০৩. ইভা আর তপু তখন ছুটছে

ইভা আর তপু তখন ছুটছে।

পালাচ্ছে ওরা।

দীর্ঘ পথ চলায় ওরা ক্লান্ত। বিবর্ণ বিধ্বস্ত।

তবু জীবনের জন্য।

বাঁচার জন্যে। সুখের জন্যে।

ওরা দুটছে।

সহসা থমকে দাঁড়ালো ওরা।

ইভা আর তপু।

দেখলো। সামনে সীমাহীন সমুদ্র। আর সেই সমুদ্রের সৈকতে, অফুরন্ত ঢেউয়ের পটভূমিকায় একটি ক্রুশ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। ক্রুশের পেছনে লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

কে? ক্রুশবিদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে সহসা প্রশ্ন করলো ইভা। অনেকক্ষণ কোন জবাব দিলো না তপু। সে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো।

তারপর বললো, যিশু। যিশু।

হ্যাঁ। যিশুখৃষ্ট। ওরা গতকাল তাঁকে হত্যা করেছে।

দুজোড় চোখ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

যেন এক অনন্ত সময়ের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে ওরা।

সহসা আবার সেই হিংস্র বন্য ধ্বনি তাড়া করে এালো।

পাগলা কুকুরগুলো খোঁজ পেয়ে গেছে ওদের।

শূকর শূকরীরা চিৎকার করে আসছে পেছনে।

ইভার একখানা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে আবার ছুটলো তপু।

প্রাণপণে ছুটছে ওরা।

সহসা। কিসের সঙ্গে যেন হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ওরা। চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহ।

ছেলে। বুড়ো। মেয়ে। শিশু।

অপু আর ইভা চমকে উঠলো।

দেখলো। সেই অসংখ্য মৃতদেহের মাঝখানে ওদের দুজনের মৃতদেহও পড়ে আছে।

নিজের মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ইভা।

তাকালো তপু।

বুশেনওয়ান্ডে।

না। অসউইজে।

না। স্ট্যালিনগ্রাডে? অথবা ভিয়েতনামে?

ভয়ে শিউরে উঠে তপুর বুকে মুখ লুকালো ইভা।

সহসা কাছাকাছি কোথায় যেন প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করলে তপু। একটা বাচ্চা ছেলে কাদছে।

দুজনে মাথা তুলে তাকালো ওরা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। মৃতদেহগুলোর মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো ইভা আর তপু। কিছুদূর এসে দেখলো। একটি মৃত মা মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। তার স্তন থেকে চুইয়ে পড়া দুধে আর রক্তে মাটি ভিজে গেছে।

পাশে চার পাঁচ বছরের একটি আহত ছেলে শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে ওদের দিকে।

আর।

একটি শিশু আকাশের দিকে হাত পা ছুঁড়ে তীব্র কান্না জুড়ে দিয়েছে।

মৃত মায়ের স্তনের ওপর পরনের কাপড়টা টেনে দিলো ইভা। মাটি ঢেকে দিলো।

আহত ছেলেটিকে কোলে নিলো তপু।

শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো ইভ।

তারপর আবার ছুটতে লাগলো ওরা।

সামনে অগুনতি লোক। বাস্তুহারাদের অফুরন্ত মিছিল।

নানা বর্ণের।

নানা গোত্রের।

নানা ধর্মের।

দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত। শীর্ণ। জীর্ণ।

ক্ষতবিক্ষত অবয়ব।

ওদের মাঝখানে এসে কিছুক্ষণের জন্যে হতবিহবল হয়ে গেলো ইভা আর তপু।

তোমরা কোত্থেকে আসছে।

ইন্দোনেশিয়া থেকে।

ভিয়েতনাম থেকে।

গ্রিস থেকে।

সাইপ্রাস থেকে।

জেরুজালেম থেকে।

হিরোশিমা থেকে।

কোথায় যাচ্ছে? কোথায় যাবে তোমরা?

আমরা অন্ধকার থেকে আলোতে যেতে চাই।

আমরা আলো চাই।

তোমরা কোথায় যাচ্ছে একজন বুড়ো প্রশ্ন করলে ওদের।

তপু ইতস্তত করে বললো। আমার মা বাবা ভাই বোনের কাছে।

তোমার নাম? তোমার নাম কি? সহসা আরেকজন শুধালো।

আমার নাম তপু।

তপু। লোকটা এগিয়ে এলো সামনে। ও হ্যাঁ। তোমার মায়ের সঙ্গে আমাদের পথে দেখা হয়েছিলো, তিনি তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন আমাদের। তোমার খোঁজ জানতে চাইছিলেন।

বাচ্চাটা আবার কেঁদে উঠতে ইভা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।

মিছিল এগিয়ে গেলো সামনে।

 

বুড়ি মা আশ্রিত মানুষগুলোর জন্যে রান্নার আয়োজন করছিলেন। তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়েটি সাহায্য করছিলো তাঁকে।

বুড়ো বাবা তাঁর ঘরে একখানা জায়নামাজের উপরে বসে তছবি শুনছিলেন আনমনে।

আর বক্সঘরের বাসিন্দারা ওয়োপোকার মত হাত পা গুটিয়ে ঝিমুহিল বসে বসে।

এমন সময়।

ঠিক এমনি সময় তপুর মৃত্যুর খবর নিয়ে এলো তিন সন্তানের একজন। সকলকে ডেকে এক ঘরে জড়ো করলো সে। তারপর ধীরে ধীরে বললো।

বললো। তপু মারা গেছে। তলুকে মেরে ফেলেছে ওরা।

মুহূর্তে চমকে উঠলো সবাই।

বুড়ি মা, বাবা চৌদ্দ বছরের মেয়েটি আর দুই ভাই।

বুকের উপরে হাত দুখানা জড়ো করে ক্ষীণ একটা আর্তনাদের ধ্বনি তুলে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লেন বুড়ি মা।

শুকনো দুচোখ ভিজে এলো।

মনে হলো যেন সন্তানের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছেন তিনি।

তপু মনে পড়ে আছে রাস্তার উপরে উপুড় হয়ে।

তপুর মৃতদেহ একটি গাছের সঙ্গে ঝুলছে।

ঘরের ভেতরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে তপু। চারপাশে রক্তের স্রোত বইছে।

তপুকে ওরা ঘরের কড়িকাঠের সঙ্গে ঝুলিয়ে মেরেছে।

তপুর মৃতদেহটা ওরা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।

তপু মনে পড়ে আছে একটা নর্দমার ভেতর।

এক মুহূর্তে তপুর করুণ মৃত্যু দৃশ্যগুলো চোখের সামনে যেন দেখতে পেলো ওরা।

বুড়ি মা। বাবা। তিন সন্তান আর চৌদ্দ বছরের মেয়েটি। সহসা একজন ছুটে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা দাটা হাতে তুলে নিলো আরেক ভাই নিলো একটা ছুরি।

তৃতীয় জন একটা লোহার শিক।

তিন জোড়া চোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে।

দরজার দিকে এগিয়ে গেলো ওরা।

সহসা পেছন থেকে দুটে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন বুড়ো বাবা। না। ওদের তোমরা হত্যা করতে পারবে না।

কেন?

কেন?

কেন?

তিন কণ্ঠ এক হয়ে প্রশ্ন করলো।

ওরা তো কোন দোষ করে নি। বুড়ো বাবা জবাব দিলেন। ওরা তোমাদের আশ্রিত। ওরা অসহায়। ওদের কেন হত্যা করবে।

কারণ ওরা সেই ধর্মের লোক যারা আমার ভাইকে খুন করেছে।

ওদের জাত এক।

ধর্ম এক।

বর্ণ এক।

গোষ্ঠী এক।

ভাষা এক।

ওদের খুন করে আমরা প্রতিশোধ নেবো।

না। বুড়ো বাবা যেন সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী আর ভাষা এক বলে ওরা দোষী নয়। ওরা তো তপুকে খুন করে নি।

ওরা করে নি, ওদের জাতভাইরা করেছে। সহসা বাঘিনীর মতো স্বামীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বুড়ো মা। সরে যাও সামনে থেকে। সরে যাও।

বাক্সঘরের মধ্যে জানোয়ারের মতো থাকা মানুষগুলো তখন পরম নির্ভরতায় ঘুমুচ্ছে।

মই বেয়ে উপরে উঠে এলো তিন ভাই।

ধীরে ধীরে দরজাটা খুললো ওরা।

ওদের চোখে মুখে রক্তের নেশা। মনে হলো যেন মানুষের চেহারা সরে গিয়ে কতগুলো হিংস্র বন্য পশুর মুখ ওদের কাঁধের ওপর ঝুলছে।

একটা বাচ্চা ছেলে ঘুমন্তু মায়ের স্তন নিয়ে খেলা করছিলো। সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো সে।

তাঁর হাসির শব্দে চমকে উঠলো তিন তস্কর।

হাত থেকে দা আর ছুরি নিচে মেঝেতে খসে পড়ার আওয়াজে বাক্সঘরের বাসিন্দারা জেগে গেলে সবাই। ওরা অবাক হয়ে খোলা দরজায় দাঁড়ানো তিন ভাই এর দিকে তাকালো।

ওদের সে দৃষ্টি যেন সহ্য করতে পারলো না তিন ভাই।

ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে নিলো।

একজন বললো, ও কিছু না। তোমরা কেমন আছে দেখতে এসেছিলাম। ঘুমোও এখন। ঘুমিয়ে পড়ো।

দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *