২৭. এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে

এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে

একদিন দোপরবেলায় চুলো থেকে উজ্জ্বলন্ত ভাতের হাঁড়িটি খালি নামিয়েছি, এমন সোমায় খবর প্যালম রায়েদের বড় ছেলে সত্য কলকেতায় হিঁদু-মোসলমানের হিড়িকে কাটা পড়েছে। পেথম ই কথার কুনো মানে বুঝতে পারলম না। কাটা পড়েছে আবার কি? বাসে চাপা পড়ে, টেরেনে কাটা পড়ে, কলকেতায় মানুষ কাটা পড়েছে মানে কি? মানুষ কি কদু-কুমড়ো যি বঁটির ছামনে ধরলম আর ঘাস করে কেটে ফেললম। সবাইকে আমি শুদুই, হ্যাগো হিঁদু-মোসলমানের দাঙ্গা আবার ক্যানে শুরু হলো। ই কথার জবাব আর কে দেবে? সবাই তো আমারই মতুন, কথা শুনে হাঁ হয়ে আছে। ঐ রায়েরা, এককালে য্যাতো বড়লোকই থাক, আজ তারা ভিখিরি। ছোটরায় দাদঅয়লা পেট বার করে, গলায় কালো-কিটকিটে পৈতে ঝুলিয়ে খালিগায়ে কাপড়ের একটো ঝোলা নিয়ে পেত্যেকদিন ভিক্ষে করতে বের হয়। তা তার মনে খুব দয়া যি সি ই গাঁয়ে ভিস্থ করে না। যেদি করত, তাইলে ই গাঁয়ের ভদ্দরলোকদের মুখে জুতো পড়ত। সে ভিস্থ করে ভিন গাঁয়ে। কঠিন গরমের দিনে, তেতে পুড়ে কিম্বা ঝড়-বাদলে কাক ভেজা হয়ে ভিক্ষার চাল কটা এনে বামুন-গিন্নির হাতে দেয় তবে চুলো ধরে, দুটো ভাত ছেলেমেয়েদের মুখে ওঠে। ধিঙ্গি ধিঙ্গি মেয়েদের বিয়ে হয় নাই, দুটি ছেলে ইস্কুলে যায় আবার যায়ও না। শুদু বড় ছেলেটিই কলকেতায় যেয়ে কার বাড়িতে রাঁদুনি হয়েছে, না মুদির দোকানে মাল ওজন করে–সে দু-চার টাকা সংসারে পাঠায় তবে এতগুলিন মানুষ বেঁচে আছে। সেই সত্য আবার কলকেতায় কি করলে, কার ক্ষেতি করলে যি খচাৎ করে তার মাথাটো কেটে ফেলতে হলো! তার না হয় কল্লা গেল, এইবারে যি তার বাড়ির এতগুলিন মানুষ না খেয়ে মরে যাবে! ছোটরায়ের সাধ্যি নাই যি এতগুলিন পেরানিকে সে পেরানে বাঁচায়। ছেলেটোকে আমি চেনতম, আমার অ্যাকনকার বড় খোঁকার বয়েসি, দু-একবার তাকে দেখেছি বড় খোঁকার সাথে। সে এমনি ভালো মানুষ যি একটো পিপড়ে মারারও ক্ষমতা নাই তার। আমাকে কেটে ফেললেও বিশ্বেস করতে পারব না যি সে কাউকে মারতে গেয়েছে। সত্যর মায়ের, রায়েদের ছোট গিন্নির মুখটো আমার মনে পড়তে লাগল। দু-একবার দেখেছি। ফরশা টুকটুকে বউমানুষটি ময়লা চেকট ছোঁড়া শাড়ি পরে থাকে। মাজা সোনার মতুন তার খোলা গা বেরিয়ে পড়ে। সেই মানুষের কপালে এমন পুত্রশোক লেখা ছিল! হায় হায়!

সবাই বলতে লাগল নেড়ে মোসলমানরা তাকে মেরেছে। তাই হবে, হিঁদু-মোসলমানে হিড়িক মানেই হচে হিঁদুকে মোসলমান মারবে, মোসলমানে হিঁদু মারবে। আর কিছু দেখাদেখি নাই, পাঁচজনা হিঁদু কলকেতার রাস্তায় একটো মোসলমানকে একা বাগে পেলে তো পিটিয়ে কিম্বা ছোরা ঢুকিয়ে মেরে ফেললে আবার পাঁচজনা মোসলমান একটো হিঁদু দেখতে পেলে কি চিনুক না চিনুক, কিছু করুক না করুক, তাকে তরোয়াল নাইলে টাংগি, নাইলে যা দিয়েই তোক মেরে ফেললে।

বাঃ ভালো! এইবার এই গাঁয়ের হিঁদুরা বলছে সত্যকে মেরেছে মোসলমানরা। তাইলে বিশ্বভাবনের মোসলমানরা বিশ্বভভাবনের হিঁদুদের শত্রুর। তাই যেদি হয়, তাইলে ই গাঁয়ের মতুন যেখানে য্যাতো হিঁদু-মোসলমানের গাঁ আছে, সব জায়গাতেই কি দাঙ্গা শুরু হবে? কি অস্থির যি লাগতে লাগল আমার! কত্তা কি এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলবে না?

আমাদের এই বেরাট গাঁয়ে মাত্তর বিশ ঘর মোসলমান। ছানাপোনা নিয়ে একশোটো লোক হবে কিনা সন্দ। হিঁদু খুব কম করেও পাঁচশো ঘর। আশেপাশের গাঁগুলিনও মোটামুটি হিঁদু-গাঁ। এই কথা কুনোদিন মনে হয় নাই। ক্যানে মনে হবে? মানুষ আপনমনে বাস করছে। নিজের নিজের পেরান, ছেলেমেয়ে সোংসার নিয়ে হাবু-সোঁটা খেতে হচে সবাইকে। হিঁদু-মোসলমান আবার কি? কুনোদিন মনে করি নাই যি ই নিয়ে আবার ভানা করতে হবে। মনে তো অ্যাকনো করতে চাই না। কিন্তু খালি যি মনের ভেতর আগা লিছে, যেদি ই গাঁয়ে দাঙ্গা লাগে তাইলে এই কটি মোসলমান তো এক লাপটেই মারা পড়বে। সাথে সাথে মনে হলো, মনে পাপ ঢুকেছে তাই এই কথা মনে হচে। ভাবো দিকিনি কত্তা কাটতে যাবে কত্তামাকে! নাপিত বউয়ের স্বামী, নাইলে হলা বাগদির বাপ খুন করতে আসবে আমার ছেলেদুটিকে।

গত বছর থেকে খালি শুনছি, মোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে আন্দোলন হচে, বিটিশদের সাথে খুব দেন-দরবার চলছে। কত্তা খালি তাড়া দিত আর নতিজা করত বলে গত কবছর ‘বঙ্গবাসী’ কাগজটো এট্টু এট্টু পড়তে চেষ্টা করতম। ত্যাকন থেকেই জেনে আসছি, মোসলমানদের লেগে একটো আলেদা দ্যাশ করার বন্দোবস্ত হচে। কত্তা আর আগের মতুন পেরায় পেত্যেকদিন শহরে যায় না, পেসিডেন্টগিরি যাবার পর থেকে বাড়িতেই থাকে বেশির ভাগ দিন। তাপরে এমন যি আকাল গেল, বুকে হেঁটো ঠেকিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে কুনো পেরকারে সেই পুলসেরাত পার হতে হয়েছে, শহরগঞ্জে যেতে ভয়ই লাগত মানুষের। তা ত্যাকন কত্ত বাড়িতে বসে বসে আর কি করবে, কাগজ-মাগজ পড়ত আর মন-মর্জি ভালো থাকলে দ্যাশ দুনিয়া নিয়ে আমাকে কখনো কখনো দু-চার কথা বলত। যে করে থোক আকালটো মোটামুটি মানুষ সামলাইলে, দুবার ফসল যাওয়ার পরে, তিতিয় বছর খুব ধান হলো। গবরমেন্টের সাধ্যি হলো না, চোরা-কারবারিদেরও লিকিন খ্যামতা হলো না যি আকালটো আর কিছুদিন চালিয়ে যায়। ইদিকে যুদ্ধর ত্যাজও মরতে মরতে গত বছর বর্ষাাকালের গোড়ায় সারা পিথিমির যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। কিন্তুক সেলমানদের লেগে আলেদা একটো দ্যাশের কথা ক-বছর থেকেই শুনে আসছি। ই নিয়ে কতো কথা থাকে কাগজে, কত্তাও অ্যানেক কথা বলে এই নিয়ে। সব কি আর বুঝতে পারি? কাগজে অ্যানেক মজার মজার নাম পড়ি, আবার সিসব নাম ভুলেও যাই। কিন্তুক কতকগুলিন আর ভুলতে পারি না। এক সময় খালি পড়তম শ্যামা-হক এই নাম। বুঝতে পারতম না ই একটো লোকের নাম, না দুটি লোকের নাম। কত্তাকে শুদুইলে বললে, না, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। দুটি মানুষের নাম তাও বুঝতে পারলে না? শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে আর শেরে বাংলা ফজলুল হক। মন্ত্রীদের একটি সভা আছে, তাদের পরামর্শে আর ব্রিটিশদের চোখ-রাঙানি সয়ে এই দুজনেই এখন দেশ চালাচ্ছে।

কবে বলেছিল কত্তা এই কথা। তাপর কাগজেও পড়েছেলম, কত্তা-ও বললে ঐ সভা ভেঙে গেয়েছে। উদের ক্ষমতা শ্যাষ। অ্যাকন খাঁটি মোসলমানদের শাসন চলবে। সে-ও ক-বছর হয়ে গেল। তার পর থেকেই শুনছি মোসলমানদের আলেদা একটো দ্যাশের লেগে খুব আন্দোলন চলছে, সি লিকিনি না করে ছাড়বে না। আর পড়তে লাগলম, শুনতেও লাগলম কটি নাম–জিন্না, নেহেরু, গান্ধি, প্যাটেল। এমন নাম তো জেবনে শুনি নাই, কিছুতেই মনে থাকত না যেদি হাটে মাঠে ঘরে বাইরে সব সোমায় এই নামগুলিন না শুনতে পাওয়া যেত। আরও পড়লম নাজিমুদ্দীন, লেয়াকত আলী, সোরাবর্দী, আবুল হাশিমের নাম। আবুল হাশিমের নাম খুব দেখতে প্যাতম। ঐ নামটি ভুলি নাই। একে তো মোসলমানদের নেতা, তাপর তার দ্যাশের বাড়ি আমার বাপের বাড়ির খুব কাছে, দু-তিনকোশের মদ্যেই।

সি যাকগো, কথা তা লয়। দাঙ্গার কথাটো বলতে যেয়েই এত কথা। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তানের কথা হতে হতে এমনি শোরগোল হতে লাগল সি আর কান পাতা যায় না। শ্যাষের দিকে খালি বলে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। লড়কে তো লেঙ্গে, কিন্তুক নিয়ে করেঙ্গেটা কি? কোথা পাকিস্তান হবে জানিস? তু যাবি সেখানে?

কত্তাও দেখি মাঝে মাঝে খুব রাগ করছে। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশের কথা তো সেই আকালের সোমায় থেকেই শুনে আসছি। ত্যাকন এক কান দিয়ে ঢুকত আর এক কান দিয়ে বেরুইত। বলে, মানুষের প্যাটে-পিঠে সেঁটে গেয়েছে, পরনে ত্যানা নাই, লতাপাতা, শামুক, গুগুলি খেয়েও লোকে বাঁচতে পারছে না, শেয়াল-কুকুরের জেবন হয়েছে মানুষের আর তারই মধ্যে আবার মোসলমানদের আলেদা অ্যাকটো দ্যাশের কথা! কে তাতে কান দেবে? কিন্তুক কান দেবার লোক আছে বইকি! যাদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তা নাই, খাওয়া-পরার চিন্তা নাই, তারা তো গরিব মানুষের লেগে ঘরে বসে মাহা মাহা চিন্তা করতেই পারে।

যাই হোক সিসব কথায় ত্যাকন লোক কান দেয় নাই। কিন্তুক কথাটো গেল না, জিটিবিটি করে ধরে থাকল। আকাল গেল, যুদ্ধ গেল, পাকিস্তানের কথা আবার ফিরে এল। আগে আগে কত্তা বলত, পাকিস্তানের বাতিকটা বোধ হয় গেল। লোক দেখানো হোক, যাই হোক, ব্রিটিশ চেষ্টা করছে হিঁদুদের গান্ধি, নেহেরু, প্যাটেল আর মুসলমানদের নেতা জিন্নার সাথে বসে একটা পথ বার করতে, যাতে দেশটাকে আর ভাগ করতে না হয়। আবার কদিন বাদে হয়তো এসে বললে, নাঃ হলো না, একটা দক্ষযজ্ঞ মনে হচ্ছে হবেই, এবার জিন্না রাজি না। কদিন পরে ফের বললে, এবার নেহেরু রাজি হলো না। এই করতে করতে একদিন মাহা বিরক্ত হয়ে এসে বললে, এই জিন্না লোকটা একটা দিন জেল খাটলে না, একটা দিন উপোস করলে না গান্ধির মতো, মুসলমানের কিছুই নাই তার, জামাকাপড় আগে পরত সাহেবদের মতে, এখন মুসলমানদের নেতা হয়েছে, শেরওয়ানি পরে, মাথায় পরে তার নিজের কায়দার টুপি।

অত রাগ করছ ক্যানে? আমি এট্টু অবাক হয়ে শুদুই।

রাগ হবে না? সারা দেশের মানুষ কি চায়, না চায়, তার খবর তে হবে না? কাগজ-কলম নিয়ে শুধু ঘরে বসে আঁক কষলেই হবে।

আমাকে এট্টু বুঝিয়ে বলো দিকিনি। আঁক ক্যা আবার কি?

কোথা ভারতের স্বাধীনতা তার কোনো খবর নাই। আঙুলটা পর্যন্ত কোনোদিন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তোলে নাই আর যখুনি এই দেশের স্বাধীনতা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার অবস্থা ব্রিটিশের, দিশেহারা অবস্থা, তখুনি সে বলছে মুসলমানদের আলাদা দেশ দিতে হবে। আবার প্যাটেল-ম্যাটেল কটা হিঁদু নেতা আছে যারা হিঁদু-মুসলমান। দুই দুই না করে কোনো কথা ভাবতেও পারে না।

কত্তা কথাগুলো এমন করে বলছিল যেন নিজের সাথে নিজে কথা বলছে। সেই লেগে আমি একটু চেঁচিয়ে বললম, আহা, ঘরে বসে কাগজ-কলমের কথা কি বলছিলে সেই কথাটি পোঞ্চার করে বলো।

ও, কাগজ কলম–কত্তা হাসলে, যাদের জন্যে এইসব কথা, তাদের কাছে না এসে ঘরে বসে চিঠি চালাচালি করা, খবরের কাগজে একগাদা কথা ছাপানো, এইসব করেই বাজিমাত করার কথা বলছিলাম রাগ করে। স্বাধীনতার জন্যে একটা আন্দোলন হচ্ছে, আবার সেই আন্দোলনের পেটের ভেতর মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা দেশের আন্দোলনও হচ্ছে। ডালে-চালে মিশে যাচ্ছে না?

আমি আজ শুনব। মোসলমানদের আলেদা দ্যাশ ঠিক কি কথা?

আচ্ছা, ঠিক আছে শোনো। আমি নিজেও যে খুব বুঝি তা নয়। কোনো কিছুর সঙ্গে এখন আর আমি নাই। খবরের কাগজ-টাগজ পড়ে যা বুঝি তাই বলছি।

আগে বলল, মোসলমানদের দ্যাশ যি বলছ, সেই দ্যাশ হলে সব মোসলমান সিখানে বাস করবে? কেউ তার বাইরে থাকবে না?

আর দূর, তাই কখনো হয় নাকি? সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের কত দেশ আছে জানো? কতো পোশাক, কতো ভাষা, কতো জাত–তার কোনো অন্ত আছে নাকি! একটিমাত্র দেশে তাদের সবারই থাকার কোনো জায়গা নাই। আমাদের এই ভারতেই কতো দেশ! কতো কিসিমের মুসলমান এই বিরাট দেশে আছে কেউ জানে? ওভাবে এক দেশে সব মুসলমানকে রাখার কথা হয় নাই। এই বাঙালি হিঁদু-মোসলমানের মধ্যেই কতো মুসলমান আছে, সবাইকে একটা আলাদা দেশে রাখতে পারবে কেউ?

তবে? আলেদা দ্যাশের কথা ক্যানে? আমাদের এই দ্যাশের মোসলমানকেই যেদি একটা দ্যাশের মদ্যে রাখতে না পারে তাইলে উকথা হচে ক্যানে?

আমার এই কথায় কত্তা যেন একটু থমকে গেল। কিন্তুক উ কি থামবার মানুষ? বললে, প্রথমে কথা হয়েছিল, সারা দেশে যেখানে যেখানে মুসলমান অন্য জাতের চেয়ে বেশি বাস করে, সেই সব জায়গা নিয়ে বেশ কটা আলাদা দেশ হবে। তারপর সেকথা উড়ে গেল, ব্রিটিশরা বললে দেশ ভাগ কোরো না, বরঞ্চ তিনটে খণ্ড করে এক দেশের মধ্যেই সবাই থাকো। সে কথাটিও আবার নেহেরু প্যাটেল হিঁদু নেতাদের পছন্দ হলো না। এখন জিন্না খেপেছে, কোনো কথা নয়, পাকিস্তান বলে একটি আলাদা মুসলমানদের দেশ চাই।

এতক্ষণ ধরে কত্তা যেসব কথা বলছিল, মনে হছিল তা অন্য কুনো ভাবের কথা তার একটি বন্ন বুঝতে পারছেলম না। খুব চেষ্টা করলম। বুঝতে কিন্তুক কি বুঝব, দুনিয়ার কি কিছু জানি? কোথা কোথা মোসলমান থাকে, এই দ্যাশেই বা কোথা কোথা তারা থাকে, কি খায়, কি মাখে, কি পরে, কেমন করে কথা বলে, কি ভাষায় কথা বলে, কি তাদের স্বভাব-চরিত্তির ইসব কিছুই জানি না। বোঝলম ই নিয়ে কথা বলা আমার ঠিক হবে না, তবে এই কথাটো খুব মনে হছিল যি ইসব কথার সাথে হিঁদু-মোসলমান সোংসারি মানুষের কুনো সম্পক্ক নাই। আর নাই য্যাকন, ত্যাকন আমি মাথা ঘামাইতে যাই ক্যানে! তবে খালি মনে হতে লাগল মোসলমানের দ্যাশ হবে অথচ সব মোসলমান সিখানে থাকবে না, এমনও হতে পারে যি আমি থাকব কিন্তুক আমার সোয়ামি ছেলেমেয়ে থাকবে না। তাই যেদি হয় তাইলে ই কাজ করতে যেয়ে হিঁদু-মোসলমান সম্পক্ককে বিষ বিষ করতে হবে ক্যানে?

কত্তার সাথে এই নিয়ে আর কুনোদিন কথা বলতে চাই নাই। কিন্তুক মনে হয় তারও বুকের ভেতরে ঝড় বইছিল। অ্যাকন তো আর বুঝতে কিছু বাকি নাই। মাঘ-ফাগুনে কত্তা একদিন বললে, একটো নিৰ্বাচন হবে। কঠিন নিব্বাচন, এমন নিব্বাচন লিকিনি আর কুনোদিন হয় নাই। এই নিব্বাচনে ঠিক হবে মুসলমানরা তাদের আলেদা দ্যাশ পাকিস্তান চায় কি চায় না।

কত্তার সেই কথার পরে, উঃ, এই অজ পাড়াগাঁয়েও যি কি জগঝম্প বাজতে লাগল! বাড়িতে থাকি, তাও কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কদিন এগু যুদ্ধ শ্যাষ হয়েছে, অ্যাকন শুরু হলো আর এক মহাযুদ্ধ। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান রব করছে মোসলমানরা। পাকিস্তান চাইদের দলে দাঁড়াইলে আবুল হাশিম, আর বোধায় পাকিস্তান চাই-না-র দলে দাঁড়াইলে সে-ও একজনা মোসলমান। তার নামটো মনে ছিল, অ্যাকন ভুলে যেচি–মনে হচে তার নাম ছিল ছাত্তার।

আমরা আর ভোট দিতে যাই নাই। কত্তাকে শুদুইলে সে কিছুতেই রা কাড়লে না। ভাবে মনে হলো আবুল হাশিম পাকিস্তান-অয়লাকেই ভোট দিয়েছে।

এর পরে আর ছটো মাসও কাটল না। হিঁদু-মোসলমানে লেগে গেল হিড়িক। কে যি লাগাইলে, ক্যানে যি লাগাইলে সিকথা বলতে পারব না। কোথা কুন্ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি দুনিয়ার কুন্ এক কোণে, চাদ-সুরুজ যিখানে চুপে-চুপে ওঠে, চুপে চুপে ডোবে, চুপে-চুপে ধান হয়, গম হয়, ফল-পাকুড় হয়, চুপেচুপেই আমাদের সন্তান হয়, বাড়ে, মরে। আমরা কার কি করেছি যি সেই গাঁয়ের এক মায়ের অন্ধের নড়ি পুতকে কেটে দুখাণ্ডা করে দেবে?

আমার খুব মনে হতে লাগল একবার রায়দের ছোট গিন্নির কাছে যাই। আমার বড় খোঁকা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল রোগে ভুগে। ছোট গিন্নির নাড়িছেড়া ধনটির দুনিয়া থেকে যাবার সোমায় হয় নাই, কে তাকে মারলে, কুন অপরাধে মারলে, সে-ও জানলে না, তার মা-বাপও জানলে না। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকল ছেলে। পচে গলে লষ্ট হয়ে গেয়েছে সেই লাশ, না কুকুর-শেয়ালে খেয়েছে, নাকি কাক-শকুনে খেয়েছে, তা-ও জানতে পারলে না মা-বাপ। আহা, একবার যাই সত্য-র মায়ের কাছে। তার গায়ে-পিঠে হাত দিতে পারব না জানি, হিঁদুরা আমাদের ছোঁয় না। ছোট গিন্নি তো আবার বামুনের মেয়ে, যিখানে যেয়ে বসব দাঁড়াব সিখানে আবার পানি ঢেলে ধোবে। তা হোক, একবার যাই। কত্তাকে শুদুব কিনা ভাবলম। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরে কুনোদিন গাঁয়ের রাস্তায় বেরুই নাই পায়ে হেঁটে। যেখানেই যাই, গেয়েছি গরু-মোষের গাড়িতে, টপ্পরের দু-মুখে শাড়ি বেঁধে। তবে গাঁয়ের মোসলমান পাড়ায়। বড় ননদের বাড়িতে দু-একবার যাই মাঝে মাঝে, হেঁটেই যাই। পাড়ার ভেতর দিয়ে ই বাড়ি উ বাড়ির পাশ কাটিয়ে, এর এনে ওর এগ্‌নের ওপর দিয়ে চলে যাই। দিনে রাস্তায় কুনোদিন বেরুই নাই। করে বউ হয়ে ঢুকেছি এই বাড়িতে, মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, পাকছে-ও দু-একটি, ইয়া চ্যাওড়া সিঁথি অ্যাকন–তবু বউমানুষের শরম গেল না আমার। মনে করলম, কত্তাকে আর শুদুব না। ক্যানে বেরিয়েছেলম শুনলে রাগ করবে না আমি জানি।

বৈকাল বেলায় গা-মাথা ঢেকে কুনোরকমে টুক করে রাস্তাটো পেরিয়ে পুকুরের পাড়ের কলাবাগানের আড়াল আড়াল গ্যালম রায়বাড়ি। পুকুরের দখিন কোণেই বাড়ি। বাইরে এসে গায়ে বাতাস লাগলে মনে হলো কুন জগতের বাতাস, চাপাপড়া ঘাস যেন নতুন জান পেলে। রায়বাড়ির সিং-দরজা নাই, কবে বিক্রি হয়ে গেয়েছে, সেখানে দুদিকের মাটির পাঁচির হাঁ হয়ে আছে। সেটো পেরিয়ে এনেয় যেয়ে দাঁড়াইতেই দেখলম সীমেনার পাঁচির কবে ভেঙে পড়ে গেয়েছে। চারিদিক খাঁ খাঁ, এককোণে একটি মাত্র ঘর, আর এগনের এক কোণে রান্নাঘর। ঘরের ছামনে যি একটুকু উসারা আছে, সেইখানে একটি ছেড়া ছপ পেতে শুয়ে আছে রায়গিন্নি। দুদিকে গিট-মারা ময়লা একটো বালিশ মাথার তলা থেকে বেরিয়ে এয়েছে আর উঁচু উসারার বাড়ি থেকে রায়গিন্নির এলোচুল এনে পয্যন্ত ঝুলে আছে। খানিক আগে হয়তো পানি ঢেলেছে মাথায়, ভালো করে মোছা হয় নাই, চুল গড়িয়ে টপ টপ করে ত্যাকনো পানি পড়ছে, দু-চারটি পাকা চুল দেখা যেচে। ছোট গিন্নির চোখ বোজা, জেগে না ঘুমিয়ে ঠিক বুঝতে পারলম না। বাড়িতে কাক-পক্ষী নাই, একদম ফাঁকা। মেয়েদুটি নাই, ছেলেটি-ও নাই আর ছোটরায় লিশ্চয় ভিক্ষেয় বেরিয়েছে। এত বড় পুত্রশোকেও তার উপয় নাই, পোড়া প্যাট তো মানবে না, ভিক্ষার চালেই সেই প্যাটের গত্ত ভরাইতে হবে।

কি করব বুঝতে পারছি না। চলে আসব না কি ভাবছি, এমন সোমায় রায়গিন্নি চোখ মেলে আমাকে দেখলে। চোখের পাতা তার তখুনি আবার বন্ধ হয়ে যেছিল, চেয়ে তাকানোর খ্যামতা নাই। কিন্তুক তবু কি কষ্ট করে যি সি চোখের পাতাদুটি খুলে রাখলে, তা আমি বুঝতে পারলম।

কে?

গলার আওয়াজ শুনে গা শিউরে উঠল। ই কি মানুষেরা গলা? আমি নিজের পরিচয় দেলম। মাথায় পানি ঢালতে যেয়ে ছোট গিন্নির লালপাড় ঘেঁড়া শাদা শাড়িটিও ভিজে গেয়েছে। মুশুরির বিউলির মতুন গায়ের রঙ তার অ্যাকনো আছে, ভেজা শাড়ির ভেতর দিয়ে সেই রঙ যেন ফুটে বেরুইছে। আমি পরিচয় দিলে অতি কষ্টে উঠে বসতে বসতে ছোট গিন্নি উসারার দিকে দেখিয়ে আমাকে বসতে বললে, বোসো দিদি।’

একটু অবাকই হয়ে আমি আস্তে আস্তে ছোট গিন্নির কাছ থেকে একটু দূরে উসারার ওপর মাটিতেই বসতে গ্যালম, গিন্নি ইশারায় আর। এট্টু কাছে যেতে বললে।

আমার এমন সাধ্যি নাই যে আসনটা এনে তোমাকে বসতে দি–হারামজাদি দুটি এখন কোন্ চুলোয় গেছে!

তাড়াতাড়ি করে মাটিতে বসে পড়ে আমি বললম, না না, আমি এই মাটিতেই বসি, তুমি বেস্ত হোয়ো না। আমাকে তুমি চিনতে পারো নাই, আমি–

না, না, চিনতে পেরেছি। দু-তিনবারের বেশি তোমাকে দেখি নাই বটে, তবে একবার তোমাকে দেখলে কেউ ভুলতে পারে? পিতিমে দেখা আর তোমাকে দেখা যে এক কথা। আমার কি সৌভাগ্য যে তুমি এ বাড়িতে এসেছ–

আমি যি মা খপ করে মুখ দিয়ে কথাটো বেরিয়ে গেল আর কি যি হলো জানি না, চোখদুটি আমার পানিতে ভেসে গেল। সেই ঝাপসা চোখেই আবছা দেখতে প্যালম রায়গিন্নি একদিষ্টে আমার দিকে ঠিক যেন শাদা পাথরের চোখে চেয়ে রয়েছে। আমার চাউনি পোঞ্চার ইলে দেখলম রায়গিন্নির চোখের পাতা পড়ছে না, থির তাকিয়ে আছে। আমার দিকে। তাপর, অ্যানেকক্ষণ পর, আস্তে আস্তে তার ডাগর চোখদুটি পানিতে ভরে এল, টইটম্বুর হয়ে এল আর গলা দিয়ে শুকনো বাস বার করতে করতে সে বললে, দিদি বড় কষ্ট, বড় কষ্ট দিদি! সি এমন করে বলা, সি এমন করে বলা! আর বলতে বলতেই রায়গিন্নি মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বুক ফাটিয়ে কেঁদে উঠল, কোথা রে, কোথা রে, কোথা গেলিরে, কোথা মরে পড়ে থাকলি রে বাবা!

আমার এমন ইচ্ছে হলো যেন সব ভুলে এই মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মনে হলো সে-ও যেন হাত বাড়িয়ে আছে। এত ইচ্ছে, তবু যেতে কি পারলম? তখনি মনে হলো, যেতে যি পারছি না, তার কারণ তো আমি মোসলমান আর রায়গিন্নি হিঁদু! আর য্যাত লড়ালড়ি, খুনোখুনি হচে সব তো শুদু হিঁদু-মোসলমান বলে। এক হিঁদু মায়ের পুতকে মারছে একজনা মোসলমান আবার এক মোসলমান মায়ের পুতকে মারছে। একজন হিঁদু। আঃ হায়রে! মানুষ লিকিন বুদ্ধিমান পেরানি।

আমি যেখানকার সিখানেই বসে থাকলম, একফোঁটা নড়তে পারলম না আর রায়গিন্নি মেঝেতে মুখ গুঁজে অমনি করে গুঙিয়ে গুঙিয়ে এমন কাঁদন কাঁদতে লাগল যেন ধরণী ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবছি আমি এখানে কিছুই করতে পারব না, মায়ের। এমন শোকে আল্লাই সান্ত্বনা দিতে পারবে না, আমি তো কুন ছাড়, তাইলে আমি অ্যালম ক্যানে?

এইসময় সিং-দরজার হাঁ-মুখ দিয়ে রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি বাড়ি ঢুকল। সি যি কি সোন্দর মেয়েদুটি! পাতলা পাতলা ঠোঁট, টানা টানা চোখ, যেন পটে আঁকা। প্যাট ভরে খেতে পায় না, রুখু চুল উড়ে বেড়াইছে। কতোদিন ত্যাল পড়ে নাই তাতে, তবু কি রূপ, কি রূপ। হাতে পায়ে চুলে ধুলোর পরত পড়েছে, তারই ফাঁকে ফাঁকে ধপধপে গায়ের রঙ যেন ফেটে বেরুইছে। তারা মাথা নামিয়ে মায়ের দু-পাশে হেঁটো মুড়ে বসল। সি মুখদুটিতে যি কি আছে আমি বলতে পারব না। একবার একবার বুনদুটি আমার দিকে তাকাইছে, আবার মুখ নামিয়ে নিছে। আস্তে আস্তে তারা মায়ের ছড়ানো চুলগুলি গুছিয়ে তার উবুড় পিঠে রাখলে, তাপর দুপাশ থেকে রায়গিন্নির মুখটি ধরে খুব নামো গলায় বললে, ওঠো, ওপাড়ার জেঠি বসে আছে, উঠে কথা বলো। এই বলে তারা মাকে উঠে বসাইলে।

চেয়ে দেখলম ছোট রায় ভিক্ষের ঝুলিটি কাঁধে নিয়ে বাড়ি ঢুকছে। ভিক্ষে অ্যানেক পেয়েছে, ঝুলিটি বেঁধে বস্তার মতুন করে কাঁধে বয়ে নিয়ে আসছে। খালি-গা, সারা প্যাটে দাদ, চুলকিয়ে চুলকিয়ে যেন। খড়ি উঠেছে। ময়লা পৈতেটি দেখে মনে হচে বামুন বটে! এনে পেরিয়ে উসারায় উঠে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে মাটি দেখতে দেখতে সে ঘরে যেয়ে ঢুকল।

কি করব, এইবার আমি আবার উঠব উঠব করছি, রায়গিন্নি ধরা গলায় বললে, কি করে কি হলো দিদি, কিছুই বলতে পারব না। ছেলে মরল মরল, তার দেহটি-ও পেলাম না। শেষ কাজও করতে পারলাম না। আমাদের হিঁদুদের মধ্যে গঙ্গা না পেলে কারু মুক্তি নাই। যতো পুণ্যিই থাকুক, পাপ তো কিছু সব মানুষেরই থাকে। সেই পাপ কিছুতেই ক্ষয় হবে না মা গঙ্গা কোলে না নিলে। তার দাহ হলো না, ছেরাদ্দ-ও এখনো হয় নাই। তোমাদের মতোই তো দিদি, গোর না দিলে তোমাদের কারু কি গতি হয়?

খবরটো কেমন করে পেয়েছিলে ছোট গিন্নি?

সিদগাঁ আমার বাপের বাড়ি। আমার ছোট ভাই কলকাতায় কাজ করে। সেই তো সত্যকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে এক বড়লোকের বাড়িতে রান্নাবাড়ার ঠাকুরের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। দুজনাই একসাথে এক মেসে থাকে। আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করলেও দুজনে মেসে ফেরে একসাথে। সেদিনও তেমনি ফিরছিল তারা। রাস্তা ফঁকা। দাঙ্গা নাকি কদিন আগে শুরু হয়েছিল, এরা ওদের মারছিল, ওরা এদের মারছিল। এক দিকে হিঁদু-পাড়া আগুনে পুড়ছে, আর একদিকে তোমাদের মোসলমান-পাড়া পুড়ছে। ভাই বলছিল, সামনা-সামনি দাঙ্গাতে-ও মানুষ মরছিল।

সত্য তো সামনা-সামনি দাঙ্গাতে মরে নাই।

না দিদি, হিঁদুপাড়ায় একজন মোসলমানকে বাগে পেলে মারছে আবার মোসলমানপাড়ায় একজন হিঁদুকে বাগে পেলে মারছে, চিনুক আর নাই চিনুক। হিঁদু না মোসলমান বুঝতে পারলেই হলো। সেদিন রাস্তা ছিল ফাঁকা, কিরীটী—

কিরীটী তোমার ভাই?

হ্যাগো দিদি, ঐ একটিই ভাই আমার। তা কিরীটী বললে, হঠাৎ চারজন তোমাদের জেতের লোক পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাদের ঘিরে ধরল। চারজনের হাতেই ছুরি ছিল। এসেই কোনো কথা নয়, সত্য-র তো খালি গা, পৈতে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বামুন–সত্য-র পেটে বুকে চারজনেই ছুরি ঢুকিয়ে দিল। কিরীটী-ও বাঁচত না–সত্য-র দিকেই ওদের সবার নজর ছিল বলে সে লাফ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসে একটা বড় নিমগাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সেখান থেকেই সে সব দেখলে। সত্য দুবার মা মা বলে ডেকেছিল, আর কোনো কথা বলতে পারে নাই। পেটে বুকে পিঠে ছুরি মারতে মারতে ছেলেটিকে আমার আঁঝরা করে দিয়ে আর একটুও দাঁড়ায় নাই। তারা। কিরীটী বললে, আমাকে তুমি জুতো মারো দিদি, আমি কাছে গিয়ে সত্যকে আর একবার দেখে আসতে পারি নাই গো, পেরান নিয়ে সেই যে দৌড়েছি, মেসে এসে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে তবে থেমেছি।

আমি রায়গিন্নির মুখের দিকে চেয়ে থাকলম। তার চোখে অ্যাকন আর পানি নাই, চোখদুটি যেন ধকধক করে জ্বলছে। আমার মনে হতে লাগল, আমার বোধায় আসা ঠিক হয় নাই, আমার বোধায় অ্যাকন চলে যাওয়াই ঠিক। রায়গিন্নি কাকে ঘিন্ করবে বুঝতে পারছে না, বোধায় আমাকেই তার ঘিন্ লাগছে। কি দোষ দেব রায়গিন্নির? ঐ। মা তার ছেলের লাশটো-ও দেখতে পায় নাই। রাস্তায় সেইখানেই লাশ পড়েছিল না, মুদ্দোফরাস টানতে টানতে নিয়ে যেয়ে মড়া-ফেলার গাড়িতে তুলেছিল কিছুই জানে না সে। কিন্তুক কারা তাকে মেরেছে তা জানতে পেরেছে সে। আমি য্যাতোই আসি একজন মা-কে সান্ত্বনা দিতে, সে আমাকে ভালো চোখে দেখতে পারবে ক্যানে? আমি আর বসে থাকতে পারলম না, বাড়ি যাবার লেগে উসারা থেকে এনেয় এসে নামলম। সাথে সাথে রায়গিন্নির মেয়েদুটি–একটির নাম লক্ষ্মী, আর একটির নাম সরস্বতী রায়গিন্নির হারামজাদি দুটি উঠে দাঁড়াইলে। ত্যাকন রায়গিন্নি সব ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, দিদি তুমি যাচ্ছ? আমি আর কি বলব দিদি! আর যেন কারু কোল এমনি করে খালি না হয়। ভগবানকে বোলো আমি যেন কাউকে শাপ-শাপান্ত না করি, ও মা, মাগো–

ঘোট গিন্নি আবার মাটিতে পড়ে কাতরাইতে লাগল। আমি গা-মাথা ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যালম।

এই শুরু হলো। কতো কথা যি চারদিক থেকে আসতে লাগল–কতো কাইনি, কতো ঘটনা। সারা গাঁ, সারা এলেকা সরগরম। আকালেও এইরকম হয়েছিল বটে, তবে সি যেন উল্টো। জাড়কালের রেতে মাঠ যেমন ঠান্ডা, শক্ত কঠিন আর শব্দ নাই–যেন কতোদিনের বাসি মড়া পড়ে আছে মড়া যেন গলতে পচতে গন্ধ বার করতেও ভয় পেছে, আকাল ছিল তেমনি। সারা সারা এলেকা একদম মরে গেয়েছিল। কিন্তুক অ্যাকন যেন গাঁয়ের পর গাঁ উঠে বসেছে, মোসলমানরা মাথায় ফ্যাটা বেঁধেছে, হিঁদুরা কপালে সিঁদুর লেপেছে, রাগে সবারই চোখ টকটকে লাল। বাঁশের ঝাড়ে ঢুকে বাঁশ। কেটে লাঠি বানাইছে, কামারশালে যেয়ে টাঙি সড়কি এই সব বানিয়ে নিছে।

আমার ল-দ্যাওরের খুব ফুত্তি। কার কাছ থেকে কি শুনে লাফাইতে লাফাইতে বাড়ি ঢুকে বলছে, আর হবে না, হিঁদুদের সাথে আর কিছুতেই থাকা হবে না, পাকিস্তান হাশিল করতেই হবে। তার কথা শুনে মনে হছে, তাই বোধায় হয় ঠিক, পাকিস্তান হাশিল না করলে আর উপয় নেই। ই গাঁয়ের হিঁদুরা তো বটেই, আশেপাশের গাঁয়ের সব হিঁদুরা লিকিন তৈরি হচে, একটি মোসলমানও তারা আর রাখবে না। তা ঠিক, এত হিঁদু ই দিগরে আছে একবার যেদি ঢেউয়ের মতুন আসে, একজন মোসলমানও জানে বাঁচতে পারবে না। তোড়ে ভেসে যাবে। তা এই আবস্তায় সে এত লাফইছে ক্যানে? দ্যাওরকে জিগ্গাসা করতেই সে এমন নোম্বা নোম্বা বাত দিলে যি বুঝতে পারলম সে ঘোরে আছে, তার মাথা কাজ করছে না।

তৌহিদের খ্যামতা জানো? তৌহিদি শক্তির সামনে হিঁদু মালাউন দাঁড়াইতে পারবে না। এক মোসলমান, সত্তরজনা কাফের!

আবার কিসব বলতে বলতে সে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। হিঁদুদের তো অত দেখতে পাই না, তারা অত চেঁচায়ও না। কতো কথা যি কানে আসে! কুকুর-বেড়াল কান বন্ধ করতেও পারে, খুলতেও পারে। তাদের কান নড়েচড়ে। মানুষের কান বন্ধ করার উপয় নেই, তার কান খোলাই থাকে। তাই শুনতে না চাইলেও শুনতে পাই, গাঁয়ের হিঁদুদের লিকিন গতি-মতি ভালো লয়, তারা ভিন্ ভিন্ গাঁয়ের, হিঁদুদের সাথে ষড় করছে।

তাইলে কি সব মিছে হয়ে গেল। নতুন বউ হয়ে আসার পরে কত্তামা যি আমার লেগে এক-গা গয়না গড়িয়ে রেখেছিল, সামনে বসিয়ে একটি একটি করে গয়না দিয়ে আমাকে সাজিয়েছিল, সি কি মিছে? কত্তা লিকিন তার বড় ছেলে, তার ছোট ছোট ছেলেদের যি ভাইয়ের অধিক যত্ন দিয়ে মানুষ করলে, সি-ও কি মিছে? ভচ্চায্যি বড় খোঁকা মরলে কত্তার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে বুকে টেনে ঠায় কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে, সি-ও কি হিঁদু-মোসলমানের লোক-দেখানো আদিখ্যেতা? আর ইদিকে যি আপন ভাইরা এক কথায় পেথগন্ন হয়ে গেল, সি বুঝি কিছু লয়? দাইবউ নাপিতবউ কতোদিন আর ইদিগপানে আসে না সি কি শুদু হিঁদু-মোসলমানে দাঙ্গা হচে বলে? আমার বড় খোঁকাটির লেগে এই কমাস আগেও যি সি আমার কাছে কেঁদে গেল, তা-ও কি তোক দেখানো ছিল? সে ছোট জেতের হিঁদু, বড় জেতের হিঁদুদের কাছে লোক-দেখানোর কাঁদন কাঁদার লেগে তার কি দায় ঠেকেছে? হা, থাকে বটে হিঁদুদের মদ্যে দু-চার জনা হিঁদু যারা মোসলমানদের জান থেকে ঘিন্ করে, পারলে দুনিয়ার সব মোসলমানকে কেটে ফেলে। তেমনি মোসলমানদের ভেতরেও তো আছে তেমন মোসলমান যারা হিঁদুদের ঘিন্ করে, তাদের কাফের মালাউন বলে গাল দেয়, পারলে সব হিঁদুকে মাটিলাগ করে দেয়। এমন দু-চারজনা হিঁদু মাথাসরো যোবক ই গাঁয়ে আছে, সি কথা কত্তাও জানে, আমিও জানি। তেমনি মোসলমান পাড়ায় আছে কটো মাথাড্যাকরা ছোঁড়া, রাতদিন হিঁদু মারবে বলে লাফাইছে। এমন তো সব জায়গায় সব সোমায়েই আছে। তাই বলে দাঙ্গা করতে হবে ক্যানে? রায়গিন্নির হাতের নড়ি ছেলেটিকে রাগ নাই ঝাল নাই শুদু পৈতে দেখে বামুন বলে চেনা গেল বলে মেরে ফেলতে হবে। ক্যানে?

বিষ কেরমে কেরমে কি আমার ভেতরেও ঢুকতে লাগল? এতদিন যা জেনেছেলম, যেমন করে চলেছেলম, সব কি বদলে যেছে? আস্তে আস্তে আমারও মনে হচে দিন আর রেতের মতুন হিঁদু-মোসলমানও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেয়েছে। কে দিন আর কে রাত অ্যাকনো জানি না। সব গোলমাল হয়ে যেছে। কত্তার যি এত জ্ঞান, সেই কত্তাও অ্যাকন চুপ! একার সোংসারে সারাদিন খেটে মরি, কুনো কুনো দিন সকালে, কুনোদিন সাঁঝবেলায় গুমুড়ে গুমুড়ে কাঁদন আসে, চুপে চুপে কঁদি, শব্দ করে কাদি। কেউ কি শুনতে পায়? শুতে এলে কত্তার সাথে দেখা হয়, সে-ও চুপ, মরিয়া হয়ে একদিন শুদুই, ইসব কি হচে? তুমি এমন চুপ ক্যানে?

আমার কিছু করার নাই, এখন আর আমার কিছু করার নাই।

বাঃ, তোমার কিছু করার নাই, তাইলে কে করবে? এতকাল ই সোংসারের লেগে, ই এলেকার লেগে তুমিই তো সব করে এয়েছ?

আমার সময় চলে গিয়েছে। আমাকে ছেড়ে সময় চলে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। এ এমন আগুন লেগেছে, আমি তো আমি, হিঁদু-মুসলমানের কোনো নেতাই এখন আর এই আগুন সামলাতে পারবে না। খেলা করতে গিয়েছিল আগুন নিয়ে। এখন সেই আগুনে দেশ পুড়ে ছারখার হচ্ছে এ তাদের দেখতেই হবে। যতসব জোচ্চোর বদমাশ!

কত্তা কাকে গাল দিচে, ক্যানে এত হেঁয়ালি করছে তা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না।

হেঁয়ালি না করে আমাকে বলে দিকিনি দ্যাশ ভাগ হবে কি হবে?

আগে সব পুড়ে ছাই হোক, তারপরে পোড়া দ্যাশ ভাগও হবে, স্বাধীনও হবে।

বোঝলম কত্তা এর চেয়ে পোঞ্চর করে আর কিছু বলবে না। তারপর বেশিদিন যায় নাই, একদিন সাঁঝরেতে আমাদের গাঁয়েই হ্যাঙ্গামা লাগল হিঁদু-মোসলমানদের মদ্যে। কারণ সামান্য। শ্যাভেদের একগাদা আউশ ধান পিটনোর লেগে খামারে রাখা ছিল, বোধায় জায়গা হয় নাই, খানিক আঁটি রাস্তায় গাদিয়ে রেখেছিল। হাজরাদের মোষের গাড়ি রাস্তার সেই ধানের গাদা মাড়িয়ে চলে গেয়েছে। সাঁঝরেতে দেখতে পায় নাই হতে পারে আবার ইচ্ছে করেও হতে পারে। শ্যাভেদের কত্তা দলিজে বসে লোকজন নিয়ে তামুক খেছিল। সে গজ্জন করে উঠল, ধানের গাদা মাড়িয়ে গেলি যি?

অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাই নাই।

জোসনা রেতে আবার আঁদার কি? দেখতে পাস্ নাই মানে?

দেখতে পাই নাই, পাই নাই, কি করবে কি তুমি? যা করেছি, বেশ করেছি।

বাস, আর যায় কোথা। শ্যাখের বড় ছেলে তাগড়া জোয়ান, সে কুদি মেরে ছুটে যেয়ে হাজরার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। এক ঝটকায় তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাজরা বললে, থাকল এই আমার গাড়ি। সবাইকে খবর দিয়ে আসছি আবার। বাপের ব্যাটা হলে গাড়ি তখন আটকে রাখিস।

আসলে ইসব কিছুই লয়। হিঁদু-মোসলমান দু-পক্ষই ভেতরে ভেতরে তৈরি হছিল। আগুন এতদিন ধোঁয়াইছিল, আজ এট্টু ফুই পেতেই দপ করে জ্বলে উঠল। খানিকক্ষণের মদ্যেই সারা গায়ের হিঁদু-মোসলমান মুখোমুখি এসে দাঁড়াইলে। আমার দ্যাওর-রা সব ছুটে বেরিয়ে গেল। লাঠি কাটারি গাঁইতি শাবল যে যেমন পেলে হাতে নিয়ে ছুটলে। ছি ছি ছি! সবাই কি সব ভুললে? এক মাঠ, এক ঘাট, এক রাস্তা, এক খরানি, এক বর্ষা, এক ধান–হায়, হায়, দু-দলের মাত্তর কটো লোকের লেগে সব বরবাদ হয়ে গেল! সি যি কি চেল্লানি, কি হাঁকাড়ি কানে আসতে লাগল কি বলব! জোস্না রাত খান খান হয়ে যেতে লাগল। নোংরা কথায় বাতাস ভরে উঠল। সি-সব কথা শুনে আমার গা পাক দিতে লাগল। কত্তা ঠায় পরচালিতে বসে। মানুষের সামান্য বেপদে যে কুনোদিন ঘরে বসে থাকে নাই, আজ এই মাহা বেপদেও সে থির বসে থাকছে কি করে? সি কথাটি তাকে বলতে গ্যালম।

আমি খবর পেয়েছি, শুধু আমাকে মারার জন্যেই আজকের এই ব্যাপার। আমাকে পেলেই মেরে ফেলবে, তারপর সব মিটিয়ে ওরা চলে যাবে। হিঁদুদের বিশেষ কাউকে মারার কোনো কথা আমাদের মুসলমানদের মধ্যে আছে কিনা জানি না।

কথা শুনে গা শিউরে উঠল। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে অ্যালম। এই কি সব হিঁদুদের মনের কথা? লয়, তা কিছুতেই নয়, ই শুদু দু-চারজনা মাথা মাথা মানুষ আর কটো বজ্জাত হিংসুক ছেলেছোকরাদের মতলব। আমার এই কথাই ঠিক। দু-পক্ষেরই কজনা মানুষের গলা কানে আসতে লাগল। তারা শুদু শুদুইতে লাগল, কাকে মারবে আর ক্যানে মারবে। আর মানুষ মারলে কার কি লাভ হবে। * শ্যাষ পয্যন্ত হলো না কিছু। সারারাত চেঁচাইতে চেঁচাইতে ঘ্রান্ত হয়ে ভোরবেলায় সবাই নিজের নিজের বাড়ি চলে গেল।

ই গাঁয়ে কিছু হলো না বটে, তাই বলে সারা এলেকায় কি কিছুই ঘটে নাই? দাঙ্গা লাগানোর এমন সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? চেরকাল দেখে আসছি দুনিয়ায় একটো-দুটো মানুষই সব লষ্টের মূল। রাখাল যেমন করে গরু ডাকিয়ে নিয়ে যায় তেমনি করে এই একটো-দুটো মানুষই ঘরো ভালোমানুষদের ডাকিয়ে নিয়ে যেয়ে গাড়ায় ফেলে। শহরগঞ্জেই এমন খারাপ মানুষ বেশি বোধায়। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব সোমায় শহরেই শুরু হয় এই লেগে। গাঁয়ের মানুষ শহরে গেলে সব ভুলে যায়, তার পাড়াপড়শি থাকে না, ভাইবন্ধু থাকে না। সে কাউকে চেনে না। পাশের বাড়িতে যে থাকে তাকেও লয়। ছোট দ্যাওরের শহরের বাসায় দু-একবার গেয়েছি বটে কিন্তু কিছুতেই জান টেকে নাই।

হিঁদু-মোসলমানের হিড়ি যেদি পাড়াগাঁয়েই চলে এল, তাইলে টাউন শহর কি বাদ থাকবে? ঠিক, একদিন খবর এল, মউকুমা টাউনের ইসুফ মিয়েকে তার নিজের বাড়ির ভিতরে যেয়ে মেরে এয়েছে হিঁদুরা। খুব নাম করা মোকাদিম এই ইসুফ মিয়ে। তার চামড়ার ব্যাবসা। মোসলমানদের মদ্যে তো বটেই, হিঁদুদের মদ্যেও এমন আবস্তাপন্ন মানুষ বেশি নাই। নিজেদের গাঁয়ের বাড়িতে সে থাকে না। ব্যাবসার লেগে শহরে একটো বেরাট রাজবাড়ির মতুন বাড়ি বানিয়েছিল। সিদিন সে বসে ছিল বাইরের ঘরে। একাই ছিল। এই সোমায় পাঁচ-সাতজনার একটি দল সিং-দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। তাদের হাতে টাঙি, খাঁড়া, রামদা–এই সব। অ্যাই, অ্যাই, কে, কে, কি চাই, বাড়ির চাকরবাকররা এইসব বলতে বলতেই তারা বাইরের ঘরের পাকা বারেন্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। শোনলম, ইসুফ মিয়ে চোখ তুলে তাকিয়েই দলটোকে দেখতে পেয়েছিল। সাবধান হবার কুনো সোমায় পায় নাই। সে উঠে দাঁড়িয়ে তোমরা কারা, কি চাই–শুদু এই কথাটি বলতে পেরেছিল, তখুনি তার ঘাড়ে পড়ল পেথম খাঁড়ার কোপ।

তাপর জান-পরান দিয়ে ইসুফ মিয়ে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ছুটে পালাইছে, গায়ে মাথায় পড়ছে দুদ্দাড় করে লাঠির বাড়ি। ঝুঁঝিয়ে রক্ত ঝরছে সব্বাঙ্গ দিয়ে আর গোটা দলটো আসছে তার পেছু পেছু। ই ঘর উ ঘর, কতো ঘর ই বাড়ির তার হিশেব নাই। ইসুফ মিয়ে একবার পালঙ্কের আড়ালে লুকুইছে, একবার আলমারির পেছনে দাঁড়াইছে, নাই, রক্ষা নাই, টাঙ্গি খাড়া লাঠি সব এক সাথে চলল। শ্যাষে রান্নাঘরে ঢুকে আর কুনোদিকে সে যেতে পারলে না, হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। দেখতে দেখতে খাঁড়া টাঙি রামদায়ের কোপে ইসুফ মিয়ের শরীল সাত টুকরো হয়ে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল।

আমি নিজে তো যাই নাই, নিজের চোখে দেখিও নাই, কিন্তুক এই বেবরণ শুনেই আমি যেন সব ঘটনা চোখের ছামনে দেখতে প্যালম। তারপর থেকে খালি ওয়াক দিতে লাগল প্যান্টের ভেতর। কিছু খেতে গেলেই বমি আসছে। কিন্তুক কিছুতেই বমি হচে না। রেতে ঘুমুইতে যেয়ে চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পেচি ইসুফ মিয়েকে একদল লোক একসাথে কোপাইছে।

সত্য আর ইসুফ মিয়ের মিত্যুর বেত্তান্ত শোনবার পর ভেবেছেলম আর হয়তো এমন খবর কুনোদিন শুনতে হবে না। তাই কি কখনো হয়? আমি শুনছি না, জানছি না বলে কি দাঙ্গা বন্ধ হবে? শুনতে চাই নাই তবু কদিন বাদেই শুনতে প্যাম পাশের গাঁয়ের মোসলমানদের একটি ছেলে জেলার বড় শহরে স্কুলে পড়ত। আমার খোঁকার বয়েসি। মনে হচে যেন দেখেছি ছেলেটিকে, খোঁকার সাথে একবার দুবার এয়েছে ই বাড়িতে। সে মোকাদিম বাড়ির ছেলে না হোক আবস্তাপন্ন গেরস্থ ঘরের ছেলে বটে। শহরে তাদের নিজেদের ছোট বাড়িতে সেই সোমায়ে সে একাই ছিল, আর কেউ ছিল না বাড়িতে। একদিন দোপর বেলায় আজরাইল এল তার জান কবচ করতে। কোথাও পালাইতে পারলে না। ছুটে যেয়ে বাড়ির খাটা পাইখানায় লুকিয়েছিল। সেইখানেই খাঁড়া বগী ছোরা ছুরি কিরিচ নিয়ে একদল হিঁদু যেয়ে তাকে কেটে কুচি কুচি করলে। আহা, জড়াপুটুলি পাকিয়ে পায়খানা-ভরা পাতনাতেই সে মুখ গুজে মরে পড়ে থাকল।

এই দুটি ভায়ানক খবরের পরে আমার দ্যাওর আর গাঁয়ের সব মোসলমানরা বলতে লাগল, মোসলমান সব মেরে শ্যাষ করবে হিঁদুরা, দ্যাশে একটি মোসলমানকে আর তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। বিশেষ করে দ্যাওর-রা এক-একদিন এক-একটি গুজব নিয়ে আসতে লাগল। কুনোদিন এসে বলছে, সাত গাঁয়ের হিঁদু এক হয়েছে, মা কালীর পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে খাড়া হাতে করে তারা সব সাঁঝরেতে ই গায়ে এসে হামলা করবে মোসলমানদের ওপর। কুনোদিন বলছে, অত সোজা হবে না, মোসলমানকে যারা চেনে নাই, তারা চেনে নাই। পাশের মোসলমান গাঁয়ের সব মোসলমান আজ সেজে আসছে। আগে এই গাঁয়ের হিঁদুকটোকে সাফ করবে, তবে অন্য কথা।

এইবার আমি কি করব? হিঁদু আর মোসলমানকে আলেদা না করে কি করব? কিন্তুক য্যাতত আলেদা করতে যেচি ত্যাতত যেন পাঁকে ডুবে যেচি! খালি মনে হচে দুজনা মোসলমানের এমন মরণের কথা শুনেই কি ভাবছি হিঁদু জাতটোই এমনি? তাইলে কি দুজনা হিঁদুর মোসলমানের হাতে এমুন মরণের কথা শুনলে ভাবতে হবে মোসলমান জাতও ঐ রকম? তাইলে সত্য-র যি মাকে দেখে এয়েছি সে আর ইসুফ মিয়ের মা যদি অ্যাকনো বেঁচে থাকে, সেই থুথুড়ি বুড়ি মা-টো কি আলেদা?

খবর সোমানে আসত লাগল। হাজার হাজার মোসলমান যেমন মরছে হাজার হাজার হিঁদুও লিকিন তেমনি মরছে। কারা কম, কারা বেশি ভেবে লাভ নাই। বাড়ির কাজকর্ম ছেড়ে বাইরের ঘরের জানেলা দিয়ে পাড়ার রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি। ছেলেমেয়েরা কাছে আসে না, কোথা কোথা ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটি থাকে ননদের কাছে। একা বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। সব ঠিক আছে, পাখি ডাকছে, বাতাস বইছে, আসমান ভেঙে মানুষের মাথার ওপর পড়ছে না, রাস্তা পথ। ঘাট যেখানকার যেমন তেমনি আছে এর মধ্যে খালি মানুষ মানুষকে মারছে! কলকেতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মোসলমানের রক্ত, হিঁদুর রক্ত। আলেদা কিছুই লয়, একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মোসলমান এক। ” কত্তাকে বলতে সে বললে, পড়তে কি ভুলে গিয়েছ? পড়ে দ্যাখো না? কাগজ আসা তো এখনো বন্ধ হয় নাই! পড়লেই বুঝতে পারবে, সব কিছু খালি তোমার এই পাড়াগাঁয়েই হচ্ছে না। সারা দেশে আগুন জ্বলছে। কলকাতায় হিঁদু বেশি, মুসলমান কম, কাজেই সেখানে মুসলমান মারা পড়েছে বেশি। মোটকথা এখন আর স্বাধীনতা টাধিনতার কথা নাই, স্বাধীনতা দাও আর না দাও, দেশ ভাগ করে দাও।

তাপর একদিন কত্তা বললে, গান্ধি নোয়াখালি গিয়েছে। সেখানে মুসলমান বেশি, খুব হিঁদু মারা যাচ্ছে। বিহারে মুসলমান মরছে বেশি। গান্ধি কলকাতাকে একরকম করে থামিয়েছে, নোয়াখালি বিহারকেও হয়তো এখন থামাতে পারবে, কিন্তুক ইংরেজরা যা চেয়েছিল তাই হলো। হিঁদু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিলে। পাকিস্তানের নাম করে জিন্না ইংরেজদের কাজটিকেই করে দিলে আর ক্ষমতার লোভে পড়ে নেহেরু-রাও তাই করলে। প্যাটেল, শ্যামা মুখুজ্জে মুসলমানদের আলাদা করে দিতে চেয়েছিল, তাই হলো। গান্ধি এখন একঘরে। দরজায় দরজায় তাকে কেঁদে মরতে হবে।

কত্তার সব কথা ভালো বুঝতে পারলম না। শুধু এই বোঝলম, বেপদ মুটেই শ্যাষ হয় নাই, মাহা বেপদ নেমে আসছে, সব লন্ডভন্ড হবে। এই দাঙ্গাই হবে অছিলা। মানুষ যি আবার সব ভুলে যাবে, আবার হিঁদু-মোসলমান একসাথে বসবাস করবে, সুখে-দুখে দিন। কাটাবে, এর কাজ উ করবে, ওর কাজ ই করবে, সবই হবে কিন্তুক তার এ সব ওলটপালট হয়ে যাবে।

দাঙ্গা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। ঠিক যেন যুদ্ধ আকাল মাহামারীর মতুন। এই আমাদের জেবনেই ওগুনো সব এল, আবার চলেও গেল। উসব তত মানুষের সোংসারে সব সোমায়ে ঘটে না, আসে আবার চলে যায়। ই দাঙ্গাও বোধায় তাই। দাঙ্গা তো জেবনের লিয়ম নয়, শান্তিই জেবনের লিয়ম। মনে হলো, সারা দ্যাশের মানুষের ভারি জ্বর হয়েছিল, জ্বরে গা পুড়ে যেছিল, চোখ হয়েছিল করমচার মতুন লাল, পিয়াসে বুকের ছাতি ফেটে যেছিল আর মাথা গোলমাল হয়ে শুদু ভুল বকছিল। সেই জ্বর এইবার ছাড়ছে।

এইরকম সোমায়ে, কে আর খবর দেবে, কত্তাই একদিন খবর দিলে, যাও, দেশ তোমার স্বাধীন হয়েছে।

তাই? আমাকে এট্টু বুঝিয়ে বলল–আমি ব্যাগোতা করে ফেলল।

হ্যাঁ, ইন্ডিয়া স্বাধীন হলো, দুশো বছর বাদে ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাবার সময় দেশটাকে কেটে দুভাগ করে দিয়ে গেল। দুভাগ কেন, তিন ভাগ! যেখানে যেখানে হিঁদু বেশি সেইসব জায়গা নিয়ে হিঁদুস্থান, আর যেখানে যেখানে মোসলমান বেশি সেসব জায়গা নিয়ে পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমানদের জন্যে পুব-পাকিস্তান। আর একটি ভাগ।

সব হিঁদু সব মোসলমান এই দুই দ্যাশে চলে যাবে?

তাই কি হয় নাকি? যেখানে হিঁদু বেশি সেখানে কিছু কিছু মুসলমান থাকবে আবার যেখানে মুসলমান বেশি, সেখানে হিঁদুও কিছু থাকবে।

আলেদা করবে বলে এমন করলে ক্যানে?

দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও একরকম ভাগ হয়েছে বললাম না? আমাদের এই বাংলা ভাগ হয়েছে আর পাঞ্জাব বলে আর একটি দেশও ভাগ হয়েছে। বাংলায় মুসলমান বেশি, হিঁদু কম। তুমি বোধহয় জানো না, বাংলা-বলা লোক ধরলে মুসলমানই বেশি। সেই হিশেবে গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানে ঢোকাতে হয়। হিঁদু নেতারা কি তাই হতে দেবে? বাংলাও এখন দুভাগ হয়েছে–যেদিকে হিঁদু বেশি সেই বাংলা হিঁদুস্থানে আর যেদিকে মুসলমান বেশি সেই বাংলা পাকিস্তানে ঢুকেছে।

বাঃ, ই আবার কিরকম কথা? ইখানকার সব মোসলমান পাকিস্তানে চলে যাবে, আর পাকিস্তানের সব হিঁদু হিঁদুস্থানে চলে আসবে?

না, আসবে না। গোঁজামিলই চলতে থাকবে। তুমি যদি মুসলমানের হিশেব করো, তাহলে তোমাকে এই দেশ ছেড়ে দিতে হবে—এ দেশ আর তোমার নয়, তোমাকে যেতে পুব-পাকিস্তান। পুব-পাকিস্তানের হিঁদুদেরও চলে আসতে হবে এখানে। হয়তো তোমার এই বাড়িতে আসবে কোনো হিঁদু গেরস্থ।

কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

নাক তো চাও নাই–কাজেই নাক পাও নাই তবে নরুন একটা পেয়েছ–ঐ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো।

এই বলে কত্তা বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *