অলকনন্দা – ৮

সমস্তটা দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল। অলক আজকেও ফিরবে না নাকি? কিন্তু পর্ণাকে টেলিফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে কেন? দুজনে কী করছে ওরা?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ক্রমে সন্ধ্যা। তারপর আবার ঘনিয়ে এল রাত। এ কী কাণ্ড, অলক কি আজকের রাতটাও বাইরে কাটাবে? সত্যিই বর্ধমানে গেছে তো? আর কে কে আছে সেখানে? হঠাৎ ঝঝন্ করে বেজে ওঠে টেলিফোন। উঠে গিয়ে ধরলাম। হ্যাঁ, অলকই ফোন করছে। না, ট্রাঙ্ক লাইন নয়। অফিস থেকে।

—কে, সুনন্দা? হ্যাঁ, অলক বলছি। শোন, তুমি এখনই চলে এস এখানে। হা হা, অফিসে! জরুরি দরকার। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।

অবাক হয়ে বলে–কী বলছ যা তা? আমি অফিসে যাব কী? তুমি বাড়ি আসবে না? কোথা থেকে বলছ তুমি?

—অফিস থেকেই বলছি। তোমার সঙ্গে জরুরি দরকার। গাড়ি যাচ্ছে। রামলালও যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।

আমি আর কিছু বলার আগেই ও লাইন কেটে দেয়। এর মানে কী? অন্য কেউ এ-ভাবে ফোনে ডাকলে মনে হত কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে হয়তো। কিন্তু ওই তো কথা বলল। তাহলে ওর কিছু হয়নি। এমনভাবে আমাকে অফিস ডেকে নিয়ে যাবার মানে? আমি কি কখনও ওর অফিসে গিয়েছি, যে এভাবে মাঝরাতে আমাকে সেখানে ডেকে পাঠাচ্ছে?

গৌতমের ব্যাপারটা কি ও জানতে পেরেছে? কোন সূত্রে? নমিতা বা কুমুদবাবু কি বলেছেন? বেশ, তাই যদি হবে, তাহলে সে ব্যাপারে ফয়শালা করবার রঙ্গমঞ্চ তার অফিস নয়। বাড়িতে এসে সে কৈফিয়ত দাবি করতে পারত।

ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে দাঁড়ায় পোর্টিকোর সামনে।

কাপড়টা পাল্টে নেমে আসি। রামলালকে জিজ্ঞাসা করি–কী হয়েছে রামলাল? সাহেব আমাকে ডাকছেন কেন?

রামলাল প্রত্যাশিত জবাবই দেয়। সে তা জানবে কেমন করে? ড্রাইভারকে প্রশ্ন করে জানতে পারি, বর্ধমান থেকে গাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যায়। তারপর থেকে কী যেন মিটিং হচ্ছে বন্ধ ঘরের ভেতর। কারখানার সামনে এসে পৌঁছাল গাড়ি। দারোয়ান আভূমি নত হয়ে প্রণাম জানায়। রাইফেলধারী প্রহরী পাহারা দিচ্ছে গেটে। কারখানার বাইরের দেওয়ালে ধর্মঘটি শ্রমিকদের হাতে-লেখা পোস্টার। সাদা কাগজের ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা পোস্টারগুলো দেখে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল যেন। একেই কি বলে দেওয়ালের লিখন? মনে পড়ে গেল কলেজের দেওয়ালে একদিন ঐ কথাই নিজে হাতে লিখেছিলাম আমি পোস্টারে। গৌতমরা রাতারাতি সেগুলি এঁটে দিয়ে এসেছিল কলেজের প্রাচীরে। সেই ভুলে যাওয়া বেয়াল্লিশ সালে। ঐ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে–।

অলকের অফিসঘরে ইতিপূর্বে কখনও আসিনি। মস্ত বড় ঘর, মাঝখানে সেগুনকাঠের বিরাট পালিশ করা টেবিল। কাগজ-চাপা থেকে প্রত্যেকটি জিনিস ঝকঝক করছে ফুরেসেন্ট আলোয়। সবই উজ্জ্বল–শুধু মাঝখানে বসে আছে অলক-যেন বাজে পোড়া বটগাছ! সারাদিন বোধহয় স্নান হয়নি, রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। টাইয়ের বাঁধনটা আলগা করা। এত হাওয়ার নীচেও লক্ষ করলাম ওর কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। অলক আজ দাড়ি কামায়নি! পাশ থেকে দুজন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে নমস্কার করলেন আমাকে। ঠিক মনে নেই, বোধহয় প্রতিনমস্কার করতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি। অথবা হয়তো যন্ত্রচালিতের মতো হাত দুটো উঠে এসেছিল বুকের কাছে। ওঁরা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। বিহ্বলভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। পার্কার কলমটার উল্টো দিক দিয়ে অলক সম্মুখস্থ একটা চেয়ারে নির্দেশ করে। আমি বসি।

মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে অলক বলে ওঠে–এ অসময়ে তোমাকে ডেকে আনার কারণটা জানতে নিশ্চয় খুব কৌতূহল হচ্ছে তোমার। অবাক হওয়া তোমার পক্ষে স্বাভাবিক, আমিও কম অবাক হইনি।

তোমাকে আমি এখানে ডেকে আনিনি–এনেছেন এঁরা–

এতক্ষণে লক্ষ হয় ঘরে আরও দুজন লোক আছেন। একজন পুরুষ একজন মহিলা! ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বললে-বহুবচন নয়, মিস্টার মুখার্জি, একবচনে বলুন। আমি ওঁকে এখানে আনতে চাইনি। এনেছেন মিসেস ব্যানার্জি। আমি এর ভেতরে নেই। সুতরাং আপনার আপত্তি না থাকলে আমি বরং বাইরে অপেক্ষা করি।

আমি তাঁর দিকে ফিরতেই ভদ্রলোক আমাকে হাত তুলে নমস্কার করেন। অলকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই তিনি বেরিয়ে যান ঘর ছেড়ে।

গৌতম!

ঘরে ক্ষণিক স্তব্ধতা। আমার মনটা ক্রমশ যেন অসাড় হয়ে আসছে। গৌতম এখানে কেন? কী বলছিল সে অলককে এতক্ষণ? আমার কথা? বেশ তো, তাহলে স্থানত্যাগ করে পালিয়ে যাবার কী আছে? অলক কি আমার কৈফিয়ত তলব করতে চায়? তাই যদি হবে তবে প্রধান সাক্ষীর তত বিচারালয়ে উপস্থিত থাকারই কথা। কিন্তু অলকের এ কী ব্যবহার! আমার বিরুদ্ধে তার যদি কোনো অভিযোগই থাকে তাহলে তা নিয়ে আলোচনা করার এই কি পরিবেশ, না সময়?

অলক একটা সিগারেট ধরায়। কাঠিটা অ্যাশট্রেতে রাখে। সেটাতে বোধহয় জল ছিল না। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে কাঠিটা। আগুনটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবু অ্যাশট্রের অন্ধ কোটরে কাঠিটা যে নিজেরই বারুদের আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে তা অনুভব করা যায়। দেশলাই কাঠিগুলো এত মূর্খ কেন? কেন বোকার মত মাথায় তুলে রেখেছে একফোটা বারুদ? আর যদি রেখেই থাকে তাহলে তা আবার ঘষে জ্বালতে যাওয়া কেন? এখন নিজেই পুড়ে মরছে!

কী আবোলতাবোল ভাবছি?

হঠাৎ অলক বলতে শুরু করে–আজ সকালে আমরা একটা উড়ো চিঠি পেয়েছি। আমি ছিলুম না এখানে। ফিরে এসে এইমাত্র সে চিঠি পড়েছি। তাতে শ্রমিকপক্ষ থেকে আমাকে শাসানো হয়েছে যে, তাদের দাবি যদি মেনে না নিই তাহলে আমাদের কয়েকটি গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হবে। চিঠিটায় আমাদের কনফিডেন্সিয়াল ফাইলের লেটার নম্বর ও তারিখের উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের গলতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই তথ্যগুলির প্রকাশ কোম্পানির পক্ষে মর্যাদাহানিকর এবং অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে সন্দেহটা পড়ে আমার কনফিডেনশিয়াল স্টেনো মিস রায়ের ওপর, আই মিন মিসেস্ ব্যানার্জির ওপর;–বাই-দ্য-ওয়ে, তোমাকে এঁর সঙ্গে এখনও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি আমার স্টেনো মিসেস পর্ণা ব্যানার্জি।

এবারও নমস্কার করতে ভুলে গেলাম আমি। ও হাত দুটো বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গি করল–আমার মনে হল, আসলে হাত দুটিতে যে বালা ও রিস্টওয়াচের বদলে শাঁখা ও নোয়া রয়েছে এইটেই সে হাতদুটি তুলে দেখাল। একতিলও বদলায়নি সে এ ছাড়া।

–যদিও মিস পর্ণা রায় নামে ইনি আমাদের অফিসে পরিচিত, কিন্তু আজ শ্রমিক নেতা শ্রীগৌতম ব্যানার্জি হঠাৎ দাবি করে বসেছেন এই শাঁখা-সিঁদুরহীন আমার স্টেনোটি তার ধর্মপত্নী আই মীন অধর্মপত্নী, কারণ এঁদের মতে ধর্ম জিনিসটা সমাজের পক্ষে আফিঙের নেশার মতো পরিত্যাজ্য। না কী বলেন মিসেস ব্যানার্জি?

পর্ণা সে কথায় কান দেয় না। আমার দিকে ফিরে সবিনয়ে বলতে থাকে–মাফ করবেন মিসেস্ মুখার্জি-রাত করে আপনাকে কষ্ট দিতে হল! অলকের ধারণা ও-পক্ষকে আমিই গোপন সংবাদগুলি দিয়েছি। তাই আজ ও হঠাৎ আমায় কৈফিয়ত তলব করে। আমি জানি, আমার উত্তরের মমোদ্ধার করতে পারবেনা ও;—আমার ধারণা বরাবরই আমাকে তুমি ভুল বুঝে এসেছ অলক।

ওর দিকে ফিরে এই শেষ কথাটা বলেই আবার আমার দিকে ফেরে–ও, আপনার স্বামীকে নাম ধরে ডাকছি বলে অবাক হচ্ছেন বুঝি…না, না, অধিকার-বহির্ভূত কিছু করছি না আমি। অলক আমাকে তুমি বলতে পারমিশান-আই শুড সে-বারে বারে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছে!

আবার আমাকে ছেড়ে ওকে আক্রমণ করে-নাকি মিসেস মুখার্জির সামনে আবার তোমাকে আপনি-আজ্ঞে করতে হবে? অফিসে সবার সামনে যেমন করি?

অলক গর্জে ওঠে–কী সব আবোলতাবোল বকছেন আপনি!

–ও আপনি! বুঝেছি, বুঝেছি, এইটুকু ইঙ্গিত বুঝবার মত বুদ্ধি আছে আমার! বেশ, আমিও না হয় আপনিই বলব সুনন্দা দেবীর সামনে! হ্যাঁ, যা বলছিলাম–বুঝলেন মিসেস মুখার্জি, ছাত্রজীবন থেকেই আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সে যুগে ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলন, এ যুগে অর্থনৈতিক। সে যুগে অনেকে এসে যোগ দিয়েছিল আমার সঙ্গে, তারা বেশ গরম গরম বক্তৃতা দিত। আজকাল তারা সুযোেগ পেয়ে সরে দাঁড়িয়েছে—শুধু তাই নয়, অন্যায় যে সহে-র দল ত্যাগ করে অন্যায় যে করে-র দলে নাম লিখিয়েছে। তাতে অবশ্য আমার দুঃখ নেই। আমি একই পথে চলেছি। আপনার স্বামীর অধীনে চাকরি করার দীনতা আমাকে স্বীকার করতে হয়েছে পার্টির নির্দেশে। এ তথ্যগুলি ও পক্ষকে আমিই সরবরাহ করেছি; কারণ…

অলক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে—ইউ ট্রেচারাস্ ওয়েঞ্চ!

পর্ণা নির্বিকারভাবে বলে—শেক্সপীয়র!

এতক্ষণে বাক্যস্ফূর্তি হয় আমার, অবাক হয়ে বলি–মানে?

পর্ণা আমার দিকে ফিরে হাসি গোপন করে বলে-কী আশ্চর্য! আপনি এ খেলা জানেন না? একে বলে কোটেশান-খেলা। এই খেলার মাধ্যমেই আমরা হাতে-হাত মিলিয়েছি যে! অলক একটা উদ্ধৃতি দেয়—আই মীন, অলকবাবু একটা উদ্ধৃতি দেন—আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলে দিতে হয় কোথা থেকে কোটেশান দেওয়া হল। ঠিক ঠিক বলতে পারলেই হাতে হাতে পুরস্কার পাই। অবশ্য কী জাতীয় পুরস্কার তা আর নাই বললাম, অলক লজ্জা পাবে তাহলে!

অলক ঘরময় পায়চারি করছিল। আমাদের কথোপকথন তার কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। নিজের আসুনে এসে বসে এতক্ষণে। অর্ধদগ্ধ সিগারেটটাকে অ্যাশট্রের গায়ে ঘষে ঘষে থেতলে দেয়। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে–বিশ্বাসঘাতকতা করবার জন্য আমরা আপনাকে মাসে মাসে মাইনে দিয়েছি? এই কি আপনার ধারণা?

–ঠিক তাই। ধারণা করা অন্যায় নয় নিশ্চয়ই। আমার আর কী কোয়ালিফিকেশন আছে বলুন? স্টেনো হিসাবে আমার যোগ্যতা যে কতখানি তা আর কেউ না জানুক আপনি-আমি তো জানি! লোকে স্টেনো রাখে চারটি কারণে। হয়, সত্যি ডিকটেশান নিতে—তা আমি পারি না। নয়, অফিসের শোভাবর্ধন করতে,আমার ক্ষেত্রে সেটাও ঠিক নয়, কারণ আমার ফটো দেখেই পছন্দ করেছেন আপনি। এতদিনে তোমার মনের ভাব অবশ্য অন্য রকম হয়েছে, কিন্তু ফটো দেখেই নিশ্চয় গলে যাওনি তুমি। তৃতীয়ত, স্ত্রীর উপরোধ। কিন্তু মিসেস মুখার্জি আমাকে চেনেনই না যে সুপারিশ করবেন। আর স্টেনো রাখার চতুর্থ কারণ হতে পারে তাকে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করানো। যেহেতু প্রথম তিনটি কারণ আমার ক্ষেত্রে অচল, তাই আমার ধারণা হয়েছিল, বিশ্বাসঘাতকতা করবার জন্যই আমাকে মাসে মাসে মাইনে দেওয়া হয়।

হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলে–আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বল তো অলক, আমার মাইনে বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে কেন? সে কি আমাকে ভালবেসে ফেলেছ বলেই, নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে?

অলক চিঙ্কার করে ওঠে-শাট আপ! ইউ ইনফার্নাল ভাইপার!

একগাল হেসে পর্ণা বলে–প্যারাডাইস লস্ট! মিল্টন!

থরথর করে কাঁপতে থাকে অলক, ভূকম্পনে উদগীরণ-উন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো। অথবা স্বর্গচ্যুত বিয়েলজিব্যাব-এর মতো।

পর্ণা একটু অপেক্ষা করে, আবার গম্ভীরভাবে বলতে থাকে—অলক, তোমার হাতে আছে অগাধ অর্থ, শ্রমিক-মালিকের যুদ্ধে তুমি অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করছ তোমার ক্ষমতা। ফ্যাক্টরীতে লক-আউট ঘোষণা করে, ছাঁটাই করে, ধৰ্মঘাটি কর্মীদের পাওনা না দিয়ে তুমি আর্থিক পীড়ন করে চলেছ-অন্যায়-যুদ্ধ চালাচ্ছ তোমার তরফ থেকে। সুতরাং এ-পক্ষ অন্যায়-যুদ্ধ করলে রাগ করছ কেন? আর তা ছাড়া জান তো, জীবনের দুটি ক্ষেত্রে অন্যায় বলে কোনো শব্দের স্বীকৃতি নেই! এ বিষয়ে আমি চমৎকার একটা কোটেশান শুনেছিলাম ছাত্ৰীজীবনে। সেটা আজও ভুলিনি আমি দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার! বলতে পার কার কোটেশান?

অলক জবাব দেয় না।

পর্ণা আমার দিকে ফিরে বলে–আপনি জানেন?

জবাব দেবার ক্ষমতা তখন আমারও ছিল না।

—এটা লাভ না ওয়্যার ঠিক জানি না, সম্ভবত দুটোই। সুতরাং এখানে অন্যায়-যুদ্ধ করায় আমার বিবেকে কোনো দাগ পড়েনি।

আবার সংযম হারায় অলক, বলে বিবেক! তোমার মতো রাস্তায়-পাওয়া নষ্ট মেয়ের বিবেক বলে আবার কিছু থাকে নাকি?

পর্ণা চমকে ওঠে। ঠিক এ ভাষায় গালাগালি শুনবার জন্য বোধকরি প্রস্তুত ছিল না সে। চাবুক সেই চালাচ্ছিল এতক্ষণ, ডাইনে-বাঁয়ে—কিন্তু শালীনতার সীমা অতিক্রম না করে, রুচির মাত্রা না ছাড়িয়ে। পর্ণার শ্বাপদ চোখ দুটি জ্বলে ওঠে।

অলক উত্তেজিতভাবে বলে–যাক, অনেক অর্থ তুমি নিয়েছ কোম্পানির, এখন বল—কত টাকা পেলে এই যুদ্ধ থেকে তুমি সরে দাঁড়াতে পার?

আমি তখন সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছি। নীচে, কত নীচে নেমে গেছে ঐ মেয়েটা! একদিন একই ক্লাসে পড়তাম আমরা, বসতাম একই বেঞ্চিতে। আমার অন্তরাত্মা বলে উঠল–বল পর্ণা, এখানে অন্তত একবার বল—টাকা দিয়ে আদর্শকে কেনা যায় না।

হায়রে আমার দুরাশা। অম্লানবদনে পর্ণা বলল–পাঁচ হাজার টাকা।

পকেট থেকে চেকবই বার করে অলক।

–মাফ করবেন, মুখার্জি-সাহেব। চেক নেব না, বাউন্স করতে পারে। ক্যাশ টাকা চাই!

এতক্ষণে আত্মসংবরণ করেছি আমি। প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে সংযত করে বলি—টাকা পেলে আপনারা বুঝি সব পারেন?

পর্ণা হেসে বলল–আপনি বুঝি বায়রন পড়েননি? অলকের একটা ফেভারিট কোটেশান শোনেননি?—রেডি মানি ইজ আলাদীনস ল্যাম্প?

ততক্ষণে আয়রন চেস্ট খুলে পাঁচ তাড়া নোট বার করে এনেছে অলক। পাঁচ বান্ডিল নোট টেবিলের ওপর রেখে বলে-এগুলো নেবার পরেও যে তুমি ব্ল্যাকমেলিং করবে না তার প্রমাণ কী?

–তাই কি পারি?

–পার, সব পার তুমি! তোমার মত চরিত্রহীন নষ্ট মেয়েমানুষ না পারে কী?

আমার ভীষণ কান্না পায়। ছি ছি ছি। মাত্র পাঁচটা হাজার টাকার শোকে অলক এমন অভিভূত হয়ে পড়ল? শালীনতাবোধ বলে কি কিছুই অবশিষ্ট নেই তার। কিন্তু এ টাকার শোকে নয়–অপমানের জ্বালায়। স্ত্রীর সামনে তার চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করায় ভদ্রতাবোধ হারিয়ে ফেলেছে অলক!

পর্ণার চোখদুটি জ্বলে ওঠে। শাপদ চক্ষু! কয়েক মিনিট চুপ করে কী ভাবে, বোধহয় সামলে নেয় নিজেকে। তারপর অদ্ভুতভাবে হাসে ও বলে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না অলক?

ও গর্জে ওঠে—বাড়াবাড়ি! তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক নষ্ট চরিত্রের মেয়ে—

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় পর্ণা। বলে–বিশ্বাসঘাতকতা তুমি কাকে বল অলক? বিশ্বাসঘাতক কে নয়? আমার সঙ্গে রাত বারোটায় ফল অফ বার্লিন দেখে এসে যখন স্ত্রীর কাছে পোলিশ বন্ধুর গল্প বলেছিলে তখন ও শব্দটার মানে তুমি জানতে? শুধু তাই নয়–আবার হেসে হেসে সে গল্প যখন আমার কাছে ফলাও করে বলেছিলে তখনও কি মনে ছিল, আমি রাস্তায়-পাওয়া নষ্ট মেয়েমানুষ?

অলক জবাব দিতে পারে না। বাকরোধ হয়ে গিয়েছে যেন তার। পর্ণা হেসে বলে-ভয় নেই; ব্ল্যাকমেলিং আমি করতে পারব না। যতই কেন না নষ্ট চরিত্রহীন হই। তোমার মৃত্যুবাণ যেমন রইল আমার হাতে, তেমনি আমার মৃত্যুবাণও যে রয়ে গেল তোমার কাছে। নিজ নিজ স্বার্থে আমরা পরস্পরকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারব না। বাঙালি গৃহস্থঘরের বধূ আমি, বিখ্যাত শ্রমিক নেতার স্ত্রী বলে শ্ৰমিকমহলে সবাই আমাকে চেনে–তা ছাড়া তোমার-আমার অন্তরালের জীবনকথা যেমন সুনন্দা দেবী জানেন না, তেমনি গৌতমও তো জানে না। সব কথা কি মুখ ফুটে তাকেই বলতে পেরেছি ছাই? সুতরাং আমার যে চিঠিগুলি তোমার কাছে রয়ে গেল, সেলফ-এক্সপোজারে ভোলা আমাদের সেই আলিঙ্গনবদ্ধ ফটো…আর তা ছাড়া হোটেলের রেজিস্টার খাতায় আমাদের সই—সেই যে হোটেলে আমরা দুজনে সারারাত…

—ইউ শাট আপ! মিথ্যা কথা! বানিয়ে বানিয়ে কী সব যা-তা বকছু তুমি?

পর্ণার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একটা অদ্ভুত টান। বলে—আর কোনো লাভ নেই অলক, মিসেস মুখার্জি সব কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন। আর তা ছাড়া অতটা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই তোমার। সুনন্দা দেবীও কিছু গঙ্গাজলে যোওয়া তুলসীপত্রটি নন। না হয় ওঁকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ। শাঁখা-সিঁদুর পরে বাসে-ট্রামে বেলেঘাটা অঞ্চলে কোথায় যেতেন উনি! বিশ্বাসঘাতক তো আমি একা নই–তুমি, আমি, সুনন্দা দেবী–আমরা সবাই।

অলক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে-গেট আউট!

পর্ণা বলে-–থাক, দারোয়ান ডাকতে হবে না। যাচ্ছি। কিন্তু এখনও একটা কাজ যে বাকি আছে স্যার। আমাদের শ্রমিক য়ুনিয়ানের চাঁদার খাতায় একটা সই দিতে হবে আপনাকে।

টেবিলের ওপর চাঁদার খাতাখানা মেলে ধরে বলে—একশো টাকার নম্বরী নোট, বেহিসাবি এত টাকা আমার ব্যাগে থাকাটা ঠিক নয়।

–ড্যাম ইট! ঘসঘস করে সই করে দেয় অলক।

চার বান্ডিল নোট তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় পর্ণা। পরিত্যক্ত নোটের বান্ডিলটার দিকে ঘৃণাকুঞ্চিত আঙুল তুলে অলক বলে-ওটা?

–ওটা আমার দুশ টাকা হিসাবে পাঁচ মাসের মাইনে। ওটা তুলে রাখ!

কাঁপতে কাঁপতে অলক আবার গর্জে ওঠে–আই সে, টেক ইট!

যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল পর্ণা। এ কথায় ঘুরে দাঁড়ায়।

বলে—না! তোমার প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তার মূল্য ঐ হাজার টাকাই! সে মূল্য আমি মিটিয়ে দিয়ে যাব।

তারপর আমার দিকে ফিরে বলে–আমরা সবাই তো বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু জেনে রাখুন মিসেস্ মুখার্জি, পার্টির নির্দেশে আমি এখানে যা কিছু করেছি তা আমার স্বামী জানেন—তাঁর কাছে কিছুই লুকোইনি আমি। আচ্ছা চলি, নমস্কার।

আমার মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে তখন!

ঠিকভাবে কিছুই আর চিন্তা করতে পারছি না।

ওর শেষ কথাগুলিই মনে পড়ছে কেবল!

ওর ঐ শেষ বিষ-উদগীরণটা কি একটা মিথ্যা কাহিনীর ওপর প্রতিষ্ঠিত? চিঠি-ফটো-হোটেল–সব-সবই কি অলীক কাহিনী?

আমার চরিত্রবান স্বামীর কাছে আমল না পেয়ে নিস্ফল আক্রোশে পরাজয়ের জ্বালা ভুলবার জন্যেই কি এই অন্তিম দংশন করে গেল কালনাগিনী? অথবা আমিই ছিলাম তার লক্ষ্যস্থল? আমাকেই বিষজর্জরিত করে গেল সে এই কুহকী মায়ার ছলনায়?

কিংবা হয়তো, হয়তো কিছুই মিথ্যা বলেনি সে।

বিষকন্যার বিষে বুঝি নীল হয়ে গেল এ সোনার সংসার!

কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে সে কি সত্যিই পারবে গৌতমকে সব কথা খুলে বলতে? দারোগাবাবুর কাছে সারারাত স্বেচ্ছায় আটক ছিল যে মেয়েটি সে কি পারত, বিয়ে হলে, তার স্বামীকে সে রাত্রের সব কথা বলতে?

জানি, এ সব প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না!

তা না যাক, তবু বলব আমার অঙ্কে শুধুই লোকসান জমা পড়েনি। এ আঘাতের প্রয়োজন ছিল–ওর, আমার, আমাদের দুজনেরই। বৈচিত্র্য চেয়েছিলাম না আমি? তা সে বৈচিত্র্যও এসেছিল আমাদের দাম্পত্য জীবনে, চরম সর্বনাশীর বেশে। তাতে আমরা দুজনেই বুঝতে শিখেছি, আমাদের দুর্বলতা কোথায়। বড় বেশি জাঁক হয়েছিল আমাদের। ঠিক কথা, এ আঘাতের প্রয়োজন ছিল।

উঠে এলাম অলকের কাছে। ওর হাতটা তুলে নিয়ে বলি-চল, বাড়ি চল।

ও কী যেন ভাবছিল। চমকে উঠে বলে–অ্যাঁ?

বলি–এতটা বিচলিত হচ্ছ কেন? আমি ওর একটা কথাও বিশ্বাস করিনি। ভেঙে পড়লে তো চলবে না। ওঠ, চল।

—কোথায়?

–কোথায় আবার কী? বাড়িতে। তোমার অলকনন্দায়।

অলক আমার মাথাটা টেনে নিয়ে বলে–তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?

আমি হেসে বলি, অলক, বল দেখি–কে বলেছেন—দে হু ফরগি মোস্ট শ্যাল বি মোস্ট ফরগিভন্‌?

আমার হাত দুটি ধরে অলকও হেসে ফেলে।

বলে-বেইলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *