০৪. মেস-এর ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া

মেস্-এর ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া প্রদীপ উপরে আসিয়া দেখিল, তাহার নামে এক চিঠি আসিয়াছে। ঠিকানায় হাতের লেখা দেখিয়াই পত্র-লেখককে চিনিল এবং সেই জন্যই তৎক্ষণাৎ চিঠিটা খুলিল না। আয়নার কাছে দাঁড়াইয়া শক্ত চিরুনি দিয়া নিজের রুক্ষ চুলগুলি ছিঁড়িতে-ছিঁড়িতে ম্যানেজারের উপর রাগটা প্রশমিত করিতে লাগিল।

এই যুগে ভীষ্মকে হয় ত’ প্রদীপ ক্ষমা করিত না, কিন্তু তাই বলিয়া পৈতৃকসম্পত্তি অটুট রাখিবার জন্য সুধী-র এই পিতৃভক্তিকেও স্বৰ্গারোহণের সোপান বলিয়া সে স্বীকার করিতে পারে নাই। তাই সুধী-র বিবাহে সে ত’ যায়ই নাই, বরং তাহাদের দুইজনে যে উপন্যাসখানি লিখিতে সুরু করিয়াছিল, তাহা ফিরাইয়া দিয়া সুধী-কে লিখিয়াছিল : তোমার বর্তমান মনোভাব নিয়ে তুমি উপন্যাসের চরিত্রগুলির প্রতি সুবিচার করতে পারবে না। অতএব এই খাতাগুলি তুমি ফিরিয়ে নাও। যেটুকুন লেখা হয়েছে তাই একদিন তোমাদের অভ্যস্ত বিরস জীবনযাপনের ফাঁকে তোমার ভাৰ্য্যাকে পড়িয়ে শুনিয়ে ও যথাসময়ে তোমাদের প্রথম শাবকের আবির্ভাবের পরে কালক্রমে যখন তার জন্যে মাতৃস্তন্য অকুলান হয়ে উঠবে, তখন গো-দুগ্ধ তপ্ত করবার জন্যে এই খাতাগুলো ব্যবহার করা। ইতি।

তাহারই উত্তরে এই বুঝি সুধী-র চিঠি আসিল—সাত মাস বাদে। আশ্চর্য্য হইবার কারণ আছে বৈকি। এবং আশ্চর্য হইবার কারণ ঘটিলে কৌতূহল চাপিয়া রাখিতে বেশিক্ষণ চিরুনি চালানো অসম্ভব হইয়া উঠে। অতএব ম্যানেজারের পিতৃকুলকে নরকে পাঠাইয়া প্রদীপ চিঠি খুলিয়া ফেলিল।

সুধী বেশি কিছু লিখে নাই; শুধু দু’টি কথা: যত শিগগির পার চলে এস। তোমাকে আমার ভীষণ দরকার।

সাত মাসে নদী শুকাইয়া যে চর জাগিতেছিল, তাহাকে কখন এবং কি করিয়া যে অজস্র জোয়ার আসিয়া ভাসাইয়া দিয়া গেল, তাহা সত্যই বুঝা গেল না। প্রদীপ তখুনি তাহার ছেড়া সুটকেসটা নিয়া ম্যানেজারের ভাতের থালায় লাথি মারিয়া ষ্টেশনের মুখে বাহির হইয়া গেল।

সুধী-দের বাড়িতে যখন আসিয়া পৌঁছিল, তখনো বিকালের আলোটুকু আকাশের গায়ে লাগিয়া রহিয়াছে। দুয়ারের কাছেই উমার সঙ্গে প্রথম দেখা। প্রদীপ সরাসরি জিজ্ঞাসা করিল,—“সুধী কোথায়?” উমা ভড়কাইয়া গিয়া কি বলিবে কিছু ভাবিতে না ভাবিতেই, প্রদীপ প্রায় উমার গা ঘেঁসিয়া তাড়াতাড়ি যে-ঘরটাতে আসিয়া প্রবেশ করিল, তাহারই এক কোণে দরজার দিকে পিছন করিয়া সুধী তখনো টেবিলের উপর মুখ গুঁজিয়া তন্ময় হইয়া বই পড়িতেছে। হঠাৎ প্রদীপ তাহার দ্রুত পদবিক্ষেপগুলিকে সংযত করিয়া লইল। অতি ধীরে নিঃশব্দপদে সুধী-র পিছনে আসিয়া দুই হাত দিয়া তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল। অল্প একটু মুখ তুলিয়া সুধী কহিল,—“এই উঠছি নমিতা, এখনো ঢের আলো আছে। বেশ অন্ধকার করে না এলে শালমৰ্ম্মরের সঙ্গে মানুষের প্রেমগুঞ্জনের সঙ্গতি হয় না। ছাড়, দেখি কেমন সেজে এলে।”

চক্ষু হইতে হাত দুইটা সরাইয়া সুধীর কর্ণমূলে স্থাপন করিয়া প্রদীপ কহিল,-“এই তুই পাণিগ্রহণ করেছিস! মূখ। এখনো হাত চিনিস নি?”

সুধী চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিল। আনন্দদীপ্ত কণ্ঠে কহিল, “তুই এই অসময়ে এসে পড়লি? কখন চিঠি পেয়েছিস?”

“অসময়ে এসে পড়েছি বলে’ এই গণ্ডারের চামড়ার হাতকে তুই এমন অসম্মান কবি? বিয়ে করে তুই কাণা হয়ে গেলি নাকি?”

“দাঁড়া।” বলিয়া সুধী ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল এবং মুহুৰ্তমধ্যে যাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল, তাহাকে দেখিয়া প্রদীপ এতটা অভিভূত হইল যে, মানুষের ভাষায় তাহার ব্যাখ্যা হয় না। সৃষ্টির প্রারম্ভে একাকী আকাশের তলায় দাঁড়াইয়া নিঃসঙ্গ প্রদীপ এমনি করিয়াই অভিভূত হইত হয়ত। একদিন পুরী-ষ্টেশন হইতে গরুর গাড়ি করিয়া বাহির হইয়া সমুদ্রের খোঁজে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, গাছ আর বৃক্ষান্তরালে আকাশের টুকরো; সহসা এক সময়ে দেখিল সমস্ত গাছ সরিয়া গেছে, দৃষ্টিকে অপরিসীম মুক্তি দিবার জন্য আকাশ শূন্যে বিলীন হইয়া গেছে—সম্মুখে ফেনফণাময় মহাসমুদ্র! সেদিন প্রদীপ এমনিই অভিভূত হইয়াছিল। বিকালবেলা স্বামীর সঙ্গে শালবীথিতলে কয়েকটি নিভৃত মুহূর্ত যাপন করিবার জন্য নমিতা সাজিয়া আসিয়াছে, সেই দেহসজ্জায় কীই-বা ছিল আর! প্রদীপ রূপ দেখিল না, দেখিল বিভা—প্রতিভামণ্ডিত ললাটে ব্রীড়ার স্নিগ্ধতা, বুদ্ধিবিকশিত চোখে কুণ্ঠার মাধুৰ্য্য! নমিতা যেন শরীরী আত্মা, যেন শেলির মূর্তিমতী কবিস্বপ্ন! প্রদীপ এমন পাগল যে, হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া তৃপ্ত হইবে না বলিয়া, নীচু হইয়া নমিতার পা স্পর্শ করিয়া বসিল।

সুধী বলিল,-“তুই যে দেবর লক্ষ্মণের মতো মুখ ছেড়ে পা-কেই বেশি মর্যাদা দিচ্ছিস?”

নমিতা লজ্জায় চক্ষু নামাইয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল, আর, এমন একটা মুহূর্তে কেহ এমন একটা বাজে রসিকতা করিতে পারে ভাবিয়া প্রদীপের আর কথা বলিতে ইচ্ছা হইল না।

সুধী নমিতাকে কহিল,—“তুমি নিশ্চয়ই এ কে, বুঝতে পেরেছ। আমাদের উপন্যাসের নায়কের মাথাটাকে যে ভাগ্যের পায়ের ফুটবল বানিয়েছে। ভালো করে চেয়ে দেখ। ঘরে অতিথি এসেছেন, আৰ্যপুত্রের কুশল প্রশ্ন কর। তুমি সীতা-সাবিত্রীর মাসতুতো বোন হ’য়ে অমন ঘাবড়ে গিয়ে ঘাড় গুজে থাকলে চলবে কেন?”

প্রদীপ কহিল,—“একলা তোমার সম্বর্ধনাই যথেষ্ট হয়েছে। বৌদির নীরব সহানুভূতিটির মূল্য তার চেয়ে কম নয়।”

সুধী। (নমিতার প্রতি) মুখে ও তা’ বলছে বটে, কিন্তু অমন শ্রীমুখের কথা না শুনে ওর পেট নিশ্চয়ই ভরূবে না। তুমি যাদ আজ আকাশের তারাগুলোর যোগাযোগে প্রদীপের দীপধারিণী হতে, তা হ’লে আমি তোমার ঐ বোব মুখের ওপর অত্যাচার করে কথা ফোটাতাম।

নমিতা সুধী-র কনুইয়ে চিমটি কাটিয়া দিল।

সুধী। এ চিমটি তুমি প্রদীপকেও উপহার দিলে বেমানান হত। কেননা সাত মাস আগে তোমার উপর ওর দাবি আমারই সমান। ছিল। তোমার গায়ের গয়না যথেষ্ট নয় দেখে, আমি যদি বিয়ে-সতা থেকে সরোষে গাত্রোখান করতাম, আর প্রদীপ যদি সেই পরিত্যক্ত পিঁড়িতে এসে বস্ত, তা হলে তোমার আজকের এই রমণীয় কুণ্ঠাটি আমারই একান্ত উপভোগ্য হ’ত। ও তোমাকে প্রণাম কবুল, আর তুমি ওকে সামান্য একটু চিমটি কাটবে না?

নমিতার পক্ষে ই দাঁড়াইয়া সহ্য করা অস্বাভাবিকরূপে কঠিন হইয়া দাঁড়াইল। স্বল্প একটু ‘যাও’ বলিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইলে প্রদীপ বলিল,—“এ তোমার বাড়াবাড়ি সুধী!”

সুধী। বাড়াবাড়ি মানে? নমিতাকে পাবার জন্যে কী মূল্য দিয়েছি? সমাজকে মেনে নিয়ে ওর দেহের ওপর একচ্ছত্র রাজত্ব করছি বটে, কিন্তু ওর মনকে আমারই মুঠির মধ্যে চেপে ধরে মলিন করে দেব, আমি সে-বর্বরতা সহ্য করতে পারবো না। ওর লজ্জা তোমাকে জোর করে’ ভেঙে দিতে হবে।

প্রদীপ। ওর লজ্জা ভাঙতে গিয়ে তোমারো মন যদি ভেঙে যায়?

সুধী। ( দৃপ্ত-স্বরে) ভাঙুক! এই ঠুনকো মন নিয়ে আমি বাঁচতে চাই নে।

প্রদীপ। তোকে পাগলা কুকুরে কামড়ালে কবে?

সুধী। ঠাট্টা নয়; নমিতাকে আমার ভালো লাগে নি, লাগবেও না।

প্রদীপ। বলিস কি? এমন সুন্দর মেয়েটি থামিয়া গেল )

সুধী। হ্যাঁ জানি, কিন্তু পরখ করে দেখলাম নারী-মাংস আমার রুচবে না। গার্হস্থ্য-ধৰ্ম্ম পালন করবার মত আমার মনের সেই প্রশান্তি বা প্রশস্ততা কিছুই নেই। আমি জীবনে যে ভুল করে বসেছি, তার থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে তোর সাহায্যের দরকার হয়েছে।

প্রদীপ। যথা?

সুধী। নমিতাকে জাগিয়ে দিতে হবে। ও আমাকে ভয় বা ভক্তি করতে পাবে বটে, কিন্তু ভালোবাসতে পারূবে না; কারণ, আমাকে কোনো দিন হারাবে বলে’ ওর মনে না থাকবে সন্দেহ না-বা আশঙ্কা। ও জল হয়ে চিরকাল আমার গ্লাশের রঙ ধরে থাকবে। ওর মধ্যে স্থিরতা থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণ নেই। যার প্রাণ নেই সে কুৎসিত।

প্রদীপ। অন্ধকারে ঘরে বসে থেকে সব ঝাপসা দেখছি। চল বেরোই।

সুধী। বাইরেও অন্ধকার বটে, কিন্তু মুক্তি আছে, বিস্তৃতি আছে। নমিতাকে তোর মানুষ করে দিতে হবে; ওর আত্মার অবগুণ্ঠন যদি ছিড়ে ফেলতে পারি ভাই, তবেই হবে ওর পুনর্জীবন!

প্রদীপ। তুই তা হলে কি করূতে আছিস, গৰ্দত?

সুধী। ওর শরীরের ওপর পাহারা দেওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করবার নেই। তোর সঙ্গে নমিতার সম্পর্কে-ই একটা বন্ধনহীন ক্ষেত্র আছে, তোর কাছে ও নবীন, মধুররূপে অনাত্মীয়, সেইখানেই তোদের পরিচয় ঘটুক। তোর মাঝে নমিতাকে আমি পুনরাবিষ্কার করতে চাই।

প্রদীপ। এই সাত মাসেই এত সব সিদ্ধান্ত হয়ে গেল?

সুধী। রমণীর মন লক্ষ বর্ষ ধরে’ও আয়ত্ত করা যায় না, উনবিংশ শতাব্দীর এই সেন্টিমেন্টাল উক্তি আমি বিশ্বাস করি না। তাতে শুধু আয়ুরই বৃথা অপচয় ঘটে। আমার হাতে অত সময় নেই।

প্রদীপ। (হাসিয়া) আর আমারই আছে? এর জন্যে তুই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিস? ভেবেছিলাম কারু অসুখ হ’ল বুঝি। আমাকে তোর ভীষণ দরকারের এই যদি নমুনা হয়, দে, সুটকেশটা এগিয়ে দে, চললাম ফিরে’। ফমাসে কবিতা এলেও বন্ধুতা আসে না।

এই সময় বেড়াইতে যাইবার পোষাকে অবনীনাথ সেই ঘরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ঘরে অপরিচিত লোক দেখিয়া কিছু জিজ্ঞাসা করিবার জন্য তিনি একটু ইতস্তত করিতেছেন, সুধী আগাইয়া আসিয়া কহিল,—“এ আমার বন্ধু, প্রদীপেন্দ্র বসু—ভারতের ভাবী ‘ডেলিভারার।”

অবনীনাথ বিস্মিত হইবার আগেই প্রদীপ বলিল,—“তার মানে?”

সুধী। ( অবনীনাথের প্রতি) ইনি এক চড় মেরে এক গুণ্ডাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন!

অবনীনাথ। তাই নাকি? দেখি, আমার সঙ্গে পাঞ্জা ধর ত’! ( শিশুর মত সরলবশ্বাসে হাত প্রসারিত করিয়া দিলেন।

প্রদীপ। (সঙ্কুচিত হইয়া) গুণ্ডা ঠেঙিয়ে আমি যদি ভারতের কনিষ্ঠ ডেলিভারার হই তা হলে দু’ পাতা গল্প লিখে সুধী নিশ্চয়ই ভলটেয়ার হয়েছে।

প্রসন্নহাস্যে মুখ উদ্ভাসিত করিয়া অবনীনাথ কহিলেন,—“কয়েক দিন আছ ত’?”

প্রদীপের মুখ হইতে কথা কাড়িয়া নিয়া সুধী বলিল,-“নিশ্চয়ই।”

তাহার পর বন্ধুকে লইয়া সুধী একেবারে রান্নাঘরে আসিয়া হাজির,–সেখানে তাহার মা বঁটি পাতিয়া তরকারি কুটিতেছিলেন। সুধী হাঁকিল,—“তোমার জন্যে আরেকটি ছেলে কুড়িয়ে আনলাম, মা। আরেকটি বাতি জ্বলল।”

প্রদীপ প্রণাম করিতেই অরুণা কহিলেন,—“তোমার কথা অনেক শুনেছি আগে, সুখী-র সঙ্গে তোমার অনেক দিনের চেনা; অথচ আগে দেখিনি। ওর বিয়ের সময় ত’ রাগ করেই এলে না।”

প্রদীপ অল্প-একটু হাসিল, কহিল,সুধী-ও বিয়ে করে বয়ে যাবে এ-আঘাতের জন্যে তৈরি ছিলাম না। নিয়তিকে আমবা খণ্ডিত কবুব এই ছিল আমাদের পণ। দেখলাম পণের টাকা মিললে নিয়তি যথারীতি কাঁধে চড়াও হয়।”

সুধী নমিতার খোঁজে তাহার শুইবার ঘরে আসিয়া উঠিল। দেখিল, নমিতা তাহার বেড়াইবার দামী কাপড়-চোপড়গুলি ছাড়িয়া সাদাসিধা একখানি আটপৌঁরে শাড়ি পরিয়াছে। সুধী কহিল,—“হঠাৎ এ বেশ? আমার বন্ধুকে দেখে এক নিমেষেই তপস্বিনী সেজে গেলে নাকি?”

নমিতা। বন্ধু এসেছেন; এখন বেড়াতে যাবে কি? যাও!

সুধী। বাঃ, বন্ধু এসেছে বলেই মাঠে যাওয়া বন্ধ করে আমাকে এমন সন্ধ্যাটা মাঠে মারূতে হবে নাকি? দাঁড়াও, ডাকি প্রদীপকে।

নমিতা। ( বাধা দিয়া) দরকার নেই আজ গিয়ে। অমি যাবো না কখনো।

সুধী। কেন? আমার বন্ধুকে তোমার কিসের ভয়? তোমাকে ভয় দেখাতে ও বন্দুক নিয়ে আসেনি, যদিও তোমাকে জয় করতে দুই চক্ষুর দৃষ্টিই ওর যথেষ্ট।

 

 

নমিতা মনে মনে স্বামীর উপর নিদারুণ চটিতেছে, এমন সময় সুধী-র ডাকাডাকিতে প্রদীপ সেই ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল।

সুধী। (নমিতাকে দেখাইয়া) দেখলে?

প্রদীপ। বেশ ত, নিরাভরণেই শ্ৰী। তারা ফোটার আগেকার স্নিগ্ধ গোধূলি-আকাশটুকুর মতই তোমাকে দেখাচ্ছে, বৌদি।

সুধী। এই যাঃ, মাটি করে দিলে! প্রদীপ। তার মানে?

সুধী। ঐ ‘বৌদি’-কথাটা এসে এমন সুন্দর উপমাটাকে একেবারে বধ করলো। কর্ণ, বধির হও! ( নমিতাকে) তুমিও যদি এবার কৃপা করে’ ওকে ঠাকুরপো বলে ডাক, তবেই কলির পাপ চারপোয়া পূর্ণ হয়ে ওঠে।

হাসিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইল বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দ্বারান্তরালে তাহার যখন পুনরাবির্ভাব হইল, দেখা গেল, উমার ঘর হইতে সে আরেকখানা শাড়ি পরিয়া আসিয়াছে। না সাজিলে তাহার লজ্জা যেন ঘুচিবে না। আড়ষ্ট হইতে না পারিলে তাহার এই অপরিচয়ের দৈন্য তাহাকে কেবলই পীড়া দিতে থাকিবে। ভাবের অভাব ঘটিলেই ভাষায় বর্ণবাহুল্যের প্রয়োজন ঘটে—নমিতা সেই ভাববিরহিত অলঙ্কত ভাষা, মূক, নিরর্থক!

উঠানটুকু পার হইবার সময় অরুণা বলিলেন,—“ওকে এক্ষুনি বেড়াতে নিয়ে যাবি কি? এসে একটুও বিশ্রাম করূল না।”

সুধী। শালের বনে বসে’ই বিশ্রাম করা হবে ‘খন।

অরুণা। বাঃ, একটু জলখাবার খেয়ে যাক্।

সুধী। তুমি ততক্ষণ তৈরি করতে থাক,—তার চেয়ে হাওয়ায়ই বেশি উপকার হবে। তুমি বরং উমাকে ডেকে নাও, বৌ-র সাহায্য আজ পাচ্ছ না! বলিয়া সুধী হাঁক ছাড়িল,—“উমি উমি!”

উমা তবুও লুকাইয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *