2 of 4

৩.০৯ বসরাহর হাসানের দুঃসাহসিক অভিযান

বসরাহর হাসানের দুঃসাহসিক অভিযান

শাহরাজাদ বলে ও আমার গল্পের নাম বসরাহর হাসানের দুঃসাহসিক অভিযান।

অনেককাল আগে পারস্য ও খুরাসনের বাদশাহ ছিলেন কিনদামির। সমগ্র ভারত চীন ও সিন্ধের সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা ছিলেন তিনি। তার মতো দুঃসাহসিক, যোদ্ধা, দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার, এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী অসি-যোদ্ধা আর কেউ ছিলো না। ভ্রমণ, শিকার এবং লড়াই-এ তার আসক্তি ছিলো অপরিসীম। এছাড়া আলোচনা, বিতর্ক এবং রঙ্গ রসিকতাতেও সবিশেষ পটু ছিলেন তিনি।

উৎসব অনুষ্ঠানে কবি দার্শনিক এবং কথকদের আমন্ত্রণ জানাতেন। তাদের কাব্য কাহিনী এবং সারগর্ভ আলোচনা শুনতেন। যদি কখনও কোনও বিদেশী মুসাফির তার আশ্রয়ে আসতো, প্রভূত সমাদরে তাকে আপ্যায়ন করতেন। তাঁর জীবনের বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতেন। এবং প্রচুর ধনরত্ন উপহার দিয়ে স্বদেশে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর সভার বেতনভূক কবি এবং কথকদের তিনি উজিরের সমান মর্যাদায় আসন দিতেন। এই কারণে তার প্রাসাদ দেশের সেরা বিদ্বজ্জনদের সমাবেশে এক মহাতীর্থ হয়ে উঠেছিলো। বহু লুপ্ত প্রায় গল্পগাথা কাব্য-দর্শন তার প্রচেষ্টায় আবার নতুন করে বেঁচে উঠতে পেরেছিলো।

আপনি শুনে হয়তো অবাক হবেন জাঁহাপনা, তার স্মৃতিশক্তি এতোই প্রখর ছিলো যে, একবার তিনি যে গল্প-গাথা শুনতেন তা আর কোনও দিনই বিস্মৃত হতেন না। এই রকম শোনা বহু ভারতীয় আরবী এবং পারসী উপকথার প্রতিটি ছত্র তিনি নির্ভুলভাবে পরিবেশন করতে পারতেন। বহু কবির কাব্য অনর্গল মুখস্থ আবৃত্তি করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবে না তার।

এইভাবে দিনে দিনে তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। নতুন কিছুই আর বাকী ছিলো না শোনার। যিনি তাকে যা শোনাতে আসতেন তা পূর্বাহ্নেই জানা বলে আর শোনার কোনও দরকার হতো না তার। এই কারণে দুঃখ পরিতাপের অন্ত ছিলো না বাদশাহ কিনদামিরের। কি করে কার গল্প কিসসা শুনে তিনি অবসর বিনোদন করবেন সেই চিন্তায় তাঁকে দহন করতো সর্বদা।

একদিন এই রকম এক যন্ত্রণাকাতর মুহূর্তে বাদশাহ কিনদামির তার ব্যক্তিগত খোজাকে বললেন, যা তো, আবু আলীকে একবার ডেকে নিয়ে আয়।

আবু আলী বাদশাহর খুবই প্রিয়পাত্র। তার সমকক্ষ কথক সে-সময়ে আর দ্বিতীয় ছিলো না কেউ! এমন গল্প সে ফঁদতে পারতো যা শুনতে শুনতে শ্রোতারা আহার নিদ্রা ভুলে যেত। একটা কিসসাই একনাগাড়ে এক সাল ধরে বলে যেত সে। কোথাও কোনোও ছেদ-যতি পড়তো না। শুনতে শুনতে কেউ হাই তুলতো না, কেউ বলতে পারতো না—গল্পটা কোনও জায়গায় ঝিমিয়ে আসছে বা শুনতে আর তেমন জমজমাট মনে হচ্ছে না।

সেই আবু আলীও আজ বাদশাহর কাছে দেউলে হয়ে গেছে। তার সমুদ্রগর্ভ গল্পের অগাধ সম্ভার সব আত্মসাৎ করে নিয়েছেন তিনি। নতুন গল্প তেমন আর বানাতে পারে না আজকাল। তবু বাদশাহ আবু আলীকে অশ্রদ্ধা করেন না। ভঁড়ারের সবখানি উজাড় করে দিয়েছে সে। এবং তার পরিমাণও পর্বত প্রমাণ। এতোবড় গুণী লোককে সমাদর না করে কী পারা যায়?

বৃদ্ধ আবু আলী এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ায়।

—এই যে এসো এসো। এককালে কত গল্প কি শুনিয়েছ, আজ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলে! তা সত্ত্বেও তোমাকেই আজ ডেকে পাঠিয়েছি। নতুন একটা কিসসা শোনাতেই হবে। কী, পারবে না? আমি যে অনেকদিন উপবাসী, আলী। আজকাল কেউ আর নতুন কোনও কাহিনী শোনাতে পারে না। যারা আসে, তারা সবাই পুরোনো কাহিনীই সম্বল করে আসে। সবই যে আমার শোনা। দেশে গল্পের এতো দুর্ভিক্ষ হয়ে গেলো কেন, আলী? আমার যে একা একা সময় আর কাটে না। তাই বলছি, নতুন কোনও গল্প যদি শোনাতে পার, আমি তোমাকে একটা জায়গীর দেব, অনেক বাগ-বাগিচা গোলাবাড়ি চাষাবাদের নিষ্কর, জমিজমা দেব। কিন্তু একটা শর্ত—এমন গল্প বলবে যা আমার অজানা এবং অসাধারণ। যদি তোমার কাহিনী শুনে আমি মুগ্ধ হই, কথা দিচ্ছি, তোমাকে আমার প্রধান উজিরে বহাল করবো। এবং তুমি আমার ডান পাশে বসবে। এবং তোমার খেয়াল খুশি মতো হুকুমত চালাবে। পুরো ক্ষমতা দেওয়া হবে তোমাকে। আর যদি বলল, না, পারবে না শোনাতে তেমন কাহিনী, তবে আর এখানে পড়ে থেকে কী করবে? তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিবি বালবাচ্চাদের কাছে দেশে ফিরে যাও। বাকী জীবনটা শাক-রুটি খেয়ে কাটিয়ে দাও গে।

বাদশাহর প্রস্তাব শুনে আবু আলী দিশাহারা হয়ে পড়ে।

-শাহেন শাহর আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু জাঁহাপনা এই অজ্ঞ-অধম আপনার একটু দাক্ষিণ্য প্রার্থনা করছে। আমি কি আপনাকে শোনাবো ঠিকই, তবে তার জন্য একটা বছর সময় ভিক্ষা করছি। এক বৎসর পরেও যদি আমি কাহিনী শুরু করতে না পারি, তবে বাদশাহ যে ফরমান দিয়েছেন, আমি তা মেনে নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবো।

বাদশাহ বলেন, পুরো একটা বছর-বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে না? কে বলতে পারে কোন্ মানুষ আরও একটা সাল বেঁচে বর্তে থাকবেই? যাই হোক, তোমার গল্প আমার বড় প্রিয়। সেই কারণে একটা বছরই সময় তোমাকে দিলাম। তবে একটা শর্ত—এই সময়কালের মধ্যে তুমি তোমার গৃহ-ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতে পারবে না।

আলু আলী বাদশাহকে কুর্নিশ জানিয়ে ঘরে ফিরে গেলো।

একা একা বসে অনেকক্ষণ চিন্তা করলো সে। তারপর তার প্রিয়পাত্র পাঁচটি তরুণ ম্যামলুককে ডেকে বললো, বড় বিপদে পড়েছি, বাবা সকল। বাদশাহ হুকুম করেছেন, নতুন গল্প শোনাতে হবে। এবং অপূর্ব অসাধারণ হওয়া চাই। কিন্তু এই বুড়ো বয়সে নতুন গল্প কোথায় পাবো আমি! তাই তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, এই বুড়ো মনিবকে যদি বাঁচাতে চাও তবে তোমাদের একটু তখলি সইতে হবে।

আমি তোমাদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার দিনার সঙ্গে দিচ্ছি। পাঁচদিকে পাঁচজন বেরিয়ে পড়। পৃথিবীর নানা দেশ তোমরা পরিভ্রমণ করবে। নানা জাতের ধর্মের মানুষের সঙ্গে মিশবে। তাদের কাছ থেকে গল্প কি শুনবে। এরমধ্যে বসরাহর হাসান-এর দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী যদি কেউ শোনাতে পারে, তাকে খুশি করে, পয়সা কড়ি যা চায় দিয়ে, তার কাছ থেকে সেই কাহিনী শুনে একটা খাতায় লিখে আনবে। আমি নিজে জানি না সে কাহিনী। এবং আমার বিশ্বাস খুরাসন পারস্যের কোনও কথকই তা জানে না। দুনিয়ার সব কিসাই তাকে আমি শুনিয়েছি শুধু মাত্র এই একটা গল্পই বাদশাহ কিনদামিরের না জানা। এ কাহিনী যদি তাকে শোনাতে পারি, আমার মান-ইজ্জত সব বাঁচবে। আমি বাদশাহর জায়গীর জমা পাবো, উজির হয়ে তার হুকুমত চালাবো। আর তা যদি তোমরা কেউ সংগ্রহ করে না আনতে পারো—আমার নকরী যাবে। শূন্য হাতে স্বদেশে ফিরে যেতে হবে। এখন সবই তোমাদের হাতে। তোমরা যদি চেষ্টা করো, যদি ঐ হাসানের লুপ্ত কাহিনী উদ্ধার করে আনতে পারো তবেই তোমাদের মনিবের মুখ রক্ষা হয়।

আবু আলী তার পাঁচজন কর্মচারী, কে কোন্ দেশে যাবে তাও বলে দিলো। প্রথম জনকে বললো, সে যাবে ভারত এবং সিন্ধে। দ্বিতীয় জন যাবে পারস্য, চীন এবং তার আশে পাশের দেশ। তৃতীয় যাবে, খুরাসন এবং তার সংলগ্ন রাষ্ট্রগুলি। চতুর্থ যাবে মাঘরীবের পূর্ব পশ্চিম এবং পঞ্চম জন যাবে সমগ্র মিশর এবং সিরিয়া।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সাতাত্তরতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

দিনক্ষণ দেখে একদা পাঁচজনকে পাঁচদিকে রওনা করে দিলো আবু আলী।

এর এগার মাস পরে চারজন ব্যর্থকাম হয়ে ফিরে এসে জানালো, তারা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু তন্ন তন্ন করে তলাশ করেও এমন কোনও মানুষের সন্ধান করতে পারেনি যে তাদের সেই হাসানের কাহিনী শোনাতে পারে।

আবু আলী বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চিন্তায় ভাবনায় বার্ধক্য নেমে আসে দেহে মনে। প্রায় হতাশ হয়ে শুধু আল্লাহর নাম জপ করতে থাকে। এখন একমাত্র ভরসা তিনি। তার দয়া na হলে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না।

সবাই শূন্য হাতে ফিরে এসেছে। শুধু মুবারকই ফেরেনি।

তামাম মিশর এবং সিরিয়ার প্রায় বেশির ভাগ অঞ্চলই সে ঘুরেছে। কিন্তু হাসানের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী জানে—তেমন কোনও ব্যক্তিরই সন্ধান পায়নি। তবু সে আশা ছাড়েনি। অক্লান্তভাবে ঘুরে চলেছে।

কাইবোর জগৎ বিখ্যাত কথকদের সঙ্গেও সে দেখা করেছিলো। তারা তাকে আরও অনেক মজার মজার কাহিনী শোনাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আবু হাসানের দুঃসাহসিক অভিযান তাদের সকলেরই অজানা। তাই প্রায় ব্যর্থ মনোরথ হয়েই সে স্বদেশে ফেরার উদ্যোগ করছিলো। কারণ সময় আসন্ন। এক বছর পূর্ণ হতে আর বেশি দেরি নাই। তার মধ্যে মালিককে কৈফিয়ৎ দাখিল করতে হবে।

কাইরো ছেড়ে মুবারক দামাসকাসে আসে। মনে তখনও আশা—যদি কেউ শোনাতে পারে।

দামাসকাস বড় সুন্দর শহর। তার পথ ঘাট, হাট বাজার, প্রাসাদ ইমারত চোখ মেলে দেখার মতো। তাছাড়া চমৎকার জলহাওয়া। প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

এক পড়ন্ত বিকেলে শহরের অভ্যন্তরে এসে পৌঁছয় সে। একটা সরাইখানার সন্ধানে এপথে ওপথে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। বড় বড় দোকান-পাট, ফিরিওলা, গাধা, খচ্চর, ভিস্তিওলা, ছেলে-ছোকরাদের হুটোপুটি এইসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছিলো, এমন সময় কে যেন পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো। মুবারক চমকে ওঠে। এই অজানা অচেনা বিদেশ বিভূঁই—এখানে কে তার কাঁধে হাত রাখবে! মুখ ফেরাতে এক হাসিখুশি যুবককে দেখতে পেলো।

—তুমি তো মুসাফির? তা এই ভর সন্ধ্যাবেলা কোথায় চলেছ?

মুবারক বলে, হ্যাঁ ঠিক ধরেছ, আমি পরদেশী। এখানে একটা আস্তানা খুজতে বেরিয়েছি। আপাতত রাতটা কাটাতে হবে।

-তারপর? তারপর কোথায় যাবে?

মুবারক বলে, কোথায় আর যাবো। পথে পথেই ঘুরবো। জনে জনে জিজ্ঞেস করবো, কেউ যদি শোনাতে পারে হাসানের কাহিনী?

-হাসানের কাহিনী? সে কে? কোথায় থাকে?

মুবারক হাসে, এ হাসান বসরাহর হাসান। অনেক অনেক কাল আগে তার ইন্তেকাল হয়েছে। তিনি ছিলেন দুঃসাহসিক মানুষ। তার জীবনে বহু বিচিত্র ঘটনা ঘটেছিলো। সে-সব কাহিনী এখন প্রায় হারিয়েই গেছে। আমি বহু দেশ ঘুরে এলাম, কিন্তু কেউই বলতে পারলো না। তাই হতাশ হয়ে দেশে ফিরে চলেছি। যাবার পথে দামাসকাস পড়লো—জগৎ বিখ্যাত প্রাচীনতম শহর, ভাবলাম একবার দেখে নয়ন সার্থক করে যাই।

যুবক বললো, তুমি কী জান এখানে দুনিয়ার সেরা কথক শেখ ইশাক থাকেন।

–শুনেছিলাম।

—চলো, তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাই। ঐ যে দলে দলে মানুষ প্রায় ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে—দেখছো, ওরা সবাই চলেছে শেখ ইশাকের কিসসা শুনতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি কাহিনী বলতে শুরু করেন। যারা আগে ভাগে গিয়ে জায়গা দখল করে বসতে পারে তারা ভাগ্যবান—পুরো কাহিনীটা শুনতে পায়। আর যারা দেরি করে তাদের মাঝখান থেকেই শুনতে হয়। চলো একটু পা চালিয়ে চলো, এখনও হয়তো বসার জায়গা পাবো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বলতে শুরু করবেন।

একটা প্রকাণ্ড বড় মহলের মত ঘর। তার ঠিক মাঝখানে একটা উঁচু মঞ্চে বসে কি বলে চলেছেন শেখ ইশাক-পৃথিবীর নামজাদা কথক। প্রতিদিন নানা দেশ থেকে শত সহস্র মানুষ আসে তার কিসসা শুনতে।

ইতিমধ্যেই প্রচুর জনসমাগম হয়ে গিয়েছিলো। মুবারক এবং ঐ যুবক ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে এক পাশে জায়গা করে বসে পড়লো।

পলিতকেশ সদাপ্রফুল্ল সেই কথক বৃদ্ধকে ঘিরে প্রথম সারিতে বসেছে শহরের সম্রান্ত আমির ও সওদাগররা। তাদের পিছনে পিছনে বসেছে সুধী গুণী এবং ইতর সাধারণ মানুষ।

যুবক বললো, এ কাহিনীটা শেখ সাহেব কয়েকদিন আগে শুরু করেছেন। এখন তিনি এ গল্প প্রায় শেষ করে এনেছেন। এরপরে নতুন কিসসা শুরু হবে আজ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা এবং হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে কাহিনীটা শেষ করে শেখ ইশাক।

এক এক করে শ্রোতারা বিদায় নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মুবারক দাঁড়িয়ে থাকে। ইশাক ইশারা করতে তার সামনে এসে সালাম জানায়।

–মালিক, আমি পরদেশী। আপনাকে দু একটা কথা বলতে চাই।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো আটাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

বৃদ্ধ ইশাক বলে, ওকথা বলতে নাই বেটা, আমরা সকলেই পরদেশী। তার ঠিকানা ছেড়ে দুদিনের তরে এসেছি। আবার তার কাছেই ফিরে যাবো।

মুবারক বলে, আমার স্বদেশ খুরাসান। আমার ওস্তাদ আবু আলী, হয় তো তার নাম শুনে থাকবেন, খুব নামজাদা কথক। তিনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। এই তার নজরানা-একহাজার দিনার। মেহেরবানী করে আপনি গ্রহণ করুন, তিনি ধন্য হবেন।

আমার ওস্তাদের বিশ্বাস বর্তমানে জীবিত তাবৎ সেরা কথকদের মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠ। আপনার তুল্য কাহিনীকার সারা দুনিয়ায় আর দুটি নাই।

ইশাক বললো, হ্যাঁ, আমি তার অনেক খ্যাতি ও প্রশংসা শুনেছি। তিনি আজ আরব দুনিয়ায় সুপরিচিত। ঠিক আছে তার উপহার আমি সাদরে গ্রহণ করলাম। এখন বলো, কী তোমার অভিপ্রায়? আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।

মুবারকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

—আল্লাহ আপনার নাম যশ খ্যাতি চিরকাল অক্ষুন্ন রাখুন মালিক। আবু আলী, আমার ওস্তাদ নতুন এক কাহিনী চেয়ে পাঠিয়েচেন আপনার কাছে। আমাদের সুলতান শুনতে চেয়েছেন। দুনিয়ার সব কিসসাই তার শোনা হয়ে গেছে। একমাত্র বসরাহার হাসানের বিচিত্র অভিযানের কাহিনী ছাড়া। আমি তারই প্রত্যাশায় আপনার কাছে এসেছি। যদি আপনি জেনে থাকেন সে কাহিনী আমাকে মেহেরবানী করে শোনান—এই আমার একমাত্র বাসনা।

বৃদ্ধ ইশাক হাসে, তুমি যথাস্থানেই এসে পড়েছ বাছা। আমি ছাড়া আর কেউই জানে না সে কাহিনী। ঠিক আছে, আমি তোমাকে খুশি করে দেব। তোমার মালিক, আবু আলী যথার্থই ভেবেছেন, হাসানের কাহিনীর মতো অমন চমৎকার কিসসা আজ পর্যন্ত কেউ কখনও শুনেছে। বলে আমার জানা নাই। অতি শৈশবে আমি এক লোলচর্ম পীর ফকিরের মুখ থেকে শুনেছিলাম এই কাহিনী, সেই পীর সাহেবও নাকি শুনেছিলেন অন্য এক সদাশয় বৃদ্ধ পণ্ডিতের কাছে। তারা আজ আর কেউ ইহজগতে নাই।

তোমার মালিকের অনুরোধে, শুধু শোনার মতো করেই বলবো না, তুমি যাতে নিখুঁতভাবে তার প্রতিটি ছত্র লিপিবদ্ধ করে করে নিতে পারো সেদিকেও আমি লক্ষ্য রাখবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে, বেটা।

মুবারক বলে, আপনি আদেশ করুন মালিক, আপনার শর্তের প্রতিটি অক্ষর আমি যথাযথ পালন করবো।

—বহুত আচ্ছা, বেটা। কারণ এ কাহিনী সকলের জন্য নয়। তোমাকে কথা দিতে হবে পাঁচ রকম লোকের কাছে এ কাহিনী তোমরা শোনাতে পারবে না। অজ্ঞ এবং উগ্ররা এর মর্ম বুঝবে na। এ কাহিনী ভণ্ডরা শুনলে রাগান্বিত হবে। মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা ক্ষীণবুদ্ধি বা নির্বোধ হয়—তারাও এ বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। বোকা হাঁদাদেরও ঠিক একই কারণে শোনাবে na। এবং পরিশেষে বিধর্মীদের কখনই শোনাবে না। এ কাহিনীর সার, যা অমূল্য সম্পদ, তারা মেনে নিতে পারবে না।

মুবারক বলে, উপরে আল্লাহ সাক্ষী আর নিচে আপনি, মালিক, আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।

বৃদ্ধ ইশাক খাতা এবং দোয়াত কলম দিলো মুবারককে।

-নাও শুরু করে। প্রথমে হাসানের বিচিত্র অভিযানের দুঃসাহসিক কাহিনী এক শিরোনাম লেখ।

একটানা সাত দিন সাত রাত্রি ধরে লিখে চললো মুবারক। লেখা শেষ হলে আগাগোড়া সবটা আবার সে পড়ে শোনালো বৃদ্ধ ইশাককে। মাঝে মাঝে ইশাক সাহেব একটু আধটু পরিবর্তন পরিমার্জন করে দিলো।

এতো দিনে মুবারকের মুখে এক দুর্গ জয়ের আনন্দ ফুটে ওঠে। ইশাক-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশের পথে রওনা হয়।

বৎসর পূর্তির আর মাত্র দশ দিন বাকী। প্রাসাদের সদর ফটকে আবু আলীর নামের ফলক আঁটা হবে। দেশের আপামর সবাই জানবে আলু আলী বাদশাহকে নতুন এক কাহিনী শোনাবে। কী বেইজ্জতের কথা হবে। আবু আলী কী কাহিনী শোনাবে বাদশাহকে। কী নতুন কাহিনী তার জানা আছে? সবই তো তার শোনা। একমাত্র শেষ ভরসা ছিলো মুবারক। কিন্তু সে-ও ফিরলো না। আর শূন্য হাতে ফিরেই বা কী হবে? তাতে তো মান বাঁচবে না।

বৃদ্ধ যখন একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে, ঠিক সেই সময় মাত্র দশ দিন আগে এসে পৌঁছলো এ মুবারক। আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে তুললো আবু আলীর বাসগৃহ।

—আপনার আশীর্বাদে আমি পেয়েছি মালিক, এই নিন।

খাতাখানা আলীর হাতে তুলে দেয় মুবারক। বৃদ্ধের চোখ থেকে দু-ফেঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে।

খাতাখানার প্রথম পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়লো আবু আলীর, বেশ বড় বড় হরফে লেখা আছে : বসরাহর হাসানের বহু বিচিত্র অভিযানের দুঃসাহসিক কাহিনী।

আবু আলী বুকে জড়িয়ে ধরে ম্যামলুক মুবারককে। তারপর ডান পাশে বসায়। মাথায় হাত রেখে বলে, অতি শৈশবে বাজার থেকে তোমাকে কিনে এনে আমি নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছি বাবা। বান্দা বলে মুখ করে রাখিনি। আমার সাধ্যমতো লেখা-পড়া তোমাকে শিখিয়েছি। আজ আমি বড় খুশি হয়েছি তোমার কাজ দেখে। আর কেনা গোলাম করে তোমাকে আটকে রাখবো না, বাবা। যাও আজ থেকে তুমি মুক্ত। তোমার গোলামী জীবন শেষ হয়ে গেলো। এবার নিজের ইচ্ছামতো যেখানে খুশি চলে যাও। যা প্রাণ চায় করো, কেউ তোমাকে আর বাধা দেবে না। আজ থেকে আমি আর তোমার মালিক নই, বেটা। এখন তোমার নিজের মালিক তুমি নিজে। আর ওপরে যিনি আছেন তিনি তো মালিকের মালিক।

—আমি তোমাকে দশটা আরবী টাট্ট ঘোড়া, পাঁচটা মাদী ঘোড়া, দশটা উট, দশটা খচ্চর, তিনটি নিগ্রো এবং দুটি খুদে বান্দা উপহার দিচ্ছি—এ তোমার কাজের যোগ্য পুরস্কার, তুমি নাও।

নয় দিন নয় রাত্রি ধরে বৃদ্ধ আলী, মুবারকের হাতের লেখা সেই খাতাখানা আগাগোড়া মুখস্থ করে ফেললো।

দশ দিনের দিন সকালে হামামে গিয়ে গোসল করলেন তিনি। নতুন সাজ-পোশাক পরলেন। তারপর পাণ্ডুলিপিখানা একটি ছোট সোনার বাক্সে বন্দী করে হাজির হলেন বাদশাহ কিনদামিরের দরবারে।

বাদশাহ কিনদামির আবু আলীর প্রতীক্ষাতেই অধীর আগ্রহে বসেছিলেন মসনদে। উজির আমির ওমরাহ আমলায় পরিপূর্ণ দরবার-কক্ষ।

আলু আলী কুর্ণিশ জানায়। বাদশাহ উৎফুল্ল হয়ে স্বাগত জানায়, এসো এসো আবু আলী, তোমার পথ চেয়েই বসে আছি আমরা।

সোনার বাক্সটা মসনদের সামনে রেখে আবু আলী বললো, এই আমার সেই কাহিনী। আজ ওয়াদার শেষ দিন। আপনি যদি হুকুম করেন আমি পড়ে শোনাতে পারি।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো ঊনআশিতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

বাদশাহ বললেন, তুমি তোমার কথা রেখেছ, আমি খুব প্রীত হয়েছি। যাই হোক, এখন কিসসাটা শোনাও। দেখি কেমন লিখেছ।

একটানা সাত দিন ধরে পড়ে শোনালো আবু আলী। বাদশাহ এবং দরবারের সকলে আহার নিদ্রা ভুলে রুদ্ধশ্বাসে শুনলেন সেই হাসানের বিচিত্র অভিজ্ঞতার দুঃসাহসিক কাহিনী। বাদশাহ মুগ্ধ, বিস্মিত এবং চমকৃত হলেন। আবু আলী প্রধান উজিরের পদে বহাল হয়ে বাদশাহর ডানপাশে অলঙ্কৃত হয়ে বসলো। জায়গীর জমি-জমা বাগ-বাগান, দাস-দাসী, ঘোড়া, খচ্চর-নানা উপহার উপঢৌকনে ভূষিত করলেন তাকে।

শাহরাজাদ বললো, জাঁহাপনা, এই হাসানের কাহিনীর পাণ্ডুলিপির একখানা নকল আমার সংগ্রহে আছে। অনেকবার এই চমৎকার কাহিনী আমি পড়ে প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। এখন সেই কাহিনীই আপনাকে শোনাবো।

অনেক অনেক দিন আগে বসরাহ শহরে এক প্রিয়দর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ এবং সাহসী যুবক বাস করতো। তার নাম-হাসান। বৃদ্ধ বাবা মা-এর বড় আদরের দুলাল ছিলো সে। কারণ হাসান তাদের শেষ বয়সের সন্তান।

বাবা মার যাওয়ার পর প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছিলো, এবং নানা রকম ভোগ-বিলাসে ডুবে অল্পকালের মধ্যে সব নিঃশেষও করে দিয়েছিলো সে।

ছেলের দীনদশা দেখে মায়ের প্রাণ কেঁদে ওঠে। সে নিজের পাওয়া অংশের সম্পত্তি বিক্রি করে ছেলেকে একখানা স্যাকরার দোকান করে দিলো।

হাসান বিধাতার আশ্চর্য সৃষ্টি। তার মতো সুঠাম সুন্দর সুপুরুষ বড় একটা চোখে পড়ে না। দোকান খুলে বসার সঙ্গে সঙ্গে পথচারীরা ভিড় করে দাঁড়ায়। এমন খুব-সুরত চাঁদের মতো ছেলে তারা কেউ দেখেনি কখনও।

দু দিনেই দোকান জম-জমাট হয়ে উঠলো। ছেলে মেয়ে বুড়ো, বণিক সওদাগর আমির-সবাই এসে ভিড় জমাতে থাকলো। সওদা করাটা গৌণ, আসল উদ্দেশ্য হাসানকে প্রাণ ভরে দেখা।

একদিন হাসান তার দোকানে বসেছিলো, এমন সময় সাদা দাড়িওলা এক পারসী এসে দাঁড়ালো। তার মাথায় বিরাট এক পাগড়ী। আর হাতে একখানা কোরান।

—খোদা হাফেজ, এ তো দেখছি সুন্দর এক স্বর্ণকার। দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে হাসানকে শুভেচ্ছা জানায় সে। হাসানও প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে ওকে বসতে অনুরোধ জানায়।

পারসী আসন গ্রহণ করে স্মিত হেসে বলে, বেটা, তোমার সুরত এবং আদব কায়দা বড়ই সুন্দর। আমার নিজের কোনও সন্তানাদি নাই। তোমাকে আমি যদি দত্তক নিতে ইচ্ছা করি তো তুমি কি রাজি হবে? সারা জীবন ধরে যে বিদ্যা আমি শিখেছি, তা আমার মরার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে যাবে—এ ব্যথা আমি সইতে পারছি না। সেই কারণেই আমি তোমাকে দত্তক নিতে চাই। শিখেয়ে যেতে চাই আমার গুপ্ত মন্ত্র। দিয়ে যেতে চাই আমার সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ-ধনদৌলত—সব।

হাসান এক কথায় রাজি হয়ে যায়।

—আপনি কখন আমাকে গ্রহণ করতে চান, চাচা? আমি রাজি।

—আগামীকাল। আজ আমি উঠি তাহলে?

পারসী সাহেব উঠে দাঁড়ায়। হাসানের মাথায় হাত রেখে সে আশীর্বাদ জানায়। তারপর আর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে চলে যায়।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো আশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

হাসান ভীষণ চঞ্চল, উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরে এসে মাকে সব কথা বলে।

মা আঁৎকে ওঠে, এ তুই কী বলছিস হাসান? পারসীরা কী কখনও সৎ হয়? ওদের কী জন্মের ঠিক আছে?

কিন্তু মা, ঐ সদাশয় পারসী সাহেবটি বেজন্মা নয়। ওর সঙ্গে কথা বললে, ওর চেহারা চরিত্র দেখলে তুমি বুঝতে পারতে। ওর মাথার পাগড়ী সাদা মুসলিনের। সাচ্চা মুসলমান পীর ছাড়া এ পাগড়ী কেউ পরে?

মা বাধা দিয়ে বলে, ভুল করো না বাবা, আমি জানি এই পারসীরা ভীষণ ঠগ জোচ্চোর হয়। ওদের শিক্ষা-দীক্ষা সবই বদ কাজের উদ্দেশ্যে, জীবনে ভালো চিন্তা তারা কখনও করে না। নিজের ভাইকে কী করে পথে বসাতে হবে সেই চিন্তাই তাদের আসল।

হাসান হো হো করে হেসে ওঠে, মা, আমরা গরীব। গরীব বললে ঠিক বলা হলো না, আমরা দীন দরিদ্র। তাই কারো ভালো আমরা সহ্য করতে পারি না। আমি তো বাজি রেখে বলতে পারি, সারা বসরাহয় একটা লোকও নাই, যে ঐ পারসী সাহেবের মতো উদার মহৎ। একটা লোকের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায় না? লোকটা সৎ কী শঠ? ঐ পারসী সাহেবকে দেখলেই তোমার মনে হবে—কোন পীর-টির কেউ হবে হয়তো। লোকের নামে নিন্দা করার আগে তাকে একবার ভালো করে যাচাই করা উচিত মা। মিছিমিছি কারো নামে দোষ দিতে নাই।

মা দেখলো ছেলেকে বোঝানো যাবে না। সে আর কথা বাড়লো না।

পরদিন সকালে যথারীতি দোকান খুলে বসে আছে হাসান। একটু পরে সেই পারসী এলো। হাসান সাদর অভ্যর্থনা করে তাকে বসতে দিলো। পারসী প্রশ্ন করলো, আচ্ছা তুমি কী শাদী

করেছ?

হাসান বলে, জী না। তবে আমার মা ভীষণ পীড়াপীড়ি করেন রোজই।

পারসী বলে, অতি উত্তম। তুমি যদি শাদী নিকা কিছু করতে তবে আমার বিদ্যা তোমাকে শেখাতাম না। কারণ তুমি গোপন রাখতে পারতে না তোমার বিবির কাছে। আচ্ছা, তোমার দোকানে কোনও তামার জিনিস আছে?

—জী হ্যাঁ। তামার রেকাবী আছে, চলবে?

একখানা তামার রেকাবী এনে দিলো হাসান। সে বললো, চমৎকার, এতেই হবে। তোমার হাপরটা জ্বালাও। এই রেকাবীখানা পোড়াও। তারপর কাটারী দিয়ে কুটি কুটি করে কেটে ফেল।

পারসীর কথামতো হাসান রেকাবীখানাকে পুড়িয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললো।

 

-আচ্ছা, এবার তোমার ধাতু গলানো পাত্রে টুকরোগুলো রেখে গলিয়ে ফেললো।

হাসানের কাছে এসব কাজ শক্ত নয়। যথা নির্দেশ মতো তামার টুকরোগুলোকে সে গলিয়ে ফেললো।

পারসী হাপরের কাছে এগিয়ে এসে তার হাতের বইখানা খুলে বিড় বিড় করে কী সব মন্ত্র পড়লো। তারপর হঠাৎ গলা চড়িয়ে সে হক্ ব ম বলে চিৎকার করে ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। তারপর আবার খাটো গলায় বলতে থাকলো, আ যা! আ যা—সুরজ কা রোশনি-আযা!

এরপর আবার সে হুঙ্কার ছাড়লো। ওরে শয়তানের বেহদ্দ, ধাতুর বাচ্চা—আসবি কিনা বল, না হলে পিটিয়ে খাল খিচে নেব। অক্ ব মক্। ওরে শয়তানের জাসু তামা, সোনা-হ। না হবি- তো আমার হাতে মরবি।

এরপর পাগড়ীর ভঁজ থেকে একটা ছোট কাগজের পুরিয়া বের করে খুললো সে। হলুদ আর জাফরান মেশানো রঙের একটু গুঁড়ো। গলিত তামার মধ্যে ঢেলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে তরল ধাতুটি জমে একটা শক্ত বাঁট হয়ে গেলো। হাসান বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে দেখলো—একখানা সোনার বাঁট।

তবু মনে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই হাসান পরীক্ষা করার জন্য কষ্টি পাথরখানা নিয়ে আসে।

না, কোনও সন্দেহ নাই, একেবারে খাঁটি সোনা। কোনও খাদ নাই।

পারসী বললো, জলদি বাজারে গিয়ে বেচে টাকা নিয়ে এসো। টাকাটা দোকানে রাখবে না। বাড়িতে নিয়ে যেও, বুঝলে?

হাসান তাড়াতাড়ি বাজারে চলে যায়। দু-হাজার দিনারে বিক্রি করে টাকা নিয়ে ফিরে আসি।

তখুনি বাড়ি ফিরে হাসান মার হাতে টাকাটা তুলে দেয়। ছেলে রোজগার করে এনেছে।

মা খুশি হয়ে সিন্দুকে তুলে রাখে। হাসান হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু কী করে টাকাটা পেলাম তা তো জিজ্ঞেস করলে না, মা?

-কেন ব্যবসা করছিস, লাভ হবে না।

—তা বলে একদিনে এতো নাফা?

মা বুঝতে পারে না, তবে কোথায় পেলি?

তখন সে সব ঘটনা খুলে বলে। মা শুনে আঁৎকে ওঠে, সর্বনাশ। এ তুই কী করেছিস। কোন্ জালিয়াতের পাল্লায় পড়েছিস, বাবা। (স্ব ৯ এবার যে ফাটকে যেতে হবে।

-কেন, ফাটকে যেতে হবে কেন? আমি তো কাউকে ঠকাইনি—খাঁটি সোনা দিয়ে ন্যায্য দাম নিয়েছি। সোনা যে নিখাদ খাঁটি তা আমিও যাচাই করে দেখেছি, যে কিনেছে সেও যাচাই করে দেখেছে। এতে ভয় পাওয়ার কী আছে। তোমার যত্তোসব আজগুবি চিন্তা।

মা বলে, তুই চিনিস না ঐ জালিয়াত পারসীগুলোকে। ওরা পারে না এমন কাজ নাই। গুন তুক করে ভেল্কি দেখিয়ে না’ কে হাঁ করে দিতে পারে। তুই যাকে সোনা রলে বেচে এসেছিস বাবা, আসলে তা সোনা নয়। হতে পারে না। কালই দেখবি তা পিতল বা তামা হয়ে গেছে। ওরা তুক তাক জানে, কিছুক্ষণের জন্য যে-কোনও ধাতুকে সোনার মতো করে দিতে পারে। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আবার সে নিজের ধাতুর গুণে ফিরে আসে।

হাসান বলে, আমি তো এই বিদ্যাই শিখবো, তার কাছে। আজ প্রথমে তিনি আমাকে মৌলিক ধাতু থেকে সোনা বানাবার কায়দা শিখিয়েছেন।

মা কী বলবে বা বলতে চায়, সেদিকে আর ভ্রক্ষেপ না করে রসুইখানায় ঢুকে পিতলের হামানদিস্তাখানা তুলে নিয়ে সোজা দোকানে ফিরে আসে হাসান। এই হামানদিস্তায় তার মা পেঁয়াজ রসুন থেঁতো করে। লঙ্কা মরিচের গুড়ো-মসলা বানায়।

হামানদিস্তাখানা দোকানের মেঝেয় রেখে হাপরটা জ্বালাতে যায়। পারসী দোকানেই বসেছিলো। হাসানের কাণ্ড দেখে সে হাসে।

-এটা কী হবে?

হাসান উৎসাহিত হয়ে বলে, খাঁটি পিতলের। অনেকটা ভারি আছে। সোনা বানাবো। কত ওজন হবে?

পারসী বলে, কিন্তু এ বিদ্যা তত দিনে মাত্র একবারই খাটানো চলে। বেশি লোভ করলে কোনও লাভ হবে না। আজকের যা পাওনা পেয়ে গেছ, আবার কাল বানাতে পারবে।

হাসান চুপসে যায়, কিন্তু আমি আপনার বিদ্যার গুপ্ত রহস্যটা জানতে চাই, মালিক।

-তুমি একটা বদ্ধ পাগল। যত্থাসময়ে সব শিখতে পারবে। এতে ধৈর্যই বড় কথা। অসংযম বিদ্যার সুফল নষ্ট করে।

হাসান মাথা নাড়ে, তা ঠিক, সব কিছুরই নির্দিষ্ট সময় আছে। তাড়াহুড়ো করলে সমূলে বিনাশ হতে পারে।

পারসী বলে যদি তুমি সত্যিই শিখতে অভিলাষ কর, তোমার সব যন্ত্রপাতি বেঁধে-ছেদে চলো আমার বাসায়। সেখানে গোপনে শেখাবো তোমাকে। এখানে এই বাজারের মধ্যে কী এসব কাজ হয়?

হাসান বলে, তা হলে তাই চলুন। সত্যিই তো এ সাধনার বস্তু। এতো হট্টগোলের মধ্যে সম্ভব হবে কী করে?

যন্ত্রপাতি সব বেঁধে-হেঁদে নিয়ে দোকান বন্ধ করে পারসীর সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়ে হাসান। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মা-এর কথাগুলো বার বার মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে।

পারসী কাছে এসে মাথায় হাত রাখে, কী মনে দ্বিধা আছে? না, মন যতক্ষণ না সাফা হচ্ছে ততক্ষণ কোনও কাজে পা বাড়াবে না। ঠিক আছে, যেতে হবে না আমার বাসায়। চলো, আজ তোমার বাসাতেই যাবো। সেখানেই শুরু হবে তোমার শিক্ষানবিশী।

—সেই ভালো। মা নিজের চোখে দেখলে মনে ভরসা পাবেন।

হাসান পারসীকে নিয়ে তার নিজের বাসার দিকে চললো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে!

 

পাঁচশো একাশিতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

-বাসায় পৌঁছে হাসান পারসীকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে যায়।

-মা, মাগো, উনি এসেছেন। আজ রাতে আমাদের বাসায় মেহমান হবেন। আমরা একসঙ্গে খানাপিনা করবো।

মা বলে, বাড়িতে যা শাক-রুটি আছে, তাই খাবে, চিন্তার কী? আমাদের শাস্ত্রে নুন আর রুটির মতো পবিত্র জিনিস আর কিছু নাই। কিন্তু ঐ নাস্তিক সূর্যের উপাসক পারসীরা এর মর্ম বোঝে না। যাই হোক, একবার যখন আমার ঘরে সে এসেছে, তাকে যেতে বলবো না—যেতে দেবোও না। কিন্তু ঐ জালিয়াত ঠগ জোচ্চোরটা যতক্ষণ থাকবে আমি এ বাড়িতে থাকবো না। তোমাদের খানা-পিনা যা দরকার সব আমি বানিয়ে দিয়ে পড়শীদের কারো বাড়িতে রাত কাটাতে যাবো। তারপর কাল চলে গেলে, সারা বাড়িটা আগে ভালো করে ধোয়া পোঁছা করে তবে এখানে নুন রুটি খাবো আমি।

পাঁচরকম তরকারী রুটি নুন জল সব সাজিয়ে রেখে হাসানের মা পাশের বাড়িতে শুতে চলে যায়।

হাসান এবং পারসী দু’জনে বসে খানাপিনা শেষ করে। পারসী বলে, হাসান, আজ তোমার নুন খেলাম, এ ঋণ পরিশোধ করা যায় না। তোমাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছি। শুধু সেই কারণেই আমার অর্জিত বিদ্যার গুপ্তরহস্য তোমাকে শেখাতে চাই।

এই বলে সে একটি কাগজের পুরিয়া বের করে পাগড়ীর ভাজ থেকে। ভঁজ খুলে সেই জাফরান হলুদ বর্ণের গুঁড়োটা দেখিয়ে বলে এর মাত্র এক টিপ পরিমাণ গুঁড়োতে পাঁচ সের পিতলকে সোনা করে ফেলতে পার। এই অমোঘ বস্তুটি এক হাজার সহজলভ্য এবং এক হাজার দুষ্প্রাপ্য গাছ-গাছড়ার মূল থেকে তৈরী করা হয়। বহু পরিশ্রম-সাধ্য! কী কী প্রক্রিয়ায় করা যায় তার বিস্তারিত বিবরণ তোমাকে পরে বলবো একদিন। এখন এটা তোমার কাছে রেখে দাও। কিন্তু সাবধান, খুলে রেখ না, এর মধ্যে একটা গন্ধ আছে সেটা উবে যেতে পারে।

স্বাভাবিক কৌতূহলের খেয়ালেই পুরিয়াটা নাকের কাছে ধরে গন্ধের প্রকৃতি আঘ্রাণ করে দেখতে যায় হাসান। ঠিক এইটেই চেয়েছিলো পারসী। হাসানের অচৈতন্য দেহটা লুটিয়ে পড়ে। পারসী আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।—বাজীমাৎ। হাসান, তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি ক’টা বছর ফন্দী ফিকির করছিলাম। শেষে আজ আমার মনস্কামনা পূর্ণ হতে চলেছে। এবার আর আমার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছ না তুমি।

ঘরের এক পাশ থেকে একটা বাক্স টেনে নিয়ে ডালা তুলে ভিতরের জামা-কাপড়গুলো বের করে ছুঁড়ে দেয়। হাসানের অচৈতন্য দেহটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাক্সের মধ্যে ভরে। একটা কুলিকে ডেকে এনে বাক্সটা তার মাথায় চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারপর সোজা সমুদ্রের তীর। সেখানে তার একখানা জাহাজ ছাড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলো। পারসী বাক্সটা নিয়ে উঠতেই জাহাজটা ছেড়ে দিলো।

জাহাজ চলতে থাকুক, এবার আমরা হাসানের মা-এর কথায় আসি।

সকালবেলায় হাসানের মা বাড়িতে ঢুকেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে যা আশঙ্কা করেছিলো, তাই ঘটেছে। দরজাটা হাট করে খোলা। ঘরের মধ্যে যে বাক্সটা ছিলো তা নাই। বাক্সের সাজপোশাকগুলো মেঝের ওপর ছত্রাকারে ছড়ানো। হাসান নাই, পারসীটাও নাই।

ছেলের শোকে মা ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কপাল চাপড়ায়। বুক চাপড়ায়। চুল ঘেঁড়ে।

—হায় রে আমার চোখের মণি, হায় রে আমার সোনা, কোথায় গেলি, বাবা। কী করে তোকে ফিরে পাবো।

পাড়া-পড়শীরা ছুটে আসে। সমবেদনা জানায়। অনেকেই এদিক ওদিক খোঁজ করতে ছুটে। কিন্তু হাসানকে কোথায় পাবে তারা। সে ততক্ষণে এক সমুদ্রগামী জাহাজের খোলে অচৈতন্য অবস্থায় বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে।

শোকাতুরা মা হাসানের আশায় কোনও রকমে জীবন ধারণ করতে থাকে।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো বিরাশিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

পারসীটা মহা ধুরন্ধর ধড়িবাজ এক যাদুকর। লোকটার নাম বাহুরাম। অগ্নির উপাসক। প্রতি বছর সে মুসলমানদের ঘর থেকে একটি করে সুঠাম সুদর্শন যুবককে চুরি নিয়ে আসে। তার বিকৃত কামনার ভোগ্য হিসাবে ব্যবহার করে। একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে। সে নিজে কুকুর তার মা বাবাও কুকুর। তার বাবার বাবাও তো কুকুর। এবং যে পথ ধরে সে চলে সে পথে তো একমাত্র কুকুররা চলে। সুতরাং সে যে পুরোপুরি একটা কুকুর সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী?

জাহাজ ছাড়ার পর প্রতিদিন একবার করে সে নিচের খোলে যায়। বাক্সের ডালা তুলে দেখে, হাসানের চৈতন্য ফিরেছে কিনা। কয়েকদিন পরে আস্তে আস্তে সে জ্ঞান ফিরে পেতে থাকে। পারসী খানাপিনা নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেয়। তারপর ডালা বন্ধ করে ওপরে চলে আসে। এইভাবে যাত্রাপথ একদিন শেষ হয়ে আসে। জাহাজ এসে ভিড়ে এক উপকূলে। বাক্সটা নিয়ে বাহুরাম তীরে নামে। জাহাজটা আবার দরিয়ার মাঝখানে ভেসে গিয়ে চলতে থাকে।

বাহুরাম বাক্সের ডালাটা তোলে। হাসানের আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে দেয় মন্ত্রবলে। এবার সে চোখ মেলে তাকায়। উঠে বসে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

সামনে সমুদ্র। পায়ের নিচে পাথরের নুড়ির সমুদ্র-সৈকত। নুড়িগুলো কত বিচিত্র বর্ণের। কোনটা লাল, কোনটা সবুজ, কোনটা সাদা, আবার কেউ বা নীল।

হাসানের বুঝতে কষ্ট হয় না, সে আর নিজ দেশের সমুদ্র-সৈকতে দাঁড়িয়ে নাই। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে দেখে, তার পিছনের দিকে একটা পাহাড়ের টিলার ওপর বসে আছে ঐ পারসী। একটা চোখ বন্ধ করে তাকে ট্যারার মতো দেখছে। এবার সে পরিষ্কার বুঝতে পারে, এই শয়তানটিরই এই কাণ্ড। মায়ের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণ হয়। আগেই সে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু হাসান নিজেই তা উপেক্ষা করেছে।

পারসীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে।

—এ সবের মানে কী? আপনি না আমার নুন খেয়েছেন?

বাহূরাম হো হো করে হেসে ওঠে।

—আমরা তো অগ্নির উপাসক। তোমাদের নুন-ফুনের ধার ধারি না। এযাবৎ আমি ন’শো নিরানব্বইটি মুসলমান ছেলের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছি। আগুন সাক্ষী রেখে বলতে পারি, তোমার মতো এমন সুন্দর তাদের কেউই ছিলো না। তুমিই আমার এক হাজার সংখ্যা পূরণ করবে। ভাবিনি, এতো সহজে তুমি আমার খপ্পরে ধরা দেবে। কিন্তু সূর্যের অপরা মহিমা, এখন তুমি আমার কজায়। এবং দেখ, কী ভাবে কতখানি আমি তোমার সঙ্গে ভালোবাসা করি। প্রথমে তুমি তোমার ধর্মমত ত্যাগ করে আমার ধর্মমত মাথা পেতে নাও।

এই কথা শোনামাত্র হাসান তড়িৎ বেগে ঘুরে দাঁড়ায়, কী? কী বললেন? আবার বলুন তো শুনি? শয়তান!

পারসী বলে, আরে না না, আমি তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম মাত্র। যাক, পরীক্ষায় তুমি পাশ করে গেছ। এবং প্রমাণ করতে পেরেছ ধর্মে তোমার অটুট মতি আছে। তুমি পরমপিতা আল্লাহর একনিষ্ঠ সেবক।

-আমি তোমাকে এই পাহাড়-সন্নিহিত নির্জন সমুদ্র উপকূলে কেন নিয়ে এসেছি, জান? প্রকৃত শিক্ষা এই রকম নির্জন স্থানেই সম্ভব হতে পারে। ঐ যে পাহাড়ের চূড়া দেখছো, ওখানে। আমাদের উঠতে হবে। ঐখানেই আছে প্রকৃত সঞ্জীবনী সুধা-যা এই বিদ্যা আয়ত্ত করার জন্য

একান্ত অপরিহার্য। ঐ পর্বতের শিখরে শয়ন করে এই বিদ্যার সাধনা করতে হবে তোমাকে। তবেই সিদ্ধিলাভ হবে। নচেৎ নয়। যদি তুমি স্বেচ্ছায় ওখানে যাও খুব সুখের কথা। অফুরন্ত আনন্দ আহরণ করতে পারবে। আর যদি যেতে না চাও, তবে আমাকে বলপ্রয়োগ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তুমি যেখানে একদিন নিদ্রিত ছিলে সেখানেই রেখে দেবো আবার। এবার বলল, কী করতে চাও? আমরা ঐ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অনেক গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতে পারবো। সেগুলো আমাদের এই বিদ্যায় একান্তভাবে প্রয়োজন। ওগুলো আনতে পারলে তোমাকে শেখানোর কাজ আরও দ্রুততর হতে পারবে।

হাসান সরাসরি ‘না’ করতে পারলো না। লোকটা মহা শয়তান, বদমাইস ধড়িবাজ। মা-এর উপদেশগুলো আবার মনে ভেসে ওঠে। জলে দু-চোখ ভরে ওঠে।

-কেঁদো না, হাসান। খুব শীগগিরই প্রমাণ পাবে আমার উপদেশ কত মূল্যবান।

হাসান ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, কিন্তু কী করে আমি ওখানে উঠবো? অত উঁচু পাহাড়।

–তোমাকে কোনও কষ্ট করতে হবে না, হাসান। আমি যাদুমন্ত্র দিয়ে তোমাকে ওপরে উঠিয়ে দেব। পাখীর মতো ডানা মেলে উঠে যাবো আমরা।

আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা ছোট্ট তামার পাত্র বের করলো পারসীটা। পাত্রটার গায়ে উল্কীর্ণ করে লেখা কতকগুলো শব্দ—ঠিক যেন দৈববাণীর মতো।

পাত্রটার মুখ মোরগের একটুকরো চামড়া দিয়ে ঢাকা। ঠিক যেন ছোট্ট একটা দামামা। আঙ্গুলের টোকা দিয়ে টঙ্কার তোলে সে। এবং তৎক্ষণাৎ ধূলির ঝড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় চারদিক। এবং মিশমিশে কালো একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সামনে। ঘোড়াটার দুখানা পাখা নড়তে থাকে।

পারসী ঘোড়াটার পিঠে চেপে বসে এবং হাসানকে উঠিয়ে নেবার জন্য হাত বাড়ায়। পারসীর হাতে ভর করে হাসান ওপরে উঠে বসতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে পক্ষীরাজ উড়ে চলে আকাশে। পলকের মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে ওদের নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

শয়তানের দুষ্ট চাহনি পারসীর চোখে। গগনবিদারী শব্দ করে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, এবার—হাসান, তুমি আমার পুরো কজায়। তোমাকে রক্ষা করে এমন প্রাণী কেউ জন্মায়নি দুনিয়ায়। এবার আমার কামনা-বাসনা চরিতার্থ কর। এখন তো মানবে, একমাত্র অগ্নি ছাড়া কোনও শক্তি নাই।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো তিরাশিতম রজনী : আবার সে শুরু করে :

হাসান চিকার করে ওঠে, আল্লা হো আকবর! আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নাই। মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর। ওরে শয়তান বেল্লিক, তুই আমার শক্তি জানিস না, আমি এক সাচ্চা মুসলমান, তাঁর কৃপাতেই তোকে আমি খতম করে ফেলবো।

এই বলে প্রবল বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ে যাদুকরের হাত থেকে সেই দামামাটা ছিনিয়ে নিয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে পর্বতশিখরের এক ধারে ঠেলে নিয়ে যায়। এবং প্রাণপণ শক্তিতে এক লাথি বসিয়ে দেয় ওর নাভিস্থলে। টাল সামলাতে না পেরে পারসীর দেহটা ছিটকে চলে যায় শূন্যে। এরপর ঘুরপাক খেতে খেতে শয়তানের দেহটা গিয়ে আছড়ে পড়ে নিচে সমুদ্র-সৈকতে। এবং সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়।

এইভাবে ঐ বিকৃত-কাম জালিয়াত যাদুকরের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।

হাসান উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।

অনেকক্ষণ সেই পাহাড় চূড়ায় বসে থাকার পর নিজেকে সহজ স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। হাসানের হাতে ছিলো সেই ছোট্ট দামামাটা। মোরগের চামড়া দিয়ে ছাওয়া। সে। জানে, বস্তুটা যাদু-মন্ত্রপুত। কিন্তু কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিছুই বুঝতে পারে না। হাসান সে চেষ্টাও করে না। কী করতে কী হয়ে যাবে কে জানে। এই ভেবে দামামাটাকে সে কোমরে ঝুলিয়ে নেয়।

এবার নিচে নামবার উপায় দেখতে হয়। হাসান নিচে তাকায়, মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে ওর। পাহাড়টা এতো উঁচু যে নিচে বড় বড় গাছ-পালাগুলো খুবই ছোট চারার মতো দেখাচ্ছে। মাথার ওপরে হাত বাড়ালেই পেঁজাতুলোর মেঘ।

এই রকম অত্যুচ্চ পাহাড়ের শিখর থেকে অবরোহণ অসম্ভব কাজ। হাসান দেখতে পায় পাহাড়ের একপ্রান্তে অনেক দূরে একটি আগুনের শিখা। জনমানবের চিহ্ন নাই, এখানে আগুন কে জ্বালায়? হাসান ভাবে, তবে কী কেউ আছে ওখানে? কোনও মানুষ?

অতি সন্তর্পণে দেখে-শুনে পা ফেলে হাসান। বিপদ-সঙ্কুল গিরি পর্বত। পথ নাই। তবু নিদারুণ কৌতূহলে ধীরে ধীরে ঐ অগ্নি-শিখাকে লক্ষ্য করে সামনে এগিয়ে চলতে থাকে।

বেশ কিছুটা এগোবার পর হাসান বেশ বুঝতে পারে, আসলে ওটা কোনও আগুনের শিখা নয়, বিশাল স্বর্ণ-প্রাসাদের শিখরে একটি বিরাট গোলাকৃতি গম্বুজ। সূর্যের কিরণে ঐ রকম লেলিহান অগ্নিশিখা বলে ভ্রম হচ্ছে। চার পাশের চারটি সোনার থাম ওকে রক্ষা করে আছে।

ঐ গম্বুজটা লক্ষ্য করে সে চলতে থাকে। কাছে মনে হলেও আসলে অনেক অনেক দূরে। হাসান ভাবতে ভাবতে হেঁটে চলে, হয়তো ঐ প্রাসাদে জিন দৈত্যরা বসবাস করে। যাই হোক, সুলতান বাদশাহ অথবা আফ্রিদি জিন যে-ই থাক সেখানে, আমি যাবোই। হাসান মনে মনে সঙ্কল্প করে। খিদেয় পেট চো-চেঁ করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, খানাপিনার তো একটা সন্ধান দেখতে হবে। আমি প্রাসাদের দ্বাররক্ষীকে বলবো, আমাকে একটুকরো রুটি আর একটু পানি দাও, আমি খাবো। বড় খিদে তেষ্টা পেয়েছে। দেখি, সে কী বলে? যদি ওর প্রাণে দয়ামায়া কিছু থাকে। যদি সে রক্তমাংসের মানুষ হয়, হয়তো দয়া-ধম্মে করে প্রাসাদের এক কোণে একটু মাথা গোঁজার মতো ঠাইও দিয়ে দিতে পারে।

হাসান বুকে সাহস সঞ্চয় করে প্রাসাদের সামনে এগোতে থাকে। তবে যা হয় হবে, নসীবে যা লেখা আছে তার বাইরে কিছুই হবে না। সুতরাং ও নিয়ে বৃথা মাথা ঘামিয়ে, ভীত শঙ্কিত হয়ে কী ফায়দা? বরং বেপরোয়া হওয়াই ভালো। তাতে মনের সাহস বাড়ে, দেহে অনেক বেশি শক্তি সঞ্চার হয়।

হাসান প্রাসাদের সিংহদরজায় এসে দাঁড়ায়। একখানা প্রকাণ্ড পান্না পাথরের চাই কেটে বানানো হয়েছে এই সুন্দর সিংহদরজাটি।

ফটকে কোনও প্রহরী নাই। হাসান প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে।

কয়েক পা মাত্র এগিয়েছে, এমন সময় নজরে পড়লো, ফোটা ফুলের মতো সুন্দর দুটি কুমারী কন্যা একটি শ্বেত পাথরের মঞ্চে বসে খুব মনোযোগ সহকারে দাবা খেলছে। এমনই নিবিষ্ট মনে খেলায় মগ্ন ছিলো যে, হাসানের প্রবেশ, এবং উপস্থিতি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না ওরা। কিন্তু একটু পরে ছোটটি মুখ তুলে তাকায়। হঠাৎ বাইরের আগন্তুক দেখে অবাক হয়।

বড় মেয়েটিকে সজাগ করে দিয়ে বলে, ঐ দ্যাখ, কী সুন্দর একটি ছেলে! মনে হচ্ছে, সেই বদমাইস বাহূরামের শিকার। কিন্তু কী করে সে ওই শয়তানের হাত থেকে পালাতে পেরেছে, বুঝতে পারছি না।

অন্য মেয়েটি ফিরে তাকায়। হাসানের নিটোল স্বাস্থ্য, নিখুঁত রূপলাবণ্য অপলক মুগ্ধ-নয়নে দেখতে থাকে সে। প্রতি বছরই তো বাহুরাম একটি করে মুসলমানের ছেলেকে চুরি করে নিয়ে আসে এই পাহাড়ে। তার বিকৃত কামনা চরিতার্থ করে। কিন্তু তারা কেউই এর মত এতো সুন্দর সুপুরুষ ছিলো না।

হাসান ছোট মেয়েটির পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। আকুল হয়ে বলে তুমি যা ভেবেছ, আমি তাই, সুন্দরী। শয়তান বাহুরাম আমাকে এনেছিলো এই পাহাড়ে তার বিকৃত কাম-ক্ষুধা মেটাতে। কিন্তু আমার সাহস এবং বিক্রমের কাছে সে হেরে গেছে। তাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি নিচে একেবারে সমুদ্রের উপকূলে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই সে অক্কা পেয়েছে।

ছোট মেয়েটি বিস্ময়ে চমকে ওঠে, বলো কী? কী সাংঘাতিক কাজ করতে পেরেছ? কত শত ফুলের মতো ছেলেকে ধরে নিয়ে এসে লোকটা শেষ করে দিয়েছে। তুমি তো বাহাদুর পুরুষ, ওই রকম একটা ধূর্ত ধড়িবাজ শয়তানকে খতম করেছ?

মেয়েটি ওর দিদির দিকে তাকিয়ে বলে, দিদি, আজ থেকে একে আমি ভাই বলে মেনে নিলাম।

হাত ধরে হাসানকে সে তুলে ধরে, চলো, আমাদের সঙ্গে থাকবে তুমি। আমরা যা খাব, তাই তুমি খাবে।

হাসানকে সে হামামে নিয়ে যায়। ভালো করে স্নান করায়। বাহারী সাজ-পোশাক পরতে দেয়। তারপর খাবার ঘরে নিয়ে এসে বসায়। তিনজনে মিলে খানাপিনা করে। ছোট বোন জিজ্ঞেস করে, তোমার কী নাম, ভাই?

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চুরাশিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

–আমার নাম হাসান। আল্লাহর ইচ্ছায় আজ তোমাদের এখানে এসে পৌঁছেছি।

এরপর হাসান তার অভিজ্ঞতার কাহিনী বর্ণনা করে। কী করে বাহুরাম তাকে ধোঁকা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিলো, সেই সব বৃত্তান্ত আগাগোড়া খুলে বললো ওদের।

মেয়ে দুটি ক্রোধে আরক্তবর্ণ হয়ে বলে, ঐ কুত্তার বাচ্চাটাকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুমি খুব ভালো কাজ করেছ, ভাই। তা না হলে দোজকের পোকাটা আরও কত শত নিরীহ ছেলের সর্বনাশ করতে কে জানে!

বড় বোন ছোটকে উদ্দেশ্য করে বলে, গুলাবী, তোর ভাইটিকে আমাদের জীবনের কাহিনীটা বল, তাহলে সে বুঝতে পারবে আমরা কে, কেন এখানে আছি।

তখন গুলাবী বলতে শুরু করে :

শোন ভাইসাব, আমরা সম্রাট-নন্দিনী। আমার-নাম গুলাবী, আর দিদির নাম জামিলা। আরও পাঁচটি বোন আছে আমাদের। তারা অবশ্য—আমাদের চেয়েও সুন্দরী। এখন ওরা শিকারে গেছে, তবে তাড়াতাড়িই ফিরবে। আমাদের যে সকলের বড় তার নাম শুকতারা, তার ছোটর নাম সন্ধ্যামণি, তার ছোট-চুনী, পরেরটার নাম পান্না আর সব ছোট-পাপিয়া।

আমরা সকলেই এক পিতার সন্তান। কিন্তু আমাদের মা ভিন্ন ভিন্ন। আমি আর জামিলা সহোদরা। আমাদের বাবা জিনদের সম্রাট। তিনি ভীষণ উদ্ধত, অহঙ্কারী, অত্যাচারী। সেই কারণে কেউই আমাদের বিয়ে করতে সাহস করেনি, বা রাজী হয়নি। বাবার ধারণা তাঁর পরমাসুন্দরী কন্যাদের পাণিগ্রহণ করার যোগ্যতা সারা দুনিয়ায় কারো নাই। তার এক পণ,, কারও তিনি বিয়ে দেবেন না। এই কারণে তার মন্ত্রীকে বলেছিলেন, দুনিয়ার মধ্যে এমন এক গুপ্তস্থানের সন্ধান করো, যেখানে আমার মেয়েদের নিরাপদে রাখা যাবে। এবং কোনও জিন আফ্রিদি কখনও সন্ধান করতে পারবে না। আমাদের একমাত্র বিশ্বাস, ঈশ্বর নারী সৃষ্টি করেছেন কেবলমাত্র পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম করার জন্য। পয়গম্বরের পবিত্র বাণী—কোনও নারীই কুমারীত্ব নিয়ে বাঁচে না। সুতরাং সম্রাট যদি তার কন্যাদের চিরকুমারী করেই রাখেন, তা কিন্তু অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হবে। এবং কন্যাদের জীবন গভীর দুঃখের মধ্যে কাটবে। কিন্তু আমাদের বাবার সেই এক গোঁ। তিনি বললেন, বিবাহিত দেখার আগে ওদের আমি মরা-মুখ দেখবো। এই মুহূর্তে এখনি যদি তুমি ওদের লুকিয়ে রাখার মতো কোনও গুপ্ত-গৃহের ব্যবস্থা

করতে পারো, তোমার গর্দান নেব আমি। উজির তখন নিরুপায় হয়ে বললো, সম্রাট যদি এমনই ধনুভাঙ্গা পণ করেন তবে আমি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করছি। মেঘমালা পর্বতে এক স্বর্ণ-প্রাসাদ আছে। জনমানবের অগম্য সেই স্থান। দুর্গের মতো সুরক্ষিত। বহু প্রাচীন কালে সম্রাট সুলেমানের বিদ্রোহী সেনাপতিরা এই দুর্গম পর্বতশিখরে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য এক মনোহর সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলো। সেই থেকে সে প্রাসাদ জনমানবশূন্য পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। বড় মনোরম পরিবেশে তৈরি করা হয়েছিলো প্রাসাদটি। চমৎকার জল-হাওয়া, একেবারে চির-বসন্ত। যে দিকে যতদূর দৃষ্টি যায়, লতাগুল্ম গাছপালার নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী। হাজারো রকম ফুল ফলের সে কী সীমাহীন সমারোহ। কোথাও নিরন্তর নিঝর ঝরনা নিরবধিকাল ধরে ঝরে চলেছে। কোথাও পাহাড়ের ছোট নদী এঁকে বেঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে দূর-দূরান্তরের কোনও এক দুর্গম গুহার অন্ধকারে। সে-নদী, জল, সে-ঝরনার জল বরফের মত শীতল, মধুর মতো মধুর।

বাবা আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না। তার দুই বিশ্বস্ত অনুচর জিন ও মরিদকে দিয়ে এই প্রাসাদে পাঠিয়ে দিলেন আমাদের। আমাদের পৌঁছে দিয়েই ওরা আবার ফিরে গেলো বাবার সাম্রাজ্যে।

সেই থেকে আমরা এখানে আছি। উজিরের প্রতিটি কথা বর্ণে বর্ণে সত্য। আমাদের এই প্রাসাদ-পরিবেশ বড়ই সুন্দর। চারদিকে ফুলে ফলে ভরা। ঝরনা আর ছোট নদীর ছড়াছড়ি। এখানকার আকাশে-বাতাসে ফুলের সুবাস। পাখিদের গান শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। আবার ওদের কল-কাকলীতে জেগে উঠি। এখানে মানুষের কোলাহল, বিদ্বেষ বিভেদের হলাহল নাই। আছে ফুলে ফুলে মধু, পাখির কুজন, আর ঝরনার কলতান। এখানে শীতের কাঁপুনি নাই। এখানে গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে হয় না। এখানে চিরকাল বসন্ত জাগ্রত, সামনেই সরোবর। সারাদিন হাঁসেরা খেলা করে। এই পাহাড়ের নাম মেঘমালা। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। বিশ্ব সংসার আঁধার হয়ে যায়। তখন, ময়ূরের পেখম মেলে, সে দৃশ্য তুমি দুনিয়ার আর কোথায় দেখতে পাবে? আর ঐ যে দেখছো, কত নাম না জানা হরেক রঙের পাখি—আমরা ভাবি, লাল নীল গোলাপী, প্রবাল, মুক্তো, চুনী পান্নার মতো এতো হাজারো রকম সুন্দর সুন্দর রঙ ওরা পেলো কোথায়। দিনের পর দিন বছরের পর বছর দেখেও পুরনো হয় না ওরা—মনে হয় একেবারে আনকোরা নতুন।

আমরা বেশ আছি। সুখে আছি এখানে। ঈশ্বরের কাছে একটাই আমাদের প্রার্থনা ছিলো, তাও আজ পূরণ করে দিলেন তিনি। আমরা চেয়েছিলাম অন্ততঃ একজন পুরুষ সঙ্গী। তা তিনি আমাদের আশার অতিরিক্ত দিয়েছেন। তোমার মতো অলোক-সামান্য সুপুরুষ—সঙ্গী হিসাবে এতোটা আশা করি না আমরা।

কিছুক্ষণ পর অন্য পাঁচ বোনেরা এসে গেলো। গুলাবী এক এক করে সকলের সঙ্গে – আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলো, আজ থেকে হাসান আমাদের ভাইজান, বুঝলে?

সকলে হাততালি দিয়ে নেচে ওঠে, আমরা সাত বোন আর, তুমি আমাদের মাথার মণি একটিমাত্র ভাই।

হাসানের আর কোনও দুঃখ থাকে না। এক অবর্ণনীয় আনন্দে ভরে ওঠে মন। আর কী আশ্চর্য, এতোগুলো ভরা-যৌবনের কন্যা তাকে ঘিরে আছে, অথচ মনের নিভৃত কোণেও এতোটুকু যৌবন-চঞ্চলতা অনুভব করে না সে।

ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পঁচাশিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

হেসে খেলে নেচে গেয়ে বেড়িয়ে শিকার করে বড় সুন্দরভাবে দিনগুলো কেটে যেতে থাকে। হাসান এক নতুন জীবনের, নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছে। জীবনের সুধাপাত্র কানায় কানায় ভরপুর হয়ে উঠেছে। কোনও অভাব-অভিযোগ দুঃখ সন্তাপের লেশ মাত্র নাই আর। এখানে এসে যে আনন্দ, যে সুখ, সে শান্তি সে পেয়েছে—কামনা-বাসনা-কলুষিত মাটির পৃথিবীতে তা কল্পনাও করা যায় না।

হাসান তার দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা বলে। মেয়েরা মুগ্ধ বিস্ময়ে শোনে। সেই রকম মেয়েরাও তাদের নিজের দেশের, নিজের জাতের জিন আফ্রিদিদের বিচিত্র কাহিনী শোনায়। হাসান শুনতে শুনতে অবাক হয়, মজা পায়। আবার ভয়ে শিউরে ওঠে কখনও।

সব মেয়েরাই তাকে খুব ভালোবাসে। আদর যত্ন করে। বিশেষতঃ ছোটটি গুলাবী হাসানকে আরও বেশি আপন করে নিতে চায়।

একদিন ওরা দল বেঁধে বেড়াতে বেরিয়েছিলো। এ-বনে ও-বনে অনেক ঘুরলো, শিকার করলো। তারপর এক সরোবরের ধারে পা ছড়িয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশাপাশি বসে নানা গল্পে মশগুল হয়ে উঠলো।

হঠাৎ একসময় ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র গর্জনের মতো তাণ্ডব নিনাদ শুনতে পেয়ে সকলে সামনের দিকে ভয়ার্থ চোখে তাকায়! ধূলি-ধূম্রজালে ঢেকে আসতে থাকে সারা আকাশ। নিমেষের মধ্যে কালো অন্ধকার নেমে আসে। গুলাবী ভয়ে আর্তনাদ করে হাসান-এর হাত ধরে টেনে তোলে, শিগ্নির ওঠ, আর এক পলক এখানে নয়।

প্রায় একরকম জোর করেই হাসানকে টেনে হিচড়ে সে নিয়ে আসে প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের ফুল-বাগিচায়। একটা ঝাউ-এর ঝোপের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে বলে, চুপ! কোনও সাড়া শব্দ করবে না। নড়বে না চড়বে না একটুও। এখুনি সম্রাট জিনিস্থানের বিশাল জিন সৈন্যবাহিনী এখানে এসে নামবে। এই ধূলিধূম্রজাল তারই ইঙ্গিত। প্রতি বছর আমাদের দেশে বাবার প্রাসাদে এক বিরাট উৎসব হয়। সে উৎসবে দেশ-বিদেশের অনেক জিন আফ্রিদি রাজারা আমন্ত্রিত হয়ে আসে। বাবা বছরে ঐ একটিবার আমাদের নিয়ে যান সেখানে। কিন্তু পাছে আমরা কোনও পুরুষের দ্বারা আক্রান্ত হই, এই আশঙ্কায় তিনি তার বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে যান। উৎসব শেষ হলে আবার আমরা ফিরে আসবো। কিন্তু ভাইজান, এই ক’টা দিন তোমাকে একা একা কাটাতে হবে। এইভাবে এখানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তোমাকে ফেলে যেতে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে আমাদের। কিন্তু কী করবো বলো। সম্রাটের আদেশনা গিয়ে উপায় নাই।

বিদায়বেলায় মেয়েরা চোখের জল ফেলতে থাকে। ছোট বোন,একটা চাবির গোছা হাসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, সব ঘরের তালার চাবি আছে এতে। ইচ্ছে হলে যে-কোনও ঘর খুলতে পার। কিন্তু সাবধান, ঐ যে দেখছে পাশের ঐ ঘরটা—ভুলেও কখনও ওদিকে যেও না। ও-ঘর খোলার চেষ্টা করো না, ভাইজান। তোমাকে ভালো করে বোঝাবার, জন্য ও-ঘরের এই চাবিটায় দেখ, একটা মার্কা করে রেখেছি। এই চাবিতে খোলা যাবে ও-ঘরের তালা। কিন্তু ভাইটি আমার, ওদিকে পা মাড়িও না।

–অন্য আর সব ঘরে যেও। খানাপিনা অঢেল আছে। ইচ্ছে মত খেও। ক’টা দিন একটু কষ্ট করে কাটাও। আমরা শিগ্নিরই ফিরে আসবো, কেমন?

হাসান হাত পেতে চাবির গোছাটা নেয়। ঘাড় নেড়ে বলে, আমি তোমাদের ফেরার পথ চেয়েই বসে রইলাম, বোন। আমার কোনও কষ্ট হবে না। আর হলেও, আবার তোমাদের ফিরে পাবো সেই আশাতেই সব সইতে পারবো।

নীরব নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিঃসঙ্গ জীবন কাটতে থাকে হাসানের। দুঃখ বেদনায় টনটন করে ওঠে হৃদয়। কবে ওরা ফিরবে, আবার কবে হাসি কল-গানে মুখর হয়ে উঠবে তার জীবন, সেই ভেবে ভেবে সময় আর তার কাটতে চায় না।

সারাটা দিন সে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় পাখির গান শোনে, ফুলের শোভা দেখে, ঝরনার সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু রাত আর ফুরায় না। এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়ায়। কত রকম বাহারী-বাহারী খানাপিনা। হাসানের মুখে রোচে না।

চোখে ঘুম আসে না। একা একা পালঙ্ক-শয্যায় শুয়ে ছটফট করে হাসান। নাঃ, আর ভালো লাগে না। মনের মধ্যে একটা নিষিদ্ধ বাসনা কুরে কুরে খায়। হাসান ভাবে, ঐ ঘরে ঢুকতে বারণ করে গেছে কেন গুলাবী? কী আছে ও-ঘরে? বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। পায়ে পায়ে সেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। চাবিটা নিচে নাড়া-চাড়া করে। খুব ইচ্ছে হয়, খুলতে। কিন্তু গুলাবীর সেই কাতর অনুনয় মনে পড়ে। ওর কাজল-কালো চোখের মিনতি সে ভুলবে কী করে? নাঃ, না না, সে খুলবে না। কাজ নাই খুলে। বারণ যখন করে গেছে, কী হবে তার কথা অমান্য করে, দ্রুত পায়ে আবার ফিরে আসে শোবার গরে। সটান শুয়ে পড়ে শয্যায়। মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে ওই অহেতুক কৌতূহল।

কিন্তু যা করতে বারণ করা হয়, যা না দেখতে বলা হয় এবং যা শুনতে দেওয়া হয় না—তার প্রতি মানুষের সহজাত অদম্য কৌতূহল অনেক বেশি। হাসান আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। কী আছে ঐ ঘরে—তাকে দেখতেই হবে। কেন বারণ করে গেছে গুলাবী? হাসানের কোনও বিপদ হবে বলে? তা হোক, মরার বাড়া তো বিপদ নাই। যদি জানও কবুল করতে হয় তাও সে করবে। কিন্তু দেখবে, ঐ ঘরে কী আছে? কেন ঢুকতে নিষেধ করে গেছে সে?

এবার সে দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে ঐ দরজার দিকে এগোয়। চাবি দিয়ে খুলে ফেলে কুলুপ।

ভিতরে ঢুকে কিছুই দেখতে পায় না প্রথমে। সব যেন কেমন কালো অন্ধকারে ঢাকা। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে সব। ঘরে আসবাব বলতে কিছু নাই। না আছে একখানা কুর্শি কেদারা, না আছে খাট পালঙ্ক। গালিচা পর্দা কিছুই চোখে পড়ে না। অবশেষে এক প্রান্তে দেওয়ালে দাঁড় করানো একখানা কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়িটা যেখানে ছাদে গিয়ে ঠেকেছে সেই জায়গাটায় মানুষ গলার মতো একটা ফোকর। হাসান বাতিটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু, নিচে থেকে কিছু দেখা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে সে ওপরে ওঠে। ফোকরটা দিয়ে শরীরটাকে গলিয়ে দেয়।

মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ। নিচে সমতল ভূমি, ফুটফুটে চাদের আলোয় ভরে গেছে দশ-দিগন্ত। সামনে বিশাল ফুলের বাগিচা। কত নাম না জানা বাহারী ফুলচাদের আলোয় হাসছে। যতদূর চোখ যায় শুধু প্রকৃতির অপার সুন্দর সাজে বনরাজি নীলা।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ছিয়াশিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

অদূরে একটা সরোবর। কানায় কানায় ভর্তি স্বচ্ছ নীল নিষ্পন্দ জলরাশি। যেন মনে হয়, ঘুমে গলে গেছে। পুকুরের পাশে নানা জাতের বিরাট বিরাট গাছপালা। মৃদু-মন্দ সমীরণে পাতার মর্মর ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। বাদাম গাছের মাথায় চাদের আলো বরফের আস্তরণ ফেলেছে। অদূরে কোনও তরুশাখায় রাতজাগা পাখি একই আওয়াজের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। পুকুরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট একখানা প্রাসাদ। প্রাসাদের ভেতর থেকে পুকুরের ঘাট পর্যন্ত নেমে এসেছে শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। ঘাটের দু’পাশে সারি সারি স্ফটিকের থাম। সিঁড়ির ধাপগুলো প্রবাল আর পান্না দিয়ে তৈরি। এবং ধারগুলো সোনা দিয়ে বাঁধানো। ওপরে পাতা একখানা চন্দন কাঠের সিংহাসন। সিংহাসনের মাথায় সোনার রাজছত্র। ঘাটের প্রবেশ দ্বারের ওপরে এক আঙ্গুর কুঞ্জ। তার লতাপাতা সবই সোনার। আঙ্গুরগুলো মুক্তোর। সারা চত্বরটা চাদী আর সোনার জরিতে বোনা এক পর্দা দিয়ে ঘেরা। এমন সুন্দর বস্তু ধরায় কেউ কল্পনা করতেও পারে না।

হাসান হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। এক অজানা আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু করে ওঠে।

এক ঝাক পাখি উড়তে উড়তে পুকুরের পাড়ে এসে বসে। বিরাট বিরাট সব দেখতে। সংখ্যায় মোট দশটি। সাদা ডানাগুলো ঘাসের ওপর ঘসতে ঘসতে ঘাটের কাছে আসে। ওদের মধ্যে যে বয়সে প্রবীণ সে ঐ সিংহাসনে উঠে বসে।

পাখিগুলো প্রবল বেগে পাখা ঝাপটাতে থাকে। এবং একটু পরে পাখার খোলসের ভেতর থেকে দশটি পরমাসুন্দরী বিবসনা তরুণী হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে। মেয়েগুলো ঝাপিয়ে পড়ে জলে। নানা ছন্দে, নানা ভঙ্গী করে সাঁতার কাটতে থাকে।

এক সময় সাঁতার ও স্নান শেষ করে ঘাটে উঠে আসে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি সিংহাসনে গিয়ে বসে। দীর্ঘায়িত কেশদাম ছাড়া তার দেহে আবরণ বলতে অন্য কোনও বসন ছিলো না।

হাসান বিচলিত বোধ করে। দেহে রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। এখন সে বুঝতে পারছে, গুলাবী কেন তাকে এই দরজা খুলতে নিষেধ করেছিলো।

মেয়েটি আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। ওর দেহের কোথাও কোন খুঁত নাই। নিপুণ শিল্পীর হাতে গড়া এক নিভঁজ নিখাদ শিল্পকর্ম।

সে সম্পূর্ণ নিরাবরণ। তার গভীর কাজল-কালো চোখেও – কীসের যাদু! হাসান আর স্থির থাকতে পারে না। ওর অধর কপোল, পীনোন্নত স্তন, ক্ষীণ কটি, ভারি নিতম্ব, পাথর কুঁদা জঙ্ঘা, উরু-সব মিলে সে-কি এক অপরূপ ছন্দ। সম্রাজ্ঞীর মতো ভঙ্গী করে সে পা ছড়িয়ে কনুই-এ ভর দিয়ে অর্ধশায়িত হয়ে থাকে। ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সাতাশিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

সম্রাজ্ঞীর সঙ্গী-সাথীরা এক গোছা সোনার জরি ঝালর এনে ওর কাঁধের ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেহের নিম্নাঙ্গ কিছুটা আচ্ছাদিত করে দেয়। মাথায় পরিয়ে দেয় নানা রত্ন খচিত একটা স্বর্ণমুকুট। কোমরে জড়িয়ে দেয় একখানা সুক্ষ্ম কাজ করা সুবর্ণ পেটিকা। এইবার সে আরও মোহিনী রূপ ধারণ করে।

হাসান এতক্ষণ একটা গাছের গুড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে। এগিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে।

এমন সময় শুনতে পায় হাসান, মেয়েদের মধ্যে একজন বলে, রাজকুমারী, ভোর হয়ে আসছে। এবার আমাদের যেতে হবে। দূর দেশের পথ, এই সময় না বেরুলে সকাল হয়ে যাবে!

আবার ওরা পালকের পাখাগুলো পরে নিয়ে দূর নীল আকাশে উঠে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওরা দৃষ্টির ওপারে চলে যাওয়ার পরও হাসান ঊধ্বাকাশের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। যদি কোনও ভাবে আবার নজরে আসে। কিন্তু নীল আকাশ আর পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। হাসানের হৃদয় বিদারিত হতে থাকে। বহু সুন্দরী মেয়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য সে পেয়েছে। কিন্তু কেউ তাকে এইভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। বুকের মধ্যে কী এক দুঃসহ অনুভূতি। কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। সাতটি পরমাসুন্দরী কন্যা তার হৃদয়ের যে বস্তুতে সাড়া দিতে পারে নি, এই মেয়েটি অনায়াসে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তা চুরি করে পালালো কী উপায়ে?

নিজের ঘরে ফিরে আসে হাসান। সারাদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে ঐ রাজকন্যার চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে সে।

আবার রাত্রি নামে। সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে আবার সে ওপরে উঠে আসে। এক ঠায় দাঁড়িয়ে পুকুরের ঘাটের দিকে তাকিয়ে রাতের প্রহর গুণতে থাকে।

কিন্তু সে রাতে তারা আর আসে না। আসে না তার পরের রাতেও। তারপর এক এক করে অনেক রাত আসে যায়। কিন্তু তারা আর আসে না। হাসান আহার নিদ্রা ত্যাগ করে। সারা দিনে রাতে তার একই ধ্যান জ্ঞান। দারুণ অসহ্য প্রেমানলে জ্বলতে থাকে সে। এর চেয়ে মৃত্যুও যে অনেক ভালো ছিলো।

এইভাবে হাসানের যখন মৃতকল্প দশা, তখন একদিন সেই সপ্ত কন্যারা ফিরে এলো। বাইরের সাজপোশাক না খুলেই ছোট মেয়ে গুলাবী ছুটে এলো হাসানের ঘরে। দেখতে পেলো সে, হাসান বিবর্ণ হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে প্রায়। চোখ দুটো আধ বোজা। অঝোর ভাবে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

গুলাবী হাসানকে দু’হাতে টেনে তোলার চেষ্টা করে, ভাইজান, কী হয়েছে? তোমার জন্যে ভাবনার আমার অন্ত ছিলো না। না জানি, কেমন আছ তুমি? শেষে, যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই হলো? যাই হোক, কী হয়েছে খুলে বলো দেখি। আমি সব ঠিক করে দেব, বলো ভাইটি।

হাসান শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কোনও কথা বলতে পারে না। গুলাবীও কাঁদতে থাকে। বার বার বলে, আমাকে তোমার দুঃখের কারণটা বলল, ভাই। দেখ, আমি তার কিনারা কিছু করে দিতে পারি কি না।

অনেকক্ষণ পরে হাসান বলতে পারে, আমি সাধ করে মরেছি। দোষ আমার। তুমি কী করে বাঁচাবে, বোন? যাক যে ভুল আমি করেছি, তার চারা নাই। এবার আমাকে নীরবে মরতে দাও।

গুলাবী এবার আর্তনাদ করে ওঠে, এসব কী অলুক্ষণে কথা মুখে আনছ ভাই। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার সব দুঃখ ঘুচিয়ে দেব। তা যদি না পারি, তোমার আগে তোমার এই বোনটিই দেহ রাখবে—এই বলে দিলাম।

হাসান বলে, শোনো বোন, আজ দশটা দিন আমি মুখে একটা দানা তুলতে পারিনি। রাতে ঘুমোইনি।

এরপর সমস্ত ঘটনা গুলাবীকে বলে।

ভোর হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো অষ্টাশিতম রজনী ও আবার সে বলতে থাকে।

রাগ করবে কী—হাসানের বিরহ-বেদনার কাহিনী শুনে অনুকম্পা জাগে গুলাবীর। হাসানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, নিজেকে শান্ত করো ভাইজান। চোখের পানি মুছে ফেলো। আমি ভরসা দিচ্ছি, তোমার কল্পলোকের মানসীকে আমি এনে দেব তোমার হাতে। জানি না সে মেয়ে কে? কী তার রুচি প্রকৃতি পরিচয়! তবু তুমি যখন চাইছ, আমি আমার জীবন তুচ্ছ করেও এ-কাজ করবো। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। কিন্তু একটা কথা—এ ব্যাপারটা আমার অন্য সব বোনদের কাছে গোপন রাখতে হবে। ওরা যদি শোনে, বারণ করা সত্ত্বেও তুমি ঐ দরজা খুলে বাইরে গিয়েছিলে, তা হলে বিশ্রী ব্যাপার হবে। তার চেয়ে কোনও কথা বলার দরকার নাই। ওরা জানতে পারলে আমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে। ওরা যদি তোমাকে ঐ নিষিদ্ধ দরজার কথা জিজ্ঞেস করে বলবে, ওর ধারে কাছে যাওনি। যদি জানতে চায়, তবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে কেন?’ বলবে, তোমরা চলে যাওয়ার পর থেকে এই দশা হয়েছে।

হাসান বলে, বাঃ চমৎকার। ঠিক আছে, আমি ঐ রকমই বলবো ওদের।

হাসান অনেকটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এর প্রধান কারণ, গুলাবী ভরসা দিয়েছে, তার মানসীকে পাইয়ে দেবে। এবং অন্য কারণ, নিষেধ সত্ত্বেও ওই দরজা খোলায় সে রাগ করেনি। হাসান বলে, আমাকে কিছু খেতে দাও, বোন।

গুলাবী ওর দিদির কাছে যায়। বলে, হাসান আজ দশ দিন অসুস্থ ছিলো। খানাপিনা কিছুই করেনি। এখন সে অনেকটা সুস্থ বোধ করছে। খিদেও পেয়েছে। চলো, ওকে কিছু খাওয়াবার ব্যবস্থা করি, বেচারা আমাদের অদর্শনে কাতর হয়ে পড়েছিলো। স্বদেশ স্বজন ছেড়ে এখানে একা একা পড়ে থেকে সে কাহিল হয়ে পড়েছে। চলো, যাই, আমরা ওকে একটু সঙ্গ দিয়ে আবার হাসি আনন্দে মাতিয়ে রাখি।

মেয়েরা নানারকম খানাপিনা এনে টেবিলে সাজায়। হাসানকে সঙ্গে নিয়ে হৈ হল্লা করে খায়। কেউ গায়, কেউ নাচে-আবার জমজমাট হয়ে ওঠে স্বর্ণপ্রাসাদ। অল্প সময়ের মধ্যে হাসান আবার হাসিখুশি প্রাণবন্ত হয়।

দু একদিন পরে মেয়েরা শিকারে যায়। যায় না শুধু গুলাবী। সে বলে, হাসানের কাছে একজন থাকা দরকার। তোমরা যাও, আমি ওকে দেখবো।

গুলাবী হাসানকে সঙ্গে করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে। পুকুর পাড়ের ঘাটের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে হাসানকে প্রশ্ন করে,ত এখন বলো তো ভাইজান, তোমার মানসী ঘাটের কোন্ জায়গায় বসেছিলো সে রাতে?

হাসান বলে, ঐ যে ঐ চন্দনকাঠের সিংহাসন দেখছো—ঐ সিংহাসনে সে বসেছিলো-সাম্রাজ্ঞীর মতো ভঙ্গী করে।

গুলাবী শিউরে ওঠে, বলো কী! ও যে এক জিন-সম্রাটের কন্যা! সারা পৃথিবীর চার ভাগের একভাগ তার দখলে। আমার বাবাও অনেক বড় সম্রাট। কিন্তু সে তো আরও অনেক বড়। এক সময় আমার বাবা তার প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তুমি যে চাঁদে হাত বাড়িয়েছ, ভাই?

গুলাবী বলতে থাকে? ওর বাবার এক দল নারী সাগরেদ আছে। ওরা প্রত্যেকেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা—সেনাপতি। ওদের এক-একজনের অধীনে পাঁচ হাজার করে নারী-সেনার এক একটা বিশাল বাহিনী আছে।

জিন সম্রাটের সাতটি কন্যা। এইটিই সবচেয়ে ছোট। এবং পরমাসুন্দরী। ওর নাম রোশনি। প্রতিপক্ষের প্রথমায় ওর বাবার দরবারের উজির আমিরদের কন্যাদের সহচরী করে সে এ। সরোবরে সাঁতার কাটতে আসে। ঐ যে পালকের ডানাগুলো ওরা খুলে যখন জলে ঝাঁপ দেবে সেই সময় টুক করে রোশনির ডানা দু’খানার খোলসটা সরিয়ে ফেলতে হবে তোমাকে। এই ডানার খোলস যাদুমন্ত্রপুতঃ। পরে নিলে তবেই আকাশে ওড়া যায়, নচেৎ নয়।

চুরি করে এই গাছের আড়ালে তুমি ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তারপর জলকেলী শেষ করে সে যখন ওপরে উঠে দেখবে ডানা নাই—তখনই মজাটা জমবে ভালো। তোমাকে আর কিছু কসরত করতে হবে না। আপসে আপসে তোমার কজায় এসে যাবে। কিনতু খুব সাবধান, অনেক ছলাকলা করে সে তোমাকে ভোলাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু মেয়েমানুষের ছলচাতুরীতে ভুলে একবার যদি তাকে ফেরত দিয়ে দাও তার ডানার খোলস, তবে সব রসাতলে যাবে। তুমি তো মরবেই, সেই সঙ্গে আমরাও বাঁচবো না। ওর বাবার আক্রোশে আমার বাবার সাম্রাজ্যও ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। ওর কোনও মিঠে কথা কানে তুলবে না। বরং সব সময় কড়া তবে রাখবে। যাতে সে তোমাকে ভয় পায়, এবং বাধ্য থাকে। তারপর যা ঘটে ঘটবে।

ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো ঊননব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

হাসান খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে। গুলাবীর হাতে সে ঠোঁট স্পর্শ করে চুম্বন করে। বলে, তোমার মাথা আছে বলতে হয়। এক চালেই বাজিমাৎ হয়ে যাবে, বোন।

গুলাবী বলে, আহা আগে থেকেই অত আশা করতে নাই। শেষে ভরাডুবি হলে দুঃখটা বেশি করে বাজে,বুঝলে।

এরপর ওরা আবার নিচে নেমে আসে।

পরদিন সন্ধ্যায় প্রতিপদের চাঁদ ওঠার দিন। হাসান সন্ধ্যা হতে না হতেই পুকুরের পাশে ঘাটে এসে উঁচু মঞ্চের পিছনে এসে লুকিয়ে পড়ে। রাত বাড়ে। এক সময় ঐ দশটি পাখি এসে নামে পুকুরের পাড়ে। ওরা ডানার খোলসগুলো ছেড়ে জলে ঝাপিয়ে পড়ে। এই মওকায় হাসানও রোশনির খোলস সরিয়ে নিয়ে যায় এক গুপ্ত স্থানে। নিজেও লুকিয়ে থাকে একটা গাছের আড়ালে।

জলকেলী শেষ করে সকলে ঘাটে উঠে আসে। কিন্তু রোশনি আর তার নিজের ডানা-খোলস খুঁজে পায় না। আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠে সে। কপাল চাপড়াতে থাকে, চুল ছিড়তে থাকে। দারুণ হতাশায় সে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে।

অন্য মেয়েরা এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে ওঠে। যে যার নিজের নিজের ডানাগুলো চটপট পরে নিয়ে আকাশ পথে উঠে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের রাজকুমারী অসহায় অবস্থায় পড়ে রইলো সেখানে—সেদিকে কেউই কোনও ভ্রূক্ষেপ করে না। ওরা বুঝেছে, বাইরের কোনও অজানা শত্রু ওদের পিছনে লেগেছে। প্রাণ নিয়ে পালাতে না পারলে বাঁচা দায় হবে।

রোশনি সহচরীদের এই অশোভন স্বার্থপর আচরণে ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ হয়ে যুঁসতে থাকে, ঠিক আছে, এর প্রতিফল তোদের পেতে হবে একদিন।

হাসান আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। গাছের আড়াল থেকে  বেরিয়ে এসে বিবসনা সুন্দরীর দিকে সে ধাবিত হয়। মেয়েটি ছুটে পালিয়ে যায় পুকুরের অপর পাড়ে। ওর চোখে মুখে সে কী নিদারুণ ভয় আর লজ্জা। হাসান চিৎকার করে বলে, শোনো পিয়ারী আমাকে ভয় করার কিছু নাই। কাছে এসো, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো না।

কিন্তু সে কথা সে কানে তোলে না। কোনও রকমে দু’হাত দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস করতে করতে ছুটে চলে। হাওয়ার দাপটে ওর লম্বা চুলের রাশি পতাকার মতো। পতপত করে উড়তে থাকে। হাসান পিছনে পিছনে দৌড়তে দৌড়তে এক সময় রোশনির চুলের গোছা মুঠি করে ধরে ফেলে, আহা পালাচ্ছ কেন? আমি কী বাঘ, না ভালুক যে খেয়ে ফেলবো?

মেয়েটি হাত পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করে নিজেকে ছাড়াবার কায়দা কসরৎ চালায়। কিন্তু হাসানের বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সে আর বিশেষ সুবিধে করতে পারে না। টানতে টানতে এনে তার নিজের ঘরে তালা বন্ধ করে ফেলে। তারপর ছুটে যায় গুলাবীর কাছে। এমন শুভ সংবাদ আগে তো তাকেই জানাতে হবে।

গুলাবী হাসানের কামরায় এসে দেখে, মেয়েটি নিদারুণ দুঃখে হতাশায় কপাল বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নাকাটি করছে। সে ওর পায়ের কাছে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলে, আপনি মহারানী। আমাদের ঘরে যখন একবার পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এখানে থাকুন ঘর আলো করে—এই আমাদের একান্ত ইচ্ছা।

রোশনির ভুরু নেচে ওঠে, ওঃ, তুমি গুলাবী! তা হলে এইসব ফন্দী তোমারই! তাই বলি, মাটির মানুষ এখানে আসবে কী করে? এতক্ষণে বুঝলাম তোমারই সব ষড়যন্ত্র। তোমার বাবা যাঁর গোলামী করেছে সেই জিন-সম্রাটের কন্যা আমি। আর আমাকে কিনা তুমি একটা মানুষের বাচ্চার যৌন-কামনার শিকার বানাবার জন্য ফাঁদ পেতেছিলে? ঠিক আছ—দেখা যাবে। তুমি তো জান গুলাবী, আমার বাবার কী বিক্রম। তামাম দুনিয়ার তাবৎ জিন সম্রাট তার অনুদাস মাত্র। সেই বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা বাঁধবার সাধ হয়েছে তোমার? তুমি কী জান না, আমার বাবার এক ইশারায় লাখো লাখো সৈন্য গগনমণ্ডল ছেয়ে ফেলতে পারে। তুমি এক জিন-সম্রাটের কন্যা হয়ে একটা মানুষের সন্তানকে আশ্রয় দিয়েছ? একথা শুনলে আমাদের সমাজে তোমার বা তোমার বাবার কী দশা হবে একবার ভেবেছ? তার উপর আমার সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা—কি ভেবেছ, অত সহজেই আমি ভুলে যাব? তোমার সহায়তা ছাড়া, কোনও মানুষের পক্ষে কী সম্ভব ছিলো আমার জলকেলীর সরোবরের পথ সন্ধান করা?

গুলাবী গলায় মধু ঢেলে রোশনির মন ভোলাবার চেষ্টা করে, রাজকুমারী, আপনার পিতা আমার পিতার মালিক। সুতরাং তিনি আমার মালিকের মালিক। আপনি তার কন্যা। আপনার মতো রূপসী নারী তামাম জিন দুনিয়ায় দুটি নাই। জলকেলীর সময় এই অবোধ যুবক আপনার অঙ্গ-সৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বিধাতা পুরুষ কার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন আগে থেকে কেউ আমরা তা বলতে পারি না। তা না হলে দুনিয়াতে এতো নারী থাকতে সে মাটির দেশের মানুষ হয়ে আপনার মতো এক জিন-পরীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়বে কেন? নিশ্চয়ই, বুঝতে হবে, এর পিছনে অদৃশ্য ঈশ্বরের কোনও হাত আছে। আপনি একটু গভীরভাবে ভাবার চেষ্টা করুন রাজকুমারী। ঈশ্বরের অভিপ্রায় না থাকলে এই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার কিছুতেই ঘটতে পারতো না।

–ভালোবাসার অপরাধ সর্বদা মার্জনীয়। সে দিক থেকে এই যুবকের গোস্তাকি আপনি মাফ করতে পারেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, শুধু চোখের নেশা নয়, এর মহব্বৎসাচ্চা সোনা। আপনাকে সে দিল-ক্যা-প্যার করেই রাখতে চায়। আপনি প্রসন্ন হোন। এর ভালোবাসা গ্রহণ করে দেখুন, সেখানে কোনও খাদ নাই। আপনারও ভালো লাগবে একে। আপনিও প্রাণ ঢেলে ভালোবাসতে পারবেন। আপনি শুনে অবাক হবেন রাজকুমারী এক পক্ষ আগে আপনাকে প্রথম দেখার পর থেকে এই পনের দিন সে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আপনার। বিরহে কাতর হয়ে শয্যা নিয়েছিলো। আপনাকে না পেলে এর জীবন ব্যর্থ হয়ে, যাবে। এবং বিরহ জ্বালাতেই মৃত্যু হবে।

গুলবী আরও সবিস্তারে হাসানের হৃদয় যন্ত্রণার বিষাদ করুণ চিত্র তুলে ধরে রোশনির সামনে। এবং বলে, আপনারা দশ জন ছিলেন। তাদের প্রত্যেকেই পরমাসুন্দরী। কিন্তু ভেবে দেখুন, রাজকুমারী, এ কিন্তু কোনও নারীর দিকে কোনও নজর করেনি। এর একমাত্র কাম্য আপনি আর আপনার মহব্বত।

রোশনি বুঝতে পারে, যুবকের উদ্দেশ্য অসৎ নয়। এতক্ষণে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো নব্বইতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

জমকালো সাজ-পোশাকে সাজিয়ে রোশনিকে খানাপিনা এনে দেয় গুলাবী। অনেক আদর-আপ্যায়ন তোয়াজ করতে থাকে সারাক্ষণ। রোশনি-সুন্দরী খুশি হয়ে ওঠে, আমিও ভাবছি গুলাবী, এই বোধহয় করুণাময়ের ইচ্ছা ছিলো! তা না হলে আমার স্বদেশে, বাবা আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে এই দূর প্রবাসে এসেই বা এমন কঠিন পরীক্ষার সামনা-সামনি হব কেন? এখন নসীবের কাছে নতি স্বীকার ছাড়া গতি কী?

গুলাবী হাসানের কাছে গিয়ে বলে, এবার যাও, এই উপযুক্ত সময়। ওর মনটা বেশ নরম হয়ে আছে। প্রথমে ঘরে ঢুকেই ওর পা দু’খানা জড়িয়ে ধরবে। তারপর ওর হাত এবং কপালে চুমু খাবে। এর আগে পর্যন্ত একটি বাক্য উচ্চারণ করবে না, মনে থাকে যেন।

হাসান ঘরে এসে কাঁপতে থাকে। রোশনি এগিয়ে আসে কাছে। অপলক নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সে হাসানকে। হাসান বড় রূপবান যুবক। খুশিতে ভরে ওঠে ওর মন। নিচে বসে পড়ে রোশনির পা দু’খানা চেপে ধরে হাসান। চুম্বনে চুম্বনে ভরে দেয়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথম হাতে এবং পরে ওর চোখে কপালে এবং পরিশেষে অধরে অধর রাখে।

তুমি সুন্দর সবচেয়ে সুন্দর, রূপের রানী—আমার দিল-ক্যা-প্যার। আমার আনন্দ, আমার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-চোখের মণি রোশনি! আমার ওপর একটুখানি সদয় হও, সোনা। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। আমার এই জীবন-যৌবন—সব বিলিয়ে দিতে চাই তোমার পায়ে। শুধু একটু খানি ভালোবাসা। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো—আমি তোমার বান্দা হয়ে থাকতে চাই, রোশনি তুমি একটুখানি সদয় হও। আমি তোমাকে ঠকাতে চাই না, ভালোবাসতে চাই, প্যার করতে চাই। শাদী করতে চাই তোমাকে।

আমি তোমাকে আমার স্বদেশ বাগদাদে নিয়ে যাবো। সেখানে তুমি আমার বেগম হয়ে থাকবে। দাস দাসী খোজা নফর চাকর তোমার সেবা-যত্ন করবে। তোমার জেল্লায় ঘর ভরে উঠবে আমার। বাগদাদ বলতে শান্তির শহর বোঝায়। সেখানকার বাসিন্দা কলহ-বিবাদ জানে না। দেখবে, সেখানকার মানুষজন কত ভালো, কত ধার্মিক। আমার মা আছে, তার মতো ভালো মানুষ আজকালকার দিনে দেখা যায় না। দেখো, সে তোমায় পেটের সন্তানের মতোই আদর সোহাগ করবে। ভালোবাসায় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে তোমার হৃদয়। কত সুন্দর সুন্দর খানা বানিয়ে খাওয়াবে, তোমাকে পেয়ে যে কী খুশি হবে!—কারণ আমি তার একমাত্র সন্তান, আর তুমি আমার পেয়ারের বিবি। আমার মায়ের হাতের রান্না একবার যে খেয়েছে, সে আর ভুলতে পারেনি কোনও দিন। তামাম বাগদাদের মধ্যে তার তুল্য ভালো খানা আর কেউই বানাতে পারে না।

একটানা এতো সব কথা বলে হাসান থামে। ভাবে, রোশনি কিছু বলবে। কিন্তু একটাও কথা বলে না সে!

এই সময় হঠাৎ সদর দরজায় করাঘাত হয়। হাসান দরজা খোলার জন্য বাইরে আসে। মেয়েরা শিকার থেকে ফিরেছে। হাসানকে দেখে ওরা কলমুখর হয়ে ওঠে। অনেকগুলো হরিণ খরগোস, বুনো মোষ, শেয়াল এবং আরো অনেক রকমের পশু শিকার করে এনেছে তারা। এবং সেই আনন্দেই সকলে মশগুল। হাসান ভয় করছিলো, রোশনিকে ওরা দেখে ফেলবে। কিন্তু তখন কে কী ভাবে কোন জানোয়ারটাকে ঘায়েল করেছিলো, তারই ফিরিস্তি শোনাতে ব্যস্ত। অন্য কোনও দিকে লক্ষ্য ছিলো না। মেয়েরা বলে, হাসান ভাই, একটু হাত লাগিয়ে ধরতো, বাব্বা জানোয়ারগুলো কি পেল্লাই ভারি।

অন্য দিন হাসান ওদের হৈ-হুল্লোড়ে নিজেকে সামিল করে দেয়।শিকার সামগ্রী দেখে আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু আজ যেন হাসান তেমন প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। বারবার ওর নিজের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কেমন যেন একটা অন্যমনস্ক ভাব। ব্যাপারটা বড় বোনের নজর এড়ায় না। হাসানকে একটু টিপ্পনি কেটেই বলে, কী হলো ভাইজান, মনে হচ্ছে, আজকের শিকার তোমার পছন্দ হয়নি? তা আর কোনও বড় শিকার ধরেছ নাকি।

হাসান ভীষণ বিচলিত বোধ করে। তবে কী বড়দিদি সব জেনে ফেলেছে? মাথা তুলে আর তাকাতে পারে না সে। লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়! বড় বোন আবার বলে, না কি দেশের জন্য মন খারাপ করছে। মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। শরম করো না ভাইটি, খুলে বলো তোমার মনের কথা। তা না হলে আমরা জানবো কেমন করে?

হাসান তবু কোনও কথা বলতে পারে না। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময় গুলাবী ছুটে আসে সেখানে। হাসতে হাসতে বলে, ভাইজান আজ একটা সুন্দর চিড়িয়া ধরেছে, দিদি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে পাখিটা কিছুতেই পোষ মানছে না। তোমরা যদি চেষ্টা-চরিত্র করে তাকে একটু বশে আনতে পারো দিদি, ভাই-এর আমার মুখে হাসি ফুটবে।

মেয়েরা হো হো করে হেসে ওঠে। বড় বোন বলে, এটা কী একটা সমস্যা হলো? না না, একটা সামান্য চিড়িয়ার জন্য ও বেচারী অমন মনমরা হবে কেন? নিশ্চয়ই অন্য কিছু হয়েছে।

–কারণ, হাসান ঐ পাখিটাকে পেয়ার করে ফেলেছে। আর সে কী পেয়ার দিদি! যদি একবার দেখতে–

হাসান তখনও আরক্ত হয়ে নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

বড় বোন এবার বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পারে।

-তা হলে খুব বড় রামপাখি বল?

-তা আমাদের মতই আকরে হবে আর কি।

গুলাবী মুখ টিপে হাসে। হাসতে হাসতেই বলে, হলেও মনুষ্য সন্তান তো! বুদ্ধিতে একটু খাটো! তাই আমরা যখন দেশে গিয়েছিলাম, তখন হাসানকে বারবার করে বারণ করে গিয়েছিলাম, ঐ নিষিদ্ধ দরজাটা খুলো না। কিন্তু খাটো বুদ্ধির মানুষগুলোর অহেতুক কৌতূহল একটু বেশি হয়। আমার বারণ অমান্য করে আমাদের আদরের ভাইজান এক রাতে ঐ দরজা খুলে ওপরে চলে গিয়েছিলো। এবং ভাগ্যক্রমে সে রাত ছিলো প্রতিপদের। তোমরা তো জান দিদি, প্রত্যেক প্রতিপদ তিথিতে সম্রাট জিনিস্থানে মেয়েরা সরোবরে জলকেলী করতে আসে! হাসান ঐ সম্রাট-নন্দিনীকে দেখে মূৰ্ছা যায়। তারপর থেকে সে আর শয্যাত্যাগ করে দাঁড়াতে পারেনি—এমনই শরীরের হাল হয়েছিলো।

যাই হোক, অনেক প্যাচ-পয়জার করে সেই রাজকুমারী রোশনিকে সে ঘরে এনে বন্দী করে রেখেছে। কিন্তু কিছুতেই তাকে পোষ মানাতে পারছে না।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো একানব্বইতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

গুলাবীর কথা শুনে মেয়েরা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, তাই নাকি, ভাইজান? তা একবার দেখাও তোমার সে আজব চিড়িয়া? দেখি সে কতবড় রূপসী।

হাসান ওদের সঙ্গে করে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। সাত বোন এক সঙ্গে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ করে রাজকুমারী রোশনিকে। বড় বোন এগিয়ে এসে বলে, আপনার আগমনে এই স্বর্ণ-প্রাসাদ আনন্দে মুখর হয়ে উঠেছে, রাজ-নন্দিনী। আমাদের ভাই হাসান, রূপে-গুণে সেরা ছেলে! এতো ভালো ছেলে আজকের দিনে হয় না। আমি হলফ করে বলতে পারি, হাসানকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আপনার জীবন মধুর হয়ে উঠবে। আপনি রাজা হয়ে যান। হাসান ভাইজানের সঙ্গে আপনার শাদী দিয়ে দিই আমরা। এই প্রাসাদে চিরকাল ঘর আলো করে থাকুন।

মেয়েরা রোশনির জবাবের প্রত্যাশায় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু রোশনি না বলে ‘হ্যাঁ’, না বলে ‘না’। গুলাবী রোশনীর একখানা হাত টেনে নিয়ে হাসানের হাতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে বলে, ব্যস, হয়ে গেলো। দু’হাত এক করে দিয়েছি আমরা—এবার তোমরা বোঝাপড়া করে নাও, কেমন?

হাসানের আনন্দ আর ধরে না। গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে সে?

যখন তুমি খেলা কর জলে,
খেলার ছলে হারিয়ে যাও তলে,
তখন আমি চমকে উঠে বলি,
কোথায় আমার স্বর্ণচাপার কলি?
হঠাৎ আবার ভেসে ওঠো জলে,
রুষ্ট হই, কপট কোপানলে।
তখন তুমি মধুর করে হাসো,
শুধাও যেন—এতোই ভালোবাসো?

মেয়েরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে ওঠে, হৈ-হৈ–

হাসিতে গড়িয়ে পড়ে ওরা। হাসির হুল্লোড়ে এ ওর গায়ে ঢলাঢলি করে অনেকক্ষণ।

-এবার বলুন রাজকুমারী, আমাদের ভাইটি কেমন? কী সুন্দর করে মহব্বতের ছড়া বেঁধে দিলো এক লহমায়, আপনি পারবেন?

-তা হলে তোমাদের ভাইটি কবিয়াল, দেখছি।

এই প্রথম রোশনির মুখে বোল ফোটে। গুলাবী বলে, হা, আলবাৎ কবি। মুখে মুখে সে এই রকম মহব্বতের হাজারো কবিতা বানিয়ে শুনিয়ে দিতে পারে আপনাকে।

এবার রোশনি কোমল দৃষ্টি মেলে হাসানের দিকে, তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখের ইশারায় হাসানকে কাছে ডাকে।

এরপর হাসানের দুই বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হয় রোশনি। মেয়েরা খিলখিল করে হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পর পর চল্লিশটা দিবস রজনী হাসান আর রোশনি। পালঙ্ক-শয্যায় পড়ে থাকে। এমন মধুময় মুহূর্ত হাসান জীবনে কখনও উপভোগ করেনি। প্রাণ মন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। রোশনি তাকে কোনও ভাবেই বঞ্চিত করেনি। দু হাতে সব উজাড় করে দিয়েছে।

কিন্তু একচল্লিশ দিনের শেষ রাতে হাসান স্বপ্নে তার মাকে দেখে। পুত্র শোকে কেঁদে কেঁদে তার মা প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। হাসানের তাজিয়া বানিয়ে সারা দিনরাত সে তার সামনে বসে চোখের জল ফেলে।

স্বপ্ন দেখতে দেখতেই হাসান আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে, মা, মা গো, মা—

হঠাৎ এই অস্বাভাবিক আওয়াজে চমকে ওঠে মেয়েরা। দ্রুত পায়ে ছুটে আসে হাসানের ঘরের দিকে। গুলাবী রোশনিকে জিজ্ঞেস করে, কী কী হয়েছে হাসানের?

রোশনি বলে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে স্বপ্নে কিছু দেখে থাকবে।

গুলাবী হাসানকে জাগিয়ে তোলে, ভাইজান? ভাইজান, কী হয়েছে তোমার? অমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

হাসান বিছানায় উঠে বসে। তখনও ওর চোখে জল টলমল করছে। স্বপ্নের কাহিনীটা বললো সে।

গুলাবী এবং অন্য মেয়েরাও কাঁদতে থাকে, তোমাকে আর এখানে আটকে রাখা ঠিক হবে, ভাইজান। তুমি এবার দেশে যাও। কিন্তু কথা দাও, ফি বছর একবার করে এসে তোমার এই বোনদের সঙ্গে দেখা করে যাবে?

হাসান বলে, একশোবার। যেখানেই যাই, যত দূরেই থাকি বোন, তোমাদের এই আদর আর এতো ভালোবাসা ভুলবো কেমন করে? মন আমার পড়ে থাকবে এখানেই।

কিন্তু হাসান যাবে কী ভাবে! হঠাৎ তার মনে পড়ে, বাহুরামের সেই ছোট্ট যাদু দামামাটা আছে তার কাছে। তবে সে বস্তুটি কী করে ব্যবহার করতে হয় তা তো সে জানে না! গুলাবী শুনে বললো, আমি জানি। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সেই ছোট্ট দামামাটা মোরগের চামড়ার ছাউনিতে ঢাকা। গুলাবী অদ্ভুত কায়দা করে দুটি আঙ্গুল রেখে টোকা মারে। আর তখুনি সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে পিলপিল করে গাধা, ভেড়া, খচ্চর, ঘোড়া, মোষ, উট প্রভৃতি নানা জাতের জন্তু-জানোয়ার এসে স্বর্ণ-প্রাসাদের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। গুলাবী তার থেকে কয়েকটা উট এবং খচ্চর বেছে নিয়ে বাকীগুলোকে বিদায় করে দেয়।

নানারকম সাজ-পোশাক, রত্ন আভরণ এবং মনোহারী উপহার সামগ্রী বেঁধে-হেঁদে জানোয়ারগুলোর পিঠে চাপিয়ে দেয় মেয়েরা।

বিদায় বেলায় সাত বোন চোখের জলে ভাসে। বিশেষ করে গুলাবীর বেশি করে বাজে। কারণ, এতোদিন সেই সবেচেয়ে বেশি করে হাসানকে কাছে কাছে রেখেছিলো। তার খানাপিনা সুখ-সুবিধা দেখা-শোনার ভার ছিলো তারই ওপর।

দীর্ঘ পথ, কিন্তু বিশেষ কোন দুর্ভোগ পোয়াতে হলো না। কয়েকদিন চলার পর হাসান রোশনিকে সঙ্গে করে বসরায় এসে পৌঁছয়।

মা কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গেছে। ছেলের আগমন প্রথমে সে বুঝতে পারে না। হাসান আকুল হয়ে জড়িয়ে ধরে, মা, মাগো চেয়ে দেখ, আমি—হাসান, তোমার ছেলে আবার ফিরে এসেছে তোমার কোলে।

হাসানকে যে আবার ফিরে পাবে সে আশা করেনি তার মা। তার ধারণা জন্মেছিলো, হাসান আর বেঁচে নাই। তাই বাড়ির আঙ্গিনায় হাসানের নামে একটা তাজিয়া বানিয়ে সে তার সামনে বসে দিনরাত কান্নাকাটি করতো।

হাসান বলে, মা আমি বেঁচে আছি। এই দেখ, শাদীও করেছি। এই তোমার পুত্র-বধু।

মা রোশনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তুমি যে-ই হও মা, তুমি আমার বড় আদরের। যখন এসেছ, ঘর আলো করে থাক,।

হাসানের বাড়িটা ছোট-খাটো। কোনও প্রাসাদ ইমারত নয়। ঘরদোর অতি সাধারণ। রোশনি সম্রাট-নন্দিনী—সে অবাক হয়। এই ছোট বাড়িতে মানুষেরা বাস করে কী করে?

বসরাহর বড় বাজার থেকে সবচেয়ে দামি দামি সাজ-পোশাক কিনে আনে হাসান। রোশনিকে ডেকে বলে, দেখ তো, কেমন মানবে তোমায়?

সে-সব অতি সাধারণ, একেবারেই জোলো বলে মনে হয় রোশনির কাছে। এমন সাজ-পোশাক সে কেন, তাদের দাসী বাঁদীরাও কেউ ব্যবহার করে না। কিন্তু হাসান বা তার মা মনে দুঃখ পেতে পারে, তাই মুখে বলে মন্দ কী! এতেই চলবে।

হাসানের মা সব বুঝতে পারে। বলে, এখানকার হাট-বাজারে বাহারী সওদা পাওয়া শক্ত, মা। ওসব পেতে গেলে বাদদাদে যেতে হবে।

রোশনি বলে কী দরকার মা। এই বেশ হয়েছে। এতেই চলে যা। খলিফা হারুন অল রসিদের শহর। উজির আমির সওদাগরদের বাস। বড় লোকের জায়গা, শখের সামানের অভাব নাই সেখানে। ওখানে গিয়ে খুব বড় দেখে একখানা বাড়ি কিনে বৌমাকে নিয়ে ওখানেই তুই বাস কর গে। নতুন অচেনা জায়গা। গোড়া থেকেই যদি আমিরি চালে চলতে শুরু করিস, কারো মনে কোনও সন্দেহ হবে না। কারণ কত দেশ থেকে কত বড়লোক সেখানে যায়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে। কেউ সে দিকে তাকিয়েও দেখে না। কিন্তু এখানে এই ছোট্ট বসরাহতে আমাকে তোকে তো সবাই চেনে জানে। এতে কাল আমাদের কী অবস্থা ছিলো কারো অজানা নাই। আজ যদি তুই এখানে হঠাৎ তিনমহলা বাড়ি হাঁকিয়ে বসিস, গণ্ডা কয়েক দাসী-বাঁদী কিনিস, লোকের চোখ টাটাবে না? ভাববে, এতো পয়সা কোথায় পেলো ওরা? এমনিতেই ঐ শয়তান পারসীটার সঙ্গে তোর অত মাখামাখি মেলামেশার জন্য অনেক কথা উঠেছিলো। লোকটা যে জালিয়াত-মন্তর অন্তর দিয়ে তামা-পিতলকে সোনা বানিয়ে বাজারের লোককে ঠকায়, সে খবর তারা পেয়েছিলো। এখন তুই ফিরে এসেছিস। বিদেশ থেকে অঢেল সোনাদানা হীরে জহরৎ নিয়ে এসেছিস। সে খবরও লোককে জানানো যাবে না। যা ঘরদোরের হাল চুরি ডাকাতি হয়ে যাবে। এবং যদি আমিরি চালে চলতে থাকিস, তখন এখানকার লোক রটাবে সোনা জাল করে পয়সা বানাচ্ছিস। তার অনেক বিপদ আছে, বাবা। একবার যদি খলিফা হারুন অল রসিদের কানে যায়—একেবারে গর্দান নিয়ে নেবে আমাদের সকলের। তার চেয়ে ওসব ঝুঁকির মধ্যে গিয়ে কাজ নাই। তুই বাগদাদে চলে যা। গোড়া থেকেই বড়লোকি চালে চলতে থাকলে কারো আর নজরে পড়বে না।

হাসান বললো, তুমি ঠিকই বলেছ, মা। এখানে থাকলে ভয়ে ভয়ে গরীবের মতোই দিন কাটাতে হবে। কিন্তু তার তো কোনও দরকার নাই। আমি যে ধনদৌলত সঙ্গে এনেছি ; সাতপুরুষ বসে খেলেও তা ফুরাবে না। ঠিক আছে এখানকার পাট আমি একেবারেই তুলে দিচ্ছি মা। তুমিই বা এখানে পড়ে থাকবে কী কারণে? আমি বাড়িঘর সব বেচে দিয়ে তোমাকে সঙ্গে নিয়েই বাগদাদে যাবো।

কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি এবং বাড়ির যাবতীয় সামানপত্র সব বেচে দিলো হাসান। প্রতিবেশিরা অনেকে দুঃখ করল, আহা, সাত পুরুষের ভিটে, বেচে দিলে?

হাসান বলে, ভিটে তো খাওয়াবে না, চাচা। বাঁচতে গেলে পয়সা চাই। সে-পয়সা রোজগার করতে হলে ভালো বাণিজ্য করা দরকার। আমি বাগদাদে গিয়ে সওদাগরি ব্যবসা করবো।

এই সময়ে ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো তিরানব্বইতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

সামানপত্র বাঁধা ছাঁদা করে নিয়ে হাসান সেই ছোট্ট দামামাটায় টোকা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একপাল জন্তু জানোয়ার এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার মধ্য থেকে কয়েকটা উট বাছাই করে নিয়ে বাকীগুলোকে বিদায় করে দেয় সে। এবং বাক্সপ্যাটরা চাপিয়ে বাগদাদের পথে রওনা হয়ে যায়।

বাগদাদ শহরের পাশে টাইগ্রিসের উপকূলে এসে এক লক্ষ দিনার দিয়ে একখানা সুরম্য অট্টালিকা কেনে। এই প্রাসাদখানা এক উজিরের ছিলো।

বাজার থেকে অনেকগুলো দাসী বাদী নফর চাকর খোজা কিনে নিয়ে আসে হাসান। আর নিয়ে আসে দুষ্প্রাপ্য দামী কাঠের খাট পালঙ্ক কুর্শি কেদারা মেজ। সুক্ষ্ম কাজকরা পর্দা কিনে এনে টাঙিয়ে দেয় জানালা-দরজায়। পারস্যের শৌখিন গালিচা এনে পাতে মেঝেয়। এবং আরও নানা রকম সুন্দর সুন্দর শখের জিনিস এনে ঘরদোর সাজায়। এইভাবে দিন কয়েকের মধ্যে প্রাসাদখানা ঝকমক করে ওঠে।

রোশনি আর মাকে নিয়ে হাসান পরম সুখ বিলাসের মধ্যে দিন যু কাটাতে থাকে। প্রতিদিন নতুন নতুন স্বাদের সুন্দর সুন্দর খানা তৈরি। করে তার মা। রোশনি নিজহাতে হাসানকে খাবার সাজিয়ে দেয়। এ অa৪ নাচ গান বাজনায় মাতিয়ে রাখে স্বামীকে।

রোশনি গর্ভবতী হয়, এবং ন’মাস বাদে ফুটফুটে সুন্দর দুটি জমজ পুত্রের জন্ম দেয়। হাসান ওদের একটির নাম রাখে নাসির এবং আর একটির মনসুর।

একটা বছর কেটে গেলো। হাসানের মনে পড়ে সেই সপ্তকন্যার কথা। ওরা বলেছিলো, বছর শেষে একবার করে এসে বেড়িয়ে যাবে।

একমাত্র ইরাকেই মেলে সেই রকম কিছু বিশেষ উপহার সামগ্রী সংগ্রহ করে আনে হাসান। মেয়েদের জন্যে নিয়ে যাবে সে। কিন্তু হাসানের আশঙ্কা হয়, মা হয়তো যেতে দিতে চাইবে না। কিন্তু মা বাধা দেয় না, বলে যারা তোমার জন্য এতো করেছে, যাবে বই কি সেখানে। তবে বেশি দেরি করো না, বাবা। জানতো মায়ের প্রাণ কিছুতেই স্থির থাকতে পারি না।

হাসান বলে তুমি কিছু ভেব না মা, আমি বেশি দেরি করবো না। তুমি রইলে, রোশনি, নাসির, মনসুর এরা রইলো—আমি কি বেশিদিন না দেখে থাকতে পারি।

হাসান গলাটা খাটো করে বলে, একটা কথা মা—তোমার ঘরের খাটের তলায় একটা পাখীর.ডানার খোলস আছে ; খুব হুঁশিয়ার থেকো, ঐ খোলসটা যেন কিছুতেই রোশনির হাতে না পড়ে। ওর উড়ে বেড়ানোর নেশাটা এখন কেটে গেছে। কিন্তু ঐ খোলসটা দেখলেই আবার তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আর একবার যদি সে আকাশে উড়তে পায় তখন কী হবে কে বলতে পারে। হয়তো সে চিরকালের মতো আমাদের ছেড়ে ওর বাবার কাছে পালিয়ে যাবে। ওই খোলসটা তোমার বুকের কলিজা—এই জ্ঞান করে ওটাকে আগলে রাখবে, মা। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।

হাসান আরও সতর্কবাণী শোনায় মাকে, তুমি নিজে হাতে রোশনির খানাপিনা এনে দিও মা। নফর চাকরদের ওপর ছেড়ে দিও না। কারণ ওরা কেউই ওর মেজাজ-মর্জি জানে না। কোন জিনিসটা ওর পছন্দ কোল্টা অপছন্দ, আমি আর তুমি ছাড়া তো কেউ জানে না, মা। রোশনিকে তুমি বাড়ির বাইরে এক পা যেতে দেবে না কোথাও। ও যেন জানালা দিয়ে পথের দিকে মুখ না বাড়ায়, ছাদে না যায়। সব সময় চোখে চোখে রাখবে ওকে। একবার যদি সে আমাকে ছেড়ে চলে যায় মা, আমি আর বাঁচবো না। রোশনি আমার জান, আমার কলিজা! এই কথাটা তুমি মনে রেখো, মা।

মা হেসে বলে, তুই কী আমাকে এতোই বোকা হাঁদা মনে করিস নাকি, বাবা। আমি সব বুঝি, সব আঁচ করতে পারি। তোর বৌ আমাদের ঘরে বেগমের তোয়াজে থাকলে কী হবে, ওর মন পড়ে থাকে আশমানে। ওর বাবা মার দেশে। তুই দেখিস্ না, নিজের গর্ভের সন্তান নাসির মনসুর—হীরের টুকরো, চাঁদের মতো ছেলে, সেই ছেলের ওপরই বা ওর মায়ের দরদ কতটুকু। তবে আমিও সেয়ানা মেয়ে। আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালানো সম্ভব নয়। তুই কিছু ভাবিস নি বাবা, যা ঘুরে আয় মেয়েদের সঙ্গে দেখা করে। এসে দেখবি তোর রোশনি যেমনটি ছিলো তেমনি আছে আমার কাছে। ওর আদর যত্নের কোনও ত্রুটি রাখিনি এতোদিন, এখনও কোন অনাদর করবো না। তুই যা ওদের দেখে আয়। তবে বেশি দেরি করিস নে, বাবা।

মা-পোয়ের এই নিভৃত আলাপ কিন্তু আড়ালে থেকে রোশনি সবই শুনে ফেলে।

দিনক্ষণ দেখে হাসান মায়ের কাছে বিদায় নেয়। রোশনি নাসির এবং মনসুরকে আদর সোহাগ করে। রোশনিকে বলে, খুব সাবধানে থেক। মায়ের কথার অবাধ্য হয়ো না। আমি খুব শিগগিরই ফিরে আসবো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চুরানব্বইতম রজনী আবার গল্প শুরু হয় :

দামামায় টোকা দিতেই অনেক জন্তু-জানোয়ার এসে হাজির হয়। হাসান এক পক্ষীরাজ ঘোড়াকে রেখে বাকী সবগুলোকে চলে যেতে বলে।

শেষ বারের মতো সকলের কাছে বিদায় নিয়ে পক্ষীরাজের পিঠে চেপে বসে হাসান। এবং পলকের মধ্যে সে উড়ে চলে আসে স্বর্ণপ্রাসাদে।

সাত বোন আনন্দে নেচে ওঠে। সারা প্রাসাদ আলোর মালায় সাজায়। রাশি রাশি ফুল এনে ভরে ফেলে ঘরদোর। সুন্দর সুন্দর খাবার তৈরি করে। সারা প্রাসাদময় সে কি উৎসব আনন্দের ঘটা।

সাত বোন, বিশেষ করে গুলাবী যে কী খুশি হলো তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। নাচগান হৈ হল্লা, শিকার ভ্রমণ সাঁতারে মেতে উঠলো সকলে। প্রাণের ভাই হাসান সব কিছুতে তাদের সঙ্গী সহচর হয়ে রসের ভিয়েন জোগাতে থাকলো।

আচ্ছা, ওরা ওদিকে হেসে খেলে আনন্দে দিন কাটাক, আমরা চলুন আবার ফিরে যাই বাগদাদে হাসানের প্রাসাদে।

হাসান চলে যাওয়ার পর দুদিন শাশুড়িকে ছেড়ে এক পাও নড়লো না রোশনি। কিন্তু তৃতীয় দিন ভোরে উঠে সে হাসানের মাকে বললো, মা আজ কতকাল গোসল করিনি। বাচ্চা দুটো তো দুধ মাখিয়ে বুকখানা চটচটে করে ফেলেছে। গা ঘিন ঘিন করছে, আমি হামাম থেকে গোসল সেরে আসি।

মা বললো, হায় আমার কপাল, এ শহর তো আমার কাছে একেবারেই অচেনা, মা। এর পথ ঘাট বাজার হাট কিছুই জানি না। এখান থেকে কত দূরে হামাম, কোন পথেই বা যাওয়া যায়, কিছুই জানি না। এ অবস্থায় কী করে হামামে যাবে তুমি। তার চেয়ে আর কটাদিন কষ্ট করে কাটাও। হাসান শিল্পির এসে পড়বে। ছেলে এসে তোমাকে গোসল করিয়ে নিয়ে আসবে। আর তোমার যদি নিতান্তই খারাপ লাগতে থাকে তাহলে ঘরেই আমি খানিকটা পানি গরম করে দিচ্ছি। তাই দিয়ে গা হাত পা ভালো করে মুছে ফেলল, দেখবে—আরাম পাবে। গোসলের সব সাজ-সরঞ্জামই আমার ঘরে আছে। দিন কয়েক আগে হাসান একটা আলেপ্পোর সুগন্ধী আতরের শিশি এনে রেখেছে। পানির মধ্যে খানিকটা মিশিয়ে দিলে ফুরফুর করে খুশবু ছাড়বে। মনটা খুশ হয়ে উঠবে।

রোশনি কিন্তু তার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারে না! ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকে, মা একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন না। শহরের পথ-ঘাট অচেনা-অজানা এ অজুহাত অচল। আমি নাজুক নাবালিকা নই যে, পথে বেরুলে হারিয়ে যাবো। আপনার একটা কেনা বাঁদিকেও যদি এই ধরনের বাধা দিতেন তবে আমি বলতে পারি, সেও তা মানতো না। বাঁদী-বাজারে তাকে বিক্রি করে দিয়ে আসার জন্য জুলুম করতো। আপনি আমাকে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করেন। তা না হলে বাড়ির বাইরে যেতে দিতে আপনার আপত্তি হতো না। কিন্তু একথাও জেনে রাখুন মা, কোনও নারী যদি মনে করে সে পালাবে বা নষ্ট হবে তাকে আপনি শিকলে বেঁধে রেখেও আটকাতে পারবেন না। আপনি আমার সতীত্বে কটাক্ষ করেছেন। এ অবস্থায় এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না, মা। এখন আমার মৃত্যু ছাড়া পথ নাই।

এই বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে রোশনি। মা দেখলো রোশনি তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। এই রাগের মাথায় মানুষ করতে পারে না এমন কাজ নাই। কী জানি, হয়তো সে জহর খেয়েই জীবন শেষ করে দেবে! ভয়ে শিউরে ওঠে সে।

-তুমি যখন এতোই গোঁসা করছ মা, তবে চলো যাই তোমাকে হামামে গোসল করিয়ে নিয়ে আসি। হাসান বলেছিলো, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমাকে যেন বাড়ির বাইরে যেতে না দিই। কিন্তু আমি তার কথা রাখতে পারলাম না। চলো তেল সাবান আতর সঙ্গে নাও, আমি তোমাকে নিয়ে যাবো হামামে।

রোশনিকে বাগদাদের এক সম্ভ্রান্ত হামামে নিয়ে যায় হাসানের মা। কিন্তু না নিয়ে গেলেই ভালো হতো, আরও একটু পাষাণ প্রাণ হয়ে রোশনির সব কথা হজম করে চুপচাপ কটাদিন কাটালে কী ক্ষতি ছিলো? কিন্তু নিয়তিকে কে এড়াতে পারে? যা হবার তা তো হবেই।

হামামে পৌঁছতেই রোশনির অসাধারণ রূপলাবণ্য প্রত্যক্ষ করে গোসলের জন্য অপেক্ষমান মেয়েরা চমকে ওঠে। এতো রূপ কোনও মানুষের হতে পারে না। এ নিশ্চয়ই কোনও হুরী-পরী।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পচানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

কেউ আর চোখ ফেরাতে পারে না। তারপর সাজপোশাক ছেড়ে যখন রোশনি বিবস্ত্রা হয় তখন তারা ওর নগ্ন দেহবল্লরীর অপার লাবণ্য এবং নির্ভাজ নিখুঁত অঙ্গ-সৌষ্ঠব দেখে আরও বেশি অবাক হয়ে যায়। একেবারে নিপুণ কারিগরের হাতে গড়া অপূর্ব এক শিল্পমূর্তি।

অন্য মেয়েরা, যারা গোসল করার জন্যে গিয়েছিলো, সকলেই গোসল-টোসল ভুলে গিয়ে রোশনিকে দেখতে থাকে। এতো রূপ সে কোথায় পেলো? দুনিয়ার বহু রূপসী নারীর দেহ-বর্ণনা ওরা শুনেছে কিন্তু এ মেয়ে তো তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। কোনও শিল্পীর সাধ্য নাই এ রূপ তুলিতে আঁকে। কোনও কবির কল্পনা এর ধারে কাছেও পৌঁছন সম্ভব নয়।

মুহূর্তের মধ্যে রোশনির রূপের খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে! দলে দলে মেয়েরা হামামে এসে ভিড় জমাতে থাকে। কেউ গোসল করতে আসে না—আসে রোশনিকে দেখে নয়ন সার্থক করতে। এই সব মেয়েদের মধ্যে বেগম জুবেদার এক চরও ছিলো। মেয়েটির নাম তুহফা। ভীষণ চালাক এবং অপরূপ সুন্দরী।

গোসল শেষ করে সাজপোশাক পরে রোশনি বাড়ি ফেরার জন্য শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামে। যতক্ষণ সে ফোয়ারার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নগ্ন দেহ মর্দন করতে করতে স্নান করছিলো ততক্ষণ একভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো তুহফা।

রোশনির সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলার ছল করে সে। কিন্তু রোশনি কোনও আমল দেয় না। নিজের মনে পথে নামে। তুহফা কিন্তু চিনে-জোঁক। সে ওদের পিছু ছাড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে হাসানের বাড়ির দরজায় এসে পড়ে। রোশনি আর তার শাশুড়ি ভিতরে ঢুকে যায়। খোজা দরজা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় তুহফা খোজাকে বলে, আমিও যাবো ভেতরে। তোমার মালকিনের সঙ্গে আমার কথা আছে।

—আরে ভাগ।

খোজাটা খিচিয়ে ওঠে, যা পালা এখান থেকে, মালকিনের সঙ্গে কথা আছে। কথা আছে তো সারাটা পথ মুখে কুলুপ এঁটে ছিলে কেন। বলতে পারলে না?

তুহফা বলে, আহা ছাড়োই না গো, আমি শুধু এই গুলাবটা তার হাতে দেব, ও তার পরেই বেরিয়ে আসবো। খোজাটা এবার খেউড় করে, গুলাব তোর ইয়েয় ঢুকিয়ে দেব। যা ভাগ, পালা। তা না হলে চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় নামিয়ে দেব।

তুহফা সাপিনীর মতো ফুঁসে ওঠে, কী, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! দাঁড়া তোর দেমাক আমি দুমড়ে দিচ্ছি।

এই বলে দুমদাম পা ফেলে তুহফা রাস্তায় নামে।

-আরে যা যা, তোর মতো কত ছেনাল দেখলাম আমি। তুই এসেছিস এখানে খাপ খুলতে।

ক্রুদ্ধ তুহফা প্রাসাদে ফিরে আসে। মুখ ভার করে বসে থাকে জুবেদার সামনে। বেগম জুবেদা বুঝতে পারে আজ কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে। তা না হলে সদা-চঞ্চল তুখোড় তুহফা ঐভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকার পাত্রী নয়।

-হ্যাঁরে তুহফা, অমন মুখ ভার করে বসে আছিস কেন, কী হয়েছে? এ দিকে আয় তো

শুনি।

তুহফা কোনও কথা বলে না। ধীরে ধীরে জুবেদার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

-কী হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলি এতক্ষণ?

–হামামে।

—তা সেখানে তোক কেউ কিছু বলেছে?

না।

-তবে?

—মালকিন, আজ হামামে গোসল করতে এসেছিলো একটি মেয়ে। তেমন রূপবতী নারী আমি জীবনে দেখি নি। আমি কেন, আপনারা কেউই দেখেন নি। ধরার মানুষ এতো সুন্দর হতে পারে না। এ নিশ্চয়ই ডানাকাটা হুত্রী-পরী!

-বলিস কী?

জুবেদা জানে, তুহফা নিজে দেখতে সুন্দরী বলে ও সহসা কোনও মেয়েকেই সুন্দরী বলে স্বীকার করতে চায় না। অথচ ওর মুখে অন্য মেয়ের রূপের প্রশংসা!

—মেয়েটার কী নাম?

-তাতো বলতে পারবো না, তবে শুনলাম বসরাহর এক সওদাগর হাসানের বিবি সে। ওদের বাড়িটা আমি দেখে এসেছি।

—কোথায়?

টাইগ্রিসের ধারে একটা বিরাট প্রাসাদ আছে। তার একটা ফটক এধারে আর একটা ফটক নদীর সামনে।

জুবেদা দেহরক্ষী মাসরুরকে ডেকে পাঠায়। সে এলে জুবেদা তাকে বলে, টাইগ্রিসের ধারে একটা প্রাসাদ আছে জানিস?

-জী হ্যাঁ।

সেই প্রাসাদের এধারে একটা ফটক আর নদীর দিকে আরেকটা। ওই প্রাসাদের মালিক বসরাহর এক সওদাগর হাসান। তার বিবিকে আমার কাছে নিয়ে এসো একবার।

মাসরুর হাসানের প্রাসাদে যেতেই দ্বাররক্ষী খোজা সেলাম ঠুকে সরে দাঁড়ায়,

–বান্দাকে হুকুম করুন মালিক।

মাসরুর বলে, হাসানের মা কোথায়?

খোজা ওকে ভেতরে নিয়ে যায়। হাসানের মা ভয়ে কেঁপে ওঠে। খলিফার দেহরক্ষী মাসরুরকে সে চেনে। মাসুরুর বলে, আমি পয়গম্বর মহম্মদের চাচা আব্বাসের ষষ্ঠ পুরুষ খলিফা হারুন অল রসিদের চাচা কাসিমের কন্যা এবং খলিফার খাস পেয়ারের বেগম জুবেদার আজ্ঞাবহ নফর মাসরুর। তিনি আপনার পুত্রবধূকে নিয়ে যেতে হুকুম করেছেন। তাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে এখুনি।

হাসানের মা এবার আর্তনাদ করে ওঠে, আমরা এখানে বিদেশী বণিক। আমার একমাত্র ছেলে, সে-ই বাড়ির কর্তা, এখন বাড়ি নাই। দূরদেশে বাণিজ্যে গেছে। বিদেশ যাওয়ার আগে সে আমাকে বার বার বারণ করে গেছে, ঘরের বিবিকে যেন বাইরে না বের করি। এমন কি আমিও যেন তাকে নিয়ে বাইরে না যাই, তা সে যে কারণেই হোক। আমার ডর লাগছে, সে যদি বাড়ির বাইরে যায় তাহলে তার ঐ রূপ-যৌবন অনর্থ ঘটাবে। আর কোনও কারণে যদি অঘটন কিছু ঘটে যায়, ছেলে আমার আত্মঘাতী হবে। এই কারণেই আপনার কাছে আমার আর্জি মাসরুরজী, আমার এই অসহায় অবস্থা বিবেচনা করে আপনি আমার ওপর একটু করুণা করুন। হাসান না আসা পর্যন্ত এই কটা দিন সবুর করে থাকুন। ও আসুক, তারপর যতবার খুশি নিয়ে যাবেন ওর বিবিকে। আমি একটুও আপত্তি করবো না।

মাসরুর বলে, আপনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হবেন না মালকিন, আপনার পুত্র বধূর কোনও তখলিফ হবে না। আমাদের বেগমসাহেবা শুধুমাত্র একবার দেখতে চেয়েছেন তাকে। কারণ, তিনি শুনেছেন, তার মতো পরমাসুন্দরী কন্যা তামাম দুনিয়ায় আর দুটি নাই। সেইটাই পরখ করে দেখবেন তিনি নিজের চোখে। অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই। এমনও তো হয়, তাক লাগাবার জন্য অহেতুক বাড়িয়ে বলে অনেকে। বেগমসাহেবা এর আগেও আমাকে অনেক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার হুকুম করেছেন। এবং আমি তা তামিলও করেছি। তিনি কারো না কারো মুখ থেকে সেই সব মেয়েদের রূপগুণে অনেক রংদার বর্ণনা শুনেছিলেন এবং আমাকে হুকুম করেছিলেন তাদের হাজির করতে। আপনার পুত্রবধূকেও তিনি ঐ সব মেয়েদের মতোই স্বচক্ষে যাচাই করে দেখে নিতে চান মাত্র। আপনি নির্ভয়ে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিন ওকে। আমি কথা দিচ্ছি, যথাসময়ে আবার আমিই ফিরিয়ে দিয়ে যাবো তাকে। তার কোনও অনিষ্ট হবে না, হতে পারে না। আমি খলিফার দেহরক্ষী মাসরুর তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবো, দিয়ে যাবো।

হাসানের মা দেখলো মাসরুরকে আর বেশি কিছু বোঝাতে যাওয়া বৃথা। সে বাদশাহী হুকুমের তাঁবেদার। বেগম জুবেদা যখন নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে, কিছুতেই ছাড়বে না সে।

অন্দরে গিয়ে রোশনিকে বলে, মা, বেগম জুবেদা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। এখনি যেতে হবে। ভালো করে সেজে-গুজে নাও। আমি নাসির ও মনসুরকে সাজিয়ে দিচ্ছি। ওদের দু’টোকে নিয়ে মাসরুরের সঙ্গে তুমি প্রাসাদে চলে যাও। আচ্ছা চলো, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

আগে আগে পথচারীদের হট যাও হট যাও’ করতে করতে মাসরুর চলো। দুই নাতিকে কোলে করে নিয়ে তার পিছনে পিছনে চলে হাসানের মা। এবং মোটা কাপড়ের বোরখায় আপাদ-মস্তক আবৃত করে রোশনি চলে সব পিছনে।

খলিফার প্রাসাদে পৌঁছে মাসরুর ওদের নিয়ে আসে বেগম জুবেদার খাসমহলে। বেগমসাহেবা তখন তার তখতে আরাম করছিলো। রোশনির কোলে শিশু-সন্তান দুটিকে তুলে দিয়ে হাসানের মা আভূমি আনত হয়ে বেগম সাহেবাকে কুর্নিশ জানায়। জুবেদা হাত বাড়িয়ে তাকে আশীর্বাদের ভঙ্গী করে। রোশনিকে কাছে ডাকে, এদিকে কাছে এসো বাছা। শরম করার কি আছে, এখানে তো কোনও পরপুরুষ নাই। বোরখা নাকাব খুলে ফেলল।

তুহফাঁকে সে ইশারা করতে সে এসে রোশনির বোরখা খুলে সরিয়ে নেয়। রোশনির রূপের আলোয় জুবেদার মহল ঝলমল করে ওঠে। জুবেদা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোশনির মুখের দিকে। তুহফা বাড়িয়ে বলেনি কিছু। সত্যি, এমন অলৌকিক রূপলাবণ্য সে আগে দেখেনি কখনও। বিধাতা পুরুষ কী ভাবে এমন নিখুঁত সুন্দর নারী সৃষ্টি করেছিলেন সেই কথাই ভাবতে থাকে জুবেদা।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সাতানব্বইতম রজনী?

আবার সে বলতে শুরু করে :

অনেকক্ষণ পরে জুবেদা নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে। তখত ছেড়ে উঠে এসে সে রোশনির গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে, চুমু খায়, সোহাগ জানায়। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে তখতে নিজের পাশে বসায়। গলায় পরিয়ে দেয় নিজের গলার সাতনরী মুক্তোর মালাখানা।

এই হারটা এক সময় অল রসিদ পরিয়ে দিয়েছিলেন জুবেদাকে।

–তুমি আমার সারা মুলুকের গৌরব। আমার ছোট্ট বাঁদীটা তোমার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে একটা জায়গায় মস্ত ভুল করেছে, রোশনি। তোমার এ রূপ তো কোনও ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, বাছা। আচ্ছা এবার বলো নাচ গান কিছু জান তুমি? নিশ্চয়ই জান। তোমার মতো রূপবতী কন্যার সব গুণই থাকা সম্ভব।

রোশনি বলে, বিশ্বাস করুন, বেগমসাহেবা, আমি ও-সব কিছুই জানি। না গান, না নাচ। সাধারণতঃ মেয়েরা যে সবগুলোর অধিকারী হয় তার কিছুই আমার জানা নাই। শুধু একটা জিনিস খুব ভালো জানি, আসমানে পাখীর মতো উড়ে বেড়াতে পারি।

-বাঃ এ তো ভারি অদ্ভুত।

জুবেদা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকায় রোশনির দিকে। বলে, শুনেছি জিন-পরীরা ডানামেলে শূন্যে উড়ে বেড়ায়। তা তুমি ডানা ছাড়া উড়বে কী করে? ডানা ছাড়া নয় বেগমসাহেবা, ডানা আমার আছে। কিন্তু এখন আমার কাছে নাই, আমার শাশুড়ির হেপাজতে আছে। আপনি যদি দেখতে ইচ্ছা করেন, তবে এঁকে বলুন, তিনি যদি আমার ডানার খোলসটা এনে দেন আমি আপনাকে আমার আকাশে ভেসে বেড়ানোর খেলা দেখাতে পারি।

জুবেদা বৃদ্ধার দিকে তাকায়, বুড়িমা, ঐ পালকের খোলসটা একবার এনে দাও তো ওকে। আমি ওর আকাশে ওড়া দেখবো।

বৃদ্ধা শিউরে ওঠে, এইবার সব গেলো! মনে মনে ভাবে সে। একবার মুক্ত আকাশে উড়লে ও কী আর এই ইট-পাথরের শহরে ফিরে আসবে? ইয়া আল্লা, একি মুসকিলে ফেললে আমাকে। এখন আমি কী করি। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে, বাছা আমার আপনাকে দেখে ঘাবড়ে গেছে। কী যে আবোল বোল সব বকতে শুরু করেছে বুঝতে পারছি না। ভাবছি, ওর মাথাটাই বুঝি খারাপ হয়ে গেলো। কোনও মানুষ কী কখনও ডানা পাখা পরে উড়তে পারে, না ডানা পাখা কারো থাকে?

কিন্তু রোশনি বাধা দিয়ে বলে, আমি আপনার নামে কসম খেয়ে বলছি বেগমসাহেবা, আমার পাখার খোলসটা আমাদের প্রাসাদেরই কোনও স্থানে লুকানো আছে।

জুবেদা এক জোড়া মণি-রত্ন খচিত মহামূল্যবান বালা তুলে দেয় হাসানের মার হাতে। প্রায় ঘুষ বলা যায়।

—আর দেরি করো না, বুড়ি মা, শিগ্নির যাও। খুঁজেপেতে নিয়ে এসো ঐ খোলসটা। আমরা তোমার ছেলের বিবির মজার খেলা দেখবো। তারপর আবার তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো এক্ষুনি। যাও, আর দেরি করো না।

কিন্তু হাসানের মা কিছুতেই কবুল করে না। বলে, আপনি বিশ্বাস করুন বেগমসাহেবা, সে জিনিস আদৌ আছে কিনা, বা থাকলে কোথায় আছে—আমার জানা নাই।

জুবেদা মাসরুরকে ডাকে। মাসরুর হাসানের বাড়ি চলে যাও। সারা প্রাসাদ তন্ন করে তলাসী করে দেখ একটা পাখীর ডানার খোলস কোথাও আছে কিনা। খুঁজে পেলে আমার কাছে নিয়ে এসো।

মাসরুর ছুটলো হাসানের প্রাসাদে। অবশ্য যাবার আগে হাসানের মা-এর কাছ থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে যেতে ভুললো না সে।

সারা প্রাসাদ ছুঁড়ে সে বের করলো সেই খোলসখানা। হাসানের মায়ের পালঙ্কের তলায় একটা বাক্সের মধ্যে লুকানো ছিলো।

জুবেদা বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে সেই শশাঙ্কশুভ্র পাখীর পালকের খোলস-খানা নেড়ে চেড়ে দেখলো। ভিতরে কোনও অলৌকিক যন্ত্রপাতি কিছু নাই। নেহাতই বাহারী একখানা মুখোশ জাতীয় খেলনা মাত্র।

দেখা শেষ হলে সে রোশনির হাতে দিয়ে বললো, নাও এবার দেখাও দেখি তোমার ভেল্কিবাজী। আমার তো বাপু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না—

রোশনি খোলসখানা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে পরীক্ষা করে। নাঃ, অবিকল সেই রকম আছে। যেমনটি সে খুলে রেখেছিলো পুকুরপাড়ে, ঠিক সেই রকম।

চোখের পলকে পরে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। পাখা দু’খানা আলতোভাবে নাড়তে নাড়তে মেঝে থেকে অল্প উঁচুতে হাওয়ায় ভর করে চারপাশে ঘেরা হারেমের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি কয়েকেবার ঘুরে বেড়ায়। তারপর ছোঁ-মেরে ছেলে দুটিকে তুলে নেয় দুই হাতে। আবার সে ঘুরতে থাকে-এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি।

জুবেদা হতবাক হয়ে এই অভাবনীয় আশ্চর্য কাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে থাকে। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। ভাবে, স্বপ্ন দেখছে না তো। জ্ঞে কে। কিন্তু স্বপ্ন তো অনেকে মিলে দেখা যায় না।

রোশনি বলে, এই দেখুন বেগমসাহেবা, ছেলে কোলে মাথা নিয়ে কেমনভাবে আমি উড়ে বেড়াচ্ছি। উড়তে উড়তেই ওদের আদর সোহাগ করছি, মাই দিচ্ছি কেমন দেখুন।

একটুক্ষণ পরে আরও খানিকটা ওপরে ছাদ বরাবর উঠে যায় রোশনি। সবাই মাথার ওপরের দিক করে একভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকে রোশনির খেলা। হঠাৎ সে অনেক ওপরের খোলা জানালা দিয়ে গলে প্রাসাদের বাইরে চলে যেতে যেতে বলে, বিদায় বেগমসাহেবা, আমি চললাম—চির বিদায়।

হাসানের মাকে বলে, মা আপনার ছেলেকে বলবেন যদি ইচ্ছা হয় ওয়াক ওয়াক দ্বীপে আমার সঙ্গে সে দেখা করতে পারবে।

-রোশনি-রোশনি, শোনো ফিরে এসো!

একটানা চিৎকার করতে থাকে জুবেদা। একি হলো, মেয়েটা ধোঁকা দিয়ে কেটে পড়লো। তবে তো হাসানের মার আশঙ্কা মিথ্যে নয়। হায় হায়, একি হলো—একি করলাম আমি? এখন এই বুড়ি আর ছেলের কী দশা হবে। না না, আর ভাবতে পারে না সে।

-হাসানের মা, তোমাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নাই আমার। আমি তোমার কাছে চির-কালের মতো অপরাধী হয়ে গেলাম। ছি ছি ছি, একী করলাম? আজ থেকে তোমার জীবনে যে নিদারুণ বিয়োগ ব্যথা নেমে এলো, তা আর কী করে সারাববা আমি। আমার খেয়াল-খুশি মেটাতে গিয়ে তোমাদের সর্বনাশ করলাম। এ পাপ আমি রাখবো কোথায় বুড়ি মা?

হাসানের মার কানে এ সব কথা কিছুই ঢুকলো না। রোশনি জানলার মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতেই সে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়েছিলো। অনেকক্ষণ পর যখন সে সম্বিত ফিরে পেলো, দেখলো রোশনি নাই, তার দুই নাতিও নাই।

রোশনি যে সুযোগ পেলেই পালাবে তা সে কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলো। কিন্তু কোনও ভাবেই সে সুযোগ করতে পারছিলো না। আজ জুবেদা বেগমের হঠকারিতায় সব পণ্ড হয়ে গেলো। এমন বেইমান মেয়েটি, যাবার সময় দুধের বাছা—তার আদরের ধন নাসির আর মনসুরকেও তুলে নিয়ে চলে গেলো? হাসান-তার একমাত্র সন্তান, এই শোকতাপ কী করে সহ্য করবে সে। রোশনির শোকে তো সে সারা হয়ে যাবেই, সেই সঙ্গে পুত্রশোকও কী কম দহন করবে তাকে?

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো আটানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

জুবেদা বলে, হাসানের মা, তুমি আমাকে আগে বললে না কেন, তোমার ছেলে একটা জিন-পরীকে শাদী করে নিয়ে এসেছে? তাহলে আমি তাকে এভাবে পালাবার সুযোগ দিতাম না। আমি বুঝতে পারিনি আগে ওর এই মতলব ছিলো, তাহলে এই ঘটনা কিছুতেই ঘটতে না।

হাসানের মা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, দোষ কারো নয় বেগমসাহেবা, দোষ আমার নসীবের। ভাগ্যে যা লেখা আছে তা এড়াবো কী করে? যাক, এখন আমি শুধু ভাবছি, হাসান ফিরে এলে এই দুঃসংবাদে তাকে জানাবো কী করে?

মনের দুঃখে ঘরে ফিরে যায় হাসানের মা। বাড়ির আঙ্গিনায় তিনটি তাজিয়া বানিয়ে তার সামনে বসে সারা দিনরাত চোখের জল ফেলতে থাকে।

হাসান সপ্তকন্যাদের সঙ্গে তিনটি সুখের মাস অতিবাহিত করে একদিন বাগদাদে ফিরে আসে। আসার সময় মেয়েরা দশটি উটের পিঠে সোনাদানা হীরে জহরত বোঝাই করে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়।

বাড়িতে এসেই সে প্রথমে রোশনি এবং পরে পুত্র দুটির সন্ধান করে। কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে রোরুদ্যমানা মাকে জিজ্ঞেস করে, মা আমার রোশনি কোথায়?

মা এ কথার কী জবাব দেবে। হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে, বাবা আমাদের কপাল ভেঙ্গেছে, রোশনি ছেলে দুটোকে নিয়ে উড়ে পালিয়ে গেছে।

হাসান উন্মাদের মতো মায়ের ঘরে ছুটে যায়। খাটের তলায় বাক্সটা খোলা পড়ে আছে। খোলসটা নাই, এবার সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে। ঘরের এক কোণে একখানা তলোয়ার রাখা ছিলো, সে-খানা তুলে নিয়ে ছুটে আসে আঙ্গিনায়।

-মা এ জীবন আমি আর রাখবো না।

মা হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, অমন কাজটি করিসনে বাছা। তুই আমার বুকের কলিজা, একমাত্র দুলাল। এইভবে আত্মঘাতী হলে আমি তো আর একদণ্ড বাঁচবো না। বাবা, সোনা আমার, মাথাটা ঠাণ্ডা কর। চলো, ঘরে চলো। সব আশাই,গেছে, তবু তার মধ্যে একটুখানি ভরসা সে দিয়ে গেছে, বাবা! উড়ে চলে যাবার সময় সে একটি মাত্র কথা বলে গেছে, হাসান যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, ওয়াক ওয়াক দ্বীপে গেলে দেখা হবে।

রজনী প্রভাত হয়ে আসে, শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো নিরানব্বইতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

এই নিদারুণ দুঃখের মুহূর্তে হাসান যেন একটু আশার আলো দেখতে পায়।

—মা, আমি যাবো সেই ওয়াক ওয়াক দ্বীপে। কোথায় সে দ্বীপ আমি জানি না, তবু আমি যাবো। নাম শুনে মনে হচ্ছে, দ্বীপ-এ শুধু পাখীরাই থাকে। হয়তো বহু দুরদেশে সিন্ধু কিংবা চীন, পারস্য ভারতের কোনও দুরধিগম্য সমুদ্রের ওপারে। তা হোক, যেখানেই হোক, যত দূরেই হোক, আমি যাবো। পথের নিশানা আমি জানি না। কিন্তু নিশানা আমি পাবো। আমার সাতবোনরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে এই দ্বীপের ঠিকানা। আমি আর দেরি করবো না, মা। এখনি মেঘমালা পাহাড়ে আবার চলে যাবো। মেয়েদের কাছ থেকে ওয়াক ওয়াক দ্বীপের ঠিকানা জেনে নিয়ে আমাকে যেতে হবে রোশনির সন্ধানে। রোশনি ছাড়া আমার বেঁচে থাকা

অসম্ভব। রোশনি বিহীন এ জীবন আমার কাছে একেবারে অর্থহীন।

হাসান সেইদিনই মেঘমালা পাহাড়ে আবার ফিরে আসে। মেয়েরা তো হাসানকে দেখে অবাক। আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে সকলে। কিন্তু হাসানের মুখে সেই দুঃসংবাদ শুনে সবাই চুপসে যায়। সবারই মুখ কালো হয়ে ওঠে। চোখে জল আসে। গুলাবী এগিয়ে এসে হাসানের কাঁধে হাত রাখে, নিজেকে শক্ত করো, ভাইজান। জীবনে সুখ যেমন আছে দুঃখেরও সীমা নাই। সবই সইবার শক্তিও তিনি দিয়েছেন। নিজেকে হারিয়ে দিও না। সময়ে সুবই সয়ে যায়, ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় একটা মারাত্মক ভুল করে বসলে, তা আর শুধরানো যায় না। সে ক্ষতি অপূরণীয়ই থেকে যায়।

হাসান অসহায় শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে, কিন্তু বোন, এ ব্যথা আমি সইবো কী করে? না না, সে আমি পারবো না। হয় রোশনিকে তোমরা ফিরিয়ে পাওয়ার উপায় বলে দাও, নয়তো এ জীবন আমি রাখবো না। রোশনি যাওয়ার সময় বলে গেছে, ওয়াক ওয়াক দ্বীপে গেলে তার সঙ্গে দেখা হবে। আমি জানি না, সে দ্বীপ কোথায়? কোন পথে যেতে হয়? কতই বা দূর। যাই হোক পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, আমি সেখানে যেতে চাই। তোমরা কী জান বোন, সেই ওয়াক ওয়াক দ্বীপের ঠিকানা?

গুলাবী বলে জানবো না কেন? সবই জানি। কিন্তু ঐ দ্বীপে তুমি যাবে কী করে ভাইজান? ওর চেয়ে তুমি যদি বলো বেহেস্ত যাবে, আমরা তোমাকে এক্ষুনি যেতে বলবো। কিন্তু ওয়াক ওয়াক দ্বীপ-সে তো মানুষের অসাধ্য!

গুলাবীর কথা শুনে হাসানের মনে যে ক্ষীণ আলোটুকু টিমটিম করে জ্বলছিলো, তাও মিলিয়ে যায়।

গুলাবী হাসানকে আদর সোহাগ করে ভোলাবার চেষ্টা করে। মন খারাপ করো না, ভাইজান। তুমি না পুরুষমানুষ, একটু শক্ত হও। ধৈর্য ধর। প্রবাদ আছে জানেনা তো-ধৈর্যই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা—ধৈর্য ধরে শান্ত ধীর ভাবে এগোতে পারলে একদিন লক্ষ্যে পৌঁছন সম্ভব। সুতরাং এই দারুণ দুঃখের দিনে ধৈর্য ধরে মাথা ঠিক রাখ। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বিবি বাচ্চাদের ফেরত পাওয়ার জন্য আমি আমার প্রাণ পণ করবো। এবং আশা করি, তোমার মুখে আবার হাসি ফোটাতে পারবো। কী দুর্ভাগ্য! তোমাকে আমি বার বার বলেছিলাম, অশুভের শেষ রাখতে নাই। তখনই যদি আমার কথামতো ঐ খোলসটাকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারতে তাহলে আজ এতো দুঃখ পেতে হত না। যাক, নসীবে যা আছে, কে আর এড়াবে বলল। এখন চেষ্টা করতে হবে যাতে এই দুঃখ বেদনার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। এই কথা বলার পর গুলাবী তার দিদিদের মিনতি করে, তোমরা সকলে মিলে যদি হাসানকে না বাঁচাও, সেই দুর্গম ওয়াক ওয়াক দ্বীপে তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা না করো তবে ভাইজান আমার প্রাণে বাঁচবে না, দিদি।

মেয়েরা ভরসা দেয়, ঠিক আছে বোন, আমরা সবাই মিলে প্রাণপণ চেষ্টা করবো, কথা দিচ্ছি।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শোতম রজনীতে আবার গল্প শুর হয়?

মেয়েদের এক চাচা আছে তিনি প্রতি বছর একবার করে এই মেঘমালা প্রাসাদে এসে ভাইঝিদের দেখে যান। সবাইকেই খুব পেয়ার করেন। কিন্তু তার মধ্যে বড় বোনকে একটু বিশেষ নেকনজরে দেখেন তিনি।

এই চাচার নাম আবদ অল কাদ্দুস। গতবারে তিনি যখন এসেছিলেন তখন বড় ভাইঝিকে একটি আতরের বাক্স উপহার দিয়ে যান তিনি। বলেছিলেন, এই আতর-এর অল্প একটুখানি তুলোয় মাখিয়ে যদি আগুনে ধরিয়ে দাও তবে তোমার ঈপ্সিত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে পারবে।

গুলাবী বললো, বড়দি তোমার সেই আতর একটুখানি দেবে? বড়বোন বলে, ওমা সে কি কথা, দেব না কেন? যা, আমার ঘরে আছে, নিয়ে আয়।

গুলাবী অতরের বাক্সটা নিয়ে এসে একটুকরো তুলোয় কয়েক ফোটা মাখিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক সুগন্ধে ভরে ওঠে। এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা তুষার-শুভ্র হাতীর পিঠে চেপে আকাশ পথ থেকে নেমে আসেন চাচা আবদ্ অল কান্দুস।

-এই যে মা সকল, আমি হাজির, বলো কী চাই?

বড়বোন চাচার পায়ে হাত রেখে বলে, কেন, শুধু দেখার জন্য আমরা স্মরণ করতে পারি আপনাকে? সেই এক সাল আগে এসেছিলেন আপনি। এতোকাল দেখিনি, মন খারাপ করছিলো, তাই আতরে আগুন দিয়েছি, চাচা।

চাচা প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। মৃদু হাসলেন।

—সে কথা ঠিক, বেটা। বছর ঘুরে এলো অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। আমিও ভাবছিলাম, দু একদিনেই আসবো। তা সে যাই হোক, এখন আসল ব্যাপারটা কী বলো তো, মা জননী? কেন ডেকে পাঠিয়েছ, এই বুড়ো ছেলেকে?

বড়বোন বলে, ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন চাচা, আপনি যখন জানতে চাইছেন, বলছি।

এরপর হাসানের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘনিষ্ঠতা, রোশনির সঙ্গে তার শাদী এবং সন্তান দুটি সহ রোশনির পলায়নের বিস্তারিত কাহিনী চাচাকে সে খুলে বলে।

—এখন চাচাজী, আমাদের এই ভাইটি রোশনির তালাশে ওয়াক ওয়াক দ্বীপে যেতে চায়। আমরা জানি, আপনি বলে দিতে পারেন তার নিশানা।

শেখ আবদ্ অল কাদ্দুস গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে কী সব আঁকিবুকি কাটলেন। এবং বার বার ঘাড় আন্দোলিত করে অস্ফুট স্বরে স্বগত ভাবে না না’ শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন।

-না, বেটা কোনও উপায় নাই। ওয়াক ওয়াক দ্বীপে পাঁচ হাজার কুমারী জিন-কন্যাদের বাস। এবং তারা সকলে সম্রাট জিনিস্থানের নারী-সেনা। তোমাদের ভাইটিকে বলো, বৃথা শোক করে নিজেকে ধ্বংস না করে সে যেন এই দুরাশা মন থেকে মুছে ফেলে। কোনও জনপ্রাণী এই দুর্গম দ্বীপে কখনও পৌঁছতে পারবে না। এই অবাস্তব অসম্ভব চেষ্টা করে কোন ফয়দা নাই।

গুলাবী অসহায় ভাবে শেষ চেষ্টা করে, কিন্তু চাচাজী, আমাদের ভাইটিকে একথা বলে শান্ত করা যাবে না। আপনি ওকে আরও বিশদভাবে একটু বুঝিয়ে বলুন!

চাচা এবার হাসানের দিকে তাকায়। হাসান ওঁর পায়ে হাত রাখে। হাসানকে আদর জানিয়ে চাচা বলেন, বেটা, বৃথা শোক করে নিজেকে শেষ করো না। শান্ত মাথায় ভাবো। শোক নিয়ে, চিরকাল কেউ বসে থাকে না। সময়ে একদিন সে সয়ে যায়ই। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত অনেকে টিকে থাকতে পারে না। আমি বয়সে প্রবীণ, অনেক দুঃখ তাপ সকলের জীবনে যেমন আসে আমার জীবনেও এসেছিলো। কিন্তু তাদের জন্য দগ্ধ হয়ে যদি নিজেকে নষ্ট করে ফেলতাম তবে আর আজ তোমার সামনে বসে এই উপদেশ দিতে পারতাম না। শুধু একটা কথা মনে রেখ বাবা, নিজের ব্যথাটাই সবচেয়ে বড় করে দেখ না। তোমার চেয়ে আরও বেশি ব্যথিত মানুষ এই দুনিয়ায় আছে। তাদের কথা ভেবে নিজের দুঃখটা ঈষৎ হাল্কা করার চেষ্ট করো।

চাচা বলতে থাকেন, যত চেষ্টা করো কোনও ভাবেই তুমি সেই ওয়াক ওয়াক দ্বীপে পৌঁছতে পারবে না। এবং সে চেষ্টাও কোরো না। তার ফল শুভ হবে না। এমন কি যদি ডানালা জিন আফ্রিদিদের এক বিশাল বাহিনীরও সাহায্য পাও; তবুও আমি বলছি, ওখানে যেতে পারবে না তুমি। এই ওয়াক ওয়াক দ্বীপ তোমার শ্বশুর জিনিস্থান-সম্রাটের অত্যন্ত সুরক্ষিত অঞ্চল। এখান থেকে ওয়াক ওয়াকের দুরত্বটা একবার শোনো : সাতটা দুস্তর সমুদ্র পার হতে হবে। তারপর সাতটা মহাদেশ, এবং সাতটা অত্যুচ্চ গিরি পর্বতমালা অতিক্রম করে যেতে হবে সেই দ্বীপে। পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তের ওপারে মহাশূন্য ছাড়া আর কিছু নাই। আমি মনে করি না, তুমি এই দুর্লঙ্ সমুদ্র প্রান্তর গিরি পর্বত পার হয়ে সেখানে পৌঁছতে পারবে কখনও। যদিও পারও, তবু ওয়াক ওয়াক দ্বীপের সুরক্ষা ভেদ করতে পারবে না কিছুতেই। তাই বলছি, বাবা ঐ দুরাশা ত্যাগ করে তোমার বোনদের সঙ্গে হেসে খেলে এখানেই দিন কাটাও।

হাসানের মুখ ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে যায়! এবং মুহূর্ত মধ্যেই এক বিকট আর্তনাদ তুলে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মেয়েরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সাজপোশাক ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলে।

হাসানের যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তখন দেখে, গুলাবীর কোলে মাথা রেখে সে শুয়ে আছে। আর অন্য মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে কেউ হাওয়া করছে, কেউ বা চোখে মুখে গোলাপ জলের ঝাপটা দিচ্ছে।

চাচা আবদ অল কাদুসের করুণা হয়। মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলে, তোমরা শান্ত হও মা, এই সময়ে শোকার্তকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে যদি নিজেরাই ভেঙ্গে পড় তা হলে ওর কী দশা হবে?

এই বলে তিনি হাসানের কাছে এগিয়ে আসেন। মাথায় হাত রেখে বলেন, চুপ কর বেটা, চুপ কর। তুমি পুরুষমানুষ, তোমার চোখে পানি শোভা পায় না। ওঠ, আমার সঙ্গে এসো। দেখি কি করা যায়।

প্রায় জোর করেই তিনি হাসানকে উঠিয়ে নিয়ে হাতীর পিঠে চেপে বসেন।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো একতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

মেয়েরা হাসিমুখে বিদায় জানালো। ওদের মনে আশা জেগেছে, চাচা যখন একবার ভরসা দিয়েছেন নিশ্চয়ই একটা কিছু ব্যবস্থা তিনি করবেন।

হাতীটার কানে কী যেন ফিসফিস করে বললেন চাচা। আর সঙ্গে সঙ্গে শোঁ শোঁ করে ঊধ্বাকাশে উঠে যেতে লাগলো সে। তারপর মহাশূন্যে উঠে গিয়ে এক পলকের জন্য নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে এবং পর মুহূর্তেই উল্কার গতিতে ছুটে চলতে থাকলো।

একটানা তিনি দিন তিন রাত্রি চলার পর অনেক সমুদ্র গিরি নদী প্রান্তর পার হয়ে চলে এলো তারা পৃথিবীর অপর প্রান্তে অদ্ভুত অজানা এক বিচিত্র দেশে। চাচা বললেন, এই তিন দিনে আমরা যে পথ পার হয়ে এলাম তা সাধারণ মানুষের কত দিনের পথ, জান?

হাসান বলে, অনুমান করতে পারবো না, চাচা।

সাত বছর ধরে যদি চলতে থাকো, তবেই এখানে এসে পৌঁছতে পারো। সেই পথ আমরা এলাম মাত্র তিন দিনে।

একটা গাঢ় নীলবর্ণের পাহাড়ের চুড়ায় এসে থামলো হাতীটা। এই পাহাড়ের উপত্যকায় একটি বিশাল গুহা দেখতে পেলো হাসান। গুহার মুখে একখানা লোহার দরজা। দরাজর রঙও গাঢ় নীল। ভেতর থেকে বন্ধ। বৃদ্ধ গিয়ে টোকা দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটা নিগ্রো। তার হাতে ধরা ছিলো একখানা নীলবর্ণের ঢাল এবং তলোয়ার। কোনও কিছু ভাববার বা বলার সুযোগ না দিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রহাতে নিগ্রোটার হাত থেকে তিনি ছিনিয়ে নিলেন তলোয়ারখানা। নিগ্রোটা সসম্রমে পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। হাসানকে নিয়ে চাচা ভিতরে ঢুকে গেলেন। নিগ্রোটা দরজা বন্ধ করে দিলো।

ওরা তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। আশে পাশে স্বচ্ছ নীল পাহাড়ের দেওয়াল। তার ভিতর দিয়ে নীল আলো এসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো সিঁড়ির পথ।

এইভাবে নিচে নামতে নামতে এক সময়ে ওরা দুটি বিরাট ফটকের সামনে এসে হাজির হয়। ফটকের দরজা ভারি সোনার পাতে গড়া। এর একখানা দরজা খুলে ফেললেন আবদ অল কাদ্দুস। এবং ভিতরে ঢুকে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যেতে যেতে হাসানকে উদ্দেশ করে বলে গেলেন, যেমন দাঁড়িয়ে আছ, তেমনি দাঁড়িয়ে থাক, একদম নড়াচড়া করবে না। আমি ফিরে আসছি।

প্রায় এক ঘন্টা পরে একটি নীল রঙের ঘোড়ায় লাগাম ধরে ফিরে এলেন তিনি। বললেন, উঠে বসো।

এরপর অন্য ফটকের দরজা খুলে ফেললেন। হাসান তাকিয়ে দেখে, দূর নীল দিগন্ত বিস্তৃত এক শস্য শ্যামল প্রান্তর। কোথায় যে তার শেষ, কিছুই অনুমান করা সম্ভব নয়।

বৃদ্ধ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন, বেটা,প্রস্তুত থেকো, যে কোনও মুহূর্তে প্রাণ সংশয় বিপদ ঘটে যেতে পারে। আর যদি মনে করো, এখনও সময় আছে, তোমার সাত বোনের কাছে ফিরে যেতে পারো।

হাসান বলে, যাই ঘটুক, মৌৎ যদি আসে আসুক—আমি ফিরবো না, চাচা।

বৃদ্ধ বললেন, বাবা বাড়িতে তোমার বুড়ো মা আছেন, এই বয়সে পুত্রশোকে কেঁদে ভাসাবেন তিনি—সেটা কী সন্তান হয়ে তোমার ভাবা উচিত নয়? আমি বলি কি, এই মৃত্যুর গুহায় না ঢুকে তার চেয়ে মা-এর ছেলে মা-এর কোলে ফিরে যাও। তোমাকে পেয়ে আবার তার মুখে হাসি ফুটে উঠবে। কী বলে?

হাসানের সেই এক কথা, আমার বিবি বাচ্চাদের না নিয়ে আর তার কাছে ফিরে যাবো না, চাচা।

আবদ অল কান্দুস আর বেশি বোঝাবার চেষ্টা করলেন না। একখানা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই খৎখানা সঙ্গে রাখ।

ঘন নীল কালিতে চিঠিখানার ওপরে নাম লেখা ছিলো ‘সেখ-এর গুরু সেখ আলী আমাদের পরম শিক্ষাগুরু সদাশয় মহামতি পালক-পিতা’–

চাচা বললেন, তা হলে ঠিক আছে, হাসান, এবার আমার ফেরার পালা। তোমাকে একাই যেতে হবে। আল্লাহর নাম করতে করতে এগিয়ে যাও। তারপর নসীবে যা আছে, হবে। তোমাকে কিছু নিশানা বাতলাতে হবে না, এই ঘোড়া যেদিকে যেখানে নিয়ে যায় সেইদিকেই যাবে তুমি। চলতে চলতে এক সময় এক কালো পাহাড়ের সামনে গিয়ে হাজির হবে। সেই পাহাড়ের চূড়াটাও দেখতে ভীষণ কালো। পাদদেশে দেখবে একটা গুহা। ঘোড়া থেকে নেমে পড়বে। এবং জিন লাগামশুদ্ধ একে ঢুকিয়ে দেবে ঐ গুহার অভ্যন্তরে। তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে বাইরে—গুহার মুখে। একটুক্ষণ পরে একজন মিশমিশে কালো মানুষ এসে দাঁড়াবেন তোমার সামনে। তিনি দেখতে যেমন আবলুস-কালো; তাঁর সাজপোশাকও তেমনি কাঠ কয়লার মতো ম্যাটমেটে কালো। অঙ্গের অন্যান্য আবরণ-আভরণ সবই কালো। শুধু তার আজানুলম্বিত দাড়িগুলো দেখবে শাঁখের মতো সাদা। তার হাতে চুম্বন করবে তুমি। এবং ওর পোশাকের একপ্রান্তে মাথা ঠেকাবে একবার। এরপর এই চিঠিখানা তুলে দেবে তার হাতে। তোমার সম্বন্ধে এতে সুপারিশ করা আছে। এই কৃষ্ণকায় বৃদ্ধই সেই সদাশয় মহামতি পালকপিতা। আমার ওস্তাদ—শিরোমণি। মনে রেখ, তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তোমার সকল ইচ্ছা পূরণ করে দিতে পারেন। সেই কারণে তাকে খুশি করে তার প্রিয়ভাজন হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে তোমাকে। তিনি যা যা বলেন, গভীর মনোেযোগ দিয়ে তা শুনবে এবং সেইভাবে চলবে। আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন।

আবদ অল কদুস বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসান বুঝতে পারলো, ঘোড়াটা একবার গা-ঝাড়া দিয়ে শোঁ-শোঁ করে ওপরে উঠে তারপর তীরগতিতে ছুটে চলতে। থাকলো।

দশদিন ধরে ঘোড়ার লাগাম ধরে রইলো হাসান। উল্কার মতো একটানা ছুটে চলেছে সে। কোথায় কতদূরে এবং কোন পথে সে চলেছে, জানে না, জানতে চায়ও না। কারণ, চাচা গেছেন, ঘোড়াকে চালাতে হবে না। শুধু লাগাম ধরে বসে থাকবে। যেখানে যাবার সেখানেই ও যাবে।

অবশেষে সেই কৃষ্ণ পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামে ঘোড়াটা। হাসান দেখলো পাহাড়ের শিখরে ঘোরতর কৃষ্ণকালো অন্ধকার। একদিকে একটা গুহা। তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। জিন লাগামসহ ঘোড়াটাকে গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো।

প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলো। চাচার বর্ণিত সেই কৃষ্ণকায় বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন। তার তুলোর মতো সাদা দাড়িগুলো জানু পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো দুইতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

এই বৃদ্ধই সদাশয় মহামতি পালক-পিতা শেখ আলী–পয়গম্বর সুলেমানের বিবি বিলকিসের পুত্র। হাসান নতজানু হয়ে বৃদ্ধের হাতে চুম্বন করে। তারপর ওঁর পোশাকের এক প্রান্তে মাথায় ঠেকায়, এবং চিঠিখানা হাতে তুলে দেয়। বৃদ্ধ নীরবে চিঠিখানা গ্রহণ করে গুহার অভ্যন্তরে চলে যান।

হাসান আশায় আশায় দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। শেষে প্রায় হতাশ হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ আর ফেরেন না। আরও অনেক সময় কেটে যায়। আবার তিনি ফিরে এলেন। এবার তার সারা সঙ্গের আবরণ আভরণ সব সাদা।

তাকে অনুসরণ করে ভিতরে আসতে ইশারা করলেন হাসানকে।

গুহার অভ্যন্তরে চার দেওয়ালে ঘেরা বিরাট একখানা কামরায় এসে দাঁড়ালো হাসান। সেই ঘরের চার কোণে বলেছিলো চারজন বৃদ্ধ। ওদের সকলেই একই রকম কালো পোশাক পরিহিত। প্রত্যেকের সামনেই স্থূপীকৃত পাণ্ডুলিপি এবং একটি করে ধূমায়িত সুবর্ণ ধূপদানী। ধূপের সুগন্ধে সারা ঘর ভরপুর হয়ে উঠেছিলো। ওদের সামনে আরও সাতজন শিষ্য বসে বসে তুলট কাগজে কী যেন লিখে চলেছিলো এক মনে।

পালক-পিতা যখন ঘরে ঢুকলেন, ওরা সকলে সসম্রমে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালো তাঁকে। চার কোণের সেই চার বৃদ্ধ ব্যক্তিও উঠে এসে ঘরের মাঝখানে রক্ষিত আসনে পালক-পিতার পাশে বসলো। সকলে যে যার আসন গ্রহণ করার পর শেখ আলী হাসানকে বললো, এবার তোমার যা বলার, বলো।

হাসান কী বলবে, যতবারই শুরু করতে যায়, চোখে জল ভরে আসে। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একটুক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিতে পারে সে। জীবনের আগাগোড়া সমস্ত ঘটনাই সবিস্তারে মেলে ধরে ওঁদের সামনে। কী ভাবে পারসী জালিয়াতটা তাকে বিভ্রান্ত এবং মেঘমালা পর্বত শিখরে নিয়ে যায়, কী ভাবে তার ওপর সে পাশবিক অত্যাচার করে বিকৃত কামনা চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়, আত্মরক্ষার জন্য কি ভাবে তাকে পাহাড় চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে হাসান হত্যা করে, তারপর সপ্তকন্যার সঙ্গে পরিচয়, রোশনির সঙ্গে তার শাদী, সন্তান লাভ এবং তার পলায়ন, পরিশেষে তাকে উদ্ধারের নিমিত্ত শেখ আবদ অল কাদুসের সঙ্গে এই অভিযানে আসা-সব আগাগোড়া খুলে বলে সে।

সকলে অবাক হয়ে শুনলো। এবং হাসান থামতে ওরা এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো, বেগম বিলকিসের যোগ্য সন্তান, আমাদের বিচারে এই যুবক দয়ার যোগ্য। কারণ, সে একদিকে স্বামী, এবং অপর দিকে পিতা হিসাবে নিদারুণ দুঃখ শোক ভোগ করছে। আমাদের উচিত ওর বিবি এবং বাচ্চাদের সন্ধান করে ওর হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।

প্রাজ্ঞ শেখ আলী বললেন, তোমরা বিশেষ বিজ্ঞ, কিন্তু একটা কথা কি জান, এই কাজটা যত সহজে বললে তত সহজে সমাধা করা কিন্তু সম্ভব হবে না। দুস্তর বাধা, বিস্তর বিপদ কাটাতে হবে। তোমরা নিশ্চয়ই জান, ওই ওয়াক ওয়াক দ্বীপে যাওয়া এবং সেখান থেকে কার্য সমাধা করে ফিরে আসা কত কঠিন কাজ। সবচেয়ে শক্ত সম্রাটের ঐ দুর্ধর্ষ পাঁচ হাজারী উড়ন্ত সৈন্যবাহিনী। ওরা দিনরাত অতন্দ্র পাহারা দিচ্ছে সম্রাট এবং তার কন্যাদের। এ হেন অবস্থায় তোমরা কী করে আশা করতে পার, রোশনির সঙ্গে হাসানের দেখা হওয়া সম্ভব হতে পারে!

শিষ্যরা বললো, আপনি যথার্থই বলেছেন, পিতা। কিন্তু আপনি তো জানেন, এই যুবককে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন আমাদেরই এক ধর্মভাই—আবদ অল কাদ্দুস। শুধু এই কারণেই আমরা এই দায়িত্ব এড়াতে পারি না কোনও মতে।

হাসান পালক-পিতার পা জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো।

—আপনিই একমাত্র পারেন, আমার বিবি বাচ্চাদের ফিরিয়ে দিতে।

পালক পিতা বিচলিত হয়ে ওঠেন। হাসানকে দু’হাতে তুলে ধরে বললেন, জীবনে আমি অনেক দেখেছি জেনেছি। কিন্তু এর মতো একজনকেও দেখিনি। বিবি বাচ্চাদের জন্য এই মহব্বত, তাদের উদ্ধারের জন্য মরাণাপন্ন বিপদ নিশ্চিত জেনেও এইভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করতে পারে, এ আমি ভাবতে পারি না। যাই হোক, পথ অতি বন্ধুর, তবু আমি কথা দিচ্ছি, আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

এর পর শেখ আলী প্রায় এক ঘণ্টা মৌন হয়ে রইলো। শিষ্যরাও তারা অনুগামী হলো। সারা ঘরময় বিরাজ করতে থাকলো এক নিঃসীম নীরবতা।

এক সময় মৌন ভঙ্গ করে পালক-পিতা বললেন, প্রথমে আমি সম্ভাব্য বিপদ কাটাবার জন্য একটা জিনিস দিচ্ছি। তার দীর্ঘ দাড়ির গোছা থেকে সবচেয়ে লম্বা একগাছি চুল ছিড়ে হাসানের হাতে দিয়ে বললেন, যখন বুঝবে মরণাপন্ন বিপদ, বাঁচার আর কোনও আশাই নাই, তখন এই চুল থেকে একটুখানি বের করে আগুন ধরিয়ে দেবে। তাহলেই তৎক্ষণাৎ আমি তোমার সামনে উপস্থিত হবো।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে!

 

ছয়শো তিনতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

বৃদ্ধ ওপরের গম্বুজ-এর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। হাতে তুড়ি বাজিয়ে কাকে যেন এত্তেলা দিলেন। এক আফ্রিদি এসে হাজির হলো সঙ্গে সঙ্গে। শেখ আলী জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী আফ্রিদি? ‘

-আমি দানাস ইবন ফাঁকতাস—আপনার দাসানুদাস, পরম-পিতা।

দানবের কানে কানে ফিস ফিস করে কী যেন বললেন তিনি। তারপর হাসানের দিকে মুখ ফিরিয়ে সকলকে শোনাবার মতো স্বরে বললেন, এই আফ্রিদির পিঠে চেপে বসো বেটা। এ তোমাকে আসমানের অনেক ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। খুব শক্ত করে ধরে থাকবে এর গলা। এ তোমাকে নামিয়ে দেবে শ্বেত কপূর দ্বীপে। সেখানে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে এ আবার ফিরে আসবে। কারণ তার ওপরে আর যাওয়ার এক্তিয়ার নাই এর। এরপর তোমাকে একা একা পার হতে হবে সেই কপূর দ্বীপের প্রান্তরভূমি। ওই দ্বীপ অতিক্রম করে সামনে আর একটা দ্বীপ দেখতে পাবে। তারই নাম ওয়াক ওয়াক দ্বীপ। তারপর আল্লাহ তোমাকে দেখবেন।

হাসান বৃদ্ধ শেখ আলী এবং তার শিষ্যদের কাছে বিদায় নিয়ে আফ্রিদি দানাস-এর কাঁধে চেপে বসলো।

মুহূর্ত মধ্যে মহাশূন্যে উঠে গেলো আফ্রিদি। তারপর বায়ুবেগে ধাবিত হতে থাকলো সেই শ্বেত কপূর দ্বীপের দিকে।

যথাসময়ে দানাস নামিয়ে দিলো হাসানকে। তারপর বললো, এই সেই কপূর দ্বীপ, এর ওধারে আমার যাওয়ার উপায় নাই। আপনি একাই যান। আমি চললাম।

সামনে চকচকে রূপোলী প্রান্তর। হাসান এগিয়ে চলে। চলতে চলতে এক সময় অনেক দূরে একটা তাবু দেখতে পায়। হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে চলে আসে। না তাবু নয়, ঘাসের শয্যায় শুয়ে পড়ে আছে এক বিশাল বিকট দৈত্য। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে হাসান। দৈত্যটার নিদ্রাভঙ্গ হয়। ক্রোধে আরক্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মেঘ-নিনাদের মতো গর্জন করে ওঠেন। সেই ভয়ঙ্কর আওযাজে হাসান চৈতন্য-লুপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায়। দৈত্যটা আলতোভাবে এক হাত দিয়ে ওর দেহটাকে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নেয়, আবার সে ছুড়ে দেয়, আবার লুফে নেয়। এইভাবে বার কয়েক লোফালুফির পর সে দু আঙ্গুলে ওর ঘাড়টা চেপে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে।

হাসানের পায়ের তলায় মাটি নাই। শূন্যে ঝুলেই হাত পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করতে থাকে, ওরে বাবা রে, গেলাম রে, ওগো কে আছ, বাঁচাও। ও বাবা, দৈত্য মহারাজ দোহাই তোমার—তোমাকে গড় করি বাবা, আমাকে মেহেরবানী করে ছোছড়ে দাও।

হাসানের এই কাকুতি মিনতি শুনে দৈত্যটার মুখে হাসি ফোটে, আরে এ তো বৃহৎ আচ্ছা গানেবালা চিড়িয়া। ভারি সুন্দর মিঠে তো এর বোল। সম্রাটের কাছে নিয়ে গেলে অনেক ইনাম মিলবে। ঠিক আছে তাই নিয়ে যাবো!

হাসানকে আলগোছে হাতের তালুর ওপর বসিয়ে দৈত্যটা আধ ক্রোশ লম্বা লম্বা পা ফেলে বন-বাদাড় ভেঙ্গে এগিয়ে চলে। এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে অনেক দূরে এক পাহাড়ের গুহায় চলে আসে। এই ওর সম্রাটের ডেরা-দরবার। এক শিলাখণ্ডকে মসনদ বানিয়ে তার উপর বসেছিলো দৈত্য-সম্রাট। চারপাশে ঘিরে বসেছিলো, ওর সাঙ্গ-পাঙ্গরা। প্রায় পঞ্চাশজন হবে। প্রত্যেকেই এক একজন ভয়ঙ্কর-দর্শন দানব। দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা সবদিকেই সমান—প্রায় পঞ্চাশ হাত হবে।

এই দেখুন মহারাজ, আমি আপনার জন্য এক আজব চিড়িয়া ধরে এনেছি। ভারি সুন্দর গান গাইতে পারে। গলার আওয়াজ বড় মিঠে।

দৈত্যটা হাসানের নাকে টোকা দিতে দিতে বলে, গাও মেরে বুলবুল। গাও।

দৈত্যের ভাষা হাসান কী করে বুঝবে। ফ্যালফ্যাল করে সে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। ভাবে এবার তার ইন্তেকাল এসে গেছে। ওরা ওকে মেরে খেয়ে ফেলবে। আকুল হয়ে সে কেঁদে ওঠে, কে আছ গো। রক্ষা কর, রক্ষা কর। ও বাবা গো ম’লাম গো–বাঁচাও গো—

ইনিয়ে বিনিয়ে সে কাঁদতে থাকে। এবং তাতেই কাজ হয়। সম্রাট হাসানের করুণ কান্নার অর্থ বুঝতে পারে না। কিন্তু ওর কণ্ঠের আওয়াজ বড় মধুর মনে হয় তার।

খোদা হাফেজ, খুব মজাদার—চমৎকার চিডিয়া তো! কোথায় পেলে? যাও এক্ষুণি আমার মেয়েকে দিয়ে এসো। মেয়ের খুব ভালো লাগবে। একটা খাঁচায় ভরে ওর ঘরের সামনে ঝুলিয়ে রেখে দিয়ে এসো। এর গান আর গলার কিচির-মিচির আওয়াজ শুনে মেয়েটা ভারি আনন্দ পাবে।

এই সময় ভোর হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো চারতম রজনী। আবার সে বলতে থাকে।

দৈত্যটা একটা খাঁচায় পুরলো হাসানকে। খাঁচার মধ্যে বসিয়ে দিলো দু’টো চাড়ি। একটায় জল, অন্যটায় দানা! আর দুখানা দোলনা। ভাবলো, চিড়িয়াটা নেচে নেচে গাইবে আর এ দোলনা থেকে লাফিয়ে ও দোলনায় গিয়ে বসবে। তারপর খাঁচাটাকে রাজকুমারীর পালঙ্কের শীর্ষে একটা আংটায় ঝুলিয়ে রেখে চলে গেলো।

হাসানকে দেখে রাজকুমারীর আর আনন্দ ধরে না। নানাভাবে ওর সঙ্গে সে নিজের ভাষায় কথা বলে মনের অভিব্যক্তি বোঝাবার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসান তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারে না। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না, মেয়েটা তাকে কোন কষ্ট দিতে চায় না। বরং হাবভাবে মনে হয়, আদর সোহাগই করতে চায় সে।

হাসান হাত পা নেড়ে মুখে অদ্ভুত আওয়াজ তুলে মনের ভাব বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু রাজকুমারী ভাবলো সে গান গাইছে। ওর গলার মিষ্টি স্বরে মুগ্ধ হয় সে।

হাসানকে তার এতোই ভালো লাগে যে, কোনও সময়ই তার কাছ ছাড়া হতে চায় না। সারাদিন সারারাত ধরে ওর সঙ্গে দুর্বোধ্য ভাষায় বক বক করে চলো, আদর সোহাগ ও তর্জন করে! হাসানেরও মন্দ লাগে না। সে-ও চোখের ভাষায় হাতের ঈশারায় তাকে মনের কথা বোঝাবার চেষ্টা করে। বিচিত্র সুরে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক আবোল তাবোল বকে। রাজকুমারীর কানে সে-সব আওয়াজ গান হয়ে বাজে।

হাসান কখনও কখনও উত্তেজিত বোধ করে। আকারে ইঙ্গিতে তার সঙ্গম সহবাস অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। এসব কথা বোঝার জন্য কোনও ভাষার প্রয়োজন হয় না। রাজকুমারীও সঙ্গসুখ পেতে উন্মুখ। কিন্তু বুঝতে পারে না, ঐ চড়ুই-এর মতো ছোট্টো একটা চিড়িয়াকে দিয়ে কী ভাবে রতিসুখ পাবে।

একদিন রাজকুমারী খাঁচা থেকে হাসানকে বাইরে বের করে। সাজপোশাক খুলে ফেলে স্নান করাতে যায়। হঠাৎ সে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে হাসানের নিরাবরণ নগ্ন দেহের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে। একি! এ তো পুরুষদের মতোই পুরুষাঙ্গ। শুধু আকারে অত্যন্ত ছোট একটা ধানি লঙ্কার মতো। ইয়া আল্লাহ, কোনও পাখীর এরকম হয় তাতে কখনও দেখিনি। এবার সে হাসানের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করে দেখতে থাকে। বাঃ একি, সবই তো পুরুষের মতো। এ তো বহুৎ আজব চিড়িয়া। হাসানের নগ্ন দেহখানা সে বাঁ হাতের তালুর ওপর বসিয়ে নেয়। হাসান একটি ছোট্ট চড়ুই-এর মতো ওর হাতের মধ্যে ছটফট করতে থাকে। রাজকুমারী লক্ষ্য করে, ধানি লঙ্কাটা ধীরে ধীরে ফুলে ঢপের আকার ধারণ করে।

এ কেমন পাখী? পাখীর মতো গান গায় বটে কিন্তু আর সবই তো এর আমাদের দানবদের মতো? রাজকুমারী ভাবে।

হাসানের অনাবৃত দেহে হাত বুলাতে থাকে সে। স্বভাবতই হাসান উত্তেজিত হয়ে ওঠে। রাজকুমারীর বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না। সে-ও রিরংসায় কাতর হয়।

রাজকুমারীর খুব একটা মন্দ লাগে না। যদিও চড়ুই-এর মতো একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। আরও খানিক সময় থাকতে পারলে হয়তো আরও ভালো লাগতে পারতো।

সেই থেকে হাসান রাজকুমারীর পোষা মোরগ হয়ে গেলো। যখন তখন সে হাসানকে বের করে আদর করে, সোহাগ করে, চুমু খায়, এবং সারা গায়ে হাত বুলায়! হাসান উত্তেজনায় কেঁপে ওঠে। কিন্তু রাক্ষস-কন্যা এক পলকেই ওকে অসাড় অবশ করে ফেলে।

এই রকম মজার খেলা চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। হাসানের মন্দ লাগে না। কিন্তু ওর আসল উদ্দেশ্যের কথা এক নিমেষের জন্য বিস্মৃত হতে পারে না। তার বিবি রোশনি, তার পুত্র নাসির আর মনসুরকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে।

কিন্তু এখানে এই রাক্ষসপুরীতে খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে রাজকুমারীর চোখে চোখে থাকলে তার মনস্কামনা সিদ্ধ হবে কী উপায়ে? তাকে যেতে হবে ওয়াক ওয়াক দ্বীপে। জিনিস্থান সম্রাটের সুরক্ষা থেকে লোপাট করে আনতে হবে ওদের।

হাসানের সঙ্গে সেই আশ্চর্য দামামা আর শেখ আলীর একগাছি চুল আছে। বিপদের দিনে কাজে লাগানো যেতে পারতো। হাসানের পোশাক পাল্টাবার সময় রাক্ষস-রাজকন্যার সে দুটো বস্তু ঐ কুর্তার জেব থেকে বের করে রাখা সম্ভব হয়নি। তা হলে সে সন্দেহ করতে পারতো। ঐ পোশাকের মধ্যেই সেগুলি রয়ে গেছে। পোশাক এখন রাজকুমারীর হেপাজতে। অনেক বার সে ঐ দামামা আর চুলের গাছিটা রাজকুমারীর কাছে ইশারা ইঙ্গিত করে ফেরত চেয়েছে। রাজকুমারী প্রতিবারই ভুল ভেবেছে—চিড়িয়া গরম হয়েছে। প্রতিবারই সে হাসানকে ঐ ভাবে ঠাণ্ডা করেছে। এখন সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, কী ভাবে কথাটা ওকে বোঝানো যায়, কী ভাবে আবার ফেরত পাওয়া যায় ও দু’টো অমূল্য সম্পদ।

একদিন রাতে রাজকুমারী হাসানকে খাঁচা থেকে বের করে তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আদর সোহাগ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। এই মওকায় হাসান আস্তে আস্তে উঠে তার পরিত্যক্ত পোশাকের ভেতর থেকে সেই দামামাটা আর শেখ আলীর দেওয়া চুলের গাছিটা বের করে

এক গাছি চুলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো পাঁচতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

সঙ্গে সঙ্গে গুহাগহুর কেঁপে ওঠে, পালক-পিতা আবির্ভূত হন। তার সর্বাঙ্গে কালো সাজপোশাক।

-কী চাও বেটা?

হাসান নতজানু হয়ে তার চরণ স্পর্শ করে বলে, দোহাই আপনার, জোরে কথা বলবেন। ও জেগে যাবে এবং আমাকে ঐ খাঁচায় ভরে ফেলবে।

শেখ ওকে হাতে তুলে নিয়ে অলৌকিক ক্ষমতাবলে গুহার বাইরে পাহাড়ের ওপরে চলে যায়। তারপর জানতে চান, কী ঘটেছে। তখন হাসান তার শ্বেত কপূর দ্বীপের এই বন্দীদশার কাহিনী ব্যক্ত করে তাঁকে।

শেখ আলী হাসানের ব্যভিচার-প্রক্রিয়া শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। বলেন, তোমার যদি এই করার ইচ্ছা থাকে তবে বাকী চুলগুলো তুমি আমাকে ফেরত দিয়ে দাও। তারপর তোমার যা প্রাণ চায় করতে পারো আমার কিছু বলার নাই। তবে জেনে রাখ, আমার দ্বারা আর কোনও সাহায্য পাবে না তুমি। তোমার নিজের হিম্মতে যদি কুলায় তুমি ওয়াক ওয়াক দ্বীপ থেকে বিবি বাচ্চাদের উদ্ধার করে দেশে নিয়ে যেও। আমার সাহায্য চেও না—পাবে না। আর যদি আমার ওপর তোমার ভরসা থাকে তবে এই সব ব্যভিচার তোমাকে ছাড়তে হবে। আমি তোমার বিবি বাচ্চাদের উদ্ধার করে দেব।

হাসান কেঁদে ফেলে, আপনি আমাকে মাফ করুন, প্রভু আমার বিবি বাচ্চাদের ফেরত নিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। আমার কাছে, এই দেখুন। একটা আশ্চর্য দামামা আছে, এর সাহায্যে আমি পরীর দেশে উড়ে যেতে পারি।

শেখ আলী বললেন, আমি চিনতে পেরেছি। এটা বাহুরামের কাছে ছিলো। সেও আমার এক শিষ্য—অগ্নি উপাসক ছিলো। সে-ই একমাত্র যে আল্লাহতে বিশ্বাস রাখতে পারেনি। কিন্তু এ দামামা ওয়াক ওয়াক দ্বীপে কোনও কাজে আসবে না। কারণ জিনিস্থান-সম্রাট তার এলাকার সব যাদু অকেজো করে রেখেছে। একমাত্র তার নিজের যাদুই সেখানে কাজ করতে পারে।

হাসান বলে, পয়গম্বরের বাণী : যার দশ সাল বেঁচে থাকার ওয়াদা ন’বছরের মাথায় তার ইন্তেকাল হয় না। যদি আমার নসীবে লেখা থাকে ঐ অজ্ঞাত দেশে প্রাণ যাবে। সেইজন্যে আপনার কাছে আমার আর্জি, আপনি আমাকে সঠিক পথ বলে দিন প্রভু। আমি তার থেকে বিচ্যুত হব না।

তখন পালক-পিতা হাসানকে বললো চোখ বন্ধ কর।

হাসান চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

—চোখ খোলো।

হাসান চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু কী আশ্চর্য, সামনে দাঁড়িয়েছিলো পালক-পিতা। নিমেষে তিনি অদৃশ্য হয়েছেন। আরও আশ্চর্য হলো হাসান এখন সে আর শ্বেত কপূর দ্বীপের রাক্ষসদের প্রাসাদ পাহাড়ের চূড়ায় নাই। সে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা অজানা এক দ্বীপের সমুদ্রের বেলাভূমিতে। যে দিকে নজর যায়, সারা সমুদ্র সৈকত ব্যাপী লক্ষ লক্ষ হাজার হাজার বহু বিচিত্র রঙের হীরে জহরত ছড়ানো।

কিন্তু সে দিকে বা নিজের দিকে নজর দেওয়ার পলকমাত্র সময় পেলো না হাসান। হাজার হাজার সাদা পাখীর ঝক নেমে এলো তার মাথার ওপর। কী বিরাট বিরাট সে-সব পাখী। এক একটা প্রায় মানুষের মতো দেখতে। সারা আকাশে ছেয়ে গেলো তারা, সূর্য ঢাকা পড়ে গেলো তাদের পাখার আড়ালে। চার দিকে নেমে এলো ঘন কালো অন্ধকার।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা হাসানের চারপাশে নেমে এসে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ওয়াক ওয়াক আওয়াজ তুলে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকলো।

হাসান বুঝলো, এই সেই ওয়াক ওয়াক দ্বীপ—সেই নিষিদ্ধ দেশ। পাখী গুলো তাড়া করে হাসানকে সমুদ্রে নামাতে চায়। কিন্তু হাসান দৌড়ে কাছেই একটা কুঁড়েঘরের মধ্যে আশ্রয় নিলো। ঘরটার মধ্যে একটা যুৎসই জায়গা খুঁজে বসতে যাবে, এমন সময় পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো। চারদিক থেকে গুম গুম আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো।

এমন সময় ধুলোর ঝড় উঠলো। অন্ধকার হয়ে গেলো দশদিক। সেই অন্ধকারের মধ্যে হাজার সৈন্যের ঢাল-তলোয়ার ঝিলিক মেরে উঠলো।

এরাই আমাজন সেনা! সম্রাটের নারী-সৈন্যবাহিনী। সকলেই সোনার ঘোড়ায় চেপে এসেছে। হাসানকে কুঁড়েঘরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরা লাগাম টেনে ঘোড়াগুলোকে পিছনের দিকে হঠাতে থাকে। তখন ওরা পিছনের পা ছুঁড়ে বালির পাহাড় তুলে মেয়েগুলোকে ঢেকে ফেলে। কিন্তু হাওয়ার দাপটে মূহূর্তে ধূলো বালি সরে সরে যায়। হাসান দেখলো, মেয়েগুলোর মুখ একেবারে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর।

ভোর হয়ে এলো! শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো ছয়তম রজনী :

আবার সে বলতে থাকে।

ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা চওড়া একটি মেয়ে ঘোড়া থেকে নেমে হাসানের দিকে এগিয়ে এলো। তার ইশারায় সব মেয়েই নিচে নেমে সার হয়ে দাঁড়ালো। ওরা সবাই ফুলের মতো সুন্দর।

লম্বা জাঁদরেল মেয়েটির মুখ সেনাপতির শিরস্ত্রাণ বর্মে ঢাকা ছিলো। হাসানের বুঝতে অসুবিধে হয় না, সে-ই এই নারী সেনাবাহিনীর প্রধান। কাছে আসতেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে ওর পা দু’খানা চেপে ধরলো, আপনি আমাকে রক্ষা করুন। আমি পরদেশী মুসাফির।

ভাগ্যের তাড়নায় এখানে এসে পড়েছি। আপনি আমাকে বাঁচান। যদি আমার দুঃখের কাহিনী শোনেন আপনার করুণা হবে। এমনি হতভাগ্য আমি, বিবি বাচ্চাদের খুইয়ে আজ দেশে দেশে ঘুরছি।

মেয়েটির কী মনে হলো। সে তার মুখের বর্ম সরিয়ে নিলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে হাসান ওর কুৎসিত কদাকার চেহারা দেখে ভয়ে আঁৎকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। এমন ভয়ঙ্কর বীভৎস কারো চেহারা হতে পারে, সে ভাবতে পারে না। নাকটা ব্যাঙির মতো, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটো কয়লার গুলের মতো গোল গোল। আকর্ণ বিস্তৃত মুখের হা, নিচের ঠোঁটটা অস্বাভাবিক রকমের ঝুলে পড়েছে। হাসান আর সহ্য করতে পারে না। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে। বৃদ্ধা সেনাপতি ভাবলো মনুষ্য-সন্তানরা হয়তো মুখ ঢেকে সম্মানীয়দের সম্মান দেখায়। হাসানের ব্যবহারে সে প্রীত হলো।

শোনো ছেলে, ভয় নাই, আমি তোমাকে ভরসা দিচ্ছি, কোনও সাজা দেব না। বরং তোমার যাতে কোনও বিপদ না হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। এখন নির্ভয়ে বলো তো, কে তুমি, কেনই বা এসেছ এই নিষিদ্ধ দেশে। আজ পর্যন্ত কোনও মানুষ এখানে আসার দুঃসাহস করেনি। তুমি জান না, এই ওয়াক ওয়াক সপ্তদ্বীপমালা, জীন-সম্রাট জিনিস্তানের সপ্তকন্যাদের সুরক্ষিত সাতটি রাজ্য। সম্রাটের কড়া নির্দেশ আছে, কোন বিদেশী—সে মানুষই হোক আর জীন আফ্রিদিই হোক, এই সাতটি দ্বীপের ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারবে না। যদি কেউ তার আদেশ লঙ্ঘন করে ঢোকার চেষ্টা করে, তবে কঠোর সাজা পেতে হবে তাকে। তা তুমি কী এসব কিছু জানতে না। আর তা ছাড়া ঐ সব দুর্গম গিরি পর্বত কান্তার মরুপ্রান্তর এবং সাগর দরিয়া পার হয়ে এমন দূর দেশে পৌঁছতেই বা পারলে কী করে? এবং কী উদ্দেশ্যেই বা এসেছ এখানে?

হাসান বলে, আপনি যদি ধৈর্য ধরে আমার দুর্ভাগ্যের কাহিনী শোনেন আমি নিশ্চয় শোনাবো, মা। তবে সে কাহিনী একটু দীর্ঘ, কিছু সময় লাগবে।

নারী-সেনাপতি ইশারা করতে তার গোটা বাহিনীটা নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে গেলো। বৃদ্ধা সস্নেহে বললো, চলো ঐ পাহাড়ের টিলাটায় গিয়ে বসি। তার পর শুনবো তোমার কাহিনী।

হাসান তার কাহিনী বলে।

বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে তোমার বিবি বাচ্চাদের কী নাম।

—আমার দুই ছেলের নাম নাসির আর মনসুর। আর বিবির আসল নাম কী—বলতে পারবো না। তবে আমাকে সে তার নাম বলেছিলো রোশনি।

এই বলে হাসান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

বৃদ্ধা সান্ত্বনা দিতে দিতে বলে, কেঁদো না বাছা, তোমার এই দুঃখের কাহিনী শুনে বড় ব্যথিত হলাম। কোনও মা-ই কী সন্তানের চোখে পানি দেখতে চায়? কেঁদো না, চুপ কর। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বিবি বাচ্চাদের সন্ধান করার জন্য জান প্রাণ চেষ্টা করবো। এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার নারী-সেনাদের কেউ হয়তো তোমার বিবি হতে পারে। কারণ এই দ্বীপে ওরা ছাড়া তো কোনও মেয়ে নাই। যাই হোক, কাল তোমাকে ওদের সবাইকে বিবস্ত্র করে দেখাবো। তুমি ভালো করে দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে তোমার বিবিকে।

হাসান কৃতার্থ হয়ে বলে, আলবাৎ চিনতে পারবো মা। তার চেহারা কী ভোলবার?

পরদিন বৃদ্ধা সেনাপতির বিশাল সৈন্যবাহিনীর মেয়েরা এসে হাজির হয়। সবাই সাজ-পোষাক খুলে বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। হাসানকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধা প্রতিটি মেয়ের সামনে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলে।

হাসান বলে, এরা সকলেই পরমাসুন্দরী সন্দেহ নাই। কিন্তু মা, এর মধ্যে আমার বিবি নাই।

বৃদ্ধা চিন্তিত হয়, তবে? তবে তো মনে হয়, সে এ দ্বীপের মেয়ে নয়।

হাসান বলে, কিন্তু উড়ে চলে যাবার আগে সে আমার মাকে বলেছিলো, ওয়াক ওয়াক দ্বীপে গেলে আবার তার সঙ্গে দেখা হতে পারে।

বৃদ্ধা বললো, এ ছাড়া আর মাত্র সাতটি কন্যা আছে এই সপ্তদ্বীপে। কিন্তু তারা তো সম্রাট-নন্দিনী। কেমন দেখতে ছিলো তোমার বিবি, তার রূপের কিছু বর্ণনা শোনাতে পার?

হাসান বলে, সে-রূপ ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, মা, অমন অলোকমান্যা সুন্দরী আমাদের মনুষ্য-জগতে দুটি নাই। তার চোখ নাক মুখ স্তন কটি জঙ্ঘা একেবারে নিখাদ নিখুঁত। নিপুণ ভাস্করের হাতে গড়া এক অপরূপ সৃষ্টি!

বৃদ্ধা কিছু অনুমান করতে পারে না। এখানকার সেনাবাহিনীর মেয়েরাও তো সকলে অসামান্যা সুন্দরী, অবশ্য রাজকুমারীরা আরও অনেক বেশী সুন্দরী, সে কথা ঠিক। কিন্তু রাজকুমারীদের যদি কেউ হয়, বৃদ্ধা শিউরে ওঠে, তা হলে তো সর্বনাশ। এবং তা ছাড়া কীই বা হতে পারে। আবার এই সমগ্র সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যখন সে নাই তখন তো বাকী থাকে মাত্র ঐ সাতজন রাজকুমারী। এ ছাড়া তো অন্য কোনও নারী এখানে নাই।

বৃদ্ধা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে, হাসান তোমার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, তোমার বিবি সম্রাটের সাত মেয়ের কোনও এক মেয়ে। তা যদি হয়, সে দুরাশা তুমি ত্যাগ কর, বাবা। চাঁদে হাত বাড়াতে যেও না। এ খবর সম্রাটের কানে গেলে এইখানেই তোমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবেন তিনি। সম্রাটের এই দুর্ভেদ্য সুরক্ষা থেকে তাঁর কন্যাকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারবে—সে আশা করো না। তার চেয়ে তুমি আমার কথা শোনো, আমার সেনাদের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ বলল, আমি সানন্দে তাকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। এর জন্যে সম্রাট বা তার কন্যাদের কারো অনুমতির প্রয়োজন হবে না। কারণ সম্রাটের সৈন্যবাহিনীর আমিই সর্বপ্রধান কত্রী। আমার হুকুমে ওরা প্রাণ দেবে, প্রাণ নেবে।

হাসান বলে, আপনার এই বদান্যতার কথা আমি ভুলবো না। কিন্তু আমি যৌবন কামে উন্মত্ত হয়ে কোনও নারী মাংসের সন্ধানে এখানে আসিনি মা। আমি আমার পেয়ারের বিবি বাচ্চাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে এসেছি। এবং আমার বিশ্বাস, আল্লাহ যখন এতো দুর্গম পথ অতিক্রম করিয়ে এখানে আমাকে পৌঁছে দিয়েছেন তখন শেষরক্ষাও তিনি করবেন। তা না হলে এই নিষিদ্ধ দ্বীপে এসে আপনার মতো এমন দয়াবতী মাকেই বা পাবো কেন? সবই তার ইচ্ছা। আমার মন বলছে, আপনি-আপনিই আমাকে সন্ধান করে দিতে পারবেন আমার বিবি বাচ্চার।

বৃদ্ধা প্রশংসায় বিগলিত হয়ে গেলো। ভোর হয়ে আসে।

শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

ছয়শো আটতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে–

–বাবা, আমি তোমার মনের অভিপ্রায় বুঝতে পেরেছি। বিবি বাচ্চারা তোমার কাছে বড় আদরের। তাদের অদর্শন তুমি সইতে পারছে না। যাই হোক, খুব বড় রকমের ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে আমি এই দ্বীপের রানী আমাদের সম্রাটের বড় কন্যার দরবারে নিয়ে যাচ্ছি। জানি না সে আমাকে কী বলবে।

হাসানকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধা সেনাপতি দরবারে আসে। হাসানকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সে রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়। দরবারে প্রবেশ করে রাজকুমারীকে যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে দাঁড়ায়।

রাজকুমারীর নাম নূর অল হুদা। এই বৃদ্ধাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করে সে। তার কারণ জন্মের পর থেকে সে তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। বুকের দুধ খাইয়েছে। সে তার ধাত্রী।

নূর অল হুদা বৃদ্ধাকে দেখে খুব খুশি হয়। বলে, এই যে ধাই মা, মনে হচ্ছে, সুখবর আছে?

-সুখবর কিনা জানি না, বেটা, তবে তোমার কাছে এক আর্জি নিয়ে এসেছি। আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। একটি চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর নওজোয়ান ছেলে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? এবং কেনই বা এসেছ? তার জবাবে ছেলেটি বড় করুণ কাহিনী শোনালো আমাকে। তার বিবি একজিন-কন্যা। তার সঙ্গে ছেলেটির শাদী হয়েছিলো। এবং দুটি সন্তানের জন্মও দিয়েছিলো সে। একদিন সে ছেলে দুটিকে তুলে নিয়ে আবার আকাশে উড়ে উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু যাবার সময় সে এই দ্বীপের নাম বলেছে।-যদি দেখা করতে চাও, ওয়াক ওয়াক দ্বীপে গেলে আমার সন্ধান পাবে। আমি আমার সৈন্যবাহিনীর সব মেয়েদের দেখিয়েছি তাকে। কিন্তু তাদের কেউ ওর বিবি নয়। যা বর্ণনা দেয় তাতে মনে হয়, তোমাদের সাত বোনের একজন হয়তো হতে পারে। আমি ওকে সঙ্গে করে এনেছি। যদি তুমি দেখতে চাও, দরবারের ভিতরে নিয়ে আসতে পারি ওকে।

বৃদ্ধার কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পড়ে নূর অল হুদা।

—তুমি একটা হতচ্ছাড়া মেয়েছেলে। এতোবড় সাহস তোমার, একটা মানুষের বাচ্চাকে ঢুকতে দিয়েছ আমাদের এই পবিত্র দ্বীপে? কী লজ্জার কথা? ছি ছি! তুমি কী চাও, তোমার মুণ্ডুটা আমি ছিড়ে খাই?

বৃদ্ধা ভয়ে কাঁপতে থাকলো। হাত জোড় করে সে রাজকুমারীর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো। নূর অল হুদা তখনও বলে চলেছে, তুমি কী আমার রাগ জান না? আমি তো বুঝতে পারছি না, এসব শোনার পর এখনও কেন তোমাকে জিন্দা রেখেছি। তুমি আমাদের সেনাপতি, এই দ্বীপ পাহারা দেবার ভার দেওয়া আছে তোমার ওপর। তার কী এই নমুনা? আমি তোমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো। আমাকে চেন না! থাক, সে সব পরে হবে, এখন ওকে হাজির করো আমার সামনে। দেখি, কতবড় তার দুঃসাহস, আমাদের এই পবিত্র দ্বীপে পা রেখেছে সে!

বৃদ্ধা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে এসে হাসানকে নিয়ে আবার দরবারে প্রবেশ করে।

নূর অল হুদা বোরখায় সারা দেহ আবৃত করে সিংহাসনে বসেছিলো। আভূমি আনত হয়ে হাসান কুর্নিশ জানালো তাকে। নূর অল হুদা বৃদ্ধাকে ইশারা করতে সে হাসানকে বললো, আমাদের মহামান্যা রাজকুমারী তোমাকে প্রশ্ন করছেন, তোমার নাম কী, স্বদেশ এবং তোমার বিবি বাচ্চাদেরই বা কী নাম?

হাসান বলে, আমার নাম হাসান, আমার জন্মভূমি বসরাহ। আমার বিবির নাম জানি না; দুইপুত্রের নাম নাসির আর মনসুর।

-তোমার বিবি তোমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে কেন?

হাসান বলে, খোদা কসম, আমি তা জানি না।

-কোথা থেকে চলে গেছে?

-বাগদাদের খলিফা অল রসিদের প্রাসাদ থেকে সে উড়ে চলে গেছে। যাওয়ার সময় সে আমার মাকে বলে গেছে, আপনাদের ছেড়ে যেতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আকাশ আমাকে ডাক দিয়েছে—যেতেই হবে। বিদায় বেলায় দুঃখ রয়ে গেলো। আমার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না। যদি সে দেখা করতে চায়, ওয়াক ওয়াক দ্বীপে যেতে বলবেন ওকে। এই বলে সে আমার বাচ্চা দুটোকে তুলে নিয়ে আকাশ পথে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি সে-সময় দেশে ছিলাম না। ফিরে এসে সব শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে গেলো আমার সামনে।

এবার নূর ঘাড় নাড়তে নাড়তে নিজেই কথা বললো, হুম, তোমার বিবি যদি তোমাকে দেখা না দিতে মনস্থ করতো, তা হলে তোমার মাকে তার ঠিকানা জানিয়ে আসতো না। কিছুতেই। আবার অন্য কথাও ভাববার আছে, সে যদি সত্যিই ভালোবাসতো তাহলে তোমাকে ছেড়ে পালাবেই বা কেন?

হাসান সঙ্গে সঙ্গে হলফ করে বললো, আপনি বিশ্বাস করুন রাজকুমারী, খোদা কসম, আমার বিবি আমাকে গভীরভাবে ভালোবাসতো—আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, এখনও সে ভালোবাসা অটুট আছে তার। শুধু উন্মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবার নেশা ওকে ঘর ছাড়া করেছে। আমারই ভুল হয়েছিলো, আমি ওকে অবিশ্বাস করে ওর ডানার খোলসটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। তাই শাদীর পর আর কোনও দিন সে আকাশে ভেসে বেড়াতে পারেনি। আমার মনে হয়, গোড়া থেকে ওকে পুরো স্বাধীনতা দিলে ওর আকাশে ওড়ার শখ মেটালে, ঐ ভাবে সে চলে যেত না।

একটু থেমে হাসান বললো, আমার জীবনের দুঃখের কাহিনী সব শুনলেন, এখন যদি মেহেরবানী করে আমার বিবি বাচ্চাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন, চিরকাল আপনার বান্দা হয়ে থাকবো, রাজকুমারী। আশা করি আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না।

নূর অল হুদা হাঁ না কোনও কথা বললো না। পুরো একটা ঘণ্টা মুখ গুঁজে আপন মনে ভাবতে থাকলো, তারপর এক সময় মাথা উঁচু করে বললো, এতক্ষণ কী ভাবে তোমাকে সমুচিত সাজা দেওয়া যায়, তা-ই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু এখনও ভেবে উঠতে পারলাম না ঠিক মতো।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো দশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

বৃদ্ধা আতঙ্কিত হয়ে নূর-এর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে। রাজকুমারী, মা, তোমাকে আমি নিজের কন্যার মতো করে লালন পালন করেছি। আমার স্তন খেয়ে তুমি মানুষ হয়েছ। সেই জোরে তোমার কাছে আজ এই যুবকের প্রাণ ভিক্ষা চাইছি, বেটা। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও। কত দূর দেশ থেকে সে এসেছে। কত দুস্তর বাধা বিপত্তি মাথায় নিয়ে সাত সমুদ্র, সাতটা পাহাড় পর্বত ও সাতটা মরুপ্রান্তর অতিক্রম করে তবে পৌঁছতে পেরেছে এখানে। এবং তা কীসের জন্য? বিবি আর বাচ্চাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে বলে। দুনিয়ার ইতিহাসে এই মহব্বতের নজির নাই, রাজকুমারী। একে তুমি কঠোর দণ্ড দিও না, এই আমার প্রার্থনা। বরং ক্ষমা করে এই মূর্ত ভালোবাসার প্রতীককে সৌজন্য দেখাও। তবে তোমার মহত্ত্ব বাড়বে। ছেলেটির সঙ্গে সহজ হয়ে, একটু দরদ ঢেলে, প্রাণ খুলে আলাপ-সালাপ করে দেখ, তোমার প্রাণে দয়া হবে।

নূর অল হুদা নিজের বোরখা খুলে হাসানের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে হাসান নূরকে দেখে আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বৃদ্ধা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। একটু পরে সে চোখ মেলে তাকায়।

বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ কী হলো বাছা।

ব হাসান বলে, ইয়া আল্লাহ, এ আমি কী দেখলাম? এ যে বিলকুল  আমার বিবির মতো দেখতে। একটা মুগের দু’খানা ডালের একখানা! অবিকল তার মতো!

রাজকুমারী হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।

—এ তো দেখছি আস্ত একটা উন্মাদ। আজন্ম আমি কুমারী, আমাকে সে তার বিবি বলে ঠাওরালো? আমি কিনা তার দুই ছেলের মা? আচ্ছা বলো শুনি, কেন আমাকে দেখে তোমার বিবি বলে মনে হলো?

হাসান বলে, আমার বিবির মতো পরমাসুন্দরী নারী ত্রিভুবনে কোথাও নাই, এই আমার এততদিনের বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু আপনাকে দেখে সব আমার গোলমাল হয়ে গেলো। সেই মুখ, সেই নাক, কপোল অধর সব-সব হুবহু তারই মতো। এতোটুকু তফাত নাই। শুধু ভালো করে লক্ষ্য করলে ধরা যায়, তার চোখের সঙ্গে আপনার চোখের সামান্য ফারাক আছে। আর ধরা যায় আপনার কণ্ঠস্বর শুনে। আপনার কথাও গান হয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু দুজনের স্বরে কিছু পার্থক্য আছে।

রাজকুমারী বুঝলো এ যুবক অন্য কোনও নারীতে আসক্ত হবার পাত্র নয়। কিন্তু দেখা অবধি কী এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করছে সে। এরই নাম কী ভালোবাসা?

যাই হোক, কে সেই নারী—যার সন্ধানে সে নিজের জীবন তুচ্ছ করে এই নিদারুণ ঝুঁকির মধ্যে পা বাড়িয়েছে? তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। এবং এই দ্বীপেই যখন সে আছে, নিশ্চয়ই তার অন্য ছয় বোনদেরই একজন কেউ হবে! কিন্তু কে? আমি এদের দু’জনকেই শায়েস্তা করবো।

বৃদ্ধাকে সে বলে, ধাইমা এক্ষুণি তুমি আমার ছয় বোনকে নিমন্ত্রণ করে এসো। গত দুই বছর তাদের কারো সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। ওদের বলবে, কাল আমার প্রাসাদে আনন্দ উৎসব হবে। ওরা যেন সবাই চলে আসে। কিন্তু ‘খবরদার, এই ছেলেটির কথা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলবে না কিছু।

রাজকুমারীর মনের কথা আর জানবে কী করে, হুকুম তামিল করতে তক্ষুনি সে বেরিয়ে পড়লো অন্য ছয় দ্বীপে। প্রত্যেক দ্বীপের রানী হচ্ছে এক এক বোন।

পর পর পাঁচটি দ্বীপে গিয়ে পাঁচ বোনকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে সব শেষে ছোট বোনের দ্বীপে গেলো সে। জিন-সম্রাট এই ছোট কন্যার প্রাসাদেই শেষ জীবন অতিবাহিত করছে। বৃদ্ধার মুখে বড়দিদির আমন্ত্রণ পেয়ে ছোট কন্যা নাচতে নাচতে ছুটে যায় বাবার কাছে।

-বাবা, বড়দি ডেকে পাঠিয়েছেন। কাল তার প্রাসাদে খানাপিনা, নাচ-গান হবে। সব বোনেরা—আমরা এক জায়গায় মিলবো আজ দু বছর বাদে। আমাকে যেতে দেবে তো, বাবা?

সম্রাট ছোট কন্যার কথা শুনে হঠাৎ কেমন বিচলিত বোধ করে, না মা, না, মানেনা, হা-মা না না।

ছোট মেয়ে সম্রাটের এই ধরনের ভাবভঙ্গী দেখে ঘাবড়ে যায়, সে কী বাবা, অমন করছো কেন তুমি। অনেক দিন বাদে নিজের বড় দিদির সঙ্গে দেখা করতে যাবোতাতে তোমার এতে আপত্তি হচ্ছে কেন?

এতক্ষণে সম্রাট গুছিয়ে বলতে পারেন কথাটা।

কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, মা। এবং সেই থেকে আমি ভীষণ ভয়ে ভয়ে আছি। কেন জানি না, মনে হচ্ছে, তোমাকে বুঝি আমি আবার হারাবো।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো এগারতম রজনী–

আবার সে গল্প শুরু করে।

সম্রাট বলতে থাকে, স্বপ্নে দেখেছি, আমার গুপ্তধনাগারের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। লক্ষ লক্ষ হীরে জহরত, মণিমুক্তা নেড়ে চেড়ে দেখছি। হঠাৎ আমার নজর পড়লো সাতখানা অত্যাশ্চর্য মণিরত্নের দিকে। তার মধ্যে সব চেয়ে যেখানা ছোট, সেখানা আমার কাছে আরও বেশি সুন্দর মনে হলো। আমি ঐ রত্নখানা হাতে করে প্রাসাদে উঠে এলাম। এর পর দেখলাম, হঠাৎ একটা বাজপাখী উড়ে এসে আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে গেলো ঐ রত্নখানা। আমি চিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। বাকী রাতটা শুধু পায়চারী করে কাটালাম। সকালবেলায় গণকারদের ডেকে পাঠিয়ে আমার স্বপ্নের কথা বললাম ওদের। ওরা আমাকে ব্যাখ্যা করে বললো, মহানুভব সম্রাট ঐ সাতখানা রত্ন আপনার সাতটি কন্যা। আর ছোট রত্নখানা—সে আপনার কনিষ্ঠা কন্যা।

আমাদের আশঙ্কা, কোনও এক দৈব-দুর্বিপাকে আপনি আপনার এই ছোট কন্যাকে হারাতে পারেন।

সেই থেকে আমি দারুণ উদ্বেগের মধ্যে আছি। তোমার দিদি অনেক দিন পরে তোমাকে ডেকেছে, যাওয়া খুবই সঙ্গত, কিন্তু এ অবস্থায় তোমাকে কাছছাড়া করতে কিছুতেই প্রাণ চাইছে না, মা।

সব শুনে ছোট মেয়ে হো হো করে হাসে, তুমি আমাকে সকলের থেকে বেশি ভালোবাসো, সেইজন্যেই তোমার মনে এতো ভয়, বাবা। তা না হলে খোয়াব কী কখনও সত্যি হয়? আর ঐ গণকারদের কথা ছেড়ে দাও।ওরা তো গালভরা বাণী দিতে পারলেই মোটা ইনাম পায়। তোমার আশঙ্কা করার কোনও কারণ নাই বাবা। আম নিজে যেতে রাজি না হলে কেউ আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না। তুমি তো জান বাবা, এর আগে আমার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে বিপদে পড়ে কিছুকালের জন্য আটকে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ওরা চিরকালের মতো বেঁধে রাখতে পেরেছিলো? সুযোগ বুঝে একদিন তো আবার তোমার কাছে ফিরে এলাম বাবা। সুতরাং ওসব দুর্ভাবনা মন থেকে মুছে ফেলো। আমি কোথাও চলে যাবো না। কেউ আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তোমাকে কথা দিচ্ছি বাবা মাসখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসবো তোমার কাছে। হাজার হলেও সহোদরা দিদি, সে ডেকেছে, না গেলে চলে?

সম্রাট তবু যেন প্রাণ, খুলে বলতে পারে না, আচ্ছা যা।

ছোট কন্যা-আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এই আমাদের কাহিনীর নায়িকা। রোশনি—বাবাকে আদর করতে করতে বলে, তুমি বড্ড ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছো, বাবা। তোমার এই ওয়াক ওয়াক দ্বীপে এতো সহস্র সৈন্য দিনরাত শ্যেন দৃষ্টি মেলে পাহারা দিচ্ছে। বাইরের একটা মশাও এ দ্বীপে ঢুকতে পারবে না। তা ছাড়া সাত সমুদ্র, সাত পাহাড়, সাত মরুপ্রান্তর, শ্বেত সূর্যের দ্বীপ ডিঙিয়ে তবে ওয়াক ওয়াক দ্বীপ। এতে বাধা কাটিয়ে এখানে এসে পৌঁছবে, এমন হিম্মত কার আছে? বাবা, আর মুখ ভার করে থেকো না, সব দুর্ভাবনা। ঝেড়ে ফেলে একবার প্রাণ খুলে হেসে আমাকে বিদায় দাও তো!

শেষের কথাগুলি সম্রাটের খুব মনে ধরলো। তাই তো! তার দেশের যা সুরক্ষা, তা ভেদ করে বাইরের কোন প্রাণীর এখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। মনটা অনেক হাল্কা হয়ে গেলো। বললো, যা মা, দেখে শুনে যা। তোর সঙ্গে আমি কড়া পাহাড়া দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি। জানিস তো তোকে ছাড়া আমি দিন কাটাতে পারি না।

এর পর এক হাজার নারী-সেনার এক বাহিনীর প্রহরায় রোশনি বড় দিদির প্রাসাদে এসে পৌঁছয়।

পৌঁছয় আরও পাঁচ বোন। কিন্তু আনন্দ উৎসবের কোনও আভাস দেখতে পেলো না কেউ।

নূর অল হুদা খবর পাঠালো, তোমরা বিশ্রাম করো, সবাই। যথাসময়ে আমি ডেকে পাঠাবো।

দরবারে নূর অল হুদা সিংহাসনে উপবিষ্ট। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসান। কোরবানীর খাসীর মতো তার অবস্থা। চারপাশ ঘিরে এক পাল অসিধারিণী উন্মুক্ত খঙ্গ উঁচিয়ে আছে। রাজকুমারী প্রথমে তার চেয়ে ছোট যে বোন—তাকে ডেকে পাঠালো।

—দেখ, ভালো করে তাকিয়ে দেখ, যুবক। এ-ই কী তোমার বিবি?

হাসানকে প্রশ্ন করে নূর। কিন্তু হাসান বলে, এঁরও রূপের কোনও তুলনা নাই, রাজকুমারী। দেখতেও অনেকটা আমার বিবিরই মতো, কিন্তু না, ইনি নন।

নূর অল হুদা ইশারা করতে তার ভগ্নী দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

আর একজন আসে। হাসান বলে, সত্যিই অপরূপ সুন্দরী। একেবারে নিখুঁত। কিন্তু নসীব খারাপ, ইনিও আমার বিবি নন।

এর পর তৃতীয় জন এলো। সেও নয়। চতুর্থ এলো। সেও নয়। এলো পঞ্চম সহোদরা। নূর জিজ্ঞেস করে, দেখ ভালো করে, দেখ, এ নিশ্চয়ই তোমার বিবি? হাসান অবাক হয়। এতো মিল কী করে সম্ভব। হুবহু একই রকম দেখতে। একেবারে রোশনি। কিন্তু না, এ রোশনি নয়। হাসান ঘাড় নাড়ে। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে, না না এ-ও নয়। এরা সবাই সুন্দর, সবাই দেখতে আমার বিবির মতো। আশ্চর্য ভেল্কী বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। কিন্তু এদের কেউই আমার বিবি নয়।

নূর অল হুদার বুঝতে আর বাকী থাকে। তা হলে রোশনি-তার সর্ব কনিষ্ঠ ভগ্নী ছাড়া আর কেউ নয়। ইশারা করতে প্রহরী রোশনিকে দরবারে নিয়ে আসে। হাসান মুখ তুলে তাকায়। তার পর তখুনি অস্ফুট আর্তনাদ তুলে মূৰ্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। নূর-এর ঠোঁটের কোণে হিংসার হাসি ঝিলিক মেরে ওঠে। হুম, তা হলে ছোটর এই কাণ্ড। ঠিক আছে, দাঁড়াও মজা আমি দেখাচ্ছি। এই কে আছিস, এই ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যা এখান থেকে। সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিয়ে আসবি, যা নিয়ে যা।

দুটি নারী-জহ্লাদ হাসানের অচৈতন্য দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে চলে যায়। সমুদ্র-সৈকতে এসে হাসানের হত-চৈতন্য অসাড় দেহটাকে শুইয়ে দেয় বালির ওপর—একেবারে জলের ধারে। ভাবে এক সময় সাগরের ঢেউ এসে ওকে টেনে নিয়ে যাবে অকুল দরিয়ায়। তারপর এই চাদের মতো সুন্দর নওজোয়ানের নসীবে যা লেখা আছে, তাই হবে।

এদিকে নুর ক্রোধান্বিত হয়ে রোশনিকে বলে, তুই আমাদের পবিত্র জিন-বংশের কলঙ্ক। জিনিস্থান-সম্রাট যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেতে পারে না, তিনি আমাদের জন্মদাতা পিতা। একটা সামান্য নর সন্তানের সঙ্গে ঢলাঢলি করে তুই তাকে দেহ বিলিয়ে দিয়েছিস। ছি ছি, লজ্জায় মাথা কাটা যায়। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, তোকে আমি এই মুহূর্তেই খতম করে ফেলি। কিন্তু না, বাবা এখন জীবিত। তার হুকুম ছাড়া কোনও কাজ আমি করি না। এখনি তার কাছে আমি তোমার গুণের কথা জানিয়ে খবর পাঠাচ্ছি। তিনি যা জবাব পাঠান—সেইভাবে তোমার ব্যবস্থা করা হবে। এ্যাঁই, একে পাতালের অন্ধকার কারাগারে নিয়ে যা। খুব শক্ত করে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখবি।

এর পর নূর বৃদ্ধা সেনাপতির দিকে তাকায়।

—আর তুমি? তোমার কী শাস্তি বিধান দেব, বলল তো; ধাই মা? তুমি আমাকে লালন পালন করেছ, বুকের স্তন খাইয়ে মানুষ করেছ। তোমার ওপর কিছু কৃতজ্ঞতা আমার থাকা উচিত। কিন্তু ধাইমা, ব্যক্তি-স্বার্থের চেয়ে রাষ্ট্র অনেক বড়। তার স্বার্থ সকলের ওপরে। সেখানে আমি কোনও দাক্ষিণ্য দেখাতে পারি না। তুমি আমার প্রধান সেনাবাহিনীর প্রধান। তোমার হাতে রাষ্ট্রের সুরক্ষার ভার দেওয়া ছিলো। সেই, মহান কর্তব্য থেকে তুমি বিচ্যুত হয়েছ। এর সাজা তোমাকে পেতেই হবে। তুমি আমার মাতৃতুল্য, কিন্তু তুমি এখন দেশ-দ্রোহী। এখন আমি চিন্তিত বিচলিত! কী করবো কিছুই ঠিক করতে পারছি না। দেশ-দ্রোহের সাজা প্রাণদণ্ড, কিন্তু তোমাকে আমি নিজে হাতে সে দণ্ড দেব কি করে, মা?

নূর অল হুদা এক মুহূর্ত স্থির অপলক হয়ে কী যেন ভাবে। তারপর বলে, নাঃ, আমি হাতে রাখবো না তোমার বিচার। বাবাকেই সব জানাচ্ছি। তিনি যা হুকুম করে, তাই হবে। এখনি আমি দূত পাঠাচ্ছি বাবার কাছে। তার জবাব না আসা পর্যন্ত এই দরবারে এইভাবে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, এই আমর আদেশ।

এই বলে নূর দরবার কক্ষ ত্যাগ করে অন্য বোনেদের সঙ্গে মিলিত হতে যায়।

এদিকে সমুদ্রবেলায় বালির শয্যায় শুয়েছিলো হাসান। এক সময় তার জ্ঞান ফিরে আসে। দুদিন আগে হঠাৎ এই সমুদ্র-সৈকতেই সে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো হঠাৎ সেই শেখ আলীর মন্ত্রবলে। আজ সে সেখানেই শুয়ে আছে, আশ্চর্য!

সামনে দিগন্ত-প্রসারী দুস্তর জলরাশি, আর এপাশে সেই গিরি পাহাড় শ্রেণী। ওপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। বড় মনোহর দৃশ্য। কিন্তু হাসানের কিছুই ভালো লাগে না। কোথায় তার নয়নের মণি রোশনি। এক পলকের জন্য তাকে সে দেখেছে। তারপর আর কিছু মনে নাই।

হাসান বুঝতে পারে রাজকুমারী নূর অল হুদার হুকুমে তার প্রহরীরা এখানে এই বালুকাবেলায় ফেলে গেছে তাকে। তা যাক, কিন্তু রোশনি—তার বিবিকে কী অবস্থায় রেখেছে। সে। অথবা এতক্ষণে ক্রোধে অন্ধ হয়ে সে তার প্রাণ সংহার করেছে! না না, ও-কথা হাসান ভাবতে পারে না—ভাবতে চায় না।

একটা চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ কানে আসে হাসানের। তাকিয়ে দেখে দুটি ছোট্ট মেয়ে-নারী-সেনা হবে-প্রচণ্ডভাবে মারামারি করতে করতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। হাসান উঠে দাঁড়ায়। ছুটে গিয়ে মেয়ে দুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করে, কী ব্যাপার, তোমরা এমন মারামারি করছো কেন?

একটি ছোট্ট মাথার টুপি নিয়ে ওদের মধ্যে বচসা এবং সেই নিয়ে মারামারি শুরু হয়েছে। একটি মেয়ে বলে, টুপীটা আমার, অন্য জন বলে না আমার, আমি দেব না।

হাসান হাসে। তুচ্ছ একটা মাথার টুপি, এই নিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড। আচ্ছা শোনো, আমি তোমাদের বিবাদ মিটিয়ে দিচ্ছি।

মেয়ে দুটি সাগ্রহে বলে, বেশ তাই দিন। আমরা আপনার রায়ই মেনে নেব।

হাসান বলে আমি একটা ঢিল ছুঁড়ে দিচ্ছি আসমানের দিকে। তোমরা ছুটে যাবে। যে আগে নিয়ে আসতে পারবে ঐ ঢিলটা, এ টুপি তারই প্রাপ্য, কেমন রাজি। -রাজি-রাজি।

দু’জনেই একসঙ্গে বলে ওঠে। হাসান বলে, তা হলে টুপিটা আমার কাছে জিম্মা রাখ।

একটি মেয়ের হাতে ছিলো টুপিটা। সে নির্দ্বিধায় তুলে দেয় হাসানের হাতে। হাসান একটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে ছুঁড়ে পাঠিয়ে দেয় অনেক ওপরে। আর তখনি চিলের মতো ডানা মেলে ওরা উড়ে যায় আকাশে। ঐ ঢিলটার পিছনে। হাসান হাসতে হাসতে টুপিটা মাথায় পরে নেয়,স্বগতভাবে বলে, যতো সব পাগল।

একটুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে ওরা। হাসান দেখে ওদের একজনের হাতে সেই পাথর টুকরোখানা। সে চিৎকার করে ডাকে, কই গো, কোথায় গেলে এই যে আমি ঢিলটা ধরেছি।

হাসান হাসতে হাসতে বলে,এই তো আমি।

হাসান অবাক হয়, সে কি! ওদের একেবারে নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে সে-ওরা দেখতে পাচ্ছে না। আবার সে সাড়া দেয়, এই তো আমি।

মেয়ে দুটো দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। এবার হাসানের মনে খটকা লাগে। তবে তো এ কোনও সাধারণ টুপি নয়। নিশ্চয়ই যাদু মন্ত্রঃপুত। মাথায় পরলে আর তাকে কেউ দেখতে পায় না।

মেয়েরা তারস্বরে ডাকতে থাকে ওকে। হাসান কিন্তু আর কোনও সাড়া দেয় না। হন হন করে হেঁটে চলে আসে নূর অল হুদার দরবারে। সেখানে তখন নূর ছিলো না। দরবারকক্ষ প্রায় শূন্য। শুধু একপাশে মুহ্যমান সেই বৃদ্ধা মাথায় হাত রেখে চোখের জল ফেলছিলো।

হাসান ওর কাছে গিয়ে ডাকে, আপনি কাঁদছেন কেন মা।

বৃদ্ধা মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না। ভাবে, হয়তো তার মতিভ্রম ঘটেছে।

হাসান আবার বলে, রোশনি কোথায় মা, তাকে তো দেখছি না?

এবার আর ভুল হয় না তার। এতো সেই হাসানের কণ্ঠ স্বর। কিন্তু কোথায় সে? দরবারে তো অন্য কোনও প্রাণী নাই। অবাক হয়ে সে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। হাসান বুঝতে পারে বৃদ্ধা তাকে দেখতে পাচ্ছে না। টুপিটা সে মাথার থেকে খুলে নেয়।

হঠাৎ হাসানকে দেখে চমকে ওঠে সে, তুমি? তুমি কী করে এখানে এলে বাবা? তোমাকে তো ওরা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এসেছে।

হাসান বলে, সে কথা পরে বলবো। এখন বলুন রোশনি কোথায়—জিন্দা আছে তো সে?

-এখনও আছে। তবে আর বেশিক্ষণ বোধ হয় থাকবে না।

-কেন?

নূর ওর বাবাকে খৎ লিখে দূত পাঠিয়েছে। জবাব এলেই রোশনি আর আমাকে খতম করে ফেলবে সে।

—আপনাকেও? কিন্তু কেন, মা?

-দেশদ্রোহিতার অপরাধ। আমি তার সেনাবাহিনীর প্রধান, আমি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম স্বার্থ নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছি এই অপরাধ। ও-কথা থাক, আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। মরতে আমার বাধা নাই। কিন্তু দুধের বাছা রোশনি, ওকে বাঁচাতে হবে বাবা। কিন্তু কী করে বাঁচাতে পারবে ওকে। সে তো এখন পাতালের কয়েদখানায় বন্দিনী হয়ে আছে।

হাসান আকুল হয়ে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাও অদৃশ্য হয়ে যায়। দরবারের প্রহরীরা আতঙ্কিত হয়ে একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে, আরে সেনাপতি গেলো কোথায়?

হাসান বুঝতে পারে, এ টুপি যার মাথায় থাকবে সে-ই শুধু অদৃশ্য হয়ে যাবে তা নয়, সে যাকে ধরবে, ছোঁবে—তাকেও কেউ দেখতে পাবে না।

হাসান বলে, মা, আপনি আমাকে ধরে থাকুন, তা হলে আপনাকেও কেউ দেখতে পাবে না। তারপর চলুন ঐ কয়েদখানায়, রোশনিকে উদ্ধার করতে হবে।

বৃদ্ধা পাতালের কয়েদখানায় নিয়ে আসে। সেখানে রোশনিকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো চৌদ্দতম রজনী?

আবার সে বলতে শুরু করে :

হাসান ভাবে, এই অবস্থায় রোশনিকে যদি দেখা দেয় তবে হয়তো এখুনি মুছা যাবে সে। ক্ষিপ্র হাতে হাসান ওর বাঁধন খুলে দেয়। প্রথমে রোশনি কিছুই বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। পরে হাসান ওর মাথার টুপি খুলে ফেলতে পরিষ্কার বুঝতে পারে এই অন্ধকার কয়েদখানা থেকে তাকে উদ্ধার করতে এসেছে তার স্বামী। হাসানের বুকে মাথা রেখে সে কঁদতে থাকে।

হাসান বলে, এখন কান্নার সময় নয় রোশনি। চলো, এখান থেকে পালাতে হবে। টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে আবার অদৃশ্য হয়। রোশনিকে কাঁধে তুলে এবং বৃদ্ধাকে হাতে ধরে কয়েদখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।

হাসান বলে, আমি তোমাকে বাগদাদে নিয়ে যেতে এসেছি রোশনি, যাবে তো?

রোশনি বলে, দেরি হলেও বুঝতে পেরেছি, হাসান। শাদীর পর মেয়েদের একমাত্র ভরসাস্থল তার স্বামীর আশ্রয়। এখানে যদি ফেলে রেখে যাও, আমার নিজের লোকরাই আমাকে কোতল করে ফেলবে। ওদের ধারণা, তোমাকে শাদী করে তোমার ঔরসে বাচ্চা পয়দা করে আমি পতিতা হয়েছি। জিন-সম্রাটের বংশে চুনকালি দিয়েছি, সুতরাং এই ওয়াক ওয়াক দ্বীপ-এ আমার থাকা আর নিরাপদ নয়। চলো, এই মুহূর্তে আমি তোমার সঙ্গে জাহান্নামেও যেতে রাজি আছি।

হাসান বলে জাহান্নামে কেন বলছো, তুমি আর আমি বাগদাদে ফিরে গিয়ে নতুন বেহেস্ত রচনা করবো। তার আগে একবার তোমার নিজের প্রাসাদে যেতে হবে। সেখান থেকে আমাদের চোখের মণি নাসির ও মনসুরকে তুলে নিতে হবে।

রোশনি স্বামী আর বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের প্রাসাদে ফিরে আসে। তিনখানা ডানার খোলস সংগ্রহ করে আনে সে। আর নিয়ে আসে নাসির ও মনসুরকে।

-নাও এই ডানাগুলো পরে নাও।

রোশনি নিজেও একখানা পরে। ছেলে দু’টোকে কোলে নেয় বৃদ্ধা। এবং মুহূর্তে, মধ্যে মহাশূন্যে মেঘের ওপারে নিঃসীম নীল আকাশে উঠে যায় ওরা। তারপর উল্কার গতিতে ছুটে চলে বাগদাদের দিকে।

মাত্র একটি রাত। হাজার হাজার যোজন পথ একটি মাত্র রাতের মধ্যে পার হয়ে ঠিক ভোরবেলায় টাইগ্রিস উপকূলে এসে হাসানের বাড়ির ছাদের ওপর এসে নামে সকলে।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

ছয়শো পনেরোতম রজনী :

আবার গল্প শুরু করে সে।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে হাসান দরজায় কড়া নাড়ে। তখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি। হাসানের মা অসাড় হয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলো। ছেলের শোকে কেঁদে কেঁদে সে প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। সারা দিন রাতে চোখের দু পাতা এক করতে পারে না। প্রতিটি রাতের প্রতিটি প্রহর ঘন্টা সে কান পেতে শোনে।

আত্মীয় পরিজন কেউই বড় একটা খোঁজ খবর রাখে না। হঠাৎ এই ভোরে কে আবার কড়া নাড়ে। হাসানের মা মেঝের ওপর শুয়ে থেকেই সাড়া দেয়, কে? কে কড়া নাড়ে?

-আমি মা, হাসান, তোমার ছেলে। দরজা খুলে দেখ, কাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

হাসানের মা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার হারানিধি হাসান আবার ফিরে এসেছে? কোনরকমে সে উঠে দাঁড়ায়। দরজায় হুড়কোখানা খোলে। তারপর সত্যি সত্যিই হাসানকে দেখতে পেয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে টলে পড়তে যায়। কিন্তু হাসান দু’হাত বাড়িয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাকে। মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, মা–মাগে। তাকিয়ে দেখ, আমি ফিরে এসেছি। আর, এই তোমার রোশনি। এই দেখ তোমার দাদুভাইরা, এদের বুকে নাও।

অনেকক্ষণ পর মা সম্বিত ফিরে পায়। রোশনি তার পা দু’খানা জড়িয়ে ধরে বলে সবই আমার দোষে হয়েছে মা। আমি ঘাট স্বীকার করছি। আর কখনো এমনটি হবে না। আপনি দেখবেন, কত ভালো মেয়ে হয়ে আমি ঘরে থাকবো। আকাশ আমাকে ডাক দিয়েছিলো, তাই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আপনাদের এতো আদর ভালোবাসা তুচ্ছ করে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মা, সে মোহ আমার কেটে গেছে। আমি আর কোথাও যাব না। এই আমার ঘর, এই আমার সংসার, এই-ই আমার ইহকাল পরকাল-সব।

এরপর হাসান তার মাকে সামনে বসিয়ে সেই দুঃসাহসিক অভিযানের আদ্যোপান্ত কাহিনী শোনালে। তার পুনরাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন নাই এখানে।

তখন থেকে হাসান তার মা বিবি-বাচ্চাদের এবং মাতৃপ্রতিম সেই বৃদ্ধাকে নিয়ে সুখ স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে থাকলো। বৎসরান্তে একবার করে সে তার সাত বোনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে যেত। যাবার সময় রোশনিকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে আদর সোহাগ করতে করতে কানে কানে বলে যেত, আবার পালিয়ে যাবে না তো?

গল্প শেষ করে শাহরাজাদ সুলতান শারিয়ারের মুখের দিকে তাকায়। সুলতান এতক্ষণ গল্পের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে দিয়ে বসেছিলো। গল্প শেষ হতে সে আত্মস্থ হয়।

—শুনতে শুনতে হতবাক হয়ে যেতে হয় শাহরাজাদ। সত্যিই এমন দুঃসাহসিক অভিযানে কাহিনী অনেক কাল শুনিনি। এমন তোমার শ্বাসরোধ করা গল্প যে, শুনতে আমার দরবারের কাজ কাম লাটে ওঠার দাখিল হয়েছে। র।

দুনিয়াজাদ বলে, কী চমৎকার কিসসা দিদি। তবে এ তোমার ভারি অন্যায়, গুলাবীর সঙ্গে হাসানের আর একটা শাদী দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?

শাহরাজাদ হাসে, পাগলী কোথাকার।

তারপর সুলতানের দিকে তাকিয়ে বলে রাত আর বেশি বাকী নাই। এখন নতুন কিসসা শুরু করলে আপনার ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়ে যাবে, জাঁহাপনা। এমনিতেই তো আমাকে দোষারোপ করছেন, আমার জন্যেই নাকি আপনার দরবারের জরুরী কাজ কাম নষ্ট হচ্ছে।

সুলতান শারিয়ার বলে, তা হোক, তবু তোমর কিসসা শুনে মেজাজ তো খুশ থাকে। ঠিক আছে, আজ আর, নতুন কাহিনী নয়, এখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি। এসো আমরা একটু ভালোবাসা’ করে ঘুমিয়ে পড়ি।

তারপর দুনিয়াজাদের দিকে চোখ পাকিয়ে সুলতান শাহরিয়ার কপট তম্বি করেন, দুনিয়া, তুম ইধার মৎ দেখো, আঁখ বন্ধ করকে শো যাও।

এর পর ওরা এক সময় সব কাজ সাঙ্গ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *