০১-০৫. আজাহেরের কাহিনী

বোবাকাহিনী – উপন্যাস – জসীম উদদীন

উৎসর্গ

ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজী সাহিত্যের প্রধান পরিচালক অধ্যাপক নূরউদ্দীন আহম্মদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। আমার আদরের ছোট ভাই নূরু! গত ১লা জুলাই তোমাকে কবরের ঘরে শোয়াইয়া আসিলাম। তুমি দেশের জনগণকে ভালবাসিতে। অধ্যাপক হইয়াও তুমি নিজ হাতে কৃষিকাজ করিয়া দেশের মজলুম জনগণের সঙ্গে একত্র হইতে প্রয়াস পাইয়াছ। তাই আমার এই বোবা কাহিনী তোমারই উদ্দেশে উৎসর্গ করিলাম।

তোমার মেঝোভাই
১০ নং কবি জসীমউদ্দীন রোড
পলাশ বাড়ি
কমলাপুর, ঢাকা-১৪
১-৮-৬৪

.

০১.

আজাহেরের কাহিনী কে শুনিবে?

কবে কোন্ চাষার ঘরে তার জন্ম হইয়াছিল, কেবা তার মাতা ছিল, কেবা তার পিতা ছিল, সে কথা আজাহের নিজেও জানে না। তার জীবনের অতীতের দিকে যতদূর সে চাহে, শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের এক কোণে আধো আলো আধো ছায়া এক নারী-মূর্তি তার নয়নে উদয় হয়। তার সঙ্গে আজাহেরের কি সম্পর্ক তাহা সে ভাল করিয়া বুঝিতে পারে না কিন্তু সেই নারী-মূর্তিটি বড়ই করুণ, বড়ই মমতাময়ী। তার কথা ভাবিতে আজাহেরের বড়ই ভাল লাগে। তার মনে বলে সেই করুণ নারী-মূর্তিটি অবলম্বন করিয়া সে যেন অনেক স্নেহের,অনেক মমতার সম্পর্ক পাতাইতে পারে। কিন্তু দিন উপার্জন করিয়া যাহাকে পেটের অন্ন জোগাইতে হয়, এ সব ভাবিবার অবসর তার কোথায়? সংসারে নানা কাজের নিষ্পেষণে সেই নারী-মূর্তিটি কোন্ অনন্ত অন্ধকারে মিলাইয়া যায়।

গ্রামের ফকির সারিন্দা বাজাইয়া গান করে :

নাইকা মাতা, নাইকা পিতা, নাইকা সোদ্দের ভাই,
সেঁতের শেহলা হয়া ভাসিয়া বেড়াই।

তেমনই স্রোতের শেহলার মত সে ভাসিয়া আসিয়াছে। এক ঘাট হইতে আর এক ঘাটে, এক নদী হইতে আর এক নদীতে। যতদূর তার মনে পড়ে সে কেবলই জানে, এর বাড়ি হইতে ওর বাড়িতে সে আসিয়াছে; ওর বাড়ি হইতে আর একজনের বাড়িতে সে গিয়াছে। কেহ তাহাকে আদর করিয়াছে–কেহ তাহাকে অনাদর করিয়াছে, কিন্তু সবাই তাহাকে ঠকাইয়াছে। খেত-খামারের কাজ করাইয়া, গরু বাছুরের তদারক করাইয়া মনের ইচ্ছামত সবাই তাহাকে খাটাইয়া লইয়াছে। সে যখন বেতন চাহিয়াছে তখন গলাধাক্কা দিয়া বাড়ির বাহির করিয়া দিয়াছে।

এমনি করিয়া নানা লোকের কাছে ঠকিতে ঠকিতে এখন তার বয়স পঁচিশের কোঠায়। আর সে কাহারো কাছে ঠকিবে না। নিজের বেতন ভালমত চুকাইয়া না লইয়া সে কারো বাড়িতে কাজ করিবে না–কিছুতেই না। এই তার প্রতিজ্ঞা।

কিন্তু নিজের বেতন চুকাইয়া লইয়া সে কি করিবে? তার মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, ছোট একটি বোনও নাই। বেতনের টাকা লইয়া সে কার হাতে দিবে?

সবারই বাড়ি আছে–ঘর আছে। ঘরে বউ আছে। আচ্ছা এমন হইতে পারে না? মাঠটির মাঝখান দিয়া পথটি চলিয়া গিয়াছে–সেই পথের শেষে, ওই যে গ্রামখানা, তারই এক কোণে ছোট্ট একখানা ঘর,নল-খাগড়ার বেড়া। চার ধারের মাঠে সরিষার ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে–সেই ছোট্ট ঘরখানিতে ঘোমটা পরা একটি বউ। ভাবিতে আজাহেরের মুখখানা লজ্জায় রাঙা হইয়া যায়। ঘোমটা পরা একটি বউ, না-ফর্সা, না-কালো, না-সুন্দর, না-কুৎসিত। এ সকল সে চিন্তাও করে না। একটি বউ–সমস্ত সংসারে যে শুধু তাকেই আপন বলিয়া জানে। বিপদে আপদে যে শুধু তাকেই আশ্রয়দাতা বলিয়া মনে করে; এমনই একটি বউ যদি তার হয়! ভাবিতে ভাবিতে তার দেহ-মন উৎসাহে ভরিয়া উঠে। যেমন করিয়াই হোক সে তিনকুড়ি টাকা জোগাড় করিবেই। টাকা জোগাড় হইলেই সে মিনাজদী মাতব্বরের বাড়ি যাইবে। মাতব্বর টাকা দেখিলেই তার একটি বিবাহের। বন্দোবস্ত করিয়া দিবে। তিনকুড়ি টাকার আড়াই কুড়ি টাকা সে ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছে, আর দশ টাকা হইলেই তিনকুড়ি টাকা হয়।

গ্রামের চাষীদের যখন কাজের বাড়াবাড়ি তখন তাহারা বেতন দিয়া পৈড়াত বা জন খাটায়। আজাহের এইরূপ পৈড়াত বেচিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। সারাদিন গৃহস্থ বাড়ি কাজ করে, তাহাতে চার আনা করিয়া সে পায়। এমনই করিয়া যদি তাহার উপার্জন চলে তাহা হইলে আর চল্লিশ দিন পরে তাহার হাতে দশ টাকা হইবে। আড়াইকুড়ি আর দশ,–তিনকুড়ি। কিন্তু আরও চল্লিশ দিন পরে–আরও একমাস দশদিন পরে–সে কত দূর? দুই হাতে টানিয়া টানিয়া সে যদি দিনগুলিকে আরও আগাইয়া আনিতে পারিত?

সারারাত জাগিয়া জাগিয়া আজাহের পাটের দড়ি পাকায়। বাঁশের কঞ্চি দিয়া ঝুড়ি তৈয়ার করে। এ সব বিক্রি করিয়া সে যদি আরও চার পাঁচ টাকা বেশী জমাইতে পারে; তবে মাতব্বরের নির্দিষ্ট তিনকুড়ি টাকা জমাইতে তাহার আরো কয়েকদিন কম সময় লাগিবে।

আজাহের দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে। কাজকর্মের মধ্যে যখন একটু ফুরসৎ পায়–সামনের তাঁতীপাড়ার রহিমদ্দী কারিকরের বাড়িতে যাইয়া সে বসে। লাল, হলুদ, নীল, কত রঙের শাড়ীই না কারিকরেরা বুনাইয়া চলিয়াছে। কোথাও গাছের গোড়ার সঙ্গে নানা রঙের তেনা বাধিয়া মাজন দিতেছে। ফজরের রঙীন মেঘ আনিয়া এখানে কে যেন মেলিয়া ধরিয়াছে। বেহেস্ত হইতে লাল মোরগেরা যেন এখানে আসিয়া পাখা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। চাষার ছেলে আজাহের–সে অত শত ভাবিতে পারে না। শাড়ীগুলির দিকে সে চাহিয়া থাকে–আর মনে মনে ভাবে এর কোন্ শাড়ীখানা তার বউকে মানাইবে ভাল। মনে মনে ভাবিতে ভাবিতে তার মনটি শাড়ীরই মত রাঙা হইয়া ওঠে।

রহিমদ্দী কারিকর তার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করে, “আরে কি মনে কইরা, আজাহের? বইস, বইস। তামুক খাও।”

ঘরের বেড়ার সঙ্গে লটকান কোটি লইয়া কলিকার উপরে ফুঁ দিয়া প্রথমে আজাহের কলিকার ছাইগুলি উড়াইয়া দেয়। তারপর কলিকার গুলটুকু ভাল জায়গায় ঢালিয়া রাখিয়া কলিকার মধ্যে খানিকটা তামাক ভরিয়া অতি সন্তর্পণে সেই গুলটুকু নিপুণ হস্তে তাহার উপর সাজাইয়া দেয়, যেন এতটুকুও নষ্ট না হইতে পারে। তাহার উপরে সুন্দর করিয়া আগুন ধরাইয়া রহিমদ্দী কারিকরের দিকে কোটি বাড়াইয়া ধরে।

কারিকর বলে–”আরে না, না, তুমি আগে টাইনা ধূমা বাইর কর।”

কারিকর যে তাকে এতটা খাতির করিয়াছে, আগে তাকে তামাক টানিতে বলিয়াছে এ যে কত বড় সম্মান! আজাহেরের সমস্ত অন্তর গলিয়া যায়। সে রহিমদ্দীর দিকে কোটি আরও বাড়াইয়া বলে, “কারিকরের পো, তা কি অয়? মুরব্বি মানুষ। তুমি আগে টাইনা দাও।”

খুশী হইয়া কারিকর হুঁকোটি হাতে লইয়া টানিতে আরম্ভ করে, তার তত চলা বন্ধ হয়। তামাক টানিতে টানিতে রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে, “তা কি মনে কইরা আজাহের?”

যে কথা মনে করিয়া সে আসিয়াছিল লজ্জায় সে কথা আজাহের কিছুতেই বলিতে পারে না। অন্য কথা পাড়ে, “তা চাচা, একটা গীদ-টীদ গাও না শুনি? অনেক দিন গীদ শুনি না, তাই তুমার কাছে আইলাম।”

রহিমদ্দী খুশী হয়। তার গান শোনার জন্য ওই ও-পাড়া হইতে একজন এ-পাড়ায় আসিয়াছে, একি কম সম্মানের কথা! থাক না হয় আজ তাঁতের কাজ বন্ধ। রহিমদ্দী গান আরম্ভ করে। আমির সাধুর সারিন্দার গান। নদীর ঘাটে স্নানে যাইতে আমির সাধুর বউ বেলোয়া-সুন্দরীকে মগ জলদস্যুরা ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। পাগলের বেশে আমির সাধু তার সন্ধান করিয়া দেশে দেশে ফিরিতেছে। আমির সাধু সারিন্দা বানাইল–ছাইতানের কাঠ, নীলা ঘোড়ার বাগ। অপূর্ব সারিন্দা। নীলা ঘোড়ার বাগ বাকাইয়া সে সুর ধরিল?

“প্রথমে বাজিলরে সারিন্দা আমির সাধুর নামরে;
হারে তারিয়া নারে।”

আমির সাধু সেই সারিন্দা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। আবার সে নতুন করিয়া সারিন্দা গড়িয়া তাহাতে সুর দিল ।

“তারপর বাজিলরে সারিন্দা–দেশের রাজার নামরে;
হারে তারিয়া নারে।”

তবু সেই সারিন্দা ও আমির সাধু ভাঙ্গিয়া ফেলিল। এবার আরো সুন্দর করিয়া অতি নিপুণ হস্তে ধনষ্টরী পাখির হাড় তাহাতে বসাইয়া, নীলা ঘোড়ার বাগ আরো বাঁকাইয়া সেই সারিন্দায় আবার সুর ধরিল। হেলিয়া দুলিয়া সারিন্দা বাজিয়া উঠিল,

“তারপর বাজিলরে সারিন্দা বেলোয়া সুন্দরীরে!
হারে তারিয়া নারে।”

এবার আমির সাধু খুশী হইল। সেই সারিন্দা বাজাইয়া আমির সাধু নদীর কিনারা দিয়া চলে। এ-দেশে সে-দেশে নানান দেশে সে ঘুরিয়া বেড়ায়। তার হাতের সারিন্দা গুমরিয়া গুমরিয়া কাঁদিয়া উঠে,–

“আজ কোথায় রইল আমার বেলোয়া সুন্দরীরে–”

গানের পর গান চলিতে থাকে। দুপুরের বেলা গড়াইয়া পড়ে। স্নানের বেলা যায়। তবু তাদের নেশা থামে না। আজাহের মনে মনে ভাবে সে নিজেই যেন আমির সাধু, তার সেই অনাগত বউ-এর খোঁজে সে যেন এমনি করিয়া সারিন্দা বাজাইয়া বাজাইয়া ফিরিতেছে।

রহিমদ্দীর বউ ঘরের আড়াল হইতে কয়, “বলি আমাগো বাড়ির উনি কি আইজ দিন ভইরা গীদই গাবি নাকি? ওদিক যে বাত জুড়ায়া গ্যালো!”

রহিমদ্দী তাড়াতাড়ি স্নান করিতে রওয়ানা হয়। স্নানের ঘাট পর্যন্ত আজাহের তার সঙ্গে সঙ্গে যায়। কিছুতেই কথাটা সে ভালমত করিয়া গুছাইয়া বলিতে পারে না। কোথাকার লজ্জা আসিয়া সমস্ত মুখখানা চাপিয়া ধরে। রহিমদ্দী পিছন ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করে, “কিরে আজাহের, আর কুনু কতা আছে নাকি?”

আজাহের বলে,–“তুমি যে ওই লালে আর নীলে মিশায়া একখানা শাড়ী বুনাইছাও না? পাইড়ে দিছাও সোনালী সূতা, ওখানার দাম কতো?”

“তা তুই কাপড় দ্যা করবি কি? বিয়া ত করিস নাই?”

লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়াই আজাহের বলে, “বিয়া ত একদিন করবই।”

রহিমদ্দী হাসিয়া উত্তর করে, “তা যহন তোর বিয়া অবি, কাপড় নিয়া যাইস। তোর কাপড়ের দামে আট আনা কম নিব।” কৃতজ্ঞতায় আজাহেরের সমস্ত অন্তর ভরিয়া ওঠে।

রহিমদ্দী স্নান করিতে নদীতে নামে। তাঁতীপাড়া এখন নিস্তব্ধ। তাঁতীরা কেহ স্নান করিতে গিয়াছে, কেহ স্নান করিয়া কাঠের চিরুণী দিয়া মাথা আঁচড়াইতেছে। কেহ খাইতে বসিয়াছে। বাড়ির বাহিরে রঙ বেরঙের কাপড় মাড় লাগাইয়া গাছের ডালে বাধিয়া রৌদ্রে শুখাইতে দেওয়া হইয়াছে।

আজাহের কাপড়গুলির পানে চায়, আর মনে মনে চিন্তা করে, কোন্ কাপড়খানা তার বউকে মানাইবে ভাল। তার বউ যদি ফর্সা হয়, একেবারে সরষে ফুলের মতো ফর্সা, তবে ওই নীলের উপর হলুদের ডোরাকাটা শাড়ীখানা সে তার জন্য কিনিয়া লইবে। কিন্তু বউ যদি তার কালো হয়, তা হোক, ওই যে কালোর ওপর লাল আর আছা হলুদের। ফুল-কাটা পাড়ের শাড়ীখানা, ওইখানা নিশ্চয় তার বউকে মানাবে ভাল। আচ্ছা, বরান খার মেয়ে আসমানীর মত পাতলা ছিপছিপে যদি তার গায়ের গড়ন হয়, তবে ওই যে পাড়ের উপর কলমীফুল আঁকা শাড়ীখানা, ওইখানা তার বউ-এর জন্য কিনিলে হয় না? কিন্তু তার বউ যদি দেখিতে খারাপ হয়? তা যেমন কেন হোক না, তাঁতীপাড়ার সব চাইতে সুন্দর শাড়ীখানা সে তার বউ এর জন্য কিনিয়া লইবে। একটা বউ তার হইলেই হয়। রাঙা শাড়ীর ঘোমটার আড়ালে সে তার মুখখানা ঢাকিয়া বাড়ির উঠানে ঘুরিবে ফিরিবে। কি মজাই না হইবে! শিস দিয়া গান গাহিতে গাহিতে আজাহের তাঁতীপাড়া ছাড়িয়া চাষীপাড়ার দিকে যায়।

.

০২.

সত্য সত্যই আজাহেরের বিবাহ স্থির হইয়া গেল। বউঘাটা ছাড়িয়া গাছবাইড়ার চক। তাহারই দক্ষিণে ভাটপাড়া গ্রামে আলিমদ্দীর মেয়ের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইবে। গ্রামের মোড়ল তিনকুড়ি টাকাতেই বিবাহের খরচ সারিয়া দিবে। কিন্তু তিনকুড়ি টাকাতেই বিবাহের সমস্ত খরচ কুলাইয়া উঠিল না। আলিপুর গ্রামের শরৎ সাহার বাড়ি হইতে আজাহেরকে আরো পনর টাকা কর্জ করিতে হইল। টাকা প্রতি মাসে মাত্র এক আনা করিয়া সুদ দিতে হইবে। তা হোক; শরীর যদি ভালো থাকে আজাহের পৈড়াত বেচিয়া দুই মাসের মধ্যেই। দেনাটা শোধ করিয়া দিবে।

গরীবের বিবাহ–তবু গরীবানা মতে তাহারই মধ্যে যতটা আনন্দ করা যায় কেউ সে। বিষয়ে কম করিল না। মেনাজদ্দী মাতব্বরের উৎসাহই এ বিষয়ে সকলের চাইতে বেশী। সে ফরিদপুরের খলিফাপট্টী হইতে তাহার জন্য লাল ফোঁটা দেওয়া একটি পিরান (জামা)। কিনিয়া আনিল। নিজের যে চাদরখানা একদিন তেলে ও ঘামে সিক্ত হইয়া নানা দরবারের সাক্ষ্য হইয়া তাহার কাঁধের উপর ঘুরিয়া বিরাজ করিত, তাহা সে আজ বেশ সুন্দর করিয়া পাকাইয়া পাগড়ীর মত করিয়া আজাহেরের মাথায় পরাইয়া দিল। একজোড়া বার্নিশ জুতাও। মোড়ল আজাহেরের জন্য সংগ্রহ করিল। এ সব পরিয়া নতুন “নওশা” সাজিয়া আজাহের বিবাহ করিতে রওয়ানা হইল। তখন তাহার ইচ্ছা হইল এই নতুন পোশাকে সে একবার। সমস্ত গ্রামখানি ঘুরিয়া আসে। গাঁয়ের লোকদের সে অবাক করিয়া দিয়া আসে। সবার। বাড়িতে যে এতদিন পৈড়াত বেচিয়া আসিয়াছে, সে অতটা তুচ্ছ নয়। কিন্তু তখন রাত অনেকটা হইয়াছে। তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে। বউঘাটা ছাড়াইয়া গাছবাইড়ার মাঠ পারাইয়া। যাইতে হইবে, সে ত সোজা কথা নয়।

অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া পাঁচ ছয়জন গাঁয়ের লোক বর লইয়া রওয়ানা হইল। যেমন ভাবে গাঁয়ের আরো দশজন বিবাহে রওয়ানা হয় আজাহেরের বিবাহে তেমন জাঁকজমক কিছুই ছিল না। গাঁয়ের বর্ধিষ্ণু পরিবারের ছেলেরা নতুন নওশার সাজ পরিয়া পাল্কিতে অথবা ঘোড়ায় চড়িয়া কনের বাড়িতে যায়। মশালচি আগে আগে মশাল জ্বালাইয়া পথ রোশনাই করে। গ্রামের মালাকর বরের জন্য শোলা দিয়া সুন্দর কারুকার্য খচিত একটি ছাতা তৈয়ার করিয়া দেয়। সেই ছাতা বরের মাথায় মেলিলে সুন্দর সুন্দর শোলার পাখি, নৌকা, ভ্রমর, প্রজাপতিগুলি বাতাসে দুলিতে থাকে। আজাহেরের বিবাহে এত সব : বন্দোবস্ত কিছুই হয় নাই। তবু আজাহেরের মন আজ খুশীতে যেন আসমানে উড়িয়া। বেড়াইতে চাহে। নিজের মনের খুশী দিয়াই সে তার বিবাহের সকল দৈন্য ভরাইয়া লইবে।

নওশার দল রওয়ানা হইল। নিস্তদ্ধ গ্রাম্য-পথ। দু’ধারে ঝি ঝি পোকা ডাকিতেছে। গ্রামের কুকুরগুলি ঘেউঘেউ করিয়া তাহাদের অভ্যর্থনা জানাইতেছে। দূরের বন হইতে শিয়ালগুলি ডাকিয়া উঠিতেছে। নওশার দল ধীরে ধীরে চলিয়া যায়। গ্রামের পর গ্রাম ছাড়াইয়া যায়।

বউঘাটা পার হইয়া তাহারা গাছবাইড়ার মাঠে আসিয়া পড়িল। সদ্য কেনা বার্নিশ জুতাজোড়া পায়ে লাগাইয়া চলিতে আজাহেরের পা ছুলিয়া যাইতেছিল। তবু সে জুতাজোড়া খুলিল না। এমনি নওশার সাজে, এমনই জুতা-জামা পরিয়া সে তাহার কনের বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইবে। তাহার সমস্ত অন্তর ভরিয়া খুশীর ঋঝর যেন আজ বাজিয়া ঝুম ঝুম করিয়া আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া পড়িতেছে।

যাইতে যাইতে তাহারা কনের বাড়ির কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন বরযাত্রীর দল সকলে একস্থানে দাঁড়াইল। সবাই ভালমত করিয়া কাপড়-চোপড় পরিতে লাগিল। দশ বার বৎসর আগে মোড়ল সেই কবে এক জোড়া জুতা কিনিয়া রাখিয়াছিল–সে কথা আজ। ভাল করিয়া মনেও পড়ে না,–কিন্তু জুতাজোড়ার রঙ সেই প্রথম কেনার দিনের মত। আজো চকচক করিতেছে। এতদিনে রৌদ্রে জুতাজোড়া খড়ির মত শুখাইয়া কোচকাইয়া গিয়াছে। এমনই কোন বিশেষ দিনে কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাইতে মোড়ল অল্প কয়েক মিনিটের জন্য সেই জুতাজোড়া পরিধান করিয়া থাকে। অর্থাৎ আত্মীয় বাড়ির। কাছে যাইয়া জুতাজোড়া পায়ে দেয় এবং সে বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই জুতাজোড়া পা হইতে খুলিয়া ঘরের চালের সঙ্গে লটকাইয়া রাখে। ফেরার পথে জুতাজোড়া হাতে করিয়াই ফেরে। আজো মোড়ল জুতাজোড়া হাতে করিয়াই আনিয়াছিল। এখন বিবাহ-বাড়ির নিকটে আসিয়া জুতাজোড়া কাঁধের গামছা দিয়া মুছিয়া তাহার মধ্যে অবাধ্য পা দুটি ঢুকাইয়া দিল। এই কার্যটি করিতে বলিষ্ঠ-দেহ মোড়লকেও সেই জুতাজোড়ার সঙ্গে প্রায় পনর মিনিট যুদ্ধ করিতে হইল।

আজাহের তার রঙীন গামছাখানি অর্ধেকটা বুকপকেটে পুরিয়া দিল, বাকি অর্ধেক কাঁধের উপর ঝুলিতে লাগিল।

লোকে বলে,–”যেইনা বিয়া তার আবার চিতারি বাজনা।” কনের বাড়ির সামনের পথে গ্রামের ছেলেরা কলাগাছ পুঁতিয়া গেট বানাইয়াছে। সেই গেটের সামনে দারোয়ান হইয়া কলাপাতার টোপর মাথায় দিয়া কাঁধে গোড়ালী-লাঠি লইয়া তাহারা দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের দেখিয়া আজাহেরের গা কাঁপিতে লাগিল। মোড়ল কিন্তু কোনই ভয় করিল না। সে দলের আগে যাইয়া দাঁড়াইল। বরযাত্রীর দল আস্তে আস্তে বলাবলি করিল–”তোরা। কেউ কথা কবি না। যা কয় আমাগো মোড়ল কবি।”

মোড়ল এমনই করিয়া সকলের আগে যাইয়া দাঁড়াইল; দেখিয়া আজাহেরের মন মোড়লের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে একেবারে ভরিয়া গেল। আজীবন তার বাড়িতে বিনা। বেতনে খাঁটিলেও বুঝি ইহার শোধ হইবে না।

মোড়ল সকলের আগে যাইয়া বলিল, “বুলি, তুমরা দারোয়ানী দরছাও ক্যান?”

ছেলেরা সমস্বরে উত্তর করিল, “বিবির হুকুম আছে, কেউরে দরজার মদ্দি যাইতে দিব । তবে যদি বাদশা আমাগো কিছু বকশিশ দ্যান তয় আমরা যাইতে দিতি পারি!”

মোড়ল বলিল, “কত বকশিশ চাও?”

তারা উত্তর করিল, “দশ টাহা।”

মোড়ল উত্তর করিল, “আরে বাপুরা ছাইড়া দাও। গরীব মানুষির বিয়া, কিছু কমটম কর।”

“আচ্ছা তয় পাঁচ টাহা।”

“আরে না, অত দিবার পারবনা।”

“তবে এক টাকা দেন।”

“আরো কম কর।”

“তবে আট আনা।”

“আরে গরীব মানষির বিয়া, আরো কিছু কমাও। মোটে চাইর আনা দিমু।”

ছেলের দল তাহাতেই খুশী হইয়া দরজা ছাড়িয়া দিল। আজাহেরের কিন্তু ভাল লাগিল না। কথায় বলে,–বিবাহের দিনে সকলেই আড়াই দিনের বাদশাই করে। আজ তার বাদশাইর দিন। না হয় মোড়ল আরো চার আনা ধরিয়া দিত। জন খাঁটিয়া ত খাইতে হয়ই। না হয় আজাহের আরো একদিন বেশী খাঁটিয়া সেই ঋণ পরিশোধ করিত। ছেলেদের কাছে। এতটা গরীব সাজা মোড়লের উচিত হয় নাই।

আজাহেরের শ্বশুরের নাম আলিমদ্দী। সে বড়ই গরীব। বাড়িতে কাছারী ঘর নাই। গোয়াল ঘরখানা পরিষ্কার করিয়া গোটা কতক খেজুর পাতার পাটি বিছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহাতেই বরযাত্রীর দলটিকে অতি আদরের সহিত আনিয়া বসান হইল। আজাহেরের বড়ই ভাল লাগিল। আজ বিবাহ বাড়ির সকলেরই দৃষ্টি তাহার দিকে। বরযাত্রীর দলের সবার চাইতে সে বেশী আদর পাইতেছে। খাইবার সময় তারই পাতে সব চাইতে ভাল ভাল জিনিসগুলি পড়িতেছে। গাঁয়ের মাত্র পাঁচজন লোক সে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। সবাই যদি আসিত, আজ দেখিয়া যাইত, আজাহের একেবারে কেউকেটা নয়। তাকেও লোকে খাতির করে।

বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়া সারা হইল। এবার বিবাহ পড়ানোর পালা। ভাটপাড়া গ্রামের বচন মোল্লাকে ডাকিয়া আনা হইয়াছে বিবাহ পড়াইতে। সাক্ষী উকিল ঠিক করিয়া বাড়ির ভিতর পাঠান হইল। উকিল যাইয়া জিজ্ঞাসা করিবে কনের কাছে, “অমুক গ্রামের অমুকের ছেলে অমুক, তার সঙ্গে তোমার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়–একশত পঁচাত্তর টাকা বাকি; এই শর্তে কবুল ত?” তিনবার এইভাবে কনেকে জিজ্ঞাসা করা হইবে। উহার উত্তরে কনে কি বলে তাহা জানিয়া দুইজন সাক্ষী বিবাহ সভায় সকলকে তাহা জানাইয়া দিবে। কিন্তু সাক্ষী উকিলেরা মজা করিবার জন্য বাড়ির মধ্যে কনের কাছে না যাইয়া বাহির হইতে একটু ঘুরিয়া বিবাহ সভায় আসিয়া বলিল, “কনে এই বিবাহে রাজি অয় নাই।”

বচন মোল্লা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন রাজি অয় নাই।”

“কনের একটি কতা জিগাইবার আছে।”

“কি কতা জিগাইবার আছে?”

“বচ্ছরকে দুইটা পাখি আসে। তার একটা সাদা আর একটা কালা। আপনারা কালাডা খাইবেন না ধলাডা খাইবেন। কোনভা আপনাগো জন্যি আনবো?”

শুনিয়া আজাহেরের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে গরীব মানুষ, কারো বিবাহে কোন দিন যায়। নাই–গেলে সহজেই বুঝিতে পারিত এমনই প্রশ্নের বাদ-প্রতিবাদ প্রত্যেক বিবাহেই হইয়া থাকে। আজাহের ভাবিল এইবারই বুঝি তার বিবাহ ভাঙ্গিয়া গেল। এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারিবে না, বিবাহও হইবে না। মোড়ল কিন্তু একটুও দমিল না। সে সামনে আগাইয়া আসিয়া একটু হাসিয়া উত্তর করিল, “মিঞারা, বুঝতি পারলাম ঠকাইবার চাও। বচ্ছরকে দুইডা পাখি আসে রোজার মাসে, কালা পাখি ঐল রাইত আর ধলা পাখি ঐল দিন। তা আমি কালা পাখিই খাইলাম। রোজার মাসে ত কালা রাত্তিরেই ভাত খাইতে হয়।”

“পারছেরে, পারছে” বলিয়া কনে পক্ষের লোকেরা হাসিয়া উঠিল। এইবার মোড়ল গায়ের চাদরখানা মাজার সঙ্গে জড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা মিঞারা! আপনাগো কতার জবাব আপনারা পাইলেন। এইবার আমি একটা কতা জিজ্ঞাস কইরা দেহি :

“মাইটা হাতুন কাঠের গাই–
বছর বছর দুয়ায়া খাই।”

কওত মিঞারা ইয়ার মানে কি?”

কনে পক্ষের সাক্ষী উকিলদের মাথা ঘুরিয়া গেল। বর পক্ষের মাতব্বর যে এমন পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া বসিবে ইহা তাহারা ভাবিতেই পারে নাই।

তাহাদিগকে মুখ কাচুমাচু করিতে দেখিয়া বর পক্ষের লোকদের মুখে ঈষৎ বাঁকা হাসি ফুটিয়া উঠিল।

কনে পক্ষের মোড়ল বরান খ তখন উঠিয়া দাঁড়াইল চীৎকার করিয়া উঠিল –”আরে খার বিটা! পুলাপানের কাছে ওসব কথা জিজ্ঞাসা করেন ক্যান? আমার কাছে আসেন।

মাইটা হাতুন কাঠের গাই,
বছর বছর দুয়ায়া খাই।

মানে খেজুর গাছ। এক বছর পরে খাজুইর গাছ কাটা হয়। মাটির হাঁড়ী গাছের আগায় বাইন্দা রস ধরা হয়, কি মাতব্বর সাব! ওইল? সেই জন্য কইছে বছর বছর দুয়ায়া খাই। আচ্ছা এইবার আমি একটা কতা জিজ্ঞাসা করি,–

নয় মন গোদা, নয় মন গুদি,
নয় মন তার ছাওয়াল দুটি।

নদী পার অইব। কিন্তুক নৌকায় নয় মনের বেশী মাল ধরে না। কেমন কইরা পার অবি? কন ত দেহি সোনার চানরা।”

মোড়ল এবার লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,–”তবে শোনেন, পেরতমে দুই ছাওয়াল পার হ’য়া ওপারে যাবি। এক ছাওয়াল ওপারে থাকপি, আর এক ছাওয়াল নাও বায়া এপারে আসপি। তারপর গোদা নৌকা বায়া ওপারে যাবি। গোদার যে ছাওয়াল ওপারে রইছে সে নৌকা বায়া এপারে আসপি। আইসা দুই ভাই আবার ওপারে যাবি। ওপার ত্যা এক ভাই নৌকা লয়া এপারে আসপি। এবার গোদার বউ নৌকা লয়া যাবি। ছাওয়ালডা এপারেই থাকপি। ওপার যে ছাওয়ালডা রইছে সে নৌকা নিয়া আইসা এপার ত্যা তার বাইরে লয়া যাবি। ওইল ত? আচ্ছা, আমি জিজ্ঞাসা করি আবার।”

এবার কনের বাপ আসিয়া বলিল, “রাহেন মাতব্বরসাবরা, আপনারা কেউ কারো চাইতে কম না। এ তো আমরা সগলেই জানি। এবার বিয়ার জোগাড় কইরা দেন। হগল মানুষ বইসা আছে।” এ কথায় দুই মাতব্বরই খুশী হইল।

তখন সাক্ষী, উকিল, বাড়ীর ভিতরে যেখানে নতুন শাড়ী পরিয়া পুটলীর মত জড়সড় হইয়া দুই একজন সমবয়য়ী পরিবৃতা হইয়া বিবাহের কনে বসিয়া ছিল, সেখানে যাইয়া উপস্থিত হইল। উকিল জোরে জোরে বলিতে লাগিল,

“আলীপুর গ্রামের বছিরদ্দী মিঞার ছেলে আজাহের মিঞার সঙ্গে তোমার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়, একশত পঁচাত্তর টাকা বাকী। এই শর্তে কবুল ত?”

কনে লজ্জায় আর কোন কথাই বলিতে পারে না। একজন বর্ষিয়সী মহিলা কনের মাথায় হাত দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “হ, কনে কবুল আছে।” এইভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর লওয়া শেষ হইলে সাক্ষী উকিলেরা বিবাহ সভায় যাইয়া বলিল, “বিয়ায় বিবি রাজি আছেন।”

তখন বচন মোল্লা বিবাহ পড়াইতে বসিলেন। প্রথমে কোরান শরিফ হইতে খানিকটা পড়িয়া মোল্লা সাহেব পূর্বের মত বলিতে লাগিলেন, “ভাটপাড়া গাঁয়ের আলিমদী মিঞার কন্যা আয়েসা বিবির সঙ্গে আপনার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়, একশত পঁচাত্তর টাকা বাকী। এই শর্তে কবুল ত?” আজাহের লজ্জায় যেন মাটিতে লুটাইয়া পড়ে তবু বলে, “কবুল”।

এইভাবে তিনবার মোল্লা তাহাকে উপরোক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনবার সে বলিল, “কবুল”। মোল্লা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিবি যখন তখন বাপের বাড়ীতে আসতি পারবি, তারে কুনু কারণে মাইর ধইর করতি পারবা না। তারে তুমি সাধ্যমত রোজা নামাজ শিখাইবা। তার ইজ্জত-হুঁরমত রক্ষা করবা। তোমার সঙ্গে বিবির যদি কোন কারণে বনিবনাও না অয়, হে আইসা বাপের বাড়ি থাকপি। তুমি তার খোরপোষ দিবা। এই শর্তে কবুল ত?”

আজাহের বলিল, “কবুল”।

মোল্লা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যদি বিদেশে সফরে যাও তবে রীতিমত বিবিকে খোরপোষ পাঠাইবা, সপ্তাহে একবার পত্র দিবা। যদি ছয়মাস একসঙ্গে বিবির তালাস না লও তবে ইচ্ছা করলি বিবি তোমার কাছ ঐতে তালাকনামা লইতি পারবি। এই সত্য কবুল?”

আজাহের বলিল, “কবুল”।

তখন মোল্লা কোরান শরিফ হইতে আর একটি আয়েত পড়িয়া মোনাজাত করিলেন। বিবাহের পান-শরবত আগেই আনা হইয়াছিল। বিবাহ পড়াইয়া মোল্লা আজহেরকে পান-শরবত খাওয়াইয়া দিলেন। এইভাবে রাত্রি ভোর হইয়া গেল। কাছারী ঘরে গাঁয়ের লোকেরা সারাদিন গুলজার করিয়া কেতাব পড়িতে লাগিল, কেহ গল্প-গুজব করিতে লাগিল।

বিকাল বেলা আজাহেরকে বাড়ির ভিতর লইয়া যাওয়া হইল। নতুন দুলার (বরের) সঙ্গে কনের ক্ষীর-ভোজনী হইল। প্রথমে উঠানে কনেকে আনিয়া একখানা পিড়ির উপর। দাঁড় করান হইল। এয়োদের নির্দেশ অনুসারে আজাহের কনের সামনে আর একখানা পিড়ির উপর দাঁড়াইল। কনে আর বরের মাঝখানে একখানা চাদর টানান, সেই চাঁদরের দুই কানি ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে দুইটি কিশোরী মেয়ে। চাঁদরের সামনে দাঁড়াইয়া আজাহেরের বুক কপিতে লাগিল। কি জানি কেমন যেন তাহার লাগিতেছিল। এই কাপড়ের আড়ালে তাহার কনে রহিয়াছে! এই বউ তাহার সুন্দর হইবে কি কুৎসিত হইবে সে ভাবনা আজাহেরের মোটেই ছিল না। কিন্তু কেন জানি তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগিল। বাড়ির মেয়েরা কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া একটু দূরে দাঁড়াইয়াছিল।

আজাহেরের সঙ্গে মোড়লও বাড়ির ভিতরে গিয়াছিল। সাধারণতঃ এরূপ স্থানে বরের বোনের জামাই অথবা ইয়ার্কি ঠাট্টার সম্পর্ক জড়িত আত্মীয়েরাই বাড়ির ভিতরে যাইয়া থাকে। কিন্তু আজাহেরের কোন আত্মীয়-স্বজন নাই বলিয়াই মোড়ল তাহার সহিত বাড়ির মধ্যে আসিয়াছে। গ্রাম্য মুসলমান মেয়েরা পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলিতে পরদা প্রথার শাসন মানিয়া থাকে। কিন্তু বিবাহ ব্যাপারে তাহারা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার অতটা অনুশাসন মানিয়া চলে না। তাহারা সকলেই কলরবে বলিয়া উঠিল, “টাহা না অইলে কনের মুখ দেহাব না।”

মোড়ল তখন তার কেঁচার খুঁট হইতে অতি সন্তর্পণে বাধা আট আনা পয়সা বাহির করিয়া মেয়েদের কাছে দিল। মেয়েরা তাহাতে রাজী হইবে না,–কিছুতেই না। মোড়লও বেশী দিতে চাহে না, আজাহেরের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিবার উপক্রম হইতেছিল। এমন শুভদৃষ্টির সময়ে মোড়ল কেন দরাদরি করে। এতগুলো মেয়ে তাহাকে কি মনে করিতেছে।

অবশেষে বার আনায় রফা হইল। বার আনা পয়সা পাইয়া মেয়েরা শা-নজর করাইতে রাজী হইল। মোড়ল আগেই আজাহেরকে শিখাইয়া দিয়াছিল, এই সব জায়গায় সহজে চোখ মেলিয়া চাহিবি না–লজ্জা লজ্জা ভাব দেখাইবি। কিন্তু কনের সামনের পরদা তুলিয়া দিতেই আজাহের মোড়লের সকল উপদেশ ভুলিয়া গেল। সে চোখ দুইটি সম্পূর্ণ মেলিয়া কনের দিকে একদৃষ্টিতে খানিক চাহিয়া রহিল। তারপর মনের খুশীতে একবার হাসিয়া উঠিল। আজাহেরের হাসি দেখিয়া সমবেত মেয়ের দল একবারে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। আজাহের ভাবিয়া পাইল না কেন তাহারা এত হাসে।

এবার ঘরের মধ্যে যাইয়া কনের সঙ্গে ক্ষীর-ভোজনী হইবে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে আজাহের তাহার কনে-বউকে কোল-পাথালী করিয়া কোলে তুলিয়া ঘরে লইয়া গেল। বউকে মাটিতে নামাইয়া দেওয়ার পরে বহুক্ষণ তাহার কোমল গায়ের উষ্ণতা আজাহেরের সমস্ত দেহে ঢেউ খেলিতে লাগিল।

তাহার হাতের কানি আঙ্গুলে ক্ষীর জড়াইয়া এয়োরা বউয়ের মুখের কাছে ধরিল। বউ-এর কানি আঙ্গুলে ক্ষীর জড়াইয়া আবার আজাহেরের মুখের কাছে ধরিল। আশেপাশের মেয়েরা মিহি সুরে বিবাহের গান গাহিতে লাগিল :

ওদিকে সইরা বইস হারে দামান
আমার বেলোয়া বসপি তোমার বামেনারে।
কেমনে বসপি আমার বেলোয়া হারে দামান
তাহার সিন্তা রইছে খালি নারে।
দুলার মামু দৌড়াইয়া তখন বাইনা বাড়ি যায় নারে।
কেমনে বসপি আমার বেলোয়া হারে দামান
ও তার গায়েতে জেওর নাইরে।
দুলার চাচা দৌড়ায়া তখন
সোনারূ বাড়ি যায় নারে।

আজাহেরের মনের খুশীর নদীতে যেন সেই সুর তরঙ্গ খেলিতে লাগিল।

.

০৩.

নতুন বউ লইয়া আজাহের বাড়ি ফিরিল। বাড়ি বলিতে তাহার কিছু ছিল না। মোড়ল তাহার বাড়ির ধারেই একটি জায়গা আজাহেরকে ঘর তুলিতে অনুমতি দিয়াছিল। সেইখানে দো-চালা একখানা কুঁড়েঘর তৈরী করিয়া কোনমতে সে একটা থাকার জায়গা করিয়া লইয়াছিল। তারই পাশে ছোট্ট একখানা রান্নাঘর। বউ আনিয়া আজাহের সেই বাড়িতে উঠিল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করিয়া বউ দেখিতে আসিয়া তার ছোট বাড়িখানা কলরবে মুখর করিয়া তুলিল। সেই কলরবে তরঙ্গে তরঙ্গে আজাহেরের অন্তরের খুশীর তুফান যেন উথলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে গ্রামের লোকজন সকলেই চলিয়া গেল।

আজাহের উঠানে বসিয়া নীরবে হুঁকা টানিতেছিল আর সেই কার ধুয়ার উপরে মনে মনে তাহার ভবিষ্যৎ-জীবনের সুখকর ছবি অঙ্কিত করিতেছিল। সমস্ত বাড়িখানা নীরব। কিন্তু সকল নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কে যেন তাহার চারিদিক বেড়িয়া খুশীর ঝাঁঝর বাজাইতেছিল। ঘরের এক কোণে একটা পুটলীর মত জড়সড় হইয়া বউটি বসিয়াছিল। কি করিয়া সে বউটির সঙ্গে কথা বলিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না।

বেচারী আজাহের! কত মাঠের কঠিন বুক সে লাঙলের আঘাতে ফাড়িয়া চৌচির। করিয়াছে–কত দৌড়ের গরুকে সে হেলে-লাঠির আঘাতে বশে আনিয়াছে। কত দেশে-বিদেশে সে পৈড়াত বেচিয়া কত বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা কহিয়াছে, কিন্তু যে তাহার সারা জীবনের সঙ্গী হইয়া তাহার ঘর করিতে আসিল, তাহার সঙ্গে কথা কহিতে আজাহেরের সাহসে কুলাইয়া উঠিতেছে না, কি করিয়া সে কথা আরম্ভ করে কোন কথা সে আগে বলে কিছুই তাহার মনে আসিতেছে না। বিবাহের আগে সে কত ভাবিয়া রাখিয়াছিল–বউ আসিলে এইভাবে কথা আরম্ভ করিবে। এইভাবে রসিকতা করিয়া বউকে হাসাইয়া দিবে কিন্তু আজ সমস্তই তাহার কাছে কেমন যেন ঘুলাইয়া যাইতেছে।

ভাবিতে ভাবিতে আজাহের ঘামিয়া গেল। উঠানের আমগাছটি হইতে একটা পাখি কেবলই ডাকিয়া উঠিতেছিল, বউ কথা কও, বউ কথা কও। এই সুর সমস্ত নীরব গ্রামখানির উপর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। চারিধারের ঘনবনের অন্ধকার ভেদ করিয়া ঝি ঝি পোকাগুলি সহস্র সুরে গান গাহিতেছিল, তাহারই তালে তালে বনের অন্ধকার পথ ভরিয়া জোনাকীর আলোগুলি দুলিয়া উঠিতেছিল।

অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া আজাহের উঠিয়া আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। কেরোসিনের প্রদীপটি কতকটা মান হইয়া আসিয়াছিল। আজাহের তাহার সলিতা একটু উস্কাইয়া দিল। তারপর ঘরের মধ্যে ছেঁড়া মাদুরটি বিছাইয়া তাহার উপর শততালি দেওয়া কথাখানা অতি যত্নের সঙ্গে বিছাইল। রসুনের খোসায় তৈরী ময়লা তেল লাগান বালিশটি এক পাশে রাখিল। তারপর বউটিকে আস্তে কোলপাথালী করিয়া ধরিয়া আনিয়া সেই বিছানার এক পাশে শোয়াইয়া দিল।

এবার আজাহের কি যে করে ভাবিয়া পায় না। বিছানার একপাশে সেই শাড়ী-আবৃত বউটির দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। শাড়ীর ফাঁক দিয়া বউ-এর মেহেদী মাখান সুন্দর। পা-দুটি দেখা যাইতেছিল। তারই দিকে চাহিয়া চাহিয়া আজাহেরের সাধ মিটিতেছিল না। ঘোমটার তল হইতে বউটি যেন বুঝিতে পারিল তাহার পা দুইটির পানে একজন চাহিয়া আছে। সে তখন ধীরে ধীরে পা দুইটি শাড়ীর আঁচলে ঢাকিয়া লইল। তাহাতে বউ-এর সুন্দর হাত দুটি বাহিরে আসিল। আজাহের আস্তে আস্তে নিজের দু’খানা হাতের মধ্যে। সেই রঙীন হাত দুখানা লইয়া নীরবে খেলা করিতে লাগিল। শাড়ীর অন্তরাল হইতে মেয়েটির মৃদু নিশ্বাস লওয়ার শব্দ শোনা যাইতেছিল, তাহা যেন আজাহেরের সমস্ত দেহমন গরম করিয়া তুলিতেছিল।

ধীরে ধীরে আজাহের বউএর মাথার ঘোমটাটি খুলিয়া ফেলিল। কেরোসিনের প্রদীপটি সামনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলিতেছে। তার আলোয় বউ-এর রাঙা টুকটুকে মুখখানা দেখিয়া দেখিয়া আজাহেরের সাধ মেটে না। বউ যেন ঘুমেই অচেতন। আজাহের মুখোনিকে একবার এদিকে উল্টাইয়া দেখে আবার ওদিকে উলটাইয়া দেখে। বাহুখানি লইয়া মালার মত করিয়া গলায় পরে। চারিদিকে মৃত্যুর মত নীথর স্তব্ধতা। সম্মুখের এই একটি নারীদেহ যেন সহস্র সুরে আজাহেরের মনে বাঁশী বাজাইতেছিল। সেই দেহটি সারিন্দা, তাকে মনের খুশীতে নাড়িয়া চাড়িয়া আজাহের যেন মনে মনে কত শত ভাটিয়ালি সুরের গান আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দিতেছিল। সেই সুরে চারিদিকের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া আজাহেরের অন্তরে ছবির পর ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।

তাহার ছোট্ট উঠানটি ভরিয়া একটি রাঙা টুকটুকে বউ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তার রাঙা পায়ের ছাপের উপরে কে যেন কলমীর ফুল ছড়াইয়া যাইতেছে। পৌষ মাসের উতল বাতাসে বাড়ির কদম গাছটির তলায় একটি বউ ধান উড়াইতেছে। ঈষৎ বাঁকা হইয়া দুই হাতের উপর কুলাভরা ধানগুলিকে সে বাতাসে উড়াইয়া দিতেছে, হাতের চুড়ীগুলি টুং টুং করিয়া বাজিতেছে। চিটাগুলি উড়িয়া যাইতেছে, ধানগুলি লক্ষ্মীর মত বউ-এর পায়ের কাছে আসিয়া জড় হইতেছে! সুখের কথা ভাবিতে ভাবিতে আরো সুখের কথা মনে জাগিয়া ওঠে। প্রথম অঘ্রাণ মাসে নতুন ধানের গন্ধে গ্রাম ভরিয়া গিয়াছে। আঁটি ভরা গুচ্ছ গুচ্ছ লক্ষ্মী-শালি ধান মাথায় করিয়া আজাহের ঘরে ফিরিতেছে। বাড়ির বেকী বেড়াখানা ধরিয়া বউ তার পথের পানে চাহিয়া আছে। আজাহের আসিতেই বুকের আঁচল দিয়া বউ উঠানের কোণটি মুছিয়া দিল। সেইখানে ধানের আঁটি মাথা হইতে নামাইয়া ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক টানিতে টানিতে সে বউ-এর সঙ্গে দুই একটা সামান্য প্রয়োজনের কথা বলিতেছে।

এমনি ছবির পরে ছবি–তারপর ছবি। ভাবিতে ভাবিতে আজাহের কখন যে ঘুমাইয়া পড়িল টেরও পাইল না। অনেক দেরীতে ঘুম ভাঙ্গিয়া আজাহের দেখিতে পাইল বাড়িঘর সমস্ত ঝাট দেওয়া হইয়াছে। উঠানের একধারে তেঁতুল গাছটির তলায় ভাঙা চুলাটিকে পরিপাটি করিয়া লেপিয়া তাহার উপরে রান্না চড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। সামনের পালান। হইতে বেতে-শাক তুলিয়া আনিয়া কুলার উপর রাখা হইয়াছে। তারই পাশে একরাশ ঘোমটা মাথায় দিয়া বউটি হলুদ বাটিতেছে। রাঙা হাত দুটি হলুদের রঙে আরো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে।

অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আজাহের দেখিল। তারপর তিন চারবার কাশিয়া গলাটাকে যথাসম্ভব মুলাম করিয়া কহিল, “বলি আইসাই তোমার এত কাম করনের কি দরকার ছিল? সকালে উইঠাই চুলা লেপতাছাও। তোমার ত কাল লাইগা জ্বর অবি।”

ঘোমটার তল হইতে কোন উত্তরই আসিল না। আজাহের কোলকেয় তামাক ভরিয়া যেন আগুন আনিতেই চুলার কাছে যাইয়া বসিল। এবার বউটির গায়ের সঙ্গে তাহার। ঘেঁসাঘেঁসি হইল। কোলকেয় আগুন দিয়া ফুঁ পাড়িতে পাড়িতে আজাহেরের ইচ্ছা করে এইখানে এই উনানের ধারে বসিয়া বউ-এর সঙ্গে সে অনেক রকমের গল্প করে। খেত-খামারের কথা, তার ভবিষ্যৎ জীবনের ছোটখাট কথা, আরো কত কি।

আজাহের বলে, “সামনের ভাদ্র মাসে পাট বেইচা তোমার জন্যি পাছা পাইড়া শাড়ী কিন্যা আনব। খ্যাতের ধান পাকলি তুমি মনের মত কইরা পিঠা বানাইও, কেমন?”

বউ কোন কথাই বলে না। নিরুপায় হইয়া আজাহের এবার সোজাসুজি বউকে প্রশ্ন করে, “বলি তোমাগো বাড়ির বড় গরুড়া কেমন আছে! শুনছি তোমার বাপ তোমাগো ছোট বাছুরডা বেচপি? আমারে কিন্যা দিতি পার?”

তবু বউ কথা কহিল না। আজাহেরের মন বড়ই অস্থির হইয়া পড়িল। ওই ছোট্ট রাঙা টুকটুকে মুখখানা হইতে যদি কথা বাহির হইত। রাঙা টুকটুকে কথা। কেন সে কথা বলে না!

এই রঙীন শাড়ীর অন্তরালে কি যে অদ্ভুত রহস্য লুকাইয়া রহিয়াছে! কে যেন কুয়াপের মন্ত্র পড়িয়া আজাহেরকে সেই রহস্যের দিকে টানিতেছে। সে যতই বউটির কথা ভাবিতেছে ততই সে এই রহস্য জালে জড়াইয়া পড়িতেছে।

স্নান করিতে আজাহের নদীতে আসিল। এতদিন স্নান করিতে তার দুইমিনিটের বেশী লাগে নাই, আজ প্রায় একঘন্টা ধরিয়া আঠাল-মাটি দিয়া সমস্ত গা ঘসিয়া সে স্নান করিল। তবু মনে হয় গায়ের সমস্ত ময়লা যেন তার পরিষ্কার হয় নাই। মাথার উস্কখুস্কু চুলগুলিতে আজ ছমাস নাপিতের কচি পড়ে নাই। যদি সময় থাকিত আজাহের এখনই যাইয়া নাপিত বাড়ি হইতে সুন্দর করিয়া ঘাড়ের কাছে খাটো করিয়া চুল কাটাইয়া আসিত।

স্নান করিয়া ভালমত মাথা মুছিয়া থালার উপরে পানি লইয়া রৌদ্রে বসিয়া তাহারই ছায়ায় নিজের মুখখানা সে বার বার করিয়া দেখিল। তারপর ঘরের বেড়া হইতে একখানা কাঠের ভাঙা চিরুণী আনিয়া মাথার অবাধ্য চুলগুলির সঙ্গে কসরৎ করিতে প্রবৃত্ত হইল। এই চিরুণীখানা সে চার বৎসর আগে কুড়াইয়া আনিয়াছিল। এতদিন তাহা কাজে লাগাইবার অবসর হয় নাই। আজ তাহা কাজে আসিল। অনেকক্ষণ চুলের সঙ্গে এই রকম কসরৎ করিয়া আজাহের বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, বউ তার দিকে চহিয়া মৃদু হাসিতেছে। আজাহেরের চোখে চোখ পড়িতেই তাড়াতাড়ি বউ ঘোমটায় মুখখানা ঢাকিয়া ফেলিল।

বেড়াইতে বেড়াইতে বিকাল বেলা রহিমদ্দী কারিকর আজাহেরের বাড়ি আসিল। আজাহের তাকে বড় আদর করিয়া বসাইল। নিজে তামাক সাজিতে যাইতেছিল। বউ তাড়াতাড়ি আজাহেরের হাত হইতে কলিকাটি লইয়া তামাক সাজিয়া আনিয়া দিল। রহিমদ্দী তামাক টানিতে টানিতে বলিল, “বড় ভাল বউ পাইছসরে আজাহের। বউ বড় কামের অবি।”

রহিমদ্দীর মুখে বউ-এর তারিফ শুনিয়া আজাহের বড়ই খুশী হইল। রহিমদ্দী আস্তে আস্তে আজাহেরের কানের কাছে মুখ লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বউ-এর সাথে কি কি কথা বার্তা ঐল তোর আজ?”

আজাহের রহিমদ্দীর গায়ের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া ফিসফিস করিয়া উত্তর দিল, “কি কব চাচা, বউ মোটেই কথা কয় না। বউর বুঝি আমারে পছন্দ অয় নাই।”

রহিমদ্দী বলিল, “দূর পাগলা, নতুন বউ, সরম করে না? একদিনেই কি তোর সঙ্গে কথা কবি?”

আজাহের যেন অকূলে কূল পাইল। সত্যই বউ তবে তাকে অপছন্দ করে না। নতুন বউ সরম করিয়াই তার সঙ্গে কথা বলে না। আজাহের এবার রহিমদ্দীকে একটি গান গাহিতে অনুরোধ করিল। রহিমদ্দী বলিল, “নতুন বউকে গান শুনাইবার চা নাকি?”

‘দূর’ বলিয়া আজাহের রহিমদ্দীকে একটা মৃদু ধাক্কা দিল। হাসিতে হাসিতে রহিমদ্দী গান আরম্ভ করিল,

“মাগো মাগো কালো জামাই ভাল লাগে না,–”

গান শুনিয়া আজাহের হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল। সে যদি লক্ষ্য করিত দেখিতে পাইত নতুন বউ-এর ঘোমটার তল হাসিতে ভরিয়া টুবুটুবু হইয়াছে।

চারিদিকে অন্ধকার করিয়া আবার রাত্রি আসিল। কেরোসিনের কুপিটি জ্বালাইয়া বউ নিজেই বিছানা পাতিল। আজাহের অবাক হইয়া দেখিল তার সেই সাত-তালি দেওয়া ময়লা কাঁথাখানি একদিনেই পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপরে রঙীন সূতার দুই তিনটি ফুল হাসিতেছে। সেই বিছানার ফুলগুলিরই যেন সঙ্গী হইয়া বউ একপাশে যাইয়া বসিয়া রহিল। বউটির দিকে বার বার করিয়া যতবার আজাহের তাকায় তার কেবলই মনে হয়, এমন রূপ তার গরীবের কুঁড়েঘরে মানায় না। ভরা মাঠের সরষে খেত কে আজ জীবন্ত করিয়া তার ঘরে ফেলিয়া গেল। কত কষ্টই না তার হইবে। গরীব আজাহের এমন সুন্দর মেয়েটিকে সুখে রাখিতে সব কিছুই করিতে পারিবে। কিন্তু সে কি সুখী হইবে?

আজাহের বলে, “দেহ! আমার এহানে তোমার বড়ই কষ্ট অবি। কিন্তু জাইনো আমাগো দিন এই বাবেই যাবি না। আশ্বিন মাসে পাট বেইচা অনেক টাহা পাব। সেই টাহা দিয়া তোমার জন্য জেওর গড়ায়া দিব। তুমি দুক্ষু কইর না, আমি না খায়া তোমারে খাওয়াব, ঠোঁটের আধার দিয়া তোমারে পালব–তোমারে খুব ভাল জানব–আমার কলজার মধ্যে তোমারে ভইরা রাখপ।”

বউ একটু হাসিয়া আঁচলের বাতাসে কেরোসিনের কুপিটি নিবাইয়া আজাহেরের মুখে, একটি মৃদু ঠোক্কা মারিয়া বিছানার উপর যাইয়া শুইয়া পড়িল। আজাহের বউ-এর সমস্ত দেহটি নিজের দেহের মধ্যে লুকাইয়া তার বুকে মুখে ঘাড়ে সমস্ত অঙ্গে মুখ রাখিয়া কেবলই বলিতে লাগিল, “আমার একটা বউ ঐছে–সোনা বউ ঐছে–লক্ষী বউ ঐছে–মানিক বউ ঐছে। তোমারে আমি বুকে কইরা রাখপ–তোমারে আমি কলজার মধ্যে ভইরা রাখপ–আমার মানিক, আমার সোনা, তোমারে মাথায় কইরা আমি মাঠ ভইরা ঘুইরা আসপ নাকি? তোমারে বুকে কইরা পদ্মা গাঙ সঁতরাইয়া আসপ নাকি? আমার ধানের খ্যাতরে, আমার হালের লাঠিরে–আমার কোমরের গোটছড়ারে–আমার কান্ধের গামছারে। তোমারে আমি গলায় জড়ায়া রাখপ নাকি?”

আজাহের পাগলের মত এমনই আবল তাবল বকিয়া যাইতেছিল। বউটি হাসিয়া কুটি কুটি হইতেছিল। মাঝে মাঝে আজাহেরের মুখে এক একটি মৃদু ঠোকনা দিতেছিল।

ভালবাসার অনেক কথা ওরা জানে না। বউ-এর হাতের মৃদু ঠোনায় আজাহেরের সমস্ত অঙ্গ পুলকে ভরিয়া যায়। আজাহের যেন আজ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। বউ এর সুন্দর নরম দেহটিকে সে যেন আজ লবঙ্গ এলাচির মত শুকিয়া শুকিয়া নিজের বুকে ভরিয়া লইবে।

এমনই করিয়া কখন যে রাত শেষ হইয়া গেল তাহারা টেরও পাইল না। প্রভাতের মোরগ ডাক দিতেই বউ তাড়াতাড়ি উঠিয়া উঠান ঝাট দিতে আরম্ভ করিল। ঘরের দরজার ফাঁক দিয়া আজাহের দেখিতে পাইল, পূব আকাশের কিনারায় পূব-ঘুমানীর বউ জাগিয়া উঠিয়াছে।

মুখ হাত ধুইতে ধুইতে সমস্ত আকাশ সোনালী রোদে ভরিয়া গেল। ঘর-গেরস্থালীর কাজে বউ এখানে সেখানে ঘুরিয়া ফিরিতেছিল। আজাহের ঘরের দরজার সামনে বসিয়া গান ধরিল

বাড়িতে নতুন বহু আসিয়া,
কথা কয় রাঙা মুখে হাসিয়া;
আমার বাঁশী বাজে তারিয়া নারিয়া নারিয়ারে।
পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায় বহু লাল শাড়ী পরিয়া,
লাল মোরগের রঙীন পাখা নাড়িয়া নাড়িয়া;
ও ভাইরে ঝলমল কি চলমল করিয়া।

একাজ ওকাজে যাইতে চোখাচোখী হইতেই বউ-এর মুখখানা কৌতুক হাসিতে ভরিয়া যায়। আজাহের আরো উৎসাহের সঙ্গে গান ধরে–

বউ ত নয় সে হলদে পাখি এসেছে উড়িয়া
সরষে খেত নাড়িয়া
হয়ত বা পথ ভুলিয়া;
আমার মনে বলে রাখি তারে পিঞ্জিরায় ভরিয়া হৃদয়ে পুরিয়া
নইলে যাবে সে উড়িয়া।
ও ভাইরে ফুরপুর কি তুরতুর করিয়া।

গানের শেষ লাইনটি আজাহের বারবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া গাহিতে লাগিল। গান থামিলে ঘোমটার তল হইতে অতি মিহি সুরে বউ বলিল–”বাড়িতে আগুন নাই। ও-বাড়ির ত্যা আমাগো উনি আগুন আনুক গিয়া।”

এই কথা কয়টি আজাহেরের মনে সুধা বর্ষণ করিল। তার নিজের হাতে গড়া সারিন্দা যেন আজ প্রথম বোল বলিল। ব্যস্ত সমস্ত হইয়া সে মোড়লের বাড়িতে আগুন আনিতে ছুটিল। পথে যাইতে যাইতে বউ-এর সেই ছোট্ট কথা কয়টি যেন তাহার কানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাজিতে লাগিল।

এমনই করিয়া আরো দুই তিনদিন কাটিয়া গেল। আজাহেরের নিকট তার বউকে যতই ভাল লাগিতেছিল, ততই সে মনে মনে ভাবিয়া অস্থির হইয়া উঠিতেছিল, কি করিয়া সে বেশী করিয়া উপার্জন করিবে? কি করিয়া সে বউকে আরো খুশী করিতে পারিবে?

দিনের বেলা আজাহের পৈড়াত বেচিতে ভিন গায়ে যায়। বাড়ি ফিরিতে সন্ধ্যা পারাইয়া যায়। তখন বাঁশের কঞ্চি বাঁকাইয়া ঝুড়ি তৈরী করিতে বসে। প্রায় অর্ধেক রাত বসিয়া বসিয়া কাজ করে। বউ তার সঙ্গে সঙ্গে পাট দিয়া সরু তাইতা পাকাইতে থাকে। হাটের দিন এগুলি বিক্রি করিয়া তাহারা দুপয়সা জমা করিবে।

পৈড়াত বেচিয়া আজাহের যাহা উপার্জন করে, তাহাতে দুজনের খাওয়া খরচই কুলাইয়া উঠিতে চাহে না! আলীপুরের শরৎ সাহার কাছ হইতে আজাহের পনর টাকা কর্জ করিয়া আনিয়াছে। প্রতি টাকায় মাসে এক আনা করিয়া সুদ। যেমন করিয়াই হোক আজাহের ছয় মাসের মধ্যে সেই টাকা শোধ করিয়া দিবে। দুইজনে মুখামুখি বসিয়া পরামর্শ করে, কি করিয়া আরো বেশী উপার্জন করা যায়। মোড়লের কাছ হইতে আজাহের দুই বিঘা জমি বরগা লইয়াছে। বউ এর বাপের বাড়ি হইতে কয়েক দিনের জন্য বলদ দুইটি সে ধার করিয়া জমিটুকু চষিয়া ফেলিবে। সেই জমিতে আজাহের পাট বুনিবে। খোদা করিলে দুই বিঘা জমিতে যদি ভাল পাট জন্মে, তবে ভাদ্র মাসেই সে তার বরগা ভাগে। এক বিঘা জমির পাটের মালিক হইবে। এক বিঘা জমিতে কমসেকম পনর মণ পাট জমিতে পারে। আগামী বারে যদি পাটের দাম পাঁচ টাকা করিয়াও হয়, পনের মন পাটে সে পাঁচ কম চার কুড়ি টাকার মালিক হইবে! বউ তুমি অত ভাবিও না। শরৎ সাহার দেনাটা শোধ করিয়া যে টাকাটা থাকিবে সেই টাকা দিয়া আজাহের দুইটি ভালো বলদ কিনিবে, আর বউ এর জন্য একখানা পাছাপেড়ে শাড়ী কিনিয়া আনিবে।

বউ বলে, “শাড়ী কিন্যা কি অবি। শাড়ীর টাকা দিয়া তুমি একটা ছাগল কিন্যা আইন। কয় মাস পরে ছাগলের বাচ্চা অবিবাচ্চাগুলান বড় ঐলে বেইচা আরো কিছু জমি অবি।”

আজাহের বলে, “আইচ্ছা–বাইবা দেখপ পরে।”

অনেক বড় হইতে তাহারা চাহে না। মাথা পুঁজিবার মত দুখানা ঘর, লাঙল চালাইবার মত কয়েক বিঘা জমি আর পেট ভরিয়া আহার;–এরি স্বপ্ন লইয়া তাহারা কত চিন্তা করে, কত পরামর্শ করে, কত ফন্দি-ফিকির আওড়ায়।

সকালে বউ রাধে না। পূর্ব দিনের বাসি ভাত যা অবশিষ্ট থাকে তাহাতে জল মিশাইয়া কাঁচা লঙ্কা ও লবণ দিয়া দুইজনে খাইয়া পেট ভরায়। কোন কোন দিন অনাহারেই কাটায়।

এত অল্প খাইয়াও মানুষ বাঁচিতে পারে! তবু তাহাদের কাজের উৎসাহ কমে না! তবু তাহারা গান করে! রাত জাগিয়া গল্প করিতে করিতে কাজ করে! মাথা খুঁজিবার মত একখানা ঘর, পেট ভরিয়া দুই বেলা আহার, একি কম ভাগ্যের কথা!

.

০৪.

দেখিতে দেখিতে ভাদ্র মাস আসিল। সত্য সত্যই আজাহেরের খেতে ভাল পাট হইয়াছে। সকলেই বলিল মোড়লের বরগার ভাগ দিয়া আজাহের এবার প্রায় কুড়ি মণ পাট পাইবে।

সেই পাট শুখাইতে বউ-এর কি উৎসাহ। উঠানে সারি সারি বাশের আড় পাতিয়া তাহার উপরে পাটগুলি মেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। মাঝে মাঝে সমস্ত বাড়িখানা যেন নকল বনে পরিণত হইয়াছে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে বউটি হারাইয়া যায়। তাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে আজাহেরকে বড়ই বেগ পাইতে হয়। সে যদি এদিকে যায় বউ ওদিক হইতে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠে। বউকে ধরিবার জন্য ওদিক যাইতে বিস্ময়ে আজাহের দেখে বউ অপরদিকে যাইয়া ক করিয়া শব্দ করিয়া ওঠে।

মোড়লের বউ বেড়াইতে আসিয়া বলে, “কি লো! তোগো হাসি মস্করা যে ফুরায় না?”

বউ তাড়াতাড়ি পিড়াখানা বাড়াইয়া বলে, “বুবু আইছ–বইস, বইস।”

আজাহের বড়ই অপ্রস্তুত হইয়া তামাক সাজিতে রান্নাঘরের দিকে যায়।

পাট শুখান শেষ হইতে না হইতে আজাহেরের বাড়িতে পাটের বেপারী অছিমদ্দীর আনাগোনা শুরু হইল। আজাহের শুনিয়াছে, ফরিদপুরে প্রতিমণ পাট ছয় টাকা দরে বিক্রি হইতেছে। অছিমদ্দী কিন্তু তাহার পাটের দাম চার টাকার বেশী বলে না। অছিমদ্দীর জন্য তামাক সাজিতে সাজিতে আজাহের বলে, “তা বেপারীর পো, চার টাকার পাট আমি কিছুতেই ছাড়ব না।” অছিমদ্দী বলে, “আরে মিয়া তোমার পাট ত তেমুন বাল না? কোম্পানী-আলা এ পাট নিতিই চায় না, তবে আমি কিন্‌তি আছি, দেহি বাল পাটের সঙ্গে মিশায়ানি বেচতি পারি।”

“হুনলাম ফইরাতপুরি পাটের দাম ছয় টাহা মণ।”

“অবাক করলা আজাহের! মার কাছে মাসী-বাড়ির গল্প কইতি আইছাও? ফরিদপুর, তালমা, গজাইরা, ভাঙ্গা, কালিপুর, চোদ্দরসি, ফুলতলা কোন আটের খবর আমি জানি না? যাও না ফৈরাতপুর পাট লয়া। তোমার ভিজা পাট দেকলি পুলিশেই তোমাকে দৈরা নিব্যানে। তারপর যদি স্যাত পাট বিক্রিও অয়, মণকে দশ সের নিব্যানে তোমার তুলাওয়ালা, তারপর বাকি রইল তিরিশ সের। ওজনদার নিব্যানে মণকে পাঁচ সের–কয় সের রইল মিঞার বেটা বিশ সের ত? শব্দেই হুনা যায় ছয় টাহা। চার মণ মানে সেহানে দুই মণ।”

বেপারীর আরো একটু কাছে ঘেঁষিয়া আজাহের বলিল,–”কওকি বেপারীর পো! ফইরাতপুর এমন জায়গা!”

বেপারী দেখিল তাহার ঔষধ কাজে লাগিয়াছে। গলার সুরটি আরো একটু নরম করিয়া বলিল,–”আজাহের মিঞা! আমি তোমার দেশের মানুষ, রাইত দিন চক্ষি দেহি। আমি তোমারে ফৈরাতপুইরা বেপারীগো মত ঠকাইতি আসি নাই।”

আজাহেরের মনটি যেন নরম হইয়া মাটিতে গলিয়া পড়িতে চাহে। অছিমদ্দী শোভারামপুরের ধনী মহাজন। সে তাহাকে আজাহের মিঞা বলিয়া ডাকিতেছে। কত মুলাম করিয়া তাহার সঙ্গে কথা কহিতেছে। তবু আজাহের হাল ছাড়িল না।

“বেপারীর পো! আরো দুই একদিন দেহি। আর কুনু বেপারী যদি বেশী দাম দেয়?”

“আজাহের মিঞা! আমারে তুমি অবিশ্বাস করলা! আমার চাইতি তোমারে আর কোন বেপারী বেশী দাম দিবি? ও সগল কতা থাক। তোমার মনের আন্ধার ঘুচাই। তোমার পাটের দাম মণ প্রতি আরো আটআনা বাড়াইয়া দিলাম, না হয় নিজেই লোকসান দিলাম।”

আজাহেরের দুইখানা হাত ধরিয়া বেপারী বলিল–”আজাহের মিঞা! কথা দাও। এবার পাটে ওজন দেই?”

এর উপর আর কথা বলা চলে না। এত বড় মহাজন। নিজে তার বাড়ি আসিয়াছে। তার কথা কি করিয়া অগ্রাহ্য করা যায়? আজাহের চারটাকা আটআনা দামেই পাট বেচিবে কথা দিয়া ফেলিল।

আজাহের আগেই পাট ওজন দিয়া রাখিয়াছিল। তাহাতে তাহার পাটের ওজন হইয়াছিল ছাব্বিশ মণ। কিন্তু অছিমদ্দী নতুন করিয়া পাটগুলিকে ওজন করিল। তাহাতে কুড়ি মণ পাট হইল। আজাহেরের মন কেবলই খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। সে নিজে ওজন করিয়াছিল ছাব্বিশ মণ আর এখন হইল কুড়ি মণ। কিন্তু কথাটা কি করিয়া বেপারীকে বলা যায়? অনেক চিন্তা করিয়া বহুবার ঢোক গিলিয়া আজাহের বলিল, “বেপারীর পো! একটা কতা কব্যার চাই।”

“কি কতা আজাহের মিঞা? একটা ক্যান বিশটা কও না ক্যান?”

“কব আর কি? আমি নিজে ওজন দিছিলাম। পাটের ওজন ঐছিল ছাব্বিশ মণ। কিন্তুক আপনার ওজনে ঐল মোটে কুড়ি মণ।”

বেপারী এবার রাগিয়া উঠিল, “কি কইলা আজাহের, আমি অছিমদ্দী বেপারী, পাটের ওজনে তোমারে ঠকাইছি। শুয়ারের গোস্ত খাই যদি তোমারে ঠকাইয়া থাহি। কোথাকার নকল পালা-পৈড়ান দিয়া তুমি ওজন দিছিলা। তাইতি ওজনে বেশী ঐছিল। একথা কারও কাছে কইও না, যে তোমার কাছে নকল পালা-পৈড়ান আছে। একথা পুলিশি জানতি পারলি এহনি তোমারে থানায় ধইরা নিয়া যাবি। আমার পালা-পৈড়ানে কোমপানি বাহাদুরের নাম লেহা আছে। ইংরাজী পড়বার পার মিঞার বেটা?” বলিয়া বেপারী উচ্চ হাসিয়া উঠিল। ইতিমধ্যেই অছিমদ্দীর লোকজন পাটগুলি বাঁধিয়া নৌকায় উঠাইয়া ফেলিয়াছে। অছিমদ্দী কোমরে গোজা চটের ছালার খুতিটি খুলিয়া টাকা, আনি, দু’আনি প্রায় তিন চারিশত টাকা আজাহেরের উঠানের উপর ঢালিয়া দিল।

আজাহের ফ্যাল ফ্যাল করিয়া অছিমদ্দীর অপূর্ব ঐশ্বর্য্যের পানে চাহিয়া বিসায়ে অবাক হইয়া রহিল।

সেই টাকা হইতে গণিয়া গণিয়া অছিমদ্দী কুড়ি মণ পাটের দাম নব্বই টাকা আজাহেরের হাতে খুঁজিয়া দিল।

এত টাকা একসঙ্গে পাইয়া খুশীতে আজাহেরের ইচ্ছা করিতেছিল, অছিমদ্দী বেপারীর পায়ের কাছে লুটাইয়া ছালাম জানায়। সে যেন নিতান্ত অনুগ্রহ করিয়াই তাকে টাকাগুলি দিয়া গেল। পাটগুলি যে লইয়া গেল সে যেন একটা তুচ্ছ উপলক্ষ মাত্র।

বেপারী চলিয়া গেলে বউ ঘরের মধ্য হইতে আসিয়া আজাহেরকে বলিল, “বলি, আমাগো বাড়ির উনি এত বোকা ক্যান? সে দিন মাইপা পাট ঐল ছাব্বিশ মণ আর আজই বেপারী আইসা সেই পাট মাইপা কুড়ি মণ করল। ও-বাড়ির মেনাজদ্দী মোড়লেরে ডাইকা আইনা পাটের একটা বুঝ কইরা নিলি ঐত না?”

“বাল কই কইছ তুমি। আমার উয়া মনেই আসে নাই। যাক–খোদা নছিবে যা লেখছে তাই ত আমি পাব। এর বেশী কিডা দিবি।”

এ কথার উপরে আর কথা চলে না। তবু বউর মনটা খুঁৎখুঁৎ করিতেছিল।

বউকে খুশী করিবার জন্য আজাহের বলিল, “আইজই রহিমদ্দী কারিকরের বাড়ি ত্যা তোমার জন্যি একখানা পাছা পাইরা শাড়ী কিন্যা আনিগা।”

বউ বলিল, “আমার শাড়ীর কাম নাই। আগে শরৎ সাহার কর্জ টাহাডা দিয়া আসুক গিয়া।”

“বাল কতাই কইছ তুমি। আমি এহনি যামু শরৎ সহর বাড়ি।”

গোটা তিরিশেক টাকা কোমরে বাধিয়া বাকি টাকাগুলি আজাহের ঘরের মেঝেয় গর্ত খুঁড়িয়া একটা হাড়িতে পুরিয়া তাহার মধ্যে পুঁতিয়া রাখিল। বউ তাড়াতাড়ি সেই গর্তটি মাটি দিয়া বুজাইয়া তাহার উপরটা লেপিয়া ফেলিল।

.

০৫.

দুপুরের রোদে আজাহের সেই কোমরে বাধা টাকাগুলি লইয়া শরৎ সাহার বাড়ির দিকে রওয়ানা হইল।

আলীপুরের ওধারে সাহা পাড়া। হালটের দুইধারে বড় বড় টিনের ঘরওয়ালা বাড়িগুলি। আম, জাম, কাঁঠালগাছগুলি শাখা বাহু বিস্তার করিয়া এই গ্রামগুলিকে অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। হালটের পথে সাহাদের সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েগুলি খেলা করিতেছে। তাহাদের প্রায় সকলের গলায়ই মোটা মোটা সোনার হার। কাহারো বাহুতে সোনার তাবিজ বাধা। কপালে সিঁদুর পরিয়া কাঁখে পিতলের কলসী লইয়া দলে দলে সাহা গৃহিণীরা নদীতে জল আনিতে যাইতেছে। তাহাদের কাখের ঘসামাজা পিতলের কলসীর উপর দুপুর বেলার রৌদ্র পড়িয়া ঝকঝক করিতেছে। সাহারা এই অঞ্চলে সবচাইতে অবস্থাপন্ন জাতি, কিন্তু পানীয় জলের জন্যে মুসলমানদের মত তাহারা বাড়িতে টিউবওয়েল বা পতাকুয়া বসায় না। তাহাদের, মেয়েরাই নদী হইতে জল লইয়া আসে। সেই জন্য গ্রামে কলেরা হইলে আগে সাহা পাড়ায় আরম্ভ হয়। নানা রকমের সংক্রামক রোগে তাই ধীরে ধীরে উহাদের বংশ লোপ পাইতে বসিয়াছে।

পূর্বে সাহারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দেশে-বিদেশে গমন করিত। এদেশের মাল ও-দেশে লইয়া গিয়া, ও-দেশের মাল এ-দেশে আনিয়া তাহারা দেশের সম্পদ বাড়াইত। পল্লী-বাংলার অনেকগুলি রূপরেখা তাই সাহা, সাধু-সওদাগরদের কাহিনীতে ভরপুর। আজও পল্লী গ্রামের গানের আসরগুলিতে গায়কেরা কত সাধু-সওদাগরের, শখ-বণিকের দূরের সফরের কাহিনী বর্ণনা করিয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করে। কবে কোন নীলা-সুন্দরীর মাথার কেশে-লেখা প্রেম-লিপি পড়িয়া কোন সাহা বণিকের ছেলে সুদূর লঙ্কার বাণিজ্যে বসিয়া বিরহের অশ্রুবিন্দু বিসর্জন করিয়াছিল, তাহার ঢেউ আজো গ্রাম্য-রাখালের বাঁশীতে রহিয়া রহিয়া বাজিয়া উঠে।

কিন্তু কিসে কি হইয়া গেল! সাহারা আয়াসপ্রিয় হইয়া পড়িল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অদুনা পদুনার শাড়ীর অঞ্চল ছাড়িয়া তাহারা আর সংগ্রাম-সঙ্কুল বিদেশের বাণিজ্যে যাইতে চাহিল না। পুব বাংলার দেশ-বিদেশের বাণিজ্য-ভার সাহাদের হাত হইতে সরিয়া গিয়া বিদেশী মাড়োয়ারী এবং অন্যান্য জাতির উপর পড়িল। নানা বিলাস ব্যসনে ডুবিতে ডুবিতে তাহারা লাভ-মূল সবই খোয়াইল। বাংলার সাহা সমাজ কুসীদজীবীতে পরিণত হইল। সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্য যা তাহারা করে তাহাও নামে মাত্র। এখন তাহাদের মুখ্য ব্যবসা মূর্খ গেঁয়ো চাষীদের মধ্যে উচ্চহারের সুদে টাকা খাটান।

সাহাদের প্রত্যেক বাড়িতে একখানা করিয়া বৈঠকখানা। সেই বৈঠকখানার একধারে চৌকি পাতা। তাহার উপরে চাদর বিছান। তারই এক কোণে কাঠের একটি বাক্স সামনে করিয়া বাড়ির মূল মহাজন বসিয়া থাকেন। পাশে দুই একজন বৃদ্ধ বয়সের গোমস্তা। ডানাভাঙ্গা চশমায় সূতো বাধিয়া কানের সঙ্গে আঁটকাইয়া তাহারা বড় বড় হিসাবের খাতা লেখে। মূল মহাজন মাঝে মাঝে কানে কানে কি বলিয়া দেন। তাহারা ইসারায় সায় দিয়া আবার খাতা লেখায় মনোনিবেশ করে। মহাজনের মাথার উপর গৌরাঙ্গদেবের সন্ন্যাসের ফটো। তারই পাশে নামাবলি গায়ে হরিনাম জপ-রত মহাজনের গুরুঠাকুর বা পিতৃদেবের ফটো। তাহার উপরে চন্দনের ফোঁটা। প্রতিদিন সকালে বিকালে ধূপ ধুনা দিয়া সেখানে নত হইয়া মহাজন পূজা করেন। এই সমস্ত উপকরণই যেন তার কুসীদজীবী নিষ্ঠুর জীবনের মর্মান্তিক উপহাস। ঘরের চৌকির ওপাশের মেঝে লেপাপোছা। একধারে কতকগুলি ছালা গোটান। সমবেত খাতকেরা এবং টাউটেরা সেই ছালার উপরে বসিয়া নানা রকমের চাটুবাক্য বলিয়া মহাজনের মনস্তুষ্টি করিবার চেষ্টা করে। একপাশে একটি আগুনের পাতিল। তাহা হইতে ঘুটার ধুয়া উঠিতেছে। তারই পাশে চার পাঁচটি পিতল বাধান তেলো হুঁকো। তাহার একটি ব্রাহ্মণের জন্যে, একটি কায়স্থের জন্য, একটি মূল মহাজনের জন্যে। সমবেত মুসলমান খাতকদের জন্য কোন হুঁকো নাই। তাহারা কলিকায়ই তামাক সেবন করে।

মহাজনের খাতাগুলি আবার নানা ধরনের। যাহারা তামা-কাসা বন্ধক রাখিয়া অল্প টাকা লয় তাহাদের জন্য এক খাতা, যাহারা সোনা-রূপা বন্ধক দিয়া টাকা লয় তাহাদের জন্য এক খাতা, যাহারা কোনকিছু বন্ধক না দিয়াই টাকা কর্জ করে তাহাদের জন্য এক খাতা, আবার যাহারা মহাজনের বাড়িতে তিন বৎসর খাঁটিয়া যাইবে এই অজুহাতে বিনা সুদে টাকা কর্জ করিয়াছে তাহাদের জন্য এক খাতা।

মহাজনের টাকা আবার নানা নামে খাটে।

কতক টাকা কর্জ দেয় স্ত্রীর নামে, সেই কবে স্ত্রী বউ হইয়া ঘরে আসিয়াছিল, তখন মহাজনের পিতা দশটি টাকা দিয়া নববধূর মুখ দর্শন করিয়াছিলেন, আজ সেই টাকা সুদে ফাপিয়া দশ হাজার টাকায় পরিণত হইয়াছে। তার ছেলে শহরে যাইয়া পড়াশুনা করে। জলপানের টাকা হইতে বাঁচাইয়া সে পিতার নিকট সুদে খাটাইবার জন্য পাঁচ টাকা দিয়াছিল তিন বৎসর আগে। তাহাও এখন সুদে ফঁপিয়া তিনশত টাকায় পরিণত হইয়াছে। এইভাবে নানা তহবিল হইতে মহাজনকে নানা প্রকারের টাকা কর্জ দিতে হয়।

ইহা ছাড়া জমা উসুল বকেয়া, পূজার বৃত্তি, পুণ্যার বৃত্তি আরও কত রকমের জটিল। হিসাব তাহাকে রাখিতে হয়। মহাজনের গদীর অর্ধেক স্থান জুড়িয়া কেবল খাতার উপরে খাতা। কিন্তু এতসব খাতাতে দিনের পর দিন চার পাঁচজন গোমস্তা বসিয়া শুধু কলমের খোঁচায় যে অঙ্কের উপর অঙ্কের দাগ বসাইয়া যাইতেছে, তাহার সবগুলি অক্ষর মহাজনের কণ্ঠস্থ। যদি বা কখনো এতটুকু ভুল হইবার উপক্রম হয় পাশের গোমস্তারা তাড়াতাড়ি করিয়া তাহা সংশোধন করিয়া দেয়।

সাহাপাড়া আসিয়া আজাহের দেখিল লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের নানা গ্রাম হইতে চাষী মুসলমান ও নমঃশূদ্রেরা এখানে আসিয়া ভীড় করিয়াছে। কেহ টাকা কর্জ লইয়া হাসিতে হাসিতে বাড়ি যাইতেছে। কেহ কর্জ টাকা দিতে আসিয়া সুদের অঙ্ক শুনিয়া মহাজনের পা ধরিয়া কঁদিতেছে, কেহ বউ-এর গহনা আনিয়া মহাজনের গদিতে ঢালিয়া দিতেছে। মহাজন নিক্তিতে করিয়া অতি সাবধানে সেই সোনা-রূপার গহনা মাপিয়া লইতেছে।

এইসব দেখিতে দেখিতে আজাহের শরৎ সাহার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। শরৎ সাহার বাড়িতে লোকজনের ভীড় খুব কম। কারণ কুলোকে বদনাম রটাইয়াছে “চীনা জেঁকে ধরিলেও ছাড়িয়া যায় কিন্তু খাতকের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকিতে শরৎ সাহা ছাড়ে না।” এত যে তার টাকা, কিন্তু সকালে একমুঠো চাউল মুখে দিয়া সে জলযোগ করে। বাজার যখন ভাঙ্গি ভাঙ্গি করে তখন শেষ বাজারে শরৎ সাহা যাইয়া পচা পুঁটিমাছ অথবা টাকিমাছ কিনিয়া আনে। এজন্য গৃহিণীর সঙ্গে তাহার প্রায়ই ঠোকাঠুকি লাগে।

বড় মেয়েটিকে বিবাহ দিয়াছে মানিকগঞ্জ গ্রামে। কাল জামাই আসিয়াছিল। এই খবর পাইয়াই শরৎ সাহা খিড়কীর দরজা দিয়া ভাঙ্গা ছাতির আড়াল করিয়া সেই যে সকাল বেলা তাগাদা করিতে ভাটপাড়ার গ্রামে গিয়াছিল আর ফিরিয়া আসিয়াছে রাত বারোটার সময়। শ্বশুরবাড়িতে দুপুর বেলায় শুকনো ডাটার ঝোল আর পচা আউস চাউলের ভাত খাইয়া জামাই চলিয়া গিয়াছে। অতরাত্রে বাড়ি আসিয়া গৃহিণীকে ঘুমাইতে দেখিয়া আহ্লাদে শরৎ সাহার নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। গৃহিণী জাগিয়া থাকিলে নথ-নাড়া দিয়া বকিতে বকিতে তাহাকে সারা রাত্রি ঘুমাইতে দিত না। না হয় সে সারাদিন খায় নাই কিন্তু রাত্রটা ত সে ঘুমাইতে পারিবে। এই আনন্দে কলসী হইতে তিন গ্লাস জল লইয়া এক মুঠি চাউলসহ গলাধঃকরণ করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু সকাল বেলা উঠিয়া গৃহিণীর হাত হইতে সে নিস্তার পায় নাই। যতই সন্ধ্যা আহ্নিক করার অজুহাতে সে মালা-চন্দন লইয়া জপে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করিয়াছে গৃহিণীর ঝঙ্কার ততই উদারা মুদারা ছাড়াইয়া তারায়–পঞ্চমে উঠিয়াছে।

পরে গৃহিণীর জ্বালায় অস্থির হইয়া সে বলিয়াছে,”ভাল মানুষীর বউ। একটু মন দিয়া শোন। জামাইর সঙ্গে যদি আমি দেখা করতাম তবে বাজারে যেতে হত। বড় একটা রুইমাছ না হলেও অন্ততঃ দেড় টাকা দিয়ে একটা ইলিশমাছ কিনতে হত। দুধও আনতে হ’ত। বলত পাঁচ টাকার কমে কি বাজার করতে পারতাম? আমার বুকের হাড্ডির মত এই পঁচটা টাকা বাজারে নিয়ে ঢেলে দিয়ে আসতে হত। এই পাঁচটাকা সুদে খাটালে পাঁচ বছরে দুশো টাকা হবে। দশবছরে হাজার টাকা হবে।”

গৃহিণী ঝঙ্কার দিয়া উত্তর করিয়াছে, “ওরে মুখ-পোড়া! টাকার প্রতি যদি তোর এত দরদ তবে মেয়ের জন্ম দিয়েছিলি কেন? শ্বশুর বাড়িতে শুকনো ডাটার ঝোল খেয়ে জামাই আমার মেয়েকে যখন খোটা দিবে তখন কি তোর টাকা তার উত্তর দিতে যাবে? আজ পাঁচ বচ্ছর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি, একখানা পান-বাতাসা হাতে করে মেয়েটাকে দেখতে গেলে না! মেয়েকে আনার নাম করলে ত চোখ চড়ক গাছ।”

শরৎ সাহা এবার রাগিয়া উত্তর করিয়াছে, “সব কাজেই কেবল তোমার খরচ করবার। মতলব। কিসে দু’টো পয়সা আসে সে দিকে খেয়াল নেই। ছিলে ত গরীব বাপের বাড়ি, এক বেলাও আখায় হাঁড়ি চড়তো না!”

তারপর গৃহিণীর সঙ্গে শরৎ সাহার যে ধরনের কথাবার্তা হইয়াছে পৃথিবীর কোন ভাষা তাহা ধরিয়া রাখিবার শক্তি রাখে না। নিতান্ত সাধারণ রুচির কষ্টিপাথরে ঘষিয়া মাজিয়া তাহার কিঞ্চিৎ আমরা লিপিবদ্ধ করিলাম।

“কি! তুমি আমার বাপের খোটা দিয়ে কথা বল? বলি ও যুয়ান কি শোগা! তোর মত বুড়ো শুশানের-মড়ার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে আমার বাপ-মা যে তোকে সাতকুলে উঠিয়েছে তা কি তোর মনে নেই? তোর ঘরে খেটে খেটে আমি জীবন ক্ষয় করলাম, একদিন একখানা ভাল শাড়ী কারে কয় দেখলাম না।”

“শাড়ীরই যদি দরকার তবে তোমার বাপ-মা তোমাকে তাঁতীদের বাড়ি বিয়ে দিল না। কেন?”

“তাও যদি দিত আমার শত গুণে ভাল হ’ত। তোর বাড়িতে এসে কোনদিন একটা মিষ্টি কথা শুনতে পেলাম না। দিনরাত তোর শুধু টাকা, টাকা, টাকা। বলি ও গোলামের নাতি! সারাদিন টো টো করে ঘোরো খাতকের পাড়ায় পাড়ায়, আর বাড়িতে এসে মহাজনি খাতা সামনে করে মরা-খেকো শকুনের মত বসে থাকো। বলি ও কুড়ের নাতি!–তোর ঐ খাতা পত্তর আজ আমি উনুনে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব।”

“আহা হা গিন্নি রাগ করো না। এই খাতা পত্তরগুলো হ’ল আমার বুকের পাজর। ওর পাতা ছিড়লে আমি বাচবো না। একটা কথা শোন–লোকে বলে শরৎ সাহা খায় না। তার শরীরে বল নেই। কিন্তু আমার বল যে ওই হিসাবের খাতাগুলো। ও গুলো দিনে দিনে। যত বাড়ে আমার বুকের তাগতও তত বাড়ে, একথা কেউ জানে না। এই খাতাগুলোর জোরে আজ আমি দশগ্রামের মধ্যে একটা কেউকেটা। আমার হুকুমে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তোমার যে দশটাকা ভাটপাড়া গাঁয়ে সুদে খাঁটিয়েছিলাম, চার বছরে তা বেড়ে একশ টাকা হয়েছে। কাল সেই টাকাটা পেয়েছি।”

“দাও তবে আমার সে টাকা। সেই টাকা দিয়ে আমি মেয়ের বাড়িতে তথ্য পাঠাব।”

“এইত, এই তুমি একটা নামাঙ্কুলের মত কথা বললে। টাকা কি আমি বাড়িতে নিয়ে এসেছি? তখন তখনই টাকাটা অপরের কাছে সুদে লাগিয়ে এলাম। বাড়িতে যদি নিয়ে আসতাম, সারারাত তাই পাহারা দিতে ঘুম আসত না। লোকে বলে, শরৎ সাহা লাখপতি না কোটীপতি, কিন্তু বাপের নাম করে প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি–জীবনে কোনদিন একত্রে পাঁচশত টাকার মুখও দেখি নি!”

“তবে তোমার অত মুরাদ কিসের?”

“আরে গিন্নি–একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। আমার লাখ টাকা আছে না কোটী টাকা আছে তা তোমাকে দেখাতে পারব না, কিন্তু আমার সারাটি জীবন ভরে পাওনাগণ্ডার হিসাব লিখে যত সব খাতা পত্তর লিখেছি তা মাটিতে বিছিয়ে দিলে গয়া, কাশী, বৃন্দাবন পর্যন্ত সমস্ত পথ আমি মুড়ে ফেলতে পারি। টাকা, টাকা, টাকা! টাকা ঘরে এনে কি হবে! টাকায় টাকা আনে। সেই জন্য টাকা ছড়িয়ে দিয়েছি। আমার পাঁচ’শ ঘর খাতক আছে সুন্দরবন অঞ্চলে। হাজার ঘর খাতক আছে বঙ্গোপসাগরের ওপারে কুতুবদিয়ার চরে। দশ হাজার খাতক আছে সন্দ্বীপে, ভাটপাড়া, মুরালদাহ, কত গ্রামের নাম তোমাকে বলবো। মুন্সীগঞ্জে ইকিড়ি মিকিড়ি কথা বলে, বেদের দল, নায়ে নায়ে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে আছে আমার বিশ হাজার খাতক। আর তুমি গিন্নি। তুলসীতলায় পেন্নাম করে আমার জন্য। দেবতার আশীর্বাদ এনো। আর যদি কুড়ি বছর বেঁচে থাকি তবে কৃষ্ণের গোলকখানি আমার খাতকে ভরে যাবে। জান গিন্নি সাধে কি লোকে বলে আমার নাম শরৎ সাহা!”

“পাড়ার লোকেরা বলে কি জান? সকাল বেলা উঠে তোমার নাম যদি মুখে আসে তবে সেদিন তাদের আহার জোটে না। কঞ্জুস যক্ষ কোথাকার! আমার কাশি দিয়ে রক্ত পড়ছে কতদিন। লোকে বলে যক্ষ্মা হয়েছে। আমার জন্য একফোঁটা ঔষধ কিনে আনলে না?”

“তোমাকে না বলেছিলাম রামেরাজকে ডেকে জল পড়িয়ে খেও। তা খাওনি? তোমার কেবল টাকা খরচের দিকে মন?”

“রামেরাজের পড়া জল ত কত খেলাম কিন্তু আমার অসুখ একটুও কমলো না। দেখ, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে একটু ভাল ঔষধ আনিয়ে দাও।”

“দেখ গিন্নি! টাকা পয়সা খরচের দিকে তুমি কিছুতেই আমাকে নিতে পারবে না। তোমার আগে আমি আরও দুই বিয়ে করেছিলাম। বড় জন বড়ই সুন্দরী ছিল। সান্নিপাতিক জ্বর হ’ল, মরে গেল, পয়সা খরচ করে ডাক্তার দেখালাম না। তারপর যিনি এলেন, তার ছিল বড় ঝুঁজ, এই তোমারই মতন, একদিন সিন্দুকের চাবি চুরি করে টাকা বের করে তার বাপকে দিয়েছিল। আমি তার মুখে কলকে পোড়া দিয়ে ছাপ লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেই লজ্জায় সে গলায় দড়ি দিয়ে মরল।”

“তারা মরে সকল জ্বালা জুড়িয়েছে। ওগো তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে গলাটিপে মেরে ফেল। তোমার মত কঞ্জুসের ঘর করার চেয়ে আমার মরাও ভাল। বলি ও মরা কাঠ! তোর ঐ টাকা কে খাবে? আমার এমন সুন্দর ছেলেটি পাঁচ বছর বয়সে বাড়ির এখানে সেখানে হরিণের মত ঘুরতো। ওলাউঠা ব্যারাম হোল। বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। পয়সা খরচ হবে বলে একজন ডাক্তার এনে দেখালে না।”

এমন সময় বাহিরে গলা খেকর দিয়া আজাহের ডাক ছাড়িল, “সা-জী মশায় বাড়ি আছেন নাকি?”

আজাহেরের কণ্ঠস্বর শুনিয়া গৃহিণী অন্দরে চলিয়া গেল।

বস্তুতঃ গৃহিণীর সঙ্গে উপরোক্ত বাক্যালাপ করিয়া শরৎ সাহার মেজাজ খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল কিন্তু খাতকের কণ্ঠস্বর যেন বাঁশীর স্বরের মত, তাহাকে আপন মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *