২৮. আর কেউ নাই, এইবার আমি একা

আর কেউ নাই, এইবার আমি একা

বাড়িতে আমি একা রয়েছি। আর কেউ নাই, আর কেউ থাকবে না। আজ দোপরের খানিক বাদে চেরকালের লেগে কাটান-ছিটেন করে। সব চলে গেল! ত্যাখন বাড়িভরা মানুষ ছিল। মনে হয় কেউ কেউ মজা দেখতে ই বাড়িতে ঢুকেছিল, অ্যানেকের দাড়ি-গোঁফের তলায় এট্টু এট্টু হাসি আমি দেখতে পেয়েছি।

কদিন ধরে জ্বর আসছে। ঘুষঘুষে জ্বর আর খুসখুসে কাশি। দোপরের পর থেকে মাথা টিপটিপ করে, সাঁঝবেলার মদ্যেই জ্বরটো চলে আসে। গা টিসটিস করে, জাড়-জাড় লাগে, রেতে অ্যানেকদিন খাই না। কাউকে কিছুই বলি নাই। আজ জ্বর এয়েছিল সকাল থেকে। মেয়ে এসে বলেছিল, মা, তোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? বললম, কই না তো। শুনে মেয়ে কাছে এল। ছেলেমেয়েরা কুনোদিন আমার গা-লাগোটা লয়। ওরা কেউ-ই তো শিশুকালে আমার হাতে খায় নাই, ঘুমোয় নাই। সেই লেগে ওরাও তেমন গায়ে-লাগা লয়, আমারও ছেলেমেয়েদের গায়ে মাথায় হাত দিতে কেমন লাগে। আজই দেখছি, মেয়ে একদম কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, মা, এখনো একবার ভেবে দ্যাখো। কাগজ-পত্র সব তৈরি হয়ে আছে, তুমি হ্যাঁ বলো। মা, তুমি যা করছ, তা কি কেউ কোনোদিন করে, না করতে পারে। কে কবে শুনেছে স্বামী ছেলেমেয়ে সবাই দেশান্তরী হচ্ছে আর শুধু মা তাদের সাথে যাচ্ছে না, সব ছেড়ে একা পড়ে থাকছে? আমাকে বলতে পারো কেন এমন করছ?

মেয়ে জড়িয়ে আছে, তবু ভেতরে ভেতরে আমি শক্ত হয়ে গ্যালম। একে তো ত্যাকন এট্টু জ্বর এয়েছে, আমি কথা বলতে পারছি না, চোয়াল আটকে আটকে যেছে। আমি বললম, ই নিয়ে আর কথা বোলো না, মা!

মা, তোমার গায়ে কি জ্বর?

না না, উ কিছু লয়।

আজ দশ বছর ধরে এই লতুন বাড়িতে আছি। সোংসার পেথক। হবার পর থেকেই ইখানে। এক সোংসারে থাকার সোমায় কত্তা যি একটো ভিটে কিনেছিল মাটির একটি ঘরসুন্ধু, সেই ঘরটি ভেঙে এই ভিটের ওপর একটি দোতলা কোঠাবাড়ি করা হয়েছিল। ভাইদের সোংসার আলো হয়ে যাবার কিছুদিন পরে লতুন বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে আমরা এখানে চলে এয়েছেলম। ত্যাকন থেকেই ফাঁকা বাড়িতে থাকার ওব্যেশ হয়ে গেল। ছত্রিশ জনার হৈ চৈ, চাঁ ঊ্যা-তে রাতদিন সরগরম সোংসার ছেড়ে এই বাড়িতে এসে পেথম পেথম আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। করার কিছু ছিল না। সসাংসার অ্যাকন ছোট, বলতে গেলে কত্ত আর আমি আর ছোট দুটি ছেলে। একটি গাঁয়ের স্কুলে পড়ে আর একটি খুব ছোট। বড় খোঁকা বাড়িতেই ত্যাকন থাকত। পাকিস্তান হবার পরে সে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে একটি চাকরি খুঁজতে লাগল। তাকে দেখতেই প্যাতম না, ন-মাস ছ-মাসে একবার বাড়িতে আসত। শোনলম, এখানে চাকরির বাজার খারাপ, সে চাকরি খুঁজতে পাকিস্তানে যাবে। তাপর সত্যি সত্যিই শোনলম সে পাকিস্তানে চলে গেয়েছে আর ঢাকায় একটি চাকরিও পেয়েছে। খুশির খবরই বটে, আমার পেথম পেথম তেমন কিছু মনে হয় নাই। কলকাতায় যাওয়া আর ঢাকায় যাওয়া ত্যাকন একইরকম লাগত। খোঁকা ঘন ঘন বাড়ি না এলেও বছরে একবার তো আসত। শোনলম, শুদু দূর এটু। বেশি, কলকাতা আর ঢাকায় তফাত কিছু নাই, যাতায়াতে সোমায় এট্টু বেশি লাগে এই যা।

এই যেদি হবে, পাকিস্তান হওয়া-না-হওয়াতে যেদি কুনো তফাত-ই না হবে তাইলে এমন রক্তগঙ্গা ক্যানে করলে সবাই? এত মানুষ মরল, এত মায়ের কোল খালি হলো, এত সোংসার জ্বলে-পুড়ে ছারেখারে গেল, ইসব কি এমনি এমনি! আর অ্যাকন যি হিঁদু-মোসলমানে চোখে চোখে তাকাইতে পারছে না? একই গাঁয়ে বাস করছে, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় একসাথে হচে, তবু সব সোমায়ে মনে মনে সন্দ হচে এই বুঝিন গলা কাটবে, এই বুঝিন বাড়িতে আগুন দেবে। ছি ছি, চেরকালের লেগে এমন ক্ষেতি করে সারা দ্যাশের মানুষের? আর কি করে তারা একে আরেকের পড়শি হয়ে বাস করবে?

এইসব কথা নিয়ে আমি মনে মনে তোলপাড় করতম বটে, কিন্তুক বাইরে থেকে কিছুই বোঝবার বাগ ছিল না। সবই আগের মতুন। নাপিতবউ আগের মতুনই বাড়িতে আসছে, হাড়িবউকে আজকাল আর আসতে হচে না বটে, বাড়িতে নতুন মানুষ অনেকদিন থেকেই আর নাই। আসবে কিসের লেগে? তবু শুদু কথা বলার লেগেই কখনোসখনো আসে। মজাক করে কথা বলে, ছেলেমেয়েরা থাকলে তারা দাইমা বলে ডাকে। সবই আগের মতুন। একদিন ল-দ্যাওরকে ডেকে বললম, খুব তো লড়কে লেঙ্গে করে পাকিস্তান করলে। সি দ্যাশটি কিরকম, কোথা সি দ্যাশ তা কি জানো? তা এত কষ্ট করে, মারামারি করে যি দ্যাশটি করলে, অ্যাকন সি দ্যাশে যাবে না?

খেপেছ?

ক্যানে, খেপেছ ক্যানে? এত লাফাইছিলে, অ্যাকন কি হলো?

আরে কি মুশকিল? পাকিস্তান যাব কেন? নিজের দেশ ছেড়ে?

তাইলে কার লেগে দ্যাশটি করতে গেয়েছিলে? কার লেগে অত দরদ ছিল গো তোমাদের?

ঠাট্টা করতে করতেই ইসব কথা বলছেলম বটে, কিন্তুক বলতে বলতেই কেমন চড় চড় করে রাগ চড়তে লাগল আমার। দ্যাওর বোধায় বুঝতে পারলে সি কথাটি, সে আর রা-কথা না করে সিখান থেকে চলে গেল। সে চলে গেলেও আমার বুকের ভেতরটা রি রি করতে লাগল। আসলে বড় খোঁকার ঢাকার চাকরি আমার ভালো লাগে নাই। কিন্তুক কাকেই বা কি বলব? সে তার বাপকেও চাকরির কথা কিছু শুদোয় নাই। চাকরি পেয়ে পেথম বার য্যাকন বাড়ি এল, আমিই তাকে জিগগাসা করলম, সবাই ইখানে, তুমি পাকিস্তানে চাকরি নিলে ক্যানে?

চাকরি একটা দরকার ছিল মা, পেলামই যখন, নোব না কেন?

তাই বলে ভিন্ দ্যাশে চাকরি করবে?

ভিন্ দেশ আবার কি?

ভিন্ দ্যাশ লয়? ভিন্ দ্যাশই যেদি না হবে, তাইলে উ দ্যাশের লেগে অত লড়াই করতে হবে ক্যানে? সহজে তো হয় নাই।

ও তুমি কিছু বোঝে না। সে অনেক ব্যাপার।

তা ঠিক, আমি সত্যিই বাবা কিছু বুঝি না! কিন্তুক ইটুকু তো দেখতেই প্যালম, কতো মায়ের বুক খালি হলো, কতো সোংসারে আগুন লাগল। অ্যাকন সব থেমে গেয়েছে, অ্যাকন বলছ উ কিছু লয়। তাইলে কি বাবা সারা দ্যাশের মানুষকে নিয়ে তামাশা করেছে সবাই?

এমন হয় মা, নতুন একটা দেশ করতে গেলে অমন হয়।

তাইলে ইসব কিছুই লয় বলছ ক্যানে? আমরা সবাই য্যাখন ই দ্যাশেই আছি, তুমি সেই ভিন্ দ্যাশে চাকরি নিলে ক্যানে?

তুমি কিছু ভেবো না তো মা। নামেই দুটো দেশ, কাজে এখনো একই আছে। তুমি ধরে নাও আমি এট্টু দূরে চাকরি করছি। কলকাতা থেকে বাড়ি আসতে যতো সময় লাগত, তার চেয়ে না হয় একটু বেশিই লাগবে।

খোঁকার সাথে এইসব কথা হয়েছিল সেই কতোদিন আগে! সাত-আট বছর আগে। খোঁকা ত্যাকন কিছুই বোঝে নাই, আমিও কিছু বুঝি নাই। মনে হয়েছিল, হোকগো পাকিস্তান, এই তো বেশ চলছে দুই দ্যাশ। তেমন কিছু তো এই গাঁয়ে-ঘরে বুঝতে পারছি না। হলে হোকগো পাকিস্তান। কিন্তু বেশিদিন গেল না, দু-তিন বছরের ভেতরেই শুনতে প্যালম, আবার ভায়ানক মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি লুট হচে, সোনা-দানা ধনসম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করছে। শহরেগঞ্জে, টেরেনে, ইস্টিমারে মানুষ মেরে মেরে গাদা করছে আর হাজারে হাজারে মানুষ ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেছে, উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে আসছে। ই দ্যাশ থেকে কজনা যেছে জানি না, উ দ্যাশ থেকে লিকিন বেসুমার মানুষ সব্বস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে। কলকেতায় ইস্টিশানে ইস্টিশানে লিকিনি মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নাই। আকালের সোমায় য্যাতত লোক গেয়েছিল কলকাতায়, আকন তার চেয়ে অ্যানেক বেশি মানুষ সিখানে গিজগিজ করছে। এইসব শুনে এতদিনে মালুম হতে লাগল যি দুটি আলেদা দ্যাশ হয়েছে বটে! আরও ভালো করে চালুম হলো, যিদিন শোনলম খোঁকা ইবারের ঈদে বাড়ি আসতে পারছে না। বকরিদে আসতে না পারলেও এতদিন ফি ঈদে সে বাড়ি আসছিল, বিয়ে হয়ে বউ নিয়ে যাবার পরেও সবাইকে নিয়ে আসছিল। ইবার আর আসতে পারবে না। পাপোট না কি চালু হয়েছে, সেই বই সরকার না দিলে কেউ উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে কিম্বা ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেতে আসতে পারবে না।

কপাল এমনি বটে! একমাত্তর মেয়ের বিয়ে হলো ইখানে। কিন্তুক বিয়ের কদিন বাদেই শোনা গেল, জামাই বড় চাকরি পেয়েছে পাকিস্তানে। বিয়ে য্যাকন হয়েছিল, ত্যাকননা ঐ পাস্‌পোট না কি বলে হয় নাই। তারাও যেছিল আসছিল, ইবার আর তারাও আসতে পারছে না।

এইসব ঘটার পরে আর কোথা কি হয়েছে জানি না, আমার সংসার বড্ড ফাঁকা হয়ে পড়ল। খালি ছেলেদুটি। একজনার স্কুলের পড়া শ্যাষ হলো-হলো, আর একজনা খালি স্কুলে ঢুকেছে। দ্যাশ আলেদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলেমেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল আর আলেদা দ্যাশের লেগে যারা লাফাইছিল তারা যেমনকার। তেমনিই রইল। বিনা কারণে শুদু হিঁদু-মোসলমানের মাঝখানে একটা ছোঁয়া পড়ে গেল। সেই ছেয়া আর কুনোদিন গেল না। কুনোদিন যাবে কিনা তা জানি না।

আমার যে মেজ খোঁকা গাঁয়ের স্কুলে পড়ছিল, সে একদিন স্কুলপাশ দিলে। কাগজ হাতে করে যিদিন কত্তা বাড়ি ঢুকে আমাকে দেখাইলে খোঁকা ভালো করে পাশ দিয়েছে, সেইদিনই বৈকাল বেলায় শহরে ছোট দ্যাওরের কাছে তারে খবর এল আমাদের একটি লাতিন হয়েছে। একই দিনে দুটি ভালো খবর। ছেলে বড় স্কুলের পাশ দিয়েছে সি খবর ভালো বৈকি, কিন্তুক আমাদের লাতিন হয়েছে, আমাদের একমাত্তর মেয়ের একটি মেয়ে হয়েছে, ই খবরের কি তুলনা আছে? সাত রাজার ধন মানিক হাতে পেলেও ই খবরের কাছে সি কিছুই লয়। সারা দুনিয়ায় ঢোল পিটিয়ে ই খবর জানাইলেও যি আশ মেটে না আর সেই খবর কিনা তারে জানতে পারলে দাওর আর সে খবর নিয়ে নিজে আসতেও পারলে না, একটো লোক জোগাড় করে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলে। কেউ কোথাও নাই, কেউ এল না ই বাড়ি, নথ নেড়ে নেড়ে, হাসতে হাসতে দাইবউ সোনার মাকড়ি চাইলে না, গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল না। বাড়ির পেথম লাতিন! হায় রে হায়, বাপের সোংসার, ভাইয়ের সংসার, কত্তার সোংসার সব ভেঙে খান খান। এখন আমি ভালো খবর নিয়ে কি করব?

সাঁঝবেলায় একটি হেরিকেন জ্বালিয়ে দখিন উসারায় বসে আছি। কত্ত-ও আছে। ছেলেদুটিই বাইরে। এখনো ফেরে নাই। মেজ খোঁকার আজ সাত খুন মাপ, কত্তার হিশেবে ছেলে য্যাখন স্কুলপাশ দিয়েছে ত্যাখন বড় হয়ে গেয়েছে, আর তাকে বকাবকি করা যাবে না। সে আজকে পাশ করার খুশিতে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াইছে।

হঠাৎ আমি ক্যানে যি কঁদতে শুরু করলম জানি না। দুই দুটো এমন খুশির খবরে কেউ কুনোদিন কাদে? কিন্তুক বুকের তলা থেকে গুমুড়ে গুমুড়ে ক্যানে এমন কাঁদন আসতে লাগল কে বলবে? আমার কেউ নাই, ই দুনিয়ায় কেউ নাই, এত থাকলেও আমার কিছু নাই। পশ্চিম আসমানের দিকে তাকিয়ে মনে হল সি আসমানও ধু ধু করছে, চাঁদ নাই, তারা নাই। কাঁদন শুনে কত্তা চুপ করে বসে থাকলে, একটি কথা বললে না। আমাকে কত্তা আজকাল আর কিছু বলে না! কি জানি, পুরুষমানুষ বলে সে কি আমার মতুন কেঁদে হালকা হতে পারে না?

কদিন বাদে পাকিস্তান থেকে মেয়ের চিঠিতে তার খুঁকি হবার খবরএল। সি চিঠিও কাঁদনের চিঠি, মেয়ের পেথম সন্তান তো বাপের বাড়িতেই খালাস হয়, তা তার ভাগ্যে নাই, তার মেয়ে হয়েছে হাসপাতালে। মেয়ে কালো হয়েছে, কালোর ছটায় ভোবন ভাসছে। অনেক কথা লিখেছে, তার পরে লিখেছে একটি সাংঘাতিক কথা। লিখেছে, মেজ খোঁকা আর তো গাঁয়ে থেকে পড়তে পারবে না, তাকে ছাড়তেই হবে, সে নাইলে খুঁকির কাছেই যেয়ে পড়ুক। জামাই তো কলেজের মাস্টার, খুব সুবিধে হবে, বুনকেও তাইলে আর একা থাকতে হয় না, লতুন খুঁকিও তাইলে মামু পায়।

না, আটকাইতে পারলম না! দুই দ্যাশ আলেদা হবার আমি কিছুই বুঝি নাই, কিছুই বুঝি নাই! ঘর বাড়ি সোমাজ সোংসার সব ভাঙতে ভাঙতে সাত টুকরো হবে; ঘটি-বাটি ভাঙবে, বাসো প্যাটরা ভাঙবে। অ্যাকটো গোটা মানুষও আর গোটা থাকবে না, আমিও থাকব না, কত্তাও থাকবে না। কত্তা এইবার দুটো হবে।

ঠিক তাই হলো। কত্তা আমাকে বেশি কথা বললে না। মেজ খোঁকাও বেশি কিছু বললে না। সে অ্যাকন অ্যাকটো গোটা মানুষ। এই তার স্বাস্থ্য, এই জোয়ান। যেন অন্য মানুষ। আমারই কোলে এতটুকুন ছিল, আমারই বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে, কিছুতেই বিশ্বেস হয় না। অচেনা লাগছে, কথা বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। বুঝতে পারছি, এখন আর আমার কাছে কিছু থাকার সোমায় লয়, আমার কাছ থেকে সব চলে যাবারই সোমায়।

কথা আর কত বলব? দশদিনের মদ্যে সব বেবস্থা করে মেজ খোঁকা পাকিস্তানে তার বুনের কাছে চলে গেল। পুরনো দিনের সব কথা য্যাকন বলতেই বসেছি, ত্যাকন আর কপাল চাপড়ে কি হবে, এইখানেই বলে রাখি সব শ্যাষের আঘাতটো দিলে বড় খোঁকা। জেনে লয়, ইচ্ছে করে লয়, দিলে দুনিয়ার লিয়মে। দিন চেরকাল কারুর হাতে বাঁধা থাকে না, জেবনের কিছুদিনের লেগে কিছুদিন তাবে থাকে, তাপর হাতছাড়া হয়ে যায়। আমার দিনও এইবার হাতছাড়া হতে লেগেছে, দিন আর অ্যাকন আমার লয়। বড় খোঁকা জানাইলে, সোংসারে সে কুনোদিন কিছু করতে পারে নাই, কুনো কাজেই লাগতে পারে নাই, এখন আর তার কিছু করারও নাই, তাকে পাঁচে-পেরকারে বাস করতে হচে আর এক দ্যাশে। কুনোদিন আর ফিরতে পারবে না। আর কিছু না পারুক, অ্যাকন সে নিজের ছোট ভাইটিকে মানুষ করার দায়িত্ব নিতে চায়। তাকে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সে-ই তার ল্যাখাপড়ার দায় নেবে।

পানি কুনোদিন ওপরদিকে গড়ায় না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় কই ই দ্যাশের অ্যাকটো মোসলমানকে পাকিস্তানে যেতে দেখলম না। গেয়েছে কিনা আমি কি করে জানব? ই এলেকায় তো দেখলম না। কিন্তুক বড়লোক আবস্তাপন্ন মোসলমানদের লেগে ভালো ঢল নেমেছে পাকিস্তানের দিকে, অ্যানেক মোসলমানই সিদিকে গড়িয়ে যেচে। আমার ছোট খোঁকাটিও একদিন গড়গড়িয়ে চলে গেল। ভালো হলো কি মন্দ হলো, সিকথা আমি বলতে পারব না, শুদু জানলম আমার সব খালি হলো, সাথে আর কাউকে পাব না। এই খালি সসাংসারে একা বসে থাকব। কথাটো কি ভুল হলো আমার? কত্তা তো আছে এখনো! তবে খুব ভুল বোধায় লয়। কত্তা কি আছে আমার? ভেতরে ভেতরে তা মনে হয় না!

পুরনো বাড়ি আমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে এট্টু দূরে। সি বাড়ি অ্যাকন আর একটি বাড়ি লয়, ভেঙে ভেঙে অ্যানেক বাড়ি হয়েছে। সবার খুব খোঁজ খবর নিতে পারি না, তেমন কেউ আসে না, ই বাড়িতে, আমিও যেতে পারি না। আছে সবাই আপন আপন ঘর-সংসার নিয়ে। শুদু বেধবা ননদটি থাকে একদম একা। ভাগ্নেদুটির কেউ অ্যাকন আর থাকে না তার কাছে। বড়টি চাকরি করে শহরে, ছোটটি স্কুলপাশ দেবার পরে নিজেদের বাড়িতে চলে গেয়েছে। ননদ তার বরাদ্দ ঘরটিতে একা থাকে। চল্লিশজনার সোংসারে যে ছিল মাহারানী, বারো-চোদ্দটি ছেলেমেয়ে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছে যার কাছে, আকন আর কেউ তার কাছে যায় না। সারাদিনে একটি শিশু তার কাছে খাবার চায় না, তাকে জড়িয়ে ধরে তার শাদা কাপড় ময়লা করে দেয় না, কুনো ভাই তাকে ডেকে একটি কথা জিগাসা করে না। খুব খারাপ একটি রোগে ধরেছিল তাকে। ঘন ঘন পেশাব হতো, খুব খেতে মন হতো, দিন দিন রোগা হয়ে যেছিল।

আমি বোধায় সাত-আটদিন খবর নিতে পারি নাই। সিদিন সকালবেলায় শোনলম, ল-বউ দেখেছিল ননদের ঘরের দরজা ঠেসানো রয়েছে যেমন পেত্যেকদিন থাকে। বউদের মদ্যে ল-বউ এট্টু খোঁজ-খবর করত, দিনে দু-একবার যেত ননদের ঘরে। ইদিকে সকাল গড়িয়ে দোপর হয়ে যেছে। গিন্নি ঘরের বার হচে না। ত্যাকন উকি মেরে দেখে, কাত হয়ে গিন্নি পড়ে আছে, মরে একেবারে কাঠ। বোধায় মরার আগে পানি খেতে গেয়েছিল, কাঁসার গেলাসের পানি সারা ঘরে গড়িয়ে পড়েছে, খালি গেলাসটো বালিশের কাছে পড়ে আছে। কখন জান। গেয়েছে কে জানে? আধশোয়া মড়া ঐ আবস্তাতেই শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেয়েছে, মুখের ওপর দিয়ে কালো পিঁপড়ে চলে বেড়াইছে। ল-বউ বললে ঠিক শোবার সোমায়ে সে গিন্নির ডাক শুনতে পেয়েছিল, তার নাম ধরেই ডাকছিল, তা উ রকম করে সব সোমায়ই ডাকত, সে আর গা করে নাই–হায় হায় গো, মরার আগে মুখে এট্টু পানি পয্যন্ত পড়ল না–এই কথা বলে ল-বউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আর কতো বলব! কথার তো শ্যাষ নাই, তার চেয়ে বরঞ্চ অ্যাকন যি কথাটি বলতে বসেছি সেই কথা বলি। এই কথাটির পরে আমার আর কুনো কথা নাই। এই শ্যাষ কথাটি বলার লেগেই তো এত কথা বললম। সব মানুষেরই একটি করে শ্যাষ কথা থাকে, সেই কথাটির লেগেই তো সারাজেন।

ছেলেমেয়েদের পাকিস্তান যাওয়া ত্যাকন সাত-আট বছর হয়ে গেয়েছে। মেজ খোঁকার ল্যাখাপড়া পেরায় শ্যাষ, সে লিকিন কুনো অ্যাকটো চাকরিতে ঢুকবে ঢুকবে করছে। ছোট খোঁকাও স্কুলে ভালোই ল্যাখাপড়া করছে। আমি ত্যাততদিনে বুঝে গেয়েছি ওরা কেউ-ই আর ই দ্যাশে ফিরবে না। এই সোমায় একদিন সাঁঝবেলায় কত্তা আমাকে বেশ তোয়াজ করে তার পাশে বসাইলে।

বড় খোঁকার একটি চিঠি এসেছে–কত্তা বললে। চিঠি তো মাঝে মাঝেই আসে, দরকার মনে করলে কত্তা পড়তে দেয়, নাহলে দেয় না, শুধু বলে চিঠি এয়েছে, সবাই ভালো আছে। আজ দেখছি, কত্তার। হাতেই চিঠিটো ধরা। বললম, তা সবাই ভালো আছে?

আছে। বড় খোঁকা একটি কথা লিখেছে।

কি কথা? খারাপ কুনো-কথা?

না, না, তা নয়।

কুনো কিছু নিয়েই তো কত্তা কুনোদিন এমন করে না। আজ এমন লুকোচুরি ক্যানে করছে? আবার আমি বললম, তবে?

বড় খোঁকা লিখেছে, সবাই এখন পুব-পাকিস্তানে। হিঁদুদের দেশ, মুসলমানদের দেশ এসব কথা এখন আর নাই। হিঁদুস্থান পাকিস্তান সবাই মেনে নিয়েছে। কথা তা নয়, ছেলেমেয়ে নাতিনাতিন সবাই যখন আর এক দেশে থিতু হয়েই গিয়েছে, তখন আমরা বাপ-মা এখানে একা পড়ে আছি কেন। জমি-সম্পত্তি ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করে আমরাও তাহলে ওদের কাছে চলে যাই।

মাথায় আমার বাজ পড়ল। এমন কথা কুনোদিন শুনব বলে মনে করি নাই। ই কথার মানে কি একবার ভাবতে গ্যালম। পিথিমি ঘুরে উঠল আমার চারপাশে, তাড়াতাড়ি মেঝে আঁকড়ে ধরলম। কোথা যাব, আমি কোথা যাব? মরে গেলে কোথা যাব তা জানি, কবরে যাব, আমাদের এই নতুন বাড়ি থেকে দিঘির উঁচু পাড়ের কবরস্থান দেখতে পাওয়া যায়, মরে গেলে ঐখানে যাব কিন্তুক ই দ্যাশ ছেড়ে কোথা যা আমি কিছুতেই ভাবতে পারলম না। আমার খালি মনে হতে লাগল, ক্যানে যাব কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিক। বুঝিয়ে দিলেই আমি যাব, যেখানে যেতে বলবে সেখানে যাব। ওটো মোসলমানদের দ্যাশ আর এটো হিঁদুদের দ্যাশ ই কথা বলে আর কেউ আমার কাছে পার পাবে না। উ যি মিছে কথা, উ যি শয়তানদের কাজ তা অ্যাকন মনে মনে সবাই জানছে। যাদের জান গেয়েছে তারা আল্লার কাছে ফরিয়াদ করে জানতে চাইবে, যারা ভিটেমাটি দ্যাশছাড়া হয়েছে তারাও আল্লার কাছে এই ফরিয়াদ করার লেগে রপিক্ষে করছে। আমি এই কথাটিই কত্তাকে বললম, বড় খোঁকা যা ভালো বুঝেছে বলেছে, তুমি চেরকাল আমাকে সবকথা বুঝিয়ে বলেছ, তুমি অ্যাকন আমাকে বুঝিয়ে দাও, ক্যানে যাবে?

বোঝার কি আছে? ছেলেমেয়ে নাতিপুতি সব যেখানে আছে, সুখে-স্বচ্ছন্দে আছে, ঘরবাড়ি করেছে, সেখানে তাদের কাছে আমরা যাব না?

না, যাব না। ছেলেমেয়েরা করেছে তাদের নিজেদের জেবনের লেগে, তাদের ছেলেমেয়েদের লেগে। আমরা সিখানে যেয়ে কিছুতেই জোড় মিলব না। সি ফাটল তুমি ভরাইতে পারবে?

আহা, আমাদের জীবন তো শেষ। আর আমাদের করার কিছুই নাই।

শ্যাষ তো ভালো কথা। শ্যাষ ইখানেই হবে। শ্যাষ হবার লেগে বিদ্যাশে যেতে হবে ক্যানে?

এমন করে মুখে মুখে তক্ক আমি কুনোদিন কত্তার সাথে করি নাই। কিন্তু আল্লা জানে আমি তক্ক করি নাই, কত্তার মুখে মুখ করি নাই। আমার বিশ্ব-বোম্ভান্ডাে ভেঙে যেচে যি। আমি যি শতেক চেষ্টাতেও কত্তার কথা মেনে নিতে পারছি না? জানের ভেতর থেকে যি কথাগুলিন আসতে লাগল, আমি সেই কথাগুলিন বলতে লাগলাম আর এককথা দুকথা হতে হতে আসল কত্তা বেরিয়ে এল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বললে, চিরকাল আমি যা করব বলে ঠিক করি, তাই করি। কারুর কথা আমি শুনব না, আমি সব বেচেকিনে পাকিস্তান চলে যাব।

সি তুমি যেতে পারো তবে চেরকাল তুমি যা ঠিক কর তাই হয় না। তুমি অ্যানেক কিছু ঠিক কর নাই, কিন্তুক তাই হয়েছে। তুমি পাকিস্তান হওয়াও ঠিক কর নাই, তোমার সোংসার ভাঙাও ঠিক কর নাই। কিন্তুক উসবই হয়েছে। পিথিমিতে যত জোর তোমার নিজের পরিবারের ওপর। আর একটি মানুষও তুমি পাও নাই জোর খাটাবার লেগে। তা ইবার আমি বলছি, বড় খোঁকা য্যাতেই বলুক, আর তুমি য্যাতো জোরই খাটাও, আমি যাব না।

রাগে জ্বলে ওঠার আগে কত্তা আর একবার নরম হলো, তোমার একটিমাত্র মেয়ে, সেই মেয়েটির মুখ মনে করো, তার কোলে যে খুকিটি এসেছে, তোমার বড় খোঁকার যে ছেলে হয়েছে–তোমার নিজের নাতিপুতি, তাদের মুখ মনে করো, ছেলেগুলির মুখ ভাবো।

এই পৃথিবীতে আর কি আছে তোমার?

চেরকাল তাদেরই মুখ মনে করেছি, চেরকাল তাদেরই মুখ মনে করব। মন করলে এইবার তারা একবার আমার মুখের দিকে দেখুক। তাদের মুখ মনে করতে আমাকে তাদের কাছে যেতে হবে ক্যানে? আমার বড় খোঁকার মুখ আজ কতকাল দেখি নাই, আর দেখব-ও কুনোদিন। তা সি মুখটি কি কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পেরেছে?

কথা শুনে আর একবার কত্তা নরমসুরে বললে, নিজের নাতি-নাতনির কাছে যাবে না এমন আজগুবি কথা কেন বলছ তুমি? সেখানে গেলে আবার তোমার সব হবে। নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।

ঐ লোভ আমাকে তুমি আর দেখিয়ো না। চারাগাছ এক জায়গা থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না।

কত্তা অবাক হয়ে বললে, তুমি আবার এত কথা কবে শিখলে?

রাগ আমারও হলো, বললম, এতকাল যা শিখিয়েছ তাই শিখেছি, যা বলিয়েছ তাই বলেছি, অ্যাকন একটি-দুটি কথা আমি বোধায় নিজে নিজে শিখেছি।

এই কথার পরে পাকা একটি বছর গেল। কেমন করে যি গেল সি একমাত্তর আমি জানি। একটির পর একটি বড় খোঁকার চিঠি আসে–খুঁকির চিঠিও আসে দু-একটি। চিঠি এলে কত্তা কখনো আমার সাথে কথা বলে, কখনো বলে না। কথা বলবে কি, দু-এক কথা হতে না হতে তকরার শুরু হয়ে যায়, কত্তা ত্যাকন মুখে যা আসে, তাই বলে। একবার খুব সোন্দর একটি কথা বললে, শুনে ভারি আমোদ প্যালম। কত্তা বললে, তোমাকে আমি পরিত্যাগ করব। একবার বললে, দেখি, তুমি কি করে এখানে থাকো। সব বেচেকিনে চুকিয়ে তবে যাব।

মুখে মুখে ঐ মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলব সি আমার সাধ্যি কি? আমি একবারও মনে করি নাই যি আমার কথা দিয়ে কত্তার কথা কাটব। আমার শুদু মনে হছিল, কত্তা যাই বলুক আর যাই করুক, আমার কথাটি আমাকে বলতেই হবে আর সেই কথার মতুন কাজ আমাকে করতেই হবে।

শ্যাষ পয্যন্ত কত্তা একদিন বললে, আর এই নিয়ে একটি কথা আমি তোমাকে বলব না। তোমার মতের আর কোনো দরকার নাই। জমি-জমা বদলের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। একটি বাড়ির ব্যবস্থাও হয়েছে। বাকি আছে আমাদের এই বাড়িটির বিলি-ব্যবস্থা। থাকো তুমি তোমার গোঁ নিয়ে। যাবার দিনে ঠিকই যাবে তুমি।

কথা শুনে খুব নজর করে আমি আমার সারা জেবনের মানুষটির মুখের দিকে চেয়ে থাকলম, কেমন ধুলোর আড়ালে আঁদার আঁদার লাগল। মুখটো। বুঝতে পারলম, কত্তা মিছে কথা বলছে না, আমাকে হুমকিও দিছে না। কিছুদিন থেকে খুব শহরে আনাগোনা করছিল। পাকিস্তান থেকে আসা একটি হিঁদু পরিবারের সাথে বদলের কথা হচে। ধুতি-পরা কেমন একধারা একটি লোক আজকাল পেরায়ই বাড়িতে আসছে।

এইবার আমার সাথে কত্তার কথার শ্যাষ দিনটির কথা বলি। সাঁঝের খানিক পরে কিছুই যেন হয় নাই এমনি ভাব করে হেরিকেনের আলোটো এট্টু বাড়িয়ে দিতে দিতে বললে, ব্যবস্থা সব হয়ে গেল। এই রোববারের পরের রোববারে যাওয়া। বড় খোঁকা আসতে পারছে না, ওদিকের সব ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে তো। খুকি আসছে তার মেয়েকে নিয়ে। মেজ খোঁকা আসছে তার সঙ্গে। এক্ষুনি সবার আসার দরকারই বা কি। আসা-যাওয়া তো বন্ধ হচ্ছে না। এখন এই বাড়িটা

সেইখানেই বসে পড়ে আলো-আঁধারিতে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে আমি বললম, কেমন করে বললম আমি জানি না, বললম, এই বাড়িটিতে আমি থাকব।

কে যেন থাবড়া মেরে কত্তার মুখ বন্ধ করে দিলে। জেবনে এই পেথম আমি আমার সোয়ামিকে এমনি করে মারলম, আলো-আঁদারির চেয়েও আঁদার হয়ে এল কত্তার মুখ। খুব, খুব কষ্ট সিখানে। তবে সে আর কততক্ষণ? তখুনি পুরুষ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যেখানে খুশি চলে যাও, যেখানে খুশি থাকো গা, এই বাড়ির বদলি-দলিল হয়ে গিয়েছে।

ও কথা শুনেও আমি আমার কথা থেকে সরলম না, এই বাড়িতেই আমি থাকব। আমাকে হাতে ধরে বাড়ির বার করে দিলে তবে আমি যাব।

 

আর কুনো কথা হলো না। আর তো কথার কিছু নাই। আমিও আর কুনো কথা বলব না। কতো লোক এল, কতো কথা চলল, কতো বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে লাগল। ভাইরা সব দলবেঁধে এল, ঝগড়াঝাটি, কাদাকাটা কিছুই বাদ থাকল না। ছোট ভাইটি মাটিতে মাথা কুটতে লাগল। জায়েরা এসে সব আমার গলা জড়িয়ে কেঁদে গেল, রাজ্যের জিনিশ বাঁধাছাঁদা হতে লাগল, কিছু জিনিশ ফেলা গেল। কিছু জিনিশ দান-খয়রাত হলো। মোট কথা দশদিন ধরে বাড়িতে ম-হা-জ্ঞ হতে লাগল। মুখ বুজে, ঠোঁট টিপে আমি সব কাজে থাকলম। তাপর খুকি আসার ঠিক আগের দিন সকালে কত্তা এসে আমার সামনে দাঁড়াইলে। জেবনে এই কত্তা কারুর কাছে মাথা নামো করে নাই। আজ দেখলম আমার ছামনে মাথাটো হ্যাট করে দাঁড়াইলে। শরমে আমি মরে গ্যালম।

তুমি যাবে ধরে নিয়ে ব্যবস্থা করা আছে। কি করছ একবার ভেবে দেখবে না? এমন কাজ কি কেউ কুনোদিন করেছে? যে শুনবে সেই ছি ছি করবে, আমাদের সকলের মুখে চুনকালি পড়বে।

বাড়িটো বিক্কিরি হলো, না বদল হলো?

কোনোটাই এখনো হয় নাই।

ক্যানে?

কত্তা আমার মুখের দিকে একদিষ্টে তাকিয়ে থাকলে, তাপর আস্তে আস্তে বললে, বলতে যেয়ে তার চোখমুখ কুঁচকে গেল, যদি কিছুতেই না যাও, বাড়িটি এইরকমই থাকবে আর তোমার দাদির দেওয়া জমিটাও বদল হবে না।

 

অন্যদিন জ্বরটা আসে দোপর থেকে, আজ এয়েছে সকাল থেকেই। বাড়িতে সারা গাঁয়ের মানুষ। হাজার বছরেও যি এমন ঘটনা ঘটে নাই। যা হতে লাগল সি আর বলার লয়। বুড়ো বুড়ো মানুষ সব কেউ কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, কেউ গা ছাড়তে বারণ করে, কেউ। শাপ দেয়। যার যেমন মনে হচে করছে। ভেতরে ভেতরে ঘুষঘুষে জ্বর নিয়ে আমি আর নিজের দ্যাহটিকে টানতে পারছি না। একবার দেখলম, কত্তামার ছেলেরাও এয়েছে। কত্তামা কবে গত হয়েছে। তার ছেলেদেরও দেখলম একটি-দুটি চুল পেকেছে। যা হয় তোক আমি একদিকে সরে গ্যালম।

হেঁশেলে যেয়ে বসে আছি, তখুনি মেয়েকে নিয়ে খুঁকি আমার কাছে এয়েছিল। তার সাথে কি কথা হলো তা তো খানিক আগেই বললম। খুব কঁদছে দেখে তাকে আমি আবার বললম, মা, তোমরা যা মনে করছ তা কিন্তু ঠিক নয়। আমি জেদ করে যেচি না মনে কোরো না। তুমি আমার জানের টুকরো, বড় সাদনা করে তোমাকে পেয়েছি মা, তোমার এই কন্যে আমার সাত-রাজার ধন মানিক। বলতে বলতে এইবার আমার চোখ দিয়ে দরদরিয়ে পানি গড়াইতে লাগল। সি পানি মোছলম না, সেই পানির সাগরের ভেতর দিয়ে মেয়ে-নাতিনের আবছেয়া মুখ দেখতে দেখতেই বললম, সব ঠিক আছে মা, তোমাদের সাথে যেচি না বলে মনে কোরো না তোমাদের আমি চেরকালের লেগে জান থেকে বিদায় দেলম। আমি জানব, ছেলেমেয়ে সব-সোমায় কাছে থাকে না, তাদের আলেদা জেবন, আলেদা সোংসার, একসাথে থাকবে ক্যানে? আগেও যেমন যেতে-আসতে, অ্যাকননা তেমনি আসবে-যাবে। এতগুলিন কথা বলে আমি চোখ মুছে তাদের দিকে তাকালম। দেখি, খুঁকির চোখেও অ্যাকন আর পানি নাই। আমি তাদের দুজনাকে ধরে চুমো খেলে খুঁকি মেয়েকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে গেল।

দুপুর গড়িয়ে বেলা আর একটু পড়ে এলে রওনা হয়ে যাবার সোমায় হলো। ত্যাখন ভেতরে ভেতরে বোধায় ভাবলম, মেজ খোঁকা কি একবার আসবে না? না এলে সি ভালো! তবে একবার কি সে আসবে না? এই ভেবে চোখ তুলতেই দেখি, সামনে মেজ খোঁকা। সে কিন্তুক হাসছে। সোজা আমার কাছে এসে বললে,, আমি সব জানি। তোমাকে নিয়ে সবাই পিড়াপিড়ি করছে। আমারও করা উচিত ছিল, করি নাই। এখনো আমি তোমাকে একটুও জোর করব না। শুধু ঠিক করে বলো তো মা, তুমি এই কাজটি করলে কেন? অত জোরই বা কিসের তোমার? এই কথাটা জানতে আমার খুব মন হচ্ছে।

সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝাইতে পারে নাই। পেথম কথা হচে, তোমাদের যি একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুদু ধম্মে আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়। শুদু ধম্মাের কথা বোলো না বাবা, তাইলে পিথিমির কুনো দ্যাশেই মানুষ বাস করতে পারবে না।

মেজ খোঁকা আমার কথাগুলিন যেন গিলছিল। আমার বলা হয়ে গেলে সে শুধু বললে, মা তোমার কথা ঠিক, তবে আরও কথা আছে।

তা থাকুকগো, তা নিয়ে আমার দরকার নাই। আমি এই বুঝি যি ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে আজকালকার দিনে আর কাছে থাকতে পারে না। কাছে রাখতে গেলেই তারা আর বড় হতে পারবে না। দিনকাল বদলাইছে, তাদের ছেড়ে দিতেই হবে। তাদের জেবন আলেদা হবে, সোংসার আলো হবে। তার লেগে আমি ক্যানে,আমার বাড়ি, আমার দ্যাশ ছাড়ব? আমি জানব তোমরা সবাই দূরে গেয়েছ। বিদ্যাশ বলে যেদি না মানি, তাইলে তোমরা যতো দূরে গেয়েছ তার চেয়ে অ্যানেক অনেক বেশি দূর তো ই দ্যাশেই যেতে পারতে। বছরে একবার দুবার মা-কে দেখতে এসো, তাইলেই হবে।

ইচ্ছা করেই কত্তার কথা আর তোললম না। মেজ খোঁকা কিন্তুক হাসিমুখেই বিদায় নিলে। আমি তার পেছু পেছু এসে দেখলম, মালবোঝাই তিনটো গরুর গাড়ি রওনা হয়ে গেয়েছে। নাতনিকে নিয়ে খুঁকি আর একটি গাড়িতে উঠতে যেচে। একবার আমার দিকে তাকাইলে। কত্তাও গাড়ির দিকে যেছিল, কি মনে করে হঠাৎ ফিরে এসে আমার কাছে দাঁড়াইলে, লহমার লেগে তাকাইলে আমার মুখের দিকে, তাপর আবার গাড়ির কাছে ফিরে গেল। কত্ত কবে ফিরবে? এক মাস পরে? দু-মাস? একবছর? দু-বছর? তিনবছর? ফিরবে না কুনোদিন?

এই দোতলা মাটির বাড়ি খুব বড়। একতলায় চারটো ঘর, দোতলায় চারটো ঘর। কটো আর ব্যাভার করতে পারি? দু-একটো বাদে বাকি সব ঘরই পড়ে থাকে। দোতলার একটি ঘরে অ্যাকনো জানেলা বসানো হয় নাই। শুদু এই জানেলা ক্যানে, অ্যানেক জানেলাই অ্যাকনো লাগানো হয় নাই। ভেতরের দিকে অ্যানেক দরজাও নাই। সব দেয়াল ল্যাপা হয় নাই, কাদার ওপরে মিস্ত্রির আঙুলের দাগ দেখা যায়। কত্তা বলে, মানুষ বাড়ি তৈরি শুরু করতে পারে, বাড়ি কুনোদিন শ্যাষ করতে পারা যায় না। তাই বটে! যাই হোক, দোতলার ঐ ফাঁকা জানেলাটির কাছে যেয়ে বসলে ইস্টিশানের সয়রানের অ্যানেকটো দেখা যায়। সেইখানে যেয়ে বসে বসে দেখলম, পাড়ার ভেতর দিয়ে যাবার সোমায় গাড়িচারটো চোখের আড়ালে চলে গেয়েছিল, অ্যাকন আবার তাদের দেখতে পাওয়া যেছে, দিঘির উঁচু পাড়ে উঠে আবার গরানে নেমেছে। গাড়ি আর গরুগুলিকে শুদু দেখতে পেছি, আর কাউকে লয়। পেছনের ঐ গাড়িতে আছে আমারই প্যান্টের ভেতরে-বাড়া নাড়িছেড়া আমার দুটি সন্তান আর তাদের বাপ যি তাদের জনমো দিয়েছিল আমারই ভেতরে। ওরা অ্যাকন চলে যেছে। যে যায় নাই সে আছে ঐ দিঘিটোরই ঢালু পাড়ে কবরের ভেতরে ঘুমিয়ে। সে কুনোদিন যাবে না। একদিন আমি তার পাশেই যেয়ে চেরকালের লেগে ঘুমুবো।

গাড়িচারটো যা-ও বা এতক্ষণ দেখা যেছিল, চোখের পানিতে অ্যাকন আর কিছুই দেখতে পেচি না। কি ঢল যি নামল পানির আর কিছুই দেখতে পেচি না। ঘরদুয়োর বিশ্বসোংসার উঠছে নামছে। বুকের ভেতর কতো বাতাস, কতো আগুন, কত আলো, কতো ছোঁয়া ফুলে ফুলে গলার কাছে আসছে আবার নেমে যেচে। অ্যাকন যদি এমনি করে মরণ হয়, বেশ হয়।

তাই কি কুনোদিন হয়? কখন গাড়িচারটো মিলিয়ে গেয়েছে। আলো কমছে, হেঁয়া বাড়ছে। দেখতে দেখতে সব আলো নামতে নামতে সরতে সরতে কোথা চলে গেল আর হেঁয়া পড়তে লাগল। সারা বাড়িতে অ্যাকন হেঁয়া, ঘরে ঘরে হেঁয়া, ঘরের বাইরে এনেয় হেঁয়া, ডুমুর গাছে ছেয়া, পেয়ারা গাছে ঘেঁয়া। বাড়িতে আমি একদম একা, অ্যানেক আওয়াজ হতে লাগল সারা বাড়িতে। পশ্চিম দিকের আসমানটো দেখতে পেচি, একটি তারা দেখতে পেচি, কতোদিন বাদে মায়ের মুখটো দেখতে পেচি, কুন এক জগতের গাছপালা মাঠঘাট দেখতে পেচি আর কানে আসছে কতো রকমের আওয়াজ। পেয়ারা গাছে বাদুড় এসে বসল ডালপালা নাড়িয়ে, কি কিচ্ শব্দ করে একটো ইঁদুর ছুটে গেল, মাথার ওপর দিয়ে দু-একটো চামচিকে উড়ছে তো তার কুনো শব্দ নাই, ঝমঝম করে একবার ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আবার সব চুপ।

আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল না? মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিছু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তু হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।

সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি।

আমি একা। তা হোক, সবাইকে বুকে টানতেও পারব আমি।

একা।

1 Comment
Collapse Comments

Boro bhalo laglo. Mon chhuye gelo. Osadharon lekha. Chokher samne dekhchilam.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *