০৩. বাড়ি ফিরে এসে মন্তু দেখলো

বাড়ি ফিরে এসে মন্তু দেখলো বুড়ো মকবুলের ঘরের সামনে একটা ছোট-খাট জটলা বসেছে। বাড়ির সবার সঙ্গে কি যেন পরামর্শ করছে মকবুল। বাড়ির সবার চেয়ে বড় সে। গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সকলকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না বুড়ো। অনা সবার বেলাও তাই। মকবুলকে জিজ্ঞেস না করে বাড়ির কেউ কোনদিন কোন কাজ কারবার করে না। সুরত আলীর সঙ্গে হয়তো রশীদের মনোমালিন্য আছে। আবুলকে হয়তো মকবুল। দুচোখে দেখতে পারে না। গনু মোল্লাকে হয়তো দিনের মধ্যে পঞ্চাশ বার অভিশাপ দেয় ফকিরের মা। কিন্তু বাড়ির মান-সম্মান জড়িয়ে আছে এমন কোন কাজের বেলা কারো সঙ্গে কারো বিরোধ নেই। তখন সবাই এক। একসঙ্গে বসে পরামর্শ করবে ওরা। মন্তুকে আসতে দেখে ওর দিকে একখানা পিঁড়ি বাড়িয়ে দিলো সালেহা, বহ, মন্তু মিয়া বহ।

আলোচনার ধারটা মুহূর্তে বুঝে নিলো মন্তু।

বুড়ো মকবুলের মেয়ে হীরনের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে টুনিদের বাবার বাড়ির গ্রাম থেকে। আজ সন্ধ্যায় টুনিকে নিয়ে যাবার জন্যে ওর বাবার বাড়ি থেকে লোক এসেছিলো। সেই দিয়া গেছে প্রস্তাবটা। জুলু শেখের বেটা কদম শেখ। হাল গরু জমি সব আছে ওদের। খাস গেরস্থ ঘরের ছেলে। বিয়ে একটা অবশ্য করেছিল একবার। মাস তিনেক হলো বউ মারা গেছে।

আমেনা বলছে, অত চিন্তা কইরা আর কি অইবো; পাকা কথা দিয়া দ্যান। গনু মোল্লা বললো, সব খোদার ইচ্ছা। মাইয়ার কপালে যদি সুখ থাকে তাইলে যেইহানে বিয়া দিবা সেইহানেইসুখে থাকবো। বড় বেশি বাছ বিচার কইরো না।

মকবুল সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলো, হ্যাঁ, তাতে ঠিক কথা।

হীরেনের বিয়ের কথা নিয়ে আলাপ হচ্ছিল, মাঝখানে রশীদের বউ সালেহা বলে উঠলো, আমাগো মন্তু মিয়ারেও এইবার একটা বিয়া করাইয়া দ্যান। এককোণে নীরবে বসেছিলো মন্তু। ওর দিকে তাকিয়ে সকলে সালেহার কথায় একসঙ্গে সাড়া দিয়ে উঠলো।

বুড়ো মকবুল গীর গলায় বললো, হ, ঠিক কথা কইছু সালেহা।

ওর লাইগ্যা একটা মাইয়া দেহন লাগে।

আমেনা বললো, ওর তো বাপ-মা কেউ নাই, আপনেরা আছেন দেইখা শুইনা করায়া দেন বিয়া।

সঙ্গে সঙ্গে দু’চারজন মেয়ে নিয়েও আলাপ করলো ওরা।

ফাতেমার এক খালাতো বোন আছে। রসুন তার নাম। রসুনের মত সাদা হলুদে মেশানো গায়ের রঙ। সুঠাম দেহ। টানা টানা চোখ।

বয়স তের চৌদ্দ হবে।

আবুল বললো, ওর মামার এক মেয়ে আছে। দেখতে যেমন হরপরী। তাই মামা আদর করে পরী বলে ডাকে। শুধু স্বভাবটা যেন একটু কেমন কেমন। তাও তেমন কিছু নয়। খায় একটু বেশি। আর ঘুমোয়। মকবুল পরক্ষণে বললো, ও মাইয়া ঘরে আইনা কাজ নাই মিয়া। আমেনা বললো, অত দূরে দূরে যাইতাছ ক্যান, নিজ গেরামে দেই না। আমাগো আম্বিয়া কি খারাপ মাইয়া নাহি। ও হইলেই খুব ভালো হয়। দিনরাত গতর খাটাবার পারে। মন্তু মিয়ারে সুখে রাখবো। আম্বিয়ার প্রশ্নে কারো কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া গেলো না। ও মেয়ে গতর খাটাতে পারে এ কথা সত্যি। কিন্তু ঘরের বউ করে আনার মতো মেয়ে ও নয়।

মকবুল বললো, ওগো বংশে হাঁপানি রোগ আছে। শেষে হাঁপানি হইয়া মন্তু মরবো। মন্তু কিন্তু একটা কথাও বললো না। সে চুপ করে বসে রইল এক কোণে। আলোচনা অসমাপ্ত রেখে সেদিনের মত উঠে গেলে সবাই। একটু পরে যে যার ঘরে চলে গেলো ওরা।

পিদিম জ্বালিয়ে অবাক হলো মন্তু। মাচাঙের ওপর একরাশ শাপলার ফুল ঝুলছে। বকের মত সাদা ধবধবে পাতার মাঝখানে হলুদ রঙের কুঁড়ি। টাটাসহ ফুলগুলো মাচাঙ থেকে নামিয়ে নিলো মন্তু।

আজ সন্ধ্যায় বাপের বাড়ি চলে গেছে টুনি। যাবার আগে এগুলো রেখে গেছে ওর ঘরে। এক টুকরো ম্লান হাসি জেগে উঠলো মন্তুর ঠোঁটের কোণে। ফুলগুলো আবার মাচাঙের উপর তুলে রেখে বিছানাটা নামিয়ে নিলো।

কিছুদিন ধরে শীত পড়তে শুরু করেছে।

দিনের বেলা ঈষৎ গরম। শেষ বতে প্রচণ্ড শীত, হাড় কাপুনী শুরু হয়। কাঁথার নিচেও দেহটা ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে

এ সময়ে বাড়ির সবাই মাটির ভাড়ে ভুসির আগুন জ্বেলে মাথার কাছে রাখে। মাঝে মাঝে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আগুনটাকে উস্কে দেয়। আজকাল ভোর হওয়ার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠে যায় মন্তু। সোয়া দুটাকা দিয়ে কেনা খদ্দরের চাদরটা গায়ে মাথায় মুড়িয়ে নিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে মাঝি বাড়ির দিকে ছুটে সে। কদিন হলে করিম শেখ হাঁপানিতে পড়েছে। সারাদিন খুক খুক করে কাশে আর লম্বা শ্বাস নেয়।

মন্তু বলে এক কবিরাজ দেহাও মিয়া। করিম বলে, কিছু হয় না মিয়া, অনেক দেহাইছি। আম্বিয়া বলে, হাটে-গঞ্জে যাও ভাল দেইখা ডাকতর দেখাইতে পার না?

করিম শেখ চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। আজ সকালে মাঝি বাড়ির দিকে সবে রওয়ানা দিয়েছে মন্তু। দাওয়া থেকে মকবুল ডেকে বললো, রাইতের বেলা একটু সকাল কইরা ফিরো মন্তু মিয়া। হীরনের বিয়ার ফর্দ হইব আজই।

বাড়ির সকলকে আজ একটু সকাল সকাল ঘরে ফিরে আসতে বলে দিয়েছে বুড়ো মকবুল। বিদেশ থেকে মেহমানরা আসবে, ওদের খাতির যত্ন করতে হবে। আর আপ্যায়ন করে খাওয়াতে হবে ওদের। নইলে বাড়ির বদনাম করবে ওরা।

মন্ডুর উপরে আরো একটা ভার দিয়েছে মকবুল। নাও নিয়ে গিয়ে টুনিকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।

দু-এক দিনের মধ্যে নবীনগরে যাবে মন্তু। করিম শেখের শরীরটা একটু ভালো হয়ে উঠলেই নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে সে।

পথের দু’পাশের ক্ষেতগুলোতে কলাই, মুগ, মটর আর সরষে লাগানো হয়েছে। সারারাতের কুয়াশায় এই সকালে সতেজ হয়ে উঠেছে ওরা। রোদ পড়ে শিশিরের ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে ওদের গায়ে।

মাঝি-বাড়ির দেউড়ির সামনে আম্বিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মন্তুর। পুকুর থেকে এইমাত্র গোছল করে ফিরছে সে। ঘন কালো চুলগুলো থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে এখনো পানি ঝরছে। হাতের ভেজা শাড়িটার পানি নিংড়াতে নিংড়াতে আম্বিয়া বললো, মন্তু ভাই হুট কইরা চইলা যাইও না। পিঠা বানাইছি খাইয়া যাইও।

মন্তু বললো, এই সকাল বেলা গোছল করছে তোমার শীত লাগে না? আম্বিয়া একটু হাসলো শুধু। কিছু বললো না।

সারারাত মিয়া-বাড়িতে ধান ভেনেছে সে। এই শীতের রাতেও ধান বানতে গিয়ে সারা দেহে ঘাম নেমেছে ওর। পুরো গায়ের কাপড়ে ঘামের বিশ্রী গন্ধ। তাই সকাল সকাল গোসল করে নিয়েছে আম্বিয়া। খেয়ে-দেয়ে একটু পরে ঘুম দেবে সে। উঠবে সেই অপরাহ্নে। তারপর আবার মিয়া-বাড়ি চলে যাবে আম্বিয়া। ধান ভানবে, সারারাত।

মন্তুকে একটা পিঁড়িতে বসতে দিয়ে ওর সামনে এক বাসন পিঠা এগিয়ে দিলো আম্বিয়া। কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে করিম শেখ বললো, খাও মিয়া খাও। বলে আবার কাশতে শুরু করলো সে। আম্বিয়া তখন পাশের ঘরে গিয়ে একটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মাথার চুল ঝাড়ছে। মাঝে মাঝে বুড়ো ন্যুশেখের সঙ্গে কি যেন কথা বলছে সে।

বেড়ার খুপরি দিয়ে চোরা চাউনি মেলে ওকে দেখতে লাগলো মন্তু। অ্যাঁটসাঁট দেহের খাঁচে খাঁচে দুরন্ত যৌবন। আট হাতি শাড়ির বাঁধন ভেঙ্গে ফেটে পড়তে চায়। আজ আম্বিয়াকে বড় ভালো লাগছে মন্তর। চোখের পলক জোড়া ঈষৎ কেঁপে উঠলো।

হ্যাঁ, আম্বিয়াকে বিয়ে করবে সে। হোক হাঁপানি। সে পরে দেখা যাবে। বুড়ো মকবুলকে আজকেই ওর মনের কথাটা জানিয়ে দেবে মন্তু। সহসা একটা সিদ্ধান্ত করে বসলো সে।

করিম শেখ লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো, কি মিয়া হাত তুইলা বইসা রইলা যে?

মন্তু তাড়াতাড়ি একটা পিঠা মুখে পুরে দিয়ে বললো, হুঁ হুঁ এইতো খাইতাছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বাসনটা শূন্য করে দিলো মন্তু। কথাটা ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে করিম শেখ কাঁপা গলায় বললো, আমার বুঝি দিনকাল শেষ হইয়া আইলো মিয়া, আর বাম না।

আহা অমন কথা কয় না মিয়া। অমন কথা কয় না। পরক্ষণে ওকে বাধা দিয়ে মন্তু বললো, মরণের কথা চিন্তা কইরতে নাই। আয়ু কইমা যায়।

করিম শেখ তবু বিড়বিড় করে আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় শোক প্রকাশ করতে লাগলো।

 

রাতে এলো ওরা।

হিরণের বিয়ের ফর্দ হবে আজ।

মকবুলের বাইরের ঘরটাতে ফরাস পেতে বসানো হলো ওদের।

গনু মোল্লা বসলেন সবার মাঝখানে।

আবুল রশীদ আর সুরত আলী ওরাও বসলো সেখানে। বুড়ো মকবুল প্রথমে আসতে রাজী হয় নি। বলছিলো, তোমরা সবাই আছ, ভাল মন্দ যা বুঝ আলাপ কর গিয়ে। আমারে ওর মধ্যে টাইনো না। রশীদ বললো, কি কথা, আপনের মাইয়া আপনে না থাকলে চলবো কেমন কইরা?

ঘরের ভেতর থেকে বরের চাচা হাঁক ছাড়লো, কই, বেয়াই কই, তেনারে দেহি না ক্যান?

অবশেষে ঘরে এসে এককোণে গুটিমুটি মেরে বসে পড়লো মকবুল। প্রথমে মেহমানদের ভাত খাওয়ান হবে। তারপরে ফর্দ হবে বিয়ের। মন্তু এতক্ষণ সুযোগ খুঁজছিলো কখন বুড়ো মকবুলকে কিছুক্ষণের জন্যে একা পাওয়া যায়। তাহলে নিজের বিয়ের কথাটা ওকে বলবে সে। এই শীতে, হ্যা এই শীতেই বিয়ে করে ঘরে বউ আনতে চায় মন্তু। কিন্তু মকবুলকে একা পাওয়া গেলো না।

সারা বাড়িতে আজ ভিড়।

রান্না ঘরের ভিড়টা সবচেয়ে বেশি। বাড়ির মেয়ে-পুরুষ, কাচ্চা-বাচ্চা, সবাই গিয়ে জুটেছে সেখানে। সারাক্ষণ বকবক করছে। কার কথা কে শুনছে কিছু বোঝা যায় না।

হাঁড়িপাতিলগুলো একপাশে টেনে নিয়ে বসন বাসন ভাত বাড়ছে আমেনা।

হঠাৎ মন্তুকে সামনে পেয়ে আমেনা জিজ্ঞেস করলো, মানুষ কজন?

মন্তু বললো, আটজন।

আটজন! আমেনার মাথায় রীতিমত বাজ পড়লো। আটজনের কি ভাত রানছি আমি। আমি তো রানছি চাইরজনের। তোমার ভাইয়ে আমারে তারজনের কথা কইছিল।

বড় ঘর থেকে রান্না ঘরের দিকে আসছিলো মকবুল, কথাটা কানে গেলো ওর। পরক্ষণে ভিতরে এসে রাগে ফেটে পড়লো সে। আমি কি জাইনতাম, আটজন আইব ওরা? বারবার কইরা কইয়া দিছি চাইরজনের বেশি অইসেন না আপনেরা। ওরা তহন মাই নিছে। আর এহন- বলে ঠোঁট জোড়া বিকৃত করে একটা বিশ্রী মুখভঙ্গী করলো মকবুল, হালার ভাত যেন এই জন্যে দেহে নাই হালারা।

হইছে হইছে। আপনে আর চিায়েন না, থামেন। মেজ বউ ফাতেমা চাপা গলায় বললো, যান যা আছে তা দিয়ে একবার খাওয়ান। আমরা না হয় পরে খামু।

ফাতেমার কথায় শান্ত হয়ে চলে যাচ্ছিলো মকবুল, মন্তুর দিকে চোখ পড়তেই বললো, তাইলে মন্তু মিয়া তুমি কাইল পরশু একদিন নবীনগর যাও। কেমন?

মন্তু সংক্ষেপে ঘাড় নাড়লো।

নিজের কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সে। সহসা তার মনে একটা নতুন চিন্তা এলো। টুনি ফিরে এলে ওকে দিয়ে কথাটা মকবুলকে বলাবে মন্তু

খাওয়া-দাওয়া শেষে ফর্দ করতে বসলে সবাই।

প্রথমে উঠলে দেনা-পাওনার প্রশ্নটা।

বরের চাচা ইদন শেখ বললো, অলঙ্কার-পত্র বেশি দিবার পারমু না মিয়া। হাতের দুই জোড়া চুড়ি আর কানের দুইডা ঝুমকা।

গলার আর কমড়ের দিবো কে? সুরত আলী সঙ্গে সঙ্গে বললো, ওইগুলোও দিতে অইবো আপনেগোরে।

পায়েরটারে বাদ দিলা ক্যান মিয়া, অ্যাঁ? আবুল জোরের সঙ্গে বললো, পায়ের একজোড়া মলও দেওন লাগবে।

বুড়ো মকবুল নড়েচড়ে বসলো। সুরত আর আবুলের দিকে পরম নির্ভরতার সঙ্গে তাকালে সে।

বরের মামা আরব পটারী মৃদু হেসে বললো, এই বাজারে এতগুলান জিনিস দিতে গেলে কি কম টাকার দরকার মিয়া। আরো কম-সম কইরা ধরেন। আচ্ছা, পায়েরটা না হয় নাই দিলাম। মাঝখানে পড়ে মধ্যস্থতা করে দিলে রশীদ। বাকিগুলান তো দিবেন? হা তাই সই। সুরত আলী বললো, সোনার জিনিস তো আর দিবার লাগছে না, রূপার জিনিস দিবেন। তা মন কষাকষির কি দরকার?

মকবুল কিছুই বললো না। একপাশে বসে রইলো চুপ করে।

গনু মোল্লাও নীরব। নীরবে শুধু তছবি পড়ছেন ঢুলে ঢুলে।

গহনার কথা শেষ হলে পরে মোহরানার কথা উঠলো।

ইদন শেখ বললো, সব ব্যাপারে আপনাগোডা মাইনা নিছি। এই ব্যাপারে কিন্তুক আমাগোডা আইবো।

আহা কয়েন না শুনি। রশীদ ঘাড় ঝাঁকালো। ইদন বললো, মোহরানাডা পাঁচ টাকাই ধরেন।

পাঁচ টাহা? অ্যাঁ, পাচ টাহা কন কি? রীতিমত ক্ষেপে উঠলো সুরত। মাইয়া কি মাগনা পাইছেন নাহি অ্যাঁ। মাইয়ার কি কোন দাম নাই?

আহ, দাম আছে বইলাই তো পাঁচ টাহা কইবার লাগছি। নইলে কি আর তিন টাহার উপরে উঠতাম। আবার পাটারীর কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়লো। কণ্ঠস্বরে বিকৃতি এনে সে বললো, সকল দিক দিয়াই বাড়াবাড়ি করবার লাগছেন আপনারা। আচ্ছা যান, আরো আট আনা বাড়ায়া দিলাম। মোট সাড়ে পাঁচ টাহা।

না বিয়াই। তা অয় না, অইবো না। এতক্ষণে কথা বললো বুড়ো মকবুল। এত কম মোহরানায় মাইয়ারে বিয়া দিবার পারমু না বলে হঠাৎ কেঁদে উঠলো সে, মাইয়া আমার কইলজার টুকরা বেয়াই। কত কষ্ট কই মানুষ করছি। দুহাতে চোখের পানি মুছলো। মকবুল।

বিশ টাহা যদি মোহরানা দেন তালে মাইয়া বিয়া দিমু।

মকবুলের চোখের পানি দেখে অপ্রতিভ হয়ে গেলে সবাই। মাঝ রাত পর্যন্ত অনেক তর্কবিতর্কের পর সোয়া এগার টাকায় মিটমাট হলো সব। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে মেহমানরা বিদায় নিয়ে গেলো। মনে মনে খুশি হলো মকবুল। সোয়া এগার টাকা মোহনায় এর আগে এ বাড়ির কোন মেয়ের বিয়ে হয় নি।

নবীনগরের ছোট খালে এসে নাওয়ের নোঙ্গর ফেললো মন্তু।

খাল পাড়ে উঠে দাঁড়ালে টুনিদের বাড়ির লম্বা নারকেল আর তাল গাছগুলো দেখা যায়। আর সেই তাল নারকেলের বনের ফাঁকে ওদের দেউড়ি ঘরটাও চোখে পড়ে এখান থেকে।

নৌকো থেকে নামবার আগে মুখ হাত ভালো করে ধুয়ে নিলো মন্তু। পুরনো লুঙ্গিটা পালটে নিয়ে নতুন লুঙ্গিটা পরলো, ফতুয়াটা খুলে জামাটা গায়ে দিলো সে। তারপর খদ্দরের চাদরটা কাঁধে ফেলে, পুরনো ছাতাটা বগলে নিয়ে ধীরে ধীরে নৌকো থেকে নেমে এলো মন্তু।

কিছুদূর এসে পকেট থেকে টুপিটা বের করলো।

আসার সময় বুড়ো মকবুল বার বার করে বলে দিয়েছে; কুটুমবাড়িতে গিয়ে যেন মন্তু এমন কিছু না করে যার ফলে বাড়ির বদনাম হতে পারে। টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো মন্তু। পথঘাট জানা আছে ওর। এর আগে মকবুলের বিয়ের সময় একবার এসেছিল সে। দিন তিনেক থেকে গিয়েছে এখানে। রাস্তার দু’চারজন অপরিচিত লোক ঈষৎ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ওকে।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঝক ঝকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। একটু একটু করে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। এদিকের লোকেরা এর মধ্যে খেজুর গাছ কেটে রস নামাতে শুরু করে দিয়েছে। পথে আসতে তিন চারজন গাছুনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো মন্তুর।

ধারালো বাটাল দিয়ে গাছ কাটছে ওরা। তারপর মাটির কলসি ঝুলিয়ে দিয়ে নেমে আসছে গাছ থেকে।

টুনিদের বাড়ির সামনে এসে যার সঙ্গে মন্তুর প্রথম দেখা হলো সে টুনির চাচা মোতালেব শিকদার। সন্ধে বেলা গরু-বাছুরগুলোকে ঠেঙ্গিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে নিয় যাচ্ছিলো সে। মন্তুকে দেখে হা করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, মন্তু মিয়া না? কি মনে কইরা? মন্তু এগিয়ে এসে পা ধরে সালাম করলো ওর। তারপর বললো, ভাইজান পাঠাইছে, টুনু ভাবীরে নিবার লাইগা।

অ। মুখখানা ঈষৎ ফাঁক করে গরুগুলোকে ঠেঙ্গাতে ঠেঙ্গাতে আবার গোয়াল ঘরের দিকে চলে গেলো মোতালেব শিকদার।

একটু পরে আবার ফিরে এলো সে। বললো, আয়েন ভিতরে আয়েন। টুপিটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিলো মন্তু, তারপর শিকদারের পিছু পিছু ভেতর বাড়িতে এগিয়ে চললো সে।

দেউড়ির পাশে একখানা বাঁশের বেড়া দিয়ে বাইরের লোকদের কাছ থেকে ভেতর বাড়ির পর্দা রক্ষা করা হয়েছে। তারই পাশে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখের মধ্যে আঙ্গুল পুরে দিয়ে অলক চোখে দেখছে ওরা। ভেতর বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতে মন্তু দেখলো, ঘরের দাওয়ায় একটা বাঁশের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে টুনি। সারা মুখে ওর হাসি যেন উপচে পড়ছে। নীরবে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।

মন্তুকে টুনিদের ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল শিকদার।

রসুই ঘর থেকে টুনির মা বেরিয়ে এলেন বাইরে। মন্তু সালাম করলো তাকে।

মা বললেন, কইরে টুনি। মিয়ারে একখান জলচৌকি আইনা দে বউক।

চৌকি এনে দিলে দাওয়ায় বসলো মন্তু।

টুনির মা সবার কুশল জানতে চাইলো। টুনি কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলো না, শুধু মুখ টিপে বারবার হাসতে লাগলো সে।

টুনির মা বললো, টুনি তো কদিন ধইরা যাওনের লাগি উথাল পাথাল লাগাইছে। উঁ যাইবো। যামু না আমি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো টুনি।

মা বললো, দাঁড়ায়া থাইকো না। মিয়ার অজুর পানি দাও।

মন্তুর জন্যে হাত-মুখ ধোয়ার পানি আনতে চলে গেলো টুনি। মা-ও গেলো একটু পরে, বললো তরকারিটা নামায়া আই।

চারপাশটা তাকিয়ে দেখছিলো মন্থ। এক বছরে বেশ পরিবর্তন হয়েছে বাড়িটার। উঠোনের কোণে পাশাপাশি দুটো জাম গাছ ছিলো। কেটে ফেলা হয়েছে। রান্নাঘরের এ পাশটা নুয়ে পড়েছে এখন। আগে অমনটি ছিলো না। আগে গোয়াল ঘরটা পুকুরের পূর্ব পাশে ছিলো, এখন সেটা উত্তর পাশে সরিয়ে আনা হয়েছে।

টুনি এসে এক ঘটি পানি রাখলে ওর সামনে আর এক জোড়া খড়ম। বললো, হাতমুখ ধুইয়া নাও।

মন্তু মুখ হাত ধুয়ে নিলে ওর দিকে একটা গামছা বাড়িয়ে দিয়ে টুনি বললো, চল ভেতরে চল, বাইরে শীত পড়ছে।

মন্তু কোন কথা বললো না। শান্ত শিশুর মত ওকে অনুসরণ করে ভেতরে চলে গেলো সে।

পাশাপাশি দুটো ঘর। মাঝখানে একটা দরজা। ও পাশেরটাতে মা-বাবা থাকে আর টুনির ছোট দুই ভাইরোন। এ পাশের ঘরটা দেখিয়ে টুনি মৃদু হেসে বললো, এইডা আমার ঘর।

ওর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো মন্তু। ছোট ঘর মালপত্র ভরা। কয়েকটা বড় বড় মাটির ঘটি এক কোণে রাখা, তার পাশে তিন চারটে বেতের ঝুড়ি। ঝুড়ি ভর্তি লাল আলু রাখা আছে। দক্ষিণ কোণে একটা কাঠের চৌকি। চৌকির উপরে একটা কথা বিছানো। একটা তেল চিটচিটে বালিশ। চৌকির নিচে দুটো ছোট ছোট টিনের প্যাটরা। পশ্চিমের বেড়ার সঙ্গে একটা কাঠের তাক বসানো হয়েছে। তাকের উপরে রাখা আছে কয়েকটা ছোট ছোট মাটির ভাড় আর একটা মুড়ির টিন। তার পাশে বেড়ার সঙ্গে একটা ভাঙা আয়না ঝােলান। উত্তর কোণে একটা দড়ির সঙ্গে ঝুলছে টুনির দুখানা শাড়ি, একটা ময়লা কথা। তাছাড়া ঘরের ঠিক মাঝখানে গিলে কাঠের সঙ্গে কতগুলো ছিকে। ছিকের মধ্যে কয়েকটা হাঁড়িপাতিল রাখা। মন্তু মুহূর্তে চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো ঘরটার ওপর। টুনি চৌকিটা দেখিয়ে বললো, এইখানে বও।

মন্তু বসলো।

কিছুক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে টুনি বললো, অমন শুকায়া গেছ ক্যান?

মন্তু পরক্ষণে বললো, কই না, শুকাই নাই তো।

টুনি মৃদু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

মন্তুর মনে হলো এ কমাসে টুনি অনেক পাল্টে গেছে। ওর দেহ পা আগের থেকে অনেক ভারী হয়ে গেছে আর গায়ের রঙে একটা চিকচিকে আভা জেগে উঠেছে। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে টুনি।

রাতে টুনির ঘরে ওর শোবার বন্দোবস্ত হলো।

ময়লা কাঁথাটার ওপর ওর একখানা শাড়ি বিছিয়ে দিলো। বালিশটাকে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দিলো। তারপর বললো, আর বইসা থাইকো না শুইয়া পড়।

মন্তু বললো, বেহান রাইতে কিন্তুক রওয়ানা দিতে হবে।

ওর কথা শেষ না হতে শব্দ করে হেসে দিলো টুনি।

বললো, ইস, কইলেই অইলো। তারপর একটুকাল থেমেই আবার বললো, সে কম কইরা অইলেও তিনদিন আমাগো বাড়ি বেড়ান লাগবে। তারপরে যাওনের নাম।

মন্তু বললো, পাগল অইছ? তাহলে ভাইজানে মাইরা ফালাইবো আমারে। করিম শেখের নাও নিয়ে আইছি। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। টুনি বললো, যাই শুই গিয়া, কথা যা অইবার কাল সকালে অইবো। বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল সে।

কুপিটা নিভিয়ে দিয়ে একটু পরেই শুয়ে পড়লো মন্তু। করিম শেখের কথা মনে হতে আম্বিয়ার কথাও মনে পড়ছে তার।

এখান থেকে ফিরে যাওনের পথে টুনিকে সব বলবে মন্তু। টুনি নিশ্চয় এ ব্যাপারে সাহায্য করবে ওকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *