২৫. সোংসার তাসের ঘর, তুমি রাখতে চাইলেই বা কি

সোংসার তাসের ঘর, তুমি রাখতে চাইলেই বা কি

দুটি বছর পেরুল। এই দুটি বছর যি কেমন করে গেল সি শুদু আমিই জানি এমন কথা বলতে পারব না। দুনিয়া জাহানে যারা আজও বেঁচে আছে, না খেয়ে শুকিয়ে মরে নাই, রোগে ভুগে মরে নাই, রাস্তায় হুরে পড়ে মরে নাই–কুনো পেকারে শুদু বেঁচে আছে, তারাই তা হাড়ে হাড়ে জানে। একটি একটি করে দিন আর যেন কাটে নাই, রোজ-কেয়ামতের লেগে অপিক্ষেও এর চাইতে ভালো।

গায়ে লোক অ্যাকন অ্যানেক পাতলা। মরার ছিল যারা, অ্যানেক খুনখুনে বুড়ো, এমনিতেই দু-দিন বাদে যারা মরবে, তাপর যারা রোগে ভুগছিল, ওষুধ-পানি তো দূরের কথা, একমুঠো খুদও জোটে নাই, তারা আর দেরি করে নাই। বিছেনায় সেই যি শুয়েছে, আর ওঠে নাই। কাউকে কিছু বলে নাই, ওষুধ চায় নাই, ভাত চায় নাই, একবার কাছে বসবার লেগে বউ-ছেলে-মেয়ে কাউকে ডাকে নাই, বোধায় জাকামদানির সোমায়েও এতটুকুন শব্দ করে নাই। হিঁদু হলে, মনে হয়, ভাই বন্ধু ছেলের কাঁধে চেপে পাঁচ কোশ দূরে ভাগীরথী নদীর পাড়ে শ্মশানে যেয়ে পোড়বার আশাও করে নাই। কি জানি, মোসলমান মওতা কবরের আশা করেছিল, না করে নাই। তবে তা একরকম করে হয়ে গেয়েছিল। কবর দেবার লেগে বেশি দূরে তো যেতে হতো না! মাঠের ধারে, পুকুরের পাড়ে, নাইলে কুনো একটা খানায় গাড় খুঁড়ে মড়া রেখে এলেই হতো। এমনি করে বুড়ো-ধুরো, জনম-রুগি, ঢোক-পিয়াসি, উদুরি যারা ছিল তারা পেথমেই গেল। তাপরে মরতে লাগল সব রোগা-ভাংরোগুলিন, আজ হোক, কাল হোক যারা মরতই। এদের মরা হয়ে গেলে বাল-বাচ্চাদের মড়ক এল। দুধের বাচ্চা, দুধ ছাড়া আর কিছু খায় না, খেতে শেখে নাই–তা মায়ের বুক এমন শুকনোর শুকননা যি চোঁ চোঁ করে টেনেও এক ফোঁটা দুধ বার করতে পারত না বুকের দুধের বাছা দুনিয়ার আসে তো দয়া করে, রহমতের মতুন। বয়ে গেয়েছে তার বাঁচতে। এয়েছেলম, থাকতে দিলি না, চললম–বোধায় এই মনে করেই সব ঝটপট বিদেয় হতো। তবে এরা মরলে কুনো হ্যাঙ্গাম-ফৈজত নাই। মাঠের ধারে এই পুকুর ঐ পুকুরের পাড়ে গাড় খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে এলেই হতো। হিঁদু-মোসলমান সবাই তা-ই করত।

সেই যে পরপর দু-বছর একটি দানা ফলল না, যুদ্বুও পেলয়-আকার নিলে, কলকাতা বন্দোয়ান আর কুন কুন্ শহরে জাপানিরা বোমা ফেললে, সেই সোমায় ধানচাল একদম গরমিল হয়েছিল, পয়সা তো দূরের কথা সোনার অলংকারগয়না দিয়েও একমুঠো চাল পাবার উপয় ছিল না। শহরেও পাওয়া যেছিল না, আবার দামেও আগুন লেগেছিল ধান-চালের বাজারে। কত্তাও ত্যাকন বলেছিল চালের এত দাম সি-ও লিকিনি বাপের জম্মে দেখে নাই। তবে গাঁয়ের কথা আলেদা, গাঁয়ের লোকে তো আর চাল কিনে খেত না। তাদের কাছে চালের দাম বাড়লেই কি, কমলেই বা কি? তারা পরপর দু-সন ধান পায় নাই একটো। তাদের তো ঠারো দাঁড়িয়ে মরতে হবে–শুয়ে-বসে আয়েস করে মরার ভাগ্যও তাদের নাই।

ত্যান দেখেছেলম, মানুষরা সব এক জায়গায় বসে না, কেউ কারুর সাথে কথা বলে না, দুটো গল্পগাছাও করে না। কিসের লেগে দিনরাত কুকুরের মতুন হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াইছে। এমনিতে কথা নাই, কিন্তুক আবার কথা মানেই মারামারি। উপোসি মানুষ মারামারিই বা করে কেমন করে? খানিক বাদেই হাঁফিয়ে যেয়ে একজনা আর একজনার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন পারলে কাঁচা চিবিয়ে খায়। আমাদের বাড়ির খামারে দেখেছি একগাদা লোক পাঁচিলের ছোয়ায় বসে আছে কিন্তুক কেউ একটি কথা বলছে না। গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় হন হন করে হেঁটে চষে বেড়াইছে মানুষ, কুনো কাজ নাই। শুদু আনাগোনা-ত্যানা, তাঁত বোনাবুনি করছে। কি করবে, কোথা যাবে কিছুই যি ঠিক নাই। আদুরে আদুরে ছেলে সব দল বেঁধে মাঠের দিকে চলে যেচে, সারা দিনে আর বাড়ি আসে না। এসে কি করবে? বাড়িতে চুলো জ্বলে নাই, হাঁড়ি চড়ে নাই–তাইলে বাড়ি এসে কি করবে? ঘাটে মাঠের পুকুরে যেদি দুটো বনকুল কি শেয়ার্কুল পায়, গাছে একটো কয়েতবেল পায় কিম্বা শালুক, পদ্মর উঁটা ঘাটা খাঝার মতুন কিছু পায় তা-ই চিবিয়ে পেটে দেবে। গাঁয়ের ইস্কুল খোলাও নাই, বন্ধও হয় নাই। যার মন হয় যায়, যার মন হয় না, যায় না। মাস্টাররাও কেউ আসে, কেউ আসে না।

নাই, নাই, কিছুই নাই। হেলেঞ্চা শাক, কলমি শাক, শুষুনি শাক যা সব যেখানে সেখানে পাওয়া যেত, যে খুশি নিয়ে যেত। অ্যাকন সিসব সারা গা খুঁজে কোথাও পাবার উপয় নাই! আচ্চয্যির কথাগাধাপুইনি, খইলুটি শাক যি শাক, যা কেউ খেত না, গরু-ছাগলেও না, সেই শাকও গরমিল। যার সজনে কি একটো ডুমুর গাছ আছে, সে অ্যাকন একটো শজনের পাতা, একটো ডুমুরও কাউকে দেয় না।

আকালের মদ্যে মানুষ কি মানুষ ছিল? পুরুষরা নাইলে প্যাটে কাপড় বেঁধে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াইত, বউ-ঝি-শাশুড়ি যারা তারা নাইলে ঘরের ভেতর মুখ বুজে বসে থাকত, জোয়ান জোয়ান বিটিছেলেগুলিন কি করে? তারা সব লোকের বাড়ি বাড়ি দাদুরে বেড়াইতে লাগল। আমি মেয়েমানুষ, তবু তাদের দিকে তাকাইতে পারতম না। ময়লা চেকট ত্যানাকানি পরে আছে। তার ভেতর দিয়ে সব দেখা যেচে, কিছুই ঢাকা পড়ে নাই। তা ঢাকা পড়বেই বা কি? না খেয়ে খেয়ে দ্যাহে কিছু নাই, ঢাকা দিলেও যা, না দিলেও তাই। সবার আবার ত্যানাকানিও জোটে নাই। কেউ এক টুকরো পচা চট জড়িয়েছে কোমরে। আর এক টুকরো জড়িয়েছে বুকে! কাকে শরম করবে, কি করে শরম করবে? এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াইছে ভূতের মতুন, গাছপালার আড়ালে আড়ালে। জট পাকিয়ে আছে চুল, ডাইনির মতন সেই চুল চুলকোতে চুলকোতে ছিড়ে ফেলছে। খারাপ কিছু তারা করে নাই। তবে খিদের জ্বালা এমমি জ্বালা লোকে করতে চাইলে কি তাদের নিয়ে খারাপ কাজ করতে পারত না? তা তেমন কিছু হয় নাই। গাঁয়ে ঘরে সবাই আকালে মরছে, ফুত্তি করার মানুষ কোথা?

গাঁ থেকে কুনো মেয়ে যায় নাই। কটো পরিবার, তা দশ ঘর হবে, গাঁ থেকে চলে গেয়েছে। ঐ দশটো বাড়ি বাগদিপাড়ার দু-ঘর, হাঁড়ি-ডোমপাড়ার তিন ঘর আর হিঁদু-মোসলমানপাড়ার চার-পাঁচ ঘর শ্যাষ পয্যন্ত গাঁয়ে আর থাকতে পারলে না। কারুর সাধ্যি হলো না যি তাদের বলে, যেয়ো না। রাত আঁদার থাকতে থাকতে কাউকে কিছু না বলে ওরা গা ছেড়ে চলে গেল। শহরে গেলে লিকিনি কাজ পাবে, কাজ খুঁজে নেবে। আমরা ভাবতম, আকাল পেরুইলে গাঁয়ে ফিরবে বোধায়। কেউ ফেরে নাই। ঘর-বাড়ির চাল গলে-পচে ভেঙে পড়েছে, ন্যাংটো দেয়ালগুলিন অ্যাকনও আছে।

একদিন সাঁঝরেতে, ত্যাখনো ভালো করে আঁদার নামে নাই, কি মনে করে বাড়ির বাইরে এসে খামারে দাঁড়িয়েছেলম। খামারের পচ্চিমদিকের দুই বাড়ির ছামনের গলি দিয়ে তামিল পুকুরের পাড় আর মাঠ দেখা যেচে। দেখি কি, পুকুরের ঢাল ধরে কারা সব মাঠে এসে নামল। ঐ তিমি-সাঁঝের আঁদারে সব ছেয়া হেঁয়া মানুষ তাদের গায়ে জামাকাপড় আছে কি নাই, এতদূর থেকে বুঝতে পারলম না। বোধায় নাই, থাকলেও ছেড়া ত্যানাকানির বেশি কিছু নাই, রেতে বেরিয়েছে য্যাকন। যেচে কোথা ওরা? ই গাঁয়ের মানুষ যি লয়, সি তোবোঝাই যেচে। তাইলে কি আশেপাশের এলেকা থেকে এসে ওরা এই গাঁয়ের ঝোপ-জঙ্গলে এসে লুকিয়ে ছিল? হায়, রেতের আঁদারও যে মানুষের এত দরকার, তা কি কুনোদিন ভেবেছি! মানুষগুলিন দূরে চলে যেচে, তা দেখতে পেচি। মেয়ে-মরদ বালবাচ্চা সব আছে ঐ দলে। সব ভূতের মতুন, সব ছেয়া ঘেঁয়া। ভাত নাই, কাপড় নাই–জেবনটো এসে ঢুকেছে প্যাটের চুলোয়। সিখান তুষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে–কিছুই চোখে দেখতে পেচে না। ইজ্জত-শরম তো দূরের কথা, সন্তানটোকেও দেখতে পেচে না। ভিটেমাটি ছেড়ে সব বেরিয়ে পড়েছে। ই গাঁয়ে এসে যি বাড়ি বাড়ি ভিখ মাঙবে তারও উপয় নাই। আধ-উদম মেয়ে-পুরুষ সব–যেদি কেউ চিনে ফেলে। দূরে যেয়ে যা খুশি তাই করবে–কে আর চিনবে?

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রয়লম। আঁদারে মিলিয়ে যেতে লাগল দলটো, আঁদারেই গোটা দলটো জড়া-পুটুলি পাকিয়ে একটা বড় হেঁয়া হয়ে গেল। তা-বাদে আর তাদের দেখতে প্যালম না।

দুই চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বসলম। ওরে, অ্যাকন কাকে ডাকি? কার সাথে দুটো কথা বলি? বাড়ি খাঁ-খাঁ করছেএত লোক বাড়িতে কিন্তুক অ্যাকন কেউ নাই, একটি ছেলেমেয়েও দেখতে পেচি না। নিজেরগুনো বড় হয়েছে। তারা মায়ের কাছে অতো আসে না। তাইলে এইবার কি আমাদেরও নিজের নিজের প্যাটের ভেতরে সেঁদোনর সোমায় হলো? শ্যাষ যি মরাইটো ছিল, তার আর আধখানা বাকি আছে। এইমাত্তর খামারে তা দেখে অ্যালম। তা ভালো। এখনো আমরা দোকান করতে যাই, গামছার কোণে দুটো চাল বাঁধা থাকে। ঐ চাল দোকানদারকে বেচে ত্যাল-নুন ট্যানাকাঠি মশলাপাতি কিনি, দু-বেলা চুলো জ্বলে, ভাতের চাল ফোটে। তবে সি আর কদিন কে জানে! আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। উসারার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে একা বসে থাকলম। গিন্নির ঘর ফাঁকা–সি ঘরে কো-কাপ আঁদার। এই তো কদিন হলো চলে গেয়েছে, মওতার ঘরে আলো জ্বালানোর নিয়ম। কিন্তুক আলো জ্বালাব কোথা থেকে?

যুদ্ধ নিয়ে অ্যাকন আর কেউ ভাবে না। যা হবে হোক। দিনে রেতে কতোবার কতো উড়োজাহাজ আসছে-যেচে, কেউ তাকিয়েও দেখে না। বোধায় বোমা ফেললেও কেউ গা করবে না। বোমাতে আর কতোজনা মরবে? আর মরলে সাথে সাথে মরবে। ভুখের জ্বালায় এমন করে ধুকে ধুকে তো মরতে হবে না! বউ-মেয়ে-পুতের মরণও দেখতে হবে না।

গাঁয়ে অ্যাকন কন্টোলের দোকান হয়েছে। কটো বাঁধাবাঁধি জিনিশ সিখানে পাওয়া যায়। শাড়ি এলে শাড়ি পাওয়া যায়। সবুজ বা নীল পাড়ওয়ালা মোটা, মিলের শাড়ি। আজকাল তা-ই পরছি। আর পাওয়া যায় মোটা মার্কিন কাপড়। ছেলেদের জামা তৈরির লেগে পাওয়া যায় লংক্লথ বলে আর একরকম কাপড়। মিলের শাড়ি এমন মোটা যি, ভেজালে ভারি চব্বর হয়ে যায়। তোলে কার সাধ্যি। এমন মোটা কাপড় কুনোদিন পরি নাই। ননদ পরত মিহি ধূতি। অ্যাকন সবাই ঐ মোটা মিলের শাড়ি পরছি। পাওয়া যে যেচে, সেই কত! ই কাপড়ও কন্টোলের দোকানে সব সোমায় আসে না। য্যাতো দরকার ত্যাত কুনোদিনই মেলে না। সবাই যেদি কিনতে পারত, তাইলে কন্টোলের দোকানে য্যাতোই শাড়ি আসুক সবাই পেত না। বাজারের দিষ্টে দাম বেশ কমই বটে। তা য্যাততই কম হোক, দাম দিয়ে শাড়ি কেনার লোক আর কজনা? কন্টোলের দোকানে জিনিশ পেতে গেলে রেশন কাট করতে হতো। তাতেই সব জিনিশের নাম লেখা থাকত। কাপড় ছাড়া পাওয়া যেত চিনি, ট্যানাকাটি, কেরাসিন এসব। আরও অনেক জিনিসের নাম লেখা থাকত। ঐ নাম পয্যন্তই সারা বেশিরভাগ জিনিশই থাকত না–যা বা থাকত তা কখন পাওয়া যাবে, কতোটো পাওয়া যাবে, তা বলবার জো ছিল না।

বাড়িতে কন্টোলের শাড়ি এল। শাশুড়ি নাই। তাই ননদ জা-দের সবাইকে ডাকলে, নিজের হাতে এক-এক জনের হাতে কাপড় তুলে দিলে। কিন্তু পেত্যেকে দেখলম কাপড়-হাতে মুখ নামিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। কাপড় কি পছন্দ হয় নাই? ননদ কিছুই বুঝতে পারে না। এতকাল ইসব কাজ গিন্নি নিজে করত, তা সে চলে গেয়েছে দুনিয়া ছেড়ে। অ্যাকন ননদের ওপরেই সব দায় পড়েছে। সে বুঝতেই পারছে না, কাপড়-হাতে সব মুখ বেজার করে দাঁড়িয়ে আছে কেনে। ননদ এই কথা দু-একবার শুদুইতেই আসল কথাটো বেরিয়ে এল। কাপড় পছন্দ হয় নাই। সবই তো এক কাপড়, শুদু পাড়ের রঙ আলাদা, তাইলে পছন্দ না হওয়ার কি আছে? আমরা পাঁচ বউ সিখানে হাজির। ছোট দ্যাওরের সোংসার শহরে–তা সে-ও পরিবার অ্যাকন গাঁয়ে রেখে গেয়েছে শহরের আবস্থা দেখে। তাই আমরা পাঁচ বউ-ই হাজির। মনের কথাটি কেউ ভেঙে বললে না বটে কিন্তুক কথায় কথায় বুঝতে পারা গেল, নিজের কাপড়টোই কারুর পছন্দ লয়, অন্য জনার হাতে যি কাপড়টো সেইটো পছন্দ। কি আচ্চয্যির কথা–ননদ বলেই ফেললে, একই কাপড়, তফাত কিছুই নাই, শুদু পাড়ের রঙের তফাত। এরই জন্যে নিজের কাপড়টি পছন্দ নয়, আরেকজনারটি পছন্দ? না, এ ভালো কথা নয়, ভালো কথা নয়।

আমি তো কিছুই করি নাই, মায়ের আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। মেতর-ভাই শুধু মায়ের ইচ্ছার দাম দিয়েছিল। দু-বছরও হয় নাই, মা দুনিয়া ছেড়ে গেয়েছে, এর মধ্যেই সব নিয়ম পাল্টে যাবে? তা যাকগো, এই নিয়ে আমি অশান্তি করতে পারব না। শাড়ি সব এই রইল, যার যেমন মন হয়, তুলে নাও।

সিদিন এর বেশি আর কিছু হলো না। যার হাতে যি শাড়ি ছিল, সে সিটিই নিলে কুনো কথা না বলে, কিন্তুক হাসিমুখে লয়। যেমন বেজার মুখে ছিল, তেমনি বেজার মুখেই নিজের নিজের কাপড় নিয়ে গেল। কি মনে করে রেতে এই কথা কত্তাকে বলতে গ্যালম। রাগ করে বলি নাই, আমার ভালো লাগছিল না বলেই বলতে গ্যালম। তা এমন করে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে–উঃ, সি যি কি চাউনি আমার জানের ভেতরটা পয্যন্ত দেখে নিলে–আমি কথাটো আধখানা বলেই থেমে গ্যালম। এই পেথম কত্তা আমাকে যেন দেখলে, আমিও তেমনি দেখতে প্যালম কত্তাকে। কত্তার সেই চাউনির ভেতরে রাগ ছিল না। মনে হছিল কষ্টে আর দুঃখে সে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে।

তাইলে সব্বোনাশ কি এমনি করেই শুরু হয়? চুলের মতন সরু একটো চিড় কোথা যেন ছিল, চোখে দেখতেই পাওয়া যেত না। পেথম দিন দেখে মনে হলো, কই, আগে কুনোদিন দেখি নাই তো, পরের দিন দেখছি, ওমা, তার পাশে আর একটো চিড়, তাপর দেখতে দেখতে অ্যানেক অ্যানেক চিড় সব জায়গায় কখন হলো, কি হলো, কেমন করে হলো ভালো করে কিছু বোঝার আগেই একদিন বড় বড় ফাটল ধরে জিনিশটো চৌচির হয়ে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সোংসারেও কি তাই হতে যেচে? হঠাৎ খেয়াল করলম, আমাদের বড় সোংসার অ্যাকন কত বড় হয়ে গেয়েছে! এ তো একটো সোংসার লয়, পাঁচটা সোংসার; এ তো ডালপালা বাড়া নয়, ই বটগাছের মতুন। আলেদা আলেদা ঝুরি নেমে আলেদা আলেদা বটগাছ হয়েছে আর মূল গুঁড়িটো

অ্যাকন আর মুটেই নাই, ফোপরা হয়ে কবে শ্যাষ হয়ে গেয়েছে। গিন্নি ছিল মূল গুঁড়ি, সে থাকতে থাকতেই যার যার ঝুরি নামছিল। অ্যাকন আর সি গুঁড়িই নাই, মূল গাছটো থাকবে কি করে?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটো ভায়ানক কথা মাথায় এল। আমিও কি তাইলে এত দিন তলায় তলায় ঝুরি নামিয়েছি? সবাইকে বাদ দিয়ে আমার নিজের সোংসারের একটো আলেদা বটগাছের ঝুরি কি পুঁতিছি? একবার ভেবে দেখি তো! নিজের মন নিজের কাছে বিচের করলে দোষ কিছুই নাই। নিজের য্যাতো খারাপই বেরুক কে আর তা জানতে পারছে? সেই লেগে খুব চেষ্টা করলম জা-দের কথা না ভেবে নিজের মনের উলুক-শুলুক খুঁজে দেখতে। বড় খোঁকা মারা গেয়েছে তেরো-চোদ্দ বছর। সে আজ বেঁচে থাকলে মনের আবস্তা কি হতো জানি না, হয়তো জা-দের চেয়েও দশকাঠি সরেস স্বাস্থপর হতোম। কিন্তুক সে নাই, সে চলে যাবার পর আর আমার জেবনে জেবন নাই, কোথাও খুঁটি পুঁতি নাই, কোথাও ঝুরি নামাই নাই। আমার, এই কথা কেউ জানে না, কত্তাও জানে না। ছেলেমেয়ে আজ যারা আছে, বড় হয়ে গেয়েছে, তারাও কেউ জানে না। আমার ঝুরি মাটিতে নাই, বাতাসে আলগ ঝুলছে।

তাই বলে আমার কপাল দিয়ে সবাইকে বিচের করতে যাব ক্যানে? দুষবই বা ক্যানে? সিদিন আর কিছু হয় নাই, ঝগড়াঝাটি না, কথা-কাটাকাটি না, ননদের দিকে চোখ তুলে কেউ একটো কথাও বলে নাই। তবু ক্যানে আমার মনে হলো, এই শুরু–সোংসারের ভাঙনের এই হলো গোড়াপত্তন? সুখের দিনে কিছু হয় নাই, সবাই হেসেছে, খেলেছে, সবাই সবাইকে দেখেছে, দুখে দুখি, সুখে সুখী হয়েছে আর অ্যাকন য্যাকন কাল খারাপ পড়েছে, অভাব দেখা দিতে। শুরু করেছে, সবকিছুই ভাগে কম পড়ছে, অমনি কোথা থেকে বিষের মতুন গল গল করে হিংসে বেরিয়ে আসতে অরম্ব হয়ে গেয়েছে।

অভাব যি অমনি করে আস্তে আস্তে হাঁ করে, কুনোদিন জানতম। ধানের শেষ মরাইটো খালি ছোট হছিল। অত বড় পেল্লায় মরাইমনে হতো, অত ধান খেয়ে কে ফুরুইতে পারবে–সেই মরাই হঠাৎ একদিন দেখলম কেমন এতটুকুনি হয়ে গেয়েছে। তারপর দেখলম ল-দাওর একদিন মুখটো হাঁড়ি করে মরাই ভেঙে সব ধান বার করে ফেললে। পোষ-মাঘ ত্যাকননা অনেক দেরি। দ্যাওরকে শুধুইতে সে মুখ কালো করে বললে, এই ধানকটির চাল ফুরুলেই বাড়ির খোরাকি ধান আর কোথাও নাই। তার কথাটো নিয়ে ত্যাকন তেমন ভাবি নাই। ওমা, ওর কথার মানে হচে এই বাড়িতে উপোস অরম্ব হবে আর দু-তিন মাসে বাদে? সিদিন কি সত্যিই আসবে? কত্তা কিছু করবে না? এই সোংসার তো তার। সেই-ই তিলে তিলে গড়েছে, সেই অ্যাকন এই খেলাপাতি ভেঙে দেবে? তার পক্ষে সবই সম্ভাব, দিতেও পারে। সিদিন রেতে একবারের লেগে দেখে ফেলেছেলম তার ভায়ানক দুঃখ আর কষ্টের মুখ! তবু কি শক্ত সেই মুখ, যেন লোহা পুড়ে গনগন করছে। ঐ মুখটিকে আমি খুব ভয় করি।

এই গরমকালেও কোথা থেকে আসছে এই হাঁড়কাপুনি ঠান্ডা বাতাস? সব একদম কালিয়ে জমে যেচে। আগে আগে সোংসারে সব জিনিশ খালি বেড়ে যেত। সব কিছুতেই ছিল বরকত, কিছুতেই কুনো কিছু শ্যাষ হতো না। অ্যানেক জিনিশই ফেলে দিতে হতো। কতবার গুড় আলু পেঁয়াজ পচে গেল, নষ্ট হয়ে গেল, সব ফেলে দিতে হলো। কখনো কখনো ভাবতে হতে এত ফলে ক্যানে? সব ল্যাজোবরা হয়ে থাকে। হাতের কাজ আর শেষ হতে চায় না। এইবার দেখছি সবকিছুতে ভাটার টান। সেই যি দু-বছর আগে ফাঁপা সমুদুরের মতুন। পানি উথাল-পাথাল হাওয়ায় দু-দিনে হুড় হুড় করে নেমে গেল, ঠিক তেমনি এক হাড়কাপুনি হাওয়ায় বাড়ির সব জিনিশ যেন উধাও হয়ে যেতে লাগল! এই ছিল, আর নাই। ভরা ছিল সকালে, বৈকালে খালি। একটু বেলা হলে গাই দুইয়ে দুধ আনা হয় বাড়িতে। অতো দুধ কোথা রাখব, কি করব, আগে এই ভাবনা হতো। কতদিন দুধ নষ্ট হয়েছে। বলে গিন্নির ধমকানি খেয়েছি। অ্যাকন দেখি, সেই দুধ এক বলকা করে রেখে দিলে ঠান্ডা হওয়ারও সময় হয় না। জা-রা সব তক্কে তক্কে থাকছে। ঘটি-বাটি-গেলাসে সবাই নিজের নিজের ছেলেমেয়ের দুধ ঢেলে নিয়ে নিজের নিজের ঘরে চলে যেচে। ননদ যি ছেলেপিলেদের ডেকে ডেকে দুধ খাওয়াত, অ্যাকন আর তার কুনো উপয় নাই। আগে দুধ ফুরুইত না, অ্যাকন সবার কুলুইচে না। ননদ দুধ দিতে যেয়ে দেখছে দু-একজনকে বাদ দিতে হচে। যারা বড় হয়েছে, তারাই কেউ কেউ হয়তো বাদ পড়ছে। জা-রা বাছাবাছির কুনো ধার ধারছে না, যে যেমন পারছে দুধ ঢেলে নিয়ে চলে যেচে। কত্তা বরাবরই রেতের বেলা এট্টু দুধ খায়। আমি তো আর কত্তার দুধ ঢেলে আনার লেগে বাটি নিয়ে জায়েদের সাথে দাঁড়াইতে পারি না। শরমে মাথা হেঁট হয়ে যেতে লাগল। আমার রকম দেখে ননদ-ই বা আর কি বলবে–চুপ করেই থাকছে। এক-একদিন দুধের কমবেশি নিয়ে জায়েদের মধ্যে লেগে যেচে তুলকালাম কাণ্ড। চিকার চেঁচামেচি শুনে কত্তা একদিন বাড়িতে ঢুকেছিল। আগে তাকে দেখলে জা-রা ভয়ে শরমে পাথর হয়ে যেত। সিদিন কেউ গেরাহ্যি করলে না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে কত্ত আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

ভরা গোয়াল কবে খালি হলো কেউ জানে না। মাহিন্দার দুটো বিদায় হয়েছে। পাড়ার এক ছোঁড়া মাঠে গরু চরাতে নিয়ে যায়। গাইগুলিন কি দড়ি ছিড়ে ছিড়ে গোয়াল থেকে লাপাত্তা হয়েছে? কোথা গেল ঐসব বড় বড় দুধেল গাই? ক-বছর আগে মড়কে মরেছিল তিনটো, গেমার বিষ খেয়ে ধড়ফড় করে মরল সিন্দিটো। অনেক কটো বকনের বাছুর হলো না। মোষও অ্যাকন আদ্দেক। পেয়ালা রঙের একটো বুড়ি ঘুড়ী আছে অ্যাকনো। কত্তা ঘোড়ায় চাপা ছেড়েছে অ্যানেকদিন। কেউ কিনতে আসে না বলেই ঘুড়ীটো অ্যাকনো বাড়িতে রয়েছে।

যুদ্ধ তো ছিলই, তাতে তেমন কিছু হয় নাই। কিন্তু মাত্র দু-বছরের আকালে দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। ভাত-কাপড়ের টান বড় টান। আর একজনার কি হছে তা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? যার পরনে কাপড় নাই, সে দেখছে সেই-ই ন্যাংটো, আর কেউ ন্যাংটো তা কি সে দেখতে পায়? ছেলে ভুখে কঁদছে তা চোখে দেখতে হয় আর মনে আন্দাজ করতে হয় কিন্তু নিজের প্যাটে আগুন জ্বললে দেখতেও হয় না, আন্দাজ করতেও হয় না। সি আগুনের কি কুনো তুলনা আছে? সি আগুন জ্বললে পেটের সন্তানকেও দেখতে পাওয়া যায় না।

ছেলেপুলেরা বাড়িতে অ্যাকন য্যাকন-ত্যাকন যা খুশি তা-ই খেতে পায় না। বাঁধা তিনবার খাবার। অ্যাকনো ননদই তাদের খেতে দেয়। পেরায়ই দুখে-রাগে তাকে চোখের পানি ফেলতে হয়। যি ছেলেটো বেশি খায় কিংবা কুনো বিশেষ জিনিশ খেতে পছন্দ করে, তার দিকে তাকানোর জো নাই, ননদকে নিক্তিতে মেপে চলতে হয়। একটু ইদিক-ঊদিক হলে–কি শরমের কথা–মুখফেঁড় কুনো ছেলেই হয়তো বলবে, উ বেশি পেচে। একজনার খাবার আর একজনার থালা থেকে তুলে নিতেও দেখছে ননদ। ছেলেরা কেউ দুর্দান্ত, কেউ শান্ত, কেউ হিংসুটে, কেউ সাত চড়ে রা করে না। খাবার সোমায়ে ঘরে হুড়োহুড়ি মারামারি। সব চাইতে খারাবি হচে, সময়ে সময়ে তাদের মা-রাও ঘরে হাজির থাকছে। কিছু বলছে না বটে, একদিষ্টে নিজের নিজের ছেলেমেয়ের থালার দিকে চেয়ে আছে। ননদ কাঁদবে না তো কি করবে? পোঞ্চার বোঝা যেচে, আজ বলছে না কিন্তুক কালকেই কুনো বউ বলবে, তার ছেলেকে কম দেওয়া হচে। ননদ এক দিষ্টিতে দেখছে না সবাইকে, দুই-দুই করছে। কে জানে, হয়তো নিজেরাই নিজের নিজের ছেলেমেয়েকে খাবার খসিয়ে দেবে আর তা করতে গিয়ে নিজেরাই হুড়োহুড়ি করে মরবে। ত্যাকন হয়তো তাদের সোয়ামিরাও এসে হেঁশেলে ঢুকবে, নিজের নিজের ইস্ত্রীর হয়ে লড়াই করবে। ত্যাকন ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি হতে আর বাকি কি থাকবে? বউদের হয়ে ঝগড়া করতে করতেই হয়তো দ্যাওর তার ভাবির গায়ে হাত দেবে কিংবা ভাসুর মারবে ভাদ্দর-বউকে। পোস্কার দেখতে পেচি ইসব হবে, হবে। এর মদ্যেই ছেলেমেয়েরা হাঁড়ি থেকে নিজেরা খাবার তুলে খেতে শিখে ফেলেছে। সারাদিন সবাই নিজের নিজের খাবারের ধান্দায় থাকে। কোথা থেকে একটো মাছ পেলে সেটি পুড়িয়ে খায়, নাইলে তার মা-ই তাকে আলো করে বেঁধে দেয়। ননদই কি সত্যি সবাইকে এক দিষ্টিতে দেখতে পারছে? সেই যি ভাগ্নেদুটিকে কত্তা ই সোংসারে এনেছিল মানুষ করার লেগে, তাদের একজন তো বড়। হয়ে শহরে চাকরি করছে, আর একজন ই বাড়িতে অ্যাকননা আছে। ননদের চোখের মণি এই ছেলেটি। তাকে এট্টু অন্য রকম করে না দেখে কি ননদ পারে? সকলের ছামনে হয়তো ভালো একটু কিছু ননদ তাকে দিয়ে ফেলে, কিম্বা লুকিয়ে-চুরিয়ে কুনো খাবার দেয়। হয়তো নিজের খাবার থেকেই দেয়। তা এমন শিক্ষে হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তাদের বাপ-মায়ের কাছ থেকে, তারা চেঁচিয়ে উঠবে, ফুপু ওকে দিলে, আমাকে দিলে না। একদিন চূড়ান্ত হলো, য্যাকন বউদের একজন ছেলেপুলেদের খাবার সোমায় হেঁশেল থেকে উঠে গেল আর একটু বাদে সোয়ামিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। তাপর সেই দ্যাওর সকলের ছামনে, ছেলেমেয়ে-বউ-ঝি সকলের ছামনে, নিজের বুনকে যা লয়, তা-ই বলে রপমান করলে। এমন করলে ই সোংসারে থাকা হবে না তা-ও বললে।

সোংসারের ভেতরটো এইবার তাকিয়ে দেখতে প্যালম আর সোংসারের মধ্যে মানুষ কি, তা-ও দেখলম। কুকুর-বেড়ালের ছেড়াছিড়ি দেখে রাগ করি কিন্তুক মানুষ কুকুর-বেড়ালের চাইতে কিসে ভালো? মূলে টান পড়লে সবাই সমান। সেই মূল হচে প্যাট। এই আমি সার বোঝলম। মূল ঠিক থাকলে সব ঠিক, তাই বলছেলম প্যাটের খোরাকি নাই তো কিছুই নাই, তুমি নাই, আমি নাই, কেউ নাই। এই দ্যাশে সেই মূলের নাম হচে ধান। ঐ ধান থেকেই খাবার, ঐ ধান থেকেই কাপড়, ঐ ধান থেকেই সব। ঐ জিনিশের অভাবেই সব ছত্রখান হয়ে গেল। ঘর ভেঙে গেল, ঘরের চাল হুমড়ি খেয়ে পড়ল, মাটির দেয়াল মাটিতে মিশল, গরু মোষ ছাগল মুরগি সব উধাও হলো, চাকর মাহিন্দার পালিয়ে গেল। ভরাভত্তি পানি সব নেমে গেল, পাঁক আর কাদা বেরিয়ে পড়ল।

একদিন ঠিক ভরাদোপরে দু-ভাই নিজের নিজের ইস্ত্রীর কথা শুনে মারামারি করে দুজনই জখম হলো। সি এমনি জখম যি দুজনার কেউ আর দাঁড়াইতে-বসতে পারলে না। একজনার লাগল কোমরে, কোমর ভাঙল কি না কে জানে আর একজনার মাথায় পড়ল লাঠির বাড়ি। দর দর করে রক্ত ঝরতে লাগল। এইটি ল-দ্যাওর–আমার ভাইয়ের অধিক, ছেলের মতুন ফেনা মেশানো টকটকে লাল তাজা রক্ত মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যেচে। সে দু-পা ছড়িয়ে দু-হাতে ভর দিয়ে বসে আছে। মুখে কি খারাপ খারাপ কথা! মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ করে কোঁকাইছে।

সবাই ছামনে এসে জড়ো হলো। ছোট দাওর নাই তবে তার বউ-ছেলেমেয়ে সব ওখানে। ভাসুরও এল। কিন্তুক কত্তা এল না। হয়তো বাড়িতে নাই, থাকলেও আসবে না, জানা কথা। সবাই এসে দাঁড়িয়ে থাকলে, কারুর মুখে একটো কথা নাই। শুধু হাহাকার করে কেঁদে উঠল ননদ। যে ছোটভাই এত রপমান করেছিল, সেই ছোট ভাইয়ের ব্যাকন রক্ত ঝরল, ত্যাকন তার লেগেই মাথা ঠুকতে লাগল। ননদ, ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্ত–সোংসার আর থাকবে না, থাকবে না।

পড়ে থাকলে দু-ভাই। উঠে দাঁড়িয়ে যি নিজের নিজের ঘরে যাবে সি সাধ্যিও নাই। ঐ উসারাতেই পাশাপাশি দু-ভাইয়ের বিছেনা করে দিলে তাদের বুন। দুর থেকে মনে হতে লাগল তারা দুজনা গলাগলি করে শুয়ে আছে। যি কদিন তারা উঠতে পারবে না, যেমন করে হোক একটু সাবু-বার্লি জোগাড় করে তাই বেঁধে খাওয়াবে ঐ বুন। জা-দের কিছুই করার সাধ্যি নাই, তারা শুদু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। ডাক্তার-বদ্যির কুনো কথা নাই। অ্যাকন অসুখে-বিসুখে জ্বরজারিতে ছেলেমেয়েগুনোই দিনের পর দিন বিছেনায় পড়ে থাকছে, সাবু-বার্লিও জুটছে না, তা এইসব বুড়ো দামড়া জোয়ান মরদুরা মারামারি করে পড়ে আছে–কে দেখবে তাদের?

আমি দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেজ দ্যাওরটো একটু আখচোটা রকম, ভালো করে কারুর সাথে আলাপ করতে পারে না, কাজকম্ম গোঁয়ারগোবিন্দের মতুন কিন্তুক মানুষটি সে খারাপ লয়। আর ল-দ্যাওরকে নিয়ে তো কুনো কথা নাই! রাজপুত্তুরের মতুন চেহারা। অবশ্য আর আগের চেহারা নাই, তবু সে এখনো সোন্দর। বিয়ে হয়ে আমি য্যাকন ই সোংসারে আসি, ঐ দ্যাওর ভাইয়ের মতুন, ছেলের মতুন কাছে কাছে থাকত, যা ফরমাশ করতম তাই শুনত। আমার বড় খোঁকাটি হয়েছিল তার জানের জান। দাদির দেওয়া জমির বদলে ইখানে য্যাকন জমি কেনা হলো, সেই জমির ধান নিয়ে কত্তাকে বলে আলেদা একটো মরাই বাঁধলে। আমাকে এসে বললে, তোমার ধান আলাদা করে রাখা হলো।

আমার আবার ধান কি, সবই সোংসারের এই কথা তাকে বলেছেলম আমি। কতদিন আগের কথা! ওর কি মনে আছে সি কথা? উসব কথা কারুর মনে থাকে না। মাটি থেকে ওঠা ভাপের মতুন কোথা উড়ে যায়।

দুজনাই আবার উঠে দাঁড়াইলে বটে কিন্তুক দুই ভাই লয়, ঠিক যেন একে আরেকের দুশমন। কুনোই কারণ নাই, তবু ওদের দুই বউ-ও একে আরেকজনার দুশমন। আর এ কথা কে পেত্যয় যাবে যি দু-ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও হলো ঠিক তাই।

খামার অ্যাকন ফাঁকা! শ্যাষ মরাইটোর শ্যাষ কটি ধানও বার করে নেওয়া হয়েছে, খামারবাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। আর কদিন চলবে? যিদিন তা বন্ধ হবে, সিদিন থেকে কি হবে? কি বেবস্থা হবে এতগুলিন পেরানির? কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কি কঠিন সেই মুখ, যেন পাথরের। তাকে একটো কথা বলতে সাহসও হয় না, ইচ্ছাও হয় না।

আমার এত কথা, কার কাছে বলি? কেউ নাই। গিন্নি য্যাতোদিন ছিল, তার কাছে যেয়ে চুপ করে দাঁড়াইলেই হতো, কুনো কথার দরকারই হতো না। আপনা-আপনিই মন শান্ত হতো। ননদের কাছে তো সিটি হবার উপয় নাই, তারই বরং কত কথা বলার লেগে বুক ফেটে যেচে। আর আছে ঐ কত্তা। কিন্তুক উ মানুয অ্যাকন মানুষই লয়, পাষাণ। তাকে আমার চিকার করে শুদুতে মন যায়, দু-বছরের। মদ্যে সব এমন ছারেখারে গেল ক্যানে? কেমন দেখেছেলম ই সংসার, আর অ্যাকন কেমন দেখছি? অমন সোংসার তো সেই-ই দিয়েছিল, অ্যাকন সব দেখে চুপ করে আছে কেন? জানি, যেদি তাকে এই কথা শুধুই তার কুনো জবাব সে দেবে না, বড় জোর সব কথার এক কথা বলবে, সারা দুনিয়া ছারেখারে গিয়েছে, তোমার আমার সংসারও ঐ এক পথে যাচ্ছে। তবে কি লোকটো একবারে হেরে গেল?

পরপর দুবার মারা গেলেও মাঠে কিন্তুক ইবার ধান আছে। ই বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে দেখতে পাই না, মনে ইচ্ছা হয় একবার যাই, দেখে আসি আর কত দূর? বাড়িতে বসে মনে হয়, এখনো অনেক দূর। এখনো অনেক দিন বাকি।

উত্তর-দুয়ারি ঘরের আঁদার কোণে মাটির বেরাট এক পয়ায়। ভাতের চাল থাকে। ওখান থেকেই পেত্যেক দিন খরচ হয়। উত্তরপাড়ায় দুই বেধবা বুন আছে। তাদের কাছে লোকে ধান ভঁচা দেয়। সেই ধান তারা সিজোয়, শুকোয়, তাপর টিকিতে পাড় দিয়ে। চাল বানায়। এই তাদের পেশা, এই করেই তারা খায়। আমাদের ধানও ওদেরই কাছে ভঁচা দেওয়া থাকে। ধান যায় ওদের কাছে, তাপর চাল আসে। সি চাল খরচ হয়ে গেলে আবার আসে। এই চেরকাল চলছে। পয়ায় চাল শেষ হতে না হতে আবার ‘য়া চালে ভরা হয়। এই পেথম দেখছি পয়া আধেক খালি হয়ে গেয়েছে। ভেতরটো আঁদার, উকি দিয়েও বোঝা যেচে না চাল আর কতোটো আছে। দিনের বেলা লম্ফ জ্বালিয়ে পয়াল ভেতরটা দেখলম। একদম তলায় সেরদশেক চাল কুনো পেরকারে থাকতে পারে। লম্ফর আলোয় পুরনো চাল কটো দেখে আমার যি কেমন মনে হতে লাগল কি বলব? মনে হচে সাত রাজার ধন এই চাল। চালের রঙ কি অত সোন্দর হয়?

কিন্তু বাড়িতে আর চাল এল না। ল-দ্যাওরের ওপর ছিল সব দেখার দায়িত্ব। তা সে চুপ করে থাকে। ননদ পেত্যেক দিন তাকে বলছে, চাল কিন্তুক শ্যাষ, আর দিন দুয়েক পরে বাড়িতে চুলো জ্বলবে না। কদিন চুপ করে থেকে থেকে একদিন সে বললে, ভঁচা দেওয়া ধানের আর কুনো চাল পাওনা নাই। ননদ এই কথা শুনে বললে, তাইলে কি হবে? ছেলেপুলে না খেয়ে মরবে? যিখান থেকে হোক ধান জোগাড় করতে হবে না? সে ত্যাকন কাঠ-কাঠ গলায় জবাব দিলে, আমি কোথা থেকে ধান জোগাড় করব? চুরি করব, না ডাকাতি করব? বাড়িতে ভাত না হলে শুধু কি আমার ছেলেমেয়ে উপোস করবে? সবাই করবে। আমি কিছু জানি না।

ধানের কথা, চালের কথা, সংসারের কথা ভাশুরকে বলা বেথা। তার নিজের কুনো ছেলেপুলে নাই, অমন সোজা মানুষের কিছু করার খ্যামতাও নাই। সেজ দ্যাওরকে তো এসব কথা বলার আরও কুনো মানে নাই। সে এমন গোঁয়ারগোবিন্দ যি এসব শুনলে হয়তো আবার কার সাথে মারামারি-ফ্যাসাদ লাগিয়ে দেবে। আর থাকল ছোট দ্যাওর। তারও কুনো ভরসা নাই। এমন দিন পড়েছে যি সে অ্যাকন চাকরির কটো টাকা বাঁচাবার লেগে শহরে একা থাকে। বউ আর পাঁচটা বাচ্চা সে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কাউকে কিছু বলার নাই। ননদ কাকে কিছুই বলবে না। কত্তা যেদি নিজে থেকে কিছু না করে, তাইলে শত বললেও কারুর কথায় কিছু করবে না। তাকে বলার কিছু নাই, তার অজানা কি আছে? ইদিকে জা দের দেখে মনে হচে তারা যেন কিছুই জানে না। কুনো কাজকৰ্ম্ম নাই, মনে কুনো দুচ্চিন্তা নাই, ঘর-দুয়োরে ঝটপাট নাই, কোথাও কুনো ছিরিছাঁদ নাই। তারা সবাই সারা বাড়ি ছিরফুটি করে বেড়াইছে আর কথায় কথায় কুঁদুল অর করছে। মনে হচে, সোংসারের এই আবস্তা দেখে তারা ব্যাজায় খুশি। এমনি চললে আর কিছুদিন বাদে তাদের নিজের নিজের সোংসার হবে।

পেত্যেক দিন রাঁধার সোমায় ননদের সাথে আমি য্যাতম ভাতের চাল আনতে। ঘরের কোণের ঐ বেরাট পয়ার ভেতরে আঁদার দিন-দিন ঘোনো হচে। তার হাতের চাল তোলার টিনের কটোটো খরাৎ খরাৎ করে পয়ার গায়ে লাগে, অ্যানেকটো ঝুঁকেও ননদ পয়ার তলার চাল কটোর নাগাল পায় না। শ্যাষকালে সে মাথা ঢুকিয়ে দিলে পয়ার ভেতরের আঁদারের মদ্যে। স্যারদুয়েক চাল বার করে ঘরের বাইরে এসে দোপরের রোদে এগনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেঁদে বললে, আর একটি দানাও নাই। বাছারা আজ রেতে আর কেউ খেতে পাবে না।

কথাটা শুনেই মনে হলো দিনের আলো কেমন মিইয়ে এল, শন শন করে ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল, আর বুকের ভেতরটা খামচে খামচে উঠতে শুরু হলো।

দোপর বেলায় ছেলেরা সব খেতে বসেছে। খাবার তেমন কিছু নাই। পাতলা ডাল আর ভাত। আগের দিনের মতুনই সব মারামারি হুড়োহুড়ি করছে। খালি বড়গুনোর মন ভার। তারা বোধায় কিছু জানতে পেরেছে। অন্য দিন ননদ রাগারাগি-বকাবকি কতো কি করে। আজ সে একদম চুপ। তাকিয়ে দেখলম, চোখ দিয়ে তার টস-টস করে পানি পড়ছে। ফোলা ফোলা টকটকে লাল মুখ বারে বারে একদিকে পাশ করে পানি মুচছে।

বৈকাল গেল, সারা বাড়িতে কারুর দেখা নাই। দেখলম সুয্যি উঠল, দেখলম সাঁঝ নামল, দেখলম আঁদার ঘোনো হলো। আর একটু বাদে ঝিঁঝি পোকা ডাকতে লাগল। অন্যদিন জোনাকি দেখতে পাই না। বাড়িতে লম্ফ-হেরিকেন জ্বলে, জোনাকি পোকা কে খেয়াল করে; আজ বাড়িতে কোথাও আলো নাই, বাড়িময় আঁদারে জোনাকি ঘুরে বেড়াইছে।

চুলো জ্বলে নাই। ভাত হয় নাই। কেমন করে ছেলেমেয়েগুলিন। বুঝে গেল আজ বাড়িতে রাঁধাবাড়া হয় নাই। রেতে তারা কেউ খেতে পাবে না। তাইলে কি বাপ-মা-ই তাদের শিখিয়ে দিয়েছে যি আজ আর হেঁশেলে খেতে যাস না? আমার কিছুতেই বিশ্বেস হচে না!

সময় যেতে লাগল তবু কেউ কাছে এল না। ননদকেও দেখতে প্যালম না। শ্যাষে বসে থেকে থেকে রাত পেরায় নিশুতি হলে আমি ঐ আঁদারের মদ্যেই গা-মাথা ঢেকে চোরের মতুন পা টিপে টিপে শোবার ঘরে যেয়ে ঢোকলম। ঘর আঁদারই বটে, তবে কত্তার একটা বিদেশী লম্ফ ছিল, সেটায় একবার ত্যাল দিয়ে খুব কম করে জ্বালাইলে তিন-চার মাস জ্বলত। বহুদিন বাদে সেটিকে ঝেড়ে-ঝুড়ে বার করা হয়েছিল। দেখলম, আঁদার ঘরে খালি একটো নীল ফোটা। বোঝলম কত্তা সেইখানেই বসে আছে। আন্দাজে সিদিকে খানিকটো যেয়ে আর যেতে পারলম না। উবুড় হয়ে পড়ে আমি মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগলম। ঠান্ডা শক্ত মেঝে, বারকতক ঠুকতেই বুঝতে পারলাম কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। কেমন নেশার মতুন হলো, হাত দিয়ে রক্ত মুছি আর তেমনি করেই মাথা ঠুকি। মুখে খালি আমার একটো কথা : বাড়ির ছেলেমেয়েরা আজ না খেয়ে ঘুমুইতে গেয়েছে। ভোখ প্যাটে সারারাত তারা ছটফট করবে। তুমি কিসের কত্তা, আঁদার ঘরে বসে আছ? কারা দুনিয়ায় এনেছে তাদের? বলো, বলতে হবে তোমাকে। এইসব কথা বলতে বলতেই দেখি, ঘরের আঁদার অ্যানেকটো কমে এয়েছে, আমার খোঁকাদুটি বিছেনায় উঠে বসেছে আর পাথরের মতুন বসে আছে কত্তা।

নীল আলোর ফোঁটাটো টুপ করে নিভে গেল। বোধায় ত্যালের শেষ ফোটাটোও ফুরিয়ে গেয়েছে। আর বেশিক্ষণ গেল না, কত্তা আমার দিকে মুখ না ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বললে, আর মাথা ঠুকো না। আমি আজকের এই দিনটির অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম। দেখছিলাম, কেউ আসে কি না। ভাই আর ভাই আছে কি না। বউদের আমি গেরাহ্যি করি না। দেখছিলাম ভাইদের কেউ বলে কি না যে চিরকাল তুমিই সব করে এসেছ, এখন এই সংকটে তোমাকেই হাল ধরতে হবে। না, কেউ এল না। তা যাই হোক, ছেলেপুলে একদিন না-ই খাক, শুকিয়ে মরতে তাদের আমি দোব না। কাল আমি যাব। সন্ধের আগেই এক গাড়ি ধান যেখান থেকে পারি আনব। তবে ঐ ধান শেষ হবার আগে সবারই সংসার আমি পৃথক করে দেব এই আমার প্রতিজ্ঞা। যাও, আর মাথা খুঁড়ো না।

আমি আর বিছেনায় গ্যালম না। সেইখানেই আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়লম। বিছেনার চেয়ে মাটি ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *