১৩. বিরজিতলায় মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়িতে

বিরজিতলায় মেজোজ্যাঠামশায়ের বাড়িতে ‘মায়ার খেলা’ অভিনয় হয়। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র পরে এই ‘মায়ার খেলা’, যা দেখে মন নাড়া দিয়েছিল।

‘রাজা’ অভিনয় প্রথম বোধ হয় এই বাড়ির উঠোনেই হয়। আমরা তাতে কী সেজেছিলুম মনে পড়ছে না। স্টেজ ডেকোরেশন আমরাই করেছি।

একবার ‘শারদোৎসবে’ প্রম্প্‌টারকে স্টেজে নামিয়েছিলুম, তা জানো না বুঝি? এক অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। রবিকাকা আমরা সবাই আছি। দেখি থেকে থেকে আমরা পার্ট্‌ ভুলে যাচ্ছি। ভয় হয় রবিকাকা কখন ধমকে টমকে বসবেন। রবিকাকাও দেখি মাঝে মাঝে আটকে যান। পার্ট আর মুখস্থ হয় না।

রবিকাকাকে বললুম, বয়স হয়ে গেছে পার্ট্‌ মনে রাখতে পারি নে, প্রম্প্‌টার পাশ থেকে কী বলে শুনতেও পাই নে সব সময়। শেষে স্টেজে নেমে বিপদে পড়ব, প্রম্প্‌টারকে স্টেজে নামানো যায় না?

রবিকাকা বললেন, সে কী কথা! আমি বললুম, দেখোই-না, বেশ মজাই হবে।

প্রম্প্‌টারদের বললুম, মশায়, স্টেজে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হবে। তারাও বললে, সে কী মশায়! আমি বললুম, আমি সব ঠিক করে সাজিয়ে গুজিয়ে দেব, ঠিক মানিয়ে যাবে। ভয় নেই কিছু। নয়তো শেষে পার্ট্‌ ভুলে রবিকাকার তাড়া খেয়ে এই বয়সে একটা সিন করি আর কী। তা হবে না, তোমাদেরও নামতে হবে।

দুইজন প্রম্প্‌টার নামবে। তাদের করলুম কী, বেশ নীলচিটে কালচিটে পাতলা কাপড়ের বোরখার মতো গেলাপ পরিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দিলুম ঢেকে। চোখের আর মুখের জায়গাটা একটু ফাঁক রাখলুম অবিশ্যি। হাতে দিলুম বড়ো একটা বাঁশের ডাণ্ডা। সোনালি রুপোলি কাগজ দিয়ে চক্কোর মতো লাগিয়ে দিলুম সেই ডাণ্ডাতে। যেমন মিউজিক স্ট্যাণ্ড হয় সেইরকম—যেন জীবন্ত মিউজিক স্ট্যাণ্ড বাইরে থেকে দেখতে হল। ভিতর দিকে রইল বইয়ের পাতা সুতো দিয়ে আটকানো।

এখন, এই ডাণ্ডা হাতে নিয়ে দুইজন প্রম্প্‌টার দু-পাশ থেকে স্টেজের অ্যাক্‌টারদের পিছনে ঘুরে ঘুরে প্রম্প্‌ট করে দিতে লাগল। আমাদের বড়ো সুবিধা হয়ে গেল, আর ভুল নেই, অভিনয় চলল।

বেশ হয়েছিল তাদের দেখতে, অনেকটা ব্যাকগ্রাউণ্ডের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, অল্প অল্প দেখাও যাচ্ছে পাতলা কাপড়ের ভিতর দিয়ে, কালো দৈত্যদানবের মতো পিছনে ঘোরাঘুরি করছে আর স্টেজও বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কী একটা অভিনয় ছিল ঠিক মনে পড়ছে না। রথী বা নন্দলালকে জিজ্ঞেস কোরো, বলে দিতে পারবে।

 এখন, অভিনয় তো হল, আমাদের আর কোনো অসুবিধা নেই, থেকে থেকে কখনো আমরা প্রম্প্‌টারের কাছে যাচ্ছি, তারাও থেকে থেকে আমাদের পিছনে এসে পার্ট্‌ বলে দিয়ে যাচ্ছে। রবিকাকাও দেখি মাঝে মাঝে ঘাড় কাত করে মাথা হেলিয়ে শুনে নিচ্ছেন আর অভিনয় করছেন। অভিনয়ের পরে জানাশোনার মধ্যে যাঁরা অভিনয় দেখেছিলেন তাঁদের জিজ্ঞেস করলুম, কেমন লাগল।

 তারা বললে, অতি চমৎকার, আর ও-দুটাে কালো কালো দৈত্যদানবের মতো পিছনে পিছনে ঘুরছিল, ও কী মশায়।

 আমি বললুম, প্রম্প্‌টার। কিছু শুনতে পেয়েছিলেন কি।

 তাঁরা বললেন, কিছু না কিছু না, অতি রহস্যজনক ব্যাপার দুটো মূর্তি, আমরা আরো ভাবছিলাম পিছনে দৈত্য দানব আর সামনে আপনারা ইত্যাদি ইত্যাদি।

 তাঁরা অনেক অনেক কিছু ভেবে নিয়েছিলেন। বেড়ে হয়েছিল সেবারে ঐ প্রম্প্‌টারদের ব্যাপার। প্রম্প্‌টাররা বললে, বেড়ে তো হল আপনাদের, আর আমরা থলের ভিতর ঘেমে ঘেমে সারা।

 ‘ফাল্গুনী’ জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই হয়, তাতে আমি, দাদারা সবাই পার্ট্‌ নিয়েছিলুম। শান্তিনিকেতনের ছোটাে ছোটাে ছেলেরাও ছিল। স্টেজ সাজিয়েছিলুম দোলাটােলা বেঁধে। বাঁকুড়া দুর্ভিক্ষের জন্য টাকা তুলতে হবে, যত কম খরচ হয় তারই চেষ্টা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে দেওয়া হল সেই বাল্মীকিপ্রতিভার নীল রঙের মখমলের বনাত, দেখতে হল যেন গাঢ় নীল রঙের রাতের আকাশ পিছনে দেখা যাচ্ছে। বটগাছ তো আগেই সাবাড় হয়ে গিয়েছিল, বাদামগাছের ডালপালা এনে কিছু কিছু এখানে-ওখানে দিয়ে স্টেজ সাজানো হল। সেই বাদামগাছও এই এবারে কাটা পড়ল। বাঁশের গায়ে দড়ি ঝুলিয়ে দোলা টানিয়ে দিলুম। উপরে একটু ডালপাতা দেখা যাচ্ছে, মনে হতে লাগল যেন উঁচু গাছের ডালের সঙ্গে দোলা টানানো হয়েছে। তখন নন্দলালদের হাতেও একটু একটু স্টেজ সাজাবার ভার ছেড়ে দিই, জায়গায় জায়গায় বাৎলে দিই কোথায় কী দিতে হবে আর শেষ টাচটা দিই আমি নিজের হাতে। ঐ শেষ টাচ ঝেড়ে দিতেই আর-এক রূপ খুলে যেত। সেই গল্পই একটা বলি শোনো। এই স্টেজ সাজানো এ কি আর দু-দিনের কথা। কবে থেকে কত এক্স্‌পেরিমেণ্ট করে তবে আজকের এই দাঁড়িয়েছে।

একবার ‘শারদোৎসবে’ তো ঐ রকম করে স্টেজ সাজানো হল, পিছনে দেওয়া হল নীল বনাতটি, তখন থেকে ঐ নীল বনাতই টানিয়ে দেওয়া হত স্টেজের ব্যাকগ্রাউণ্ডে। প্রকাণ্ড একটা শোলার ছত্র ছিল বেশ ঝিক্‌কিকে আসামের অভ্র দেওয়া। সেইটিই এক পাশে টানিয়ে দেওয়ালুম। বেশ নীল রঙের আকাশের গায়ে ছত্রের রঙটি চমৎকার দেখাতে লাগল। রবিকাকার তেমন পছন্দ হল না; বললেন, রাজছত্র কেন আবার। বেশ পরিষ্কার ঝর্‌ঝরে স্টেজ থাকবে। বলে সেটিকে খুলে দিলেন।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। একদিন ড্রেস রিহার্সেল হবে, কোন্‌ সিনে কোন্‌ লাইট হবে, কোন্‌ লাইট আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে, কোন্‌ লাইট আবার ধীরে ধীরে ফুটে উঠবে রথী আর কনক সব লিখে নিলে। সেবারে অভিনয়ে লাইটের উপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছিল। এখন, সেই ড্রেস রিহার্সেল হবে, মনটা তো আমার খারাপ হয়ে আছে, শখ করে রাজছত্র টানালুম সেটা পছন্দ হল না কারো। বসে বসে ভাবছি।

নন্দলালকে বললুম, নন্দলাল, নীল রঙের বনাতের উপরে চাঁদ দিতে হবে।

নন্দলাল বললে, তা হলে চাঁদ এঁকে দেব কাপড়ের উপরে?

আমি বললুম, না, চাঁদ আঁকবে কী। সত্যিকার চাঁদ চাই। শরৎকালের আকাশ তাতে প্রতিপদের চাদ চাই আমার।

নন্দলাল আর ভেবে পায় না।

 আমি বললুম, যাও মালীর দোকান থেকে রুপোলি কাগজ নিয়ে এসো।

নন্দলাল তখুনি দু-সিট রুপোলি কাগজ নিয়ে এল।

বললুম, কাটো, বেশ বড়ো করে একটি প্রতিপদের চাঁদ কঁচি দিয়ে কাটো, আর গুটি দুই-তিন তারা।

নন্দলাল বেশ বড়ো করে চাঁদ গুটি দুই-তিন তারা রুপোলি কাগজের সিট থেকে কেটে নিয়ে এল।

আমি বললুম, যাও বেশ ভালো করে আঠা লাগিয়ে আকাশের গায়ে সেঁটে দাও। ভালো করে দিয়ে, শেষে যে আধখানা চাঁদ ঝুলে পড়বে আকাশের গা থেকে তা যেন না হয়।

নন্দলালকে পাঠিয়ে মন সুস্থির হল না। নিজেই গেলুম দেখতে ঠিকমত লাগানো হয় কি না।

নন্দলালকে বললুম, এখন কাউকে কিছু বোলো না। আজ রাত্তিরে যখন ড্রেস রিহার্সেল হবে তখন সবাই দেখবে।

তার পর স্টেজেতে নীল পর্দার উপরে যখন লাইট পড়ল, যেন সত্যিকার আকাশটি। সবাই একেবারে মুগ্ধ।

নন্দলালকে বললুম, নন্দলাল, দেখে নাও।

কী চমৎকার দেখাচ্ছিল। শেষ টাচ, এক চাঁদ আর গুটি-দুই ঝক্‌ঝকা। সেই চাঁদ ডাকঘরেও আছে, ফোটোতে দেখতে পাবে।

সেইবার ফাল্গুনীতে আমি সেজেছিলুম শ্রুতিভূষণ। শান্তিনিকেতন থেকে ছোটো ছোটো ছেলেরাও এসেছিল বলেছি। ওখান থেকে গানটান কোনোরকম তৈরি করে আনা হত, আসল রিহার্সেল এখানেই হত আমাদের নিয়ে। খুব জমে উঠেছে রিহার্সেল। মণি গুপ্তও ছিল এখানে দলের মধ্যে। দেখি ওর কোনো পার্ট নেই।

বললুম, তুইও নেমে পড়্‌, অভিনয়ে—

কী পার্ট দেওয়া যায়।

বললুম, আমার চেলা সেজে ঢুকে পড়্‌। বলে তাকেও নামিয়ে দিলুম। সে আমার পুঁথিটুঁথি নস্যির ডিবে আসন এই-সব নিয়ে ঢুকে পড়ল। ছোট্ট ছেলেটি, গোলগাল মুখখানা, লাল চেলি পরিয়ে গলায় পৈতে ঝুলিয়ে নন্দলাল সাজিয়ে দিয়েছিল। বেশ দেখাচ্ছিল।

আমি পরেছিলুম শুঁড়তোলা চটি, গায়ে নামাবলী, যেমন পণ্ডিতদের সাজ, গরদের ধুতি, তা আবার কোমর থেকে ফস্‌ফস্‌ করে খুলে যায়। নন্দলালকে বললুম লম্বা একটা দড়ি দিয়ে কোমরে ধুতিটা ভালো করে বেঁধে দাও, দেখো যেন খুলে না যায় আবার স্টেজের মাঝখানে। কাপড়ের ভাবনাই ভাবব, না অভিনয়ের কথা ভাবব। আচ্ছা করে কোমরে লম্বা দড়ি তো জড়িয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে নিলুম। মণীন্দ্রভূষণ থেকে থেকে নস্যির ডিবেটা এগিয়ে দিত—আচ্ছা করে নস্যি নাকে দিয়ে সে যা অভিনয় করেছিলুম।

রবিকাকা সেজেছিলেন অন্ধ বাউল। পিয়ার্সনকেও সেবার সেনাপতি সাজিয়ে নামানো হয়েছিল। তখন এক মেমসাহেব শান্তিনিকেতনে কিছু কাল ছোটোদের পড়াতেন, প্যালেস্টাইন না কোথা থেকে এসেছিলেন। রবিকাকাকে বললুম, তাঁকেও নামিয়ে দাও। অভিনয়ে সাহেব আছে তার একটা মেমসাহেবও থাকবে, বেশ হবে।

রবিকাকা বললেন, ও কী করবে।

আমি বললুম, কিছু করবার দরকার কী, মাঝে মাঝে স্টেজে এসে অন্য অনেকের মতো ঘোরাফেরা করে যাবে। রবিকাকাকে বলে তাকেও নামিয়ে নিলুম। প্রতিমারা মেমসাহেবকে সাজিয়ে দিলে। আমি বললুম, বেশি কিছু বদলাতে হবে না, ওদের দেশে যেমন মাথায় রুমাল বঁধে সেই রকমই বেঁধে একটু-আধটু সাজ বদলে দিলেই হবে।

অভিনয় খুব জমে উঠেছে। আমি শ্রুতিভূষণ সেজে বাঁকা সাপের মতো লাঠি হাতে, তোমার দাদা মুকুলেরই দেওয়া সেটি, লাঠির মুখটা কেটে আবার সাপের মতো করে নিয়েছিলুম, সেই লাঠি হাতে ছেলেছোকরাদের ধমকাচ্ছি।

‘ওগো দখিন হাওয়া’ গানের সঙ্গে ছেলেরা খুব দোলনায় দুলছে। কেউ আবার উঠতে পারে না দোলনাতে, নেহাত ছোট্টো, তাকে ধরে দোল্‌নাতে বসিয়ে দিই। খুব নাচ গান দোল এই সব চলছে।

শেষ গান হল ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে’। সেই গানে নানা রঙের আলোতে সকলের একসঙ্গে হুল্লোড় নাচ। আমি ছোটো ছোটো ছেলেগুলোকে কোলে নিয়ে পুঁথিপত্র নস্যির ডিবে হাতে, নামাবলী ঘুরিয়ে নাচতে লাগলুম। মেমসাহেবও নাচছে। রবিকাকার ভয়ে সে বেচারি দেখি স্টেজের সামনে আসছে না, সবার পিছনে পিছনে থাকছে। আমি তার কাছে গিয়ে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে স্টেজের সামনে এনে তিন পাক ঘুরিয়ে দিলুম ছেড়ে, মেমসাহেবের কোমর ধরে বল্‌ নাচ নেচে। অডিয়েন্সের হো হো শব্দের মধ্যে ড্রপসিন পড়ল।

ডাকঘর অভিনয় হবে, স্টেজে দরমার বেড়ার উপর নন্দলাল খুব করে আলপনা আঁকলে। একখানা খড়ের চালাঘর বানানো হল। তক্তায় লাল রঙ, ঘরে কুলুঙ্গি, চৌকাঠের মাথায় লতাপাতা, ঠিক যেখানে যেমনটি দরকার যেন একটি পাড়াগেঁয়ে ঘর। সব তো হল। আমি দেখছি, নন্দলালই সব করলে। সেই নীল পর্দার চাঁদ ডাকঘরেও এল। মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি বলি বেশ হয়েছে। নন্দলালের সাধ্যমত তো স্টেজকে পাড়াগেঁয়ে ঘর বানালে। তার পর হল আমার ফিনিশিং টাচ।

আমি একটা পিতলের পাখির দাঁড়ও এক পাশে ঝুলিয়ে দেওয়ালুম। নন্দলাল বললে, পাখি?

আমি বললুম, না, পাখি উড়ে গেছে, শুধু দাঁড়টি থাক্‌।

দেখি দাঁড়টি গল্পের আইডিয়ার সঙ্গে মিলে গেল। সবশেষে বললুম, এবারে এক কাজ করো তো নন্দলাল। যাও, দোকান থেকে একটি খুব রঙচঙে পট নিয়ে এসো তো দেখি। নন্দলাল পট নিয়ে এল। বললুম, এটি উইঙের গায়ে আঠ দিয়ে পট্টি মেরে দাও।

যেমন ওটা দেওয়া, একেবারে ঘরের রূপ খুলে গেল। সত্যিকার পাঁড়াগেয়ে ঘর হল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যেন সাজানো-গোছানো। এসব ফিলিশিং টাচ আমার পুঁজিতে থাকত। এই রকম করে আমি নন্দলালদের শিখিয়েছি।

ডাকঘরে আমি হয়েছিলুম মোড়ল। ওরকম মোড়ল আর কেউ সাজতে পারে নি। তখন মোড়ল সেজেছিলুম, সেই মোড়লি করেই চলেছি এখনো।

এই স্টেজ সাজানো দেখো কতভাবে হত, এই তো কয়েক রকম গেল। আর-একবার শারদোৎসবে বক উড়িয়ে দিলুম ব্যাকগ্রাউণ্ডে। নন্দলালদের বললুম, একটা কাপড়ে খড়িমাটি প্রলেপ দিয়ে নিয়ে এসো।

ওরা কাপড়ে খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে টান করে ধরল। আমি এক সার বক এঁকে দিলুম ছেড়ে। তারা ডাকতে ডাকতে স্টেজের উপর দিয়ে যেতে লাগল।

দালানের সামনে সেবার শারদোৎসব হয়।

তখন অভিনয়ে এক-একজনের সাজসজ্জাও এমন একটু অদলবদল করে দিতুম যে, সে অন্য মানুষ হয়ে যেত। রবিকাকার দাড়ি নিয়ে কম মুশকিলে পড়েছি? শোনো সে গল্প।

এখন, রবিকাকার যত দাড়ি পাকছে সেই পাকা দাড়িকে কালো করতে আমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনো রকম করে তো দাড়িতে কালো রঙ লাগিয়ে অভিনয়ে কাজ সারা হত কিন্তু অভিনয়ের পরে রাত্তিরে সেই কালো রঙ ওঠানো সে এক ব্যাপার। ভেসলিন তেল মেখে সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে তার রঙ ওঠাতে হয়। আমার চুলে যে সাদা রঙ একটু-আধটু লাগিয়ে কাঁচাপাকা চুল করা হত তাই ধুয়ে পরিষ্কার করাই আমার পক্ষে অসম্ভব হত। আমি তো কালিঝুলি মাখা অবস্থায়ই এসে ঘুমিয়ে থাকতুম। কে আবার রাত্তির বেলা ঐ ঝঞ্ঝাট করে। কিন্তু রবিকাকার তো তা হবার জো নেই।

সেবার ‘তপতী’ অভিনয় হবে—রবিকাকা সেজেছেন রাজা। সাজগোজ রবিকাকা বরাবর যতখানি পারেন নিজেই করতেন। পরে আমরা তাতে হাত লাগাতুম।

 তপতীর ড্রেস রিহার্সেল হবে। সুরেন, রথী ওরা বাক্সভর্তি রঙ কালি এনেছে। রবিকাকা তা থেকে কয়েকটা কালো রঙ তুলে নিয়ে ঢুকলেন ড্রেসিং রুমে। নিজেই দাড়ি কালো করবেন।

 খানিক বাদে বেরিয়ে এলেন মুখে গালে দাড়িতে কালিকুলি মেখে। ছোটাে ছেলে লিখতে গেলে যেমন হয়। আমি বললুম, রবিকাকা, এ করেছ কী।

 রবিকাকা বললেন, কেন, দাড়ি বেশ কালো হয়েছে তো।

 আমি বললুম, দাড়ি কালো হবে বলে কি তোমার মুখও কালো হয়ে যাবে নাকি।

 এখন, রবিকাকা করেছেন কী, আচ্ছা করে গালের উপর কালো রঙ ঘষেছেন—তাতে দাড়ি কালো হয়েছে বটে, সঙ্গে সঙ্গে গালের চামড়া ও মুখের চার দিক কালো হয়ে অতি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হল দেখতে।

 আমি বললুম, এ চলবে না—না-হয় সাদা দাড়ি থাকবে তাও ভালো, অল্প বয়সে কি লোকদের চুল পাকে না? এ রাজারও অল্প বয়সেই চুল পেকেছে—তাতে হয়েছে কী। তা বলে তোমার মুখ কালো হয়ে যাবে—ও হবে না। প্রতিমাও বললে, রোজ এই রাত্তিরে জল ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষে বাবামশায়ের একটা অসুখ-বিসুখ করবে।

 ড্রেস রিহার্সেল তো হল। রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কী করা যায়। সকালে উঠে প্রতিমাকে বললুম, তোরা মেয়েরা যে অনেক সময়ে মাথায় কালো রঙের গজের কাপড় দিস—তাই গজখানেক আনা দেখি। ঐ-যে মেমসাহেবরা চুল আটকাবার জন্যে পরে। পাতলা, অনেকটা চুলেরই মতো দেখতে লাগে দূর থেকে। সেই কাপড় তো এল—আমি অভিনয়ের আগে রবিকাকাকে বললুম, তুমি আজ আর রঙ মেখো না দাড়িতে। আমি তোমার দাড়ি কালো করে দেব। বলে, সেই কাপড় বেশ করে কেটে দাড়িতে গেলাপের মতো লাগিয়ে কানের দু-পাশে বেঁধে দিলুম। গোঁফেও ঐ রকম করে খানিকট কাপড় লাগিয়ে মুখের কাছটা কেটে দিলুম। সবাই বললে, কেমন হবে দেখতে। আমি বললুম, ভেবে না—স্টেজে আলো পড়লে এ ঠিকই দেখাবে।

সত্যি, হলও তাই, স্টেজ থেকে যা দেখাল, সবাই অবাক। বললে এ চমৎকার কালো দাড়ি হয়েছে। রবিকাকারও আর কোনো ঝঞ্ঝাট রইল না—অভিনয়ের পরে কাপড়ের গেলাপটি খুলে ফেললেই হল।

বহুকাল অবধি স্টেজ সাজাবার ও অভিনয় যারা করবে তাদের সাজিয়ে দেবার কাজ আমাদের হাতেই ছিল—এখন না-হয় তোমরা নিয়েছ সে-সব কাজ। আর-একবার কী একটা অভিনয়ে—এই তোমাদের কালেরই ব্যাপার, যাতে বাসুদেব তাণ্ডব নেচেছিল—সেই স্টেজেরই ঘটনা বলি শোনো। বাসুদেবকে দেশ থেকে আনানো হয়েছিল তাণ্ডব নাচের জন্য। তার পর কী কারণে যেন তাকে নাকচ করে দেওয়া হয়।

এখানে তো দলবল এসেছে অভিনয় হবে, স্টেজ তৈরি হল—মহাধুমধামে। স্টেজে রাজবাড়ির ফ্ৰণ্ট্‌ হবে—খিলেন-টলেন দেওয়া, স্টেজ আর্কিটেক্‌ট্‌ সুরেন শান্তিনিকেতন থেকেই কাঠের ফ্রেম তৈরি করে আনিয়ে ফিট-আপ করেছে। এখন তাতে কাপড় লাগিয়ে রঙ দেবে। নেপালের রাজা বোধ হয় সেবার অভিনয় দেখতে এসেছিলেন।

আমি বললুম, করেছ কী। কাপড় লাগিয়েছ, ভিতর থেকে আলো দেখা যাবে যে!

কী করা যায়!

বললুম, দরমা নিয়ে এসো।

যেখান থেকে আলো দেখা যায় সেখানে দরমা লাগিয়ে দেওয়ালুম। এখন কাপড়ে রঙ করবে কী করে। একদিনে কাপড়ে মাটি লাগিয়ে রঙ দিলে শুকোবে কেন। তখন আবার বর্ষাকাল—দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছে। খানিক শুকোবে খানিক শুকোবে না—সে এক বিতিগিচ্ছি ব্যাপার হবে দেখতে।

তাই তো, এখন উপায়। বললুম, স্টেজের মাপ নিয়ে যাও— বড়ো বড়ো পিস্‌বোর্ড কিনে এনে কাঠের ফ্রেমের উপর লাগিয়ে দাও। অভিনয় হবে সন্ধেতে—সকালে এই-সব কাণ্ড হচ্ছে। প্রোসিনিয়াম (Proscenium) ঠিক না হলে তো হবে না। নন্দলালকে বললুম, আজ আর এবেলা বাড়ি যাব না—এখানেই আমাকে একটু তামাক-টামাকের বন্দোবস্ত করে দাও।

দোকান থেকে পিস্‌বোর্ড এল, কাঠের ফ্রেমে লাগানো হল। বললুম, বেশ করে গোলাপি রঙ খানিকটা গুলে দাও।

বড়ো বড়ো তুলি দিয়ে সেই রঙ পিস্‌বোর্ডের উপর লাগিয়ে দিয়ে সুরেনকে বললুম, এবারে এদিক-ওদিকে কিছু লাইন কাটাে। চমৎকার গোলাপি পাথরের প্রোসিনিয়াম তৈরি হয়ে গেল। আমি বললুম, বাঃ, দেখো তো এবার। কাদা দিলে তার উপরও আঁকা চলত বটে কিন্তু সাত দিনেও শুকোত না।

বাড়ি ফিরে এলুম—ওদিকে তো ঐ-সব হচ্ছে—বাসুদেব দেখি মুখ শুকিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। আমি রবিকাকাকে গিয়ে বললুম, আচ্ছা বাসুদেব তো ভালোই নাচে, তবে ওকে তোমরা এবারে নাচতে দিচ্ছ না কেন।

রবিকাকা বললেন, না, ও যেন কী রকম নাচে, এদের সঙ্গে মেলে না—আর ও যা কালে, স্টেজে মানাবে না।

আমি বললুম, আচ্ছা আমার হাতে ছেড়ে দাও এক রাত্তিরের জন্য। আশা করে এসেছে, আমি সাজিয়ে দিই—যদি ভালো না লাগে পরে নাকচ করে দিয়ে।

রবিকাকার তো মত নিয়ে এলুম। আমাদের ছেলেবেলায় সেই ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ দেখবার দরবার মনে পড়ল। বাসুদেবকে বললুম, দরবার মঞ্জুর হয়ে গেছে, ঠিক তিনটের সময় আমাকে খবর দিয়ো—আমি তোমাকে সাজিয়ে দেব। সে তো খুব খুশি।

ইতিমধ্যে আমি খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম করে উঠতে তিনটার সময় বাসুদেব এল। বাসুদেবকে নিয়ে গেলুম যেখানে নন্দলাল সবাইকে সাজাচ্ছে। সবার সাজ তৈরি। নন্দলাল আমাকে বললে, তা হলে বাসুদেবকে একটু হলদে রঙটঙ মাখিয়ে দিই।

আমি বললুম, অমন কাজও কোরো না। ওকে সাদা রঙই দাও আর হলদে মাখাও, ভিতর থেকে নীল আভা বের হবেই। খানিক গেরিমাটি আনো। সব গায়ে মাখাবার দরকার নেই—জায়গায় জায়গায় যেখানে রুখো কালো আছে সেখানে সেখানে লাগিয়ে দাও।

নন্দলাল বাসুদেবের হাঁটুতে কনুইতে ঘাড়ে এখানে ওখানে বেশ করে গেরিমাটির গুঁড়ো ঘষে লাগিয়ে দিলে। কালো রঙের উপরে গেরি লাগাতে দিব্যি যেন একটা আভা ফুটে উঠতে লাগল। এইটুকু করে দিয়ে আমি নন্দলালকে বললুম, এবারে একটু চোখ ভুরু টেনে ওকে ছেড়ে দাও। বেশ করে মালকোঁচা ধুতি পরিয়ে মাথায় একটা পটকা, গলায় একটু গয়না এই-সব একটু-আধটু দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া গেল।

সেদিন অডিয়েন্সের খুব ভিড়, কোথায় বসি। কৃতির বাড়ির সামনে নীচের তলায় একটু খিলেনমত আছে। নন্দলাল আমার সঙ্গে। সেখানেই দুজনে কোনোমতে জায়গা করে চৌকির চেয়েও আরামে বসে রইলুম।

বাতি জ্বলল, সিন উঠল। বাসুদেব যখন স্টেজে ঢুকল—কী বলব তোমাকে—মনে হল যেন ব্রোঞ্জের মূর্তিটি। মনে ভয় ছিল বাসুদেব এবার কী করে, শেষে না রবিকাকার তাড়া খেতে হয়।

অন্য সব নাচ কানা সেদিন। বাসুদেবেব নাচে সবাই আশ্চর্য হয়ে রইল—যেন ব্রোঞ্জের নটরাজ জীবন্ত হয়ে স্টেজে নেচে দিয়ে গেল। শুধু রঙ মাখালেই স্টেজে খোলতাই হয় না। রঙ মাখানোর হিসেব আছে। ভগবান-দত্ত চামড়াকে বাঁচিয়ে তবে রঙ মাখাতে হয়। এ কি সোনার উপর গিল্‌টি করা—খোদার উপর খোদকারি? যার যা রঙ তা রেখে সাজাতে হয়।

অভিনয়ের পরে রবিকাকাকে বললুম, এই বাসুদেবকে না নামালে তোমাদের প্লে জমতই না।

 এখন দেখো সাজের একটু অদলবদলে জিনিসটা কতখানি তফাত হয়।

 ‘নটীর পূজা’তে আমরা ছিলুম না। তখন ওরা সবাই পাকা হয়ে গেছে—আমরা দেখবার দলে। রবিকাকা তার কিছুকাল আগে বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন। আমাকে দাদাকে ফিরে এসে আরবী জোব্বা দিলেন।

সেদিন অভিনয়ে অনেকেই আসবেন—লাটসাহেবের মেমও বুঝি আসবেন। রবিকাকা আমাদের বললেন, তোমরা ভালো করে সেজে এসো।

আমরা রবিকাকার দেওয়া সেই আরবী জোব্বা পরে দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি অতিথি রিসিভ করতে।

নটীর পূজা অভিনয় হল—নন্দলালের মেয়ে গৌরী নটী সেজেছে। ও যখন নটী হয়ে নাচল সে এক অদ্ভুত নাচ। অমন আর দেখি নি। ড্রপ পড়তেই ভিতরে গেলুম। গৌরীকে বললুম, আজ যে নাচ তুই দেখালি; এই নে বকশিশ। বলে রবিকাকার দেওয়া সেই জোব্বা গা থেকে খুলে দিয়ে দিলুম। ওকে আর কিছু বললুম না—নন্দলালকে বললুম, তোমার মেয়ে আজ আগুন স্পর্শ করেছে, ওকে সাবধানে রেখো।

তার পরে আর-একবার দেখেছিলুম যখন ‘তপতী’ হয়েছিল। অমিতা তপতী সেজে অগ্নিতে প্রবেশ করছে। সেও এক অদ্ভুত রূপ। প্রাণের ভিতরে গিয়ে নাড়া দেয়। আমি ‘তপতী’র সমস্ত ছবি এঁকে রেখেছিলুম।

পরে যত অভিনয়ই হয়েছে আজকাল, অমন আর দেখলুম না—সে সত্যি কথাই বলব।

তাই তো একবার রবিকাকাকে বললুম, করলে কী রবিকাকা, ঘরের পিদিম নিভিয়ে ফেললে, এখন বাইরের পিদিম জ্বালিয়ে কী করবে।

রবিকাকা বললেন, তা আর কী করা যায়, চিরকালই কি আর ঘরের পিদিম জ্বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *