২৬. ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই, সবাই পেথগন্ন হলো

ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই, সবাই পেথগন্ন হলো

সত্যিই, কত্তা পরের দিনই গেল আর সাঁঝলাগার আগেই গরুর গাড়িতে এক গাড়ি ধান নিয়ে ফিরে এল। এ এমন মানুষ যি জানে, ঘরে এখুনি খাবার নাই, শুদু ধান নিয়ে গেলেই হবে না, ধান তো আর খাওয়া যায় না, চালের দরকার সেই লেগে ধানের সাথে এক বস্তা চালও আনলে।

সাঁঝবেলায় গাড়ি য্যাখন বাড়ির ছামনে এসে দাঁড়াইলে, আমার ননদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বারে বারে বলতে লাগল, বাছারা সব না খেয়ে আছে গো, এই কথা কাকে বলি? মানুষ নাই, এই সাংসারে মানুষ নাই! অ্যাকনো এই ভাইকেই হাতে ধরে খাওয়াইতে হবে সবাইকে।

ভাইকে জড়িয়ে ধরে এত কথা সে বলতে লাগলে বটে, ভাই কিন্তুক চুপ। আমি দেখলম কত্তা বুনকে একটো সান্ত্বনা দিলে না, পাথরের মতুন দাঁড়িয়ে থাকলে। তাই দেখে আমার নতুন করে ভয় লাগতে লাগল। বাড়ির ভেতরে যেয়ে দেখি, ভাইয়েরা সব যেমনকার তেমনি ঘোরাফেরা করছে, কারুর কুনো তাপ-উত্তাপ নাই, যেন কিছুই হয় নাই। ছেলেপুলেরা যি দু-দিন খায় নাই, তার সব দায় যেন একা কত্তার। বোধায় সবারই একটি হিশেব, মাঠ জুড়ে ইবার খুব ধান, কুনো পেরকারে তিন-চার মাস কাটাইতে পারলেই আর ভাবনা নাই। ত্যাকন আর অভাব হবে না।

ধান সব সাথে সাথে গাঁয়ের সেই বেধবা বুনদের বাড়িতে ভাঁচা দেওয়া হলো। কাঠ-কুটো জ্বালটও কিছু জোগাড় করে দেওয়া হলো তাদের। আর ভাবনা নাই, কদিন বাদেই আগন মাস পয্যন্ত খাবার মতুন চাল থাকবে বাড়িতে। রেতে কত্তা বললে, অনেক হীন হয়ে এই ধান আনতে হয়েছে আমাকে। কাছের কোনো গাঁয়ে যাই নাই। আমি, চেনা মানুষের কাছেই গিয়েছিলাম, তবে দূরের এক গাঁয়ে।

দিলে ধান?

দিলে বৈ কি। আমি জানি চাইলেই দেবে। এমনি এমনি তো নোব–মাঘ মাসের মধ্যে দেড়গুণ ধান ফেরত দিয়ে শোধ দোব।

এই ধানে ই কমাস আমাদের খুব চলে যাবে, খুব খুশি হয়ে আমি বললম, মাঠেলিকিন এবার ধান খুব, খামারে মরাইয়ের জায়গা হবে না।

তা হবে, সে হলে তো ভালোই।

কত্তার কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে তাকাই। আসলে ভয় ভয় করছিল বলেই খুশি হবার ভাব দেখাইছেলম। কত্তা কি তার সেই পিতিজ্ঞা ভোলে নাই। না, ভোলে নাই, কত্তার মুখ দেখেই বোঝলম যে ভোলে নাই। ই সোংসার সে আর এক-ভাতে রাখবে না। শাশুড়ি নাই, কত্তাকে জোরের সাথে কথা বলার অ্যাকন আর কেউ নাই। এক উপায়, সব কটি ভাই যেদি তাদের বুনকে সাথে নিয়ে কত্তার কাছে এসে তাকে ধরে। কিন্তুক তাতেও দেরি হয়ে যেচে, উ মানুষের এমনি জেদ যি য্যাতো দিন যায় জেদ তার ত্যাতো বাড়ে আর ভেতরে যি রস-কষ আছে, সব শুকিয়ে যায়। তবে ইসব কথা ভেবে লাভ কি? কেউ তো এল না তার কাছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, মাঠের ধানের দিকে চেয়ে সবাই নিজের নিজের হিশেব করছে। আমি যেমন ভাবছি, তেমন হিশেব সবাই না-ও করতে পারে কিন্তুক সোংসারে অ্যাকন শান্তি আর নাই। সবারই ভেতরে একটো রাগ তুষের আগুনের মতুন ধিকি ধিকি জ্বলছে আর জায়ে জায়ে যি আখেজ দেখছি তাতে রেষারেষির, কুনো ঢাকাচাপা নাই, সব সোমায় পেকাশ পেয়ে যেচে। দেখেশুনে ননদ আর কি করবে, মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়াইছে। শুদু একটি ভয় তার জানটোকে কুরে কুরে খেচে। বড় ভাগ্নেটি অ্যাকন আর ইখানে থাকে না, শহরে চাকরি করে। সে ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে গেয়েছে বলা যায়। ছোটটি অ্যাকনো ইখানে আছে, কিন্তুক ডামাডোলে সোংসার ভাঙলে সে কি আর ইখানে থাকবে, না তার বাপ চাচা তাকে ইখানে থাকতে দেবে? ত্যাকন বাঁচবে কি করে ননদ?

কত্তা আজকাল শহরে কমই যেছে। কথা খুব কম বলছে। সারাদিন বাড়িতেই থাকে, গাঁয়েও কারুর বাড়ি পেরায় যায় না। কত্তামার বাড়ি যাওয়াও কমতে কমতে আকন পেরায় বন্ধই হয়ে গেয়েছে। গাঁয়ের সেই আবস্তা তো আর নাই। মহামারী যুদ্ধ আর আকাল এসে সব লয়ছয় করে দিয়েছে। ঘরে ঘরে মানুষ উপোস করেছে, অ্যাকননা করছে। রোগে, শোকে-তাপে, না খেয়ে কতো চেনা লোক যি দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেয়েছে, তার সুমার নাই। কত্তামা, যি কিনা রাজার ভাগ্নি, তাদের না খেয়ে হয়তো থাকতে হয় নাই, তবে যুছু আর আকালের হাওয়া সি সংসারেও যেয়ে লেগেছে। ইসব নিজের চোখে দেখতে হবে বলে কত্তা যি কোথাও যায় না, তা আমি জানি। খামারের দিকে পরচালিতে একটো লোহার চেয়ারে সারাদিন সে বসে থাকে, কথা বলতে গেলেই কেমন খেকিয়ে ওঠে। সকাল দোপর রেতে দুটি খেয়ে আবার ঐ পরচালির চেয়ারে।

ভেতরে-বাইরে লক্ষ্মী ছেড়েছে। তিন-তিনবার গরু-মোষের কি একটো রোগ এল, ঝেটিয়ে গোয়াল খালি হয়ে গেল। চোখের ছামনে বড় বড় হেলে গরু, দুধেল তিনটো গাই, দু-জোড়া হাতির মতুন বড় বড় মোষ দেখতে দেখতে ছটফট করে মরে গেল। এমন দিন ত্যাকন এয়েছিল যি মনে হয়েছিল গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মানুষজন কিছুই থাকবে না। অ্যাকন দেখছি কিছু কিছু টিকলে বটে, তবে সব যেন কেমন আড়া-আড়া ছাড়া-ছাড়া। শনি ঢুকেছে গেরস্থালিতে–সবাই যেন ডোকলা, সবাই যেন হাঘরে।

বাড়ির ভেতরে জায়েরা কিসের লেগে যি ইসব করছে কে জানে! এই টানছে, এই ছিড়ছে, মাটির ভাতের হাঁড়ি এমন করে চুলো থেকে নামাইছে, তাতে যি ভাঙছে না এই বড় ভাগ্যি। ঝন ঝন করে কাঁসার থালা ফেলছে, পেতলের ডেকচি, পানির ঘড়া দুম করে নামাইছে মেঝের ওপর, কাঁসার গেলাস ঠন ঠন করে গড়িয়ে পড়ছে উসারা থেকে এগনেয়। শাড়ি শায়াটো এমন করে টান দিচে যি কাপড় শুকনোর তারে লেগে ফাঁস করে ছিড়ে যেচে। কিন্তুক এত যে গামুস-গুমুস করছে, মুখে কুনো কথা নাই। বাড়ির ভেতরে বোদ-বাদারি ময়লা আবজ্জনা, ঘরে ঝটপাট নাই, লেপামোছা নাই, সব জায়গায় চিমসে গন্ধ। ননদ-ও হাল ছেড়ে দিয়েছে, কে কখন আসছে, কখন

যেচে, সি হিশেব সে আর রাখতে পারছে না।

বাইরে গোয়াল তিনটো পেরায় খালি। দলিজ ঘর খাঁ খাঁ করছে। কবে থেকে মানুষের আসা-যাওয়া নাই, খামার জুড়ে একহাঁটু ঘাস আর কন্টিকারির জঙ্গল। এইসব ছামনে নিয়ে কত্তা বসে থাকে, সে-ও যেন সব্বোনাশটোর লেগে অপিক্ষে করছে।

ইদিকে সারা গাঁয়ের মানুষ মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। য্যাতো দূরেই হোক পোষ মাস, তাকে তো শ্যাষ পয্যন্ত আসতেই হবে। ধান পাকছে, সোনার মতো রঙ ধরছে ধানে, কঁচা সোনার রঙ এট্টু এট্টু করে ধানের গায়ে লাগছে। সারা মাঠ ভরা, দু-বছর বাদে কি ধানই না এবার হয়েছে! ঘরে বসে ভাবনা করতে করতেই গরম ভাত মনে মনে খাওয়া হয়ে যেচে। সেই আসবে, তাইলে এতকাল কোথা ছিল পোষ মাস!

অন্য অন্য বার কতো কথা বলে দ্যাওর-রা। ইবার সব মুখে কুলুপ এঁটে মাঠের কাজে নেমেছে। একটি কথা বলে না কেউ। ধান কাটা শুরু হয়ে গেয়েছে, আঁটি বাঁধা, টিপ দেওয়ার কাজও চলছে। তাপর একদিন শুরু হয়ে গেল ধান বওয়ার কাজ। দুটো মোষের গাড়ি ভোর থেকে সারাদিন ধান আনছে। মুনিষরা সারাদিন ধান পিটোইছে। আমি একবার একবার যেয়ে দেখি, ধান গাদা হচে, পিটনোর পাটার গায়ে ঠিক গাদা করা সোনার নোলক। ঐ থেকেই ধোঁয়া ওঠা কুঁদফুলের মতুন শাদা ভাত হবে। সেই ভাত থালায় থালায় ভরে ছেলেপুলেদের সামনে ধরে দেবে ননদ। ভাবনা এই পয্যন্ত যেই এল অমনি বুকের ভেতরটো কে যেন খামচে ধরলে। ছেলেপুলে কোথা পাব? সব তো আলো আলেদা ঘরে নিজের নিজের মায়ের হাতে খাবে।

তবে এইটি, আমি জানি কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না বলে, কারুর সাধ্যি নাই যি তাকে যেয়ে বলবে, আর দেরি করা ক্যানে, সোংসার পেথক করে দাও। না, সি সাধ্যি কারুর হবে না। অ্যাকন আবার কত্তাকে দেখে মনে হচে, সে বোধায় এইবারের মতুন নিজের পিতিজ্ঞে ভুলে গেল! আল্লা, তাই যেন হয়। কিন্তুক তাই কি হবে? হঠাৎ একদিন রেতে, কিছুই যেন হয় নাই, এমনি করে কত্তা বললে, ধার করে আনা ধানের চালে সংসার কতদিন চলল, বলতে পারবে?

তা পেরায় চারমাস।

ঠিক করে বলতে হবে। এখনো চাল যা আছে, তাতে কতোদিন চলবে?

কাল বুবুর সাথে যেয়ে দেখেছেলম, দশ-পনেরো দিন যেতে পারে আরও। মাঠের লতুন ধান ভঁচা দেওয়া হয়েছে বুবু বললে। এমন হিশেব করে দেওয়া হয়েছে যি মজুত চাল শেষ হবার আগেই যেন বাড়ির নতুন চাল আসে।

শেষ হবার দু-একদিন আগে আমাকে বোলো।

ইকথা শুনে কত্তা আবার কি করবে? একবার ভাবলম বটে কথাটো নিয়ে, আবার ভুলেও গ্যালম। ই কথা কি কারুর মনে থাকে? কদিন বাদে যেই বলেছি বাড়ির পুরনো চালে আর দিন দুয়েক চলতে পারে, অমনি কত্তা একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।

তোমাকে বলেছিলাম না ঠিক করে জানাবে। দিনকতক, দু-দিন, তিনদিন আবার কি কথা। যাও, দেখে এসে আমাকে জানাও ঠিক কদিন যাবে।

কি করব, দেখে এসে বললম আবার, কাল আর পরশু এই দুদিন যাবে। ভঁচা-বাড়ি থেকে কালকে নতুন চাল দিয়ে যাবে বলেছে।

কি আচ্চয্যি, ঠিক পরের দিনই সাঁঝবেলায় কত্তা উত্তর-দুয়য়ারি ঘরের উসারায় সব ভাইদের ডাকলে। ঘোট দাওর যি শহরে থাকে, তাকেও একদিনের মদ্যে খবর দিয়ে ডেকে আনলে।

সাঁঝবেলায় সারা বাড়ি থমথমে। একটো হেরিকেন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ভাইরা সব বসেছে শেতলপাটির ওপর। কত্ত সব শ্যাষে বুনকেও ডেকে নিলে। তাপর আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলে। সি কথা শোনা যায় কি যায় না, কান পাতলে তবে শোনা যায়। কিন্তুক পেত্যেকটি কথা পোষ্কার, একবারও থামছে না, একটানা বলে যেছে। ভাইরা ঘাড় নামিয়ে শুনছে। জায়েরা দেখলম নিজের নিজের ঘরের দরজার ছামনে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করছে, নোখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে, আঙুলে কাপড়ের আঁচল জড়াইছে। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে কত্তার কথা শুনছি। মানুষ কি এমন করে কথা বলতে পারে! গলার আওয়াজে উঁচু-নিচু নাই, কথা হাতড়ানো নাই। এক জেবনের সব বলছে কত্তা। এমন করে বলছে যি মনে হচে কথা শ্যাষ হলে আর একটি কথা যোগও করতে হবে না, বাদও দিতে হবে না। বাপের মিত্যুর কথা থেকে বলতে শুরু করেছে। মা কেমন করে ছেলেপুলেগুলিনকে আগুলে রেখেছে, কেমন করে খাওয়া জুটেছে, মা সারাদিনের পরে ঝিকিমিকি সাঁঝবেলায় দোপরের ভাত খেতে বসেছে, কেমন করে রাত গেল, কেমন করে দিন গেল, মাস গেল, বছর হয়ে গেল।

এইসব কথা বলতে যেয়ে কত্তা মুটেই নিজের কথা সাতকাহন করে বললে না। শুদু ভালোদিন, মদিনের কথা বললে, দুবারের যুদূর কথা বললে, একবার বড় খোঁকার মিত্যুর কথা বললে। কিন্তু তাতে তার গলা কাপল না। মায়ের মিত্যুর কথাও বললে অমনি করে। আকাল মহামারীর কথাও বললে। রাত বাড়ছে, সোমায় গড়িয়ে যেছে কিন্তুক মাঝখানে তাকে থামিয়ে কারুর একটি কথা বলবার জো নাই। ভাইরা বসে আছে আর আমরা বউরা সেই যি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি।

সব কথা বলা হয়ে যাবার পরে কত্তা ঐ একইরকম গলায় খুব কঠিন কঠিন কথা বলতে লাগল। রাগ করে লয় বটে, তবে সি বড় কঠিন কথা। তার আসল কথাটো হচে, বেপদ মসিবতের সাগর পেরিয়ে আসা হয়েছে, অ্যাকন সবারই নিজের নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলেদা সোংসার চালানোর ক্ষমতাও হয়েছে। নিজের সোংসার ছেলেপুলে নিজেই চালাইতে চায় সবাই, আর মোট একজনা চালাইলে কিংবা সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে চালিয়ে দিলে ভালো লাগে না। কত্তা খুব ভালোমুখে বললে, এক-এক জন এক-এক ভাবে চলতে চায়, এক-এক পথে ছেলেপুলে মানুষ করতে চায়, একান্নবর্তী পরিবারে তা সম্ভব হয় না। সেইজন্যে যুক্তি পরামর্শ করে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। সবাই যেটা মনে মনে চাইছে, সেটাই করার জন্যে আজ আমি সবাইকে ডেকেছি।

আমরা তো কেউ সংসার ভাঙতে চাই নাই।

তুই নিজের কথা বল্। আর কেউ কি চেয়েছে না চেয়েছে সে সেই-ই বলবে।

আমি সংসার পৃথক করতে চাই নাই।

আমি দেখলম, সত্যি যে সসাংসার ভাঙতে চায় নাই, আমার ভাশুর–সে এইকথা বললে না, বললে আর একজনা। আমি জানি ছোট দ্যাওর-ও মন থেকে আলেদা হতে চায় নাই, কিন্তুক সিকথা তার বলার সাওস নাই, একদিষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে ছোটবউ।

এই কথাটি আমি যেন আর একবার কারুর মুখ থেকে না শুনি। মিছে কথা আমি ঘেন্না করি। কে কি ভাবে সেকথা আমি তার নিজের চাইতেও ভালো জানি।

কত্তা আরও কি কি কথা বলতে যেছিল, এই সোমায়, আমার ভাশুর একেবারে কচি শিশুর মতুন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। সেই কান্না শুনে কাকে চুপ করতে হলো। ভাশুর ত্যাকন দু-হাতে কপাল চাপড়াইতে চাপড়াইতে মাথার চুল টেনে ছিড়ছে আর মুখে খালি এক কথা, হায় হায়। ই কি হলো, হায় হায় ই কি হলো। ঘাড় পেরায় মাটিতে ঠেকিয়ে ভাইরা। সবাই চুপ করে থাকলে। কত্তাও দেখলম ঘাড় নামিয়ে রয়েছে।

খানিক বাদে ভাশুর থামলে কত্তা আবার ঠিক আগের মতুন গলায় বললে, যুদ্ধ চলছে সারা দুনিয়ায়, এখনো শেষ হয় নাই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ একরকম করে পার হয়ে এইছি। দুর্ভিক্ষ আকাল মারী কিছুই ভেদ করতে পারে নাই এই সংসারের। কতো সংসার ছারখার হয়ে গেল, কতো মানুষ দুনিয়া ছেড়ে গেল, আমাদের কিছু হয় নাই। আর কিছু নয়, বাড়ির ছোটরা যেদিন না খেয়ে উপোস করে দিন কাটালে, আমার মাথায় বাজ পড়ল না, তাদের বাপ-চাচাদের মাথাতেও বাজ পড়ল না। পড়া উচিত ছিল, সংসার ভাঙার জন্যে যে বাপ-চাচারা ছেলেমেয়েদের উপোস করিয়ে অপেক্ষা করতে পারে তাদের মরাই ভালো। সেইদিনই আমি ঠিক করেছি, সকলের মনোবাঞ্ছা আমি পূরণ করব। মানুষ না হয়ে স্ত্রৈণ হয়েছে যে পুরুষমানুষ তার আর এক সংসারে থাকার কোনো দরকার নাই।

কত্তা এই ততদিলে নিদেন হেঁকে। সে চুপ করলে দেখলম বাকি সবাই মাথা হাট করে চুপ করে থাকলে। গলা নামোয় নিয়ে যেয়ে ঐ যি কথা কটি সে বললে, কেউ আর তার কুনো উত্তর করতে পারলে না।

ত্যাকন কত্তাই আবার সহজ গলায় বললে, মন খারাপ করার কি দরকার? যা হবার তাই হচ্ছে। ঝগড়া-ফ্যাসাদ আমরা কেউ করছি না। আর এক দিক থেকে বলি, নিজের মতন করে, নিজের হাতে সংসার করতে ইচ্ছে সবারই করে, সব সময় ঘাড়ে একটি কর্তার ভূত থাকা কি ভালো? সংসার বেশি বড় হয়ে গেলে গোলমাল বিশৃঙ্খলা হয়। তাতে ছেলেমেয়েদেরও ওপর অবিচার হয়।

কত্তার এই কথার পরে বাতাস যেন অ্যানেকটো হাল্কা হয়ে এল। সবাই সহজ সুরে কথা বলতে লাগল। সোংসার ভালো করে চালাবার লেগে যেমন করে কথা বলে, সোংসার পেথ করার লেগে অ্যাকন তেমনি করেই সবাই জমি-সোম্পত্তি নিয়ে কথা বলতে লাগল। সবকিছুর ভালোটা কত্তার ভাগে দেবার লেগে ভাইদের সি কি ঝুলোঝুলি! একমাত্তর ভাশুর শুদু চুপ করে থাকলে।

বাড়িতে যে যেমন থাকে, ছেলেমেয়ে নিয়ে যে যে-ঘরে থাকে, আগের সেই বেবস্কাই বাহাল রইল। রাঁধা-বাড়ার লেগে যি চালাটো ছিল সিটি বেশ বড়ই। সি-টি আর অ্যাকন ভাগ হলো না শুদু পেয়োজন মতুন আরও কটো চুলো তৈরি করে নেওয়ার কথা বলা হলো। জমি-সোম্পত্তি ল-দ্যাওরের ঠোঁটস্থ, সে-ই মুখে মুখে কোথা কি আছে বলতে লাগল। গরু মোষ ছাগল কুনো হিশেবই তার জানা বাকি নাই। সে বলতে লাগল আর মুখে মুখেই সব ভাগ হতে লাগল। কতক সরেস জমি কত্তাকে দেবার লেগে কে যেন পেস্তাব দিলে, কত্তা আবার একবার ধমকিয়ে উঠল কিন্তুক আমার দাদির দেওয়া জমিটো যা এতদিন এজমালিতে খাওয়া হছিল, সেই জমিটো য্যাকন আবার আমাদের ভাগে দেবার কথা হলো, ত্যাকন কত্ত বেশি আপত্তি করতে পারলে না। জমি তো তার লয়, সে আপত্তি করবে কি করে? জমি আমার। মনে পড়তে লাগল, একদিন এই জমির ধান আলাদা করে। মরাই বেঁধে রেখে ল-দ্যাওর বলেছিল, এ মরাই তোমারই রইল। আমি তাতে রাজি হই নাই। আজ আমাকে রাজি হতে হচে। একবার মনে করলম, যাই, ঐ পুরুষমানুষদের যেয়ে বলি, ই জমি আমার বটে, তবে ই আমি একা নোব না, সবার ভেতরে ভাগ হোক ই জমি। ভাবলম বটে, তবে সি যি কি অসোম্ভাব তাও সাথে সাথে বুঝতে পারলম। সোয়ামির কথা ছাড়া জমি ক্যানে একটি পয়সাও কাউকে দেবার আমার এক্তিয়ার নাই! ল-দ্যাওরের দিকে চেয়ে দেখলম। তার কিছুই মনে নাই, সে হেসে হেসে ই জমি যি আমার, কেনার পর থেকেই আমার সেই কথাটোই বারে বারে বলছে।

সব বিলি-বেবস্থা য্যাকন হয়ে গেল, কত্তা বললে, দলিল সব আমার কাছে, যার যেমন জমি ভাগে পড়েছে সেইরকম সব দলিল আমি পরে সবাইকে বুঝিয়ে দোব। নিজের নিজের দলিল নিজের কাছেই রাখতে হবে।

কথাবার্তা শ্যাষ করে সবাই উঠতে যেছে, এমন সোমায় আমার ননদ ভাইদের কাছে বসে পা ছড়িয়ে মড়াকান্না কাদতে শুরু করলে। সি এমনি কাঁদন যি তাতে একটি কথা নাই, তা শুদুই কাদা, শুনলে পাষাণও ফেটে যায়। অ্যানেকক্ষণ কেঁদে সে এইবার ফেঁপাইতে ফেঁপাইতে বললে, আমার জমি আমাকে দিয়ে তোমরা আমার সব কেড়ে নিলে। জমি নিয়ে আমি কি করব? আমার কবরের লেগেও তো উ জমি লাগবে না। উসব না করে আমাকে বরঞ্চ তোমরা মেরে ফেলল। এই কথা বলে আবার চুল ছিড়তে লাগল ননদ।

কত্তা শুদু বললে, কঁদিস না, তুই একা মানুষ, তোর আবার ভাবনা কি? এখন তোর একার একটি বাড়ি নয়, সব ভাইয়ের বাড়িই তোর বাড়ি।

এই পেথম মনে হলো কত্তা মন-রাখা কথা বললে।

ভাগ-জোগের কথা শ্যাষ হতে হতে সিদিন রাতদোপর পেরিয়ে গেয়েছিল। মাঝে একবার থেমে রাতদোপরের পরে সবাই রেতের খাবার খেয়ে নিলে। সবকিছু গরম করে আমরা বউ-ঝিরা পুরুষদের খাওয়ালম। সব ভাই মিলে মনে হয় এই পেথম আর শ্যাষবারের মতুন একসাথে বসে খেলে। পেথমবার বলছি এইজন্যে যি আমি অন্তত ই সোংসারে আসার পর থেকে পাঁচ ভাইকে একসাথে খেতে দেখি নাই। কত্তা বরাবর নিজের ঘরে আলেদা একা খায়। ভাশুরের সাথে কুনো কুনো ভাইকে কিম্বা ল আর ছোট দ্যাওরকে একসাথে কখনো কখনো খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে কিন্তুক পাঁচজনাকে একসাথে কখনো দেখি নাই। আর শ্যাষবারের লেগে বলছি, অনুমান যি, আর কি কুনোদিন তাদের একসাথে খেতে দেখতে পাব? সোংসার ভাঙার। লেগে জড়ো হয়েছে বলে বাধ্য হয়ে তারা আজ একসাথে বসে খেচে, সোংসার জোড়া দেবার লেগে নয়।

ঐ রেতেই যেমন যেমন কথা হলো সেইভাবেই সব ভাগ হলো, ঝগড়াঝাটি হলো না, পাড়াপড়শি, গাঁয়ের লোকদের ডাকতে হলো না। তবে সব ঠিকঠাক হতে, আলেদা আলেদা হাঁড়ি হতে দিনকতক সময় গেল। বুকে পাষাণ বেঁধে চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলম। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝবার জো নাই, কিছুই বদলাইল না, যে যেমন ছিল তেমনি থাকলে, শুদু ছেলেপুলেগুলি নিজের নিজের মায়ের কাছে খেতে লাগল।

আমি জানি কি সব্বোনাশ ই সোংসারের হয়েছে। মুখে কারুর একটি বাকি নাই। সবাই ঘুরে বেড়াইছে ঠিক যেন মড়া, ধড়ে জান তাই, মুখে হাসি নাই। ছেলেমেয়ের মুখে জ্যোতি নাই, রা-কথা নাই। কি চেল্লাচিল্লি, হাঁকাহাঁকি, মারামারি ছিল ই সোংসারের ছেলেমেয়েদের মদ্যে অ্যাকন–তার কিছু নাই। ননদকে আজ কদিন থেকে দেখতে পাওয়াই যেচে না। নিজের ঘরটিতে–যে ঘরে বড় খোঁকা মরেছিল, গিন্নি মরেছিল–সেই ঘরে আঁদারের মদ্যে দিনরাত বসে আছে। তার বুনপো, আমাদের ছোট ভাগ্নেটি আজ কদিন হলো নিজের বাড়িতে গেয়েছে, আর বোধায় ফিরবে না। বড় হয়েছে, হয় স্কুলপাশ দিয়ে শহরে পড়তে যাবে, নয় নিজের বাড়িতে বাপ-চাচার কাছে ফিরে যাবে। কথা অ্যাকনো হয় নাই, তবে ননদ ঠিক বুঝে গেয়েছে যি পাখি আর বেশি দিন থাকবে না। আমার ছেলেটি কবে থেকে শহরে পড়ছে কলেজে, বাড়ি পেরায় আসেই না। মেয়েটো-ও শহরের মেয়ে-স্কুলে ভত্তি হয়েছে, থাকে তার মামুর কাছে, আমার সেই মায়ের প্যাটের ভাইটির কাছে। তবে খুকি ঘন ঘন বাড়িতে আসে। বাইরের ঘরটিতে আগের মতুনই আমি ছোট ছেলেদুটিকে নিয়ে থাকি। ওখানে একবার ঢুকে গেলে বাড়ির আর কুনোকিছু আমাকে দেখতে হয় না। কত্তা ঠিক আগের মতুন পরচালিতে লোহার চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। কি ভাবে সেই জানে।

খামারে একটার পর একটা মরাই বাঁধা হতে লাগল। একদিন দু-দিন পরে পরে মুখে গামছা জড়িয়ে মুনিষরা সব মরাইয়ে ধান তোলে। কেমন রাবণের মতুন মুখ ফুলিয়ে গোমড়ামুখে কাজের দেখাশোনা করে ল-দ্যাওর। এক-একটো মরাই যিদিন শ্যাষ হয়, সিদিন যার মরাই সে মুনিষদের চিতুই পিঠে না হয় ধুকি খাওয়ায়। আগের মতুন আট-নটো মরাই দেখে খুশিতে ডগোমগো হয় না কেউ। খামার ভরে মরাই তেমনিই আছে বটে, কিন্তুক কুনো ভাইয়ের একটি, কুনো ভাইয়ের দেড়টি মরাই, তা দেখে একা একা আর কতো খুশি হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *