৩.১ উপসংহার : কথায় কথায় নিশাবসান

কথায় কথায় নিশাবসান ও পূর্ব্বদিক্ ধূসরবর্ণ হইল। পম্পাসরোবরে কলহংসগণ কলরব করিয়া উঠিল। প্রভাতসমীরণ তপোবনের তরুপল্লব কম্পিত করিয়া মন্দ মন্দ বহিতে লাগিল। শশধরের আর প্রভা রহিল না। দূর্ব্বাদলের উপর নিশির শিশির মুক্তাকলাপের ন্যায় প্রভা পাইতে লাগিল। মহর্ষি হোমবেলা উপস্থিত দেখিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। মুনিকুমারেরা এরূপ একাগ্রচিত্ত হইয়া কথা শুনিতেছিলেন এবং শুনিয়া এরূপ বিস্ময়াপন্ন হইলেন যে, মহর্ষিকে প্রণাম না করিয়াই প্রভাতকৃত্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। হারীত আমাকে লইয়া আপন পর্ণশালায় রাখিয়া নির্গত হইলেন। তিনি বহির্গত হইলে আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, এক্ষণে কি কর্ত্তব্য, যে দেহ প্রাপ্ত হইয়াছি, ইহা অতি অকিঞ্চিৎকর, কোন কর্ম্মের যোগ্য নয়। অনেক সুকৃত না থাকিলে মনুষ্যদেহ হয় না। তাহাতে আবার সর্ব্ববর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকুলে জন্ম লাভ করা অতি কঠিন কর্ম্ম। ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া তপস্বিবেশে জগদীশ্বরের আরাধনা ও অপবর্গের উপায় চিন্তা করা প্রায় কাহারও ভাগ্যে ঘটিয়া উঠে না। দিব্যলোকে নিবাসের ত কথাই নাই। আমি এই সমুদায় প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, কেবল আপন দোষে হারাইয়াছি। কোন কালে যে উদ্ধার পাইব তাহারও উপায় দেখিতেছি না। জন্মান্তরীণ বান্ধবগণের সহিত পুনর্ব্বার সাক্ষাৎ হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। এ দেহে কোন প্রয়োজন নাই। এ প্রাণ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ। আমাকে এক দুঃখ হইতে দুঃখান্তরে নিক্ষিপ্ত করাই বিধাতার সম্পূর্ণ মানস। ভাল, বিধাতার মানসই সফল হউক।

এইরূপ চিন্তা করিতেছিলাম এমন সময়ে, হারীত সহাস্য বদনে আমার নিকটে আসিয়া মধুর বচনে কহিলেন, ভ্রাতঃ! ভগবান শ্বেতকেতুর নিকট হইতে তোমার পূর্ব্বসুহৃৎ কপিঞ্জল তোমার অন্বেষণে আসিয়াছেন। বাহিরে পিতার সহিত কথা কহিতেছেন। আমি আহ্লাদে পুলকিত হইয়া কহিলাম কই, তিনি কোথায়? আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া চল। বলিতে বলিতে কপিঞ্জল আমার নিকটে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমার দুই চক্ষু দিয়া আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বলিলাম, সখে কপিঞ্জল! বহু কাল তোমার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই। ইচ্ছা হইতেছে গাঢ় আলিঙ্গন করিয়া তাপিত হৃদয় শীতল করি। বলিবামাত্র তিনি আপন বক্ষঃস্থলে আমাকে তুলিয়া লইলেন। আমার দুর্দ্দশা দেখিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। আমি প্রবোধবাক্যে কহিলাম, সখে! তুমি আমার ন্যায় অজ্ঞান নহ। তোমার গম্ভীর প্রকৃতি কখন বিচলিত হয় নাই। তোমার মন কখন চঞ্চল দেখি নাই। এক্ষণে চঞ্চল হইতেছে কেন? ধৈর্য্য অবলম্বন কর। আসনপরিগ্রহণ দ্বারা শ্রান্তি পরিহার পূর্ব্বক পিতার কুশল বার্ত্তা বল। তিনি কখন এই হতভাগ্যকে কি স্মরণ করিয়া থাকেন? আমার দারুণ দৈবদুর্ব্বিপাকের কথা শুনিয়া কি বলিলেন? বোধ হয় অতিশয় কুপিত হইয়া থাকিবেন।

কপিঞ্জল আসনে উপবেশন ও মুখ প্রক্ষালন পূর্ব্বক শ্রান্তি দূর করিয়া কহিলেন, ভগবান কুশলে আছেন এবং দিব্যচক্ষু দ্বারা আমাদিগের সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া প্রতীকারের নিমিত্ত এক ক্রিয়া আরম্ভ করিয়াছেন। ক্রিয়ার প্রভাবে আমি ঘোটক রূপ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়াছিলাম। আমাকে বিষণ্ণ ও ভীত দেখিয়া কহিলেন, বৎস কপিঞ্জল! যে ঘটনা উপস্থিত তাহাতে তোমাদিগের কোন দোষ নাই। আমি উহা অগ্রে জানিতে পারিয়াও প্রতীকারের কোন চেষ্টা করি নাই; অতএব আমারই দোষ বলিতে হইবেক। এই দেখ, বৎস পুণ্ডরীকের আয়ুষ্কর কর্ম্ম আরম্ভ করিয়াছি, ইহা সিদ্ধপ্রায়; যত দিন সমাপ্ত না হয় তুমি এই স্থানে অবস্থিতি কর, বলিয়া আমার ভয় ভঞ্জন করিয়া দিলেন। আমি তখন নির্ভয় চিত্তে নিবেদন করিলাম, তাত! পুণ্ডরীক যে স্থানে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন অনুগ্রহ পূর্ব্বক আমাকে তথায় যাইতে অনুমতি করুন। তিনি বলিলেন, বৎস! তোমার সখা শুকজাতিতে পতিত হইয়াছেন; এক্ষণে তুমি তাঁহাকে চিনিতে পারিবে না। তাঁহারও তোমাকে দেখিয়া মিত্র বলিয়া প্রত্যভিজ্ঞা হইবে না। অদ্য প্রাতঃকালে আমাকে ডাকিয়া কহিলেন, বৎস! তোমার সখা মহর্ষি জাবালির আশ্রমে আছেন। পূর্ব্বজন্মের সমুদায় বৃত্তান্ত তাঁহার স্মৃতিপথবর্ত্তী হইয়াছে; এক্ষণে তোমাকে দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। অতএব তুমি তাঁহার নিকটে যাও। যত দিন আরব্ধ কর্ম্ম সমাপ্ত না হয়, তাবৎ তাঁহাকে জাবালির আশ্রমে থাকিতে কহিও। তোমার মাতা লক্ষ্মী দেবীও সেই কর্ম্মে ব্যাপৃত আছেন। তিনিও আশীর্ব্বাদ প্রয়োগ পূর্ব্বক উহাই বলিয়া দিলেন। কপিঞ্জল এই কথা বলিয়া দুঃখিত চিত্তে আমার গাত্র স্পর্শ করিতে লাগিলেন। আমিও তাঁহার ঘোটকরূপ ধারণের সময় যে যে ক্লেশ হইয়াছিল, তাহার উল্লেখ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলাম। মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইলে আহারাদি করিয়া, সখে! যাবৎ সেই কর্ম্ম সমাপ্ত না হয় তাবৎ এই স্থানে থাক। আমিও সেই কর্ম্মে ব্যাপৃত আছি, শীঘ্র তথায় যাইতে হইবেক, চলিলাম বলিয়া বিদায় হইলেন। দেখিতে দেখিতে অন্তরীক্ষে উঠিলেন ও ক্রমে অদৃ্শ্য হইলেন।

হারীত যত্ন পূর্ব্বক আমার লালন পালন করিতে লাগিলেন। ক্রমে বলাধান হইল এবং পক্ষোদ্ভেদ হওয়াতে গমন করিবার শক্তি জন্মিল। একদা মনে মনে চিন্তা করিলাম, এক্ষণে উড়িবার সামর্থ্য হইয়াছে, এক বার মহাশ্বেতার আশ্রমে যাই। এই স্থির করিয়া উত্তর দিকে গমন করিতে লাগিলাম। গমন করা অভ্যাস ছিল না, সুতরাং কিঞ্চিৎ দূর যাইয়াই অতিশয় শ্রান্তি বোধ ও পিপাসায় কণ্ঠশোষ হইল। এক সরোবরের সমীপবর্ত্তী জম্বুনিকুঞ্জে উপবেশন করিয়া শ্রান্তি দূর করিলাম। সুস্বাদু ফল ভক্ষণ ও সুশীতল জল পান করিয়া ক্ষুৎপিপাসা শান্তি হইলে নিদ্রাকর্ষণ হইতে লাগিল। পক্ষপুটের অন্তরালে চঞ্চুপুট নিবেশিত করিয়া সুখে নিদ্রা গেলাম। জাগরিত হইয়া দেখি জালে বদ্ধ হইয়াছি। সম্মুখে এক বিকটাকার ব্যাধ দণ্ডায়মান। তাহার ভীষণ মূর্ত্তি দেখিয়া কলেবর কম্পিত হইল এবং জীবনে নিরাশ হইয়া ব্যাধকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, ভদ্র! তুমি কে, কি নিমিত্ত আমাকে জালবদ্ধ করিলে? যদি আমিষলোভে বদ্ধ করিয়া থাক নিদ্রাবস্থায় কেন প্রাণ বিনাশ কর নাই? যদি কৌতুকের নিমিত্ত ধরিয়া থাক, কৌতুক নিবৃত্ত হইল এক্ষণে জালমোচন করিয়া দেও। নিরপরাধে কেন আর যন্ত্রণা দিতেছ? আমার চিত্ত প্রিয়জন দর্শনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত, আর বিলম্ব সহেনা। তুমিও প্রাণী বট, বল্লভ জনের অদর্শনে মন কিরূপ চঞ্চল হয়, জানিতে পার।

কিরাত কহিল, আমি চণ্ডাল বটি, কিন্তু আমিষলোভে তোমাকে জালবদ্ধ করি নাই। আমাদিগের স্বামী পক্কণদেশের অধিপতি। তাঁহার কন্যা শুনিয়াছিলেন, জাবালি মুনির আশ্রমে এক আশ্চর্য্য শুকপক্ষী আছে। সে মনুষ্যের মত কথা কহিতে পারে। শুনিয়া অধিক কৌতুকাক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং অনেক ব্যক্তিকে ধরিবার আদেশ দিয়াছিলেন। অনেক দিন অনুসন্ধানে ছিলাম। আজি সুযোগক্রমে জালবদ্ধ করিয়াছি। এক্ষণে লইয়া গিয়া তাঁহাকে প্রদান করিব। তিনিই তোমার বন্ধু অথবা মোচনের প্রভু। কিরাতের কথায় সাতিশয় বিষণ্ণ হইলাম। ভাবিলাম, আমি কি হতভাগ্য! প্রথমে ছিলাম দিব্যলোকবাসী ঋষি; তাহার পর সামান্য মানব হইলাম; অবশেষে শুকজাতিতে পতিত হইয়া জালবদ্ধ হইলাম ও চণ্ডালের গৃহে যাইতে হইল। তথায় চণ্ডাল-বালকের ক্রীড়াসামগ্রী হইব এবং ম্লেচ্ছ জাতির অপবিত্র অন্নে এই দেহ পোষিত হইবেক। হা মাতঃ! কেন আমি গর্ভেই বিলীন হই নাই! হা পিতঃ! আর ক্লেশ সহ্য করিতে পারি না। হা বিধাতঃ! তোমার মনে এই ছিল! এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিলাম। পুনর্ব্বার বিনয়বচনে কিরাতকে কহিলাম, ভ্রাতঃ! আমি জাতিস্মর মুনিকুমার, কেন চণ্ডালের আলয়ে লইয়া গিয়া আমার দেহ অপবিত্র কর? ছাড়িয়া দাও, তোমার যথেষ্ট পুণ্যলাভ হইবেক। পুনঃ পুনঃ পাদপতনপুরঃসর অনেক অনুনয় করিলাম; কিছুতেই তাহার পাষাণময় অন্তঃকরণে দয়া জন্মিল না। কহিল, রে মোহান্ধ! পরাধীন ব্যক্তিরা কি স্বামীর আদেশ অবহেলন করিতে পারে? এই বলিয়া পক্কণাভিমুখে আমাকে লইয়া চলিল।

কতক দূর গিয়া দেখি, কেহ মৃগবন্ধনের বাগুরা প্রস্তুত করিতেছে; কেহ ধনুর্ব্বাণ নির্ম্মাণ করিতেছে; কেহ বা কূটজাল রচনা করিতে শিখিতেছে; কাহার হস্তে কোদণ্ড কাহার হস্তে লৌহদণ্ড। সকলেরই আকার ভয়ঙ্কর। সুরাপানে সকলের চক্ষু জবাবর্ণ। কোন স্থানে মৃত হরিণশাবক পতিত রহিয়াছে। কেহ বা তীক্ষ্ণধার ছুরিকা দ্বারা মৃগমাংস খণ্ড খণ্ড করিতেছে। পিঞ্জরবদ্ধ পক্ষিগণ ক্ষুৎপিপাসায় ব্যাকুল হইয়া চীৎকার করিতেছে। কেহ এক বিন্দু বারি দান করিতেছে না। এই সকল দেখিয়া অনায়াসে বুঝিলাম, উহা চণ্ডালরাজের আধিপত্য। উহার আলয় যেন যমালয় বোধ হইল। ফলতঃ তথায় এরূপ একটীও লোক দেখিতে পাইলাম না, যাহার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র করুণা আছে। কিরাত চণ্ডালকন্যার হস্তে আমাকে সমর্পণ করিল। কন্যা অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া কাষ্ঠের পিঞ্জরে আমাকে বদ্ধ করিয়া রাখিল। পিঞ্জরবদ্ধ হইয়া ভাবিলাম, যদি বিনয় পূর্ব্বক কন্যার নিকট আত্মমোচনের প্রার্থনা করি, তাহা হইলে, যে নিমিত্ত আমাকে ধরিয়াছে তাহারই পরিচয় দেওয়া হয়; অর্থাৎ মনুষ্যের ন্যায় সুস্পষ্ট কথা কহিতে পারি বলিয়া ধরিয়াছে তাহাই সপ্রমাণ করা হয়। যদি কথা না কহি, তাহা হইলে শঠতা করিয়া কথা কহিতেছে না ভাবিয়া অধিক যন্ত্রণা দিতে পারে। যাহা হউক, বিষম সঙ্কটে পড়িলাম। কথা কহিলে কখন মোচন করিবে না, বরং না কহিলে অবজ্ঞা করিয়া ছাড়িয়া দিলেও দিতে পারে। এই স্থির করিয়া মৌনাবলম্বন করিলাম। কথা কহাইবার জন্য সকলে চেষ্টা পাইল, আমি কিছুতেই মৌনভঞ্জন করিলাম না। যখন কেহ আঘাত করে কেবল উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠি। চণ্ডালকন্যা ফল মূল প্রভৃতি খাদ্য দ্রব্য আমার সম্মুখে দিল, আমি খাইলাম না। পর দিনও ঐরূপ আহার সামগ্রী আনিয়া দিল। আমি ভক্ষণ না করাতে কহিল, পক্ষী ও পশুজাতি ক্ষুধা লাগিলে খায় না, ইহা অতি অসম্ভব বোধ হয়, তুমি জাতিস্মর, ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিবেচনা করিতেছ। অর্থাৎ চণ্ডালস্পর্শে খাদ্য দ্রব্য অপবিত্র হইয়াছে বলিয়া আহার করিতেছ না। তুমি পূর্ব্বজন্মে যে থাক, এক্ষণে পক্ষিজাতি হইয়াছ। চণ্ডালস্পৃষ্ট বস্তু ভক্ষণ করিলে পক্ষিজাতির দুরদৃষ্ট জন্মে না। বিশেষতঃ আমি বিশুদ্ধ ফল মূল আনয়ন করিয়াছি, উচ্ছিষ্ট সামগ্রী আনি নাই। নীচজাতিস্পৃষ্ট ফল মূল ভক্ষণ করা কাহারও পক্ষে নিষিদ্ধ নহে। শাস্ত্রকারেরা লিখিয়াছেন, পানীয় কিছুতেই অপবিত্র হয় না। অতএব তোমার পান ভোজনে বাধা কি?

চণ্ডালকুমারীর ন্যায়ানুগত বাক্য শুনিয়া বিস্মিত হইলাম এবং ফলভক্ষণ ও জলপান দ্বারা ক্ষুৎপিপাসা শান্তি করিলাম; কিন্তু কথা কহিলাম না। ক্রমে যৌবন প্রাপ্ত হইলাম। একদা পিঞ্জরের অভ্যন্তরে নিদ্রিত আছি, জাগরিত হইয়া দেখি, পিঞ্জর সুবর্ণময় ও পক্কণপুর অমরপুর হইয়াছে। চণ্ডালদারিকাকে মহারাজ যেরূপ রূপলাবণ্যসম্পন্ন দেখিতেছেন ঐরূপ আমিও দেখিলাম। দেখিয়া অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। সমুদায় বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব ভাবিয়াছিলাম। ইতিমধ্যে মহারাজের নিকট আনীত হইয়াছি। ঐ কন্যা কে, কি নিমিত্ত চণ্ডালকন্যা বলিয়া পরিচয় দেয়, আমাকেই বা কি নিমিত্ত ধরিয়াছে মহারাজের নিকটই বা কি জন্য আনয়ন করিয়াছে কিছুমাত্র অবগত নহি।

রাজা শূদ্রক, শুকের এই দীর্ঘ উপাখ্যান শ্রবণ করিয়া শেষ বৃত্তান্ত শুনিবার নিমিত্ত অতিশয় কৌতুকাক্রান্ত হইলেন। প্রতীহারীকে আজ্ঞা দিলেন, শীঘ্র সেই চণ্ডালকন্যাকে লইয়া আইস। প্রতীহারী যে আজ্ঞা বলিয়া কন্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল। কন্যা শয়নাগারে প্রবেশিয়া প্রগল্‌ভ বচনে কহিল, ভুবনভূষণ রোহিণীপতে, কাদম্বরীলোচনানন্দ, চন্দ্র! শুকের ও আপনার পূর্ব্বজন্মবৃত্তান্ত অবগত হইলেন, পক্ষী অনুরাগান্ধ হইয়া পিতার আদেশ উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক মহাশ্বেতার নিকট যাইতেছিল তাহাও শুনিলেন। আমি ঐ দুরাত্মার জননী লক্ষ্মী, মহর্ষি কালত্রয়দর্শী দিব্য চক্ষু দ্বারা উহাকে পুনর্ব্বার অপথে পদার্পণ করিতে দেখিয়া আমাকে কহিলেন, তুমি ভূতলে গমন কর এবং যাবৎ আরব্ধ কর্ম্ম সমাপ্ত না হয় তাবৎ তোমার পুত্ত্রকে তথায় বদ্ধ করিয়া রাখ এবং যাহাতে অনুতাপ হয় এরূপ শিক্ষা দিও! কি জানি, যদি কর্ম্মদোষে আবার তির্য্যগ্‌জাতি অপেক্ষাও অন্য কোন নীচ জাতিতে পতিত হয়। দুষ্কর্ম্মের অসাধ্য কিছুই নাই। আমি মহর্ষির বচনানুসারে উহাকে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। অদ্য কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়াছে এই নিমিত্ত তোমাদিগের পরস্পর মিলন করিয়া দিলাম; এক্ষণে জরামরণাদিদুঃখসঙ্কুল এই দেহ পরিত্যাগ করিয়া আপন আপন অভীষ্ট বস্তু লাভ কর, এই বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *