প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

১০. আনা শেষ পর্যন্ত

আনা শেষ পর্যন্ত ঘনরামকে খুঁজে পেয়েছে।

খুঁজে পেয়েছে সমস্ত বাড়িতে ব্যাকুল হয়ে ছুটে বেড়াবার পর এমন অবস্থায় এমন একটি জায়গায় যেখানে সন্ধান করার কথা সে প্রথমে ভাবতেই পারেনি।

বাড়িতে দাসদাসী কেউ তখন নেই। ইস্টারের উৎসবের জন্যে বিকেল থেকে সেরাতের জন্যে যে তাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে তা আনার ভুলে যাবার কথা নয়। সোরাবিয়াকে একবার শুধু জানিয়ে দুপুর থেকে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থাটা আনা নিজেই করেছিল সন্ধ্যায় কিষাণ মেয়ের ছদ্মবেশে বার হবার সুবিধের জন্যে। এখন কিন্তু সাহায্য করবার কাউকে না পেয়ে সে ক্রমশই বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে। তার সমাজের অন্য মেয়েদের চেয়ে কুসংস্কার তার কম। তবু আজকের সব কটি ব্যাপার মিলে তার মনটা যেন দুর্বল করে দিয়েছে। আশাতীতভাবে যার দেখা সে আজ পেয়েছে এই বাড়ির মধ্যেই সোরাবিয়ার সঙ্গে ঢুকে সে লোকটা হঠাৎ এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে কী করে?

ব্যাপারটা সত্যিই ভৌতিক কিছু, না সোরাবিয়া নিজের খপ্পরে এনে মানুষটাকে গুমখুনটুন কিছু করেছে?

তার কাছে জনহীন নিস্তব্ধ তার নিজের চেনা বাড়িটাই কেমন যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে হঠাৎ।

একবার মনে হয়েছে বাড়ি থেকে বার হয়ে গিয়ে কাউকে সাহায্যের সঙ্গী হবার জন্যে ডেকে আনে।

কিন্তু কাকে এখন সে ডেকে আনতে যাবে? রাস্তায় যাকে তাকে তো সে আহ্বান করতে পারে না। তার নিজের এখনকার সমাজের কাউকে ডাকতে গেলে একটা কৈফিয়ত তো দিতে হবে। কী কৈফিয়ত সে দিতে পারে!

সোরাবিয়াকে বাড়ি থেকে ঘোড়া চড়ে বেরিয়ে যেতে সে দেখেছে। ঘনরামকে সঙ্গে করে এনে তারপর একলা সে গেলই বা কোথায়?

স্থিরভাবে সমস্ত অবস্থাটা একবার বোঝবার চেষ্টা করবার জন্যে আনা তার নিজের ঘরে এবার গেছে! তিয়ো সানসেদোর সঙ্গে দেখা করা আজ আর হবে না। তার নিজের কিষাণ মেয়ের পোশাকটাও তাই বদলানো দরকার।

নিজের ঘরে ঢুকেই আনাকে স্তম্ভিত বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে।

ঘনরাম তারই ঘরে পড়ে আছে, তারই বিছানার ওপর।

সমস্ত বাড়ির মধ্যে এই ঘরটিতে ঘনরামের থাকার কথা কল্পনা করতে পারেনি বলেই আনা এখানে খোঁজ করতে আসেনি।

নিজের ঘরে নিজের বিছানায় ঘনরামকে দেখবার পর আনা কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে। তার হাত পা নাড়বার যেন আর ক্ষমতা নেই।

ঘনরাম কেন যে তার এতক্ষণের ব্যাকুল চিৎকারে সাড়া দেয়নি তা এইবার বোঝা গেছে।

না, সে মৃত কি আহত বা অজ্ঞান নয়, আনার বিছানার ওপরই আষ্টেপৃষ্ঠে খাটের সঙ্গেই বাঁধা। শুধু চোখ দুটি বাদে মুখটাও তার কাপড় গুঁজে বন্ধ করা।

তোমার, তোমার এ অবস্থা কে করেছে! কে তোমায় বেঁধেছে এখানে! এক হিসেবে অর্থহীন প্রশ্ন ক্ষুব্ধ চিৎকার হয়ে বেরিয়েছে আনার কণ্ঠ থেকে।

এ অবস্থায় ঘনরামের যে উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই পরমুহূর্তে তা স্মরণ করে আনা ছুটে গিয়ে পাশের সোরাবিয়ার ঘর থেকে আর কিছু না পেয়ে তার দীর্ঘ ছোরাটা নিয়ে এসেছে।

সেই ছোরা দিয়ে ব্যস্তব্যাকুলভাবে ঘনরাম দাসের বাঁধন সে কেটেছে। সব বাঁধন কাটতে হয়নি। বিছানার সঙ্গে জড়ানো হাতের বাঁধনটা কাটবার পর ঘনরাম নিজেই তাঁর মুখের ওপর চাপা দেওয়া কাপড়টা খুলে ফেলে যা বলেছেন তা ওই অবস্থায় একটু অপ্রত্যাশিত আর অস্বাভাবিক।

অন্য সময় হলে আর অমন উত্তেজিত বিহ্বল হয়ে না থাকলে আনার মতো মেয়ে এ কথায় বোধহয় জ্বলে উঠত।

ঘনরাম দাস নিজের মুখের বাঁধন খুলে বিছানার ওপর উঠে বসে একটু হেসে বলেছেন, কাজটা কি ভাল করলেন, মার্শনেস? একটা ফেরারি গোলামকে পালাবার সুযোগ দেওয়া যে অপরাধ তা তো জানেন!

কথাটায় সূক্ষ্ম খোঁচা যা ছিল তা বোঝবার মতো মনের অবস্থা আনার তখন নয়।

জানি!বলে অস্থির আগ্রহে সে জিজ্ঞাসা করেছে, তোমাকে সোরাবিয়াই তা হলে এখানে বেঁধে রেখেছে! কিন্তু কেন? বাঁধলই বা কেমন করে? তোমায় এমন করে বাঁধবার ক্ষমতা তার হল?

তা হবে না কেন? ঘনরাম এবার উঠে দাঁড়িয়ে ঈষৎ কৌতুকের স্বরে বলেছেন, আমি নিজেই যখন তাকে বাঁধতে দিয়েছি।

তুমি নিজেই তাকে বাঁধতে দিয়েছ! আনার গলায় প্রথম গভীর বিভ্রান্তি প্রকাশ পেয়েছে। তারপর তীব্রস্বরে সে বলেছে, এ পরিহাসের সময় নয়, দাস। মনে হচ্ছে চরম বিপদে পড়ে তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে! নইলে তোমার অবস্থা যে কী সাংঘাতিক তুমি বুঝতে!

অবস্থা সাংঘাতিক জেনেই এখানে এসেছি, মার্শনেস! ঘনরামের গলায় আর কৌতুকের সুর তখন নেই—আর, পরিহাস করে নয়, সত্যই বলছি, আপনার মার্কুইসকে স্বেচ্ছায় এইভাবে আমায় বাঁধতে দিয়েছি!

কিন্তু গভীর বিমূঢ়তায় আনা কয়েক মুহূর্ত থেমেছে নিজের প্রশ্নটা গুছিয়ে নিতে। একটু অধৈর্যের সঙ্গে তারপর জিজ্ঞাসা করেছে, নেহাত উন্মাদ না হলে তা কি কেউ দেয়? তোমাকে তো তার সঙ্গেই এসে আমি এখানে ঢুকতে দেখেছি। তুমি কি এইভাবে বাঁধতে দেবার জন্যেই তার সঙ্গে এসেছিলে?

তা একরকম বলতে পারেন! ঘনরামের মুখে একটু তিক্ত হাসি এবার দেখা দিয়েছে—বাঁধা পড়বার জন্যে না থোক, তাঁর শর্ত মানতে রাজি হয়েই তার সঙ্গে

এখানে এসেছিলাম। এখানে আসবার পর তিনি ওই শর্তই জানিয়েছিলেন।

মানে তোমায় বেঁধে রাখার শর্ত! আনার মুখ দেখে মনে হয়েছে, ঘনরাম তার সঙ্গে যে পরিহাস করছেন তা তখনও সে এ বিষয়ে নিঃসংশয় হতে পারেনি—আর বেঁধে রাখা আমারই ঘরে আমার বিছানার ওপরে?

হ্যাঁ, এটা মার্কুইস মানে আপনার স্বামীর একটা নীচ ইতর কৌতুক। ঘনরামের গলার স্বর এবার ঘৃণাতীব্র হয়ে উঠেছে—তিনি তাঁর শর্ত জানিয়ে বলেছেন যে, শুধু বাঁধা পড়লেই হবে না, তাঁর স্ত্রী মার্শনেস-এর ঘরের বিছানায় আমায় বাঁধা থাকতে হবে।

এরকম শর্তের মানে?—তীব্র হয়ে উঠেছে আনার কণ্ঠস্বর!

এ বিশেষ শর্তের কারণ কুৎসিত রসিকতা করে তিনি যা বলেছেন তা আপনাকে শোনাতে পারব না মার্শনেস। তিক্তকণ্ঠে বলেছেন ঘনরাম, তা শুনেও বাধ্য হয়ে তাঁর সব কথায় যে রাজি হয়েছি তার জন্যে মনের গ্লানিটুকু ঘোচাবার সুযোগ আশা করছি। এখুনি পাব।

ঘনরামের কথার যথার্থ তাৎপর্যটা আনা তখনও ঠিক ধরতে পারেনি। কথাটা কেমন অদ্ভুত লাগায় ঘনরামের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে নিজের মনের জ্বালাতেই জিজ্ঞাসা করেছে, আমার ঘরে আমারই বিছানায় তোমাকে বাঁধবার শর্তের কী কারণ দেখিয়েছিল আমার স্বামী! শুনি কী রসিকতা সে করেছিল?

সে রসিকতাটা ওই নকল কাবালিয়েরো-সাজা ফেরারি গোলামের জিভে বোধহয়। বাধছে! অত যখন শোনবার আগ্রহ তখন আমিই শোনাচ্ছি না হয়।

আনা চমকে ফিরে তাকিয়েছে। তার স্বামী সোরাবিয়াই খাপ থেকে খোলা তলোয়ার হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে। মুখে তার হিংস্র পৈশাচিক কৌতুকের হাসি।

আনার সাময়িক বিমূঢ় অস্বস্তিটুকু উপভোগ করে সে কথাগুলো এবার যেন কুরিয়ে কুরিয়ে বলেছে, স্বপ্নে যাকে পাশে দেখো সেই গোলামটাকে জ্যান্ত তোমার বিছানায় বেঁধে তোমায় দেখানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য। সেইজন্যেই তোমার ফেরার অপেক্ষায় হতভাগাকে বেঁধে রেখে গিয়েছিলাম। ওকে তখন অবশ্য অন্য কৈফিয়ত দিয়েছিলাম। বলেছিলাম—আমাদের মার্শনেস-এর শুচিবায়ু বড় বেড়েছে। আলাদা ঘরে থাকেন, নোংরা হবার ভয়ে তাঁর বিছানা আমায় ছুঁতে দেন না। একটা গোলামকে বেঁধে শুইয়ে বিছানাটা তাই একটু পবিত্র করতে চাই।

আনার মুখের চেহারা আর চোখের শানিত তীব্র ঝিলিক দেখে মনে হয়েছে সে বুঝি ক্ষিপ্ত চিতার মতো তৎক্ষণাৎ সোরাবিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

কিন্তু তা সে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। তার বদলে ঘনরামের দিকে ফিরে জ্বলন্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করেছে, এই কুৎসিত ইতর বিদ্রূপ শুনে একটা জবাবও দাওনি! খুব মজা

পেয়েছিলে বোধহয়?

মজা পাইনি। তবে জবাবও দিতে পারিনি তখন। ঘনরাম অনুত্তেজিত গলায় বলেছেন সোরাবিয়ার দিকে চেয়ে।

জবাবটা এখন তা হলে দিবি বোধহয়! হিংস্রভাবে হেসে উঠেছে সোরাবিয়া তাই দেওয়াই তো আমি চাইছি! ফেরারি গোলাম হিসেবে তোকে শুধু ধরিয়ে দিয়ে আমার কতটুকু আর সুখ হত! মার্শনেস আদর করে তোর বাঁধন খুলে দিয়েছে। এখন তার বিছানাতেই তোর লাশটা শুইয়ে তার সাধ মেটাই। কই, জবাব দে!

সোরাবিয়া তার খোলা তলোয়ারটা ঘনরামের দিকে তুলে ধরেছে এবার।

সেটা যেন লক্ষই না করে ঘনরাম অবিচলিতভাবে বলেছেন, জবাব আপনাকে সত্যিই দেব, মার্কুইস। কিন্তু শুধু ওই ইতর নোংরা রসিকতার নয়। আরও অনেক কিছুর জবাব আপনাকে দেবার আছে। প্রথম জবাব আপনার বেইমানির। পরস্পরের শর্ত মানব বলে আমরা কথা দিয়েছিলাম। আপনার শর্ত মেনে আমি আপনারই আবাসে এসে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমার বক্তব্য আপনাকে শোনাতে রাজি হয়েছিলাম। আপনার নীচ জঘন্য রসিকতাও নীরবে সহ্য করেছিলাম আপনাকে দিয়ে একটা বড় কাজ করাবার জন্যে। কথা ছিল আপনার শর্ত মানলে আপনিও আমার শর্ত মানবেন। আমার বক্তব্য শুনে সেই অনুসারে কাজ করা আপনার পণেও লাভের বুঝলে আমাকে মুক্ত করে সেই কাজই করবেন। এই বিছানায় বাঁধা অবস্থায় আপনাকে যা আমি বলেছি তার মূল্য আপনি বুঝেছেন, বুঝেছেন যে পিজারোর মতো

অসামান্য আবিষ্কারকের সেভিলে অন্যায়ভাবে বন্দি হওয়ার খবর সম্রাটের দরবারে পৌঁছে দিতে পারলে আপনার কদর সেখানে অনেক গুণ বেড়ে যাবে। সমস্ত কথা বুঝে মনে মনে আমার পরামর্শ নেওয়ার মতলব করেও আমার বাঁধন আপনি খুলে দেননি। সত্যি সত্যিই আপনার স্ত্রী মার্শনেসকে তাঁরই বিছানায় আমার বাঁধাপড়ে-থাকার দৃশ্য দেখিয়ে চরম অপমান করবার জন্যে তাঁকেই খুঁজতে গেছলেন। আপনার এতরকম নীচতা ইতরতা বিশ্বাসঘাতকতার পুরোপুরি জবাব এখন অবশ্য দেওয়া চলবে না।

কেন, তৈরি করার সুযোগ পাসনি বুঝি? বাঁকা হাসির সঙ্গে তলোয়ারের ডগাটা ঘনরামের গলার কাছটায় সুনিপুণ কৌশলে দুবার ঘুরিয়ে বলেছে সোরাবিয়া, মার্শনেস-এর সঙ্গে একটু প্রেমালাপেরও সময় মেলেনি? বড় আচমকা এসে পড়েছি, কেমন!

না, আচমকা নয়, মার্কুইস। যেন বিনীতভাবে বলছেন ঘনরাম, গোলাম হিসেবে। মনিবদের কানমলা খেয়ে খেয়ে কান দুটো আমার একটু বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে। এইখানে বসে বাড়ির বাইরের রাস্তায় ঘোড়া থামিয়ে নিঃশব্দে আপনার নামবার চেষ্টা আমি টের পেয়েছি। টের পেয়েছি চুপি চুপি পা টিপে আপনার বাড়ির ভেতর ঢোকা। মার্শনেসকে তাই তখন বলছিলাম যে আপনার ইতর মনের জঘন্য শর্ত মেনে নেওয়ার গ্লানিটুকু ঘোচাবার সুযোগ বোধহয় পাব। আপনি তখন সবে বাইরের দেউড়িতে টুকছেন।

বটে! তোর কান তো তা হলে কুকুরকেও হার মানায়! কুৎসিতভাবে হেসে উঠে বলেছে সোরাবিয়া, তোর কান দুটোই তা হলে আগে কেটে রাখি, তারপর এমন সরেস জবাব দেবার ওই জিভটা।

সোরাবিয়ার আস্ফালিত তলোয়ারের ফলাটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে ঘরের ঝোলানো বাতিদানের আলোয়।

সোরাবিয়ার তলোয়ারের ফলাটা তখনই রক্তপাত করবার জন্যে অবশ্য ঝিলিক। দিয়ে ওঠেনি। সোরাবিয়া নিষ্ঠুর কৌতুকে ঘনরামকে নিয়ে একটু খেলাবার জন্যেই তলোয়ারটা তাঁর মুখের চারিধারে নাচিয়েছে একটু।

কিন্তু সে শুধু বুঝি মুহূর্তের জন্যে।

সোরাবিয়ার তলোয়ারটা তাঁর মুখের কাছে নেচে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘনরাম বিদ্যুৎ গতিতে আনার হাতের ছোরাটা টেনে নিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়েছেন।

সোরাবিয়া প্রথম এক লহমা বুঝি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, তারপরই তার মুখ শয়তানি হাসিতে কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

বাঃ, চমৎকার! চাপা হিংস্র উল্লাসে বলেছে সোরাবিয়া, ফেরারি গোলামের ধরা পড়ে ছোরা নিয়ে আক্রমণ! আজকাল আইন-কানুন একটু বেয়াড়া হয়েছে। নফর গোলাম মারলেও কৈফিয়ত দিতে হয়। কিন্তু বেয়াড়া গোলাম কি খ্যাপা কুকুর মারলে ইনাম পর্যন্ত মেলে। তোকে মুর্দা বানাবার এমন নির্দয় সুযোগ তুই নিজেই দিবি ভাবতে পারিনি।

শোনো!—সোরাবিয়া তলোয়ারটা বাড়িয়ে আবার একটু নাচাতেই রেগে চিৎকার করে এগিয়ে গিয়েছে আনা—এ তোমার অন্যায় লড়াই, সারাবিয়া। তোমার হাতে তলোয়ার আর দাসের হাতে শুধু একটা ছোরা।

ইস! গোলাম জাতের জন্য বড় যে দরদ। তার জন্যেই এ অভিসারের সাজ? কেমন? কুৎসিতভাবে হেসে উঠেছে সোরাবিয়া। তারপর হঠাৎ তলোয়ারের ফলাটা অদ্ভুত কৌশলে আনার পোশাকের ওপর যেন বুলিয়ে দিয়েছে।

তলোয়ারের খেলায় সোরাবিয়া যে উঁচুদরের বাহাদুর তার এই গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়ে ফলা বুলোবার কায়দাতেই তা বোঝা গেছে। আনার পরনে কিষাণ মেয়ের পোশাক। কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত সে পোশাক তলোয়ারের ফলার সূক্ষ্ম টানে দু ফাঁক হয়ে ঝুলে পড়েছে শরীরের দুধারে। হঠাৎ এভাবে বেআবরু হয়ে ক্ষণেকের জন্যে স্তম্ভিত ও তার পরেই লজ্জায় অপমানে দিশাহারা অবস্থায় আনাকে ছুটে বেরিয়ে যেতে হয়েছে ঘর থেকে অস্ফুট আর্তনাদ করে।

গোলাম প্রেমিককে রূপ দেখাতে এত লজ্জা কীসের!ইতর মুখভঙ্গি করে আনার পেছনে অপমানটা যেন নোংরা কাদার মতো ছুড়ে দিয়েছে সোরাবিয়া। তারপর ঘনরামের দিকে ফিরে বিদ্রূপে বাঁকা কুৎসিত হাসির সঙ্গে বলেছে, জানের বদলে তোকে একটু খেসারত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যাবার আগে চক্ষু সার্থক করে যাওয়া তোর কপালে নেই!

ঘনরাম তখন শান্ত স্থির অবিচল, কিন্তু সে স্থৈর্য যেন থমকে যাওয়া তুফানের ভয়ংকর মেঘের।

ভেতরে যে কী চলছে তা শুধু তাঁর চোখের দৃষ্টির তীব্র বিদ্যুৎ-জ্বালায় ধরা পড়ে। গলা কিন্তু তাঁর সহজ স্বাভাবিক, বরং একটু যেন পরিহাসলঘু।

সেই হালকা গলাতেই তিনি বলেছেন, আপনি যে সত্যিকার বনেদি মার্কুইস তা আপনার চালচলনেই বোঝা যায়। নিজের স্ত্রীর সম্মান এভাবে রাখতে ইতর ভুঁইফোড় কেউ পারে! আপনার মতো মার্কুইস-এর উপযুক্ত নজরানা আজই দিয়ে যেতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু তার উপায় নেই। আপনাকে শুধু একটা অনুরোধ করছি। হাতের তলোয়ারটা ফেলে দিন। আমাকে শিক্ষা দেবার বাসনা থাকে তো শুধু হাতেই তা দেবার চেষ্টা করতে পারেন। তলোয়ার হাতে থাকলে আপনার বেশি জখম হবার বিপদ আছে।

বটে! হিংস্রভাবে হেসে উঠে বলেছে সোরাবিয়া, তলোয়ার চালাতে আমি যে আনাড়ি তা ধরে ফেলেছিস, কেমন?

না, আনাড়ি নয়, মার্কুইস, বেশ একটু তারিফ করার ভঙ্গিতেই বলেছেন ঘনরাম, আমি সমুদ্রের এপারে-ওপারে আপনার মতো তলোয়ারের পাকা হাত দেখেছি কি

সন্দেহ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, আপনি তলোয়ার না ছাড়লে আমাকেও ছোরাটা হাতে রাখতে হয়। তলোয়ার ঠেকাতে ছোরা, বুঝতেই তো পারছেন বেসামাল হয়ে যদি একটু বেশি ঘা দিয়ে ফেলি।

বেসামাল হয়ে আমায় বেশি ঘা দিয়ে ফেলবি! তোর ওই পুঁচকে ছোরা দিয়ে? শুনে থ হয়েই সোরাবিয়া বোধহয় হাসতে ভুলে গেছে প্রথমে। তারপর রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠে বলেছে, সত্যিই তোর মরণ ছিটফিটিনি ধরেছে দেখতে পাচ্ছি। মুখে যাই বলি, ভেবেছিলাম, শুধু তোর নাক কান কেটে খাঁদা বোঁচা করে ঠেলে ফেলে দেব রাস্তায় তোর প্রেয়সীর মন ভোলাতে। সত্যিই তোর শমনের ডাকই এসেছে। নে, ইষ্টনাম জপ করে নে।

দাঁড়ান! দাঁড়ান মার্কুইস। সোরাবিয়া চালাবার জন্যে তলোয়ারটা তুলতেই মিনতির সুরে বলেছেন ঘনরাম, আবার আপনাকে বলছি, তলোয়ারটা ফেলে দিন।

এখনও আপনার অনেক কিছু করার আছে। অনেক ওপরের ধাপে ওঠবার–

ঘনরাম তখন তাঁর কথা আর শেষ করতে পারেননি। সোরাবিয়ার ঘা সামলাতে তাঁকে এক লাফে পাশে সরে যেতে হয়েছে।

সেখান থেকে প্রায় যেন নাচের পায়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি আবার আগের কথার খেই ধরেই বলেছেন, আপনাকে সম্রাটের দরবারে যেতে হবে, মার্কুইস—সে কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন?

সোরাবিয়ার পরের মারটাও নাচুনে পায়ে এড়িয়ে ঘনরাম যেন বেশ একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছেন, এই সোজা কথাটা বুঝছেন না কেন? সম্রাটের কাছে কানা খোঁড়া হয়ে কি গায়ে মাথায় ঘেয়ো পটি বেঁধে যাওয়া কি ভাল দেখাবে!

সোরাবিয়ার তৃতীয় মারটা ঘনরাম তাঁর ছোরা দিয়েই ঠেকিয়েছেন এবার। তারপর কিছুক্ষণ কথা বলার ফুরসত পাননি।

সোরাবিয়া তখন সত্যিই একেবারে খেপে গেছে। আজেবাজে নয়, যথার্থই সে উঁচুদরের অসিযোদ্ধা। সামান্য একটা ছোরা নিয়ে তাকে ঠেকানো মানে তার চরম অপমান। সে অপমানের শোধ নিতে খোঁচানো বাঘের মতো সে তখন হিংস্র হয়ে। উঠেছে। ঘনরামকে টুকরো টুকরো করে না কাটলে বোধহয় তার রাগ যাবে না।

কিন্তু ঘনরামকে কাটতে হলে ধরা তো চাই। সেইটেই যে মুশকিল। হাতে তাঁর একটা খাটো ছোরা মাত্র। কিন্তু সেই ছোরা দিয়েই যেন তিনি ভেলকি দেখিয়েছেন। হাতের ছোরার চেয়ে তাঁর পায়ের ভেলকি অবশ্য বেশি বই কম নয়। তলোয়ার হাতে ওই ঘরটুকুর মধ্যে চরকিপাক খেতে হয়েছে সোরাবিয়াকে তাঁকে বাগে পাওয়ার জন্যে। হেলে দুলে যেন নাচের পা ফেলার কৌশলে ঘনরাম সোরাবিয়াকে বার বার এড়িয়ে গিয়ে তার তলোয়ারের নিপুণ চালও হাস্যকর করে তুলেছেন।

সোরাবিয়ার খ্যাপা আক্রোশের প্রথম ধাক্কাটা সামলে ঘনরাম আবার তাকে বোঝাতেও শুরু করেছেন আগের জের টেনে, তলোয়ার আপনি ভালই খেলেন, কিন্তু পায়ের কাজ কিছু শিখলে ভাল করতেন। পায়ের দোষেই ঠিক সুবিধে করতে পারছেন না। তা ছাড়া আমার এই ছোরাটাকে হেনস্থা করাও আপনার উচিত হয়নি। এ ছোরা আপনারই। শুধু এর দাম যে কত তা আপনি জানেন না। নেহাত বাহার হিসেবেই এটা কখনও-সখনও তলোয়ারের কোমরবন্ধে ঝুলিয়েছেন। এ বিষয়ে একটু ওয়াকিবহাল হলে বুঝতেন তলোয়ারের সঙ্গে ডানদিকে শোভার জন্যে ঝোলাবার মিজেরিকদে ছোরা এটা ঠিক নয়। এটা তার চেয়ে অনেক দামি আর কাজের জিনিস। এ ছোরা আপনাদের উত্তর-পুবের পাহাড়ি রাজ্যের পেশাদার সেপাইদের কাছ থেকে পাওয়া। আপনি কোথা থেকে এটা হাতিয়েছেন কে জানে, কিন্তু এ ছোরার পুরো মর্ম ববাঝেননি। পাহাড়ি সেপাইদের ছোরার সঙ্গেও এ ছোরার একটু তফাত আছে। সে ছোরা একটু বদলে এক ধার দাঁতালো করে এ ছোরা বানানো। নাম হল মাইন গাউচে!

হঠাৎ থেমে গিয়ে জিভে আফশোশের আওয়াজ করে ঘনরাম বলেছেন, এই দেখুন, এ বেয়াড়া হাতিয়ার এত সাবধানে চালাবার চেষ্টা করেও একটা কান আপনার কেটে ফেললাম। এই জন্যেই আপনাকে তলোয়ার ফেলে হাতে লড়তে বলেছিলাম। যাক, একটা কানই যখন গেছে তখন দুটোই যাক। ছেলেবেলায় যেন কোথায় শুনেছিলাম দুকান কাটা হলে আর লজ্জা-শরম কিছুর দরকার থাকে না। আরে, আরে—আপনি যে আরও খেপে যাচ্ছেন! ভুলে যাচ্ছেন কেন যে এ ছোরার একধারে দাঁত থাকাটা মিথ্যে বাহার নয়। এর কাজ হল অতি ধারালো তলোয়ারও এমনইভাবে কায়দা মাফিক ধরে নিয়ে দু-টুকরো করে ফেলা।

সোরাবিয়ার তলোয়ার তখন সত্যিই ঘনরামের হাতের ছোরার দাঁতালো ধারে পড়ে দু-টুকরো হয়ে সশব্দে মেঝের ওপর পড়েছে।

ব্যাপারটা বোধহয় সোরাবিয়ার একেবারে কল্পনাতীত। মেঝের ওপরকার তলোয়ারের টুকরো দুটোর দিকে চেয়ে সে একেবারে হতভম্ব, নির্বাক।

প্রথম বিমূঢ়তাটা একটু সামলে সে সভয়ে ঘনরামের দিকে তাকিয়েছে। ঘনরামের দিকে ঠিক নয়, তাঁর হাতের ছোরাটার ওপরই তার দৃষ্টি তখন স্থির।

ঘনরাম প্রথমে সজোরে মারবার ভঙ্গিতেই ছোরাটা তুলেছেন।

ফ্যাকাশে মুখে সোরাবিয়া দু-পা পিছিয়ে যেতে একটু মুচকি হেসে ঘনরাম ছোরাটা। আবার নামিয়ে বলেছেন, ভয় নেই, মার্কুইস। আগেই বলেছি আপনার সব কীর্তি আর কথার পুরো জবাব আজই দেওয়া হবে না। দুনিয়ার ইতিহাসের একটা নতুন পাতা খোলাবার জন্যে আপনাকেও এখন একটু দরকার। আপনাকে এই অবস্থাতেই তাই ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। আমি চলে যাবার পর আপনারও বেশিক্ষণ এখানে থাকার অন্য বিপদ আছে। আপনার স্ত্রী মার্শনেসকে যে চরম অপমান করেছেন, তাতে লজ্জায় ঘেন্নায় দেশান্তরী হবার মতো মেয়ে তিনি বোধহয় নন। পোশাক বদলে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে আসতে তিনি দেরি করবেন না এ অনুমান আমার বোধহয় ভুল নয়। আমি সামনে থাকলে ব্যাপারটা একটু কুৎসিত রকম জটিল হতে পারে বলে আমি এখুনি চললাম। তারপর বিলম্ব না করে আপনারও টোলেডো রওনা হওয়া উচিত। সম্রাট পঞ্চম চার্লস সেখানেই দরবার বসিয়েছেন খবর পেয়েছি। আশা করি নিজের স্বার্থ বুঝে আমার পরামর্শটা নেবেন—

হঠাৎ থেমে বাঁ-হাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় সোরাবিয়াকে ঘরের কোণে ছিটকে ফেলে দিয়ে ঘনরাম আবার বলেছেন, না না, মার্কুইস এরকম ভুল করা আপনার উচিত হয়নি। বিশেষ কারণে এখনকার মতো উদার হচ্ছি বলে অসাবধান আমি হইনি। আপনার মতো প্রাণীর প্যাঁচালো মাথার অন্ধিসন্ধি আমার জানা। সুতরাং অন্যমনস্কতার সুযোগে আচমকা কাবু করবেন, বৃথাই সে আশা করেছেন। আপনার সঙ্গে হিসেব-নিকেশ সব বাকি রেখেই এখন যাচ্ছি। আশা করছি একটা কান একটু ছিঁড়ে যার নমুনা দেখিয়েছি, একদিন সেই হিসেব পুরোপুরি চোকাবার সুযোগ পাব।

সেই মুহূর্তে ঘরের বাইরে একটা দ্রুত পদশব্দ শোনা গেছে।

ঘনরাম সজোরে ঘরের বাতিদানের দিকে তাঁর ছোরাটা সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে মেরেছেন।

ঝনঝনিয়ে কাঁচের ঢাকনা সমেত বাতিদানটা মেঝেয় আছড়ে পড়ে ঘর অন্ধকার হয়ে যেতে-না-যেতেই ঘনরাম সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছেন।

যাবার পথে অন্ধকারে সজোরে একবার ধাক্কা খেয়েছেন।

দেহের উষ্ণ কোমলতা থেকেই সংঘর্ষটা যে কার সঙ্গে হয়েছে তা বুঝতে দেরি হয়নি।

ধাক্কা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোমল দেহটা তাঁর অঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে তা থেকে যেন ইস্পাতের দুটি বাহু বেরিয়ে তাঁকে ধরে রাখতে চেয়েছে।

সেই সঙ্গে নারীকণ্ঠে শোনা গেছে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা, কে? কে তুমি? দাস?

ঘনরাম কোনও উত্তর দেননি। নীরবে প্রাণপণ শক্তিতে আনার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে প্রায় নিষ্ঠুরভাবে মুক্ত করে ছুটে বেরিয়ে গেছেন।

বাড়ি থেকে জনহীন নিরালোক রাস্তায় বেরিয়ে এসে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন অনেকখানি।

আপাতত সেভিল শহরে সে রাত্রের মতো অন্তত তিনি নিরাপদ। সোরাবিয়ার বাড়ির দেউড়ি থেকে রাস্তায় পা বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়েই তিনি কিন্তু চমকে উঠেছেন।। সেখানে এমন একজন তাঁর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে এখানে দেখবার কথা ঘনরাম কল্পনাও করতে পারেননি।