প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

২০. দিনের আলোর জন্যে অপেক্ষা

দিনের আলোর জন্যে অপেক্ষা করা কিন্তু সে রাত্রে এক দুঃসহ ধৈর্যের পরীক্ষা বলে মনে হয়েছিল।

মূৰ্ছিতা বন্দিনীকে বালির ওপর শোয়াবার পরে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে প্রথমে ঝরনার জলে মুখে চোখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করেছিলেন গানাদো।

জ্ঞান তাতে ফেরেনি। মেয়েটির গলায় একটা অস্ফুট গোঙানিই শুধু শোনা গিয়েছিল।

গানাদো মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া বন্ধ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল নিদারুণ আতঙ্কে মেয়েটির চেতনা অসাড় হয়ে গিয়ে একটা গাঢ় আচ্ছন্নতার মধ্যে সে ড়ুবে আছে। এ আচ্ছন্নতাই তার একরকম শুশ্রুষা। হঠাৎ তা ভাঙাতে গেলে বিপরীত প্রতিক্রিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। চেতনার সূক্ষ্ম স্তরে সচকিত আঘাত হয়ে স্থায়ী ক্ষতিই করতে পারে।

বন্দিনীকে তাই সম্পূর্ণভাবে বিশ্রাম করতে দিয়ে গানাদো নীরব অতন্দ্র পাহারায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন।

ধীরে ধীরে তাভানতিনসুইয়ুর দেবাদিদেবের প্রথম সুবর্ণকিরণ স্পর্শ করেছে কাক্‌সামালকার গিরিপ্রাকার চূড়া।

সে সোনালি ঈষৎ রক্তিম আলো তারপর ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ের কোলে। গানাদো সবিস্ময়ে ঝরনার ধারে বালির শয্যায় শোয়ানো বন্দিনীর দিকে। চেয়েছেন।

না, দিনের আলোয় অপ্সরা-অস্ফুট স্বপ্ন কায়ার মতো সে মূর্তি শূন্যে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু তখনও এক অপার্থিব লাবণ্যের আভায় তাকে যেন মণ্ডিত মনে হয়েছে। সূর্যালোকের স্পষ্টতাতেও সে তার রহস্যময়া হারায়নি।

সেই মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকতে থাকতে গানাদো গাঢ় নীল জলে পদ্মকোরকের মতো দুটি চোখ উন্মীলিত হতে দেখেছেন।

বন্দিনী প্রথমে বিস্মিত বিহ্বলভাবে একবার তার পরিবেশ আর একবার গানাদোর দিকে চেয়েছে।

তারপর তার মুখ অকস্মাৎ পাণ্ডুর হয়ে উঠেছে আতঙ্কে। সর্পাহতের মতো সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে বসে শঙ্কিত অস্ফুট চিৎকারে কী যেন বলে সে ছুটে পালাবার চেষ্টা করেছে।

সাধ্যে কিন্তু তার কুলোয়নি। দাঁড়িয়ে উঠে এক-পা যেতে না-যেতে সে টলে পড়ে গেছে। তারপর অনিবার্যভাবে এগিয়ে আসা অজগরের সামনে পাখা-ভাঙা পাখির মতো দৃষ্টিতে গানাদোর দিকে চেয়ে আবার আকুল আর্তনাদে যা বলেছে গানাদো তার কিছুই বুঝতে পারেননি।

এ রাজ্যের ভাষার সঙ্গে গানাদো নিজের চেষ্টায় ভালভাবেই পরিচিত। কিন্তু এই মেয়েটির অপরূপ অপার্থিব কণ্ঠে যে ভাষা শোনা গেছে, তা তাঁর সম্পূর্ণ অজানা। তার কণ্ঠের মতো সে ভাষাও যেন অপার্থিব।

গানাদো তাঁর বিচক্ষণতার দরুন একটি ভুল এড়াতে পেরেছেন। এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ধরবার চেষ্টা দূরে থাক, একটা হাত নেড়েও তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা তিনি করেননি।

যেখানে ছিলেন, সেখানে নিথর নিস্পন্দ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর যা জানা সেই কুইচুয়া ভাষায় শান্তস্বরে মেয়েটিকে অস্থির আতঙ্কবিহ্বল না হতে অনুরোধ করেছেন। বলেছেন যে, অবুঝ অস্থির হলে তার বিপদ বাড়বে বই কমবে। তিনি যে মেয়েটির শত্রু নন, এ কথা তার পক্ষে বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব, তিনি জানেন। যারা মেয়েটির ও তার আপনার জনের ওপর পৈশাচিক নির্মমতা দেখিয়েছে, তার চরম সর্বনাশের চেষ্টা যারা করেছিল, তাঁর নিজের অঙ্গে তাদেরই দলের পোশাক। তিনি তাদের দলেরও বটে। তবু দলের মধ্যে সবাই একরকম হয় না। তাঁকে মেয়েটি কখনও যে বিশ্বাস করবে এমন আশা তিনি করেন না, তিনি শুধু চান যে, সে যেন তাঁকে পরীক্ষা করে দেখে নিতে দ্বিধা না করে।

মেয়েটি কুইচুয়া ভাষায় তাঁর কথা বুঝেছে কি না গানাদোর পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর শান্ত গলার স্বর ও বলার ধরনে কিছু বোধহয় কাজ হয়েছে।

মেয়েটির মুখের আতঙ্ক-পাণ্ডুরতা কেটে গেছে অনেকখানি।

কাছে যাওয়ার বদলে আরও একটু দূরে সরে গিয়ে ঝরনার ধারে একটি পাথরের ওপর বসে এবার গানাদো সংক্ষেপে গত রাত্রের ঘটনার কথা বলেছেন। কীভাবে তার আর্ত আবেদন শুনে পাষণ্ড এসপানিওলের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করেছেন তারও আভাস দিয়েছেন একটু।

মেয়েটি কুইচুয়া ভাষা জানে কি না তখনও বুঝতে পারেননি গানাদো, তার মুখে শঙ্কা-বিহ্বলতার জায়গায় যে বিমূঢ় কৌতূহলের আভাসটুকু এবার ফুটে উঠেছে তাতে গানাদোর কথা তার একেবারে অবোধ্য হয়নি এইটুকু শুধু মনে হয়েছে।

বেলা বাড়ছে। এ পার্বত্য অঞ্চল সাধারণত নির্জন ও নিরাপদ, তবুনগরের বর্তমান অবস্থায় নিশ্চিন্ত নির্ভয় হয়ে কোনও জায়গাতেই থাকা যায় না।

গানাদো তাই একটু ব্যস্ত হয়েই মেয়েটিকে গোপন গুহাশ্রয়ের কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যে সে গুহা তিনি মেয়েটিকে দেখিয়ে দেবেন শুধু, সেখানে তাকে অনুসরণ করবেন না। সারারাত বাইরে থেকে তাকে পাহারা দেবেন আর যতদিন না এ শত্ৰুপুরী থেকে তাকে মুক্ত করতে পারেন ততদিন এই গোপন আশ্রয়ে যথাসাধ্য স্বাচ্ছন্দ্যে তাকে রাখবার চেষ্টা করবেন।

হঠাৎ চমকে উঠে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেননি গানাদো।

মেয়েটি ভাঙা-ভাঙা কুইচুয়াতেই তাঁকে বলছে, তুমি কি উদয়-সমুদ্র-তীরের মানুষ?

বেশ কয়েক মুহূর্তের বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে ছিলেন গানাদো।

মেয়েটি তাঁর বোধ্য কোনও ভাষায় কথা বলতে পারে বলেই তিনি আশা করেননি। তার ওপর এরকম অদ্ভুত একটা প্রশ্ন তার পক্ষে করা সম্ভব, এ কল্পনাই তাঁর ছিল না।

অবাক হয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কুইচুয়া। ভাযায়, এমন অদ্ভুত প্রশ্ন হঠাৎ তুমি করলে কেন? উদয়-সমুদ্র বলতে কী বোঝে তুমি?

মেয়েটির মুখে গানাদোর পালটা প্রশ্নে প্রথমে কীরকম একটা অপ্রতিভ অস্বস্তি ফুটে উঠেছিল।

হঠাৎ নিজের ওইটুকু প্রগলভতার জন্যেই যেন লজ্জিত হয়ে সে শুধু কাতরভাবে মাথা নেড়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে এ বিষয়ে আর কিছুই সে বলতে চায় না।

না, তোমার ভয় কিছু নেই। গানাদো তাকে স্নিগ্ধ স্বরে উৎসাহ দিয়েছিলেন, পরস্পরের কথা যে আমরা বুঝতে পারছি এই আমাদের দুজনেরই সৌভাগ্য। এ সৌভাগ্য যেন বিফল না হয়। নির্ভয়ে যা বলবার তুমি বলো। বলো উদয়-সমুদ্রের কথা কী তুমি জানো?

তেমন কিছুই জানি না! গানাদোর আশ্বাসে ধীরে ধীরে সাহস পেয়ে সরল মধুক্ষরা কণ্ঠে বলেছিল মেয়েটি, শুধু দেবাদিদেব বিশ্বজ্যোতি প্রতিদিন যে-সমুদ্র থেকে স্নান করে আকাশ-সোপানে ওঠেন তারই তীর থেকে কেউ একদিন এসে এ রাজ্যের চরম অভিশাপের দিনে আমার পরম সহায় হবে এই আমি শুনেছিলাম—

মেয়েটির কথায় বাধা না দিয়ে পারেননি গানাদো। গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে তার কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলেন, উদয়-সমুদ্র-তীর থেকে কেউ এসে তোমার সহায় হবে শুনেছিলে? কার কাছে? কীভাবে?

আগ্রহের তীব্রতায় গানাদো উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা বুঝি এগিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটির দিকে।

মেয়েটিও উঠে দাঁড়িয়েছিল আপনা থেকেই। কিন্তু এক পা পিছিয়ে গিয়েই সে থেমে গিয়েছে। তারপর মিনতির স্বরে বলেছে, আমার কাছে এসো না। যা বলবার আমি সবই বলছি।

সজাগ হয়ে গানাদো নিজেই তখন থেমে পড়েছেন। লজ্জিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, আমায় মার্জনা করো। যেটুকু তুমি বলেছ তাতেই বিস্ময়ে কৌতূহলে উত্তেজনায় আমি একটু আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সব কথা না শুনলে আমার স্বস্তি নেই। তবু এখন আমায় আত্মসংবরণ করতে হবে। এখানে প্রকাশ্য জায়গায় আর তোমার থাকা নিরাপদ নয়। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করে শুধু আমায় অনুসরণ করো।

একটু থেমে মেয়েটিকে তখনও দ্বিধা করতে দেখে আবার বলেছিলেন, উদয়-সাগরের তীরের কেউ তোমার সহায় হবে এ গণনার কথা কোথায় কার কাছে তুমি শুনেছ জানি না। এ গণনা সত্য কি না তা-ও বিচারের ক্ষমতা আমার নেই। এইটুকু শুধু তোমায় জানাচ্ছি যে যাদের দলে আমায় দেখছ তাদের দেশের মানুষ আমি নই। সত্যিই বহু বহু দূরের উদয়-সাগরের তীর থেকেই আমি আসছি। এইটুকু জেনে আমায় বিশ্বাস করলে তোমার ক্ষতি হবে না।

মেয়েটি কী বুঝেছিল বলা যায় না। কিন্তু এবারে দূর থেকে হলেও গানাদোকে অনুসরণ করতে সে আপত্তি করেনি।

গুহা মুখের গুপ্ত পথের কাছে পৌঁছে সেটি নির্দেশ করে দেখিয়ে গানাদো যা করেছিলেন তাতে মেয়েটি পর্যন্ত বিস্মিত চমকিত হয়ে উঠেছিল।

হঠাৎ কোমর থেকে তাঁর ছোরাটা খুলে নিয়ে মেয়েটির কাছে ছুড়ে দিয়ে তিনি শান্ত দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন, যে গুপ্তপথ দেখিয়ে দিলাম তা দিয়ে গুহার ভেতর নির্ভয়ে চলে যাও। এবার ওই সামান্য অস্ত্রটাও তুলে নিয়ে যাও। আমিই হই বা আর যে কেউই হোক, দুর্জন হিসেবে আক্রমণ করলে ওই অস্ত্রে তাকে রুখতে হয়তো পারবে না, কিন্তু জীবনের চেয়ে যার মূল্য বেশি নিজের সেই মর্যাদা তো বাঁচাতে পারবে ওই অস্ত্রটুকুর সাহায্যে!

মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকেছিল গানাদোর মুখের দিকে চেয়ে।

কিন্তু তখন তার চোখের দৃষ্টিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ছায়া আর নেই। তার বদলে বিস্ময় মেশানো একটা কৃতজ্ঞ নির্ভরতার আভাস ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

খানিক বাদে ছোরাটি তুলে নিয়ে মেয়েটি গানাদোর নির্দেশ করা গুপ্ত পথ দিয়ে উঠে গুহামুখের দিকে যেতে শুরু করেছিল। গানাদো কিছু দূরে নীচেই ছিলেন দাঁড়িয়ে।

বিরাট একটি পাথরের চাঁই-এর আড়ালে মেয়েটি অদৃশ্য হবার আগে গানাদো হঠাৎ কে ডেকেছিলেন!

শোনো।

মেয়েটি একটু চমকে ফিরে দাঁড়িয়েছিল।

কয়েকটা কথা তোমায় বলে যেতে চাই, বলেছিলেন গানাদো, গুহাপথে তোমায় আমি অনুসরণ করব না। এখান থেকেই বিদায় নেব এখনই। সারাদিন আমায় নিজেদের শিবিরে থাকতে হবে। তারপর আবার রাত্রে গোপনে শিবির ছেড়ে এসে তোমায় আমি পাহারা দেব। যতদিন তোমায় এ পাপ নরক থেকে উদ্ধার করতে না পারি ততদিন এই হবে প্রতিদিনের নিয়মিত ব্যবস্থা। আজ সারাদিনের জন্যে তোমায় উপবাসীই থাকতে হবে বুঝতে পেরেছি। এখানে ঝরনাধারা বইছে। গুপ্ত পথের মুখ থেকে ভাল করে চারিদিক লক্ষ করে নিরাপদ বুঝলে তার জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারো। রাত্রে আমি তোমার জন্যে আহার্য কিছু নিয়ে আসব। নিশ্চিন্ত থাকো যে তখনও গুহা মুখে আমি যাব না। কিন্তু বাইরে থেকে তোমায় ডাকা প্রয়োজন। কী নামে তোমায় ডাকব শুধু বলে দাও।

গানাদোর কথা শেষ হবার পরও মেয়েটি এতক্ষণ এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল যে সন্দেহ হয়েছিল সমস্ত বক্তব্য হয়তো সে বুঝতে পারেনি।

গানাদো আবার প্রশ্নটা করবেন কি না ভাবছেন এমন সময়ে মেয়েটি যেন বিষণ্ণ স্বরে বলেছিল, আমার নাম তো কিছু নেই।

নাম নেই! গানাদো বিস্ময়প্রকাশ না করে পারেননি।

না, নাম আমাদের থাকে না। মেয়েটি মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, সূর্যকন্যা আর সেই দেবাদিদেবের সেবিকা এই আমাদের পরিচয়।