২৫. মীমাংসা সভা

কল্লোলের শেষ বছরে বিচিত্রায় চাকরি নিলাম। আসলে প্রুফ দেখার কাজ, নামে সাব-এডিটর। মাইনে পঞ্চাশ টাকা।

বহুবিত সাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিচিত্রার সম্পাদক। তার ভাগ্নে আদি পোস্ট-গ্রাজুয়েটে আমার সহপাঠী ছিল। সেই একদিন বললে, চাকরি করব কি না। চাকরিটা অপ্রীতিকর নয়, মাসিক পত্রিকার আপিসে সহসম্পাদকি। তারপর বিচিত্রার মত উচকপালে পত্রিকা-–যার শুনেছি, বিজ্ঞাপনের পোস্টার শহরের দেয়ালে ঠিক-ঠিক লাগানো হয়েছে কিনা দেখবার জন্যেই ট্যাক্সি-ভাড়া লেগেছিল একটা স্ফীতকায় অঙ্ক। কিন্তু আমরা নিন্দিত অতি-আধুনিকের দলে, অভিজাত মহলে পাত্তা পাব কিনা কে জানে। সাহিত্যের পূর্বগত সংস্কায়-মানা কেউ আছে হয়তো উমেদার। সে-ই কামনীয় সন্দেহ কি।

কিন্তু উপেনবাবু অবাক্যব্যয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন। দেখলাম গণ্ডূষজলে সফরীরাই ফরফর করে, সত্যিকারের যে সাহিত্যিক সে গভীরসঞ্চারী! উপেনবাবুর দুই ভাই গিরীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় দুইজনেই আধুনিক সাহিত্যের সংরক্ষক ছিলেন। সুরেনবাবু তো সক্রিয় ভাবে অজস্র লিখেছেনও কল্লোল-কালিকলমে। গিরীনবাবু না লিখলেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন মজঃফরপুর সাহিত্য-সম্মিলনে। খানিকটা অংশ তুলে দিচ্ছি :

আজ সাহিত্যের বাজারে শ্লীল-অশ্নীল সুরুচিসম্পয়-রুচিবিগর্হিত চনার চুলচেরা শ্রেণীবিভাগ লইয়া যে আলোচনার কোলাহল জাগিয়াছে তাহা বহু সময়েই সত্যকার রুচির সীমা লঙ্ঘন করিয়া যায়। কুৎসিতকে নিন্দা করিয়া যে ভাষা প্রয়োগ করা হয় তাহা নিজেই কুৎসিত।।

অশ্লীলতা এবং কুৎসিত সাহিত্য নিন্দনীয়, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন। ইহা এমন একটা অদ্ভুত কথা নহে যাহা মানুষকে কুৎসিত কণ্ঠে শিখাইয়া না দিলে সে শিখিতে পারিবে না। কিন্তু আসল গোল হইতেছে শ্লীলতা এবং অশ্লীলতার সীমানির্দেশ ব্যাপার লইয়া। কে এই সীমা-নির্দেশ করিবে? …

এই তথাকথিত অশ্লীলতা লইয়া এত শঙ্কিত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। ছেলেবেলায় আমি একজন শুচিবায়ুগ্রস্ত নারীকে দেখিয়াছিলাম, তিনি অশুচিকে বাঁচাইয়া চলিবার জন্য সমস্ত দিনটাই রাস্তায় লক্ষ্য দিয়া চলিতেন, কিন্তু রোজই দিনশেষে তাহাকে আক্ষেপ করিতে। শুনিতাম যে, অশুচিকে তিনি এড়াইতে পারেন নাই। মাঝে হইতে তাহার লম্ফঝম্পের পরিক্রমই সার হইত। সাহিত্যেও এই অত্যন্ত অশুচিবায়ুরোগের হাত এড়াইতে হইবে। …

যাহা সত্য তাহা যদি অশুভও হয় তথাপি তাহাকে অস্বীকার করিয়া কোন লাভ নাই, তাহাকে গোপন করিবার চেষ্টা বৃথা! বরং তাহাকে স্বীকার করিয়া তাহার অনিষ্ট করিবার সম্ভাবনা কোথায় জানিয়া লইয়া সাবধান হওয়াই বিবেচনার কাৰ্য। …

মাসিকে সাপ্তাহিকে দৈনিকে আজ এই হাহাকারই ক্রমাগত শোনা যায় যে, বাঙলা সাহিত্যের আজ বড় দুর্দিন, বাঙলা-সাহিত্য জঞ্জালে ভরিয়া গেল—বাঙলা-সাহিত্য ধ্বংসের পথে দ্রুত নামিয়া চলিয়াছে। হাহাকারের এই একটা মস্ত দোষ যে, তাহা অকারণ হইলেও মনকে দমাইয়া দেয়, খামকা মনে হয় আমিও হাহাকার করিতে বসি। এই সভায় সমাগত হে আমার তরুণ সাহিত্যিক বন্ধুগণ, আমি আপনাদিগকে সত্য বলিতেছি যে, বাঙলা-সাহিত্যের অত্যন্ত শুভদিনে আপনাদের সাহিত্যজীবন আরম্ভ হইয়াছে, এত বড় শুভদিন বাঙলা-সাহিত্যের আর আসিয়াছিল কি না জানি না। বাঙলা-সাহিত্য-জননী আজ রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র—এই দুই দিকপালের জন্মদান করিয়া জগৎবরেণ্যা। জননীর পূজার জন্য যে বহু বঙ্গসন্তান, সক্ষম অক্ষম, বড় ও ছোট—আজ থরেথরে অর্ঘ্যের ভার লইয়া মন্দির-পথে উৎসুক নেত্রে ভিড় করিয়া চলিয়াছেন, এ দৃশ্য কি সত্যই মনোরম নহে?

উপেনবাবুই তার অভিমত ব্যক্ত করেন নি, না কোনো সাহিত্যসাহচর্যে না কোনো লেখায়-বক্তৃতায়। তাই কিছুটা সংকোচ ছিল। গোড়াতে। কিন্তু, প্রথম আলাপেই বুঝলাম, বিচিত্রার ললাট যতই উচ্চ হোক না কেন, উপেনবাবুর হৃদয় তার চেয়ে অনেক বেশি উদার। আর, সাহিত্যে যিনি উদার তিনিই তো সবিশেষ আধুনিক। কাগজের ললাটে-মলাটে যতই সন্ত্ৰান্ততার তিলকছাপা থাক না কেন, অন্তরে সত্যিকারের রসসম্পদ কিছু থাক, তাই উপেনবাবুর লক্ষ্য ছিল। সেই কারণে তিনি কুলীনে-অকুলীনে প্রবীণে-নবীনে ভেদ রাখেন নি, আধুনিক সাহিত্যিকদেরও সাদরে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বয়সের প্রাবণ্য তার হৃদয়ের নবীনতাকে শুষ্ক করতে পারেনি। আর যেখানেই নবীনতা সেখানেই সৃষ্টির ঐশ্বর্য। আর যেখানেই প্রতি সেখানেই রসম্বরূপ।

আর এই অক্ষয়-অক্ষুন্ন প্রীতির ভাবটি সর্বক্ষণ পোষণ করেছেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—বাংলা-সাহিত্যের সর্বজনীন দাদামশায়। কল্লোলে তিনি শুধু লেখেনইনি, সবাইকে স্নেহাশীর্বাদ করেছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণের দুটি সাধ ছিল—প্রথম, ভক্তের রাজা হবেন, আর দ্বিতীয়, শুটকে সাধু হবেন না। কেদারনাথের জীবনেও ছিল এই দুই সাধপ্রথম, ঠাকুর রামকৃষ্ণের দর্শন পাবেন আর দ্বিতীয়, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হবেন। এই দুই সাধই বিধাতা পূর্ণ করেছিলেন তাঁর।

সজ্জা শোভা ও কারুকার্যের দিকে বিচিত্রার বিশেষ ঝোঁক ছিল। একেক সময় ছবির জমকে লেখা কুণ্ঠিত হয়ে থাকত, মনে হত লেখার চেয়ে ছবিরই বেশি মর্যাদা—অন্তশ্চক্ষুর চাইতে চর্মচক্ষু। লেখকের নামসজ্জা নিয়েও কারিকুরি ছিল। প্রত্যেক লেখার দু অংশে নাম ছাপা হত। লেখার নিচে লেখকের যে নাম সেটি লেখকদত্ত, তাই সেটি হীন, আর যেটি শিরোভাগে সেটি সম্পাদকদত্ত, তাই সেটি শ্ৰীযুক্ত। এর একটা তাৎপর্য ছিল। নামের আগে যে শ্রী বসে সেটা সমাস হয়ে বসে, তার অর্থ, নামধারী একজন শ্বসংশালী লক্ষ্মীমন্ত লোক। নিজের পক্ষে এই আত্মঘোষণটি। শিষ্টাচার নয়। তাই বিনয়বুদ্ধিবিশিষ্ট লোক নিজের নামের আগে এই শ্রী ব্যবহার করে না। সেই ব্যবহারটা অব্যবহার। কিন্তু পরের নামের বেলায় শ্রী যুক্ত করে দেয়াটা সৌজন্যের ক্ষেত্রে সমীচীন। পরকে সম্মান দেয়া সুখৈশ্বর্যবান আখ্যা দেওয়া ভদ্রতা, সভ্যতা, বিনয়বাক্যের প্রথম পাঠ। এই তাৎপর্যের ব্যাখ্যাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আর, এটি একটি যথার্থ ব্যাখ্যা।

যতদূর দেখছি, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ই বোধহয় আত্মোল্লেখে প্রথম শ্ৰী বর্জন করেন। এবং সে সব দিনে এমন অরসিকেরও অভাব ছিল না যে শ্রীহীন চারুকে নিয়ে না একটু ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে।

আসলে সব চেয়ে সরল ও পরিচ্ছন্ন, নাম নামের আকারেই ব্যক্ত করা। নাম শুধু নামই। নামের মধ্যে নাম ছাড়া আর কিছুর নাম-গন্ধ না প্রকাশ পায়। শ্রী একেবারে বিশ্রী না হোক, নামের তে। বটেই, প্রসঙ্গেরও বহিভূত।

একদিন দুপুরবেলা বসে আছি—বা, বলতে পারি, কাজ করছিএকটি দীর্ঘকায় ছেলে ঢুকল এসে বিচিত্রা-আপিসে। দোতলায় সম্পাদকের ঘরে।

উপেনবাবু তখনো আসেননি। আমিই উপনেতা।

একটা গল্প এনেছি বিচিত্রার জন্যে হাতে একটা লেখা, ছেলেটি হাত বাড়াল।

প্রখর একটা ক্ষিপ্রতা তার চোখে-মুখে, যেন বুদ্ধির সন্দীপ্তি। গল্প যেন সে এখুনি শেষ করেছে আর যদি কাল বিলম্ব না করে এখুনি ছেপে দেওয়া হয় তা হলেই যেন ভালো হয়।

এই রইল—

ভঙ্গিতে এতটুকু কুণ্ঠা বা কাকুতি নেই। মনোনীত হবে কি না হবে সে সম্বন্ধে এতটুকু দ্বন্দ্ব নেই। আবার কবে আসবে ফলাফল জানতে, কৌতূহল নেই একরতি।

যেন, এলুম, লিখলুম আর জয় করলুম—এমনি একটা দিব্য ভাব।

লেখাটা নিলুম হাত বাড়িয়ে। গল্পটির নাম অতসী মামী। লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক ভট্টাচার্য যিনি লিখতেন এ সে নয়। এ বন্দ্যোপাধ্যায়।

লেখাটা অদ্ভুত ভালো লাগল। উপেনবাবুও পছন্দ করলেন। গল্প ছাপা হল বিচিত্রায়। একটি লেখাতেই মানিকের আবির্ভাব অভ্যর্থিত হল।

মানিকই একমাত্র আধুনিক লেখক যে কল্লোল-ডিঙিয়ে বিচিত্রায় চলে এসেছে–পটুয়াটোলা ডিঙিয়ে পটলডাঙায়। আসলে সে কল্লোলেরই কুলবর্ধন। তবে দুটো রাস্তা এগিয়ে এসেছে বলে সে আরো ত্বরান্বিত। কল্লোলের দলের কারু কারু উপন্যাসে পুলিশ যখন। অশ্লীলতার ওজুহাতে হস্তক্ষেপ করে, তখন মানিক বোধ হয় শুক্তি-মগ্ন! এক যুগে যা অশ্লীল পরবর্তী যুগে তাই জোলো, সম্পূর্ণ হতাশাব্যঞ্জক।

বিচিত্রায় এসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্নিহিত হই। তখন তার পথের পাঁচালী ছাপা হচ্ছে—মাঝে-মধ্যে বিকেলের দিকে আসতেন বিচিত্রায়। যখনই আসতেন মনে হত যেন অন্য জগতের সংবাদ নিয়ে এসেছেন। সে জগতে প্রকৃতির একচ্ছত্র রাজত্ব—যেন অনেক শান্তি, অনেক ধ্যানলীনতার সংবাদ সেখানে। ছায়ামায়াভরা বিশালনির্জন অরণ্যে যে তাপস বাস করছে তাকেই যেন আসন দিয়েছেন হৃদয়ে—এক আত্মভোলা সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে তিনিও যেন সমাহিত, প্রসন্নগম্ভীর। প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য আত্মসংযোগ রেখেছেন বলে তাঁর ব্যক্তে ও মৌনে সর্বত্রই সমান স্বচ্ছতা, সমান প্রশান্তি। তার মন যেন অনন্তভাবে স্থির ও আবিষ্ট। মনের এই শুক্লধর্ম বা নৈর্মল্যশক্তি অন্য মনকে স্পর্শ করবেই। যে মানবপ্রীতির উৎস থেকে এই প্রজ্ঞা এই আনন্দ তাই তো পরমপুরুষার্থ। এই প্রীতিম্বরূপে অবস্থিতিই তো সাহিত্য। এই সাহিত্যে বা সহিত-বেই বিভূতিভূষণের প্রতিষ্ঠা। স্বভাবস্বচ্ছধবল নিশ্চিন্ত-নিস্পৃহ বিভূতিভূষণ।

এই বিভূতিভূষণের আওতায় এসে শনিবারের চিঠি তার সুর বদলাতে সুরু করল। অর্থাৎ সে স্তুতি ধরলে। এর আগে পর্যন্ত সে একটানা ঘৃণা-নিন্দা করেই এসেছে, পরের ছিদ্রদর্শনই তার একমাত্র দর্শন ছিল। চিত্তের ধর্মই এই, যখন সে যার ভাবনা করে, তখন তদাকারাকারিত হয়। আকাশ বা সমুদ্র ভাবলে মন যেমন প্রশান্ত ও প্রসারিত হয় তেমনি ক্লেদ ও কর্দম ভাবলে হয় দূষিত ও কলুষিত। যার শুধু পরের দোষ ধরাই ঝোঁক—এমন মজা–সে দোষই তাকে ধরে বসে। আর, ভাগ্যের এমন পরিহাস, যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সে-ই শেষে একদিন সেই অশ্লীলতার অভিযোগেই রাজদ্বারে দণ্ডিত হয়।

সব চেয়ে লাঞ্ছনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। সে এক হীনতম ইতিহাস। শনিবারের চিঠির হয়তো ধারণা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ আধুনিক লেখকদের উপর সম্পূর্ণ বীতরাগ নন-তাঁরই প্রশংসার আশ্রয়ে তারা পরিপুষ্ট হচ্ছে। এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়ির বিচিত্রাভবনে যে বিচার-সভা বসে তা উল্লেখযোগ্য। আধুনিক সাহিত্যের গতি ও রীতি নিয়ে যে তর্ক উঠেছে তার মীমাংসা নিয়েই সে সভা। মীমাংসা আর কি, রবীন্দ্রনাথ কি বলেন তাই শোনা।

দুদিন সভা হয়েছিল। প্রথম দিন শনিবারের চিঠি উপস্থিত ছিল না। দ্বিতীয় দিন ছিল। তার দলে অনেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন–মোহিতলাল, অশোক চট্টোপাধ্যায়, নীরদ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, গোপাল হালদার—তবে দ্বিতীয় দিনের সভায় ও-পক্ষে ঠিক কে-কে এসেছিলেন মনে করতে পারছি না। কল্লোল-দল দুদিনই উপস্থিত ছিল। আর অনপেক্ষদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী, প্রশান্ত মহলানবিশ, অপূর্বকুমার চন্দ, নরেন্দ্র দেব—আর সর্বোপরি অবনীন্দ্রনাথ।

কথা-কাটাকাটি আর হট্টগোল হয়েছিল মন নয়। এর কি কোনো ডিক্রি-ডিসমিস আছে, না, এ নিয়ে আপোষ-নিষ্পত্তি চলে? দল বেঁধে যদি সাহিত্য না হয়, তবে সভা করেও তার বিধি-বন্ধন হয় না।

চরম কথা বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, এদের লেখা যদি খারাপ তবে তা পড়ো কেন বাপু। খারাপ লেখা না পড়লেই হয়।

শুধু নিজের পড়েই ক্ষান্তি নেই, অন্যকে চোখে আঙুল দিয়ে পড়ানো চাই। আর তারি জন্যে মণি-মুক্তা অংশটিতে ঘন-ঘন ফোঁড় দিয়ে দেওয়া যাতে করে বেশ নিরিবিলিতে বসে উপভোগ করা চলে। প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপনটি এইরূপ : ‘অশ্লীলতার জন্য যাহারা শনিবারের চিঠির মণিমুক্তা অংশটি না ছিঁড়িয়া বাড়ী যাইতে পারেন না বলিয়া আপত্তি করেন তাহাদের জন্য মণিমুক্তা perforate করিয়া দিলাম।’ কেউ-কেউ আকর্ষণ বাড়াবার জন্যে পৃষ্ঠাগুলো আঠা দিয়ে এঁটে দেয়, কেউ-কেউ বা স্বচ্ছাবরণ জ্যাকেটে পুরে রাখে।

অপূর্ব ভাষণ দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি সাহিত্যধর্ম নামে ছাপা হল প্রবাসীতে। মূল কথা যা বলেছিলেন সেদিন, তা যেন আজকের দিনের সাহিত্যের পক্ষেও প্রযোজ্য।

‘রসসাহিত্যে বিষয়টা উপাদান, তার রূপটাই চরম।

মানুষের আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্র কালে কালে বিস্তৃত হতে থাকে।… অতএব বিষয়ের বৈচিত্র্য কালে-কালে ঘটতে বাধ্য। কিন্তু যখন সাহিত্যে আমরা তার বিচার করি তখন কোন কথাটা বলা হয়েছে তার উপর ঝোঁক থাকে না, কেমন করে বলা হয়েছে সেইটের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিই। …

কয়লার খনিক বা পানওয়ালীদের কথা অনেকে মিলে লিখলেই কি নবযুগ আসবে? এই রকমের কোনো একটা ভঙ্গিমার দ্বারা যুগান্তরকে সৃষ্টি করা যায় এ মানতে পারব না। বিশেষ একটা চাপরাসপরা সাহিত্য দেখলেই গোড়াতে সেটাকে অবিশ্বাস করা উচিত। তার ভিতরকার দৈন্য আছে বলেই চাপরাপের দেমাক বেশি হয়। …আজকের হাটে যা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কালই তা আবর্জনা-কুণ্ডে স্থান পায়। … সাহিত্যের মধ্যে অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ তখনি প্রকাশ পায়, যখন দেখি বিষয়টা অত্যন্ত বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। … বিষয়প্রধান সাহিত্যই যদি এই যুগের সাহিত্য হয়, তা হলে বলতেই হবে এটা সাহিত্যের পক্ষে যুগান্ত।’

কিন্তু আসল মর্মকথাটি কি?

‘রাজপুত্র বৈজ্ঞানিক নন—অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি—তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন বোধ করি চব্বিশ বছর বয়স এবং তেপান্তরের মাঠ। দুর্গম পথ পার হয়েছেন জ্ঞানের জন্যে নয়, ধনের জন্যে নয়, রাজকন্যারই জন্যে। এই রাজকন্যার স্থান ল্যাবরটরিতে নয়, হাটবাজারে নয়, হৃদয়ের সেই নিত্য বসন্তলোকে, যেখানে কাব্যের কল্পলতায় ফুল ধরে; যাকে জানা যায় না, যার সংখ্যা নির্ণয় করা যায় না, বাস্তব ব্যবহারে যার মূল্য নেই, যাকে কেবল একান্তভাবে বোধ করা যায়–তারি প্রকাশ সাহিত্যকলায়, রসকলায়। এই কলাজগতে যার প্রকাশ, কোনো সমজদার তাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে না, তুমি কেন? সে বলে, তুমি যে তুমিই এই আমার যথেষ্ট। রাজপুত্রও রাজকন্যার কানে-কানে এই কথাই বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের এই সাহিত্যধর্ম নিয়েও তর্ক ওঠে। শরৎচন্দ্র প্রতিবাদে প্রবন্ধ লেখেন বঙ্গবাণীতে—সাহিত্যের রীতি ও নীতি। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তও শরৎচন্দ্রকে সমর্থন করেন। শরৎচন্দ্র ও নরেশচন্দ্র তো প্রকাশ্যভাবেই আধুনিকতার স্বপক্ষে। শনিবারের চিঠি মনে করল, রবীন্দ্রনাথও যেন প্রচ্ছন্নরূপে আশীর্বাদময়। নইলে এমন কবিতা তিনি কেন লিখলেন?

‘নিম্নে সরোবর স্তব্ধ হিমাদ্রির উপত্যকাতলে;
উদ্ধে গিরিশৃঙ্গ হতে শ্রান্তিহীন সাধনার বলে
তরুণ নির্ঝর ধায় সিন্ধুসনে মিলনের লাগি
অরুণোদয়ের পথে।” সে কহিল, “আশীৰ্বাদ মাগি,
হে প্রাচীন সোবর। সরোবর কহিল হাসিয়া,
“আশীষ তোমার তরে নীলাম্বরে উঠে উদ্ভাসিয়া
প্রভাত সুর্যের করে; ধ্যানমগ্ন গিরি তপস্বীর
নিরন্তর করুণার বিগলিত আশীৰ্বাদ-নীর
তোমারে দিতেছে প্রাণধারা। আমি বনচ্ছায় হ’তে
নির্জনে একান্তে বসি, দেখি তুমি নির্বারিত স্রোতে
সঙ্গীত-উদ্বেল নৃত্যে প্রতিক্ষণে করিতেছ জয়
মসীকৃষ্ণ বিপুঞ্জ পথরোধী পাষাণ-সঞ্চয়
গূঢ় জড় শত্ৰুদল। এই তব যাত্রার প্রবাহ
আপনার গতিবেগে আপনাতে জাগাবে উৎসাহ।”

শুধু আশীর্বাদ নয়, বিপক্ষদলের শত্রুকে “মসীকৃষ্ণ” বলা, “জড়” বলা! অসহ্য। সুতরাং বেড়া-আগুনে পোড়াও সবাইকে। শ্রদ্ধা ভক্তি ভদ্রতা শালীনতা সব বিসর্জন দাও।

সুরু হল সে এক উদ্দণ্ড তাণ্ডব। “তাণ্ডবে তুষিয়া দেবে খণ্ডাইবে পাপ”। পাপটি খণ্ডে গেল, মহাপ্রভু জগাই-মাধাইকে কোল দিলেন। কংস পেয়ে গেল কৃষ্ণের পাদপদ্ম।

সুবাতাস বইতে লাগল আস্তে আস্তে। কটূক্তি ছেড়ে সদুক্তির চেষ্টা-চৰ্চা সুরু করল শনিবারের চিঠি। বিভূতিভূষণের আগমনেই এই বাঁক নিলে, বাঁকাকে সোজা করার সাধনা। আসলে রোষ অস্ত গেলেই রস এসে দেখা দেয়। শনিবারের চিঠিও ক্রমে-ক্রমে রোষের জগৎ থেকে চলে আসতে লাগল রসের জগতে। ‘পতন-রব্যুদয়-দুর্গম-পন্থা’ শেষ পর্যন্ত ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর-পন্থা’ বলেই মান পেল। ‘খোকা-ভগবান’ বা ‘গক্‌’ মান পেল মহাপুরুষপ্রবর নেতাজীরূপে! বিদ্রোহী নজরুল ইসলাম পেল উপযুক্ত স্বদেশপ্রেমীর বিজ্ঞাপন। ক্রমে-ক্রমে সে স্তুতিবাদের সংসারে দেখা দিতে লাগল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর। কিছুকালের জন্যে বা মানিক—মনোজ, বনফুল–এবং পরবর্তী আরো কেউ-কেউ। বস্তুত ইচ্ছে করলে ওদের সম্বন্ধেও কি অপভাষ রচনা করা যেত না? কিন্তু শনিবারের চিঠি হৃদয়ঙ্গম করল শুধু নিন্দা কোথাও নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় না; আর শুধু-প্রশংসা কোথাও নিয়ে গিয়ে পৌঁছে না দিলেও অন্তত হৃদয়ে এনে জায়গা দেয়। সেই তো অনেক। এমনিতেও সমালোচনা নয়, অমতি ও সমালোচনা নয়। তবে বৈরাচরণ না করে বন্ধুকৃত্য করাই তো শুভকর। আঘাত অনেকই তো দিয়েছি, এবার আলিঙ্গন দেয়া যাক। দেখিয়েছি কত পরাক্রান্ত শক্ত হতে পারি, এখন দেখানো যাক হতে পারি কত বড় অনিন্দ্যবন্ধু। সজনীকান্ত প্রীতির মায়াপাশে বাঁধা পড়ল। যার যেমন পুঁজি, জিনিসের সে সেই রকমই দাম দেয়। কিন্তু অন্তরে প্রীতি জন্মালে বোধ করি নিজেকেও দিয়ে দিতে বাধে না।

কল্লোল উঠে যাবার পর কুড়ি বছর চলে গেছে। আরো কত বছর চলে যাবে, কিন্তু ওরকমটি আর ‘ন ভূতো ন ভাবী’। দৃশ্য বা বিষয়ের পরিবর্তন হবে দিনে-দিনে, কিন্তু যে যৌবন-দীপ্তিতে বাংলা সাহিত্য একদিন আলোকিত হয়েছিল তার লয়-ক্ষয়-ব্যয় নেই—সত্যের মত তা সর্বাবস্থায়ই সত্য থাকবে। যারা একদিন সেই আলোকসভাতলে একত্র হয়েছিল, তারা আজ বিচিত্র জীবনিয়মে পরস্পরবিচ্ছিন্ন–প্রতিপূরণে না হয়ে হয়তো বা প্রতিযোগিতায় ব্যাপৃত—তবু, সন্দেহ কি, সব তারা এক জপমালার গুটি, এক মহাকাশের গ্রহতারা। যে যার নিজের ধান্দায় ঘুরছে বটে, কিন্তু সব এক মন্ত্রে বাঁধা, এক ছন্দে অনুবর্তিত। এক তত্ত্বাতীত সত্তা-সমুদ্রের কল্লোল একেক জন। বাহ্যত বিভিন্ন, আসলে একত্র। কর্ম নানা আনন্দ এক। স্পর্শ নানা অনুভূতি এক। তেমনি সর্বঘটে এক আকাশ, সর্বপীঠে এক দেবতা, সর্বদেহে এক অধিষ্ঠান। ‘একো দেবঃ সর্বভূতেষু গূঢ়ঃ সর্বব্যাপী সর্বভূতান্তরাত্মা।’ তাই সর্বত্র মহামিলন। ভেদ নেই, দ্বৈত নেই, তারতম্য নেই, সর্বত্র এক সনাতনের উপাসনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *