অলকনন্দা – ৭

ল্যভ ইজ লাইক দ্য মুন; হোয়েন ইট ভাজ নট ইনক্রিজ, ইট ডিক্রিজে। কোটেশানটা কার, ঠিক এই মুহূর্তে মনে আসছে না। কিন্তু কথাটা একেবারে খাঁটি। অর্থাৎ প্রেম ঠিক চাদের মতো— যখন বৃদ্ধি পাওয়ার আর উপায় থাকে না, তখন তা হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে।

আমার ক্ষেত্রে কথাটা অদ্ভুতভাবে ফলেছে।

অলক আর সুনন্দা। আমরা এক আদর্শ দম্পতি। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলুম এই অলকনন্দা। তুষারদ্রব সুরগঙ্গা। এ অলকনন্দার ধারা ছিল নির্মল, পবিত্র, স্বর্গীয়। পার্থিব মলিনতার স্পর্শ লাগেনি এর গায়ে। আমাদের দুজনেরই মন ছিল কানায় কানায় ভরা—দুজনকে নিয়ে।

মহাপ্রস্থানের যাত্রাপথে শুনেছি অলকনন্দার অববাহিকা ধরে চলতে হয়। যাত্রীদল অন্যমনে পথ চলে—লক্ষ্য তার মহাতীর্থের দিকে—সারা পথে অলকনন্দার উপলমুখর কুলুকুলু ধ্বনি শুনতে শুনতে চলে; সারা পথ দেখতে দেখতে যায় স্বচ্ছতোয়া রজতশুভ্র জলধারার প্রবাহ। দূর থেকে অলকনন্দা ওদের উৎসাহ যোগায়, প্রেরণা দেয়। কিন্তু ক্ষণিক বিচ্যুতিতে যদি ঐ খাড়া খাদের দিকে যাত্রীর পদস্খলন হয়, তখন ঐ অলকনন্দা ভয়ঙ্করী মৃত্যুর মত করাল গ্রাসে টেনে নেয় তাকে।

ফেনিল আবর্তে অবলুপ্ত হয়ে যায় তীর্থযাত্রীর শেষচিহ্ন।

আমাদেরও হয়েছে তাই। খেয়াল-খুশিতে পথ চলতে চলতে হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছি অলকনন্দার খাদের সম্মুখে। আমরা দুজনেই! জানি না, পদস্খলন কার আগে হবে।

সুনন্দার কথা ঠিক জানি না। নিজের কথাটা জানি। এতদিন আকণ্ঠ ডুবে ছিলুম নন্দার প্রেমে। শশীকলার মতোই দিন দিন তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে চলছিল; কিন্তু তারপর যেমন হয়। মন যখন পূর্ণিমায় কানায় কানায় ভরে গেল তখনই দেখলাম–মনের অনেকটাই ফাঁকা। আর তারপর–হোয়েন ইট ডাজ নট ইনক্রিজ, ইট ডিক্রিজেস!

এটা বোধহয় পুরুষের ধর্ম। যা পাওয়া গেছে তার ওপর আর মোহ থাকে না–যা পাওয়া গেল না, মনটা তাকে নিয়েই মেতে ওঠে। রবিঠাকুরের কী একটা লাইন আছে না? যাহা পাই না তাহা চাই না–না ঐ-জাতীয় কিছু?

আজ আর অস্বীকার করে লাভ নেই, পর্ণা আমার মনে আবর্ত তুলেছিল। হয়তো তার জন্য কিছুটা দায়ী আমার স্বাভাবিক পুরুষের ধর্ম, কিছু হয়তো তার বিচিত্র মোহবিস্তারের কায়দা হয়তো বা কিছুটা সুনন্দার সাম্প্রতিক ব্যবহার।

ভেবেছিলুম, মনের এ পরিবর্তনটুকু গোপন করে যাব। বস্তুত আমার চেতন মনের কাছে প্রথমাবস্থায় অবচেতন মনও এটা গোপন রাখতে পেরেছিল। কিন্তু প্রথমাবস্থায় তো চিরকালই কোনো কিছু থাকে না।

আর এ এমন একটি জিনিস যা চিরকাল লুকিয়ে রাখা যায় না। হার্বাট ঠিকই বলেছেন—এ ল্যভ অ্যান্ড এ কা ক্যানট বি হিড। প্রেম আর সর্দি-কাশি লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। সুনন্দা কিছুটা আন্দাজ করেছে এতদিনে।

যেদিন বুঝলুম–সুনন্দা আন্দাজ করেছে, সেদিন থেকে আরও যেন বেপরোয়া হয়ে পড়েছি। সেই বেলেঘাটার মোড়ে মধ্যরাত্রে শোনা ডনের উদ্ধৃতিটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না!

কিন্তু আপাতত আমার মনের কথা থাক। তার চেয়ে বড় বিপদ ঘনিয়ে উঠেছে বাস্তবে। যার জন্য ছুটে আসতে হয়েছে এই বর্ধমানে।

কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করেছি, আমাদের কারখানা থেকে গোপনতম খবর কেমন করে জানি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতদিন পর্ণা ও-তরফের গোপন খবর সরবরাহ করত আমাকে। সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। পর্ণা বলে, তার সেই পঞ্চাশ টাকা বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবের পর থেকেই। যেমন করেই হোক, ও-পক্ষ সে খবরটা পেয়ে গিয়েছিল এবং তারপর থেকেই শ্রমিক নেতা ব্যানার্জি আর পাত্তা দেয় না পর্ণাকে। এখন আবার গোপন খবরের উজান বইতে শুরু করেছে। কে আছে এর মূলে? পর্ণাকে সন্দেহ করতে মন সরে না। সে এখন পুরোপুরি আমার এক্তিয়ারে। সে আমাকে ভালবাসে। গৌতমের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে আরও ঘনিয়ে এসেছে আমার কক্ষপুটে। কুমারী মেয়ে যখন কাউকে ভালবাসে তখন তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। যতদিন না আমার কাছ থেকে প্রতিহত হচ্ছে ততদিন সে এ কাজ করবে না।

তাহলে কে?

অনেক চিন্তা করে শেষ সিদ্ধান্তে এলাম অবশেষে। আমি ছাড়া এ সব গোপন খবর আর আর একটি মাত্র প্রাণী জানতেন। তিনি শম্ভুচরণবাবু। বাবার আমলের লোক। তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করেছিলাম। তাকে সন্দেহ করাও অত্যন্ত কঠিন। তবু তাই করতে হল। জানতে পারলাম, আমাদের এমন কয়েকটি গোপন খবর বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে যা আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না। পর্ণাও নয়! শম্ভুবাবু নিজেই সে সব চিঠি টাইপ করেছেন—স্টেনোর মাধ্যমে ছাপা হয়নি সেগুলো। চিঠিগুলি যে কনফিডেনশিয়াল ফাইলে থাকে তার চাবি অবশ্য মাঝে মাঝে পর্ণাকে দিতে হয়েছে কিন্তু সে ফাইল পর্ণা পড়ে দেখেনি নিশ্চয়।

অগত্যা চরম অপ্রিয় কাজটা করতে হল শেষ পর্যন্ত। বরখাস্ত করলাম শম্ভুবাবুকে। ভদ্রলোক বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন অর্ডারখানা হাতে করে। আমাকে তিনি খোকা বলে ডাকতেন বাবার আমলে। এখনও অবশ্য স্যার বলেন না—মুখার্জি-সাহেব বলেন।

বিহ্বলের মতো বললেন-এ কথা তুমি বিশ্বাস কর?

গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম—দেখুন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। এটা জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধান্তের মত, প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বোম্বাইয়ের ডীলটা আপনাতে-আমাতে হয়েছে। লং-হ্যান্ড-এ সমস্ত করেসপন্ডেন্স আমি লিখেছি, টাইপ করেছেন আপনি। তৃতীয় কোনো লোকের এ খবর জানার কথা নয়। সুতরাং এ খবর লিক হলে দায়ী হবেন হয় আপনি, নয় আমি। যেহেতু আমি মালিক এবং ক্ষতিটা আমার, তাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেকে না। কিন্তু আপনি? বায়রনের ভাষায় দেয়ার ইজ নো ট্রেটর লাইক হিম হুজ ডোমেস্টিক ট্রিসন প্ল্যান্টস্ দ্য পনিয়ার্ড উইদিন দ্য ব্রেস্ট দ্যাট ট্রাস্টেড টু হিজ টুথ। বুঝলেন?

শম্ভুবাবু জবাব দিতে পারেননি। জবাব ছিল না যে। তখন নিজে থেকেই বললাম—আপনি কোম্পানির যে ক্ষতি করেছেন তাতে আপনার প্রতি কোনো করুণা দেখানোর কথা নয়। তবু আপনার পাস্ট সার্ভিসের কথা মনে করে আপনাকে এক মাসের বেতন দিয়ে দিচ্ছি। কাল থেকে আপনি আর আসবেন না অফিসে। য়ু আর ডিসমিসড়।

ভেবেছিলাম নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে অফিসটাকে। শম্ভুবাবুর মত কর্মদক্ষ বিশ্বাসী লোক জোগাড় করা কঠিন–তবু ডান হাতেও যখন গ্যাংগ্রিন হয়, মানুষ তাও তো কেটে ফেলে।

ছোটাছুটি বেড়ে গেল। মাথার ওপর খঙ্গ ঝুলছে। শত্রুপক্ষের হাতে ট্রাম্পকার্ডখানা চলে গেছে। নিশ্চয়ই এখনও তা সরকারি মহলে পৌঁছায়নি। না হলে এনফোর্সমেন্ট পুলিস এতক্ষণে হানা দিত আমার অফিসে। নিশ্চয়ই ও পক্ষ একবার ব্ল্যাকমেইলিং করবার চেষ্টা করে দেখবে খবরটা পেশ করার আগে। তাই তার আগেই ছুটে এসেছি বর্ধমানে। বড়কর্তাদের কাছে আগেভাগে সাফাই গেয়ে রাখলে যদি কিছু হয়। শুনলাম, সরকারি বড়কর্তা বর্ধমানে এসেছেন ইন্সপেকশনে, উঠেছেন সার্কিট হাউসে। তাই আমিও ছুটে এলুম এতদূর।

কিন্তু সে চেষ্টাও সুবিধের হল না। বড়কর্তার সময়ই হল না।

বর্ধমানের উত্তরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে একটা বিস্তৃত জমি নাইন্টিনাইন ইয়ার্স লিজ নিয়েছি আজ বছরচারেক। ইচ্ছা ছিল এখানে নতুন একটি কারখানা গড়ে তুলব। ফরেন এক্সচেঞ্জ জোগাড় করতে পারিনি—নানান তালে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে সে পরিকল্পনা। শুধু জমিতে প্রবেশ করবার মুখে এই ছোট্ট বাংলো বাড়িটি বানিয়েছি। বর্ধমানে এলে আমি এখানেই উঠি। এবারও তাই উঠেছি।

কাল বিকেলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সারাদিন খাটাখাটনিতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি। গাড়িতে ক্লান্তিনাশক ঔষধাদি আমার বরাবরই থাকে। ড্রাইভার যোর্গীন্দর সিং সেগুলো নামিয়ে দিয়ে গেল। জুত করে বসেছি, এমন সময় এখানকার দারোয়ান এসে খবর দিল, কয়েকজন লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। প্রথমটা অবাক হলুম। এখানে কে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবে? যাই হোক তাদের ডেকে পাঠালুম।

তিনজন লোক এলেন দেখা করতে। ভদ্রলোক বলা ঠিক হবে না। অথচ ঠিক ছোটলোকও নয়। ময়লা জামা-কাপড় পরা, অথচ পায়ে জুতো অথবা চটি। কে এরা? বসতে বলব কি না স্থির করবার আগেই দেখি ওরা দিব্যি জাঁকিয়ে বসল।

-কী চাই? জানতে চাইলাম আমি।

মুখপাত্র হিসাবে যে ছোকরা কথা বলল তার বয়স অল্প। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। পরনে পায়জামা, গায়ে চুড়িদার পাঞ্জাবি, চুলগুলো অবিন্যস্ত, মুখে বসন্তের দাগ। বললে—আপনার সঙ্গে কিছু গোপন কথা ছিল।

বলি, এর চেয়ে নির্জন স্থান আমার জানা নেই, কিন্তু কে আপনারা?

ছোকরা পরিচয় দিল। নিজের নয়, পার্শ্ববর্তী লোকটির। তাকিয়ে দেখলাম তার দিকে। বছর পঞ্চাশ বয়স, চিবুকে ছোট্ট নূর, চোখে গগলস এই ঘরের ভেতরেও। শুনলাম তার নাম আবদুল গণি। তিনি নাকি বানপুর অঞ্চলের নামকরা শ্রমিক নেতা।

ভদ্রলোক হাত তুলে আমাকে নমস্কার করে বলেন–আপনার সঙ্গে কখনও পরিচয় হয়নি, কিন্তু আপনার নাম শুনেছি। আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা যেতুম; কিন্তু আপনি এখানে এসেছেন শুনে এখানেই এলুম।

বলি, সে প্রসঙ্গ তো হল—কিন্তু কেন এসেছেন সেটা তাড়াতাড়ি বলে ফেললেই ভাল হয় না?

ছোকরা বললে, আপনার যেন একটু তাড়াতাড়ি আছে মনে হচ্ছে স্যার?

বলি, তা আছে। আপনাদের যা বক্তব্য তাড়াতাড়ি সেরে নিলেই আমি খুশি হব।

মিস্টার গণি বলেন, খুব সংক্ষেপেই সেরে ফেলি তাহলে। প্রথম কথা, আপনার কারখানার শ্রমিকদের কোনও য়ুনিয়ান নেই; কিন্তু তারা আমাদের শ্রমিক য়ুনিয়ানের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড হতে চায়–

আমি হেসে বলি, ব্যাপারটা তো বুঝলাম না। আমাদের কারখানায় য়ুনিয়ান থাকলে তারা অন্য কোথাও অ্যাফিলিয়েশন চাইতে পারত—কিন্তু যার মাথা নেই সে কেন মাথাব্যথার ওষুধ খুঁজতে আসবে?

গণি বলেন, ওরা মাথাব্যথার ওষুধ খুঁজতে আমাদের কাছে আসেনি, মাথা খুঁজতেই এসেছে। ওদের ঘাড়ের ওপর যে মাথা আছে এটা আপনাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতেই আমাদের সাহায্য চাইছে।

বাধা দিয়ে বলি, এ সব আলোচনা আমি আপনাদের সঙ্গে করতে চাই না। আমার কারখানায় য়ুনিয়ান নেই বটে, কিন্তু তাদের মুখপাত্রদের ডেলিগেশনের বক্তব্য আমি শুনেছি। তাদের আর কোনো বক্তব্য থাকলে তারাই জানাবে। আপনাদের কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।

গণি একটু হেসে বলেন, মিস্টার মুখার্জি, তবু আমাদের বক্তব্যটা আপনাকে শুনতে হবে। তাতে আপনারই মঙ্গল।

বিরক্ত হয়ে বলি, প্লীজ মিস্টার গণি, আপনারা এবার উঠুন। আপনাদের প্রতি দুর্ব্যবহার আমি করতে চাই না, কিন্তু আমাকে বাধ্য করবেন না আপনারা। আমি এখন বিশ্রাম করতে চাই।

মিস্টার গণি বলেন, যে জন্যে আপনি বর্ধমানে ছুটে এসেছেন আমরা কিন্তু সেই বম্বে ডীলটার বিষয়েই আলোচনা করতে এসেছি!

আমার মুখে কথা ফোটেনি।

গণি দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন, বলেন—কী বলেন? বিশ্রাম করবেন, না আলোচনা করবেন?

মনস্থির করে নিয়ে একটু বিস্ময়ের ভান করে বলি, কোন বম্বে ডীল? কিসের কথা বলছেন আপনি?

গণি আবার বসে পড়েছিলেন। আমার বিস্ময় প্রকাশের অভিব্যক্তিতে কৌতুক বোধ করে বলেন—ও হো, আপনার মনেই পড়ছে না বুঝি? আই সী! তা হবে। হয়তো এ জাতীয় কারবার প্রতি সপ্তাহেই একটা-দুটো করছেন, তাই মনে পড়ছে না। আচ্ছা একটু রেফারেন্স দিলেই মনে পড়বে। আপনার কনফিডেন্সিয়াল ফাইল নম্বর xiv/64 থেকে গত মাসের তেশরা 713/Con/xivL64 নম্বরে যে চিঠিখানা ইন্সিওার্ড ডাকে ইস্যু করা হয়েছে, সেইটির কথা বলছি আমি। যে চিঠির জন্যে আপনি আপনার বাপের আমলের কর্মচারী শম্ভ দত্তকে বরখাস্ত করেছেন। একটু একটু মনে পড়ছে এবার?

আপাদমস্তক জ্বালা করে ওঠে। মুহূর্তে স্থির করি কী করব। অস্বীকারই করতে হবে। এরা হয়তো কিছুই জানে না, শুধু কোনো সূত্রে হয়তো নম্বরটা জানতে পেরেছে। গম্ভীর হয়ে বলি–মিস্টার গণি, আপনার সঙ্গে পাগলামো করার সময় আমার নেই। আপনারা যেতে পারেন।

ভদ্রলোক ধীরে ধীরে ফোলিও ব্যাগ খুলে একখণ্ড কাগজ আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলেন— হস্তলিপি-বিশারদ যখন কোর্টে বলবেন এ-লেখা মিস্টার অলক মুখার্জির, তখন তাঁকেও কি পাগল বলবেন আপনি?

স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। আমার লং-হ্যান্ড-এ লেখা চিঠিখানির ফটোস্টাট কপি! সর্বনাশ!

–ভুল এভাবেই হয় মুখার্জি-সাহেব! টাইপ হয়ে যাবার পর টাইপড় ডুপ্লিকেটখানা ফাইলে রেখে অরিজিনালখানা ছিঁড়ে ফেলা উচিত ছিল আপনার। দেখুন দেখি কাণ্ড! কোনো কর্মচারীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও জেলের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আর উপায় রাখেননি!

মাথার মধ্যে সমস্ত গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

–সরকার আপনাকে কন্ট্রোল্ড কমোডিটিজের পারমিট দিচ্ছে আপনার ফ্যাক্টরীর জন্যে। বম্বের কালোবাজারি মহাজনের কাছে তা বেচে দেবার জন্য নয় নিশ্চয়!

কী বলব ভেবে পাই না।

গণি ঘনিয়ে আসেন—দেখুন স্যার, ব্ল্যাকমেলিং করতে আমরা আসিনি। আপনার ফ্যাক্টরীর কোন লোক এ সব কথা আপনাকে বলতে এলে লজ্জায় আপনার মাথা কাটা যেত। তাই তাদের হয়ে আমরাই কথাবার্তা বলতে এসেছি। ওদের ন্যায্য দাবিদাওয়াগুলো মেনে নিলে এ সম্বন্ধে আর কোনো উচ্চবাচ্য হবে না।

আর ইতস্তত করে লাভ নেই। বলি-বেশ, কিন্তু এখানে তো সে সব কথা হতে পারে না। আপনারা কাল আমার সঙ্গে অফিসে দেখা করুন। সেখানেই যা হয় স্থির করা যাবে।

—এটা শুভ প্রস্তাব। আশা করি কেমন করে এ চিঠি বেরিয়ে গেছে তা নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন আপনি।

একটু রুক্ষস্বরে বলি, এটা আপনার পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না মিস্টার গণি?

–আচ্ছা, তবে ও প্রসঙ্গ থাক।

ওরা উঠে পড়ে। নমস্কার করে বিদায় নেয়। যাবার আগে বলে—কাল কটার সময় ফ্রি থাকবেন আপনি? এ সব কথা তো আবার সর্বসমক্ষে–

বাধা দিয়ে বলি–কাল সন্ধ্যা সাতটায়। অফিসেই।

–আচ্ছা, নমস্কার।

ওরা চলে যেতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত একটা কথা মনে হল আমার। ভুল করেছি আমি। শম্ভুবাবু নয়। অন্য কেউ। যার মাধ্যমে এ চিঠি অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে সে এখনও আছে আমার কারখানায়। না হলে আবদুল গণি কেন ব্যস্ত হয়ে উঠবে ও বিষয়ে? কেমন করে এ খবর বেরিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে আমি অনুসন্ধান চালালে ওর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার কী আছে,—যদি অপরাধী হন শম্ভুচরণবাবুই?

শম্ভুচরণ দত্ত নয়,–সর্বনাশী মিস্ পর্ণা রয়!

সমস্ত শরীরে আগুন ধরে গেল। হাতঘড়িতে দেখলাম বিকেল পাঁচটা। আজ রাত্রেই এর ফয়শালা করতে হবে। তৎক্ষণাৎ যোগীন্দর সিংকে ডেকে পাঠালাম।নির্দেশ দিলাম কলকাতা চলে যেতে। পর্ণাকে নিয়ে আসতে বললাম। অফিসে একটা ট্রাঙ্ককল করে বলে দিলাম মিস্রয়ের বাড়িতে খবর পাঠাতে। সে যেন তৈরি হয়ে থাকে। অত্যন্ত জরুরি দরকার। গাড়ি যাচ্ছে, সে যেন তাতে চলে আসে।

হিসাব করে দেখলাম রাত দশটা নাগাদ ফিরে আসবে গাড়ি। কিন্তু আসবে তো পর্ণা? সে কি আন্দাজ করেনি যে, আমি সব খবর পেয়ে গেছি? এ ভাবে তাকে ডেকে পাঠানোর উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই সে অনুমান করতে পারবে। সেই যদি অপরাধী হয় তাহলে সে নিশ্চয় জানে যে, আজ এখানে আমার কাছে আবদুল গণি আসবে প্রস্তাব নিয়ে। তারপরেই যদি আমি গাড়ি পাঠাঁই, তখন সে নিশ্চিত বুঝতে পারবে আমার উদ্দেশ্য কী। কোনো একটা অছিলা করে সে সরে দাঁড়াবে। হয় তাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না, অথবা তার শরীর খারাপ হবে কিংবা–আচ্ছা পর্ণার হোম-অ্যাড্রেস যা কোম্পানির খাতায় দেওয়া আছে সেখানে সে থাকে তো? এজাতীয় মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব।

বেশ বুঝতে পারছি মাত্রাতিরিক্ত পান করা হয়ে গেছে। এ বোধ ঠিকই আছে যে, আজ রাত্রে আমার পক্ষে মাতাল হওয়া মারাত্মক; মাথা ঠিক রাখা দরকার। কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে সামলাতে পারি না। একটানা ঘড়ির টিকটিক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই বিশ্বচরাচরে। মাঝে মাঝে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে দ্রুতগামী মালবোঝাই লরী চলেছে। ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়েছি। রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো যাবার সময় যখন বাঁক ঘুরছে তখন হেডলাইটের ক্ষণিক আলোয় মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে ঘরের ভেতরটা—খোলা জানলা দিয়ে আসছে ওদের আলোর আক্রোশ!

পর্ণার সঙ্গে বোঝাপড়ার আজকেই শেষ!

পর্ণা যদি অলক মুখার্জির চরম সর্বনাশ করে থাকে তাহলে পর্ণা রায়কেও আজ রাত্রে কেউ চরম সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।

ক্রমশ রাত বাড়ছে।

মাঝে একবার এখানকার বেয়ারাটা খবর নিতে এল নৈশ আহার দিয়ে যাবে কিনা। আমার কিন্তু খাবার চিন্তা মাথায় উঠেছে তখন।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ গাড়ি ফিরে আসার আওয়াজ পেলুম।

উত্তেজনায় স্থির থাকতে পারি না। বেরিয়ে আসি বাইরের বারান্দায়। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।

যোগীন্দর সিং নেমে এল গাড়ি থেকে। আর কেউ আসেনি।

সেলাম করে একটি খাম এগিয়ে দিল সে।

ছোট্ট চিঠি। পর্ণা লিখেছে–মধ্যরাত্রে বসের বাগানবাড়িতে যাবার কথা নেই তার চাকরির শর্তে। তাকে যেন আমি ক্ষমা করি।কাল সকালে সে আসছে। গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই। সকাল নটার মধ্যে সে ট্রেনেই এসে পড়বে। আমি যেন তার জন্য এখানেই অপেক্ষা করি।

আবার স্বীকার করতে হল অত্যন্ত ধূর্ত মেয়ে ঐ পর্ণা রায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *