উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

০১. গড়ের মাঠ

গড়ের মাঠ। সারাটা দিন দারুণ গরম গেছে, হাড়ে-মাংসে যেন আগুনের আলপিন। ফুটছিল। এই সন্ধ্যেবেলায় আমি আর টেনিদা গড়ের মাঠে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। কেল্লার এ-ধারটা বেশ নিরিবিলি, অল্প-অল্প আলো-আঁধারি, গঙ্গা থেকে ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া।

একটা শুকনো ঘাসের শিষ চিবুতে চিবুতে টেনিদা বললে, ধ্যেৎ।

–কী হল?

—সব বাজে লাগছে। এমন গরমের ছুটিটা—লোকে আরাম করে সিমলা-শিলং বেড়াতে যাচ্ছে আর আমরা এখানে বসে বসে স্রেফ বেগুনপোড়া হচ্ছি। বোগাস!

—একমন বরফ কিনে তার ওপর শুয়ে থাকলেই পারো—আমি ওকে উপদেশ দিলুম। টেনিদা তক্ষুনি হাত বাড়িয়ে বললে, টাকা দে।

–কীসের টাকা?

–বরফ কেনবার।

—আমি টাকা পাব কোথায়?

টাকা যদি দিতে পারবিনে, তা হলে বুদ্ধি জোগাতে বলেছিল কে র‍্যা?—টেনিদা দাঁত খিচোল বিচ্ছিরিভাবে; ইদিকে গরমের জ্বালায় আমি ব্যাং-পোড়া হয়ে গেলুম আর উনি বসে বসে ধ্যাষ্টামো করছেন।

—এখন গরম আবার কোথায়—আমি টেনিদাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলুম : কেমন মনোরম রাত, গঙ্গার শীতল বাতাস বইছে—আরও একটু কবিতা করে বললুম : পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির

নিশির শিশির।—টেনিদা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল : দ্যাখ প্যালা, ফাজলামিরও লিমিট আছে। এই জষ্টিমাসে শিশির! দেখা দিকিনি, কোথায় তোর শিশির।

ভারি ল্যাঠায় ফেলল তো! এরকম কাঠগোঁয়ার বেরসিকের কাছে কবিতা-টবিতা বলতে যাওয়াই বোকামো। আমি অনেকক্ষণ মাথাটাথা চুলকে শেষে একটু বুদ্ধি করে বললুম, আচ্ছা, কালকে সকালে তোমাকে শিশির দেখাব, মানে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে শিশিরদা-কে ডেকে আনব।

বুদ্ধি করে আগেই সরে গিয়েছিলুম, তাই টেনিদার চাঁটিটা আমার কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল। টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, তুই আজকাল ভারি ওস্তাদ হয়ে গেছিস। কিন্তু এই আমি তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিলুম। ফের যদি গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি করবি, তা হলে এক ঘুষিতে তোকে–

আমি বললুম, ঘুষুড়িতে উড়িয়ে দেবে!

বদমেজাজী হলে কী হয়, টেনিদা গুণের কদর বোঝে। সঙ্গে সঙ্গে একগাল হেসে ফেলল।

-ঘুষি দিয়ে ঘুষুড়িতে ওড়ানো। এটা তো বেশ নতুন শোনাল। এর আগে তো কখনও বলিসনি!

আমি চোখ পিটপিট করে কায়দাসে বললুম, হুঁ হুঁ—আমি আরও অনেক বলতে পারি। সব একসঙ্গে ফাঁস করি না, স্টকে রেখে দিই।

—আচ্ছা, স্টক থেকে আরও দু-চারটে বের কর দিকি।

আমি বললুম, চাঁটি দিয়ে চাটগাঁয় পাঠানো, চিমটি কেটে চিমেশপুরে চালান করা–

–চিমেশপুর? সে আবার কোথায়?

—ঠিক বলতে পারব না। তবে আছে কোথাও নিশ্চয়।

–তোর মুণ্ডু।—টেনিদা হঠাৎ ভাবুকের মতো ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। খানিকক্ষণ ড্যাবড্যাব করে আকাশের তারা-টারা দেখল খুব সম্ভব, তারপর করুণ স্বরে বললে, ডাক-ডাক!

–কাকে ডাকব টেনিদা? ভগবানকে?

—আঃ, কচুপোড়া খেলে যা! খামকা ভগবানকে ডাকতে যাবি কেন? আর তোর ডাক শুনতে তো ভগবানের বয়ে গেছে। ডাক ওই আইসক্রিমওলাকে।

আমার সন্দেহ হল।

—পয়সা কে দেবে?

—তুই-ই দিবি। একটু আগেই তো একমন বরফের ফরমাশ করছিলি।

বোকামোর দাম দিতে হল। আইসক্রিম শেষ করে, কাঠিটাকে অনেকক্ষণ ধরে চেটেপুটে পরিষ্কার করে টেনিদা ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছে, হঠাৎ-ফ্যাঁচ।

আমিই হেঁচে ফেললুম। একটা মশা-টশা কী যেন আমার নাকের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল।

টেনিদা চটে উঠল : এই, হাঁচলি যে?

—হাঁচি পেলে।

—পেল? আমি শুতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময়েই তুই হাঁচলি? যদি একটা ভালোমন্দ হয়ে যায়? মনে কর এই যদি আমার শেষ শোয়া হয়? যদি শুয়েই আমি হার্টফেল করি?

বললুম অসম্ভব! স্কুল ফাইনালে তুমি এত বেশি হার্টফেল করেছ যে সব ফেলপ্রুফ হয়ে গেছে।

টেনিদা বোধহয় এক চাঁটিতে আমাকে চাটগাঁয়ে পাঠানোর জন্যেই উঠে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক তক্ষুনি ঘটে গেল ব্যাপারটা।

কে যেন মোটা গলায় বললে, ওঠো হে কম্বলরাম–গেট আপ!

আমরা দুজনেই একসঙ্গে দারুণভাবে চমকে উঠলুম।

দুটো লোক আমাদের দুপাশে দাঁড়িয়ে। একজন তালগাছের মতো রোগা আর ঢ্যাঙা, এই দারুণ গরমেও তার মাথাটাথা সব একটা কালো র‍্যাপার দিয়ে জড়ানো। আর একজন ষাঁড়ের মতো জোয়ান, পরনে পেটুলুন, গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। তারও নাকের ওপর একটা ফুলকাটা রুমাল বাঁধা আছে।

এবার সেই রোগা লোকটা হাঁড়িচাঁচার মতো চ্যাঁ-চ্যাঁ গলায় বললে, আর পালাতে পারবে না কম্বলরাম, তোমার সব ওস্তাদি এবার খতম। ওঠো বলছি—

টেনিদা হাঁকপাঁক করে উঠে বসেছিল। দাঁত খিঁচিয়ে বললে, কে মশাইরা এই গরমের ভেতরে এসে খামকা কম্বল কম্বল বলে চ্যাঁচাচ্ছেন? এখানে কাঁথা কম্বল বলে কেউ নেই। আমরা কী বলে ইয়ে—এই গঙ্গার শীতল সমীর-টমীর সেবন করছি, এখন আমাদের ডিসটার্ব করবেন না!

—ও, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না দেখছি! ষণ্ডা লোকটা ফস করে প্যান্টের পকেট থেকে কী একটা বের করে বললে, দেখছ?

দেখেই আমার চোখ চড়াৎ করে কপালে চড়ে গেল। আমি কাঁউ-মাউ করে বললুম, পিস্তল!

ঢ্যাঙা লোকটা বললে, আলবাত পিস্তল! আমার হাতেও একটা রয়েছে। এ-দিয়ে কী হয়, জানো? দুম করে আওয়াজ বেরোয়ধাঁ করে গুলি ছোটে, যার গায়ে লাগে সে দেন অ্যান্ড দেয়ার দুনিয়া থেকে কেটে পড়ে।

টেনিদার মতো বেপরোয়া লিডারেরও মুখ-টুখ শুকিয়ে প্রায় আলুকাবলির মতো হয়ে গেছে, খাঁড়ার মতো লম্বা-নাকটা ঝুলে পড়েছে নীচের দিকে। কুক্ষণে বেশ কায়দা করে দুজনে একটা নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়েছিলুম—আশেপাশে লোকজন কোথাও কেউ নেই! চেঁচিয়ে ডাক ছাড়লে, দু-পাঁচজন নিশ্চয় শুনতে পাবে, কিন্তু আমরা আর তাদের বিশেষ কিছু শোনাতে পারব না, তার আগেই দু-দুটো পিস্তলের গুলিতে আমাদের দুনিয়া থেকে কেটে পড়তে হবে! একেবারে দেন অ্যান্ড দেয়ার!

আমার সেই ছেলেবেলার পিলেটা আবার যেন নতুন করে লাফাতে শুরু করল, কানের ভেতরে যেন ঝিঝি পোকারা ঝিঝি করতে লাগল, নাকের মধ্যে উচ্চিংড়েরা দাঁড়া নেড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে এমনি মনে হতে লাগল! ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল অজ্ঞান হয়ে যাই, কিন্তু দু-দুটো পিস্তলের ভয়ে কিছুতেই অজ্ঞান হতে পারলুম না।

টেনিদা-ই আবার সাহস করে, বেশ চিনি-মাখানো মোলায়েম গলায় তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলতে লাগল : দেখুন মশাইরা, আপনারা ভীষণ ভুল করছেন। এখানে কম্বল বলে কেউ নেই, কম্বল বলে কাউকে আমরা চিনি না, শীতকালে আমরা কম্বল গায়ে দিই না—লেপের তলায় শুয়ে থাকি। এ হল আমার বন্ধু পটলডাঙার প্যালারাম, আর আমি হচ্ছি শ্রীমান টেনি, মানে–

মোটা লোকটা ঘোঁত-ঘোঁত করে বললে, মানে কম্বলরাম। প্যালারামের বন্ধু কম্বলরাম রাম রামে মিলে গেছে। যাকে বলে, রামে এক, রামে দো! ঘুঘু খুঁত

শেষের বিটকেল আওয়াজটা বের করল নাক দিয়ে। হাসল বলে মনে হল। আর সেই বিচ্ছিরি হাসিটা শুনে অত দুঃখের ভেতরেও আমার পিত্তিসুষ্ঠু জ্বালা করে উঠল।

সেই ঢ্যাঙা লোকটা খ্যাচম্যাচ করে বললেন, কী হাসি মস্করা করছ হে অবলাকান্ত। ফস করে একটা পুলিশ-ফুলিশ এসে যাবে, তা হলেই কেলেঙ্কারি। ওদিকে সিন্ধুঘোটক তখন থেকে খাপ পেতে বসে রয়েছে, কম্বলরামকে নিয়ে তাড়াতাড়ি না ফিরলে আমাদের জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে! চলোচলো! ওঠো হে কম্বলরাম, আর দেরি নয়। গাড়ি রেডিই রয়েছে।

রেডি রয়েছে, তাতে আর সন্দেহ কী! একটু দূরেই দরজাবন্ধ একটা ঘোড়ার গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারলুম, ওটা কম্বলরামকেই অভ্যর্থনা করবার জন্যে এসেছে।

টেনিদা বললে, দেখুন বুঝতে পারছেন–

–আমাদের আর বোঝাতে হবে না, সিন্ধুঘোটককেই সব বুঝিয়ো। নাও—চলো–বলেই ঢ্যাঙা লোকটা পিস্তলের নল টেনিদার পিঠে ঠেকিয়ে দিলে।

আর এ-অবস্থায় হাত তুলে নির্বিবাদে সুড়সুড় করে হেঁটে যেতে হয়, গোয়েন্দার গল্পের বইতে এই রকমই লেখা আছে। টেনিদা ঠিক তাই করল। আমি সরে পড়ব ভাবছি—দেখি বেঁটে লোকটার পিস্তলের নল আমাকেও খোঁচা দিচ্ছে!

–বা-রে, আমাকে কেন?—আমি ভাঙা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম : আমি তো কম্বলরাম নই।

–না, তুমি কম্বলের দোস্ত কাঁথারাম! তোমাকে ছেড়ে দিই, তুমি দৌড়ে পুলিসে খবর দাও—আর ওরা গাড়ি ছুটিয়ে আমাদের ধরে ফেলুক! চালাকি চলবে না, চাঁদ—চলো!

এ-অবস্থায় হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্ত পর্যন্ত চলতে বাধ্য হয়, আমি কোন্ ছার! আমরা চললুম, ঘোড়ার গাড়িতে উঠলুম, গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আর গাড়ি গড়গড়িয়ে চলতে

শুরু করে দিলে।

হায় গঙ্গার শীতল সমীর! বেশ বুঝতে পারলুম, এই আমাদের বারোটা বেজে গেল!