০৭. কাজীর বিষের বাঁশী নিষিদ্ধ

ঘোর বর্ষায় পথ-ঘাট ডুবে গেলেও আড্ডা জমাতে আসতে হবে তোমাকে কল্লোল: আপিসে—তা তুমি ভবানীপুরেই থাকো বা বেলেঘাটায়ই থাকে। আর সোমনাথ আসত সেই কুমোরটুলি থেকে। সোমনাথের যেটা বাড়ি তার নিচেটা চালের আড়ত, সারবাঁধা চালের বস্তায় ভর্তি। উপরে উঠে গিয়ে চালের গাদি পেরিয়ে সোমনাথের ঘর। একটা জলজ্যান্ত প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ শুধু তার ঘরে নয়, চেহারায়ও। গদির মালিকদের পরনে আটহাতি ধুতি, গা খালি, গলায় তুলসীর কন্ঠী। সোমনাথের পরনে ঢিলেঢালা অঢেল পাঞ্জাবি, লম্বা ললাটানো কোচা, অতৈললাঞ্ছিত চুল ফঁাপিয়োপিয়ে ব্যাকব্রাশ করা। সব মিলিয়ে একটা উদ্ধত বিদ্রোহ সন্দেহ নেই, কিন্তু দেখতে যেমন সৌম্যদর্শন, শুনতেও তেমনি অতিন। মোলায়েম মিষ্টি হেসে একটু বা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে, কথায় পরিহাসের রসটাই বেশি। অথচ এদিকে খুব বেশি সিরিয়স—পড়ছে মেডিকেল কলেজে। ডাক্তারি করবে অথচ গল্প লিখছে ভারতীতে, কাগজ বের করেছে ঝর্ণা বলে। (একটা স্মরণীয় ঘটনার জন্যে ও কাগজের নাম থাকবে, কেননা ও কাগজেই সত্যেন দত্তের ঝর্ণা কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।) এ হেন সোমনাথ, হঠাৎ শোনা গেল, ব্রাহ্ম হচ্ছে। সখের ব্রাহ্ম নয়, কেতাদুরস্ত ব্রাহ্ম। গোকুলই খবর নিয়ে এল তার দীক্ষার দিন কবে। স্থান ভবানীপুর সম্মিলন সমাজ। গেলাম সবাই মজা দেখতে। গিয়ে দেখি গলায় মোটা ফুলের মালা পরে সোমনাথ ভাবে গগদ হয়ে বসে আছে আর আচার্য সতীশ চক্রবর্তী ফুল দিয়ে সাজানো বেদী থেকে হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিয়ে তাকে দীক্ষিত করছেন। বহু চেষ্টা করে চোখের সঙ্গে চোখ মিলিয়ে তাকে টলানো  গেল না, ধর্মবিশ্বাসে সে এত অবিচল। ব্যাপার কি? মনোবনবিহারিণী কোনো হরিণী আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু, কি পরিহাস, কিছুকাল পরে বিধিমত হিন্দুমতে সমাজমনোনীত একটি পাত্রীর পাণিগ্রহণ করে বসল। সোমনাথ সাহা কল্লোল যুগের এক ঝলক বাসন্তী হাওয়া।

সমস্ত বিকেলে হৈ-চৈ-হল্লার পর সন্ধ্যোত্তীর্ণ অন্ধকারে গোকুলের সঙ্গে একান্ত হবার চেষ্টা করতাম। কল্লোল-অপিসে একখানি যে চটের ইজিচেয়ার ছিল তা নিয়ে সারাদিন কাড়াকাড়ি গেছে—এখন, নিভৃতে তাইতেই গা এলিয়েছে গোকুল। পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে বুঝি? সারাদিন সুবোধকে পথিকের তলিপি দিয়েছে। তারই জন্যে কি এই ক্লান্তি? মনে হত, শুধু শারীরিক অর্থেই যেন এ ক্লান্তির ব্যাখ্যা হবে না। যেন আত্মার কোন গভীর নিঃসঙ্গতা একটি মহান অচরিতার্থতার ছায়া মেলেছে চারপাশে; হয়তো অন্ধকার আর একটু ঘন ও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেই তার আত্মার সেই গভীর স্বগতোক্তি শুনতে পাব।

কিন্তু নিজের কথা এতটুকুও বলতে চাইত না গোকুল। বলতে ভালোবাসত ছেলেবেলাকার কথা। সতীপ্রসাদ সেন—আমাদের গোরাবাবু–গোকুলের সতীর্থ, নিত্যি যাওয়া-আসা ছিল তার বাড়িতে, রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। গোরাবাবুদের বাড়ির সামনের শীতলাতলায় বৈশাখ মাসে তিন দিন ধরে যাত্রা হত, শলমা-চুমকির পোশাক-পরা রাজা-রানিসখির দল সরগরম করে রাখত সেই শীতলাতলা। প্রতি বৎসর গোরাবাবুদের বাড়ির ছাদে বসে সারারাত যাত্রা শুনত গোকুল—একবার কেমন বেহালা নিয়ে এসেছিল সখীদের গানগুলো বেহালায় তুলে নেবার জন্যে। কি বলতে চাইত আর আগের কথা। সেই যখন সাউথ সুবার্বান স্কুলে ফিফথ ক্লাশে এসে ভর্তি হল। অত্যন্ত লাজুক মুখচোরা ছেলে, ক্লাশের লাস্ট বেঞ্চিতে লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা। আলিপুরে মামার বাড়িতে থাকে, মামা ব্রাক্ষ, তাই তার কথাবার্তায় চালচলনে একটা চকচকে গোছগাছ ভাব সকলের নজরে না পড়ে যেত না। তার উপর মার্বেল ডাণ্ডাগুলি চু-কপাটি খেলবে না কোনোদিন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে, আর নাকি খাতার পাতায় ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। রাষ্ট্র হয়ে গেল, ও বেহ্মজ্ঞানী। সে নাজানি কি রকম জীব, ছেলেরা মন খুলে মিশত না, কপট কৌতূহলে উঁকিঝুকি মারত। মাস্টার-পণ্ডিতরাও টিটকিরি দিতে ছাড়তেন না। ফোর্থ ক্লাশে যখন পড়ে তখন ওর খাতায় কবিতা আবিষ্কার করে ওর পাশের এক ছাত্র পণ্ডিতমশায়ের হাতে চালান করে দেয়। পড়ে পণ্ডিতমশায় সরাসরি চটে উঠতে পারলেন না, ছন্দেবন্ধে কবিতাটি হয়ত নিখুত ছিল। শুধু নাক সিঁটকে মুখ কুঁচকে বলে উঠলেন : এতে যে তোদের রবিঠাকুরের ছায়া পড়েছে! কেন, মাইকেল হেম নবীন পড়তে পারিস না? রবিঠাকুর হল কিনা কবি। তার আবার কবিতা। আহা, লেখার কি নমুনা। রাজার ছেলে যেত পাঠশালায়, রাজার মেয়ে যেত তথা— তথা—কথাটা এমন মুখভঙ্গি করে ও হাত নেড়ে উচ্চারণ করলেন যে ক্লাশশুদ্ধ, ছেলেরা হেসে উঠল।

মেজবৌদি গোকুলের জন্যে খাবার পাঠিয়ে দিলেন। কি করে খবর পেয়েছেন তিনি গোকুল আজ সারাদিন ধরে উপবাসী। বাড়িতে ফিরতে তার দেরি হয় বলে সে সাফাই নিয়েছে বাইরে খেয়ে-আসার। তার মানে, প্রায় দিনই একবেলা অভুক্ত থাকবার। কোনো-কোনদিন আরো নির্জন হবার অভিলাষে সে বলত, চলো, এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত হাঁটি, তার মানে তখন বুঝতে পারিনি পুরোপুরি। তার মানে, গোকুলের কাছে পুরোপুরি ড্রামভাড়া নেই।

অথচ এই গোকুল কোনো-কোনোদিন নৃপেনের পাশ ঘেঁসে বসে অলক্ষ্যে তার বুক-পকেটে টাকা ফেলে দিয়েছে যখন বুঝেছে নৃপেনের অভাব প্রায় অভাবনীয়।

অথচ যখন কথা বলতে যাও গোকুলের মুখে হাসি আর রসিকতা ছাড়া কিছু পাবে না। সুর করে যখন সে পূর্ববাংলার কবিতা বলত তখন অপরূপ শোনাত :

পদ্মা-পাইড়া রাইয়তগ লাঠি হাতে হাতে
গাঙের দিকে মুখ ফিরাইয়া ভাত মাখেন পাতে।
মাখা ভাতটি না ফুরাতেই ভাইঙ্গা পড়ে ঘর
সানকির ভাত কোছে ভইরা খোঁজেন আরেক চর।
টানদেশী গিরস্তগ বাপকালান্যা ঘটি
আটুজলে ডুব দেন আর বুকে ঠেকে মাটি।
আপনি পাও মেইল্যা বইস্যা উক্কায় মারেন টান,
একপহরের পথ ভাইঙ্গা বউ জল আনবার যান।

সাতাশ নম্বর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে একটা একদুয়ারী এক চিলতে ঘরে কল্লোলের পাবলিশিং হাউস খোলা হয়। আপিস, থাকে সেই পটুয়াটোলা লেনেই। তার মানে সন্ধের দিকের তুমুল আড্ডাটা বাড়ির বৈঠকখানায় না হয়ে হাটের মাঝখানে দোকানঘরেই হওয়া ভালো। সেই চিলতে ঘরে সবাইর বসবার জায়গা হত না, ঘর ছাপিয়ে ফুটপাতে নেমে পড়ত। সেই ঘরকেই নজরুল বলেছিল একগাদা প্রাণভরা একমুঠো ঘর। সেই একমুঠো ঘরেই একদিন মোহিতলাল এসে আবির্ভূত হলেন। আমরা তখন এক দিকে যেমন যতীন সেনগুপ্তের পেসিমিজম-এ মশগুল, তেমনি মোহিতলালের ভাবঘন বলিষ্ঠতায় বিমোহিত। মোহিতলালকে আমরা মাথায় তুলে নিলাম। তিনি এসেই কবিতা আবৃত্তি করতে সুরু করলেন, আর সে কি উদাত্তনিস্বন মধুর আবৃত্তি! কবিতার গভীর রসে সমস্ত অনুভূতিকে নিষিক্ত করে এমন ভাবব্যঞ্জক আবৃত্তি শুনিনি বহুদিন। দেবেন সেনই আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন। আজো তাঁর সেই ভাবগদগদ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি, দেখছি তার সেই অধমুদ্রিত চক্ষুর সূক্ষ্ম শুভ্ররেখা।

চাহি না আনার যেন অভিমানে ক্রুর
আরক্তিম গণ্ড ওষ্ঠ ব্রজসুন্দরীর,
চাহিনাক ‘সেউ’ যেন বিরহবিধুর
জানকীর চিরপা বদন রুচির।
একটুকু রসে ভরা চাহি না আঙুর
সলজ্জ চুম্বন যেন নববধূটির,
চাহিনা ‘গন্নার’ স্বাদ, কঠিনে মধুর
প্রগাঢ় আলাপ যেন প্রৌঢ় দম্পতির।

কল্লোল-পাবলিশিং হাউস থেকে প্রথম বই বেরোয় সুবোধ রায়ের নাটমন্দির—তিনটি একাঙ্ক নাটিকার সঙ্কলন। আর চতুষ্কলা ক্লাবে খানকয় পুরানো বই, ঝড়ের দোলা বা রূপরেখা—তার বিষয়বিভব। আর, সর্বোপরি, নজরুলের বিষের বাঁশী জমায় রেখে হুহু করে যে বেচতে পারছে এই তার ভবিষ্যতের ভরসা।

তেরোশ একত্রিশ সালের পূজার ছুটিতে কলকাতার বাইরে বেঁড়াতে যাই। সেখানে দীনেশদা আমাকে চিঠি লিখেন :

সোমবার
৩রা কার্তিক, ১৩৩১
সন্ধ্যা ৭-৩০ টা

পথের ভাই অচিন্ত্য,

কিছুদিন হল তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি। তোমাকে ছাড়া আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে—কিন্তু যখন ভাবি হয়ত ওখানে থেকে তোমার শরীর একটু ভাল হতে পারে তখন মনের অতখানি কষ্ট থাকে না।

হয়ত এরই মধ্যে পবিত্র ও ভূপতির বড় চিঠি পেয়েছ। কি লিখেছে তারা তা জানি না, তবে এটা শুনেছি যে পত্র দুখানাই খুব বড় করে লিখেছে।

আজ সারাদিন খুব গোলমালে গেল। এই কিছুক্ষণ আগে মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা আমার শেষ হল। শৈল, মুরলী, গোকুল, নৃপেন, পবিত্র ভূপতি প্রভৃতি কল্লোল আপিস ছেড়ে গেল। আমি স্নান সেরে এসে নিরালায় তাই তোমার কাছে এসেছি। এইটুকু আমার সময় কিন্তু তাও কেউ কেউ আসেন কিংবা মনের ভিতরই গোলমাল চলতে থাকে।

কাল রবিবার গেল, মুরলীদার বাড়ীতে সন্ধ্যাবেলা জোর আচ্ছা। বসেছিল। চা, পান, গান, মান, অভিমান সবই খুব হল। বীরেনবাবু ও জ্ঞানাঞ্জন পাল মহাশয়রাও ছিলেন।

রূপরেখার বেশ একটা রিভিয়ু বেরিয়েছে Forward-এ কালকের।

নাটমন্দিরও আজ বেরিয়ে গেল। এবার তোমাদের পালা। একখানা করে সবাইকার বের করতেই হবে। কেমন? অন্তত একশটি টাকা আমাকে প্রথম এনে দাও, আর তোমাদের লেখাগুলি, তা হলেই কাজ শুরু করে দিতে পারি।

প্রেমেন এসেছে ফিরে, তাকেও জোর দিয়েছি। সে তো একটু seriouslyই ভাবছে।

শৈলজার রাঙাশাড়ীখানা যদি পাওয়া যায়—যেতেও পারে—তা হলে তো কথাই নেই।

তোমার চাষা-কবি এখনও পেলাম না কেন? এতই কি কাজ যে কপি করে আজও পাঠাতে পারলে না? তোমার কবিতাটিই যে আগে যাবে, সুতরাং কবিতা পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত করবে। এবারে প্রেমেনের কমলা কেবিনটা ফিরিয়ে পেলে হয়তো যাবে। তুমি না থাকাতে তার যথেষ্ট একলা লাগছে বুঝতে পারি। সত্যি, বেচারার একটা আস্তানা নেই যে খাবে থাকবে।

কিন্তু এরকমই থাকব সব? না, তা হবে না-এই মাটি খুঁড়ে তা হলে শেষ চেষ্টা করে যাব। আমরা তো সইলাম আর বুঝলাম কিছু কিছু। কিন্তু যে কষ্ট নিজেরা পেলাম তা কি পরকে জেনে-শুনে দিতে পারি? ঐ সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনাগত অযুত সংখ্যক কালকের মানুষের দল, তারা এসেও কি এই ভোগই ভুগবে? আমাদের এই সত্যের নির্বাক যুদ্ধ জয় করে রাখবে বাংলার প্রাণের প্রান্তে-প্রান্তে সবুজ পাতার বাসা। নীড়হারা পথহারা নীল-আকাশের রং-লাগান নীলপাখীর দল একেবারে সোজা সবুজ পাতার বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। পথের বাঁকের বিরাট আয়ুবৃদ্ধ বটগাছ দেখবে বাংলার প্রান্ত হতে প্রান্তে রুক্ষরূপের বক্ষভেদ করে ফুটে আছে অপরাজিতার দল।

কি জানি কতদূর হবে। যদি না থাকি!

আহা, বাঁচুক তারা যারা আসছে। বেচারারা কিছু জানে না, বিশ্বাস ভাঙিয়ে সাদা মনের সওদা কিনতে গিয়ে কিনছে কেবল ফুটো আর পচা! তারা যে তখন কাঁদবে। আহা, যদি তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকে যে সে ভেঙে পড়বে, পৃথিবীকে অভিশাপ দিয়ে ফেলবে? না, না, তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারব না আমরা কজনে?

পলিটিক্স বুঝি না, ধর্ম মানি না, সমাজ জানি না—মানুষের মনগুলি যদি সাদা থাকে—ব্যস, তা হলেই পরমার্থ।

তোমাকে একটা কথা বলছি কানে-কানে। মনটার জন্য একটা চাবুক কেনো। চাবুক মেরো না যেন কখনও, তাহলে বিগড়ে যাবে। মাঝে-মাঝে কেবল সপাং-সপাং করে আওয়াজ করবে-মনের ঘরের যে যেখানে ছিল দেখবে সব এসে হাজির। ভয়ও না ভাঙে, ভয়ও না থাকে–এমনি করে রাখতে হবে।

আর একটা কথা—ভালবাসাটাকে খুঁজে বেড়িও না। ওটা ঘোড়ার গায়ের নালও নয় আর মাটির তলায় মোহরের কলসীও নয়। হাতড়ে চললেই হোঁচট খাবে। তবে কোথায় আর কবে সত্যিকারের ভালবাসবার মত ভালবাসাটুকুকে পাবে তা জানবার চেষ্টাও করো না। খানেখানে পাওয়া যায়—সবটুকু রসগোল্লায় মত একজায়গার তাল পাকিয়ে বসের গামলায় ভাসেনা।

ঝড়ের দিনে শিল কুড়োয়না ছেলেমেয়েরা? কুড়োতে-কুড়োতে দু একটা মুখেই দিয়ে ফেলে আর সব জড় করে একটা তাল পাকায়, সেটা আর চোষে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আর দেখে। কত রঙের খেলা। ঘুরতে থাকে—আর মাঝে-মাঝে ঠাণ্ডা হাত নিজেরই কপালে চোখে বুলোয়। কুড়েবার সময়ও ঝড়ের যেমন মাতন, যারা শিল কুড়োয় তাদেরও তেমনি ছুটোছুটি হট্টগোল! কোনটা ঠকাস করে মাথায় পড়ে, কোনটা পায়ের কাছে ঠিকরে পড়ে গুড়িয়ে যায়, কোনটা বা এক ফাঁকে গলার পাশ দিয়ে গলে গিয়ে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুড়োনো শেষ হলে আর গোল থাকে না, সব চুপচাপ করে তাল পাকায় আর নিজের সংস্থান ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে।

বিয়ে করতে চাও? চাকরী দেখ। অন্ততঃপক্ষে দেড়শ টাকাঙ্কমে হবেই না। তা-ও নেহাৎ দরিদ্রমতে-প্রেম করা চলবে না। যদি সমাজকে ডিঙিয়ে যেতে চাও তাহলে অন্তত দুশো আড়াই শো।

শরীরের খবর দিও। লেখা immediately পাঠাবে। দেরী করোই না। ভালবাসা জেনো।

তোমাদের দীনেশদা

এর দিন কয়েক পরে গোকুলের চিঠি পাই।

কল্লোল
১০-২ পটুয়াটোলা লেন, কলিকাতা
১১ই কার্তিক, ৩১

স্নেহাস্পদেষু

তোমার চিঠি যখন পাই তখন উত্তর দেবার অবস্থা আমার ছিল না। অবস্থা যখন ফিরে পেলাম তখন মনে হল—কি লিখব? লেখবার কিছু আছে কি? চোখের সামনে বসে পবিত্র পাতার পর পাতা তোমায় লিখেছে দেখেছি, ভূপতি নাকি এক ফর্মা ওজনের এক চিঠি লিখেছে, দীনেশ ও সম্ভবত তাই। আর কে কি করেছে তা তুমিই জান, কিন্তু আমার বেয়াদবি আমার কাছেই অসহ্য হয়ে উঠছিল। তাই আজ ভোরে উঠেই তোমাকে লিখতে বসেছি। আমার শরীর এখন অনেকটা ভাল। তোমার প্রথমকার লেখা চিঠিগুলো থেকে যেকথা আমার মনে হয়েছিল তোমার পবিত্রকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে ঠিক সেই সুরটি পেলাম না। কোথায় যেন একটু গোল আছে। প্রথমে পেয়েছিলাম তোমার জীবনের পূর্ণ বিকাশের আভাস, কিন্তু দ্বিতীয়টা অত্যন্ত melodramatic. দেখ অচিন্ত্য, যে বলে দুঃখকে চিনি, সে ভারী ভুল করে। অনেক দুঃখ পেয়েছি জীবনে কথাটার সুর অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। মনের যে কোন বাসনা ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি অতৃপ্ত থাকলেই যে অশান্তি আমরা ভোগ করি তাকেই বলি দুঃখ, কিন্তু বাস্তবিক ও দুঃখ নয়। যে বুকে দুঃখের বাসা সে বুক পাথরের চেয়েও কঠিন, সে বুক ভাঙ্গে না টলে না। দুঃখের বিষদাত ভেঙ্গে তাকে নির্বিষ করে যে বুকে রাখতে পারে সেই যথার্থ দুঃখী। ভিখারী, প্রতারিত, অবমানিত, ক্ষুধার্ত—এরা কেউই দুঃখী নয়। খৃষ্ট দুঃখী ছিলেন না, তিনি চিরজীবন চোখের জল ফেলেছেন, নালিশ করেছেন, অভিশাপ দিয়েছেন, অভিমান করেছেন। গান্ধী যথার্থ দুঃখী। এবার ক্ষুধা, অশান্তি, ব্যথার প্রত্যেকটি stage-এর সঙ্গে মিলিয়ে নাও, বুঝতে পারবে দুঃখ কত বড়। সবাই যে কবি হতে পারেনা তার কারণ এই গোড়ায় গলদ। অত্যন্ত promising হয়েও melodramatic monologue-এর সীমা এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রত্যেক ব্যক্তিগত অতৃপ্তি ও অশান্তির ফর্দ করে যায়, তাই সেটাকে মানুষ বলে সখের দুঃখ। যাক বাজে কথা, কতকগুলো খবর দিই।

হঠাৎ কেন জানি না পুলিশের কৃপাদৃষ্টি আমাদের উপর পড়েছে, আমাদের আপিস দোকান সব খানাতল্লাস হয়ে গেছে, আমরা সবাই এখন কতকটা নজরবন্দী–1818 Act 3 তে।

নৃপেন বিজলী আপিসে কাজ করছে। শৈলজার বাংলার মেয়ে বেরিয়েছে, সে এখন ইকড়ায়। মুরলীর জ্বর হয়েছিল। প্রেমেনের অসমাপ্ত আমি পড়েছি, সম্ভবত পৌষ থেকে ছাপব। ভূপতি এখন পুরুলিয়ায়। পথিক ছাপা আরম্ভ হয়েছে, 1st formএর অর্ডার দিয়েছি। আমাদের চিঠি না পেলেও মাঝে মাঝে যেখানে হোক লিখো। শুভ ইচ্ছা জেনো। ইতি। গোকুলচন্দ্র নাগ।

নজরুলের বিষের বাঁশীর জন্যই পুলিশ হানা দিয়েছিল। মনে করেছিল সবাই এরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী। ভাবনৈতিক সন্ত্রাসবাদীদের দিকে তখনো চোখ পড়েনি। তখন আসেননি তারক সাধু।

কাগজে পড়েচো কলকাতায় ধরপাকড়ের ধুম লেগে গেছে। পবিত্র লিখল : কাজীর বিষের বাঁশী নিষিদ্ধ হয়েছে। কল্লোলের আপিস ও দোকান খানাতল্লাসী হয়েছে। সকলের মধ্যেই একটা প্রচণ্ড আশঙ্কাভীতি এসে গেছে। সি আই ডি-র উপদ্রবও সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কলকাতা শহরটাই তোলপাড় হয়ে গেছে। যেখানেই যাও চাপাগলায় এই আলোচনা। যারা ভুলেও কখনও রাজনীতির চিন্তা মনে আনে নাই তাদের মধ্যেও একটা সাড়া পড়ে গেছে–

সেই সাড়াটা কল্লোলের লেখকদের মধ্যেও এসে গেল। চিন্তায় ও প্রকাশে এল এক নতুন বিরুদ্ধবাদ। নতুন দ্রোহবাণী। সত্যভাষণের তীব্র প্রয়োজন ছিল যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে, তেমনি ছিল অচলপ্রতিষ্ঠ স্থবির সমাজের বিপক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *