2 of 4

৩.০৭ মিশরের ফাল্লাহ ও তার ফর্সা ছেলেমেয়েরা

মিশরের ফাল্লাহ ও তার ফর্সা ছেলেমেয়েরা

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে সুলতান শাহরিয়ারের দিকে তাকায়। শাহরিয়ার বলে, ভারি সুন্দর তোমার কিসসা, শাহরাজাদ। মন ভরে যায়। তোমার এই গল্প থেকে অনেক অজানা জিনিস জানলাম। অবশ্য দরিয়া আবদাল্লার কাহিনীও বহুৎ মজাদার ছিলো। পানির নিচে যে কী অদ্ভুত সুন্দর দেশ আছে তা তো আগে জানতাম না। আচ্ছা, শাহরাজাদ, শয়তান বদমাইশের গল্প শোনবে দু একটা?

শাহরাজাদা বলে, নিশ্চয়ই শোনাবো।

এবং শাহরাজাদ বলতে থাকে।

কাইরোর সুবাদার আমির মহম্মদ এই কাহিনীটি বলেছিলেন।

মিশরের উত্তরাঞ্চলে সফর করার কালে এক রাতে আমি এক জিলার সেরা চাষীফাল্লার অতিথি হয়েছিলাম। বয়সে তিনি প্রাচীন। এবং গাঢ় তামার মতো তার গায়ের বর্ণ। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, তার ছেলেমেয়েরা সকলে ধবধবে ফর্সা। চিবুকে গোলাপী আভা। চোখ নীল এবং চুল হালকা নরম।

ফাল্লা সাহেব আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার গায়ের রং তামাটে, কিন্তু আপনার ছেলেমেয়েরা তো সব চাদের মতো ফুটফুটে সুন্দর?

তিনি সহাস্যে বললেন, ওদের মা ফ্রাঙ্ক দেশের মেয়ে। আমি তাকে এক যুদ্ধ বন্দিনী হিসেবে কিনেছিলাম। হিতিনের যুদ্ধে সালা অল দিন খ্রীস্টানদের আক্রমণ প্রতিহত করে পরাজিত করেছিলেন। সেই থেকে জেরুজাস খ্রীস্টান আক্রমণ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে।

এসব অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন আমি সবে যৌবনে পা দিয়েছি।

আমি বললাম, যদি মেহেরবানী করে শোনান সে কাহিনী–

নিশ্চয়ই শোনাবো। সেই খ্রীস্টানদের সঙ্গে আমার দুঃসাহসিক অভিযান বড়ই আশ্চর্যজনক।

আপনি হয়তো জানেন, আমি একজন শন-চাষী। এটা আমাদের বংশগত ব্যবসা। আমার বাবা, আমার বাবার বাবা, সকলেই এই কাজ করে গেছেন। আমি উত্তরাধিকার সূত্রে এই কাজ করি। ফাল্লা আমাদের পৈতৃক উপাধি।

এক বছর কপাল জোরে অনেক ভালো আবাদ হয়েছিলো। শনের গাছগুলোর এমনই বাড়-বাড়ন্ত চেহারা হয়েছিলো যে প্রায় পাঁচশো দিনারের ফসল ঘরে তুলতে পারলাম। কিন্তু বাজারে গিয়ে বোকা বনে গেলাম। আড়ৎদাররা এমন দাম বলে যাতে বিক্রি করলে নাফা দূরে থাক, লোকসান হয়ে যায়। তারা বললো, তোমার শন নিয়ে সিরিয়ার একরে যাও। সেখানে গেলে ভালো দাম পেতে পার। ওদের কথায় আমি একর শহরে গেলাম।

এক সময় এই একর শহর ফ্রাঙ্কদের দখলে ছিলো। যাই হোক, সেখানে যাওয়াতে মোটামুটি ভালোই বাণিজ্য হলো। মালের অর্ধেকটা দালালদের ছয় মাসের বাকীতে দিলাম। আর বাকী অর্ধেকটা খুচরো খদ্দেরের কাছে বেচে বেশ মোটা লাভ বানালাম।

একদিন আমার দোকানে এক খ্রীষ্টান ফ্রাঙ্ক তরুণী এলো। আমাদের মেয়েদের মতো ওরা বোরখা-টোরখা পরে না। লাজ-শরমের বালাই নাই, শরীরের আধখানাই খোলামেলা।

মেয়েটি সুদর্শনা, সুন্দরী এবং ধবধবে ফর্সা। প্রথম দর্শনেই আমার খুব ভালো লেগে গেলো। যতক্ষণ সে আমার দোকানে বসেছিলো, আমি শন ওজন করা এবং দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম ওর দেহ-সৌষ্ঠব, মুখশ্রী, আয়ত চোখ। আজ বলতে লজ্জা নাই, ন্যায্য যা দাম হয় তার চেয়ে অনেক কম দামই নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। দোকান থেকে বেরিয়ে সে চলে যায়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি—যতদূর। চোখ যায়।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো বাহান্নতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে।

এর কয়কেদিন পরে আবার সে এলো। এবার আমি তাকে আরও সস্তা দরে মাল বেচলাম। মেয়েটি কিন্তু আদৌ দর-দাম করে না। আমি হিসেব করে যা বলি তাই সে দিয়ে চলে যায়।

এরপর আরও একবার এলো সে। বুঝতে পারলাম, আমি যে ওকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে দেখি সে ব্যাপারটা ওর চোখ এড়ায়নি। এবার সে একা আসেনি। এক বৃদ্ধা রমণীকে নিয়ে এসেছে সঙ্গে।

এই বুড়িটা আমার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে কী যেন তল্লাস করে দেখতে থাকলো।

এরপর আরও কয়েকবার মেয়েটি এসেছে, আমার দোকানে। বলাবাহুল্য উদ্দেশ্য—শন কেনা। কিন্তু প্রতিবারই ঐ বুড়ি মেয়েছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

দিনে দিনে মেয়েটির প্রতি আমি গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি। বুকের মধ্যে হু হু করে পুড়ে যেতে থাকে।

একদিন বুড়িটাকে একান্তে ডেকে বললাম, মেয়েটির সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিতে পার? আমি তোমাকে খুশি করে দেবো।

বুড়িটা বলে, দেবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমি তুমি আর সে ছাড়া কাক-পক্ষীটি জানবে না এই গুপ্তমিলনের কথা।

আমি বললাম, আমার তরফ থেকে কোনও বেইমানী হবে না, কথা দিচ্ছি।

বুড়ি বললো, ঠিক আছে দিনক্ষণ ঠাই সব জানাবো তোমাকে। যথাসময়ে যথাস্থানে সঙ্গে কিছু পয়সা-কড়ি নিয়ে হাজির থেক, কেমন?

আমি বলি, আমি তৈরি আছি, তুমি ব্যবস্থাপত্র করো। পয়সা কড়ি আমার কাছে তুচ্ছ। আমি চাই ওর ভালোবাসা। তারজন্য যত টাকা লাগে আমি দু-হাতে খরচ করবো। আচ্ছা বুড়ি মা, তোমাকে কী দিতে হবে, বলল। তোমারটা আগাম দিয়ে দিই।

সে বলে, ও নিয়ে বিশেষ ভাবনার কারণ নাই, বাছা। সে হবে খন।

-না না, সে হয় না। এই নাও ধর, পঞ্চাশটা দিনার রাখ এখন।

আমি প্রায় জোর করেই ওর হাতে গুঁজে দিই টাকাটা। বুড়ি আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো, তুমি একটু দাঁড়াও বাবা, আমি ওকে জিজ্ঞেস করে এসে বলছি।

বুড়িটা সুন্দরীর কাছে গিয়ে কী সব আলোচনা করলো, বলতে পারবো না। একটু পরে সে ফিরে এসে বললো, ওর কোন জানা জায়গা কোথাও নাই। একেবারে আনকোরা কুমারী মেয়ে। এ সবের মর্ম সে এখনও বোঝে না। তা বাবা তোমার বাড়িতেই ব্যবস্থা করো না কেন? সন্ধ্যাবেলায় দিয়ে যাবো ওকে, আর সকালবেলায় নিয়ে যাবো। আমার মনে হয়, সে-ই ভালো হবে।

আমি বললাম, তা হতে পারে। আমি তো একলাই থাকি, কোনও অসুবিধে হবে না।

সেইদিনই সন্ধ্যায় সে আসবে—সেই রকমই ঠিক হলো। আমি সকাল সকাল দোকান-পাট বন্ধ করে মাংসের অনেক রকম দামি-দামি খানা, তন্দুরী, ফল, মিষ্টি এবং শরাব, গোলাপ জল নিয়ে বাসায় পৌঁছলাম। সব সাজিয়ে গুছিয়ে অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকলাম।

যথাসময়েই সে এলো।

তখন গ্রীষ্মকাল। আমি ছাদের ওপরে ফরাস পেতেছিলাম। ওকে সঙ্গে করে ওপরে নিয়ে গেলাম। পাশাপাশি বসলাম। দু’জনে মিলে খানাপিনা করলাম। তারপর সুরার পেয়ালা পূর্ণ করে নিলাম আমরা।

আমার বাসাটা একেবারে সমুদ্র উপকূলে। সেদিন ছিলো শুক্লপক্ষের শেষের দিকের এক তিথি। চাদের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা ছাদে। সমুদ্রের জলে এক অপূর্ব যাদু লেগেছিলো সেদিন। সেই মনোহর দৃশ্য আজও আমার চোখে ছবির মতো ভেসে ওঠে।

আমার মনের মধ্যে কী যেন তোলপাড় শুরু হয়। সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, এই সুন্দর ধরণীতে আমি যেন এক অসুন্দর, অসুর। তা না হলে, আমি আল্লাহর দোয়াতে এই দুনিয়ায় এসেছি, তাকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি, অথচ তার বাণী আমি বিস্মৃত হয়ে এক বিধর্মী খ্রীস্টান কন্যাকে অঙ্কশায়িনী করার জন্যে লোলুপ হয়ে উঠেছি। ছিঃ ছিঃ, ধিক আমাকে।

যদিও আমরা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে পড়েছিলাম তবু নিজেকে সংযত করে একটু সরে গিয়ে বললাম, এই চাঁদিনী রাত, মৃদুমন্দ হাওয়া, সমুদ্রের শোভা, শরাবের গুলাবী নেশা এবং তোমার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য-এর বেশি আর কী কাম্য হতে পারে প্রিয়া। নাই বা হলো আমাদের। দেহ-মিলন, আজকের মধুযামিনী এমনি মধুর হয়েই কাটুক না।

মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমার হৃদয়ের অনুভূতি ও হয়তো বুঝতে পারে না। আমার মতো একটি জোয়ান পুরুষের নিরালা সঙ্গ পাওয়ার পর তার মনের সুপ্ত নারী-সত্তা ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছিল। সে আমি বুঝতে পারছিলাম। ক্রমশঃ সে উজ্জ্বল এবং প্রগলভ হয়ে উঠছিলো। আমার গায়ে হাত রাখছিলো। আমার মাথার চুলের মধ্যে বিলি কেটে আদর করতে করতে ওর মুখখানা অস্বাভাবিকভাবে নামিয়ে নিয়ে আসছিলো আমার মুখের ওপর।

আমি ওকে আলতোভাবে সরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ থাক সোনা। অন্য দিন হবে। আজ শুধু তোমাকে, চাঁদকে আর এই সমুদ্রকে নয়ন ভরে দেখি, কেমন?

মেয়েটি লজ্জা পেয়ে সরে যায়।

সে রাতে আমি আর সে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়েছিলাম বটে কিন্তু কেউ কারো কাছে ঘেঁষে আসিনি বা অঙ্গ স্পর্শ করিনি।

খুব সকালে ফ্রাঙ্ক-সুন্দরী ঘুম থেকে উঠে নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমি আমার দোকানে এসে বসলাম।

ঠিক দুপুরবেলায় মেয়েটি আমার দোকানের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেলো। দেখলাম, ওর চোখের দৃষ্টিতে সাপিনীর ক্রোধ। এবার আমি আর নিজেকে সহজ সংযত করে রাখতে পারলাম না। মেয়েটির সারা চোখে মুখে অতৃপ্ত কামনা ক্ষুধা। আমাকে দেখে ফুঁসতে থাকে। তখন ওকে আরও অনেক অনেক বেশী সুন্দরী মনে হতে লাগলো। আমার সমস্ত দেহমন ওর সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কাল রাতে হঠাৎ তুমি এতো উদাস বিবাগী পীর মুসাফিরের মতো হয়ে গেলে কেন? তুমি না কাইরোর ফাল্লা। ভোগ-বিলাস কামনা-বাসনা নিয়েই তোমাদের জীবন কেটেছে এতোকাল। আজ হঠাৎ সাধু সন্ত বনে গেলে কী করে? তুমি প্রাসাদের খোজা নও। যৌবন-মদে মত্ত এক নওজোয়ান তুমি।

তবে শুধু শুধু নিজেকে বঞ্চিত করে রাখবে কেন?

মেয়েটিকে আর একবার কাছে পেতে হবে। তাকে পরিতৃপ্ত করতে হবে। নিজেরও কাম-ক্ষুধা মেটাতে হবে। এই রকমের একটা চিন্তা-ভাবনা ঘুরতে থাকলো মাথার মধ্যে। আমি ছুটে বাইরে গেলাম। বুড়িটাকে সঙ্গে করে মেয়েটি ততক্ষণে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।

বুড়িকে একপাশে ডেকে বললাম, হ্যাঁগো, বুড়িমা, আর একটা রাত ওর সঙ্গে কাটাবার ব্যবস্থা করে দাও।

বুড়ি বললো, তা দেখি চেষ্টা করে। কিন্তু সে কী রাজি হবে?

আমি বুড়ির হাতে একশোটা দিনার গুঁজে দিয়ে বললাম। রাজী তাকে করাতেই হবে। অন্ততঃ আর একটা রাতের জন্য।

বুড়ির চোখে হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। বললো, ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যাতেই নিয়ে যাবো।’

সেদিনও সন্ধ্যাবেলায় এলো মেয়েটি। কিন্তু কী আশ্চর্য, সে রাতেও চাঁদনী রাতের ঐ কাব্যগন্ধময় মনোহর শোভা দেখে চিত্ত বিগলিত হয়ে গেলো। দেহ মন থেকে উদগ্র কামনা উধাও হয়ে গেলো। আমি পারলাম না। সেদিনও পারলাম না তাকে কাছে টেনে নিতে পারলাম না ভোগ করতে তার দেহ-সুধা।

সে রাত্রিও কেটে গেলো নিরামিষ ভাবে।

মেয়েটি, বুঝতে পারলাম, আমার এই রকম অদ্ভুত আচরণে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলো না। নীরবে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

পরদিন আবার সে যখন আমার দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল আবার তাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে কামনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। আশ্চর্য!

সে কিন্তু আমার দিকে বিষ-দৃষ্টিতে তাকালো। মনে হতে লাগলো, এখনি বুঝি পঞ্চশরে দগ্ধ করে দেবে আমাকে।

মেয়েটি আমার সামনে এগিয়ে ভুরু কুঁচকে ক্রুদ্ধ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে বললো, প্রভূ খ্রীষ্টের নামে বলছি, ওগো মুসলমানের সন্তান, এই কী তোমাদের ধর্মের শিক্ষা? একটি নবযৌবন-উদ্ভিন্ন কুমারী মেয়েকে পাশে শুইয়ে তসবীর জপ করো তোমরা? আর কখনও ভেবো না, আমার দেখা পাবে।

নিরুপায় হয়ে আমি বুড়ির শরণাপন্ন হলাম। সেও দাও বুঝে কোপ বসালো। বললো, এবার পাঁচশোর কমে হবে না বাছা।

বুড়ি আর দাঁড়ালো না। মেয়েটিকে নিয়ে হন হন করে চলে গেলো।

আমার বুকে তখন কামনার আগুন ধকধক করে জ্বলছে। যে ভাবে হোক ওকে ভোগ করতে হবে, এই আমার তখন একমাত্র চিন্তা। পাঁচশো দিনার আমার কাছে অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও টাকা পয়সার কথা চিন্তা না করে একটা থলেয় পাঁচশোটা দিনার ভরে ছুটে যাবো বুড়ির কাছে, হঠাৎ এমন সময়…

ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো শাহরাজাদ।

 

পাঁচশো তিপান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

আমি শুনতে পেলাম, সুলতানের আমির সনদ ঘোষণা করে চলেছে, শোনও মুসলমান ভাই সব, যারা আমাদের শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন—অবিলম্বে তাদের দোকান-পাট গুটিয়ে ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ ব্যাপারে মাত্র এক সপ্তাহের সময় মঞ্জুর করা হচ্ছে।

আমার সব কামনা বাসনা মাথায় উঠলো। তড়িঘড়ি মাল যা ঘরে ছিলো সব বেচে সাবাড় করতে লাগলাম। দালালদের বললাম, আমার পাওনা-গণ্ডা সব মিটিয়ে দাও তোমরা, আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে।

টাকা পয়সা যা আদায়, বিক্রি হলো তা দিয়ে নানারকম জিনিষপত্র সওদা করলাম। আমাদের দেশে সেগুলো বেচে লাভ হবে।

সাতদিনের মাথায় একর শহর ত্যাগ করে দেশের পথে রওনা হলাম। মন ভারাক্রান্ত ছিলো, কারণ আমার একমাত্র কামনা—সেই খ্রীস্টান মেয়েটির সঙ্গে সহবাস আর হলো না।

প্রথমে আমি দামাসকাসে এলাম। সেখানকার বাজারে বেশ ভালো মুনাফায় অনেক জিনিষপত্র বেচলাম। এতে মোটা লাভ আমি আশা করিনি। কিন্তু যুদ্ধের দামামা বাজছে। অন্য দেশ থেকে মালপত্রের আমদানি ছিলো কম। সেই কারণে আমার মাল আশাতীত চড়া দামে বিকিয়ে গেলো। অবশ্য সবই খোদার দোয়া। তা না হলে যে কাজেই হাত দিই, সোনা ফলে কেন?

সে সময় একটা জব্বর ব্যবসায়ে নেমে পড়লাম। মোটা লাভ। যুদ্ধে যে সব খ্রীস্টানরা বন্দী হতো, তাদের নিলামে তুলে বিক্রী করে দিত সরকার। আমি এই নিলাম ডাকতে শুরু করলাম। নতুন জাতের ব্যবসা। অনেকেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকলো। কিন্তু আমি বেপরোয়া হয়ে। উঠেছি তখন। লাভ হোক, লোকসান হোক, ছাড়বো না।

লোকসান দূরে থাক, লাভের অঙ্কের কোনও সীমা সংখ্যা রইলো না। এক একটা চালান পানির দরে কিনি। আর তার এক একজন বন্দীকে বিক্রি করে কেনা দামের দশগুণ উঠে আসে। যুদ্ধের ভয়ে অনেক বড় মহাজন শহর ছেড়ে পালিয়ে গণ্ডগ্রামে চলে গিয়েছিলো। আমার পক্ষে সুবিধে হলো সেই। কারবারে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে তবে যা খুশি দাম হেঁকে মাল বেচা সম্ভব। আমারও হলো তাই। আমি সর্বেসর্বা। আমার ওপরে টেক্কা দিয়ে নিলাম ডাকার মতো মক্কেল মহাজন তখন সারা দামাসকাসে কেউ ছিলো না।

এইভাবে পুরো তিনটি বছর দু’হাতে কামিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে আমার মনে সেই খ্রীষ্টান মেয়েটির স্মৃতি অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছিলো।

আমাদের সুলতানের বিক্রমের কাছে খ্রিস্টান ফ্রাঙ্করা দাঁড়াতে পারলো না। ফ্রাঙ্ক-কবলিত জেরুজালেম এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল অধিকার করে নিলেন। ফ্রাঙ্করা প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে সুলতান বাহিনীর হাতে বন্দী হতে লাগলো। আর যত বন্দী আসে, ততই আমার পোয়া বারো, জলের দামে কিনে সোনার দামে বেচা।

একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটলো। একটি সুন্দরী বাদী সংগ্রহ করে সুলতানকে ভেট দিতে তার তাবুতে গিয়েছি। বাঁদীটিকে সুলতানের বেশ পছন্দ হয়ে গেলো। খুশি হয়ে তিনি আমাকে একশো দিনার বকশিশ দিতে বললেন তার উজিরকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই লড়াই ক্ষেত্রের খাজাঞ্চীখানায় সেদিন একশোটি দিনারও পুরো ছিলো না। প্রতিদিন যুদ্ধের খরচ এলাহী। প্রাসাদ থেকে রোজই টাকা আসে। রোজই সব খরচ হয়ে যায়। যাই হোক, উজির বললেন, তহবিলে মাত্র নব্বইটা দিনার আছে।

সুলতান বিচলিত বোধ করলেন, ঠিক আছে, ঐ নব্বইটা দিনারই দিয়ে দাও একে। আর আমার যুদ্ধবন্দীদের খোঁয়াড়ে নিয়ে যাও।

সুলতান আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ঐ বাকী দশ দিনারের জন্য যে কোনও একটি বাঁদী পছন্দ করে, নিয়ে যাও তুমি।

এসবের কোনও প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু সুলতানের জবান থেকে বেরিয়েছে, আমাকে একশো দিনার দিতে হবে। সে কথার খেলাপ হবে কী করে?

প্রহরী আমাকে বন্দী করে খোঁয়াড়ে নিয়ে গেলো। খোঁয়াড়টা দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে মেয়ে আর একদিকে পুরুষদের আটক করে রাখা হয়েছে। আমাকে সে নিয়ে গেলো মেয়েদের খোঁয়াড়ে। হাজারখানেক বন্দিনী-আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎ নজর পড়লো, সেই ফ্রাঙ্ক-সুন্দরীর ওপর। ওর সঙ্গে আমি দুটি অ-সহবাস রাত্রি কাটিয়েছিলাম একদা। খুব চেনা মুখ, প্রথম দর্শনেই চিনতে পারলাম। বুকের মধ্যে পুরোনো ক্ষতটা টনটন করে উঠলো।

একর শহর ছেড়ে চলে আসার পর সে এক খ্রীস্টান সেনাপতির অঙ্কশায়িনী হয়েছিলো। in ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে প্রহরীকে বললাম, এই মেয়েটিকে আমি নেব।

মেয়েটির নাম ড্যামজেল। ওকে সঙ্গে নিয়ে আমার তাঁবুতে ফিরে এলাম।

—আমাকে চিনতে পার? ড্যামজেল ঘাড় নাড়ে, না। আমি চিনতে পারছি না।

-কেন মনে পড়ছে না, তুমি আমার দোকানে যেতে সওদা করতে। তোমার সঙ্গে এক বুড়ি থাকতো। এক শহরের সমুদ্র উপকূলের এক, ভাড়াবাড়িতে আমি থাকতাম। পরপর দুটি রাত্রি তুমি আমাকে সঙ্গসুখ দিয়েছিলে, মনে নাই? অত কাছে নিভৃতে পেয়েও আমি কিন্তু তোমার কুমারীত্ব নষ্ট করিনি সেদিন। এবং সেই কারণেই বোধ হয় তুমি আমার ওপর ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলে। তবে বিশ্বাস কর, তৃতীয় রাতেও তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে আসতাম আমি। আমার ইচ্ছে ছিলো, সেই রাতে আমি তোমার দেহ-সম্ভোগ করবো। তোমার বুড়ি আমার কাছে পাঁচশো দিনার সেলামী চেয়েছিলো। দেবার জন্যে তৈরিও হয়েছিলাম। কিন্তু নসীব খারাপ, সেইদিনই সরকারের হুকুম জারী হলো, বিদেশী মুসলমান সওদাগরদের ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফিরে যেতে হবে। সুতরাং মনের খেদ মনেই রয়ে গেলো। আর তোমার সঙ্গে মিলতে পারলাম না। সেদিন একটা রাতের জন্য পাঁচশো দিনারও দিতে তৈরি ছিলাম, কিন্তু কপাল দোষে পাইনি। আজ কিন্তু সামান্য দশটা দিনারের বিনিময়ে তোমাকে চিরকালের মতো লাভ করেছি, ড্যামজেল! এখন থেকে তুমি আমার।

ড্যামজেল মাথা নিচু করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললো, সেদিন আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছ তোমার বাসায় আর কেনই বা নিজে অভুক্ত থেকে আমাকে উপবাসী রেখে বিদায় করে দিচ্ছ—ঠিক বুঝতে পারিনি তখন। আমি রুষ্ট হয়েছিলাম তোমার ওপর, কিন্তু পরে বুঝেছি। ইসলামের নির্দেশ তোমাকে ঐ ব্যভিচার করতে দেয়নি। সেই থেকে ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে আমার ভ্রান্ত ধারণার অবসান হয়েছে। এখন আমি মনে-প্রাণে পয়গম্বর মহম্মদের বাণীই গ্রহণ করে নিয়েছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কোনও মহান্ শক্তির অস্তিত্ব নাই।

খোদা কসম, সেই রাতেও আমি তাকে শয্যা সঙ্গিনী করতে পারলাম না। কারণ সে তখনও আমার কেনা বাঁদী। বিধিমতে আগে তাকে মুক্ত করতে হবে। তারপর ইসলাম-ধর্মমতে আমি শাদী করতে পারবো তাকে।

এরপর কাজী ও সাক্ষী-সাবুদ ডেকে ড্যামজেলকে আমি শাদী করেছিলাম। আমার ঔরসে সে গর্ভবতী হলো। আমরা দামাসকাসে পাকাপাকি বসবাস করতে থাকলাম।

আমাদের শাদীর বেশ কিছুকাল পরে একদিন ফ্রাঙ্কের সম্রাটের দূত এলো আমদের সুলতান সালা-অল-দিনের দরবারে। যুদ্ধ তখন শেষ হয়ে গেছে। কতকগুলো শর্তে সন্ধি হয়েছিলো দুই পক্ষের। সেই সূত্রেই দূত এসেছিলো। উদ্দেশ্য যুদ্ধবন্দী বিনিময় চুক্তি হবে।

আলোচনায় সাব্যস্ত হলো, ফ্রাঙ্কের সমস্ত নারী-পুরুষ বন্দীদের ফেরত দেওয়া হবে। অবশ্য ফ্রাঙ্ক-সম্রাটও সমস্ত মুসলমান বন্দীদের ওয়াপস করে দেবে।

সুলতানের সেনাপতি একখানা ফর্দ দিলো। যাবতীয় বন্দীদের নাম-ধাম পরিচয় ছিলো সেই ফর্দে। দূত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলো সব। কিছুক্ষণ পরে সে বললো, কিন্তু এই ফর্দে তো একটি রমণীর নাম নাই। সে রমণী আমাদের এক সেনাপতির সহধর্মিণী। তাকে তো চাই।

সুলতান প্রহরীদের বললেন, দেখ, সে কোথায় গেলো। খুঁজে-পেতে নিয়ে এসো তাকে।

প্রহরীরা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে আমার গৃহে এসে তার সন্ধান পেলো। সুলতানকে সব ব্যাপারটা জানিয়ে আবার যখন তারা আমার কাছে ফিরে এলো, আমি ততক্ষণে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি। আমার বিবি অবাক হয়ে আমার পিঠে হাত রাখে, কী, হয়েছে কী? তোমার চোখে পানি কেন?

আমি সব বললাম তাকে।

—সুলতানের পেয়াদা এসেছে। তোমাকে নিয়ে যাবে তারা।

ড্যামজেল বললো, পেয়াদাদের যেতে বলল, তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলো দরবারে। তারপর সুলতানকে যা বলতে হয়, আমি বলবো।

বোরখা পরিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম সুলতানের দরবারে। সুলতানের এক পাশে বসেছিলো ফ্রাঙ্ক-সম্রাটের দূত।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চুয়ান্নতম রজনী : আবার সে গল্প শুরু করে :

আমি কুর্নিশ করে দাঁড়ালাম।

–এই সেই নারী, জাঁহাপনা!

সুলতান আমার বিবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী বলার আছে? এই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তুমি কী তোমার স্বদেশে ফিরে যেতে চাও? না, যেমন আছ তেমনি তোমার স্বামীর সঙ্গে এখানে ঘর করতে চাও?

—আমি আমার স্বামীর সঙ্গেই থাকতে চাই, জাঁহাপনা। তাঁর সন্তান আমার গর্ভে আছে। এবং আমি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাকে বিধিসম্মত ভাবে স্বামী বলে গ্রহণ করেছি। এখন আমি আর খ্রীষ্টান নই আর সেখানে আমার ফিরে যাওয়ারও কোন অভিপ্রায় নাই।

সুলতান সালা-অল-দিন ফ্রাঙ্ক-রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ করে বললেন, তা হলে সবই শুনলেন। এখন আপনি যদি মনে করেন, ওর সঙ্গে বাক্যালাপ করে দেখতে পারেন।

সুলতান যেভাবে প্রশ্ন করলেন, ঠিক সেইভাবে ফ্রাঙ্ক-রাষ্ট্রদূত, আমার বিবিকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি তোমার বর্তমান মুসলমান স্বামীর কাছেই থাকতে চাও? না, তোমার খ্রীস্টান স্বামীর কাছে আবার ফিরে যাবে?

আমি এই মিশরীয়কে ছেড়ে কোথাও যাবো না। এখন আমি আর খ্রীস্টান নই। ইসলাম ধর্মমতে দীক্ষা নিয়েছি।

রাষ্ট্রদূত গর্জে উঠলেন, ঠিক আছে। আমার যা জানার, জানা হয়ে গেছে। এবার তুমি যেতে পার।

বিবিকে নিয়ে আমি দরবার থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে যাচ্ছি, এমন সময় রাষ্ট্রদূত আমাকে ডাকলো, একর শহরে যে বুড়িটার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিলো, সে তোমার বিবির মা। এই মোড়কটা তোমাকে দেবার জন্য পাঠিয়েছে আমার হাতে।

আমি হাত পেতে সেই মোড়কটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। খুলে দেখি, ড্যামজেলের পুরনো ব্যবহৃত কিছু সাজ-পোশাক। আর একখানি রুমালের এক কোনায় পঞ্চাশ এবং অপর কোনায় একশোটা দিনার বাঁধা।

আমার কাছে সব ব্যাপারটা স্বচ্ছ হয়ে গেলো। তার কন্যার প্রতি আমি যে মর্যাদা দেখিয়েছিলাম এবং এখনও যে মর্যাদা তাকে দিয়েছি তারই কৃতজ্ঞতা এবং আশীর্বাদই জানিয়েছে সে।

এরপর দামাসকাস ছেড়ে আমরা মিশরে চলে এলাম। তারপর কতকাল কেটে গেছে। ড্যামজেল এক এক করে আমার ঔরসের অনেকগুলো সন্তানের জননী হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে তারা সকলেই আমার বিবির রং পেয়েছে।

এই আমার জীবনের কাহিনী, খোদা হাফেজ।

শাহরাজাদ গল্প শেষ করে। সুলতান শাহরিয়ার মুগ্ধ বিস্ময়ে বলে, ফাল্লার মতো ভাগ্যবান সুখী মানুষ কম আছে, শাহরাজাদ।

কিন্তু তার চেয়েও সুখী এবং ভাগ্যবান লোকের কাহিনী আপনাকে শোনাবো।

—কী কাহিনী?

এক জেলে খলিফা, এক সামুদ্রিক বাঁদর আর এক খলিফার কাহিনী শুনুন তাহলে—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *