স্বরে বললেও, গলায় ছিল অভিমান আর অকারণে মারার জন্য অনুশোচনা।

কলাবতী সেদিন রাতে নিজের হাতে রুটি খাইয়েছিল এক হাতে খয়েরির গলা জড়িয়ে ধরে। খাওয়ার পর তার হাতটা বাড়িয়ে দেয় খয়েরির দিকে চাটার জন্য। অবশ্যই সে চেটেছিল, কেননা এভাবেই সে আদর জানায়।

গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিলেন রাজশেখর। তিনি পাশে দাঁড়ানো সত্যশেখরকে তখন বললেন, ”ঠিক যেন মা আর মেয়ে।”

.

কলাবতী অন্যমনস্ক হয়ে গেছল খয়েরির কথা ভাবতে—ভাবতে। মনা ভটচাযের কথায় তার হুঁশ ফিরে এল।

”তুমি পুষবে? অ্যাঞ্জেলার বাচ্চচা হলে তোমায় একটা দেব।”

”দরকার নেই, আমার আছে।” কলাবতী ছোট্ট জবাব দিয়ে হাসল।

”বটে, বটে, কী জাতের?” মনা ভটচায উৎসাহী হয়ে উঠলেন।

”নেড়ি।”

মনা ভটচাযের মুখ দেখে কলাবতীর মনে হল এমন জাতের নাম কখনও শোনেননি। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন।

”ওকে কিনতে হয়নি। নিজের থেকেই এসেছে। ওকে বেঁধে রাখা হয় না, ও বাঁধা থাকতে চায় না। যে কেউই ওর গায়ে হাত দিতে পারে।” চাপা একটা গর্ব কলাবতীর স্বরে ফুটে উঠল। রাজশেখর প্রসঙ্গটা ঘোরাতে বলে উঠলেন, ”মনা, যেজন্য আসা। তুমি কালুকে কিছু টিপস দাও, যাতে ও উইকেটকিপার হতে পারে।”

”দ্যাখো, আমাদের সময়ে এখানকার মতো কোচিংটোচিং ছিল না। ব্যাট বা বলের জন্য তবু কোচ পাওয়া যেত কিন্তু উইকেটকিপারদের জন্য কিছুই ছিল না। একটু—আধটু যেটুকু শেখার শিখেছি ভাল উইকেটকিপারদের দেখে দেখে। আর বাকি বেশির ভাগটাই নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে আর অনবরত প্র্যাকটিস করে করে। উইকেটকিপিংয়ের ছকবাঁধা কোনও নিয়ম নেই। সুভাষ গুপ্তের বলে কোনদিকে কীভাবে ক্যাচ উঠবে কেউ জানে না; মুহূর্তের জন্যও কনসেনট্রেশন হারাবে না, বল থেকে চোখ সরাবে না। দিনে পঞ্চাশ ওভারের খেলায় একস্ট্রা বল বাদ দিয়ে তিনশো বল করা হয়, তার মানে তিনশো ওঠবোস। এজন্য আগে পায়ের, কোমরের জোর চাই। সারা ইনিংসে পাবলিক তোমার কথা ভুলে থাকবে, যেই একটা ক্যাচ কি স্টাম্প মিস করবে তখন তাদের তোমাকে মনে পড়বে আর সাতদিন ধরে খোঁটা শুনে যেতে হবে। আর একটা শক্ত ক্যাচ নিলে বা স্ট্যাম্প করলে জুটবে শুধুমাত্র কিছু হাততালি। যাক তোমাকে এইসব বলে নিরুৎসাহ করব না। দেখি তো উইকেটের পেছনে তুমি কীভাবে স্টান্স নাও।”

কলাবতী ঘরের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে উবু হয়ে বসে, দু’পায়ের ফাঁকে মেঝের ওপর দুই হাতের মুঠি ঠেকিয়ে রাখল ঠিক সেইভাবে টিভি—তে যেরকমটি দেখেছে দেশি ও বিদেশি উইকেটকিপারদের। মন ভটচায চোখ দুটো সরু করে ওর বসার ভঙ্গি দেখে বললেন, ”নড়াচড়া চট করে করতে তোমার সুবিধে হয় এমনভাবে বসবে। পা দুটো অত কাছে রাখলে ডাইনে কি বাঁয়ে কুইক সরে যেতে পারবে না, দেরি হয়ে যাবে। আর বাটিংয়ের সময় যেমন স্টান্স নেয় তেমনই শরীরের ভর থাকবে পায়ের পাতার সামনের দিকে, গোড়ালি দুটোর ওপর ভর থাকলে ফুট ওয়ার্কে দেরি হয়ে যাবে। আচ্ছা এবার গ্লাভসে বলধরাটা দেখি।”

কলাবতী দু’হাতের চেটো পাশাপাশি জড়ো করে দেখাল।

”আঙুলগুলো আর একটু ফাঁক করে বল জমানোর জায়গাটা বড় করো আর একটা হাতের কড়ে আঙুলের ওপরে অন্য কড়ে আঙুলটা রাখলে বল গলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আঙুল কখনও বল রিসিভ করার সময় বলের দিকে উঁচিয়ে রাখবে না, গ্লাভস জোড়া পেতে রাখবে, বলটাকে গ্লাভসে আসতে দেবে, জমা পড়লে হাত পেছন দিকে টেনে নিয়ে বলটা জমতে দেবে।” বলার সঙ্গে সঙ্গে মনা ভটচায সোফায় বসেই যথাসাধ্য দেখালেন। ”তোমাকে কিন্তু প্যাড আর গ্লাভস পরে বাড়িতে দু’হাত দিয়ে বল ধরার জন্য ডাইনে—বাঁয়ে ঝাঁপিয়ে পড়াটা প্র্যাকটিস করে যেতে হবে। প্রথমে ক্যাম্বিস কি রবারের বলেই কোরো, তারপর ক্রিকেট বলে।”

কলাবতী মন দিয়ে শুনল। রাজশেখর জানতে চাইলেন, ”মনা এই যে বললে যেটুকু শিখেছি দেখে দেখে। কাকে দেখে শিখেছিলে।”

”খোকনদাকে।”

কলাবতী জিজ্ঞেসা করল, ”কে খোকনদা?”

রাজশেখর জানালেন, ”প্রবীর সেন, ডাকনামেই সবাই চিনত। প্রথম বাঙালি যিনি টেস্ট ম্যাচ খেলেন তাও আবার অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যাডম্যানের টিমের এগেনস্টে।”

কলাবতী এবার লক্ষ করল বাক্সে চন্দ্রপুলি তলানিতে এসে ঠেকেছে। দুই বুড়োই কথার সঙ্গে মুখ চালিয়ে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে বলল, ”মনা দাদুর জন্য এনে তুমি নিজেই শেষ করে দিচ্ছ, আর নয়।”

বিব্রত এবং লজ্জিত রাজশেখর বললেন, ”শুনলি না মনা বলল ওর ডায়বিটিসটা বেশির দিকে, তাই যাতে আর বেশির দিকে না যায় সেজন্য চন্দ্রপুলি কমিয়ে দিলুম। বাড়িতে তো খাবার লোক নেই।”

.

ফণী ঘোষ সমস্যায় পড়েছেন। বোধ হয় মেয়েদের কোচিং করা আর সম্ভব নয়। ক্রিকেটের মতো খরচের খেলার জন্য প্রাথমিক যা—যা দরকার—বুট, ট্রাউজার্স, ব্যাটিং গ্লাভস, সম্ভব হলে নিজের ব্যাট এগুলো কিনে দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা দু—তিনজন ছাড়া কোনও মেয়ের পরিবারের নেই। প্রগতি সঙ্ঘ তাদের মাঠ ব্যবহার করতে দিচ্ছে, তিনটে স্টাম্প, পুরনো একজোড়া ব্যাটিং প্যাড, গ্লাভস, দুটো পার্চমেন্ট মোড়া ফাটা প্র্যাকটিস ব্যাট আর দুটো পুরনো ক্রিকেট বল, যা বহুবার ব্যবহারে নরম এবং ফুলে বড় হয়ে গেছে, মেয়েরা পাঁচ আঙুলে ভাল করে ধরতে পারে না। প্রগতি সঙ্ঘের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। সিনেমা শো, যাত্রাপালা, দুর্গাপুজোর সুভেনিরের বিজ্ঞাপন ও কয়েকজন ডোনারের টাকায় তাদের নেতাজি ও রবীন্দ্র জন্মোৎসব এবং ফুটবল ও ক্রিকেট বিভাগ চলে। সিজনের সময় একজন পার্ট টাইম মালী রাখা হয়। স্থানীয় কাউন্সিলারের বদান্যতায় দুর্গাপুজোর পর কর্পোরেশনের রোড রোলার এসে মাঠের মাঝখানটা রোল করে দেয়। সারা সিজন তাতেই চলে যায়। ম্যাচের দিন লাঞ্চের পাউরুটি—আলুর দম দেওয়া হয় কোয়ার্টার থেকে চাঁদা তুলে।

ক্লাবের সচিব তপন তরফে তপা বাগচি পরিশ্রমী এবং কাটখোট্টা ধরনের মানুষ। একদিন ফণী ঘোষকে বললেন, ”ফণীদা, মেয়েদের কাছ থেকে চাঁদা তুলুন। ওদের বলুন বিনা পয়সায় কিছু শেখা যায় না। ক্লাবই সব দেবে তা তো হয় না, স্কুলে পড়ার জন্য মাইনে দিতে পারে, ক্লাবে শেখার জন্য চাঁদাও দিতে হবে। ছেলেদের ব্যাট প্যাড গ্লাভস বেশিরভাগ মেয়েরই তো দেখছি ভারী হয়ে যাচ্ছে, ওরা তো ব্যাট তুলতেই পারছে না, প্যাড পরে ছুটতেও পারছে না। সবকিছুই একটু ছোট সাইজের কিনতে হবে, সেজন্য টাকার দরকার। যেমন—তেমন একজোড়া ব্যাট, দু’জোড়া করে প্যাড আর গ্লাভস কিনতেই তো আড়াই—তিন হাজার টাকা লাগবে। তার ওপর আছে বল। এতসব দেওয়া আমার ক্লাবের পক্ষে সম্ভব নয়, আপনি টাকা তুলুন, ডোনার খুঁজুন।”

ফণী ঘোষ অতঃপর স্থির করলেন যে—ক’টি মেয়ে এখনও আছে তাদের বাবা—মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন, চারশো টাকা করে প্রত্যেকের কাছে চাইবেন। চারদিন ধরে তিনি তিনজন বাবা, একজন দাদু, একজন মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। বাবারা সোজা বলে দিলেন, দিতে পারবেন না। একজন বাবা বললেন, ”ভেবে দেখি। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে লেখাপড়ার কতটা ক্ষতি হবে সেটা তো আগে ভেবে দেখা দরকার।”

আর একজন বললেন, ”প্রাইভেট টিউটরের মাইনে, তার ওপর ক্রিকেটের খরচ। না দাদা, পারব না।”

এক মা বললেন, ”অত শক্ত বলে খেলা! সেদিন মেয়ের আঙুলে বল লাগল, আজ তিনদিনেও ভাল করে আঙুল বাঁকাতে পারছে না। কলম ধরতে পারছে না। না বাপু ক্রিকেট খেলে কাজ নেই তার থেকে বরং টেনিস—মেনিস খেলা শেখাতে পারেন যদি তার ব্যবস্থা করুন। সেদিন টিভি—তে স্টেফিকে দেখছিলুম, কী সুন্দর যে লাগছিল। আপনি ডোনেশনের জন্য ভাববেন না।”

দাদু বললেন, ”ক্রিকেট খেলে কী হবে, মেয়েদের ক্রিকেটে কি টাকা আছে? চাকরি পাওয়া যাবে? ছেলেদের যত নাম বেরোয় কাগজে কই মেয়েদের নাম তো দেখি না? না মশাই, টাকাফাকা দিতে পারব না, যতটুকু শিখেছে তাই যথেষ্ট।”

অবশ্য একজন বাবা এককথার দিতে রাজি হলেন, আর একজন বললেন, ”জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে একটু টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছি। বড় জামাইবাবুর বাইপাস সার্জারিতে অনেক টাকা দিতে হল। হাত এখন একদম খালি। তবে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে চার মাসে দিতে পারি।”

ফণী ঘোষ আর কোনও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতে উৎসাহ বোধ করলেন না। সকালে মেয়েরা মাঠে আসতে তিনি তাদের জড়ো করে বললেন, ”ক্রিকেট কী করে খেলতে হয় সে সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আশা করি তোমাদের হয়েছে। একদমই খেলতে জানতে না, এখন তবু ব্যাট ধরা, বল করা, ফিল্ড করাটা তোমরা শিখেছ। এটা হল ভিত। এর ওপর একতলা, দোতলা তৈরি করতে করতে উঁচু বাড়ি তৈরি করা। এজন্য আসল ক্রিকেট সরঞ্জাম নিয়ে আসল প্র্যাকটিস করে যেতে হবে। সেই জিনিসগুলো পেতে হলে টাকা দিয়ে কিনতে হবে, কিন্তু টাকা আমাদের নেই। আমি চেষ্টা করেছি টাকা জোগাড়ের। তা তো তোমরা জানোই। তোমাদের বাড়ি বাড়ি গেছি কিন্তু—” ফণী ঘোষ মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। তিনি নিজেও বিষণ্ণ বোধ করছেন। উৎসাহে টগবগ করা, খেলা শিখে বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা উজ্জ্বল চোখগুলিকে ঝিমিয়ে যেতে দেখে তার মন দুঃখে ভরে গেল।

মেয়েদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল কলাবতীও। শুনে তারও মন খারাপ হয়ে গেল, শুধু টাকার অভাবে ক্রিকেট খেলার এই সুযোগটা, এত মেয়ের বন্ধুত্ব তাকে হারাতে হবে ভেবে। ক্রিকেট তো একা খেলা যায় না, একটা দল থাকতে হবে। দল না থাকলে তার খেলাও নেই। সেই দল গড়ে উঠছিল কিন্তু গড়ার মুখেই ভেঙে যেতে বসেছে।

সে জিজ্ঞেস করল, ”ফণীদা, কত টাকা হলে আমাদের আসল প্র্যাকটিস শুরু করা যাবে?”

ফণী ঘোষ মুখে ক্ষীণ ফুটিয়ে বললেন, ”তিন হাজার হলেই এখন চলবে।”

কলাবতী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না, শুধু ভ্রূদুটো একবার ওপরে তুলে, কী যেন ভাবল।

রাজশেখরের ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে শুনেছিলেন ফণী ঘোষ। জিজ্ঞেস করলেন, ”কালু, এখন রাজু কেমন আছে?”

”সেরে গেছেন, তবে বেশ দুর্বল। আজ বলছিলেন আসবেন, আমি বারণ করলুম। এতটা পথ হেঁটে আসার জন্য শরীরে যথেষ্ট জোর এখনও ফিরে পাননি।”

”আজ বিকেলের দিকে রাজুকে দেখতে যাব আর সেইসঙ্গে দেখে আসব তোমাদের বাগানে তুমি কীরকম উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করছ।”

সিংহি বাড়ি ও বাগান প্রায় দু’বিঘে জমিতে। কলকাতা শহরে এতবড় জমিসমেত বাড়ি খুব কমই আছে। বাড়িতে থাকেন মাত্র পাঁচটি লোক। আর সবই ঠিকে ঝি—চাকর। বাড়ির সঙ্গের বাগানটি অযত্নেই পড়ে ছিল এতদিন। কলাবতীর প্র্যাকটিসের জন্য ঝোপঝাড় কেটে, ইটকাঠ সরিয়ে রাস্তার দিকের পাঁচিলের কাছে চাঁপাগাছের ধারে প্রায় দশ বর্গফুট জমি থেকে জনমজুর লাগিয়ে কাঁকর বেছে তুলে ফেলে, বড় বড় ঘাস ছাঁটাই করে এবং জল ঢেলে মাটি দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ক্রিকেট পিচ বানানোর চেষ্টা হয়েছে। সেখানে দশটা বল পড়লে অন্তত তিনটে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে ছিটকে যাবে, দুটো লাফিয়ে বুকের কাছে আসবে, দুটো আসবে জমি ঘষড়ে। বাকি তিনটে আসবে ঠিক উচ্চচতায়। এই পিচেই তিনটি স্টাম্প পুঁতে কলাবতী উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করে আসল ক্রিকেট বল দিয়ে। প্রথম দিন রাজশেখর নিজে আটটা লেগ ব্রেক বল করে হাঁফিয়ে পড়েন। আটটার মধ্যে চারটে কলাবতীর মাথার অনেক ওপর দিয়ে গিয়ে পাঁচিলে ঠকাস করে লাগে। বাকি চারটের মধ্যে দুটো রাজশেখরের থেকে পাঁচ হাত দূরে পিচ পড়ে তিনটে ড্রপ খেয়ে উইকেটকিপারের কাছে পৌঁছয়। আর দুটো গালির দিকে যেতে যেতে চাঁপাগাছের গুঁড়িতে ধাক্কা মারে।

মুরারি, অপুর মা কাছেই দাঁড়িয়ে ”কিরকেট” নামক এই অদ্ভুত খেলাটা দাদু ও নাতনি কেমন করে খেলে তাই দেখছিল। পাশে ছিল আর এক দর্শক, খয়েরি। ওদের শুনিয়ে লাজুক স্বরে রাজশেখর জানালেন, ”নাহ শরীরটা দুর্বল লাগছে। পঁয়তাল্লিশ বছর খেলা ছেড়েছি তারপর ক্রিকেট বল তো আর ছুঁইনি।…..মুরারি পারবি বল করতে? যা, কালু দিদিকে প্র্যাকটিস দে।”

আদেশটা প্রথম হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি মুরারি। সে শুধু দাঁত বার করে হেসে দাঁড়িয়ে রইল।

”মুরারি, কথাটা কানে গেল কী? বলটা নিয়ে এইভাবে কালুদিদির দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিবি। ঠিক ওই জায়গাটায় যেন পড়ে।” এই বলে রাজশেখর বলটা ঢিল ছোড়ার মতো জোরে ছুড়ে কলাবতীর প্রায় দশ ফুট সামনে ফেললেন। উইকেটের পেছনে উবু হয়ে বসা কলাবতী অফস্টাম্পের এক হাত বাইরে পরিচ্ছন্ন ভাবে কোলের কাছে বলটা গ্লাভসে জমিয়ে নিল।

”দেখলি তো, এইভাবে ছোড় ঠিক ওইখানটায়।” রাজশেখর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কলাবতী বলটা গ্লাভসে ধরে বোলারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য উঁচু করে তুলে ছুড়ে দিয়েছে। বলটা রাজশেখরের দিকে না গিয়ে উঠল মুরারির মাথার ওপর। সে ‘হাই হাই’ বলে দু’হাত মাথার ওপর তুলল হরিনাম সঙ্কীর্তন করার মতো। বলটা তার মাথার ওপর পড়ত কিন্তু পড়ল কাঁধে, সেখান থেকে ছিটকে খয়েরির পাশ দিয়ে যেতেই, খয়েরি তাড়া করে বলটা কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে যেতে লাগল।

কলাবতী হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল, ”আয়, খয়েরি আয়, বলটা দে।”

বল মুখে নিয়ে খয়েরি ছুটে এল কলাবতীর কাছে। ওর মুখ থেকে ক্রিকেট বলটা বার করে নিয়ে কলাবতী সেটা গড়িয়ে দিয়ে ”ধর ধর” বলে চেঁচিয়ে উঠল। খয়েরি বলের পেছনে ছুটল। বারো—চোদ্দো মিটার বলটা গেছে তখন গিয়ে বলটা মুখে ধরল যেভাবে সে তাড়া করে ইঁদুর ধরে বাগানে। বল মুখে সে ফিরে এল কলাবতীর কাছে। বলটা মুখ থেকে জমিতে নামিয়ে রেখে সে লেজ নাড়তে থাকল। লেজ নাড়াটা তার খুশির প্রকাশ। এখন সে একটু বাহবা চায়। অপুর মা ওর মাথা নেড়ে দিল।

উচ্ছ্বসিত কলাবতী বলল, ”দাদু, দেখো একটা ফিল্ডার পেয়ে গেছি।”

সে বলটা এবার আলতো করে তুলে নিল দাদুর দিকে। রাজশেখর লুফলেন। খয়েরি ধরবে বলে ছুটে গেল বল অনুসরণ করে। বল না পেয়ে খয়েরি দু—তিনবার ”ভৌ ভৌ” করে ডেকে বলটা চাইল। রাজশেখর খয়েরির মাথা চাপড়ে দিলেন। ”কী রে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন!” তিনি ধমক দিলেন মুরারিকে।

মুরারি দু’বার ঢোক গিলে, অপুর মার আঁচল চাপা মুচকে হাসা মুখের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে রাজশেখরের হাত থেকে বলটা নিল। চোখ সরু করে রাজশেখরের দেখিয়ে দেওয়া জায়গাটার দিকে দশ সেকেন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলটা মিডিয়াম পেসে ছুড়ল। ঠিক জায়গাতেই পড়ে অফ কাটারের মতো লেগের দিকে বলটা প্রায় এক ফুট সরে গেল। কলাবতী বাঁ দিকে হাত বাড়িয়ে বলটা ধরে রাখতে না পারলেও থামিয়ে ফেলল।

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”আরে, মুরারি তো ভালই বলটা করল! নে, আবার কর।”

কত্তাবাবুর প্রশংসা শুনে মুরারি এক বুক শ্বাস নিয়ে ছাতি ফুলে গেল। প্রায় একই জায়গায় সে পরপর চারটে বল ফেলল। কলাবতী এবার সবক’টাই গ্লাভসে ধরে রাখল। সে চেঁচিয়ে বলল, ”দারুণ মুরারিদা, দারুণ। করে যাও, আরও করে যাও।”

মুরারি মুখ করুণ করে বলল, ”কত্তাবাবু এসব কাজ করা তো ওব্যেস নেই। কাঁধে ব্যথা লাগছে।”

রাজশেখর বললেন, ”ব্যথা না হওয়ার ওষুধ দিচ্ছি, কালুদিদিকে যতবার বল করবি, প্রত্যেক বলের জন্য পাঁচ পয়সা করে পাবি। যা, এবার বল কর।”

মাথা চুলকে মুরারি বলল, ”আজ্ঞে, ওটা ছ’পয়সা করুন।”

রাজশেখর একটুও না ভেবে বললেন, ”ঠিক আছে। দিনে তা হলে ক’টা করে বল ছুড়বি?”

”চল্লিশ—পঞ্চাশটা তো পারবই।” মুরারি নিশ্চিত স্বরে বলল।

সন্ধেবেলায় অপুর মা জিজ্ঞেস করল মুরারিকে, ”চল্লিশ—পঞ্চাশটা বল ছুড়ে ক’পয়সা পাবে মুরারিদা?”

মুরারি বলল, ”সে মেলা পয়সা, হিসেব না করে বলতে পারব না।”

”তুমি তো দেখছি ভাল বল ছুড়তে পারো।”

”পারব না কেন। ছেলেবেলার ঢিলিয়ে কত আম পেড়েছি জানিস? এক টিপে এক—একটা আম পড়ত।”

এরই চারদিন পর ফণী ঘোষ সকালে কলাবতীকে বলেন, ”আজ বিকেলের দিকে রাজুকে দেখতে যাব।” তিনি বিকেলে সিংহিবাড়ির ফটক দিয়ে ঢুকেই দেখলেন রাজশেখর একটা টুলে বসে তার পাশে গলায় বকলস দেওয়া একটা খয়েরি কুকুর সামনের দু’পা জমিতে ছড়িয়ে বসে, ধুতি আর গেঞ্জি পরা একটি কাঁচাপাকা চুলের লোক ক্রিকেট বল ছুড়ছে কলাবতীকে। তিনটে স্টাম্পের পেছনে গ্লাভস আর প্যাডে সজ্জিত ট্রাউজার্স পরা কলাবতী বল ধরতে ডান দিকে ঝাঁপাল। ফণী ঘোষ আর না এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দূর থেকেই দেখার জন্য।

রাজশেখরের হাতে ফর্দের মতো লম্বা কাগজ আর কলম। মুরারি একটা করে বল ছুড়ছে আর ফর্দে তিনি টিক দিচ্ছেন। তেরো নম্বর টিক দিয়েছেন যখন কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল, ”দাদু দেখো দেখো কে এসেছেন।”

রাজশেখর মুখ ফিরিয়ে দেখে বললেন, ”আরে ফণী, ওখানে দাঁড়িয়ে কেন, এসো এসো। কেমন দেখছ বলো।”

‘ফণী ঘোষ কাছে এসে বললেন, ”কালু তো ভালই কালেক্ট করছে। তবে একটা মুশকিল কী জানো রাজু, ম্যাচে যখন কিপ করবে তখন তো সামনে ব্যাট হাতে একজন থাকবে। তখন কিন্তু কিপিংটা এমন সোজা ব্যাপার হবে না। কিন্তু তোমার এখানে তো কারুর ব্যাট করা সম্ভব নয়, ওকে এবার মেয়েদের ভাল ক্লাবে দিতে হবে সেখানে সত্যিকারের প্র্যাকটিস হয়।”

”মেয়েদের ক্লাব! কোথায় পাব?” রাজশেখরকে অসহায় দেখাল। তারপরই তাড়া দিলেন মুরারিকে। ”হাঁ করে কথা গিলছিস কী? বল ছোঁড়। অপুর মা এটা ধরো।” রাজশেখর বল ছোড়ার ফর্দ আর কলমটা ওর হাতে দিয়ে বললেন, ”যেভাবে টিক দিয়েছি, গুনে গুনে সেইভাবে দিয়ে যাও। আমি বৈঠকখানায় যাচ্ছি।”

ফণী ঘোষকে নিয়ে রাজশেখর বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

”ঠিক করে টিক দিবি।” মুরারি হুঁশিয়ার করে দিল অপুর মাকে। একটা বড় কাজের দায়িত্ব পেয়ে অপুর মার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। মুরারি একটা করে বল ছোড়ে আর বলে, ”টিক মার।” অপুর মা একটা টিক দেয় দুটো বল ছোড়ার পর।

আধঘণ্টা পর কলাবতী ফিরল। তখন ফণী ঘোষ বলছেন, ”ধুপুদের ক্লাবটা ভাল। টাকাকড়িও আছে, নইলে নেট খাটিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারে? এই যে কালু, শোনো তুমি ধুপুদের ক্লাবে জয়েন করো। প্রগতি সঙ্ঘে থাকলে তোমার কিছু হবে না। উইকেট কিপিংয়ে তোমার একটা সহজাত ঝোঁক মানে—” বোঝাবার জন্য সঠিক কথাটা তিনি খুঁজতে শুরু করলেন।

রাজশেখর বললেন, ”সহজাত দখল আছে।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি দেখছিলুম ওর বডি মুভমেন্ট। এটা তো কেউ ওকে শেখায়নি কিন্তু ঠিক বলের লাইনে মুভ করছিল।” ফণী ঘোষ তারিফের ভঙ্গিতে চোখ বুজে মাথা হেলালেন।

রাজশেখর বললেন, ”কালু, ফণী আজ প্রথম এল, মিষ্টিমুখ তো করাতে হবে।”

কলাবতী মুখ টিপে হেসে জানাল, ”মুরারিদাকে আমি বলে দিয়েছি।”

সিংহিবাড়ির দুটো ফ্রিজ সবসময়ই ভর্তি থাকে মরসুমি ফল আর নানাবিধ মিষ্টান্নে। একটু পরেই ট্রে হাতে মুরারি এল। প্লেট ভরা কাটা ল্যাংড়া আম আর কড়াপাকের সন্দেশ।

”চা দেব না লস্যি?” মুরারি রাজশেখরের কাছে জানতে চাইল।

”লস্যিই দিক।” রাজশেখর অনুমোদনের জন্য ফণী ঘোষের দিকে তাকালেন, মাথা হেলিয়ে তিনি সম্মতি জানালেন।

পরদিন স্কুলে টিফিনের সময় কলাবতী খুঁজে বার করল ধুপুকে। ”তোর সঙ্গে একটা কথা আছে, চালতাতলায় আয়।” স্কুলের উঠোনে একটা চালতাগাছ আছে, তার গুঁড়ি ঘিরে সিমেন্টের রক। সেটাই চালতাতলা।

দু’জনে এসে রকে বসল। কলাবতী টিফিন বক্স খুলে ধুপুর সামনে ধরে বলল, ”নে তোল।” ধুপু খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধ ডিমটা তুলে নিয়ে আধখানা কামড়ে চিবোতে চিবোতে বলল, ”বল এবার।”

ভণিতা না করে কলাবতী বলল, ”তোদের ক্লাবে ভর্তি হব, উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করব।”

ধুপু বলল, ”আমাদের ক্লাবে একজন উইকেটকিপার আছে।”

”দু’জন থাকলে অসুবিধে হবে কি? একজন যদি কোনও কারণে না খেলতে পারে?” কলাবতী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

ধুপু ভ্রূ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত ভেবে বাকি ডিমটা মুখে পুরে বলল, ”আমাদের সেক্রেটারি ইন্দুদিকে জিজ্ঞেস করে পরশু তোকে বলব। তুই বল—টল ধরতে বা থামাতে পারিস তো?

”আজ বিকেলে আয় না আমাদের বাড়িতে, তোকে দেখিয়ে দেব বল ধরতে পারি কি না। আর কিছু খাবি না?” কলাবতী টিফিন বক্সটা আবার এগিয়ে ধরল। ধুপু ইতস্তত করে চমচমটা তুলে নিল।

বিকেলে কলাবতী বাগানে মুরারির ছোড়া বল ধরছে। টুলে বসে রাজশেখর, তার পাশে খয়েরি। অপুর মা অনুপস্থিত। সে তখন বাড়ির মধ্যে বাসন মাজার ঠিকে কাজের লোকের সঙ্গে কী একটা ব্যাপারে হেস্তনেস্ত করায় ব্যস্ত। তখন ধুপু এল। ফটক দিয়ে ঢুকে এধার—ওধার তাকিয়ে কলাবতীকে চোখে পড়তেই এগিয়ে গেল। খয়েরি এগিয়ে এসে ধুপুর জুতো শুঁকল। একটা হাই তুলে আগের জায়গায় ফিরে এল।

”দাদু, এই আমার বন্ধু ধুপু, ভাল নাম ধূপছায়া। ব্যাটে ওপেন করে। দাদুর কথা তো তোকে বলেইছি।”

ধুপু বলল, ”বাহ, প্র্যাকটিসের তো ভাল ব্যবস্থা। গ্লাভস প্যাড সবই নিজের! দেখি তো কেমন ফিল্ড করিস।” এই বলে ধুপু মুরারির কাছ থেকে বলটা চেয়ে নিল। কলাবতী উইকেটের পেছনে গেল। খুবই স্লো লেগব্রেক কিন্তু বল ভালই ঘুরল জমি থেকে। দুটো স্টাম্পে লাগল। চারটে মিডল স্টাম্প থেকে অফের দিকে গেল, কলাবতী ধরল এবং লেগ স্টাম্পের বাইরের তিনটেও।

চমৎকৃত ধুপু বলল, ”বাহ, তুই তো সবক’টা বলই ধরলি! ধরে আবার স্টাম্পও করলি। শিখলি কোত্থেকে?”

”টিভিতে দেখে দেখে উইকেটকিপারের কাজটা বুঝে গেছি, তারপর প্র্যাকটিস।” কলাবতী হাসতে শুরু করল। ”কী রে, আমাকে দিয়ে তোদের চলবে?”

”সেটা ঠিক করবেন বাবুদা, ভাল নাম সুবীর ব্যানার্জি। রঞ্জি ট্রফি খেলেছেন, এখন আমাদের কোচ। আমাদের নেট হয় একদিন অন্তর দু’বেলা এক ঘণ্টা করে, কাল হবে সকাল সাতটায় আর বিকেল চারটেয়, তারপর আবার তরশু হবে। ছুটির দিনে একবেলা সকালে তিন ঘণ্টা হয়। আমি কালই সেক্রেটারিকে বলব, হাসিদির একজন বদলি থাকা দরকার।”

কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”হাসিদি কে?”

”আমাদের উইকেটকিপার। থাকে বাগুইহাটিতে। তুই আয়, ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, খুব ভাল মেয়ে।”

পরদিন স্কুল শুরুর আগে কলাবতী অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে স্কুলের ফটকে অপেক্ষা করছিল ধুপুর জন্য।

”কী বললেন, ইন্দুদি?” কলাবতী শ্বাস বন্ধ করে ধুপুর দিকে তাকিয়ে ওর মুখভাব লক্ষ করে যেতে লাগল। মুখটা গম্ভীর লাগছে যেন। ধুপু না দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল।

”বল কী বললেন?” কলাবতী হতে চেপে ধরে ধুপুকে থামাল।

”বললেন পরশু সকালে যেতে, তোকে দেখবেন।”

হতভম্ব কলাবতী বলল, ”দেখবেন? আমাকে দেখে কী হবে।”

”বাঃ, দেখবেন না, তুই ব্যাকস্টপার না সত্যিকারের উইকেটকিপার?”

”আমি তো এখনও উইকেটকিপারই হইনি। ভাল করে শেখার অন্য ভাল বোলারদের বলে প্র্যাকটিস করতে চাই ভাল উইকেটে। দেখেছিস তো আমাদের বাগানে কী রকম এবড়োখেবড়ো জমিতে কীরকম বোলিংয়ে শিখি। এই বিদ্যে নিয়ে কি উইকেটকিপিং পরীক্ষায় পাশ করা যায়!” কলাবতীকে নিরুৎসাহ দেখাল।

ধুপু ওর কাঁধে হাত রেখে শান্ত নরম স্বরে বলল, ”এটাকে ক্লাসের পরীক্ষা ভাবছিস কেন, স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য যে পরীক্ষা দিতে হয় এটা সেইরকম। আমাকেও দিতে হয়েছিল। অনেক এলেবেলে আসে তো, সবাই বলে দারুণ ব্যাট করি, দুর্দান্ত বল করি। বাবুদা তাদের এক ওভার দেখে নিয়েই ইন্দুদিকে বলে দেন, ‘এর কোনওকালে হবে না’, কারুর সম্পর্কে বলেন, ”তিন বছর রগড়ালে যদি কিছু হয়’, কিংবা বলেন, ‘এই মেয়েটার ক্রিকেট সেন্স আছে, একে রেখে দিন, খাটলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।’ বাবুদা একজন উইকেটকিপার চাইছেন, যে হাসিদির স্ট্যান্ডবাই থাকবে।”

”তোর কথা শুনে তো ভয় লাগছে, যদি বাবুদা বলে দেয় এর কোনওকালে কিসসু হবে না কিংবা তিন বছর রগড়াতে হবে।”

”তা বলে দিতে পারেন। কিন্তু পরীক্ষায় না নেমেই তুই ধরে নিচ্ছিস কেন ফেল করবি? কাল ঠিক সকাল সাড়ে ছ’টায় তোদের বাড়ির সামনের বাসস্টপে দাঁড়াবি, আমি এসে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ব্যাট গ্লাভস প্যাড নিতে ভুলিসনি।”

ধুপু ক্লাসে চলে গেল, কলাবতীও। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মতো মুরারির ছোড়া বল ধরার প্র্যাকটিসে সে নামল না। তার বদলে বাগানে ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম আর পাঁচশো স্কিপিং করল দড়ি দিয়ে। দাদুকে বাড়ি ফিরেই বলেছে সকালে সল্টলেকে যাবে পূর্ব কলকাতার নেটে পরীক্ষা দিতে। রাতে খাবার টেবলে রাজশেখর ছেলেকে বললেন, ”সতু কাল সকালে তোর একটা কাজ আছে, কালুকে সল্টলেকে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি, ও পরীক্ষা দিতে যাবে।”

সত্যশেখর অবাক হয়ে বলল, ”পরীক্ষা! কীসের?”

”উইকেটকিপিংয়ের। এ—কে ব্লকের পার্কে পূর্ব কলকাতার নেট পড়ে, সেখানে কালু পরীক্ষা দিতে যাবে, সাড়ে ছ’টায় বেরোবে।”

সত্যশেখর বলল, ”সল্টলেকের রাস্তা আমার গুলিয়ে যায়, ব্লক—টলকও আমি চিনি না। ওখানে তো জলের ট্যাঙ্কের নম্বর দিয়ে পাড়া চিনতে হয়।”

কলাবতী বলল, ”ধুপু চেনে। ও সঙ্গে যাবে।”

মাঝরাত পর্যন্ত কলাবতী বিছানায় এ—পাশ ও—পাশ করল। তার মাথায় শুধু ঘুরছিল কথাগুলো ‘এর কোনওকালে হবে না হবে না হবে না।’ স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার দিনও সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, এমন অস্থির কখনও হয়নি। অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়িটা সাড়ে পাঁচটায় তার ঘুম ভাঙিয়ে না দিলে হয়তো সে সাতটা পর্যন্ত ঘুমোত।

সত্যশেখর চা খেয়ে গাড়ি বার করল ঠিক সাড়ে ছ’টায়। ভোজনপটু, অলস কাকাকে শর্টস, কেডস আর টি—শার্ট পরা দেখে কলাবতী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ”কী ব্যাপার, তুমি দৌড়বে নাকি?”

”ভাবছি একটু ছুটলে টুটলে কেমন হয়। খিদেটা একটু বাড়ে তা হলে, কাল পাঁচু রায় হাইকোর্টের বার লাইব্রেরিতে আমাকে কুলপি মালাই খাওয়ার চ্যালেঞ্জ দিল, বলল দু’ ঘণ্টার একটা সেশনে ও নাকি পনেরোটা খেয়েছে বড়বাজারের কোন এক দোকানে। নে ওঠ।”

পাশবালিশের খোলের মতো একদিকে দড়ি লাগানো একটা কাপড়ের থলিতে ব্যাট প্যাড গ্লাভস ইত্যাদি নিয়ে কলাবতী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে তখন লেজ তুলে ঘৌ ঘৌ করে ডাকতে ডাকতে ফিটনের ঘর থেকে ছুটে এল খয়েরি। ওর গলা জড়িয়ে আদর করে কলাবতী বলল, ”এখন যা, আমি বেরোব।” খয়েরি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু লেজ নেড়ে যেতে লাগল।

”লোমগুলোয় চেকনাই ধরেছে, কালু তোর কুকুরটা দেখছি বেশ তাগড়াই হয়েছে, খুব খাওয়াচ্ছিস!” সত্যশেখর মন্থর গতিতে গাড়িটাকে ফটক থেকে বার করার সময় বলল।

”কুকুর নয় কাকা, ওর একটা নাম আছে।” গম্ভীর মুখে কলাবতী বলল, খয়েরিকে কেউ কুকুর বললে তার রাগ হয়। ”আমরা যা খাই, ডাল ভাত তরকারি, খয়েরিও তাই খায়। ওর জন্য আলাদা করে কিছুই কেনা হয় না। ও তো বিলিতি মেমসাহেব নয়। ওই যে ধুপু দাঁড়িয়ে।”

একটা ব্যাট হাতে নিয়ে সাদা ট্রাউজার্স পরা ধুপু বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িটা ওর সামনে এসে দাঁড়াতে অবাকই হল।

কলাবতী বলল, ”উঠে আয়, কাকার খিদে হচ্ছে না তাই একটু ছুটতে যাবে।”

”ভালই হল।” গাড়িতে উঠে ধুপু বলল, ”একটু আরাম করে আজ যাওয়া যাবে।”

সকালে রাস্তা ফাঁকাই। গাড়ি সাত—আট মিনিটেই পৌঁছে গেল এ—কে ব্লকের পার্কে। কোমর সমান উঁচু পাঁচিলে সারা পার্কটা ঘেরা। মাঠে কোনও লোক নেই। ওরা ছোট লোহার ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকল । মাঠের একধারের পাঁচিলের দিকে কুড়ি গজের একটা জালকে লম্বা করে ছড়িয়ে বাঁশে বেঁধে দাঁড় করানো।

কলাবতী বলল, ”আমরা একটু আগেই এসে পড়েছি। ধুপু নেটটা এভাবে খাটানো কেন রে?”

ধুপু বলল, ”বাবুদা ব্যাটসম্যানের দু’ধারে নেট রাখতে চান না। বলেন, যেভাবে ম্যাচে খোলা মাঠে ব্যাট করবে, বল করবে, উচিত নেটেও সেইভাবে খেলে যাওয়া। ফাইন লেগ থেকে থার্ডম্যান পর্যন্ত জাল, বল ফস্কালে জালে আটকে যাবে।”

জালের চার—পাঁচ গজ সামনে স্টাম্প পোঁতার গর্ত আর পপিং ক্রিজ চুন দিয়ে দাগানো। কলাবতী দেখল মাটির মসৃণ পিচ, তাকে ঘাস নেই। একটি—দুটি করে মেয়েরা এসে পৌঁছতে শুরু করল। মাঠটাকে পাক দিয়ে মন্থর গতিতে তারা যখন ছুটছে ধুপু বলল, ”কালু দাঁড়িয়ে থাকিসনি, আয়।” কলাবতী ওদের সঙ্গে যোগ দিল।

সত্যশেখরও তার খিদে—বাড়াবার—দৌড় মেয়েদের পঞ্চাশ মিটার পেছনে থেকে শুরু করে দিল। একটা পাক শেষ হতে দেখা গেল মেয়েদের থেকে তার ব্যবধান সত্তর মিটার, দেড় পাক সম্পূর্ণ হওয়ার সময় সেটা দাঁড়াল প্রায় একশো মিটারে, অবশেষে সত্যশেখর হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। কলাবতী নজরে রেখেছিল কাকাকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ”কাকা, চ্যালেঞ্জ নিতে হলে আর একটা রাউন্ড দিতে হবে।” শুনেই সত্যশেখর ছোটা শুরু করে দশ পা গিয়েই হাঁটতে লাগল।

ইন্দুদি অর্থাৎ ইন্দিরা বসাক মাঠে এলেন, উচ্চচতা টেনেটুনে পাঁচ ফুট, ওজন কম করে আশি কেজি, ঘোর কৃষ্ণ গায়ের রং, বয়স চল্লিশের মাঝামাঝি। চোখে চশমা, মিষ্টি মুখশ্রী। তার পেছনে চাকরের পিঠে বড় একটা ক্যানভাসের খোল, তাতে আছে প্র্যাকটিসের জন্য ব্যাট, প্যাড, স্ট্যাম্প, গ্লাভস আর বল।

”ধুপু ইনি কে রে?”

”ইন্দুদি, আমাদের ক্লাবের সব খরচ ইনিই দেন, কাছেই থাকেন। গিয়ে একটা প্রণাম কর।”

কলাবতী পায়ে পায়ে ইন্দুদির সামনে গিয়ে বলল, ”আমার নাম কলাবতী সিংহ। আমাকে আপনি আসতে বলেছেন, আমি উইকেটকিপিং প্র্যাকটিস করব।” এই বলে সে প্রণাম করল। ইন্দুদির মুখে প্রসন্নতার ছায়া ভেসে উঠল।

”ভাল কথা, প্র্যাকটিস করো, আমাদেরও একজন সেকেন্ড উইকেটকিপার দরকার।” ইন্দুদির কণ্ঠস্বর তার মুখের মতোই মিষ্টি। ”তোমার উইকেটকিপিং গ্লাভস, প্যাড আছে?”

”সঙ্গে করে এনেছি।”

”রেডি হয়ে নাও।” ইন্দুদি একটি মেয়েকে বললেন, ”সাবিনা প্যাডআপ।” তিনি চারটে বল গড়িয়ে দিলেন চারটি মেয়ের দিকে। বাকি মেয়েরা ছড়িয়ে দাঁড়াল ফিল্ড করার জন্য।

কলাবতী প্যাড আর গ্লাভস পরে তিনটে স্টাম্পের পেছনে দাঁড়াল, সামনে সাবিনা। তার বুকের মধ্যে দুরু দুরু কাঁপন শুরু হয়ে গেছে, উবু হয়ে উইকেটের কতটা পেছনে বসতে হবে বুঝতে পারছে না। যে বল করবে সে কী ধরনের বোলার—পেসার না স্পিনার সে জানে না। সাবধান হওয়ার জন্য সে উইকেট থেকে প্রায় দু’গজ পিছিয়ে দাঁড়াল, প্রথম বোলারটি বল করল ফ্লাইট করিয়ে, অফ স্পিনার, অফ স্টাম্পের দেড় ফুট বাইরে, সাবিনা স্কোয়ার কাট করতে গেল, ব্যাট বলে লাগল না, বলটা স্পিনও করেনি, ব্যাটের তলা দিয়ে এসে দ্বিতীয়বার পিচ খেল কলাবতীর দেড় গজ সামনে। সে তড়িঘড়ি সামনে ঝাঁপিয়ে ধরতে গিয়ে ফস্কাল। উঠে দাঁড়িয়ে সে আড়চোখে ইন্দুদির দিকে তাকাল। মুখে একচিলতে হাসি ফুটে রয়েছে দেখে সে বোঝার চেষ্টা করল হাসিটা সহানুভূতির না হতাশার।

এবার সে এগিয়ে গিয়ে স্টাম্পের পেছনে বসল। মেয়েটি দশ কদম ছুটে এসে বল করল। সাবিনার লেগের দিকে পিচ পড়ল। বলটা বেশ জোরেই এসেছে এবং ওভারপিচ। সাবিনা ব্যাট চালাল কিন্তু বলে তা লাগল না। কলাবতী বাঁ—হাত বাড়াল বলটা ধরতে বা থামাতে। সে দেখল হুসস করে বলটা বেরিয়ে গেল গ্লাভসের পাশ দিয়ে। অপ্রতিভ হয়ে সে জালের নীচে পড়ে থাকা বলটা কুড়িয়ে আনতে গেল।

”উইকেটের অত কাছে থাকলে তো ফস্কাবেই।”

জালের ওধারে দাঁড়িয়ে থাকা যে লোকটি কথাগুলো বলল কলাবতী তাকে এই প্রথম দেখল।

”কে কী ধরনের বোলার তা তো আমি জানি না।” কলাবতী কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বলল।

”আজ প্রথম?”

”হ্যাঁ”।

লোকটি জালের এধারে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করল। ফরসা গায়ের রং, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে। নাতিদীর্ঘ, দোহারা, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পরনে সবুজ টি—শার্ট সাদা টাউজার্স ও স্নিকার। কলাবতীর মনে হল, ইনিই বোধ হয় সেই বাবুদা।

বোলারদের কাছে গিয়ে বাবুদা দুটি মেয়ের কাছ থেকে বল চেয়ে নিয়ে অন্য দুটি মেয়েকে দিলেন। তারপর চেঁচিয়ে কলাবতীকে বললেন, ”সবাই মিডিয়াম পেসে বল করে।” শুনে সে এবার চার গজ পিছিয়ে গেল। মনে মনে বলল, কপিলদেব তো আর নয়, কত জোরে আর বল করবে!

সাবিনা আবার ব্যাট নিয়ে দাঁড়াল, একটা বল পিছিয়ে এসে আটকাল, পরেরটা পুল করল, তৃতীয়টা ফুলটস, কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পড়ল কলাবতীর দু’গজ সামনে, সে বলের লাইনে সরে এসেছিল। পিচ পড়ে বলটা লাফিয়ে তার কপালে লেগে ছিটকে উঠল। ‘ঠকাস’ একটা শব্দ হল। ছুটে গেল সাবিনা, ইন্দুদি, ধুপু ও বাবুদা।

কপাল ফাটেনি, রক্ত বেরোয়নি, আঘাতের জায়গাটা ফুলে উঠেছে, একটা টনটনে ব্যথা শুরু হয়েছে, কিন্তু এটা ছাপিয়ে কলাবতীর শুরু হল লজ্জা পাওয়ার যন্ত্রণা। কী ভাবছে সবাই! বড় প্লেয়ারের মতো সাজগোজ করে নেমে শেষে কিনা বলই ধরতে পারল না। চাল মারতে ক্রিকেট খেলছে। সবাই মুখে আহা উহু করবে কিন্তু মনে মনে নির্ঘাত মুচকি হাসবে। প্রথম দিনে চার—পাঁচটা মাত্র বল হতেই এই লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপারটা ঘটে গেল, তাও যদি একটা বলও সে ঠিকমতো ধরতে পারত!

ইন্দুদি আলতো করে কপালে আঙুল বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ”লাগছে?”

কলাবতী মুখে হাসি টেনে মাথা নাড়ল, ‘একটুও না।’

বাবুদা বলল, ”আজ থাক, আর উইকেটের পেছনে গিয়ে কাজ নেই।”

”না, না, আমি ঠিক আছি, একটু—আধটু তো ক্রিকেট খেলতে গেলে লাগবেই।” কলাবতী তাচ্ছিল্য দেখিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল। কপালে টনটনে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কিন্তু সে ঠিক করেই ফেলেছে লজ্জা নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না।

ধুপু এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তোর কপালে তো একটা ছোট্ট আলু ফলেছে রে! কালু, আজ তুই চলে যা।”

”না।” কঠিন গলায় কথাটা বলে কলাবতী উইকেটের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ইন্দুদি একটি মেয়েকে বললেন, ”দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে এসো।” বাবুদা আগাগোড়া কলাবতীর ভাবভঙ্গি লক্ষ করে যাচ্ছিল। বলল, ”ঠিক আছে, তুমি কিপ করো।” সত্যশেখর দূরে বসে ছিল ঘাসের ওপর। ভাইঝিকে ঘিরে একটা জটলা দেখে সে অবাক হয়ে উঠে পড়ল। কিন্তু আবার কলাবতী উইকেটের পেছনে যাওয়াতে সে বসে পড়ল।

সাবিনা ব্যাট হাতে ফ্রিজে স্টান্স নিল। কলাবতী অনেকটা পিছিয়ে দাঁড়াল। অফস্টাম্পে বল, সাবিনা ড্রাইভ করল, ব্যাটের কানায় লেগে বল সেকেন্ড স্লিপের দিকে যাচ্ছে। কলাবতী ডান হাত বাড়িয়ে ঝাঁপাল এবং একবার জমিতে শরীরটা গড়িয়ে বল হাতে নিয়ে উঠল। বলধরা হাতটা তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”হাউস দ্যাট।”

ধুপু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ইন্দুদির মুখ ভরে গেল হাসিতে। বাবুদা নীচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নেড়ে যাচ্ছে। আর কলাবতীর সারা দেহ গরম হয়ে উঠেছে লজ্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায়। তার মাথার মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করছে একটা কথাই, ”দেখিয়ে দিতে হবে, দেখিয়ে দিতে হবে।”

এর পর সে আরও কয়েকটা বল ধরল এবং ফস্কালও। মেয়েটি একটা রুমালে বেঁধে বরফ এনেছে। কলাবতী সেটা কপালে ঘষল। চারজনের ব্যাটিং হয়ে যাওয়ার পর বাবুদা বলল, ”ব্যাট করতে পারবে?”

”পারব।”

নিজের থলি থেকে ব্যাট আর ব্যাটিং গ্লাভস বার করে নিয়ে কলাবতী ক্রিজে এল। মাথার মধ্যে এখনও আগুন জ্বলছে। উইকেটকিপারকে ব্যাটটাও করতে হয়। যার বল তার কপালে লেগেছে সে প্রথমেই তাকে বল করতে এল। অফ স্টাম্পে পিচ। একটু পেছনে হেলে মারার জন্য জায়গা করে নিয়ে কলাবতী কাট করল। বল গেল গালির দিকে। পরের বলটাকে প্রচণ্ড আক্রোশে এক পা বেরিয়ে গিয়ে তুলে দিল বোলারের মাথার ওপর দিয়ে। পরের বলটারও একই অবস্থা হল। চতুর্থ বলটাকে পুল করল, একটি মেয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও হাত টেনে নিল। সে ষোলোটা বল খেলল, ষোলোটাই তার মার—মার করা ব্যাটের ধাক্কায় মাঠের সর্বত্র ছিটকে ছিটকে গেল, একটা বল গেল পয়েন্টে যেখানে সত্যশেখর বসে ছিল। সে বলটা কুড়িয়ে ছোড়ার জন্য হাতটা তুলে বুঝল বলটা যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারবে না। বল হাতে সে বোলারের কাছে এসে আলতো করে ছুড়ে দিল।

”সতু না?” বাবুদা চোখ কুঁচকে বলল, ”তাই বলি! কুমড়োর মতো বসে থাকা লোকটাকে যেন চেনা—চেনা মনে হচ্ছিল! এখানে কী করতে?”

”আমি কিন্তু অনেকক্ষণ আগেই তোকে চিনতে পেরেছি। ওই মেয়েটা, যে তোর বোলারদের ছাতু করছে, আমার ভাইঝি।” সত্যশেখর ক্রিজে থাকা কলাবতীর দিকে আঙুল তুলল।

”তোর ভাইঝি!” বাবুদার গলায় সুস্পষ্ট অবিশ্বাস। ”এমন একটা অ্যাথলিট মেয়ে তোর ভাইঝি? বিশ্বাস হচ্ছে না।”

”বিশ্বাস না হয় তুই মলুকে জিজ্ঞেস করিস, ওর স্কুলেই পড়ে।”

”মেয়েটার দিকে নজর রাখিস, দারুণ সম্ভাবনা আছে। বহু বছর পর তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখনও আগের মতো খাচ্ছিস?” বাবুদা সত্যশেখরের পেটে হাত বোলাল।

”কুড়ি বছর পর দেখা আর অমনই খাওয়ার কথা! তোর কি আর কিছু মনে পড়ে না?” অভিযোগের সুরে সত্যশেখর বলল।

”মনে পড়বে কী করে, তোর সঙ্গে শেষ দেখা তো মামিমার, মানে মলুর মার শ্রাদ্ধে। তোর পাশে খেতে বসেছিলুম নিয়মভঙ্গের দিন, তখন দু’জনেই কলেজে পড়ি। খাওয়া শেষ হওয়ার পর তুই বাজি ধরলি তিরিশটা রাজভোগ খাবি, প্রত্যেকটার জন্য দশ পয়সা। তিনটে টাকা আদায় করে ছেড়েছিলি। দেখ দেখ, তোর ভাইঝি চালাচ্ছে কেমন। কপালে একটা বল ভালই লেগেছিল কিন্তু বসে যায়নি। মেয়েটা খুব রোখা।” বাবুদার স্বর তারিফে ঘন হয়ে উঠল। ”ওর নাম কী?”

”কলাবতী। কালু বলে ডাকি। তুই থাকিস কোথায় রে?”

”এই তো বি—জে ব্লকে। আয় না একদিন।”

ঠিক আটটায় প্র্যাকটিস শেষ হল। বিদায় নেওয়ার সময় বাবুদা কলাবতীকে বলল, ”তুমি কিন্তু রেগুলার এসো। বিকেলের প্র্যাকটিসে আসতে যদি বেরোতে দেরি হয় তা হলে মলুকে বলে তোমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছুটির ব্যবস্থার চেষ্টা করব, ধুপুর জন্যও।”

ইন্দুদি বললেন, ”তোমার কিটসগুলো এখানেই রেখে যাও, রোজ রোজ বয়ে আনবে কেন! কপালটা বড্ড ফুলেছে, বাড়িতে গিয়ে বরফ দিও।”

ফিরে আসার সময় কলাবতী জিজ্ঞেস করল, ”কাকা তুমি বাবুদাকে চেনো?”

”চিনব না? ও তো মলুর পিসতুতো ভাই, মলুদের কলকাতার বাড়িতে থেকেই তো কলেজে পড়েছে।”

.

ধুপুকে বাসস্টপের কাছে নামিয়ে দিয়ে ওরা বাড়ি ফিরল। প্রতিদিনের মতো কলাবতী রান্নাঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ”খয়েরিকে দুধ দিয়েছ অপুর মা?”

থোড় কাটতে কাটতে ঝাঁঝিয়ে উঠল অপুর মা, ”না, দিইনি, অপুর মা নিজেই সব গিলেছে।” এর পর মুখ তুলে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ স্থির হয়ে গেল। ”কপালে তোমার ওটা কী কালুদি?”

”কিছু না, বল লেগেছে।”

”ওমমা গো, এ কী কাণ্ড গো।” প্রায় মড়াকান্নার মতো চিৎকার করে উঠল, অপুর মা। ঠিকে ঝি, চাকররা মুরারি, এমনকী দোতলার বারান্দায়ও রাজশেখর ছুটে এলেন। সবার মুখে এক কথা, ”কী হল, কী হয়েছে অপুর মা?”

”ওই দ্যাকো।” আঙুল তুলে সে কলাবতীর কপালটা দেখাল।

সবাই দেখল, ঠিকে ঝি বলল, ”মাথাটা কোথাও ঠুকেটুকে গেছল হয়তো, জলপটি দাও।” এই বলে সে কাপড় কাচতে কলঘরে চলে গেল।

”চুন—হলুদ গরম করে লাগিয়ে দাও গো অপুর মা।” মুরারি বিজ্ঞের মতো বলল।

”হয়েছে কী?” উদ্বিগ্ন স্বর রাজশেখরের, ”কালু ওপরে আয়।”

কলাবতী ওপরে এসে বলল, ”কিসসু হয়নি দাদু, একটু যা টনটন করছে।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে আলতো করে কপালের ফুলো জায়গাটায় আঙুল ছুঁইয়ে একটু চাপ দিল। মুখটা ব্যথায় বিকৃত করল। রাজশেখর সেটা লক্ষ করে বললেন, ”আজ আর স্কুলে গিয়ে কাজ নেই, ধাক্কাটাক্কা লাগাতে পারে। ডাক্তার বোসকে ফোন করি, ওষুধ খেতে বলেন যদি।”

কলাবতী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িতে রইল। ডাক্তার যে ট্যাবলেট খেতে বলেছেন তাই খেয়ে দুপুরে শুয়ে রইল। বিকেল চারটে নাগাদ স্কুল থেকে বড়দির ফোন এল।

”আজ স্কুলে আসোনি কেন? তনিমা বলল আজ সে তোমাকে ক্লাসে দেখতে পায়নি, মিসেস ঘোষও তাই বললেন, হয়েছে কী?” মলয়ার স্বরে উদ্বেগ। ”আমার পিসতুতো দাদা একটু আগে ফোন করেছিল, বলল ধূপছায়া আর তোমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছুটি দিতে পারি কিনা ক্রিকেট প্র্যাকটিসের জন্য। কেউ খেলতে চাইলে আমি বাধা দেব না। কিন্তু তারপর ও বলল, আজ সকালে তোমার কপালে খুব জোরে একটা বল লেগেছিল তা সত্ত্বেও তুমি উইকেটকিপিং করেছ, ব্যাটও করেছ। অন্য মেয়ে হলে বসে পড়ত। কিন্তু তুমি ইনজুরির পরোয়া না করেই নাকি খেলে গেছ। বাবুদা তোমার জেদ আর রোখ নিয়ে প্রশংসা করলেও আমি কিন্তু প্রশংসা করতে পারছি না। আমি তোমাকে ছুটি দিতে পারব না আর ক্রিকেট খেলতে বারণই করব। জানো, ওরকম লোহার মতো শক্ত বল দেড়শো গ্রাম ওজন, ঘণ্টায় তিরিশ মাইল স্পিডেও যদি এসে লাগে তা হলে মানুষ মারাও যেতে পারে। না, তোমাকে খেলতে হবে না।” মলয়ার শেষ বাক্যে যে দৃঢ়তা ফুটে উঠল তাতে কলাবতী প্রমাদ গুনল। দু’জনের কথা সে অমান্য করতে পারে না, দাদু আর বড়দির। তার যত কিছু আবদার আর অনুরোধ এই দুটি মানুষের কাছে এবং তা পূরণ হয়।

কলাবতী বুঝল খুব হুঁশিয়ার হয়ে তাকে এখন কথা বলতে হবে, আবদার—টাবদার চলবে না।

”বড়দি, মঙ্গলা এখন কেমন আছে? শুনেছিলাম ওর সর্দি হয়েছে।”

”হঠাৎ মঙ্গলার খবর জানতে তোমার ইচ্ছে হল কেন? ওর তো তিন মাস আগে একটু ঠাণ্ডা লেগেছিল, তোমায় কে বলল?”

”কাকা।”

”কোর্টে মিথ্যে কথা বলে—বলে ওটাই ওর স্বভাবে দাঁড়িয়েছে।”

”বড়দি, অনেকদিন মঙ্গলাকে দেখিনি, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, আজ যাব?”

”এসো। তবে মাথা ঘুরলে কি যন্ত্রণা হলে আসতে হবে না। ডাক্তার দেখিয়েছ?”

”দাদু ট্যাবলেট এনে দিয়েছেন। এখন একদম ব্যথা নেই। একটু শুধু ফুলে রয়েছে।”

”ক্ষুদিরামবাবু পড়িয়ে যান কখন?”

”আটটায়।”

”ঠিক আটটায় আমি গাড়ি পাঠাব। ভাল কথা, তুমি নাকি একটা কুকুর পুষেছ? দিশি কুকুর।”

”খয়েরি, ওর গায়ের রঙে নামটা রেখেছি।” এর পর গলায় উচ্ছ্বাস ঝরিয়ে কলাবতী বলল, ”বড়দি ওকে আপনি দেখবেন? তা হলে ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।”

”নিয়ে এসো।”

ঠিক আটটায় মলয়ার পাঠানো গাড়ি এল। কলাবতী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সদর দরজা থেকে একটু দূরে খয়েরি গোল হয়ে শুয়ে রয়েছে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে কলাবতী ডাকল, ”আয় আমার সঙ্গে।” খয়েরি ওর পিছু নিল।

গাড়ির পেছনের দরজা খুলে কলাবতী বলল, ”ওঠ।”

খয়েরির কথাটা বোধগম্য হল না, সে লেজ নাড়ল শুধু। কখনও সে মোটরগাড়িতে চড়েনি। কলাবতী আবার বলল, ”ওঠ ওঠ।” খয়েরি লেজ নেড়েই চলল, কলাবতী ওর কোমর দু’ হাতে ধরে খোলা দরজার দিকে ঠেলল, ”ওঠ, ভেতরে চল।” খয়েরি শক্ত হয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। এবার কলাবতী ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে গাড়ির মধ্যে তুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠেই দরজা বন্ধ করে দিল, যাতে খয়েরি নেমে যেতে না পারে।

ড্রাইভার রামভরোসা হাসছিল, বলল, ”মংলাকে নিয়ে কোনও তকলিফ হয় না, দিদি গাড়িতে বসে একবার ডাকলেই উঠে আসে।”

”ওর অভ্যেস আছে গাড়ি চড়ার।” কলাবতী শুকনো স্বরে বলল।

গাড়িতে তিন মিনিটের পথ। খয়েরিকে সিটের পাশে বসিয়ে কলাবতী জড়িয়ে ধরে রইল। খয়েরি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া দোকানের উজ্জ্বল আলো দেখতে দেখতে, আর পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির হর্ন শুনতে শুনতে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে করুণ চোখে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অভিজ্ঞতাটা তার কাছে ভীতিকর ঠেকছে।

মলয়াদের বাড়ি আকারে—প্রকারে সিংহিবাড়ির মতো বড় না হলেও, বেশ বড়। ফটক থেকে ঢুকেই সিমেন্টের চওড়া পথ। বাঁ দিকে লম্বা পাঁচিল, ডান দিকে বাড়ি। বাড়ির সদরে গিয়ে গাড়ি থামল। রামভরোসা নেমে পেছনের দরজা খুলে দিল। কলাবতী নেমে ডাকল, ”আয়।”

খয়েরি গাড়ি থেকে সবেমাত্র নেমেছে আর তখনই একটা ”ঘৌ” নির্ঘোষ সদর দরজার ওপরের বারান্দা থেকে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। কলাবতী মুখ তুলে দেখল চার নম্বর ফুটবলের আকারের মঙ্গলার মাথাটা বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে। আরও তিনটে ”ঘৌ” শোনা গেল। খয়েরি সরে এল কলাবতীর পেছনে।

বাড়িতে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়ে কলাবতী ডাকল, ”আয় আমার সঙ্গে।” আসার কোনও ইচ্ছা খয়েরির ভঙ্গিতে ফুটল না। কলাবতী আর ডাকাডাকি না করে ওর বকলেসটা শক্ত করে ধরে অনিচ্ছুক খয়েরিকে হিঁচড়ে টেনে দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। এভাবে সিঁড়ি দিয়ে তোলা যাবে না তাই খয়েরিকে সে কোলে তুলে উঠতে শুরু করল। বাঁক নিয়েই দেখল মঙ্গলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে। কান দুটো খাড়া, প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা জিভটা ঝুলছে। পাঁশুটে আর কালো রঙের ঘন বড় বড় লোম, দীর্ঘ লেজ, বিশাল ভারী শরীর। ওদের দেখে সে আবার ডেকে উঠল এবং তা সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হল।

কলাবতী ওর পেল খয়েরির কথা ভেবে। অচেনা একটা কুকুর তার নিজের এলাকায় ঢুকেছে এটা হয়তো মঙ্গলা সহ্য নাও করতে পারে। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে খয়েরিকে কামড়ে মেরে ফেলে। খয়েরি আকুপাকু করছে কলাবতীর কোল থেকে নামার জন্য।

”বড়দি, বড়দি।” কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল।

ঘর থেকে মলয়া বেরিয়ে এল। ”দাঁড়িয়ে আছ কেন, ওপরে এসো। এই তোমার খয়েরি, বাঃ বেশ দেখতে তো!”

”মঙ্গলাকে সরান বড়দি, খয়েরি ভয় পাচ্ছে।”

মলয়া মৃদু কিন্তু দৃঢ় স্বরে ডাকল, ”মঙ্গলা….কাম হিয়ার।” শোনামাত্র সে মলয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ”সিট ডাউন।” মঙ্গলা উবু হয়ে বসে খয়েরির দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে ছোট্ট একটা ”ঘৌ” করল।

এগিয়ে এসে মলয়া কলাবতীর কোল থেকে খয়েরিকে দু’ হাতে নিয়ে বলল, ”মাথার সাদাটা খুব সুন্দর। বয়স কত?”

”তা তো জানি না বড়দি। রাস্তায় পেয়েছি, খুব রোগা ছিল। অপুর মা খাইয়ে—দাইয়ে ওকে নাদুসনুদুস করে দিয়েছে! কী ঝকঝকে হয়েছে ওর লোমগুলো!”

কথা বলতে—বলতে ওরা ঘরে এসে খাটে বসল। যেখানে বসতে বলা হয়েছিল, মঙ্গলা সেখানে বসেই রইল।

”তোমার কপাল তো এখনও ফুলে রয়েছে। ইসস ঠিক রগের কাছটায়, যদি ওখানে লাগত?”

হালকা সুরে কলাবতী বলল, ”লাগলে কী আর হত অজ্ঞান হয়ে যেতুম। তারপর হাসপাতালে দু’দিন পরে মরে যেতুম।” বলতে বলতে সে মলয়ার কোলে থাকা খয়েরির পিঠে হাত বুলোল। মঙ্গলা ঘরের দরজা থেকে উসখুস করে ”আঁউ আঁউ” করে উঠল। কলাবতী তাকে ডাকল, ”আয় মঙ্গলা।” মঙ্গলা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকল।

কলাবতীর কথা শুনে রেগে মলয়া বলল, ”ফাজলামো করতে হবে না। ক্রিকেট একটা মারাত্মক খেলা।”

”বড়দি, হাজার হাজার ছেলে ক্রিকেট খেলছে কিন্তু ক’জন মরছে?”

”একজনও মরছে না, কেমন?” মলয়া উত্তেজিত হয়ে বলল, ”কিন্তু তুমি এখনও এই খেলার উপযুক্ত হওনি। হাজার হাজার ছেলে রবারের বল দিয়ে খেলছে। এই তো সেদিন কীসের জন্য, যেন একটা বনধ হল, রাস্তায় ছেলেরা রবারের বলে ক্রিকেট খেলছিল। তুমিও তো রবারের বলে খেলতে পারো।”

”কিন্তু বড়দি, আমি সত্যিকারের ক্রিকেটার হতে চাই। রবারের বল খেলে কখনওই তা হওয়া যাবে না।” বলতে বলতে কলাবতী লক্ষ করল মঙ্গলা দু’পা এগিয়ে মুখটা বাড়িয়ে দিল বড়দির কোলে গুটিয়ে থাকা খয়েরির মুখের দিকে। খয়েরি ভয়ে ”কুঁই কুঁই” করে উঠে মুখটা গুঁজে দিল বড়দির কোলে। এতবড় একটা অ্যালসেশিয়ানকে সে জীবনে কখনও এত কাছ থেকে দেখেনি। মঙ্গলা খয়েরির কানের কাছে শুঁকল। জিভ দিয়ে কানটা চাটল। বড়দি কলাবতীকে জবাব দিতে গিয়ে মঙ্গলার কাণ্ডটা নজর করে ঠোঁট টিপে হাসল।

”ভাব করতে চাইছে।” মৃদু গলায় মলয়া বলল। ”ভয় কী খয়েরি, দিদি হয় তোমার, কিচ্ছু বলবে না।” খয়েরিকে সে একটু ঠেলে ধরল মঙ্গলার দিকে। মঙ্গলা খয়েরির নাকের কাছে নিজের নাকটা নিয়ে গিয়ে শুঁকল। নাক ঝাড়ার মতো ”ফোঁত ফোঁত” শব্দ করল, খয়েরি ভয়ে ভয়ে ট্যারা চোখে ওর দিকে তাকাল। মঙ্গলা দু’বার চেটে দিল ওর মাথা।

কলাবতীর মনে হল খয়েরির ভয়টা কেটে গেছে, কেননা মুখটা নামিয়ে সে মঙ্গলার দেওয়া আদর নিরুদ্বেগে মাথায় নিয়ে চলেছে।

”ক্রিকেটে খেলা ছাড়া আরও অনেক কিছু আছে, সেসব তো করতে পারো।” মলয়া আবার ক্রিকেটের কথায় ফিরে এল। ”স্কোর লেখাও তো একটা বড় কাজ। মাঠে নামতে হবে না অথচ খেলার সঙ্গেও রইলে। আমি বরং বাবুদাকে বলে দেব তোমাকে স্কোরার হওয়ার ট্রেনিং দিতে।”

কলাবতী ব্যগ্র স্বরে বলল, ”তা হলে আমাকে লাস্ট পিরিয়ডে ছেড়ে দেবেন?”

”কেন?” মলয়া ভ্রূ কোঁচকাল। ”স্কোর লেখা তো বাড়িতে বসেও শেখা যায়। তুমি ক্রিকেট আইনের বইতেই পাবে স্কোরারদের কী কী কাজ করতে হবে। কার্ডিফে গ্ল্যামোরগান আর ইন্ডিয়ান টিমের খেলা দেখতে যাওয়ার আগে আমি ক্রিকেট আইনের বইটা উলটে—পালটে দেখেছিলুম।”

”স্কোরিংয়ের একটা প্র্যাকটিক্যাল দিকও তো আছে। সেটা মাঠে বসে না করলে শেখা যাবে না।” কলাবতী মরিয়া হয়ে এবার শেষ চেষ্টা করল।

মলয়া খয়েরির পিঠে হাত বুলোতে—বুলোতে আলোচনায় শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল। ”নেট প্র্যাকটিসে স্কোর লেখার দরকার হয় এমন কথা কখনও তো শুনিনি।”

কলাবতী বুঝে গেল শেষ পিরিয়ডে তার ছুটি পাওয়ার দফা—রফা হয়ে গেছে। তারপরই দেখল অদ্ভুত জিনিস, মঙ্গলা চোখ বুজে মুখটি তুলে আর খয়েরি তার চোয়াল—থুতনি চেটে দিচ্ছে। ভয় ভেঙে গেছে খয়েরির। মলয়া কোল থেকে ওকে মেঝেয় নামিয়ে দিয়ে বলল, ”বিস্কিট দিই খয়েরিকে।”

মলয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মঙ্গলা তার পিছু নিল। খয়েরিও যাচ্ছিল, কলাবতী ধমকে উঠতে থমকে পড়ল। মিনিট দুই পরে মলয়া ফিরল, হাতে দুটি চৌকো আকারের বিস্কুট। একটি মুখের সামনে ধরতেই খয়েরি টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল। মঙ্গলা ঘাড় বাঁকিয়ে খাওয়া দেখতে লাগল।

”কালু, মাংসের চপ ভাজছে ঠাকুর, হাতটা ধুয়ে এসো।”

কলাবতী বাইরে দালানের বেসিনে হাত ধুয়ে এল। ”বড়দি, মঙ্গলাকে বিস্কুট দিলেন না?”

”ওর রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। তারপর আর কিছু খেতে দেওয়া হয় না।” মলয়া সস্নেহে মঙ্গলার মাথায় হাত বুলোল, ”ওর সবকিছুই চলে নিয়ম মেনে। খয়েরি খায় ক’টার সময়?”

কলাবতী ঢোক গিলল। সবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর অপুর মা রাত দশটা নাগাদ সবার উচ্ছিষ্ট যা পড়ে থাকে সেগুলোই ফিটনের ঘরে খয়েরির থালায় রেখে আসে। একথা জানাতে কলাবতীর লজ্জা করল। সে শুধু বলল ”দশটার সময় খায়।”

একটা প্লেটে দুটো বড় আকারের চপ আর স্যালাড নিয়ে এল ঠাকুর। কলাবতী একটা চপ থেকে একটু ভেঙে মঙ্গলার মুখের কাছে ধরল, কতটা নিয়ম মানে সেটা পরীক্ষা করার জন্য।

”ভাজাভুজি কখনও মঙ্গলাকে খাওয়ানো হয়নি। দেখো ও খাবে না।”

সত্যিই তাই হল। চপের টুকরোটা একবার শুঁকেই মঙ্গলা মুখ সরিয়ে নিল। কলাবতী সেটা খয়েরির মুখের সামনে ধরতেই সে শোঁকাশুঁকি না করেই কপাত করে মুখে পুরে দিল।

”কালু, এসব জিনিস ওকে খাইও না।” মলয়া বিচলিত করে বলল, ”পেটের গোলমাল হবে, লোম ঝরে যাবে।”

”কিচ্ছু হবে না খয়েরির। ও তো ভুখা পার্টি থেকে এসেছে, যা খাবে হজম করে ফেলবে।” কলাবতী নিশ্চিন্ত গলায় বলল।

ওরা ফিরে আসার জন্য যখন গাড়িতে উঠছে মঙ্গলা তখন বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে মাথা বার করে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। কলাবতীর মনে হল, খয়েরি চলে যাচ্ছে বলে মঙ্গলার মনখারাপ হয়ে গেছে।

”খয়েরি আবার আসবে।” কলাবতী হাত তুলে মঙ্গলাকে বিদায় জানাল। গাড়ি যখন ফটক পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল তখনও ঘৌ ঘৌ ডাক সে শুনতে পাচ্ছে।

.

কলাবতী বাবুদাকে জানিয়ে দিল বড়দি খেলার জন্য ছুটি দেবেন না।

”না দিক, তুমি স্কুলের পর বাসে উঠে সোজা চলে এসো। হয়তো একটু দেরি হবে, প্র্যাকটিসের সময় খানিকটা কমে যাবে। তা হোক, যতটুকু হয় সেটাই লাভ। আমাদের স্কুলগুলোর ছুটির সময়টা এমন, ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করবে কখন, শিখবেই বা কখন, আমি বরং মলুকে জানিয়ে দেব তুমি স্কোরার হওয়ার জন্য বাড়িতে প্র্যাকটিস করছ।” তারপর ধুপুকে বলল, ”খবরদার স্কুলে একদম মুখ খুলবে না।”

এইভাবে বড়দিকে লুকিয়ে সল্টলেকের নেটে চলল কলাবতীর প্র্যাকটিস। বাড়িতে সে নানাদিকে ঝাঁপিয়ে বল ধরার কসরত চালিয়ে যেতে লাগল দাদুর বা মুরারির ছোড়া বলে। তার দুটো কনুই ও পুরো বাহু ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোল, বেকায়দায় পড়ে গিয়ে ব্যথা হল কিন্তু সে এইসব ঝামেলা গ্রাহ্যে আনল না। তাকে উইকেটকিপার হতেই হবে।

স্কুলের প্রতিষ্ঠা বছরের সুবর্ণজয়ন্তী, তাই সোমবার স্কুলের ছুটি। দুপুরে সভা, বিকেলে নানা অনুষ্ঠান ও নাটক হবে। নাটকে কলাবতীর ছোট্ট একটা পার্ট আছে ঝগড়ুটে এক বিধবা বুড়ির। সকাল থেকে ঘরে আয়নার সামনে সে একাই মহড়া দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সত্যশেখর কোর্টে বেরোবার মুখে ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, ”কালু, আমার একটা কাজ করে দিবি, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হবে। আজ সন্ধেবেলায় আমাদের কোর্টের এক বেয়ারাকে এক হাজার টাকা দিতে হবে, কাল ওর ছেলে মুম্বইয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে, এদিকে হাতে একটা পয়সাও নেই, ধার করার অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারেনি। শেষে আমার কাছে চাইল। মানুষটা খুব ভাল, বলেছি সোমবার এসে যেন নিয়ে যায়। তুই টাকাটা তুলে মুরারির কাছে রেখে দিস।”

এই বলে সত্যশেখর চেকটা কলাবতীর হাতে দিল। সে এর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কয়েকবার চেক ভাঙিয়েছে। তাদের বাড়ির খুব কাছেই ক্যালকাটা ব্যাঙ্কের শাখা। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের অনেকে তাকে চেনে। সাড়ে দশটায় কলাবতী ব্যাঙ্কের কোলাপসিবল গেটে এল। এক মানুষ গলে যাওয়ার মতো ফাঁক রেখে গেটটা মোটা লোহার শিকল জড়িয়ে সেটায় তালা লাগিয়ে বন্ধ। একনলা বন্দুক হাতে দরোয়ান ভেতরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে বেশ ভিড়। কলাবতী বুকসমান উঁচু খোলা কাউন্টারে বসা লোকটিকে চেক দিয়ে পেতলের একটা চাকতি টোকেন নিল। তাতে নম্বর লেখা সতেরো। সে পেমেন্ট লেখা লোহার খাঁচার মতো জাল ঘেরা কাউন্টারের সামনে ছোট ভিড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। খাঁচার মধ্যের লোকটি টোকেন নাম্বার ডাকছে, টোকেন নিচ্ছে, নোট গুনে ফোকরের মধ্যে দিয়ে সেগুলো এগিয়ে দিচ্ছে, টাকা পেয়ে নোট গুনে নিচ্ছে। কলাবতী দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে এবং দেখতে তার ভালই লাগছে। ব্যাঙ্কের লোকেরা কী অদ্ভুত দ্রুত নোট গোনে এবং ভুল করে না। এটা তাকে অবাক করে। সে এর আগে যে ক’বার টাকা তুলেছে কখনও কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গুনে মিলিয়ে নেয়নি। বাড়ি এসে গুনে দেখেছে একটা টাকাও বেশি বা কম নেই।

.

নিবিষ্ট হয়ে সে পিঁপড়ের শুঁড় নাড়ানোর মতো নোট গোনা আঙুলের নড়াচড়া দেখছিল তখনই একটা ভারী গলার চিৎকার করে বলা কথা সে শুনতে পেল, ”কেউ নড়বেন না। যে যেখানে যেমনভাবে আছেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। বাধা না দিলে আপনাদের কোনও ক্ষতি আমরা করব না।” ব্যাঙ্কের ভেতরে দাঁড়িয়ে কোলাপসিবল গেট টেনে বন্ধ করে দিয়ে লোকটি হাতের রিভলভার দারোয়ানের পেটে ঠেকিয়ে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল।

লোকটির মাথায় সাদা ক্যাপ যেমনটি ক্রিকেটাররা পরে। চোখের নীচ থেকে গলা পর্যন্ত মুখ একটা সবুজ রুমাল বেঁধে ঢেকে রাখা। পরনে বিবর্ণ জিনস আর গোলগলা নীল গেঞ্জি, স্বাস্থ্যটা মোটেই কলাবতীর পড়া বিশেডাকাত বা রোঘোডাকাতের মতো নয়, খুবই ছিপছিপে পাতলা।

কলাবতীর পাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল, ”ডাকাত পড়েছে। কেউ যেন না বাধা দেয়। ওরা ব্যাঙ্ক লুট করেই চলে যাবে।”

ব্যাঙ্কের ভেতরে তখন প্রায় তিরিশজন লোক। তার মধ্য থেকে তিনজন দ্রুত মুখে কালো রুমাল বেঁধে নিয়ে ছুটে কাডন্টারের ওধারে হলঘরে ঢুকে পড়ল। তাদের দু’জনের হাতে পাইপগান, অন্যজনের হাতে বড় একটা সাদা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। ব্যাগ থেকে সে দু’হাত লম্বা একটা মোটা রড বার করে হলঘরের একমাত্র টেলিফোনটাকে পেটাল। ভেঙে ছত্রাকার হয়ে গেল টেলিফোনটা। তারপরই সে হাত বাড়াল সেই টেবলে বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দিকে। তিনি ভয়ে—ভয়ে মাথা নাড়লেন। ডাকাতটি তার টেবলের খোলা ড্রয়ারটা টেনে একটা চামড়ার ওয়ালেট বার করে খুশিতে মাথা নাড়ল।

ইতিমধ্যে দুই পাইপগানধারী একজন ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পড়েছে। কলাবতী তারপরই টেলিফোন আছড়ে ভাঙার শব্দ পেল। কয়েক সেকেন্ড পর ম্যানেজার পিঠে ঠেকানো পাইপগান—সহ নিরক্ত মুখে কাঁপতে—কাঁপতে বেরিয়ে এলেন, স্ট্রংরুমের চাবি রাখা ওয়ালেটটি ম্যানেজারের হাতে দিয়ে ব্যাগধারী তাকে কী যেন বলল। পাশেই তালা দেওয়া একটা ভারী দরজার দিকে ম্যানেজার এগোলেন। তাকে অনুসরণ করল দু’জন।

”হারি আপ, হারি আপ, ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম।” গেটে দাঁড়ানো নেতা অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে উঠল। সারা ব্যাঙ্ক পাথর, বোবা। টেবলে বসা কর্মচারীরা ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে। কিছু করতে গেলেই গুলি খেতে হবে। কলাবতী লক্ষ করছিল নেতাকে। একটা মশা বা কোনও পোকা নেতার বাঁ চোখের পাশে কামড়েছে বোধ হয়। মুখে বাঁধা রুমালটা টেনে নামিয়ে সে চুলকোতে শুরু করল। কলাবতী দেখল ওর বাঁ চোখের নীচেই একটা বড় আঁচিল আর বাঁ চোখের ওপর পাতাটা অর্ধেক নেমে, ঘুম পেলে যেমন আধবোজা হয় অনেকটা সেইরকম। নেতার চোখ হঠাৎ পড়ল কলাবতীর ওপর, ভ্রূ তুলে মেয়েটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে দ্রুত রুমালটা টেনে তুলে দিয়ে অস্বস্তিভরে বারকয়েক কলাবতীর দিকে তাকাল।

”ম্যানেজারের টেবলের নীচে তো অ্যালার্মের বাটন আছে, টিপে দিল না কেন?” ফিসফিস করে একজন বলল।

”টিপুক আর গুলি থাক।” সঙ্গে—সঙ্গে আর একটা ফিসফিস হল। ”আগে ব্যাঙ্ক না আগে প্রাণ?”

কলাবতীর কানে আরও কিছু কথা এল :

”দেখলেন, সব আগে থেকে ওরা অবজার্ভ করে রেখেছে, চাবির ব্যাগটা কীরকম ভাবে ড্রয়ার থেকে বার করে নিল!”

”আরে মশাই, ভেতরে ওদের লোক আছে খবর দেওয়ার। ঠিক জানে ভল্ট খুলতে দুটো চাবি লাগে আর সে দুটো কার কার কাছে থাকে।”

ডাকাতদুটো মিনিট তিনেকের মধ্যেই ছুটে স্ট্রংরুম থেকে বেরিয়ে এল। তিনজন হলঘরের মধ্য দিয়ে দৌড়ে কাউন্টারের এদিকে এসে গেটের দিকে এগোল। ভিড় বিভক্ত হয়ে ওদের জন্য যাওয়ার পথ করে দিল। গেটটা ফাঁক করে নেতা দাঁড়িয়ে। ক্যাম্বিসের ব্যাগটা রুগণ অবস্থায় স্ট্রংরুমে ঢুকেছিল, বেরোল এমনই নধর হয়ে যে, গেটের ফাঁক দিয়ে তাকে গলাতে গিয়ে পেটটা আটকে গেল। অবশেষে একটা হ্যাঁচকা টানে তাকে বার করা গেল।

সবশেষে বেরোল নেতা। বেরোবার আগে সে কলাবতীর দিকে একঝলক তাকিয়ে নিল। বেরিয়ে গেটটা টেনে বন্ধ করেই সে ছুটে গিয়ে, ইঞ্জিন চালিয়ে রেখে অপেক্ষা করা একটা মোটরবাইকে উঠে পড়ল। তাতে চালক ছাড়াও বসে ছিল ব্যাগ কোলে নিয়ে অন্য ডাকাতটি। নেতা ওঠামাত্র তিনজনকে নিয়ে বাইকটা পশ্চিম দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল। বাকি দুই ডাকাতকে নিয়ে আর একটা বাইক আগেই রওনা দিয়েছে পূর্ব দিকে। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল মিনিট সাতেক।

মোটরবাইক দুটো চলে যাওয়ার সঙ্গে—সঙ্গে ”ডাকাত, ডাকাত” রব যথারীতি উঠল। লোকজন বাইরে থেকে ছুটে এল। সবাই জানতে চায় কত টাকা ডাকাতি হয়েছে, কেউ মরেছে কিনা। ম্যানেজার মুহ্যমানের মতো হলঘরে বসে শুধু মাথা নেড়ে যাচ্ছেন। থানায় ও লালবাজারে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ আসছে। আজ আর ব্যাঙ্কের কোনও কাজকর্ম হবে না। টাকা নেওয়াও নয়, দেওয়াও নয়।

টোকেনটা সঙ্গে নিয়ে কলাবতী বাড়ি ফিরে এল। তার মন খুব খারাপ লাগছে কাকার সেই বেয়ারাটির কথা ভেবে, যে আজ সন্ধ্যায় এক হাজার টাকা নিতে আসবে। তার ছেলে কাল মুম্বই যাবে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে, হাতে একটা টাকাও নেই। মুম্বই তো আর রানাঘাট কি বর্ধমানের মতো একদিনেই যাতায়াত করা যায় না, হাজার—বারোশো মাইল দূরে তো হবেই। অতদূরে যেতে হলে কিছু টাকা তো সঙ্গে রাখা উচিত।

আজই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সন্ধ্যাবেলায় তাকে নাটকে নামতে হবে। তার ইচ্ছে করছে না স্কুলে যেতে। দাদুকে সে ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনাটা সবিস্তারে বলল। আর বলল, কেন সত্যশেখর টাকাটা তুলতে তাকে পাঠিয়েছিল।

”সতুর কাছে এক হাজার টাকা নেই! আশ্চর্য! এক হাজার টাকা দেওয়ার জন্য সিংহিবাড়ির ছেলে কিনা চেক কাটল?” রাজশেখর রাগে গরগর করে কথাগুলো বলে শোয়ার ঘরে গিয়ে সিন্দুক থেকে দশটা একশো টাকার নোট বার করে এনে কলাবতীর সামনে ধরে বললেন, ”যা, মুরারির কাছে রেখে আয়।”

স্কুলের অনুষ্ঠানের পর রাত্রে বাড়ি ফিরে সদর দরজা পেরোতেই কলাবতী সেরেস্তা থেকে চাপা গলায় কাকার ডাক শুনল, ”কালু, একটু দাঁড়া।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এল সত্যশেখর। কলাবতীর মুখে নাটকের মেকআপ, সত্যশেখরের মুখে বিপক্ষ কৌঁসুলির আচমকা তোলা নতুন এক পয়েন্ট। ”বাবাকে তুই বলেছিস আমার কাছে টাকা নেই?”

অবাক কলাবতী বলল, ”তা তো বলিনি। শুধু বলেছি চেকে টাকা তোলার জন্য আমাকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়েছ। তোমার লোক টাকা নিতে এসেছিল?”

”এসেছিল, নিয়ে গেছে। নাটক কেমন হল?”

কলাবতী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ”দারুণ হয়েছে। সবচেয়ে ভাল হয়েছে বড়দির, উকিলের পার্ট করেছিল। আমি করেছি মিথ্যে সাক্ষী দিতে আসা এক বুড়ির।”

”ব্যাঙ্কের টোকেনটা তোর কাছে রয়েছে, কাল গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসবি।” এই বলে সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে সেরেস্তায় ঢুকে গেল।

রাতে খাওয়ার টেবলে ব্যাঙ্ক ডাকাতি এবং স্কুলের নাটক নিয়ে কথাবার্তা হল। সত্যশেখর জানতে চাইল, ”কালু তুই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি তো? এতদিন তো শুধু বইয়ের পাতায় আর সিনেমাতেই ডাকাত দেখেছিস, এবার রক্তমাংসের ডাকাত দেখা হয়ে গেল। কেউ যে রেজিস্ট করতে যায়নি এটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে।”

রাজশেখর গর্জন করে উঠলেন, ”বুদ্ধিমান না ছাই। কাপুরুষের মতো কাজ হয়েছে। আটঘরার বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল। আমাদের শ্যামা পাইক লাঠি আর সড়কি নিয়ে একা মহড়া দিয়েছিল সেই ডাকাত দলের সঙ্গে, শেষে পালাবার পথ পায় না। গ্রামের লোক তাড়া করে চারটেকে ধরে ফেলে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দেয় তিনদিন। শেষে মাফ চেয়ে নাকখত দিয়ে বলল, জীবনে আর ডাকাতি করবে না। তখন ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়।”

”বাবা, এটা কোন সময়ের ঘটনা।” সত্যশেখর তেরছা চোখে তাকাল বাবার দিকে।

কলাবতী বলল, ”শুনলে না, লাঠি—সড়কি নিয়ে ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, নাকখত দিইয়ে চারজনকে ছেড়ে দিয়েছিল। দাদু, এটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের ঘটনা, তাই না?”

”এইট্টিন ফিফটি নাইনের। সিপাহি বিদ্রোহের দু’ বছর পরে।” রাজশেখরের গলায় বনেদি আভিজাত্য ঝলসে উঠল। ”তখন বাঙালির সাহস ছিল।”

সত্যশেখর বলল, ”এখন পাইপগান—বোমা আর পিটিয়ে মেরে ফেলার আমল। এখন সাহস দেখায় শুধু ডাকাতরাই। লড়াই করার জন্য এখন কাছে আসতে হয় না। দূর থেকেই গুলি করে দেয়, বোমা ছোড়ে। মানুষ ভয় পায় বলেই ওরা সাহসী।”

এই শুনে রাজশেখরের মুখের উদ্দীপ্ত ভাবটা ধীরে—ধীরে ম্লান হয়ে গেল। গলা নামিয়ে শুধু বললেন, ”অনেক কিছুই আমাদের হারিয়ে গেছে।”

দাদুর মুখ দেখে কলাবতী দুঃখ পেল। এই সময় তার মনে পড়ে গেল একটা কথা। চোখ বড় করে সে বলে উঠল, ”জানো দাদু, নাটকের পর গ্রিনরুমে বড়দি চুপি চুপি আমাকে কী বলল?…মঙ্গলার বাচ্চচা হবে আর তিন মাস পরেই।”

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অপুর মা। সে ঘরে ঢুকল, চোখ চকচক করছে, গলায় চাপা উত্তেজনা, বলল, ”আমাদের খয়েরিরও বাচ্চচা হবে কালুদি।”

শোনামাত্রই কলাবতী দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠল, রাজশেখরের মুখে হাসি ফুটল আর সত্যশেখর মাথা চুলকোতে শুরু করে দিল।

পরের দিন খবরের কাগজে দশ লাইন বেরোল এই ডাকাতির খবর। খবরের শেষে লেখা: ‘ডাকাতির কোনও সূত্র পুলিশ পায়নি, কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ডাকাতি হওয়া ছয় লক্ষ টাকা উদ্ধার করতে পারবে বলে পুলিশ আশা করছে। জোর অনুসন্ধান চলছে।’

সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের জন্য পরদিনও স্কুলের ছুটি। কলাবতী ব্যাঙ্কে গিয়ে জানল যারা গতদিন টোকেন নিয়ে টাকা তুলতে পারেনি তারা আজ পাবে, ব্যাঙ্কের ফটকে রাইফেল হাতে দু’জন পুলিশ, যারা ঢুকছে তাদের দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকাচ্ছে। ভেতরে যথারীতি কাজকর্ম চলছে, পরিবেশ থমথমে। কলাবতী গতকালের টোকেনটা কাউন্টারে যাকে দিল তিনি মুখচেনা। নতুন একটা টোকেন তাকে দিয়ে তিনি বললেন, ”কাল অত তাড়াতাড়ি চলে গেলে কেন, পুলিশ এসে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করল।

কলাবতী আলগোছে বলল, ”জিজ্ঞেস করলে আমি বলতুমই বা কী? সবাই যা দেখেছে আমিও তাই দেখেছি। কী জিজ্ঞেস করল পুলিশ?”

”কাউকে চেনা মনে হল কি না, দেখলে চিনতে পারবেন কি না, এইসব। আজও তো ওরা এসে জিজ্ঞেস করছে, ঘুরে—ঘুরে দেখছে, ওই দ্যাখো না দুটো লোক। ডাকাতরা কি আর কোনও ক্লু রেখে গেছে যে, চাইলেই পেয়ে যাবে।” লোকটি তাচ্ছিল্যভরে তাকাল।

কলাবতী দেখল হাওয়াই শার্ট পরা সাধারণ চেহারার দুটি লোককে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার টেবলের ড্রয়ার টেনে খুলে—খুলে দেখাচ্ছেন। এর পর ওই দু’জনের একজন নিজে ড্রয়ার টানাটানি শুরু করল।

ব্যাঙ্কে আজও বেশ ভিড়। কলাবতী সরে গিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, লোকটির কথাগুলো—কাউকে চেনা মনে হল কি না, দেখলে চিনতে পারবেন কি না। নাহ, চেনা মনে হওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। সবাই মুখ ঢেকে রেখেছিল রুমালে, শুধু চোখদুটো দেখা যাচ্ছিল। তাই দিয়ে কাউকে পরে চেনা সম্ভব নয়, কেউ কথা বলেনি শুধু লিডার ছাড়া। গলার আওয়াজটা তার মনে আছে শুনলে হয়তো চিনতে পারবে।

একটু পরেই তার টোকেন নাম্বার ধরে ডাক হল। কলাবতী পেমেন্ট কাউন্টারের দিকে এগোল। তার আগের লোক টাকা পেয়ে তখন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গুনছে। গুনতে—গুনতে লোকটি আঙুল দিয়ে দু’—তিনবার চোখের কোণ ঘষল। তাই দেখে কলাবতীর হঠাৎই ডাকাতদের নেতার কথা মনে পড়ে গেল, সেও চোখের নীচে চুলকোচ্ছিল, একটা আঁচিল, চোখটা আধবোজা…এই তো ক্লু!

.

টাকা নিয়ে সে কাউন্টার ঘুরে ব্যাঙ্কের ভেতরে ঢুকল। কোথায় পুলিশের লোক দু’জন? সে এধার—ওধার তাকিয়ে তাদের দেখতে পেল না। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, তিনি বললেন, ”ওরা তো এইমাত্র চলে গেল। কেন, কী দরকার?”

”দরকার আছে।” বলেই কলাবতী ছুটল কোলাপসিবল গেট লক্ষ করে। লোক দু’টি তখন একটা জিপে উঠতে যাচ্ছে।

”এই যে, এই যে, শুনুন।” হাত তুলে সে দৌড়ে গেল। লোকদুটি ফিরে তাকাল।

হাঁফাতে—হাঁফাতে কলাবতী বলল, ”আপনাদের আমি একটা ক্লু দিতে পারি। কাল যে ডাকাতিটা হল তার লিডারের বাঁ চোখের নীচেই একটা বড় আঁচিল আছে আর লোকটার বাঁ চোখটা আধবোজা।”

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করার পর একজন বলল, ”চলো, ভেতরে চলো।”

লোকদুটি কলাবতীকে নিয়ে ব্যাঙ্কের ভেতরে এসে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। একজন বিনীতভাবে ম্যানেজারকে বলল, ”আপনার কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটাব। আমরা এই মেয়েটির সঙ্গে একটু কথা বলব। জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কথা, বাইরে বসে বলতে চাই না।”

ম্যানেজার শশব্যস্ত বললেন, ”বসুন, বসুন। যতক্ষণ ইচ্ছে কথা বলুন।”

লোকদুটির একজন নোটবই বার করল পকেট থেকে। কলাবতীর নাম, বাড়ির ঠিকানা, কে কে আছে বাড়িতে, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে পড়ে, কীজন্য কাল ব্যাঙ্কে এসেছিল, চেকটা কার ছিল ইত্যাদি জেনে নিয়ে প্রশ্ন করল, ”তুমি ঠিক দেখেছ বাঁ চোখের নীচে আঁচিল আছে আর চোখটা ডিফেক্টিভ।”

কলাবতী জোর দিয়ে বলল, ”হ্যাঁ, ঠিক দেখেছি। লোকটা যখন দেখল আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি তখন তাড়াতাড়ি রুমালটা টেনে তুলল আর বারকয়েক আমার দিকে তাকাল। আমি যে আঁচিলটা দেখে ফেলেছি সেটা ও বুঝতে পেরেছে মনে হল।”

লোকটি খসখস করে তার কথাগুলো লিখে নিয়ে বলল, ”আমাদের কাছে ডাকাতদের যেসব ছবি আর চেহারার বর্ণনার ফাইল আছে তোমার কথামতো সেখানে আমরা খুঁজব। আমাদের যা বললে সেসব কথা আর কাউকে কি বলেছ?”

”আপনাদেরই প্রথম বললুম।”

অন্য লোকটি বলল, ”একদম এই নিয়ে কাউকে একটি কথাও বলবে না। বললে বিপদ হতে পারে। এখন তুমি আসতে পারো, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

বাড়ি ফিরে কলাবতী ব্যাঙ্ক থেকে তোলা টাকাগুলো দাদুকে দিয়ে পুলিশ দু’জনকে সে যেসব কথা বলেছে তা বলল। শুনে রাজশেখরের মুখ উদ্বেগে ভরে গেল।

”তুই বলে ভালই করেছিস কিন্তু ওই যে বিপদের কথা বলল সেটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তুই যেমন ডাকাতটার মুখ দেখেছিস তেমনই ডাকাতটাও তোর মুখ দেখে রেখেছে। যদি ও জানতে পারে তুই পুলিশকে বলে দিয়েছিস মুখে কী কী চিহ্ন আছে, তা হলে কিন্তু লোকটা তোকে আঘাত করতে পারে।” রাজশেখর থেমে—থেমে চিন্তিত স্বরে বললেন।

কলাবতীর বুকের মধ্যে হালকা একটা ভয় মেঘের মতো উড়ে গেল। ফুঁ দিয়ে সেটা সরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে সে বলল, ”লোকটা জানবে কী করে পুলিশকে আমি বলেছি। সেখানে তো ছিলেন শুধু ম্যানেজার, তিনি নিশ্চয় ডাকাতটাকে বলতে যাবেন না।”

”পুলিশের মধ্যেও গুণ্ডাবদমাশদের লোক আছে, তারা জানিয়ে দেবে।”

তিনদিন পর বিকেলে একটা টেলিফোন এল। রিসিভার তুলে রাজশেখর বললেন, ”রাজশেখর বলছি।”

ওধার থেকে একজন পুরুষ শান্ত গলায় বলল, ”কলাবতী আপনার কে হয়?”

”নাতনি।”

শীতলকণ্ঠে লোকটি বলল, ”ওকে বারণ করে দেবেন যেন ডাকাত চেনাবার জন্য উৎসাহ না দেখায় আর সাবধানে থাকতে বলবেন।”

রেগে উঠে বললেন রাজশেখর, ”যদি উৎসাহ দেখায় তা হলে কী করবেন?”

আরও ঠাণ্ডা গলায় উত্তর এল, ”তা হলে চিরকালের মতো উৎসাহ দেখানো বন্ধ করে দেব।”

রাজশেখর জবাব দেওয়ার আগেই ওধারে ফোন রেখে দিল। এই ফোন পাওয়ার কথাটা তিনি কাউকে বললেন না, কলাবতীকেও না। তাঁর মনে হল, ডাকাতরা এখনও জানে না কালু পুলিশকে ঠিক কী বলেছে। ফোনটা করেছে আন্দাজে, আগাম একটা হুমকি দিয়ে, ভয় দেখাতে। তবে কালু কী বলেছে সেটা ওরা ঠিকই জেনে যাবে।

এর দু’দিন পর কলাবতী স্কুল থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। আজ বিকেলে তার সল্টলেকে প্র্যাকটিসে যাওয়ার দিন নয়। হাওয়াই শার্ট পরা পাতলা গড়নের একটা লোক, যে তাকে স্কুলের গেট থেকে পিছু নিয়েছে তা সে জানে না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে—করতে সে আসছিল। বন্ধুরা যে যার বাড়ির পথে চলে যেতে সে একাই সিংহিবাড়ির ফটকে পৌঁছল। দূর থেকেই সে দেখেছিল ফটকের সামনে রাস্তায় খয়েরি তার জন্য বসে আছে। প্রতিদিনই বসে থাকে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। সদর দরজা পর্যন্ত গিয়ে কলাবতী স্কুল ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বার করবে। খয়েরি তখন দ্বিগুণ বেগে লেজটা নাড়তে—নাড়তে সামনের দু’ পা কলাবতীর কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে উঠে, ”উঁ উঁ” শব্দ করে খাবার চাইবে। না খেয়ে ওর জন্য রেখে দেওয়া টিফিনের খাবার কলাবতী যতক্ষণ না মুখে তুলে দিচ্ছে, খয়েরি নাছোড়বান্দার মতো বারবার দাঁড়িয়ে উঠে খাবার চাইবে। অবশ্য এই সামান্য খাবারে ওর পেট ভরবে না। কিন্তু এটা প্রতি বিকেলে ওর করা চাই—ই। খয়েরি মনে করে রেখে দিয়েছে কলাবতীর সঙ্গে তার প্রথম ভাব হয়েছিল এই টিফিন খাওয়া থেকেই। আজও সে যত অল্পই হোক কলাবতীর হাত থেকে টিফিন খাবেই আর কলাবতীও ওর জন্য টিফিনের ভাগ রেখে দেবেই।

আজও কলাবতী দূর থেকে দেখল ফটকের সামনে খয়েরি উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। সে কাছাকাছি এলে খয়েরি ফটক দিয়ে আগে ঢুকে কয়েক পা গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে তারপর সঙ্গে—সঙ্গে যাবে সদর দরজা পর্যন্ত। এটাই রোজ হয়ে থাকে। কলাবতী ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার পিছু নেওয়া লোকটি ফটক পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়াল, দু’পাশে ও ভেতরে তাকিয়ে দেখে নিল লোকজন আছে কিনা। রাস্তা দিয়ে দু’চারজন যাচ্ছে বটে কিন্তু ভেতরের বাগানে একটা কুকুর ছাড়া আর কাউকে সে দেখতে পেল না। লোকটা চট করে ফটক পেরিয়ে ঢুকল।

”অ্যাই অ্যাই, দাঁড়াও তো।”

কর্কশ গলায় ধমকের মতো কথাগুলো শুনে অবাক কলাবতী ঘুরে দাঁড়াল। চকরাবকরা হাওয়াই শার্ট পরা, বেঁটে, কালো বিশ্রী মুখের একটা লোককে সে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল।

”কী বলেছ তুমি পুলিশকে, অ্যাঁ?” লোকটা বাঁ হাতে কলাবতীর ব্লাউজের কলার ধরে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিল। কলাবতীর গলায় ও ঘাড়ে ব্যথা লাগল। তার মধ্যেই সে ”গররর” একটা আওয়াজ শুনতে পেল।

লোকটা কলার ছাড়েনি। আরও দু’—তিনবার ঝাঁকুনি দিয়ে চাপা গলায় হিংস্র স্বরে বলল, ”কী বলেছ, অ্যাঁ কী বলেছ?”

কলাবতী বুঝে গেছে গায়ের জোরে সে এই গুণ্ডার সঙ্গে পারবে না। মুখটা নিচু করে সে গুণ্ডার হাতটা কামড়ে ধরল সজোরে। দাঁত বসে গেল আঙুলের ওপর দিকে।

”আহহহ।” চিৎকার করে উঠেই গুণ্ডাটা ডান হাতে কলাবতীর গালে ঘুসি মারল। টলে পড়ে গেল কলাবতী। পড়ার সময় তার কানে এল, ”খ্যা খ্যা খ্যা খ্যা” একটা শব্দ।

গুণ্ডাটা জামা তুলে প্যান্টে গুঁজে রাখা একটা ছোরা বার করে কলাবতীর গলার কাছে ধরে বলে উঠল, ”কী বলেছ পুলিশকে, কী বলেছ? না বললে এই ছোরা গলায় ঢুকিয়ে দেব।”

কলাবতী চোখে অন্ধকার দেখছে। চিৎকার করে কাউকে যে ডাকবে সে জোরও তার গলায় নেই। শুকিয়ে গেছে গলা। ছোরার ঠাণ্ডা ছুঁচোলো আগাটা তার গলায় খোঁচা দিচ্ছে। সে হাঁটু গেড়ে বসা গুণ্ডাটার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেল। তার মনে হচ্ছে ছোরাটা তার গলায় সত্যিই ঢুকিয়ে দেবে। অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগে শুনতে পেল খয়েরির গলায় যা কখনও শোনেনি এমন একটা হাড়কাঁপানো হিংস্র গর্জন— ”ঘউউঅউঅউ।”

গুণ্ডাটার ডান পায়ের ডিমের কাছটায় খয়েরি কামড়ে ধরে মুখটা ঝাঁকাচ্ছে। প্যান্টের মধ্য দিয়ে তার দাঁত বসে গেছে মাংসে। ছোরা ধরা হাতটা সে ঘুরিয়ে সজোরে চালাল খয়েরির উদ্দেশ্যে। ছোরাটা লাগল খয়েরির সামনের বাঁ পায়ের থাবার ওপরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরোল। কিন্তু খয়েরি তার কামড় আলগা করল না।

ঠিক এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অপুর মা। চোখের সামনে কলাবতীকে শুয়ে থাকতে, একটা লোককে ছোরা হাতে এবং খয়েরি তাকে কামড়ে ধরে আছে দেখে সে তার বিখ্যাত আকাশ ফাটানো গলায় চিৎকার করে উঠল, ”ওগো কে কোথায় আছ গো, ডাকাতে কালুদিদিকে মেরে ফেলল গো।” বলতে—বলতে অপুর মা ছুটে গেল গুণ্ডাটার দিকে। চিৎকার শুনে রাস্তা দিয়ে যাওয়া দুটি লোক ফটকের সামনে থমকে দাঁড়াল, গাড়ি বারান্দায় ছুটে এলেন রাজশেখর। অপুর মা একটা আধলা ইট কুড়িয়ে নিয়ে ছুটলেন গুণ্ডাটার দিকে।

গতিক সুবিধের নয় বুঝে, কুকুরের কামড়ের যন্ত্রণা এবং সেকেলে ডাকাতদের মতো পিলে চমকানো হাঁক দিয়ে আসা রণরঙ্গিণী মূর্তিটিকে দেখে গুণ্ডাটি ফটকের দিকে দৌড় দিল। খয়েরি তাড়া করতে গিয়ে কয়েক পা দৌড়ে লুটিয়ে পড়ল। রাজশেখর তার দোনলা বন্দুকে কার্তুজ ভরে আবার যখন গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তখন অপুর মার ছোড়া ইটটা ফটকের লোহার গরাদে লেগে ‘ঠং’ করে শব্দ তুলেছে আর গুণ্ডাটা খোঁড়াতে—খোঁড়াতে তখন রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছে এবং একদল লোক তার পেছনে ছুটছে।

কলাবতীর জ্ঞান একটু পরেই ফিরে এল। প্রথমেই সে বলল, ”খয়েরি কোথায়?”

মুরারি কলাবতীকে দাঁড় করিয়ে পিঠ থেকে স্কুলব্যাগটা খুলে নিয়ে বলল, ”অপুর মা ওকে তুলে ঘরে নিয়ে গেছে, কত্তাবাবু পুলিশ আর ডাক্তারকে ফোন করছেন, তুমি কি পারবে আস্তে—আস্তে হেঁটে বৈঠকখানা পর্যন্ত যেতে?”

”আমার হয়েছে কী যে, পারব না?” এই বলে কলাবতী সটান হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকল। অপুর মা তার নিজের ঘরের মেঝেয় খয়েরিকে শুইয়ে একটা ন্যাকড়া দিয়ে পা—টা বেঁধে রেখেছে। কলাবতী ঘরে ঢুকতেই খয়েরি মুখ তুলে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেজটা নাড়ল। হাড় ভেঙে ওর বাঁ পায়ের থাবাটা ঝুলে পড়েছে।

রাজশেখর ঘরে ঢুকে বললেন, ”ডাক্তার গুপ্ত অর্থোপেডিক সার্জন। তাকে ফোন করে পেলুম না, এখন কী করি?”

কলাবতী বলল, ”উনি তো মানুষের ডাক্তার। এখন দরকার ভেটারিনারি সার্জন, তুমি বরং বড়দিকে ফোন করো, মঙ্গলাকে যে ডাক্তার দেখেন তাকে কল করো।”

রাজশেখর ফোন করলেন মলয়াদের বাড়িতে। ফোন ধরলেন মলয়ার বাবা হরিশঙ্কর মুখুজ্জে।

”বলছিস কী রে রাজু, একটা নেড়িকুত্তার চিকিচ্ছের জন্য মঙ্গলার ডাক্তারকে চাই! অবাক করলি। বাড়িতে গেলে ডাক্তার পাল তিনশো টাকা নেন। দিবি?”

”হরি, তিনশো বলছিস কী রে তিন হাজার, তিন লক্ষ দেব। এই নেড়ি কুত্তাটাকে বাঁচাতেই হবে। ও আমার একমাত্র নাতনির প্রাণরক্ষা করেছে। হরি এসব বোঝার মতো ঘিলু তোর মাথায় নেই। মলু কোথায়, ফোনটা ওকে দে।”

আধঘণটার মধ্যে ডাক্তার পালকে নিয়ে মলয়া হাজির হল সিংহি বাড়িতে। শেষবার সে এ বাড়িতে এসেছিল মাধ্যমিকে থার্ড স্ট্যান্ড করে রাজশেখরকে যখন প্রণাম করতে আসে। ডাক্তার পাল খয়েরির পা দেখে বললেন, হাড় ভেঙেছে, অপারেশন করে ঠিক করতে হবে।

লোকাল অ্যানাসথেসিয়া করে ডাক্তার পাল ভাঙা হাড় জুড়লেন। সারাক্ষণ অপুর মার কোলে মাথা রেখে খয়েরি ঘরের লোকেদের মুখগুলো শুধু দেখে গেল। তার মুখ দেখে মনে হল সে যেন বুঝতে চাইছে—আমাকে নিয়ে আবার এত বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে কেন!

অপুর মা বলল, ”ডাক্তারবাবু খয়েরি মা হবে, ওর পেটের বাচ্চচাদের কোনও ক্ষেতি হবেনি তো?”

খয়েরির পায়ে প্লাস্টার করতে—করতে ডাক্তার বললেন, ”কোনও ক্ষতি হবে না। তবে বোধ হয় খোঁড়া হয়ে যাবে। অসম্ভব শান্ত আমাদের দিশি কুকুররা। পৃথিবীর যে—কোনও দেশের কুকুরদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। আপনি কিছু ভাবছেন না।” ডাক্তার পাল খয়েরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।

সেই গুণ্ডাটি পালাতে গিয়ে সিংহিবাড়ির কাছেই জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং গণপ্রহারে মারা যায়। পুলিশ একজনও ডাকাত ধরতে বা ছ’ লাখ টাকা উদ্ধার করতে এখনও পারেনি।

পায়ে প্লাস্টার করা খয়েরি আশ্রয় পেল সিংহিবাড়ির ভেতরে একতলায় সিঁড়ির নিচে। আগে এই জায়গায় সত্যশেখরের প্রিয় জার্মান শেফার্ড কুকুর হিটলার থাকত। জায়গাটাকে সে বলত, ‘হিটলারের বাঙ্কার।’ পঁচিশ বছর পর বাঙ্কারে এল আদ্যন্ত বাঙালি খয়েরি, তবে দেড়মাসের জন্য। পায়ের প্লাস্টার কাটার পর ক্ষতস্থান শুকোতেই সে আবার ফিরে যায় নিজের আস্তানা ফিটনের ঘরে। খোঁড়াতে—খোঁড়াতে সে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ফটক পর্যন্ত গিয়ে কলাবতীর জন্য বিকেলে অপেক্ষা করে।

.

সকালে খাওয়ার টেবলে একবাক্স দানাদার দেখে সবাই অবাক! মুরারি মাথা চুলকে বলল, ”অপুর মার কাণ্ড। বলল মুরারিদা এমন একটা শুভদিনে সবাইকে মিষ্টিমুখ না করালে কি চলে? ও দশটা টাকা দিল, আমিও দশটা টাকা দিলুম।”

রাজশেখর অবাক হয়ে বললেন, ”কীসের শুভদিন?”

সত্যশেখর আর কলাবতী জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল মুরারির দিকে। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে মুরারি বলল, ”কত্তাবাবু, আপনার আটঘরার মেয়েই বলুক। আয় রে খবরটা তুই দে।”

অপুর মা ঘরে ঢুকে কোনও ভণিতা না করে যথাসম্ভব তার বিখ্যাত গলাটা চেপে বলল, ”খয়েরি আজ ভোরে মা হয়েছে, পাঁচটা বাচ্চচা।”

কলাবতীর আগেই রাজশেখর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সত্যশেখর বাক্স থেকে দানাদার তুলে মুখে ঢোকাতে গিয়ে থমকে বলল, ”পাঁচ—পাঁচটা?”

”সতু, তোমার কাছে তো নগদ টাকা থাকে না কিন্তু এখন কি তোমার পকেটে কয়েকটা টাকা আছে চন্দ্রপুলি কেনার মতো?” রাজশেখর গম্ভীর সিরিয়াস গলায় বললেন।

সত্যশেখর পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা নোট বার করে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ”বাবা শ’ তিনেক হবে।”

”মুরারি ফেলু ঘোষের দোকানে এক্ষুনি যা। চন্দ্রপুলি বাসী হলেও নিয়ে নিবি, না থাকলে কড়াপাক। ফেরার সময় অর্ধেকটা মলয়াকে দিয়ে খবরটা দিবি।”

এর পর সারা সিংহিবাড়ি ফিটনের ঘরে গিয়ে হাজির হল। একটা চটের ওপর খয়েরি হাত—পা ছড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে। কালো খয়েরি সাদা লোমের, ধাড়ি ইঁদুরের সাইজের পাঁচটা চোখ—না—ফোটা বাচ্চচা তার বুকের কাছে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। কলাবতী একটা বাচ্চচা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই অপুর মা ধমকে উঠল, ”হাত দিউনি, গায়ে নোনা লাগবে। আর একটু বড় হোক।”

সত্যশেখর বলল, ”একটা বেবি কটে বাচ্চচাগুলোকে রাখলে কেমন হয়, কালু কী বলিস?”

”অপুর মাকে জিজ্ঞেস করো।”

কথাটা বুঝে নিয়ে অপুর মা বলল, ”কটমট আবার কী, মায়ের পাশে না থাকলে ওরা দুধ খাবে কী করে?”

সন্ধ্যায় ফোন এল কলাবতীর কাছে, করেছে মলয়া। তার গলায় দুশ্চিন্তা, ”কালু, কাল রাত থেকে মঙ্গলার লেবার পেন উঠেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার পাল দুপুরে এসেছিলেন, বললেন আরও চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখতে, নাহলে সিজারিয়ান করবেন।”

”বড়দি শুনেছেন তো খয়েরির বাচ্চচা হয়েছে, পাঁচটা।” উচ্ছ্বাস চেপে কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে কলাবতী বলল। মঙ্গলার কষ্টের কথা শোনার পর আনন্দ প্রকাশ করা যায় না।

”বাচ্চচা হওয়ার খবর তো সকালেই মুরারি দিয়ে গেছে, সেইসঙ্গে সন্দেশও। কেমন আছে খয়েরি, বাচ্চচারা দেখতে কেমন হয়েছে?”

”মায়ের মতো অত সুন্দর কেউ নয়।”

”আমার মন খুব খারাপ। কাল স্কুলে যাব না। মঙ্গলার কাছেই সারাক্ষণ রয়েছি, বেচারা খালি কাঁদছে। কী যে হবে জানি না।” মলয়া ভিজে গলায় কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিল।

পরদিন সকালে কলাবতী মলয়াকে ফোন করে জানল, মঙ্গলার কষ্ট আরও বেড়েছে। ডাক্তার বলছেন আর দেরি নয়, বাড়িতেই সিজারিয়ান অপারেশন করবেন। একতলায় একটা ফাঁকা ঘর আছে, সেখানে একটা বড় টেবল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডাক্তারের সঙ্গে থাকবেন দু’জন সহকারী। মঙ্গলার হার্টের অবস্থা খুব ভাল নয়।

কলাবতী ভাবল স্কুল ছুটির পর মঙ্গলাকে দেখে আসবে। ছুটির পর মলয়াদের বাড়ির দিকে কিছুটা হেঁটে হঠাৎ কী এক অজানা ভয় তার মনে ধরল। সে আর না এগিয়ে বাড়ি ফিরে এল। ফটকে আজ খয়েরি তার জন্য অপেক্ষায় ছিল না। সে ফিটনের ঘরে গিয়ে দেখল পাঁচটা বাচ্চচা জড়ামড়ি করে একের ঘাড়ে অন্যজন ওঠার চেষ্টা করছে। দুটো বাচ্চচা খুবই রুগণ, বোধ হয় বাঁচবে না। খয়েরি জিভ দিয়ে ওদের গা চেটে চলেছে। কলাবতীকে দেখে শুধু একবার চোখ তুলে তাকাল। খয়েরির ভাতের থালাটা পরিষ্কার একটা কণাও পড়ে নেই। সে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে টিফিনবক্স বার করল। খয়েরির লেজ নড়ে উঠল।

সন্ধ্যায় ক্ষুদিরামবাবুর কাছে কলাবতী যখন পড়ছে তখন মলয়াদের বাড়ি থেকে ফোন এল, ধরলেন রাজশেখর। অপর প্রান্তে মলয়ার গলায় তিনি শুনলেন শুধু একটি বাক্য, ”জ্যাঠামশাই মঙ্গলা আর নেই।” এর পর হাউহাউ করে কান্নায় শব্দ এবং ফোন রেখে দেওয়া।

রাজশেখর খবরটা বাড়ির কাউকে তখন দিলেন না। কলাবতীর পড়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাকে ডেকে বললেন, ”সতুকে গাড়ি বার করতে বল কালু, হরির বাড়িতে যাব। মঙ্গলা মারা গেছে।”

শোনামাত্রা কলাবতীর মুখ থেকে আর্তনাদের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল। সে ছুটে গেল কাকার সেরেস্তায়। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে সত্যশেখর দোতলায় উঠে এল। ”বাবা এ কী শুনছি?”

”মলয়া ফোন করে আমায় জানিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।’ ধীর স্তিমিত গলা রাজশেখরের।

দশ মিনিটের মধ্যে ওঁরা তিনজন মলয়াদের বাড়ি পৌঁছলেন। রাজশেখর তিরিশ বছর আগে হরিশঙ্কর মুখুজ্জের মায়ের শ্রাদ্ধে শেষবার এই বাড়িতে এসেছিলেন তারপর আজ এলেন। বাড়ির বাইরের আলোগুলো নেভানো। ভেতরেও টিমটিম করছে একটি—দুটি। সাড়াশব্দ নেই কোথাও।

”আয়।” হরিশঙ্কর ডাকলেন রাজশেখরকে, নিয়ে বসালেন, বৈঠকখানায়।

”মলয়া কোথায়?” রাজশেখর নিচুগলায় জিজ্ঞেস করলেন।

”পাশের ঘরে।”

সত্যশেখর আর কলাবতী পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, মঙ্গলাকে টেবলেই শুইয়ে রাখা হয়েছে গলা পর্যন্ত একটা সাদা চাদরে ঢেকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মলয়া হাত বুলিয়ে যাচ্ছে মৃত মঙ্গলার মাথায়।

ঘরের একধারে একটা বড় প্লাস্টিকের গামলায় মঙ্গলার বাচ্চচারা স্তূপ হয়ে রয়েছে। পলতে পাকানো ন্যাকড়া গোরুর দুধে ডুবিয়ে চাকর চেষ্টা করছে ওদের খাওয়াতে। কয়েক ঘণ্টা বয়সী বাচ্চচারা পারছে না পলতে চুষে দুধ খেতে।

কলাবতী ফিসফিস করে চাকরটিকে জিজ্ঞেস করল, ”ক’টা বাচ্চচা হয়েছে?”

”সাতটা। তার মধ্যে দুটো মরা।”

”এভাবে কি ওরা খেতে পারে? ড্রপারে করে খাওয়াতে হবে।” কলাবতী পরামর্শ দিল।

”চেষ্টা করেছি, মুখ থেকে ফেলে দিল।” চাকরটির অসহায়ত্ব গলায় ফুটল।

সত্যশেখর বলল, ”ফিডিংবটলে করে খাইয়ে দেখা যেতে পারে। তুমি দৌড়ে স্টেশনারি দোকান থেকে একটা কিনে আনো।”

ম্যানিব্যাগ থেকে সে টাকা বার করে দিল। রাজশেখর ঘরে এলেন, সঙ্গে হরিশঙ্কর। মলয়ার মাথায় হাত রেখে রাজশেখর বললেন, ”মঙ্গলা যাদের রেখে গেল এবার তাদের তো দেখতে হবে। ওদের মধ্য দিয়েই মঙ্গলা বেঁচে থাকবে।”

.

মুখ ফিরিয়ে মলয়া গামলাটার দিকে তাকাল। তার চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরে পড়ল। চাকরটি একটি দুই খাওয়াবার ফিডিং বটল আনল। তাতে দুধ ভরে সে নিপলটা একটা বাচ্চচার মুখে ঢোকাল। কিন্তু অত বড় মোটা নিপল মানুষের বাচ্চচাকে দুধ খাওয়াবার জন্য। অতটুকু সদ্যোজাত কুকুরের বাচ্চচা চুষে দুধ বার করতে পারল না।

”তাহলে কী হবে?” হরিশঙ্কর দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ”এরা তো না খেয়ে মারা যাবে।”

গামলার মধ্যে পাঁচটা দৃষ্টিহীন বাচ্চচা নড়াচড়া করছে, কলাবতীর মনে হয় ওরা খিদেয় ছটফটাচ্ছে। কিন্তু কীই—বা তারা এখন করতে পারে! বাচ্চচাগুলো না খেতে পেয়ে হয়তো একে—একে মরে যাবে। এ—কথা ভেবে তার চোখে জল এসে গেল। সে আর এখানে থাকতে চাইল না, রাজশেখরকে কানে—কানে বলল, ”দাদু বাড়ি চলো।”

ওরা বাড়ি ফিরে আসতেই অপুর মা ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল, মঙ্গলা মারা গেল কেন? কলাবতী তাকে কারণটা বলল, হার্টফেল। তারপর অপুর মা জিজ্ঞেস করল, ”বাচ্চচাক’টার কী হবে?”

মনের কষ্ট চেপে কলাবতী উদাসীন ভাবে বলল, ”কী আবার হবে, মায়ের দুধ না পেয়ে একসময় মরে যাবে।”

অপুর মা অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ডে কলাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ”সে কী। মরে যাবে কেন? এই তো আমি দিব্যি বেঁচে আছি। আমাকে জম্মো দিয়েই তো মা মরে গেল। সেই সময় মাসির ছেলে হয়েছে। মাসিই তো আমাকে আর নিজের ছেলেকে একসঙ্গে বুকের দুধ খাওয়াত।”

”তুমি বলতে চাও কী?” কলাবতীর খটকা লাগল কথাগুলো শুনে। নিশ্চয় কিছু একটা ভেবে অপুর মা কথাটা বলল।

”বলতে চাই খয়েরিকে মঙ্গলার বাচ্চচাদের কাছে নিয়ে যাও।” দু’ হাত শূন্যে তুলে কলাবতী চেঁচিয়ে উঠল, ”দি আইডিয়া।” সে ছুটে গেল সত্যশেখরের ঘরে। ”কাকা, প্রবলেম সলভড। এখনই খয়েরিকে নিয়ে যেতে হবে বড়দির বাড়ি, মঙ্গলার বাচ্চচাদের ও দুধ খাওয়াবে। এটা অপুর মার সাজেশন। আবার তুমি গাড়ি বার করো।”

ফিটনের ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে হাজির হল অপুর মা আর কলাবতী। খয়েরি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাচ্চচারা ছড়িয়ে—ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে। খয়েরি উঠে দাঁড়াল ওদের দেখে।

অপুর মা ডাকল, ”খয়েরি, আয় আমার সঙ্গে।” কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে সে আবার ডাকল। ”আয়, আয়।”

খয়েরি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অপুর মা’র পিছু নিল। কলাবতী তাকে পাঁজাকোলা করে মোটরে তুলল। ইতিমধ্যে রাজশেখর টেলিফোনে হরিশঙ্করকে জানিয়ে দিয়েছেন খয়েরিকে নিয়ে কালু আর অপুর মা যাচ্ছে। ওরা পৌঁছেই দেখল দরজার ব্যগ্র মুখে হরিশঙ্কর দাঁড়িয়ে তাদের জন্য।

গাড়ি থেকে নেমেই খয়েরি মুখ তুলে ”ঘৌ উ উ উ উ” ডাক দিল। কলাবতীর মনে হল ও মঙ্গলাকে যেন বলছে আমি এসেছি। গামলাভরা বাচ্চচাগুলিকে বৈঠকখানায় এনে রাখা হয়েছে। খয়েরি এগিয়ে গিয়ে বাচ্চচাগুলোকে প্রথমে শুঁকল, তারপর কলাবতী আর অপুর মার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল। অপুর মা ওর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে চাপ দিয়ে কাত করে শুইয়ে দিল। তারপর সে গামলা থেকে একটি একটি করে বাচ্চচা তুলে খয়েরির বুকের কাছে রেখে দিল। ক্ষুধার্ত বাচ্চচাগুলো আঁকুপাঁকু করে হামলে পড়ল খয়েরির ওপর। মাথা ঘুরিয়ে খয়েরি ওদের গা চাটতে শুরু করল।

হরিশঙ্কর পাশের ঘর থেকে মলয়াকে ডেকে আনলেন দেখার জন্য। বাচ্চচাদের দুধ খাওয়াতে দেখে মলয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

সত্যশেখর বলল, ”এখনকার মতো তো সমস্যা মিটল, কিন্তু এর পর?”

অপুর মা বলল, ”ওর নিজের তো বাচ্চচা রয়েছে, তাদেরও তো দুধ খাওয়াতে হবে। অত বাচ্চচাকে পারবে কি?”

হরিশঙ্কর বললেন, ”খয়েরি আজ রাত্তিরটা এখানেই থাকুক, কাল সকালে ওকে দিয়ে আসব।”

তার কথামতো খয়েরি রয়ে গেল। খয়েরির বাচ্চচারা সারারাত একা—একা কাটাল। খিদের জ্বালায় মাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে ওরা ফিটনের ঘর থেকে রাত্রে বেরিয়ে আসে দরজার বাইরে। সকাল ন’টা বেজে গেল তবুও খয়েরিকে ওরা পাঠাচ্ছে না দেখে কলাবতী ফোন করল। ওধার থেকে হরিশঙ্কর বললেন, ”এই পাঠাচ্ছি। খয়েরি এখন বাচ্চচাদের দুধ খাওয়াচ্ছে।”

ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে কলাবতী গাড়ি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। খয়েরিকে এখনও ওরা পাঠায়নি। সে অধৈর্য বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলল, রাতে ওকে না রেখে এলেই হত। ওর নিজের বাচ্চচাদেরও তো খাওয়া দরকার। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল ফিটনের ঘরের দিকে। গোটা কুড়ি কাক ঘরের মাথায়, পাঁচিলের ওপর আর গাছের ডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে ওড়াউড়ি করে চলেছে। রেলিংয়ে ঝুঁকে সে ফিটনের ঘরের দরজাটা দেখার চেষ্টা করল। যা দেখল তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। দুটো চিল ঠুকরে ঠুকরে ছিঁড়ে কী যেন খাচ্ছে।

চিৎকার করে, ”দাদু, অপুর মা, মুরারিদা” বলে উঠে কলাবতী সিঁড়ির দিকে ছুটল। ছ—সাতটা লাফে একতলায় পৌঁছে, ”মেরে ফেলল, মেরে ফেলল” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিটনের ঘরের দিকে পাগলের মতো ছুটে গেল। তার পেছনে ছুটল অপুর মা, মুরারি আর এক ঠিকে ঝি।

পাঁচটা বাচ্চচা নিথর হয়ে পড়ে আছে। চিল দুটো বাচ্চচার পেট ঠোঁট দিয়ে চিরে নাড়িভুঁড়ি বার করে খাচ্ছে। কয়েকটা কাক চিল দুটোর তিন—চার হাত দূরে কা—কা করে ওড়াউড়ি করছে। কলাবতী এধার—ওধার তাকিয়ে একটা বাঁশের টুকরো দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে, ”ভাগ ভাগ” বলে এগিয়ে গেল চিলদুটোর দিকে।

”হায় হায় হায়, কী সব্বোনাশ হল গো।” অপুর মা এই বলে ঝুঁকে পড়ল বাচ্চচাগুলোর ওপর। ”এখন আমি খয়েরির কাছে মুখ দেখাব কী করে কালুদি। ওকে তো আমিই বাচ্চচাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ও—বাড়িতে দিয়ে এনু। রেতে যদি ওকে আনতুম তাইলে এই সব্বোনাশটা হতনি গো।” অপুর মা কপাল চাপড়াতে লাগল।

মুরারি বলল, ”দ্যাখ তো এখনও একটা যেন বেঁচে আছে মনে হচ্ছে।” পেটের কাছটা সাদা তা ছাড়া আগাগোড়া খয়েরি লোমের বাচ্চচাটার মাথা নড়ছে, মুরারি আঙুল দিয়ে দেখাল। সন্তর্পণে আলগোছে অপুর মা বাচ্চচাটাকে তুলে নিল। ‘দেখি বাঁচাতে পারি কি না।’

কলাবতীর তাড়া খেয়ে কাক—চিলেরা উড়ে গিয়ে ছাদের ওপর বসল। গাড়ি বারান্দা থেকে রাজশেখর বললেন, ”মুরারি ওখানেই মাটি খুঁড়ে ওদের কবর দিয়ে দে, খয়েরি এসে বাচ্চচাদের মরামুখ যেন না দেখে।”

মৃতপ্রায় বাচ্চচাটিকে অপুর মা বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল, মুরারি একটা কোদাল এনে জমি খুঁড়তে শুরু করল। কলাবতী একদৃষ্টে মরা বাচ্চচাগুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে। চারটে বাচ্চচাকে গর্তে শুইয়ে মুরারি মাটিচাপা দিল।

তার মিনিটখানেক পরেই মলয়ার মোটর সিংহিবাড়িতে ঢুকল। গাড়ি থেকে নামল মলয়া আর খয়েরি। নেমেই খয়েরি খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে গেল ফিটন ঘরের দিকে, ঘরের ভিতরে ঢুকে বাচ্চচাদের দেখতে না পেয়ে ঘরের এধার—ওধার ঘুরে ঘুরে মেঝেয় কিছুক্ষণ শোঁকাশুঁকি করে বেরিয়ে এসে চাপা গলায় বাচ্চচাদের ডাকল।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল কলাবতী। মলয়া তার কাছে এসে কৈফিয়ত দেওয়ার স্বরে বলল, ”বাচ্চচাগুলোকে সকালে পেটভরে খাইয়ে দিয়ে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব, এই ভেবেই খয়েরিকে রেখে দিয়েছিলুম। একটু দেরি হয়ে গেল, এবার ও নিজের বাচ্চচাদের খাওয়াক।”

কলাবতী শান্ত স্বরে বলল, ”তার আর দরকার হবে না বড়দি। খয়েরি তার বাচ্চচাদের আর দুধ খাওয়াতে পারবে না, ওরা মরে গেছে, ওই দেখুন কবর।”

কলাবতী আঙুল তুলে যেখানটা দেখাল তার ধারেই দাঁড়িয়ে খয়েরি মুখটা আকাশের দিকে তুলে করুণ সুরে দু’বার ডাকল—”ও ঔ ঔ ঔ, অউ অউ অউ”। তারপর সে কলাবতীর কাছে এগিয়ে এল। কলাবতীর মনে হল খয়েরি যেন জিজ্ঞেস করছে—আমার বাচ্চচারা কোথায়! তুমি জানো কী?

হতভম্ভ মলয়াকে দাঁড় করিয়ে রেখে কলাবতী ছুটতে ছুটতে বাড়ির মধ্যে ফিরে এল। রান্নাঘরে সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে সে সদর দরজার দিকে তাকাল, খয়েরি তার পিছু নিয়ে আসছে কি?

খয়েরি নয়, এল মলয়া।

”কালু, আমি মঙ্গলার বাচ্চচাদের কথাই শুধু স্বার্থপরের মতো ভেবেছি, খয়েরির বাচ্চচাদের কথা ভাবিনি।” অনুতপ্ত স্বরে সে বলল।

রাজশেখর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মলয়ার কথাগুলি শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, ”খয়েরির মুশকিল কী জানো, ও অবোলা, মানুষের মতো কথা বলতে পারে না, পারলে অনেক কিছু বলত।”

সদর দরজার কাছ থেকে শোনা গেল, ”ভুক ভুক ভ উ উ উ।”

রাজশেখর বললেন, ”কী বলল বলো তো?”

সবাই চুপ করে রইল।

কালু ওকে ডেকে আনো, না ডাকলে তো বাড়ির মধ্যে ঢুকবে না।”

কলাবতী সদরে গিয়ে খয়েরিকে সঙ্গে করে ফিরে এল। এত চেনা মানুষকে একসঙ্গে দেখে সে লেজ নাড়তে লাগল। অপুর মা ওকে বকলস ধরে সিঁড়ির নীচে টেনে নিয়ে গেল, ”এই নে তোর বাচ্চচা, ওকে বাঁচিয়ে তোল।”

রাজশেখর বললেন, ”অপরাধ যা হওয়ার তা তো হয়েছেই, আর সংশোধন করতে পারে বলে মানুষকে মানুষ বলা হয়। মলু তোমার বাড়ির বাচ্চচাগুলোকে এবার বাঁচাতে হবে, ওরা যেন না মরে যায়। এই বাড়িতে ওর পা গেল, বাচ্চচাদের হারাল, আর নয়—এবার খয়েরিকে তুমি নিয়ে যাও।”

অপুর মা জুড়ে দিল, ”সঙ্গে ওর বাচ্চচাটাকেও নিয়ে যেও।”

মলয়া তাই নিয়েই বাড়িতে ফিরল।

.

ছ’মাস পর পূর্ব কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব লখনউ, কানপুর, দিল্লি দু’সপ্তাহের জন্য সফরে যাচ্ছে আটটি ম্যাচ খেলতে। কলাবতীকে হাওড়া স্টেশনে মোটরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে সত্যশেখর, সঙ্গে ধুপুও চলেছে। সিংহিবাড়ি থেকে গাড়ি বেরোতেই কলাবতী বলল, ”কাকা একবার বড়দির বাড়ি হয়ে যাবে, এখনও তো ট্রেনের জন্য হাতে অনেক সময় রয়েছে।”

সত্যশেখর বলল, ”বড়দির বাড়িতে আবার কেন!”

কলাবতী বলল, ”খয়েরিকে একবার দেখব।”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যশেখর বলল, ”যাবি তো, তারপর বড়দি যদি তোর খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়? দেড়শো গ্রাম ওজনের লোহার মতো শক্ত বল ঘণ্টায় তিরিশ—চল্লিশ মাইল স্পিডে আসবে, সেই বল ধরতে তোকে বারণ করেছিল না?” গাড়িটা মলয়াদের বাড়ির পথে ঘুরিয়ে সত্যশেখর বলল।

”সেই বড়দি এখন আর নেই, একদম বদলে গেছে। আমি প্র্যাকটিসে ঠিকমতো যাচ্ছি কিনা বাবুদার কাছে প্রায়ই খোঁজ নেন।”

মলয়াদের বাড়ির ফটক দিয়ে গাড়িটা ঢুকে সদর দরজার সামনে দাঁড়াল। গাড়ির শব্দে দোতলার বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তিনটি অ্যালসেসিয়ান ও একটি দেশি কুকুরের মুখ বেরিয়ে এল। মোটর থেকে নামল শুধু কলাবতী। তাকে দেখেই ওরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কলাবতী কলিং বেল বাজাতে কাজের লোক এসে দরজা খুলল।

”বড়দি, কী করছে?”

”বেরিয়েছেন।”

”খয়েরি কোথায়?”

”ঘুমোচ্ছে।”

ভৃত্যটির কথা শেষ হওয়ামাত্র কলাবতীর কানে এল ভেতরের ঘর থেকে ”ভুক ভুক ঘৌ উ উ উ” একটা চাপা ডাক। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল খয়েরি। কলাবতীকে দেখেই সে ছুটে এসে সামনের দু’ পা তুলে দিল ওর কোমরে। কলাবতী মুখ নামাল, খয়েরি ওর গাল চেটে কুঁই কুঁই শব্দ করে লেজ নাড়তে লাগল, কান দুটো ঘাড়ে মিশিয়ে দিয়ে। কলাবতী আড়চোখে দেখল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে পাঁশুটে ও কালো রঙের একটু বড়সড় চেহারার পাঁচটি আর তাদের মাঝে ছোটখাটো চেহারার খয়েরি কিন্তু পেটের কাছে সাদা রঙের একটি কুকুর। এখন আর ওদের বাচ্চচা বলা যায় না। ওরা নেমে এসে খয়েরির পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ এল।

”এখন কেমন আছিস?” কলাবতী জানতে চাইল খয়েরির গলা জড়িয়ে ধরে।

”ঘেউ।”

”এবার আমি যাই। আবার আসব।”

”ঘেউ ঘেউ।”

দরজা থেকে বেরিয়ে কলাবতী পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, ছ’টি সন্তান নিয়ে খয়েরি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *