গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০৪. চলাফেরার কায়দা

ও! আপনি বুঝি চলাফেরার কায়দাও বদলে দিয়েছিলেন? ঘনাদার কথার মাঝখানেই মুগ্ধ গদগদ স্বরে বললেন পল্টুবাবু।

হ্যাঁ, চেনার অসাধ্য করে ভোল পালটাতে হলে শুধু চেহারা পোশাকই নয়, হাঁটা, চলা, কথা বলার ধরনও বদলাতে হয়! ঘনাদা একটু অনুকম্পার হাসির সঙ্গে জ্ঞানটুকু দিতে পেরে খুশি হয়েই আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু লেভিও তো গুপ্তচরগিরির বিদ্যায় বড় কম যায় না। গরমিলগুলো সত্ত্বেও সে দূর থেকে আমার পিছু নেয়, আর তারপর আমার হোটেলটার হদিস পেয়ে দেখা করতে আসে মরিয়া হয়েই।

তার নিজের যে আর কিছু করবার ক্ষমতা নেই তা সে ভাল করেই জানে। এস-এস-পি-এস-র কয়েদখানায় তার শরীরের যা হাল হয়েছে তাতে আর ক-দিনই বা সে টিকবে! তা ছাড়া বেঁচে থাকলেও যে-দুশমনেরা তার পেছনে লেগে আছে, তারা তাকে ধরে ফেলবেই। আমায় তাই লেভি তার জোগাড় করা সমস্ত সুলুকসন্ধান দিয়ে ই-ইউ-ডব্লিউ-সি আর এস-এস-পি-এস সম্বন্ধে যা করবার তাই করতে বলে।

আমার একটা সুবিধের কথাও সে আমায় জানিয়ে দেয়। ই-ইউ-ডব্লিউ-সি তো বটেই, এস-এস-পি-এস-এর চর আর চাঁইদের কাছেও আমি একেবারে অজানা। আমি তাই বেশ চুপিসারে তাদের পেছনে লেগে থেকে নিজের মতলব হাসিল করতে পারব।

সবশেষে লেভি বলেছে, ই-ইউ-ডব্লিউ-সি সম্বন্ধে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়িত্ব যে কী তা আমায় যে বলে দিতে হবে না, তা সে জানে।

লেভিকে তারই ভালর জন্য মাঝিমাল্লার ওই কফি-খানাতেই রেখে আমি একলা সেখান থেকে চলে এসেছি। সাবধানের মার নেই বলে হোটেলটা থেকেও পাওনাগণ্ডা চুকিয়ে সরে পড়েছি সেইদিনই।

তারপর লেভির কাছে পাওয়া সব সুলুক-সন্ধানের খেই ধরে যত জায়গায় ঘুরেছি। তা দেখাতে হলে সারা দুনিয়ার ম্যাপটাই খুলে ধরতে হয়। সারা দুনিয়া চষে বেড়াবার পর তখন ক-দিনের জন্য হংকং-এ আছি। কাজ যে কিছু সারতে পারিনি তা নয়, কিন্তু হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যাবেলা যা হয়ে গেল, তা আমার সম্পূর্ণ আশাতীত।

বিকেলের দিকে সেদিন হংকং-এর সব দ্রষ্টব্যের মধ্যে তুলনাহীন সেই সমুদ্র-পার্কে গিয়েছিলাম। পৃথিবীর কোথাও যা নেই, সামুদ্রিক প্রাণীর সেই বিরাট স্বাভাবিক পরিবেশের সমাবেশে অন্য সবকিছুর মধ্যে বিশেষ করে গ্লোরি আর বার্ট নাম দেওয়া দুই ডলফিনের জল থেকে পুরো এক-মানুষ-প্রমাণ লাফ দিয়ে দিয়ে উঠে বল হেড করার বাহাদুরি দেখে বেশ একটু আমোদ পেয়ে কেবল কারে চড়ে বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে উঠে বসতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেছি।

ট্যাক্সির দরজাটা খুলে সবে ভেতরে উঠে বসেছি, এমন সময় অন্যদিক থেকে একটা রোগাটে হাঘরে চেহারা ও পোশাকের মানুষ যেন চোরের মতো ছুটে এসে অন্যদিক দিয়ে আমার ট্যাক্সিটায় উঠে পড়ে কাতর মিনতি করে বলল, দোহাই আপনার, যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানেই চালাতে বলুন।

মিনতিটা ফরাসিতে করা। ট্যাক্সিতে চিনে ড্রাইভার ফরাসি বুঝুক না বুঝুক এ উপদ্রবে রেগে উঠে তার নিজের ভাষায় আর পিজিন ইংরেজিতে লোকটাকে নেমে যাবার জন্য ধমক দিলে।

আমার দিকে করুণভাবে চেয়ে লোকটা নেমে যেতেই উঠছিল। কিন্তু আমি বাধা দিয়ে তাকে থামিয়ে ড্রাইভারকে আমারে হোটেলের ঠিকানায় চালাতে বললাম। হোটেল পর্যন্ত পৌঁছবার পর লোকটা নেমে চলে যাবে ভেবেছিলাম। তা গেলে তাকে বাধা দিতেও পারতাম না। কিন্তু তা সে গেল না। আমি লবি থেকে অটোমেটিক লিফটে গিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই আধময়লা ছেঁড়া হ্যাভারস্যাক নিয়ে সুড়ত করে ঢুকে পড়ে আমার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

পাঁচতলায় আমার কামরা। সেখানকার ল্যান্ডিংয়ে নামবার পরেও দেখি, সে আমার সঙ্গ ছাড়ছে না। আমার কামরা সতেরো নম্বর। সে কামরায় যাবার প্যাসেজে তখন কোনও লোক নেই। আমার কামরার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে তার দিকে ফিরে বললাম, আমি কিন্তু এবার আমার কামরায় যাচ্ছি।

দয়া করে আমাকে তা হলে আজকে রাত্রের মতো এখানে থাকতে দিন। লোকটা আতঙ্ক-মেশানো চাপা গলায় বললে, আমি মেঝের কার্পেটের ওপর শুয়ে থাকব। আপনার এতটুকু অসুবিধে করব না। আর কাল ভোর হবার আগেই এখান থেকে পালিয়ে যাব।

একটু বাঁকা ঠোঁটে হেসে কামরার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার আগেই সেই আগের মতো সুড়ুত করে যেন চোরের মতো ভেতরে ঢুকে পড়ল।

দরজাটা বন্ধ করে তার দিকে চেয়ে এবার একটু কড়া গলাতেই বললাম, এ হোটেলটা পশ যাকে বলে সেইরকম খানদানি মোটেই নয়। তবে অনেকগলের চেনা, আর এদের আদর-যত্নের ব্যবস্থা খারাপ নয় বলে এখানেই আমি সাধারণত উঠি। এ হোটেলের ওপর আর যেমন একটু টান আছে, এখানকার মালিক ম্যানেজারও তেমনই আমায় একটু খাতির করে। তাদের কিছু না-জানিয়ে বেআইনিভাবে সম্পূর্ণ অচেনা একজন লোককে আমার কামরায় থাকতে দেওয়ার মতো বেয়াড়া কাজের কথা যদি তারা জানতে পারে তা হলে আমার অবস্থাটা কী হবে? আমার এ কামরায় হোটেলের বয়-বেয়ারারা নানা ফরমাশ তামিল করতে আসে। হোটেলের ডাইনিং রুমে নয়, আমি এখানেই নিজের কামরায় ডিনার খাই। সে-ডিনার দিতে, প্লেট-টেট নিয়ে যেতে, আর আরও নানা কাজে বয়-বেয়ারারা যখন আসা-যাওয়া করবে, তখন আপনি তাদের চোখে পড়বেন না বলতে চান? কোথায় আপনি তখন লুকোবেন? বাথরুমে?

হ্যাঁ, বলেই থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে লোকটি শুকনো মুখে কয়েক সেকেন্ড পরে বললে, তা হলে? তা হলে আমি চলেই যাই।

সে অসহায়ভাবে বাইরের দরজার দিকে পা বাড়াতে তাকে হাতের ইঙ্গিতে বাধা দিয়ে বললাম, আপনার বিপদ খুব বেশি তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি তা থেকে বাঁচবার জন্য আমার শরণ কেন নিলেন বলুন তো?

আমি-আমি কিছু না ভেবেচিন্তে প্রথম আপনাকে ট্যাক্সি করে যেতে দেখে আপনার গাড়িতে উঠে পড়েছি।

লোকটি আরও কী বলতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি যা করেছেন তা তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। কিন্তু আপনার কাজটা কী রকম হয়েছে জানেন?

একটু থেমে কামরার একটা দেয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, হোটেলটা খুব নতুন নয়, তা আপনাকে আগেই বলেছি। ওই দেখুন, দেয়ালে একটা শিকারি মাকড়শা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ছোট্ট মাকড়শাগুলো জাল পাতে না। একা একা শিকার করে বেড়ায়। পোকা বা মাছি দেখলে ওত পেতে থেকে জো বুঝে ঝাঁপ দিয়ে ধরে।

লোকটি এবার কেমন একটু সন্দিগ্ধভাবে আমার দিকে চাইছে। আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ কি না এই বোধহয় সন্দেহ।

তার সন্দেহটা একটু গভীর হতে দিয়েই বললাম, বাগে পেলে এ মাকড়শা মাছি-টাছি শিকার করে, কিন্তু ধরুন, কোনও মাছি যদি নিজে থেকে যেচে এসে ওর খপ্পরে পড়ে, তখন মাকড়শাটার কীরকম ভাব হতে পারে বুঝতে পারেন?

লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে বেশ হতভম্ব আর একটু ভয়-ভয় মুখ নিয়ে আমার দিকে এবার চেয়ে রইল।

বুঝতে ঠিক পারছেন না, না? আমিই আবার একটু হেসে বললাম, আচ্ছা অন্য একটা কথা বলি। আমি কে, তা তো আপনি জানেন না। আমি ট্যাক্সি করে চলে যাচ্ছি দেখে পালাবার জন্য কিছু না ভেবেচিন্তে আমার গাড়িতে এসে উঠেছেন। এখন আমার পরিচয় একটু শুনুন। আমি এই হংকং শহরে কেন এসে আজ সাতদিন ধরে সমস্ত শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছি? বেড়াচ্ছি শুধু একটি মানুষকে খোঁজবার জন্য। তার নাম দ্যুব্যারি। রোগা পাতলা প্রায় হাঘরে চেহারা পোশাকের একটা নেহাত সাধারণ মানুষ। নাম যশ অর্থ প্রতিপত্তি, কিছুই তার নেই। তবু পৃথিবীর কারও কারও কাছে তার দাম তার ওজনের হিরে-মানিকের চেয়ে বেশি। তেমনই একটি পার্টি দ্যুব্যারিকে খুঁজে বার করবার জন্য যা চাই তা-ই খরচা আর ইনাম কবুল করে আমায় লাগিয়েছে। দুব্যারিকে আমি এই হংকং শহরে খুঁজেও পেয়েছি। শুধু খুঁজেই পাইনি, সে নিজে থেকে—

এরপর আর কিছু আমার বলা হল না। দুব্যারি নামটা করার পর থেকেই একেবারে ভয়ে সিঁটিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে লোকটা একটা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে যেন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার কথার মাঝখানে শুকনো কাঁপা গলায় বললে, আপনি–আপনি আমাকে নিয়ে কী করবেন এখন?

আপনাকে নিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য একটি মিথ্যে বিস্ময়ের ভান করতে গিয়ে খুব খারাপ লাগল বলে সোজাসুজিই এবার বললাম, আপনি তা হলে স্বীকার করছেন যে, দুবারি আপনার নাম। কিন্তু কারা আপনাকে যেমন করে হোক, যেখানে হোক ধরবার জন্য সমস্ত দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে তা জানেন কি?

না। শুকনো কাতর গলায় দুব্যারি বলল, সত্যিই ঠিক করে জানি না। তবে তাদের যে অনেক ক্ষমতা, অনেক টাকা, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই যে তাদের লোকজন চর-টর আছে, এটুকু ভাল করেই বুঝতে পেরেছি।

হেসে বললাম, তা হলে অনেকটাই বুঝেছেন। কিন্তু কেন তারা আপনাকে ধরতে চায় তা কিছু জানেন কি?

জানি, একটু ইতস্তত করে বললে দুব্যারি, তারা—তারা আমার সমস্ত কাজ নষ্ট করে দিতে চায়, আমায় তারা ব্যর্থ করতে চায়।

কিন্তু কেন তা চায়, কী আপনার কাজ, তা বলতে আপনার একটু দ্বিধা হচ্ছে— কেমন? এবার গম্ভীর হয়ে বললাম, এমনই বেকায়দায় পড়েও আপনার সব রহস্য আমার মতো অচেনা একজনের কাছে ফাঁস করতে চান না। তা হলে কী আপনার কাজের রহস্য, আর কেন কারা আপনাকে নিজেদের খপ্পরে পুরে সে কাজ নষ্ট করে দিতে চায় তা আমিই বলছি, শুনুন।

দুব্যারির করুণ অসহায় চেহারা দেখলে তখন মায়া হয়। দেওয়ালের ধার থেকে তাকে একটা সোফায় বসিয়ে তার পাশের আর-একটা আসনে বসে বলতে শুরু করলাম, উনিশশো তিয়াত্তরে আরব দেশগুলো তাদের অঢেল তেলের পুঁজির জোরেই গোদা গোদা সব রাজাগজার দেশের বড়মানুষি গরম ঠাণ্ডা করে দেবার পর পৃথিবীর সব জায়গায় নতুন করে হিসেবনিকেশ শুরু হয়। এ সব বিষয়ে মাথা যাদের পাকা, তারা এইটে তখন বুঝে ফেলেছে যে, আরবরা হঠাৎ আবার দয়া করলে বা নতুন আরও ক-টা আরব দেশের মতো তেলের খনি বেরুলেও পৃথিবীর জ্বালানির সমস্যা চিরকালের মতো তাতে মিটবে না। এখন যত অঢেলই মনে হোক, মানুষের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে পৃথিবীর বুকের এ সব তেলের পুঁজি ক্রমশই একেবারে ফুরিয়ে যাবে। তখন উপায়? উপায় অনেক রকমই আছে মনে হয়। পারমাণবিক শক্তি থেকে শুরু করে সূর্যের তাপ পর্যন্ত অনেক কিছু ভবিষ্যতের ভরসা হতে পারে। কিন্তু তা, অপর্যাপ্ত শুধু নয়, সস্তা আর সহজে পাবার মতো হওয়া চাই। পৃথিবীর পয়লা নম্বর মহাজনি কারবারিরা তার চেয়েও যা বেশি চায়, তা হল যাকে বলে মৌরসি পাট্টা। দুনিয়ার জ্বালানির সমস্যা যা মেটাবে তা যেন গোনাগুনতি ক-জনের মাত্র দখলে। থাকে। নগদ লাভ ওরা বোঝে, কিন্তু শুধু সেই দিকে নজর দিয়েই কাজ করে না। ওরা অনেক দূর-ভবিষ্যতের ওপর চোখ রেখে খুঁটি সাজাতে জানে। ও সব দেশে তাই এস-এস-পি-এস অর্থাৎ স্যাটেলাইট সোলার পাওয়ার স্টেশন নিয়ে এক বিরাট কারবার ফাঁদা হয়েছে। এ কারবারে জোট বেঁধেছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর ধুরন্ধর টাকার কুমিরেরা।

সূর্যের তাপ পৃথিবীতে যা পাওয়া যায় তার চেয়ে মহাশূন্যে শুধু অনেক বেশি নয়, সারাক্ষণই পাওয়া যায়। মহাকাশে অসংখ্য সূর্যের তাপ ধরবার যন্ত্র-বসানো স্যাটেলাইট ঘুরিয়ে, তারই উৎপন্ন বিদ্যুৎশক্তি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বেতার অণু-তরঙ্গে পৃথিবীর কারবারিদের নিজস্ব সব অণু-তরঙ্গ-ধরা অ্যান্টেনা-গ্রিডের ঘাঁটিতে পাঠিয়ে, তা থেকেই সর্বত্র নিজেদের লাইনে পাঠাবার মতো হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করে এই কারবারিরা ভবিষ্যতের দুনিয়াকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখবার জন্য এস-এস-পি-এস নিয়ে এক বিরাট কোম্পানি গড়ে তুলছে। দু-চার বছর নয়, অমন বিশ পঞ্চাশ, এমনকী, একশো বছর এরা অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। এরা জানে, একদিন এদের কাছে পৃথিবীর সবাইকে হাত পাততে হবে। তাদের শুধু সাবধান থাকতে হবে যাতে তাদের এই ভাবী শক্তি-সাম্রাজ্যের একাধিপত্যে বাদ সাধবার মতো কোথাও কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না গোকুলে বাড়তে পারে।

একটু থেমে তার দিকে নালিশের আঙুল তুলে বললাম, আপনি সেই প্রতিদ্বন্দ্বী। কী এক আজগুবি ফন্দি খাটিয়ে আপনি ওদের এই একচ্ছত্র সাম্রাজ্য ধসিয়ে দিতে চান—আপনি—

না, না, অস্থিরভাবে আমার কথায় বাধা দিয়ে বললে দুবারি, আমি যা করতে চাইছি, তা সত্যিই আজগুবি কিছু নয়। আমি একা নয়, আমার সঙ্গে আমারই মতো আরও ক-জন এই কাজে নিজেদের উৎসর্গ করেছে। আমরা সাম্রাজ্য গড়তে চাই না। পৃথিবীর সকলের জন্যে নিতান্ত সস্তায় এমন অঢেল এনার্জির ব্যবস্থা করতে চাই, যা আকাশ-বাতাসকে কোথাও এতটুকু নোংরা করবে না। আমরা একাজে অনেক দূর এগিয়েছি, আর কিছুদিন নির্বিঘ্নে একট নিরিবিলিতে যদি কাজ করতে পারি, তা হলে আমাদের আবিষ্কারে উদ্ভাবনে পথিবী স্বর্গ হয়ে উঠবে। আমাদের আসল কাজটা যা নিয়ে তা এখনও কাউকে বলার উপায় নেই, তাই

বলার দরকার নেই, দ্যুব্যারিকে থামিয়ে বললাম, কী আপনাদের কাজ, তা আমি জানি।

জানেন? অবাক আর সেই সঙ্গে একটু হতভম্ব গলায় বললে দ্যুব্যারি, কিন্তু আমরা তো–

আপনাদের আসল কাজ আর উদ্দেশ্য ঘুণাক্ষরেও কোথাও প্রকাশ করেননি, এই তো? দ্যুব্যারির কথাটা তার হয়ে শেষ করে দিয়ে বললাম, তা না করলেও আপনারা কোথাও কোনও গোপনে একটা নতুন ধরনের রেডিয়ো-টেলিস্কোপ বসিয়েছেন, এই খবরটুকুই অল্পবিস্তর এখানে ওখানে ছড়িয়েছে। কেউ কেউ তার ওপর শুধু আর-একটু অনুমান করেছে যে অমন গোপনে চুপিচুপি কোথাও নতুন রেডিয়ো-টেলিস্কোপ বসানো নেহাত বাতুল খামখেয়াল নয়। আমি কিন্তু জানি যে, আপনাদের কাজকর্মগুলো খামখেয়াল না হলেও ছোট শিশুর চাঁদ ধরতে চাওয়ার চেয়ে কম আজগুবি বাতুলতা নয়।

আজগুবি বাতুলতা বলছেন আপনি? দুব্যারি রীতিমতো ক্ষুণ্ণ।

তা ছাড়া কী বলব? একটু হেসে বললাম, অবোধ শিশু আকাশের চাঁদ ধরতে চায়, আর আপনারা চাইছেন চাঁদ-সূর্য-তারা-টারা কিছু নয়, মহাশূন্যের একটা ঘেঁদা, একটা কালো ফুটো। সেই ফুটো দিয়েই দুনিয়ার সব এনার্জির সমস্যা আপনারা মিটিয়ে দেবেন। কয়লা, পেট্রোল কি পরমাণু শক্তির আর কোনও দরকারই থাকবে —এই তো আপনারা বলতে চান?

খানিক যেন ভোম মেরে চুপ করে থাকবার পর দুব্যারি ধীরে ধীরে বললে, কী করে আপনি এ সব জেনেছেন জানি না, কিন্তু সত্যিই এই কাজেই আমরা লেগে আছি। আকাশের একটা কালো ফুটো, এর মানে যদি সবাই বুঝত!

তার মুখ থেকে কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললাম, বৈজ্ঞানিকেরা নিজেরাই এখনও ভাল করে বোঝে কি? উনিশশো সত্তরে আফ্রিকার কিনিয়া থেকে উঁহুরু নামে উপগ্রহকে পথিবী প্রদক্ষিণে ছাড়ার তিন মাস বাদে, এক্স-রে-র উৎস ধরে সিগনাস তারামণ্ডলে পৃথিবী থেকে প্রায় আট হাজাব আলোকবর্ষ দূরের, আমাদের সূর্যের বিশগুণ বড়, এক জ্বলন্ত তারার বেতালা অয়নেই তার বিরাট সঙ্গী হিসেবে মহাশূন্যের প্রথম যথার্থ এক কালো ফুটোর হদিস মেলে। মহাশূন্যের সেই কালো ফুটো যে কী তা এখনও প্রায় বেশির ভাগই অঙ্ক দিয়ে হাতড়ানো অনুমান আর কল্পনা। মাধ্যাকর্ষণ এমন এক শক্তি, যা দূরত্বের বর্গ হিসেবে বাড়ে কমে। দূরত্ব দু-গুণ বাড়লে মাধ্যাকর্ষণ চারগুণ কমে যায়, আবার দূরত্ব তিন ভাগ কমলে তা ন-গুণ যায় বেড়ে। বিশ্বের বিরাট বিরাট রাক্ষুসে সব তারার তো বটেই, সব জ্বলন্ত নক্ষত্রই শেষ পর্যন্ত নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে কুঁকড়ে ছোট হতে হতে নিজের মধ্যেই এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে তলিয়ে যায় যে, একটা আলোর কিরণেরও ক্ষমতা থাকে না সেই চরম মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে বার হতে। জ্বলন্ত নক্ষত্রের সেই শেষ কবর মহাশূন্যের একটা কালো রাক্ষুসে ফুটো হয়ে থেকে যা নাগালের মধ্যে পায় তা শুধু গিলেই খায়। সে শুধু খায়, ওগরায় না কিছু। তার নাগালের মধ্যে পড়লে কোনও কিছুর নিস্তার নেই। সব কিছু সে টেনে নেবেই ফুটোর মধ্যে।

হ্যাঁ, ওই টেনে নেওয়ার ওপরই আমাদের সব ফন্দি খাটানো। দুব্যারি যেন আমার কথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে, মহাশূন্যের কালো ফুটো সম্পর্কে অন্যকিছু সঠিক জানা থাক বা না থাক, তা যে নাগালের মধ্যে যা পায়, অবিরাম নিজের গহ্বর কবরে তা টেনে নেয়, এ-বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। তা ছাড়া আর-একটা বিষয়ে বেশির ভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরই ধারণা যে, সমস্ত নিখিল ব্রহ্মাণ্ডে যেমন অসংখ্য ছায়াপথ নক্ষত্র আছে, তেমনই আছে অগুনতি কালো ফুটো। আমাদের নিজেদের এই ছায়াপথেই এমন অন্তত এক কোটি কালো ফুটো থাকা অসম্ভব নয়। সেসব ফুটো আবার বিরাট না হয়ে নেহাত ছোটও হতে পারে।

একটু থেমে দম নিয়ে দুব্যারি গর্বভরে বললে, তেমনই একটি কালো ফুটো আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি আমার রেডিয়ো-টেলিস্কোপে। সেটা সিগনাস এক্স-ওয়ান-এর মতো দূরও নয়, মাত্র দুই আড়াই আলোকবর্ষ দূরে। আর কিছু দিন নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারলে তার অবস্থানটা আমি একেবারে নির্ভুলভাবে ছকে ফেলতে পারব। তা হলেই কাম ফতে। ওই খুদে কালো ফুটোর চারধারে কুয়ো বাঁধিয়ে দেবার মতো একটা উপগ্রহের কায়েমি চাকতি হিসেব করে মাপজোখা দূরত্বে লাগিয়ে দিলেই, পাহাড়ি প্রপাতের জল পড়বার বেগ থেকে যেমন, কালো ফুটোর সর্বনাশা টান থেকে তার গলার চাকতিতে বসানো যন্ত্র দিয়ে তেমনই অফুরন্ত অগাধ এনার্জি পৃথিবীতে চিরকাল ধরে জোগান দেওয়া যাবে। আর কিছুদিন মাত্র বিনা উপদ্রবে নিরিবিলিতে কাজ করবার অবসরটুকু আমার দরকার। আমার রেডিয়ো-টেলিস্কোপ যে কোথায় কোন অজানা জায়গায় লুকোনো, তা এরা জানে না। আমায় শুধু মাঝে মাঝে কিছু দরকারি সাজসরঞ্জাম আর রসদের জন্য কোনও-না-কোনও বড় দেশের আধুনিক শহরে আসতে হয় বলে এবারে এদের নজরে আমি পড়ে গেছি। আমার কাজ শেষ করবার জন্য যেমন করে হোক এদের কাছ থেকে লুকিয়ে নিজের ঘাঁটিতে আমায় পালাতে হবে। সেই সুযোগটুকু শুধু আমি চাই।

দুদ্যুব্যারি আমাকেই যেন দেবতা বানিয়ে তার প্রার্থনা জানালে!

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তাই বলতে হল, সে সুযোগ তো আপনি পাবেন না, সিয়ে দ্যুব্যারি। যারা আপনার পেছনে লেগে আছে তারা আপনার ওই কালো ফুটো কবজা করবার ফন্দি নেহাত আজগুবি ঘোড়ার ডিম মনে করলেও সাবধানের মার নেই হিসেবে আপনাকে নিজের খুশি মতো পাগলামি করবার জন্যও ছেড়ে দেবে না। তাদের একজন হিসেবে আমি আপনার সামনেই আছি। তা ছাড়া এই হোটেলে আর তার বাইরে ক-জন যে এই শহরে আপনার ওপর নজর রাখবার জন্য আছে, তা আমিও জানি না। এদের হাত ছাড়িয়ে, এখন আর আপনি পালাতে পারবেন না।

এতক্ষণে হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়ে দুব্যারি বললে, তা হলে কী করতে চান এখন আমাকে নিয়ে?

আপনাকে আমি ধরিয়ে দেব। শক্ত হয়েই বললাম, তবে আপনার নিজের সম্মানের খাতিরে আর হোটেলের সুনামের জন্য সামনের কোনও লিফটে হোটেলের লবি দিয়ে আপনাকে নিয়ে যেতে চাই না। হোটেলের পেছনের দিকে দরকার মতো হোটেলের মালমাত্র তোলা আর নামানোর জন্য যে সার্ভিস লিফট আছে, তাই দিয়েই আপনাকে নিয়ে যাব। যাবার আগে শুধু দু-একটা কাজ সারবার আছে।

সেসব কাজ সেরে যখন দুব্যারিকে নিয়ে যাবার জন্য ডাকলাম, তখন সে যেভাবে বিনা প্রতিবাদে সোফা থেকে উঠে এল, তাতে মনে হল, সব আশা-ভরসা হারিয়ে সে একটা নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে গেছে। সোফায় এলিয়ে পড়ে থেকে আমি যে এতক্ষণ কী করেছি, তাও সে লক্ষ করেনি।

দুব্যারিকে যা বলেছিলাম, সেইমত পুলিশ-ঘাঁটিতে রেখে আসবার পর সামনের গেট দিয়েই হোটেলে ঢোকবার সময় বোরোত্রাকে প্রথম দেখলাম। তার নিজের চেহারা এমন যে, সামনে কোথাও পড়লে পাঁচশো জনের মধ্যেও লক্ষ না করে উপায় নেই, বিরাট বপু আর তার সেই জালার মতো বিশাল ভূঁড়িটির জন্য মানুষের চেয়ে। তাকে হিপোপটেমাসেরই স্বজাতি বলে মনে হয়। এর ওপর আর-একটি কারণে তাকে সব সময়ে আলাদা করে চেনা যাবে। তাকে কোথাও কখনও একলা দেখা যায় না। একটি নিত্যসঙ্গী তার সঙ্গে সব সময় থাকে।

সেদিনও সেই সঙ্গীটিকে কাছে নিয়েই সে বসেছে। জালার মতো ভুড়ি নিয়ে দৈত্যের মতো চেহারায় নিজে যে চেয়ারটাতে বসেছে, তার পাশের চেয়ারটিতেই রেখেছে তার পুঁচকে সেই নিত্যসঙ্গীটিকে।

লবি দিয়ে লিফটের দিকে যাবার পথে এরকম মানুষটাকে দেখে দু সেকেন্ডের বেশি মনোযোগ হয়তো দিতাম না। কিন্তু হঠাৎ ক-টা কথা কানে গিয়ে ছুঁচের মতো বেঁধায় লিফটের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েও ওপরে এখনই যাব কিনা ভাবতে হল।

তখনও অবশ্য লোকটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে পুঁচকে সঙ্গীর সঙ্গে তার কথাগুলো যে শুনেছি, তা আমি বুঝতে দিইনি। লিফটটা তখনও ভাগ্যক্রমে নামেনি। সেটার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মধ্যে আরও ক-টা কথা শুনে কান ঝাঁঝাঁ করার বদলে মজাই পেলাম।

জ্বলে ওঠার বদলে মজা পাওয়াটাই অবশ্য গোড়া থেকে উচিত ছিল। তবে তখন আচমকা ওই ধরনের কথাগুলো ওইভাবে আর ওই ভাষায় শুনে মেজাজটা একটু টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল ঠিকই।

লোকটার আর তার সঙ্গীর দিকে একবার নজর দিয়েই লিফটের দিকে যেতে যেতে একটা সরু পিনপিনে গলায় শুনেছিলাম এই শুঁটকো চামচিকেটাকেই খুঁজছিলি না? তার উত্তরে ভারী গলার কথা শোনা গেছল, হু। তা হলে চুপ করে বসে আছিস কেন?আবার সেই পিনপিনে ছুঁচলো গলায় শোনা গেল, ডাক না ছুঁচোটাকে! আর না যদি আসে, তবে দে মুরগির গলাটা মুচড়ে ছিঁড়ে। কথাগুলোর পরেই সেই পিনপিনে ছুঁচলো গলার হিহি করে বিদঘুটে হাসি। আর সেই ভারী গলায় আদরের ধমক, আরে চুপ চুপ, লোকে বুঝতে পারবে।

লবিতে ওদের কাছাকাছি যারা ছিল, তাদের অনেকেই তখন এই বাক্যালাপে হাসছে। তবে তার মানে বুঝে নয়। কারণ সে মানে বোঝা কারওর পক্ষে সম্ভব নয় এই জন্য যে, বাক্যালাপের ভাষাটা হল বাপৃথিবীর মধ্যে যা বিরলতম ভাষার একটি। লোকগুলো হাসছিল মিহি আর মোটা গলা দুটোর কথা বলাবলির ধরনে।

লিফটটা এতক্ষণে ওপর থেকে নামতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাকে আর তাতে উঠব কি উঠব না তা ঠিক করবার দ্বিধায় থাকতে হল না। লিফটের কাছে তখন আমিই একা দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পেছন থেকে ভারী গলায় ফরাসিতে অত্যন্ত ভদ্র বিনীত অনুরোধ শুনলাম—ও মশাই, লিফটের কাছে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে বলছি। দয়া করে আমাদের এ টেবিলে একট এসে আমাদের বাধিত করবেন? আমার শরীরটা বড় বেসামাল, নইলে আমিই এখনই উঠে যেতাম। কিছু মনে করবেন না।

কথাগুলো যতক্ষণ বলা হচ্ছে, তার মধ্যে লিফটের দরজার কাছ থেকে প্রথম যেন অবাক হয়ে, ঘাড় ফিরিয়ে কে আমায় ডাকছে দেখে আমি একটু যেন অবাক হয়ে ওই দুই মূর্তির টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

দৈত্যাকার মানুষটা তখন তার সঙ্গীটিকে বাঁ হাতের মুঠোয় তার চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করে বলছে, আমায় মাপ করবেন। একটু বিশেষ কারণে আপনাকে এমন করে বিরক্ত করলাম। আমার নাম বোরোত্ৰা, হ্যাঁ বোরোত্রা, আর এর নাম হল—

আমার নাম পিঁপিঁ। পিঁপিঁ। বোরোত্রার আগেই তার বাঁ হাতের মুঠোর পুঁচকে সঙ্গী যেন ছটফটিয়ে উঠে সরু খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠল, তারপর দাঁতে-দাঁত-চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে সেই বাক ভাষাতে বললে, ছুঁচোটা যেন আমায় না ছোঁয়।

যেন কিছুই বুঝতে পারিনি, এমনই মজা-পাওয়া মুখ করে আমি পিঁপিঁর একটা খুদে নরম হাত ধরে নাড়া দিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম, সেনর পিঁপিঁ। আমার নাম হল দাস। শুধু দাস।

পিঁপিঁ তখন কাছাকাছি সকলের হাসির মধ্যেই কঁকিয়ে উঠে চিৎকার করে আমায় গাল পাড়ছে ফরাসি ভাষাতেই। ছিঁড়ে গেছে নড়াটা আমার, ছিঁড়ে গেছে একেবারে! ওরে বাবা রে! মরে গেছি রে!

সেই সঙ্গে বাস্ক ভাষায় ফোড়নও চালাচ্ছে মাঝে মাঝে। যেমন—চিমসেটাকে, দে না নিংড়ে শেষ করে, কিংবা—ছারপোকাটাকে টিপে মার।

বাস্ক তো নয়ই, ফরাসিও কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, কাছাকাছি যারা ছিল, তারা পিঁপিঁর সেই সরু খ্যানখেনে গলার কাতরানি আর সেই সঙ্গে চুপ! চুপ বলে বোরোত্রার ভারী গলার ধমকে দারুণ মজা পেয়ে হাসি আর থামাতে পারেনি।

তাদের হাসির কারণ হল পিঁপিঁ। পিঁপিঁ একটা তুলো-ভরে-সেলাই করা পুঁচকে পুতুল। ভেন্ট্রিলোকুইস্টরা মুখ না নেড়ে তাদের ছদ্ম-গলার কথা যেন অন্য জায়গা থেকে বার করবার জন্য এই পুতুল ব্যবহার করে। এ পুতুলকে দিয়ে মজা করে অনেক উলটোপালটা খোঁচানো কথা বলানো যায়।

বোরোত্রা সব সময়ে এই পুতুল তার সঙ্গে রাখে। এ পুতুলকে দিয়ে যখন তখন যেখানে সেখানে বেয়াড়া কথা বলানো তার শুধু মজার খেলা নয়, এটা তার একটা রোগও। নিজের মনের কথাগুলো এইভাবে সে পেট থেকে বার না করে দিয়ে পারে না। কেউ যাতে কিছু বুঝতে না পারে সেই জন্যেই সে অবশ্য বাস্ক-এর মতো এমন একটা ভাষা ব্যবহার করে, যা দুনিয়ার কেউ জানে না বললেই হয়।

ঘনাদা থামলেন। তাঁর একটানা কাহিনী শোনার মধ্যে অবাক হয়ে আর একটা ব্যাপারও আমরা লক্ষ করেছি। এতক্ষণের মধ্যে ঘনাদা একবার একটা সিগারেটও খাননি। শিশির অবশ্য মেজাজ খারাপ থাকার দরুন ইচ্ছে করেই নিজে থেকে তাঁকে সিগারেট এগিয়ে দেবার চেষ্টা করেনি। কিন্তু ঘনাদার তো ভালমানুষের মতো তা মেনে নিয়ে চুপ করে থাকার কথা নয়।

এখন এতক্ষণের অন্যায়টা শোধরাবার জন্য শিশির যখন পকেটে হাত দিতে যাচ্ছে, ঘনাদা তখন নিজের পকেট থেকেই সিগারেটের একটা প্যাকেট বার করে

আমাদের চমকে দিলেন।

সে আবার যেমন-তেমন সিগারেট নয়। প্যাকেটের এক কোণ ছিঁড়ে তা থেকে একটা সিগারেট অবহেলাভরে বার করার সময় খানদানি গন্ধটাই শুধু নাকে গেল না, প্যাকেটের ওপর ছাপা ব্র্যান্ডের নামটা পড়েও চোখ কপালে ওঠবার জোগাড়।

বিদেশি একেবারে পয়লা নম্বরের একটা সিগারেট। ঘনাদা এয়ারপোর্ট হোটেলেই কিনেছেন নিশ্চয়।

এখন সেটা ধরাবার জন্য শিশিরের দেশলাইকাঠি জ্বালবারও অপেক্ষা করলেন। নিজেই আর এক পকেট থেকে এক বিদেশি দেশলাইয়ের খাপ বার করে তার কাঠি খুলে জ্বেলে সিগারেট ধরালেন।