৬.৬.২ দ্বিপক্ষ পতঙ্গ : মশা

মশা

এইবার আমরা মশার কথা বলিব। ছোট দেহে লম্বা লম্বা ছয়খানা পা থাকায় ইহাদিগকে কি বিশ্রীই দেখায়! যেমন চেহারায় বিশ্রী, তেমনি কাজেও বিশ্রী। মানুষকে কাম্‌ড়াইয়া অস্থির করে। ইহাদের মুখে নলের মত লম্বা শুঁড় থাকে। তার পরে গায়ের চাম্‌ড়া কাটিয়া রক্ত চুষিয়া খাইবার জন্য ছুঁচের মত চারিটা অস্ত্রও লাগানো থাকে। আবার মাথার দুই পাশে হাজার হাজার চোখ। মশার দাঁত নাই। দাঁত দুটাই লম্বা হইয়া ছুঁচের মত হইয়াছে। এই অস্ত্র দিয়া গায়ের চাম্‌ড়া কাটা হইলে, মশারা মুখ হইতে এক রকম লালা বাহির করিয়া কাটা ঘায়ে লাগাইয়া দেয়। আমাদের শরীরের কোনো জায়গায় ক্ষত হইলে কি হয়, তোমরা তাহা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ,—তথন পাশ হইতে রক্ত আসিয়া বেদনার জায়গায় জড় হয়। কাটা জায়গায় মশার মুখের লালা লাগিলে অবিকল তাহাই হয়। লালার এক রকম মৃদু বিষ থাকে, কাজেই তাহা জ্বালা-যন্ত্রণার সুরু করে এবং পাশ হইতে তাজা রক্ত আসিয়া সেখানে জমা হয়। মশারা এই রকমে শুঁড়ের কাছে রক্ত পাইয়া তাহা চুষিয়া খাইতে থাকে।

একবার পেট ভরিয়া রক্ত খাইলে মশারা দুই তিন দিন আর কিছু খায় না। এই কয়েক দিন তাহারা চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে, তার পরে গা ঝাড়া দিয়া আবার রক্তের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়ে। রক্ত খাইলে যে কেবল ইহাদের শরীরই পুষ্ট হয়, তাহা নয়; সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের পেটের ভিতরকার ডিমগুলিও পুষ্ট হয়।

স্ত্রী ও পুরুষ মশা

মশাদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে। স্ত্রী ও পুরুষের চেহারাতে অনেক তফাতও দেখা যায়। স্ত্রীদেরই মুখে ঐ রকম শুঁড় ও ছুঁচ লাগানো থাকে। পুরুষ মশারা নিতান্ত নিরীহ প্রাণী। তাহারা রক্ত খায় না এবং বেশি দিন বাঁচেও না। ডানা গজাইলে দুই এক দিনমাত্র এদিক্ ওদিক্ উড়িয়া ফুলফলের রস শুষিয়া খায় এবং তার পরে মরিয়া যায়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, রক্ত খাওয়ার জন্য সব মশাকে দোষ দেওয়া যায় না। স্ত্রী-মশারাই দুষ্ট। ইহারাই আমাদের কানের গোড়ায় ভন্ ভন্ শব্দ করিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া দেয় এবং রক্ত খাইয়া হাত পা ফুলাইয়া দেয়।

স্ত্রী ও পুরুষ সকল মশারই দুখানা করিয়া ডানা থাকে। কিন্তু ইহা পিঁপ্‌ড়ে বা বোল্‌তাদের ডানার মত স্বচ্ছ নয়। তা’ছাড়া মাছিদের ডানার গোড়ায় যে দুটি খুঁটির মত অংশ থাকে, মশার ডানার কাছে তাহাও দেখা যায়। উড়িবার সময়ে দেহকে সাম্য অবস্থায় রাখার জন্য ঐ খুঁটি দুটা দরকার হয়।

মশার ডিম ও বাচ্চা

মশার ডিম পাড়া, ডিম হইতে বাচ্চা বাহির হওয়া এবং সেই বাচ্চা হইতে নূতন মশার উৎপত্তি হওয়া—সকলি বড় আশ্চর্য্য-জনক।

যে প্রাণী ডাঙায় বাস করে এবং ডাঙাতেই চরিয়া বেড়ায় তাহারা প্রায়ই ডাঙাতেই ডিম পাড়ে। কিন্তু মশারা তাহা করে না। পচা পুষ্করিণী বা গর্ত্তের বদ্ধ জলই তাহাদের ডিম পাড়িবার জায়গা। কখনো টবের নর্দ্দামার ও পাতকূয়োর বদ্ধ জলেও তাহাদিগকে ডিম পাড়িতে দেখা যায়।

ডিম পাড়ার সময় হইলেই মশারা নিকটের নোংরা এবং বদ্ধ জলের দিকে ছুটিয়া চলে এবং তাহাতে ডিম পাড়ে। সেগুলি জলে ভাসিয়া বেড়ায়, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হইয়া ভাসে না। ডিম পাড়া শেষ হইলে মশারা সেগুলিকে পিছনের পা দিয়া একত্র করে এবং তার পরে লালার মত এক রকম জিনিস দেহ হইতে বাহির করিয়া, সেগুলিকে পরস্পর আট্‌কাইয়া রাখে। এই রকমে ডিমগুলি একত্র থাকিয়া ভেলার মত জলের উপরে ভাসিয়া বেড়ায়।

মশাদের ডিম হইতে বাচ্চা বাহির হইতে বেশি সময় লাগে না। শীঘ্রই প্রত্যেক ডিম হইতে একএকটি বাচ্চা বাহির হইয়া জলের উপরে কিল্‌বিল করিতে থাকে। এই বাচ্চাদের চেহারা বড়ই অদ্ভুত। মুখে এক এক গোছা চুলের মত লোম লাগানো থাকে। জলের ছোট ছোট পোকা-মাকড়দিগকে ইহারা ঐ চুলের গোছা দিয়া ঠেলিয়া মুখে পূরিয়া দেয়। জলে বাস করিবার সময়ে জলের পোকাই ইহাদের খাদ্য।

মশার বাচ্চা কখনই মাথা উপরে রাখিয়া মাছের মত সাঁতার দেয় না। লেজ উঁচু এবং মাথা নীচু করিয়া সাঁতার দেওয়াই ইহাদের স্বভাব। মাছের মত ইহাদের কান্‌কো নাই। আমরা যেমন নাকের ছিদ্র দিয়া বাতাস টানিয়া বাঁচিয়া থাকি, মশার বাচ্চারাও সেই রকম লেজে-লাগানো সরু নলের মত ছিদ্র দিয়া বাতাস টানিয়া বাঁচিয়া থাকে। এইজন্যই লেজ উপরে রাখিয়া ইহারা সাঁতার দেয় এবং যখন দরকার হয় তখন লেজের ছিদ্রটা জলের উপরে উঠাইয়া বাতাস টানিয়া লয়। মুখে যেমন চুলের গোছা থাকে, ইহাদের লেজেও সেই রকম কয়েকগাছি চুল দেখা যায়।

এখানে মশার ডিম ও বাচ্চার ছবি দিলাম। তোমরা এই রকম পোকা জলে কখনই দেখ নাই কি? গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে চৌবাচ্চা বা টবে কিছুদিন ধরিয়া জল পচিতে থাকিলে, তাহাতে এই রকম লম্বা পোকা অনেক দেখিতে পাওয়া যায়। মানুষের সাড়া পাইলে বা কোনো শব্দ শুনিলে সেগুলি শরীর ও লেজ নাড়িয়া এবং মুখ বাঁকাইয়া জলের মধ্যে ডুব-সাঁতার কাটে। এইগুলিই মশার বাচ্চা। যে জলে এই রকম মশার বাচ্চা থাকে, তাহাতে একটু কেরোসিন তেল ঢালিয়া দিলে সেগুলি মরিয়া যায়। জলের সঙ্গে কেরোসিন মেশে না। কাজেই জলে ঢালিয়া দিলে তাহা পাত্‌লা সরের মত হইয়া জলের উপরিভাগ ঢাকিয়া রাখে। তার পরে মশার বাচ্চারা বাতাস লইবার জন্য লেজ উপরে উঠাইলেই নিশ্বাস টানিবার নলে কেরোসিন ঢুকিয়া যায়। ইহাতে উহারা দম আট্‌কাইয়া মারা পড়ে।

মশার বাচ্চা প্রায় পনেরো দিন জলে বাস করে এবং এই সময়ের মধ্যে চারি বার খোলস ছাড়ে। তার পরে গোলাকার পিণ্ডের মত হইয়া পুত্তলি-অবস্থায় থাকার পরে খোলস ছাড়িয়া ডানা-ওয়ালা মশা হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু খোলস ছাড়িলেই উহারা উড়িতে পারে না। আমরা নৌকায় চড়িয়া যেমন জলের উপরে ভাসিয়া বেড়াই, নূতন মশারাও ঠিক্ সেই রকমে নিজের গায়ের খোলসের উপরে বসিয়া কিছুক্ষণ কাটাইয়া দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ডানা মেলিয়া গায়ের জল শুকাইতে থাকে। ইহার পরে তাহারা আহারের সন্ধানে উড়িতে সুরু করে।

ম্যালেরিয়ার মশা

তোমরা বোধ হয় শুনিয়াছ, মশারা ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত খাইলে, ম্যালেরিয়া জ্বরের বীজ রক্তের সঙ্গে তাহাদের পেটের ভিতরে যায়। তার পরে ঐ মশারাই যখন কোনো সুস্থ লোককে কামড়াইতে আরম্ভ করে, তখন তাহারা পেটের ভিতরকার ম্যালেরিয়ার বীজ সেই সুস্থ ব্যক্তির রক্তে মিশাইয়া দেয়। খোস-পাচড়ার বীজ সুস্থ লোকের গায়ে লাগিলে, তাহারো খোস-পাচড়া হয়। হাম বা বসন্তের বীজ কোনোগতিকে কাহারো রক্তের সঙ্গে মিশিলে তাহারো ঐ-সকল রোগ হয়। মশারা ম্যালেরিয়ার বীজ লইয়া সুস্থ লোকের রক্তে লাগাইলে, তাহারো ম্যালেরিয়া জ্বর হয়। ডাক্তাররা বলেন, আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে যে এত ম্যালেরিয়া, তাহা মশারাই ছড়াইয়া দেয়।

যেমন কুকুর বেড়ালের মধ্যে অনেক রকম জাতি থাকে, সেই রকম মশাদের মধ্যেও নানা জাতি আছে। নানা জাতি মশার মধ্যে কেবল এক জাতিই ম্যালেরিয়ার বীজ ছড়ায়। অপর মশারা ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত খাইলে, তাহা পেটের ভিতরে নষ্ট হইয়া যায়। কাজেই ইহারা সুস্থ লোককে কামড়াইলে, শরীরে ম্যালেরিয়া বীজ প্রবেশ করিতে পারে না। তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, ম্যালেরিয়া রোগের জন্য সকল মশার দোষ দেওয়া যায় না। শঞ্চাশ ষাট্ রকম মশার মধ্যে এক জাতিই ভয়ানক অপকারী। ইহারা রক্তের সঙ্গে ম্যালেরিয়ার বীজ খাইলে তাহা হজম করিতে পারে না। বরং পেটের ভিতরে বীজগুলিকে ভয়ানক জোরালো করিয়া তুলে।

তোমরা বোধ হয়, এই মশাদের নাম জান না। ইহাদিগকে ইংরাজিতে এনোফিল্ (Anophele) বলে। ইহাদের জীবনের ইতিহাস সাধারণ মশাদেরি মত। যে-সকল খুঁটিনাটি ব্যাপারে অন্য মশাদের সহিত ইহাদের অমিল আছে আমরা কেবল তোমাদিগকে তাহারি কথা বলিব।

পর পৃষ্ঠায় যে দুইটি মশার ছবি দিলাম, প্রথমটি এনোফিল্ অর্থাৎ ম্যালেরিয়া মশা এবং দ্বিতীয়টি সাধারণ মশার ছবি। ম্যালেরিয়া মশা লেজের দিক্‌টা উঁচু ও মাথাটা হেঁট করিয়া আছে। যখন গায়ের উপরে বা ডালপালায় বসে, তখন উহারা ঐ-রকমে লেজ উঁচু ও মাথা হেঁট করে। কিন্তু সাধারণ মশারা কখনই ঐ রকম-ভঙ্গীতে বসে না। তাহারা দ্বিতীয় ছবির মত মাথা ও লেজ মাটির সঙ্গে সর্ব্বদাই সমান্তরাল করিয়া রাখে। সুতরাং, মশারা যখন তোমাদের দেওয়ালের গায়ে বা বাগানের গাছের পাতায় বসিয়া থাকিবে, তথন বসিবার ভঙ্গী দেখিয়া কোন্‌টি কোন্ জাতি মশা, তাহা তোমরা অনায়াসে বুঝিয়া লইতে পারিবে।

নানা রকম মশা যখন বাচ্চা-অবস্থায় জলে ডুবিয়া থাকে, তখন কোন্ বাচ্চারা ম্যালেরিয়ার মশা, তাহাও বুঝা যায়। ইহারা কখনই জলে সম্পূর্ণ ডুবিয়া থাকিয়া বিশ্রাম করে না। যখন অন্য বাচ্চারা জলের গভীর অংশে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে, তখন ম্যালেরিয়া মশারা জলের ঠিক্ নীচেই দেহটাকে পাশাপাশিভাবে লম্বা করিয়া ভাসিতে থাকে। ইহা দেখিয়া তোমরা ম্যলেরিয়া মশাদের বাচ্চাকে চিনিয়া লইতে পারিবে। তা’ছাড়া লেজের ও গায়ের লোম দেখিয়াও ইহাদিগকে চিনিয়া লওয়া যায়। সাধারণ মশার বাচ্চাদের লেজে লোম থাকে বটে, কিন্তু তাহা পরিমাণে বেশি নয়। ম্যালেরিয়া মশার বাচ্চাদের লেজের শেষে এবং গায়ে এমন গোছা গোছা লোম থাকে যে, তাহা খালি-চোখেই নজরে পড়ে। ম্যালেরিয়া-মশাদের ডানায় যে ছিটে-ফোঁটা দাগ থাকে তাহা দেখিয়াও উহাদিগকে চিনিয়া লওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *