২২. পর দিন কি ভাবিয়া ভোর বেলা

কিন্তু পর দিন কি ভাবিয়া ভোর বেলাতেই যে উমা একটা টিফিকেরিয়ার লইয়া ষ্টেশনে আসিয়া হাজির হইল তাহা সে-ই জানে। কাল সারা রাত ধরিয়া প্রতি মুহূর্তে মনে যাহা ডাক দিয়া ফিরিয়াছে তাহা কি পূর্ণ না হইয়া পারে? তাই দূরে প্ল্যাটফর্মে পাশাপাশি প্রদীপ ও নমিতাকে ট্রেনের দিকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া সে আর কোনো রোমাঞ্চকর বিস্ময়বোধ করিল না, আজিকার সূর্যোদয়ের মতই যেন তাহা অতি সাধারণ। দূর হইতেই প্রদীপ কহিয়া উঠিল : “তুমি আবার কোখেকে হাজির হ’লে, উমা? বাঃ।”

দুইজনে যতক্ষণ না একেবারে কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, উমা শব্দ করিল না। কাছে আসিতেই সে বুঝি প্রদীপের হাত ধরিতে গিয়া নমিতার হাত ধরিয়া ফেলিল। কহিল,—“তোমাকে আরেকবার ভারি দেখতে ইচ্ছা করছিলো, বৌদি। এই জন্যে কাল বারে বারে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। খালি মনে হচ্ছিল তোমার কাছ থেকে ভালো করে বিদায় নেওয়া হয় নি।”

নমিতা যেন উমার মনের বেদনা দেখিয়া ফেলিয়াছে। তাই তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া সস্নেহে কহিল,—“তুমিও আমাদের সঙ্গে চল, উমা।”

দুইটি আনন্দপুর্ণ চক্ষু তুলিয়া উমা কহিল,—“আমারো তাই ভারি সাধ হয়, বৌদি। কোথায় যেন চলে যেতে ইচ্ছা করে।”

প্রদীপ কথাটা শুনিয়া ফেলিয়াছিল। হাসিয়া কহিল,—“তুমি গেলে। এবার আমার জেল আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। শচীপ্রসাদ নিশ্চয়ই তা হ’লে দাঁত বত্রিশটা গুড়ো করে দেবে। কাজ নেই উমা, ফুলহাটিতে ফলস্ দাঁত কিনতে পাব না।”

দুইজনে ট্রেনের কামরায় গিয়া উঠিল। নমিতা কহিল,—“ভেতরে একটু বসবে, উমা?”

—“কাজ নেই বৌদি। গাড়ি এক্ষুনি ছেড়ে দেবে। শেষে যদি নামতে না পারি?”

একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া নমিতা কহিল,—“হাতে তোমার ওটা কী?”

সচেতন হইয়া উমা কহিল,-“তোমার জন্যে কিছু খাবার তৈরি করেছিলাম, বৌদি। নাও, ধর।”

—“খাবার? কী আছে ওতে?”

—“কিছু কাটলেট—”

হাসিয়া ফেলিয়া নমিতা কহিল,—“কাটলেট! আমি যে বিধবা সে-কথা তুমি রাতারাতি ভুলে গেলে নাকি উমা?”

তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলাইয়া উমা কহিল,—“না না কচুরি আছে, গজা আছে-লুচি, তরকারি, চাটনি-কাল সন্ধ্যাবেলা সব তৈরি করেছি। বসে বসে। মা জিগগেস করলে বল্লাম : এক বন্ধুর আজকে নেমন্তন্ন আছে, মা। তা, বন্ধু যদি সারা রাতে না আসে, তবে আমার আর কী দোষ বল? তুমি খেয়ো, বৌদি। খুব পরিষ্কার আছে সব—”

হাসিয়া প্রদীপ কহিল,—“বৌদির জন্যে তোমার এত মায়া, উমা! খাওয়াবার জন্যে মা’র কাছে পৰ্যন্ত মিথ্যা কথা বলে।”

—“মিথ্যা কথা বৈ কি।” নমিতা রুক্ষস্বরে কহিল,—“আত্মতৃপ্তির জন্যে কে কবে না মিথ্যা বলেছে? আমি বলিনি? কাল কোর্টে সমস্ত লোকের সামনে?”

বিমূঢ় হইয়া প্রদীপ কহিল,—“তুমি নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে এসেছ—এ তোমার মিথ্যা কথা?”

নমিতা উদাসীনের মত কহিল,—“কেন হ’তে যাবে। দাও তোমার খাবার উমা, কাটলেটগুলো প্রদীপবাবুকে খেতে বল।”

উৎফুল্ল হইবার ভাণ করিয়া প্রদীপ কহিল,—“তা আর বলতে হবে

। কিন্তু মা যখন জিগগেস করবেন খাবারগুলো কী হ’ল তখন কি বলবে, উমা?”

নমিতা উত্তর দিল : “বলবে রাত্রে বন্ধু না-আসাতে সকালবেলায় সেগুলো আঁস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি। দাও, উমা, গাড়ি এবার ছাড়বে।”

জালা দিয়া টিফিন্-কেরিয়ারটা তুলিয়া দিয়া উমা গাঢ়স্বরে প্রশ্ন করিল,—“আবার কবে দেখা হবে, বৌদি?”

—“দেখা বোধহয় আর হবে না, উমা। নিরুদ্দেশ যাত্রার কি আর কোথাও পার আছে?”

ফ্ল্যাগ নড়িল, বাঁশি বাজিল, আর একটিও কথা বলিবার আগে গাড়ি ছাড়িয়া দিল। উমা নড়িল না; চিত্রার্পিতের মত মূক নিষ্পন্দ হইয়া প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াইয়া রহিল। জালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া নমিতা দেখিল, উমার দৃষ্টি ধাবমান ট্রেন্টাকে অনুসরণ করিতেছে না, মাটির উপর নিবদ্ধ হইয়া আছে।

ক্রমে এই দৃশ্যটুকুও অপসৃত হইয়া গেল।

বেঞ্চির এক ধারে উঠিয়া আসিয়া প্রদীপ কহিল,—“কী আর মিথ্যা কথা বলে’ এসেছ, নমিতা?”

নমিতা কঠিন হইয়া কহিল,-“কোটা মিথ্যা কোটা সত্য তা আপনি আজো অনুভব করতে শেখেন নি?”

—“খুব শিখেছি। তাই তোমার আচরণের কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেলাম না। গলার মালার বদলে পায়ের শৃঙ্খল হয়ে যদি আমাকে আটকে রাখতে চাও, সে-বাধা আমি সইবো না, নমিতা।”

—“সইতে কে আপনাকে বলছে? আপনি যা না যেখানে খুসি,-কপালের নীচে আমারো দুটো চোখ আছে।”

—“তবে শুধু-শুধু কেন আমাকে জেল থেকে টেনে রাখলে? আমি না হয় অমনি করে’ই মতাম।”

হাসিয়া নমিতা কহিল,—“মরবার আরো অনেক পথ ছিলো, প্রদীপবাবু।”

কিন্তু সেই ফুলহাটিতেই ফিরিয়া আসিতে হইল। প্রদীপ কহিল, “আমারই সঙ্গে এলে যে বড়?”

নমিতার মুখে সেই হাসি : “আপনি ছাড়া কে আর আমার সঙ্গী আছে বলুন। আমার জীবনে আপনার মূল্য কি একটুখানি? আপনি আমাকে কলঙ্ক দিলেন, আপন অধিকারের গর্ব করতে শেখালেন আমি অত বড় অকৃতজ্ঞ নই যে এই বনে-জঙ্গলে আপনাকে একা ফেলে পালিয়ে যাবে।”

—“কিন্তু বনে-জঙ্গলে তুমি ত’ আর কোনোদিন ঘর বাঁধবে না।”

—“ঘর বাঁধবার জন্যেই ত’ আর পথ নিই নি।”

নমিতা ঘর বাঁধিবে না বটে, কিন্তু ফুলহাটির এই শ্রীহীন শূন্য পুরীতে পা দিতে না-দিতেই সে দুইটি কল্যাণময় ক্ষিপ্রহাতে তাহার সংস্কারসাধনে তৎপর হইয়া উঠিল। তাহার সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া সেন গৃহলক্ষ্মীর মঙ্গলমাধুৰ্য্য! এইবার আর মথুরকেও ডাকিতে হইল না। যে বিছানা দুইটা দুই কোণে ধূলিলিপ্ত অবস্থায় পড়িয়া ছিল তাহাদের ঝাড়িয়া-পুছিয়া রোদে দিয়া সে খটখটে করিয়া তুলিল, ঘর নিকাইল, কাপড় কাচিল এবং সন্ধ্যা হইতে না হইতেই রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। প্রদীপ যখন হাসিয়া কহিল : “আকাশে দিব্যি মেঘ করেছে, নমিতা, একবার নদীর ধারটায় বেড়াতে যাবে না?” নমিতা কথাটাকে উপেক্ষা করিয়া কহিল : “আমার এখনো কত কাজ বাকি।”

হঠাৎ একটা মেঘ ডাকিয়া উঠিতেই নমিতা সন্ত্রস্ত হইয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল ঘন নিবিড় মেঘে সমস্ত আকাশ বেদনার্ত মুখমণ্ডলের মত থমথম্ করিতেছে। জীবনে সে এত বড় আকাশ দেখে নাই, পুঞ্জিত নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া গৰ্জ্জমানা নদীর ডাক যেন তাহার বুকে আসিয়া আঘাত করিল। কিসের তাহার গৃহ, কিসের বা তাহার গৃহকৰ্ম্ম! নমিতা মাঠের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল—দিত্মণ্ডল ছাপাইয়া অন্ধকারের অজস্র বন্যা নামিয়া আসিয়াছে। আকাশে মুক্তবেণী ঝটিকা, নীচে নমিতা যেন শরীরিনী বিদ্রোহবহ্নি!

সঙ্গে সঙ্গেই জল আসিয়া গেল বলিয়া সে আর বেশিক্ষণ বাহিরে দাঁড়াইতে পারিল না। নিজের ঘরে আসিয়া বিছানার উপর চুপ করিয়া বৃসিয়া পড়িল। ঘরের সবগুলি দরজা-জানলা খোলা, জোরে জলের হাটু আসিতেছে, তবু তাহার খেয়াল নাই। চরাচরপ্লাবী অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া সে কাহার অনুসন্ধান করিতেছিল সেই জানে। কেন সে এইখানে আসিয়াছে, কোথায়ই বা আবার এমন মুক্তবন্ধ গগন-বিহঙ্গ মেঘের মত কোন্ অপরিচিত দেশের দিকে ভাসিয়া পড়িবে—আজিকার দিনে সে-সব সমস্যা তাহাকে একটুও আলোড়িত করিতেছে না। সে যেন জানিত আজ আকাশে ঝড় আসিবে। সে আরো অনেক কিছুই জানিত!

কতক্ষণ তন্ময় হইয়া বসিয়া ছিল খেয়াল নাই, হঠাৎ তাহার আচ্ছন্ন চোখের সামনে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ভাসিয়া উঠিল। নমিতা চঞ্চল হইল না, লোকচক্ষুর অগোচরে আত্মার দর্পণে সে বারে বারে যাহার ছায়া দেখিয়াছে, আজিকাব এই ছায়াচ্ছন্ন প্রদোষে এ বুঝি তাহারই প্রতিচ্ছবি! কিন্তু হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা টর্চ জ্বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিভিয়া গেল। এক ঝলক্ তীব্র আলোতে ঘরের রাশীকৃত অন্ধকার যেন বিকট হাস্য করিয়া মূচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছে। আশ্চৰ্য, নমিতা একটুও ভীত হইল না।

কাহার স্বর শোনা গেল : “ধন্যবাদ।”

আবার সেই পীভূত স্তব্ধতা। এইবার অজয় টর্চটা টিপিয়া তক্ষুনি আঙুলটা সরাইয়া নিল না। হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“তুমি একলা। বসে’? প্রদীপ কোথায়?”

ইহাতে অভিভূত হইবার কি আছে? উমা যদি কাল রাত্রে ভাবিয়া থাকে যে তোরবেলা ষ্টেশনে গেলেই প্রদীপের দেখা পাইবে, তবে নমিতার এত রাত্রের প্রতীক্ষা-স্বপ্ন কি জীবনের একটি দিনেও সফল হইতে পারিবে না? সে মাথার উপর ঘোম্‌টা তুলিয়া দিল না,

 

 

খোঁপাটা বাঁধিল না পর্যন্ত, সুতীব্র আলোর ঝাঁজে চক্ষু দুইটা আবিষ্ট হইতে না দিয়া অপলক চোখে অজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

কিন্তু অজয়ের এ কী শ্রী! কোথায় সেই দুর্লভ তেজ, সেই গৰ্বদৃপ্ত ঋজুতা? মুখমণ্ডলে গাঢ় রোগমালিন্য, কত স্বপ্নের ব্যর্থতা যেন মুদ্রিত হইয়া আছে। বেশবাস অপরিচ্ছন্ন, এক হাঁটু কাদা, জলে ভিজিয়া কিছু আর নাই। সেই মূর্তি দেখিয়া নমিতা আনন্দধ্বনি না হাহাকার করিয়া উঠিবে কিছুই বুঝিতে পারিল না।

অজয় হাসিয়া কহিল,—“খুব অবাক হয়ে গেছ দেখছি। আমি ভূত নই, নেহাৎই বর্তমান। জলে ভিজে বহু কষ্টে ষ্টেশন থেকে পথ চিনে এসেছি। প্রদীপ কৈ?”

নমিতা কহিল,—“বোস। পাশের ঘরে আছেন বোধহয়, ডেকে আছি।”

পাশের ঘরেও প্রদীপ তাহার নিঃসঙ্গ বিছানায় বসিয়া ঝড় দেখিতে ছিল। সে-ঝড়ে সে বিপুল সম্ভাবনার সঙ্কেত খুঁজিয়া পায় নাই, এঅন্ধকার যেন তাহার জীবনে রাশি রাশি বিষন্নতা নিয়া আসিয়াছে। অচরিতার্থতার এমন রূপ আর সে কবে দেখিয়াছে? এত বড় বিস্তৃতির মধ্যে তাহারই জন্য কোথাও এতটুকু মুক্তি রহিল না!

নমিতা তাড়াতাড়ি তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, প্রদীপ টের পায় নাই। কি বলিয়া তাহাকে সে এই সংবাদ দেয় কিছুই ভাবিয়া পাইল না। হঠাৎ তাহার মাথায় এক ঠেলা দিয়া কহিল,—“শিগগির দেখবেন আসুন—কে এসেছে।”

প্রদীপ ধড়মড় করিয়া উঠিল : “কে? আবার পুলিশ নাকি?”

—“না, না। শিগগির আসুন।”

ঘরের কোণ হইতে লণ্ঠনটা লইয়া নমিতার পিছু-পিছু প্রদীপ অগ্রসর হইল। ঘরের মধ্যে আসিয়া দেখিল ডান-হাতে একটা টর্চ জ্বালিয়া দাঁড়াইয়া আছে—আর কেহ নয়, অজয়। সহসা প্রদীপ যেন এতটুকু হইয়া গেল।

প্রদীপকে দেখিয়া বিদ্রুপাত্মক অভিবাদন করিয়া অজয় কহিল, “ধন্যবাদ।”

প্রদীপ আরো একটু আগাইয়া আসিল বটে, কিন্তু বন্ধুর হাত ধরিতে সাহস পাইল না। খালি কহিল,—“তুমি? হঠাৎ? কোথেকে?”

অজয় কহিল,—“আসৃচি অনেক দূর থেকে। হঠাৎই আমি এসে থাকি। খবরের কাগজে তোমাদের কীর্তির কথা আদ্যোপান্ত পড়লাম,

-বেশ, তোমাদের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করছি। তার পর?”

কাহারও মুখে কথা জুয়াইল না। খানিক বাদে স্নিগ্ধস্বরে নমিতা কহিল,—“একেবারে ভিজে গেছেন দেখছি”

—“ভিজতে আমাকে আরো অনেক হবে। রাত্রে আজ আর জল থামবে বলে মনে হয় না।”

প্রদীপ কহিল,—“এক্ষুনি আবার চলে যাবে নাকি?”

—“নিশ্চয়। এক জায়গায় বেশিক্ষণ জিরোবার আমার সময় নেই। কিন্তু ঘর-দোরের এ কী হাল-চাল করে রেখেছ? টাকা-পয়সার টানাটানি বুঝি? তা আমার কাছেও কিছু নেই।”

একটু থামিয়া পরে আবার কহিল,—“দেশে ফিরে ভারি মজা দেখলুম প্রদীপ; বাবার সেই বাৎসরিক পনেরো হাজার টাকা দিব্যি উড়ে গেছে গ্লাশে আর বিলাসে! আমি যেই একা, সেই একা। তার পর, পল্লী-সংস্কারের বকশিস্ বাবদ সেই যে ম্যালেরিয়া পেয়েছিলুম, তাতে হাড়-মাস আমার ঝরঝরে হয়ে গেল। তার পর একটি করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া : “তোমাদের সেই অজয় আর নেই। তোমাদের দেখতে নিদারুণ ইচ্ছা হ’ল বলেই জ্বর নিয়েও জলের মধ্যে চলে এসেছি। এখন ত দিব্যি একটি রাণী পেয়েছ, এবার স্বচ্ছন্দে নিরীহ একটি কেরানি বনে’ যাও, কিম্বা লাইফ, ইসিয়োরেন্সের এজেন্ট, কিম্বা ধরে পাটের বা মাছের দালাল—কি বল?”

প্রদীপ অভিমান করিয়া কহিল,—“একটা কিছু নিশ্চয়ই হ’তে হবে, সে-পরামর্শ তোমার কাছ থেকে না নিলে কিছু এসে যাবে না।”

স্বচ্ছ হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করিয়া অজয় কহিল,—“ভালো। একটা ইস্কুল-মাষ্টারিও মন্দ হবে না। তার পর নমিতা, ফোটো পূজো করতে করতে সুরাহা একটা কিছু হ’ল তা হ’লে? বেশ।”

নমিতা একটিও কথা কহিল না, গভীর দৃষ্টিতে অজয়ের মুখের দিকে চুলের দিকে কাপড়ের দিকে পায়ের দিকে চাহিতে লাগিল।

—“কি, কথা কইছ না কেন? আমি তোমাদের এমন সন্ধ্যাবেলাটা মাটি করে দিলাম নাকি?”

নমিতা কহিল,—“বসুন, জামা-কাপড়গুলো ছাড়ুন, আপনার প্রত্যেক কথার উত্তর দিচ্ছি।”

—“আমার সময় কৈ? প্রতি নিশ্বাসে আমার বৎসর চলে যাচ্ছে।” তার পর হাসিয়া কহিল,—“কী বা আমার কথা, তার আবার উত্তর! কোর্টে দাঁড়িয়ে যাত্রা দলের ঢঙে কী তোফা বক্তৃতাই যে তুমি দিয়েছ

—ক্যাপিট্যাল! কিন্তু, কিছু খেতে দিতে পারো, নমিতা? ভারি খিদে পেয়েছে।”

নমিতা ব্যস্ত হইয়া উঠিল : “নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু আপনার যে জ্বর!”

অজয় বাধা দিয়া কহিল,—“হোক জ্বর। তা এমন কিছু মারাত্মক নয় যে তোমার হাতের খাবার খেলে আমাকে চিতেয় উঠতে হবে। আজ আমি তোমার কাছে সেদিনের মত জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে আসিনি, নিতান্ত সাদা ভাষায় কিছু খাবার ভিক্ষা করছি মাত্র। আমাকে আজো তোমার সন্দেহ হয় নাকি? আজ আর তোমাকে বাইরে আহ্বান করবার ভাষা নেই, এই ঘরেই তুমি সমস্ত পৃথিবী লাভ করেছ। ও কি, তুমি রাঁধতে চললে নাকি? পাগল! আমার এত খিদে বা সময় নেই যে বাবু সেজে আসন-পি ড়ি হয়ে যোড়শোপচার সাবাড় করব। ঘরে তোমাদের গেলবার কি কিছুই নেই? কী ছাই তবে ঘর করেছ, নমিতা!”

পথে খাইতে উমার-দেওয়া খাবারগুলির কথা মনে করিয়া নমিতা। কহিল,—“আছে কিছু, তবে তা বাসি, কালুকের রাতের তৈরি।”

—“বাসি! নিয়ে এসো চট্ করে? বলে কি না বাসি! পেলে। বাঁশ চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারি—”

নমিতা টিফিন-কেরিয়ারের বাটিটা লইয়া আসিল।

অজয় একেবারে শিশুর মত হাত বাড়াইয়া বাটিটা গ্রহণ করিল। নমিতা কহিল,—“দাঁড়া একটা প্লেট নিয়ে আসছি।”

—“প্লেট-ফ্লেট লাগবে না। এই দাও।” বলিয়া অন্ধকারে খাবার গুলি ভাল করিয়া ঠাহর না করিয়াই অজয় গোগ্রাসে গিলিতে সুরু করিল। ভাল করিয়া চিবাইবারো সময় হইল না; একমুখ খাবার লইয়া কহিল,-“দু’ দিন পেটে কিছু যায় নি একদম্। নেহাৎ ভাগ্য প্রসন্ন বলেই প্রসাদ মিললো। জল? জল লাগবে না—এক্ষুনি যেতে হবে আমাকে। দাঁড়াবার আর এক ফোটাও সময় নেই। মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁ করে’ ছুটলেই জল পাওয়া যাবে। তার ওপর এখন যদি নদী সন্ত্রাতে হয়, তা হলে ত’ কথাই নেই—”

নমিতা বাধা দিয়া কহিল,—“এখুনি যাবেন কি? দাঁড়ান, জল আনতে কতক্ষণ? সব সময়েই দুরন্তপনা করতে নেই।”

কথার সুরটা অজয়ের কানে কেমন একটু অদ্ভুত ঠেকিল,—যাইতে সত্যই পারিল না। নমিতা জল নিয়া আসিল। এক টোকে সবটা নিঃশেষ করিয়া অজয় কহিল,—“পিপাসাও আমাদের পায়, স্নেহময়ী নারীর মুখ দেখতে পেলে আমাদেরো দুটি দণ্ড কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সময় নেই। কত কাজ বাকি, কত পথ এখনো উত্তীর্ণ হতে হবে—আমি চল্লাম। তোমাকে বিশেষ কিছু উপহার দিয়ে যেতে পারলুম না—যদি পারি কিছু টাকা পাঠাবো। তা দিয়ে যা তোমার খুসি কিনে নিয়ে। কিনে দিয়ো হে প্রদীপ। শাড়ি ব্লাউজ জুতো গয়না—যা ওর পছন্দ। এখনো যে ভোল ফেরায়নি দেখছি।” বলিয়া অজয় দরজার বাহিরে পা বাড়াইল।

পিছন হইতে নমিতা হঠাৎ তাহার বা হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া আকুলকণ্ঠে কহিল,-“আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে চল। তোমার অসুথ, কে তোমাকে দেখবে বল।”

প্রথমটা কথা শুনিয়া অজয়ের সমস্ত চেতনা যেন ঘুলাইয়া উঠিল। অন্ধকারে নমিতার মুখ স্পষ্ট চোখে পড়ল না; সে-মুখ দেখিতে পাইলে হয় ত’ সে একটু দ্বিধা করিত, হয় ত’ এমন কঠোর ঘুণায় সে-স্পর্শকে উপেক্ষা করিতে পারিত না।

অজয় তাহার হাতটা ঠেলিয়া দিয়া কহিল,-“আমার সঙ্গে যাবে মানে?”

—“হ্যাঁ, যাব; যেখানে তুমি নিয়ে যাবে। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে বলেই ত’ এত দিন প্রতীক্ষা করে বসে আছি।”

অজয় আকাশ হইতে পড়িল : “এ এ-সব কী বলছে হে প্রদীপ? তুমি কোনো কথা কইছ না কেন?”

প্ৰদীপ দূরে জানালার কাছে সরিয়া গেল। নমিতাই বলিয়া উঠিল : “কে কী বলবে–কার কী সাধ্য আছে শুনি? তুমি একদিন আসবে সেই আশায় আমি আজো বেঁচে আছি। কে আমাকে বাধা দেয়?” বলিয়া নমিতা অজয়কে একেবারে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

নিশ্বাস ফেলিবার সময়টুকু পৰ্য্যন্ত কাটিল না। নমিতাকে ডান হাতে ঠেলিয়া ফেলিয়া অজয় কহিল,—“সরে দাঁড়াও শিগগির। ছুঁয়ে

না আমাকে। তুমি এতদুর নির্লজ্জ হয়েছ জানলে এখানে মরতেও আসতাম না কোনোদিন। তোমার ছোঁয়া খাবার খেয়েছি ভেবে সারা শরীর আমার অশুচি হয়ে গেছে।”

নমিতা বাঁশের একটা খুটি ধরিয়া নিজেকে রক্ষা করিল।

কটু কদৰ্য্য কণ্ঠে অজয় কহিল,—“এক জনকে তার ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট করে’ পথে বসিয়েছ, তবুও তাতে তোমার তৃপ্তি হ’ল না? এত সহজেই তোমার অরুচি ধরে গেল? ভেবেছ আমার সঙ্গে চলতে গিয়ে এক সময় জিরোতে চাইবে, পথের থেকে কাঁধে উঠতে চাইবে—অজয় অমানুষ মেয়েমানুষকে অতটা প্রাধান্য দিতে শেখেনি। লজ্জা করে না?—কে তোমাকে বাধা দেবে! বাধা দেবে তোমার লজ্জা, তোমার চরিত্র।”

অজয় পা বাড়াইয়াছিল, নমিতা আবার কাছে ছুটিয়া আসিল। সে কঁদিতেছে। কহিল,—“চরিত্র আমি মানি না, মানি আমার মনকে। সেই আমার মণি, সেই আমার সব। তুমি যেয়ো, তোমার সঙ্গেও আমি যেতে চাই নে, কিন্তু আর খানিকক্ষণ তুমি থেকে যাও। আজকের রাতটা।”

—“তোমার ঘরে? ঐ বিছানায়? সরে দাঁড়াও, নমিতা।”

নমিতা প্রখরকণ্ঠে কহিল,—“কেন, একটা রাত্রি একাকিনী নারীর ঘরে আত্মদমন করে থাকতে পারো না?”

অজয় উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল : “তুমি আমাকে লোভ দেখাচ্ছ বুঝি? আত্মদমনের চেয়েও অজয়ের জীবনে মহত্তর আদর্শ আছে। তুমি তার মহিমা বুঝবে না—পথ ছাড়। যেতে দাও আমাকে। একাকিনী নও, ঐ প্রদীপ দাঁড়িয়ে। নিষ্ঠা বলে জিনিসটাকে একেবারে অমান্য করো না। সতী নাই বা হলে, কিন্তু তাই বলে অসৎ হতে হবে?”।

নমিতা সরিয়া দাঁড়াইল। মুখে একটিও কথা নাই।

—“পথে বেরুবো বললেই কি আর বেরুনো যায়? পথ তোমাকে গ্রহণ করবে কেন? তোমার ছাড়পত্র কোথায়? ঘরে যাও, দরজাজানালা বন্ধ করে বিছানাটা উত্তপ্ত করে রাখ গে—রাত্রে ত’ আবার ঘুমুতে হবে। চল্লাম হে প্রদীপ, সুইট ড্রিমস্!” বলিয়া সেই ঝড়-জলের। মধ্যেই অজয় অদৃশ্য হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *