০৮. প্রমথ চৌধুরী সরে-আসা মানুষ, দ্বিতীয় নজরুল

কল্লোলকে নিয়ে যে প্রবল প্রাণোচ্ছাস এসেছিল তা শুধু ভাবের দেউলে নয়, ভাষারও নাটমন্দিরে। অর্থাৎ কল্লোলের বিরুদ্ধতা শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রেই ছিল না, ছিল বর্ণনার ক্ষেত্রে। ভঙ্গি ও আঙ্গিকের চেহারায়। রীতি ও পদ্ধতির প্রকৃতিতে। ভাষাকে গতি ও ভাবকে দ্যুতি দেবার জন্যে ছিল শব্দসৃজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রচনাশৈলীর বিচিত্রতা। এমন কি, বানানের সংস্করণ। যারা ক্ষুদ্বপ্ৰাণ, মূঢ়মতি, তারাই শুধু মামুলি হবার পথ দেখে—আরামরমণীয় পথ–যে পথে সহজ খ্যাতি বা:কোমল সমর্থন মেলে, যেখানে সমালোচনার কাঁটা-খোঁচা নেই, নেই বা নিন্দার অভিনন্দন। কিন্তু কল্লোলের পথ সহজের পথ নয়, স্বকীয়তার পথ।

কেননা তার সাধনাই ছিল নবীনতার, অনন্যতার সাধনা। যেমনটি আছে তেমনটিই ঠিক আছে এর প্রচণ্ড অস্বীকৃতি। আছে তার ছেয়েও আরো কিছু আছে, বা যা হয়েছে তা এখনো পুরোপুরি হয়নি তারই নিশ্চিত আবিষ্কার।

এই আবিষ্কারের প্রথম সহায় হলেন প্রমথ চৌধুরী। সমস্ত কিছু সবুজ ও সজীবের যিনি উৎসাহল। মাঝে-মাঝে সকালবেলা কেউকেউ যেতাম আমরা তার বাড়িতে, মে-ফেয়ারে। কল্লোলের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্নপ্রয় ছিলেন বলেই যখনই যেতাম, সম্বর্ধিত হতাম। প্রতিভা-ভাসিত মুখ মেহে সুকোমল হয়ে উঠত। বলতেন, প্রবাহই হচ্ছে পবিত্রতা—স্রোত মানেই শক্তি। গোড়ায় আবিলতা তো থাকবেই, স্রোত যদি থাকে তবে নিশ্চয়ই একদিন খুঁজে পাবে নিজের গভীরতাকে।

মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, লিখে যাব আমরণ। অমন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে বসে অমন প্রতিজ্ঞা করার সাহস আসত।

বলতেন, এমন ভাবে লিখে যাবে যেন তোমার সামনে আর কেউ দ্বিতীয় লেখক নেই। কেউ তোমার পথ বন্ধ করে বসে থাকেনি। লেখকের সংসারে তুমি একা, তুমি অভিনব।

আমার সামনে আর কেউ বসে নেই? চমকে উঠতাম।

না।

রবীন্দ্রনাথ?

রবীন্দ্রনাথও না! তোমার পথের তুমিই একমাত্র পথকার। সে তোমারই একলার পথ। যতই দল বাঁধো প্রত্যেকে তোমরা একা।

মনে বোমাঞ্চ হত। কথাটার মাঝে একটা আশীর্বাদের স্বাদ পেতাম।

বলেই ফের জের টানতেন : নিত্য তুমি খেল যায়, নিত্য ভাল নহে তাহা, আমি যা খেলিতে বলি সে খেলা খেলাও হে। এ কথা। ভারতচন্দ্র লিখেছিল। চাই সেই শক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কতৃত্ব, সেই অনন্তপূর্ব। যদি সর্বক্ষণ মনে কর, সামনে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, তবে নিজের কথা আর বলবে কি করে? তবে তো শুধু রবীন্দ্রনাথেরই ছায়ানুসরণ করবে। তুমি ভাববে তোমার পথ মুক্ত, মন মুক্ত, তোমার লেখনী তোমার নিজের আজ্ঞাবহ।

রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে এসেছিল কল্লোল। সরে এসেছিল অপজাত ও অবজ্ঞাত মনুষ্যত্বের জনতায়। নিম্নগত মধ্যবিত্তদের সংসারে। কয়লাকুঠিতে, খোলার বস্তিতে, ফুটপাতে। প্রতারিত ও পরিত্যক্তের এলেকায়।

প্রমথ চৌধুরী প্রথম এই সরে-আসা মানুষ। বিষয়ের দিক থেকে না হোক, মনোভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে। আর দ্বিতীয় মানুষ নজরুল।

যেমন লেখায় তেমনি পোশাকে-আশাকেও ছিল একটা রঙিন উচ্ছৃলতা। মনে আছে, অভিনবত্বের অঙ্গীকারে আমাদের কেউ-কেউ তখন কোঁচা না ঝুলিয়ে কোমরে বাঁধ দিয়ে কাপড় পরতাম—পাড়-হীন খান ধুতি—আর পোশাকের পুরাতন দারিদ্র্য প্রকট হয়ে থাকলেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হতাম না। নৃপেন তো মাঝে মাঝে আলোয়ান পরেই চলে আসত। বস্তুত পোশাকের দীনতাটা উদ্ধতিরই উদাহরণ বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু নজরুলের ঔদ্ধত্যের মাঝে একটা কবিতার সমারোহ ছিল, যেন বিহ্বল, বর্ণাঢ্য কবিতা। গায়ে হলদে পাঞ্জাবি, কাঁধে গেরুয়া উড়ুনি। কিংবা পাঞ্জাবি গেরুয়া, উড়ুনি হলদে। বলত, আমার সন্ত্রান্ত হবার দরকার নেই, আমার বিভ্রান্ত করবার কথা। জমকালো পোশাক না পরলে ভিড়ের মধ্যে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব কি করে?

মিথ্যে কথা। পোশাকের প্রগলভতার দরকার ছিল না নজরুলের। বিস্তীর্ণ জনতার মাঝেও সহজে চিহ্নিত হত সে, এত প্রচুর তার প্রাণ, এত রোধবন্ধহীন তার চাঞ্চল্য। সব সময়ে উচ্চরোলে হাসছে, ফেটে পড়ছে উৎসাহের উচ্ছৃলতায়। বড়-বড় টানা চোখ, মুখে সবল পৌঁরুষের সঙ্গে শীতল কমনীয়তা। দূরে থাকলেও মনে করিয়ে দেবে অন্তরের চিরন্তন মানুষ বলে। রঙ শুধু পোশাকে কি, রঙ তার কথায় তার হাসিতে তার গানের অজস্রতায়।

হরিহর চন্দ্র তখন বিশ্বভারতীর সহ-সম্পাদক, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে তার আপিসের দোতালায় ফোর আর্টস ক্লাবের বার্ষিক উৎসব হচ্ছে। হরিহর আর কল্লোল প্রায় হরিহর আত্মার মত। সুগোর সুন্দর চেহারা–পরিহাসচ্ছলে কেউ-কেউ বা ডাকত তাকে রাঙাদিদি বলে। তার শ্ৰী অশ্রু দেবী আসলে কিন্তু আনন্দ দেবী। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে আনন্দ মেলা নিয়ে মেতে থাকত। ছোট বড় ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলাধুলা ও নাচগানের আসরই নামান্তরে আনন্দ মেলা। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে, রামমোহন লাইব্রেরিতে বা মার্কাস স্কোয়ারে এই মেলা বসত, কল্লোলের দল নিমন্ত্রিতদের প্রথম বেঞ্চিতে। কেননা হরিহর কল্লোল-দলের প্রথমাগতদের একজন, তাই কল্লোল প্রথমাত্মীয় নামধেয়। গ্রাহক ও বিজ্ঞাপন জোগাড় করে, প্রুফ দেখে দিয়ে কত ভাবে যে দীনেশ-গোকুলকে সাহায্য করত ঠিক-ঠিকানা নেই। ব্যবহারে প্রীতির প্রলেপ, সৌজন্যের স্নিগ্ধতা—একটি শান্ত, দৃঢ়, সুস্থ মনের সৌরভ ছোত চারদিকে।

সেই হরিহরের ঘরে সভা বসেছে। দীর্ঘদীপিতদেহা কয়েকজন সুন্দরী মহিলা আছেন। গান হচ্ছে মধুকণ্ঠে। এমন সময় আবির্ভাব হল নজরুলের। পরনে সেই রঙের ঝড়ের পোশাক। আর কথা কি, হার্মোনিয়ম এবার নজরুলের একচেটে। নজরুল টেনে নিল হার্মোনিয়ম, মহিলাদের উদ্দেশ করে বললে, ক্ষমা করবেন, আপনারা সুর, আমি অসুর।

হেসে উঠল সবাই। অসুরের সুরে ঘর ভরে উঠল।

যতদূর মনে পড়ে সেই সভায় উমা গুপ্ত ছিলেন। যেমন মিঠে চেহারা তেমনি মিঠে হাতে কবিতা লিখতেন তিনি। তিনি আর নেই এই পৃথিবীতে। জানি না তার কবিতা কটিও বা কোনখানে পড়ে আছে।

এই অস্থির এলোমেলেমি নজরুলের শুধু পোশাকে-আশাকে নয়, তার লেখায়, তার সমস্ত জীবনযাপনে ছড়িয়ে ছিল। বন্যার তোড়ের মত সে লিখত, চেয়েও দেখত না সেই বেগ-প্রাবল্যে কোথায় সে ভেসে চলেছে। যা মুখে আসত তাই যেমন বলা তেমনি যা কলমে আসত তাই সে নির্বিরোধে লিখে যেত। স্বাভাবিক অসহিষ্ণুতার জন্যে বিচার করে দেখত না বর্জন-মার্জনের দরকার আছে কি না। পুনর্বিবেচনায় সে অভ্যস্ত নয়। যা বেরিয়ে এসেছে তাই নজরুল, কুবলা খান-এ যেমন কোলরিজ। নিজের মুখে কারণে অকারণে সে স্নো ঘসত খুব, কিন্তু তার কবিতার এতটুকু প্রসাধন করতে চাইত না। বলত, অনেক ফুলের মধ্যে থাক না কিছু কাঁটা, কণ্টকিত পুষ্পই ত নজরুল ইসলাম। কিন্তু মোহিতলাল তা মানতে চাইতেন না। নজরুলের গুরু ছিলেন এই মোহিতলাল। গজেন ঘোষের বিখ্যাত আড্ডা থেকে কুড়িয়ে পান নজরুলকে। দেখেন উদ্বেলতা যেমন আছে আবিলতাও কম নয়। স্রোতশক্তিকে ফলদায়ী করতে হলে তীরের বন্ধন আনতে হবে, আনতে হবে সৌন্দর্য আর সংযম, জাগ্রত বুদ্ধির বশে আনতে হবে ভাবের উদ্দামতাকে। এই বুদ্ধির দীপায়নের জন্যে চাই কিছু পড়াশোনা–অনুভূতির সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ। নিজের পরিবেষ্টনের মাঝে নিয়ে এলেন নজরুলকে। বললেন, পড়ো শেলি-কীটস, পড়ো বায়রন আর ব্রাউনিং। দেখ কে কি লিখেছে, কি ভাবে লিখেছে, মনে স্থৈর্য আনো, হও নিজে নিজের সমালোচক, কল্পনার সোনার সঙ্গে চিন্তার সোহাগ মেশাও। দে গরুর গা ধুইয়ে–নজরুল থোড়াই কেয়ার করে লেখাপড়া। মনের আনন্দে লিখে যাবে সে অনর্গল, পড়বার বা বিচার করবার তার সময় কই। খেয়ালী সৃষ্টিকর্তা মনের আনন্দে তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছে গ্রহ-নক্ষত্রকে, পড়ুয়া জ্যোতিষীরা তার পর্যালোচনা করুক। সেও সৃষ্টিকর্তা।

ভাবের ঘরে অবনিবনা হয়ে গেল। কোনো বিশেষ এক পাড়া থেকে নজরুল-নিন্দা বেরুতে লাগল প্রতি সপ্তাহে। ১৩৩-এর কার্তিকের কল্লোলে নজরুল তার উত্তর দিলে কবিতায়। কবিতার নাম সর্বনাশের ঘণ্টা :

রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা,
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচাৰ্য! আজি এই নব জয়-যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার; দাও গুরু দাও তব রূপ-মসী ছানি
অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।…
চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা
যে ভোগানন্দ দাসেদের গালি হানিয়াছ দুই বেলা,
আজি তাহাদের বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি,
বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালবাসিয়াছ বাঁদরামি।
হে অস্ত্র-গুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা,
পাণ্ডবে দিয়া জয়-কেতু হলে কুক্কুর-কুরু নেতা।
ভোগ-নরকের নারকীর দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী
ব্রহ্ম অস্ত্র ব্রহ্ম দৈত্যে দিয়া হে ব্রহ্মচারী!
তোমার কৃষ্ণ রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত,
সে কমল ঘিরি নেচেছে মরাল কত সহস্র শত,
কোথা সে দীঘির উচ্ছল জল কোথা সে কমল রাঙা,
হেরি শুধু কাদা, শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা।…
মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি
ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানী!
যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভালো করিয়াছে পূজা নিতি
তাহাদের হানে অতি লজ্জায় ব্যথা আজ তব স্মৃতি।…
আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভালো, মোর অপরাধ নহে,
কালীয়দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালীদহে–
তাহার দাহ তো তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ
তাহারা নাচুক জুলুনীর চোটে। তুমি পাও কোন সুখ
দগ্ধমুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি,
শিবসুন্দর সত্য তোমার লভিল এ কি এ গতি?…
তুমি ভিড়িওনা গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল শকুনের দলে
শতদলদলে তুমি যে মরাল শ্বেত সায়রের জলে।
ওঠ গুরু, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুনঃ,
নিন্দার নহ নানীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুন–
উঠ গুরু উঠ, লহ গো প্রণাম বেঁধে দাও হাতে রাখী,
ঐ হের শিরে চক মারে বিপ্লব-বাজপাখী!
অন্ধ হয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্ব মেলিয়া চাহ
ঘনায় আকাশে অসন্তোষের বিদ্রোহ-বারিবাহ।
দোতলায় বসি উতলা হয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী
এ নহে কবির, এ কাঁদন ওঠে নিখিল-মৰ্ম্ম হানি।…
অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি,
গোপীনাথ ম’ল? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি।
বরেন ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা
লাল বাংলার হুমকানী—ছি ছি এত অসত্য ওমা,
কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল!
সখী গো আমায় ধর ধর! মাগো কত জানে এরা ছল!…
এই শয়তানী ক’রে দিনরাত বল আর্টের জয়,
আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ-ভ্যাঙচানো নয়।…
তোমার আর্টের বাঁশরীর সুরে মুগ্ধ হবে না এরা
প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আর্টশালা হবে নেড়া।…
যত বিদ্রূপই কর গুরু তুমি জান এ সত্য বাণী
কারুর পা চেটে মরিব না, কোনো প্রভু পেটে লাথি হানি
ফাটিবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মত
ধরা মার বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত।
আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস
ততদিন গুরু সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!

মনে আছে এই কবিতা নজরুল কল্লোল-আপিসে বসে লিখেছিল এক বৈঠকে। ঠিক কল্লোল-আপিসে হয়তো নয়, মণীন্দ্রর ঘরে। মণীন্দ্র চাকী কল্লোলের একক কর্মচারী। নীরব, নিঃসঙ্গ। মুখে একটি হ্রস্ব নির্মল হাসি, অন্তরে ভাবের স্বচ্ছতা। ঠিকমত মাইনে-পত্র পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন অভাবের রুক্ষ রাজপথ দিয়ে হাঁটছে। অথচ এক বিন্দু অভিযোগ নেই, অবাধ্যতা নেই। ভাবখানা এমনি, কল্লোলের জন্যে সেও তপশ্চারণ করছে, হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে দারিদ্রের নির্দয়তাকে। লেখকরা যেমন এক দিকে সেও তেমনি আরেক দিকে। সে কম কিসে! সে লেখে না বটে কিন্তু কাজ করে, সেবা করে। সেও তো এক নৌকার সোয়ারি।

খোলার চালে ঘুপসি একখানা বিচ্ছিন্ন ঘর ওই মণীন্দ্রর। কল্লোল-আপিসের সঙ্গে শুধু একফালি ছোট্ট একটা গলির ব্যবধান। মণীন্দ্রর ঘর বটে, কিন্তু যে-কাউকে সে যে-কোনো সময় তা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। নিয়মিত সময়ে নজরুল কবিতা লিখে দিচ্ছে না, বন্ধ করো তাকে সেই ঘরে, কবিতা শেষ হলে তবে খুলে দেয়া হবে ছিটকিনি। কাশী থেকে দৈবাৎ সুরেশ চক্রবর্তী এসে পড়েছে, থাকবার জায়গা নেই, চলে এস মণীন্দ্রর ঘরে। প্রেমেন এসেছে ছুটিতে, মেসের দরজা বন্ধ তো মণীন্দ্রর দরজা খোলা। দুপুরবেলা ব্রে খেলতে চাও—সেই কালো বিবি-গছানো কালান্তক খেলা—চলে যাও মণীন্দ্রর আস্তানায়। চারজনের মামলায় ষোলোজন মোক্তারি করে হুল্লোড় বাধাও গে। কখন হঠাৎ শুনতে পাবে তোমার পাশের থেকে আশু ঘোষ লাফিয়ে উঠেছে তারস্বরে : আহাহাহা, করস কি, দুরির উপর তিনি মারিয়া দে–

গুপ্ত ফ্রেণ্ডস-এর আশু ঘোষ! কি সুবাদে যে কল্লোলে এল কে বলবে। কিন্তু তাকে ছাড়া কোনো আড়াই যেন দানা বাঁধে না। একটা নতুন স্বাদ নিয়ে আসত, ঋজু ও দৃপ্ত একটা কাঠিন্যের স্বাদ। নির্ভীক সারল্যের দারুচিনি। আশুকে কোনোদিন পাঞ্জাবি গায়ে দিতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না–শার্ট-কোট তো সুদূরপরাহত। চিরকাল গেঞ্জি-গায়েই আনাগোনা করল, খুব বেশি শালীনতার প্রয়োজন বোধ করলে পাঞ্জাবিটা বড়জোর কাঁধের উপর স্থাপন করেছে। আদর্শের কাছে অটলপ্রতিজ্ঞ আশু ঘোষ, পোশাকেও দৃঢ়পিনদ্ধ। অল্পেই সন্তুষ্ট তাই পোশাকেও যথেষ্ট। তার প্রীতির উৎসারই হচ্ছে তিরস্কারে—আর সে কি ক্ষমাহীন নির্মম তিরস্কার! কিন্তু এমন আশ্চর্য, তার কশাঘাতকে কশাঘাত মনে হত না, মনে হত রসাঘাত,–যেন বিদ্যুতের চাবুক দিয়ে মেঘ তাড়িয়ে রোদ এনে দিচ্ছে। খাঁটি, শক্ত ও অটুট মানুষের দরকার ছিল কল্লোলে।

আশু ঘোষের গেঞ্জিও যা, দীনেশরঞ্জনের ফ্রিল-দেয়া হাতা-ওয়ালা পাঞ্জাবিও তাই। দুইই এক দুদিনের নিশানা। আমাদের তখন এমন অবস্থা, একজনে এক পুরো আস্ত একটা সিগারেট খাওযা নিষিদ্ধ ছিল। কাঁচি, এবং আরো কাঁচি চললে, পাসিং শো। সিগারেট বেশির ভাগ জোগাত অজিত সেন, জলধর সেনের ছেলে। কল্লোলের একটি নিটুট খুঁটি, তক্তপোশের ঠিক এক জায়গায় গ্যাঁট-হয়ে বসা লোক। কথায় নেই হাসিতে আছে, আর আছে সিগারেট বিতরণে। কুণ্ঠা আছে একটু, কিন্তু কৃপণতা নেই। সবাই দাদা বলতাম তাকে। আশ্চর্য, জলধর সেনকেও দাদা বলতাম। আই-সি-এসের ছেলে আই-সি-এস হয়েছে একাধিক, কিন্তু দাদার ছেলের দাদা হওয়া এই প্রথম। যেমন কুলগুরুর ছেলে কুলগুরু। নিয়ম ছিল সিগারেট টানতে গিয়ে যেই গায়ের লেখার প্রথম অক্ষরটুকু এসে ছোঁবে অমনি আরেকজনকে বাকি অংশ দিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী লোক জিতল বলে সন্দেহ করার কারণ নেই, কারণ শেষ দিকে খানিকটা ফেলা যাবে অনিবার্য। তবে পরবর্তী লোক যদি পিন ফুটিয়ে ধরে টানতে পারে শেষাংশটুকু, তবে তার নির্ঘাৎ জিত।

এ দিনের দৈন্যের উদাহরণস্বরূপ দুটো চিঠির টুকরো তুলে দিচ্ছি। একটা প্রেমেনের, আমাকে লেখা :

কিন্তু সুখের বা দুঃখের বিষয় হোক, Testএ পাশ হয়ে গেছি সসম্মানে। এখন ফি-এর টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছি না। তাই আজ সকালে তোক চিঠি লিখতে বসব এমন সময় তোর চিঠি এল। এবার তুই কোন ওজর দেখাতে পাবিনা। যা করে হোত, দশটা টাকা আমাকে পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিবি। আমি পরে কলকেতায় গিয়ে শোধ করব। সত্যি জানিস Testএর ফি দিতে পারছি না। কলকেতায় দিদিমার কাছে একটি পয়সা নেই, এখন বুড়িকে বিড়ম্বিত করাও যায় না। এ সম্বন্ধে আর বেশী কিছু লিখলাম না, তোর যা সাধ্য তা তুই করবি জানি। তোর ভরসায় রইলাম।

Finalএ পাশ হব কি না জানি না, কিন্তু ছুটি যে একেবারে নেব, খাব কি? একটা কথা আমি ভালোরকমেই জানি যে দারিদ্র সমস্ত idealismকে শুকিয়ে মারতে পারে। আমি বড়লোক হতে মোটেই চাই না, কিন্তু অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম আর সাহিত্যসৃষ্টি এই দুকাজ একসঙ্গে করবার মত প্রচুর শক্তি আমার নেই। সে আছে যার সেই মহাপুরুষ শৈলজাকে আমি মনে-মনে প্রায় প্রণাম করে থাকি।

এবার কলকেতায় গিয়ে যদি গোটা ত্রিশ টাকা মাইনের এমন একটা কাজ পাই যাতে অতিরিক্ত একঘেয়ে খাটুনি নেই, তা হলে আমি তাতেই লেগে যাব এবং তাহলে আমার একরকম চলে যাবে। কোনো স্কুলের Librarian-মত হতে পারলে মন্দ হয় না। অবশ্য কেরানীগিরি আমার পোষাবে না।

শরীর ভালো নয়। ঢাকার জল হাওয়া মাটি মানুষ কিছুই ভালো। লাগছে না। হয়তো জীবনের উপরই বিতৃষ্ণার এই সূচনা।

আরেকটা শৈলজার চিঠি, দীশেরঞ্জনকে লেখা :

বৃহস্পতিবার, বারবেলা

দাদা দীনেশ,

…দু দিন আমি পটুয়াটোলার মোড় থেকে ফিরে এসেছি। জানি, এতে আমার নিজের দোষ কিছু নেই, কিন্তু যে পরাজয়ের লজ্জা আমার অষ্টাঙ্গ বেষ্টন করে ধরেছে তার হাত থেকে আজ পর্যন্ত নিষ্কৃতি পাচ্ছি না যে। আমার মত লোকের বই ছাপানো যে কত দূর অন্যায় হয়েছে তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। তাই সমস্ত বোঝার ভার আপনার ঘাড়ে চড়িয়ে দিয়ে আমি একটুখানি সরে দাঁড়াতে চাই।

এখন কি হয়েছে শুনুন। কাবলিওয়ালার মত তাগাদা দিয়ে রায়-সাহেবের কাছে হাসি লক্ষ্মীর জন্য ৫০০ পাঁচ শ টাকা আদায় করেছি, তার পরেও শ খানেক টাকা বাকী ছিল। এখন তিনি সে টাকা দিতে অস্বীকার করেছেন। কাজেই বোঝা এসে পড়েছে আমার ঘাড়ে। এ নিঃস্ব ভিখারীর পক্ষে শ খানেক টাকার বোঝাও যে ভারী দাদা। কিন্তু এখন আমি করি কি? গত দুদিন আমি বই লিখে প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে উপযাচকের মত একশটি টাকার জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু এ অভাগার দুর্ভাগ্য, কারও কাছ থেকে একটা আশ্বাসের বাণীও আমার ভাগ্যে জোটেনি। …আমি এ অন্ধকার আবর্তের মধ্যে পড়ে ভাববার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না।

আমায় একবার এ সব দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিন। লোটা কম্বল সম্বল করে বোম কেদারনাথ বলে আমি একবার বেরিয়ে পড়তে চাই। এ সব সর্বনাশ আবর্জনার মধ্যে প্রাণ আমার সত্যসত্যই ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে।….

হাসি লক্ষ্মীর আবেষ্টনের মধ্যে হাত-পা যেন বাধা হয়ে রয়েছে, তাই কুছ পবোয়া নেই বলতে কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। এ বন্ধন থেকে যদি শনিবার দিন মুক্তি পাই তাহলে বুক ঠুকে বলছি–কুছ পরোটা নাই! তাহলে–

সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মুখ হাসে মোর চোখ হাসে আর টগবগিয়ে খুন হাসে।

লিখেছেন,–হাসছ তো শৈলজা? আঃ, কি আর বোলব ভাই, এমন সান্ত্বনার বাণী অনেকদিন শুনিনি। আজ আমার মনে পড়ছে— সে আজ বহুদিনের কথা—আর একজন, তার নিজের বেদনা বক্ষের গাঢ় বক্তাক্ত ক্ষতমুখ দুহাত দিয়ে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে কয়েছিল মেয়েদের মত তোমার এ কান্না সাজে না, তুমি কেঁদো না।

সে কথা হয়ত আজ ভুলে ছিলুম, তাই আমার ক্ষণে-ক্ষণে মনে হয়–

হাসি? হায় সখা, এ তো স্বর্গপুরী নয়,
পুষ্পে কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়
মৰ্ম্মমাঝে।

আশা করি সকলেই কুশলে আছেন। আমার ভালোবাসা গ্রহণ করুন। শনিবার দিন রিক্তহস্তে এ দীন দীনেশের দরজায় গিয়ে জড়াবে—তার অন্তরের বিরাট ক্ষুধা একটুখানি সহানুভূতির নিবিড় করুণা চাওয়ার প্রত্যাশী!

এই সময় আমি এক টেক্সট-বুক প্রকাশকের নেকনজরে পড়ি। সেই আমার পুস্তক প্রকাশকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার। অনুরোধ হল, নিচু ক্লাশের স্কুলের ছাত্রদের জন্যে বাঙলায় একখানা রচনা-পুস্তক লিখে দিতে হবে—হাতি-ঘোড় উষ্ট্র-ব্যাঘ্র নিয়ে রচনা। তনখা পঞ্চাশ টাকা। সানন্দচিত্তে রাজি হয়ে গেলাম, প্রায় একটা দাও পাওয়ার মত মনে হল। লেখা শেষ করে দিলাম অল্প কয়েক দিনের মধ্যে —লেখার চেয়েও লেখা শেষ করতে পারাটাই বেশি পছন্দ হল প্রকাশকের। টাকার জন্যে হাত বাড়ালে প্রকাশক মাত্র একটি টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন। বললাম—বাকিটা? আস্তে-আস্তে দেব, বললেন প্রকাশক, একসঙ্গে একমুস্তে সব টাকা দিয়ে দিতে হবে পষ্টাপষ্টি এমন কথা হয়নি। ভালোই তো, অনেক দিন ধরে পাবেন। কিন্তু একদিন এই অনেক দিনের সান্ত্বনাটা মন মেনে নিতে চাইল না। হন্তদন্ত হয়ে দোকানে ঢুকে বললাম, টাকা দিন। প্রকাশক মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, এত হন্তদন্ত হয়ে চলেছেন কোথায়? বললাম, খেলা দেখতে। খেলা দেখতে? যেন আশ্বস্ত হলেন প্রকাশক। সরবে হিসেব করলেন শুনিয়ে-শুনিয়ে গ্যালারি চার আনা আর ট্রাম ভাড়া দশ পয়সা। সাড়ে ছ আনাতেই হবে, সাড়ে ছ আনাই নিয়ে যান! বলে সত্যি-সত্যি সাড়ে ছ আনা পয়সাই গুনে দিলেন।

বাঙলা দেশের প্রকাশকের পক্ষে তখন এও সম্ভব ছিল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *