০১. তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই

তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই।

শেষ নেই মৃত্যুরও।

তবু মানুষ মানুষকে হত্যা করে।

ধর্মের নামে।

বর্ণের নামে।

জাতীয়তার নাম।

সংস্কৃতির নামে।

এই বর্বরতাই অনাদিকাল ধরে আমাদের এই পৃথিবীর শান্তিকে বিপন্ন করেছে।

হিংসার এই বিষ লক্ষ কোটি মানব সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

জীবনকে জানবার আগে।

বুঝবার আগে।

উপভোগ করার আগে।

ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে অসংখ্য প্রাণ।

 

কিন্তু মানুষ মরতে চায় না।

ওরা বাঁচতে চায়।

এই বাঁচার আগ্রহ নিয়েই গুহা-মানর তার ও হেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

সমুদ্র সাঁতরেছে।

পাহাড় পর্বত পেরিয়েছে।

ইতিহাসের এক দীর্ঘ যন্ত্রণাময় পক্ষ পেরিয়ে সেই গুহা-মানর এগিয়ে এসেছে অন্ধকার থেকে আলোতে।

বর্বরতা থেকে সভ্যতার পথে।

মানুষের এ এক চিরন্তন যাত্রী।

জ্ঞানের জন্যে।

আলোর জন্যে।

সুখের জন্যে।

তবু আলো নেই।

তবু অন্ধকার।

 

অন্ধকারের নিচে সমাহিত মৃত নগরী।

প্রাণহীন।

যেন যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত তার অবয়ব।

দীর্ঘ প্রশস্ত পথগুলোতে কবরের শূন্যতা।

ভাঙ্গা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো। আর মৃতদেহ।

কুকুরের।

বিড়ালের।

পাখির।

আর মানুষের।

একটা।

দুটো।

তিনটে।

অগণিত। জীবনের স্পন্দনহীন নগরী শুধু এক শব্দের তাদের হাতে বন্দি।

যেন অসংখ্য হিংস্র জানোয়ার বন্য ক্ষুধার তাড়নায় চিৎকার করছে।

যেন অনেকগুলো পাগলা কুকুর।

কিম্বা রক্তপিপাসু সিংহ।

বাঘ। অথবা একদল মারমুখো শূকর শূকরী।

 

আর সেই বন্যতার ভয়ে ভীত একদল মানুষ নোংরা অন্ধকারে একটি ঘরের ভেতরে; ইঁদুর যেমন করে তার গর্তের মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে থাকে, তেমনি বসে আছে।

আতঙ্কে অস্থির মুখ, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে ওদের।

একদল ছেলে বুড়ো মেয়ে।

যুবক। যুবতী।

আর একটি সন্তান-সম্ভবা মহিলা।

অন্ধকারের আশ্রয়ে নিজেদের গোপন করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওরা।

একটা বাচ্চা ছেলে খুকখুক করে কাশলো।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঘুরে তাকালো ওর দিকে।

দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে। খবরদার, আর শব্দ করো না।

যদি না পারো দুহাতে চেপে রাখো।

নইলে ওরা আমাদের অস্তিত্বের কথা টের পেয়ে যাবে।

তাহলে কারো রক্ষা নেই।

অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটি স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে ওয়ে। যন্ত্রণাকাতর মুখে চারপাশে তাকাচ্ছে সে।

সবাই তাকে দেখছে। শব্দ করো না।

কয়েকটা আরশুলা আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেয়ালের গায়ে।

সহসা কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেলো বাইরে।

মুহূর্তে সবার মুখ ফেকাসে হয়ে গেলো। শ্বা

স বন্ধ হলো।

এই বুঝি মৃত্যু এলো।

দরজার কড়াটা নড়ে উঠলো। শুনুন। দরজা খুলুন। আমি আপনাদের নিয়ে যেতে এসেছি। পাশের বাড়ির বুড়ি মায়ের কণ্ঠস্বর। বিশ্বাস করুন। আমি আপনাদের বাঁচাতে এসেছি। কোন ভয় নেই। দরজা খুলুন।

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত।

ভেতর থেকে কেউ কোন উত্তর দিলো না ওরা।

কে যেন চাপা স্বরে বললো, না না, দরজা খুলো না। ওদের কোন বিশ্বাস নেই। বাইরে শব্দ শুনতে পাচ্ছে না? ওরা ওই বুড়িটাকে পাঠিয়েছে। আমাদের খুন করবে।

সেই শব্দের দানব ধীরে ধীরে কাছে, আরো কাছে এগিয়ে আসছে।

শুনুন। দরজা খুলুন। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দোহাই আপনাদের দরজা খুলুন। আবার সেই বুড়ি মার কণ্ঠস্বর।

একটা ছেলে সামনে এগিয়ে যেতে আরেকজন পেছন থেকে ধরে ফেললো। কোথায় যাচ্ছে?

দরজা খুলে দেবো।

না। না। না। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর এক সঙ্গে প্রতিবাদ করলো।

না। না। না।

কেন?

ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।

মরতে হলে বিশ্বাস করেই মরবো। ছেলেটি ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।

এক ঝলক আলো এসে পড়লো আতঙ্কিত মুখগুলোর ওপরে। একটা চাপা আর্তনাদ করে ওরা পরস্পরের বাহুর নিচে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলো। না। না। আমরা আলো চাই না।

দুয়ারে দাঁড়িয়ে বুড়ি মা। হাতে তার জ্বলন্ত একটা মোমবাতি। চোখ জোড়া শান্ত। মিঞ্চ।

আমরা বেঁচে থাকতে আপনাদের ভয়ের কিছু নেই। কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। আসুন। আমার সঙ্গে আসুন আপনারা।

অনেকগুলো ভয়ার্ত চোখ। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে।

আসুন। আমার সঙ্গে আসুন।

আসন্ন মৃত্যুর চেয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে ওরা শ্রেয় মনে করলো।

হয়ত ভাই, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ওরা।

বুড়ি মাকে অনুসরণ করে এগিয়ে এলো সামনে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটিকে দুজনে দুদিক থেকে সাবধানে তুলে নিলে। ধুলোয় ভর্তি অপরিসর করিডোর দিয়ে কয়েকটা ইঁদুর ছুটে বেরিয়ে গেলো এপাশ থেকে ওপাশে। চমকে উঠলো সবাই।

মোমবাতির সলতেটা বার কয়েক কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেলো।

ও কিছু না। ইঁদুর। বুড়ি মা সবার দিকে তাকিয়ে ভরসা দিলো।

করিডোরটা যেখানে শেষ হয়ে গেছে সেখানে একটা সরু সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় এসে বুড়ি মা দেখলেন তাঁর তিন সন্তান সামনে দাঁড়িয়ে। কাছে যেতে ওরা এক পাশে সরে দাঁড়ালো।

মনে হলো মায়ের আচরণে ওরা সন্তুষ্ট হইতে পারে নি। মা এগিয়ে গেলেন সামনে।

একটা ছোট্ট গলির মতো ঘর। রান্নাঘর ওটা।

বারো তেরো বছরের একটি মেয়ে চুলোয় অ্যাঁচ দিচ্ছিলো। ঘুরে তাকালো ওদের দিকে।

তার চোখেমুখে কৌতূহল।

ঘরের মাঝখানে ছাদের কাছাকাছি কাঠ দিয়ে তৈরি একটা বাক্সঘর।

সিঁড়ি লাগানো।

বুড়ি মা বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আপনারা এর মধ্যে লুকিয়ে থাকুন। আমি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেব। কেউ টের পাবে না।

আশ্রিত মানুষগুলো বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে।

আমি জানি ওর মধ্যে থাকতে আপনাদের ভীষণ অসুবিধে হবে। কিন্তু প্রাণের চেয়ে প্রিয়, আর কিছু নেই পৃথিবীতে।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে বাক্সঘরের মধ্যে উগেলো ওরা।

ঊনিশ জন মানুষ।

বাচ্চা। বুড়ো। পুরুষ। মেয়ে। যুবক। যুবতী।

আর আসন্ন সন্তান-সম্ভবা মহিলাটি।

বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিলেন বুড়ি মা। সিঁড়িটা এক পাশে সরিয়ে রাখলেন।

রাস্তায় সহস্র ধ্বনির একত্রিত পাশবিক চিৎকার।

পশুরা হল্লা করছে।

এটা তুমি ঠিক করলে না মা।

দোরগোড়ায় সন্তানের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হলেন বুড়ি মা।

কেন? কি হয়েছে? স্বপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সন্তানের দিকে তাকালেন তিনি।

প্রথম জন বললো, কেউ যদি টের পায় তাহলে?

দ্বিতীয় জন বললো, তাহলে ওরা আমাদেরকেও মেরে ফেলবে।

তৃতীয় জন বললো, এটা ঠিক করলে না মা।

মা তিনজনের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, কতগুলো নিরপরাধ মানুষকে আমাদের চোখের সামনে মেরে ফেলবে আর আমরা চেয়ে দেখবো। তপুর কথা ভাব একবার। তোমাদের ভাই। সে এখন কোথায়? তাকে যদি কেউ মেরে ফেলে। সহসা থামলেন বুড়ি মা।

মুহূর্তে তাঁর মুখখানা বিষাদে ছেয়ে গেলো। আস্তে করে ধালেন, তপুর কোন খোঁজ বের করতে পারলে না তোমরা

না।

পশুরা হল্লা করছে বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *