০৩. এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ

এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে নামকাটা সেপায়ের কি বিপদ হল শোনো। স্কুলে যাওয়ার থেকে তো নিস্তার পেলুম, ভাবলুম বেশ হল, এবার বড়দের মতোই বুঝি আমি স্বাধীন হয়ে গেলুম। যা ইচ্ছে তাই করতে পারব, স্নানের জন্য, ভাত খাবার জন্য চাকররা আর তাড়া দেবে না। নিয়মমতো চলবারও দরকার হবে না। লম্বা পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পেলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি আনন্দে দিন কাটবে বুঝি। কবে স্কুল খুলবে সে ভয়ও নেই। এই সব ফুর্তিতেই মাতলুম।

কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই দেখি, ওমা, তা তো নয়। যদু ঘোষাল মাস্টার বাড়িতেই থাকেন; ঠিক সময়ে পড়তে বসতে হয় তাঁর কাছে। দশটা বাজলেই চাকররা তাড়া লাগায়। স্নান করে খেয়ে নিতে হয় চটপট। খেয়েদেয়ে ঘুর্‌ ঘুর্‌ করি। স্কুল ছুটি তো শুধু আমারই হয়েছে। দাদা, ইন্দুদা ওঁরা সবাই চলে যান ইস্কুলে। ভেবেছিলেম, বেশ খেলাধুলো হুটোপাটি করে সময় কাটবে রোজ। তা আর হয় না। খেলব কার সঙ্গে? খেলার সাথীরা সবাই স্কুল করে, আমি একলা ঘরে কি করি ভেবে পাইনে। চাকররা থাকে তাদের কাজে ব্যস্ত। রামলাল ধমক দেয়, ‘কোথাও যেয়ো না, চুপটি করে বসে থাকো। এদিকে ওদিকে গেছ কি মুশকিল হবে বলে দিচ্ছি। গলির মোড়ে ওই ওইখানে কন্ধকাটা আছে,ধরে নেবে।’ বলে গলির মোড়ে একটা বাসাবাড়ির নিচে ড্রেনের খিলেন ছিল, সেইটে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আগে অন্দরে যেতে পারতুম যখন-তখন। আজকাল সেই যে চাকররা সকালবেলা আমায় বের করে আনে অন্দর থেকে, সারাদিনে আর ভিভরে ঢুকবার হুকুম নেই, তবু দু-এক ফাঁকে ঢুকে পড়ি অন্দরে। মা ব্যস্ত ছোটভাইকে নিয়ে। সুনয়নী বিনয়নী ছোটবোন—তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে খেলনা একটা ভেঙে গেল কি তারা কাঁদতে শুরু করে দিলে, ‘অ্যাঁ, অবনদাদা আমাদের পুতুল ভেঙে দিলে।’ অমনি তাড়া লাগায় আমায় সকলে, ‘তুই এখানে কেন? যা বাইরে যা। সেখানে গিয়ে খেলা কর্‌।’ তাড়া খেয়ে বাইরে চলে আসি। বাইরে এসে ভাবের লোক আর পাইনে কাউকে। সবাই দেখি তাড়া লাগায়, ধমক দেয়।

বাবামশায়ের ছিল পোষা একটি কাকাতুয়া গোলাপী রঙের। বারান্দার দেয়ালে-টাঙানো হরিণের শিঙের উপর বসে থাকে, কি সুন্দর লাগে দেখতে। সকালবেলা মা পান সাজেন; মার কাছে গিয়ে পানের বোঁটা খায়। ছোটপিসিমার কাছে ছোলা খায়; আবার এসে শিঙের উপর উঠে বসে। ভাবলুম এবার মানুষ ছেড়ে পশুপাখির সঙ্গেই ভাব করা যাক। এই ভেবে কাকাতুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুঁটি তুলে গায়ের পালক ফুলিয়ে সে এল তেড়ে আমায় ঠোকরাতে। ভাব করা থাকুক পড়ে, ছুটে পালিয়ে বাঁচি সেখান থেকে। তার ডানার তলায় তলায় বাবামশায় নিজের হাতে পাউডার মাখান। পাউডার মেখে সে মেমসাহেব হয়ে ঝুঁটি বাগিয়ে বসে থাকে। গুমোর কি তার। সে করবে আবার আমার সঙ্গে ভাব। ভয়ে আর সেদিক দিয়েই যাইনে।

বাবামশায়ের আদরের কুকুর কামিনী। কি তার আদরযত্নের ঘটা। কামিনীর জন্য আলাদা চাকর মেথর। তাকে যখন সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে, গায়ে পাউডার মাখিয়ে, পরিপাটি করে আঁচড়ে সিঁথি কেটে, সাজিয়েগুজিয়ে ছেড়ে দেয়, আর কামিনী ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়, যেন বাড়ির খেঁদি মেয়েটি। বাড়ির ছেলে আমাদেরও অত আদরযত্ন হয় না যত হয় কামিনীর। সেই কামিনীর কাছে যাই। সে আমায় তোয়াক্কাই করে না। লেজ নেড়ে চলে যায় বাবামশায়ের ঘরের দিকে।

ছোট্ট ছোট্ট এক জোড়া পোষা বাঁদরও আছে বাবামশায়ের। কত তাদের আদরই বা। গ্রেট ঈস্টার্‌ন্‌ হোটেল থেকে বাঁদরের জন্য স্পেশাল লাল টুকটুকে চেরি আসে চিনিমাখানো। বাবামশায় একটি একটি করে ওই চেরি খাওয়ান তাদের। দেখে হিংসেয় জ্বলে মরি। ভাবি ওই চেরিগুলো নিজেরা যদি খেতে পাই, আঃ। তাঁর শখের হরিণও আছে একটি, নাম গোলাপী। গোলাপীর কাছে গেলে মালী আসে হৈ-হৈ করে।

দেখো এমন আমার কপাল! পশুপাখির কাছেও পাত্তা পাইনে। ওই একটু যা আদর পাই ছোটপিসিমার কাছে। মাঝে মাঝে তাঁর ঘরে আমায় ডেকে নেন। সেখানে কথকতা হয় রোজ। মাইনে-করা মহিম কথক আছেন। বসে শুনি খানিক। কিন্তু তাও আর কতক্ষণই বা! মহামুশকিল, একলা একলা সময় আর কাটে না। মনের দুঃখে ভাবি, এর চেয়ে বেশ ছিলুম স্কুলেই। গাড়িতে ওঠবার আগেই যত কান্নাকাটি, উঠেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। গাড়ি চলত গলির মোড় ঘুরে। সেই শিবমন্দির, কাঁসরঘণ্টা, লোকজন, দোকানপাট, রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে বেশ যেতম। তবুও তো বাইরের জগৎ দেখতে পেতুম কিছুটা; এখন কোন বন্ধখানায় পড়লুম! ফটক পেরিয়ে ওদিকে যাবারই আর উপায় নেই। খোলা ফটক আগলে বসে আছে মনোহর সিং দারোয়ান দেউড়িতে। মনে পড়ে স্কুলের সামনে প্রতাপের লজেঞ্জুসের দোকান। চেয়ে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হলদে লাল সবুজ লজেঞ্জুস খেতুম। চাইলেই দুটি-একটি হাতে গুঁজে দিত প্রতাপ।

আর মনে পড়ে সমবয়সীদের কথা । তাদের নিয়ে হুটোপাটি করেও মন্দ ছিলুম না। আমারই মতো ডানপিটে ছেলেও ছিল একটি-দুটি। একটির কথা বলি, স্কুলে যেতে তারও ছিল বেজায় আপত্তি। স্কুলে যাবার সময় হলেই সে পালিয়ে বেড়ায়। একদিন স্কুলে যাবার সময় হয়েছে; সে এদিকে করেছে কি, বাড়ির পাশেই এক শিবমন্দির, তার ভিতরে ঢুকে কাপড়জামা খুলে অন্ধকার ঘরে কালো পাথরের শিবকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ছেলেটির রঙও কালো, শিবের কালোয় তার কালোয় মিশে গেল। চাকরবাকররা আর খুঁজে তাকে পায় না। মহা হৈ-চৈ। শেষে কে একজন শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করলে। সেই সব সঙ্গীর কথা মনে পড়ে, আর মন খারাপ হয়ে যায়।

নর্ম্যাল স্কুলের বাড়িটিও ছিল কেমন রহস্যময়। প্রকাণ্ড রাজবাড়ি; তাতে কত অলিগলি, অন্দিসন্দি, এখানে ঘর, ওখানে খিলেনদেওয়া বারান্দা, মোটা মোটা থাম; তারি গায়ে দিনের আলো পড়ে চক্চক্‌ করত। ঘুরে ঘুরে দেখতুম এই সব। কোথায় গেল আমার সেই নর্ম্যাল স্কুল! বহুকাল পর এই সেদিন কোন্‌ এক সিনেমাতে দেখলুম সেই বাড়ির ছবি। দেখে ভারি মজা লাগল। যাক সে কথা। এখন আমার একলা থাকার গল্পটাই বলি।

সকালবেলাটা লেখাপড়ায় যদিই বা কোনোমতে কেটে যায়, দুপুর আর কাটে না। দাদারা চলে যান স্কুলে, বাবামশায় যান কাছারিতে। ফার্সি পড়াবার মুনশী আসেন; দু-চারটে আ লে বে পড়িয়ে চলে যান। এই মুনশীই দাঁড়িয়ে দেয়ালে নিজের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতেন। একদিন লড়াই করতে গিয়ে রোখের মাথায় ছায়াতে যেমন ঢুঁ-মারা অমনি মুনশীর কপাল ফেটে রক্তপাত। চাকররাও তাদের তোষাখানায় গল্পগুজব করে। বৈঠকখানা শোনশান, একলা আমি সেখানে পড়ে থাকি। থেকে থেকে দাদাদের ডেক্‌সোর ঢাকা তুলে দেখি ভিতরে কি আছে। নেড়েচেড়ে দেখে আবার তেমনি সব ঠিকঠাক রেখে দিই। প্রাণে ভয়, যদি জানতে পারেন হয়তো বকুনি দেবেন। বাবামশায়ের টেবিলটা দেখি। কতরকম রঙ তার উপরে সাজানো। একটা ক্রিস্ট্যালের কলমদানি ছিল, ঠিক যেন সমুদ্রের ঝিনুক একটি। সেইরকম নকশায় গোলবাগানে ফোয়ারা তৈরি করিয়েছিলেন বাবামশায়। এখনও তা আছে। সেদিন যখন গেলুম জোড়াসাঁকোয়, দেখি বাগানের সব কিছু ভেঙে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, একটি গাছও বাকি রাখেনি; কিন্তু ফোয়ারাটি তেমনি আছে সেখানে, ফটিক জলে ভরতি। টেবিলে সেই কলমদানিতে কলম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেটাতে একবার হাত বুলোই, আবার এসে শুয়ে থাকি। তাও কোথায় শুয়ে থাকতুম জানো? বিলিয়ার্ড টেবিলের নিচে। মাকড়সার জাল, ধুলো বালি, কত কি সেখানে। শুয়ে শুয়ে দেখি মাথার উপরে ঝুলছে সেসব। শোবার জায়গা আমার ওই রকমেরই। ছেঁড়া মাদুরের উপরে, কৌচ-টেবিলের তলায় তলায়, ঢুকে শুয়ে থাকি। ঠিক যেন একটা জানোয়ার। বুদ্ধিও কতকটা আমার তেমনি। তবে একলা থাকার গুণ আছে একটা। দেখতে শুনতে শেখা যায়। ওই অমনি করে একলা থাকতে থাকতেই চোখ আমার দেখতে শিখল, কান শব্দ ধরতে লাগল। তখন থেকেই কত কি বস্তু, কত কি শব্দ যেন মন-হরিণের কাছে এসে পৌঁছতে লেগেছে। মানুষ, পশুপাখি সঙ্গী পেলেম না কাউকেই। ওই অত বড় বাড়িটাই তখন আমার সঙ্গী হয়ে উঠল; নতুন রূপ নিয়ে আমার কাছে দেখা দিতে লাগল। এখানে ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তখন বাড়িটার সঙ্গে আমার পরিচয় হচ্ছে। জোড়াসাঁকোর বাড়িকে যে কত ভালো বেসেছি। বলি যে, ও বাড়ির ইটকাঠগুলিও আমার সঙ্গে কথা কয়, এত চেনাপরিচয় তাদের সঙ্গে; তা ওই তখন থেকেই তার শুরু। পড়ে আছি; দেখছি, ঘরের কোণায় কোথায় কার্নিশের ছায়া পড়েছে, কোথায় টিকটিকিটা পোকা ধরবার জন্য ওত পেতে আছে, চড়ুইপাখি ছোট কুলুঙ্গিতে বাসা বাঁধছে। আবার কোথায় কোন্‌ উঁচুতে ছাদের উপরে লোহার শিকে এক চিল বসে আছে তাকে দেখছি তো দেখছিই। একসময়ে সে চিঃ-ঃ-ঃ করে দুটো চক্কর খেয়ে উড়ে গেল। আবার কখনো বা চেয়ে থাকতুম সামনে সাদা দেওয়ালের দিকে, ওপাশের উত্তরের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দিনের আলো এসে পড়েছে তাতে; বাইরে মানুষ হেঁটে যায়, ছায়াটিও চলে যায় ঘরের ভিতরে দেয়ালের গা দিয়ে। রঙিন এক-একখানি ছবির মতো তারা আলোর রাস্তা ধরে চলতে চলতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এই ছবি-দেখা রোগ আমার এখনো আছে, দিনে দুপুরে ঘরের ভিতরে বসে বসে ছবি দেখি। কাল দুপুরে কৌচে বসে ঝিমোচ্ছি। বাইরের তালগাছের ছায়া এসে পড়েছে দেয়ালে, পাতাগুলি নড়ছে হাওয়াতে, পিছনের আকাশে সাদা মেঘ—ঠিক যেন চাঁদের আলোর ছবি একটি। তখনও সব দেখতুম, একমনে দেখতুম। এই দেখতে যখন আরম্ভ করলুম তখন আর একলা থাকতে খারাপ লাগত না।

এদিকে আবার নানারকম শব্দও আসে কানে, দুপুর হতেই গলির মোড়ে শব্দ হল ঠং ঠং, ‘বাসন চাই ​​‌‍বাসন।’ শব্দ চলে গেল দূরে। তার পরে এল ‘চুড়ি চাই, খেলনা চাই।’ প্রায়ই মায়েদের মহলে তাদের ডাক পড়ে, ঝুড়ি ঝুড়ি নান৷ রঙের কাচের চুড়ি সাজিয়ে বসে এসে। একরকমের মজার খেলনা থাকে তাদের ঝুড়িতে; টিনের এতটুকু এতটুকু মাছ আর চুম্বকের কাঠি। মাছটি জলে ভাসিয়ে চুম্বকের কাঠি দিয়ে টানলেই মাছও সঙ্গে সঙ্গে জলের উপর চলতে থাকে, এমন লোভ হয় ওই খেলনার জন্য। বাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়েরা প্রায়ই পায় সেই খেলনা, আমি পাই ক্বচিং কখনো। আমাকে কেউ যে খেয়ালই করে না তেমন। তারপর বেলা পড়ে এলে গরমের দিনে বরফওয়ালা হেঁকে যায়, “বরিফ, বরিফ চাই, বরিফ–কুলপি বরিফ। জ্যোতিকাকা মশায় লিখেছিলেন একটা গান

‘বরিফ বরিফ’ ব’লে
বরফওয়ালা যান।
গা ঢালো রে, নিশি আগুয়ান।
‘বেল ফুল বেল ফুল’
ঘন হাঁকে মালীকুল—

সন্ধ্যাবেলার শব্দ হচ্ছে ওই বেলফুল। ‘বেলফুল চাই বেলফুল’ হাঁকতে হাঁকতে শব্দ গলির এদিক থেকে ওদিক চলে যায়। তাদের ডেকে বেলফুল কেনে দাসীরা, মালা গাঁথেন মেয়েরা।

ভরসন্ধ্যেবেলা মুশকিল আসান আসে খিড়কির দরজায় চেরাগ হাতে, লম্বা দাড়ি; পিদিম জ্বলছে মিটমিট করে। বারান্দ থেকে দেখি তার চেহারা। দোরগোড়ায় এসেই হাঁক দেয়, ‘মুশকিল আসান, মুশকিল আসান।’ দপ্তরে বরাদ থাকে, মুশকিল আসান এলেই তাকে চাল পয়সা যা হয় দিয়ে দেয়; সে আবার হাঁক দিতে দিতে চলে যায়।

আরও একটি শব্দ, সেটি এখনও থেকে থেকে কানে বাজে। দুপুরে সব যখন শোনশান, কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও, তখন শব্দ কানে আসে ‘কূ-য়ো-র ঘটি তোলা’। মনে হয় ঠিক যেন অদ্ভুত কোন্‌ একটি পাখি ডেকে চলেছে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে দেখি ঘনকালো তেঁতুলগাছের মাথা। দাসীরা বলে, বংশের সকলের নাড়ী পোঁতা আছে তার তলায়, মাঝে মাঝে ছাতের উপরে ভোঁদড় চলে বেড়ায়, সেই চলার শব্দে গল্প তৈরি হয় মনের ভিতরে; ব্রহ্মদত্যি হাঁটছে, জটেবুড়ি কাসছে। জটেবুড়ি সত্যিই ছিল, লাঠি ঠক ঠক করে আসত; ময়ূরে তার চোখ উপড়ে নিয়েছিল। ‘ক্ষীরের পুতুল’এ যে ষষ্ঠী বুড়ি এঁকেছি ঠিক সেই রকম ছিল সে দেখতে।

ওদিকে নিচে রাত দশটার পর নন্দ ফরাসের ঘরে নোটো খোঁড়ার বেহালা শুরু হয়। একটাই সুর অনেক রাত্তির অবধি চলে একটানা। বেহালা যেন সুরে এক দুই মুখস্থ করছে; এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। ওই থেকে পরে আমি একটা যাত্রার সুর দিয়েছিলুম। বাবামশায়ের বৈঠক ভাঙলে নন্দ ফরাসের ঘরে বৈঠক বসে—ছিরু মেথর, নোটো খোঁড়া, আরও অনেকের। ভোরবেলা বাড়ির সামনে ঘোড়া মলে টপ টপ ধপধপ। কাকপক্ষী ডাকার আগে এই শব্দ শুনেই ঘুম ভাঙে আমার। রোজ ঘুমোবার আগে আর ঘুম ভেঙে এই দুটি শব্দ শুনি—বেহালার এক, দুই, তিন, চার; আর ঘোড়ামলার টপ টপ ধপ ধপ।

তখন এক-একটা সময়ের এক-একটা শব্দ ছিল। এখন সেই শব্দ আর নেই। সব মিলিয়ে যেন কোলাহল চারদিকে। ট্যাক্‌সির ভোঁ-ভোঁ, দোকানদারের চিংকার, রাস্তার হট্টগোল, এসবে ঘরের কোণায়ও কান পাতা দায়। তার উপরে জুটেছে আজকাল মাথার উপরে উড়োজাহাজের ঘড়ঘড়ানি, রেডিওর ভনভনানি, আরও কত কি। তেতালার ছাদে জ্যোতিকাকামশায়ের পিয়ানোর সুর, রবিকার গান, জ্যাঠামশায়ের হাসির ধমক, কোথায় চলে গেল সে সব!

তা সেই সময়ে দুপুরে বৈঠকখানাতেই একদিন আমি আবিষ্কার করলুম ‘লণ্ডন নিউজে’র ছবি। বাঁধানো ‘লণ্ডন নিউজ’ পড়েছিল এক কোণায়। সব-কিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে গিয়ে বইয়ের ভিতরে ছবির সন্ধান পেলুম। সে কতরকম কাণ্ডকারখানার ছবি, নিবিষ্ট মনে বসে বসে দেখি। একদিন ঘোষাল মাস্টার এসে ঢুকলেন সেই ঘরে। দিব্যি ভুঁড়িদার চেহারা তার; খালি গায়ে যখন আসেন, তেলচুকচুকে ভুঁড়িটি ঠিক যেন পিতলাই হাড়া একটি। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘দেখি কি দেখছ’—বলে আমার হাত থেকে বইগুলি নিয়ে পাতা উলটে উলটে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে একটা পাতায় আছে ফরাসী রানীর ছবি, তিনি সেই ছবিটি সামনে রেখে হাতজোড় করে তিনবার মাথায় ঠেকালেন। তারপর থেকে দেখি রোজই তিনি স্নানের পর ফরাসী রানীর ছবি বের করে তিনবার পেন্নাম করেন। কারণ আর বুঝিনে কিছু। দেবদেবীর ছবি এ নয়, তবে কেন এত পেন্নামের ঘটা। শেষে বড়দাকে একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘এর মানে কি বলে না।’ বড়দা হেসে বললেন, ‘ওহো তা বুঝি জানিসনে? ঘোষাল মশায়কে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, তিনি বললেন, এই ফরাসী রানী তাঁর স্ত্রীর মতো দেখতে। তাই রোজ তিনি ওই ছবিকে পেন্নাম করেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *