3 of 4

৪.২৭ তিন কন্যার কাহিনী

এক সময়ে ভারতের এক প্রদেশে এক মুসলমান সুলতান দারুণ দক্ষতার সঙ্গে প্রজা পালন করতেন। তার কোনও পুত্র-সন্তান ছিলো না। কিন্তু সে জন্য সুলতানের কোনও ক্ষোভ ছিলো না। কারণ তিনটি পরমাসুন্দরী কন্যা-সন্তান লাভ করেছিলেন তিনি।

দিনে দিনে দল মেলে ওরা কোমল কুঁড়িটি থেকে সুবাসিত প্রস্ফুটিত কুসুম হয় ওঠে। আরও সহজ করে বলা যায়, কচি কঁচা আপেল তিনটি ক্রমশঃ রসালো ডাগর হতে থাকে।

একদিন সুলতান শাহবানুকে বললেন, মেয়ে তিনটির শাদীর বয়েস হলো, এবার ওদের একটা বিধিব্যবস্থা করতে হয়? যথাযোগ্য পাত্ৰ সন্ধান করে তাদের হাতে সমর্পণ করাই তো এখন বিধেয়, কি বলো?

শাহবানু বলেন,এ তো খুবই ভালো কথা, মেয়েদের সময়কালে শাদী দেওয়া মা বাবার একান্ত কর্তব্য। কিন্তু আমার মতে বংশমর্যাদার কোনও কথা নয়, মেয়েদের নিজেদের পছন্দই প্রধান হওয়া উচিত। ওরা যাকে পেয়ে জীবনে সুখী হতে পারবে বলে মনে করবে, তাকেইশাদী করুক। তোমার কী মত?

সুলতান বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে একমত। ওরা নিজেরাই নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করে নিক।

সুলতান ঘোষণা করে দিলেন, তার তিন কন্যা স্বয়ম্বরা হবে। যে সব পাত্র আগ্রহী তারা যথা নির্দিষ্ট দিনে প্রাসাদ- প্রাঙ্গণে সমবেত হতে পারে।

যথা দিনে দেশ-বিদেশের শতশত আমীর বাদশাহজাদারা সুলতানের প্রাসাদ- প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হলো। প্রাসাদের ওপরতলায় বাতায়ন-কক্ষে বসেছে শাহজাদীরা। উপস্থিত পাত্রদের পর্যবেক্ষণ করে বড় দুইবোন তাদের রুমাল নিক্ষেপ করলো দু’জনের গায়ে। অর্থাৎ ঐ দু’জন শাদীর পাত্র বলে নির্বাচিত হলো বড় দু’জনের জন্য।

এরপর ছোটজন রুমাল নিক্ষেপ করলো। কিন্তু হাওয়ার টানে রুমালখানা উড়তে উড়তে প্রাসাদের আঙ্গিনার বাইরে অবস্থানরত একটি রামপাঠার গায়ে গিয়ে পড়লো।

এমন অশুভ সূচনায় সুলতান বিষণ্ণ হলেন। কন্যাকে পুনরায় তিনি রুমাল নিক্ষেপ করতে আদেশ করলেন। কিন্তু কপালের এমনই ফের, পরপর তিনবারই রুমাল গিয়ে পড়লো ঐ রামপাঁঠারই গায়ে। সুলতান বিচলিত এবং ক্ষুব্ধ হলেন। ছোট কন্যা বললো, বাবা,এই বোধহয় বিধাতার ইচ্ছা। সুতরাং একে অস্বীকার করে কোনও লাভ নাই।

সুলতান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তা বলে একটা রামপাঁঠা? এর চেয়ে তোর মরা মুখ দেখাও ভালো।

সুলতানের ক্ষোভে শাহজাদী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, বাবা তুমি বৃথাই রাগ করছো, এই আমার অদৃষ্টের লিখন, একে এড়াবো কি করে। তার চেয়ে বিধাতার বিধান মেনে নিয়ে ঐ রামপাঁঠার সঙ্গেই আমার শাদী দিয়ে দাও। আমি অখুশি হবো না।

বড় দুই বোন ছোটর এই দুর্ভাগ্যে পুলকিত হয়ে ওঠে। ছোট তাদের চেয়ে রূপবতী বলে সহজাত হিংসা ছিলো তার ওপর। আজ অদৃষ্টের পরিহাসে একটি রামপাঁঠাকে পতিত্বে বরণ করতে হচ্ছে শুনে তারা মনে মনে বেশ খুশিই হলো।

যাই হোক, শেষপর্যন্ত সুলতান ছোট কন্যার কথা মেনে নিয়ে সাড়ম্বরে তিনকন্যার শাদী দিয়ে দিলো।

সন্ধ্যায় তিন কন্যার বাসরঘর গুলো সুন্দর করে সাজানো হলো। যথাসময়ে পাত্ররা উপস্থিত হলো বাসরঘরে।

রামপাঁঠা পাত্রকে বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিতেই ছোট কন্যা দরজা বন্ধ করে দিলো। রামপাঁঠাটি এক অদ্ভুত কায়দায় গা ঝাড়া দিতেই সঙ্গে সঙ্গে সে এক সুঠামদেহী সুকুমার নওজোয়ান পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে গেলো।শাহজাদী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। যুবকটি শাহজাদীকে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, আসলে আমি পাঁঠা নই শাহজাদী, কপালদোষে আজ আমি শাপগ্রস্ত। কিন্তু তোমার কাছে আমার একমাত্র অনুরোধ এই গোপন সংবাদ তুমি দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির

কাছে প্রকাশ করো না কখনও। তাহলে আমাকে হয়তো চিরকালের মতো হারাবে তুমি।

শাহজাদী বলে, না, একথা কাউকেই বলবো না আমি? কিন্তু তুমি কে? কী তোমার আসল পরিচয়? আর কেনই বা এমন দশা হয়েছে তোমার?

যুবক বলে, আমি কে, জানতে চেও না প্রিয়তমা। কেন আমার এই দশা সে কথাও এখন – বলতে পারবো না তোমাকে। তবে এটুকু জেনে রাখ, বিত্তে এবং বলে আমি, তোমার প্রবল পরাক্রান্ত পিতার চেয়েও অনেক বড়। যাদের সঙ্গে তোমার অন্য দুই বোনের শাদী হয়েছে কোনও দিক দিয়েই তারা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়।

অনেক দিন ধরেই আমি তোমাদের এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আসল কারণ, তোমাকে দেখার পর থেকেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। অহর্নিশ আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছি, তোমাকে যেন জীবন-সঙ্গিনীরূপে পাই। তা খোদা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। আমি তোমাকে লাভ করেছি। এখন আমাদের এই বন্ধন যাতে চিরস্থায়ী হয় সেজন্য তোমাকে একটি হলফ নিতে হবে।

—কী সে হলফ?

তুমি ছাড়া দুনিয়ার আর সব মানুষ জানবে, আমি একটি রামপঠা, জন্তু মাত্র। যত সাংঘাতিক ব্যাপারই ঘটুক, যে অবস্থাতেই পড় না কেন, আমার প্রকৃত পরিচয় কোনও ক্রমেই তুমি প্রকাশ করে দেবে না এই আমার একমাত্র অনুরোধ। তা যদি কর, সে যে কারণেই হোক, আমাকে আর খুঁজে পাবে না।

শাহজাদী আল্লাহর কসম খেয়ে শপথ করলো, কোনও কারণেই সে তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেবে না। তার জন্যে যদি মৃত্যুকে বরণ করতে হয়, দ্বিধা করবে না সে।

এরপর ওরা দু’জনে গভীর প্রেমের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে সারাটা রাত সুখ-সম্ভোগে কাটিয়ে দিলো।

সকাল হতেই শাহাজাদা আবার রামপাঠায় রূপান্তরিত হয়ে বাসরকক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

রীতি অনুসারে সকালে শাহবানু এলেন কন্যার খোঁজ খবর নিতে। শাদীর প্রথম রাতে কন্যা কীভাবে পাত্রদ্বারা গৃহীত হয় তা প্রত্যক্ষ করার জন্যই পাত্রীর মা বাসরঘরে আসেন।

শাহবানু ঘরে ঢুকেই কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আকুল কণ্ঠে বলেন, তুই এখনও জিন্দা আছিস, মা? আমরা তো সারারাত কেঁদে ভাসিয়েছি ঐ জানোয়ারটা বোধহয় তোকে আর আস্ত রাখেনি।

মেয়ের মুখে হাসির খৈ ফুটে, তুমি যে কি বলো, মা। জিন্দা থাকবো না কেন? এই দেখো তোমার মেয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে এখনও বেঁচে আছে।

শাহবানু অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকায়, কী যেন বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়েকে খুশির বন্যায় উচ্ছ্বসিত দেখে কেমন যেন সে ঘাবড়ে যায়।

—তা হলে, তুই সুখী হয়েছিস মা?

বাঃ রে,সুখী হবো না কেন? তোমার জামাই কত আদর সোহাগ জানে মা, কী করে তোমাকে বোঝাবো সে কথা। মোট কথা এর চেয়ে ভালো বর আমি কল্পনা করতে পারিনি মা।

মা কেমনে চুপসে গিয়ে বললেন, তা তুই যখন সুখী হয়েছিস, তার বাড়া তো আর কিছু নাই। তোর মুখে হাসি দেখলেই আমাদের দিল খুশ হবে মা। আচ্ছা তুই সুখে থাক, আমি এখন চলি?

মাস কয়েক পরে সুলতান এক বিরাট পোলা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করলেন। সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বড় দুই জামাই অংশ নিতে অবতীর্ণ হলো। কিন্তু সুলতান তাঁর ছোট জামাতা রামপাঠাকে আর হাজির করলো না পোলো মাঠে। কারণ, তিনি জানতেন, তাতে উপস্থিত দর্শকদের হাসির খোরাকই জোগানো হবে মাত্র।

বড় দুই জামাই ঘোড়ার পিঠে চেপে ইয়া পেল্লাই পেল্লাই লাঠি হাতে নিয়ে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি ছুটাছুটি করে পাঁয়তারা ভঁজছিলো। কে কাকে কেমন করে ঘায়েল করবে তারই কায়দা কসরত কষছিলো। এমন সময় এক তৃতীয় বীরপুরুষের আবির্ভাব ঘটলো সমরক্ষেত্রে।

বীরপুরুষই বটে! সুঠাম সুন্দর চেহারার এক নওজোয়ান। লাঠি হাতে ঘোড়ার পিঠে চেপে বিশ্ব-বিজেতার মতো এসে উপস্থিত হলো সে। তড়িৎ বেগে বনবন করে ঘুরিয়ে লাঠির দু’টি ঘায়ে দুই জামাতা-পুঙ্গবকে ধরাশায়ী করে সে বুক ফুলিয়ে এসে দাঁড়ালো সুলতানের বাতায়ন সম্মুখে।

উপস্থিত দর্শকরা হর্ষধ্বনি করে নওজোয়ানকে বীরোচিত সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে থাকলো। সুলতানও মুগ্ধ হলেন যুবকের অসামান্য বীরত্বে। শুধু বীর্যে কেন, এমন অলোক-সামান্য রূপবান পুরুষই বা কে কোথায় দেখেছে?

বড় দুই বোন তাদের স্বামীদের পরাজয়ে যুবকের ওপর ক্রদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু কনিষ্ঠার মুখমণ্ডল খুশির আলোয় উদ্ভাসিত হয়। মাথার খোঁপায় গোজা একটি গোলাপ নিক্ষেপ করে দেয় সে যুবকের দিকে।

আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কে এই নওজোয়ান। আমাদের কনিষ্ঠা কন্যার বর রামপাঁঠাই নিজের স্বরূপ ধারণ করে আজকের এই লড়াই-এর বাজীমাত করেছে।

কন্যার এই অশোভন আচরণ সুলতান এবং শাহবানুর নজর এড়ায় না। মনে মনে বিরক্ত হলেও তার বিড়ম্বিত জীবনের দুঃখের কথা বিবেচনা করে মুখে কিছু বলেন না তাঁরা।

দ্বিতীয় দিনেও ঐ যুবক পোলো ক্ষেত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় গৌরবের উল্লাস অভিনন্দন আদায় করে সুলতানের বাতায়ন-পথে এসে কুর্নিশ জানায়।

সে দিন সুলতান কনিষ্ঠা কন্যার অভব্য আচরণ দেখে ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। হতচ্ছাড়ি সাধ করে একটা জানোয়ারকে শাদী করে নিজের জিন্দেগী বরবাদ করে এখন পরপুরুষকে দেখে বেহায়া নির্লজ্জের মতো ঢলাঢলি করতে আরম্ভ করেছে!

তৃতীয় দিনের লড়াই শেষে আবার যখন সে বিশ্ব-বিজেতার মতো এসে দাঁড়ালো তখন ছোট মেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। বিরাট একটি ফুলের মালা সূতোয় বেঁধে নামিয়ে। দিলো তার গলায়।

–শয়তানীটা কামের তাড়নায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আজ আমি ওকে নিজের হাতে খুন করবো।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে সুলতান তেড়ে গেলো ছোট মেয়ের দিকে। চুলের মুঠি ধরে আছাড় মেরে মেঝেয় ফেলে দিলেন, বল বেয়াদপ দুশ্চরিত্রা, কেন তুই এইভাবে আমার মুখে চুনকালি দিলি। আজ তোকে আমি শেষ করে ফেলবো। হাজার বারণ সত্ত্বেও একটা রামপাঠাকে শাদী করে আমার এই বাদশাহী খানদানীতে কলঙ্ক লেপে দিয়েছিস, তাতেও তোর সাধ মেটেনি। এখন প্রকাশ্যে পরপুরুষকে ঘরে টেনে কামনা মেটাতে চাস এত বড় সাহস তোর। না, ঢের হয়েছে আর তোর এই বেলেল্লাপনা সহ্য করবো না আমি। আজই এখুনি নিজের হাতে তোকে গলা টিপে খতম করে দেব।

সুলতান দু’হাত দিয়ে কন্যার গলাটা চেপে ধরেন। উদ্দেশ্য শ্বাসরোধে মেরে ফেলবেন তাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে মেয়েটি কাতর কাকুতি করে বাবার কাছে, বাবা আমাকে ছেড়ে দাও, জানে মেরো না। আমি কোনও দোষ করিনি, কোনও পাপ করিনি—

-চোপ রও, পরপুরুষকে লুব্ধ করার চেষ্টা করে যে নারী, সে দোজকের কীট!

–না বাবা, না, আমি স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের দিকে কখনও নজর দিই না। তুমি যাকে পরপুরুষ মনে করেছ সে তোমার জামাই। বলছি, সব তোমাকে খুলে বলছি বাবা। আমাকে তুমি জানে মেরো না, আমি সব খুলে বলছি তোমাকে। আসলে সে কোনও জন্তু জানোয়ার নয়। কোনও কারণে আজ সে ঐ রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই সে তার নিজের রূপ ফিরে পেতে পারে। প্রতিদিন রাত্রে সে আমার সঙ্গে মানুষ হয়ে মিলিত হয়। আবার সকাল হতে না হতেই, কেউ দেখে ফেলার আগে, আবার ঐ জন্তুর রূপ ধরে। আসলে সে বিরাট শাহেনশাহর পুত্র সুন্দর সুপুরুষ নওজোয়ান।

সুলতান শাহবানু এবং বোনরা একথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়! এমন অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কথা কে শুনেছে কবে?

সেইদিন থেকে রামপাঠাকে আর কেউ দেখতে পেলো না। রাতের পর রাত কেটে যায়, ছোট কন্যা বাসর সাজিয়ে বসে বসে বিনিদ্র রজনী কাটায়, কিন্তু তার স্বামী আর আসে না।

সুলতান চারদিকে চর পাঠালেন। তন্ন তন্ন করে তল্লাসী চালানো হলো সর্বত্র। কিন্তু কোনও সন্ধান পাওয়া গেলো না ছোট জামাতার!

এইভাবে দিনে দিনে মাস বয়ে যায়। মাসে মাসে বৎসরও অতিক্রান্ত হয়ে চলে। ছোট কন্যা বুঝতে পারলো, সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে বলে আর তার স্বামী ফিরে আসবে না। কিন্তু স্বামী-সোহাগে বঞ্চিত হয়ে জীবন ধারণের বা কি প্রয়োজন? তাই সে ঠিক করলো, আত্মঘাতী হয়ে মরবে।

কিন্তু মরার আগে তার দেখতে সাধ হলো, এই দুনিয়ায় তার চেয়ে হতভাগী মেয়ে আর কেউ আছে কিনা। সকলের অলক্ষ্যে একদিন সে প্রাসাদ ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়লো।

চলতে চলতে একসময় ক্লান্ত হয়ে আবার প্রাসাদেই ফিরে এলো। পথ চলা আর জনে জনে। জিজ্ঞেস করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না ভেবে আপাতত গৃহ ত্যাগের পরিকল্পনা বাতিল করে শহরাভ্যন্তরে এক অনিন্দ্যসুন্দর সুরম্য হামাম গৃহ বানাবার বাসনা করলো।

বহু অর্থব্যয়ে একদিন সে হামাম গৃহ তৈরিও হয়ে গেলো। লোকে দেখে শত মুখে প্রশংসা ছড়াতে লাগলো, এ রকম স্নানাগার তামাম হিন্দুস্তানে আর দুটি নাই।

ঘোষণা করে দেওয়া হলো, সর্বস্তরের নারীদের জন্য ঐ হামামের দ্বার অবারিত থাকবে। – কোনও পয়সাকড়ি লাগবে না। তবে একটি মাত্র শর্তে। যে নারী গোছল করতে আসবে সেখানে তাকে তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখ বেদনার সত্য কাহিনী বিবৃত করতে হবে। সুলতান-দুহিতা সকর্ণে তা শুনবেন। যাদের জীবনে কোনও দুঃখ বেদনা ছায়াপাত করেনি, হামামে তাদের প্রবেশ অধিকার নাই। সারা দেশের ভাগ্য-বিড়ম্বিত শোক দুঃখ তাপে দগ্ধ নারীর সংখ্যা অগণিত। সেই সব মেয়েরা দলে দলে আসতে থাকলো শাহজাদীকে তাদের দুঃখ বেদনার কাহিনী শোনাতে।

কেউ তার স্বামীর অত্যাচারের কাহিনী শোনায়, কেউ বলে কী ভাবে তার স্বামী অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়ে তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে, আবার কেউ বা প্রতারক স্বামীর খপ্পরে পড়ে নিজের যথাসর্বস্ব খুইয়ে পথের ভিখারী হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের দুঃখ বেদনাকে অনেক বড় করে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। কিন্তু শাহজাদী নিজের দুর্ভাগ্যের চেয়ে কারো কাহিনীই আরও বেশি বেদনাদায়ক বলে মনে করতে পারে না।

একদিন এক অশীতিপরা লোলচর্ম দীনাতিদীন বৃদ্ধা হামামে প্রবেশ করলো। শাহজাদীর হাতে চুম্বন করে সে বললো, মা জননী, আমার বয়সের গাছপাথর নাই, এবং আমার দুঃখের কাহিনীরও সীমা সংখ্যা নাই। সে-সব কাহিনী শোনাতে শোনাতে জিভ আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। অত কথা বলতেও পারবো না, শোনার মতো ধৈর্যও তোমার হবে না। তার চেয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে শেষ দুঃখের কাহিনীটা তোমাকে শুনিয়ে যাই। এবং আমার মনে হয়, এইটেই আমার জীবনের সব চাইতে দুঃখজনক কাহিনী, কারণ এর ফলে দুঃখের কোনও অনুভূতি আমি বোধ করতে পারিনি। দেহ মন সব অসাড় হয়ে গেছে একেবারে। ঘটনাটা সবে গতকাল ঘটে গেছে। তাই এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না, কী আমার ঘটেছে। এবং তাতে কতটা আমার দুঃখ পাওয়া উচিত। সে যাই হোক, হুবহু যা ঘটেছে সেই কাহিনীই বলিঃ

মা জননী, এই যে আমার গায়ে কামিজটা দেখছো, এই একটিমাত্র নীলরঙের জামাই আমার সম্বল, গরীব মানুষ আর একটা বানাবো তার পয়সা জোটাতে পারি না। কামিজটা ময়লায় তেল-চিটচিটে হয়ে গেছে, গায়ে যখন আর রাখতে পারি না, তখন পুরুষমানুষের নজর এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে নদীর কোনও কিনারে বিবস্ত্র হয়ে তড়িঘড়ি জামাটা সাবান-কাচা করে তখুনি গায়ে পরে নিই।

গতকালও কামিজটা সাবান-কাচা করতে সন্ধ্যাবেলায় নদীর ধারে গিয়েছিলাম। একটা নির্জন ঘাটে নেমে জামাটা কেচেকুচে একটা পাথরের চাই-এর ওপর মেলে দিয়ে তার আড়ালে লুকিয়ে বসেছিলাম।হাওয়াতে খানিকটা শুকিয়ে গেলেই গায়ে চাপিয়ে চলে আসবো, এই রকমই মতলব ছিলো, কিন্তু খানিকটা দূরে একটা খচ্চরকে ঝিমুতে ঝিমুতে এগিয়ে আসতে দেখে আমি খপ করে কামিজটা তুলে নিয়ে গায় গলিয়ে দিলাম। ভয় হয়েছিলো, গাধাটার পিছনে নির্ঘাৎ তার সহিসও আছে! সে যদি আমার উদোম অবস্থা দেখে ফেলেছিঃ ছিঃ কি শরম-কি-বাত?

কিন্তু আশ্চর্য, দেখলাম গাধাটার পিঠে বোঝাই একগাদা ছাগল ভেড়ার কাঁচা ছাল। দিব্যি গজেন্দ্রগমনে মাথা দুলাতে দুলাতে সে আমার সামনে দিয়ে পার হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ সহিসের প্রতীক্ষা করলাম। কিন্তু না, গাধাটার পিছনে কোনও মানুষজন কেউ নেই। ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত মনে হলো। কৌতূহল এড়াতে না পেরে গাধাটার পিছু ধাওয়া করলাম। কেশ কিছুটা পথ আসার পর নদীর ধারেই একটা ছোট্ট টিলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো গাধাটা। তারপর একখানা পা দিয়ে একটা জায়গায় আচড়াতে থাকলো। একটু পরে অবাক হয়ে দেখলাম জায়গাটার মাটি দু ভাগ হয়ে সরে গেলো খানিকটা। এবং সেই ফঁক দিয়ে গাধাটা ভিতরে ঢুকে গেলো। আমিও কৌতূহল চাপতে না পেয়ে ঐ ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

একটু এগোতেই দেখি একটা গুহামুখ। গাধাটা তেমনি হেলতে হেলতে সেই গুহার ভিতরে চলে গেলো। আমি কে লক্ষ্য করে পিছু পিছু চলতে থাকলাম।

কি বিশাল গুহাপ্রাসাদ। কত সুন্দর সুন্দর দামী দামী আসবাবপত্র ঝকঝক-তকতক করে সাজানো গোছানো সব। চোখ জুড়িয়ে যায়।

পায়ে পায়ে আরও ভিতরে এগিয়ে গেলাম। সুন্দর খানার খুশবু ভেসে এলো নাকে। এক-পাশে তাকিয়ে দেখি থরে থরে সাজানো সব পেয়ালা পিরিচ, কাঁটা চামচে এবং নানা ব্যঞ্জনের ঢাকা দেওয়া হরেক রকমের ছোট বড় সব পাত্র। একটি পাত্রের ঢাকা খুলে দেখি মাংসের কাবাব। আমার তখন জিভে জল এসে গেছে। লোভ লামলাতে না পেরে একটুখানি নেবার জন্য হাত বাড়িয়েছি মাত্র। অমনি একটা গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলোর হাত ওঠাও। এ খানা আমাদের মালকিনের জন্য। খবরদার ছুঁয়েছো কি মরেছো! আমি তৎক্ষণাৎ সশব্দে ঢাকনাটা নামিয়ে রাখি। তারপর আর ওখানে না দাঁড়িয়ে অন্য দিকে, অন্য একটা ছোট্ট কুঠরীতে ঢুকে পড়ি। সেখানে দেখলাম চমৎকার সব গরম গরম রুটি তাওয়ায় বসানো হয়েছে। তন্দুরীগুলো ধীরে ধীরে ফুলছে, কোনটা বা বেশ তৈরি হয়ে এসেছে। আরও কতকগুলো রুটি সঁাকা শেষ হয়ে গেছে। সেগুলো, মনে হলো সদ্য তণ্ডুর থেকে তুলে টেবিলে সাজানো হয়েছে। একখানা রুটির দিকে হাত বাড়াতেই আবার সেই গুরুগম্ভীর স্বর ভেসে এলো? খবরদার হাত ওঠাও। এ সব খানা

আমাদের মালকিনের জন্য। হাত দিয়েছ কী মরেছে।

ভীত চকিত হয়ে আমি ছুটে পালালাম সেখান থেকে। ছুটতে ছুটতে অনেক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে এলাম এক শ্বেত পাথরের বিশাল মহলে। আমার মনে হয়, সে ধরনের জমকালো ঘর একমাত্র তোমার বাবার প্রাসাদেই থাকা সম্ভব। সেই দরবারকক্ষের ভিতরে পর পর চল্লিশটা তখত—প্রতিটি সোনার তৈরি। প্রাসাদের মনোহর দৃশ্যাবলী দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম সেখানে।

একটু পরে দেখলাম ঘরের ভিতরে চল্লিশটা রামপাঁঠা এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে তাগড়াই সে মাঝখানের সবচেয়ে বড় মসনদটিতে চেপে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে বাকী পাঁঠাগুলো বাদশাহী কেতায় কুর্ণিশ জানিয়ে এক এক আসনে এক একটি উঠে বসলো।

এর পর ওরা সবাই একসঙ্গে গা ঝাড়া দিতেই, আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, ঐ চল্লিশটি পাঁঠা ফুলের মতো সুন্দর সুন্দর সব নওজোয়ান হয়ে গেলো। ওদের শরীর থেকে যুঁইফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো সারা ঘরময়।

তারপর দেখলাম, সবচেয়ে বড় মসনদে যে ছেলেটি বসেছিলো, হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো সে। এবং তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্য ছেলেরাও একই ভাবে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কাঁদতে লাগলো? কোথায় গেলে গো, আমাদের মালকিন, কোথায় তুমি হারিয়ে গেলে। তোমার বিরহে আজ আমরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছি। তুমি এসো-আমাদের কাছে এসো। তুমি না এলে আমরা তো তোমার কাছে যেতে পারবো না। আমাদের একান্ত আবেদন, তুমি আমাদের কাছে চলে এসো।

এর পর ওরা সিংহাসন থেকে নেমে তিনবার গা ঝাড়া দিতেই আবার সকলে রামপাঠায় রূপান্তরিত হয়ে দরবারকক্ষ থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

এই সব দেখে আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম। আর সেখানে দাঁড়ালাম না। এ সিঁড়ি সে সিঁড়ি ভেঙ্গে এ ঘর ও ঘর ডিঙিয়ে অবশেষে গুহা ছেড়ে বেরিয়ে সোজা তোমার হামামের দিকে ছুটে আসছি। আমার মনে হয় এইটেই আমার জীবনের সব চাইতে দুঃখজনক কাহিনী। কারণ, ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও সামনে নানারকম সুস্বাদু খানাপিনা পেয়েও তা স্পর্শ করতে পারিনি। তা ছাড়া যে সব দৃশ্য দেখে এলাম তার এক বর্ণ বুঝতে পারলাম না কিছু। এর চাইতে দুঃখের আর কি হতে পারে, বলো মা জননী?

বৃদ্ধার কাহিনী শুনতে শুনতে শাহজাদীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিলো। বলা শেষ হতে না হতে ওর বুকের স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকলো, হাত পা অসাড় হয়ে আসতে লাগলো। তার আর বিন্দুমাত্র সংশয় নাই, ঐ প্রধান রামপাঠাই তার প্রিয়তম স্বামী। বৃদ্ধাকে সে বুকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে বলতে লাগলো, তুমি আমার মা, তোমার কাছে আমি চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবো। তুমি যা চাও, দু’হাত ভরে দেব তোমাকে। শুধু একটিবার, আমাকে ঐ গুহার ভিতরে নিয়ে চলো, মা। আমি তোমার কেনা হয়ে থাকবো সারা জীবন।

বৃদ্ধার পিছনে পিছনে সেই নদীর ধারে টিলাটার সামনে এসে পৌঁছলে শাহজাদী। একটুক্ষণ পরে একটি খচ্চর পিঠে কঁচা-চামড়ার ডাই নিয়ে হেলতে দুলতে এসে দাঁড়ালো সেখানে। তারপর পা দিয়ে একটা জায়গা আঁচড়াতেই একটা গর্ত হয়ে গেলো এবং সেই গর্তের ভিতরে ঢুকে গেলো সে। বৃদ্ধা শাহজাদীকে সঙ্গে করে খচ্চরের পিছনে পিছনে গর্তের নিচে নেমে গেলো। আবার সেই গুহামুখ। ওরা দু’জনে খচ্চরকে অনুসরণ করে গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গেলো অনেকটা। বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে দেখালো, ঐ দ্যাখো মা, কত সব জিভে জল আসা খানা-পিনা ঢাকা দেওয়া আছে ওখানে। কিন্তু খবরদার ওদিকে যেও না, এখুনি মেরে ফেলবে তোমাকে।

শাহজাদী বলে, তা মারুক, দেখাই যাক না কি বলে।

একটা পাত্রের ঢাকনা খুলতেই কাবাবের সুগন্ধে প্রাণ মন ভরে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে বিনয়-বিগলিত কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, মালকিন, মেহেরবানী করে গ্রহণ করুন, আপনার জন্যেই তো সাজিয়ে বসে আছি আমরা।

শাহজাদী কিন্তু গ্রহণ করলো না কিছু। পাশের ঘরটায় গিয়ে দেখলো সুন্দর সুন্দর সব তন্দুরী থরে থরে সাজানো। আবার সেই কণ্ঠ ভেসে আসে, একটু কিছু আস্বাদ করে আমাদের কৃতার্থ করুন, মালকিন। আমরা কতকাল ধরে খাবার সাজিয়ে আপনার পথ চেয়ে বসে আছি।

এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে এলো ওরা। সেই সুরম্য শ্বেতপাথরের দরবার মহল। চল্লিশটি সোনার সিংহাসন। যেমনটি বৃদ্ধা বর্ণনা করেছিলো অক্ষরে অক্ষরে একই দৃশ্য দেখতে পেলো শাহজাদী।

বৃদ্ধা বললো, এরপর মা, তুমি এখনই ঐ মহলে যাও। আমি আড়াল থেকে তোমাকে লক্ষ্য রাখবো।

এরপরে যা ঘটতে পারে তাই ঘটলো। অনেক দিন বাদে স্বামীকে ফিরে পেয়ে শাহজাদী আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো।

বেশ কিছুদিন সেই পাতালপুরীতে সুবিহার করার পর ওরা দুজনে একত্রে ফিরে এলো সুলতানের প্রাসাদে। কন্যা এবং জামাতাকে ফিরে পেয়ে আনন্দ হাসি গানে আবার মুখর হয়ে উঠলো প্রাসাদ। সুলতান ও শাহবানু প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন ওদের।

এরপর ওরা আর কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি।

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে একটুক্ষণ থামলো। তারপর আর এক কাহিনী বলতে শুরু করলো–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *