প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

৩০. হেরাদা ও সোরাবিয়ার তাড়নায়

হেরাদা ও সোরাবিয়ার তাড়নায় তাদের সওয়ার দল অনুসরণে ঢিলে দেয়নি। অক্লান্তভাবে চালিয়ে যথাসময়ের আগেই তারা কাক্‌সামালকায় পৌঁছেছে।

কিন্তু কোথায় তাদের শিকার?

গানাদো ফেলিপিলিও কি কয়া কারও সন্ধানই তারা পায়নি। পেয়েছে অবশ্য তাদের ঘোড়া দুটোর। পাহাড়ি সড়কের এক জায়গায় একটা অত্যন্ত খাড়াই পায়ে-হাঁটা পথের ধারের ছোট একটা কয়েক ঘর বসতির গাঁয়ের সামনে ঘোড়া দুটো ছাড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে।

কখন কারা ঘোড়া দুটোকে অমন জায়গায় ছেড়ে গেছে তার কোনও হদিস মেলেনি। হদিস দেবে কে? গাঁয়ে একটা মানুষ আছে যে তার কাছে খোঁজ মিলবে।

কোথায় গেল গাঁয়ের মানুষ? একটা নয়, দুটো নয়, পর পর কয়েকটা এমনই খাঁ-খাঁ গাঁ আর বসতি পার হওয়ার পর গাঁয়ে মানুষ না থাকার মানেটা বোঝা গেছে।

গাঁয়ে মানুষ পাওয়া যাবে কেমন করে? সব মানুষ তো সেই পাহাড়ি রাস্তায়!নারীপুরুষ ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি সব যেন আগুন-লাগা গাঁ থেকে হুড়মুড় করে ছুটে পালাচ্ছে নীচের দিকে।

এই একটা নতুন ঝামেলা মাঝরাস্তা থেকে এসপানিওল দলকে পোহাতে হয়েছে। বটে।

কুজকো থেকে মাঝরাস্তা পর্যন্ত আসার কোনও অসুবিধেই হয়নি। পাহাড়ি সড়ক একদম ফাঁকা। একটা আধটা এদেশি পথিক যদি বা সে পথে তখন চলে থাকে তারাও সওয়ার বাহিনীর ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ পেয়ে যেখানে পেরেছে, লুকিয়েছে। চোখে আর তাদের দেখা যায়নি।

এখন কিন্তু এসপানিওলদের সম্বন্ধেও ভয়ডর যেন তাদের নেই। কিংবা সওয়ার বাহিনীর চেয়ে আরও ভয়ংকর কিছুকে এড়াবার জন্যে তারা যেন মরিয়া হয়ে ছুটে পালাচ্ছে। দূর থেকে শুধু আওয়াজ পেলে যারা ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না তাদের ভিড় ঠেলে সওয়ার বাহিনীর ঘোড়া চালানোই দায় হয়ে উঠেছে।

এত ভয়টা তাদের কীসের?

সত্যি কোনও গ্রামে কোথাও আগুন তো লাগেনি। এ অঞ্চলে যা সবচেয়ে আতঙ্কের সেই ভূমিকম্প বা পাহাড়ের ধস নামারও কোনও চিহ্ন কোথাও নেই।

ফেলিপিলিও ছেড়ে যাবার পর সোরাবিয়া আর হেরাদার বাহিনীতে দোভাষী কেউ নেই। দু-চারজন সেপাই এ অভিযানে এসে সামান্য দু-চারটে এদেশি শব্দ শিখেছে মাত্র।

কাতারে কাতারে যারা নামছে এ দেশের সেই গ্রামাঞ্চলের লোকেদের কাছে জিজ্ঞাসাপত্র করে কিছুই তাই ভাল করে বোঝা যায়নি।

তারা শুধু সভয়ে কুজকোর দিকে আঙুল নেড়ে কী যেন বলেছে! যা বলেছে তার মধ্যে রেইমি কথাটা শুধু বার বার উচ্চারণের জন্যে কানে লেগেছে! তাতে এইটুকু বোঝা গেছে যে কুজকো শহরে রেইমি উৎসব সংক্রান্ত কোনও একটা ব্যাপার তাদের কাছে বিভীষিকা। সেই জন্যেই তারা সমস্ত পার্বত্য রাজ্যই ছেড়ে যত দূরে সম্ভব পালাবার চেষ্টা করছে।

এসপানিওল সওয়ার দল কাক্‌সামালকার দিকে যত অগ্রসর হয়েছে সংকীর্ণ পার্বত্য পথে এই শঙ্কিত পলাতক আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় তত বেড়ে উঠেছে। চারিদিকের গ্রামাঞ্চল থেকে বহুধারায় নেমে এসে মূল জনস্রোতে যুক্ত হয়ে তারা যেন সমতলের দিকে মানুষের ঢল সৃষ্টি করেছে।

মারধর, ধমক, হুমকিতে কোনও ফল হয়নি। যা তাদের ভিটেমাটি সব কিছু ছাড়িয়ে দিশাহারা করে ছোটাচ্ছে সে তাড়না এসপানিওলদের সম্বন্ধে আতঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল।

সে তাড়না যে কীসের তা কামালকায় পৌঁছোবার পর কিছুটা জানা গেছে, কিন্তু তার আগে সোরাবিয়া ও হেরাদার কুজকো থেকে সারা পথ ধাওয়া করে আসার

সমস্ত উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে গেছে তাইতে।

জনতার এই বন্যাস্রোতের মধ্যে কোথায় খোঁজ করবে গানাদো আর তার সঙ্গীদের? একেবারে হাতের মুঠো থেকে হঠাৎ তারা পিছলে পালিয়েছে অপ্রত্যাশিত এই দৈবদুর্বিপাকে।

কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই অমন দৈবাধীন? কামালকায় কোনওরকমে গিয়ে পৌঁছে সোরাবিয়া এই আকস্মিক জনবন্যার কারণ কিছুটা জানতে পেরেছেন। সংক্রামক মহামারীর মতো কাক্‌সামালকার অধিবাসীদের মধ্যেও তখন এক দুর্বোধ্য বিভীষিকার ছোঁয়াচ লেগেছে। কুজকোর পথে যারা নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাতারে কাতারে কাক্‌সামালকার অধিবাসীরাও সমতলের দিকে নামতে শুরু করেছে।

ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এসপানিওল সেনাপতি পিজারোকেও না ভাবিয়ে তুলে ছাড়েনি। তাঁরই উদ্বিগ্ন অনুসন্ধানের ফলে এইটুকু জানা গেছে যে রেইমির উৎসব যা দিয়ে সূচিত হয় উত্তরায়ণের সেই সূর্য বরণ অনুষ্ঠান পেরুর ইতিহাসে এই প্রথম পণ্ড হওয়ার ঘটনা আকাশপতি পরম জ্যোতির্ময়ের চরম অভিশাপ বলে এ দেশের মানুষ তাদের অন্ধ কুসংস্কারে ধরে নিয়েছে। এ অভিশপ্ত কলুষিত ঊর্ধ্বলোক ছেড়ে তাই তারা ছুটে চলেছে সমতলের সমুদ্রতটে। সেখানে সমস্ত সৃষ্টির যিনি উৎস পাচাকামাক বা ভীরাকোচা নামে পূজিত সেই দেবাদিদেবের মন্দিরে তাভান্‌তিন্‌সুইয়ুর শাপমুক্তির জন্যে তারা ধরনা দেবে। ভীরাকোচা যদি দয়া করেন তবেই সূর্যদেবের কোপ দূর হয়ে এ দেশ অভিশাপ মুক্ত হতে পারে। তা না হলে উত্তুঙ্গ তুষারমৌলি-গিরিশিখরে বেষ্টিত সূর্যদেবের পরমপ্রিয় এ দেশ ধ্বংস হয়ে সমুদ্রের জলে তলিয়ে যাবে।

সমতলের সমুদ্রতীরের দিকে আকস্মিক জনবন্যার এ ব্যাখ্যা পেয়ে পিজারো সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি উদ্বিগ্ন ও বেশ একটু শঙ্কিতই হয়েছেন। সোরাবিয়া ও হেরাদার কাছে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর তখন তিনি পেয়েছেন। হঠাৎ এ হত্যার। কারণ কী হতে পারে তিনি ভেবে পাননি। পরামর্শ সভা ডেকেও তিনি বিফল হয়েছেন। নানাজনের কাছে সব কটি আকস্মিক ব্যাপারের নানা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ঘটনাগুলির মধ্যে এ রাজ্যের নতুন কোনও অভ্যুত্থানের গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে সন্দেহ করেছে কেউ কেউ। পিজারোর নিজেরও সেরকম একটু সন্দেহ যে হয়নি এমন নয়। কিন্তু হুয়াসকার-এর অপ্রত্যাশিত হত্যার সঙ্গে অভিশপ্ত বলে দেশ ছেড়ে পালাবার এ উন্মত্ততার সম্পর্ক কী হতে পারে? রেইমির উৎসব পণ্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অভিশাপের আতঙ্ক কি আপনা থেকেই এ দেশের মানুষের মনে এমন দারুণ ও তীব্র হয়ে উঠেছে?

তা বোধহয় হয়নি।

ভাল করে খোঁজ নিলে পিজারো জানতে পারতেন যে অভিশাপের যে আতঙ্ক দিশাহারা ভয়োন্মত্ত পেরুবাসীর এ ঢল সাগরতীরের দিকে নামিয়েছে তার প্রথম উদ্ভব বেশ একটু রহস্যময়।

কুজকো শহরে রেইমি উৎসব অনুষ্ঠান পণ্ড হয়েছে। কিন্তু এ আতঙ্কের ঢেউ সেখান থেকে তো ওঠেনি। উঠেছে হঠাৎ কুজকো থেকে কামালকা নামবার পথে মাঝ রাস্তায়।

কুজকোয় হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদের ধার থেকে চুরি করে-আনা ঘোড়া দুটো যেখানে পাওয়া গেছে তার কাছাকাছি থেকেই যে অভিশাপের আতঙ্কটা প্রথম জাগতে শুরু করেছে এটুকু অন্তত সোরাবিয়া ও হেরাদারও খেয়াল করা উচিত ছিল।

ওই অঞ্চলের সকলকে ভয়ে দেশছাড়া করবার মতো ঘটনাটা হঠাৎ ওইখানেই কেন প্রথম শোনা গেছে তা বোধহয় তাহলে সোরাবিয়ার পক্ষে আঁচ করা খুব কঠিন হত না।

সোরাবিয়ার সে খেয়াল কিন্তু হয়নি। আতঙ্কবিহ্বল জনস্রোতের দরুন গানাদোকে ধরার এত বড় সুযোগটা তার নষ্ট হয়েছে এইটিই তার মনের জ্বালা। সে স্রোত-সৃষ্টিতে যে গানাদোর হাত থাকতে পারে তা সোরাবিয়া কল্পনাই করেনি।

হ্যাঁ, সমস্ত ব্যাপারটার মূলে গানাদোই আছেন। সোরাবিয়ার হিংস্র অনুসরণকে ব্যর্থ করার এই কৌশলই তাঁর হঠাৎ মাথায় এসেছে। এসেছে পাহাড়ের চূড়া থেকে অমোঘ নিয়তির মতো সওয়ার বাহিনীকে আসতে দেখার পর কয়ার কাছে। নিজেদের নিরুপায় অবস্থাটা বুঝিয়ে বলবার সময়।

নির্জন পার্বত্য পথে তাঁরা ছাড়া আর কোনও রাহি নেই বলেই সোরাবিয়ার দলের পক্ষে তাঁদের ধরে ফেলা অনিবার্য, তিনি হতাশভাবে বোঝাচ্ছিলেন। সেই হতাশার অন্ধকারে হঠাৎ নিজের যুক্তি থেকেই আশার আলো তিনি দেখতে পান।

পার্বত্য পথ নির্জন বলেই তাঁদের ধরা পড়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ পথে যদি হঠাৎ জনস্রোত বইতে শুরু করে?

এ অঘটন ঘটাবার উপায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেবে বার করেছেন গানাদো। এসপানিওল বাহিনী তখনও কমপক্ষে একবেলার পথ পিছিয়ে আছে। গানাদো তাঁদের ঘোড়া দুটিকে সেখানেই ছেড়ে দিয়ে কাছাকাছি প্রথম যে গ্রামাঞ্চল পেয়েছেন। সেখানেই চলে গেছেন সাধারণ পেরুবাসীর সাজে।

তাঁর নিজের ও ফেলিপিলিওর দুজনের চেহারা পোশাক ঠিক গ্রামাঞ্চলের মানুষের মতো নয়। কিন্তু তাতে অসুবিধের বদলে সুবিধেই হয়েছে। কুজকোর সমৃদ্ধ সম্ভ্রান্ত ঘর থেকেই যেন তাঁরা আসছেন এইভাবে গানাদো গ্রামের মানুষের মধ্যে রেইমির উৎসব পণ্ড হওয়া ও হুয়াসকার-এর হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে সমস্ত দেশ অভিশপ্ত হওয়ার রটনা শুরু করেছেন।

বিদেশি এসপানিওলরা এ পুণ্যভূমি তাদের পাপস্পর্শে অপবিত্র করার পর থেকে যা যা ঘটেছে তাতে দেশের মানুষের মন এমনিতেই দাহ্য হয়ে ছিল—রেইমি উৎসব পণ্ড হওয়ার সংবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে কুপিত সূর্যদেবের অভিশাপ সম্বন্ধে রটনায় তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

আর্ত দিশাহারা মানুষের যে বন্যাস্রোত তারপর পাহাড়ের পথ দিয়ে নেমে গেছে। তার মধ্যে গানাদোর ফেলিপিলিও আর কয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে নিজেদের মিশিয়ে দিতে কোনও অসুবিধাই হয়নি।

কাক্‌সামালকা পর্যন্ত তো বটেই, সেখান থেকে টম্‌বেজ বন্দর অবধি পাচাকামাক-এর মন্দিরে ধরনা দিতে যাওয়া ব্যাকুল অস্থির তীর্থযাত্রীদের মধ্যে তাঁরা বেমালুম গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছেন।

টম্‌বেজ বন্দরে একটু বিপদ হতে পারত। কিন্তু গানাদো আর তার সঙ্গীদের পালাবার কৌশলটা তখনও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। কামালকা ছেড়ে যাবার পর পাচাকামাকের মন্দিরের পথে ভীত অস্থির যাত্রীদের ওপর তেমন নজর রাখা হয়নি। টম্‌বেজ বন্দরে কোনও পাহারাও ছিল না।

থাকলেও একটি মেয়ে আর একটি পুরুষ গোলাম নিয়ে পানামায় বেচতে যেতে কেউ বাধা পেত না বোধহয়। এরকম ক্রীতদাস ক্রীতদাসী তখন প্রতি জাহাজেই চালান হতে শুরু করেছে।

টম্‌বেজ বন্দরের একটি জাহাজে এমনই এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক জোড়া দাস-দাসী দেখা গেছল।

কে এই ব্যবসাদার?

না, গানাদো নয়। এই ভূমিকাটা ফেলিপিলিওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে, গানাদো কয়া-র সঙ্গে গোরু ঘোড়ার মতো বেচাকেনার গোলামই সেজেছেন।

ফেলিপিলিও তাতে আপত্তি করেছিল প্রবলভাবে। কিন্তু গানাদো হেসে তাকে বুঝিয়েছিলেন যে ফেলিপিলিও নিজে যাতে অনভ্যস্ত সেই ক্রীতদাসের ভূমিকাটা তাঁর কাছে নতুন নয়। এ ভূমিকায় তিনি পাকা, তাই তার দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার সঙ্গে ভালরকম পরিচয়ই তাঁর আছে।

এই সূত্রে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই সমুদ্রপথেরই আগেকার একটি দুর্ভেদ্য রহস্যের তিনি নিজে থেকেই মীমাংসা করে দিয়েছিলেন।

এই অজানা পশ্চিম মহাসাগরে নাখোদা বার্থলোমিউ রুইজ দ্বিতীয় বার পিজারোর অভিযানের নৌ-সেনাপতি হয়ে এসে এ দেশের অদ্ভুত পালতোলা সমুদ্রযাত্রী ভেলা থেকে দোভাষী হিসেবে একটি লোককে নিজের জাহাজে তুলে নেন। টম্‌বেজ বন্দরে ঘুরে পিজারো যে দ্বীপে ছিলেন সেখানে জাহাজ ভেড়াবার পর সেই দোভাষী আশ্চর্যভাবে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।

নিখোঁজ হবার কৌশলটা এবার প্রকাশ করে দিয়েছিলেন গানাদো। তিনি জাহাজ থেকে কোথাও পালিয়ে যাননি। কেউ তাঁর খোঁজ না পেলেও তিনি জাহাজের ভেতরেই ছিলেন। ছিলেন মরণাপন্ন রোগী সেজে মৃত একজন সৈনিকেরই বিছানায়। তখনকার দিনে জাহাজে অসুস্থ না হলে কেউ বিছানা নিত না, আর বিছানা নিলে তা থেকে ওঠবার আশা কেউ করত না। কারণ রোগীদের শুশ্রুষার কি চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না জাহাজে।

পিজারোকে যে দ্বীপ থেকে রুইজ তুলে নিতে গিয়েছিলেন সেখানে জাহাজ ভেড়াবার সময় দু-জন নাবিক রুইজের জাহাজে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। নিজে থেকে তাদের একটু দেখাশোনা করতে গিয়ে গানাদো একজনকে মৃত অবস্থায় দেখেন! তাই থেকেই সম্পূর্ণভাবে আত্মগোপন করে পানামায় নামার উপায়টা তাঁর মাথায় আসে।

অন্য নাবিকেরা যখন দ্বীপে নেমে আমোদ আহ্লাদে ব্যস্ত সেই সময়ে জাহাজে উঠে এসে গানাদো মৃত সৈনিকটির যথাযযাগ্য সমুদ্র সৎকারের ব্যবস্থা করেন। তারপর তার রোগশয্যাই গানাদোর জন্যে সন্ধানের অসাধ্য গোপন আশ্রয় হয়ে ওঠে। রোগী হিসেবে তাঁর দিকে কেউ একবার দৃষ্টিপাতও করেনি। নেহাত দয়া করে কখনও একটু পান করার জল বা সামান্য কিছু খাদ্য কেউ কখনও রেখে গেছে। সেই ভাবেই সেবার পানামা পর্যন্ত পৌঁছে তিনি সুযোগ বুঝে জাহাজ থেকে সকলের অগোচরে এক সময়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া দোভাষী সম্বন্ধে খোঁজ হয়েছে, কিন্তু একটা মুমূর্ষ রোগীর অন্তর্ধান নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।

একা হলে, আর সুযোগ থাকলে এবারেও সেইরকম রোগী সেজে সকলের চোখের আড়ালে থাকার ব্যবস্থাই পছন্দ করতেন গানাদো। সে সুযোগ হয়তো হতে পারত, কিন্তু সঙ্গে কয়া আছে। তাকে নিরাপদ রাখবার জন্যেই তার সঙ্গে থাকা একান্ত প্রয়োজন। পাখির মতো হৃদয় যার কোমল, পাশে থেকে সাহস না দিলে এই অবিশ্বাস্য অমানুষিক পরিবেশে ভয়ে হতাশাতেই সে নিশ্চয় মারা পড়ত।

জাহাজে যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ অবশ্য কোনও ভয় নেই। গোরু-ছাগলের মতো ক্রীতদাসদের যেখানে প্রায় খাঁচাবন্দি করে রাখা হয় সেখানে তাদের দিকে দৃষ্টি দেবার উৎসাহ কারও হয় না।

বিপদ জাহাজ থেকে ক্রীতদাস হিসেবে নামবার পর। পানামার বন্দরে আগে থাকতে বাছাই করে চিহ্নিত করে রাখবার জন্যে ক্রীতদাসের ব্যাপারীদের দালালরা জাহাজ ভিড়তেনা-ভিড়তে এসে হাজির থাকে।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ক্রীতদাসের চেহারা তাকত যাচাই করে দেখাই তাদের পেশা। তারা নেহাত বুড়ো হাবড়া বা রুগ্ন না হলে অবহেলাভরে কাউকে বাদ দেয় না। একবার তাদের নজর পড়ে গেলে আর নিস্তার নেই।

দাদন দিয়ে তারা বাছাই করা গোলামকে তখনই অর্ধেক কিনে রাখতে পারে। জাহাজে করে ক্রীতদাস-দাসী যে আনে তারও তখন সাধ্য নেই সে দাদন নিতে অস্বীকার করে। ইচ্ছা করলে ব্যাপারী বা তার দালাল দাদন না দিয়ে পুরো দামে গোলামকে কিনেও নিতে পারে।

তিনি নিজে না হলেও পানামার যাত্রী জাহাজ পৌঁছোবার পর কয়া এমনই কোনও দালালের চোখে ধরে যেতে পারে এই ছিল গানাদোর সব চেয়ে বড় ভয়।