২০. থেমেই তো গিয়েছিল সব

থেমেই তো গিয়েছিল সব। দশ-এগারো বছর ছবি আঁকিনি। আরব্য উপন্যাসের ছবির সেট আঁকা হলে ছেলেদের বললুম, ‘এই ধরে দিয়ে গেলুম। আমার জীবনের সব কিছু অভিজ্ঞতা এতেই পাবে।’ ব্যস্‌, তার পর থেকেই ছবি আঁকা বন্ধ। কি জানি, কেন মন বসত না ছবি আঁকতে। নতুন নতুন যাত্রার পালা লিখতুম; ছেলেদের নিয়ে যাত্রা করতুম, তাদের সাজাতুম, নিজে অধিকারী সাজতুম, ফুটাে ঢোল বাজাতুম, স্টেজ সাজাতুম। বেশ দিন যায়।

রবিকা বললেন, “অবন, তোমার হল কি? ছবি আঁকা ছাড়লে কেন?

বললুম, “কি জানো রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করি তাই এঁকে ফেলতে পারি। সেজন্যই চিত্রকর্মে আর মন বসে না। নতুন খেলার জন্যে মন ব্যস্ত।’

এবার আবার এতকাল বাদে ছবি আঁকতে বসলুম। এ যেন নতুন সঙ্গী জুটিয়ে আর একবার পিছিয়ে গিয়ে পুরোনো রাস্তা মাড়ানোর মজা পাওয়া।

সবারই একটি করে জন্মতারা থাকে, আমারও আছে। সেই আমার জন্মতারার রশ্মি পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে ছায়াপথ বেয়ে নেমে এসে পড়েছে অগাধ জলে। সেই দিন থেকে তার চলা শুরু হয়েছে।

তার পর একদিন চলতে চলতে, ঝিক ঝিক করতে করতে যখন এসে ঘাটে পৌঁছল, পৃথিবীর মাটিতে ম্লান আলো ঠেকল, সেখানে কি হল? না, সেখানে সেই আলো একটি নাম-রূপ পেলে, সেই আমি।

জন্মতারার আলো জীবননদী বেয়ে এসে তীরে ঠেকল। ওই ঘাটের ধারে দাড়িয়ে অবনীন্দ্রনাথ দেখলে—‘কোত্থেকে এলুম, এবারে কোথায় চলতে হবে।’

ঘাটে এসে ঠেকলুম, এবার চলা শুরু করতে হবে। মালবাহী গাধার মত, উদরের বোঝা পৃষ্ঠের বোঝা সব বোঝা নিয়ে জীবনের মুটে তখন চলেছে পথে, অতি ভীত ভাবে—কিছু দেখলেই ভয়ে পিছু হটে, তাকেও যে দেখে ভয়ে ছুটে পালায়। ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল নানা জিনিস সংগ্রহ করতে হাটে, খানিকটা খেলার মত। অনেকদিন ধরে খেলার আয়োজন চলল। যেন সে একটি হারুয়া ছেলের মন, সে বাসায় ঢুকতে চাচ্ছে, গাছে চড়তে চাচ্ছে, ঠিক করতে পারছে না, চাঁদের মত উঁকিঝুঁকি মারছে গাছের আড়াল থেকে। ঘরের বুড়ি দাসী কোলে করে গায়—

ওই এক চাঁদ, এই এক চাঁদ
চাঁদে চাঁদে মেশামেশি।

এবারে খোঁজাখুজির পালা। কি নিয়ে খেলব? সঙ্গে আছে কে? ঘরের মানুষ বুড়ি দাসী। তার থেকেও জীবন রস টানছে। বাইরে থেকেও টানছে, ঘর থেকেও টানছে। যেমন ঘরের দাসী তেমনি পোষা পশুপাখি এরাও।

আস্তে আস্তে এল আশেপাশের সঙ্গে যোগাযোগ। বুনো ছাগল, খেলতে চাই তার সঙ্গে, সে চোখ রাঙিয়ে শিঙ বাগিয়ে তেড়ে আসে, অথচ মনকে টানে।

ফুলের ডাল দেখে মন চায় চড়ুইপাখি হয়ে তাতে ঝুলতে।

হাঁস উড়ে আসছে, এবারে মন আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়। যেন মেঘদূতের যক্ষের মত পড়ে আছে একজন; সুদূরের আকাশ হতে সংবাদ নিয়ে এসে সামনে দিয়ে উড়ে গেল হাঁস।

এইকালে কল্পনা এল। গোল চাঁদ বেরিয়ে আসছে বনের ভিতর থেকে। মেঘ তাকে ঢেকে দিচ্ছে বারে বারে। ঘন বনে অদ্ভুত এক পাথি ডাকতে ডাকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তার পর কত রকম সংগ্রহ, নানা ঘাটে ভিড়তে ভিড়তে চলেছে। কোথাও ফুল, কোথাও ছেলেমেয়ে কোথাও গাছ, কত কি! ঘাটে ঘাটে ঠেকেছে আর সংগ্রহ করেছে। বড় শৌখিন কাল সেটা। সে হচ্ছে রোমান্সের যুগ। স্ফূর্তি ক’রে, খেলায় মেতে, সময় কাটিয়ে শখের জিনিস সব সংগ্রহ করলে।

তার পর সংসার যেমনি চোখ রাঙালে, মহাকালের রক্তচক্ষু বললে, ‘কোথায় চলেছিস আনন্দে বয়ে? থাম্ এবারে।’ সেই মহাকালের ধমক খেয়ে মন চমকে উঠল। তখন আর খেলা-খেলনাতে মন বসে না। পুরোনো খেলনার বোঝা পিঠে বয়ে আর-এক ঘাটে চলল। ধমক খেয়ে এখন কোথায় যায়, কি করে, কি খেলে, এই ভাবনা।

জীবনতরু জল না পেলে বাঁচে না। পাথরের থেকেও রস নিতে চায়, যে পাষণের মঞ্চে সে বাঁধা থাকে তা থেকে।

তখন কে এল? তখন প্রভু এলেন তাকে বাঁচাবার জন্যে। বললেন, ‘সেই দিকে শিকড় পাঠা যেখান থেকে সে চিরদিন রস পাবে, বনবাসের আনন্দ পাবে।’

জোড়াগাছের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্য গাছটিতে পড়েছে অস্তরবির আলে, তাপ দিয়ে বাঁচাতে চাচ্ছে। সবুজ মরে গিয়ে গৈরিক রঙের শোভা প্রকাশ পেল। সেখানে শুরু হল বনের ইতিহাস। অন্ধকার রাত্রে আর-এক সুর বাজল মনে। বনদেবীদের দেওয়া সেই স্বর।

সোনার স্বপ্ন যেন আর-একবার ধরা দেবে দেবে করলে, যেখানে সোনার হরিণ থাকে।

অলকার রঙছুট ময়ূরী এল। সে-জগতে সে রঙের অপেক্ষ রাখে না। সেই যে কুঞ্জে নূপুর বাজে সেখানে রঙছুট ময়ূরী খেলা করে। বিরহের গভীর সুর বাজে। মনময়ূরী একলা।

শক্ত পাথরে মন-পাখি বাধছে বাসা।

রঙছুট ছবি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল সবুজ রঙ। সেখানে ভোরের পাখি শীতের সকালে গান গেয়ে বলে, ‘বেরিয়ে আয় না আমার কাছে, রঙিন জগতে।’

স্মৃতি জাগায় বহুকাল আগের। মন চায় বাড়ি ফিরতে, বোঝা বাঁধাছাঁদা করে। স্বপ্নে দেখে বহুকাল আগের ছেড়ে-আসা বাড়ি ঘর ঘাট মাঠ গাছ।

তার পর সব শেষে প্রকৃতিমাতা দেখা দেন নিশাপরীর মত। নীল ডানায় ঢাকা আকাশ, ঘরের সন্ধ্যাপ্রদীপ ধরে একটুখানি আলো।

এই হল শিল্পীর জীবনের ধারার একটু ইতিহাস। শুধুই উজানভাটির খেলা। উজানের সময় সব কিছু সংগ্রহ করে চলতে চলতে ভাঁটার সময়ে ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়া। বসন্তে যখন জোয়ার আসে ফুল ফুটিয়ে ভরে দেয় দিকবিদিক, আবার ভাঁটার সময়ে তা ঝরিয়ে দিয়ে যায়। আমারও যাবার সময়ে যা দুধারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলুম তোমরা তা থেকে দেখতে পাবে, জানতে পাবে, কত ঘাটে ঠেকেছি, কত পথে চলেছি, কি সংগ্রহ করেছি ও সংগ্রহের শেষে নিজে কি বকশিশ পেয়ে গেছি।

এতকাল চলার পরে বকশিশ পেলুম আমি তিন রঙের তিন ফোটা মধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *