অলকনন্দা – ৬

পরশু উৎসব। ভাদ্রের ভরাগঙ্গায় শেষ দিনটির জোয়ার আসতে আর তিন দিন বাকি। কাল থেকে ও বাড়ি ফেরেনি। যা আশঙ্কা করেছিলাম। শ্রমিক-মহলের ধূমায়িত অসন্তোষ হঠাৎ বিস্ফোরণের রূপ নিয়েছে। বেআইনি কাজ করেছে ওরা। মরবে ওরাই। বিনা নোটিসে ধর্মঘট শুরু করেছে হঠাৎ। শেষ সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করেছে অলক। তা তো করবেই।

ধর্মঘট আজ তিন দিনের শিশু!

কালও কোনোরকমে কাজ চলেছিল। আজ নাকি বয়লারে আগুন পড়েনি। রামলালের কাছে যা শুনলাম তা ভয়াবহ ব্যাপার। সমস্ত দিন স্তব্ধ গাম্ভীর্যে কারখানাটা যেন অপেক্ষা করে আছে–কালবৈশাখীর পূর্বাহে যেন বিশাল বনস্পতির মৌনতা।

কাল থেকে অলক বাড়ি ফেরেনি। কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। যত কাজই থাক, রাতটা সে বাড়িতেই কাটায়। কাল গেছে একটা ব্যতিক্রম। টিফিন-ক্যারিয়ারে করে অফিসেই খাবার পৌঁছে দিয়ে এসেছে রামলাল। রাত্রে কেন ফিরলনা বুঝতে পারছি না। সারাটা রাত কী এমন কাজ থাকতে পারে? আজ সমস্ত দিনে পাঁচবার টেলিফোন করেছি। প্রতিবারেই শুনতে হয়েছে বড়সাহেব অফিসে নেই। অফিসে নেই তো কোথায় আছেন? সন্ধ্যাবেলায় আবার একবার ফোন করলাম—সেই একই জবাব—সরি, মিস্টার মুখার্জি এখন অফিসে নেই।

-কোথায় আছেন তিনি?

—বলতে পারছি না।

বিরক্ত হয়ে বলি-আপনি কে কথা বলছেন?

যেন প্রতিধ্বনি হল-আপনি কে কথা বলছেন?

ধমক দিয়ে উঠি–আমি মিসেস মুখার্জি, আপনি কে?

ধীরে ধীরে ওপাশ থেকে ভেসে এল-আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি মিস্টার মুখার্জির স্টেনো। মিস্টার মুখার্জিকে এখন পাবেন না।

কানে কে যেন সীসে ঢেলে দিল। টেলিফোনের এক প্রান্তে সুনন্দা মুখার্জি, অপর প্রান্তে পর্ণা রায়। মনে হল, ও যেন বলতে চায় অলককে আমি পাব কি না পাব তা নির্ভর করছে ওর মর্জির ওপর। আমি যেন একটা ভিক্ষা চাইছিলাম ওর কাছে–সেটাই প্রত্যাখ্যান করছে ও, স্পষ্ট ভাষায় বলছে-মিস্টার মুখার্জিকে এখন পাবেন না। মনে হল কথাটার মধ্যে প্রচণ্ড বিদ্রুপ আছে–কণ্ঠস্বর অনুসারে যেন ভাষাটা হওয়া উচিত ছিল-মিস্টার মুখার্জি কি আমার বাঁধা গরু, যে আঁচল খুলে দিলেই আপনার খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকবে?

ভীষণ একটা কড়া জবাব দিতে গেলাম। কী স্পর্ধা মেয়েটার, লাইন কেটে দিয়েছে।

সমস্ত সন্ধ্যাটা ছটফট করতে থাকি। সময় যেন আর কাটে না। সন্ধ্যার ডাকে এল একখানা চিঠি। হাতের লেখা অপরিচিত। ইচ্ছে করছে না খুলতে। মাথা ধরেছে আজ। কিন্তু হাতেও কোনো কাজ নেই। গল্পের বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না। শেষপর্যন্ত খুলেই ফেললাম চিঠিখানা। আদ্যন্ত পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! চিঠি লিখেছে গৌতম। লিখেছে :

তোমার পাঠানো প্রফ পেলাম। বলেছিলে, আবার একদিন আসবে। এলে না। ভালই করেছ। যে কথা আজ চিঠিতে লিখছি, তা বোধহয় তোমার মুখের ওপর বলতে পারতুম না। তুমি বোধহয় খুব অবাক হয়ে গেছ আমার চিঠি পেয়ে, নয়? কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি জানতে না যে, আমি জানতুম-তোমার বর্তমান ঠিকানা। তোমার পরিচয়। অনেক দিনই জানি!

সেদিন তোমাকে দেখে যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম–তার কারণ শুধু এই। আমি ভাবছিলুম —ক্যাপিটালিস্ট অলক মুখার্জির স্ত্রী এ-বেশে, এ-ভাবে কেন এসেছেন আমার দ্বারে।

বারে বারে তা আমি জানতে চেয়েছিলুম। বারে বারে তুমি মিছে কথা বলেছিলে।

আমি তখন ভাবছিলাম—তোমার এই অদ্ভুত আচরণের দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত তুমি এসেছিলে অলকবাবুর স্বার্থে। হয়তো তারই নির্দেশে এসেছিলে জানতে আমাদের কাগজের কথা। আমাদের আগেকার একটি সংখ্যার গ্যালি প্রুফ চুরি যায়। তাতে তোমার স্বামীর প্রভূত সুবিধা হয়েছিল। সেই জন্যই তোমাকে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বাস কর সু (এ নামে এই শেষ বার সম্বোধন করলুম তোমাকে, মাপ কর আমাকে) এ কথা মনে করতে সেদিন রীতিমতো কষ্ট হয়েছে আমার। যে মেয়েটির সঙ্গে একসঙ্গে রাত জেগে পোস্টার লিখতুম কলেজ জীবনে, স্বপ্ন দেখতুম পুঁজিবাদীদের শোযণের বিরুদ্ধে কাগজ বার করব বলে—সেই মেয়েটিই আসবে বন্ধুর বেশে বিশ্বাসঘাতকতা করতে–এটা ভাবতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল আমার। তোমার স্বামী এবং আমি আজ ঘটনাচক্রে বিপক্ষ শিবিরে; তবু আমি ভাবতেই পারি না, তুমি আমার স্বার্থে তোমার স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পার, অথবা তার স্বার্থে আমার সঙ্গে।

তাই কিছুতেই ও কথাটা মেনে নিতে পারিনি।

সেদিন আমার স্ত্রীর কথা আলোচনা করিনি, আজ করছি। ঘটনাটা সমস্ত খুলে বলেছি আমার স্ত্রীকে। তাঁর বিশ্বাস, তুমি এসেছিলে শুধু ঐ কারণেই। শাঁখা-সিঁদুর সম্বল করে তুমি গুপ্তচরের বৃত্তিতে নেমেছিলে!

দেখ, স্পাই কথাটা শুনলেই কেমন যেন লাগে। তবু একটা আদর্শের জন্য, নিঃস্বার্থ দশের মঙ্গলের জন্য যখন মানুষ এই আপাতঘৃণ্য বৃত্তিতে নামে তখন তাকে ঘৃণা করা যায় না। স্বাধীনতা সংগ্রামের শত শহীদদের আমরা স্মরণ করি, কিন্তু আমি একটি মেয়েকে জানি যে বিপ্লবীদের পালিয়ে যাবার সুযোেগ দিতে স্বেচ্ছায় আত্মদান করেছিল দারোগাবাবুর কাছে। এক রাত আটকে রেখেছিল সেই নারীমাংসললালুপ পশুটাকে। স্বাধীনতার পরে যারা জেলে আটক ছিল তারা গদি পেল, পারমিট পেল, চাকরি পেল-পেল খেতাব আর সম্মান; কিন্তু ঐ একটি রাত যে হতভাগী দারোগাবাবুর ঘরে আটকে ছিল সে ঘর পেল না, বর পেল না-মা ডাক শুনল না জীবনে। তাকে ঘৃণা করি এত বড় নীতিবাগীশ

আমি নই?

কিন্তু আমার আশঙ্কা যদি সত্য হয়, তাহলে তোমাকে তো সে সম্মান দেওয়া যাবে না সু। তাই আজও বিশ্বাস করতে পারছি না–সেদিন তুমি এসেছিলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবার সদিচ্ছা নিয়ে।

আর একটি সমাধান হতে পারে এ সমস্যার। তুমি সেদিন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ছুটে এসেছিলে আমার কাছে অন্য এক প্রেরণায়। সেটা সামাজিক কারণে অন্যায় কি না জানি না। তবু হাজার বছরের কাব্য-সাহিত্য আমাদের শিখিয়েছে একে ক্ষমা করতে। প্রেম এমন একটা জিনিস যাতে অমার্জনীয় অপরাধেরও ধার ক্ষয়ে যায়। বিশ্বাস কর সু, আমি বিশ্বাস করেছিলুম—তুমি তারই প্রেরণায় ছুটে এসেছিলে আমার কাছে,তোমার স্বামীকে লুকিয়ে, তোমার পরিচয় গোপন করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। সে বিশ্বাসটুকুও তুমি আমাকে আঁকড়ে থাকতে দিলে না। তুমি দ্বিতীয়বার এলে না আমার সেই ভাঙা অফিস ঘরে। ডাকের সাহায্যে শুধু আমার কাগজের প্রুফ পাওয়াতেই তোমার আগ্রহ দেখলুম। তাই এই চিঠি।

সেদিন তুমি প্রশ্ন করেছিলে, আমার বউ পছন্দ হয়েছে কিনা। তখন জবাব দিইনি, এখন দিচ্ছি। হ্যাঁ, দাম্পত্যজীবনে আমি পুরোপুরি সুখী। তোমার সব কথা তাকে খুলে বললুম, এ চিঠিও দেখিয়েছি তাকে।

তুমিও ইচ্ছে করলে অলকবাবুকে আমার চিঠি দেখাতে পার।

ঈশ্বর তোমাকে শান্তি ও সুমতি দিন। –ইতি

অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। ইচ্ছা করছে কাচের ডিনার সেটটা আছড়ে আছড়ে ভাঙি! হেরে গেছি, একেবারে নিঃশেষে হেরে গেছি। এরপর আর লোকসমাজে মুখ দেখাব কেমন করে? লোকসমাজে কেন–আয়নার সামনে দাঁড়াব আর কোন লজ্জায়? ঘরে-বাইরে দাঁড়াবার যে একটুখানি ঠাঁইও আমার রইল না। এমন অবস্থাতে পড়লেই কি মানুষ আত্মহত্যা করে বসে?

না। আত্মহত্যা আমি করব না। কিছুই খোয়া যায়নি আমার। অলককে বলব, লম্বা ছুটি নাও। চল, আমরা দুজনে কিছুদিনের জন্যে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। পর্ণার নাগপাশ থেকে ওকে উদ্ধার করতে হবে। পর্ণাকে তাড়াতে হবে ওর অফিস থেকে, ওর জীবন থেকে। কিন্তু!

পর্ণাকে ওর জীবন থেকে তাড়াতে পারলেই কি সব সমস্যার সমাধান হল? আজ যে আমি ঐ সঙ্গে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছি। সুন্দরী স্ত্রীর একান্ত প্রণয় উপেক্ষা করে অলক যদি মরীচিকার পেছনে ছুটে থাকে তো তাকে দোষ দেব কেমন করে? আমিও তো ঐ পাপে পাপী! আমিও গৌতমের প্রেসে গিয়ে হাজির হয়েছিলুম ঐ একই প্রেরণায়। আমার মনে হয়েছিল, অলক যে সুনন্দার প্রেমে মুগ্ধ হয়েছে সে সুনন্দা আমার আমি নয়—সে একটা রক্ত-মাংস-চামড়ায় গড়া পুতুল। সে পুতুলটাকে আমি চিনিমাত্র। সে আমি নই। সে পুতুলটা সাজতে ভালবাসে, সাজাতে ভালবাসে, রোজ সন্ধ্যাবেলায় মাথায় গোলাপ ফুল গুঁজে সে কফির পেয়ালা হাতে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। জোলো প্রেম করে। সে কেক বানায়, উল বোনে, সামাজিক পার্টি-ডিনারে হাজিরা দেয়, অলক মুখার্জির স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করে। কিন্তু সে তো পুরোপুরি আমি নই। আমার মধ্যে যে সত্যিকার নারীসত্তাটা আছে তাকে তো অলক মুখার্জি কোনদিন ঘোমটা খুলে দেখবার চেষ্টা করেনি। সে-আমি যে প্রেমের ভরা বন্যায় নিঃসম্বল যাত্রায় প্রেমিকের হাত ধরে যাত্রা করতে রাজি; সে-আমি যে দয়িতের জন্য সব কৃসাধন হাসিমুখে স্বীকার করতে উন্মুখ। অলক মুখার্জি তো সে-আমিকে চিনবার চেষ্টা করেনি,—সে সুযোগও পায়নি সে। আমার সেই সত্তাই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঐ গৌতমের ছাপাখানার অফিসে। হ্যাঁ, আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার তখন মনে হয়েছিল, পারলে ঐ গৌতমই পারবে আমার সে প্রেমের মর্যাদা মিটিতে দিতে। ঠিকই ধরেছে সে। আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাইনি তার দ্বারে। আমি গিয়েছিলাম সেই প্রেরণায় যে প্রেরণাতে শ্রীরাধিকা ঘর ছেড়েছিলেন। কিন্তু সে কথা কোনোদিন জানতে পারবে না গৌতম; আমি নিজের কাছেও সে কথাটা এই মুহূর্তের আগে স্বীকার করিনি।

গৌতম লিখেছে, দাম্পত্য জীবনে সে সুখী! কেন লিখেছে? সেটা তো মিছে কথা। আমাকে আঘাত দেবার জন্যই লিখেছে। ভেবেছে, সে সুখী, একথা শুনলে আমি ঈর্ষার জ্বলে-পুড়ে মরব। কারণ তার বিশ্বাস, আমি তার কাছে গিয়েছিলাম শুধু বিশ্বাসঘাতকতা করতে। তার প্রতি ভালবাসার টানে নয়। এও তোমার ভুল, গৌতম। সে ভুল ভেঙে দেবার সুযোগও আমার আছে। কিন্তু তা আমি দেব না। তুমি সুখীই থাক। তোমার সুখেই আমার সুখ। উঃ! মাথার যন্ত্রণাটা আবার বাড়ছে।

চাকরটা এসে খবর দিল শম্ভুচরণবাবু এসেছেন।

শম্ভুবাবু আমার শ্বশুরের আমলের মানুষ।কারখানায় অলকের ডানহাত। শুনেছি আমার শ্বশুর যখন ফাঁকা মাঠের মাঝখানে এই কারখানা খুলবার স্বপ্ন দেখেন তখন সকলে তাকে বারণ করেছিল। এই শম্ভুচরণ তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বন্ধু ছিলেন দুজনে। তারপর অবশ্য শম্ভুচরণ বন্ধুর অধীনেই কাজ নেন। সেই অবধি তিনি রয়ে গেছেন এ কারবারে। অলক অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে তাকে। কর্মচারী হলেও তিনি যে পিতৃবন্ধু এ কথাটা আমার স্বামী ভুলতে পারে না। প্রতি বছরই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে তিনি এভাবে বাড়িতে এসেছেন বলে মনে পড়ে না

নেমে এলাম বাইরের ঘরে।

আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন শম্ভুবাবু। আমি তাড়াতাড়ি তার সম্মুখের সোফাটায় বসে বলি—কী খবর শ্যুকাকা, হঠাৎ এত রাতে?

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বলেন–মায়ের বিশ্রামের কি ব্যাঘাত ঘটালুম?

আমি বলি—মোটই না; কিছু জরুরি খবর আছে মনে হচ্ছে?

–তা আছে। কিন্তু তার আগে একটা কথা মা। আমাদের কথাবার্তা কি আর কেউ শুনতে পাচ্ছে?

আমি উঠে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এলাম। তার কাছে ফিরে এসে বসি; বলি–এবার বলুন।

বৃদ্ধ টাকের ওপর হাত বুলিয়ে আমতা আমতা করে বলেন–তোমাকে সব কথা খুলে বলব বলেই এসেছি মা।—কিন্তু স্বীকার করছি-সঙ্কোচও হচ্ছে একটু। তুমি কিছু মনে করবে না তো?

আমি বলি—মনে করার মত কথা না বললে, মনে করব কেন?

—কিন্তু মনে করার মতো কথাই যে বলব আমি, মা।

–তা হলেও বলুন।

আবার একটু ইতস্তত করে বলেন–আমার বরখাস্ত হয়ে গেছে, শুনেছ বোধকরি। চমকে উঠি আমি।বলি, কই, না?

—অলক তাহলে তোমাকেও কিছু বলেনি দেখছি।

—না। কিন্তু হঠাৎ আপনাকে বরখাস্ত করার কারণ?

—সেটাই বলতে এসেছি। সঙ্কোচও সেইজন্য। প্রথমত এ কথা ঠিক, এ বৃদ্ধ বয়সে আমার পক্ষে বিকল্প চাকরি জোগাড় করা অসম্ভব। সংসারে তোমার কাকিমা ছাড়াও আমার একটি বিধবা মেয়ে আছে। তাদের কেমন ভাবে খাওয়াব-পরাব জানি না।

বুঝতে পারি, সেইজন্য দরবার করতে এসেছেন উনি। এ সব ক্ষেত্রে সচরাচর আমি নাক গলাই–জানি, আমার স্বামী কখনও কোনো অন্যায় করেন না। এক্ষেত্রেও না জেনেও আমি স্থির-নিশ্চয়–নিশ্চিত শম্ভুচরণবাবু এমন কোন অপরাধ করেছিলেন যার ক্ষমা নেই। নাহলে কারখানার শৈশবাবস্থা থেকে যে কর্মচারী এর সঙ্গে যুক্ত, যে ওর পিতৃবন্ধু, যার চাকরি যাওয়া মানে একটি পরিবারের নিশ্চিত অনশন-মৃত্যু–তাকে এভাবে পদচ্যুত করত না অলক। সে জাতের মানুষ নয় আমার স্বামী।

বৃদ্ধও সেই কথাই বলেন। বললেন–তোমার জানার কথা নয় মা, তোমার শ্বশুর জানতেন সে সব কথা। অলক তখন বিলাতে। লেখাপড়া করছে। তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন মারা গেলেন। তখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ চলছে—অলক আসতে পারল না। আমাকেই সব কাজ করতে হল। অলকের বাবা শুধু আমার অন্নদাতাই ছিলেন না–তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। স্ত্রী-বিয়োগের পর তিনি বোধহয় মাসছয়েক কারখানায় বার হননি। চাবিকাঠি পর্যন্ত ধরে দিয়েছিলেন এই বুড়োর হাতে। আমি পরলোকে বিশ্বাস করি মা;–আমি জানি, ওপর থেকে তিনি দেখেছেন আমি নিমকহারামি করেছি কিনা!

কোঁচার খুঁট দিয়ে চোখটা মোছেন উনি।

বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কিন্তু আপনাকে বরখাস্ত করার কারণ তো কিছু একটা আছে?

গলাটা সাফ করে নিয়ে তিনি বলেন–তা আছে। আমাকে অলক আর বিশ্বাস করে না। আমি নাকি বিশ্বাসঘাতক।

আমাকে চুপ করে থাকতে হয়।

বৃদ্ধ আপনমনেই বলতে থাকেন—-কারখানার কিছু গোপন খবর বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। সব কথা তোমাকে বলতে পারব না আমি। কিন্তু সে সব খবর অলক আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। জানার কথা নয়। তাই ও মনে করে–

মাঝপথেই থেমে পড়েন উনি। আমি পাদপূরণ করে দিই—সেটা কি অস্বাভাবিক? আপনিই বলুন? বৃদ্ধ চোখ দুটি আমার মুখের ওপর তুলে বলেন—হা অস্বাভাবিক। এতে আর্থিক ক্ষতি অবশ্য আমার নয়, অলকের। কিন্তু এতে অলক যতটা আঘাত পেয়েছে তার অনেক বেশি পেয়েছি আমি! এ যে আমার নিজে হাতে গড়া কারখানা, মা।

আমি বললাম—কিন্তু, আপনি তো নিজেই বলছেন যে, আপনারা দুজন ছাড়া সে সব খবর আর কেউ জানতনা। দ্বিতীয়ত, আপনাদের শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই এ খবরগুলো উচ্চমূল্যে সংগ্রহ করতে রাজি, নয় কি?

–তা তো বটেই!

–তবে আর অলককে কী দোষ দেব? সে তো ঠিকই করেছে। আমি তো আপনার হয়ে কোনো সুপারিশ করতে পারব না।

বৃদ্ধ একটু সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন—তুমি আমায় ভুল বুঝেছ, মা। আমি তোমার কাছে দরবার করতে আসিনি। তুমি আমার হয়ে সুপারিশ কর, এ কথা বলতেও আমি আসিনি

আমি বললুম–তবে কি বিদায় নিতে এসেছেন?

বৃদ্ধ বলেন–হ্যাঁ, তা বলতে পার। যাবার আগে তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হবে বৈ কি। কিন্তু শুধু সে জন্যও আসিনি। তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার আগে তোমাকে বিশেষ করে কয়েকটি কথা বলে যাওয়া কর্তব্য মনে করছি আমি। না হলে তোমার শ্বশুর, আমার সেই অন্নদাতা বন্ধুর কাছে আমার অপরাধ হবে।

আমি চুপ করে বসে থাকি।

বৃদ্ধ বলেন—দেশে আমার সামান্য জমি আছে। সেখানেই গিয়ে উঠব। কোম্পানির দেওয়া বাড়ি আমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। দেশের বাড়িতে গুটিকয়েক ছেলেকে পড়াব স্থির করেছি। মনে হয়, কোনো রকমে ভদ্রভাবে দিন কেটে যাবে আমার। শেষদিনের বড় বেশি বাকিও তো নেই।

তারপর আমার বিরক্ত মুখের দিকে চেয়ে বলেন–বুঝেছি মা, এ সব কথা তোমার ভাল লাগছে। তবে এ কথা থাক। কিন্তু যে কথা না বলে যেতে পারছি না, সেটা যে বলতেই হবে।

–বলুন?

—অলকের নতুন স্টেনোটি কি তোমার বান্ধবী?

আমি অবাক হয়ে যাই। এ কথা শম্ভুবাবু কেমন করে জানলেন! একটু বিস্ময়ের অভিনয় করে বলি—কার কথা বলছেন আপনি?

—অলকের নূতন স্টেনো–পর্ণা রায়–কি তোমার সহপাঠিনী ছিল?

বুঝতে পারি, অস্বীকার করাটা বোকামি হবে, তাই বলতে হল—হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?

–আমাকে সব কথা জানতে হয় মা। না হলে এত বড় কারখানার কোথায় কী হচ্ছে কেমন করে খবর রাখব বল? তা মেয়েটির সম্বন্ধে তুমি কত দূর কী জান, বল ত।

–কত দূর কী জানি মানে?

–ওর স্বভাব চরিত্র-সম্বন্ধে, ওর জীবনের সম্বন্ধে?

—বিশেষ কিছুই জানি না। কিন্তু এ সব প্রশ্ন কেন করছেন আপনি?

–করছি, কারণ করাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তোমার শ্বশুর আজ উপস্থিত থাকলে তিনিই এ প্রশ্ন করতেন।

আমি একটু রুক্ষ স্বরে বলি—কিন্তু আমার শ্বশুরকে যে জবাব আমি দিতাম, তা–

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বলে ওঠেন—তা আমার স্বামীর বরখাস্ত-করা কর্মচারীকে আমি দিতে বাধ্য নই,—এই তো?

আমি চুপ করে থাকি। অপমানে ওঁর মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে। বলেন-আমারই ভুল মা, আমারই ভুল। তোমার কাকিমাও বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, চাকরিই যখন রইল না, তখন এ সব কথার মধ্যে আমাদের না থাকাই ভাল। বেশ তোমার ভালমন্দ তুমিই বুঝে নিও। আমি বরং চলি

উঠে দাঁড়ান উনি।

আমি একটু ইতস্তত করে বলি–উনি কি আজ আসবেন না?

লাঠিখানা তুলে নিতে নিতে উনি বলেন—বোধহয় না। এলে আর কেন গাড়ি পাঠিয়ে পর্ণাকে নিয়ে যাবেন?

-কে নিয়ে গেল? কোথায়?

বৃদ্ধ যেন এর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, বলেন–এইমাত্র আসানসোল থেকে গাড়ি এসেছিল ওঁর স্টেনোকে নিয়ে আবার গাড়ি সেখানে ফিরে গেল।

আমি সচকিত হয়ে বলি–সে কী! কেন?

–সে কথাই তো আলোচনা করতে এসেছিলুম মা; কিন্তু তুমি দেখছি এ বরখাস্ত-করা কর্মচারীকে বরদাস্ত করতে নারাজ।

গরজ বড় বালাই! ওঁকে জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলি—আপনি অহেতুক আমার ওপর রাগ করছেন। আমি যে সব কথা বলিনি তাই আমার মুখে বসিয়ে খামখা আমাকে দোষারোপ করছেন। কী হয়েছে আমাকে খুলে বলুন কাকাবাবু। আমিও দেখি আপনার জন্য কিছু করা যায় কিনা।

আবার বসে পড়েন বৃদ্ধ। বলেন–না, আমার জন্য কিছু আর করার নেই। সে অনুরোধও আমি করব না। কিন্তু তুমি এবার নিজের ঘর সামলাও, মা। আমার ঘর ভেঙেছে, তা ভাঙুক–আমার জীবনের বাকিই বা কী আছে? কিন্তু তোমাকে যে অনেকটা পথ এখনও চলতে হবে।

বুকের মধ্যে দুরদুর করে ওঠে। বলি—কেন, আপনি কি তেমন কিছু আশঙ্কা করেছেন?

—তা করছি। সে সব কথা আগে বলতে আমার সঙ্কোচ হত না। আজ তোমার মনে হতে পারে, আমি বুঝি প্রতিশোধ নিতেই কতকগুলো মিছে কথা বানিয়ে বলে যাচ্ছি–

-না না না। আমি তা মনে করব না। আপনি বলুন। সব কথা আমাকে খুলে বলুন! উনি কি পর্ণাকে নিয়ে

–হ্যাঁ তাই। সন্দেহটা আমার অনেকদিনই হয়েছিল। কানাঘুষা অনেক কিছুই শুনেছি। বিশ্বাস করিনি; বিশ্বাস করতে মন চায়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা দুজনেই ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। আশ্চর্য! যার ঘরে এমন সতীলক্ষ্মী বউ

লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার। কিন্তু ও বৃদ্ধের কাছে আর লজ্জা করে কী হবে? বলি–কেমন করে এমন হল কাকাবাবু?

–কেমন করে হল তা বলা বড় শক্ত মা। বোধ করি পুরুষমানুষের ধর্মই এই। যা হাতের কাছে। অনায়াসে পাওয়া যায় তাতে তার তৃপ্তি নেই! তা বড়লোকের সমাজে এটা তেমন কিছু নয়, আমিও এটাকে অতটা গুরুত্ব দিতুম না; দিতে হচ্ছে অন্য কারণে। এ মেয়েটির সম্বন্ধে যা শুনেছি তাতে আমার ভয় হয়েছে এ শুধু তোমার ঘরেই নয়; তোমাদের কারখানাতেও আগুন জ্বালাবে! একটি গোপন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। অলককে সে কথাই বলতে গেলুম–কিন্তু সে যেন নেশার ঘোরে আছে। আমার কথায় কান তো দিলেই না, অহেতুক অপমান করে বসল আমাকে।

আমি বলি–আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

–অসম্ভব কিছুই করতে বলি না। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণ গৃহস্থ বধূ যা করে থাকে তাই করবে। অলককে সরিয়ে নিতে হবে পর্ণার সান্নিধ্য থেকে। ও মেয়েটি সর্বনাশা, ওকে তাড়াতে হবে।

আবার বলি—কিন্তু আপনি যদি আমাদের ছেড়ে যান, তাহলে কেমন করে আমি তা পারব বলুন? আপনাকে তো যেতে দেওয়া যাবে না।

–কিন্তু রাখবে কেমন করে মা? সে সব বরং থাক। আপাতত আমি যাই। যে অলক্ষ্মী ওর উপর ভর করেছে, ঘাড় থেকে সে অলক্ষ্মী নামলে ওর শুভবুদ্ধি আপনিই জাগ্রত হবে। তখন হয়তো সে আবার আমাকে ডেকে পাঠাবে। ওকে আমি সন্তানের মতোই স্নেহ করি। তখন আমি অভিমান করে দূরে সরে থাকব না।

—পর্ণা যে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, এ খবর আপনি কেমন করে জানলেন?

-ঐ যে বললাম, এ সব কথা আমাদের জানতে হয়। এত বড় কারখানাটা যাকে চালাতে হয়, তাকে অনেক খবর সংগ্রহ করতে হয়।

—ওঁকে আপনি বলেছিলেন সে কথা? উনি বিশ্বাস করেননি?

—তার বুদ্ধি যে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মা। তাকে ঐ মেয়েটি সম্মোহিত করে ফেলেছে।

কেমন যেন মাথা কাটা গেল আমার।

বৃদ্ধ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্থাণুর মত বসেই রইলুম। সারারাত ঘুম হল না। আবোলতাবোল চিন্তায় সমস্ত রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছি। কেন এমন হল? অলক আর সুনন্দা দুটি সুখী প্রাণী। আদর্শ দম্পতি। ভেবেছিলাম, একটি মেয়ে জীবনে যা যা কামনা করতে পারে সবই আমার করতলগত হয়েছে। সম্মান, প্রতিপত্তি, বিলাস, বৈভব-রূপবান, স্বাস্থ্যবান স্বামীর একান্ত প্রণয়। কী নয়? নিজের পছন্দমত শাড়ি গাড়ি কিনেছি। নিজে আর্কিটেক্টের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করিয়েছি। কোন ঘরে কী রঙের টাইল বসবে, কী রঙের প্লাস্টিক ইমালশান রঙ হবে, কী ধরনের পর্দা হবে–সব আমি স্থির করে দিয়েছি। এমনকি গেটের পাশে আলোর টোপরা-পরা বাড়ির ঐ নেমপ্লেটে কী লেখা হবে তাও স্থির করে দিয়েছি আমি। মনে আছে এ প্রসঙ্গে ওর সঙ্গে যে রহস্যালাপ হয়েছিল। বাড়ি যখন শেষ হয়ে এল অলক বললে—এবার এ বাড়ির একটা নামকরণ করতে হয়।

আমি বলেছিলুম–কর। বাড়িটার কোথায় কী করতেহবে তা আমিই নির্ধারণ করেছি, অন্তত নামটা তুমি দাও।

ও বলেছিল-বাড়ির নামকরণ সম্বন্ধে ডক্টর জনসন কী বলেছেন জান?

আমি বলি—ডক্টর জনসনের উপদেশ থাক। তুমি চটপট একটা নামকরণ কর দেখি।

—সে কি হয়! তুমি বাংলার ছাত্রী। নাম দিতে হয়, তুমিই দেবে।

মনে আছে, আমি বলেছিলাম–তবে নাম দাও অলকাপুরী!

ও লাফিয়ে উঠে বলেছিল—কক্ষনও নয়! অলকের নাম থাকবেই না, ওর নাম হোক নন্দালয়। তাতে আমার ঘোর আপত্তি। শেষ পর্যন্ত মধ্যপথে রফা হল আমাদের। নামটা আমিই দিলাম অবশ্য-অলকনন্দা।

অলক আর সুনন্দা দুটি নাম একসঙ্গে গ্রথিত হয়ে গেল পাষাণের ফলকে।

হার রে নাম! সেদিন দূর থেকে কুলুকুলু ধ্বনিতে প্রবাহিত অলকনন্দার ধারাকেই দেখেছিলাম। আজ দেখলাম খাড়া প্রেসিপী! অলকনন্দার খাদ! সে খাদ অলকের সোনাতেও ছিল, সুনন্দার সুবর্ণেও ছিল। সংসারের উত্তাপে প্রেম কোথায় থিতিয়ে পড়েছে। ওপরে ভাসছে শুধু খাদ!

কিন্তু কেমন এমন হল? অলককে নিয়ে আমি সুখী না হবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমার মনের অনেকখানি ছিল ফাঁকা। প্রাপ্তির প্রাচুর্যে সে ফাঁকটি ভরেনি। প্রেমিকের জন্যে কৃচ্ছ্বসাধনের সুযোগ আমি পাইনি, দাম্পত্য-কলহের স্বাদ আমাকে পেতে দেয়নি অলক,স্বামীর ক্ষুধার অন্ন জোগাতে নিজের মুখের গ্রাস লুকিয়ে ধরে দেবার যে বিমল আনন্দ তা থেকে সে আমাকে চিরবঞ্চিত করেছিল। তা ছাড়া আমার ভেতরে চিরকালই লুকিয়ে ছিল একজন দুঃসাহসিকা। সে বেপরোয়া, সে দুর্মদ, সে অভিসারিকা। তার খোঁজই জানে না অলক। তাই অন্য কোনো আকর্ষণে দাম্পত্য জীবনচক্রের আবর্তন থেকে কেন্দ্রাতিগ বেগে ছুটে যাবার একটা তির্যক বাসনা আমার মনে জাগলেও জাগতে পারে। গৌতমের প্রেমে সম্মোহিত হবার উপাদান ছিল আমার রক্তের স্বাক্ষরে। কিন্তু সে কেন এমন লুটিয়ে পড়ল ঐ সামান্যার মোহে? কী আছে পর্ণার, যা আমার নেই? কোন স্বাদে অলক বঞ্চিত আমার কাছে?

অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলাম। স্থির করলাম, এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। অলক যদি একনিষ্ঠ প্রেমের মর্যাদা না দেয় তাহলে আমিই বা সে দায় একা বয়ে বেড়াব কোন দুঃখে!

পরদিন সকালে উঠেই ছুটলাম গৌতমের ছাপাখানায়।

এবার আর আটপৌরে শাড়ি নয়, স্বাভাবিক সাজে ভড়ংও নেই, আড়ম্বরও নেই। যে বেশে সেই কলেজ জীবনে দেখা হত আমাদের, সেই বেশে। ট্যাক্সি করেই যেতে হল। বাড়ির গাড়ি ও-পাড়ায় নিয়ে যাবার কী দরকার? গৌতম ছিল না তার ছাপাখানায়। ছিলেন সেই ভদ্রলোক, যিনি সেদিন আমাদের দু কাপ চা এনে দিয়েছিলেন।

কথাবার্তা শুনে মনে হল তিনি এখনও আমার পরিচয়টা জানেন না। গৌতম কখন আসবে তা তিনি বলতে পারলেন না।

বললাম—কোথায় গেলে তার দেখা পেতে পারি?

–বাসাতেই থাকেন এ সময়। অবশ্য এখন আছেন কিনা জানি না।

–বাসা কোথায়?

—যাবেন আপনি? বেশি দূর নয়। এই গলিটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই একটা বাঁশের পুল পাবেন। সেটা পার হয়েই ডানহাতি করোগেট টিনের চারচালা বাড়ি। যাকে শুধাবেন, সেই পথ বাতলে দেবে।

–আর কে কে আছেন তার বাসায়?

–তিনি, তার স্ত্রী আর একটি ছেলে। স্ত্রী অবশ্য আজ নেই। কাল কোথায় যেন গিয়েছেন।

—কোথায় গিয়েছেন?

–তা তো জানি না। কাল রাত্রে এখানে এসে বললেন যে, দুচার দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছেন। গৌতমবাবু তখন এখানেই ছিলেন কিনা।

-ও!

–চলুন, আপনাকে বরং দেখিয়ে দিই।

কৌতূহল প্রবল। তার ওপরে গৌতমের স্ত্রী আজ বাড়ি নেই। এ সুযোগ ছাড়া হবে না। দেখে আসা যাক ওর সংসারের স্বরূপ। সংসারের প্রেমে সে নাকি মগুল হয়ে আছে।

ভদ্রলোক দরজায় শিকল তুলে তালা লাগালেন। দুজনে পথে নামি। নোংরা গলি। যেখানে-সেখানে নির্বিচারে ময়লা ফেলা আছে। পথ জুড়ে শুয়ে আছে রোমন্থনরত নিশ্চিন্ত গো-শাবক। নির্বিচারে উলঙ্গ দুটি শিশু পথের ধারে প্রাতঃকৃত্য করতে বসেছে। একটা ঠেলাওয়ালা পথের আধখানা আটক করে পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছে। মুখের ওপর গামছা ফেলা। দেখতে দেখতে পথ চলেছি। সামনের বাড়ির বউটি আঁচল দিয়ে সারা গা ঢেকে একটা এনামেলের পাত্রে আঁজলা ছাই নিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল পথে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। এত সুন্দরী মেয়ে বোধহয় এ সব পাড়ায় আসে না। বউটি ছাই ফেলতে ভুলে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। এ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমি অভ্যস্ত। এতদিন ভাবতুম এ আমার রক্ষাকবচ-সহজাত কবচকুণ্ডল। হার রে রূপ! সে দেমাক আমার গিয়েছে।

–সাবধানে পার হবেন।

বাঁশের পুলের কাছে এসে গেছি। আমি চাই না যে, ও ভদ্রলোক আমার সঙ্গে আসেন। তাই তাকে বিদায় করবার জন্য বলি–এবার আমি যেতে পারব। ঐ বাড়িটা তো?

ভদ্রলোক মনে হয় ক্ষুণ্ণ হলেন। আমার পাশে চলতে বেশ একটা আনন্দ বোধ করছিলেন বোধ করি। কিন্তু আমার কথার জবাবে তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল–আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা, আমি তাহলে চলি।

-হ্যাঁ, আসুন।

ছোট্ট দুকামরা বাড়ি। টিনের চালা, মুলিবাঁশের ছেচা-বেড়ার দেওয়াল। মেঝেটা অবশ্য পাকা। সামনে একটু বাগান। তাতে নানান ফুলের গাছ। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মধুমালতীর গেট। সন্ধ্যামণি, বেলি, জুই, দণ্ডকলস আর রজনীগন্ধার চারা। আমার দিকে পেছন ফিরে গৌতম বেড়া বাঁধছিল। খালি গা। পরনে একটা পায়জামা। গলায় মোটা পৈতে। চুলগুলো অবিন্যস্ত। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে। তার একহাতে একখানা কাটারি, অন্য হাতে আধলা বাঁশ। গেটটা খুলতেই মুখ তুলে তাকায়। অবাক হয়ে যায় গৌতম। উঠে দাঁড়ায়, বলে–তুমি?

হেসে বলি–হ্যাঁ আমিই-কিন্তু ভেতরে আসব তো?

–কেন আসবে না?

–আমি যে নিরস্ত্র, আর তুমি সশস্ত্র! বিশ্বাসঘাতককে খতম করতে কতক্ষণ?

–ছিঃ! কী যা তা বলছ? এস, ঘরে এস—

দা-খানা ফেলে হাতের ধুলো ঝেড়ে দাওয়ায় উঠে দাঁড়ায়। বেতের মোড়া একখানা টেনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—বস।

একটু অভিনয় করতে হল। বলি, আসতে বলেছ এসেছি; কিন্তু বসতে তো তুমি বলবে না। গৃহস্বামিনীকে ডাক—তিনি অনুমতি করলেই বসতে পারি।

গৌতম হেসে বলে–তিনি উপস্থিত থাকলে তাই হত। কিন্তু তিনি যে বাড়িতে নেই।

—আয়াম সরি। বাজারে গেছেন নাকি?

না, তিনি কলকাতাতেই নেই আজ।

—ও হো। তবে তো আমার আসাটাই আজ ব্যর্থ হল।

–তাই নাকি? তাহলে তুমি আমার কাছে আসনি দেখছি।

-না তোমার কাছে নয়, তোমাদের কাছে এসেছিলাম আজ। দেখতে এসেছিলাম কী মন্ত্রে তিনি বশ করেছেন তোমায়।

গৌতম হাসল। জবাব দিল না।

–তোমার ছেলেটি কোথায়?

–ছেলের খবর পেলে কার কাছে?

বলি–গৌতম, আমি তো প্রশ্ন করিনি, তুমি আমার স্বামীর খবর কার কাছে পেয়েছিলে।

গৌতম সে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে বলে–বল্ট স্কুলে গেছে।

–স্কুল? সে কোথায়?

–ঐ তো! প্রাইমারি স্কুল। এখনই আসবে সে। চা খাবে?

—খেলে তোমাকেই বানাতে হবে তো?

–কেন? তুমিও বানাতে পার।

—পারি? তবে চল।

এলাম ভেতরের ঘরে। ছোট বাড়ি, দুখানি মাত্র ছোট্ট ঘর। ভেতরে একটি বারান্দা। তারই একান্তে রান্নার আয়োজন। কাঠের উনুন। দেওয়ালে লটকানো একটি প্যাকিং বাক্স। তাতে রান্না করার নানান উপচার। মশলার কৌটা, আচার, নুনের কেঠো। একটা ঝুড়িতে কিছু আনাজ আলু, বেগুন, পেঁয়াজ, কচু আর আদা। মাটিতে কলসিতে মোটা চাল। ছোট্ট একটি বঁটি, চাকতি-বেলুন, শিল-নোড়া। গৌতম বললে—সরো, উনুনটা জ্বেলে দিই।

–থাক মশাই, আমিই পারব।

—না পারবে না—ফুঁ দিতে দিতে শুধু শুধু চোখে জল আসবে।

হেসে বলি—শরবাবুর বইতে পড়নি রান্নাঘরের ধোঁয়া বাঙালি মেয়েদের চোখের জল লুকোবার একটা ভাল অছিলা?

–তোমারও কি কোটেশান খেলার বাতিক আছে নাকি?

চমকে উঠে বলি—তার মানে?

গৌতম অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলি—শুনেছি মিস্টার মুখার্জি নাকি অ্যাপ্ট কোটেশানের ভারি ভক্ত।

—সেটাও শুনেছ? এত কথা শোন কার কাছে?

গৌতম আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দেয়। বলে—আমি তো প্রশ্ন করিনি সু—আমার ছেলের কথা তুমি কার কাছে শুনেছ।

হেসে বলি-টুইটস! নাও সরো, উনুনটা ধরাই।

কিন্তু কী লজ্জা! কিছুতেই জ্বালতে পারি না কাঠের উনুনটাকে। গৌতম একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। এতক্ষণে এগিয়ে এসে বলে—নাও, খুব হয়েছে। বরং এইটা জ্বেলে নাও।

জনতা স্টোভ একটা টেনে আনে কোথা থেকে।

দু-কাপ চা তৈরি করে নিয়ে এসে বসলাম ওর ঘরে! সেইটা মনে হয় ওদের শয়নকক্ষ। এটাই বড় ঘর। দুখানা চৌকি পাতা। ধবধবে সাদা চাদর। বালিশ-ঢাকায় কাজ করা। ছোট একটি টিপয় টেনে আনল গৌতম। চায়ের কাপ দুটি রাখল তার ওপর। আমি বলি–টিপয়ও আছে?

গৌতম হেসে টেবিল-ঢাকাটা তুলে ফেলে। কেরোসিন কাঠের বাক্স একটা। সুদৃশ্য টেবিল-ঢাকায় তার ভোলাই পাল্টে গিয়েছে। গৌতম হেসে বলে–অত কৌতূহল দেখিও না সু! নিম্নমধ্যবিত্তের সংসার খুঁটিয়ে দেখতে চেয়ো না। কোনোক্রমে ওপরের ঐ কোচার পত্তনটি বজায় রেখেছি আমরা। ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন!

আমি হেসে বলি–সে সর্বত্রই! পোশাকের তলায় সবাই উলঙ্গ!

আবার একটু চুপচাপ।

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ওর গৃহস্থালির আয়োজন। উপকরণ সামান্যই—কিন্তু কী সুন্দর গুছিয়ে রেখেছে। মনে হল, সুন্দর গৃহস্থালির একটি অনিবার্য উপকরণ হচ্ছে অভাব! প্রাচুর্যের মধ্যে কিছুতেই এ মাধুরী ফুটিয়ে তোলা যাবে না। ঐ যে ছেড়া শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়ার ওপর আসন তৈরি হয়েছে, ঐ যে মাটির ঘটে আলপনা দিয়ে স্থলপদ্ম রাখা আছে, ঐ যে ছেড়া ধুতি বাসন্তী রঙে ছুপিয়ে জানলার পর্দা করা হয়েছে—ও জিনিস কিছুতেই পাওয়া যাবে না সুনন্দা মুখার্জির ড্রইংরুমে। কারণ ওর মূল সুরটাই হচ্ছে অভাবের মাঝখানে ফুটে ওঠা রুচিবোধ। তাজা পদ্মফুলের অনিবার্য অনুষঙ্গ যেমন পাঁক, এই গৃহস্থালির মূল সুরটিও যেন তেমনি-অনটন। এমনটি করে ঘর সাজাতে পারব না আমি কোনোদিন-এ কি আমার কম দুঃখ! জোর করে মাটির ঘট নিয়ে গেলে তাতে উপহাসের হাওয়াটাই লাগবে, অনাবিল হাসির সুরটা ফুটবে না।

–কী দেখছ অত চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে?

–দেখছি মিসেস ব্যানার্জির কোনো ফটো আছে কিনা দেওয়ালে।

–হতাশ হতে হবে তাহলে তোমাকে। তার কোনো ফটো এ বাড়িতে নেই।

আমি বলি, বুঝেছি। নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।

গৌতম হেসে বলে–নো কোটেশন প্লীজ! আমি ওটা একদম সইতে পারি না।

–তুমি দেখছি অলকের একেবারে ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা।

–তা বলতে পার?

আবার কিছুটা চুপচাপ।

নীরবতা ভেঙে আবার আমাকেই বলতে হয়—তোমার চিঠি পেয়েছি কিনা প্রশ্ন করলে না তো?

–প্রশ্ন না করলেও বুঝতে পারছি, তা তুমি পেয়েছ।

–তবু ঢুকতে দিলে বাড়িতে? ভয় নেই?

—ভয় কিসের?

–যদি আবার বিশ্বাসঘাতকতা করি? গৌতম হেসে বলেসে জন্যে তো তুমি আসনি।

–তবে কেন এসেছি?

—তা তুমিও জান, আমিও জানি–কী দরকার সেই কথাটা উচ্চারণ করে। সেটা অকথিতই থাক। তাতে তার মাধুর্য বাড়বে।

কেমন যেন লজ্জা করে ওঠে। মুখটা আর তুলতে পারি না। নিচু মুখেই অস্ফুটে বলি—একটা কথা সত্যি করে বলবে?

–বল।

–আমাদের গেছে যা দিন, তা কি একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?

গৌতম স্মিতমুখে চুপ করে বসে থাকে।

বাধ্য হয়ে বলতে হয়–কই, জবাব দিলে না?

–ভাবছি, এত কোটেশন দিচ্ছ কেন আজ। ধার করা কথা ছাড়া নিজের কথা কিছু বলতে পার না?

–মানে?

–মানে, তোমার ও কথার জবাবে একটি মাত্র কথাই তো বলা চলে—রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে!—কিন্তু তুমি-আমি তো তোতাপাখি নই সু!

অপ্রস্তুত হতে হল। বলি—বেশ, স্থূলভাবেই প্রশ্ন করছি—মিসেস ব্যানার্জি কি তোমার মনের সবটুকুই ভরিয়ে রেখেছেন—কিছুই কি নেই বাকি?

গৌতম একটুক্ষণ চুপ করে রইল-তারপর বলে–এ প্রশ্নটার জবাব দেওয়া কি আমার পক্ষে শোভন? থাক না ও কথা!

আমি হেসে বলি–আমার প্রশ্নের জবাব তুমি দিলে না গৌতম; কিন্তু তোমার চোখ-মুখ বলছে সে কথা! তোতাপাখির কথা নয়, আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তোমার চোখের তারায় ফুটে উঠেছে সেই তারা, যা লুকিয়ে রেখেছিলে তোমাকে, তোমার দিনের আলোর গভীরে।

গৌতম একটু সচকিত হয়ে বলে-সুনন্দা, আজ তোমার মন নিজের এক্তিয়ারে নেই। আমি বুঝতে পারছি, কোনো কারণে তুমি আঘাত পেয়েছ মিস্টার মুখার্জির কাছে। কিন্তু আমাদের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যার জন্যে পরে অনুতাপ করতে হয়।

হঠাৎ যেন রক্তে দোলা লাগল আমার! মনে হল, কিছুই খোয়া যায়নি। পর্ণার কবল থেকে একদিন যেমন মোহজাল বিস্তার করে ছিনিয়ে এনেছিলাম গৌতমকে, আজও তেমনি ওকে এক মুহূর্তে ছিনিয়ে আনতে পারি এই অচেনা অজানা মিসেস্ ব্যানার্জির নাগপাশ থেকে। আমার উষ্ণ যৌবন, দীপ্ত নারীত্বকে অস্বীকার করতে পারবেনা গৌতম! একটু ঝুঁকে পড়ে বলি—অনুতাপ কিসের গৌতম? তুমি ঠিকই বলেছ–একটা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েই ছুটে এসেছি আমি। কিন্তু তুমি কি একটা মুহূর্তের জন্যও সে ক্ষতচিহ্নে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পার না? এমন কিছু আমাকে দিতে পার না যা নিয়ে

কথাটা শেষ করতে পারি না। গৌতম উঠে দাঁড়ায়—বলে, প্লীস সু৷ আমিও রক্তমাংসে গড়া মানুষ। এভাবে আমাকে প্রলুব্ধ কর না।

আর স্থির থাকতে পারি না আমি। আসন ছেড়ে আমিও উঠে দাঁড়াই; বলি–তাহলে আজ আমাকে এমন কিছু একটা দাও—

এবারও শেষ হয় না কথাটা। আমাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে গৌতম আমার পেছন দিকে তাকায়।  চকিতে ঘুরে দাঁড়াই। দেখি, পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে হাফ-প্যান্ট পরা একটি বছরছয়েকের ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। জুলজুল চোখে চেয়ে দেখছে আমাকে। হঠাৎ কী হল আমার। মুহূর্তে ছোঁ মেরে তুলে নিলাম তাকে। বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম সজোরে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম তার গাল দুটো।

গৌতম স্মিতহাস্যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল আমার কাণ্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *