২১. গিন্নি বিছেনা নিলে, আর উঠলে না

গিন্নি বিছেনা নিলে, আর উঠলে না

বাড়ি ফিরে অ্যালম কিন্তুক এক দিন পরেই ক্যানে অ্যালম সি কথা কাউকেই বলতে চাই নাই। ননদ একবার শুদুইলে বটে, মেতর-বউ, দু-দিন থাকতে গেলে, কতদিন যাও নাই বাপের বাড়ি, তা একদিন বাদেই ফিরে এলে ক্যানে? ননদ শুদুইলে বটে কিন্তুক গিন্নি লয়। ঐ মানুষ কি সব বুঝতে পারত? আমি আর থাকতে না পেরে নিজে থেকেই বলে ফেললম সব কথা শুনে গিন্নি বললে, ভয় কি মেতরবউ, আল্লার দুনিয়ায় সব জায়গাই সোমান। তা বেশ করেছ, ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এয়েছ। কত্তাও শুনে তেমন কিছু বললে না, খানিক চুপ করে থেকে শুদু বললে, ভয় পেয়ে কি কিছু হয়, সাবধান হওয়া দরকার।

ঠিক কথা। হিঁদুদের মা-শেতলা লিকিন যোবতী নারী, গাঁয়ে তার পুজো হয়। তাইলেও সি কি কথা শোনে! আর মোসলমানদের ওলাবুড়ি নিজের নোংরা কাপড়ের পুঁটুলিটো নিয়ে গুটগুট করে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হেঁটে আসবে, ঐ কুঁজো বুড়িকে এক লহমার লেগে কেউ থামাইতে পারবে না। আসতে অনেক সোমায় লাগতে পারে, মনে হবে বুড়ির পা বুঝি ভেঙে পড়ছে, এইবার বুড়ি মাঠের মদ্যে মরা শুকনো কাঁকড়ার খোলের মতুন পড়ে থাকবে। তা লয়, সে ঠিক এসে ঢুকবে গাঁয়ে। এবার এমন রোদ, এমন গরম, এক দিনও বিষ্টি হয় নাই, আমের বোলগুনো সব শুকিয়ে গেয়েছে, বড় বড়। পুকুরের পানি শুকিয়ে খালি কাদাপানি আছে। মারী-মড়ক এলে ওমনিই হয়।

একদিন বাদেই ডোমপাড়ায় দু-একজনার নামুনির খবর পাওয়া গেল, তাপর দু-দিন কি তিনদিন পেরোয় নাই, সারা গায়ে লাউটো ছড়িয়ে পড়ল। অ্যানেক রোগের মতুন ই রোগেরও চিকিচ্ছের কুনো বালাই নাই। তা সোমায় নেবে না, ভাবতে দেবে না, শোক করতেও দেবে না। এক বাড়িতে একজনা মরল, তার দাফন-কাফন হতে না হতে আর-একজনা মরল। পাশাপাশি বাপ আর ব্যাটার লাশ, নাইলে মা আর মেয়ে, নাহয় দু-বুন, দু-ভাই–এমন আবস্তা, দাফন-কাফন করবে কে? কবর খুঁড়বে কে? হিঁদুদের মড়া হলে পাঁচ কোশ দূরের শ্মশানে পোড়াইতে নিয়ে যাবে কে? সোমায় কি করে পাওয়া যাবে? ভাররেতে ভেদবমি অরম্ব হলো, দিনটোও গেল না, সাঁঝের আগেই শ্যাষ। পানির মতুন দাস্ত হচে, আর চাল ধোয়া শাদা পানির মতুন বমি হচে, একবার থামাথামি নাই। যাতে ভেদবমি হচে, রুগির ত্যাতো লাগছে পিয়াস, উঃ সি কি পিয়াস, দুনিয়ার পানি এক চুমুকে শ্যাষ করবে। এমনি করে করে দোপরের পর থেকেই নেতিয়ে পড়বে, জেরবার হয়ে যাবে, হাত-পায়ের আঙুলে খাল লাগবে। চিকিচ্ছে-মিকিচ্ছে বাদ দিয়ে ত্যাকন একটোই কাজ–মওত আসার আগে পয্যন্ত কি করে রুগিকে এট্টু আরাম দেওয়া যায়। একজনা পাখা করে, বাতাস দেয়, আর-একজন হাতের পায়ের আঙুল টেনে টেনে সোজা করে। শ্যাষকালে রুগির গাল বসে যায়, চোখ কোটরে ঢুকে যায়, রুগি চোখে দেখতে পায় না, তারপর সুয্যিও ডোবে রুগিও চোখ বোজে।

চার-পাঁচ দিনের মদ্যে বাগদিপাড়া, মুচিপাড়া, বাউরিপাড়া পেরিয়ে এসে বামুনপাড়া, আগুরিপাড়া, তিলিপাড়ায় ঢুকে পড়ল ওলাউটো। মোসলমান পাড়াতেও ঢুকলে, তবে এট্টু দেরিতে। সি যি কি হতে লাগল, উরি বাপরে! পেত্যেকদিন একটো-দুটো-তিনটো করে যেতে লাগল। তাইলে কি কেউ বাঁচবে না? আমি ক্যানে বাপের বাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে অ্যালম? বাঁজা-বউটির কথাই সত্যি, যোম পেচু পেচুই আসে, যাকে চেনে তাকে ধরে-বেঁদেই নিয়ে যায়। এই বেপদে কত্তার মাথা কিন্তুক একইরকম ঠান্ডা। সে বাড়ির ভেতরে এসে বললে, মা, কেউ যেন না-ফুটনো পানি খায় না। এ রোগ মাছিতে আনে, খাবারের ভেতর দিয়ে আসে। খাবারের ভেতর দিয়ে না গেলে কিছুতেই এ রোগ হবে না। না-ফুটনো পানি এক ফোঁটা কেউ খাবে না, বাড়ির বাইরে কেউ কিছু খাবে না, সব খাবার ঢাকা দিয়ে রাখো। বাসি আর ঠান্ডা খাবার সব ফেলে দাও।

কত্তা যা যা বললে গিন্নি ঠিক ঠিক তা-ই করলে। বাড়ির কারুর সাধ্যি হলো না যি তার একটি কথা অমান্যি করে। গাঁয়ের ভেতরে পাড়ায় পাড়ায় যেয়ে কত্তা এই কথা সবাইকে বললে বটে কিন্তুক কে শোনে কার কথা? আর শোনা কি সোজা কথা? কে অত জ্বালট জোগাড় করবে আর পানি ফুটোবে? এটুখানিক পানিতে আর কি হবে, টিউকলের পানি, পোস্কারই তো রয়েছে, ঐ খেলে আর কি হবে এই মনে করে লোকে পানি খেচে। আ-ঢাকা ঠান্ডা খাবার তো আখছার খেচে। খাবার কি শস্তা, ফেলে দেবে ক্যানে, খেয়ে ফেলছে। কিন্তুক ই বাড়িতে কত্তা এমুনি করলে যি উসব করার কুনো উপয় থাকল না।

দশ-পনেরো দিনের মদ্যে গাঁয়ের অনেক লোক মরল। হাড়িপাড়া বাগদিপাড়া মুচিপাড়ায় বেশি, ভালো হিঁদুপাড়াতেও অনেকে গেল। মোসমলানপাড়া থেকেও চার-পাঁচজনা দুনিয়ার মায়া কাটাইলে। দু-হপ্তা বাদে একদিন খবর পাওয়া গেল, হারামজাদি বুড়ি ওলাবিবি কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে ঠিক বুঝকিবেলায় পুব-দখিন কোনাকুনি মাঠ পাড়ি দিয়েছে। বঁটা মার, আবার কুন গাঁয়ে ঢুকে গাঁ উজাড় করবে কে জানে! এই কদিন মুসিবতের শেষ ছিল না–কেমন করে দিন যেছিল, কেমন করে রাঁদা-খাওয়া হছিল, সি আর কি বলব! ছেলেমেয়ে খেলা ভুলে গেয়েছিল, খাওয়া ভুলে গেয়েছিল, ঘুমননা ভুলে গেয়েছিল। আমরা মায়েরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি–ইয়াদের মদ্যে কেউ কি যাবে, তার এ যেন আমি যাই–এইরকম বুকবুকুনি করে দিন গেয়েছে, রাত গেয়েছে। কুনোদিকে মন ছিল না।

বুড়ি মাগি গাঁ ছেড়ে গেলে অ্যাকন মানুষের খেয়াল হবে গাঁয়ের ই কি দশা হয়েছে! পেঁদনের কাপড় মিলছিল না তো অ্যানেকদিন থেকেই। বউ-ঝিরা আর কেউ কারুর বাড়িতে আসে না, বাড়িতেই থাকে। খুব দরকারেও পাড়ার রাস্তায় আসে না। পরনের কাপড়ের এমনি দশা যি আর আর বাড়িতে বেড়াইতে যাবে কি, একবার রাস্তায় বেরুবে কি–বাড়ির মদ্যে বাপ-ভাইদের ছামুতে বেরুতেই শরম লাগে। দিনের বেলাতেই কারুর গলা শোনা যায় না আর রাত লাগলে তো কথাই নাই। খেলাধুলোও বন্ধ, সাঁঝবেলাতেই নিঝুম রাত। কোথাও কুনো সাড়াশব্দ নাই। গাঁ যেন আঁদার কো-কাপ, কুনো বাড়িতে একটি আলো দেখা যায় না। কেরাসিন একদম গরমিল। মাথা খুঁড়লেও একটি ফোঁটা কেরাসিন পাবার উপয় নাই। গাঁয়ে দুটি মুদির দোকান আছে দুটিই বন্ধ। কি বেচবে তারা? দোকানে কিছুই নাই-নুন নাই, তেল নাই, চাল নাই, আস্তে আস্তে সব গরমিল হতে লেগেছে।

আমাদের বাড়িতে দুটো হেরিকেন ছিল। একটো-কে ঘিরে ছেলেমেয়েরা সবাই গোল হয়ে বসে শোরগোল করে পড়ত আর একটো কত্তার ঘরে দিয়ে আসা হতো। সেই হেরিকেন দুটো অ্যাকন কেরাসিন বিহনে জ্বালানো হচে না। ভাগ্য ভালো, দিঘির ঢালু ঘেসো পাড়টোতে রেড়িগাছ লাগানো হয়েছিল, খুব রেডি হয়েছে! সেই রেড়ি ঘানিতে ভাঙিয়ে রেড়ির তেল পাওয়া গেয়েছে অনেক। তাই দিয়ে পিদিম জ্বালানো হচে। একগাদা মাটির ছোট ছোট পিদিম কেনা হয়েছে। আর কেনা হয়েছে চারদিকে চারটো মোটা কাচ লাগানো লণ্ঠন। পিদিম জ্বালিয়ে ঐ লণ্ঠনের মদ্যে রেখে হেরিকেনের কাজ চালানো হচে। রেড়ির তেলে চুবনো ত্যানার পলতেয় পিদিমে আর কতোটুকুন আলো হবে? ঘরের এক কোণে কুনোমতে মিটমিট করে জ্বলে। লণ্ঠনের ভেতর রাখলে আলো একটু বেশি হয়, একটু বাতাসেই নেবে না। ঐ আলোতেই ছেলেমেয়েরা পড়া পড়ছে।

এমন করে আর কততকাল? একদিন রেতে কত্তাকে বললম।

যুদ্ধ কি এইবার একটু একটু বুঝতে পারছ তো? প্রথমে দেখলে মানুষের পরনের কাপড় নাই। এখন দেখছ একটি-একটি করে জিনিশ গরমিল হচ্ছে–নুন নাই, কেরোসিন নাই, চিনি নাই। তার মানে গাঁয়েগঞ্জে যা যা তৈরি হয় না, তৈরি করতে পারা যায় না, তাই তাই নাই। যা কিছু বাইরে থেকে আসত, তা আর এখন পাওয়া যাবে না। জমিতে চাষ-বাস করে চাল ডাল তেল এইসব পেয়েছি বলে ততো অভাব মালুম হচ্ছে না–সব জিনিস যদি নিজেদের না থাকত, যদি কিনে খেতে হতো তখুনি বুঝতে পারা যেত যুদ্ধতে কি হয়।

তাইলে শহরের মানুষদের আবস্তা কি?

তাদের তেল নুন চিনি কেরোসিন তো বটেই, চাল ডালও কিনে খেতে হয়। শহরের লোকদের খেতে হচ্ছে বিদেশ থেকে আনা মোটা চাল। আমরা গাঁয়ে ভালোই আছি।

আমি কত্তাকে সেই বাপের বাড়ি যাওয়ার গঞ্জনার কথা বললম।

আমি জানি, খবরের কাগজে পড়ি, মাঝে মাঝে শহরে যাই–দেশে এখন আর দেশের লোক নাই–বিদেশীতে দেশ ভরে গিয়েছে। গোরা সেপাইতে, বিদেশী গাড়িতে, উড়োজাহাজে, কামান-বন্দুক গোলাবারুদে, কোনো জায়গা আর বাদ নাই। শহরগঞ্জের পথঘাট, ট্রেন-বাস সব জায়গায় ওরা। ওদের যা লাগবে তাই জোগাতে হবে। ফলমূল, হাঁস-মুরগি গরু-ছাগল সব ওদের জুগিয়ে দিতে হবে। ট্রেনে বাসে ওদের পয়সা লাগবে না। সব ওদের দিতে হবে। মেয়েমানুষ পর্যন্ত বাদ নাই। না দিলে কেড়ে নেবে। ওরা যা খুশি তা-ই করবে, কোনো বিচার-আচার হবে না। যেখানে-সেখানে দেশের মানুষদের ওরা লাথি মারছে, ডান্ডা মারছে, মেরেও ফেলছে–কিছুই বিচার নাই। খুব খারাপ দিন আসছে। সারা দুনিয়ায় এই যুদ্ধ, পশ্চিম দুনিয়ায় এখন থমকে আছে, যুদ্ধ এখন পুবের দুনিয়ায়। কিছুই থাকবে না, সব মিশমার হয়ে যাবে। ফসলভরা একটা মাঠে পঙ্গপাল বসলে কি হয় দেখেছ? চার-পাঁচদিন পরে যখন দলটা চলে যায় তখন মাঠে শুকনো খটখটে শাদা মাটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। একটা ঘাসও আর দেখতে পাওয়া যায় না। এই যুদ্ধ শেষ হলে ঠিক তা-ই হবে, একটা ঘাসের ডগাও পড়ে থাকবে না সব বিরান মরুভূমি হয়ে যাবে।

এত ভেবে আর কি করব? যা হয় হবে। এবার আকাশের আবস্তাও খারাপ। ই কি খরানি! দু-মাস ধরে একটি ফোটা বিষ্টি নাই। কোথাও কুনো ঘেঁয়া নাই। সারা গাঁ উদোম খোলা পড়ে আছে। বড়-ছোট কুনো গাছে পাতা নাই, ভয়ে সব যেন কাঠি হয়ে গেয়েছে।

একদিন দোপরের খানিক আগে সব্বোনাশ হলো। উঠনে ধান মেলে দেওয়া ছিল, গিন্নি সেই ধান নাড়াতে যেয়ে হোঁচট খেয়ে, নাকি এমনি এমনি, পড়ে গেল। আমরা ছুটে তাকে তুলতে গ্যালম। হালকা মানুষ, বয়েস হয়েছে, শরীর শুকিয়ে গেয়েছে, তুলতে কষ্ট হলো না আমাদের। কিন্তুক গিন্নিকে হাঁটাতে যেয়ে দেখলম গিন্নি হাঁটতে পারছে না। খুব জোরে আঘাত লেগেছে কিম্বা কোথাও কিছু ভেঙেছে বলেও মনে হলো না। ইদিকে দেখছি গোটা ডান পা আর ডান হাত লাঠির মতুন সোজা হয়ে রয়েছে। গিন্নি কথাও কিছু বলছে না। ত্যাকন ভালো করে তাকিয়ে দেখি, মুখের চারদিকটো কেমন বেঁকে রয়েছে। এই দেখে আর কুনো কথা না বলে আমরা ধরাধরি করে গিন্নিকে নিয়ে উত্তর-দুয়োরি ঘরের মেঝেয় বিছেনা পেতে শুইয়ে দেলম।

সেই যি শয্যে নিলে গিন্নি, আর উঠলে না। ডান দিকটো, শরীলের পেরায় আধেক, একবারেই অবশ। হাতও নড়ে না, পা-ও নড়ে না। এত চেষ্টা করে গিন্নি কথা বলতে। তা মুখের বাঁ দিকটো এক-আধটু নড়াচড়া করছে বটে কিন্তুক ডান দিকটো থির। মুখ দিয়ে শব্দ হচে কিন্তুক একটি কথাও বোঝা যেচে না।

খবর পেয়ে কত্তা এল, অন্য সব ভাইরা এল, ছোট দ্যাওরকে খবর দেওয়ার লেগে শহরে লোক গেল, গাঁয়ের ডাক্তারটোও তখুন-তখুনি এল। সে বললে, আবস্তা খারাপ। ই রোগের নাম সন্ন্যাস রোগ। ই রোগেই বাপজি মরেছিল। মাথার শিরে ছিড়ে যায়, মাথার ভেতরে শরীলের সব রক্ত জমা হয়ে দইয়ের মতুন থকথকে হয়ে যায় তারপর দু-একদিনের মদ্যে রুগি মারা যায়। চোখে অন্ধকার দেখলম। তাইলে আর আমাদের গিন্নির হেয়াৎ নাই? গিন্নি ব্যাগোরে ই সোংসার একদিনও চলবে না, কেউ চালাতে পারবে না। আমি বউ হয়ে এসে মাকে মা, শাশুড়িকে শাশুড়ি একসাথে পেয়েছেলম। একদিনের লেগে ভাবি নাই, আমার কুনো দায় আছে। বুঝেছেলম যি শুদু হুকুম শুনলেই হবে। অ্যাকন কে হুকুম দেবে, কার হুকুম শুনব? এই কাঠির মতুন ফরশা রোগা এতটুকুন মানুষ শুয়ে আছে, উ কুন ধাতুতে তৈরি তা কেউ না জানলেও আমি জানি। ঐ শুকনো পাথরে কতো পানি, কতো মায়া, কতো দয়া-আমি হুহু করে কেঁদে ফেললম। তাই শুনে কত্তা এমন করে আমার দিকে চাইলে যি, কাঁদন সাথে সাথে গিলে নিতে হলো। কত্তা বললে, কিছু হয় নাই, রোদে মাথা ঘুরে গিয়েছে, দুর্বল শরীর, তাই পড়ে গিয়েছে, দু-দিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

বড় খোঁকাকে দেখার লেগে যি ডাক্তার এয়েছিল শহর থেকে, সেই ডাক্তার আবার এল। রুগি দেখে ডাক্তার বললে, শিরা ছেড়ে নাই, তাইলে বাঁচত না। মাথার ভেতর শিরা দিয়ে রক্ত যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেয়েছে বলে রক্ত জমে গেয়েছে। তখন-তখুনি য্যাকন রুগি মারা যায় নাই, আর ভয় নাই, রুগি এখুনি মারা যাবে না। ওষুধ খেতে হবে, রুগিকে খুব যত্নের মদ্যে রাখতে হবে, খাবার পথ্য যা যা লিখে দেওয়া হবে ঠিক তাই তাই খাওয়াতে হবে। আশা দিয়ে ডাক্তার বললে অবশ ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাবে–কথা হয়তো দু-চার দিনের মধ্যেই বলতে পারবে। এখুনি হাঁটতে পারবে না। তবে আস্তে আস্তে আবার হাঁটার ক্ষমতা ফিরে আসতেও পারে।

ডাক্তারের কাছ থেকে সব বুঝে নিয়ে কত্ত আমাদের বউ-ঝিদের সবাইকে ডাকলে–ভাশুর হয়েও সব ভাজ-বউদেরও ডাকলে–ডেকে বললে, মায়ের সামনেই বলছি–শাশুড়ি তার কথা শুনতে বা বুঝতে পারলে কিনা, জানি না একদিষ্টে তাকিয়ে ছিল দেখলম–তা কত্তা বললে, আমার কাছে দুনিয়া একদিকে আর আমার মা একদিকে কাজ সব ভাগ করে নাও, কে কি করবে। পায়খানা-পেশাব থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হবে। আমার দিকে চেয়ে এই পেথম সবার ছামনে আমাকে বললে, এই কাজটা তুমি নিজের হাতে করবে। তাপর বুনের দিকে চেয়ে বললে, মহুদা সবারই কাজ দেখবে। মোট কথা, রুগির যদি এতটুকু অযত্ন হয়, মায়ের কাছ থেকে যদি কিছু জানি, তাহলে যে-ই হোক, তার কোনো খাতির নাই, এ বাড়িতে তার জায়গা হবে না।

আমরা সবাই জানি, কত্তার কথার একটুকুন ইদিক-উদিক হবে না। গিন্নির সেবা এগু, তা-বাদে অন্য কিছু। ঘরের আর আর জিনিস সরিয়ে ফেলা হলো। শুদু সিন্দুকটো থাকল, তার ওপর পোঙ্কার বিছেনা আর রুগির যা যা লাগে সব রাখা হলো। মাথার দিকে ওষুধ-পত্তর আর ফলমূল পথ্য এইসব। কত্তা মুটের মাথায় চাপিয়ে মায়ের লেগে কতো জিনিস যি আনলে! ডাবের পাহাড় হলো, বাজার ঘুরে ঘুরে বেদানা, নাশপাতি, খেজুর, কলা, আম, লিচু সব কিনেছে সে, কিছু বাদ নাই। এত আক্রা-মাগনের দিনে পয়সা পেচে কোথা— একদিন এই কথা শুদুলে কি রাগ কত্তা

তাতে তোমার কি দরকার? বাড়িতে কি ধান-চাল কিছুই নাই! এক শো বিঘে জমি আছে কিসের জন্যে? সব বেচে ভিখিরি হব–যাও।

ওরে বাপরে! আর একটি কথাও বলা নয়। উ মানুষের এমন রূপ কুনোদিন দেখি নাই। তা আমি কিছু বারণ করেছি? আমাকে অত কথা বলার দরকার আছে? গিন্নির সেবার লেগে আমাকে বলতে হবে ক্যানে? ঐ মানুষ আমার মায়ের বেশি, বাপের বেশি, ই সোংসারের মুদুনি। মুদুনি ভাঙলে কি আর ঘর থাকে? কত্তা যি বুনকেই সব দেখতে বলেছে তার কারণ আছে। আমি জানি, গিন্নি গেলে ননদই লতুন গিন্নি হবে। ঐ মায়েরই তো মেয়ে, ভাইদের সোংসারের হাল সে ঠিকই ধরতে পারবে। গিন্নির সেবা-যত্নের খবরদারি করা তারই কাজ বটে! তবে সেবা-শুশুষার সব কাজ আমাদের বউদেরই করতে হবে। বড় বউয়ের ছেলেপুলে হয় নাই, কাজকম্ম সবই করে বটে কিন্তু একটু আলগা আলগা, কুনো কিছুতেই তেমন আঁট নাই, নিজের ওপরেও যত্ন নাই, কোথাও তার কুনো বাঁধন পড়ে নাই, জেবনটা কুনো গতিকে কেটে গেলেই হবে, এমনি করে চলে সে। এইসব চারদিক ভেবে গিন্নির সব দায় আমাকেই নিতে হলো। বাড়ির আরও কাজ আছে, সিসব আর দু-বউ করুক। ছোটজনা তো শহরে আছে। আসবে হয়তো কাল-পরশু দু-দিন থেকে আবার চলে যাবে। ছোট দ্যাওরের আপিস কামাই করার উপয় নাই।

আমাদের অত সেবা বেরথা গেল না। কদিন বাদেই দেখা গেল গিন্নির জবান আবার ফিরে আসছে। পেথমদিকে একটি কথাও বোঝা যেছিল না, সব কথা জড়িয়ে-মড়িয়ে খালি একটো গোঙানির মতো আওয়াজ শোনা যেছিল। তাপর মুখের ব্যাকাভাব কাটতে লাগল, একটি-দুটি করে কথা পোষ্কার হতে হতে আবার তার কথা আগের মতুন হলো। অসুখ যেন হয় নাই, সব আগের মতুন আছে। গিন্নির মনে কুনো ভয়-ভীত্ নাই। আগের মতুনই কি করতে হবে, না হবে, বলে। একবারও কই অসুখের কথা বলে না, নিজের কষ্টের কথা বলে না। একবার কাকে যেন বললে, মওত যখন আসবে তখন আসবে, আমি বেস্ত হব কেন। কথাবার্তা য্যান বেশ সড়োগড়ো হলো ত্যাকন ককে একদিন বললে, কি জানি বাবা, মাথাটা কেমন করে ঘুরে উঠল, ফু দিয়ে পিদিম নিভিয়ে দিলে যেমন হয়, তেমনি দপ করে সুয্যিটা নিভে গেল। আর আমি কিছু জানি না।

তোমার সব ঠিক আছে তো এখন? সব কথা মনে করতে পারো তো?

হ্যাঁ, সব মনে আছে শুধু এই হাঁটাটা বন্ধ। কেউ ফিরিয়ে না দিলে পাশ ফিরতেও পারছি না। বিছেনাতেই পায়খানা-পেশাব করতে হচ্ছে, বাবা! শুধু এই জন্যেই মওত চাইছি। কেন কেউ এই কাজ করবে?

কথা শুনে চোখের পানি রাখতে পারলম না, ই কথা কেন বলছে গিন্নি। আমার কঁদন দেখে গিন্নি কত্তার দিকে চেয়ে বললে, মহুদাই এই কাজ করত। কিন্তু আমি জানি মহুদাকে এ কাজ করতে দেবে না মেজ বউ। তুমি ভেবো না বাবা।

সসাংসারের আর কুনো হ্যার-ফ্যার হলো না। সব আবার ঠিক আগের মতুন চলতে লাগল। শুদু একটো মানুষ দিন-রাত শুয়ে আছে, সব দেখছে, সব শুনছে। সে সবকিছুতেই আছে কিন্তুক কুনো কিছুতেই থাকতে পারছে না। সুরুজ ওঠার আগে তাকে বিছেনা থেকে উঠে বসিয়ে দিতে হয়, পাত্তর কেনা হয়েছে, তাতে পায়খানা-পেশাব করিয়ে দিতে হয়, মুখ ধুইয়ে দিতে হয়। তাপর সকালের বাঁধা খাবারটো খাইয়ে দিতে হয়। ডান হাতটো তো অবশ। এইরকম করে দিন অরম্ব করে সারাদিনে তাকে কতোবার উঠিয়ে-বসিয়ে দিতে হয়, গোসল করাতে হয়, ওষুধ খাওয়াতে হয়, একটো মানুষের সব কাজ করে দিতে হয়। গিন্নি কিছুই বলে না। দিনের পর দিন যায়। তবে এক-একদিন গিন্নির চোখে কি এট্টু রাগ দেখি? বিড়বিড় করে কিছু যেন বলছে বলে মনে হয়। আমি জানি, গিন্নি কারু ওপর রাগে নাই, রাগ তার নিজের ওপর। বিড়বিড় করে আল্লাকে শক্ত শক্ত কথা বলে, শিগগিরি-শিগগিরি মত চায়। একদিন লিকিনি কুন্ বউ পানি খাইয়ে হাতের গেলাশটো এট্টু বেরক্ত হয়ে ঠক করে মেঝের ওপর নামিয়ে রেখেছিল। গিন্নি কত্তাকে সাথে সাথে ডেকে পাঠিয়ে বললে, সত্যি বলছি বাবা, একটুও রাগ করে বলি নাই, দুনিয়ায় দিন যদি শেষ হয়েই থাকে। শেষ তো হবেই একদিন, সব মানুষেরই হবে–তা যদি দিন শেষ হয়েই থাকে, আর কিছুই করার না থাকে, তাহলে দুনিয়ায় থাকা কেন, আল্লা কেন তবে নেয় না? এর কোনো মানে পাই না। তোমাকে শুধু একটি কথা বলার জন্যেই ডেকেছি, যার মন হয় না, সে যেন কিছুতেই আমার কাজ না করে। সে যেই-ই হোক, আমি তাতে এতটুকুনি রাগ করব না।

কথা শুনে কত্তা সবই বুঝলে, ঘর থেকে উঠে বাইরে যেতে যেতে ভারি কঠিন গলায় বললে, যার মন হবে না, সে যেন না মায়ের ঘরে যায়। ও ঘরে ঢুকে কেউ এতটুকুন বেচাল করলে, তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।

দিন যেতে লাগল আগের মতুনই। সেই সকাল থেকে চুলো জ্বলছে, সারাদিন যজ্ঞ হচে, মুনিষ-মাহিন্দার যেচে-আসছে, ভালোমন্দ খবর পেচি–কিছুই বাদ নাই। চুলো নিভছে সেই অ্যানেক রেতে। সারারাত আঙার থাকছে, ভোরে আবার সেই আঙার থেকেই চুলো জ্বালানো হচে। চেরকাল যা হবার তা-ই হচে। কিন্তু আমার কাছে সব লাগছে অন্যরকম। সব জায়গায় কথা–শুদু এক জায়গায় কথা নাই। উত্তর-দুয়োরি ঘরের দরজা সব সময়েই বন্ধ। রুগি ছাড়াও ঘরে কেউ না কেউ সব সোমায়েই আছে কিন্তুক সব চুপ। গিন্নি থিরকাঠি হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের ফরশা রঙ ঘরের আবছা আলোয় যেন আরও ধপ ধপ করে। ঠিক আগের মতুনই শাদা থানের শাড়ি কপালের আধখানা ঢেকে আছে।

এই মানুষ কুনোদিন নামাজ কাজা করে নাই। আমাদের কারু ওপর কুনোদিন জোর-জবরদস্তি করে নাই, তবু সেই কতোকাল থেকে, বোধায় ই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই গিন্নি, ননদ আর আমি একসাথে পাশাপাশি বসে আসর, মাগরেব আর এশার নামাজ পড়তম। সেই নামাজে কি হতো তা তো আমাদের কারুরি জানার উপয় নাই তবে সোংসারের জ্বালার ওপর সি ছিল মলমের মতুন। গিন্নির পাশে বসলেই এই কথাটি মনে হতো। জবান আর জ্ঞানবুদ্ধি আবার ঠিক হয়ে যাবার পরে গিন্নি আবার নামাজ পড়ছে বিছেনায় শুয়ে শুয়েই। এক হাত তুলে দোয়া করা হয় কি না, জায়েজ আছে কি না, তাও একদিন কত্তাকে শুদিয়েছিল। কত্তা বলতে পারে নাই, শুদু বলেছিল, তুমি যেমন করে পড়বে তা-ই জায়েজ। গিন্নি অ্যাকন থির হয়ে শুয়ে শুয়েই নামাজ পড়ে, লষ্ট না হলে ওজুও করে না।

এমনি করে গিন্নি নিজের বিছেনায় শুয়ে থাকলে। কুনোদিন আর উঠলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *