৪.৫১ মশুলের গায়ক ইশাকের রোজনামচা

মশুলের বিখ্যাত গায়ক ইশাকের দিনলিপি থেকে উদ্ধার করে এই গল্পটা আজ শোনাবো আপনাদের?

একদিন আমি খলিফা হারুন অল রসিদের দরবারে প্রবেশ করে দেখলাম খলিফা মসনদে বসে আছেন। তাঁর এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে উজির ফাদল এবং অল হিজাজের এক শেখসাহেব। দেখতে সে বেশ সুপুরুষ এবং সম্ভ্রান্ত।

যথাবিহিত কুর্নিশাদি জানিয়ে আমি উজিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফিসফিস করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই পরদেশীটি কে? এর আগে এঁকে তো কখনও দেখিনি।

উজির জানালো, উনি হচ্ছেন অল হিজাজের মাবাদের নাতি। গায়ক এবং কবি। নামটা নিশ্চয়ই তোমার বিশেষ পরিচিত।

আমি চিনতে পারলাম। তিনি আমার কাছে এগিয়ে এসে খাটো গলায় বললেন, ওস্তাদজী, আপনি যদি অনুমতি করেন তবে আমি আপনাকে আমার নানার বিখ্যাত গানগুলো গেয়ে শোনাতে পারি। আমার স্মৃতির পটে আজও সেই সব কথা অম্লান হয়ে আছে।

শেখের প্রস্তাবে আমি বিশেষ প্রীত হয়ে বললাম, আচ্ছা শেখসাহেব, আপনার নানা কতগুলো গান বেঁধেছিলেন আপনার ইয়াদ আছে?

-ষাটখানা।

—তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা গানগুলো কি কি আপনার মনে আছে?

—অবশ্যই আছে ইশাকজী। তার সবচেয়ে সেরা গান : ও আমার বুকের নিধি, ও আমার মুলেখা–

তানপুরাটা তুলে নিয়ে তিনি পুরো গানটা গেয়ে শোনালেন তখুনি। সত্যিই, অপূর্ব গান আর তার গলা! গান শেষ হয়ে গেলেও গানের রেশ অনুরণিত হয়ে ফিরতে লাগলো দরবারের সর্বত্র। খুশির আনন্দে ভরে গেলো আমার মন। শেখসাহেবকে অভিনন্দন জানিয়ে ফিরে এলাম আমার ঘরে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

নয়শো সাতাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে :

মনের মধ্যে তখন গুঞ্জরিত হয়ে ফিরছিলো সেই সঙ্গীত। তানপুরাটা তুলে নিয়ে গাইতে আরম্ভ করলাম। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও ওই অল হিজাজ ঘরানার পুরো সুরটা কিছুতেই আয়ত্ত করতে পারলাম না। গানের একটা জায়গায় এসে স্বরলিপিটা আর কিছুতেই ইয়াদ করতে পারলাম না। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যেতে লাগলো। জানা জিনিস যদি মন থেকে হারিয়ে যায়, তবে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। যে গান একবার আমি শুনি জীবনে কখনও বিস্মৃত হই না। কিন্তু আজ একি হলো আমার! কিছুতেই পুরো গানটা তুলতে পারছি না।

সারা দিন সারা রাত ধরে আমি মনের মধ্যে আওড়াতে থাকলাম সেই সুরটা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

শুধু একদিন দু’দিন নয়, দিনের পর দিন কেটে গেলো, কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে সঙ্গীতের সুর আমি স্মরণে আনতে পারলাম না। সে যে কি দুঃসহ যন্ত্রণা কি করে বোঝাই। একদিন ঐ গানের হারানো সুর আমাকে ঘর ছাড়া করে পথে নামালো। বাগদাদ, মশুল, বসরাহর বড় বড় ওস্তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু কেউই উদ্ধার করে দিতে পারলো না অল হিজাজ ঘরানার সেই বিখ্যাত সঙ্গীতটির স্বরলিপি।

শেষে ঠিক করলাম, মরুপ্রান্তর পার হয়ে মদিনায় চলে যাবো। সেখানে কবির নাতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবার ঐ গানখানা শুনবো তার মুখ থেকে।

সে সময় আমি বসরাহতে ছিলাম। মন স্থির করেই আমি যাত্রী-নৌকোয় চেপে বসবো বলে ঘাটের দিকে রওনা হলাম। পথের মধ্যে দুটি সম্ভ্রান্ত তরুণী আমার পথরোধ করে দাঁড়ালো।

আমি বিরক্ত হলাম মনে মনে। দেশে বিদেশে আমার অনুরক্ত ভক্তের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তাদের হাতে পড়ে অনেক সময়ই আমাকে নিগ্রহ হতে হয়। সেইরকমই কিছু একটা হতে পারে ভেবে শঙ্কিত হলাম।

কিন্তু মেয়ে দুটির কেউই আমার গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে সাদর অভিনন্দন জানালো।

আমি ঈষৎ রুষ্ট হয়ে বললাম, পথ ছাড়ুন, এখন আমার দাঁড়াবার সময় নাই।

মেয়ে দুটি খিলখিল করে হেসে উঠলো, ওস্তাদজী, এরই মধ্যে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। যে গানের সুর আপনি খুঁজে পাচ্ছেন না, তার জন্য সব উদ্যম এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেলো আপনার?

আমি ভীষণ রেগে উঠলাম, মিথ্যে কথা! একটা গানের কলির জন্য আমি দশটা বছর কাটিয়ে দিতে পারি। একটা কলিতে সুর দিতে গিয়ে আমার এক যুগ কেটে গেছে, এমন ঘটনাও বিরল নয়। কী করে আপনারা ভাবলেন যে, সুর খোঁজার উৎসাহে ভাটা পড়েছে আমার? আর তাছাড়া কোন গানের সুরের কথা বলছেন আপনারা?

অন্যতমা বললো, সেদিন দরবারে আপনি যখন শেখসাহেবের কাছে অল হিজাজ ঘরানার গান শুনতে চাইলেন, তখন আমি পর্দার পিছনে হারেমে বসেছিলাম। আপনাদের সঙ্গে আমিও যে সঙ্গীতসুধা পান করেছি সেদিন। আমি জানি ও আমার বুকের নিধি, ও আমার মুলেখা এই গানটি গাইতে গিয়ে আপনি সুর হারিয়ে ফেলেছেন। এবং হৃত সুর ফিরে পাওয়ার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু না পেয়ে এরই মধ্যে আপনি নিরাশ হয়ে পড়লেন?

আমি আর্তনাদ করে উঠি, দোহাই আপনাদের, আপনারা আমাকে পাগল করে দেবেন না।

গানের সুর খুঁজতে খুঁজতে আমি যত না উন্মাদ হয়েছি, আপনাদের এই ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তার চেয়ে বেশি হবো, আশঙ্কা হচ্ছে। আপনাদের কাছে আমার করজোড়ে মিনতি, এ নিয়ে আর আমাকে আঘাত করবেন না। মেহেরবানী করে পথ ছাড়ুন। এখন আমি মদিনায় যাত্রা করবো। ঐ সুর আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

মেয়েটি আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো।

আমি যদি আপনাকে গানটা শুনিয়ে দিই, তবু আপনাকে মদিনায় যেতে হবে?

-দোহাই আপনাকে, এভাবে আমার ওপর অত্যাচার চালাবেন না। আমি তো আগেই বলেছি, এই ব্যাপারে প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়েছি।

হঠাৎ যুবতীটি গাইতে শুরু করলো। ইশাক স্তম্ভিত হয়ে গেলো তার সুরেলা কণ্ঠ শুনে। শেখসাহেব যে ভাবে গেয়েছিলো এ সঙ্গীত তার চেয়ে সহস্রগুণ শ্রুতিমধুর।

এতদিনে আমার মনের ঝড় থামলো। হারানিধিকে খুঁজে পাওয়ার সে যে কী আনন্দ, কী করে বোঝাববা!

গাধার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মেয়েটির পায়ের ওপর।

-কে আপনি গুণবতী আমি জানি না, কিন্তু আপনার গান আমার হৃদয়ের সকল সন্তাপ জুড়িয়ে দিতে পেরেছে। এ অমূল্য রত্ন আপনি কী ভাবে আহরণ করেছেন? যদি আপনি মেহেরবানী করে আমার ঘরে পায়ের ধূলো দেন তবে আমি ধন্য হবো। আপনি শুধু আমাকে মুলেখার গানই শেখাবেন, তার বদলে আমি আপনাকে অজস্র অন্য গান শেখাবো।

মেয়েটি হাসলো, ইশাকজী, আপনার নিজের চরিত্র আপনি ভালো করেই জানেন। আজ পর্যন্ত কেউ আপনার কাছ থেকে একটির বেশি দুটি গান পায়নি। ঐ একটি ছাড়া আপনার ছাত্রছাত্রীরা অন্য যে সব গান গায়, তা অন্য ওস্তাদের কাছে শেখা। আমার আশঙ্কা আপনি আমাকেও একটির বেশি দুটি গান শেখাবেন না। তার চেয়ে ও শর্ত থাক, আপনি যতক্ষণ না মুলেখার গানখানা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবেন ততক্ষণ আমি গেয়ে শোনাবো আপনাকে। তারপর আপনার শেখার পর্ব শেষ হয়ে গেলে আমি খুশি মনে বিদায় নেব।

ইশাক অধীর হয়ে বলে, আপনি বিশ্বাস করুন ভালো মানুষের কন্যা, যদি চান আমি আপনাকে আমার খুন দিতে পারি। কিন্তু কে আপনি, কী আপনার পরিচয়?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

নয়শো অষ্টাশিতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

—আমি এক অতি সাধারণ গায়িকা। লোকের মুখে শুনে শুনে আমি গান শিখি। ঝরনার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তার কলতানের মধ্যে আমি সঙ্গীতের সুর খুঁজে পাই। কখনও তরুশাখার পাখীর কূজন কান পেতে শুনি। তার মধ্যেও সুমধুর সঙ্গীত শুনি। আমার নাম ওয়াহবা।

ওয়াহবা আর তা অনুজাকে সাদর আমন্ত্রণ করে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। সারাটা দিন সারাটা রাত্রি ব্যাপী চললো গানের আসর!

সঙ্গীত এবং সুরা স্বল্পসময়ে সম্পর্কের ব্যবধান ঘুচিয়ে ঘনিষ্ঠ করে তোলে।

সে রাতে ওয়াহবা আমাকে অনেক দিয়েছিলো, আমিও কম দিইনি। শুধু গানে নয়, দেহ মন প্রাণেও আমরা দু’জনে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম সে রজনীতে।

ইশাকের কাহিনী শেষ করে যুবকটি অন্য একটি কাহিনী বলতে শুরু করে :

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *