প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

১৭. ইংকা আতাহুয়ালপা

তারিখটা ষোলোই নভেম্বর, ১৫৩২, শনিবার।

ইংকা আতাহুয়ালপা সেইদিনই পালটা লৌকিকতা করতে সদলে পিজারোকে দর্শন দিতে আসবেন এরকম একটা কথা ঘনরাম শুনেছিলেন। কিন্তু আতাহুয়ালপা এত তাড়াতাড়ি সে-অনুগ্রহ করবেন, ঘনরাম তা বিশ্বাস করতে পারেননি।

সেইখানেই তাঁর সর্বনাশা ভুল।

এ ভুল না করলে ইংকা সাম্রাজ্যের ইতিহাস কি ভিন্ন হত?

তা হয়তো হত না, কিন্তু পিজারো আর তাঁর বাহিনীকে ইচ্ছাপূরণের জন্যে আর একটু বেশি দাম দিতে হত নিশ্চয়।

ঘনরাম নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন মন নিয়েই সকালবেলা একটি ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিলেন। ডিম্বাকৃতি কামালকা উপত্যকার চারিধারে কঠিন আকাশ-ছোঁয়া পর্বতপ্রাচীর। সেই পর্বতপ্রাচীর সত্যিই কতখানি দুর্ভেদ্য তা জেনে আনা ঘনরামের প্রয়োজন মনে হয়েছিল।

বেলা দুপুর পর্যন্ত দূর পাহাড়ের কোলে কোলে কাটিয়ে ঘনরাম ফিরে এসে শহরে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়েছেন। শহরের চেহারাই বদলে দিয়েছে। চারিদিকে উৎসবমত্ত জনতার উত্তেজিত আনন্দ কোলাহল। তার ভেতর দিয়ে ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপা সদলবলে পিজারোকে দর্শন দিতে আসছেন।

শোভাযাত্রার সামনে আসছে অসংখ্য অনুচর। ইংকা রেশের যাত্রাপথে এতটুকু আবর্জনা কোথাও যাতে না থাকে তার জন্যে তারা তাগে আগে পথ পরিষ্কার করতে করতে চলেছে। তার পরে আসছে অভিজাত ইংকা প্রধানরা সারিবদ্ধ হয়ে। তাদের মধ্যে যারা মানে সবচেয়ে বড় তারা ইংকা সম্রাটকে তাঁর শিবিকায় কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসছে।

ইংকা নরেশের অভিজাত সব সেবকদের সারা অঙ্গে বিচিত্র সব সোনার অলংকার। বিকেলের রোদে সেই সব স্বর্ণালংকার যেন আগুনের মতো জ্বলছে।

অভিজাত অনুচর আর সেবক ছাড়া ইংকা নরেশের শোভাযাত্রায় আছে অগণন সৈন্যসামন্ত। রাজপথে তাদের সকলকে কুলোয়নি। বেশির ভাগ পথের ধারের প্রান্তরে যতদূর দৃষ্টি যায় ছড়িয়ে পড়েছে।

ঘনরাম তাঁর ঘোড়াটি এক জায়গায় বেঁধে রেখে এসে কাক্‌সামালকার নাগরিকদের সঙ্গে মিশে এ দৃশ্য দেখছিলেন।

দেখতে দেখতে মনে তাঁর একটু আশঙ্কাই জেগেছে। ইংকা আতাহুয়ালপা এত সমারোহ করে পিজারোকে দেখা দিতে আসছেন শুধু কি নিজের ঐশ্বর্যের পরিচয় দিয়ে এসপানিওলদের চমকে দিতে? না, এই দেখা দিতে যাওয়ার মধ্যে ভয়ানক

কোনও উদ্দেশ্য সত্যিই আছে?

ইংকা নরেশের অনুচরদের ভাল করে লক্ষ করে সেরকম সন্দেহের কারণ আছে বলে কিন্তু মনে হয়নি। তাদের ভাবভঙ্গি চালচলনে উৎসবের আনন্দমত্ততার লক্ষণই দেখা গেছে। মনে মনে অন্য অভিসন্ধি থাকলে দু-একজনের পক্ষে তা হয়তো গোপন করা সম্ভব, কিন্তু এত বড় বিশাল বাহিনীর সকলেই অমন নিপুণ অভিনেতা নিশ্চয় হতে পারে না।

ইংকা নরেশের এটা কপট মিছিল নয় বোঝবার পরও কেন যে মনটা তাঁর সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়নি, ঘনরাম সত্যিই তখন ভেবে পাননি।

আতাহুয়ালপার একটি সিদ্ধান্তে ঘনরাম কিছুটা তবু আশ্বস্ত হয়েছেন! পিজারো আর তাঁর বাহিনী নগরের যে অতিথি-মহল্লা অধিকার করে আছে তার আধমাইলটাক দূরে এসে শোভাযাত্রা থেমে গেছে। থেমে গেছে আতাহুয়ালপারই আদেশে।

চারিদিকের মাঠে শিবির পাতবার আয়োজন দেখে ঘনরাম বুঝেছেন ইংকা নরেশ সে রাত্রের মতো তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানেই কাটাতে চান।

ঘনরাম এবার নাগরিকদের ভিড় ঠেলে নিজেদের আস্তানার দিকেই এগিয়েছেন। কিন্তু বেশিদূর যাবার সুযোগ তাঁর হয়নি। রাজপথ মুক্ত রাখবার জন্যে আবার নাগরিকদের পথের পাশে সরিয়ে দিয়েছে ইংকা নরেশের সেবকবাহিনী।

জানা গেছে যে আতাহুয়ালপা তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন পিজারোর খাতিরে। ইংকা নরেশকে রাত্রের মতো অতিথিপল্লী থেকে দূরে মুক্ত প্রান্তরে বিশ্রামের আয়োজন করতে দেখে পিজারো দূত পাঠিয়ে তাঁকে এ সংকল্প ত্যাগ করবার অনুরোধ জানিয়েছেন। অনুরোধের কারণ বলা হয়েছে এই যে পিজারো সেই রাত্রেই মহামান্য ইংকা অধীশ্বরের অভ্যর্থনার আয়োজন করে সেই সঙ্গে ভোজন-সভার সব ব্যবস্থা করেছেন। ইংকা নরেশ তাঁদের অনুগ্রহ না করলে সমস্ত আয়োজনই শুধু পণ্ড হবে না, মনে মনে পিজারোর বাহিনীর সকলে অত্যন্ত দুঃখ পাবে।

পিজারোর অনুরোধ রক্ষা করতে আতাহুয়ালপার রাজকীয় শোভাযাত্রা আবার অগ্রসর হয়েছে।

এবার আগের চেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে ঘনরাম ইংকা নরেশ আর তাঁর বাহকসেবকদের শোভাযাত্রা দেখবার সুযোগ পেয়েছেন।

আতাহুয়ালপার অনুচরদের বেশভূষা অত্যন্ত বিচিত্র তো বটেই, তাঁর নিজের পোশাকপরিচ্ছদ অলংকারও অপূর্ব।

যে শিবিকায় তাঁকে বয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে তা সোনা রুপোর পাত দিয়ে মোড়া আর নানা বিচিত্র রংবেরং-এর পাখির পালক দিয়ে অপূর্ব শোভায় সাজানো। এই শিবিকার ওপর নিরেট সোনার তৈরি একটি সিংহাসনে আতাহুয়ালপা বসে আছেন। আগের ব্রত উপবাসের দিনের সঙ্গে আতাহুয়ালপার এদিনের সাজসজ্জার অনেক তফাত। রাজচক্রবর্তীর নিদর্শনস্বরূপ কপাল ঢাকা রাঙা বোলাটি তাঁর মাথায় আগের দিনের মতোই আছে, কিন্তু সেই সঙ্গে গলায় যে অসাধারণ পান্নার মালাটি দেখা যাচ্ছে তা পিজারোর নিজের দেশের যে কোনও জহুরির চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো।

সাজপোশাক অলংকারের চেয়ে আতাহুয়ালপার চেহারা ও মুখের ভাবই ঘনরাম বেশি করে লক্ষ করেছেন।

সত্যিই বেশ একটু সশঙ্ক সম্ভ্রম জাগাবার মতো চেহারা। চারশো বছরের মহিমান্বিত ইংকা রক্তের ধারা তাঁর মুখে অনায়াস অসামান্য আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলেছে।

ইংকা নরেশের শিবিকা বহন করে বিরাট শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে এবার অতিথিপল্লীর প্রশস্ত চত্বরে প্রবেশ করেছে।

রাজশিবিকাকে পথ করে দেবার জন্য ইংকা নরেশের নিজের বাহিনীর লোকেরা দু-ধারে সরে গিয়েছে। সমস্ত ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল। কোথাও একটু বিভ্রান্তি কি গোলযোগ নেই। ইংকা নরেশের হাজার পাঁচেক সেবক অনুচর তখন অতিথিভবন বেষ্টিত মহাচত্বরে সমবেত।

নিঃশব্দে আতাহুয়ালপার শিবিকা চত্বর পার হয়ে সামনের মহামণ্ডপের প্রায় কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ থেমেছে। থামবার আদেশ আতাহুয়ালপা নিজেই দিয়েছেন। তাঁর প্রশান্ত গম্ভীর মুখে এবার একটু সন্দিগ্ধ ভুকুটি দেখা গেছে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

যাদের তিনি দর্শন দিতে এসেছেন সেই এসপানিওলরা কোথায়? সমস্ত চত্বরে পিজারোর বাহিনীর একটি লোককেও তো দেখা যাচ্ছে না।

কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ঘনরামও তখন এই ব্যাপারে বেশ বিস্মিত হয়েছেন। ইংকা নরেশকে অভ্যর্থনা করবার এ কী রকম ব্যবস্থা? ব্যবস্থার কোথাও কোনও গুরুতর ভুল হয়েছে কি!

না, তা বোধহয় হয়নি। সেই মুহূর্তে পিজারোর বাহিনীর ডোমিনিসিয়ান পাদরি ফ্রে ভিসেন্তে দে ভালভের্দেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। তাঁর এক হাতে একটি ক্রুশ-প্রতীক, আর-এক হাতে একটি বাইবেল।

আতাহুয়ালপা একটু অপ্রসন্নভাবেই পাদরি-বাবার দিকে তাকিয়েছেন। অভ্যর্থনার এ অভিনব রীতিটা তিনি ঠিক পছন্দ করতে পারেননি।

তবু রাজকীয় ধৈর্য তাঁর যথেষ্ট বলতে হবে। পাদরিসাহেব ইংকা নরেশের সামনে এসে দাঁড়িয়েই এক নিঃশ্বাসে কী যেন বলতে শুরু করেছেন। আতাহুয়ালপা মুখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করা ছাড়া সে দীর্ঘ বক্তৃতায় বাধা দেননি।

শুধু পাদরিসাহেবের ভাষণের অর্থ যখন তাঁকে অনুবাদ করে শোনানো হয়েছে। তখনই তাঁর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।

দোভাষী পাদরিসাহেবের বক্তৃতার যথাযথ অনুবাদ নিশ্চয়ই করতে পারেনি। তার অক্ষম অনুবাদ থেকে এইটুকু কিন্তু বোঝা গেছে যে পাদরিসাহেব পেরু সাম্রাজ্যের অধীশ্বরকে তাঁর নিজের অপবিত্র মিথ্যা ধর্ম ছেড়ে নবাগত এসপানিওলদের সত্য ধর্ম গ্রহণ করে ধন্য হতে বলছেন।

নতুন ধর্মের মাহাত্ম্য ও সুখ-সুবিধা বোঝাতে পারিসাহেব ক্রুশবিদ্ধ যিশুর জীবনী থেকে শুরু করে রোমের পোপের মহিমা আর স্পেনের সম্রাটের অসামান্য প্রতাপ প্রতিপত্তি সব কিছুই সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন।

দোভাষীর কাঁচা অনুবাদ থেকেই আতাহুয়ালপা কতখানি যে বুঝেছেন তা তাঁর জবাবেই এবার বোঝা গেছে।

আমি পৃথিবীর যে কোনও অধীশ্বরের চেয়ে বড়। জ্বলন্ত স্বরে তিনি বলেছেন, কারও অধীন আমি হব না। তোমাদের সম্রাট মস্ত কেউ হতে পারেন। এত দূরে সমুদ্র পারে তোমাদের যখন তিনি পাঠাতে পেরেছেন তখন তাঁর অসাধারণত্ব আমি স্বীকার করি। তাঁর সঙ্গে তাই আমি বন্ধুত্ব পাতাতে চাই। আর যে পোপের কথা তুমি বলছ তাঁর তো মাথা খারাপ বলে আমার মনে হয়। নইলে যা তাঁর নয় সে দেশ তিনি দান করেন কী হিসেবে? আমার ধর্ম আমি ছাড়ব না জেনে রাখো। তুমি নিজেই বলছ তোমাদের ঈশ্বরকে তাঁর তৈরি মানুষই হত্যা করেছে। আর চেয়ে দেখো, আমার ঈশ্বর এখনও নিজের দেবলোক থেকে তাঁর সন্তানদের দিকে করুণার দৃষ্টি মেলে আছেন।

পশ্চিম আকাশে কাক্‌সামালকার পর্বত প্রাচীরের আড়ালে রক্তিম সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। সূর্যপ্রভব ইংকাবংশের শেষ সম্রাট আতাহুয়ালপাকে সেই দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাঁর আরাধ্য ঈশ্বরকে যে দেখাতে হয়েছিল তার মধ্যেই নিয়তির নির্মম ইঙ্গিত কি ছিল না?

অস্তাচলের রাঙা সূর্যকে ইংকা সাম্রাজ্যের একেশ্বর দেবতা হিসাবে দেখিয়ে প্রায় তেমনই রক্তনেত্রে ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপা পাদরি বাবা ভালভেদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন কঠিনস্বরে, আমায় এইমাত্র যা শুনিয়েছ সেসব কথা বলবার অধিকার কে তোমায় দিয়েছে? কার হুকুমে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ?

এরপর যা ঘটেছে তার কোন বিবরণ সম্পূর্ণ সঠিক তা বলা শক্ত। প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও একটু দূরে থাকার দরুন ঘনরামও তখনকার বিশৃঙ্খল উত্তেজনার মধ্যে ঘটনার ধারা ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারেননি।

আতাহুয়ালপার ক্রুদ্ধ কণ্ঠ শোনবার পরই তাঁর অনুচর বাহক ও প্রহরীরা অস্থির চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

আতাহুয়ালপার রক্তচক্ষু দেখে আর জ্বলন্ত স্বর শুনে পাদরি বাবা ভালভের্দে-ও তখন বেশ ভড়কে গিয়েছেন নিশ্চয়। তিনি নাকি তাঁর হাতের একটি বই। আতাহুয়ালপার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, হুকুম আমি পেয়েছি এইটি থেকে।

আতাহুয়ালপা বইটি হাতে নিয়ে দু-একটা পাতা উলটেই নাকি রেগে ফেটে পড়েছেন। বইটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বজ্রস্বরে পাদরিসাহেবকে শাসিয়ে বলেছেন, তোমার সঙ্গীদের গিয়ে বলো যে তারা এ পর্যন্ত যা যা অন্যায় করেছে সব কিছুর জবাবদিহি না নিয়ে আমি যাব না।

এই বই ছুঁড়ে ফেলাই নাকি বারুদের গাদায় আগুনের ফুলকির কাজ করেছে, কারণ বইটি ছিল নাকি বাইবেল।

পাদরিবাবা ভালভেদে এরপর বাইবেলটি কুড়িয়ে নিয়ে অতিথিশালার ভেতরে পিজারোর কাছে ছুটে ফিরে গিয়েছেন। আর তার কয়েক মুহূর্ত বাদেই যা শুরু হয়েছে।

তা ঘনরামের কাছেও অবিশ্বাস্য দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়েছে।

ভিড়ের মধ্যে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে বাইবেল ছুড়ে ফেলার মতো কোনও ব্যাপার ঘনরাম দেখতে পাননি। আতাহুয়ালপাকে ঘিরে জনতার একটা ক্রুদ্ধ উত্তেজিত আলোড়নই শুধু লক্ষ করেছেন। পাদরি-বাবা ভালভের্দে-র ব্যস্ত হয়ে অতিথিশালার ভেতরে ছুটে যাওয়াটা অবশ্য তাঁর নজর এড়ায়নি।

কিছু একটা অপ্রত্যাশিত যে ঘটতে যাচ্ছে এটুকু তিনি ঠিকই অনুমান করেছেন। শুধু অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা যে কী হতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেননি।

আতাহুয়ালপার অভ্যর্থনার ব্যাপারটা এমন বিশৃঙ্খল হয়ে যাবার কারণ ভাল করে বোঝবার জন্যে ঘনরাম অতিথিশালার দিকেই তখন এগুতে শুরু করেছিলেন। হঠাৎ তাঁকে চমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে।

চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তিনি অকস্মাৎ কামানের গর্জনে।

এই সময়ে কামান গর্জে উঠল কী করে, কোথা থেকে? বিস্মিত বিহ্বলভাবে চারদিকে চেয়ে ঘনরাম এবার কোথা থেকে কামান ছোড়া। হচ্ছে দেখতে পেয়েছেন। অতিথিমহল্লার প্রবেশদ্বারের দুর্গ থেকেই কামান ছোড়া হচ্ছে ইংকা বাহিনীর ওপর। ছুঁড়ছে পিজারোরই সৈনিকরা। সুকৌশলে কামান ঢেকে রেখে এতক্ষণ তারা ভেতরে লুকিয়ে ছিল।

লুকিয়ে থাকা এসপানিওল সৈন্য চারিদিকের সমস্ত অতিথিশালা থেকেই এবার পিলপিল করে বেরিয়ে এসেছে। নেতা হিসেবে তাদের চালনা করছেন স্বয়ং ফ্রানসিসকো পিজারো। জয় সন্ত খাগো-র! মেরে শেষ করো ওদের!—এই চিৎকার-ধ্বনি তুলে নিজের রিসালা নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইংকাবাহিনীর ওপর।

সম্পূর্ণ অতর্কিত অন্যায় এ আক্রমণ। এর চেয়ে নীচ জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছু হতে পারে না!

কিন্তু এ পৈশাচিক শঠতায় লাভ কিছু হবে কি? এ তো শুধু অন্ধ মূঢ়তায় সাধ করে সর্বনাশ ডেকে আনা। ইংকা নরেশের হাজার হাজার প্রহরী অনুচর আর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ওই ক-টি এসপানিওল যোদ্ধা তো দেখতে দেখতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

তা কিন্তু হয় না।

অতিথিমহল্লার বিরাট চত্বরে আতাহুয়ালপার সঙ্গে কমপক্ষে হাজার ছয়েক সৈন্য তখন উপস্থিত। কামান-বন্দুক যা-ই থাক, পিজারোর হয়ে লড়বার লোক তো বাষট্টিজন ঘোড়সওয়ার আর একশো ছয় পদাতিক নিয়ে সবসুদ্ধ একশো আটষট্টিজন মাত্র।

ইংকা নরেশের বাহিনী যদি একবার শুধু দৃঢ়সংকল্প নিয়ে রুখে দাঁড়াত, কামানবন্দুক আর সওয়ারি ঘোড়া নিয়েও পিজারোর দল কতক্ষণ পারত যুঝতে! তাদের সব গোলাবারুদ কখন যেত ফুরিয়ে, আর সেই সঙ্গে ছ-হাজার ইংকা সেনার পায়ের চাপেই তারা দলে পিষে যেত।

তার পরিবর্তে যা অসম্ভব কল্পনাতীত তা-ই ঘটেছে এবার। পিজারোর সওয়ার সৈনিকরা খোলা তলোয়ার এলোপাথাড়ি চালাতে চালাতে ছুটে গেছে জনতার ভেতর দিয়ে। বন্দুক-কামানের গুলিগোলা আর তীরন্দাজদের তীর এই জনতার ওপর বর্ষিত হয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে। নিহত আহত হয়েছে অসংখ্য ইংকা নরেশের সৈন্য। যারা তা হয়নি, তারা গুলিগোলার ভয়ংকর ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে আর তার অজানা উৎকট গন্ধমিশ্রিত ধোঁয়ার আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে এ মরণফাঁদ থেকে পালাবার চেষ্টাতেই নিজেদের গুরুতরভাবে দলিত পিষ্ট করে গেছে। পিজারোর মুষ্টিমেয় ক-জন সৈনিক সওয়ার ঘোড়া চালিয়ে আর কামানবন্দুক ছুড়ে যা পারেনি ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে ইংকাবাহিনী নিজেরাই নিজেদের সে দারুণ সর্বনাশ করেছে। চত্বরে ঢোকবার ও তা থেকে বাইরে যাবার একটিমাত্র পথই ছিল ভোলা। সে পথ পালাবার জন্যে ব্যাকুল ইংকা সেনাদের উন্মত্ত ঠেলাঠেলিতেই যারা নিহত তাদের স্তুপীকৃত শবে রুদ্ধ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত শুধু মানুষের প্রচণ্ড চাপেই চত্বর প্রকারের একটি মাটি ও পাথরে গাঁথা অংশ ধ্বসে পড়েছে আর সেই ফাঁক দিয়ে ইংকাবাহিনীর যারা পেরেছে তারাই ছুটে পালিয়েছে নগর ছাড়িয়ে যতদূর সম্ভব বাইরের মুক্ত প্রান্তরে।

সেখানে গিয়েও তারা রক্ষা পায়নি। হত্যার আনন্দে এসপানিওল সওয়ার সৈনিকরা তখন উন্মত্ত। তারা অসহায় আতঙ্কবিহ্বল পলাতকদের ভেতর সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে অবাধে তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করেছে ডাইনে-বাঁয়ে তলোয়ার চালিয়ে।

ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার তখন কী হয়েছে? তিনিও কি এই আকস্মিক পৈশাচিক আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন?

না, প্রাণ তাঁকে দিতে হয়নি। দেওয়াই যদিও তাঁর পক্ষে আর ইংকা সাম্রাজ্যের ইতিহাসের পক্ষে গৌরবের হত।

আতাহুয়ালপা তখন পিজারোর হাতে বন্দি হয়েছেন। প্রাণে মারা নয়, এই বন্দি করাই ছিল পিজারোর অভিপ্রায়। আতাহুয়ালপাকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দি করবার জন্যে শেষ পর্যন্ত পিজারো বেশ একটু আহতও হয়েছিলেন ইংকা নরেশের ওপর এসপানিওল এক সৈনিকের নিক্ষিপ্ত অস্ত্র ঠেকাতে।

সে এসপানিওল সৈনিক অধৈর্য হয়েই নিশ্চয় ইংকা নরেশকে মারবার জন্যে অস্ত্র ছুড়েছিল। অধৈর্য হবার কারণ আতাহুয়ালপাকে কিছুতেই অক্ষত অবস্থায় বন্দি করবার মতো বাগে না পাওয়া।

আতাহুয়ালপার সঙ্গে যারা ছিল সেই বাহক-সেবক অনুচরেরা সবাই নিরস্ত্র। পিজারোর সৈনিকদের অতর্কিত ভয়ংকর আক্রমণের পর আর সকলের মতো তারা কিন্তু পালাবার জন্যে ব্যাকুল হয়নি। তারা সকলে অভিজাত বংশের বীর। এই কল্পনাতীত বিভীষিকার মধ্যেও তারা তাদের অধীশ্বরকে রক্ষা করবার জন্যে নিরস্ত্র অবস্থাতেই মরণপণ করে যুঝেছে।

পিজারোর আদেশ ছিল আতাহুয়ালপাকে বিন্দুমাত্র আহত না করে বন্দি করতে হবে। অতর্কিত আক্রমণে গোড়া থেকেই এসপানিওল সওয়ার সৈনিকরা সেই চেষ্টা করেও কিন্তু সফল হয়নি। সওয়ার সৈনিকরা ঘোড়ার ওপর থেকে খোলা তলোয়ার চালিয়েছে আর নিরস্ত্র নিরুপায় ইংকাবীরেরা তাদের বাধা দেবার চেষ্টা করেছে জীবন তুচ্ছ করে সে ঘোড়ার লাগাম ধরে ঝুলে পড়ে। একের পর এক বীর কাটা পড়েছে, কিন্তু তার জায়গা নেবার লোকের অভাব হয়নি।

এদিকে সূর্য অস্ত গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হয়ে আসছে। পিজারোর সৈনিকদের ভয় হয়েছে শেষ পর্যন্ত সেই অন্ধকার বিশৃঙ্খলার মধ্যে ইংকা নরেশ তাদের খপ্পর থেকে না পালাবার সুযোগ পায়। অসহিষ্ণু এক সৈনিক তখনই আতাহুয়ালপাকে লক্ষ্য করে বল্লম ছুড়ে মেরেছে আর নিজে আহত হয়ে সে বল্লম ঠেকিয়েছেন স্বয়ং পিজারো।

সে সন্ধ্যার একতরফা হত্যা-তাণ্ডবে এসপানিওলদের নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ নাকি ওইটুকুই! পিজারো ছাড়া তাঁর সৈন্য-সামন্তদের একজনও নাকি বিন্দুমাত্র আহত হয়নি।

পিজারোর ওই আঘাতটুকু নেওয়া অবশ্য সার্থক হয়েছে পুরোমাত্রায়। কিছুক্ষণ বাদেই শিবিকাবাহী বীরদের প্রায় সবাই একে একে প্রাণ দেবার পর আতাহুয়ালপার শিবিকাই ভেঙে পড়েছে মাটিতে। পিজারো আর তাঁর কয়েকজন সঙ্গী ইংকা নরেশকে সেই অবস্থাতেই বন্দি করে নিয়ে গেছেন অতিথিশালার একটি পাহারা দেওয়া কামরায়। আতাহুয়ালপার মাথায় রাজ চক্রবর্তীর প্রতীক-চিহ্ন রক্তিম বোলা তখন আর নেই। তাঁর শিবিকা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ এক সৈনিক তা। ছিনিয়ে নিয়েছে।

এই বোলা ছিনিয়ে নেওয়ার দৃশ্যটুকু ঘনরাম নিজের চোখেই দেখেছেন। অবিশ্বাস্য এ হত্যা-তাণ্ডব শুরু হবার পর প্রথমটা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেও তারপর তিনি আতাহুয়ালপার শিবিকা ঘিরে যেখানে উন্মত্ত সংগ্রাম চলেছে সেইদিকেই অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছেন।

অগ্রসর হওয়া অবশ্য সহজ হয়নি। মানুষের উন্মত্ত বন্যাস্রোত ঠেলে কাছাকাছি যখন গিয়ে পৌঁছোতে পেরেছেন তখন সেখানকার নিষ্ঠুর করুণ নাটক শেষ হয়ে এসেছে। রক্তাক্ত বাহকরা ধরাশায়ী হবার সঙ্গে সঙ্গে ইংকা নরেশের টলমল শিবিকা মাটিতে ভেঙে পড়েছে এবার, আর ঘনরামের চোখের ওপরেই মিগুয়েল এসতেতে নামে এক সাধারণ সৈনিক আতাহুয়ালপার মাথার বোলা খুলে নিয়েছে টান মেরে।

ঘনরামের ডান হাতটা আপনা থেকেই তাঁর কোমরে বাঁধা তলোয়ারের হাতলের ওপর গিয়ে একবার পড়েছিল। তৎক্ষণাৎ নিজেকে তিনি কিন্তু সামলে নিয়েছেন। বুঝেছেন যে নীরবে নিস্পন্দ দর্শকমাত্র হওয়া ছাড়া তাঁর করণীয় আর কিছু নেই।

করণীয় সত্যিই কি কিছু তাঁর ছিল?

করণীয় কিছু আছে মনে করেই কি তিনি এতক্ষণ তা হলে প্রাণপণে আতাহুয়ালপার শিবিকার কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা করেছিলেন?

কী-ই বা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব ছিল? কী তিনি চেয়েছিলেন করতে? কাক্সামালকা নগরের কয়েকটি অদ্ভুত পরবর্তী ঘটনায় তার আভাস পরে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

সেই মুহূর্তে ঘনরাম কিন্তু নির্লিপ্ত দর্শকের মতোই সব কিছু দেখেছেন, তারপর নিঃশব্দে এক সময়ে অতিথিমহল্লার চত্বর ছেড়েই বেরিয়ে গেছেন রাতের গাঢ় অন্ধকারে। আতাহুয়ালপার সম্মানে আয়োজিত পিজারোর ভোজসভায় সে রাত্রে তাঁকে দেখা যায়নি।

হ্যাঁ, পিজারো তাঁর কথার মর্যাদা রেখে সত্যিই সেই রাত্রে ইংকা নরেশকে ভোজ দিয়েছেন। কয়েক ঘণ্টা আগে যেখানে ইংকাবাহিনীর রক্তবন্যা বয়ে গেছে। কাক্‌সামালকার সেই অতিথিমহলেরই একটি বিরাট হল-এ ভোজসভার আয়োজন হয়েছে। পিজারো আতাহুয়ালপাকে সসম্মানে নিজের পাশের আসনে বসিয়ে আপ্যায়িত করেছেন।

সেই ভোজসভায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য যাদের হয়েছিল তারা আতাহুয়ালপাকে দেখে বেশ একটু বিস্মিতই হয়েছে। কল্পনাতীত এই আকস্মিক ভয়ংকর ভাগ্য বিপর্যয়ের পর ইংকা নরেশ বিমূঢ় বিহ্বলতায় বিবশ হয়ে পড়লে অবাক হবার কিছু ছিল না। ভেতরে ভেতরে তাঁর মনের মধ্যে যে আলোড়নই চলুক, আতাহুয়ালপার বাইরের চেহারায় তার বিন্দুমাত্র আভাস কিন্তু কেউ দেখতে পায়নি। সম্রাটোচিত প্রশান্তিই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর মুখের ভাবে। তিনি যেন নিজের ঔদার্যে অনুগ্রহ করে এই অজানা বিদেশিদের ভোজসভা অলংকৃত করতে এসেছেন মনে হয়েছে তাঁর আলাপে আচরণে।

পিজারোর এই পৈশাচিক শঠতা সম্বন্ধেও আতাহুয়ালপা প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন বলে এই ভোজসভার একজন নিমন্ত্রিত প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ রেখে গেছেন।

আতাহুয়ালপা কি সত্যিই তাঁর বন্দিত্বের সম্পূর্ণ ভয়াবহ তাৎপর্য তখনও বোঝেননি? না, এত বড় বিরাট সাম্রাজ্যের বুকের একটি কোণে মুষ্টিমেয় ক-জন বিদেশি শত্রুর উন্মত্ত বাতুল স্পর্ধার উপযুক্ত জবাব দিতে ইংকা রাজশক্তির দেরি হবে

না, নিশ্চিত নিশ্চিন্ত এই বিশ্বাসে পিজারো আর তাঁর সঙ্গীদের একটু প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ করেছেন মাত্র।