২৩. নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল

নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল

হেঁশেল ঘরের উসারায় একটো খুঁটিতে হেলান দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। পাঁচ দিন হলো বাদল নেমেছে। মাঠভরা ধান-ইবার লিকিনি খুব ফলন হয়েছে ধানের, বহুকাল এমন কেউ দেখে নাই। সবারই মনে আনন্দ। হবে না ক্যানে? ঐ এক ধান, ধান ছাড়া আর তত কিছুই নাই দ্যাশের মানুষের। আর কিছুই নয়, শুদু এই আমন ধান। সারা বছরের ঐ একটি ফসল-বর্ষায় রোয় আর পোষ-মাঘে কাটে। খাওয়া-পরা সবকিছুই ঐ ধানে। ই বছর খরানির কালে লোকের খুব ভয় হয়েছিল। আসমানের পানিই শুধু ভরসা, সেই পানি যেদি আষাঢ়-শেরাবনে না হয় তাইলে জমি আবাদ হবে না, বীজতলা শুকিয়ে যাবে আর ইয়ার মানে একটোই–মরণ। সারা বর্ষা পানির লেগে ত্যাকন হাহাকার–সেই কাত্তিক মাস পয্যন্ত। এই হলো খরানির। ভয়, আবার পানি বেশি হলেও ভয়! ধান ভেসে যাবে না তো? জমি তলিয়ে যাবে না তো? কম হলে চাষির মনে দুরদুরুনি শুকিয়ে যাবে না তো, জমি শুকিয়ে চরচরিয়ে ফেটে যাবে না তো? আর বেশি হলে ভয়, ভেসে যাবে না তো? এইরকম করে করে চলে।

ইবারের খরানির ভাব দেখে লোকে মনে করেছিল পানির অভাবে আবাদই হবে না, গেলবার পানির অভাবে চাষে জুৎ হয় নাই, লোকের খুব কষ্ট গেয়েছে, ইবারও যেদি ধান মরে যায়, তাইলে মানুষ আর কিছুতেই বাঁচতে পারবে না। উদিকে যুদ্ধর আগুন তো আছেই। কিন্তুক না, শ্যাষ পয্যন্ত আষাঢ় মাসের দিনকতক যেতেই ভালো বর্ষাই নেমেছিল। মানুষ খুব খুশি। পেটে ভাত নাই, পেঁদনে কাপড় নাই, ওলাউটোয় কত মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তবু মানুষ আশায় বুক বেঁধে ইবার খুব ভালো করে চাষ করলে। ঐ দু-মাসে পানি বেশিও হয় নাই, কমও হয় নাই। দেখা যেচে ধানও খুব ভালো হয়েছে। আমাদের সেজ আর ল-কত্তা চাষবাস নিয়েই থাকে। আমর তো আর মাঠে যাই না, ওরাই এসে বুনের কাছে গপ্পো করে, ইবারের মতুন ধান বহুকাল হয় নাই। পাঁচ-ছটো মরাই পিতি বছর হয়, ইবার মনে হয় সাত-আটটো হবে। আমাদের অতো বড় খামারেও জায়গা হওয়া কঠিন–দেখো, পাড়ার ছেলেমেয়েরা এসে লুকোচুরি খেলবে। ওরা বলছে আর আমি যেন দেখতে পেচি ধানের মরাইগুলিন!

ভাদর মাসে খুব বিষ্টি হয়, মাঠে পানি লাগেও বটে, হয়ও খুব। তাই সিদিন মাঝরেতে ঝমঝমিয়ে ম্যাঘ নামলে ভেবেছেলম বোধায় কদিনের মেয়াদি বাদল নামল। তার বেশি আর কিছু ভাবি নাই। পাঁচদিন আগে, সবাই ত্যাকন ঘুমিয়ে, ঘরবাড়ি সব আঁধার কো-কাপ। অতো রেতে মানুষ আলো জ্বালবেই বা ক্যানে? তার ওপর কেরাসিন নাই, সরষের ত্যাল নাই, রেড়ির ত্যাল নাই অ্যানেকের। পিদিম জালাবেই বা কোথা থেকে? আবার আমাদের ঘরে অবশ্যি একটো আলো জ্বলত মিটমিট করে, কত্তা ঘর একদম আঁদার করতে দিত না। তা এমন দিন পড়েছে যি সি আলোও বন্ধ–সবাই ঘুমিয়েছে, আমিও মনে হয় মরণঘুমই ঘুমিয়েছেলম। ম্যাঘ লম্পানিতে আর গুডুম গুডুম ম্যাঘের ডাকে ঘুমটো ভাঙল, খুব ঘন ঘন বিজলি চমকাইছেল আর জানেলা দিয়ে ঘরবাড়ি গাছ পুকুর মাঠ সারা দিনদুনিয়া একবার একবার দেখতে পেচি আবার চোখ বুজছি কিন্তুক থাকতে পারছি না চোখ বুজে। ম্যাঘের ডাকে কানে তালা ধরে যেচে।

কত্তার ঘুম খুব পাতলা। আমি জানি, তার ঘুম ভেঙে গেয়েছে কিন্তুক সি কুনো কথা বললে না। বলবে না জানা কথা! বিজলি লল্‌পাইছে আর ঘরের ভেতরে ছেলেমেয়ের বিছেনা আবছা দেখতে পেচি–আরামে ঘুমুইছে তারা। বড় ছেলে শহরে পড়ে, মেয়েটোও ননদের সাথে থাকে, ই ঘরে শুদু আমার দুই খোঁকা। এর মদ্যে আরো একটি খোঁকা হয়েছে কিছুদিন আগে। উ কথা আর বলি নাই–কি আর বলব–য্যাতোদিন খ্যামতা আছে পেটে ধরব, যিদিন বন্ধ হবে, সিদিন হবে। তাই বলে কি যারা এয়েছে দুনিয়ায়, মায়ের কাছে তাদের অনাদর হবে? তা লয়। ঐ যে দুই ভাই নিচ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। সব একবার দেখে নিয়ে আমি আবার চোখ বোজম আর ঠিক তখুনি দড়বড়িয়ে পানি নামল। শুকনো মাটি য্যাতক্ষণ না ভেজে, ফট ফট করে মাটিতে বিষ্টি পড়ার আওয়াজ হয়। বড় বড় ফোটায় অ্যাকন তেমনি বিষ্টি হচে। চোখ বুজেই আছি কিন্তুক বিজলি চমকাইলেই চোখে আলো দেখতে পেচি, চোখ বুজে কুনো কাজ হচে না। আর বাজ পড়ার আওয়াজ তো আছেই।

একটু বাদে বুঝতে পারলম মাটি আর শুকনো নাই, বিষ্টির চোটে মাটি আর ফটাস ফটাস করে উঠছে না, পটপট ঝমঝম করে ঘোননা আওয়াজ শুরু হয়েছে। তা ভালো, বিষ্টি হলে তো মাঠের ধানের ক্ষেতি নাই বরং ভালো। জমি কানায় কানায় ভরে থাকুক কি ভেসেই যাক তাতে কুনো ক্ষেতি নাই। ইসৰ কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গ্যালম।

ঘুম য্যাকন ভাঙল, ভোরের আলো ত্যাকন খালি ফুটেছে, পুবদিক বোধায় ফরশা হয়েছে, বিছেনায় শুয়ে শুয়েই শুনতে প্যালম একটানা বিষ্টি হয়ে যেচে। অ্যাকন আর ম্যাঘ ডাকাডাকি নাই, লপানি নাই, বাতাসের সোঁ সোঁ অওয়াজ কিম্বা ঝাপটানি কিছুই নাই। খালি অঝোর বিষ্টির ঝমঝম অওয়াজ। একবার উঠে উঁকি মেরে দেখলম, সারা আসমান আমানির মতুন ম্যাঘে ঢাকা, কোথাও একটু কম-বেশি নাই, ম্যাঘ বলে মনেও হচে না, মনে হচে আসমানের বুঝিন ঐ রঙ। ঘন কালো ম্যাঘে খুব বিষ্টি হয়, মনে হয়, ঐ ম্যাঘে বিষ্টি তো হবেই কিন্তুক এমন ঘোলা ম্যাঘের গোলা দিয়ে লেপা আকাশ থেকে এত বিষ্টি কি করে হচে? তা অবশ্যি লতুন কিছু লয়, চেরকালই দেখে আসছি, আষাঢ়-শেরাবনে ত্যাতো লয়, ভাদর মাসে আকাশ এমনি ভাব ধরলে খুব পানি ঢালে। কুনো কুনো বার ভাদর মাসে বাদল হয়, মাঠ-ঘাট ভেসে যায়, তেমন বাদল দু-তিন দিন কি তার বেশিও থাকে। ইবারেও বোধায় তাই। রাতদোপরে নেমেছে। কম বেশি নাই, বাতাসের ঝাপটানিতে বিষ্টি ছেড়া-খোঁড়া হচে না। নিশ্চয় এত বিষ্টিতে মাঠকে মাঠ ভেসে যেচে। আর খানিকক্ষণ এইরকম চললে ধানগাছ সব পানিতে তলিয়ে যাবে, সারা মাঠ হয়ে যাবে শাদা সমুদুর। তাতেই বা আর ভয় কি? কুনো কুনো বছর এমন হয়। ধান সব তলিয়ে যায়, ডগাটুকুনও দেখা যায় না মনে হয় সব ধান পচে যাবে। তা কিন্তুক হয় না। বাদলা কেটে ভাদর মাসের রোদ উঠলে দু-দিনেই পানি হড়হড় করে নেমে যায়। গরম ভাপ হয়ে পানি শুকিয়ে যায়, যেমনকার ধান তেমনি আবার জেগে ওঠে। উ নিয়ে ভাবার কিছু নাই।

আর শুয়ে থাকা যায় না, উঠেই যখন পড়লম কাজকম্ম দেখি গা। য্যাতো বাদল-বর্ষাই হোক, দিন তো বসে থাকবে না। একটু বাদেই ছেলেপিলেরা সব উঠে খেতে চাইবে, জা-রা উঠে কাঠ-কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিজের নিজের কাজে মন দেবে, বাড়ির পুরুষরা বাইরে বেরিয়ে যাবে, বিষ্টি-বাদলা মানবে না। মুনিষ-মাহিন্দাররা বাড়ির এটো-ওটো কাজ করবে–হাঁস-মুরগিতে বাড়ি ঘিনঘিন করবে–দিন এমনি করে শুরু হবে, এমনি করেই শ্যাষ হবে। ইয়ার অন্যাথা নাই। আমি হেঁশেলের পাশে রাঁধা-বাড়ার চালাটোয় যেয়ে চুলো ধরাইতে গ্যালম। এই সোমায়টোয় জ্বালটের খুব অভাব–অত শুকনো কাঠ কোথা? ডালপালা কাঠিখোঁচা. আর খ্যাড় দিয়েই কাজ চালাতে হয়। গরু-মোষের খাবারে টান পড়ে, খ্যাড় পোড়াইলে মুনিষ-মাহিন্দাররা আবার রাগ করে। আবার কয়লাও গরমিল–এইসব কথা ভাবতে ভাবতে চুলোর কাছে যেয়ে দেখি ডালপালা সব ভিজে, চুলোয় রেতের আগুন শুদু যি নিভে গেয়েছে তা লয়, চুলোর ভেতরে পানি জমে গেয়েছে। কি করে জ্বালাই চুলো?

তা দিন পড়ে থাকে নাই। আগুন ঠিকই জোগাড় হলো, যাহোক রাঁধা-বাড়া হলো, দিনের কাজে সবই হলো। ভাবনা করার কিছু হয় নাই। কিন্তু তার পরে বিষ্টি যি একবারের তরে থামল না।

আজ পাঁচ দিন বাদল নেমেছে, একবার থামাথামি নাই। হয় বটে বিষ্টি, তাই বলে অত? দ্যাওরদের কাছে খবর পেয়েছি যি মাঠ ডুবে গেয়েছে পরশুদিনই। অত পানি কি মাঠ রাখতে পারে? সব ভরা, অত পানি নেমে যাবে কোথা? সারা মাঠে ধান আর দেখাই যেচে না, সব ডুবে গেয়েছে। আগে আগে হলে বলতম দু-দিন বাদে পানি নেমে গেলেই মাঠ আবার সবুজ হবে। তাই বলে টানা ছ-দিন যেদি ধান পানির তলায় থাকে তাইলে কি সেই ধান বাঁচবে? আজ পাঁচ দিন তো হয়েই গেল।

ইদিকে দিন গুজরান তো অসোম্ভাব হয়ে যেচে। কাল পয্যন্ত কুনোরকমে বাঁধাবাড়া হয়েছে। যেমন করে তোক ছেলেপুলে, বাড়ির পুরুষমানুষ, মুনিষ-মাহিন্দারদের মুখে ডাল-ভাত জোটানো গেয়েছে। আজ কি হবে? গিন্নি আঁদার ঘরে নিথর শুয়ে আছে, ননদ হয়তো আমারই মতুন তার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কাকে কি শুদুব? কোথা কি আছে আমিই সব জানি! হেঁশেলে বড় পয়ায় চাল আছে, ডালও আছে য্যাথেষ্ট, টিনে মুড়িও আছে। চুলোটো যেদি জ্বালাতে পারি তাইলে চালে-ডালে এক পাতিল খেচুড়ি বেঁধে দিলে বাড়ির সবাই খেতে পারবে। কিন্তুক চুলো জ্বালাইতে কি পারব? এক ফোটা কেরাসিন নাই, কয়লাও নাই। কটো ভিজে ঘসি আর বাবলাগাছের ডালপালা পড়ে আছে। গুণে গুণে দ্যাখলম ট্যানাকাঠির বাসোয় মোটে তিনটো কাঠি পড়ে আছে। ডালপালা গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে বসে একটো কাঠি বারুদের গায়ে টানলম। কিছুই হলো না। বারুদ ভিজে জবজব করচে। বাসোর গায়ে আর একবার কাঠিটো জোরে টানতেই খশ করে কাঠির মাথার বারুদটো খসে গেল। কি হবে? কি করে আগুন জ্বালাব? কে এট্টু আগুন দেবে? পরের কাঠিটো খুব জোরে টানতে গ্যালম, যাঃ, কাঠিটোই ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। আর মোটে একটি কাঠি আছে। এটিও যেদি না জ্বলে!

কোথাও আগুন নাই, সারা গাঁ ভিজে চবচব, কুনো বাড়িতে আগুন নাই, কারুরি চুলো জ্বলছে না। কারু ঘরে খাবার নাই। ভয়ে আমার হাত-পা প্যাটের ভেতর সেঁদিয়ে যেচে। এই যে, এই শ্যাষ কাঠিটোর বারুদও খসে গেল। ত্যাকন আমার কাঁদন এল। কোথা আমি আগুন পাই? মুনিষদের কাছে চকমকি পাথর আছে, হয়তো তারা কষ্ট করে আগুন জ্বালাইতে পারবে। কিন্তুক অ্যাকন তারা কোথা?

কতক্ষণ থেকে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। কি যে ভাবছি আর কি যে দেখছি কে জানে? পানি হওয়া বটে? অ্যাকন মনে হচে এত বিষ্টি জেবনে দেখি নাই। পাঁচ দিন পাঁচ রাত-থির বিষ্টি হয়ে যেচে! আসমানের সেই এক আমানির মতুন রঙ–কম-বেশি নাই। একবার যেন কতো দূরে, অ্যানেক দূরে, গুড়গুড় করে আওয়াজ উঠল। বিষ্টি আর একটু ঘন হলো। বাড়ির পুব-উত্তর দিকের মাটির পাঁচিরের খ্যাড়ের ছাউনি পচে গলে গেয়েছে, এইবার মাটিই গলছে। দু-তিন হাত পাঁচির এর মদ্যেই গলে গেয়েছে। পাঁচিরের ওপর দিয়ে দেখতে পেচি খিড়কির পুকুরটো ভেসে চারদিক দিয়ে পানি উপচিয়ে পড়ছে। এইবার বাড়িতেও পানি ঢুকবে। ঐদিকে সবকটো পুকুর একটো পুকুর হয়ে গেয়েছে। পুকুরগুনোর সাথে মাঠ এক লাগোটা হয়ে গেয়েছে। সব একদম শাদা। বসে বসে দেখছি, বাড়িরই চারপাশের পাঁচির অ্যাকন গলে গলে পড়ছে, বাড়ি ইবার বে-আব্রু হয়ে পড়বে। তাপর হয়তো মাটির ঘরগুনো দুদ্দাড় করে পড়ে যাবে। ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।

বিষ্টি এইবার আরও ঘন হয়ে এল। এখন চোখের দিষ্টি বেশি দূর যেচে না। পাঁচ হাত দূরের জিনিশটো যি কি তা ঠিক বোঝা যেচে না। বাড়িতে কতো জিনিশই তো ইদিক-উদিক ছড়ানো থাকে, খেয়ালও হয় না। অ্যাকন বসে বসে ভাবছি ওটো কি জিনিশ, ওটো একটো ঝুড়ি, ঐটো কি, একটা কালো ভাঙা হাঁড়ি, আতাগাছের তলায় ওটো কি তেঁতুলগাছের শক্ত গুঁড়িটো? এই করতে করতে যেখানে কিছুই নাই, সেখানেও অ্যানেক জিনিশ দেখতে প্যালম। সি সবই যেন পানি দিয়ে তৈরি। তৈরি হয়েই আবার ভেঙে বেচে। একবার যেন মনে হলো খিড়কি-পুকুরের কোণের বাড়ি থেকে পানি দিয়ে তৈরি একটো মেয়ে বেরিয়ে এল। পানির ভেতর দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটছে। আমাদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তুক সে বাড়ির ভেতরে ঢুকল কিনা বুঝতে পারলম না। খালি ঝমঝম করে পানি হচে, সেই আওয়াজই শুনতে প্যালম। একটু বাদে ফের দ্যাখলম কে যেন হেঁশেল থেকে বেরিয়ে যেচে। না, ইবার আর বেভ্রম লয়। অবশ্যি এত পানি হচে যি মনে হচে আমার চারদিকে শাদা চাদর টাঙানো, তার আড়ালে সব ঢাকা পড়েছে। তবু ঠিক দেখলম একটো মানুষ হেঁশেল থেকে বেরিয়ে এসে এগনেয় নামার আগে উসারার খুঁটির কাছে এসে দাঁড়াইলে। তাপর যেমন সে পা বাড়িয়েছে এনেয় নামবে বলে, আমি অমনি ঐ মাহা বিষ্টির মদ্যে ভিজে শুটিয়ে যেয়ে তাকে ধরলম।

হ্যাঁ, খিড়কির কোণের বাড়ির আলিই বটে। বিয়ে হয় নাই, এক বুড়ি দাদি ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই তার। ভেজা জবজবে মোটা একটো চট বুক থেকে পা পয্যন্ত ডান হাত দিয়ে ধরে আছে। খেতে পায় না, তবু এত বড় বড় দুটো বুক ক্যানে যি তার, কি কাজে লাগবে আল্লা জানে! অমন করে চটটো হাত দিয়ে ধরে আছে। মেয়েমানুষের শরম বাঁচাইতে কিন্তুক তবু ঢাকা পড়ে নাই ঐ পব্বতের মতুন বুক। বাঁ হাতে মাটির শানকি-ভরা বাসি ভাত, তার আদ্দেক গলা। এক শানকি ভাত। হেঁশেলে ভাতের হাঁড়িতে গত রেতের পানি দেওয়া ভাত যা ছিল তা বোধায় সবটাই নিয়েছে শানকি ভরে।

আমরা দুজনা মুখোমুখি তাকিয়ে থাকলম। উঃ, মেয়ের দু-চোখের জমিন কি শাদা! ধলিবগের পালকের মতুন ধবধবে শাদা। বোঝাই যেচে চট দিয়ে শুদু শরীলের ছামনেটাই ঢেকেছে সে, ঘাড়-পিঠপাছা-কোমর উদোম। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলম। একটি কথা বলতে পারলম না। দুনিয়ায় অ্যাকন খালি সকাল হয়েছে। সারাদিন বাকি, অ্যানেক বাকি, অ্যানেক বাকি। বুকের ধুকপুকুনি কিছুতেই থামে না। কতক্ষণ বাদে আলি ফিসফিস করে বললে, তিনদিন তিনরাত কিছুই খাই নাই, দাদি ঘরেই আছে, বোধায় আজ মরতে পারে। আমি শুদু কোনোরকমে বললম, দাঁড়া। এই কথা বলে হেঁশেলে ঢুকে কি এক ভায়ানক রাগে একটো মাটির হাঁড়িতে থাবা থাবা চাল তুলে একদম ভত্তি করে উসারায় বেরিয়ে অ্যালম।

শানকি হাঁড়ির মুখে ঢাকা দে। চালটো ভেজাস না। যা–

কুনো কথা না বলে আলি পানিতে নামল। অ্যাকন আর চট দিয়ে কি হবে, মেয়েমানুষের গোটাটোই অ্যাকন উদোম! তা কি হবে, যে খুশি দেখুক। সে নেমে গেলে আমি পেছন থেকে বললম, তোদের চুলোয় আগুন আছে? থাকলে আমাদের একটু দিস। ক্যানে যে ইকথা বললম কে জানে। বলতে মন হলো তা-ই বললম।

তার পরদিন থেকে হাওয়া বইতে লাগল। এই কদিন একনাগাড়ে খালি বিষ্টি হয়েছে। একফোটা বাতাস ছিল না। আজ সকাল থেকে হাওয়া অরম্ব হলো। সকালবেলায় ভাবছি আজও যেদি অমনি করে করে বিষ্টি হয়, তাইলে দুনিয়া আর থাকবে না। ঘর-দুয়োর সব গলে মুছে যাবে। মিছে ভাবছি না, গতকাল বৈকালবেলায় মল্লিকদের একটো ঘর আমার চোখের ছামনেই ভেঙে পড়ল। আমাদের এই বাড়ি থেকে ঐ ঘরটো দেখা যেত না, বাড়ির পাঁচিরের আড়াল হতো। সকালবেলায় সেই সীমেনা-পাঁচির ভেঙে পড়েছে বলে মল্লিকদের গোটা বাড়ি দেখতে পাওয়া যেছিল। পড়ন্তবেলায় ঐ বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সোমায় উদের বড়ো ঘরটোর একটো দেয়াল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে মাটিসই হয়ে গেল। সাথে সাথে সারা বাড়িটো এমন আনকা লাগল যেন আগে কুনোদিন বাড়িটোই দেখি নাই। ভাঙা ঘরের ভেতর থেকে একঘর আঁদার আর একটা খারাপ গন্দময়লা ভাপ এসে আমার নাকে লাগল আর মানুষ হঠাৎ ন্যাংটো হয়ে গেলে যেমন লাগে ঘরটোকেও তেমনি একদম ন্যাংটো মনে হলো। ঘরের ভেতর যা যা আছে সব দেখতে পাওয়া যেচে যি! যা মানুষ দেখায় না, লুকিয়ে রাখে, সি-সব দেখা যেচে! ভাঙা ফুটো পচা সব জিনিস। জানে ধরে উসব জিনিস ফেলে দিতে পারে নাই।

সকালে যি হাওয়া বইতে শুরু হয়েছিল, তার জোর কেরমে কেরূমে বাড়ছে দেখছি। কুদিকের হাওয়া কিছুই বোঝলম না। শুদু দেখলম, অমন সোজা-চাদর ঝুলননা বিষ্টি একদিকে হেলে রয়েছে। তাপর হঠাৎ এমন একটো বিষ্টির ছাঁট এসে আমার চোখে-মুখে লাগল যি আমি কাত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লম, পরনের কাপড় সাথে সাথে ভিজে চুবচুবে হয়ে গেল। ই আবার কেমন বাতাস ভাবছি আর ত্যাকুনি আর একটো ঝাপট এসে লাগল। আগেরটোর চাইতে জোর বেশি এটোর।

এই অরম্ব হয়ে গেল! হাওয়া মাতালের মতুন করতে লাগল, কুনো ঠিক-ঠিকানা নাই, একবার ইদিক থেকে তো আর একবার উদিক থেকে। তাপর দেখি, উত্তর-দখিন-পুব-পচ্চিম হাওয়ার গতিক কিছুই ঠিক নাই। আর সি কি জোর আর শোঁ শোঁ আওয়াজ! গদগদিয়ে আজ টানা ছ-দিন ধরে যি বিষ্টি হচে, সেই বিষ্টি অ্যাকন ছিড়ে ছিড়ে যেচে, গায়ে এসে সুইয়ের মতুন বিধছে। কখনো দেখছি এলোমেলো হাওয়ার চোটে ধুমোর মতুন উড়ে যেচে। গত কদিন ধরে গাঁয়ের সব মাটির বাড়ি খালি বিষ্টিতে ভিজেছে, এইবার এই হাওয়ায় আর একটোও খাড়া থাকতে পারবে না, সব মাটিতে মিশে যাবে। মল্লিকদের ন্যাংটো বাড়িটো কাল একবার দেখেছি, এইবার গোটা গাঁ-টো ন্যাংটো হবে। খোলা আসমানের তলায় থাকবে সারা গাঁয়ের মানুষ, ছেলে-বুড়ো মেয়ে-পুরুষ সব। ত্যাকন মওত আসতে দেরি হলেই রাগ লাগবে!

আমি একা বসে আছি, আশেপাশে কেউ নাই, ছেলেপুলেদের চ্যাঁ-ভ্যাঁ নাই। বাড়িতে কেউ এখনো ওঠেই নাই। কদিন থেকে শুদু আমিই রাত থাকতে বিছেনা ছেড়ে উঠছি আর একা একা এখানে এসে বসে থাকছি, মনে হচে দুনিয়া শ্যাষ হবে। ত্যাকন মনে হতে লাগল আমার ই দুনিয়ায় আর কেউ নাই, এইবার দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।

এই কদিন কেউ সুয্যির মুখ দেখতে পায় নাই, সকাল-দোপরবৈকাল কখন আসছে কখন যেচে কারুর বোঝার উপয় নাই। ছেলেপুলের মুখ শুকনো, কেউ একটি কথা বলছে না, যা জুটছে তা-ই খেচে, কুনো হুজ্জোতি নাই। বড়রা আর কি করবে? বুকের সাথে হেঁটো লাগিয়ে সব ঢিপ ঢিপ বসে আসমানের দিকে চেয়ে আছে।

দোপরের দিকে মনে হলো বিষ্টিটো কমে আসছে আর বাতাসটো বাড়ছে। বাতাসের য্যাতো জোর বাড়ছে তাতে সি মাথাপাগলের মতুন করছে। বিষ্টিকে তাড়িয়ে একবার ইদিকে নিয়ে যেচে, একবার উদিকে নিয়ে যেচে। এই করতে করতে শ্যাষে বিষ্টিটো একদম থামল, অ্যাকন খালি বাতাস। হোক বাতাস, বিষ্টিটো তো থামল! এই ছ-দিন ছ-রাত বোধায় একবারও থামে নাই। গাঁয়ের সব পুকুর ডোবা, নামো জায়গা পানিতে ভরা; রাস্তায় একহাঁটু করে পানি। আর একদিন অমনি বিষ্টি হলে এই শুকনো দ্যাশের লোক তো সব ডুবেই মরে যেত। যাক বাবা বিষ্টিটো তত থামল। বাতাস আর কতোক্ষণ থাকবে, সাঁঝ আসতে না আসতেই ওর জোর চলে যাবে। ননদ বললে, নোহ আলাইহি সাল্লামের সোমায় একবার পেরায় কেয়ামত হয়েছিল, জাহাজে যারা জায়গা পেয়েছিল শুদু তারাই বেঁচেছিল, ইবারের যা বেপার তাতে এই পৃথিবীর জাহাজে কেউ বাঁচবে না গো! দ্যাওররা বললে, বিশেষ যি দ্যাওর চাষবাস নিয়ে থাকে, আসমান-জমিনের খবর রাখে, সে বললে, এমন অসময়ে এত পানি কুনোদিন দেখি নাই। এদিকে সব মাটির বাড়ি, দুদ্দাড় পড়ছে, বৈকালের মধ্যে গাঁয়ের আদ্দেক বাড়ি পড়ে যাবে। এ তল্লাটের সব গাঁয়েই এরকম হবে। তা নিয়ে আমি ভাবছি না। ভাবছি, ধান তো সব তলিয়ে গিয়েছে। ফুলনো ধান, শীষ খালি আসতে লেগেছে, এই অবস্থায় ধান চার-পাঁচ দিন পানির তলায়! ও কি আর আছে? পচে-হেজে নষ্ট হয়ে গিয়েছে সব ধান। নতুন করে আর রোয়ারও কুনো কথা নাই। কি ভায়ানক মাগন যে লাগবে তাই ভাবছি।

বাতাসের জোর বাড়তেই লাগল। সাঁঝ লাগতে লাগতে শোনলম গাঁয়ের আরও অনেক বাড়ি পড়ে গেয়েছে। লোকের দুর্দশার শ্যাব। নাই, অ্যানেক বাড়িতে রাঁধা-খাওয়া বন্ধ। চাল-চুলো, কাঠ-খ্যাড়, আটা-চাল কিছুই নাই! আমাদের বাড়ির লোক সব বাড়িতেই রয়েছে। কত্তাও বাড়িতে, তা সে তো আর বাড়ির ভেতরে আসবে না, পরচালিতে লোহার চেয়ারে ঠেসান দিয়ে চুপ করে বসে আছে। তার কোট-কাছারি নাই, ভোটে হেরে গেয়েছে, হিঁদুপাড়ার গিরে দায়ের কাছে। কত্তার ঘাড়ের কোঁকড়ানো চুল অ্যাকন চাছা। কথা খুব কম বলে।

সাঁঝবেলায় আবার বাড়িতে কেউ নাই। সব নিজের নিজের জায়গায়। আমি আর ননদ বসে আছি। কুনোমতে একটো পিদিম জ্বালিয়ে গিন্নির ঘরে দিয়ে এয়েছি। বিছেনায় গিন্নি মরার মতুন পড়ে আছে। শ্বাস বইছে, না, বন্ধ হয়ে গেয়েছে বুঝতে পারা যায় না। কথা বলতে পারলেও গিন্নি আজকাল কথা একদম বলে না। আমরা ঘরের ভিজে উসারায় বসে বসে সাঁঝ নামতে দেখছি। চারপাশের সব গাছের মাথা যেন ছিড়ে পড়ছে। বাড়ির মিশমিশে কালো লম্বা তালগাছদুটো এমন করে দুলছে যেন আকাশপেমান দুই লম্বা ভূত মাথা ঝাকিয়ে। নাচছে। পুকুরপাড়ের তেঁতুলগাছের ডালপালার আঁদারের ভেতর থেকে কালো কি একটা ঝাঁক উড়ে আসছে দেখলম। কালো ফুটি ফুটি এক ঝাক পোকা। কাছে আসতে দেখি, ওমা পোকা নয়, এক ঝক বাদুড়। এত বাদুড় একসাথে কুনোদিন দেখি নাই। আমার গা ছমছম করে উঠল।

সেই রেতে দুই ছেলে নিয়ে আঁদার ঘরে শুয়ে আছি। কত্তার এতদিনের অব্যেস আলো থাকতে হবে, তবু আলো জ্বালাতে পারি নাই ঘরে। আঁদার ঘরে দুই ছেলের নিশ্বেসের আওয়াজ পাওয়া যেচে। বড়টো কাছে নাই, মেয়েটো বড় হয়েছে, সে ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে থাকে না, থাকে ননদের কাছে।

মাটিতে বিছেনা পেতে একটু দূরে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে কত্তা শুয়ে আছে ঠিক মরা মানুষের মতুন। আমি জানি একটি কথা বলবে না, ঐ মানুষ ঠিক যেন পাথরের মুত্তি। শুয়ে শুয়ে শুদু বাতাসের আওয়াজ শুনতে লাগলম। হু হু করে একটানা বয়ে যাওয়া বাতাস তো লয়, সি তো অ্যানেক শুনেছি–ই বাতাস যেন মদ খেয়ে এয়েছে, আসছে যেন আর একটা দুনিয়া থেকে। সিখানে আটকানো ছিল, অ্যাকন ছাড়া পেয়ে খালি আসছে, আসছে, আসার রাস্তার কুনো ঠিক-ঠিকানা নাই, মাঠ-ঘাট ভেঙে আসছেই। কতোরকম শব্দ যি হচে তার শ্যাষ নাই–বড় গাছের ডাল ভাঙার শব্দ, টিনের চালের কাঁ-কে করে কাঁদনের আওয়াজ–সব আছে। শুদু কুনো জ্যান্ত পেরানির আওয়াজ নাই।

য্যাতো রাত গড়িয়ে ভোরের দিকে যেচে, আওয়াজ-ও যেন ত্যাতোই বাড়ছে। তবে কি এইবার ঝড় অরম্ব হবে? এমন লাগছে ক্যানে? একবার কি উঠে বাইরে যেয়ে আকাশটো দেখব? চোখে ঘুম তো এক ফোটাও নাই। বাইরে যাব বলে বিছেনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, ঠিক যেন পাথরের মুক্তির মতুন কত্তা কথা কয়ে উঠল, বাইরে যেয়ো না। এই কথাকটি বলে পাথর যেমন পাথর ছিল তেমনিই পাথর হয়ে গেল। চুপ করে আবার শুয়ে পড়লম।

ভোরবেলা থেকে শুনতে প্যালম আর-এক রকম আওয়াজ। সি বাতাসের আওয়াজ লয়, ম্যাঘ ডাকার আওয়াজও লয়। কেমন এক হড়াম হড়াম দুরদুর হড়হড় আওয়াজ। অনেকক্ষণ ধরে এইরকম শুনছি আর ভাবছি ই কি ভূঁইকম্পের আওয়াজ, না আর কিছু? কাছে লয়, অ্যানেক দূর থেকে আসছে, একবার মনে হচে মাটির তলা থেকে, একবার মনে হচে আসমান থেকে। বাতাসই বোধায় তাকে ইদিক-ঊদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেচে। খানিকক্ষণ ধরে শুনতে শুনতে আমার মাথাটোও যেন বিগড়ে গেল–কার ঘর, কার বাড়ি, কে ছেলে, কে মেয়ে কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন সোমায় পাথরের মুত্তি আর একবার কথা বলে উঠল, জোলের মাঠ থেকে পানি নেমে যাচ্ছে।

আঁদার আঁদার ঘরে চাদর-ঢাকা মানুষটো থির হয়ে শুয়ে আছে। মোটা চাদরের তলা থেকে কথা বলে উঠল এমন করে যি আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তা হবে, পানি নেমে যাবার আওয়াজই বটে। আমার মনে হতে লাগল, কুন্ দুনিয়া থেকে দানোরা এসে পানির রাজত্বে দাপিয়ে বেড়াইছে, হটর হটর করে হাঁটছে, ঢাক বাজানোর মতুন বুক চাপড়াইছে। আওয়াজ শুনি আর কেঁপে কেঁপে উঠি। ইদিকের এইসব তেপান্তরের মাঠ আর সেই সব মাঠভরা পানি। পানির সমুদুর, কুনোদিকে কূলকিনারা নাই। আসমানের সব পানি দুনিয়ায় ঢালা হয়ে গেয়েছে, অ্যাকন এত পানি নেমে কোথা যাবে? কোথা জায়গা হবে? বাতাসও বাড়ছে, পানিকে সি-ও থির থাকতে দেবে না, মাঠ থেকে চেঁছেপুছে ঠেলে নদীতে ফেলবে।

সাত দিন বাদে, আজ সকালে দেখলম সারা আকাশ ধোয়া তকতক করছে। মনে হচে কোথাও একটুকুনি ধুলো-বালি নাই। সাত দিনের কালো ময়লা আকাশ অ্যাকন নামোয় এসে দুনিয়াটোকেই কালো ময়লা চিটচিটে করে দিয়েছে। অ্যাকন এই দুনিয়া সাফ হবে কি করে? কোথাও একটুও শুকনো জায়গা নাই, সারা গায়ে একহাঁটু করে কাদা, ঘরদুয়োরের মাটি ভেজা, ঘরের মেঝে ভিজে স্যাতসেঁতে। ঠান্ডায়, জোর হাওয়ায় কাপুনি লেগে যেচে।

সকাল থেকে কাজকম্মে আছি–যখুনি একটু হাত খালি হয়, একটু একা হই, তখুনি শুনতে পাই হড় হড়, হুড় হুড় আওয়াজ। পানি নামছেই, নামছেই। আঁদার ভোররেতে য্যাতো ভয় লেগেছিল, অ্যাকন আর ওরকম লাগছে না। খালি মনে হচে, এই আওয়াজ আর সইতে পারছি না। পানির ভারে দুনিয়া হাঁসফাস করছে, নিশ্বেস নিতে পারছে না। মনে হচে আমিও নিখেস নিতে পারছি না। কবে আবার দুনিয়ার ভালো শ্বাস হবে, থির হবে পিথিমি, অ্যাকন কোথাও কুনো পাখি দেখছি না, কবে আবার পাখ-পাখালি ফিরে আসবে, এই ভায়ানক হাওয়াটো থামবে, অমন করে হাওয়া মাথাপাগলের মতুন করবে না?

বিষ্টিটো থেমেছে বটে, রোদও উঠেছে কিন্তুক হাওয়ার জোর থামল না। সব পানি না সরিয়ে সে থামবে না। গাঁয়ের পুবদিকের ঢালু দিয়ে পানি নেমে যেচে। ইদিকের মাঠ-ঘাট সব পুব-উত্তরে কাত। সিদিকে সব বড় বড় নদী আছে। বাতাস পানিকে তাড়িয়ে সিদিকেই নিয়ে যেচে।

তিন দিন পরে, দশ দিনের মাথায় এই কেয়ামত শ্যাষ হলো। বিষ্টি গেল, হাওয়া গেল, আসমান আবার নীলবন্ন হলো, সোনাবন্ন রোদ হলো–সব হলো! সেজ দ্যাওর, ল-দাওর যারা চাষবাস নিয়ে থাকে, তারা দুজনে একদিন বাড়ি এসে কপাল চাপড়ে বললে, মাঠে কিছু নাই, কিছু নাই, একটি দানা মিলবে না কারুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *