১৬. পথ আগলাইয়া দাঁড়াইবে

একেবারে নীচেই যে কেহ পথ আগলাইয়া দাঁড়াইবে প্রদীপ তাহা ভাবে নাই। তাই বসিবার ঘরে অবনী বাবুকে খবরের কাগজে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হইয়া রহিল। পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা পাশেই একটা চেয়ারে বসিয়া শচীপ্রসাদ ধীরে-ধীরে টেবিল বাজাইতেছে।

নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনীটা চাপিয়া ধরিয়া সঙ্কেত করিলে শচীপ্রসাদ নিশ্চয়ই ক্ষান্ত হইবে না; বরং দুর্বিনীত ব্যবহার সন্দেহ করিয়া হয় ত’ এমন ভাবে সম্বর্ধনা করিবে যে অবনী বাবু তাহার তন্ময়তা ভুলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রদীপের জামার গলাটা চাপিয়া ধরিবেন। কিন্তু উপরে গিয়া নমিতার সঙ্গে তাহার দেখা না করিলেই নয়—দেখা তাহাকে করিতেই হইবে। চুরি করিয়া আসিতে তাহার লজ্জা ছিল না, কিন্তু গভীর রাত্রিতে আসিলে দরজা সে খোলা পাইত না নিশ্চয়ই–পাঁচিল ডিঙাইয়া সে তাহার সাহসকে দুর্ধর্ষ করিতে গিয়া হাস্যাস্পদ করিতে চায় না। বেশ ত, অবনী বাবু জানুন, ক্ষতি নাই! নমিতার মুখোমুখি দাঁড়াইয়া সে বোঝা-পড়া করিবেই। কোন বাধাই আজ আর যথেষ্ট নয়।

শচীপ্রসাদই আগে কথা কহিল,—“কি মনে করে?”

অবনী বাবু খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিলেন। সামনেই প্রদীপকে দেখিয়া এক নিমেষে তাঁহার মুখ গম্ভীর ও কুটিল হইয়া উঠিল। চোখ দুইটা বাকাইয়া তিনি তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া লইলেন—সমস্ত অবয়বে স্বাভাবিক ভদ্রতার লেশমাত্র লালিত্যও তাহার চোখে পড়িল। শীর্ণ কঠোর দেহটায় যেন একটা নিষ্ঠুর রুক্ষতা গাঢ় হইয়া আছে—কোথাও এতটুকু বিনয়নম্র কোমলতা নাই। চোখ দুইটা রাঙা, কপালের রেখায় কুটিল একটা ষড়যন্ত্র, সমস্ত মুখের ভাবে গূঢ় একটা ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা! চেহারাটা অবনী বাবুর একটুও ভাল লাগিল না। অমন একটা দৃঢ় স্থিরসঙ্কল্প মূর্তি দেখিয়া তিনি প্রথমে একটু ঘাবড়াইয়া গেলেন। কহিলেন,—“অনেক দিন পরে যে! এখানে?”

শেষের প্রশ্নটার হয় ত’ এই-ই অর্থ ছিল যে, সেদিন অমন অপমানিত হইবার পর আবার কোন প্রয়োজনে মুখ দেখাইতেছে? প্রদীপ ঠোঁট দুইটা চাপিয়া ধরিয়া একটু হাসিল, সে-হাসি তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। সে-সঙ্কেতকে স্পষ্ট করিবার জন্য কথা বলিতে হয় না।

প্রদীপ একটিও কথা না বলিয়া বাড়ির ভিতরের দরজার দিকে অগ্রসর হইল। অবনী বাবু বিরক্ত হইয়া কহিলেন,—“ও-দিকে কোথায় যাচ্ছ?”

প্রদীপ স্পষ্ট সংযত স্বরে কহিল,—“নমিতার সঙ্গে আমার দরকার আছে।”

ইলেকট্রিক শক পাইয়া অবনী বাবু চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিলেন: “নমিতার সঙ্গে দরকার? তার মানে?”

প্রদীপ কহিল,—“মানে বলতে গিয়ে আমি অকারণে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার কাজ আছে। ভীষণ দরকার! আমাকে যেতেই হবে ওপরে।”

অবনী বাবু তাড়াতাড়ি আগাইয়া প্রদীপের পথরোধ করিলেন; শচীপ্রসাদও তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। অবনী বাবু তাঁহার দুই বলিষ্ঠ হাতে প্রদীপের কাঁধ দুইটায় ঝাকানি দিয়া বলিলেন,—“জান, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি? তোমার এ-বেয়াদবিকে আমরা সহ্য করবো না, জান?”

এই সামান্য দৈহিক অত্যাচারে প্রদীপ ধৈৰ্য্য হারাইল না। এত অনায়াসে তাহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিতে দিতে নাই। সে বিদ্রোহী বটে, কিন্তু কৌশলীও। তাই সে স্বচ্ছ অথচ উজ্জ্বল হাসিতে মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া কহিল,—“সব জানি। কিন্তু তবু আমার দেখা না করলেই নয়।”

শচীপ্রসাদ বৰ্বরের মত খেকাইয়া উঠিল : “এ তোমার কোন্ দেশী ভদ্রতা?”

প্রদীপের মুখে সেই হাসি : “আমরা যে-দেশ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি, সেই দেশের। আপনি তা বুঝবেন না।”

পরে কাঁধের উপর অবনী বাবুর আঙুলগুলিতে একটু চাপ দিয়া সে কহিল,—“ছাড়ুন, আমার সত্যিই দেরি করবার সময় নেই।”

অবনী বাবু বজ্রের মত হাঁকিয়া উঠিলেন : “না।”

বলিয়া বাঘের থাবার মত দুই হাতে জোর করিয়া তাহাকে সামনের সোফাটার উপর বসাইয়া দিলেন। প্রদীপ নেহাৎই মাধ্যাকর্ষণের শক্তিতে বিনা প্রতিরোধে সোফার উপরে ধুপ করিয়া বসিয়া পড়িল।

অবনী বাবু তীক্ষ্ণস্বরে কহিলেন,—“নমিতার সঙ্গে তোমার কী দরকার?”

প্রদীপ কহিল,-“সে-কথা আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে আসিনি। সেটা গোপনীয়।”

—“গোপনীয়! তোমার এতদূর আস্পর্ধা? একজন অন্তঃপুরিকা হিন্দু-কুল-বধূর সঙ্গে তোমার কী দরকার হতে পারে?”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“অন্তঃপুরিকা হিন্দু-কুল-বধূ বলেই বেশি দরকার। সে ত’ আর বাইরে বেরয় না যে, তাকে গড়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে পরামর্শ করুব। সে নেহাৎই বন্দিনী, তাই দরকারী কথা সেরে নেবার জন্যে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। এখানে ছাড়া আর ত’ তার দেখা পাওয়া যাবে না।”

অবনী বাবু বাহিবের দরজার দিকে আঙুল দেখাইয়া কহিলেন, “তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে কি না বল।”

মাথার চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পরম উদাসীনের মত প্রদীপ বলিল,-“যেতে বলেই সহজে চলে যাওয়া যায় না। ওপরে যাবার যেমন বাধা আছে, তেমনি বাইরেও।”

অবনী বাবু আরো রুখিয়া উঠিলেন : “না। তুমি যাও বেরিয়ে। এক্ষুনি।”

তেমনি নির্বিকার শান্তস্বরে প্রদীপ বলিল,-“এক কথা কত বার করে’ বলব! আরো স্পষ্ট উত্তর চা নাকি? আমি যাব না, অর্থাৎ নমিতার সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে। যদি বাধা পাই, সে-বাধা স্বীকার করে’ পরাস্ত হয়ে ফিরে গেলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না। বেশ ত’, তাকেই এখানে ডাকুন। কিম্বা যদি চান, তাকেও রাস্তায় বার করে দিতে পারেন। আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই।”

অবনী বাবু গর্জিয়া উঠিলেন : “জান, তোমাকে এক্ষুনি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি?”

—“জানি বৈকি। কিন্তু দয়া করে’ ওটি কবেন না। সামান্য নারী-হরণের অভিযোগে পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণের ইচ্ছে নেই। কিন্তু বৃথা বাকবিতণ্ডা করে লাভ কি? যদি বলেন, আমি-ই না-হয় এখানে নমিতাকে ডাকি।” বলিয়া প্রদীপ তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়া গলা চড়াইল : “নমিতা! নমিতা!”

অবনী বাবু কহিলেন,—“তুমি যাও ত’, শচীপ্রসাদ। শিগগির। মোড়ের থেকে একটা পাহারাওয়ালা ডেকে নিয়ে এস ত’।”

শচীপ্রসাদ বুক ফুলাইয়া সেনাপতির ভঙ্গীতে তর্জনী হেলাইয়া কহিল,—“যা শিগগির এখান থেকে। নইলে আপনার মত দু’-দশটাকে আমি ঘুষি মেরে সমান করে দিতে পারি।”

একটা হাই তুলিয়া প্রদীপ কহিল,—“আর সমান করে কাজ নেই, ভাই। মোড়ের থেকে পাহারওয়ালা ধরে নিয়ে এস গে। ( অবনী বাবুর প্রতি) আপনাদের বাড়িতে ত’ ফোন আছে। থানায় একটা খবর পাঠিয়ে দিন্ না। লরি-বোঝাই সেপাই এসে যাবে’খন। আমার পালাবার আর পথ থাকবে না। ততক্ষণে নমিতার সঙ্গে দরকারী কথাটা ধীরে-সুস্থে সেরে নেওয়া যাবে।” আড়মোড়া ভাঙিয়া জড়াইয়া জড়াইয়া কহিল, “কাল সারা রাত্রি আর ঘুম হয় নি। নমিতার অধঃপতনে সমস্ত আকাশ মাটিতে মূর্মিত হয়ে পড়েছে।”

অবনী বাবু ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন : “কি, কি? নমিতার কি হয়েছে বল্লে?”

—“পাহারওয়ালা আগে ডাকুন। বলছি।”

শচীপ্রসাদ দিব্যি একটি ঘুসি পাকাইয়া প্রদীপের মুখের কাছে আগাইয়া আসিল। কহিল,—“আবার কথা কইবে ত’ বত্রিশটা দাঁত। গুঁড়ো করে ফেলব।”

প্রদীপ ইচ্ছা করিলে অনেক কিছুই করিতে পারিত হয় ত’। কিন্তু শচীপ্রসাদের উদ্ধত ঘুসিকে স্বচ্ছন্দে এড়াইয়া আবার সোফাটায় আসিয়া নিলিপ্তের মত বসিয়া পড়িল। বলিল,-“বেশ, আপনাদের সঙ্গে কথা আমি না-ই বা কইলাম। অধিক বীরত্ব প্রকাশ করূলে আমি যে গান্ধি হয়ে বসে থাকূব এটা আশা করবেন না। তার চেয়ে থানায় একটা খবর দি। দাঁত গুড়ো করে লাভ নেই, বাজারে কিনতে পাব, বুঝলেন?”

অবনী বাবু সেই হইতে দরজা আগলাইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি কহিলেন,—“তুমি ত’ ভদ্রলোক, কিন্তু অপমানববধ বলে কিছুই তোমার নেই নাকি?”

—“আমরা আজো ততটা মহৎ হ’তে শিখিনি। অপমানিত হয়ে পিঠ দেখানোটাই অপমান, অপমানকে শাসন করাটাই আমাদের ধর্ম।”

অবনী বাবু কহিলেন,—“আচ্ছা, দাঁড়াও। তা হলে শচীপ্রসাদ, ডাক ত’ চাকর দু’টোকে।”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“কেন, পাহারওয়ালা কি হ’ল? দেরি হয়ে যাবে বুঝি? বাঃ, আমি ত’ আর পালাচ্ছিলাম না। আচ্ছা, ডাকুন। ক’টা চাকর? দুটো? এই ছোট সংসারে দু’টো চাকর লাগে?”

—“কিসের চাকর?” বলিয়া শচীপ্রসাদ বাঁ-হাতের মুঠিতে প্রদীপের চুলগুলি চাপিয়া ধরিয়া কহিল,—“তুমি উঠবে কি না বল; নইলে–”

আবার সে ঘুসি তুলিল।

এমন সময় ভেতরের দরজা দিয়া দ্রুতপদে উমা আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। প্রদীপের কণ্ঠে নমিতার ডাক তাহার কানে গিয়াছিল বুঝি। কিন্তু ঘরে আসিয়া এমন একটা অভাবনীয় দৃশ্য দেখিয়া সে নিমেষে কাঠ হইয়া গেল। শচীপ্রসাদ প্রদীপের চুলের ঝুটি ধরিয়া ঘুসি মারিতে উদ্যত, বাবা রাগে গম্ভীর, স্তম্ভিত হইয়া রহিয়াছেন—আর সোফায় বসিয়া উদাসীন প্রদীপ অলস-স্বরে বলিতেছে : “দাঁত ভাঙলে আবার দাঁত পাব, কিন্তু আপনার চশমার ওপর যদি একটা ঘুসি মারি, তবে সমস্ত পৃথিবীর বিনিময়েও চোখ আর ফিরে পাবেন না। হ্যাঁ, দাঁতের চেয়ে চোখটাই বেশি প্রয়োজনীয়। বেশ, ভালো হয়ে বসছি। মারুন্।” বলিয়া সে দুই পাটি শক্ত পরিষ্কার দাঁত বাহির করিয়া ধরিল।

ব্যাপারটা উমা কিছুই বুঝিতে পারিল না। কি এমন হইতে পারে যে শচীপ্রসাদ পৰ্যন্ত প্রদীপের মুখের উপর ঘুসি বাগাইয়াছে, আর অবনী বাবু তাহারই প্রয়োগনৈপুণ্য নিরীক্ষণ করিবার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছেন। একটি দোদুল্যমান মুহুৰ্ত্তমাত্র। উমা তাড়াতাড়ি প্রদীপের সামনে আসিয়া পড়িল। বলিল,-“এ কী!”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“শচীপ্রসাদকে বিয়ে করো না, উমা। দেখেছ, চুলের ঝুটি কেমন শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে! শিগগির ওর পেটে সুড়সুড়ি দাও। নইলে চুল ও কিছুতেই ছাড়বে না।”

উমা শচীপ্রসাদের হাত ছাড়াইয়া নিয়া কহিল,—“আপনার এ কী দুঃসাহস! দীপ-দা’র গায়ে হাত তোলেন।”

অবনীবাবু স্থান পরিবর্তন করিয়া কহিলেন,—“তুই সব তাতে সর্দারি করতে আসিস কেন? যা তেতরে। ঐ গোয়ার ইতরটাকে সায়েস্তা আমরা করবই।

বার-কতক ইতস্তত চাহিয়া উমা কহিল,—“কেন, কি হয়েছে?”

-“সে অনেক কথা।” প্রদীপ সোফাটার উপর একটু সরিয়া বসিয়া কহিল : “বোস আমার পাশে। এবার শচীপ্রসাদ পাহারওয়ালা ডাকৃতে যাবেন। পাহারওয়ালা আসুক। সব শুনতে পাবে।”

সত্য-সত্যই উমা প্রদীপের পাশে সোফায় বসিল। যেন ইহার মধ্যে এতটুকু দ্বিধা করিবার ছিল না। এই সান্নিধ্যের মধ্যে কোথাও জড়তা নাই, না বা স্লানিমা—যেন পরিচয়-প্রকাশের সামান্য একটি প্রচলিত রীতি মাত্র। কিন্তু অবনীবাবু অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এইবার শাসনের অত্যাচারে উমাকেই নিজ্জিত হইতে হইল। প্রদীপ কয়েক মিনিটের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলুক।

অবনীবাবু কহিলেন,—“ওঠ এখান থেকে। এই বেহায়াটার পাশে বলি যে!”

শচীপ্রসাদ বলিল,-“ওর ছায়া মাড়ালেও অশুচি হতে হয়। ওঠ।”

উমা বিস্ময়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। বলিল,-“কেন, কি হয়েছে? সেদিনো ত’ বাস্-এ পাশাপাশি বসে এলাম। অশুচি হ’ব? পরে গঙ্গাস্নান কব ‘খন, শচীপ্রসাদবাবু।”

—“ফের মুখে-মুখে তর্ক? ওঠ বলছি। অবাধ্য কোথাকার!” বলিয়া অবনীবাবু আগাইয়া আসিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিলেন।

মুহূর্তের মধ্যে কী যে হইয়া গেল কেহই স্পষ্ট অনুধাবন করিতে পারিল না।

—“আপনারা খানিকক্ষণ তর্ক করুন, আমি এই ফাঁকে নমিতার সঙ্গে কথাটা সেরে আসি।” বলিয়া পলক ফেলিতে না ফেলিতেই প্রদীপ ভিতরের খোলা অরক্ষিত দরজা দিয়া ছুটিয়া বাহির হইল। সামনেই সিড়ি। সিড়িগুলি লাফাইয়া লাফাইয়া পার হইতে হইতে সে কহিল, —“তাড়াতাড়ি পাহারওয়ালা ডেকে নিয়ে আসুন, শচীপ্রসাদবাবু। আমি নমিতাকে লুট করে নিয়ে যেতে এসেছি।”—কথাটা এইবারে একেবারে উপর হইতে আসিল : “লুণ্ঠনের সময়ে একটা সম্বৰ্ষ না বাধলে কোনোই মাধুৰ্য থাকে না।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য সকলেই একেবারে হিম, নিস্পন্দ হইয়া রহিল। সচেতন হইয়া শচীপ্রসাদ পশ্চাদ্ধাবন করিতে যাইতেছিল, অবনী বাবু বাধা দিলেন : “ঐ গুণ্ডাটার সঙ্গে তুমি একা পারবে না। তা ছাড়া বাড়ির মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি হওয়াটা ঠিক নয়।”

শচীপ্রসাদ কহিল,—“কিন্তু ঐ স্কাউঙুেলটাকে unseathed ছেড়ে দেবেন নাকি?”

অবনীবাবু একটু পাইচারি করিয়া কহিলেন,—“দেখি। ও ভীষণ বোম্বেটে, শচী। নিজের প্রাণের ‘পরেও ওর একবিন্দু মমতা নেই। ওর সঙ্গে পেরে উঠবে না। তুমি যখন ওর চুল টেনে ধরেছিলে তখন ভয়ে জিভ আমার পেটের মধ্যে সেধিয়ে গেছল।”

উমা কহিল,—“আপনার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে দীপদা-র চুলের বিনিময়ে মুণ্ডুটা আপনাকে দিতে হয় নি।”

শচীপ্রসাদ বিরক্ত হইয়া কহিল,—“তবে ঘরে-বাইরে আপনি মুখ বুজে এ-সব ডাকাত বোম্বেটের অত্যাচার সইবেন নাকি? কিছুই এর বিহিত করবেন না? আইন-আদালত নেই?”

——“আছে। তবে যে লোক সব অত্যাচার হাসিমুখে সইতে প্রস্তুত, তার সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ নয়। যত নষ্টের গোড়া ঐ বে-টা। তুই যা ত’ উমা, বৌমার সঙ্গে ঐ হতচ্ছাড়াটার কি-না-কি দরকারী কথা আছে। ওকে পাশের বাড়ি নিয়ে যা ত’, লক্ষ্মী। বুঝলি, আবার যেন কিছু মনে না করে। পরে আমি থানায় গিয়ে একটা ট্রেসপাসের রিপোর্ট লিখিয়ে আসব।”

উমা এইবার কিছু বুঝিতে পারিয়াছে। তাড়াতাড়ি উপরে আসিয়া দেখিল, প্রদীপ বারান্দায় দাঁড়াইয়া একটা ঘরের বন্ধ দরজার ফাঁকে উঁকি দিতেছে। উমা হাসিয়া কহিল,—“এটা নিরিমিষ্যি রান্নার ঘর। দুপুর বারোটার আগে এর উনুনে আগুন দেওয়া হয় না। দেখছেন না বাইরে থেকে তালা-বন্ধ আছে?”

প্রদীপ দেখিল। কহিল,—“নমিতা তা হলে কোন্ ঘরে?” * দক্ষিণের দিকে আঙুল দেখাইয়া উমা বলিল,-“ঐ যে। আসুন আমার সঙ্গে। বৌদি এখন পূজোয় বসেছেন। পূজোয় বসলে কারু সঙ্গে আবার কথা কন না। টু-টি পর্যন্ত না। প্রায় দু’ ঘণ্টা।”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“দু’ ঘণ্টা! বল কি? আমি কি দু ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তার এই নির্লজ্জ মৌনব্রতের তারিফ করব নাকি? আমার দু’ সেকেণ্ডও সইবে না। চল।”

উমা অবাক হইয়া প্রদীপের মুখের দিকে চাহিল। তাহার মুখের সেই সৌম্য উদারসিগ্ধতা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে, চক্ষু দুইটা অনিদ্রায় তপ্ত, শাণিত—সমস্ত দেহ ঘিরিয়া এমন একটা রুদ্র রুক্ষতা যে, উমার মনটা দুরুদুরু করিয়া উঠিল। প্রদীপ কহিল,—“নীচে একবার যাবে, উমা? দেখ ত’, ওরা সত্যি সত্যিই পাহারওয়ালা ডেকে আল কিনা।”

উমা বোধ হয় এই ইঙ্গিতটুকু বুঝিল। তাহার কথার সুরে সুগোপন একটি অভিমান : “যাচ্ছি। কিন্তু বৌদি যে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছেন। তার ধ্যান ভাঙানো চলবে না, দীপ-দা। একদিন সামান্য একখানা চিঠি দরজার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম বলে আমার অপ্রস্তুতের আর শেষ রইলো না। বেদি সারাদিন খেলেন না, চান করলেন না—সমস্তক্ষণ কেঁদে-কেঁদে ঘর-দোর ভাসিয়ে দিতে লাগলেন। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। তার ওপর এখন আর উপদ্রব না-ই করলাম আমরা। চলুন আমার ঘরে, আমাকে রাসে পড়াবেন। খানিক বাদে আমি এসে খোঁজ নিয়ে যাব।”

নমিতার ঘরের সম্মুখে তখন তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে। দরজাটা ভেতর থেকে তেজানো—নিঃশব্দ, নিশ্বাসহীন। প্রদীপ কহিল, “উপদ্ৰবই চাই, উমা। ভালবেসে নয়, উপদ্রব করেই জড় অচল প্রস্তরকে দ্রব করা চাই। তোমার সেদিনকার উপদ্রবে সে উপোস করেছে, আজকে না-হয় আত্মহত্যা করবে। তবু সে কিছু একটা করুক।”

বলিয়া উমার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই প্রদীপ হাত দিয়া ঠেলা মারিয়া দরজা খুলিয়া দিল। ধ্যানাসীনা তন্ময়ী নমিতা একবার চমকিয়া উঠিল, কিন্তু চোখ মেলিল না—সুকুমার মুখের উপর কোথা হইতে একটা অসহিষ্ণু অথচ অটল দৃঢ়তার তেজ ফুটিয়া উঠিল! দরজা খুলিয়া ফেলিয়া প্রদীপ এ কী দেখিতেছে! কয়েক মুহূর্তের জন্য সে পাথর হইয়া রহিল। নমিতা সদ্য-স্নান করিয়া পূজায় বসিয়াছে, সামনের দেয়ালে তাহার স্বামীর ফোটোটা হেলানো—চন্দনলিপ্ত, মাল্যবিভূষিত। বাঁ-পাশে পিতলের পিলসুজে একটা প্রদীপ, ধূপতিতে ধূনা জ্বলিতেছে—সমস্ত ঘরটি আচ্ছন্ন করিয়া একটি সুগভীর বৈরাগ্যের শীতল পবিত্রতা। নমিতার মাথায় ঘোমটা নাই, ভিজা চুলগুলি পিঠের উপর দিয়া নামিয়া আসিয়া মেঝেটা স্পর্শ করিয়াছে—গায়ে বাহুল্যবস্ত্র নাই, একখানি নরম গরদের থান্ শাড়ি অযত্নে ন্যস্ত হইয়াছে। সর্বাঙ্গে পদ্মাভা, অমৃতগন্ধ! বসিবার সহিষ্ণু ভঙ্গিটিতে কি কঠোর সুষমা, অগ্নিশিখার মত শীর্ণ ও ঋজু শরীরে ব্রাহ্মমুহূর্তের আকাশ-শ্রী! প্রদীপ যেন তাহার চর্মচক্ষুতে পুৰাণবর্ণিতা তপস্বিনী শকুন্তলাকে দেখিতেছে—আদিম কবিতায় যে বিরহিণীর মুর্তিকল্পনা হইয়াছিল, সেই শরীরী কল্পনা! তপস্যা-পরীক্ষিত প্রেম! এই মূর্তিকে সে স্পর্শ করিবে।

প্রদীপ কি করিয়া বসে তাহারই প্রতীক্ষায় উমা ঘামিয়া উঠিল। কানে-কানে বৌদিকে সংবাদটা দিবে কি না তাহাই সে বিবেচনা করিতেছিল। ভাবিয়াছিল এমন একটা সমাহিত ধ্যানলীন আননাভাসের প্রভাবে সে তাহার সমস্ত বিদ্রোহভাব দমন করিয়া তাহারই ঘরে আসিয়া উত্তীর্ণ হইবে। কিন্তু, বৃথা। প্রদীপ নমিতার মাথায় একটা ঠেলা মারিয়া দীপ্তকণ্ঠে কহিল,—“এসব কী করছ, নমিতা?”

নমিতা জ্বালাময় চক্ষু মেলিয়া যাহা দেখিল তাহাতে ভয়ে তাহার আকণ্ঠ শুকাইয়া গেল। কিন্তু আজ আর সে এই অনধিকার অত্যাচারের প্রশ্রয় দিতে পারিবে না। উদ্যত শাসনের ফণা তুলিয়া সে কহিল, “আমার পূজোর ঘরে না বলে কয়ে’ জুতে-পায়ে হঠাৎ ঢুকে পড়লেন যে। কে কী বলে তুমি এখানে নিয়ে এলে, ঠাকুর ঝি! জান না, এটা আমার পূজোর সময়?”

ফোটোটার সামনে নমিতা আবার একটা ঘট রাখিয়াছে, তাহার উপর আম্রপল্লবটি পৰ্য্যন্ত অম্লান। কোনো আয়োজনেরই ক্রটি ঘটে নাই। প্রদীপ জুতা দিয়া সেই ঘটকে লাথি মারিয়া উলটাইয়া ফেলিল : “কিসের তোমার পূজো? এই ভণ্ডামি তোমাকে শেখালে কে?”

উমা ভয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করিয়া উঠিল-জলে সমস্ত মেঝে ভাসিয়া গিয়াছে। নমিতা খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে প্রদীপের এই হিংস্র বীভৎস মুখের দিকে নির্বাক হইয়া চাহিয়া রহিল। সে-চোখে সৌজন্যের স্বাভাবিক সঙ্কোচ নাই, উগ্রতেজ তাপসীর নির্দয় নির্লজ্জতা। সহসা সে সমস্ত শূন্য বিদীর্ণ করিয়া চেচাইয়া উঠিল : “কেন আপনি আমার ঘট ভাঙলেন? আপনার কী আস্পর্ধা যে ভদ্রমহিলার অন্তঃপুরে ঢুকে এই দস্যুতা করবেন? যাও ত’ ঠাকুর ঝি, বাবাকে শিগগির ডেকে নিয়ে এস।”

প্রদীপ হাসিয়া কহিল,—“সে-পার্টের মহল। নীচে একবার দিয়ে এসেছি। পুনরভিনয় হবে, হোক। যাও উমা, ডেকে আন। কিন্তু তোমার এই জঘন্য অধঃপতনের কারণ কি?”

উমা নিশ্বাস বন্ধ করিয়া এক পাশে ম্লান হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। না পারিল বাহির হইয়া যাইতে, না বা আসিল একটি অস্পষ্ট প্রতিবাদ।

—“অধঃপতন?” নমিতা আসন ফেলিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। সুদূর তিমিরাকাশে নীহারিকার দিগবর্তিকার মত; “সেকৈফিয়ৎ আমি আপনাকে দিতে যাব কেন? কে আপনি?”

—“আমি? অশুদ্ধ ভাষায় তোমারই কথার পুনরুক্তি করি—আমি ছাকাত।”

—“কিন্তু আমার উপর এই উৎপাত করবার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

—“অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, নমিতা। তাও অধিকার করতে হয়।”

—“সে-অধিকার কেড়ে নেবার ক্ষমতা আপনার আজো হয় নি।” কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ করিয়া সে কহিল,—“আমি আমি-ই। তার থেকে একচুল আমি ভ্রষ্ট হ’ব না।”

প্রদীপ বিহ্বল হইয়া কহিল,—“তোমাকে ধন্যবাদ, নমিতা’। কিন্তু তুমি সত্যিই তুমি নও। তুমি সংস্কারশাসিতা, অন্ধ-প্রথার একটা প্রাণহীন স্তুপমাত্র। নইলে এই সব অপদার্থ উপচার নিয়ে দেবতার পূজো করতে বসেছ?” বলিয়া উল্টানো ঘটটাকে আবার একটা লাথি মারিয়া সে দূরে দেয়ালের গায়ে ছিটুকাইয়া মারিল।

নমিতা কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। অনুপায় মিনতিতে সে প্রার্থনা করিল,—“দয়া করে আপনি এ-ঘর থেকে চলে গেলে বাধিত হব। আমাকে অযথা পীড়ন করে লাভ নেই।”

—“আমি এ-ঘর থেকে চলে যাবার জন্যেই আসিনি পীড়ন করে’ লাভ নেই বটে, কিন্তু পীড়িত হওয়াতে লাভ আছে।”

নমিতা আবার চেঁচাইয়া উঠিল : “তুমি বাবাকে ডেকে নিয়ে এলে না, ঠাকুর-ঝি? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অপমান সইবো নাকি?”

উমা তবু নড়িল না। নমিতা সাময়িক বিমূঢ়তা বিসর্জন দিয়া বলিয়া উঠিল : “তবে আমিই যাচ্ছি নীচে।”

নমিতা যখন দুয়ারের কাছে আসিয়া পড়িয়াছে, প্রদীপ তৎক্ষণাৎ তাহার দুই বাহু বিস্তার করিয়া গাঢ়স্বরে কহিল,—“তুমি এই ব্যুহে প্রবেশ করবারই পথ জানতে, বেরবার কৌশল এখনো শেখনি। দাঁড়াও।”

বিদ্যুৎবিকাশের মত একটি ক্ষীণ মুহূর্তে দুইজনের স্পর্শ ঘটিয়াছিল। নমিতা আহত হইয়া সরিয়া গেল। প্রদীপের মনে হইল সে যেন হাতের মুঠোয় ক্ষণকালের জন্য মৃত্যুকে ছুঁইতে পাইয়াছে। তাহার অমৃতস্বাদে সে স্নান করিয়া উঠিল।

নমিতা একেবারে ছেলেমানুষের মত আর্তনাদ করিয়া উঠিল।

অবনীবাবুকে আর ডাকিয়া আনিতে হইল না। পেছনে শচীপ্রসাদও হাজির। দুয়ারের কাছে তাহাদের দেখা পাইতেই নমিতা কাঁদিয়া ফেলিল: “দেখুন এসে, ইনি আমার পূজার ঘরে ঢুকে কীসব উৎপাত শুরু করেছেন। আমার ঘট উলটে দিয়েছেন, আর মুখে যা আসে তাই বলে আমাকে অপমান করছেন। আমি যত না। বলছি।

-“নিশ্চয়, নমিতা। এ তোমার অপমান নয়, আশীৰ্বাণী! কিসের জন্য তোমার এই তুচ্ছ পূজা? এই মালা কার গলায় দিচ্ছ?” বলিয়া সুধী-র ফোটোর গলায় ঝুলানো মালাটা টানিয়া সে টুকরাটুকরা করিয়া দিল : “কিসের এই ধূপধূনো? দিনের বেলায় কেন আবার আলো জ্বেলেছ? আকাশে চেয়ে সূর্য দেখতে পাচ্ছ না?” বলিয়া প্রদীপ লাথি মারিয়া-মারিয়া পিসুজ ধূপতি সব উলটাইয়া দিতে লাগিল।

নমিতা রাগে অপমানে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। তাহার আর সহিল না; তাহার মুখ রক্তপ্রাচুর্যে একেবারে আগুন হইয়া উঠিয়াছে। সে তাড়াতাড়ি মেঝে হইতে ঘটটা কুড়াইয়া আনিয়া প্রদীপের মাথা লক্ষ্য করিয়া সজোরে ছুড়িয়া মারিল। হয় ত’ সতী বলিয়াই তাহার সে-লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইল না। প্রদীপের ডান ভুরুর উপরে কপাল ফাটিয়া আনন্দাশ্রুর মত রক্ত ঝরিতে লাগিল।

প্রদীপ যেন এতক্ষণ ধরিয়া এই আঘাতটিকেই কামনা করিতেছিল। নমিতার পরিপূর্ণ পাণ্ডুর ওষ্ঠাধরেও এমন মাদকতা নাই। সে অন্তরের গভীর সুরে কহিল,—“তোমাকে নমস্কার, নমিতা। কিন্তু তোমার এই তেজ এই বিদ্রোহ সমস্ত পুরুষজাতির অত্যাচারের বিরুদ্ধে, আত্মঘাতী প্রথার বিরুদ্ধে, অভিমানী সমাজের বিরুদ্ধে। তোমার তেজের এই বলিষ্ঠ উলঙ্গ উজ্জ্বলতা সমস্ত পৃথিবীকে দগ্ধ করুক। আর পাহারাওয়ালা ডেকে কাজ নেই, শচীপ্রসাদবাবু।”

অবনীবাবু কহিলেন, “তোমার শাসন এখনো যথেষ্ট হয় নি! ভাল চাও ত’ এখনো বিদায় হও বলছি।”

—“যাচ্ছি, কিন্তু অভিনয়ের শেষ অঙ্ক এখনো বাকি আছে।”

—“না, নেই।” বলিয়া অবনীবাবু হঠাৎ তাহার ঘাড় ধরিয়া ফেলিলেন।

প্রদীপ সামান্য একটু হাসিল : “সামান্য ঘাড়-ধরা থেকে ছাড়া পাবার জন্য যুযুৎসুর সোজা পাঁচ আমার শেখা আছে। কিন্তু আপনি মাননীয় গুরুজন, আপনাকে ভূপতিত করে’ অপদস্থ করলে আমার মন খুসি হবে না।”

ভয়ে ভয়ে অবনীবাবু হাতের মুষ্টি শিথিল করিয়া দিলেন। শচীপ্রসাদ বলিয়া গেল : “আমি দিচ্ছি ফোন করে।”

প্রদীপ শান্তস্বরে কহিল,—“পুলিশ আসবার আগেই শেষ অঙ্ক শেষ করে ফেলি নমিতা। তুমি প্রস্তুত হও। তেমন কিছু ভয়ের কারণ নেই। আঘাতের পরিবর্তে স্নেহ দিতে হবে এ-শিক্ষা আমরা নতুন লাভ করেছি এ-যুগে। তোমাকে আমি ভালবাসি। কথাটার যদি কিছু অর্থ থাকে, তবে তার উচ্চারণেই আছে, অলস অনুভূতিতে তার প্রমাণ। নেই। এ-ভালবাসা তোমাকে জ্যোৎস্নালোকে শোনাবার মত নয়, স্পষ্ট দিনের আলোয় সমস্ত সমাজের মুখের ওপর প্রখর ভাষায় বলবার মত। তুমি ভারতবর্ষের প্রতিমা কি না জানি না, কিন্তু আমার আত্মার সহোদরা।”

উমা দেয়ালের দিকে পিঠ করিয়া একেবারে পাংশু হইয়া গিয়াছে। নমিতা তখনো ভয়ে উদ্বেগে থমথম করিতেছে—গায়ের বসন তাহার সুসন্নিবেশিত নাই, শ্বশুরকে দেখিয়াও সে মাথায় ঘোম্‌টা তুলিয়া দিল না,—সে হতচেতন, বিমূঢ়, স্পন্দহীন। প্রদীপকে তাহারই সম্মুখে অগ্রসর হইতে দেখিয়া সে ভয়ে এতটুকু হইয়া গেল। এমন অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তে অবনীবাবু পৰ্য্যন্ত তাহাকে বাধা দিতে পারিলেন না।

যে-রক্ত আমার গৌরবের চিহ্ন হ’ল তাই তোমার কলঙ্ক হোক, নমিতা।” বলিয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য প্রদীপ দুই বাহুর মধ্যে হঠাৎ নমিতাকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। ঠিক চুম্বন করিল কি না বোঝা গেল না, আলিঙ্গনচু হইয়া নমিতা সরিয়া গেলে দেখা গেল প্রদীপেরই কপালের রক্তে তাহার মুখ, বুক একেবারে ভরিয়া গিয়াছে। অস্বাভাবিক উত্তেজনার প্রাবল্য নমিতা আর সহিতে পারিল না, মুহমান অবস্থায় মেঝের উপর বসিয়া পড়িল।

প্ৰদীপ দুয়ারের দিকে হটিয়া আসিয়া কহিল,—“হয় ত’ এ-জীবনে আর দেখা হবে না, নমিতা। কিন্তু সংসারে লক্ষ-কোটি কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকবার অবকাশে এটুকু শুধু মনে করে’ সুখ পেয়ো যে তোমারই কলঙ্কের মূল্যে আরেক জন মহান্ ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে।” বলিয়া আর এক মুহূর্তও দেরি না করিয়া সে ডান-হাতে কপালটা চাপিয়া ধরিয়া বাহির হইয়া পড়িল।

সিড়িতে যখন নামিয়াছে তখন উপর হইতে উমার কণ্ঠের ডাক শোনা গেল : “দীপ-দা, দাঁড়াও, মাথায় একটা ব্যাণ্ডেজ করে দি।”

প্রদীপ একবার উপরে চাহিল, কিন্তু একটিও কথা কহিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *