১.৪ কান্না এইরকম

কান্না!–কান্না এইরকম? মাকে যখন নিয়ে গেল, মাকে রেখে বাবা যখন ফিরে এলেন, তারপর বাড়িতে সেই প্রথম মা-ছাড়া রাত্রি… কেঁদে-কেঁদে মরতে বাকি ছিল তার। কিন্তু এরকম তো লাগেনি। কান্নার জোয়ারে সে ভেসে গিয়েছিল তখন, যেন অথৈ জলে ড়ুবছে, কিন্তু যতবার দম আটকে এসেছে কে যেন হাত ধরে তাকে তুলে দিয়েছে ঢেউয়ের উপর…আর এ-কান্না যেন বুক ভেঙে দিয়ে ঠেলে ঠেলে উপরে উঠল, তারপর একটু একটু করে নেমে এল চোখ জ্বালিয়ে দিয়ে। একে লুকোতে চায়, পারে না। এতে লজ্জা করে কিন্তু লজ্জা মানে কে? মার জন্য কান্নায় শুধু কষ্ট ছিল, যত কষ্ট তত আরাম…আর এ-কান্নায় সবচেয়ে বেশি মনে হল আমি যেন হেরে গেলাম; আর যেন কী বলতে গিয়ে বলতে পারলাম না, আর সেই মুখের কথাকে মুছে দিল চোখের জল…

পরের দিন কয়েক স্বাতীকে যেন কান্নায় পেল। ছোড়দির কথা মনে করে যখন-তখন সে কাঁদে; আর বড়দি-সেজদি যখন চলে গেলেন তখনো কেঁদে ভাসাল সে; আগের চেয়েও নিরিবিলি বাড়িতে কান্না যেন তাকে ধরবার জন্য ওৎ পেতেই রইল, যেমন সে শুনেছে, স্বদেশীদের পিছনপিছন ঘোরে পুলিশের গোয়েন্দা। এক-এক সময় কিছুতেই তার হাত ছাড়াতে না-পেরে গল্পের অ্যালিসের মতো নিজেকেই নিজে ধমকে দেয়-চুপ! চুপ করো বলছি, এত বড়ো মেয়ে, কাঁদতে লজ্জা করে না! থামাও এক্ষুনি। আর সত্যিই—এ-রকম করলে চলবে কেন; পরীক্ষা না? বিজুকে সে বলল—দাদা আয়, আমরা একসঙ্গে পড়ি। বিজু জিভ বের করে ঠোঁটে বুলিয়ে বললো—আমার হয়ে গেছে সব।

দ্যাখ দাদা, জিওমেট্রি তো ঢোকে না আমার মাথায়—

আচ্ছা, দেবোখন এক সময় বুঝিয়ে। আমার পরিষ্কার ধুতি আছে নাকি রে একটা?

ধোপার তো আসার কথা—–আঃ ঘাঁটিসনে! স্বাতী বই ফেলে উঠে তোরঙ্গের তলা থেকে আস্তে টেনে আনল একখানা পাটকরা ধুতি। বিজু তাকিয়ে বললো—এ তো বাবার।

তা হোক না।

যেমন মোটা তেমনি খাটো।

আ-হা। বাবা পরতে পারেন আর তুই পারিস না!

আমি বাবার চেয়ে লম্বা তো! আর বাবার ঠিক হয় নাকি? বিশ্রী স্বভাব, যেন উনি চুয়াল্লিশ ইঞ্চি ধুতি পরলেই কত আয় হবে সংসারের। এদিকে কত দিক দিয়ে কত খরচ হচ্ছে তাতে কিছু না! কোনো-এক সময়ে কোনো-এক দিদির মুখে শোনা এই কথাটা আওড়াতে পেরে খুব খুশি হল বিজু, খুব হাসল খানিকটা, তারপর বললো–আচ্ছা দে, আর নেই যখন—

দাদা, জিওমেট্রি—

দাঁড়া, খেয়ে-দেয়ে—ধুতি হাতে চলে গেল নাইতে। রাত্রে যখন বোনের সঙ্গে আবার দেখা হল, বেশ-একটু গুরুজনের মতোই জিগেস করল–পড়াশুনা তোর হচ্ছে তো ঠিকমতো? এই একরকম-স্বাতী জ্যামিতিপ্রসঙ্গ আর তুলল না।

কটা এসে মুখস্ত করেছিস?

এসে মুখস্ত মানে?

ইংরিজি এসে মুখস্ত করিসনি একটাও? এরোপ্লেনটাও না? ওটা নির্ঘাৎ পড়বে এবার, দেখিস।

ও মা! স্বাতী খিলখিল করে হেসে উঠল। এসে আবার মুখস্ত করে নাকি? ও তো বানিয়ে লিখতে হয়। যেন বোনকে শুনিয়ে-শুনিয়েই বিজু উচ্চস্বরে ইংরিজি পড়তে লাগল রাত জেগে জেগে। রাজেনবাবু চমকে বললেন–বিজু পড়ছে! আশ্চর্য কথা!

দ্যাখো না!—স্বাতী আশ্বাস দিল বাবাকে। কিন্তু বৃথা, বিজু ফেল করল এবারেও। কোনো এক সুযোগে রাজেনবাবু কুণ্ঠিতভাবে ছেলের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন—এখন কী করবি? আর পড়ব না, বাবা-দরাজ গলায় জবাব দিল বিজু।

তাহলে…?

তুমি ভেব না, আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। রাজেনবাবু ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।

আমি আর্টিস্ট হব, বাবা।

আর্টিস্ট। রাজেনবাবু হাঁ। মানে যারা ছবি আঁকে?

না বাবা, মধুর একটু হেসে বিজু খবর জানাল বাবাকে—গাইয়েদেরও আর্টিস্ট বলে আজকাল, অ্যাক্টরদেরও।

মাথা-খারাপ হলো নাকি রে বিজুর?—পরে, স্বাতীর সঙ্গে একলা হয়ে রাজেনবাবু বললেন।

নতুন কিছু হয়নি–স্বাতী হাসলো। একটু পরেই আবার বললো-দাদার খুব মাথা কিন্তু বাবা, একটু যদি মন দিত তাহলে কথা ছিলো না।

রাজেনবাবু জবাব দিলেন না। কোনোরকমে যে-কোনো একটা কাজে এক্ষুনি ওকে ঢোকাতে না পারলে পরে কি আর সামলানো যাবে? তাঁর পেনশনের আর দুবছর মোটে বাকি; যে রাজত্বে তিনি কাজে ঢুকেছিলেন এখন তার কিছুই আর নেই, তবু উপরওলাদের ধরে পড়লে এখনও হয়তো তার ডিপার্টমেন্টে-কিন্তু ম্যাট্রিকটাও…

আর তাছাড়া–স্বাতী সান্ত্বনা দিল—পরীক্ষা পাশ করাটাইতো আর সব কথা নয়। আরো কত আছে। কোনটাতে হঠাৎ ওর মন লেগে যাবে কে জানে?

একটা মূখ হয়ে থাকল। রাজেনবাবুর দীর্ঘশ্বাস।

মূর্খ আবার কী! কথাবার্তায় চাল-চলনে কার চেয়ে কম। আমাদের সঙ্গে যা করে করে— বাইরের একজন এলে দেখো-তো!

শাশ্বতীও কেমন বি. এ. পাশ করলো বিয়ের পরে—

পাশ করলেই বিদ্বান হয় বুঝি?

স্বাতী তর্ক করল বটে, কিন্তু মনে-মনে দাদার জন্য তারও দুঃখ কম না। আহা-কলেজে পড়বে

কোনোদিন? সে তো পড়ছে—কী ভালো কলেজ, কী ভালো লাগে—একেবারে অন্যরকম, একেবারে নতুন…কত নতুন কথা, শক্ত শক্ত কথা! কয়েক মাস আগেও যা ভাবতে পারতো না—সত্যি!

******

কলেজে ইংরিজির ক্লাশে পিছনের বেঞ্চিতে তার পাশে বসে বলল একদিন ইভা গাঙ্গুলি – আর ইংরিজি পড়ে কী হবে—ইংরেজের রাজত্বই থাকবে না। থাকবে না!

স্বাতী অবাক।

দ্যাখ না এই যুদ্ধে কী হয়–।

ওমা! যুদ্ধ! হারীতদার কথাই ঠিক হল!——সত্যি যুদ্ধ!

সত্যি মানে? ইভা হেসে উঠল। এনশেন্ট ম্যারিনর পড়তে-পড়তে প্রোফেসর একটু থামলেন, চকিতে একবার তাকিয়েই পড়তে লাগলেন আবার। ইভা হাসি চেপে চুপি-চুপি বলল—কাগজও পড়িস না? উত্তর না দিয়ে স্বাতী মন দিল প্রোফেসরের দিকে। বেশ লাগে শুনতে, কিন্তু এমন করে বইখানা ধরেছেন যে মুখ দেখা যাচ্ছে না। নিজের বইয়ে চোখ রেখে স্বাতী অক্ষরের সঙ্গে ধ্বনিকে মিলিয়ে নিতে লাগল। খুব-যে পড়ায় মন? পেনসিলের খোঁচা লাগল স্বাতীর পিঠে।-আঃ! হঠাৎ পড়া থেমে গেল, স্বাতী চোখ তুলে দেখল বইখানা নেমেছে প্রোফেসরের হাত থেকে টেবিলে, আর তার শান্ত দৃষ্টি পড়েছে তারই মুখের উপর। কী হয়েছে? বাংলায় মৃদুস্বরে তিনি বললেন।

ইভা তাকিয়ে রইল উদাস দৃষ্টিতে অন্যদিকে, আর স্বাতীর মুখে ফুটে উঠল অপরাধের লালরঙা বিজ্ঞাপন। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল সামনের মোটাসোটা মায়া সান্যাল—পড়ায় আমাদের আজ মন লাগছে না স্যর।

কেন?

এই-যে যুদ্ধ লাগল, সে বিষয়ে কিছু বলুন আমাদের।

সে-আলোচনার এটা-তো জায়গা নয়-বলে অধ্যাপক উঠে দাঁড়িয়ে গভীর গম্ভীর গলায় পড়তে লাগলেন–

Nor dim, nor red, like Gods own head
The glorious sun uprist :
Then all averrd I had killed the bird
That brought the fog and mist.
Twas right, said they, such birds to slay,
That bring the fog and mist.

স্বাতী আর তাকাতে পারল না, তার দৃষ্টি লেগে রইল আঠার মতো বইয়ের পাতায়, তার শ্রবণ পান করল প্রতিটি স্বর, তাল, মাত্রা। কবি যে বলেছেন তিন-বছরের শিশুর কথা, সেইরকম মুগ্ধ হয়ে সে শুনতে লাগল–

The fair breeze blew, the white foam flew,
The furrow followed free;
We were the first that ever burst
Into that–

স্যর like Gods own head মানে কী? শমের মুখে তাল কাটল হঠাৎ। মেঝেতে বাটি-ঘষার শব্দে যেমন হয় তেমনি শিউরে উঠল স্বাতীর শরীর, সামনে দাঁড়ানো মায়া সান্যালের পিঠের দিকে ক্রুদ্ধ একটা দৃষ্টি হানল সে।-আরো খানিকটা পড়ে নিই—প্রোফেসর ইংরিজিতে জবাব দিলেন তারপর আলোচনা করব।

Nor dim, nor red-টাও বুঝলাম না স্যর, আপত্তি জানাল অলকা নাগ।

এতে আপাতত বোঝবার কিছু নেই-ছাত্রীদের মাথার উপর দিয়ে প্রোফেসর তাকালেন দেয়ালের দিকে প্রথমে কান দিয়ে শোনো, তারপর মন দিয়ে ভাবো।

কিন্তু সূর্যকে কেন Gods own head বলল? মায়ার নাছোড় জিজ্ঞাসা-বড়ো শক্ত কবিতা স্যর, বললো আর-একজন ভালো করে বুঝিয়ে না দিলে ফলো করতে পারছি না। প্রোফেসরের নম্র লাজুক মুখে রক্ত উঠে আসতে দেখল স্বাতী। বিষণ্ণ হল চোখ, একটু বেঁকল ঠোঁটের কোণ, মুখে যেন কৌতুকের ভাব নিয়ে আস্তে-আস্তে তিনি ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। কী দরকার, স্বাতী ভিতরে ভিতরে জ্বলতে লাগল, এ সবের কী দরকার, পড়ে গেলেই তো হত-বেশ পড়েন কিন্তু উনি, স্বাতী বলল ইভাকে ক্লাশের পরে। কথা ভুল শুনে, কিংবা ইচ্ছে করে ভুল বুঝে, ইভা জবাব দিল-হ্যাঁঃ, ও আবার পড়াবে কী, বাচ্চা ছেলে! পাশ করেই তো বেরোল সেদিন!

সত্যি! কী ছেলেমানুষ রে! আর কী লাজুক! কারো দিকে তাকায় না কখনো!—যোগ দিল মোটা মেয়েটি—এই তো সত্যেন রায়? খুব নামজাদা ছাত্র না? নাম শুনেছি দাদার মুখে—এই প্রথম কথা বললো ছোটোখাটো চশমা-চোখের একটি মেয়ে। ভালো ছাত্র হলেই তো আর ভালো মাস্টার হয় না–ইভা উদ্ধৃত করল তার ভাইস-প্রিন্সিপাল মামার একটি বচন–অনাদিবাবুর অসুখ বলেই তো ওকে পড়াতে দিয়েছে মেয়েদের ক্লাশে। ও তো টিউটোরিয়াল করায় ছেলেদের, মাইনে পায় পঁচাত্তর। একসঙ্গে এতগুলো মেয়ে দেখে যা অবস্থা বেচারার। ইভা বয়সে ক্লাশের সব মেয়ের বড়ো, স্মার্ট, তার উপর আছে তার মামার জোর। অনেকেই হাসল তার কথা শুনে। সকলের যে হাস পেল তা নয়, কিন্তু না-হাসলে মান থাকে না।

এ কী অন্যায়। স্বাতীর তীব্র স্বর হাসি ছাপিয়ে উঠলো—পড়তে তোে দিলেই না, এখন আবার ঠাট্টা! কী সুন্দর পড়ছিলেন, আর কী-সুন্দর কবিতাটা! স্বাতীর রং-ধরা মুখের দিকে ইভা একটু তাকিয়ে রইল, তারপর গম্ভীরভাবে বলল—এইজন্যই-তো বাচ্চা মাস্টারদের মেয়েদের ক্লাশে পড়াতে দিতে নেই। বলেই মুখ টিপে হাসল। আবার কলকলানি উঠল মেয়েদের মধ্যে।–কেন, বুড়োদের দিয়ে বুঝি বিপদ নেই কিছু? দ্রুত জবাব দিয়ে স্বাতী হনহন করে বেরিয়ে এল। বাজে সব!—এইরকম জবাব দিয়েই ঠাণ্ডা করতে হয় ওদের। কী-সুন্দর কী-ভালো লাগছিলো— নষ্ট করে দিল। হিস্ট্রি ক্লাশ থাক আজ, বাড়ি যাই। ছুটি হলেই তো সঙ্গে জুটবে অনুপমা আর চিত্রা আর সুপ্রীতি, বকবক করবে সারাটা পথ-এখন বেশ একা-একা…We were the first, ফুটপাতে নেমে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল স্বাতী, গা-ঘেঁষে একটা গাড়ি চলে গেল…we were the first that ever burst into that silent sea ঈশ, কী করে বানায় এ-রকম, কারা বানায়? into that silent পা বাড়িয়েই সরে এল স্বাতী–বাস! কী মস্ত আর কী আওয়াজ! বাসএর আওয়াজ, ট্রামের আওয়াজ, বড়ো রাস্তায় পঞ্চাশ গোলমাল সব পার হয়ে তার কানে এসে পৌঁছলো সত্যেন রায়ের ভারি, নরম গলা—

Nor dim, nor red, like Gods own head
The glorious sun uprist.
Nor dim, nor red, like Gods own head–মানে! এর আবার মানে! এ-ততা চোখে দেখা যায়।…সমুদ্র, শেষ নেই, শব্দ নেই, শুধু সমুদ্র… একলা একটা জাহাজ, শুধু সমুদ্র… কালোকালো কুয়াশা, ছায়া-ছায়া আলো, শুধু সমুদ্র। আর এই সমুদ্রে কিনা মাথা তুলল আশ্চর্য সূর্য আশ্চর্য, এর চেয়ে আশ্চর্য আর কীট্রামের তোড়, বাস-এর শোর, বড়ো রাস্তার পঞ্চাশ গোলমাল, ভিড়, রোদুর, উঁচু-উঁচু বাড়ি, আপিশ-যাওয়া ছুটোছুটি—মুহূর্তের জন্য কিছু দেখল না স্বাতী, কিছু শুনল না…দেখল সমুদ্র, শুধু সমুদ্র, আর সেই আলোছাড়া কালোছায়ার সমুদ্রে সুর্যের আশ্চর্য মাথাতোলা…শুনল শুধু নরম গম্ভীর একটি গলায় সেই আশ্চর্য কথা, যেমন আশ্চর্য সে জীবনে আর শোনেনি—Nor dim nor red…

কী? রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে চাপা পড়বি নাকি? তার কাঁধে হাত রাখল অনুপমা। তুমি যে? সহপাঠিনীকে সম্ভাষণ করতে একটু দেরি হল স্বাতীর। —তোর পিছন পিছন এলুম। ইভাটা বড়ো অসভ্য, সত্যি…চল। বাড়ি এসে সেই লম্বা কবিতাটি স্বাতী আগাগোড়া একবার পড়ে ফেলল। ভাললা লাগল, কিন্তু তত না। সবটা যদি সত্যেনবাবুর মুখে শুনতে পেত! আবার এক মঙ্গলবার তার ক্লাশ। কিন্তু ক্লাশে আর কতটুকু হয়, আর মেয়েগুলো যা!

পরের মঙ্গলবারে মেয়েরা আরো চঞ্চল, কেননা পুজোর ছুটি দুদিন পরে। বোধহয় সেটা অনুমান করেই সত্যেনবাবু ক্লাশে এলেন না। আর ছুটির পর ক্লাশ নিতে লাগলেন আবার অনাদিবাবু। ভারিক্কি চেহারা, প্রচণ্ড গলা, কখন কবিতা পড়ছেন আর কখন বক্তৃতা করছেন বোঝা যায় না; আর কখন বক্তৃতার মধ্যে হঠাৎ এক ফাঁকে Take down বলে নোর্ট দিচ্ছেন সেটাও বুদ্ধি করে বুঝে নিতে হয়। চল্লিশ মিনিট টু শব্দ নেই সমস্ত ক্লাশে।

…মুহূর্তের জন্য একটু ফাঁক হয়েই কি বন্ধ হয়ে গেল দরজা? কিন্তু আমি-যে দেখে ফেলেছি ভিতরে কী আশ্চর্য! আর কি খুলবে না? আর কি দেখব না? ভিতরে যেতে পারব না কোনোদিন?… লাল মলাটের মোটা পাঠ্যবইখানার স্বাতী পাতা উল্টাতে লাগল বার-বার। যে সুর তার কানে লেগেছিল, আর লাগে না। গুমোটের রাত্রে যেমন অত্যন্ত মৃদু, অস্ফুট, অস্পষ্ট একটুখানি হাওয়া হঠাৎ স্বর্গ ছড়িয়ে মিলিয়ে যায়, তেমনি মাঝে-মাঝে একটু ঝিরঝিরানি লাগল তার মনে-কিন্তু তারপরেই চুপ, আবার গুমোট, নিঃসাড় গুমোট। ক্লাশের মেয়েদের কাছে সে কথাটা পাড়লো—আচ্ছা, এনশেন্ট ম্যারিনর যিনি লিখেছেন তিনি আর কিছু লেখেননি? আর-কিছু টেক্সট নেই আমাদের-বলল সেই ছোটোখাটো কালো মেয়েটি, ম্যাট্রিকুলেশনে স্কলারশিপ পাওয়া।

বাবাঃ, এই নিয়েই হয়রান! মানে-জানতে-চাওয়া মায়া সান্যাল মাথা ঝাঁকাল–যা বিতিকিচ্ছিরি কবিতা!

যত আজগুবি!—বললো সুপ্রীতি। চিনের জাগরণ বিষয়ে সে প্রবন্ধ লিখেছে কলেজ ম্যাগাজিনে।—পাখি মেরেছে তো হয়েছে কী? আর কি ঠাকুমার ঝুলির দিন আছে!

এর পরে ছোড়দিরা যেদিন বাড়িতে এল, স্বাতী কথায়-কথায় বলল-হারীতদা, আপনার কাছে কবিতার বই আছে?

কবিতা? হারীত ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল—কবিতা-টবিতা আমি পড়ি না।

কেন? স্বাতী একটু অবাক হল। কলেজের মেয়েগুলো না-হয় বোকা, হারীতদা তো বিদ্বান। কবিতা দিয়ে কী হয়? কবিতা পড়ে কি পেট ভরে মানুষের?

সে আবার কী! স্বাতী খিলখিল করে হেসে উঠল! কবিতা পড়ে পেট ভরবে কেন? ভাত খেয়ে পেট ভরবে। তরুণী শ্যালিকার এই চপলতা হারীত মার্জনা করল মহতের মতো হেসে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্ত্রীকে বললো—স্বাতীর শিক্ষা ঠিকমতো হচ্ছে না।

স্বাতী খুব ব্রিলিয়ান্ট—জবাব দিল শাশ্বতী। ও ছেলে হয়ে বিজু যদি মেয়ে হতো—

কেন, মেয়েদের ব্রিলিয়ান্ট হতে নেই?

পুরুষ যা পারে মেয়েরা-তো আর তা পারে না?

উঃ! আর্তস্বর বেরল হারীতের। —আর কত, আর কতকাল শুনবো এ-সবনিজে মেয়ে হয়ে লজ্জা করে না এরকম বলতে?

পারে না মানে করতে দেয়া হয় না–শাশ্বতী তৎক্ষণাৎ নিজেকে শুধরে নিল।

তবে? হারীত খুশি হল এবার। আর-ততা কিছু না, সুযোগ-সুবিধের কথা। সোভিয়েট ইউনিয়নে মেয়েরা রেলের এঞ্জিন পর্যন্ত চালাচ্ছে! আরামে গাড়িতে বসে যেতে-যেতে (হারীতের সেই বন্ধুর গাড়ি) শিফন-পরা শাশ্বতী মুহূর্তের জন্য নিজেকে দাঁড় করাল এঞ্জিনের রাক্ষুসে চুল্লির সামনে, আর মনে-মনে ঈশ্বরকে (ঈশ্বর!–কিন্তু কেউ তো আর শুনছে না।) কৃতজ্ঞতা জানাল সোভিয়েট ইউনিয়নে মেয়ে হয়ে জন্মায়নি বলে।

আমাদের দেশেও হবে ও-রকম। স্টিয়ারিং-হুইলে হাত রেখে হারীত একটু হেসে মুখ ফেরাল, আর মুখে-চোখে জ্বলজ্বলে উৎসাহ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শাশ্বতী।

এদিকে স্বাতী শরণ নিল কলেজের লাইব্রেরির। একটু ভয়ে-ভয়ে জিগেস করল–কোলরিজের কবিতার বই আছে? বুড়ো লাইব্রেরিয়ান না-তাকিয়েই জবাব দিল—না কোলরিজ নেই।

–একখানাও না?

না।…উৎপলা সরকার…গোরা—

অনেক আকাঙক্ষায়, অনেক হাতের দাগ লাগা, পেনসিলে-কালিতে অনেক বিচিত্র মন্তব্যের উল্কি আঁকা জীর্ণ মলিন গোরা বইখানা হাতে নিয়ে উৎপলা সরকার সরে যাবার পর স্বাতী আর একবার চেষ্টা করল—আর-কিছু আছে? আর কোনো কবিতার বই?

চশমার ভিতর দিয়ে গোল-গোল নির্জীব চোখে মুখ তুলে তাকাল লাইব্রেরিয়ান। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আলমারির বই ঘাঁটতে-ঘাঁটতে অন্য-একজন বলে উঠলেন–প্যালগ্রেভের গোল্ডেন-ট্রেজরি দিন না।

—প্যালগ্রেভ টেক্সট-বুক, স্টুডেন্টদের ইস্যু করা হয় না। একটু মুখ ফিরিয়েই আবার বই দেখতে লাগলেন সত্যেন রায়, তারপর দু-খানা বই বের করে নিয়ে টেবিলের ধারে এসে দাঁড়ালেন। স্বাতী একবার তাকাল, আবার তাকাল, তারপর হঠাৎ সত্যেনবাবুর চোখ পড়ল তার উপর। লাইব্রেরিয়ানকে তিনি বললেন–দেখুন না মেয়েটি কী চায়। বই দুখানার নাম প্রচুর পরিশ্রম করে খাতায় তুলতে-তুলতে লাইব্রেরিয়ান বললো—আজ আর ইস্যু হবে না।

স্বাতী মনমরা হয়ে ফিরে এল। আস্তে আস্তে হেঁটে লাইব্রেরির দরজা পর্যন্ত এসেছে, এমন সময় হঠাৎ ঝুপ করে একটা বই যেন ছিটকে তার পায়ের কাছে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে বাঁ হাতে সেটি তুলে নিলেন সত্যেন রায়, ডান হাতে এক পাঁজা বই কোনোরকমে সামলে।—এত বই! স্বাতীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

সলজ্জ একটু হেসে সত্যেনবাবু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বইগুলি দু-ভাগ করে দু-হাতে নিলেন। স্বাতীও থেমে গেল, চোখ দিয়ে বইগুলি একবার স্পর্শ করে বাধোবাধো গলায় বললো–আপনি…আপনি আমাদের ক্লাশ আর নেন না? বইয়ের দুটি স্তুপের উপর প্রোফেসরের দুই হাতের আঙুল একটু চঞ্চল হয়ে উঠল, মৃদুস্বরে বললেন কোন ইয়ার তোমার? ফার্স্ট ইয়ার…এনশেন্ট ম্যারিনর পড়াচ্ছিলেন আমাদের…খুব ভালো লেগেছিলো।

ভালো কবিতা। ভালো লাগাই উচিত—বলেই সত্যেনবাবু যেন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে, স্বাতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি কবিতা ভালোবাসো?

কবিতা? আমি… কী জবাব দেবে, কী-কথা বললে ঠিক হবে স্বাতী ভেবে পেল না।

রবীন্দ্রনাথ পড়েছো?

এ-প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দিতে পারল না স্বাতী।—রবীন্দ্রনাথ পড়ো। নিজের বই-ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে সত্যেনবাবু আবার বললেন।–আর… এ-কলেজের লাইব্রেরির কোনো আশা রেখো না—বাঁ হাতের স্কুপ থেকে ডান হাতের দু-আঙুল দিয়ে সুকৌশলে ছোটো একটি বই বের করে আনলেন তিনি—এ-বইটা পড়ে দেখো। প্রোফেসরের দু-আঙুলের ফাঁক থেকে স্বাতী বইটা নিজের হাতে নিল। মলাটের ভিতরে পাতায় লেখা নামের দিকে তাকিয়েই মুখ তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে আর সময় না দিয়ে দু হাতে দুই বইয়ের বোঝা নিয়ে একটু দুলে-দুলে সত্যেনবাবু বেরিয়ে গেলেন।

গোল্ডেন-ট্রেজরির সবগুলি পাতা ওল্টাতেই স্বাতীর সাত-আট দিন লেগে গেল। যে-পাতাই খোলে, সেখানেই চোখ আটকে যায়…কত!..কত! কোনটা ফেলে কোনটা পড়বে! আট লাইনের ছোটো একটি যদি পড়ল, সেটাই পড়তে ইচ্ছে করে বার-বার, আবার সেই সঙ্গে তার পাশেরটিও তাকে টানে, আর তার পরেরটিও। Spring, the sweet spring is the years pleasant king…the spring time, the only pretty ring time… mistress mine… Full fathom five… এসব কী? …কী! ছাপার অক্ষর যদি গান করে, তাহলে কি মানুষ পাগল হয়ে যায় না? কতদিনে সে পড়ে উঠবে এ-বই, কত মাসে, কত বছরে?…একটি লাইনই তো সারা দিনে মাথা থেকে নড়ে না—এ রকম হলে সারা জীবনেই শেষ হবে না তো! কবে ফেরৎ দিতে হবে কিছু বলেননি উনি, তাই বলে অনেক দিন তো আর রাখা যাবে না। স্বাতী মাঝে-মাঝে কলেজে নিয়ে যেতে লাগল ফেরৎ দিতে, কিন্তু কোথায় সত্যেন রায়। তিনি ছেলেদের পড়ান, আর এখানে ছেলেদের আর মেয়েদের ক্লাশ আলাদা ভাগ করা–কেমন করে দেখা হবে? আর উনিও বেশ, বই দিয়ে ভুলেই আছেন একেবারে, চেয়ে পাঠালেও তো পারেন। কিন্তু চাইবেন কার কাছে, উনি তো আমার নাম জানেন না। এ রকম দেয়াই ঠিক না, আমি হলে দিতাম না কখনো—এখন দরকার হলেই বা পাবেন কী করে, আমারই উচিত ফেরৎ দিয়ে আসা, না-দেয়াটা অন্যায় হচ্ছে। স্বাতী রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল এ নিয়ে, কিন্তু সত্যেন রায়কে আর ধরাই গেল না; একদিন দু-দিন করে-করে শীত কেটে গেল, গরম পড়ল, পরীক্ষা হল কলেজের, গ্রীষ্মের ছুটি এল।

******

ছুটির মধ্যে বাবা একদিন বললেন—স্বাতী, আজকাল যেন তুই একটু মন-মরা?

না-তো! ঝকঝকে হেসে জবাব দিলো স্বাতী।

সারাটা দিন তোর তো একাই কাটে। স্বাতী চুপ করে রইলো।

ছোড়দির বাড়ি যাস না?

যাই তো।

দু-চার দিন থাকলেও তো পারিস গিয়ে?

না, বাবা–।

কেন? শাশ্বতী আমাকে বলছিলো সেদিন—

বাড়িতে ছাড়া আমার ভালো লাগে না কোথাও।

বেশ তো, বাড়িতেই বন্ধুদের আসতে বল।

বন্ধু পাবো কোথায়?

কেন, কলেজে পড়ছিস আজকাল—আমি ভেবেছিলাম কত রঙিন শাড়ি পরাপর মেয়েরা আসবে বিকেলে—হাসি, গান, গল্প—চমৎকার!

এ-বিষয়ে ওস্তাদ ছোড়দি, না বাবা? কী হৈ-চৈ—আর কী-রকম নিশ্চুপ হয়ে গেছে বাড়িটা।

তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লাগে?

তোর লাগে বুঝি?

আমার না।

মেয়ের মুখের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে রাজেনবাবু বললেন—দিদিরা তো মস্ত মিশুক এক একজন—তুই এ-রকম কুনো হলি কেন? ছেলেবেলার মতো একটুখানি শরীর বেঁকিয়ে স্বাতী বলল—আছি আছি কুনো। কুনোই ভালো।

কলেজে একটি মেয়ের সঙ্গেও ভাব হয়নি তোর?

স্বাতী জবাব দিল না। একটু চুপ করে থেকে রাজেনবাবু বললেন–তোর দাদার খবর-টবর কিছু রাখিস? দাদার দু-একটা কথার সঙ্গে নিজের অনেকখানি ইচ্ছা মিশিয়ে স্বাতী খবর দিল— দাদা বোধহয় কোনো রেডিওর দোকানে কাজ শিখছে।

ভালো। উদাস মন্তব্য রাজেনবাবুর।

তোমার সঙ্গে আজকাল বুঝি দেখাশোনাই হয় না দাদার?

কোথায় আর!

ওর একটা অদ্ভুত ধারণা হয়েছে যে তুমি ওকে ভালোবাসো না।

মূর্খের অশেষ দোষ।

ঐ তো! ও-রকম যে বলল ও বুঝি আর বোঝে না?

মিথ্যে বলি?

সত্য হলেই বলতে হয় নাকি সব সময়?

বলাবলির আর আছেই বা কী–ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাজেনবাবু চুপ করলেন।

বাবা, শোনো-স্বাতী তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়লো—সেদিন একখানা পুরোনো বই খুঁজে পেলাম—গীতাঞ্জলি—মার নাম লেখা। আগে তো দেখিনি। রাজেনবাবু একটু ভেবে বললেন–কোন জন্মের বই। আছে এখনো? হাতে নিতেই রাজেনবাবুর চোখে পড়ল মলাটছেড়া বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা নামটি। যেন চিনতেই পারলেন না সেই হাতের লেখা, সেই নাম। সাদা কাগজ হলদে হয়েছে, কালো কালি বাদামি–তবু হাতের লেখার সেই ডৌল, পাশাপাশি দুটো তালব্য-শর হাসি-হাসি মুখ—সেই নাম..নাম। চোখ সরাতে গিয়েও আবার চোখ রাখলেন রাজেনবাবু। বাবার চোখের দৃষ্টি লক্ষ করে স্বাতী বলল–মা বুঝি ভালোবাসতেন। এ-বই? বইখানা উল্টো করে শুইয়ে রাজেনবাবু বললেন—তখন তো ঘরে-ঘরে গীতাঞ্জলি–কী-কাণ্ড! সকলের মুখে ওসব গান। আমার এক বন্ধু ছিল হরেন–কতদিন কত গান শুনিয়েছে সে-আর তোর মা হঠাৎ একটু থেমে, কেমন-একটু আড়ষ্ট হয়ে রাজেনবাবু যেন কোনোরকমে কথাটা শেষ করলেন—তোর মা খুব খাওয়াতেন-টাওয়াতেন আর কী! বলল, বাবা, বলো-বাপের গা ঘেঁষে বসল স্বাতী।

আর কী বলবো!

মা খুব গান ভালোবাসতেন, না?

ঐ তো-রান্নাঘরে বসে লুচি ভাজতেন, আর দরজার আড়াল থেকে গানের ফরমাস করতেন মাঝে-মাঝে।

আড়াল থেকে কেন?

তখন কি মেয়েরা বেরোত নাকি রে কারো সামনে–রাজেনবাবু হাসলেন।

কী বিশ্রী! সঙ্গে-সঙ্গে স্বাতীর মন্তব্য।–ভাগ্যিশ সে-যুগে জন্মাইনি! তারপর?

তারপর কী রে! গর নাকি যে তারপর?

তোমরা তখন কোথায় ছিলে, বাবা?

তখন? শাঁখারিপাড়ায়।

শাঁখারিপাড়া কোথায়, বাবা?

আছে কলকাতাতেই কোথাও।

আমি তখন জন্মেছি?

দূ–র! সরস্বতীই ও-বাড়িতে জন্মাল।

দুটি-তিনটি শিশু নিয়ে মা-বাবার সেই গান-শোনা ঘোমটা-মানা সংসার স্বাতীর মনে হল স্বপ্নের মতো। এতো সুখ…বুকটা যেন টনটন করে উঠল তার—এ সুখ আমি কি জানবো কোনোদিন? মা বেরোতে পারতেন না কারো সামনে, রান্নাঘরে বসে গান শুনতেন। তবু এত সুখ! আমি ততা স্বাধীন, আমি তো কত কিছু পারি, কিন্তু…কিন্তু…এতে কি সুখ বেশি? ছোড়দি কি মা-র, চেয়ে বেশি সুখী? সেই শাঁখারিপাড়ার মা-বাবার সঙ্গে তুলনা হয় নাকি ছোড়দি আর হারীতদার?… কেন হবে না? ছোড়দি খুব ভালো আছে, কত নতুন গয়গায় যাচ্ছে, কত নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে, মুখে তার ঝরে পড়ছে খুশি। কিন্তু.. বাবা—স্বাতী একটু ক্ষীণ স্বরে বললো—আমাকে সেই শাঁখারিপাড়ার বাড়িটা দেখাবে একদিন?

কথা না-বলে রাজেনবাবু আর একবার তাকালেন কোন জন্মের পুরনো সেই গীতাঞ্জলির দিকে। আর স্বাতী, উপুড়-করা বইখানার গায়ে আস্তে হাত বুলিয়ে আস্তে বললো—সুন্দর গানগুলি, না বাবা?

রাজেনবাবু চোখ দিয়ে সায় দিলেন। বাবা—স্বাতীর কথায় লজ্জার ঢেউ উঠল—আমাকে দশটা টাকা দেবে?

কী চাই? তক্ষুনি বদলে গেল রাজেনবাবুর চোখ-মুখ।

রবীন্দ্রনাথের বই আরো কিনলে হয় না?

মোটে দশ টাকা তার জন্য?

ও মা! তুমি কি ভাবছো আমি সব বই কিনব? দোকানে বলল যে সব কিনতে দেড়শো-দুশো টাকা লাগবে।

তা এমন কী বেশি! বইও তো বোধহয় দেড়শো-দুশো।

বেশ-তো! আনন্দের আলো জ্বলে উঠল স্বাতীর মুখে-মাসে-মাসে আস্তে-আস্তে–।

ইশ! খুব-যে হিসেবি হয়েছিস-রাজেনবাবু মেয়ের মাথাটি ধরে নেড়ে দিলেন।

******

মানসী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা–টাটকা নতুন বই কখানা বিছানায় ছড়িয়ে স্বাতী চুপ করে শুয়েছিলো দুপুরবেলায়। মেঘ করেছে আকাশে—ধোয়ারঙের… ছায়ারঙের… রাতরঙের মেঘ, উঁচু-উঁচু নারকেল গাছের মাথা কালো করে দিয়ে, কাঁপা-কাঁপা হাওয়ায় সেতারের মীড় তুলে-তুলে আকাশের মেঘ আস্তে-আস্তে স্বাতীর মনে ছড়িয়ে পড়ল। কেন মন খারাপ লাগে? কীসের দুঃখ আমার? কোনো দুঃখ তত নেই। তবে? কবিতা পড়ে পড়ে হল নাকি এ রকম? হারীতদার কথাই কি তবে ঠিক-তবে কি ইভা-শোভনা-সুপ্রীতিরা বোকা নয়— যা কোনো কাজে লাগে না সেটাই বাজে? ঠেসে ইকনমি পড়ো, মাথা থেকে সব ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে–হারীতদা তাকে বলেছিলেন। ধোঁয়া…মেঘও তো ধোঁয়া, কিন্তু মেঘ কি বাজে? যদি মেঘ না-হত, বৃষ্টি না-হত…

স্বাতী–! দাদাকে দেখে খুশি হয়ে স্বাতী উঠে বসল।

আলমারির চাবিটা দে তো একটু।

আলমারি তো খোলাই, শাড়ি বুঝি? বিজু জবাব না-দিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে শাড়ি বাছতে লাগল।

আর কতকাল তুই মেয়ে সাজবি রে দাদা?

বেশিদিন না—বিজু ঘাড় ফিরিয়ে হাসল—মেয়ে পুরুষে মিলে যে-রম নাটক লাগিয়েছে। আজকাল, যাকে বলে জীবননাট্য। কথাটা অগ্রাহ্য করে স্বাতী বলল ছেলেবেলায় তবু একরকম, তাই বলে এখন নাকি দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মেয়ে সাজলে মানায়!

দাড়ি-গোঁফ তো এমনিই সবাই কামায় আজকাল—বিজু জবাব দিল।আর মানাবার কথা কী বলছিস, ঢাকুরেতে ষোড়শী করেছিলাম, তিন দিন পর্যন্ত আর কোনো কথা বলেনি কেউ। স্বাতী হেসে উঠল।

দেখলে আর হাসতিস না ও রকম করে! ভালো শাড়ি কিছু নেই রে তোর, ছোড়দির কত ছিল! এই নীলাম্বরীটা–

ওটা নিস না, দাদা, ওটা মার-চেঁচিয়ে উঠলো স্বাতী।

দেখি না একটু!

না, না, দেখতে হবে না রেখে দে! লাফিয়ে খাট থেকে নেমে স্বাতী হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল। এক পলক তাকিয়ে বিজু বলল—থাক বাবা, থাক। তোরই মা, তোরই বাবা, আমার তো কেউ নয়।

মার শাড়িখানা যথাস্থানে ফিরিয়ে রেখে স্বাতী বলল—তাই বলে তোদের ঐ গোলমালের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে না। সেবার হারালি তো আমার অত সুন্দর ঢাকাই জামদানিখানা!

ভারি তো! পাঁচ টাকা দাম!

তা যা-ই হোক, কী-সুন্দর কচিপাতা রঙটা ছিলো! আর পাঁচ টাকা এমন কমই বা কী!

তোর আবার টাকার অভাব! বাবার কাছে চাইলেই তো পাস—

তুই পাস না? বিজু এ-কথার জবাব দিল না; বিছানার ধারে এসে ছড়ানো বইগুলির দিকে তাকিয়ে বলল-কিনলি? তা আমাকে কেন বললি না, শস্তায় এনে দিতাম।

বইয়ের আবার শস্তা দাম আছে নাকি?

তুই জানিস কী?–জ্ঞানের গৌরবে বিজুর চোখ দুটি চকচকে হয়ে উঠল। —এই-ততা শেষ রক্ষা করছি আমরা। ছকপি বই লাগবে। এক টাকার বই চোদ্দো আনায় আনিয়ে দিলেন ধ্রুব দত্ত।

কে?

নামও শুনিসনি? কী তাহলে কলেজে পড়িস, এত বড়ো কবি একজন! ষোড়শী দেখতে ধরে এনেছিলাম ওঁকে। আমার পার্ট দেখে বললেন—

কবি? কবিতা লেখে?

লেখে মানে? ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আওয়াজ করে বিজু বলল-কত বই ওঁর। তাই-তো সব বই কম দামে কিনতে পান। জানিস, আমাদের শেষ রক্ষাতেও আসবেন।

গোঁফ কামানো ইন্দুমতীকে দেখতে?

রাখ, রাখ, তোরাই যেন ভাল পারিস এর চেয়ে? পাইচারি করতে-করতে বিজু সগর্বে বলতে লাগল-বিলেতেই অ্যাকট্রেস ছিল নাকি শেক্সপীয়রের সময়? চীনদেশে তো এখনও নেই। স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর নটী সাজেননি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে? দাদার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে স্বাতী বলল–কার কাছে শুনেছিস এ-সব?

যার কাছেই শুনি না! বিজু খাটের উপর বসে পড়ে মনে করবার চেষ্টা করল এ বিষয়ে ধ্রুব দত্ত আরো কী বলেছিলেন। একটু পরে চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে বলল—একবার দেখে আয় না কেমন, তারপর বলিস।

না —

তা যাবি কেন? আমি যেখানে আছি সেখানে কি তুই যেতে পারিস: জীবনে কখনো যা করলি না , সে-রকম একটা কাজ তোকে করতে বলাই ভুল হয়েছিল আমার।-বিজু মুখ লাল করে উঠে দাঁড়াল।কথায়-কথায় তোর রাগ ওঠে কেন রে দাদা?

রাগ আবার কী? অনন্যরা যত ভালই বলুক, আমি যা করি তা-ই তোর কাছে বাজে! স্বাতী হেসে ফেলল–তোকে ভাল বলতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু অন্যেরা ভাল বললে ভাল লাগে।

শুনিস না তো কী বলে সবাই–বিজু তক্ষুনি নরম হল। আমিও ভাবছি রে—হঠাৎ গলে গিয়ে বোনকে সে মনের কথাটা বলে ফেলল—আর মেয়ে সাজব না। দু-একবার হিয়োর পার্টে নামতে পারি যদি, তা হলেই ফিল্মে একটা চান্স পাওয়া যাবে।

ফিল্মে…?

এখন বসিল না কাউকে কিছু–বিজু চোখ টিপল।–দ্যাখ-না একেবারে অবাক করে দেব। দাদা, তুই-যে সেই রেডিওর দোকানে—

হয়েছে, হয়েছে—বিজু ব্যস্ত হয়ে উঠল—পছন্দ করা শাড়ি তিনখানা তাড়াতাড়ি কাগজে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল—তাহলে কাল যাবি নাকি?

বাবা যদি যান—

বাবার দরকার কী রে? এই তো এখানে সাদার্ন এভিনিউ আর ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে—

তাছাড়া ছোড়দিরাও কথা শেষ করবার সবুর সইল না বিজুর।

আবার একা ঘরে মেঘলা দুপুরে স্বাতীর মন খারাপ লাগল। চুপচাপ পাড়া। বড়ো রাস্তার ট্রামের শব্দ হঠাৎ শোনা গেল। ঠিক যেন কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঘরের মধ্যে। কোথাও তার চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিছু তার করতে ইচ্ছে করে, কী-যেন দেখতে শুনতে, জানতে ইচ্ছে করে…না, কপালে হাত বুলিয়ে স্বাতী মনে মনে বলল—কিছু না। জানলা দিয়ে চোখে পড়ল আকাশে মেঘের ফাঁকে নীল, আর গাছের কচি-কচি পাতা-ভরা সবুজ মাথা। আর সেই নীল আর সবুজের মাঝখানে আস্তে উড়ে চলা শান্ত, নিশ্চিন্ত, কুচকুচে কালো একটা কাক। কী সুখী ঐ কাক! দেখেও সুখ। কিন্তু এ কীরকম সুখ যাতে আরো বেশি মন খারাপ হয়ে যায়!

পরের দিন বেশ তোড়জোড় করেই সে দাদার শেষরক্ষা দেখতে গেল ছোড়দি আর হারীতদার সঙ্গে। বইখানা পড়ে কী হেসেছিল একবার! তখন যদি কেউ তাকে বলত, রবীন্দ্রনাথ পড়া, তাহলে এতদিনে…কী হত? বই পড়ে কী হয়? বই পড়েই কি সুখী হয় মানুষ? কবিতা পড়ে কি পেট ভরে? বিলেত থেকে এই শিখে এলেন হারীতদা! কবিতা পড়ে দুঃখ বাড়ে, তাই তো কেউ কবিতা পড়ে না…দুঃখ?

******

সামনের দিকের চেয়ারে সসম্মানে বসে স্বাতী একবার মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দর্শকদের দেখে নিল। মনে হল, রাজ্যের বাজে ছোকরা আর মোটা-মোটা গিন্নি আর বিরক্ত চেহারার আধ-বুড়ো পুরুষ জড়ো হয়েছে এক জায়গায়। কিন্তু মানুষ তো তার চেহারা…চেহারাটা কিছুই কি নয় তাই বলে? বাবাকে দেখে কে না বলতে পারে যে অমন ভালমানুষ হয় না। আর সত্যেন রায়ের মুখ দেখেই বোঝা যায় যে তিনি কবিতা-পড়া মানুষ। তাই তো মেয়েগুলো সাহস পায়। ঐ ধ্রুব দত্ত এলেন।—কথাটা কানে যেতেই স্বাতী তাকাল। তিন-চার জন ভলান্টিয়র পায়েপায়ে বিনয় ঝরিয়ে তাদের প্রধান অতিথিটিকে এনে বসাল একেবারে সামনে। বাচ্চাদের সতরঞ্চির ধারে একটু আড় করে পাতা একটি স্বতন্ত্র চেয়ারে। বোধহয় তাঁর আসবার জন্যই দেরি হচ্ছিল। একটু পরেই পরদা উঠে পালা আরম্ভ হল।

স্বাতীর চোখ মাঝে-মাঝে সরে আসছিল নাটক থেকে ধ্রুব দত্তর দিকে। কবি! একজন কবি। এই প্রথম একজন জ্যান্ত কবিকে চোখে দেখল সে। মুখ দেখা যাচ্ছিল আধখানারও কম, চেয়ারের মধ্যে কেমন এলিয়ে, মাথা নামিয়ে, পা দুটোকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে বসেছেন ভদ্রলোক। অথচ সুস্থির ভাব নেই, ওরই মধ্যে অবিশ্রান্ত নড়াচড়া করছেন, আর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত একটার পর একটা। ইনি কবিতা লেখেন? ঐ-রকম করে সাজাতে জানেন কথা? বোবা অক্ষরকে দিয়ে গান গাওয়ান?…ঐ রকম দেখতে? ছছাটো করে ছাঁটা চুল, মোটা ঘাড়, শক্ত-শক্ত হাতএকেবারেই সত্যেন রায়ের মতো নয় তো! কিন্তু হবেই বা কেন, সত্যেন রায় কি কবি? আর হলেই বা কী? দু-জন কবি কি একরকম হয় দেখতে? দু-জন মানুষ কি একরকম হয় কখনো? সে কেন ভাবছিল? সত্যি, কী বোকার মতো…চোখ সরিয়ে নিল, নাটকে মন দিল। প্রথম অঙ্ক শেষ হবার পর হারীত বলল—উঠবে নাকি এবার?

এখনই? শাশ্বতী আপত্তি জানাল। বেশ তো লাগছে, আর বিজুকে সত্যি মেয়ে মনে হচ্ছে। মন্দ কী–দাঁতে পাইপ চেপে হারীত বলল। ক্যাপিটালিজম-এর রাজত্বে এর বেশি আর কী হবে! শাশ্বতী মিইয়ে গিয়ে বলল—কেন, ভাল না?

কী-রকম ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলছে সবাই! হারীত ছোটো করে হাসল—জীবনেও যারা কোনো কাজ করে না….

সে-তো ঠিকইছোড়দির খোপার পিছন দিকে তাকিয়ে স্বাতী বলল—কাজের লোকেরা কি কথা বলে।

অন্তত ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে না—হারীত জবাব দিল।

চিবিয়ে-চিবিয়ে বলে—সঙ্গে সঙ্গে স্বাতীর প্রত্যুত্তর। হারীত গম্ভীর হয়ে চুপ করল। আর দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে একেবারেই উঠে দাঁড়াল-না, আর না, বলে। শাশ্বতী উশখুশ করে বলল–কী স্বাতী, যাবি?

যে-উত্তর সে চেয়েছিল তা পেল না। তোমরা গেলেই যাব, বলতে-বলতে স্বাতীর চোখ ফিরল ধ্রুব দত্তর দিকে। স্বামীর মুখের দিকে চকিতে একবার তাকাল শাশ্বতী, কোনো আশা পেল না। কী মুশকিল! কে জানত শেষ রক্ষা নাটকও সর্বনেশে ক্যাপিটালিজম-এরই একটি বিষফল। বেশ লাগছিল, আর এমন বেশিক্ষণও তো নয়! হঠাৎ হারীত বলল–তোমরা তাহলে থাকো, আমি চললাম। তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল শাশ্বতী, একটু পরে স্বাতী।

ইচ্ছে হলে থাকে না তোমরা—দু-সারি চেয়ারের ফাঁক দিয়ে একটু এগিয়ে-হারীত থামল। শাশ্বতী কথাটা শুনল, মুখ দেখল না।—থাকব? তার গলার স্বরে খুশি গোপন থাকল না–তুমি কি তাহলে ঘুরে আসবে আবার?

আমার আর আসবার দরকার কী? ফিরতে পারবে না একা? আর না-ই ফিরলে না-হয়, ও বাড়িতে থেকে রাতটা…বলতে-বলতে হারীত তাকাল স্ত্রীর দিকে। শাশ্বতী আর কথা বলল না, মাথা নিচু করে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে এল। রাগ? এই নিয়ে এত রাগ? আর স্বাতীর সামনে? এ রকম রাগ করতেও জানে? তা মনের কথাটা প্রথমেই খুলে বললে হত, আমি কি জোর করতাম? রাস্তায় এসে হারীত হাঁটতে লাগল পুরো পুরুষালি কদমে। স্বাতী বলল—একটু আস্তে হারীতদা।

তোমার অসুবিধে হচ্ছে?

আমার না ছোড়দির। মোটা হয়ে পড়েছে কিনা।

তোমাদের সঙ্গে চলতে আমারই অসুবিধে–বলে হারীত দয়া করে একটু ঢিল দিল হাঁটায়। কী আর করবেন, অসুবিধেটা নিজেই ঘটিয়েছেন যখন-স্বাতী আড়চোখে তাকাল ছোড়দির দিকে। কিন্তু শাশ্বতী কিছু বলল না, হারীতও চুপ। হনহন হেঁটে কয়েক মিনিটেই তারা দেখতে পেল টালিগঞ্জের ব্রিজ। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে হারীত বলল—আমরা এখান থেকেই ট্রাম ধরি। যাঃ! কথাটা উড়িয়ে দিল স্বাতী। কিন্তু হারীত শক্ত হয়ে দাঁড়াল ট্রাম-স্টপের কাছে। শাশ্বতীর শরীরে যেন একটা ঢেউ উঠল। ঢেউ মিলিয়ে গেল, গলা পর্যন্ত এসে ফিরে গেল কথা। দুই কণ্ঠার ফাঁকে ছছাটো গর্তটুকু যেন কেঁপে কেঁপে উঠল। ঢোঁক গিলে, নেকলেসে একবার হাত রেখে গায়ে-মাথায় আঁচল টেনে স্থির হল সে।

আসুন, বাঃ! স্বাতী হারীতদাকে ডাকল।আজ আর থাক। হারীত তাকাল ট্রামের আশায়। রাস্তার ইলেকট্রিক আলোর তলায় মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হল দু-বোনে। শাশ্বতী আগে চোখ নামাল, নিচু করল সিঁদুর-ছোঁওয়ানো মাথা। ফিরিয়ে নিল ঈষৎ রঙ-বোলানো মুখ। বাঁকের মুখে দেখা দিল আলো-জুলা ট্রাম। আচ্ছা যাই—কোনোদিকে আর না তাকিয়ে স্বাতী তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল বাড়ির গলিতে।

রাজেনবাবু শুয়েছিলেন চোখ বুজে, কপালে হাত রেখে। শব্দ শুনে উঠে বসে বললেন–ওরা কোথায়?

ওরা বাড়ি গেল, বাবা।

এল না?

একটুও দেরি না করে স্বাতী জবাব দিল—হারীতদার কাছে কার যেন আসবার কথা সাড়েনটার সময়। জরুরী কাজ, তাই…

একটু এল না!

আহা, তোমার আবার সবটাতেই বাড়াবাড়ি। এখান থেকে এখানে, কালই হয়তো আসবে আবার।

তুই কার সঙ্গে এলি?

আমি? আমি… মস্ত দল এল পাড়ার। দাদা কী সুন্দর করল, বাবা দাঁড়াও, সব বলছি এসে–এক ছুটে কাপড় বদল এল স্বাতী। পিঠের উপর কোঁকড়া ঘন চুল ছড়িয়ে দিয়ে বসে বসে সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগল নাটকের। প্রত্যেকের গলার আওয়াজ, বলার ধরন এমন করে নকল করল, যে রাজেনবাবু শব্দ করে হেসে উঠলেন কয়েকবার।

খুব যেন একটা গোলমালে স্বাতীর ঘুম ভেঙে গেল রাত্তিরে। বাইরে শো-শে ঝড়। ঘরের মধ্যে হাওয়ার হৈ-চৈ, আর জানলার ঠকাশ-ঠকাশ শব্দ। একলা অন্ধকারে ভয় পেয়ে হঠাৎ সে ডেকে উঠল ছোড়দি! তারপরেই পাশ ফিরে ভাল করে চোখ মেলে তাকাল। ঘরের মধ্যে আর-এক কোণে ছোড়দির খাট পড়ে আছে এখনো। খালি-খালি বিশ্রী দেখাচ্ছে, আর জায়গাও জুড়ে আছে মিছিমিছি।…কী ছেলেমানুষ ছিলাম! একা শুতে পারতাম না কিছুতেই, কত বড়ো হয়েও বাবার কাছেই শুয়েছি। তারপর মা যখন… তখন থেকেই ছোড়দি আর আমি। বাবা আলাদা করে দিলে কী হবে, আমি ছোড়দির খাটেই বকরবকর করতাম শুয়ে-শুয়ে। ঝগড়া করে নিজের বিছানায় এসে উপুড় হয়ে পড়তাম। তারপরেই আবার ডাকতাম—হোড়দি! নিজের সেই ঘুমে-ভরা ভাঙা-ভাঙা গলার ডাক স্বাতী যেন কানে শুনতে পেল।… কে ভেবেছিল একা। একা ঘরে… কেন, ভাবতে না পারার কী আছে, এ তো জানাই জানা। আর এখনো ছেলেমানুষ আছছা নাকি যে রাত্রে ঘুম ভাঙলে ভয় করবে! ওঠো, আলো জ্বালো, জানলা বন্ধ করো! ভাবতেভাবতেই আলো জ্বলে উঠল তার চোখে বাড়ি মেরে। আর স্বাতী তক্ষুনি চোখ বুজে ফেলল, কিন্তু দেখতে লাগল মিটিমিটি। কাছের জানলাটা বন্ধ করে দূরের জানলা দুটোয় ছিটকিনি লাগিয়ে খুলে রেখে বাবা এসে দাঁড়ালেন তার বিছানার ধারে। বাবা! চোখ মেলে হেসে উঠল সে। জেগেছিস?

তুমি আবার উঠে এসেছ কেন?

তবু একটু ঠান্ডা হল, বাঁচলাম।

বাবা, দাদা ফিরেছে?

কই, না!

রাত-বিরেতে না-ফেরাই ভাল, কী বল? সে কথার জবাব না দিয়ে রাজেনবাবু আলনা থেকে একখানা খদ্দরের চাদর এনে মেয়ের গায়ের উপর বিছিয়ে বললেন—ঘুমো এখন। বাবা, একটু বসবে আমার কাছে? থাক, শোও গিয়ে। রাজেনবাবু বসে বললেন–বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিটা কেশ, না রে? খুব ভাল, বাবা, খুব ভাল লাগে-উষ্ণ নিশ্চিন্ত আরামে স্বাতীর কথা জড়িয়ে এল। বাবা, শোনো, ঐ খাটটা তো কোনো কাজে আর লাগে না হ্যাঁ, ওটা সরিয়ে দেব। জাজিম-পাতা, বিছানাহীন শূন্য খাটটার দিকে রাজেনবাবু একবার তাকালেন। তারপর দুই চোখ ভরে দেখতে লাগলেন তার সবচেয়ে ছোটো, সবচেয়ে সুন্দর, তার সর্বশেষ, তার একমাত্র কন্যাকে। স্বাতীর চোখে তখন বাসা বেঁধেছে ঘুম, সে দেখছে অনেক ভিড়, লোকজন… নাটক আরম্ভ হবে এখুনি, ধ্রুব দত্ত সিগারেট খাচ্ছেন বসে বসে, কিন্তু ছোড়দি নেই, হারীতদাও না, চারদিকে অচেনা মুখ, জায়গাটা অচেনা। কোথায় এল সে, কেমন করে এল? আরে, ঐ-তো বাবা! বাবা! ঘুমে-ভরা ভাঙা-ভাঙা স্বরে ডাকল একবার। বাবা এটা তোমার হাত? হাত বাড়িয়ে টেনে নিল বাবার হাতখানা। আঁকড়ে ধরে তক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ল। বাইরে বৃষ্টি, বৃষ্টি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *