১১. সব গোলমাল লেগে যেচে

সব গোলমাল লেগে যেচে

সোয়ামি পুত্তুর ননদ শাশুড়ি দ্যাওর ভাশুর ইদের নিয়ে সোংসার করি। সেই ভোর ভোর ঝুঝকিবেলায় উঠি, সুয্যি ত্যাকনো দেখা দেয় নাই। সেই শুরু, সারা দিনে একবার কামাই নাই। কাজ কাজ। রেগেমেগে বলি রাবণের গুষ্টি। ঘর-দুয়োর পোষ্কার রাখো, কুটনো কোটো, বাটনা বাটো, রাজ্যের রাঁধন রাঁধো, চাকর মুনিষ মাহিন্দার সবাইকে খাওয়াও। ই আবার এক সুখও বটে! আমরা বউ-ঝিরা য্যাকন খেতে বসছি, সুয্যি ত্যাকন পাটে বসতে যেচে, রোদ লি লি করচে। এমনি করে দিন কাটে, দ্যাশ-দুনিয়ার আর কি খবর রাখব? নিজের দুটো ছেলের একটো শহরে বোডিংয়ে থাকে, তাকে ন-মাস ছ-মাসেও একবার দেখতে পাই না, আর একটো যে কখন খেচে, কখন ঘুমুইচে তার কিছুই জানি না, সি জানে তার ফুপু। বাড়িতে অ্যাকন ছেলেপুলে বেড়েছে। মনে হচে সেজ বউয়ের আবার ছেলেপুলে হবে। আমার ননদটির হাত এতদিন ফাঁকাই ছিল, তার কাজ ছিল হালকা। অ্যাকন আর তা লয়, তার বুনপেপাদুটো সোংসারে এয়েছে, আমার খোঁকা রয়েছে, সেজর খোঁকা রয়েছে–সব অ্যাকন ঐ ননদকেই দেখতে হবে। কেউ বসে নাই, সবারই কাজ।

সব কাজ সেরে য্যাকন শুতে যাই, কত্তা দ্যাশ-ঘরের কথা দু-চারটে বলে বটে, তার কিছুই বুঝতে পারি না। অক্ষর শিখেছেলম, বই পড়তে শিখেছেলম, বানান করে খবরের কাগজ পড়তে পারতম, বুঝতেও পারতম, অ্যাকন মনে হচে সব ভুলে গেয়েছি। মনে করেছেলম কত্তাকে একদিন শুদোব সেই কুন দ্যাশের খলিফার চাকরি অ্যাকনো আছে না গেয়েছে, সি আর শুদননা হয় নাই। বিছেনায় শুই আর মরার মতুন ঘুমিয়ে পড়ি। কখন শুদোব!

ইদিকে কত্তার গতিক সুবিধে মনে হচে না। পেরায় দিন শহরে যায়। ভোরবেলায় যায় আর এক দণ্ড রেতে ফেরে। গাঁয়ে খুব কমই থাকে। ইশকুলে যাওয়া কি ছাড়লে? আর কত্তামার বাড়ি যি কমই যাওয়া হচে সি তো দেখাই যেচে। বাড়িতে আকা লোকজন আসা অ্যাকন অনেক বেড়েছে। কত্তা আগে কথাবার্তা ত্যাতো বলত না, বরং কিছু শুদুলেই কেমন খেকিয়ে উঠত। অ্যাকন দেখছি নিজে থেকেই এটো-ওটো কথা বলে। যিদিন যিদিন লোক আসে বাড়িতে সিদিন শহরে যায় না। তাইলে লোকজন নিশ্চয় বলে-কয়েই আসে আর যারা আসে তারা যে-সে লোক লয়, তা তাদের চেহেরা, জামা কাপড়, পোশাকআশাক দেখেই বোঝা যায়। আড়াল থেকে অনেকদিন দেখেচি, খাবার বানিয়ে কাউরির হাতে পাঠিয়ে দিতে যেয়ে চোখে পড়েছে উসব মানুষদের। হিঁদু ভদ্দরলোক তো আসেই, আজকাল দেখি যেন মোসলমান মিয়ে-মোকাদিম এট্টু বেশি বেশি আসছে। বড় বড় পাগড়ি দেখতে পাই, হেঁটো পয্যন্ত আলখেল্লা গায়ে দিয়ে আসে কেউ, কারু কারু নোম্বা দাড়ি, বাবরি চুল। কারা ইয়ারা? কি করছে, কাদের নিয়ে আছে কত্তা–এইসব কথা ভেবে ভেবে মরি।

একদিন হঠাৎ কত্তা আমাকে শুদুইলে, আচ্ছা, হিঁদু-মুসলমানে তফাত কি বলো তো শুনি। ই আবার কি কথা? ইসব তো কুনোদিন ভাবি নাই, ভাবতে হবে বলে কুনোদিন মনেও করি নাই। কত্তার কথা শুনে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলম। দেখি সে মিটি মিটি হাসছে। কত্তার ই রূপ তো কুনোদিন দেখি নাই। একটু পরে সে বললে, এত কষ্ট করে যে পড়তে লিখতে শিখলে তা দিয়ে কি তোমার কোনো কাজই হবে না?

কথা শুনে আমার রাগ-ও হলো দুঃখ-ও হলো। কি কথা বলছে এই মানুষ? সকাল থেকে রেতে বিছানায় শোয়া পয্যন্ত তার সোংসারের ঘানি টানছি, চোখে বেঁধেচি ঠুলি, কানে দিয়েচি তুলো, পিঠে বেঁধেচি কুলো, দোপরের খাওয়া খেতে বসি সাঁঝবেলায় আর সে কিনা বলে লেখাপড়া শিখে আমি কি করলম! রাগে আমি গুম মেরে থাকলম, অ্যাকটো কথা বললম না। একটু সোমায় যেতে কত্তা বললে, হিঁদু-মুসলমান সব এক হয়ে এই একবারই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নেমেছিল। মোসলেম জাহানের খলিফাঁকে তাড়ানো যাবে না বলে কত কি করেছিল! শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে জানো? ব্রিটিশদের কিছুই করতে হয় নাই। সে দেশের মুসলমানদের এক নেতাই খলিফাগিরি খতম করে দিয়েছে। এখন এ দেশের হিঁদু-মুসলমান এক হয়ে যাই করুক সব বেকার। দাবিই তো আর কিছু নাই। সব ছত্রখান হয়ে গেল। আবার সেই হিঁদু-মুসলমানের নিজের নিজের দাবি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। তাতে তো বিদেশীদেরই পোয়াবারো। সেইজন্যে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, হিঁদু-মুসলমানে তফাত কি? এইবার বুঝতে পেরেছ?

কত্তা তো শুদুইলে কিন্তুক আমি কি বলব কিছু খুঁজে পেচি না। সত্যি সত্যি, ই কথা নিয়ে কুনোদিন ভাবি নাই। তবে বলছে য্যাকন, ত্যাকন নাহয় এট্টু ভেবেই দেখি। ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের গাঁয়ে মোসলমান ছিল বেশি, হিঁদু ছিল কম। আর আমার শ্বশুরবাড়ির এই গাঁয়ে হিঁদু বেশি, মোসলমান কম। ই হলো গাঁয়ে গাঁয়ে তফাত। তবে সেই তফাতের লেগে উ গাঁয়ে আমাদের কুনো অসুবিদা হয় নাই, ই গাঁয়েও কুনো অসুবিদা নাই। মারামারি হরহামেশা হিঁদুতে হিঁদুতে হচে, মোসলমানে মোসলমানে হচে, আবার হিঁদু-মোসলমানেও হচে।

মনে করে দেখলম, বিয়ের পরে কত্তামার কাছে গ্যালম। সি তো বড়লোক হিঁদুর বাড়ি। কামা সারা গায়ে গয়না পরিয়ে দিলে। একবারও মনে হয় নাই হিঁদুতে গয়না পরিয়ে দিচে। মনে হয়েছিল ঠিক যেন আপন মেয়েবউকে জান ভরে মা গয়না পরাইচে। দ্যাখো দিকিনি, তেমন মনে না হলে কি গয়না গায়ে রাখতে পারতম? গা যি আগুনে পুড়ে যেত। আর যেদি বলো উ হচে বড়লোকের গুমর, তা হতেও পারে। সি তো বড়লোক মোসলমান মিয়ে মোকাদিমের গুমরও হতে পারে। তাপরে দেখছি, হিঁদু কামার কেস্তে কাটারি কুড়ুল বানিয়ে দিচে, লাঙলের ইশ, ফাল তৈরি করে দিচে, হিঁদু ছুতোর মিস্ত্রি দরজা জানলা তৈরি করে দিচে, হিঁদু নাপিতবউ এসে দু-পা ভিজিয়ে কতো যত্ন করে হাত-পায়ের নোখ কেটে দিচে, হাড়িবউ এসে সোমায় সোমায় রাত জেগে সন্তান খালাস করে দিয়ে যেচে। সারা জেবন সে সন্তানের মায়ের মতুনই থেকে যেচে। কই হিঁদু বলে তো কিছুই আটকাইচে না, সব কাজই হচে। উদিকে মোসলমানরা চাষের কাজ করছে, মুনিষ খাটছে, মোসলমান রাজমিস্ত্রি স্কুল বোডিং বানাইচে, মোসলমান করাতিরা কাঠ চেরাই করচে, ঘর ছাইয়ে দিচে, সবাই সব কাজ করছে। তফাত কোথা হচে আমি বুঝতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, কতকগুলিন কাজ মোসলমানরাই বেশি করে, কতগুলিন কাজ হিঁদুরা বেশি করে। ই গাঁয়েরই স্কুলে একজনাও মোসলমান মাস্টার নাই। ওস্তাদজি তো ইস্কুলের মাস্টার লয়। চাষাভুষাে মুনিষ মোসলমানই বেশি। ক্যানে তা কি আর আমি জানি! যাদের ভদ্দরলোক বলে মোসলমানদের মদ্যে ই এলেকায় তারা এট্টু কম। আবার অন্য এলেকায় হয়তো শ্যা সৈয়দ পাঠান অ্যানেক আছে।

তা সি যা-ই হোক, হিঁদু-মোসলমানে তফাত আছে কি নাই তা নিয়ে এত ভাবনার কি দরকার? সি তো ধম্মে ধম্মে অ্যানেকই তফাত। কেরেস্তানদের সাথে হিঁদুদের তফাত নাই? কেরেস্তানদের সাথে মোসলমানদের নাই? বলে হিঁদুতে হিঁদুতে কতো তফাত তারই ঠিক নাই! মুসলমানে মুসলমানে কি তফাত নাই? এক সোংসারে একজনার সাথে আর একজনার কত তফাত। উসব নিয়ে ভেবে লাভ আছে?

আমি কিন্তুক কত্তাকে ইসব কথা একটো-ও বলি নাই। আমি চুপ করে ভাবছেলম–দেখি সে যেদি কুনো কথা বলে। বললে শেষ পয্যন্ত।

হিঁদু-মুসলমান এখন নিজের নিজের হিসেব নিয়েই আছে। খালি হিসেব কষছে। হিঁদু-মুসলমান একবার এক হয়েছিল তুর্কির খলিফার দাবিতে। সে দেশের মানুষ নিজেরাই খলিফাগিরি বন্ধ করে দিয়েছে। বাস–হিঁদু-মুসলমান আর একসাথে থাকার দরকার কি? একটা বড় দাঙ্গা পর্যন্ত হয়ে গেল সেদিন। ব্রিটিশরা এখন খালি ফাঁদ পাতছে, খালি ফাঁদ পাতছে। হিঁদু-মুসলমানের মধ্যে কেমন করে কিসব ভাগাভাগি হবে তার লিস্টি বার করেছে।

আমি খুব ভয় পেয়ে গ্যালম। ইসব নিয়ে কত্তা তো আগে কুনোদিন। কথা বলে নাই।তবে কি সে অ্যাকন থেকে উসব নিয়েই থাকবে? আমার যেমন ভয় হলো, তেমনি রাগও হলো। এট্টু দাঁড়িয়েছে সোংসার, জমি-জোমা হয়েছে, ঘরবাড়ি সহায় জন মুনিষ রাখাল হয়েছে, নিজের হাতে আর কাউকে কিছু করতে হয় না, খাওয়া-পরার অভাব নাই।মনের মদ্যে চিন্তা নাই–অ্যাকন এটুল্যাশদুনিয়া নিয়ে থাকলে ক্ষেতি কি? এই হলোকত্তার মনের ভাব। কিন্তুক আমি ভাবি কি দরকার ইসবের? জেবন সব্বারই নিজের নিজের, নিজের ছেলে-পুলে, মা, বোন-ভাই-বেরাদর নিয়ে সোংসার। তার বাইরে যাবার কি দরকার? কে কিসের পিতিকার করতে পারে বলে দিকিনি! ই গাঁয়ের জমিদার ছিল রায়েরা, তারা অ্যাকন ভিক্ষে করছে আর আমরা কিনে নিয়েছি তাদের জমি। তারা হিঁদু, আমরা মোসলমান। কত রকম হিঁদু আছে, কত রকম মোসলমান আছে। ক্যানে ইসব ভাবতে হবে? বিটিশরা অ্যাকন আছে, চেরকাল ছিল না, আবার চেরকাল থাকবেও না।

আমি এ কথাগুলিনই বললম। কথা শুনে কত্ত আমার মুখের দিকে একদিষ্টে তাকিয়ে থাকলে বটে, কিন্তুক পষ্ট বুঝতে পারলম, তার মন আমার কথার দিকে নাই। কি যি সে ভাবছে, সেই জানে। আমি আবার বললম, উসব কথা কানে বলছ?

তুমি তো সংসার করছ, না কি? কেউ তোমাকে বারণ করছে না। ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শি এইসব নিয়ে তোমার সংসার। সব ঠিক, তবে তোমার সংসারই কি সব? আর কিছু নাই? সংসারের বাইরে গাঁ আছে–একটি-দুটি নয়, হাজার হাজার লাখ লাখ–তেমনি আছে তোমার দেশ, হাজার দেশ, সারা দুনিয়া। দুনিয়ায় কতো মানুষ! সবাই যদি শুধু নিজের নিজের কথা ভাবত, তাহলে দুনিয়ায় আর মানুষ থাকত না, মারামারি কাটাকাটি করে সব মারা পড়ত।

ভালো বুঝতে পারছেলম না কত্তার কথা। কিন্তু তার পরের কথা কটি জানের ভেতরে যেয়ে লাগল।

কাগজে কাগজে বেরিয়েছে, নিজে তো আর দেখি নাই, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঘরবাড়ি মা-বাপ ছেড়ে চলে এসেছে, ইংরেজ না তাড়িয়ে আর ঘরে ফিরবে না। দ্যাখো, তারা কিছুই চায় না, চায় শুধু জান দিতে, রক্ত দিতে। তাতে হয়তো ব্রিটিশের কিছুই হবে না। সব তারা জানে, জানে তাদের জেল হবে, জরিমানা হবে, ফাসি হবে। তা হোক, ফাঁসির দড়ি কষ্ট করে গলায় পরিয়ে দিতেও হবে না, নিজেরাই গলায় পরিয়ে নেবে। এসব কথার কথা নয়, এসব হচ্ছে। কি করে সম্ভব বলতে পারো পনেরো-ষােলো বছরের একটি মেয়ে নিজের হাতে বন্দুক চালিয়ে ইংরেজ খতম করলে, তারপর ধরা পড়তে যাচ্ছে দেখে কঠিন বিষ খেয়ে সাথে সাথে মরে গেল। কত বয়েস এই মেয়ের? ধরো তোমার বড় খোঁকার বয়েসি।

খোঁকার কথা শুনে এতক্ষণ বাদে জানটো আমার ধড়াস করে উঠল। কত্তাকে কি আজ ভূতে পেলে? তাড়াতাড়ি করে আমি বললম, আর কথা বোলো না। আমার সব গোলমাল হয়ে যেচে। অনেক দিন ছেলের খোঁজখবর পাই না। কালই একবার যেয়ে খবর নিয়ে এসো।

এতক্ষণে কত্তা হাসতে হাসতে বললে, যাব যাব। আমার কথা শুনে তুমি মনে কোরো না আমি ঘর-সংসার ভাসিয়ে দিয়ে না জানি কিসব করব ঠিক করেছি, মোটেই তা নয়। যাই-ই করি, আমি নিজে কোথায় আছি, নিজের ভালো-মন্দ না বুঝে কিছু করব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *