০৪. চারপাশে ধুধু বালির চর

চারপাশে ধুধু বালির চর।

আর আলকাতরার মতো যেন অন্ধকার।

ভয়াবহ ক্লান্তির অবসাদে ভেঙ্গে পড়া তপু আর ইভার দুচোখে গভীর উৎকণ্ঠা।

একটি জীবন কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেবে। কুড়িয়ে পাওয়া আহত ছেলেটি একটু পরে মারা যাবে। তার চোখ জোড়া বিবর্ণ হয়ে এসেছে, শুকনো ঠোঁট জোড়া ঈষৎ নেড়ে কি যেন বলতে চাইছে সে।

একটু পানি জোগাড় করতে পারে? ইভা অনুনয়ের সঙ্গে তাকালো তপুর দিকে। ওর মুখে দেব।

উঠে দাঁড়ালো তপু। সমস্ত অবসাদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মৃতপ্রায় ছেলেটির জন্যে পানির খোজে বেরিয়ে পড়লো সে।

তপু ছুটছে।

চারপাশে শুধু শুকনো বালি আর বালি।

এক ফোঁটা পানির অস্তিত্ব নেই কোথাও।

আরো অনেকক্ষণ পর যখন অবসন্ন দেহ আর হতাশ মন নিয়ে ফিরে এলো তপু, তখন আহত ছেলেটি মারা গেছে।

তৃষ্ণার্ত ঠোঁট জোড়া তার ঈষৎ খোলা।

পাশে বসে আছে ইভা।

আর মাটিতে শুয়ে থাকা শিশুটি আকাশের দিকে হাত পা ছুঁড়ে খেলা করছে। মুখে তার নিষ্পাপ হাসি।

ইভা কাঁদছে। দুগণ্ড বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে তার।

তপু কিছু বললো না। ওর মাথার উপরে নীরবে একখানা হাত রাখলো শুধু।

তারপর।

তারও অনেক অনেক পরে আহত ছেলেটির শেষ কৃত্যের জন্যে একটা কবর খোঁড়ার চেষ্টা করলো ওরা।

মাটি এখন মনে হলো পাথরের মতো শক্ত।

ছোট্ট একটা কবর খুঁড়তে গিয়ে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠলো দুজনে। কিছু মাটি তোলার পর অবাক হয়ে দেখলো চারপাশ থেকে স্রোতের মতো পানি এসে কবরটা ভরে যাচ্ছে।

দুহাতে পানি ফেলে দিয়ে কবরটাকে শুকোবার চেষ্টা করলো তপু, পারলো না।

অফুরন্ত পানি শুধু বেড়েই চলেছে।

ধীরে ধীরে সেই পানির মধ্যে মৃতদেহটাকে নামিয়ে দিলো ওরা। তারপর বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যে পা বাড়ালো দুজনে।

ইভা মৃদুস্বরে বললো, আমি আর পারছি না।

তপু বললো। আর একটু পথ। এই পথটুকু পেরিয়ে গেলে আর কোন ভয় নেই ইভা। আমরা তখন নিরাপদ সীমানার মধ্যে গিয়ে পৌঁছবো।

 

সামনে একটা জলে ভরা নাতিদীর্ঘ ঝিল।

দুপাশ তার মখমলের মতো নরম সবুজ ঘাসে ভরা।

এখানে সেখানে দুএকটা গাছ। ইতস্তত ছড়ানো।

ঘাসের ওপর এসে বসলো ওরা।

তপু আর ইভা।

বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লো ইভা।

জানো, ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।

তপুও শুয়ে পড়লো।

উপরে বিরাট বিশাল সীমাহীন আকাশ।

আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে তপু বললো, এখন আর আমাদের কোন ভয় নেই ইভা।

ইভা ওর দিকে চেয়ে মিষ্টি একটু হাসলো। আমি এখন কি ভাবছি বলতে?

কি ভাবছে?

বিয়ের পরে আমাদের জীবনটা কেমন হবে, তাই। আমাকে হেড়ে কিন্তু তুমি কোথাও যেতে পারবে না। যেখানে যাবে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। সারাক্ষণ তোমার পাশে পাশে থাকবো।

কি মজা হবে তাই না?

আর আমি কি ভাবছি জানো?

কি?

আমি যখন সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবো, তখন দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তোমার নাম ধরে ডাকব। আশে পাশের বাড়ির লোকগুলো সবাই চমকে তাকাবে সে দিকে। তুমি দরজা খুলেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে, এতে দেরি হলো যে

আমি বলবো। কি বলবো বল তো?

তুমি বলবে অনেক কাজ ছিলো তাই।

না না। আমি বলবো। কাজের মাঝখানে তোমাকে নিয়ে একটা মিষ্টি কবিতা লিখেছি, তাই।

তুমি শব্দ করে হেসে উঠে বলবে। কই দেখি, দেখি। দেখাও না।

না, এখন না।

কখন?

যখন পাড়া-প্রতিবেশীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। এই পৃথিবীর একটি মানুষও জেগে থাকবে না। তুমি আমি পাশাপাশি বসবো। দুজনে দুজনকে দেখবো। তখন শোনাববা তোমাকে।

কি সুন্দর তাই না। ইভা ধীরে ধীরে বললো।

বাচ্চা ছেলেটা ইভার বুকে মুখ গুঁজে নীরবে ঘুমুচ্ছে।

তপু আর ইভার চোখেও ঘুম নেমে এলো একটু পরে। বহুদিন পরে ঘুমুছে ওরা।

শহরটা এখনো মৃত।

ক্ষতবিক্ষত।

এখানে সেখানে এখনো অনেক মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে।

কুকুরের।

বিড়ালের।

মানুষের।

অবাক হয়ে চারপাশে তাকালো তপু আর ইভা।

জনশূন্য পথ দিয়ে চলতে গিয়ে ক্ষণিকের ভুলে যাওয়া আতঙ্কটা যেন ধীরে ধীরে আবার উঁকি দিতে লাগলো ওদের মনের মধ্যে। তপুর দিকে তাকালে ইভা।

আমার ভয় করছে।

না। না। ভয়ের কোনই কারণ নেই ইভা। আমরা এসে পড়েছি।

একটা বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়ালো।

আমাদের বাড়ি। তপু আস্তে করে বললো।

ইভা মুখ তুলে বাড়িটাকে এক পলক নিরিখ করলো।

বার কয়েক কড়া নাড়লো তপু।

কোন সাড়াশব্দ নেই।

আবার কড়া নাড়লো।

আবার।

সহসা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেলো।

তপু দেখলো। তার মা। বুড়ি মা।

তিন ভাই।

আর চৌদ্দ বছরের সেই মেয়েটি।

তপুকে দেখে চমকে উঠলো সবাই।

মা। বাবা। ভাই। বোন।

ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন মা। তপু! তপু! তুই বেঁচে আছিস?

না। না। পরক্ষণেই প্রচণ্ড শব্দে আর্তনাদ করে উঠলো ইভা।

তপু চমকে তাকিয়ে দেখলো।

বুড়ি মায়ের হাতজোড়া রক্তাক্ত। যেন এই একটু আগে, এক সমুদ্র রক্তের মধ্যে হাতজোড়া ডুবিয়ে এসেছেন তিনি।

বাবার হাতে একটা চকচকে দা। দা-এর ডগা থেকে তাজা রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে। ভাইদের হাতে লোহার শিক। তাজা খুনে ভরা।

না। না। মায়ের আলিঙ্গন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো তপু।

ইভা ততক্ষণে বাচ্চা ছেলেটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আবার ছুটতে আরম্ভ করেছে।

তীব্রবেগে তাকে অনুসরণ করলো তপু।

না। না। না।

শব্দের রাক্ষসগুলো আবার তাড়া করছে পেছন থেকে।

পাগলা কুকুর নয়।

শূকর শূকরী নয়।

কতগুলো মানুষ।

কতগুলো চেনা মুখ।

মায়ের। বাবার। ভাইয়ের। বোনের।

পেছন থেকে ছুটে আসছে। ছুটে আসছে ওদের হত্যা করার জন্যে। প্রাণপণে ছুটছে তপু আর ইভা।

বাচ্চা ছেলেটা বুকের মধ্যে কাঁদতে শুরু করেছে। তার তীব্র কান্নার শব্দে মনে হলো যেন মৃত শহরটা থরথর করে কাঁপছে। ওকে আরো জোরে বুকের মধ্যে চেপে ধরলো ইভা।

আমি আর পারি না। আর পারি না। গভীর যন্ত্রণায় পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো ইভা।

তপু এসে হাত ধরলো ওর।

ওরা ছুটছে।

শব্দের রাক্ষসগুলো তাড়া করছে পেছন থেকে।

ওরা ছুটছে।

তারপর।

 

অনেক অনেক অন্ধকার পথের শেষে। সহসা নিজেদের সেই অফুরন্ত মিছিলের মাঝখানে আবিষ্কার করলো ওরা।

তপু আর ইভা।

একটা সীমাহীন সমুদ্রের পাড় ধরে মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে সামনে।

ছেলে। বুড়ো। মেয়ে। শিশু। যুবক। যুবতী।

দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত অবসন্ন।

জীর্ণ। শীর্ণ। বিবর্ণ।

ক্ষতবিক্ষত দেই। আর অবয়ব।

আমরা কোথায়?

ভিয়েতনামে না ইন্দোনেশিয়ায়।

জেরুজালেমে না সাইপ্রাসে।

ভারতে না পাকিস্তানে।

কোথায় আমরা?

জানো, ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়।

ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়।

আমার বোনটাকে ধর্ষণ করে মেরেছে ওরা আফ্রিকাতে।

আমার বাবাকে মেরেছে বুখেনওয়াল্ডে গুলি করে।

আর আমার ভাই। তাকে ওরা ফাঁসে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।

বলতে গিয়ে দুচোখের কোণে দুফোঁটা অঞ মুক্তোর মত চিকচিক করে উঠলো বুড়োটার।

ওর পাশে এসে দাঁড়ালো অপু আর ইভা।

তারপর সমুদ্রের পাড় ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ওরা।

সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *