গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০১. বাহাত্তর নম্বরের একেবারে চক্ষুস্থির

বাহাত্তর নম্বরের একেবারে চক্ষুস্থির।

হ্যাঁ, চক্ষুস্থির ছাড়া আর কী বলে অবস্থাটা বোঝাব?

বাহাত্তর নম্বর মানে তো তিনি, ওই নম্বরের বনমালি নস্কর লেনের একটি বেশ বয়স্ক বাড়ির তেতলার টঙের ঘরে যিনি বেশ কিছুকাল বিরাজ করছেন।

আসল তিনি, আর ফাউ হিসেবে আমরা কজন।

তা সেই তেতলার টঙের ঘরে তিনি, মানে একমেবাদ্বিতীয় ঘনাদার সঙ্গে আমাদের, মানে শিবু শিশির গৌর ও আমার চক্ষুস্থির তো তখন বটেই।

চক্ষুস্থির না বলে চক্ষুচড়কগাছও বলা যায় অবশ্য, আর আমাদের তালিকাটা একটু সংশোধন করে শিশিরকে বাদ রাখা যায়। শিশির তখন সত্যি অনুপস্থিত।

শিশির থাকুক বা না থাকুক আমাদের চোখের অবস্থায় তাতে হেরফের কিছু অবশ্য হবার নয়। দুদিন ধরে রীতিমত রিহার্সালে নিজেদের পাকিয়ে, জোড়া জোড়া চোখ একেবারে ছানাবড়া করে আমরা তখন যে যার পার্ট সিনেরিও মাফিক করে যাচ্ছি।

সত্যি কথা বলতে গেলে পার্ট যা করতে হচ্ছে তা এমন কিছু শক্ত নয়। ব্যাপার যা তখন ঘটেছে, তার হাড়-হদ্দ জানা থাকলেও চোখগুলো বুঝি আপনা থেকেই কপালে উঠে যায়।

চিত্রনাট্যটা গোড়া থেকে শোনালেই ব্যাপারটা বোঝার অসুবিধা থাকবে না।

প্রথম লং শট। বাহাত্তর নম্বরের বনমালি নস্কর লেনের তেতলার টঙের ঘরে যাবার ন্যাড়া সিঁড়ি।

ব্যস্তসমস্ত হয়ে শিবু সেখান দিয়ে ওপরে উঠেছে। শিবু তেতলার ছাদ পর্যন্ত ওঠার পরই কাট। তারপর ছাদ থেকে ক্যামেরা শিবুকেই ধরে প্যান করে টঙের ঘরের ভেতর। সেখানে পাতা তক্তপোশের ওপর গৌর ও আমি বসে অবাক হয়ে শিবুর দিকে তাকাচ্ছি আর ঘনাদা ওই তক্তপোশেরই অন্য প্রান্তে আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে একটি ছোট আয়নায় নিজেকে নিরীক্ষণ করছেন।

পরের শট-এ অ্যাকশন, মানে যাকে বলে খেল শুরু।

ব্যাপার কী! শিবুর বিমূঢ় জিজ্ঞাসা, বাহাত্তর নম্বরটা হাসপাতাল হয়ে উঠল নাকি?

হাসপাতাল? সে আবার কী? গৌর ও আমি উঠে কি দাঁড়িয়ে পড়েছি তখন!

হাসপাতাল না হলে এত ডাক্তার বদ্যি, যন্তরপাতির আমদানি কেন?

আড়চোখে ঘনাদার দিকে তখন একবার তাকিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে।

না, শিবুর ভগ্নদূতের পার্টটা একেবারে বিফলে যায়নি, ঘনাদার নিজের মুখ নিরীক্ষণ করায় একটু ছেদ পড়েছে। মুখটা না হলেও কানটা এদিকে ফেরানো।

তারস্বরে এবার তাই বিমূঢ় বিস্ময় প্রকাশ করতে হয়েছে। ডাক্তার-বদ্যি, যন্ত্রপাতি আসছে বাহাত্তর নম্বরে? কী বলছিস, কী! মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?

মাথা খারাপ হওয়ার অপরাধ কী? শিবুর ক্ষুব্ধ স্বর—চেয়েই দেখোনা একবার।

সেই চেয়ে দেখার পর চক্ষুস্থির না হয়ে পারে? সিঁড়ি দিয়ে যেন মিছিল করে যাঁরা উঠে আসছেন তাঁদের পরিচয় সাজ-সরঞ্জামেই অনেকখানি মালুম।

এটা কি মি. দাসের ঘর? প্রথম জনের জিজ্ঞাসা, তাঁর হাতের ব্যাগটার মর্ম যদি প্রথমে না-ও বোঝা যায়, গলায় ঝোলানো স্টেথিস্কোপটা ভুল করবার নয়।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাই নিজেদের বিস্মিত কৌতূহলটা

প্রকাশ করেছি, কিন্তু আপনি?

আমি ডাক্তার সোম। গম্ভীরভাবে যেন আমাদের বকুনি দিয়ে বলছেন ভদ্রলোক, মি. দাসের প্রেশার নিতে এসেছি।

কী নিতে এসেছেন? প্রশ্নটা সবিস্ময়ে করে ফেলার পর আমাদের হাঁকরা মুখগুলো যেন আর বোজাবার অবসর মেলেনি।

প্রেশার যিনি নিতে এসেছেন তাঁর পেছনে ব্যাগ হাতে আর-এক মূর্তি আর এ দুজনের পেছনে বাহকের মাথায় ছোটখাটো একটা যন্ত্রাগারের নমুনা চাপিয়ে অন্য একজন।

আমাদের অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলো যেন অনুমান করে নিজেরাই তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন।

প্রেশার নেবার জন্য যিনি আগে ঢুকেছেন তাঁর পরের জন আমাদের যেন আশ্বস্ত করবার সুরে বলেছেন, ভাবনার কিছু নেই। আমি শুধু একটু রক্ত নেব।

আঁ! রক্ত নেবেন? ঘনাদার?

আমাদের সম্মিলিত আর্তনাদের ওপরই তৃতীয় জন যেন বরাভয় দেবার মতো করে তাঁর পরিচয় দিয়েছেন, আমার কার্ডিয়াগ্রাম।

ভ্যাবাচাকা ও ভয়ে-কোঁকড়ানো চেহারা নিয়ে ওরই মধ্যে ঘনাদার দিকে একবার চেয়ে দেখে নিয়েছি।

হ্যাঁ, ওষুধ ধরেছে বলেই মনে হচ্ছে। ঘনাদা অন্তত আর্শিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে তাঁর ঘরের দেওয়ালের কেরোসিন কাঠের শেলফে সেটা রেখে যেভাবে কী খোঁজাখুঁজি করবার ভান করছেন সেটা দিশাহারা অবস্থাটা ঢাকবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু বোধহয় নয়।

চিকিৎসা-জগতের তিন প্রতিনিধির তখন ঘরের ভেতরে ঢুকে কোনও অস্বস্তি কি আড়ষ্টতার চিহ্নমাত্র নেই, যেন নিত্যই এখানে আসেন-যান এমনই স্বচ্ছন্দে নিজেদের মধ্যে তাঁরা একটা আপস করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই।

আপনি রক্তটা আগে নিন ড. গুপ্ত! প্রেশার মাপার সোম সৌজন্য দেখিয়েছেন রক্ত নেবার গুপ্তকে।

না, না, তা কি হয়! গুপ্ত পাল্টা বিনয় দেখিয়েছন, আপনার প্রেশার আগে। আপ উঠিয়ে ভদ্রতা মিনিট দশেক ধরে চলেছে তারপর।

বিনয়ের পাল্লা দুজনের কেউ হারতে না চেয়ে প্রেশারের সোম আর রক্তের গুপ্ত শেষ পর্যন্ত হৃদয়কেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে সাব্যস্ত করেছেন।

আপনিই কার্ডিয়োগ্রামটা আগে করে ফেলুন ড. সান্যাল। সমস্বরে অনুরোধ জানিয়েছেন সোম আর গুপ্ত।

বেশ তাই। এ সম্মানে যেন বেশ বিব্রত হয়ে ড. সান্যাল তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে তাঁর যন্ত্রপাতি খাটাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন।

এ নাটক যখন চলছে তখন আমরা তো ােেম মেরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন সেই ঘনাদা করছেন কী এতক্ষণ ধরে!

ওষুধের কাজও এতক্ষণে শুরু হয়ে যাওয়া উচিত। তার লক্ষণ কিছু দেখা যাচ্ছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঘনাদা তখনও শেলফটার এ-তাক ও-তাক ঘাঁটাঘাঁটিতেই যেন তন্ময়। তাঁর ঘরে এত বড় একটা উপদ্রব যে চলেছে সে বিষয়ে যেন হুঁশই নেই।

আচ্ছা, হুশ হয় কি না দেখা যাক।

এখনও পর্যন্ত বড়ে-ঘোড়া-গজের চালই চলেছে। নৌকো, আর তারপর দাবার চালটা এবার পড়ুক।

নৌকার চালটা কার্ডিয়োগ্রামের সান্যালই দিলেন। মধুর কণ্ঠে জানালেন, আপনাকে এবার একটু শুয়ে পড়তে হবে, মি. দাস!

আমরা একদৃষ্টিতে তখন ঘনাদার দিকে তাকিয়ে। বুকের ধুকধুকুনিটা বেড়ে গেছে। কী করবেন এবার ঘনাদা? এইবার কি ফাটবেন?

না, সলতে ঠিক যেন ধরল না। চালটা বুঝি ভেস্তেই গেল। বিস্ফোরণের বদলে ঘনাদা এতক্ষণে ঘাড় ফিরিয়ে প্রথম যেন তাঁর ঘরের অনধিকার প্রবেশের ভিড়টা লক্ষ করলেন। তারপর অতি সরল ভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন, শুয়ে পড়তে হবে?

এ সরল জিজ্ঞাসার মানে, নৌকোর চালটা ফসকেছে। তা ফসকাক, এরপর মোক্ষম দাবার চাল যা আছে, ববি ফিসার হয়েও তা সামলাতে পারবেন না।

সেই দাবার চালই এবার পড়ল। একেবারে যেন সেকেন্ডের কাঁটা মিলিয়ে শিবুর চেয়েও অস্থিরভাবে হাঁফাতে হাঁফাতে শিশিরের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ।

কার্ডিয়োগ্রামের সান্যাল ঘনাদার সরল জিজ্ঞাসার জবাবে যা বলতে যাচ্ছিলেন তা আর বলা হল না।

সে কী! আপনারা করছেন কী? শিশির এসেই একেবারে সকলের ওপর খাপ্পা। এখনও শুধু গজল্লা করছেন?

আর তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছ কী? শিশির আমাদেরও রেহাই দিলে না, হাঁ করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছ?

আমরা, মানে আমরা যেন লজ্জিত হয়ে নিজেদের অসহায় অবস্থাটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ এই এত ডাক্তারবদ্যি যন্ত্রপাতি কেন?

কেন? শিশির আমাদের বুদ্ধির জড়তা আর স্মৃতিশক্তির অসাড়তায় যেন স্তম্ভিত—এ ঘরে কেন এত ডাক্তার বদ্যি জিজ্ঞেস করছ তোমরা? কিছুই তোমরা জানো না? গোনা-গুনতি এই তিন জন ডাক্তারকে দেখেই বিরক্ত হচ্ছ? এখনও তো আর সবাই এসেই পৌঁছননি?

আরও কেউ কেউ আসবেন নাকি? শিবুর শঙ্কিত বেফাঁস প্রশ্ন।

বাঃ, আসবেন না? শিশির আমাদের অজ্ঞতাকে যেন তিরস্কার করলে, ই-এন-টি মানে ইয়ার-নোজ-থ্রোট, আই স্পেশ্যালিস্ট, ডার্মাটোলজিস্ট, কিরোপডিস্ট, এক্স-রে ফটোগ্রাফার, মায় সাইকোঅ্যানালিস্ট পর্যন্ত আসছেন। এঁরা কেন আসছেন এখনও জিজ্ঞাসা করতে চাও? বলতে চাও যে অতবড় গুরুতর ব্যাপারটা ভুলেই গেছ? কী হয়েছিল মনেই পড়ছে না?

না, না, পড়ছে পড়ছে। আমরা যেন হঠাৎ স্মরণশক্তি ফিরে পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলাম, আমাদের খুব দেরি হয়ে গেছে কিন্তু। সেই আগের হপ্তা থেকে ঘনাদার শরীর খারাপ, আর আমরা চুপ করে বসে আছি।

চুপ করে বসে আছি! শিশির এবার আমাদের ওপর চটল। চুপ করে থাকলে এঁরা সব এলেন কোথা থেকে! সেই শনিবার থেকেই এই ধান্ধায় লেগে আছি। ঘনাদার একেবারে থরো চেকিং না করিয়ে ছাড়ব না।

যাঁর উদ্দেশে এত বড় নাটক তিনি এই মোক্ষম চালে কুপোকাত না হয়ে যাবেন। কোথায়?

তাঁর দিকে ফিরে অত্যন্ত যেন কুণ্ঠিত হয়ে শিশির এবার মিনতি জানাল, আপনার ওপর একটু অত্যাচার করব, ঘনাদা।

বেশি কষ্ট অবশ্য দেব না। আশ্বাসও দিলে তারপর, এই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই এঁদের যা করবার এঁরা সেরে ফেলবেন।

বেশি কিছু তো নয়। শিশির ভরসা দেবার কারণগুলো ব্যক্ত করলে, আপনার প্রেশার উঠছে না নামছে হাত বেঁধে একটু দেখা, হৃৎপিণ্ডটায় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে কি না ইলেকট্রো কার্ডিয়োগ্রামে তার একটা ছাপ নেওয়া, শরীরের ভেতরের কলকবজা হাড়গোড়ের গলদ ধরবার জন্যে এক্স-রে ফটো তোলা, আর চিনি কোলেস্টেরল ইউরিয়া ঠিক মাপ মতো আছে কিনা পরীক্ষা করবার জন্য শিরা থেকে একটু রক্ত টেনে নেওয়া। তা-ও বড়জোর পো খানেক।

পো খানেক? আমরা রিহার্সেল মাফিক যথারীতি শিউরে উঠলাম—পো খানেক রক্ত নেবে?

হ্যাঁ, নেবে তো হয়েছে কী? শিশির আমাদের ধমকালে, ঘনাদা কি দুধের বাচ্চা যে পো খানেক রক্ত দিয়ে একেবারে দেউলে হয়ে যাবেন? এই রক্তটুকু থেকে কাজ কী হবে ভাবো দেখি? সব কিছু পুরো পরীক্ষার পর ডাক্তারদের আর আন্দাজে ঢিল ছুড়তে হবে না। রোগের জড়টি নির্ভুলভাবে ধরে উপড়ে ফেলে দেবেন।

এঁরা তা হলে কাজ শুরু করুন, কী বলেন? শেষ অনুমতি-ভিক্ষাটা ঘনাদার কাছে।

আমরাও তখন উৎসুকভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে। মেগাটন গোছের কিছু একটা ফাটবে আমাদের আশা।

ঘনাদা তখনও অবশ্য শেলফের কাছেই দাঁড়িয়ে। হাতে ছোট একটা কাগজের পুরিয়া বলেই মনে হল। এত শেলফ ঘাঁটাঘাঁটি করে এইটিই বার করেছেন নাকি!

তা যাই করুন, ওই কাগজের পুরিয়া এ সংকট থেকে তো তরাবে না! যে বেড়াজালে ঘেরা হয়েছে, তা কেটে বেরুতে, হয় হার মেনে নাকে খত দিতে হয়, না হয় বোমার মতো ফাটতেই হবে।

আর তা হলেই যে জ্বালায় এই কদিন উনি আমাদের জ্বালাচ্ছেন সব তার শোধবোেধ।

কিন্তু কই? নরম গরম কোনও লক্ষণই যে দেখা যাচ্ছে না।

সেই যে বলে অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর—তাই হয়ে গেলেন নাকি! আমাদের আর ডাক্তারদের নিয়ে সপ্তরথীর বেষ্টনে একেবারে ভ্যাবাচাকা ভোম!

একটু উসকে দিতে হল তাই।

আর দেরি করবেন না, ঘনাদা! ডাক্তারবাবুরা অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছেন। রোগটা যখন আপনার অমন বেয়াড়া, তখন হদিস পেতে এসব পরীক্ষা তো করালে নয়।

পরীক্ষা করাতেই তোমরা বলছ? ঘনাদা যেন নেহাত সরলভাবে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন।

উত্তর দেব কী, বুকের ধুকপুকুনি তখন বেড়ে গিয়ে আমরা চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছি। এত মাথা খাটিয়ে সাজানো এত কষ্টের আয়োজন এমনই করে পণ্ড হবে নাকি? ঘনাদা অকুতোভয়ে সব পরীক্ষায় রাজি হয়ে আমাদের উলটো ফ্যাসাদে ফেলবেন?

করো কার্ডিয়োগ্রাম, নাও রক্ত বলে ঘনাদা যদি এখন এক কথায় তাঁর তক্তপোশে গিয়ে শুয়ে পড়েন তা হলে কেলেঙ্কারির যে কিছু আর বাকি থাকবে না। ডাক্তার সাজিয়ে যাদের আনা হয়েছে তারা যে সব জাল। হাতের শিরা থেকে রক্ত নিতে গেলে নিজেরাই ভির্মি যাবে। রক্ত নেওয়া তো দূরের কথা, প্রেশার মাপবার যন্ত্রের টিউবটাও যে তারা বাঁধতে জানে না।

আগের শনিবার থেকে অসুখের ছুতো করে এ ক-দিন ঘনাদা যা জ্বালাচ্ছেন তারই শোধ হিসেবে ঘনাদাকে একটু শিক্ষা দিতে সবাই মিলে এই ফন্দিটি এঁটেছিলাম।

যেমন অসুখ বলে ঘনাদা আমাদের সব উৎসাহে এ কদিন জল ঢেলেছেন, তেমনই তাঁর চুড়ান্ত চিকিৎসার ব্যবস্থাই করেছি। নিজেদের নয়, বেপাড়ার থিয়েটার ক্লাব থেকে ডাক্তার সাজবার লোক এনেছি ভাড়া করে, তাদের দু-চারটে বোল-চালই শেখানো হয়েছে,ঘনাদাকে ভড়কে দেবার জন্য।

কিন্তু এখন সব কিছুই যে যায় ভণ্ডুল হয়ে। শুধু ভণ্ডুল নয়, আমাদের অস্ত্রই বুমেরাং হয়ে আমাদের ওপর চড়াও হবার উপক্রম! তা হলে উপায়?

উপায় নেই। তবু উলটো গাওয়া শুরু করে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।

পরীক্ষার ঝামেলা অবশ্য বড় কম নয়। আমি যেন খুঁত না ধরে পারি না। ডাক্তারদের তো মায়া-দয়া নেই—পরীক্ষার নামে কাটা-ছেঁড়া বাঁধা-ছাঁদা ফুটো করে একেবারে জান কয়লা করে দেবে।

ঠিক বলেছ। শিবুর পোঁ ধরতে দেরি হল না—রোগের চেয়ে চিকিচ্ছের জ্বালা বেশি।

আমি হলে তো এখুনি বিদেয় করে দিতাম। গৌর শিশিরের ওপরই যেন গরম হল—শিশিরের যেমন বুদ্ধি!

না, না, শিশিরের দোষ কী? আমাদের সকলকে থ করে শিশিরের ওকালতি করতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং ঘনাদা।

বুমেরাং-এর মার এড়াবার আশা তখন ছেড়েই দিয়েছি। বিশেষ করে ঘনাদা শিশিরের সপক্ষে যা যুক্তি দিলেন তাতে। ও তো অন্যায় করেনি, ঘনাদা শিশিরকে পূর্ণ সমর্থন জানালেন, রোগটা যেখানে বাঁকা আর বেয়াড়া সেখানে তার হদিস পেতে পুরো পরীক্ষাই তো করা দরকার।

এরপর আর কী আমাদের করবার থাকতে পারে। হাল ছেড়ে দিয়ে শেষে বেইজ্জতির জন্য যখন তৈরি হচ্ছি, তখন ঘাটের কাছে এসে ড়ুবতে ড়ুবতে নৌকো আবার ভাসল।

ভাসালেন ঘনাদা নিজেই। শিশিরকে আপাতত ঠেকো দিয়ে বাঁচিয়ে তিনি যা বললেন তাতে অকূলে কূল পেয়ে আমাদের ধড়ে প্রাণ ফিরে এল।

ধড়ে প্রাণটা ফিরলেও মাথায় কিন্তু তখন চরকি পাক লেগেছে। লেগেছে ঘনাদার কথাতেই।

পরীক্ষার জন্য এঁদের সব ডাকিয়ে ভালই করেছে শিশির। ডাক্তার সাজা তিন মূর্তির দিকে যেন অভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন ঘনাদা, কিন্তু এই পুরিয়াটা পেয়ে গেলাম কিনা!

পুরিয়া? তার মানে? ও পুরিয়াটা আবার কীসের? তা পেয়ে হলটা কী?

গলার আওয়াজে নয়, আমাদের, মায় সাজা-ডাক্তারদের হতভম্ব মুখের দৃষ্টিতেই কাতর প্রশ্নগুলো ফুটে উঠল।

সে দৃষ্টি দেখেই বুঝি সদয় হলেন ঘনাদা। একটু বিশদ হয়ে জানালেন, পুরিয়াটা যখন পেয়ে গেছি তখন পরীক্ষা-টরিক্ষার আর দরকার নেই।

ওই পুরিয়া পাওয়ার জন্যই আর দরকার নেই? বিমূঢ় বিস্ময়টা নবাগতদের মধ্যে ব্লাডপ্রেশারের গলাতেই সরবে প্রকাশ পেল।

ওই পুরিয়াই তা হলে মুশকিল আসান? কার্ডিয়োগ্রামের বিস্ময়ে যেন একটু সন্দেহ মেশানো।

পুরিয়াটা কীসের? রক্ত পরীক্ষকের প্রশ্নে স্পষ্ট যেন অবিশ্বাসের সুর। আমরা তখন আবার প্রমাদ গুনতে শুরু করেছি। ভাগ্যের জোরে অনুকূল হাওয়া সবে যখন বইতে আরম্ভ করেছে, তখন এই ডেকে আনা আহম্মকগুলো দেয় বুঝি সব বানচাল করে।

শিশির তাড়াতাড়ি তাল সামলাতে তাই বলেছে, পুরিয়ায় নিশ্চয়ই আছে আসল মৃগনাভি। একেবারে তিব্বত থেকে আনা।

না, না, মৃগনাভি কেন হবে! শিবু শিশিরের ওপর টেক্কা দিয়েছে, পুরিয়ায় আছে সূচিকাভরণ, আসল শঙ্খচূড়ের বিষ ঘেঁকে তৈরি। ছুঁচের ডগায় ঠেকালেই মরা-মানুষ চাঙ্গা—

উঁহু। সূচিকাভরণ নয়। আমি গুরুগম্ভীর গলায় বলেছি, পুরিয়ায় আছে জিন সেঙ। নেপালের নিরেস রিন-সেন নয়, সাইবেরিয়ার টাইগা থেকে ভোলা আসল মাল। একরত্তি পেটে গেলে কাটা মুণ্ডু জোড়া লাগে! তাই না, ঘনাদা!

নাগাড়ে মাঠফাটানো খরার পর আকাশে কোদালে কুড়ুলে মেঘের দিকে চাষি যেমন করে চায় তেমনই করে ঘনাদার দিকে চেয়েছি এবার।

বিফলও হয়নি সে চাওয়া।

না। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনই অনুকম্পাভরে আমাদের সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে বলেছেন ঘনাদা, মৃগনাভি, সূচিকাভরণ, জিন-সেঙ, কিছুই নয়।

তবে? আমরা যেন বিমূঢ় বিহ্বল।

পুরিয়াতে আছে, ঘনাদা একেবারে মাপা এক সেকেন্ডের নাটকীয় ছেদ দিয়ে বলেছেন, শুধু একটু ছাই!