প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

১৯. ঘনরামকে তাঁর নির্দিষ্ট সেনাবাসে

পরের দিন সকালে ঘনরামকে তাঁর নির্দিষ্ট সেনাবাসে ঠিক মতোই দেখা যায়।

আগের রাতের হত্যাতাণ্ডবের উত্তেজনার পর ক্লান্ত সৈনিকদের কোনও কিছু খুঁটিয়ে লক্ষ কর মতো তখন অবস্থা নয়। সে অবস্থা থাকলে একজন এসপানিওল সৈনিকের কপালের ওপরকার অদ্ভুত কাটা দাগটা অনেকেরই বোধহয় বিস্ময় জাগাত।

তার কপালের ঠিক মাঝখানে নাকের ওপর কে যেন সূক্ষ্ম ছুরির ফলা দিয়ে গুণর্ক চিহ্নের মতো দুটো লম্বা ঢ্যারা কেটে দিয়েছে।

শুধু তার কপালের ওই কাটা দাগ নয়, তার মুখের চেহারাও লক্ষ করবার মতো। কী যেন এক অজানা আতঙ্কে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে তখনও।

সেই সৈনিককে ছাড়া ঘনরামকেও লক্ষ করবার মতো কিছু ছিল। ঘনরামের এরকম চেহারা আগে কখনও অন্তত দেখা যায়নি। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যারা পরিচিত তাদের কেউ, যেমন কাপিন সানসেদোও, ঘনরামের এ চেহারা দেখলে বোধহয় চিন্তিত হতেন।

না, বেশি বা অল্প, ঘনরাম কোনওরকম আহত হননি। আগের রাত্রে তাঁর মুখে যে ক্লান্ত হতাশার ছাপ পড়েছিল তা সম্পূর্ণ মুছে না গেলেও তার চেয়ে আর একটা রহস্যজনক কিছু তাঁর মুখের ওপর যেন গভীর ছায়া ফেলেছে। ভাসাভাসাভাবে দেখলে সেটা এক রকম অন্যমনস্কতা বলেই মনে করবার মতো। বাইরে যা-ই করুন, ভেতরে ভেতরে তিনি যেন আর কোনও দূর ভাবনায় তন্ময় হয়ে আছেন।

অতিথি-মহল্লার সৈন্য শিবিরে ফিরে ঘনরাম অবশ্য নিজের ভাবনায় তন্ময় হয়েই সময় কাটাননি। তাঁর প্রথম কাজ হয়েছে গত দিনের অবিশ্বাস্য ব্যাপার কেমন করে সম্ভব হল তার বিবরণ সংগ্রহ করা।

যা ঘটেছে তার পেছনে শুধু আকস্মিক উত্তেজনা যে ছিল না, সমস্ত ব্যাপারটা যে আগে থাকতে সুপরিকল্পিত, ঘনরাম তার সমস্ত খুঁটিনাটি প্রমাণই ক্রমে ক্রমে পেয়েছেন।

বাতুল হাস্যকর বলে যা ধরে নেওয়া হয়েছিল হেরাদার সেই পরামর্শই গ্রহণ করেছেন পিজারো আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। মাকিয়াভেল্লী থেকে চুরি করে হেরাদা সিসিলির পিশাচ আগাগোক্লিস-এর সার্থক শয়তানির যে দৃষ্টান্ত দিয়েছিল তারই ছক ধরে পিজারো ইংকা নরেশকে হাতের মুঠোয় নেবার কূটকৌশল সাজিয়েছেন।

কাক্সামালকা শহরের অতিথি-মহল্লার মাঝখানে যে বিরাট উদ্যান-প্রাঙ্গণ তার তিন দিক বিশাল সব মণ্ডপালয় দিয়ে ঘেরা। সেই সব মণ্ডপের বড় বড় দরজা উদ্যানপ্রাঙ্গণের দিকেই উন্মুক্ত।

পিজারো এই সব মণ্ডপের ভেতর দু-ভাগে তাঁর সওয়ার সৈন্য রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন। পদাতিকদের তিনি রেখেছিলেন অন্য একটি আয়তনে। তা থেকে নিজের সঙ্গে তিনি বাছাই করা কুড়িজন মাত্র রেখেছিলেন বিশেষ প্রয়োজনের জন্যে। এসব ব্যবস্থা ছাড়া পেড্রো দে কানডিয়ার অধীনে দুটি ছোট কামান সমেত কয়েকজন বন্দুকধারী তিনি রেখেছিলেন নগর তোরণের দুর্গের ভেতর।

সকলের ওপরই হুকুম ছিল নির্দিষ্ট সংকেত পাবার আগে কেউ যেন ঘুণাক্ষরে নিজের উপস্থিতি জানতে না দেয়।

নির্দিষ্ট সংকেত হল একটি কামানের আওয়াজ। সে সংকেত পাওয়ার পর যে যেখানে আছে বন্যাবেগে ইংকা নরেশ আর তাঁর অনুচরবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এ-ই ছিল নির্দেশ।

সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও এই অতর্কিত আক্রমণের চমকেই শত্রুবাহিনী বিহ্বল দিশাহারা হয়ে ভেড়ার পালের মতো প্রাণ দেবে ও হার মানবে এই অনুমানই ছিল পিজারোর কূট পৈশাচিক যুদ্ধ-কৌশলের ভিত্তি।

তাঁর অনুমান আশাতীতভাবে অবশ্য নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ঘনরাম এ সমস্ত বিবরণই তন্ন তন্ন করে সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু কী লাভ তাঁর এ নীচ পৈশাচিক চক্রান্তের কথা খুঁটিয়ে জেনে? যা ঘটে গেছে তার পর কিছু কি তাঁর করবার আছে এ অন্যায়ের প্রতিবিধানের জন্যে?

সত্যিই কিছু নেই। আতাহুয়ালপার নিজের সৈন্য সামন্ত আর প্রজামণ্ডলীই এ নিয়তি মেনে নিয়েছে নির্বিচারে।

হত্যাতাণ্ডবের পরের দিন সকালে পিজারো যেখানে যত মৃতদেহ জমে আছে সমস্ত সরিয়ে নগর পরিষ্কার করবার হুকুম দিয়েছেন। মৃতদেহ তো দু-চারটি নয়। পিজারোর, সচিব সেরেস হাজার দুয়েক ইংকা প্রজার নিহত হওয়ার কথা লিখে গেছেন। গার্সিলার্সে দা ভেগার চেয়েও বিশ্বাসযোগ্য আর-এক বিবরণে দশ হাজার মৃতদেহের কথা পাওয়া যায়। এ বিবরণ যিনি লিখে গেছেন তিনি নিজেও একজন ইংকা বংশধর। হুয়াইনা কাপাক-এর তিনি নাতি, সুতরাং আতাহুয়ালপার ভাইপো!

তাঁর বিবরণ পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও সেই এক ভয়ংকর রাত্রে বড় জোর এক ঘণ্টার মধ্যে অন্তত হাজার পাঁচেক ইংকা সাম্রাজ্যের প্রজা যে পিজারোর জল্লাদসৈনিকদের হাতে প্রাণ দিয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

পিজারোর হুকুমে নগর পরিষ্কার করা হয়েছে, সেই সঙ্গে উষ্ণ-প্রস্রবণ ঘেরা আতাহুয়ালপার বিশ্রাম বা বিলাস শিবির লুণ্ঠন করতেও ভুল হয়নি।

সোনা রুপোর বাসন-কোসন গয়না-পত্রের যে পাকার সম্পদ তাতে পাওয়া গেছে তা সোনার নামে পাগল এসপানিওল সেনারা স্বপ্নেও বোধহয় আশা করতে পারেনি।

সোনাদানা নিয়ে যেমন উৎফুল্ল হয়েছে পিজারো আর তার দলবল তেমনই ফাঁপরে পড়েছে বন্দিদের সমস্যা নিয়ে।

তাদের রাজ্যেশ্বরই বন্দি হবার পর বিমূঢ় হতাশায় অতিসম্ভ্রান্ত থেকে সাধারণ অসংখ্য ইংকা প্রজা প্রায় স্বেচ্ছাতেই এসপানিওলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। স্বয়ং ইংকা নরেশকেই যারা এত সহজে বন্দি করতে পারে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার চেষ্টাই বৃথা, ইংকা প্রজাদের এ-ই তখন বদ্ধমূল ধারণা। দলে দলে তারা দাসত্ব স্বীকার করেছে এসপানিওলদের।

কিন্তু এই অসংখ্য বন্দিকে নিয়ে কী করা হবে তা-ই কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পিজারোর বাহিনীর কাছে।

হোমরা-চোমরারা তো বটেই, সাধারণ পাঁওদল সৈনিকরাও জনে জনে অমন দশটা বিশটা করে বিনা মাইনের খিদমদগার পেয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যা মেটেনি। খিদমদগার পেলেই তো হবে না, তাদের খোরাক তো জোগাতে হবে। তা জুটবে কোথা থেকে?

গরম জলের ফোয়ারাগুলির কাছাকাছি পাহাড়ি উপত্যকায় প্রচুর গ্লামার পালের সন্ধান অবশ্য পিজারো পেয়েছেন। ইংকা নরেশের রাখালরা সেখানে সে পশুপাল চরায়।

সে গ্লামার পাল দিনে প্রায় শ-দেড়েক করে মেরে পিজারোর বাহিনীর রসদ জোগানো হয়েছে। সে বরাদ্দ থেকে গোলামদের ভাগ দেবার কথা নিশ্চয় ভাবা যায় না।

কয়েকজন তাই যুক্তি দিয়েছে বন্দির সংখ্যা কিছু কমিয়ে ফেলবার জন্যে।

কেমন করে? কেন, স্রেফ নিকেশ করে দিয়ে। কমপক্ষে পাঁচ-ছ হাজার যেখানে আগেই খতম হয়ে গেছে সেখানে আর দু-তিন হাজার গেলে এমন কী আসবে-যাবে?

এ যুক্তি অনুসারে কাজ অবশ্য হয়নি। কিন্তু পেরুবাসীদের ওপর অত্যাচার ক্রমশ বেড়েই গেছে অবাধে।

কামালকা উপত্যকার একটি অদ্ভুত কিংবদন্তির সূত্রপাত হয়েছে বুঝি তখন থেকেই।

আশ্চর্য সে কিংবদন্তি। হয়তো তা পরাজিত নিপীড়িত নিরুপায় পেরুবাসীর মিথ্যে সান্ত্বনা খোঁজার জন্যে বানানো অলীক কাহিনী মাত্র।

নিজেদের হাতে যে প্রতিকার করবার ক্ষমতা তাদের নেই, দেবতাকে দিয়ে তাই করাবার কল্পনা করে তারা মনের আশা মেটাতে চেয়েছে হয়তো।

এ দেবতা হলেন ভীরাকোচা। সুদূর অজানা সমুদ্র পর্বত পার হয়ে যারা ইংকা সাম্রাজ্যে এসেছে সেই এসপানিওলদের মতোই ভীরাকোচার গায়ের রং শুভ্র। তিনি নাকি এসপানিওলদের বিচার ও শাস্তি নিজের হাতে তুলে নিয়ে কাক্সামালকার

পর্বত বেষ্টিত অধিত্যকায় মাঝে মাঝে সশরীরে দেখা দেন।

এসপানিওলদের কানেও এ কিংবদন্তি পৌঁছেছে। বাইরে হেসে উড়িয়ে দিলেও অনেকেই মনে মনে এ কাহিনী সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করতে পারেনি।

কারণ ভীরাকোচাকে স্বচক্ষে সুস্পষ্ট না দেখলেও এ দেবতার রহস্যময় আবির্ভাবের প্রমাণ কেউ কেউ একটু বিশ্রীভাবেই পেয়েছে।

পেরুবাসীদের ভীরাকোচা নামে দেবতাটি বেশ একটু অসাধারণ ও রহস্যময়।

ভীরাকোচা ইংকা সম্রাটদের আরাধ্য সূর্যদেব নন। অথচ তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি আর মহিমা সূর্যদেবেরই সমান। এই দেবতাটি শুধু ভীরাকোচা নয়, পাচাকামাক নামেও পরিচিত। এই নামের একটি নগর পাচাকামাক দেবতার পীঠস্থান হিসেবে সে-যুগে বিখ্যাত ছিল। এনগরের অবস্থান কর্ডিলিয়েরা অর্থাৎ আন্ডিজ পাহাড়ের শীর্ষদেশের কোনও মালভূমিতে নয়, পশ্চিমের সমতল সমুদ্রতীরে।

সেখানে পাচাকামাক বা ভীরাকোচার পূজামন্দিরের স্থাপত্যও ইংকা সম্রাটদের প্রতিষ্ঠিত সূর্যমন্দিরের চেয়ে অনেক বেশি পুরনো বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের সিদ্ধান্ত।

পাচাকামাক বা ভীরাকোচা হলেন সেই দেবতা, সমস্ত সৃষ্টির যিনি প্রাণের উৎস। এ-সৃষ্টির রক্ষকও তিনি।

ইংকা সম্রাটরা বিজয়ীরূপে দেখা দিয়ে সমস্ত পেরু রাজ্যে যে সূর্যপূজার প্রবর্তন করেন, ভীরাকোচা দেবতা হিসাবে তার অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত।

ইংকা বিজয়ীরা রাজনৈতিক সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এই আগেকার দেবতাকে সূর্যদেবের সঙ্গেই সমান মর্যাদা দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন। আমরা যে-রাজ্যকে পেরু বলে জানি ইংকা সম্রাটদের কাছে জিভে গিঠ-পড়ানো তার একটা অদ্ভুত নাম ছিল—তাভতিনসুইয়ু। শব্দটার মানে হল, দুনিয়ার চার তরফ। এই তাভতিনসুইয়ুর মধ্যে পাচাকামাক-এর মন্দিরের দৈববাণীর খ্যাতি ছিল অসামান্য। সমস্ত পেরু রাজ্য থেকে তীর্থযাত্রীরা আসত এই পাচাকামাক বা ভীরাকোচার মন্দিরে দৈববাণীর জন্যে ধরনা দিতে। ভীরাকোচার প্রাধান্য ইংকা সম্রাটদের আরাধ্য সূর্যদেব তাই খর্ব করতে পারেননি।

আগাগোড়া শ্যামলা মানুষের দেশে এই ভীরাকোচা দেবতার গায়ের রং সাদা বলে কল্পনা করা আর তাঁর মন্দিরনগর ঠিক সমুদ্রকূলেই স্থাপিত থাকার মধ্যে পেরুর লুপ্ত ইতিহাসের কোনও অস্ফুট ইঙ্গিত আছে কি না কে বলতে পারে!

এই আশ্চর্য দেবতা ভীরাকোচা-ই কি সত্যি এত যুগ বাদে তাঁর ভক্তদের সাহায্য করতে পৃথিবীতে নেমেছেন? এরকম কিংবদন্তি রটবার কারণ কী?

পেরু রাজ্যের প্রজারা ভীরাকোচা-র পুরাণ-কথা স্মরণ করেই এসপানিওলদের প্রতি প্রথম সশ্রদ্ধ আকর্ষণ অনুভব করেছিল। এসপানিওলদের গায়ের রং সাদা, সুতরাং সেই সুদূর পুরাণের যুগের ভীরাকোচার সঙ্গে তাদের হয়তো কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে—এইরকম একটা ধারণাই গোড়ায় গড়ে উঠেছিল তাদের মনে। তাদের এ-ভুল মর্মান্তিকভাবে ভাঙতে দেরি হয়নি অবশ্য।

নিষ্ঠুর আঘাত পেয়ে পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তারা বুঝেছে, সমস্ত সৃষ্টি যাঁর কাছে। জীবন পেয়েছে, জীবনের যিনি পরম রক্ষক, সেই ভীরাকোচা-র সঙ্গে সামান্যও একটু সম্বন্ধ থাকলে, এসপানিওলরা এমন পিশাচ কখনও হতে পারত না।

কামালকা নগরে ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপা পিজারোর হাতে বন্দি হবার কয়েকদিন পর থেকেই অত্যন্ত গোপনে প্রায় চুপি চুপি একটা কথা তাই কান থেকে কানে ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। কথাটা কী? কথাটা এই যে, গায়ের রং সাদা হলেও, এসপানিওলরা অনাদি জীবন-দেবতা ভীরাকোচা-র কেউ নয়। ভীরাকোচার সঙ্গে তাদের মিলটা একটা প্রতারণা। ওপরটাই তাদের সাদা, ভেতরটা একেবারে ঝুলের মতো কালো।

ভীরাকোচার কাছে তাদের আসল চেহারা তো লুকোনো নেই। তিনি তাই যুগযুগান্তর বাদে অকস্মাৎ দেখা দিয়ে পিশাচ এসপানিওলদের উচিত শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেছেন।

পেরুর লোকেরা এরকম আজগুবি কিছু ভেবে নিয়ে সান্ত্বনা পেতে চায় তো পাক, কিন্তু এ-অদ্ভুত কিংবদন্তি এসপানিওলদের মধ্যেও ছড়িয়ে একটু-আধটু ভয় জাগালেই ভাবনার কথা। পিজারোর বিশ্বস্ত বীর সেনাপতি দে সটোর মনে সেই ভাবনাই হয়েছে।

ব্যাপারটা আলোচনা করবার জন্যে তিনি বেদে গানাদোর খোঁজ করছেন। এ-ধরনের ব্যাপারে তার মতামতের একটা দাম আছে বলেই মনে হয়েছে দে সটোর।

গানাদোর খোঁজ দে সটো শেষ পর্যন্ত পেয়েছেন, কিন্তু দিন-তিনেক চেষ্টা করার পর।

গানাদোকে পাকড়াও করবার পর সেই প্রশ্নই তিনি আগে করেছেন। কোথায় ছিলে বলো তো হে ক-দিন? জিজ্ঞাসা করেছেন দে সটো, রোজ তোমার খোঁজ করতে এসে পাইনি।

কখন খোঁজ করতে এসেছিলেন কাপিন? গানাদোর গলায় সম্রমের সঙ্গে একটু যেন অন্য সুর শোনা গেছে।

দে সটো অবশ্য তা লক্ষ না করে বলেছেন, কখন আবার? রোজই সন্ধ্যার পর খোঁজ করেছি তোমার ছাউনিতে। তোমায় পাইনি।

পাবেন কী করে, কাপতান? গানাদো যেন সরলভাবেই বলেছেন, সন্ধের পর কাউকে এখন পাওয়া যায়!

কেন, পাওয়া যায় না কেন? দে সটো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, কোথায় যায় সবাই?

আজ্ঞে, কেউ যায় লুঠ করতে, আর কেউ লুকোতে, গানাদো যেন দে সটোর মনের ভাবনাটা আঁচ করেই জবাব দিয়েছেন।

লুকোতে কী রকম? দে সটো একটু চমকে উঠেই প্রশ্ন করেছেন এবার, এসপানিওলরা সুবিধে পেলেই লুঠ করে, মানি। কিন্তু তাদের কেউ কেউ ভয়ে লুকোচ্ছে বলতে চাও? কার ভয়ে? এ-দেশের মানুষের?

শেষ কথাগুলো বলবার সময় দে সটোর গলায় উত্তেজনার সঙ্গে বেশ একটু রাগই ফুটে উঠেছে।

গানাদো কিন্তু তাতে বিচলিত হননি। বরং এবার একটু কৌতুকের স্বরে বলেছেন, , এ-দেশের মানুষের ভয়ে নয় কাপিন, লুকোচ্ছে ভূতের ভয়ে। ভূত আবার কী? ধমক দিয়েছেন দে সটো, স্পষ্ট করে বলো।

ভূতকে যে স্পষ্ট করা যায় না কাপিন। যেন দুঃখের সঙ্গে বলেছেন গানাদো, আমাদের মনের অন্ধকার সব কোণেকানাচেই যে তার আস্তানা।

বেদে গানাদোকে ধমক দিলে এইরকম ধোঁয়াটে ধাঁধাই বার হবে বুঝে দে সটো এবার নরম হয়ে সোজাসুজি তাঁর প্রশ্নটা জানিয়েছেন।

সত্যিই ভৌতিক কিছু ব্যাপার কামালকায় ঘটছে বলে তুমি মনে করো? ওরা যা বলে তার ভেতর কিছু সত্য আছে বলে তমার ধারণা!

ওরা যা বলে তা তাহলে আপনি জানেন? এবার গণনাদোর গলা গম্ভীর। হ্যাঁ, জানি। দে সটো অনিচ্ছার সঙ্গে স্বীকার করেছেন, সেই জন্যেই তুমি এ ব্যাপারের কী কতটুকু জানো জিজ্ঞাসা করছি।

আমাকে জিজ্ঞাসা করে কী লাভ কাপিন! গানাদো যেন পাশ কাটাতে চেয়েছেন, আপনার মতো আমিও ওরা যা বলে সেইটুকুই জানি।

না, না, প্রায় অনুরোধের সুর ফুটে উঠেছে দে সটোর গলায়, আমার কাছে লুকিও না, গানাদো। আমাদের সৈনিকদের মধ্যে এরকম অদ্ভুত কথা রটনার মূলে কিছু আছে কি না আমার চেয়ে নিশ্চয় তুমি বেশি জানো। যা জানো তা বলো।

এবার খানিক চুপ করে থেকে গানাদো ধীরে ধীরে বলেছেন, বলবার বেশি কিছু নেই, কাপিন দে সটো। এইটুকু শুধু নিজে ভেবে দেখলেও বুঝতে পারতেন যে, নেহাত হাওয়ার ওপর এরকম একটা অদ্ভুত ভয়ের গল্প এই ক-দিনে গড়ে উঠতে পারে না। কিছু একটা ভিত্তি তার আছেই।

সেই ভিত্তিটা কী তাই তো জানতে চাইছি।—দে সটোর গলায় অধৈর্যের সঙ্গে বিস্ময়বিহ্বলতা মেশানো—ধবধবে সাদা ঘোড়ায় সাদা পোশাকে সাদা মুখোশ-ঢাকা। এক মূর্তি এসপানিওলদের কাউকে একা পেলে হঠাৎ যেন ভোজবাজিতে যেখানে সেখানে দেখা দিয়ে তাদের আক্রমণ করে এরকম আজগুবি কল্পনার কী ভিত্তি থাকতে পারে? তুমি নিজে দেখেছ কখনও সে-মূর্তি?

না, কাপিন। একটু যেন ভয়ে কাঁপানো গলায় বলেছেন গানাদো, আপনাকে হলফ করে বলতে পারি, এ-মূর্তি নিজের চোখে দেখার ভাগ্য আমার হয়নি। তবে সাদা ঘোড়ায় সাদা মুখোশ-ঢাকা সওয়ার দেখার ব্যাপারটা সত্য বা কাল্পনিক যা-ই বলুন না কেন, সেইরকম অদ্ভুত কোনও কিছুর ধরবার ছোঁবার মতো প্রত্যক্ষ প্রমাণ দু-একটা যে নেই এমন নয়।

একটু থেমে দে সটোকে তাঁর প্রশ্নটা করবার অবসর না দিয়ে গানাদো আবার বলেছেন, প্রমাণগুলো অবশ্য লুকিয়ে রাখবার চেষ্টাই হয়েছে। যারা ভুক্তভোগী তারাই ব্যস্ত হয়েছে লুকিয়ে রাখতে। তবু রহস্যটা সম্পূর্ণ চাপা দেওয়া যায়নি।

কী বলছ তুমি আবোল-তাবোল? দে সটো এবার একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলেছেন, কী প্রমাণ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে? যারা ভুক্তভোগী তারাই বা প্রমাণ লুকোতে ব্যস্ত হয়েছে কেন?

ব্যস্ত হয়েছে প্রমাণগুলো একটু লজ্জার বলে। গম্ভীরভাবে বলেছেন গানাদো, আস্ত না থেকে তলোয়ার যদি কারও দু-টুকরো হয়, তাহলে ঢাক পিটিয়ে তা জানাতে নিশ্চয় কেউ ব্যাকুল হয় না। সাহসী বীরের হাতের তলোয়ার দু-টুকরো হওয়ার কৈফিয়ত বানানো তো সোজা নয়। ভাঙা তলোয়ার লুকিয়ে ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টাই তাই করতে হয়। মুশকিল হয় শুধু কপালের কলঙ্কের দাগটা নিয়ে।

ভাঙা দু-টুকরো তলোয়ার, কপালে কলঙ্কের দাগ, এসব কী হেঁয়ালি করছ, গানাদো? দে সটো ক্ষুব্ধস্বরে বলেছেন, আমি তোমার কাছে হেঁয়ালি শুনতে চাইনি, তার জবাব চেয়েছি।

জবাবই আপনাকে দিয়েছি, কাপতান। এবার একটু হেসে বলেছেন গানাদো, একটু খোঁজ নিলে ভাঙা দু-টুকরো তলোয়ার আর কপালের দাগের প্রমাণ আপনি নিজেই বার করতে পারবেন। প্রথমে আরমেরিয়ায় গিয়ে অস্ত্রাগারের ভাঁড়ারির কাছে গত এক হপ্তার মধ্যে ক-জন সৈনিক নতুন তলোয়ারের আর্জি জানিয়েছে খবর নিন, তার পর পারেন তো কুচকাওয়াজে সবাইকে ডেকে কপাল পরীক্ষা করে দেখুন।

একটু চুপ করে দে সটোর বিমূঢ় মুখের দিকে চেয়ে গানাদো আবার বলেছেন, কপাল পরীক্ষা করাটা এসপানিওলদের পক্ষে একটু বেশি অপমান হয়ে যাবে, কাপিন। সুতরাং তার দরকার নেই। শুধু ভাঙা তলোয়ারের হিসাবটা গোপনে নিলেই বুঝতে পারবেন একটা অদ্ভুত কিছু ঘটনা নিশ্চয়ই তার পেছনে আছে। সেই অদ্ভুত কিছু ঘটনার সঙ্গে সাদা মুখোশধারী ঘোড়সওয়ারের কিংবদন্তির সম্পর্ক কী, আর কতটুকু, তা আপনাকে বলতে পারব না।

বেশ কিছুক্ষণ দে সটো বিস্ময়বিমূঢ় হয়েই নীরব হয়ে থেকেছেন। তারপর গভীর সংশয়েরই সুর গলায় নিয়ে বলেছেন, ভাঙা তলোয়ারের ব্যাপারটার নির্ভুল প্রমাণ যখন আছে তখন তার মূলে সাদা মুখোশধারী কোনও শত্রু ঘোড়সওয়ারের রহস্য থাকতেও পারে তুমি মনে করো?

তা করি। স্বীকার করতে যেন বাধ্য হয়েছেন গানাদো।

কিন্তু, দে সটো তাঁর অবিশ্বাসের কারণগুলো প্রকাশ করেছেন, এই কাকসামালকার পাহাড়-ঘেরা অধিত্যকায় ওরকম সাদা ঘোড়া আর তার সওয়ার আসবে কোথা থেকে? ঘোড়া তো এ-দেশের প্রাণী নয়। আমরা যে-কটি সঙ্গে এনেছি তা ছাড়া একটি ঘোড়াও এই বিশাল রাজ্যে নেই। রোগে, অপঘাতে যে-ক-টা গেছে, তা বাদে ঘোড়া এখনও আমাদের যা আছে, তা গোনাগুনতি। সে-সব ঘোড়ার মধ্যেও সত্যিকার দুধে ঘোড়া যাকে বলে, তা তো একটাও নেই যে বলব কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়ে চালাচ্ছে। আমাদের কোনও ঘোড়া চুরি সত্যিই যায়নি এ পর্যন্ত। তা গিয়ে থাকলেও তো রহস্যের কিনারা হয় না। মুখোশধারী সওয়ার তার ঘোড়া নিয়ে কোথা থেকে আসে, চলে যায়ই বা কোথায়? তাহলে ব্যাপারটা কি সত্যিই ভৌতিক বলে ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই? অশরীরী কোনও মূর্তি কি হঠাৎ দেখা দিয়ে আবার শূন্যে মিলিয়ে যায়?

দে সটো শেষ প্রশ্নটা নিজেকেই যেন করেছেন। দরকার নেই বলেই বোধ হয় গানাদো তার কোনও জবাব দেবার চেষ্টা করেননি।

দে সটো আবার নিজেই অন্য প্রশ্ন তুলেছেন, সাদা ঘোড়ার মুখোশধারী মূর্তি অশরীরী ছায়া মাত্র হতে পারে, কিন্তু সে যা করে থাকে, তা তো অলীক স্বপ্ন গোছের কিছু নয়। ভাঙা দু-টুকরো তলোয়ার আর কপালের কাটা চিহ্নের কথা যা বলছ, তা

যদি ঠিক হয়, তাহলে সে তো বিশ্রী বাস্তব সত্য। অলীক ছায়া আর এই বাস্তব সত্যে যে মেলানো যাচ্ছে না।

মেলাবার দরকার কী, কাপিন দে সটো! এবার হেসে বলেছেন গানাদো, দু-চারটে ভাঙা তলোয়ার আর কপালের কাটা দাগ কত আর আপনাদের ক্ষতি করবে? আপনাদের পেরু বিজয় তাতে আটকে থাকবে না।

তা হয়তো থাকবে না। চিন্তিতভাবে বলেছেন দে সটো, কিন্তু এরকম একটা রহস্যের কিনারা না হলেও তো নয়। আস্ত তলোয়ার কেমন করে দু-টুকরো হয়, সৈনিকদের কপালে কী করে কাটা দাগ আসে, তার ঠিক মতো হদিস না পেলে অজানা আতঙ্কটা ক্রমশ আরও ছড়িয়ে যাবে। ভুতুড়ে অত্যাচারটা বাড়তে বাড়তে কতদূর পৌঁছবে, আর কখন কার ওপর পড়বে তারই বা ঠিক কী?

না, কাপিতান। প্রতিবাদ জানিয়েছেন গানাদো, ভুতুড়ে রহস্যের মীমাংসা হবে কিনা জানি না, কিন্তু যেটুকু দেখা গেছে তাতে এটুকু বোধহয় বলা যায় যে, ভুতুড়ে অত্যাচারটা এলোপাথাড়ি খামখেয়ালিভাবে যার-তার ওপর হয়নি ও হবে না।

তার মানে? দে সটো সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।

তার মানে, যাকে অত্যাচার বলছেন, তা এ পর্যন্ত যার-তার ওপরে নয়, বাছাই করা কয়েকজনের ওপরেই শুধু হয়েছে।

বাছাই করা কজনের ওপর হয়েছে। গানাদোর কথাটাই আবার আউড়ে দে সটো বিমূঢ়ভাবে জানতে চেয়েছেন, কী হিসেবে বাছাই করা?

তাদের কীর্তি ধরে বাছাই করা। গানাদোর গলাটা একটু যেন তীব্র মনে হয়েছে, এ-দেশের নিরীহ অসহায় স্ত্রী-পুরুষের ওপর সবচেয়ে অন্যায় অত্যাচার যারা করেছে, শুধু তাদের কয়েকজনকেই যেন ভুতুড়ে সওয়ার বেছে নিয়ে শাস্তি দিয়েছেন দেখা যাচ্ছে।

তুমি তো তাহলে এ-দেশের লোকের অন্ধ কুসংস্কারেই সায় দিচ্ছ? গানাদোর দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে বলেছেন দে সটো।

কোন অন্ধ কুসংস্কার? জিজ্ঞাসা করে যেন সরলভাবেই মন্তব্য করেছেন গানাদো, এদের অন্ধ কুসংস্কারের তো অন্ত নেই।

এদের পুরাকালের দেবতা ভীরাকোচা সম্বন্ধে এরা যা বলছে, সেই অন্ধ বিশ্বাসের কথা বলছি। দে সটো ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ভীরাকোচাই এদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে নেমেছেন বলে এদের ধারণা। তুমি তা বিশ্বাস করো?

বিশ্বাস ঠিক করি না, কিন্তু অবিশ্বাসও বা পুরোপুরি করতে পারছি কই! গানাদো ধরাছোঁয়া না দিয়ে বলেছেন, দেবতারা কখন কীভাবে দেখা দেন কেউ কি জানে!

এ-দেশের দেবতাও তাহলে তুমি মানো! সাদাসিধে মানুষ দে সটোর গলাতেও একটু তিক্ত বিদ্রূপের সুর শোনা গেছে তুমি যে জাতে খিতানো, সেটাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

হ্যাঁ, কাপিতান, আমি যে আসলে বেদে, সেটা আমাকেও ভুলতে দেবেন না, বলে গানাদো একটু অদ্ভুতভাবে হেসে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দাঁড়াও বলে সে সটো তাঁকে থামিয়েছেন।

তারপর একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই তাঁর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, আচ্ছা, সন্ধের পর ক-দিন তোমায় খুঁজে পাইনি কেন বলো তো? তুমি-ই তো বলেছ সন্ধের পর এখন কেউ লুঠ করে, কেউ লুকোয়। তুমি নিজে কী করেছ? লুঠের ধান্দায় বেরিয়েছ,

লুকিয়েছ?

দুটোর কোনওটাই করিনি, কাপিন। একটু হেসে বলেছেন গানাদো। তাহলে? সন্দিগ্ধভাবে গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন দে সটো। পাছে-ভেঙে-যায় ভয়ে একটা স্বপ্নকে আমি পাহারা দিয়ে রাত কাটিয়েছি, কাপিতান। আর সেই পাহারা দিতে গিয়ে ভীরাকোচা সত্যি কোথায় নামতে পারেন সন্ধান নিয়েছি তারও।

হতভম্ব দে সটোর এর পর অনেক কিছু হয়তো বলবার ছিল। কিন্তু সে-সুযোগ হয়নি। মোক্ষম হেঁয়ালিটুকু ছেড়েই গানাদো সেখান থেকে উধাও হয়ে গেছেন।

এসপানিওলদের কাছে যিনি গানাদো আমাদের সেই ঘনরাম দে সটোর কাছে সব শেষে যা বলেছিলেন তা কি সত্যিই নেহাত অর্থহীন হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছু নয়? না, তার ভেতর অন্য কোনও গৃঢ় ইঙ্গিত ছিল?

পাছে-ভেঙে-যায় ভয়ে একটা স্বপ্নকে আমি পাহারা দিয়ে রাত কাটিয়েছি কাপিন। তিনি বলেছিলেন। সেই সঙ্গে বলেছিলেন, আর সেই পাহারা দিতে গিয়ে ভীরাকোচা সত্যি কোথায় নামতে পারেন সন্ধান নিয়েছি তারও।

দুটো উক্তিরই ওপর থেকে বিচার করলে কোনও মানে আছে বলে মনে হয় না। শুধু যেন একটু ধোঁয়াটে ধাঁধা তৈরি করবার জন্যেই তা বলা।

খিনো মানে এসপানিয়ার বেদেদের ওরকম একটু-আধটু মিথ্যে হেঁয়ালি দিয়ে বাহাদুরি করা যে স্বভাব তা দে সটোর অজানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত কথা দুটোকে তাই তিনি তেমন আমল দেননি। গানাদোর কাছে এসপানিওল সৈনিকের আরমেরিয়া থেকে ভাঙার বদলে নতুন তলোয়ার চাওয়ার ব্যাপারটা যা শুনেছেন তা কতখানি ঠিক যাচাই করাই তাঁর কাছে বেশি জরুরি মনে হয়েছে।

যাচাই করে যা জেনেছেন তা সত্যিই তাঁকে রীতিমতো ভাবিত করে তুলেছে। একজন দু-জন নয়, প্রায় সাতজন সৈনিক এ ক-দিনে নতুন তলোয়ার অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে গেছে। ব্যাপারটা খোদ কাপিন জেনেরাল পিজারোর কানে তোলবার মতো।

তবে তার আগে আর একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার।

সেই চেষ্টায় অস্ত্রাগারের ভাণ্ডারীর কাছে নতুন তলোয়ার যারা বদলি নিয়েছে দে সটো তাদের নাম জানতে চেয়েছেন। কিন্তু সঠিকভাবে তা জানা সম্ভব হয়নি। সত্যিকারের কেতাদূরস্ত আরমেরিয়া তো নয়, নেহাত ঢিলেঢালা ব্যাপার। সৈনিকদের নিজেদের সঙ্গে যা থাকে তার ওপর বাড়তি অস্ত্রশস্ত্রের একটা সঞ্চয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে বওয়া হয়। সকলে যার যখন যা দরকার হয় তা থেকে নেয়। নামকা ওয়াস্তে একজন ভাঁড়ারি আছে। সে খাতাপত্র কিছু রাখে না বললেই হয়।

আর খাতাপত্র থেকে পাওয়াই বা যাবে কী! বেশির ভাগই তো মুখখু। নাম লেখার বদলে ঢেরা কাটে মাত্র। সেরকম কয়েকটা ঢেরাই শুধু খাতায় পাওয়া গেছে। সই দিতে যারা জানে তারাও ধরা না পড়বার জন্যে ঢেরা কেটেছে কি না কে জানে।

অস্ত্রাগারের ভাঁড়ারির নাম সোটেলো। এই অভিযানেই প্রথম যোগ দিয়েছে। একটু আনাড়ি। দে সটোর তাগাদায় তলোয়ার যারা নিয়েছে তাদের একজনের নাম অতি কষ্টে সে মনে করে বলতে পেরেছে। দে সটোর ধমকে তার অপ্রস্তুত ধবনধারণে বোঝা গেছে যে একদিন লুঠপাটের উত্তেজনায় সে নিজেও এমন মেতে ছিল যে আর কোনও কিছুর হুশ রাখেনি।

একটিমাত্র যে নাম পেয়েছেন দে সটো তাই দিয়েই শুরু করেছেন তাঁর সন্ধান। খবর দিয়ে সৈনিকটিকে ডেকে পাঠিয়েছেন অতিথিশালায় তাঁর নিজের ঘরে। সৈনিকের নাম গাল্লিয়েখো। ঠিক কাবালিয়েরো মানে ভদ্রবংশের না হলেও একেবারে হেঁজিপেঁজি ইতর সাধারণ থেকে সেনাদলে নাম লেখায়নি। লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ চেহারায় একটু বড় ঘরোয়ানার ছাপ আছে। চালচলনে একটা উগ্র দাম্ভিকতাও। শরীরের শক্তি সত্যিই অসুরের মতো, অন্য সৈনিকরা দু-চারবার ঠেকে শিখে তাকে একটু সমীহ করে চলে বলেই আস্ফালনটা একটু বেশি।

দে সটো অনেক ওপরওয়ালা কাপিন। তবু গাল্লিয়েখো তাঁর সামনে একটু যেন ব্যাজার মুখেই এসে দাঁড়িয়েছে। সে নিজে অন্য একজন সেনাপতির অধীন বলেই বোধহয় দে সটোর ডাকে আসতে বাধ্য হওয়াটা তার পছন্দ নয়।

বিরক্তিটুকু দে সটোর নজর এড়ায়নি। কিন্তু তখন অন্য একটা কারণে ভেতরে। ভেতরে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। বাইরে তবু সেটা দমন করে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন যথাসাধ্য শান্তভাবেই, তোমার নাম তো গাল্লিয়েখো?

হ্যাঁ, সে সটোকে যেন কথাটা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যেই অতিরিক্ত পরিচয় দিয়ে বলেছে, দে কান্ডিয়া আমাদের দলপতি।

অযাচিত এ অতিরিক্ত খবরটুকু দেওয়ার মধ্যে ইঙ্গিত নিশ্চয় এই যে দলপতি ছাড়া আর কারও কোনও সৈনিককে এভাবে তলব করা ঠিক দস্তুর নয়।

দে সটো এ ইঙ্গিত বোঝেননি এমন নয়, কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে এবার একটু কঠিন গলায় জানতে চেয়েছেন, তুমি আরমেরিয়া থেকে নতুন তলোয়ার নিয়েছ কেন?

নতুন তলোয়ার! প্রথমটায় চমকে ওঠার পর এক মুহূর্তের মধ্যে গাল্লিয়েখোর মুখ লাল হয়ে উঠেছে রাগে।

কে বললে আমি নতুন তলোয়ার নিয়েছি! গলার স্বরেই বোঝা গেছে যে বেশ একটু কষ্ট করেই তাকে নিজেকে সামলাতে হচ্ছে।

আমি বলছি! গাল্লিয়েখখার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলেছেন দে সটো, তাড়াতাড়ি জবাব দাও আমার প্রশ্নের। নতুন তলোয়ার কেন তোমার দরকার হল?

গাল্লিয়েখো খানিকক্ষণ চুপ করে থেকেছে। তার চোখ মুখের ভাব দেখে এমন সন্দেহও একবার হয়েছে যে সে হয়তো হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে সেনাদের অবশ্যবাধ্যতার অলঙ্ঘ্য আইনটাই ভেঙে বসবে।

কিন্তু তা সে করেনি। সম্ভবত প্রতিবাদ নিস্ফল বুঝেই এবার অন্য ভঙ্গি নিয়েছে। একটু চাপা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যেন সহজভাবে জবাব দিয়েছে, নতুন তলোয়ার যে জন্যে দরকার হয় সেই জন্যেই নিয়েছি। আগেরটা ভেঙে গেছে বলে।

আগেরটা ভাঙল কী করে? দে সটোর সেই বজ্রগম্ভীর স্বর।

গাল্লিয়েখো আবার খানিক চুপ করে থেকেছে। বোধহয় ভাববার সময় নেবার জন্যেই। জিভের ডগায় তার যে উত্তরটা আপনা থেকে উঠে এসেছে, সেটা খুব বিনীত বোধহয় নয়। সেটাকে একটু বদলে তাই সে প্রশ্নের আকার দিয়েছে। কী করে ভাঙল তার কৈফিয়ত দিতে হবে? আগে তো কখনও হত না।

আগে না হলেও এখন দিতে হবে। গাল্লিয়েখো সম্বন্ধে রীতিমতো সন্দিগ্ধ হয়ে উঠে দে সটো কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করেছেন, আগে কখনও তোমার তলোয়ার ভেঙেছে কি?

না, ভাঙেনি। গাল্লিয়েখোর গলার ঔদ্ধত্যটা সম্পূর্ণ চাপা থাকেনি, ভেঙেছে এইবারই। তলোয়ার কি কারও কখনও ভাঙে না!

নিশ্চয়ই ভাঙে। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলেছেন দে সটো, সুতরাং কী করে ভেঙেছে বলতে তোমার এত আপত্তি কেন?

আপত্তি! গাল্লিয়েখো যেন অবাক হয়ে অস্বীকার করে বলেছে, আপত্তি থাকবে কেন? ব্যাপারটা বলার মতো কিছু নয় তাই বলতে চাইনি। খোলা তলোয়ার নিয়ে এ-দেশি ক-টা হতভাগাকে ঝরনামহল থেকে তাড়িয়ে বার করছিলাম। হঠাৎ ঘোড়াটা হোঁচট খেয়ে পড়ায় তলোয়ারের ফলাটা একটা পাথুরে থামে লেগে দু-টুকরো হয়ে যায়।

কৈফিয়তটা বেশ সাজানো গোছানো। খুঁত ধরবার কিছু নেই।

সেই জন্যেই কি দে সটো চুপ করে গিয়ে শুধু একটু ভুকুটিভরে গাল্লিয়েশখার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তা যে নয় তা তাঁর পরের কথাতেই বোঝা যায়। তীক্ষ্ণ তীব্র বিদ্রূপের স্বরে গাল্লিয়েখোকে শুধু নয়, ঘরটাকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে তিনি বলেন, আর তাইতেই তোমার কপালের মাঝখানে ওই দুটো ঢেরা দাগ আপনা থেকে কেটে বসল! খোলো তোমার ও মাথার বাহারে ফেটি। দাগ দুটো আমি ভাল করে দেখতে চাই।

একেবারে চুপ হয়ে গেছে এবার গাল্লিয়েখো। আর মুখ-চোখ তার রাগে লাল নয়, বেশ একটু ফ্যাকাশে।

মাথার বাহারে ফেটি খোলবার জন্যে হাত সে তোলেনি বটে, কিন্তু দে সটোর কথার কোনও প্রতিবাদও করেনি। নীরবে ফ্যাকাশে মুখে কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

কই? খুলবে তোমার মাথার ফেটি। না, তার অন্য ব্যবস্থা করতে হবে?

দে সটোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে গাল্লিয়েখো আর দেরি করেনি। মাথার চারিধারে জড়ানো ইংকা নরেশের বোলা-র ধরনের ফেটিটা ধীরে ধীরে খুলে ফেলেছে। ফেটিটার নীচে সামান্য যে কাটাটুকু লক্ষ করে দে সটো সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন তা এবার স্পষ্ট দুটি চেরার মতো কাটা দাগ বলে বোঝা গেছে। দে সটোর অনুমান সুতরাং ভুল হয়নি।

কাটা দাগ তোমার কপালে হল কী করে? কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন দে সটো, কিছু লুকোবার চেষ্টা কোরো না। বলো, কেউ কি এ দাগ দিয়েছে?

হ্যাঁ, দিয়েছে! গাল্লিয়েখোর গলা দিয়ে যেন আগুনের হলকা বার হয়েছে এবার। তবে তার জ্বলন্ত রাগের লক্ষ্য এখন আর দে সটো নন।

তখনই পেলে যেন দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে এমনই হিংস্র আক্রোশে সে আবার বলেছে, এ যার কাজ, সে যদি শয়তানের খাস সাগরেদ কি স্বর্গের দেবদূতও হয় তবু এই দাগের শোধ আমি নেবই। তলোয়ারের ডগায় তার দুটো চোখ আমি উপড়ে নেব। একটা একটা করে হাতের পায়ের সমস্ত আঙুল আমি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটব, তার পর

তার পর হাতের সুখ যা করবে তা আরও ভাল করে পরে ভেবে নিও। কঠিন হলেও এতক্ষণে তার সঙ্গে একটু কৌতুক মেশানো অবজ্ঞার সুরে দে সটো ধমক দিয়ে গাল্লিয়েখোকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, এখন লোকটা কে বলো তো? তোমার

তলোয়ারও কি সেই ভেঙেছে?

হ্যাঁ, কাপিন। গাল্লিয়েখো এবার দে সটোর যোগ্য সম্মান দিয়ে রাগে ফুলতে ফুলতে বলেছে, তলোয়ার সে-ই ভেঙেছে। তা যদি না ভাঙত, যদি তলোয়ার নিয়ে আমার সঙ্গে লড়ত—

তাহলে তার দুটো চোখ তুমি উপড়ে নিতে তা জানি। আবার বাধা দিয়ে গাল্লিয়েখোকে থামিয়ে দে সটো বলেছেন, কিন্তু লোকটা কে তাই আগে জানতে চাই।

তা আমি জানি না, কাপিন। সে কোন জাতের কী রকম মানুষ তা-ও আমি জানি না।

জানো না কী রকম! গানাদোর কথাগুলো মনে করেই বোধহয় দে সটোর গলায় উদ্বিগ্ন বিস্ময় ফুটে উঠেছে যে তোমার তলোয়ার ভাঙল, তোমার কপালে দাগ দিল, সে লোকটার কীরকম চেহারা তা তো বলতে পারো অন্তত।

না, তা-ও পারি না। ক্ষুব্ধভাবে মাথা নেড়েছে গাল্লিয়েখো, তার মুখ আমি দেখতে পাইনি। শুধু দেখেছি তার মুখোশ।

শুধু মুখোশ দেখেছ? সাদা মুখোশ? দে সটোর গলাটা আপনা থেকে ধরে গিয়ে যেন বুজে এসেছে, আর তার ঘোড়া যা ছিল তার রংও সাদা?

হ্যাঁ, কাপিনা সংশয়বিমূঢ়তার সঙ্গে তীব্র আক্রোশ মেশানো স্বরে বলেছে গাল্লিয়েখো, রাতের অন্ধকারে যেন প্রেতমূর্তি বলে মনে হয়।

ভূত প্রেত বা সত্যি মানুষ যা-ই হোক, রাত্তিরবেলা তাকে তুমি দেখেছ তাহলে? দে সটোর কণ্ঠস্বর আবার তীব্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু হঠাৎ তলোয়ার ভেঙে তোমার কপালেই বা সে দাগ দিতে গেল কেন। আচমকা অকারণে কি তোমার ওপর এসে চড়াও হল?

গাল্লিয়েখোর উত্তর দিতে কয়েক মুহূর্ত এবার দেরি হয়েছে।

অধৈর্যের সঙ্গে দে সটো তাকে ধমক দিতে যাচ্ছেন—এমন সময় নিজে থেকেই। হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠে সে মুখের বাঁধন খুলে দিয়েছে। লজ্জা-সংকোচের বালাই

রেখে বিষটালা গলায় বলেছে, কারণ যদি বলতে হয় তাহলে একটাই তো খুঁজেপেতে ধরা যায়। দিনের বেলা জানলায় একটা মুখ দেখে শহরের একটা বাড়ি চিহ্নিত করে রেখেছিলাম। রাত্রে সে বাড়িতে হানা দিয়ে দরজা ভেঙে বার করে আনছিলাম মেয়েটাকে। ঘোড়াটা বাইরে বাঁধা ছিল। আটকাতে যে দু-চারটে হতভাগা এসেছিল তাদের হাত-পাগুলো উড়িয়ে দিয়ে দামি মালটা টেনে হিঁচড়ে ঘোড়ার পিঠে তুলতে যাব, এমন সময় ঘোড়াটাই চিহি করে বিকট ভয়ের ডাক ছেড়ে খাড়া হয়ে

দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে তখন চেয়ে দেখি, ওই এক অদ্ভুত মূর্তি। সাধা ঘোড়া, সাদা পোশাক, মুখে সাদা মুখোশ। এর আগে কানাঘুষায় এরকম মূর্তির কথা শুনেছিলাম। বিশ্বাস করিনি। এবার স্বচক্ষে দেখলাম। ভয় আমি কিন্তু পাইনি। মওড়া নেবার জন্যে আমি তখন প্রস্তুত।

হ্যাঁ, তুমি খুব সাহসী সবাই জানে। তিক্ত গম্ভীর স্বরে বলেছেন দে সটো, কিন্তু এ দেশের লোকেদের ওপর হামলা করা, তাদের মেয়েদের ওপর অত্যাচার করা যে গুরুতর অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে তা কি তুমি জানো না?

অপরাধ বলে ঘোষণা! কথাটা নেহাত আজগুবি মনে হয়েছে বলে এবার দে সটোর মুখের ওপরই হেসে উঠতে গাল্লিয়েখোর বাধেনি, আমরা সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে জীবনমরণ তুচ্ছ করে এদেশে এসেছি কি গির্জের ব্রহ্মচারী পাদরি হব বলে? এ দেশের লোকের গায়ে জাদুর হাত বুলোব, মেয়েদের দেখলে চোখ বন্ধ করে থাকব, এই আমাদের কাছে আশা করেন? না, কাপিন। ও সব ঘোষণার মানে আপনিও জানেন, আমরাও জানি। লোক দেখানো ওসব ভড়ং একটু করতে হয় বলে সত্যি কিছু দাম ওর আছে না কি!

গাল্লিয়েখো যা বলেছে তাই যে বেশির ভাগ সৈনিকের মনের কথা তা জেনে দে সটো তীব্র প্রতিবাদ আর কিছু করতে পারেননি। সামান্য একটু ভৎসনার সুরে শুধু বলেছেন, পাদরি হতে কাউকে বলা হয়নি, কিন্তু এ দেশের মানুষের ওপর যা খুশি অত্যাচার তো করতে পারো না। জন্তু-জানোয়ার হলেও তা করা যায় না।

এরা জন্তু-জানোয়ারের অধম। বেপরোয়া হবার পর ক্রমশ যেন মনের আর গলার জোর পেয়ে বলেছে গাল্লিয়েখো, এদের ওপর অত্যাচারের আবার জবাবদিহি আছে নাকি! তার জন্যে যদি ওই মূর্তি দেখা দিয়ে থাকে তাহলে ভূত, প্রেত, শয়তানের বাচ্চা যা-ই হোক, তার সঙ্গে আবার আমার মোকাবিলা হবেই আর তখন শোধ কী করে নেব তা আমি জানি।

কিন্তু শোধ নেবার দরকারই বা হচ্ছে কেন? তীব্রভাবেই বিদ্রূপ করে বলেছেন দে সটো, প্রথম দেখা হবার সময় কোথায় ছিল তোমার বীরত্ব। তখন তলোয়ারই বা ভাঙল কেন আর দাগই বা পড়ল কেন কপালে? তখন লড়তে পারোনি?

না, পারিনি বলেই তো আফশোশ। প্রচণ্ড জ্বালা ফুটে উঠেছে গাল্লিয়েখখার গলায়, শয়তানি চালাকিতে আমায় ঠুটো পঙ্গু করে দিয়েছে আগেই। তলোয়ার আমি ধরতেই পারিনি।

তার মানে? এবার সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন দে সটো, তোমার সে মূর্তির সঙ্গে লড়াই-ই হয়নি? শয়তানি চালাকি সে করেছে?

গাল্লিয়েখো বলেছে, সাদা মুখোশধারী মূর্তিকে দেখেই হুঁশিয়ার হয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সাদা মুখোশধারীও তখন তার ঘোড়া থেকে নেমেছে। কোমরে ঝোলানো তলোয়ার তখনও কিন্তু সে খুলে হাতে নেয়নি। গাল্লিয়েখোর হাতে তখন খোলা তলোয়ার। সেই সুবিধেটা কাজে লাগাবার জন্যে গাল্লিয়েখো মূর্তিটার দিকে তলোয়ার উঁচিয়ে এবার ছুটে যায়—মূর্তিটা খাপ থেকে তলোয়ার খুলতে খুলতে গাল্লিয়েখো তাকে বেকায়দায় পেয়ে যাবে। কিন্তু সে সুযোগ আর মেলে না। হঠাৎ দড়ির মতো একটা বাঁধনে জড়িয়ে সে হোঁচট খেয়ে পড়ে। তলোয়ারটা ছিটকে যায় হাত থেকে। তলোয়ারটা কুড়োবার জন্যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সে টের পায় যে অদ্ভুত একটা দড়ির ফাঁসে হাত-পা তার জম্পেস করে বাঁধা হয়ে গেছে। এ বাঁধনটা যে মূর্তিটারই কারসাজি তা বুঝতে দেরি হয় না। তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যাবার সময় মূর্তিটাকে অন্ধকারে মাথার ওপর হাত তুলে কী যেন একটা করতে দেখেছিল। কিন্তু সেটা যে এই শয়তানি ফাঁস ছোড়া তা কল্পনা করতে পারেনি।

রাগে সমস্ত শরীর জ্বললেও তখন কিছু করবার নেই। হাত-পা বাঁধা পঙ্গু অবস্থায় শুধু চেয়ে দেখতে হয় যে সাদা মুখোশ-ঢাকা মূর্তিটা এগিয়ে আসছে।

মূর্তিটা কাছে এসে প্রথমে গাল্লিয়েখোর তলোয়ারটা কুড়িয়ে নেয়। তাই দিয়ে তাতেই ঘোড়ার বাঁধনটা প্রথমে কেটে সেটাকে ছুটিয়ে দেয় খোলা প্রান্তরে। তারপর তলোয়ারটা নিয়ে গাল্লিয়েখোর কাছে এসে দাঁড়ায়।

যার জন্যে এত কাণ্ড সেই মেয়েটা ভয়েই এতক্ষণ বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। এতক্ষণে সাড় ফিরে পেয়ে সে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে তার বাড়ির দিকেই ছুটে পালায়। তলোয়ারটা তুলে সে দিকে দেখিয়ে মূর্তিটা হঠাৎ তলোয়ারটা গাল্লিয়েখোর কপালের ওপর দুবার কাঁপায়। গাল্লিয়েখো একটু অস্ফুট চিৎকার না করে উঠে পারে না। চিৎকারটা শুধু কপালের কাটার জ্বালার জন্যে নয়, অক্ষম রাগের জন্যেও বটে। তার চোখের ওপরই মূর্তিটা তার তলোয়ারটা হাঁটুর ওপর দুমড়ে এক ঝটকায় তখন ভেঙে ফেলেছে। ভাঙা টুকরোগুলো মাটির ওপর দূরে ছুঁড়ে দিয়ে মূর্তিটা তারপর তার সাদা ঘোড়ায় চড়ে চলে যায়।

মূর্তিটা আর তার সাদা ঘোড়া তাহলে তুমি স্পষ্ট দেখেছে? গাল্লিয়েখোর বিবরণ শেষ হবার পর দে সটো তাঁর কাছে সবচেয়ে যা অবিশ্বাস্য সেই বিষয়টা সম্বন্ধেই আগে প্রশ্ন করেছেন।

হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছি কাপিন। বলেছে গাল্লিয়েখো, আর দ্বিতীয়বারও দেখব বলে আশা রাখি।

কীসের ওপর এ আশা? সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করেছেন দে সটো।

সত্যিই এ দেশের মানুষের সহায়, অবলা-সরলার বিপদতারণ হলে, মানের দায়ে। সে মূর্তিকে যাতে আসতে হয় সেই ব্যবস্থা করছি বলে। হিংস্র আনন্দের সঙ্গে যেন তারিয়ে তারিয়ে বলেছে গাল্লিয়েখখা, আমার হাত-ফসকানো সুন্দরীকে এখন কোথায় লুকোনো হয়েছে তার পাকা খবর পেয়েছি। সেখান থেকেই তাকে জ্যান্ত বা মরা লুঠ করবই। মুখোশওলার সঙ্গে মোলাকাত সেইখানেই হবে আশা করছি।

শোনো, গাল্লিয়েখখা! অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠে দাড়িয়েছেন দে সটো, তোমায় আমি সাবধান করে দিচ্ছি আগে থাকতে। তোমার বিরুদ্ধে এরকম কোনও অত্যাচারের নালিশ যদি আমার কানে আসে তাহলে আমি নিজে হাতে তোমায় কোতল করব।

তা-ই করবেন। কিন্তু আপনার কানে নালিশ এলে তো! গাল্লিয়েখ এখন একেবারে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে বলেছে, নালিশ করতে আসছে কে?

জবাবে কিছুই যে বলবার নেই তা বুঝে দে সটোকে বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকতে হয়েছে। সত্যিই গাল্লিয়েখোকে এতক্ষণ যে জেরা করেছেন তা-ই যথেষ্ট। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ করবার মতো কোনও অভিযোগ তো নেই। এই কাক্সামালকা শহরের নিরীহ অসহায় স্ত্রী-পুরুষের ওপর যত বড় অত্যাচারই সে করুক, হাতে হাতে ধরা না পড়লে এসপানিওল সৈনিক বলে কেউ তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে সাহস করবে

না, কোনও শাস্তিও তাকে দেওয়া যাবে না তাই।

শাস্তি কিন্তু গাল্লিয়েখো পেয়েছে। অবিশ্বাস্য শাস্তি। কামালকা শহরে একদিন সকালে হই-চই পড়ে গেছে। শহরের বড় রাস্তার ওপরই একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা এক এরপানিওল সৈনিক। তার কপালে শুধু নয়, দুই গালেও ঢেরা কাটা দাগ।

হিড্যালগো অর্থাৎ খানদানি বংশের না হোক, ভাল ঘরের নামকরা এক এসপানিওল বীর। সেই বীর কিনা কপালে আর দু-গালে দাগ নিয়ে সদর রাস্তার মাঝখানে বাঁধা! এ লজ্জা যে রাখবার জায়গা নেই।

কিন্তু এ কাজ কে করতে পারে! এতখানি ক্ষমতা কার হতে পারে তাই ভেবেই তো অবাক হতে হয়। গাল্লিয়েখো যেমন-তেমন যোদ্ধা তো নয়। মানুষটা অতি বদ সন্দেহ নেই। তার সঙ্গী-সাথীরাও তাকে সুনজরে দেখে না। বরং বেশ একটু ভয়ে ভয়েই থাকে। দূরে দূরে থাকে গাল্লিয়েখোর দাম্ভিক স্বভাব, অসুরের মতো শরীরের শক্তি আর তারই সঙ্গে হাতিয়ার চালাবার অদ্ভুত দক্ষতার দরুন। মানুষটার সব কিছু। নিন্দের হলেও সাহস শক্তি আর অস্ত্রকৌশলের প্রশংসা না করে উপায় নেই।

সেই অসামান্য বীরের এমন মুখ-পোড়ানো অপমান লাঞ্ছনা কার হাতে হল?

এ কাজ করবার ক্ষমতা যদিবা কারও থাকে তার এত বড় সাহস আর স্পর্ধা হয় কী করে?

এ দেশের মানুষের কাছে এসপানিওলদের দেবতার চেহারা এখন আর নেই। কিন্তু দানবের চেহারাটা তার বদলে খাড়া না রাখলে তো নয়। এমন দানব যে ইচ্ছে করলে যা খুশি করতে পারে, নিজেদের সম্বন্ধে এরকম একটা ভয় জাগিয়ে রাখতে না পারলে মুষ্টিমেয় ক-টা এসপানিওল-এর এ দেশে দু-দিন টিকে থাকাই তো সম্ভব হবে না।

সুতরাং যে কোনও একজন এসপানিওল-এর চূড়ান্ত অপমান এভাবে এ দেশের মানুষের গোচর করার মানে পিজারোর সমস্ত বাহিনীকে এদের চোখে খাটো করে তাদের ভয় ভাঙার ব্যবস্থা করা।

ধরা পড়লে এ কাজের শাস্তি পিজারোর কাছে যে কী হবে তা বোঝা শক্ত নয়। এসপানিওল হয়ে অত বড় সাহস আর স্পর্ধা কারও পক্ষে দেখানো তো অসম্ভব মনে হয়।

কিন্তু এসপানিওল কোনও সৈনিকের যদি না হয় তাহলে কাজটা কার? এ দেশের আজগুবি কুসংস্কারের গল্পই কি তাহলে বিশ্বাস করতে হয়?

পিজারোর বাহিনীর মধ্যে একটা চাপা ভয়ের গুঞ্জন আগে থাকতেই ছিল। এবার তা তীব্রভাবে ছড়াতে শুরু করেছ।

এ গুঞ্জন ক্রমশ কী চেহারা নিত বলা যায় না, কিন্তু পিজারোর কাছে অনুমতি নিয়ে আর দে কান্ডিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে দে সটো একটা বুদ্ধিমানের মতো ব্যবস্থা করেছেন, ব্যাপারটার মূলেই কোপ দিয়ে।

ঘটনার পরের দিন থেকেই গাল্লিয়েখকে আর কামালকায় দেখা যায়নি।

কোথায় সে গেছে জানতে পারেনি কেউ। জল্পনা কল্পনা অবশ্য কয়েকদিন চলেছে। নানারকম। কেউ বলেছে লজ্জায় অপমানে আত্মঘাতী হয়েছে গাল্লিয়েখো, স্বয়ং পিজারোই তাকে এসপানিওলদের মুখে চুনকালি দেবার অপরাধে গোপনে কোতল করবার হুকুম দিয়েছেন বলেছে কেউ। কার হাতে গাল্লিয়েখোর এমন লাঞ্ছনা হয়েছিল তা নিয়ে লুকোছাপা আলোচনাটা এবার একটু অন্য দিকে বাঁক নিয়েছে। কাপিতানদেরই কাউকে, হয়তো স্বয়ং দে কাণ্ডিয়া কি দে সটোর মতো মানুষকেই ঘাঁটাতে গেছল বলে গাল্লিয়েখোর শাস্তি আর লাঞ্ছনাটা অমন চরম হয়েছে বলে শোনা গেছে কারও কারও মুখে।

এ গুজবে পুরোপুরি বিশ্বাস কেউ বোধহয় করেনি। তবু গাল্লিয়েখো সামনে থাকলে অস্ফুট সন্দেহ আর ভয়টা যে ইন্ধন পেয়ে সাংঘাতিক হয়ে উঠতে পারত সেটা না পাওয়ার দরুন এ গুজবও সৈনিকদের আশ্বস্ত করবার কাজে কিছুটা লেগেছে।

কাপিতানদের কারও হাতে শিক্ষা পেয়ে গাল্লিয়েখোর বেমালুম গায়েব হওয়ার গুজব রটাবার ফন্দিটা কিন্তু দে সেটোর নয়, কূটচক্রী সেই হেরাদার, মাকিয়াভেল্লী থেকে চুরি করা বিদ্যে দিয়ে এক হিসেবে যে ইংকা সাম্রাজ্য ধ্বংসের সবচেয়ে শয়তানি উপায় বাতলেছে।

দে সটোর হেরাদার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধার বদলে বেশ একটু ঘৃণাই ছিল। তার কাছে। পরামর্শের জন্যে তিনি যাননি।

সদর রাস্তার ওপর গাল্লিয়েখোর লজ্জাকর লাঞ্ছনাটা শহরসুদ্ধ সবাই-এর চোখে পড়বার পর এসপানিওল বাহিনীর মান-সম্ভ্রম বাঁচাবার জন্যেই দে সটো তাকে : কামালকা থেকে সরিয়ে দেবার কথা ভেবেছেন।

এ বিষয়ে পরামর্শ করবার জন্যে প্রথমে গানাদোরই খোঁজ করেছিলেন। তাকে কোথাও না পেয়ে গাল্লিয়েশখা যাঁর দলের লোক সেই দে কান্ডিয়ার সঙ্গেই পরামর্শ করেছেন গোপনে। দে কান্ডিয়া তাঁর মতেই সায় দেবার পর দুজনে মিলে গেছেন পিজারোর কাছে।

পিজারোর কাছে খবরটা ঠিক মতো তখনও পৌঁছোয়নি। সকাল থেকে তিনি বন্দি ইংকা সম্রাট আতাহুয়ালপার কাছেই উপস্থিত আছেন বলে বোধহয় সবাই তাঁকে যথার্থ খবরটা দিতে দ্বিধা করেছে।

শহরে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে এমনই একটু ভাসা-ভাসা খবর ছাড়া পিজারোর কানে আর কিছু পৌঁছোয়নি। ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার সঙ্গে এমন একটা অত্যন্ত লোভনীয় আলোচনায় তিনি তখন তন্ময় যে দে সটো আর দে কান্ডিয়ার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সেখানে আসাটা তিনি উপদ্রবই মনে করেছেন প্রথমে।

আসলে বন্দীনিবাস হলেও ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার জন্যে নির্দিষ্ট মহলে সম্রাটোচিত স্বাচ্ছন্দ্যবিলাসের কোনও উপকরণেরই অভাব নেই বললে হয়। পিজারো সে দিক দিয়ে কোনও ত্রুটি না রাখবার ঢালাও হুকুম দিয়েছেন। আতাহুয়ালপা যেন তাঁর নিজের ঝরনা-মহল ছেড়ে সাধ করেই অতিথি মহল্লায় কিছুদিন ডেরা বেঁধেছেন বাইরে থেকে দেখলে এমনই মনে হবে। তাঁর পেয়ারের সব পত্নীরা সেখানে জায়গা পেয়েছেন, তাঁর সেবা করবার খিদমদগার আগে যেমন থাকত এখনও তেমনই আছে। অভিজাত থেকে সাধারণ তাঁর ভদ্র প্রজারা নিত্য ভেট নিয়ে যথাসময়ে তাঁকে এখানে দর্শন করে যাবার সুযোগ পায়। পিজারো স্বয়ং আর তাঁর হুকুমে এসপানিওলরা সবাই তাঁকে সম্রাটের উপযুক্ত খাতিরই দেখায়।

সেদিন সকালেও পিজারো যেন রাজদর্শনে আসার ভঙ্গিতে আতাহুয়ালপার কাছে। বসেছিলেন। আতাহুয়ালপার সেটি এখানকার দরবার-ঘর। তিনি নিজে তাঁর বিশেষ সোনা-রুপোর কাজ করা আসনে বসে আছেন, পিজারোও দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু তিনি বসেছেন অতি সাধারণ আর আরও নিচু একটি আসনে। ঘরে আর একটি মাত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে দোভাষী।

পিজারো তাঁর আলোচনায় একেবারে তন্ময় থাকার দরুন প্রথমে দে সটো আর দে কান্ডিয়াকে দেখতেই পাননি। দোভাষীই তাঁদের উপস্থিতির কথা তাঁকে জানিয়েছে। পিজারোর মুখে তাতে একটু ভুকুটি ফুটে উঠেছে গোড়ায়। সেটা এক মুহূর্তের জন্যেই। তাঁর দুই প্রিয় কাপিতানকে পরে দেখা করবার কথা বলতে গিয়ে তাই তিনি থেমেছেন। দে সটো আর দে কান্ডিয়ার মুখের ভাব দেখেই গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। তাঁরা মুখ ফুটে কিছু বলার আগে, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও, নিজে থেকেই তিনি উঠে পড়ে ইংকা নরেশের কাছে সসম্রমে বিদায় চেয়েছেন।

কিন্তু আমার যে আরও কিছু বলার ছিল। দোভাষীর মারফত জানিয়েছেন আতাহুয়ালপা। তাঁর বক্তব্যটায় ক্ষোভের আভাস থাকলেও মুখ তাঁর নির্বিকার উদাসীন।

আমি ফিরে এসেই সব শুনব। পিজারোই কুণ্ঠিত প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলেছেন, আমায় সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে মাপ করুন, সম্রাট।

সম্রাটের কথা পুরো না শুনে চলে যাওয়ার যে স্পর্ধার জন্যে এককালে মাথাটাই কেটে রাখতেন, আতাহুয়ালপাকে প্রসন্ন মুখে তা মাপ করবার উদারতা দেখাতে হয়েছে।

পিজারো দুই কাপতানকে নিয়ে নিজের কামরায় যেতে যেতেই সমস্ত ব্যাপারটা শুনেছেন। শুনে চিন্তিত হয়েছেন অত্যন্ত বেশি। দে সটোর গাল্লিয়েখোকে কামালকা থেকে সরিয়ে দেবার প্রস্তাবে সায় দিয়েও উদ্বিগ্ন দুশ্চিন্তা তাঁর ঘোচেনি।

কে এ কাজ করতে পারে, এ প্রশ্নের চেয়ে একজন এসপানিওল সৈনিকের এ। রকম লজ্জাকর প্রকাশ্য দুর্গতির কী প্রতিক্রিয়া এ দেশের লোকের ও এসপানিওল বাহিনীর অন্য সকলের মনে হতে পারে তাই নিয়েই তাঁর দুশ্চিন্তা অত্যন্ত বেশি দেখা গেছে।

এর পর তো এ দেশের লোকের মনে সন্দেহ জাগবে আমাদের ক্ষমতায় আর আমাদের নিজেদের সৈনিকদের মনে ভয়। পিজারো যেন যন্ত্রণার সঙ্গে বলেছেন, এত কষ্টে যে চেষ্টা প্রায় সফল করে তুলেছি তা তো সব যাবে পণ্ড হয়ে। গাল্লিয়েখোকে সরিয়ে দিতে বলছেন তা দিচ্ছি, কিন্তু তাতে কি ধিকিধিকি সন্দেহের আগুন নিভবে, না লোকের মুখ বন্ধ হবে!

দে সটো আর দে কান্ডিয়া নিজেদের মনের সংশয় নিয়ে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাননি। পিজারো নিজে থেকে এবার হেরাদাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইংকা নরেশকে বন্দি করার ব্যাপারে তার বাতলানো শয়তানি ফন্দি সফল হবার পর থেকে পিজারোর কাছে হেরাদার খাতির বেড়ে গেছে।

হেরাদা এসে সমস্যা শুনে সব দিক রক্ষা করবার জন্যে যে রটনার পরামর্শ দিয়েছে তাতে একেবারে মুশকিল আসান না হলেও হেরাদার বিচক্ষণতারই পরিচয় পাওয়া গেছে সন্দেহ নেই।

কাকসামলকা নগরের ইংকা প্রজাদের কাছে এ রটনা কতখানি পৌঁছেছে আর। তারা কীভাবে সেটা নিয়েছে তা বোঝবার সুবিধে পিজারোর সৈনিকদের হয়নি, কিন্তু তাদের নিজেদের মনে গাল্লিয়েখোর কথা চাপা দেবার জন্যে কোনও চতুর রটনার আর বিশেষ দরকার হয়নি। এমন এক উত্তেজনায় এর পর তারা মেতে উঠেছে যা অন্য সব ভয়-ভাবনা ফিকে করে দিয়েছে।

এ উত্তেজনার সূত্রপাত হয়েছে আতাহুয়ালপার দরবার-ঘরে দে কান্ডিয়া আর দে সটো যখন পিজারোর সঙ্গে দেখা করতে যান তার কিছুক্ষণ মাত্র আগে।

আতাহুয়ালপা তাঁর দোভাষীকে দিয়ে সেইদিনই পিজারোকে বিশেষ একটি অনুরোধ করে পাঠিয়েছিলেন। পিজারো সেই সকালেই সময় করে তাঁর একটি বিশেষ প্রস্তাব যদি শুনে যান তাহলে আতাহুয়ালপা অত্যন্ত খুশি হবেন।

পিজারো মনে মনে একটু বিরক্তি নিয়েই আতাহুয়ালপার কাছে গেছলেন। বাইরে থেকে ইংকা নরেশের মর্যাদা রক্ষার কোনও ত্রুটি না রাখলেও তাঁর কাছে দণ্ডবৎ রাজভক্তির ভান করতে কত আর ভাল লাগে! আতাহুয়ালপা ক-দিন ধরে আবার মুক্তি পাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছেন। মুক্তি চাইবার ধরনটা ভিক্ষের মতো না হলেও দেখা করলেই সেই এক কথা, তোমরা তো এখন ইংকা সাম্রাজ্যের সহায় আর আমি তোমাদেরই লোক। আমার কি আর এই কাকসামালকা শহরের অতিথি মহল্লায় বসে বসে দিন কাটানো ভাল দেখায়? চলো, তোমাদের নিয়ে আমার সাম্রাজ্য ঘুরিয়ে দেখাই।

তা তো দেখাবেনই। আতাহুয়ালপাকে নানাভাবে স্তোক দিতে হয়েছে পিজারোকে, এখানকার গোলমালগুলো একটু সামলেই আপনার সঙ্গী হব।

সেদিন সকালের তলবটাও ওই এক কথার জন্যে ধরে নিয়ে অপ্রসন্ন মনে আসবার পর আতাহুয়ালপার প্রস্তাবটা শুনে থ হয়ে গেছেন পিজারে।

প্রথমটা আতাহুয়ালপার প্রস্তাব সত্যি বলে বিশ্বাস করতেই পারেননি। অবাক হয়ে।

আতাহুয়ালপাকে না জিজ্ঞেস করে পারেননি, আপনি আমার সঙ্গে পরিহাস করছেন নিশ্চয়!

পরিহাস করব! আপনার সঙ্গে? আতাহুয়ালপা একটু আহত হয়ে দোভাষী মারফত জানিয়েছেন, ইংকা সাম্রাজ্যের অধীশ্বরেরা পরিহাস করতে জানে না, সাগর-পারের বীর। তারা চিরকাল হয় তিরস্কার করেছে, না হয় পুরস্কার দিয়েছে। আমি আপনাকে পুরস্কার দিতে চাই। এমন পুরস্কার যা আপনার কল্পনার বাইরে।

আতাহুয়ালপা সেদিন তাঁর মুক্তির কথা একবার ইঙ্গিতেও জানাননি, পিজারোকেও তাই ঘুরিয়ে কথা বলতে হয়েছে।

আপনার কাছে পুরস্কার পাব, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য, কিন্তু তা পাবার মতো কী যোগ্যতা আমার আছে? সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো।

এবার আতাহুয়ালপা যা বলেছেন, তা অনুবাদ করতে দোভাষীর বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ইংকা নরেশ বলেছেন, কী আছে তা আমার চেয়ে তিনি বেশি জানেন, সারা বিশ্বের দীপ্তিদাতা পরমারাধ্য সূর্যদেবের যিনি দোসর ও অগ্রদূত। আপনাদেরই মতো শুভ্র বর্ণ নিয়ে যিনি পশ্চিম সমুদ্রকূলে ইংকা রাজশক্তির অভ্যুদয় বার্তা নিয়ে এসেছিলেন সেই মহিমান্বিত ভীরাকোচাই আমায় এ আদেশ দিয়েছেন।

ভীরাকোচা! অস্ফুটভাবে নিজের অজ্ঞাতেই পিজারোর মুখ দিয়ে বিস্মিত উচ্চারণটা বেরিয়ে গেছে। কিছুদিন ধরেই ভীরাকোচা দেবতার নামটা নানাভাবে তাঁর কানে আসছে। ভীরাকোচার নতুন করে আবির্ভাবের কিংবদন্তিও তিনি কয়েকজনের কাছে শুনেছেন।

মনের বিস্ময়-চাঞ্চল্যটা চাপা দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, কিন্তু আপনাদের আরাধ্য তো সূর্যদেব। ভীরাকোচাকে আপনারা মানেন? তিনি তো সূর্যদেবের প্রতিদ্বন্দ্বী।

প্রতিদ্বন্দ্বী! আতাহুয়ালপার মুখে একটু বিদ্রূপের হাসি দেখা দিয়েছে দোভাষীকে বোঝাবার সময়, আপনাদের পণ্ডিতরা তাই আপনাকে বুঝিয়েছে বুঝি! দু-দিন আমাদের দেশে পা দিতে না দিতেই আমাদের জাতি-ধর্ম-সমাজ তারা বুঝে ফেলেছে!

একটু থেমে আতাহুয়ালপা গম্ভীর হয়ে আবার বলেছেন, না, আপনি যা শুনেছেন তা ভুল। ভীরাকোচা সূর্যদেবের প্রতিদ্বন্দ্বী নন, দোসর। তাঁর আর-এক নাম পাচাকামাক। সে নামের মানে হল যিনি জীবন দেন। তিনি সৃষ্টির মধ্যে জীবনের উৎস আর সূর্যদেব তার প্রাণশিখা। দু-জনের কোনও বিরোধ নেই। ভীরাকোচা তাঁর দোসরের অগ্রদূত হয়ে বরং আগে আমাদের রাজ্যে পদার্পণ করেছেন। পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে তাঁর বিশাল দেবায়তন আপনাদের দেখাবার বাসনা রাখি।

কী করে তাঁর আদেশ পেলেন একটু জানতে পারি? পিজারো তাঁর এ কয়দিনের শোনা উদ্ভট কল্পনা-কিংবদন্তিগুলোতে আতাহুয়ালপারই অদৃশ্য হাত আছে কি না কৌশলে জানবার চেষ্টায় সরল সশ্রদ্ধ কৌতূহলের ভান করেছেন।

উত্তর যা শুনেছেন তা তাঁকে বিমুঢ় করে দিয়েছে। আতাহুয়ালপা জানিয়েছেন, ভীরাকোচার এ আদেশ আপনাদের একজনেরই মুখ দিয়ে পেয়েছি।

আমাদেরই একজনের মুখ দিয়ে সন্দিগ্ধ স্বরটা লুকোতে পারেননি পিজারো।

হ্যাঁ, আপনাদেরই একজন। অবিচলিতভাবে বলেছেন আতাহুয়ালপা, আপনারা যাকে গানাদো বলেন সেই দৈবজ্ঞই জানিয়েছেন এ আদেশ। এ দৈবজ্ঞ আপনারই। পাঠানো মনে আছে বোধহয়?

আতাহুয়ালপার কাছে দৈবজ্ঞ পাঠাবার কথা পিজারোর ঠিকই মনে পড়েছে। না মনে পড়বার কথা নয়।

এই তো মাত্র কয়েকদিন আগের ব্যাপার। আতাহুয়ালপা সম্বন্ধে একটা মজার। খবর পিজারোর কানে আসছিল। খবরটা এমন কিছুই বলতে গেলে নয়। অন্য কোথাও বা অন্য সময় হলে হেসেই উড়িয়ে দেওয়া যেত।

আতাহুয়ালপাকে ক-দিন ধরে মাঝে মাঝে কীরকম সব রংচঙে সুতো নাড়াচাড়া করতে দেখা যাচ্ছে, এই ছিল খবর।

খবর এনেছিল অবশ্য গুপ্তচরেরা। ইংকা নরেশকে রাজসমাদরে রাখলেও। পিজারো তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস তো আর করেননি। আতাহুয়ালপার মহল ঘিরে সারাক্ষণ কড়া পাহারা যেমন ছিল, তেমনই ছিল এ দেশেরই বাছা বাছা আর শেখানো পড়ানো দু-একজনকে দিয়ে তাঁর ওপর গোপনে নজর রাখবার ব্যবস্থা।

এসব গুপ্তচর হয় পুনা দ্বীপ কিংবা কুজকো শহরের কাছাকাছি দক্ষিণ অঞ্চলের লোক। পুনা দ্বীপের অধিবাসীরা ইংকা সম্রাট মাত্রেরই বিরুদ্ধে শত্রুতা করে আসছে বহুকাল ধরে। কোনও ইংকা সম্রাটের অধীনতাই তারা খুশিমনে মেনে নেয়নি। তারা দুর্দান্ত লড়াইবাজ। পিজারো নিজেই তাদের হাতে দলবল সমেত প্রায় মারা পড়তে বসেছিলেন একবার। তা সত্ত্বেও ইংকা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাদের মজ্জাগত আক্রোশের কথা জেনে তাদের দু-একজনকে দলে নিতে তিনি দ্বিধা করেননি।

পেরুর দক্ষিণ অঞ্চলের লোকও সানন্দে পিজারোর হয়ে গুপ্তচরের কাজ করেছে। আতাহুয়ালপার ভাই হুয়াসকারকেই তারা সত্যকার ইংকা মনে করে বলে। কুইটো নয়, কুজকোই তাদের কাছে আসল রাজধানী। কুইটোর ভিনদেশি রাজকুমারীর গর্ভে যার জন্ম সেই আতাহুয়ালপাকে তারা ইংকা বলেই স্বীকার করে না।

এই দুই জাতের চরই পিজারোর কাছে অদ্ভুত রঙিন সুতোর খবরটা দিয়েছিল।

খবরটা শুনে মনে মনে হাসিই পেয়েছিল পিজারোর। আতাহুয়ালপার ওপর। এদের জাতক্রোধের কথা তিনি ভালো করেই জানেন। সেই রাগে এরা নেহাত তিলকে তাল করে তুলেছে বলে মনে হয়েছিল তাঁর।

তবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন চরেদের একটু ঠাট্টার সুরে, রঙিন সুতোগুলো কীরকম? নিজের বা অন্য কারও গলায় ফাঁস দেবার মতো কিছু?

না, তা নয়। জানিয়েছিল চরেরা প্রত্যেকেই, নেহাত রংবেরং-এর ক-টা গিট-বাঁধা সুতুলি।

এসব সুতুলি পেলেন কোথায় আতাহুয়ালপা? মুখটা কষ্ট করে গম্ভীর রেখে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল পিজারোকে।

তা জানি না। একই উত্তর দিয়েছিল জনে জনে।

দোষটা কী, অমন দুচারটে রঙিন সুতো নাড়াচাড়া করলে? ইংকা নরেশের হয়তো ওগুলো একরকম খেলার জিনিস! বলে চরেদের মুখের দিকে একটু বাঁকাভাবে চেয়ে পিজারো জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ওগুলো নিয়ে ভাবনা করবার কিছু আছে? শুধু ক-টা

রঙিন গিট-পড়া সুতো বই আর কিছু তো নয়?

চরেদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলেছিলেন পিজারো। তাঁর শেষ প্রশ্নের জবাব তারা কেউ দেয়নি।

আতাহুয়ালপা আর ইংকা-সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জন্মগত আক্রোশ নিয়েও রঙিন গিট-পড়া ক-টা সুতোর বিষয়ে খবরটুকু মাত্র জানিয়ে তারা নীরব থেকেছে।

কিন্তু ওগলো তো কিপু!—হঠাৎ উত্তেজিত উচ্ছাস শোনা গেছে। গিট-দেওয়া যে-রঙিন সুতো দিয়ে পেরুতে লেখাপড়ার কাজ চলত!

ষোড়শ শতাব্দীর কোনও এসপানিওল কি পেরুবাসীর কণ্ঠ নয়, ওই উচ্ছাস শোনা গেছে মেদভারে যিনি হস্তীর মতো বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুর কণ্ঠে।

দাসমশাই কি বিরক্ত হয়েছেন?

আর সকলেই প্রায় তটস্থ হয়ে চেয়েছেন তাঁর দিকে। এ ধরনের মূঢ় বেয়াদবির ফল কী হতে পারে, তাঁদের অজানা নয়। দাসমশাই মুখে একেবারে তালাচাবি দিতে পারেন। মাঝপথেই পূর্ণচ্ছেদ পড়তে পারে কাহিনীর ধারায়।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ দাসমশাই-এর প্রতি নাতিপ্রসন্ন সেই ঐতিহাসিক শিবপদবাবুও ভবতারণবাবুর মূঢ়তাকে ঈষৎ তিরস্কার করেছেন বিপদটা কাটাবার জন্যে। বলেছেন, আপনার এখুনি বিদ্যে জাহির না করলে চলছিল না ভবতারণবাবু! ওগুলো কী, তা কি শুধু আপনিই জানেন যে কিপু বলে না চেঁচিয়ে উঠলে আমরা অন্ধকারে পড়ে থাকতাম! পিজারো নিজেই কি কিপু-র কথা একেবারে জানতেন না।

না, তিনি জানতেন না বিন্দুবিসর্গও।দাসমশাই শিবপদবাবুকে সংশোধন করতে পেরেই খুশি হয়েছেন। কিপু তখন সত্যিই তাঁর কাছে হেলাফেলার কটা রঙিন সুতো ছাড়া কিছু নয়। আতাহুয়ালপাকে জব্দ করার এমন একটা সুযোগ পেয়েও গুপ্তচরেরা কিপু-র রহস্য ফাঁস করে দিতে পারেনি।

কেন?

হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থবুদ্ধির চেয়ে মনের আরও গহিন গভীর কোনও নির্দেশে বোধহয়। ব্যক্তিগত সত্তা ছাড়িয়ে যে নির্দেশ এসেছে রক্তের অতলতা থেকে।

চরেরা সব বলতে চেয়েও এক জায়গায় এসে থেমে গেছে এবং পিজারোও আতাহুয়ালপার হাতে সামান্য ক-টা রঙিন সুতোর খবর নিয়ে ব্যস্ত হবার কিছু পাননি।

তা সত্ত্বেও ওরই মধ্যে একদিন কথায় কথায় আতহুয়ালপার কাছে প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন পিজারো।

আপনি নাকি কী সব রঙিন সুতো নিয়ে খেলা করেন, সম্রাট?

হ্যাঁ, করি, ভাবান্তরহীন মুখে বলেছেন আতাহুয়ালপা, আর কোনও কাজ নেই যখন সময় কাটাবার একটা কিছু তো চাই!

দেখতে পারি রঙিন সুতোগুলো!—পিজারো বিনীতভাবে যেন প্রার্থনা জানিয়েছেন।

খুব পারেন! বলে নিজের রাজাসনের পাশ থেকেই একটি রঙিন সুতুলি আতাহুয়ালপা পিজারোর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন।

নেড়েচেড়ে সেটা দেখতে দেখতে পিজারোর ঠোঁটের কোণে একটু অবজ্ঞার হাসি একেবারে চাপা থাকেনি। নেহাত সাধারণ ক-টা রংবেরং-এর গিটপড়া সুতো একসঙ্গে জড়ানো। ছেলেখেলার যোগ্যও সেটা নয়।

মনে যা হয়েছে বাইরে তার বিপরীতটাই প্রকাশ করে পিজারো উৎসাহ দেখিয়ে বলেছেন, জিনিসটা তো বেশ মজার! সত্যি কী করেন এগুলো নিয়ে?

তা জানেন না? পিজারের চরেদের সম্বন্ধে বিদ্রূপের ইঙ্গিতটুকু খুব অস্পষ্ট না। রেখে আতাহুয়ালপা জিজ্ঞাসা করেছেন, কেউ কিছু বলেনি আপনাকে?

বিদ্রূপের প্রচ্ছন্ন খোঁচাটাই লক্ষ করেছেন পিজারো। আতাহুয়ালপার নির্বিকার মুখে যার আভাসও পাওয়া যায়নি এ প্রশ্নের পেছনে সেই আসল উদ্বেগটা কী নিয়ে তা পিজারো ধরতেই পারেননি।

শুধু খোঁচাটা টের না পাবার ভান করে তাই তিনি সরল সত্য কথাই বলেছেন, না, বলবে আবার কে কী! এ যে খেলার জিনিস তা তত বোঝাই যাচ্ছে। তবে সময় কাটাতে এর চেয়ে ভাল খেলার জিনিস আপনাকে দিতে পারি। তা শেখাও সহজ।

পিজারো তাঁদের তখনকার স্পেনের চালু তাসের জুয়া ব্যাকারা-র কথা ভেবেই ও প্রস্তাব করেছিলেন নিশ্চয়। জুয়ায় মাতিয়েও আচাহুয়ালপার কাছে যা কিছু পারা যায় নিংড়ে বার করবার লোভ বোধহয় তাঁর হয়েছিল।

আতাহুয়ালপা কিন্তু সে ফাঁদে পা-ই বাড়াননি। একটু উন্নাসিকভাবেই বলেছিলেন, সময় কাটাবার জন্যে নতুন খেলা শেখবার ধৈর্য আমার নেই, সাগরপারের বীর। চান তো, নতুন খেলা শিখিয়ে নয়, সময় কাটাতে আমার অন্য একটা নেশার জিনিস জুগিয়ে সাহায্য করতে পারেন।

কী নেশা আপনার? একটু সন্দিগ্ধসুরেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন পিজারো। আতাহুয়ালপার একটু-আধটু চিচা পান ছাড়া আর কোনও নেশার কথাই জানা যায়নি এ পর্যন্ত।

ভবিষ্যৎ গণনার নেশা! পিজারোকে বেশ অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন আতাহুয়ালপা।

সে নেশা মেটাতে আমি কী করতে পারি! পিজারোর মুখে একটু ভুকুটি এবার অস্পষ্ট থাকেনি। আমি তো আর গণৎকার নই।

আপনি নিজে না হন আপনার দলের মধ্যে তেমন কি কেউ নেই? আতাহুয়ালপার সাধারণত নির্বিকারমুখে এবার এক ঔৎসুক্য ফুটে উঠেছিল।

আবেদনটা সত্যিই অদ্ভুত লেগেছিল পিজারোর। বিস্মিতভাবেই জানতে চেয়েছিলেন, আপনি আমাদের দল থেকে একজন জ্যোতিষী চান! কেন?

আমার নিজের দেশের গণকারদের ওপর আর ভক্তি নেই বলে। অসংকোচে জানিয়েছিলেন আতাহুয়ালপা, যে কোনও পাপে হোক, তাদের দিব্যদৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত যা ঘটল তার একটু ইঙ্গিতও তারা দিতে পারেনি।

আমাদের কেউই যে তা পারবে তার ঠিক কী? পিজারো নিজের মনের সত্যকার সংশয়টাই জানিয়েছিলেন।

কিন্তু আতাহুয়ালপা এ সংশয়কে আমল না দিয়ে বলেছিলেন, তবু চেষ্টা করতে আপত্তি কী! আছে আপনাদের মধ্যে কেউ এমন দৈবজ্ঞ?

পিজারো তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারেননি। প্রথমটা কারও নামই মাথায় আসেনি তাঁর। তারপর হঠাৎ বেদে গানাদোর কথা মনে পড়েছিল। জ্যোতিষবিদ্যা সত্যি সে জানে কি না তা পিজারো নিজেই বলতে পারেন না। কিন্তু জাতে বেদে বলে তার অদ্ভুত কিছু ক্ষমতা-টমতা বোধ হয় আছে। তার পরিচয়ও একটু-আধটু পাওয়া যায়নি এমন নয়। আর কিছু না হোক, আতাহুয়ালপাকে কিছুটা ভুলিয়ে রাখতে সে পারবে। আতাহুয়ালপার পেটের কথাও একটু-আধটু বার করা তার পক্ষে হয়তো অসম্ভব হবে না।

পিজারো গানাদোকেই আতাহুয়ালপার কাছে একদিন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পাঠাবার আগে তাকে একটু তালিম দিতে ভোলেননি।

তোমার তো ভর-টর হত বলেছিলে। ভর হলে আবার নাকি দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। তা এখন ভর-টর হয়? একটু যেন কড়া গলাতেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন পিজারো।

যাঁরা ভর করেন তাঁদের মর্জি হলেই হয়, আদেলানতাদো। সবিনয়ে জানিয়েছে গানাদো।

আদেলানদো ছাড়া আর কিছু বলে গানাদো তাঁকে সম্বোধন করে না। আগে বিরক্তি লাগত। এখন সয়ে গেছে।

তবু ধমক দিয়ে পিজারো বলেছেন, ও-সব প্যাঁচালো কথা ছাড়ো। দেবতা-অপদেবতার ভর হালফিল হয়েছে কি না জানতে চাইছি।

আজ্ঞে তা অনেক দিন হয়নি। কুণ্ঠিতভাবে যেন স্বীকার করেছে গানাদো। হুঁ, পিজারো বিদ্রূপের খোঁচাটুকু না দিয়ে পারেননি, যাঁরা ভর করতেন তাঁরা সাগর পেরিয়ে আর তোমার নাগাল পাচ্ছেন না কেমন?

গানাদো লজ্জাতেই যেন কোনও জবাব দেয়নি।

পিজারোই আবার বলেছেন, শোনো, ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার আমাদের জ্যোতিষীদের দিয়ে ভাগ্য গণাবার শখ হয়েছে। পারবে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে?

দেবতারা যদি দয়া করেন, আদেলানতাদো, তাহলে নিশ্চয়ই পারব।—প্রায় করুণভাবে জানিয়েছে গানাদো।

দেবতারা দয়া করুন না করুন, আতাহুয়ালপাকে খুশি তোমায় করতেই হবে, এবার কঠিন আদেশের স্বরেই বলেছেন পিজারো, আর চেষ্টা করতে হবে গণনা করার ছলে ওর পেটের কথা বার করবার। ওর সোনাদানা কোথায় কী লুকোনো আছে যদি জানতে পারো–

তাহলে আপনাকে তৎক্ষণাৎ জানাব, আদেলানতাদো। পিজারোর কথাটা পূরণ করে দিয়েছে গানাদো মাঝখানে বাধা দিয়ে।

পিজারো এ বেয়াদপি কিন্তু গ্রাহ্যই করেননি। লুব্ধ প্রত্যাশায় বদান্য হয়ে বলেছেন, হদিস যা তুমি দেবে তা নির্ভুল হলে সোনাদানা যা কিছু উদ্ধার হবে তার মোটা বখরা তোমার।

আপনার অসীম দয়া, আদেলানতাদো, বলেছে গানাদো।

গানাদো তারপর থেকে আতাহুয়ালপার কাছে নিয়মিতভাবে যাতায়াত যে করেছে। পিজারো তা জানেন।

আতাহুয়ালপা জ্যোতিষের বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করায় এইটুকু তিনি ধরে নিয়েছেন যে, ইংকা নরেশকে খুশি করতে না পারুক, একেবারে হতাশ সে করেনি।

আতাহুয়ালপার গোপন কোনও খবর সে এখনও আনতে পারে এইরকম একটু ক্ষীণ আশার বেশি পিজারোর মনে আর কিছু ছিল না।

হঠাৎ আতাহুয়ালপার অবিশ্বাস্য প্রস্তাব শুনে আর সে প্রস্তাবের মূলে সেই গানাদোই আছে জেনে প্রথমটা পিজারো সত্যিই তাই রীতিমতো অভিভূত বিহ্বল হয়ে যান।

আতাহুয়ালপা যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। বন্দিনিবাসে আতাহুয়ালপার দরবার ঘরটির মাপ ছিল লম্বায় প্রায় চল্লিশ আর চওড়ায় বারো হাত। পিজারোর সঙ্গে পুরস্কারের কথাটা আলাপ করতে করতে আতাহুয়ালপা প্রথমে ঘরের মেঝেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছেন, এই মেঝের মাপটা ভাল করে দেখে রাখুন, সাগরপারের বীর।

পিজারো অবাক হয়ে মেঝের দিকে তাকাবার পরই আতাহুয়ালপা হঠাৎ তাঁর রাজাসন থেকে উঠে পড়ে প্রশস্ত ঘরটির দেয়ালের কাছে চলে গিয়েছেন। পিজারোকে রীতিমতো চমকে দিয়ে তারপর পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা হাত যতদূর সম্ভব ওপরে তুলে আঙুলের ডগা দিয়ে দেওয়ালে একটা দাগ টেনে বলেছেন, আমার হাতটা কতদূর পৌঁছোয় তা-ও লক্ষ করুন।

দেওয়ালের কাছ থেকে আবার ঘরের মাঝখানে নিজের রাজাসনে এসে বসে আতাহুয়ালপা তারপর যা বলেছেন তা উন্মাদের প্রলাপ বলে মনে হয়েছে। পিজারোর।

মেঝে থেকে যতদূর পর্যন্ত হাত তুলে দাগ দিয়েছেন দরবার-ঘরের সেই সমস্ত জায়গা আতাহুয়ালপা উপহার হিসেবে সোনায় যদি ভরে দেবেন বলেন তাহলে তা প্রলাপ ছাড়া আর কী ভাবা যায়?

প্রলাপ কিংবা পরিহাস!

প্রলাপ নয়, পরিহাস নয়, পিজারোর নিজেরই দলের এক দৈবজ্ঞ গানাদোর মুখ দিয়ে পেরুর আদিম দেবতা ভীরাকোচার নাকি এই আদেশ!

আতাহুয়ালপার মুখে এই পর্যন্ত শোনবার পর দে সটো আর দে কান্ডিয়া এসে পড়ায় গুরুতর সমস্যার মীমাংসার জন্যে পিজারোকে আলোচনায় ছেদ টেনে চলে যেতে হয়েছিল।

দ্বিতীয়বার এ বিষয়ে আলাপ করতে পেরেছিলেন তার পরের দিন।

যা ভয় করেছিলেন তা অমূলক বলে বোঝা গেছে। আতাহুয়ালপার ইতিমধ্যে মতিগতি বদলায়নি। আগের দিন যা বলেছিলেন এখনও তাঁর মুখে সেই এক কথা। ভীরাকোচার আদেশে শ্বেতবাহিনীর সেনাপতিকে পুরস্কৃত তাঁকে করতেই হবে, আর সে পুরস্কার কী তা তিনি আগেই দেখিয়ে দিয়েছেন।

কিন্তু এত সোনা আপনার আছে কোথায়? এবার লুব্ধভাবে প্রশ্ন করেছেন পিজারো, এই কামালকা শহরে?

না। জানিয়েছেন আতাহুয়ালপা, আছে আমার সমস্ত রাজ্যের নানা জায়গায় লুকোনো। সেখান থেকে সে সব আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু যদি নিজের কথা আপনি না রাখতে পারেন, পিজারোর গলা লুকোবার চেষ্টা সত্ত্বেও তীক্ষ্ণ কঠিন হয়ে উঠেছে, যদি মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানা যায় শেষ পর্যন্ত?

তাহলে ভীরাকোচা আমায় ক্ষমা করবেন না, একটু হেসে বলেছেন আতাহুয়ালপা।

তার বেশি কোনও ভয় আপনার নেই? পিজারোর গলায় ব্যঙ্গের সুরটা খুব অস্পষ্ট থাকেনি এবার।

না, তার চেয়ে বড় ভয় কিছু আমার নেই। পিজারোর প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গটুকু গ্রাহ্য না করে দৃঢ়স্বরে বলেছেন আতাহুয়ালপা, যেমন বড় সৌভাগ্য কিছু নেই তাঁকে প্রসন্ন করার চেয়ে।

ভীরাকোচা প্রসন্ন হলে কী সৌভাগ্য আপনার হবে বলে আশা করেন? পিজারোর মুখে আপনা থেকেই প্রশ্নটা যেন উঠে এসেছে।

আশা কেন করব, কী সৌভাগ্য আমার হবে আমি জানি। আগের মতোই গভীর। বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন আতাহুয়ালপা, সমস্ত অভিশাপের মেঘ কাটিয়ে উঠে আমার আরাধ্য সূৰ্য্যদেবের মতোই আমি আবার দীপ্ত হয়ে উঠব।

তা-ই যেন হতে পারেন। ব্যঙ্গ ভরে নয়, পরম আন্তরিকতার সঙ্গেই পিজারো এ শুভকামনা জানিয়েছেন মনে হয়েছে।

পরের দিন থেকেই আতাহুয়ালপার নির্দেশ মতো পিজারোর হুকুম নিয়ে সমস্ত পেরু রাজ্যের দূরদূরান্তরে পাইক-পেয়াদারা ছুটে গেছে যেখানে যত সোনা সঞ্চিত আছে সব কামালকায় বয়ে নিয়ে আসবার জন্যে। দেখা গেছে এসপানিওলদের হাতে বন্দি হওয়া সত্ত্বেও কী আশ্চর্য আতাহুয়ালপার প্রতাপ প্রতিপত্তি! দূরদুর্গম পথে ভারে ভারে সোনা এসে পৌঁছেছে প্রতিদিন কাক্সামালকা শহরে। দেখতে দেখতে দরবার ঘর সত্যিই সোনায় ভরে উঠেছে।

সমস্ত এসপানিওল বাহিনীর মধ্যে তীব্র হয়ে উঠেছে এই সোনার স্তুপ জমা হওয়ার উত্তেজনা।

কল্পনাতীত দুর্ভোগ, যন্ত্রণা আর বিপদ মৃত্যু সব কিছু তুচ্ছ করে তাদের এ দুঃসাহসী অভিযানের পরম সার্থকতা এবার তারা নিজেদের চোখে দেখতে পাচ্ছে, স্পর্শ করতে পারছে নিজেদের হাতে ওই সোনার স্কুপের মধ্যে।

তাঁর বাহিনীর আর সবাইকার মতোই পিজারোর উল্লাসের আর সীমা নেই। এমন আশাতীত সৌভাগ্যের জন্যে পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দেবার জন্য তিনি কামালকা শহরে নতুন এক গির্জা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গির্জার জন্যে নতুন আয়তন তাঁকে তৈরি করাতে হয়নি। অতিথি-মহল্লার একটি জমকালো বাড়িই একটু-আধটু অদলবদল করে তিনি গির্জা বানিয়েছেন।

পিজারো একেবারে অকৃতজ্ঞ নয়। দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মানুষের কথা।

এবার তাঁর মনে হয়েছে।

গানাদোর অবশ্য নিজে থেকেই তাঁর কাছে আসবার কথা। এত বড় একটা বাহাদুরি দেখাবার পর কেন যে সে নিজের তারিফ শুনতে আর বখরা চাইতে আসেনি সেইটেই একটু আশ্চর্য লেগেছে পিজারোর।

আতাহুয়ালপার প্রতিজ্ঞা পূরণ হতে আর সামান্য কিছু বাকি। হয়তো কাজটা শেষ। হবার পর আরও মোটা বকশিশ দাবি করবার জোর পাবে বলেই গানাদো এখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছে কিংবা নিজে হাত বাড়িয়ে পুরস্কার চাইতে তার সাহস কুলোয়নি। গানাদোর এ-পর্যন্ত দেখা করতে না আসার কারণ এইরকমই ধরে নিয়েছেন পিজারো।

বকশিশ নেবার জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য গানাদোর যদি থাকে তো থাক, পিজারোর সে ধৈর্য নেই। গানাদো আতাহুয়ালপাকে জ্যোতিষের কী ভড়ং-ভাঁওতায় এমন করে কাবু করেছে জানবার জন্যে তিনি ব্যাকুল। আতাহুয়ালপার পেটের কথা আরও কিছু সে বার করতে পেরেছে কি না তাও তাঁর জানা দরকার।

পিজারো গানাদোকে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে তলব পাঠিয়েছেন। গানাদোকে ডেকে আনতে যে গেছল সেই সেপাই যা খবর এনেছে পিজারো তা বিশ্বাস করতেই পারেননি।

গানাদো তার ডেরায় নেই। ডেরায় তো নয়ই, কাক্‌সামালকার অতিথি-মহল্লার সৈন্য-শিবিরের কোথাও নাকি তাকে খোঁজ করে পাওয়া যায়নি।

খোঁজ করতে গিয়ে অনেকেরই খেয়াল হয়েছে যে শুধু সেইদিনই নয়, গত কয়েকদিন ধরেই গানাদোর সঙ্গে দেখা হবার কথা কেউ মনে করতে পারে না।

কোথায় গেল তাহলে গানাদো!

এসপানিওল একজন সৈনিক হিসেবে কামালকা থেকে একেবারে তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া তো আজগুবি ব্যাপার। সোনা নিয়ে সবাই তখন মেতে আছে। গানাদোও কেও-কেটাদের একজন নয়, তবু তাকে নিয়েও কিছু জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে।

তার অন্তর্ধানের পেছনেও ভীরাকোচার রহস্য কিছু আছে নাকি! কিন্তু তা থাকলেও মানুষটা এমন হাওয়া হয়ে যায় কী করে?

ভীরাকোচার হাতে যাদের লাঞ্ছনার কথা জানা গেছে তাদের তো সব সশরীরেই উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। একেবারে গায়েব তো কেউ হয়ে যায়নি গানাদোর মতো।

অন্যেরা যত না হোক, পিজারো আর তাঁর দুই বিশ্বস্ত সেনাপতি দে সটো আর দে কান্ডিয়া চিন্তিত অস্থির হয়েছেন সবচেয়ে বেশি।

দে সটোকে নিয়ে পিজারো শেষ পর্যন্ত আতাহুয়ালপার কাছেই গেছেন এ রহস্যের হদিস পাবার আশায়।

আপনার কাছেই তো সে ইদানীং আসত যেত। পিজারো প্রায় অভিযোগের সুরে বলেছেন, শেষ তাকে দেখেছেন কবে?

কবে? আতাহুয়ালপাকে যেন ভাবতে হয়েছে।

এই তত দিন তিনেক আগেই।—ভেবে নিয়ে জানিয়েছেন আতাহুয়ালপা—হ্যাঁ, সেইদিনই আমাকে ভীরাকোচার কোপে পড়বার ভয় দেখায়।

ভীরাকোচার কোপে পড়বার ভয় দেখায়? আপনাকে? পিজারোর সঙ্গে দে সটো আর কান্ডিয়ার মুখে একই বিস্মিত প্রশ্ন শোনা গেছে। এ ভয় দেখাবার কারণ? গানাদোর অন্তর্ধান রহস্যের মীমাংসা আপাতত স্থগিত রেখে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে পিজারোকে।

ভয় দেখাবার কারণ প্রতিজ্ঞা রাখবার মেয়াদ আমার ফুরিয়ে আসছে বলে। আতাহুয়ালপা যেন অনিচ্ছার সঙ্গে জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কথা না। রাখতে পারলে ভীরাকোচা তো আমায় ক্ষমা করবেন না। আপনাদের গানাদো তাই সেদিন আমার জমানো সোনা দূরদূরান্তর থেকে বয়ে আনবার জন্যে আরও বেশি লোকজন লাগাতে বলেছিল। তা না লাগলে আমারই শুধু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে না, আমার লুকোনো সব পুঁজি হয়তো বেহাতই হয়ে যাবে।

বেহাত হবে কেন? সোনার পুঁজি থেকে বঞ্চিত হবার ভয়, গানাদোর অন্তর্ধান রহস্য সম্বন্ধে উদ্বেগ কৌতূহল ছাপিয়ে, পিজারোর গলা রুক্ষ করে তুলেছে।

হবে-ই বলছি না–আতাহুয়ালপা মনে মনে নিশ্চয় পিজারোর এই অস্থিরতাটুকু উপভোগ করে বাইরে অবিচলিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে সম্রাটোচিত কূটবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাঁর জবাবে—তবে আমার নিজের টহলে বার হওয়া বন্ধ দেখে কেউ কেউ শয়তানির চেষ্টা করতে পারে বলে ভাবনা হচ্ছে। তাই উপরি লোক লাগিয়ে যেখানে যা আছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনিয়ে ফেলা দরকার মনে করছি।

বেশ, উপরি লোকই আজ থেকে পাবেন। পিজারো আশ্বাস দিতে দেরি না করলেও আর একটা প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু আপনার লোকজনের অমন ঘটা করে জাঁকজমকের সাজপোশাকে যাবার দরকার কী? অত সাজগোজের মধ্যে আবার মুখে রংচং আর মুখোশের ছড়াছড়ি দেখলে তো মনে হয় কোনও বিয়ের বরযাত্রীদের সঙ্গে তামাশা দেখাবার সব ভাঁড় চলেছে। ও সব হই-হুল্লোড় না করে আর সোনা আনতে যাওয়া যায় না?

চুপি চুপি কাউকে কিছু না জানিয়ে যাওয়া-আসার কথা বলছেন!

দোভাষীকে দিয়ে বলাবার ভেতরও আতাহুয়ালপার প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের রেশ একটু বুঝি থেকে গেছে। সেটা চাপা দেবার জন্যে একটু বেশি গাম্ভীর্যের সঙ্গে আতাহুয়ালপা তারপর জানিয়েছেন—চোরের মতো লুকিয়ে গেলে আসল কাজই যে হবে না। লুকোনো পুঁজির জিম্মাদাররাই যে অবিশ্বাস করবে। ইংকা অধীশ্বরদের সম্পদ—সূর্যদেবের জমানো চোখের জল রাখতে বা বার করে আনতে এমনই। সমারোহ করাই যে এ দেশের দস্তুর।

দস্তুর শোনাবার পর পিজারো তার বিরুদ্ধে আর কিছু বলার পাননি। গানাদো। সম্বন্ধে আর দু-চারটে প্রশ্ন করে আতাহুয়ালপাকে বাড়তি কিছু লোক লাগাতে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে দে সটো আর দে কান্ডিয়াকে নিয়ে ফিরে গেছেন।

গানাদোর মতো একজন সৈনিকের বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়া যত বড় রহস্যই হোক, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার বেশি সময় পিজারো বা তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতিরা পাননি।

আতাহুয়ালপার দরবার ঘর সোনায় ভরে ওঠার উত্তেজনা তো আছেই, তার ওপর আর এক খবর দূতমুখে এসে পিজারো আর তাঁর বিশ্বাসী সেনাপতিদের অস্থির চঞ্চল করে তুলেছে।

আর কারও কাছ থেকে নয়, খবর এসেছে আতাহুয়ালপারই ভাই আর প্রতিদ্বন্দ্বী ইংকা সাম্রাজ্যের ন্যায্য প্রথা-সংগত অধীশ্বর হুয়াসকার-এর কাছ থেকে।

রাজসিংহাসন নিয়ে হুয়াসকার আর আতাহুয়ালপার জীবনপণ সংগ্রামের কথা আমরা জানি। আতাহুয়ালপার কাছে পরাজিত হয়ে হুয়াসকার যে ইংকা সাম্রাজের যথার্থ রাজধানী কুজকোর কাছে সৌসার সুরক্ষিত দুর্গে বন্দি হয়ে আছেন তাও আমাদের অজানা নয়।

সৌসা-য় বন্দি থাকতেই হুয়াসকার এসপানিওল নামে অজানা এক শত্রুর হাতে আতাহুয়ালপার কল্পনাতীত ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনেছেন। শুনেছেন যে আতাহুয়ালপা বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্যে প্রচুর ধনরত্ন এসপানিওলদের দেবার কড়ার করেছেন।

এই সংবাদই উৎসাহিত করে তুলেছে হুয়াসকারকে। আতাহুয়ালপার ওপর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার আর নিজের মুক্তি কেনবার একটা কূটকৌশল তাঁর মাথায় এসেছে। গোপনে নিজের বিশ্বাসী গুপ্তচরকে দিয়ে এসপানিওলদের অধিপতির কাছে তিনি একটা প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন। প্রস্তাব এই যে আতাহুয়ালপার বদলে তাঁকে মুক্তি দিলে তিনি আতাহুয়ালপার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সোনাদানার সম্পদ এসপানিওলদের দিতে প্রস্তুত। সে ক্ষমতা তাঁর সত্যিই আছে, কারণ কুজকো তাঁর নিজের রাজধানী। ইংকা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বেশি সম্পদ স্বাভাবিকভাবে এই শহরেই মজুত। কোথায় তা কী পরিমাণ আছে তা বাইরের লোক হয়ে আতাহুয়ালপা আর কতটুকু জানে!

হুয়াসকার-এর এই প্রস্তাবে পিজারো আর তাঁর ঘনিষ্ঠ সাঙ্গোপাঙ্গের উত্তেজিত চঞ্চল হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কী এ বিষয়ে করা উচিত স্থির করা সত্যিই তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে।

প্রলোভন তো বড় সামান্য নয়। আতাহুয়ালপা যা দিতে চেয়েছেন তা-ই পিজারো আর তাঁর দলবদলের কাছে কল্পনাতীত। হুয়াসকার তার চেয়েও অনেকগুণ বেশি দেওয়ার লোভ দেখাচ্ছেন। এখন আতাহুয়ালপা, না হুয়াসকার কার দিকে হেলা যায়?

গোপন রাখবার চেষ্টা সত্ত্বেও হুয়াসকার-এর এ প্রস্তাবের খবর আতাহুয়ালপার কানে একেবারে পৌঁছোয়নি এমন নয়।

তাঁর তো এ খবরে অত্যন্ত বিচলিত হবার কথা। কিন্তু তা তিনি হননি। হননি এই কারণে যে এই রকম একটা অবস্থা যে হতে পারে তা জেনে তিনি আগে থাকতেই প্রস্তুত ছিলেন অনেকখানি। এসপানিওলরা এই দোটানার মধ্যে মনঃস্থির করে ওঠবার আগেই তারা যা ভাবতে পারে না এমন কিছু ঘটে যাবে। আতাহুয়ালপা আর হুয়াসকার-এর মধ্যে একজনকে বেছে নেবার সময় সুযোগ তখন আর পিজারোর থাকবে না এই মেঘ-ছাড়ানো তুষার-চূড়ার দেশে।

নির্ভুলভাবে সমস্ত মতলব ভাঁজা হয়েছে, ধাপে ধাপে শেষ লক্ষ্যে পৌঁছোবার যে আয়োজন করা হয়েছে তা নিখুঁত।

প্রথম ধাপ হল পিজারোকে পাকার সোনা উপহার দিয়ে বিমূঢ় বিহ্বল করার সেই প্রস্তাব। এসপানিওলরা সোনা বলতে অজ্ঞান। তাদের সেই উন্মত্ত লোভই। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফন্দি হয়েছে তাই।

এ ফন্দি অবশ্য আতাহুয়ালপার নিজের মাথা থেকে বার হয়নি। ধাপে ধাপে আগাগোড়া সমস্ত চালগুলো যিনি কষে কষে সাজিয়েছেন তিনি যে কে তা আতাহুয়ালপা এখনও ঠিকমতো জানেন না। গানাদো নামে পরিচিত এ লোকটি এসপানিওল বাহিনীরই একজন। তবু আতাহুয়ালপা লোকটিকে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছেন। বাধ্য হয়েছেন তার কাজ দেখে।

কিন্তু ঘনরামকে কামালকা শহরে তো পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্ত ফন্দি সাজিয়ে তিনি নিজে গেলেন কোথায়?

আর কেউ না জানুক, আতাহুয়ালপা তা জানেন।

দু-দিন বাদে আতাহুয়ালপা নিজে যেখানে রওনা হবেন, নেহাত অসম্ভব কিছু না ঘটে থাকলে গানাদে। সেই সৌসায় ইতিমধ্যে পৌঁছে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন।

হ্যাঁ, সৌসা সেই সুরক্ষিত দুর্গনগরী আতাহুয়ালপার ভাই হুয়াসকার যেখানে বন্দি হয়ে আছেন।

আর কোথাও নয়, গানাদো সৌসা-তে গেছেন কেন, আতাহুয়ালপার জন্যে অপেক্ষা করতে?

তাঁর পরাজিত রাজভ্রাতা ভূতপূর্ব ইংকা নরেশ হুয়াসকারকে যেখানে বন্দি করে রেখেছেন, সেই দুর্গনগরী সৌসা-তেই আতাহুয়ালপার নিজেরও গোপনে যেতে চাইবার কারণ কী?

হুয়াসকার যে তাঁর ভাগ্যবিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে নিজের স্বাধীনতা আর ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্যে বেশি সোনার লোভ দেখিয়ে পিজারোকে হাত করতে চাইছে, এ গোপন খবর জানবার পরও আতাহুয়ালপার সংকল্প তো বদলায়নি।

এরকম সম্ভাবনার কথা আগে থাকতেই অনুমান করে নিয়ে তিনি অবিচলিত ছিলেন কীসের জোরে?

শুধু কি গানাদোর ছকে দেওয়া চালের ওপর অটল বিশ্বাসে?

কিন্তু গানাদোর চাল যে অব্যর্থ এ বিশ্বাস তাঁর হল কী করে? গোড়ায় তো। গানাদোকে পিজারোর গুপ্তচর বলে ধরে নিয়ে তাঁর সমস্ত কিছুই অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিলেন।

যে নির্দেশ পেয়ে পিজারোর কাছে প্রথম একজন এসপানিওল দৈবজ্ঞের কথা পাড়েন তা-ই তো রীতিমতো সন্দেহজনক মনে হয়েছিল। নির্দেশ পেয়েছিলেন অবশ্য সেই রঙিন সুতোর জট থেকে। সেই কিপুক-টা তাঁর মহলে কোথা থেকে এল তাই প্রথম বুঝে উঠতে পারেননি। পিজারোর চরদেরই সেটা কারসাজি ভেবেছিলেন প্রথমে। এমন কথাও ভেবেছিলেন যে ইংকা-সাম্রাজ্যের কোনও কুলাঙ্গার দেশধর্মের চরম অপমান করে বিদেশি পিজারোর কাছে কিপুর রহস্য জানিয়ে দিয়েছে, আর পিজারো সেই কিপু দিয়ে তাঁকে পরীক্ষা করতে চাইছেন।

কিপুগুলো পর পর হাতে পড়ার পরও আতাহুয়ালপা তাই তার নির্দেশ মানবার কোনও চেষ্টা করেননি। সেগুলো যেন বাজে রঙিন সুতো হিসেবেই নাড়াচাড়া করেছেন। সত্যিই কিপুর রহস্য জেনে থাকলেও পিজারো আতাহুয়ালপাকে ধরা-ছোঁয়ার যাতে কিছু না পান।

গুপ্তচরদের চরম দেশদ্রোহ সম্বন্ধে তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক, পিজারোর কিপুগুলো সম্বন্ধে খোঁজ নেবার ধরন দেখেই আতাহুয়ালপা বুঝতে পারেন একদিন। কিপুগুলো পিজারোর কাছে যে খেলাধুলোর রঙিন সুতোর বেশি কিছু নয়, তা বুঝে

সেই দিনই এসপানিওল একজন দৈবজ্ঞের কাছে ভাগ্য গনাবার ইচ্ছে জানান।

কিপুগুলোর মধ্যে সেই নির্দেশই ছিল। সব দুর্ভাগ্য ঘোচাতে চাও তো এসপানিওল দৈবজ্ঞ ডাকাও।—এই ছিল কিপুর রঙিন জটপাকানো সুতোর আদেশ বাণী।

গিট-দেওয়া রঙিন সুতোর জট দিয়ে এ আদেশ বাণী প্রকাশ করা যেমন, তার পাঠোদ্ধার করাও তেমনই পেরু রাজ্যের নিতান্ত গুপ্তবিদ্যা। কিপু কী জিনিস জানলেও তা পড়বার ও তা নিয়ে কিছু বলবার ক্ষমতা যার-তার থাকে না।

ইংকা রাজবংশের লোক হিসাবে আতাহুয়ালপাকে ছেলেবেলাতেই এ বিদ্যা শিখতে হয়েছে। রাজ ও অত্যন্ত অভিজাত বংশের লোক ছাড়া, পুরোহিতদেরই শুধু এ বিদ্যা শেখার অধিকার আছে।

কিপুগুলির আদেশ বাণী সেদিক দিয়েও আতাহুয়ালপাকে বিস্মিত চিন্তিত করেছিল।

কিপুর রঙিন সুতোয় ভাষা ফোটাতে যারা জানে, ইংকা রাজ্যের এমন কে এরকম। অদ্ভুত নির্দেশ পাঠাতে পারে! দুর্ভাগ্য ঘোচাবার জন্য শত্রুর দৈবজ্ঞের শরণ নেবার পরামর্শ দেওয়া তাদের কারও পক্ষে সম্ভব বলেই আতাহুয়ালপা ভাবতে পারেন না।

মনের এ সমস্ত দ্বিধাসংশয় নিয়েও আতাহুয়ালপা পিজারোর কাছে কিপুর নির্দেশ অনুসারে একজন এসপানিওল জ্যোতিষীর খোঁজ করেছিলেন। সেরকম কেউ থাকলে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন তাঁর কাছে। নেহাত কিপুগুলোর মানে বোঝা যায় কি না দেখবার চেষ্টাতেই এ অনুরোধ।

সেই অনুরোধ রাখতে পিজারো কয়েকদিন বাদে যাকে পাঠিয়েছিলেন, তাকে দেখে তো গোড়াতেই মনটা বিরূপ হয়ে উঠেছিল।

এই কি এসপানিওল জ্যোতিষী! না, পিজারো তাঁর নিজের মতলব হাসিল করতে যাকে-তাকে দৈবজ্ঞ সাজিয়ে পাঠিয়েছেন?

লোকটার চেহারাই তো প্রথমত অন্য এসপানিওলদের থেকে কেমন আলাদা। গায়ের রংটা তাদের মতো অমন কটা নয়। আর-এক পোঁচ ময়লা হলে ইংকা রাজবংশের ছেলেদের সঙ্গেই প্রায় মিলে যেত। মুখ-চোখ ধরন-ধারণও অন্য এসপানিওলদের সঙ্গে মেলে না। লোকটা তাদের মতোই লম্বা হলেও, পাতলা একহারা ধরনের। জ্যোতিষের মতো বিদ্যের চর্চা যারা করে, তাদের মুখ-চোখে যে ধীর-স্থির গাম্ভীর্যটুকু থাকা উচিত তা-ও এর মুখে নেই। কেমন একটা অস্থিরচঞ্চল ভাব তার জায়গায়, আর সেই সঙ্গে চোখের দৃষ্টিতে একটা চাপা কৌতুকের আভাস, মাঝে মাঝে যা হঠাৎ আবার যেন অন্যভাবে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

লোকটার নাম জেনেছিলেন গানাদো। গানাদোর সঙ্গে প্রথম দেখার সময় যা-কিছু হয়েছিল তাও বেশ একটু অদ্ভুত বেয়াড়া ধরনের।

গানাদোর সঙ্গে কথা বলবার জন্যে আতাহুয়ালপা সঙ্গে তাঁর দোভাষীকে রেখেছিলেন।

দোভাষী কিন্তু গানাদোর কথা কিছুক্ষণ শোনবার পর অনুবাদের চেষ্টা না করে একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল। বোবা হওয়ার আর দোষ কী। গানাদোর কথা সে একবর্ণ বুঝতে পারেনি।

চুপ করে থাকতে দেখে আতাহুয়ালপা ভ্রুকুটিভরে তার দিকে চেয়েছিলেন।

গানাদোকেও অত্যন্ত বিরক্ত মনে হয়েছিল। তিনি রাগের চোটে মুখে যেন তুবড়ি ছুটিয়ে কী সব বলেছিলেন দোভাষীকে।

দোভাষী ঘেমে উঠে কাঁচুমাচু মুখ করে এবার আতাহুয়ালপার কাছে স্বীকার করেছিল যে, গানাদোর কথা অনুবাদ করবার ক্ষমতা তার নেই।

কেন?—আতাহুয়ালপা রেগে উঠেছিলেন—-তুমি এসপানিওলদের ভাষা জানো

না?

জানি। কিন্তু উনি যা বলছেন তা কাস্তেলিয়ানো মানে এসপানিওলদের ভাষা নয়। করুণস্বরে নিবেদন করেছিল দোভাষী।

কী! এসপানিওল শব্দটা থেকেই যেন দোভাষীর কুইচুয়া ভাষায় বলা বক্তব্যটা বুঝে ফেলে গানাদো একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে বলেছিলেন, আমি যা বলছি, তা এসপানিওল নয়? এসপানিওলদের ভাষা শুধু কাস্তেলিয়ানো? কেন, বাস্ক, গালিসিয়ান, কাটালান কি বানের জলে ভেসে এসেছে? আমি কাটালান বলছি, কাস্তেলিয়ানো নয়। বুঝেছ?

ভ্যাবাচাকা খেয়ে গানাদোর কথাগুলো যে কাস্তেলিয়ানোতেই বলা সে খেয়াল হয়নি দোভাষীর।

কিন্তু আমি তো শুধু কাস্তেলিয়ানোই শিখেছি।—অপরাধীর মতো সে জানিয়েছে—কাটালান আমি জানি না।

যদি জানো তা হলে এখানে করছ কী! যাও। আর কিছু না বুঝুন আতাহুয়ালপা গানাদোর রাগের সঙ্গে বলা শেষ কথাটা বুঝেছিলেন। বন্দি হবার পর থেকে এসপানিওলদের সংসর্গে যে দু-একটা শব্দ তিনি। এই ক-দিনে শিখেছেন তার একটা হল ভায়িয়া। ভায়িয়া মানে যাও। গানাদো। রাগের মাথায় দোভাষীকে সেই কথাই বলেছে।

কথা যে বোঝে না এমন দোভাষীর ওপর রাগ হওয়া অবশ্য স্বাভাবিক। তার থাকা-না-থাকা সমান। যাও বলে তাকে তাড়ালে সুতরাং কোনও ক্ষতি নাই। আতাহুয়ালপা দোভাষীকে বিদায় দেওয়ায় তাই আপত্তি করেননি।

কিন্তু যে গেছে তার জায়গায় গানাদোর কথা বোঝে এমন দোভাষী তো একজন দরকার। নইলে ইশারায় তো তাঁদের পরস্পরের আলাপ আর হতে পারে না।

ইশারায় কথা বোঝাতে হয়নি, দরকার হয়নি কোনও দোভাষীরও, হঠাৎ চমকে উঠে অবাক হয়ে আতাহুয়ালপা গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন। নিজের কানকেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না তখন বিশ্বাস করা সত্যিই শক্ত।

গানাদো তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলছে পেরুর সাধারণ ভাষা কুইচুয়ায় নয়, ইংকা রাজপরিবারের নিজস্ব বিশেষ ভাষায়, বাইরের প্রজাসাধারণেরও যা অজানা।

গানাদোর এ ভাষা ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে আতাহুয়ালপা প্রথমে তাঁর কথাটাই মন দিয়ে শুনতে পারেননি।

গানাদো একটু হেসে দ্বিতীয়বার কথাটা বলার পর তিনি সজাগ হয়েছেন।

দোভাষীকে তাড়িয়েছি বলে রাগ করেননি নিশ্চয়? বলেছেন গানাদো।

না, তা করিনি। ভ্রুকুটিভরে বলে আতাহুয়ালপা নিজের তীব্র কৌতূহলটা আর চাপতে পারেনননি! তুমি–তুমি আমাদের এ ভাষা শিখলে কোথায়?

এ ভাষা কি এমন অদ্ভুত কিছু যে শিখলে আশ্চর্য হতে হয়! গানাদো যেন সরল বিস্ময়ই প্রকাশ করেছেন।

হ্যাঁ, তাই! ইংকা নরেশ একটু উষ্ণস্বরেই বলেছেন, এ দেশের সবাই যা বলে এ সেই কুইচুয়া নয়। ইংকা-রক্ত যাদের গায়ে আছে, রাজবংশের, তারাই শুধু এ ভাষা ব্যবহার করে। , ইংকা রক্ত আমার গায়ে নেই, সবিনয়ে বলেছেন গানাদো, সুতরাং এ ভাষা ব্যবহার করে আমার যদি অন্যায় হয়ে থাকে তো মাপ করবেন। আমি কুইচুয়াতেই যা। বলবার বলতে চেষ্টা করব।

সে চেষ্টা করতে তোমায় বলছি না, আতাহুয়ালপা অধৈর্যের সঙ্গে বলেছেন,কোথায় এ রাজভাষা তুমি শিখলে তাই জানতে চাইছি।

রাজভাষা তো যার-তার কাছে শেখা যায় না। আবার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছেন গানাদো-কোথায় কেমন করে শিখেছি আশা করি তা জানাবার সময়-সুযোগ পরে পাব। কিন্তু এখন সবচেয়ে যা জরুরি, সেই কথাগুলোই আপনার সঙ্গে আগে আলোচনা করতে চাই। দোভাষীকে সেইজন্যেই ওভাবে সরিয়ে দিলাম।

কী জরুরি কথা আলোচনা করতে চাও? আতাহুয়ালপা অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন, তারপর রূঢ়স্বরে বলেছেন, এসপানিওলদের জ্যোতিষবিদ্যার দৌড় কতটা তা-ই আমি তোমায় দিয়ে পরীক্ষা করতে চাই। গোপন আলোচনা করবার জন্যে তোমায় ডাকিনি। পারো তুমি ভাগ্য গণনা করতে!

না।

সোজা স্পষ্ট দৃঢ়স্বরের এ অপ্রত্যাশিত জবাব শুনে চমকে উঠে আতাহুয়ালপা সবিস্ময়ে গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন। লোকটা বলে কী! অম্লানবদনে স্বীকার করছে যে, সে জ্যোতিষী নয়! গানাদোর অবিচলিত নির্বিকার মুখের ভাব দেখে একমুহূর্তে মেজাজ তাঁর আরও গরম হয়ে উঠেছে।

তীব্রস্বরে তিনি বলেছেন, ভাগ্য গণনা করতে জানো না, তবু তুমি এখানে এসেছ! এসেছ কি পরিহাস করতে?

না, সম্রাট। শান্ত দৃঢ়স্বরে বলেছেন গানাদো, পরিহাস করবার জন্যে নিজের মাথায় খাঁড়া ঝুলিয়ে এখানে আসিনি। এসেছি আর এক উদ্দেশ্য আর আশা নিয়ে। ভাগ্য গণনা করতে আমি জানি না, কিন্তু ভাগ্য বদলাতে হয়তো পারি।

ভাগ্য বদলাতে পারো!—আতাহুয়ালপা জ্বলন্তস্বরে ওইটুকু বলে গানাদোর স্পর্ধাতেই বোধহয় নির্বাক হয়ে গেছেন।

আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না, জানি। গানাদো আগের মতোই। স্থির-ধীরভাবে বলেছেন, ভাবছেন পিজারোর চর হিসেবে আপনার মনের কথা বার করবার চেষ্টা করছি। নিজেকে বাঁচাতে পিজারোর কাছে আমার সব কথা ফাঁস করে দেবেন কি না তা-ও তোলাপাড়া করছেন মনে মনে। তা আমায় ধরিয়ে দিতে আপনি সত্যিই পারেন। মুখ-সাপাটিতে তখন নিজের সাফাই গেয়ে পার পাব কি না জানি না। পাই বা না পাই, এই তাতিসুইয়ুর যিনি জীবনের উৎস, সেই ভীরাকোচা আর তাহলে ইংকা সাম্রাজ্যের অভিশাপ মোচন করতে বোধহয় দেখা দিতে পারবেন না।

তাভানতিসুইয়ু-র জীবনের উৎস ভীরাকোচা!–আতাহুয়ালপার গলায় রাগের চেয়ে বিস্ময়বিমূঢ়তাই বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবার—কী জানো তুমি তাঁর বিষয়ে?

এইটুকু জানি যে তাঁর নাম নিয়ে তাঁর ভরসার জোরে এই ইংকা সাম্রাজ্য আবার। জাগিয়ে তুলে তার সমস্ত অভিশাপ কাটিয়ে দেওয়া যায়।আতাহুয়ালপার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছেন গানাদো, আপনার ভাগ্য সত্যিই বদলে যেতে পারে, সম্রাট, শুধু যদি যা আপনাকে বলব তা বিশ্বাস করতে পারেন।

বিশ্বাস তোমায় আমি করব কেন? এবার বিদ্রূপের স্বরে বলেছেন আতাহুয়ালপা, শুধু আমাদের রাজভাষা তুমি কোথা থেকে শিখেছ, আর জীবনদেবতা ভীরাকোচার দোহাই দিচ্ছ বলে?

না, সম্রাট! একটু হেসে বলেছেন গানাদো, রাজভাষা শিখেছি বা ভীরাকোচার দোহাই দিচ্ছি বলে আমায় বিশ্বাস করতে হবে না। তার চেয়ে ভাল প্রমাণ

গানাদো কথাটা শেষ করতে পারেননি। ইংকা রাজবংশের সম্ভ্রান্ত কেউ একজন আতাহুয়ালপার সঙ্গে দেখা করতে দরবার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। যথারীতি, খালি পায়ে কাঁধে বশ্যতার নিদর্শন হিসেবে একটা বোঝা নিয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়ে প্রণামী দিয়ে ও কুর্নিশ করে তিনি যেভাবে বেশ একটু ব্যাকুল অস্বস্তির সঙ্গে গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন, তাতে বোঝা গেছে, ইংকা নরেশের কাছে খুব গুরুতর কিছু তাঁর নিবেদন করার আছে।

আতাহুয়ালপাকেও একটু বিব্রত মনে হয়েছে।

আগন্তুক ইংকা জ্ঞাতির কাছে তার জরুরি নিবেদনটা গোপনে তিনি শুনতে চান, কিন্তু আলাপ অসমাপ্ত রেখে গানাদোকে বিদায় দিতে বাধছে।

গানাদোই আতাহুয়ালপার এ দোটানার অস্বস্তি দূর করেছেন অপ্রত্যাশিতভাবে।

হঠাৎ আগন্তুক ইংকা-প্রধানকেই উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ভুল হলে মাপ করবেন। আপনার নামই তো পাউল্‌লো টোপা?

ইংকা নরেশ ও আগন্তুক দুজনেই সবিস্ময়ে গানাদোর দিকে তাকিয়েছেন।

আতাহুয়ালপাই জিজ্ঞাসা করেছেন ভ্রুকুটিভরে, তুমি ওর নাম জানলে কী করে?

শুধু ওঁর নাম নয়, উনি আপনার কাছে কী আবেদন জানাতে এসেছেন, তা-ও আমি জানি, ঈষৎ কঠিনস্বরে বলেছেন গানাদো, ওঁকে আপনি আশ্বাস দিতে পারেন, সম্রাট, যে স্বয়ং ভীরাকোচা ওঁর সহায় হবেন। একবার শিক্ষা পেয়েও যার সংশোধন হয়নি, পাউলো টোপার স্ত্রীর ওপর পাশব লালসা নিয়ে আবার যে তাঁকে লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবার আয়োজন করেছে, আজ রাত্রেই এমন চরম শাস্তি সে পাবে, এসপানিওল বাহিনীর কাছে যা গল্প কথা হয়ে থাকবে বহুদিন। প্রকাশ্য রাজপথে কলঙ্কচিহ্ন-ভরা মুখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাল সকালে তাকে পাওয়া যাবে।

কী, বলছ কী তুমি! যেন একটু অধৈর্যের সঙ্গে বলেছেন আতাহুয়ালপা, ভীরাকোচার নাম নিয়ে তামাশা করছ কোন সাহসে!

তামাশা করিনি, সম্রাট! গানাদো দৃঢ়স্বরে বলেছেন, সত্য কথাই বলছি যে, ভীরাকোচাই পাউলো টোপাকে চরম অপমান থেকে রক্ষা করবেন।

একদিকে যেমন বিস্ময়বিমূঢ় আর একদিকে তেমনই ক্রুদ্ধ উত্তেজিত হয়ে আতাহুয়ালপা জ্বলন্তস্বরে পাউলো টোপাকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, এ এসপানিওল তোমার দুর্ভাগ্যের কথা যা বলছে তা সত্য টোপা!

হ্যাঁ সত্য, সম্রাট!নত আরক্তমুখে স্বীকার করেছে পাউলো টোপা।

কিন্তু ভীরাকোচার পবিত্র নাম নিয়ে যে আশ্বাস দিচ্ছ, তা যদি শুধু মিথ্যে দম্ভ হয়— গানাদোর দিকে ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে যেন বিদ্ধ করে আতাহুয়ালপা প্রশ্নটা অসমাপ্তই রেখেছেন।

তাহলে আমায় প্রতারক গুপ্তচর বলেই বুঝবেন? কুণ্ঠাহীন গলায় বলেছেন গানাদো, আমি কতখানি বিশ্বাসের যোগ্য আমার এই দাম্ভিক আস্ফালনই তার প্রমাণ দিক।

তার পরদিন সত্যিই সে প্রমাণ পেয়েছিলেন আতাহুয়ালপা, গাল্লিয়েখো নামে সেই পাষণ্ড এসপানিওল সৈনিকের অবিশ্বাস্য লাঞ্ছনায়।

আতাহুয়ালপা বিস্ময়বিমূঢ় হয়েছিলেন সত্যিই, কিন্তু গানাদোকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করা আর তাঁর পক্ষে কঠিন হয়নি।

বিশ্বাস যে তাঁর অপাত্রে পড়েনি তার প্রমাণ এর পর পদে পদে পাওয়া গেছে। যা প্রায় কল্পনাতীত ছিল গানাদোর নিখুঁত চাল সাজাবার গুণে সম্ভব হয়েছে। আশ্চর্যভাবে।

সোনার ঢিবি উপহার দেবার টোপ বিফল হয়নি। অসন্দিগ্ধভাবে পিজারো সে টোপ গিলেছেন। সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান হয়েছে তাই দিয়েই।

সে বড় সমস্যা কী? চারদিকে দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়ের প্রাচীরে ঘেরা কামালকা থেকে এসপানিওল বাহিনীর সজাগ পাহারা এড়িয়ে বার হওয়া।

সেই সমস্যার কিনারাই করেছেন গানাদো সোনার কাঁড়ির প্রলোভন দেখিয়ে।

তা না করতে পারলে পিজারোর পাহারাদারদের একরকম চোখের ওপর দিয়ে গানাদো কি অমন উধাও হতে পারতেন।

কিন্তু কৌশলটা সত্যিই কী ছিল?

পিজারোর ঝানু সব সঙ্গী-সাথী সেনাপতিরা ভেবেই পায়নি।

শুধু পিজারোই একবার নিজের অজান্তে কৌশলটা প্রায় ধরি-ধরি করে ফেলেছিলেন একটা কৌতূহল মেটাতে গিয়ে। রহস্যের চৌকাঠ পার হওয়া কিন্তু তাঁর হয়নি। সত্যিই কিছু সন্দেহ না করে দরজা থেকেই তিনি ফেরত গেছেন বলা চলে। গানাদোর অন্তর্ধান রহস্য শেষ পর্যন্ত ভেদ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

কী কৌশলে গানাদো কামালকা থেকে পালিয়েছেন তা শুধু একজনই জানেন। পালিয়ে তিনি কোথায় গেছেন তা-ও শুধু আতাহুয়ালপারই জানা।

আতাহুয়ালপার অনুমান নির্ভুল হলে গানাদো তখন দুর্গনগর সৌসানগরে পৌঁছে সাগরপারের দুশমনবাহিনীর বিরুদ্ধে একেবারে মোক্ষম মাত-এর চালটি চেলে আতাহুয়ালপার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

মাত-এর মোক্ষম চালটি কী?

তা আর কিছুই নয়, দু-ভাগ হয়ে যা পলকা হয়ে গেছল তা-ই আবার এক করে জুড়ে দেওয়া। সে জোড়া হাতিয়ারের সামনে তখন দাঁড়াবে কে?

আতাহুয়ালপা আর হুয়াসকার নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে যখন শক্তি ক্ষয় করছেন শত্রু এসে তখন হানা দিয়েছে এই গৃহ বিবাদের সুযোগে। দুই ভাই একবার দেশের জন্যে জাতির জন্যে আকাশের যিনি অধীশ্বর সেই সূর্যদেব আর জীবনের যিনি উৎস সেই ভীরাকোচার জন্যে মিলিত হলে এসপানিওল বাহিনী তো ফুঙ্কারে উড়ে যাবে।

হুয়াসকার তাঁর সঙ্গী-সাথীর কুপরামর্শে পিজারোর কাছে অত্যন্ত গর্বিত একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

তা পাঠালেও ক্ষতি নেই। পিজারো আর তাঁর দলবল যতক্ষণ সে প্রস্তাবের সুবিধে-অসুবিধে লাভ-লোকসান হিসেব করছেন ততক্ষণে গানাদো সৌসায় পৌঁছে হুয়াসকার-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন নিশ্চয়।

হুয়াসকার নির্বোধ নন। গানাদোর ছকা চালগুলি যে অব্যর্থ তা বুঝতে তাঁর দেরি হবে না। তারপর শুধু আতাহুয়ালপার সৌসা পৌঁছোবার জন্যে অপেক্ষা। আতাহুয়ালপাকে সশরীরে সামনে দেখলে হুয়াসকার-এর মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তখনও যদি কিছু থাকে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে নিশ্চয়। ইংকা রাজরক্ত যাঁদের মধ্যে প্রবাহিত সেই দুই রাজভ্রাতা এখন এক হয়ে মিললে সমস্ত কর্ডিলিয়েরাই কেঁপে উঠবে তাঁদের বাহিনীর পদভারে। কোথায় তখন দাঁড়াবে ওই ক-টা দুশমন বিদেশি।

কিন্তু আতাহুয়ালপা তো পিজারোর কড়া পাহারায় তাঁর নিজের অতিথি-মহল্লাতেই বন্দি। অতিথি-মহল্লা থেকে বাইরের চত্বরে পর্যন্ত একটু পা ছাড়িয়ে আসার সুযোগ তাঁর নেই

তিনি সেই দূর দুর্গনগর সৌসায় যাবেন কেমন করে?

কেমন করে আর! গানাদো যেমন করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে গেছেন। তেমনই করে।

পিজারোকে সোনার কাঁড়ি উপহার দিয়ে ভীরাকোচাকে প্রসন্ন করবার ব্রত কি আতাহুয়ালপা অকারণে নিয়েছেন!

প্রতিদিন সমারোহ করে সূর্যদেবের জমানো চোখের জল বয়ে আনবার শোভাযাত্রীর দল কি এদিকে-ওদিকে মিছিমিছি পাড়ি দিচ্ছে?

তাদের রংবেরং-এর পোশাক, মুখের রংচং মুখোশ আর যাবার পথে নাচগান বাজনা দেখতে শুনতে গোড়ায় গোড়ায় এসপানিওলরাও রাস্তায় জড়ো হত। সং দেখার মতো একটা মজা ছিল তার মধ্যে।

কিন্তু দু-বেলা দেখে দেখে তারপর অবশ্য একঘেয়েমিতে অরুচি ধরে গেছে। এখন আর সোনাবরদার মিছিল দেখলে কেউ দাঁড়িয়ে ভিড় জমায় না। যেটুকু আগ্রহ তাদের বিষয়ে আছে তা শুধু ভারে ভারে তারা সোনা আনছে বলে।

কামালকা থেকে কুজকো যাবার রাস্তায় প্রতিদিন একটা করে অন্তত মিছিল যায় আসে। তার মধ্যে একটা বিশেষ দলকে কে আর লক্ষ করেছে।

লক্ষ করলেই বা বুঝত কী! সেই মুখোশ পরে সং সাজা রংবেরং-এর পোশাক পরা ভেঁপুর মতো বাঁশি আর করতালের মতো বাজনা নিয়ে একদল আধা নাচের ভঙ্গিতে চলেছে।

হ্যাঁ, একটা ব্যাপার লক্ষ করবার মতো ছিল বটে। মুখোশ আঁটা নানা রং-এর প্রায় ঘেরাটোপ পরা একটা নেহাত ছোটখাটো পাতলা দুবলা চেহারা। একেবারে বাচ্চা। ছেলেই মনে হয়। এত অল্পবয়সের কেউ সাধারণত এ সব সোনাবরদার মিছিলে থাকে না।

কিন্তু থাকলে দোষও কিছু নেই। বুড়োবুড়ি ছাড়া ছেলে-ছোকরার এ দলে থাকা বারণ তো আর নয়! কারও চোখে পড়লে তা নিয়ে জেরা সে করতে পারত না সুতরাং। এসপানিওলরা তো নয়ই। কারণ তারা এ সব মিছিলের নিয়মকানুন কী আর জানে!

কিন্তু লক্ষই যখন কেউ করেনি তখন সন্দিগ্ধ হবে কে? আর এ দলের পক্ষে বেমানান এই ছেলে-ছোকরার মতো চেহারা যদি নজরে না পড়ে থাকে তাহলে তার সঙ্গী হিসেবে আর কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি নিশ্চয়।

না বলতেই বোঝা গেছে বোধহয় যে গানাদো এই দলের সঙ্গে সোনাবরদার সেজেই কামালকা থেকে উধাও হয়েছেন। উধাও হয়েছেন কুজকোর পথে। কুজকো কাক্‌সামালকার খুব কাছাকাছি নয়। পথও বেশ দুর্গম। তবে ইংকা স্থপতিরা। সেখানে পাহাড় কেটে পথ বানাবার এমন আশ্চর্য বাহাদুরি দেখিয়েছেন, তখনকার ইউরোপে অন্তত যার তুলনা ছিল না।

এ পথে তখনও পর্যন্ত ইংকা সাম্রাজ্যের নিজস্ব দৌড়বাজ হরকরার ব্যবস্থা চালু আছে। পেরুর উত্তর থেকে দক্ষিণপ্রান্ত আর সাদা তুষারের পাহাড়ের রাজ্য থেকে মরুর মতো ধূ-ধূ পশ্চিম সমুদ্র তীরের নগর বসতি পর্যন্ত এই ডাকবিলির ব্যবস্থা সে যুগের এক বিস্ময়। দৌড়বাজ ডাক-হরকরা প্রতিদিন অবিশ্বাস্য তৎপরতার সঙ্গে রাজ্যের সংবাদ ও ইংকা নরেশের আদেশ সর্বত্র বহন করে নিয়ে যায়।

এই দৌড়বাজ হরকরাদের পর পর হাতফেরতা হয়ে ডাকবিলি হত অবশ্য। রিলে রেস-এর মতো এক হরকরার দৌড় যেখানে শেষ সেখানে আর-এক হরকরা তৈরি থাকত তার বার্তা নিয়ে ছুটে যাবার জন্যে।

এই ব্যবস্থা সত্ত্বেও কামালকা থেকে কুজকোয় ডাক পৌঁছোতে পাঁচ দিন অন্তত লাগত।

সোনাবরদার শোভাযাত্রীদের দলের সঙ্গে গানাদোর কুজকো পৌঁছোতে আরও বেশি কিছুদিন লাগা তাই স্বাভাবিক।

কুজকো শুধু নয়, সেখান থেকে সৌসা পর্যন্ত পৌঁছোতে যে সময় লাগতে পারে, তার হিসেব ধরেই গানাদো আতাহুয়ালপার অন্তর্ধানের সব ব্যবস্থা পাকা করে ছকে রেখে গেছেন।

সৌসায় পৌঁছেই দূত হিসাবে বিশ্বাসী দৌড়বাজ হরকরাদেরই একজনকে। হুয়াসকার-এর পাঞ্জা দিয়ে আতাহুয়ালপার কাছে গোপন খবর দেবার জন্যে পাঠানো হবে।

আতাহুয়ালপা কিন্তু কামালকাতেই তার অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। গানাদো যেদিন থেকে নিরুদ্দেশ তার ঠিক গুণে গুণে একপক্ষকাল বাদে তিনি কামালকা থেকে রওনা হয়ে পড়বেন। কুজকোর দূতের সঙ্গে মাঝপথেই যাতে তাঁর দেখা হয়।

আতাহুয়ালপা রওনা হবেন ওই সোনাবরদার দলের শোভাযাত্রী হয়েই অবশ্য। কিন্তু অতিথি-মহল্লার বন্দিশালায় যারা তাঁকে দিনরাত পাহারায় রাখে সেই এসপানিওল সেপাইদের দৃষ্টি তিনি এড়াবেন কী করে?

যদি বা কিছুক্ষণের জন্যে তাদের ফাঁকি দিয়ে অতিথি-মহল্লার বন্দিশালা থেকে শোভাযাত্রী সেজে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন, তারপর যথাস্থানে তাঁকে না দেখতে পেলে হুলস্থুল তো বাধবেই।

গানাদোর বেলা যা হয়েছিল তার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি নিশ্চয়ই। আতাহুয়ালপা আর গানাদো তো এক নয়। আতাহুয়ালপা তাঁর চোখের ওপর থেকে নিরুদ্দেশ হলে পিজারো আর প্রকৃতিস্থ থাকবেন কি না সন্দেহ। ক্ষিপ্ত হয়ে সমস্ত পেরু রাজ্য তোলপাড় করে ফেলবেন নিশ্চয়।

গানাদোর পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিল আতাহুয়ালপার পক্ষে সেইরকম শুধু রংবেরং-এর পোশাক মুখোশ এঁটে এসপানিওলদের চোখে ধূলো দেওয়া বোধহয় সম্ভব হবে না। কামালকা থেকে বার হতে পারলেও কুজকোর পথেই তিনি ধরা পড়ে যাবেন।

সৌসায় পৌঁছে হুয়াসকার-এর সঙ্গে যতক্ষণ না মিলিত হতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথি-মহল্লা থেকে তাঁর অন্তর্ধানটা পিজারো আর তাঁর সহচর অনুচরদের কাছে গোপন রাখবার ব্যবস্থা তাই না করলেই নয়।

কেমন করে তা সম্ভব?

সম্ভব যেভাবে হতে পারে তার কূট-কৌশলও বলে দিয়ে গেছেন গানাদো।

গানাদোর অন্তর্ধানের কয়েকদিন বাদে পিজারো হুয়াসকার-এর প্রস্তাব সম্বন্ধেই আতাহুয়ালপার সঙ্গে আলোচনা করতে এসে বিস্মিত ও হতাশ হয়েছেন।

আতাহুয়ালপা শয্যাশায়ী না হলেও অত্যন্ত অসুস্থ। রাজাসনে বসেই তিনি পিজারোর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্যে তাঁর কণ্ঠ এমন রুদ্ধ যে তা থেকে কোনও আওয়াজই বার হয়নি। অতি কষ্টে তিনি পিজারোকে পরের দিন আসবার অনুরোধটা শুধু করতে পেরেছেন।

পরের দিন অবস্থা আরও খারাপই দেখা গেছে। আতাহুয়ালপা সেদিন শয্যাশায়ী। গলার স্বর সম্পূর্ণ রুদ্ধ। ইংকা পরিবারের রাজবৈদ্য তাঁর শয্যাপার্শ্বে দোভাষীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। ব্যবস্থা বেশ একটু অদ্ভুত লেগেছে পিজারোর। আতাহুয়ালপার শয্যার পাশে এক তাল সোনার গুঁড়ো মেশানো কাদামাটির তাল।

রাজবৈদ্য সেই মাটি চাপড়া চাপড়া করে আতাহুয়ালপার মুখে মাথায় লাগাচ্ছেন।

এ আবার কী চিকিৎসা! সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো।

এ-ই হল ইংকা রাজ্যের চিকিৎসা। দোভাষীর মারফত জানিয়েছেন রাজবৈদ্য। রাজবৈদ্য আর কেউ নয়, পাউলো টোপা।

হ্যাঁ, ইনি সেই পাউল্লাে টোপা যাঁর পরিবারের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বয়ং ভীরাকোচাই বুঝি এক এসপানিওল পাষণ্ডকে চরম শাস্তি দিতে নেমে এসেছিলেন।

গানাদো আতাহুয়ালপাকে উদ্ধার করবার যে চক্রান্ত করেছেন তাতে বিশ্বাস করে একজনকেই শুধু দলে নেওয়া হয়েছে। পাউলো টোপা-কে।

পাউলো টোপাও সম্ভ্রান্ত নাগরিক। তাঁর শরীরেও ইংকা রক্ত বয়। কিন্তু শুধু সে জন্যে তাঁকে এতখানি বিশ্বাস করা হয়নি। বিশ্বাস করা হয়েছে ভীরাকোচা ও তাঁর মুখপাত্র বলে নিজেকে যিনি প্রমাণ করেছেন সেই গানাদোর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া টোপার পক্ষে সম্ভব নয় জেনে।

পাউলো টোপা এ বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন। কেমন করে রেখেছেন তা পরে যথাস্থানে জানা যাবে।

আপাতত গানাদোর কূট-কৌশল সব দিক দিয়েই সফল হয়েছে!

দ্বিতীয় দিনের পর তৃতীয় দিন পিজারো আতাহুয়ালপাকে দেখতে এসে বিরক্তই হয়েছেন।

আতাহুয়ালপার মুখ-হাত-পা সব যেন সোনালি মাটিতে পলস্তারা করা।

চোখ, নাক আর মুখের হাঁ-টুকু বাদে সমস্ত মুণ্ডটা একটা যেন সোনালি কাদার তাল। তার ভেতর থেকে আতাহুয়ালপার গলার স্বরেই শুধু তাঁকে চেনা গেছে।

গলার রুদ্ধ স্বর সেদিন কিছুটা খুলেছে। এটা চিকিৎসার গুণ বলেই দাবি করেছেন রাজবৈদ্য।

এ আসুরিক চিকিৎসা কতদিন আর চলবে? বিরক্ত হয় জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো। চিকিৎসার গুণ পুরোপুরি কবে বোঝা যাবে জানতে চেয়েছেন।

চলবে দক্ষিণায়নের শেষ দিন পর্যন্ত। দোভাষী মারফত জানিয়েছেন রাজবৈদ্যবেশী টোপা, সূর্যদেবের উত্তরায়ণের প্রথম দিন রেইমির উৎসব শুরু হলেই ইংকা নরেশ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে বসবেন। সকাল-সন্ধ্যায় সূর্যদেবের অনুগত পার্শ্বচর হয়ে যে সেবা করে দেবকিশোর সেই চাস্কা আতাহুয়ালপার প্রতি ঈর্ষায় তাঁর গলার স্বর চুরি করে পাতালে লুকিয়ে রেখে এসেছে। সূর্যদেব দক্ষিণায়নের শেষ সীমায় পৌঁছে সে স্বর খুঁজে নিয়ে আতাহুয়ালপাকে ফিরিয়ে দেবেন, রেইমি-র উৎসবের দিন সূর্যদেব উত্তর আকাশে আরোহণের প্রথম ধাপে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে যাতে আতাহুয়ালপা তাঁকে বন্দনা করতে পারেন। আর–

ঠিক আছে। ঠিক আছে! ইংকা পুরাণের হিং টিং ছটে ধৈর্য হারিয়ে প্রায় ধমকের সঙ্গে বাধা দিয়ে পিজারো দোভাষীকে বলেছেন, রেইমি-র উৎসবের পরেই একদিন আসব দেখা করতে। তখনও যদি তোমাদের ওই চাস্কা না কার কাছ থেকে ইংকা নরেশের গলার স্বর না উদ্ধার হয় তাহলে এই সোনার গুঁড়ো মেশানো মাটির তাল ঠেসে ওই রাজবৈদ্যের গলাই বুজিয়ে দেব বলে দাও।

পিজারো বিরক্ত হয়ে আতাহুয়ালপার মহল ছেড়ে গেছেন।

রাজবৈদ্য সেজে টোপা তাঁকে হিং টিং ছট পুরাণই শুনিয়েছেন সত্য, কিন্তু সূর্যের পার্শ্বচর সেবায়েত চাস্কা-র নামটা মিথ্যে করে বানানো নয়। পেরুতে শুকতারা ও সন্ধ্যাতারারূপী শুক্র গ্রহকে চাস্কা নামে কমনীয় দেবকিশোররূপেই কল্পনা করা হয়।

রেইমি উৎসবের দিনটা উল্লেখ করবার মধ্যেও একটা গূঢ় অর্থ আছে।

আর মাত্র কয়েকদিন বাদেই সূর্যের দক্ষিণায়ন শেষ হবার তারিখ। পেরুর রেইমি উৎসব তার পর দিন থেকেই শুরু। তার আগে তিন দিন ধরে সমস্ত পেরু রাজ্যে অরন্ধন। কোথাও কোনও বাড়িতে কারও উনুন এই তিন দিন জ্বালানো হয় না।

রেইমি উৎসবের প্রথম দিনে উত্তরায়ণের প্রথম সূর্যোদয় দেখবার জন্যে সমস্ত পেরুবাসী যে যেখানে আছে সক্ষম হলে ভোরের আগে মুক্তাকাশের তলায় পূর্ব দিগন্তে উৎসুকভাবে চেয়ে থাকবে।

উদয়-দিগন্তে সূর্যের প্রথম রক্তিম রেখাটুকু দেখার মতো পুণ্য আর কিছু নেই।

সেই সূর্যোদয় দেখবার সরব আনন্দোচ্ছ্বাসে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠবে তখন। তার পর সারাদিন চলবে উৎসব-মত্ততা।

গানাদো আতাহুয়ালপার কাক্সামালকা ত্যাগের জন্যে এই দিনটিই স্থির করে দিয়ে গেছেন।

পরাধীনতার গ্লানি সত্ত্বেও পেরুর মানুষ এ দিনটিতে উৎসব-মত্ত হবেই।

সেই উৎসব-মত্ত নগরের বিশৃঙ্খলার ভেতর আতাহুয়ালপার নিঃশব্দে আত্মগোপন করে কাক্সামালকার সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ।

একবার কাক্সামালকা ছাড়িয়ে কুজকো যাবার রাস্তা ধরতে পারলে আর কোনও ভাবনা নেই।

পথে এমন সব গুপ্ত আশ্রয় আছে ইংকা নরেশদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত পার্শ্বচর ছাড়া যার সন্ধান কারও জানবার কথা নয়।

আতাহুয়ালপার শরীরে ইংকা রাজরক্ত থাকলেও তিনি কুইটোর যুবরাজ। এ সব গুপ্ত আশ্রয়ের রহস্য তাঁর অজানা।

কিন্তু তাঁকে সাহায্য করবার জন্যে আছেন পাউললো টোপা। সোনা-বরদার। শোভাযাত্রীদের একজন হয়ে টোপাই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। পূর্বেকার ইংকা নরেশ হুয়াসকার-এর বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে সমস্ত গুপ্ত আশ্রয় তাঁর জানা। একবার কামালকা থেকে বার হতে পারলে এসপানিওল বাহিনীর তাই সাধ্য নেই তাঁদের ধরবার।

শুধু তাই নয়, আতাহুয়ালপা বিদেশি শ্বেতদানবের কবল থেকে ছাড়া পেয়েছেন জানলে সমস্ত পেরু রাজ্য দুলে উঠবে উত্তেজনায়। যেখান দিয়ে আতাহুয়ালপা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যাবেন সেখানেই জ্বলে উঠবে প্রতিরোধের প্রচণ্ড আগুনের বেষ্টনী, এসপানিওলদের পক্ষে যা ভেদ করা অসম্ভব।

সূর্যের উত্তরায়ণের আর মাত্র কটা দিন বাকি।

ইংকা নরেশের রাজপালঙ্কে সোনালি কাদার প্রলেপে ঢাকা বিশ্বাসী এক অনুচর শায়িত থাকে।

রাজ অন্তঃপুরে গোপনে আতাহুয়ালপা প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করেন অনুকূল মুহূর্তটির জন্যে। গানাদোর পরিকল্পনা এ পর্যন্ত প্রতি ধাপে আশাতীতভাবে সফল হয়েছে। এখন শুধু শেষের কটি চালই বাকি।

গানাদো ইতিমধ্যে সৌসায় না হোক, পেরুর রাজধানী কুজকোতে পৌঁছে গেছেন নিশ্চয়।

সেখানে সূর্য মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে আতাহুয়ালপার নিজের হাতে পাকানো ও সাজানো কিপু তিনি এমন একজনের হাত দিয়ে পাঠাবেন যাকে হুয়াসকার নিজেও যেমন অবিশ্বাস করতে পারবেন না, বাধাও দিতে পারবে না তেমনই তাঁর প্রহরীরা।

হুয়াসকার-এর প্রহরীরা আতাহুয়ালপার-ই দলের লোক। কিন্তু তারা হুয়াসকারকে পরাজিত শত্রু বলেই জানে, নির্মমভাবে যাকে বন্দি করে রাখাই তাদের কাজ।

আতাহুয়ালপা যে হুয়াসকার-এর সঙ্গে মিলিত হতে চাইতে পারেন এ তারা কল্পনা করতেও পারে না। হুয়াসকার-এর সঙ্গে বাইরের যে কোনও যোগাযোগ সম্পর্কে তাই তারা অতন্দ্রভাবে সজাগ।

কিন্তু তারাও যাকে বাধা দেবে না এমন কার হাতে কিপু দিয়ে হুয়াসকার-এর কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা ভেবে রেখেছেন গানাদো?

এমন আশ্চর্য দূতটি কে?

আর কেউ নয়, মুখোশ-আটা সত্ত্বেও কিশোর বালকের মতো কমনীয় চেহারায় যে শোভাযাত্রাটির অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম হিসেবে কৌতূহলী দর্শককে সন্দিগ্ধ করে তুলে গানাদোর দলের বিপদ ডেকে আনতে পারত।

এমন সহযাত্রী গানাদো জোটালেন কোথা থেকে তাঁর দলে? কুইটো আর কুজকো সেদিনকার দুই পরম শত্রুশিবিরের দু-পক্ষের কাছেই যার অমন খাতির, কিশোর বালকের মতো চেহারায় আসলে সে কে?

তা জানতে হলে সোনা বরদারদের দলের সঙ-এর মুখোশ খুলে তাকে দেখতে হয়।

আর দেখলে নির্বাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয় কিছুক্ষণ।

যেমন হয়েছিলেন গানাদো।

কবে?

আতাহুয়ালপাকে নীচ চক্রান্তে যেদিন বন্দি করা হয়, এসপানিওলদের চরম বিশ্বাসঘাতকতার সেই পৈশাচিক হত্যাতাণ্ডবের রাত্রে।

হ্যাঁ, সেই রাত্রেই আতাহুয়ালপার বিশ্রাম-শিবিরের কাছে এক অসহায় লুণ্ঠিতা নারীর আর্তধ্বনি শোনা গিয়েছিল, এসপানিওল এক পাষণ্ডের ললাটে প্রথম দেখা গিয়েছিল তলোয়ারে আঁকা এক অদ্ভুত কলঙ্ক চিহ্ন, আর কয়েক দিন বাদে সেনাপতি দে সটোর কাছে নিজের সময় কাটাবার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে গানাদো হেঁয়ালি করে বলেছিলেন, পাছে ভেঙে যায় ভয়ে একটা স্বপ্নকে আমি পাহারা দিয়ে রাত কাটিয়েছি কাপিন।

এই তিনটি ব্যাপার একই সুতোয় বাঁধা।

পাছে ভেঙে যায় ভয়ে যে-স্বপ্নকে পাহারা দিয়ে রাত কাটাবার কথা গানাদো বলেছিলেন সে স্বপ্নকে শরীরিণীরূপে সেই রাত্রেই তিনি প্রথম দেখেছিলেন।

দেখে নির্বাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলেন সত্যি।

সাত সমুদ্রের জল ইতিমধ্যে যথার্থই তিনি ঘেঁটেছেন, মধ্যোপসাগর থেকে আতলান্তিকের এপারে-ওপারে নারীর সৌন্দর্যের বিচিত্র প্রকাশ দেখেছেন, তবু এ রূপ যেন তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল।

ক্ষণিকের জন্যে জ্বালা একটা মশালের আলোয় যা দেখেছিলেন তাতে নিজের প্রকৃতিস্থতা সম্বন্ধেই তাঁর সন্দেহ জেগেছিল। মনে হয়েছিল অলীক কোনও মায়াই তাঁর অস্বাভাবিক কল্পনায় সময়ের ক-টি বুদ্বুদে ভেসে উঠেছে, এখুনি বুঝি মিলিয়ে যাবে।

মশালটা নিভিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েও ছিল যেন মিলিয়ে।

মশালটা সংগ্রহ করেছিলেন ইংকা নরেশের প্রস্রবণ-ঘেরা বিশ্রাম-শিবির থেকে শহরের প্রান্তে পর্বতপ্রাচীরের দিকে যেতে যেতে এক জায়গায় থেমে। কোনও হতভাগ্য কাকসামালকার নাগরিক সে মশাল জ্বেলে তার কোনও আপনার জনকে বোধহয় খুঁজে ফিরছিল সেই শ্মশান প্রান্তরে। হিংস্র কোনও এসপানিওল সৈনিকের হাতে নিহত তার দেহটার পাশেই পড়ে ছিল নিভে যাওয়া মশালটা।

গানাদো তাঁর তলোয়ারের উলটো পিঠ সেখানকার ছড়ানো পাথরে ঠুকে ফুলিঙ্গ বার করে অনেক কষ্টে মশালটা ধরিয়েছেলেন শুধু মৃত্যুর চেয়ে নিদারুণ নিয়তি থেকে যাকে তখনকার মতো উদ্ধার করতে পেরেছেন তার সত্যকার অবস্থাটা এক পলকে দেখে একটু বুঝে নেবার জন্যে।

পাষণ্ড এসপানিওল সেপাই তার বন্দিনীকে ঘোড়ার ওপর বেঁধে রেখেছিল।

সেই ঘোড়াই চালিয়ে গানাদো প্রস্রবণ-শিবির থেকে কাক্সামালকার পর্বত-বেষ্টনীর দিকে বেশ কিছুদূর যাবার পর থেমেছিলেন। থেমেছিলেন, ঘোড়ার পিছে বাঁধা বন্দিনী জীবিত কি মৃত, বুঝতে না পেরে।

সন্তর্পণে বাঁধন খুলে বন্দিনীকে তারপর তিনি মাটিতে নামিয়েছিলেন।

বন্দিনীকে বাঁধন খুলে পার্বত্যভূমির ওপর নামাবার সময় যেটুকু স্পর্শ লেগেছিল, তাতে গানাদো বুঝেছিলেন যে, অচৈতন্য অসাড় হলেও দেহে প্রাণ তখনও আছে। কিন্তু সে-প্রাণ ওষ্ঠসীমায় এসে পৌঁছেছে কি না, আর কতক্ষণ সেখানেই বা থাকবে,

সেইটেই ভাবনার বিষয় হয়েছিল।

অন্ধকার তখন চোখে কিছুটা সয়ে এসেছে। বন্দিনীকে মাটিতে নামাবার পর কিছুদূরেই একটি মৃতদেহ দেখতে পেয়ে অস্বস্তিভরে বন্দিনীকে আবার একটু সরাতে যাচ্ছেন এমন সময় নেভানো মশালটা চোখে পড়েছিল।

সেই রাত্রে হত্যাকাণ্ডের ওই মশান-প্রান্তরে মশাল জ্বালা কোথাও নিরাপদ নয়। তবু সে বিপদের ঝুঁকি গানাদো নিয়েছিলেন শুধু বন্দিনীর অবস্থাটা তাঁর না বুঝলেই নয় বলে।

অনেক কষ্টে মশালটা জ্বালাবার পর বিহ্বল এক বিস্ময় ছাড়া আর সব ভাবনাই তাঁর মন থেকে মিলিয়ে গিয়েছিল অবশ্য।

বেশ কয়েকটি মুহূর্ত কেমন একটা অবর্ণনীয় মুগ্ধ বিহ্বলতায় কাটাবার পর তাঁর হুঁশ ফিরে এসেছিল।

মূৰ্ছিতার চোখ-মুখের ভাব আর নাড়ির গতি পরীক্ষা করে তিনি তাড়াতাড়ি মশালটা নিভিয়ে দিয়েছিলেন।

যেটুকু তিনি দেখেছেন তাতে বন্দিনী সম্বন্ধে একেবারে হতাশ হবার কিছু পাননি। সযত্নে উপযুক্ত শুশ্রুষা ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করলে এখনও তাকে বাঁচানো যেতে পারে।

কিন্তু কোথায় সে ব্যবস্থা করবেন।

কাঞ্চন আর কামিনীলোলুপ, লুণ্ঠন হত্যা আর ধর্ষণের নেশায় উন্মত্ত পিশাচদের দৃষ্টির আড়ালে কোথায় এ স্বপ্নমূর্তিকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব?

বন্দিনীর শুধু রূপ নয়, তার পরিচ্ছদ অলংকারও ওই কয়েক মুহূর্তের আলোয় দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন গানাদো।

এ রাজ্যে আসবার পর প্রায় সব শ্রেণীর নারী-পুরুষই তাঁর চোখে পড়েছে। দরিদ্র সাধারণ থেকে সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারের বহু সুন্দরী তিনি দেখেছেন। অল্পবিস্তর তাদের বেশভূষাও লক্ষ করেছেন।

বন্দিনীর বেশভূষা তাদের থেকে বেশ একটু ভিন্ন। কামালকা নগরে শাপভ্রষ্টা সুরসুন্দরীর মতো এ মূর্ত স্বপ্ন কোথায় ছিল লুকোনো? কোথা থেকে পাষণ্ড এসপানিওল সৈনিক তাকে লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছিল!

ঘটনা বিচার করে গানাদোর মনে হয়েছেনগরে হত্যাতাণ্ডব শুরু হবার পর বন্দিনী বোধহয় কোনও সঙ্গী দলের সাহায্যে নগর থেকে পালাবার জন্যে বার হয়ে পড়েছিল। তারপর নারীমাংসলোপ এসপানিওল সৈনিকের দৃষ্টিতে পড়ে তার এই দশা হয়েছে। তার সঙ্গীরা হয়তো সবাই নিহত। রক্ষা কেউ যদি পেয়েও থাকে তারা এখন পলাতক।

বন্দিনীকে কারও হাতে সমর্পণ করবার সুতরাং উপায় নেই। তাকে শুশ্রুষায় সুস্থ করে তোলবার চেষ্টা গানাদোকে করতে হবে।

একটা নির্জন নিরাপদ গোপন আশ্রয় তার জন্যে অবিলম্বে প্রয়োজন।

ব্যাকুল হয়ে সেরকম আশ্রয়ের কথা ভাবতে গিয়ে গানাদোর হঠাৎ তাঁর সেইদিনকার সকালের টহলদারির কথাই মনে পড়েছে।

কামালকা নগর যে উপত্যকার ওপর বসানোে সেদিন সকালেই তার চারিদিকের উত্তুঙ্গ পর্বতপ্রাচীর কতখানি দুর্ভেদ্য গানাদো ঘোড়ায় চড়ে তা দেখতে বেরিয়েছিলেন।

উপত্যকা ঘিরে রাখা পাহাড়গুলোর তলায় তলায় ঘুরেওছিলেন বেশ বেলা পর্যন্ত আর তার জন্যেই আতাহুয়ালপার পিজারোকে দর্শন দিতে আসবার সংকল্প আর পিজারোর তারই ওপর পৈশাচিক আয়োজনের কথা আগে থাকতে জানতে পারেননি। এসপানিওল শিবিরের ভেতর থেকে নয়, বাইরের পেরুবাসী দর্শকদের মধ্যে থেকে এসপানিওলদের হাতে ইংকা নরেশের বন্দিত্বের অবিশ্বাস্য করুণ কুৎসিত নাটকটা তাঁকে দেখতে হয়েছিল নিরুপায়ভাবে।

সারা সকালের টহলদারিতে গানাদো কাক্‌সামালকার পর্বতপ্রাচীরে গোপন কোনও গিরিবর্ত্য অবশ্য পাননি, কিন্তু এমন একটা কিছু দেখেছিলেন যা সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে ভাগ্যের আশাতীত দান বলে মনে হয়।

উপত্যকার বেষ্টনীস্বরূপ একেবারে অলঙ্ঘ্য পাহাড়ের নানা খাঁজ গোপনপথের খোঁজে পরীক্ষা করতে গিয়ে গানাদো এক জায়গায় একটি গুহা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। গুহাটি পাহাড়ের খাঁজের আড়ালে এমনভাবে লুকোনো যে, গুপ্তপথ জানা না থাকলে অত্যন্ত কাছ দিয়ে যাতায়াত করলেও তার হদিস পাওয়া যায় না।

গানাদো গুহাটির সন্ধান যে পেয়েছিলেন, তাও নেহাত দৈবাৎ।

কিংবা তাঁর নিয়তিই ভাবী সম্ভাবনার কথা স্মরণে রেখে তাঁকে এই অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের সুযোগ দিয়েছিল বলতে ইচ্ছে করে।

গুহাটার কথা মনে হওয়ার পর গানাদো আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি। বন্দিনীকে ঘোড়ার পিঠে তুলে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়েছিলেন সেই গোপন গুহার সন্ধানে।

কিন্তু দিনের আলোতেই যে গোপন গুহার প্রবেশপথ খুঁজে পাওয়া কঠিন, রাতের অন্ধকারে তা চিনে বার করবার আশাই বাতুলতা।

ঘোড়া চালিয়ে পর্বতপ্রাচীরের কাছে পৌঁছে কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টার পরই গানাদো নিরস্ত হয়েছিলেন।

দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় তাঁর নেই।

ছোট একটি ঝরনা-ধারার ধারে বন্দিনীকে নামিয়ে কিছুটা নরম বালির শয্যায়। শুইয়ে রেখে গানাদো ঘোড়াটাকে একটু মৃদু চাপড় মেরে ছেড়ে দিয়েছেন। ছাড়া পাওয়া মাত্র ঘোড়াটা নিজে থেকেই ছুটে শহরের দিকে চলে গেছে।

ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছেন গানাদো। জায়গাটা বেশ নির্জন ও নিরাপদ। রাতের অন্ধকারে কারও এদিকে আসার সম্ভাবনা অল্প। এলেও সহজে কেউ সন্ধান পাবে না। ঘোড়াটা সঙ্গে থাকলে তার আকস্মিক ডাক বা পায়ের শব্দে ধরা পড়ার যেটুকু ভয় ছিল, তাও এখন নেই। নিঃশব্দে এখন শুধু রাত ভোর হবার জন্যে অপেক্ষা করে থাকাই আসল কাজ। আলো ফুটলে গোপন গুহাপথ খুঁজে বার করা কঠিন হবে না বলেই মনে হয়। খুঁজে বার করার অসুবিধা বুঝেই গানাদো আশ-পাশের পাহাড়ের কিছু বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন মনে করে রেখেছিলেন। দিনের আলোয় দেখলেই। সেগুলি চিনতে পারবেন এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না।