যোগী-গোফা

রংপো নদীটি খুব বড় নদীও নয় ম্যাপেতেও তার নাম ওঠেনি। ঘুম আর বাতাসিয়া দুই পাহাড়ের বাঁকের মধ্যে ছোট একটি ঝরণা থেকে বেরিয়ে নদীটি পাহাড়ের গা বেয়ে দু-ধারের বনের মাঝ দিয়ে নুড়ি পাথর ঠেলে আস্তে-আস্তে তরাইয়ের জঙ্গলে নেমে গেছে, নদীর দু-পার করঞ্চা টেঁপারি তেলাকুচো বৈচী ডুমুর জাম এমনি সব নানা ফল নানা ফুল গাছে একেবারে হাওয়া করা, মাথার উপরে আকাশ সবুজ পাতার ছাউনীতে ঢাকা, তলায় সরু নদীটি ঝি-ঝি করে বয়ে চলেছে! এই পাখির গানে ভোমরার গুনগুনে ফুল-ফলের গন্ধে জলের কুলকুল শব্দে ভরা অজানা এই নদীর গলি পথ দিয়ে হাঁসেরা নেমে চলেছে আবার সিলিগুড়ির দিকে। উপরে মেঘ করেছে, বনের তলা অন্ধকার। শেওলা জড়ানো একটা গাছের ডাল এক থোকা লাল ফুল নিয়ে একেবারে নদীর জলে ঝুঁকে পড়েছে, তারি উপরে লাল টুপি নীল গলাবন্ধ সবুজ কোর্তা পরে-পরে মাছরাঙা নদীতে মাছ ধরতে বসেছে বাদলার দিনে। নদীর মাঝে একরাশ পাথর ছড়ানো; তারি কাছাকাছি এসে চকা হাঁক দিলে—“জির্‌ওবো, জির্‌ওবো।” অমনি মাছরাঙা সাড়া দিলে—“জিরোও-জিরোও।” আস্তে-আস্তে হাঁসের দল ঝরনার স্রোতে পিছল পাথরগুলোর উপর একে-একে উড়ে বসল। এমনি জায়গায়-জায়গায় জিরিয়ে-জিরিয়ে চলতে-চলতে সন্ধ্যা হয়ে এল, নিচের অন্ধকার পাহাড়ের চূড়োর দিকে আস্তে-আস্তে উঠতে আরম্ভ করলে, মনে হচ্ছে কে যেন বেগুনী কম্বলে ঘেরাটোপ দিয়ে একটার পর একটা পর্বত মুড়ে রাখছে, দেখতে-দেখতে আকাশ কালো হয়ে গেল, তারি মাঝে গোলাপী এক-টুকরো ধোঁয়ার মতো দূরের বরফের চুড়ো রাত্রের রঙের সঙ্গে ক্রমে মিলিয়ে গেল।

পাহাড়ের গলিতে অন্ধকার যে কি ভয়ানক কালো, রিদয় আজ টের পেলে, নিজেকে নিজে দেখা যায় না, কোনদিক উপর কোনদিক নিচে চেনা যায় না। কিন্তু এই অন্ধকারেও ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে রাতের পাখিরা পাহারা দিচ্ছে। এ পাহাড়ে এক পাখি হাঁকলে—“হুহু বাতাস হুহু,” ও পাহাড়ের পাখি তারি প্রতিধ্বনি দিয়ে বলে উঠল—“ঘুটঘুট আঁধার ঘুটঘুট।” দুই পাখি থামল, আবার খানিক পরে দুই পাখি আরম্ভ করলে-“জল পিটপিট তারা মিটমিট।” বোঝা গেল এখনো বিষ্টি পড়ছে, দু-একটি তারা কেবল দেখা দিয়েছে। ভালুক-ভালুকী ঝরণার পথে জল খেতে নেমেছে, তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না, কেবল বলাবলি করছে শোনা যাচ্ছে—“সেঁৎ-সেঁৎ।” একটা হরিণ কিম্বা কি বোঝা গেল না হঠাৎ বলে উঠল—“পিছল।” তারপরেই পাহাড়ের গা দিয়ে একরাশ নুড়ি গড়িয়ে পড়ল।

রাতে যে এত জানোয়ার চারদিকে ঘোরাঘুরি হাঁকাহাঁকি করে বেড়ায়, তা রিদয়ের জ্ঞান ছিল না। আঁধারের মধ্যে কত কি উসখুস করছে, খুসখাস করছে, চলছে, বলছে—কত সুরে কত রকম গলায় তার ঠিক নেই। রিদয়ের মনে হল বাতাসটা পর্যন্ত যেন বনের সঙ্গে ফুসফাস করে এক-একবার বলাবলি করে যাচ্ছে। তখন রাত গভীর ঝিঁঝিঁ পোকা বলে চলেছে ঝিমঝিম, ঝরণা বলছে ঘুম-ঘুম, রিদয়ের চোখ ঢুলে আসতে লাগল। সেই সময় দূরে শোনা গেল—“ইয়া-হু ইয়া-হু” তারপরে একবারে রিদয়ের যেন কানের কাছেই ডেকে উঠল বিকট গলার কি এক জানোয়ার—“তোফা- হুয়া তোফা-হুয়া।”

রিদয় চমকে উঠে শুনলে, কখনো এ-পাহাড়ে কখনো ও-পাহাড়ে দূরে-কাছে আগে-পাছে উপরে-নিচে যেন দলে-দলে কারা চীৎকার লাগিয়েছে—“ইয়াহু-ইয়াহু তোফা-হুয়া তোফা-হুয়া।” ভয়ে রিদয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে চকার গা ঘেঁষে শুধোলে—“একি ব্যাপার?”

চকা অমনি বললে—“চুপ-চুপ কথা কয়ো না, ডালকুত্তা শিকারে বেরিয়েছে”—বলতে-বলতে ছায়ার মতো একটা হরিণ ওপার দিয়ে দৌড়ে জলের ধারে এসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ঠিক সেই সময় নদীর দুই পারে শব্দ উঠল—যেন একশো কুত্তা এক সঙ্গে ডাকছে—“হুয়া-হু হুয়া-হু হুয়া-হু!” ঝপাং করে জলে একটা ছায়া লাফিয়ে পড়ল, তারপর পিছল পাথরের উপর খুরের আঁচড় বসিয়ে ভিজে গায়ে হরিণ এসে রিদয়ের পাশে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে শ্বাস টানতে-টানতে কেবলি ঘাড় ফিরিয়ে চারদিকে চাইতে লাগল। চকা হরিণের ভয় দেখে বললে—“ডালকুত্তা রইল কোন পাহাড়ে তুমি এখানে ভয়ে কাঁপছ দেখি!”

রিদয় বললে—“সে কি এই পাহাড়েই তো এখনি ডাকছিল কুকুরগুলো!”

চকা হেসে বললে—“কুকুরগুলো নয়, একটা কুকুর ডাকছিল, তাও খুব দূরে। ডালকুত্তার ডাকের মজাই এই, একটা ডাকলে মনে হবে যেন দশটা ডাকছে—দূরে কাছে চারদিকে—ভয়ে কোনদিকে যাব ভেবে পাওয়া যায় না, বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। ডালকুত্তার ডাক শুনে ভয় পেয়ে ছুটাছুটি করেছ কি মরেছ। ঠিক পায়ের শব্দ শুনে কুত্তা এসে তোমায় ধরেছে, যেখানে আছ সেইখানে বসে থাক চুপটি করে, তোমার সন্ধানও পাবে না ডালকুত্তা।”

হরিণ চকার কথায় কতকটা সাহস পেলে বটে কিন্তু তখনো ভয়ে তার কান দুটো কেঁপে-কেঁপে উঠছে, এমন সময় পিছনে অন্ধকারে খেঁকশেয়াল খেঁক করে হেসে উঠল, হরিণছানাটা একলাফ দিয়ে একেবারে নদী টপকে উপরের পাহাড়ে দৌড় দিলে। চকা বলে উঠল—“কে ও খেঁকশেয়াল নাকি?”

এই পাহাড়ে যে চাঁদপুরের শেয়াল এসে উপস্থিত হবে তা চকা ভাবেনি, আর খেঁকশেয়ালও মনে করেনি হাঁসেদের দেখা পাবে সে এখানে। শেয়াল আনন্দে চিংকার আরম্ভ করলে—“হুয়া-হুয়া হুয়া-উয়া বাহোয়া ওয়া-ওয়া!”

চকা শেয়ালকে ধমকে বললে—“চুপ অত গোল করো না, এখনি ডালকুত্তা এসে পড়বে, তখন তুমিও মরবে আমরাও মরব।”

শেয়াল একগাল হেসে বললে—“এবার আমি বাগে পেয়েছি ডালকুত্তা লেলিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব। সেদিন বড় যে হাঁসবাজি দেখানো হয়ে ছিল, এইবার শেয়ালবাজিটা দেখে নাও।” বলেই শেয়াল ডাকতে লাগল—“হুয়া-উহা হুয়া-উহা—তোদের জন্যে আমার আর দেশে মুখ দেখাবার যো নেই!”

চকা নরম হয়ে বললে—“অত চেঁচাও কেন, তুমি আগে আমাদের সঙ্গে লেগেছিলে। আমাদের দলের লুসাই আর বুড়ো-আংলা দুজনকে খেতে চেয়েছিলে, তবে না আমরা তোমায় জব্দ করেছি, আমরা তো মিছিমিছি তোমার সঙ্গে লাগতে যাইনি।”

শেয়াল দাঁত কড়মড় করে বললে—“ওসব আমি বুঝিনে, বিচার আমার কাছে নেই। বুড়ো-আংলাটিকে আমার দু-পাটি দাঁতের মধ্যে যদি হাজির করে দাও তো এবার ছাড়া পাবে, না হলে ডালকুত্তা এল বলে!”

চকা মুখে সাহস দেখিয়ে বললে—“আসুক না কুত্তা, এই ঝরনার মধ্যে পাথরের উপরে আর আসতে হয় না—জলে নেমেছে কি কুটোর মতো কোথায় তলিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। রিদয়কে আমরা কিছুতে ছেড়ে দেব না শেয়ালের মুখে, মরি সেও ভালো।” চকা খুব তেজের সঙ্গে এই কথা বললে বটে কিন্তু রিদয় দেখলে ভয়ে তার লেজের ডগাটি পর্যন্ত কাঁপছে। চকা চুপি-চুপি তাদের সবাইকে বললে—“সাবধান, বড় গোল এবারে, যে অন্ধকার উড়ে পড়বার যো নেই, ডালকুত্তা পাকা সাঁতারু, বিষম জোরালো, ঝরনা মানবে না সাঁৎরে উঠবে। সে জলের কুমির, ডাঙ্গার বাঘ বললেই হয়। সব সাবধান, যে যার সামলে, দেখতে না পায় পাথরের সঙ্গে মিশিয়ে বস!”

হাঁস অমনি ডানায় মুখ ঢেকে গুটিসুটি হয়ে এক-এক পাথরের মতো এখানে-সেখানে চেপে বসল, কালো বুনো হাঁসের ডানার রঙে পাথরের রঙে এমন এক হয়ে গেল যে, দু-হাত তফাৎ থেকে চেনা যায় না, হাঁস কি পাথর। কিন্তু সুবচনীর হাঁস—তার শাদা রঙ অন্ধকারেও ঢাকা গেল না, সে রিদয়কে বুকের কাছে নিয়ে বললে—“দেখ ভাই এবার তোমার হাতে মরণ-বাঁচন।”

রিদয় নিজের টেঁক থেকে নরুনের মতো পাতলা ছুরিটি বার করে বললে—“দেখছ তো আমার অস্তর!”

হাঁস বললে—“অস্তরে ভালো করে শান দিয়ে রাখ ভাই।”

ঠিক সেই সময় উপর থেকে একবার ডাক এল—“ইয়াহু!” তারপরেই ঝপাং করে জলে পড়ে ডালকুত্তা হাঁসের দিকে সাঁৎরে আসছে দেখা গেল। শেয়ালটা ঝোপের আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠল—“হুয়া-হুয়া হত্যা হুয়া!”

শেয়াল দেখলে, কুত্তা জল থেকে একটা বাঁকা-নখওয়ালা লাল থাবা শাদা হাঁসটির দিকে বাড়িয়ে দিলে। হাঁসটা কখন ক্যেঁক করে ওঠে শেয়াল ভাবছে ঠিক সে সময় ডালকুত্তা “উঁয়াহুঃ” বলে ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে-খেতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওপারে উঠল, আর ডানা ঝটপট করে হাঁসের দল অন্ধকার দিয়ে একদিকে উড়ে পালাল।

শেয়ালের ইচ্ছে হাঁসের পিছনে তাড়া করে চলে, কিন্তু ব্যাপারটা হল কি সেটা জানতে তার লোভ হচ্ছে, সে ওপর থেকে ডালকুত্তাকে ডাক দিয়ে শুধোলে—“ক্যায়াহুয়া ক্যোয়া-হুয়া?”

রিদয়ের নরুনের ঘায়ে তখন ডালকুত্তা অস্থির! সে রেগে বললে—“চোপরাও যাও-যাও!”

শেয়াল বললে—“কি দাদা হাত ফসকে গেল নাকি?”

কুত্তা গা ঝাড় দিয়ে বললে—“শাদা হাঁসটাকে টেনে নিয়েছিলুম আর কি, কি জানি সেই সময় টিকটিকির মতো একটা কি জানোয়ার হাতে এমন দাঁত বসিয়ে দিলে যে, চোখে আমি সরষে-ফুল দেখলুম!” কুত্তা তার থাবা চাটতে বসে গেল।

শেয়াল “হাঃ-গিয়া হাঃ-গিয়া” বলে কাঁদতে-কাঁদতে হাঁসেদের সঙ্গে আবার দৌড়ল। হাঁসের রিদয়কে নিয়ে দুই পাহাড়ের গলির মধ্যে দিয়ে কেবল কুলকুল জলের শব্দটি ধরে এঁকে-বেঁকে উড়ে চলেছে অজানা জায়গায়, কোথায় গিয়ে বসে ঠিক পাচ্ছে না, এমন সময় মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠল, তখন আর চকাকে পায় কে, ঝকঝকে সরু সাপের মতো নদীর ধারাটির উপরে চোখ রেখে চকা হাঁসের দলকে নিয়ে সোজা নিচ মুখে নেমে চলল। সিনিবালি চা-বাগানের উপরটায় এসে নদী একটা বড় পাথর ঘুরে ঝরনা দিয়ে একেবারে দুশো হাত নিচে পড়েছে, চাতালের মতো সেই পাথরে এসে চকা দলবল নিয়ে বাকি রাতটা কাটাতে বসল।

ঝরনার একদিকে ধাপে-ধাপে চা-বাগান পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত সিঁড়ির মতো উঠে গেছে, আর একদিকে বনের ধারে চা-বাগানের মালিকের ঘরবাড়ি, সেখান থেকে পাকদণ্ডি নেমেছে ঝরনা পর্যন্ত। হাঁসেরা রাতে এখানে-ওখানে উড়ে হাঁপিয়ে পড়েছিল, সবাই তারা ঘুমিয়ে পড়ল, রিদয় কেবল জেগে পাহারা দিতে লাগল।

খানিক রাতে বনের মধ্যে একটা ঝটাপট শব্দ শোনা গেল, তারপরেই রিদয় দেখলে ডালকুত্তার সঙ্গে শেয়াল কি ফুসফাস করতে-করতে পাকদণ্ডি দিয়ে নামছে, অন্ধকারে দুজনের চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। রিদয় তাগ করে একটা পাথর কুচি ছুঁড়ে শেয়ালটাকে মারতে যাবে ঠিক সেই সময় একটা পাহাড়ি সাপের গায়ে তার হাত পড়ল, ঠাণ্ডা যেন বরফ! রিদয় একেবারে হাঁসের পিঠে লাফিয়ে উঠে বললে—“পালাও-পালাও, শেয়ালটা এবারে আমাদের সাপে খাওয়াবার মৎলব করেছে।”

হাঁসেরা একেবারে ডানা মেলে আকাশে যেমন লাফিয়ে উঠল, ঠিক সেই সময় পাথরের হাতুড়ির মতো পাহাড়ি সাপের মাথাটা সোঁ করে তাদের পায়ের নিচে দিয়ে ছুটে এসে পাথরে ছোবল দিলে। চকা শিয়ালের উপর ভারি চটেছে, নদীর উপর দিয়ে গেলে শেয়ালটা সহজে তার সঙ্গ ছাড়বে না বুঝে চকা এবারে একেবারে উপর দিয়ে উড়ে চলল, সোজা সিলিগুড়ির স্টেশনের টিনের ছাতের দিকে।

দাৰ্জিলিঙ মেল আসতে এখনো তিন ঘণ্টা। স্টেশনে লোকজন নেই, হোটেলগুলোর টিনের ছাত বিষ্টিতে ভিজে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে। পাহাড়ের অন্ধকার ছেড়ে হঠাৎ ফাঁকায় পড়ে রিদয়ের ধাঁধা লেগে গেল। আকাশ থেকে সে টিনের ছাতগুলোকে দেখছে যেন ছোট-ছোট পাহাড়ের চুড়ো শাদা বরফে ঢাকা! হাঁসেরা সেই দিকে নেমে চলল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বললে—“কর কি, ওখানে যে খালি বরফ, বসবার জায়গা কোথা!” কিন্তু হাঁসেরা তার কথায় কান না দিয়ে নেমেই চলল!

রিদয় দেখলে পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশে দুই হাত ছড়িয়ে একটা যেন দৈত্য লাল সবুজ দুটো চোখ নিয়ে কটমট করে তার দিকে চেয়ে রয়েছে! রিদয়ের আরো ভয় হল। সে দুই পা গুটিয়ে হাঁসের পিঠের পালকে লুকোবার চেষ্টা করছে এমন সময় হাঁসেরা ঝুপঝাপ করে স্টেশনের টিনের ছাতে নেমে পড়ল। তখন রিদয়ের ভুল ভাঙল, সে দেখলে রাস্তার আলোগুলোকে ভেবেছিল সব তারা, টিনের ছাদগুলোকে পাহাড়ের চুড়ো—আর লাল সবুজ লণ্ঠন দেওয়া সিগনেল পোস্টটাকে একটা দৈত্য।

রিদয় স্টেশন কখনো দেখেনি, টিনের ছাতে ছুটোছুটি করে এদিক-ওদিক দেখতে আরম্ভ করলে, স্টেশনের সব উঁচু চুড়োর দুটো কাঁটা উত্তর দক্ষিণ কোনদিকে বাতাস বইছে দেখবার জন্যে কেবলি ঘুরছে, তারি উপরে একটি গোলা, সেই গোলায় এক-পা রেখে আকাশে চিমটের মতো দুই ঠোঁট উঠিয়ে কঙ্ক-পাখি আরামে ঘুম দিচ্ছেন। রিদয়কে টিনের উপর ছুটোছুটি করতে শুনে কঙ্ক-পাখি গোলার উপর থেকে ধমকে উঠলেন—“গোল করে কে?”

রিদয়ের দুষ্টুমি গেছে কিন্তু ফষ্টিনষ্টি করবার বাতিক এখনো খুব আছে। সে অমনি বলে উঠল—“গোল আর করবে কে, গোলের মাঝে বসে আছ তুমি, তোমারি এ কাজ!”

“ভালো রে ভালো বলেছিস” বলে কঙ্ক-পাখি চিমটের মতো ঠোঁটে গিরগিটির মতো রিদয়কে ধরে বার কতক আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিয়ে আদর করে বললে—“দেখ ছোকরা, এত রাত্রে ছাতে খুটখাট করলে এখনি স্টেশন-মিস্ট্রেস মেমের ঘুম ভেঙে যাবে আর স্টেশন-মাস্টার এসে আমাদের উপরে গুলি চালাবে। যদি স্টেশন দেখতে চাও তো ওই জলের পাইপটা ধরে নেমে যাও কিন্তু খবরদার স্টেশনের জল খেও না, তাহলেই ম্যালেরিয়া হয়ে যুধিষ্ঠিরের চার ভাই যেমন একবার মরেছিলেন তেমনি তুমিও মরবে।”

রিদয় বললে—“সে কেমন কথা?”

কঙ্ক বললেন—“শোনো তবে বলি!”

কথার নাম শুনেই চারদিক থেকে হাঁস পাখি যে-যেখানে ঘুমিয়ে ছিল চাঁদের আলোতে টিনের ছাতে বুড়ো কঙ্ক-পাখিকে ঘিরে বসল। চাঁদটাও যেন গল্প শুনতে কঙ্কের ঠিক পিঠের দিকে টিনের ছাদের কার্নিসে এসে বসল।

কঙ্ক গলা খাঁকানি দিয়ে শুরু করলেন:

আমাদের কঙ্ক বংশের শেষ অঙ্কের যে আমি, আমার স্বর্গীয় প্রপিতামহ ছোট-কঙ্ক, তার প্রস্বর্গীয় মধ্যম প্রপিতামহ মেঝো-কঙ্ক মহাশয়ের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ ধর্মাবতার বড়-কঙ্ক—তিনি কাম্য বনে এক রম্য সরোবরে বাস করছেন, এদিকে একদিন হয়েছে কি, না ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের তৃষ্ণা পেয়েছে। বনের মধ্যে তেষ্টা পেয়েছে, খুঁজে-খাঁজে জল খেয়ে নিলেই হত, না হুকুম করলেন—‘ওরে ভীম জল নিয়ে আয়।’ ভীম চললেন—‘জল খুঁজে খুঁজে তাঁরও তেষ্টা পেয়ে গেল। সেই সময় আমাদের ধর্মাবতার বড়-কঙ্ক সে পুকুরে পাহারা দিচ্ছিলেন। সেই কতকালের পানা পুকুরটার দিকে ভীমের নজর পড়ল, জল দেখে ভীমের তেষ্টা যুধিষ্ঠিরের চেয়ে দুগুণ বেড়ে গেল। ভীম তাড়াতাড়ি পুকুরে নামলেন, অঞ্জলি ভরে বৃকোদর প্রায় পুকুরের অর্ধেক জল তুলে নিলেন দেখে আমার স্বৰ্গীয় প্রপিতামহের পিতামহের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ বলে উঠলেন—‘অঞ্জলি করিয়া জল না করিহ পান, সমস্যা পু্রণ করি কর জল পান—নতুবা তোমার মৃত্যু।’

সমস্যা দিয়ে জল ফিলটার করে খাবার দেরি সইল না, বৃকোদর আমাদের ধর্মাবতারের পানা-পুকুরের পচাজল চকচক করে খেয়ে ফেললেন। যেমন খাওয়া, অমনি কম্পজ্বর সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যু। তার পর অর্জুন এলেন, নকুল সহদেব এলেন, দ্রৌপদী এলেন, সবার সেই দশা, কেউ সমস্যা দিয়ে জল শোধন করে নিতে চাইলেন না। শেষে যুধিষ্ঠির এসে ধর্মাবতার কঙ্কের কথা মতো চারবার সমস্যা দিয়ে জল শোধন করে তবে বেঁচে গেলেন; আর সেই শোধন করা শান্তি জল দিয়ে চার ভাই আর দ্রৌপদীকেও বঁচিয়ে দিলেন।

রিদয় শুধোলে—“বারি শোধন করার সমস্যা কোথায় পাওয়া যায়, তার দাম কত?”

কঙ্ক হেসে বললে—“সমস্যা কি জলের কুঁজো যে, বাজারে পাবে? সমস্‌কৃততে সমস্যা লেখা হয় মন্তরের মতো, সেইটে পাঠ করে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলে এক নাক টিপে নাকের মধ্যে জল টেনে নিতে হয়, আর বলতে হয়, আদি গঙ্গা সাত সমুদ্র তেরো নদী বান্ধিলাম, দশঘড়ায় বান্ধিলাম, জিহ্বার উপর বান্ধিলাম, সরস্বতী যমুনা বন্ধ, মাতা গঙ্গাভাগিরথী ফুঃ ফুঃ ফুঃ। মন্তর যদি শিখতে চাও তো কামরূপ কামিখ্যেয় আমার হাড়গিলেদাদার কাছে যাও। সাপের মন্তর বাঘের মন্তর শেয়ালের মন্তর সব মন্তর তিনি জানেন, আর কোনো ভাবনা থাকবে না নিৰ্ভয়ে যেখানে খুশি বেড়িয়ে বেড়াতে পারবে।”

চকা বলে উঠল—“এ পরামর্শ মন্দ নয়। খেঁকশেয়ালটা যে রকম সঙ্গে লেগেছে তাতে একটা শেয়ালের মন্তর রিদয়কে না শিখিয়ে নিলে তো আর চলছে না। সেই কৈলাস পর্যন্ত যেতে হবে, এর মধ্যে কত বিপদ-আপদ আছে—চল কিছুদিন কামরূপে থেকে গোটাকতক মন্তর নিয়ে যাওয়া যাক।”

কঙ্ক বললেন—“চল, দাদার কাছে আমারো গোটাকতক মন্তর নেবার আছে।” চকাকে কঙ্ক শুধোলেন—“তোমরা কোন পথে কামরূপ যেতে চাও? ব্রহ্মপুত্রের পথে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হবে, আর আমার সঙ্গে যদি সিধে রাস্তায় যেতে চাও তো এখান থেকে তরসা নদী একবেলা, সেখান থেকে জলপাইগুড়ি বক্সাও কুচবেহার হয়ে জয়িন্তী আর একবেলা, সেখানে রাত কাটিয়ে মোচু নদীতে জল খেয়ে গোয়ালপাড়া দশটার মধ্যে, সেখানে থেকে বেলা পাঁচটায় মানস নদী, ছটা নাগাদ কামরূপ কামাখ্যার মন্দির—সেখানে ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে হাড়গিলের চরে আমার দাদা থাকেন।”

চকা কঙ্ক-পাখির কথায় সায় দিয়ে তরসার পথেই বাঁয়ে হিমালয় পাহাড় রেখে সোজা পুবমুখী কামরূপে রওনা হল। খানিক উড়েই চকা বুঝলে কঙ্ক-পাখির সঙ্গে বেরিয়ে ভালো করেনি। তার নাম যেমন কঙ্ক চলাও তেমনি বঙ্ক, মোটেই সোজা নয়। সে সিলিগুড়ি ছেড়েই দক্ষিণমুখো চলল, মহানদীর ধার দিয়ে জলপাইগুড়ি স্টেশন হয়ে তিতলিয়া পর্যন্ত, সেখান থেকে উত্তরপুবে বেঁকে কুচবেহার ঘেঁষে বাৰ্ণিশ-ঘাট, তারপর তিস্তানদীর উপর দিয়ে এঁকতে-বেঁকতে উত্তর মুখে রামসাই হাট হয়ে বোগরা কুঠি, একেবারে পাহাড়তলীতে উপস্থিত, এখান থেকে সেখান থেকে পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে পুবে মাদারী পর্যন্ত। সেখান থেকে তরসা নদীর স্রোত ধরে দক্ষিণে এসে একেবারে কুচবেহারের রাজবাড়ির উপরে এসে পড়া, সেখান থেকে আবার উত্তর আলিপুর বক্সাও জয়িন্তী একেবারে জলপাইগুড়ি পরগনার পুব মোহড়ায় মোচু নদীতে হাজির। এর পরেই গোয়ালপাড়া আরম্ভ।

এইভাবে এদিক-ওদিক একোণ-ওকোণ এপাড়া-ওপাড়া যেন কি খুঁজতে-খুঁজতে কঙ্ক-পাখি তীরবেগে চলেছে। তার সঙ্গে উড়ে চলা হাঁসদের সম্ভব নয়, কাজেই চকা নিজের পথ দেখে হাঁক দিতে-দিতে চলল—“তরসা—তরসা।” ওদিকে যেমন কুঁকড়ো, এদিকে তেমনি উত্তর থেকে দক্ষিণমুখো যে সব নদী চলেছে, তারি ঘাটে-ঘাটে কাদাখোঁচা দলপীপী ঘাটিয়াল হাঁক দিচ্ছে—“তরসা পশ্চিমকুল মাদারি!” মাদারি হয়ে তরসার উপর দিয়ে হাঁসেরা পাড়ি দিতে লাগল, দূরে ডাইনে কুচবেহারের রাজবাড়ি, তরসার পুবপারে রাজাদের জলকরে পানিকাক হাঁকলে—“বক্সাও।” আরও দূরে জলপাইগুড়ির সীমানায় তিতিরে হাঁকলে—“জয়িন্তি।”

জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে গোয়ালপাড়ার মোচু নদীর কাছ বরাবর এসে হাঁসেরা আকাশ মেঘে অন্ধকার দেখলে, জোর বাতাস তাদের ক্রমেই উত্তরে পাহাড়ের গায়ে ঠেলে নিয়ে চলল। হাঁসেরা এঁকে-বেঁকে কখনো উত্তর ঘেঁষে একেবারে হিমালয়ের দেওয়ালের ধার দিয়ে কখনো দক্ষিণে ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে উড়ে চলল, সারাদিন।

গোয়ালপাড়া ছাড়িয়ে কামরূপ মানস নদীর কাছ বরাবর এসেছে, এমন সময় পশ্চিম দিকে বোঁ-বোঁ সোঁ-সোঁ শব্দ উঠল যেন হাজার-হাজার পাখি উড়ে আসছে। পায়ের তলার মানস নদীর জল হঠাৎ কালো ঘোরাল হয়ে উঠল, দমকা হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে হাঁসেদের ডানার পালকগুলো উস্কোখুস্কো করে দিলে।

চকা ঝপ করে ডানা বন্ধ করে পলকের মতো চমকে যেন আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল তারপরে তীরের মতে মানস নদীর দিকে নেমে চলল, ডাক দিতে-দিতে—“সামাল জমি লাও জমি লাও।” কিন্তু জমি নেবার আগেই ঝড় একেবারে ধুলো বালি শুকনো পাতা ছোট-ছোট পাখিদের ঠেলতে-ঠেলতে তরতর করে এসে পড়ল। বাতাসে জোরে মাঝ-দরিয়ার দিকে চকা নিকোবরের দলকে ঠেলে নিতে লাগল, জমি নেবার উপায় নেই। মানস নদীর পশ্চিম কূলে বিজলী-গাঁয়ের উপর দিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে বাতাস হাঁসের দলকে দেখতে-দেখতে মাঝ-দরিয়ায় নিয়ে আসছে, সামনে মানস নদীর ওপারের ভাঙন-জমি পাহাড়ের মতে উঁচু, সেখানে হাওয়া যদি আছড়ে ফেলে, তবে একটি হাঁসও বাঁচবে না। ঘোরবারও উপায় নেই, ওদিকে মাঝনদীতে তুফান উঠেছে, ঝড়ের মুখে উড়ে গিয়ে সামনের ভাঙনে আছড়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চয়, তার চেয়ে জলে পড়ে বরং সাঁতরে বাঁচবার উপায় আছে স্থির করে সব হাঁস ঝুপঝাপ নদীতে নেমে পড়ল, শাদা-শাদা ফেনা নিয়ে চারদিকে সাপের ফনার মতো ঢেউ উঠছে-পড়ছে, একটার পিছে তেড়ে আসছে আর একটা, মাথার উপর ঝড় ডাকছে সোঁ-সোঁ, চারদিকে জল ডাকছে গোঁ-গোঁ, নদীতে একখানি নৌকা নেই, একটি ডিঙ্গিও নেই, কেবল মাঝনদীতে ঢেউয়ের উপরে-উপরে স্রোতের মুখে ভেসে চলেছে মোচার মতো হাঁস কটি।

জলে পড়ে হাঁসেদের কোনো কষ্ট নেই। স্রোতে গা ভাসিয়ে একগাছ ছেঁড়া মালার মতো, ঢেউয়ের সঙ্গে উঠে পড়ে চলেছে। কেবল চকার ভয় হচ্ছে পাছে দলটা ছড়িভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই সে থেকে-থেকে ডাক দিচ্ছে—“কোথায়!” অমনি বাকি হাঁসের উত্তর দিচ্ছে—“হেথায়-হেথায়।” চকা একবার রিদয়কে ডাক দিচ্ছে—“হংপাল-হংপাল।” রিদয় অমনি উত্তর দিচ্ছে—“ভাসান-ভাসান।” আকাশ দিয়ে স্থলচর পাখিরা ঝড়ে লুটোপুটি হয়ে চলেছে। হাঁসের দিব্বি আছে দেখে তারা বলতে-বলতে উড়ে চলল—“সাঁতার-সাঁতার উ-উ-উ গেছি-গেছি-গেছি, মরি-মরি-মরি!” কিন্তু ঢেউয়ের উপর দিয়ে দড়ি ছেঁড়া নৌকার মতো দুলতে-দুলতে চলাতেও বিপদ আছে। চকা দেখলে হাঁসেরা ডানায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়বার যোগাড় করছে, সে অমনি সবাইকে সাবধান করতে লাগল—“ঘুমেসারা দলছাড়া, দলছাড়া, গেছ-মারা, চোক খোল চোখ মেল।” চকা বলছে বটে চোখ খোল কিন্তু নিজেরও তার চোখ ঢুলে এসেছে, অন্য হাঁসগুলো তো একঘুম ঘুমিয়েই নিচ্চে।

ঠিক সেই সময় সামনের একটা ঢেউয়ের মাথায় পোড়া কাঠের মতো একটা কি ভেসে উঠল! চকার অমনি চটকা ভেঙে গেল—সে কুমির-কুমির বলেই দুই ডানার ঝাপট মেরে সোজা আকাশে উড়ে পড়ল, খোঁড়া হাঁস রিদয়কে নিয়ে যেমন জল ছেড়েছে আর কুমির জল থেকে ঝম্প দিয়ে তার খোঁড়াপায়ে একটা দাঁতের আঁচড় বসিয়ে ডুব মারলে। খোঁড়া ইস বলে এক লাফে আর পাঁচ হাত উপরে উড়ে পড়ল। কুমিরটা আর একবার জল থেকে নাটা-চোখ পাকিয়ে নাকটা তুলে এদিক-ওদিক করে ভুস করে ডুব মারলে।

হাঁসের দল উড়তে-উড়তে খানিক গিয়ে আবার জলে পড়ল, কিন্তু সেখানেও আবার কুমির, আবার ওড়া, আবার গিয়ে জলে পড়া—এই ভাবে সারাদিন কাটল।

কত ছোটপাখি যে এই ঝড়ে মারা পড়ল, পথ হারিয়ে একদিকে যেতে আর একদিকে গিয়ে পড়ল, না খেয়ে জলে ভিজে নদীতে পড়ে পাহাড়ে আছাড় খেয়ে কত যে পাখি মরে ঝরে গেল তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

চকার দল হাঁফিয়ে পড়েছে, এদিকে অজানা নদী, ওদিকে অচেনা ডাঙ্গা। পাহাড় থেকে জল বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গড়িয়ে চলেছে—ঝড়ে ভাঙা বড়-বড় গাছের ডাল ভেসে চলেছে, চকা দলবল নিয়ে একবার গাছের ডালে ভর দিয়ে জিরোবার চেষ্টা করলে কিন্তু ভিজে ডাল একেই পিছল তার উপরে আবার স্রোতে গড়িয়ে-গড়িয়ে চলেছে। বাতাস ক্রমাগত তাদের জলে ঠেলে ফেলতে লাগল, ওদিকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল, জলে থাকা আর চলে না, হাঁসেরা উড়ে পড়ল।

আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই, কেবল কালো মেঘ আর বিদ্যুৎ, আর হুহু বাতাস, থেকে-থেকে পাখিরা ভয়ে চীৎকার করে উঠছে, জলের ধারে ঝুপঝাপ পাড় ভেঙে নদীতে পড়ছে, বজ্রাঘাতে বড়-বড় গাছ মড়মড় করে মুচড়ে পড়ছে, এরি মাঝ দিয়ে চকা তার দল নিয়ে ডাঙ্গায় আশ্রয় নিতে চলেছে। হঠাৎ এক সময় সামনে একটা গুনগুন আওয়াজ শোনা গেল, তারপরেই রিদয় দেখল হাওয়ার মতো একটা পাহাড়ের দেওয়াল নদী থেকে আকাশে উঠেছে আর তারি তলায় নদীর জল তুফান তুলে ঝপাঝপ পড়ছে। চকা সোজা পাহাড়ের দিকে চলেছে! রিদয় ভাবলে—এইবার শেষ, আর রক্ষে নেই, সে বিষ্টিতে কুয়াশায় ঝাপসা পাহাড়ের দিকে চেয়ে রয়েছে এমন সময় চকা ডাক দিলে—“বাঁয়ে ঘেঁষে।” দেখতে-দেখতে পাহাড়ের গায়ে প্রকাণ্ড খিলেনের মতো একটা গুহা দেখা গেল, চকা হাঁসের দল নিয়ে তারি মধ্যে সোজা ঢুকে পড়ল—সেখানে বিষ্টি নেই, জল নেই, বাতাসও আস্তে-আস্তে আসছে সোঁ-সোঁ করে। ডাঙ্গায় পা দিয়েই চকা দেখতে লাগল সেথো সবাই আছে কিনা। সবাইকে পাওয়া গেল, কেবল কঙ্ক-পাখি, যে তাদের পথ দেখিয়ে আনছিল তার কোনো খোঁজই হল না!

গুহাটার মধ্যে শুকনো বালি কাঁকর আর ঘাস। হাঁসেরা তারি উপরে বসে ভিজে পালক ঝেড়ে-ঝুড়ে নিচ্ছে, চকা রিদয়কে নিয়ে গুহাটা তদারক করতে চলল। মস্ত গুহা, মুখের কাছটায় আলো পড়েছে, ভিতর দিকটা অন্ধকার, দু-ধারে দেওয়ালের গায় রেলগাড়ির বেঞ্চির মতো থাকে-থাকে পাথর সাজানো—একপাশে একটি ডোবা, তাতে পরিষ্কার বিষ্টির জল ধরা রয়েছে। রিদয় বলে উঠল—“বাঃ ঠিক যেন ধর্মশালাটি।” অমনি গুহার ওধারে অন্ধকার থেকে কারা বলে উঠল—“ধর্মশালাই বটে!” রিদয় ভয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে গেল।

চকা এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে অন্ধকারে এ-কোণে ও-কোণে জোড়া-জোড়া সবুজ চোখ পিটপিট করছে। “ওই রে বাঘ!” বলেই চকা রিদয়কে মুখে করে তুলে দৌড়! রিদয় চেঁচাচ্ছে—“বাঘ বাঘ!” সেই সময় অন্ধকরে থেকে জবাব হল—“ভ্যে-ভ্যে ভ্যেড়া!”

এবার রিদয়ের সাহস দেখে কে, সে বুক ফুলিয়ে ভেড়াদের সর্দার দুম্বার কাছে গিয়ে শুধোলে—“এখানে যে তোমরা বড় এলে? এটা আমাদের ঘর, যাও!”

দুম্বা তার কানের দু-পাশে গুগলী পেঁচ দুই শিং পাথরে ঘষে বললে— “এখানে আমরা ইচ্ছে সুখে এসে ধরা পড়ে কামিখ্যের ভেড়া বনে গেছি, যাব কোথায়, যাবার স্থান নেই।”

রিদয় অবাক হয়ে বললে—“কি বল এই কামরূপ কামিখ্যের মন্দির? এইখানে মানুষকে তার ভেড়া ছাগল বানিয়ে রাখে!”

হাঁও বটে নাও বটে, এই ভাবে ঘাড় নেড়ে দুম্বা বললে—“এটা কি গোয়াল না এটা আমাদের বাড়ি—এটা একটা যাদুঘর। এখানে যা দেখছ সব ইন্দ্রজাল, ভৌতিক ব্যাপার। এদিক দিয়ে পাখিরা পর্যন্ত উড়ে চলতে ভয় পায়, তোমরা কার পরামর্শে এখানে এলে শুনি? মহাভারতের ধর্মাবতার কঙ্ক তার কোনো পুরুষের কেউ নয়, সেই বকাধাৰ্মিক কঙ্কপাখির সঙ্গে তোমাদের পথে দেখা হয়নি তো?”

কঙ্ক-পাখির পাল্লায় পড়েই তারা এদিকে এসেছে শুনে দুম্বা হা-হুতাশ করে বললে—“এমন কাজও করে, বকাধার্মিকের কাজই হচ্ছে নানা ছলে লোককে ভুলিয়ে এই কামরূপে এনে মানুষকে ভেড়া, ভেড়াকে ছাগল বানিয়ে দেওয়া, এটা বুঝলে না—কি আপশোষ!”

রিদয় ভয় পেয়ে বলে উঠল—“এখন উপায়!”

দুম্বা খানিক ভেবে বললে—“উপায় আর কি, এক উপায় যদি বকধাৰ্মিক এই ঝড়ে রাস্তা ভুলে অন্যদিকে গিয়ে পড়ে থাকে তবেই তোমরা এবারের মতো বেঁচে গেলে।”

চকা শুধোলে—“আর সে যদি এসে পড়ে তো কি হবে?”

দুম্বা উত্তর করলে—“সে এসে ঠোঁট দিয়ে তোমাদের মাথা ফুটো করে যা কিছু বুদ্ধি আছে মগজের সঙ্গে সবটুকু বার করে নেবে; আর তোমরা কেউ বোকা ছাগল, কেউ মেড়া কেউ ভেড়া হয়ে আ—আ করে তাকেই তোমাদের ভেড়া বানিয়ে দেবার জন্যে বাহবা ধন্যবাদ দিতে থাকবে।”

রিদয় রেগে বলে উঠল—“মাথা ফুটো করতে দিলে তবে তো? যেমন দেখব সে আসছে, অমনি আমরা সরে পড়ব না?”

দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“তা হবার যো নেই, সে ধুলোপড়া দিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে কখন যে কাজ উদ্ধার করে যাবে তোমরা টেরও পাবে না। মনে হবে, কে তোমাদের মাথা চুলকে দিচ্ছে, তোমরা ঘুমিয়ে পড়বে আরামে। তারপর চোখ খুলে দেখবে ভেড়া হয়ে গেছ।”

চকা এগিয়ে এসে শুধোলে—“এত বোকা ছাগল বোকা মেড়ায় তার কি দরকার বলতে পার?” দুম্বা থানিক চোখ বুজে বললে—“ঠিক জানিনে, তবে শুনেছি নাকি”—বলেই দুম্বা হঠাৎ চুপ করে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল।

রিদয় ব্যস্ত হয়ে শুধালে—“কি শুনেছ বলেই ফেল না।”

দুম্বা আরো ব্যস্ত হয়ে বললে—“চুপ-চুপ অত চেঁচিও না, কাজ কি বাবু ওসব কথায়, শেষে কি ফ্যেঁসাদে পড়ব? কে কোন দিকে শুনবে, শেষে আমাকে নিয়ে টানাটানি। যাক ও কথা, কুবরী-কুবরী”—বলে দুম্বা চোখ বুজল।

রিদয় অনেক পেড়াপীড়ি করেও কুবরী ছাড়া আর একটি কথাও বোকাছাগলের মুখ দিয়ে বার করতে পারলে না। চকা চুপিচুপি রিদয়কে বললে—“তুমিও যেমন, বোকামেড়া ও, ওর কথার আবার মূল্য আছে? নিশ্চয় ওটার মাথার গোল আছে, এস এখন খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম করা যাক, সকালে উঠে নিজের পথ নিজে দেখা যাবে।” তারপর দুম্বার দিকে চেয়ে বললে—“মশায় যদি জানতেন আমরা আজ সারা রাস্তাটা কি কষ্টে কাটিয়ে এখানে এসেছি, তবে এই রাতে আমাদের মিছে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা না করে বরং কিছু অতিথি সৎকারের বন্দোবস্ত করে দিতেন। আমরা নিতান্ত দায়ে পড়েই এখানটায় আশ্রয় নিয়েছি, এখন উচিত হয় আপনার আর কালবিলম্ব না করে আমাদের জন্যে জলযোগ এবং তারপরে সুনিদ্রার ব্যবস্থা করে দেওয়া।”

এবারে দুম্বা অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এসে বললে—“আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না, আচ্ছা আমি আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করছি; দেখুন কি কাণ্ড হয়, তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবেন না।”

চকা এবার সত্যিই ভয় পেলে, কোনদিক থেকে কি বিপদ আসে ভেবে চারিদিক চাইতে লাগল।

দুম্বা ডাকলে—“আসুন আহার প্রস্তুত কিন্তু দেখবেন চটপট আহার সেরে উঠবেন, না হলে ব্যাঘাত হতে পারে। আপনার আসন গ্রহণ করুন আমি এখানে দাড়িয়ে আসন-বন্ধন মন্ত্রটি পাঠ করছি।” রিদয় আর হাঁসের খেতে বসে গেল। দুম্বা মন্ত্র পাঠ করতে লাগল—

মেষ চর্মের আসন তোরে করিরে পেন্‌নাম
আমার এই কার্যে তুই হ রে সাবধান।
কামিখ্যার বরে তোরে করিলাম বন্ধন
এ কার্যে যেন তুই না হোস লঙ্ঘন।।

হাঁসেদের অর্ধেক খাওয়া হয়েছে এমন সময় দূরে ফেউ ডাকল। দুম্বা মন্তর জপতে-জপতে বললে—“ওই শুনছেন তো এঁরা আসছেন, এরি মধ্যে খবর হয়ে গেছে। ব্যাঘাৎ হল চটপট খেয়ে নিন” বলেই দুম্বা তাড়াতাড়ি মন্তর পড়তে লাগল:

লাগ-লাগ ফেরুপালের দন্তের কপাটি
কোনো ভূতে করিতে নারিবে আমার ক্ষতি
শীঘ্রি লাগ শীঘ্রি লাগ।

মন্তরের চোটে কেউ ঘরে ঢুকতে সাহস পেলে না বটে কিন্তু বাইরে চারদিকে ফেরুপাল চিৎকার করে কানে তালা ধরিয়ে দিতে লাগল—“হুয়া-হুয়া, খাওয়া হুয়া, হুয়া খাওয়া, হুয়া খাওয়া।”

রিদয় বললে—“এত গোল করে কে?” রিদয়ের কথা তখন আর কে শোনে? তখন দুম্বা “ব্যেঘাৎ-ব্যেঘাৎ” বলে চেঁচাচ্ছে আর ঘরের মাঝে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, যেন সর্বনাশ হচ্ছে। রিদয় দুম্বার রকম দেখে চেঁচিয়ে বললে—“আরে মশায়, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন না, অত বুক চাপড়ে ছুটোছুটি করচেন কেন?”

দুম্বার তখন ভয়ে মাথা ঘুলিয়ে গেছে সে কাঁপতে-কাঁপিতে বললে—“সর্বনাশ হল, হায়-হায় কি উপায়, কি উপায়!”

রিদয় আরো চটে বললে—“আরে মশায় হয়েছে কি তাই বলুন না?”

দুম্বা তখন একটু স্থির হয়ে বললে—“ওই খেঁকি-খেঁক-খেঁকি খেঁকশেয়ালী ওই তিন ফেরুপাল ওঁরা যদি আমাদের দেওয়া মুড়ো কিম্বা ভেড়ার মাংস না খেতে চান তো কি হবে এখন।”

রিদয় হেসে বললে—“এই জন্যে এতো ভয়, তা ওঁরা যদি আপনাদের মুড়ো মাংস না খান তো আপনাদেরই তো লাভ, এতে আপনার দুঃখুই বা কি, ভয়ই বা কি?”

দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“আহা আপনি বুঝেন না, ওঁদের মুড়ো মাংস খাওয়ানো যে ভেড়াবংশের সনাতন প্রথা, সেটা বন্ধ হলে যে আমাদের জাত যাবে, আমরা একঘরে হয়ে যাব, তার করলেন কি?”

রিদয় গম্ভীর হয়ে বললে—“আগে আপনি কি করতে চান শুনি!”

দুম্বা কেঁদে বললে—“আমি এ প্রাণ আর রাখব না—আমি সমাজদ্রোহী, আমি নরকে যাব স্থির করেছি, আমি অতি হতভাগ্য।”

রিদয় দুম্বার শিংএ হাত বুলিয়ে বললে—“ওদের ঠাণ্ডা করবার কি আর কোনো উপায় নেই!”

দুম্বা ঘাড় নেড়ে বললে—“আর এক উপায়—তুষানলে জ্বলে পুড়ে মরা, কিন্তু তার চেয়ে নরককুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াই সহজ!”

রিদয় বলে উঠল—“কাজ আরো সহজ হয় ওই তিনটে কুকুরকে নরকে পাঠিয়ে দেওয়া!”

দুম্বা দুই চোখ পাকল্‌ করে অবাক হয়ে বললে—“একি সম্ভব!”

রিদয় বললে—“দেখি তোমার শিং, খুব সম্ভব এক ঢুঁয়ে তিনটেকে একেবারে নরকে চালান করে দেওয়া যায় যদি তুমি তাল ঠুকে লাগ!”

দুম্বা বলল—“তাল ঠুকে ঢুঁ লাগাতে আমি মজবুত কিন্তু ওদের দেখলেই যে আমাদের বুদ্ধি লোপ পায়, তার কি?”

রিদয় দুম্বার পিঠ চাপড়ে বললে—“তোমরা চোখ বুজে থেক—আমি যেমন বলব ‘শিং টিং চট্‌’ অমনি একসঙ্গে সবাই ঢুঁ বসিয়ে দিও, দেখি ওরা কি করে!”

এবারে অন্য-অন্য ভেড়া তুলাড়ু ঝাঁকাড়ু, তারা এগিয়ে এসে বললে—“আমরা দু-একটা কথা বলতে চাই, আমরা ঢুঁসোতে রাজী কিন্তু তার আগে ভেবে দেখা কর্তব্য যে ফেরুপালদের সরিয়ে দিয়ে কি আমরা চলতে পারব? তারা হলেন আমাদের ধোপা নাপিত এবং চরাবার কর্তা, ধরতে গেলে মেষবংশের মাথা। রাজদ্বারে শ্মশানে চ ওঁরা আমাদের বান্ধব, আত্মীয়, কুটুম্ব বললেই হয়। ওঁরা মাঝে-মাঝে আমাদের চিরুণী দাঁতে টেনে, নখে আঁচড়ে, রোঁয়া ছেঁটে, চাম ছাড়িয়ে, চেটে-পুটে সাফ না করে দিলে—কে মড়মড়ায় কে পড়পড়ায় কে ভাঙে খড়ি? আমাদের গা-শুদ্ধি হবারই যো নেই যদি না পাল-পার্বণে তাঁদের মাঝে-মাঝে মেষ চর্মের আসনে বসিয়ে মেষমাংসে না আমরা মুখশুদ্ধি করিয়ে দিতে পারি, এছাড়া আমরা খাঁড়া আর হাড়িকাট সামনে রেখে হাড়িপ-বাবা আর হাঁড়ি-ঝী মাতাজীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি—তুমি খণ্ডা দ্বিখণ্ডা সুমুক্তি বাহার গরল ভাবহং মানুরিক্ত ঘুমাইয়া আছি স্মটিকের মুণ্ডি! আমাদের এ মাথায় কোনো কাজ করতে গেলেই গুরুর কোপে পড়তে হবে, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ পাপে লিপ্ত হয়ে নরকেও যেতে হবে, এর জবাব আপনি কি দেন?”

রিদয়কে আর কোনো জবাব দিতে হল না—খেঁকি-খেঁক-খেঁকি খেঁকখেকানি তিনটে হেঁড়েল হঠাৎ এসে তিন মেড়ার লেজ ধরে টেনে নিয়ে চলল, হাঁসেরা ডানা ঝটাপট করে গুহার মধ্যে অন্ধকারে উড়ে বেড়াতে লাগল, রিদয় তাড়াতাড়ি দুম্বার পিট চাপড়ে দুই হাতে তার ঘাড় বেঁকিয়ে ধরে হুকুম দিলে—“শিং টিং চট্‌, দে ঢুঁসিয়ে চটপট।” দুম্বা আর ভাবতে সময় পেলে না, অন্ধকারে সামনে আর ডাইনে-বাঁয়ে তিন ঢুঁ বসিয়ে দিলে। খটাশ-খটাশ করে তিনটে হাঁড়িমুখো হাড়খেগো হেঁড়েলের মাথার খুলি ফেটে চৌচির হয়ে গেল! ঠিক সেই সময় বাইরে দুদ্দাড় করে ঝড়বৃষ্টি নামল—

শিল পড়ে তড়বড় ঝড় বহে ঝড়ঝড়
হড়মড় কড়মড় বাজে—ঘন-ঘন ঘন-ঘন গাজে!
ঝঞ্ঝনার ঝঞ্ঝণী বিদ্যুৎ চকচকি
হড়মড়ি মেঘের ভেকের মকমকি
ঝড়ঝড়ি ঝড়ের জল ঝরঝরি
তড়তড়ি শিলার জলের তরতরি
ঘুটঘুট আঁধার বজ্রের কড়মড়ি
সাঁই-সাঁই বাতাস শীতের থরথরী।

ভেড়াগুলো কুরবী-কুরবী বলতে-বলতে এ ওর মুখের দিকে ফ্যেলফ্যেল করে চেয়ে আছে, এমন সময় ঝড়ে একখানা পাথর খসে গুহার মুখটা একেবারে দরাজ হয়ে কত বড় যে হয়ে গেল তার ঠিক নেই! ঝড় থামলে সেই খোলা পথে সকালের আলো এসে গুহার মধ্যে সবাইকে জাগিয়ে দিলে। চকা সেই আলোতে ডানা মেলে রিদয় আর খোঁড়া আর কাটচাল আর নানকৌড়িকে নিয়ে হাড়গিলের চরে যেখানে আণ্ডামানি লালসেরা হাঁসদের বড় দলটা নিয়ে অপেক্ষা করছে, সেই দিকে চলল।

ভেড়ার দল হঠাৎ কতকালের অন্ধকার গুহার মধ্যে দিনের আলো পেয়ে প্রথমটা অনেকক্ষণ ধরে হতভম্বের মতো আকাশের দিকে চেয়ে রইল, তারপর আস্তে-আস্তে পাহাড়ের উপর বুনো ভেড়ার দলে মিশে দিব্বি চরে বেড়াতে লাগল। রাতের কথা, রিদয়ের কথা, হাঁসদের কথা কোনো কথাই তাদের মনে রইল না। তারা যেন চিরকালই বুনো ভেড়া এইভাবে সহজে খোলা আকাশের নিচে পাহাড়ের চাতালে-চাতালে ঘাস খেয়ে পাতা-লতা খেয়ে মনের সুখে দিন কাটাতে লাগল! ভেড়াদের মধ্যে দুম্বাই কেবল মনে রাখতে পারলে রিদয় কেমন করে, তাদের নরককুণ্ডের মুখের কাছ থেকে পাহাড়ের উপরকার এই খোলা জায়গায় পৌছে দিয়ে গেছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে চরে বেড়াতে কোনো বাধা নেই! দলের ভেড়ারা সন্ধ্যেবেলায় অভ্যেস মতো যখন তাদের পুরোনো ঘর গুহাটার দিকে চলল তখন দুম্বা তাদের এক-এক ঢুঁ মেরে বনের দিকে ফিরিয়ে দিলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *