গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

ভেলা

ভেলা

অবিশ্বাস্য! অভূতপূর্ব! কল্পনাতীত!

ঠিকানা–বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন।

স্থান-দোতলার আড্ডাঘর।

সময়—শুক্রবার সন্ধ্যা ছটা।

কুশীলব—শিব শিশির গৌর আমি রামভুজ।

না, হল না। ঘনাদার নামটাই বাদ নাকি? তাঁর নাম তা হলে যাবে কোথায়? শেষে?

হ্যাঁ, পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপনে নামকরা কোনও কোনও লেখককে মাথার ওপরে না তুলে আরও খাতির বাড়াতে একটি এবং-এর নকিবের পেছনে যেমন সকলের শেষেই আলাদা করে রাখা হয়, ঘনাদার নামটাও তেমনই আমাদের ক-জন গার্ড অফ অনার-এর পেছনে ভিন্ন সারিতে একেশ্বর হয়েই থাক।

কিন্তু এ পর্যন্ত যা বলেছি তাতে অনেকের ভুরুই কুঁচকে উঠেছে বুঝতে পারছি। বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের দোতলার আজ্ঞাঘরে শুক্রবার ছটায় ঘনাদার সঙ্গে আমরা চারজন উপস্থিত থাকব এ তো নেহাত মামুলি রুটিন মাফিক ব্যাপার। অদ্ভুত কিছু তো নয়!

কিন্তু রামভুজ সেইসঙ্গে কেন?

হিঙের কচুরির ঝুড়ি কি ট্রে-তে করে মাংসের শিঙাড়ার প্লেট নিয়ে নিশ্চয়।

না, হল না।

কচুরির ঝুড়ি মাংসের শিঙাড়া আনবার জন্য বনোয়ারি থাকতে রামভুজ আসবে কেন?

ঘটনাটা তা হলে কী? ঘটনাটা একেবারে অবিশ্বাস্য! অভূতপূর্ব! কল্পনাতীত! রামভুজকে নিয়ে আমাদের পাঁচজোড়া চোখ বিস্ফারিত বিস্ময়ে ঘনাদার কোলের ওপর রাখা দক্ষিণ হস্ত আর সে হাতের একটি কাগজের দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে।

কেন? কীসের কাগজ সেটা? সিমলা প্যাক্টের খসড়া? নিকসন-চৌ-এনলাই-এর গোপন চুক্তির দলিল?

না, সে সব কিছু নয়।

ঘনাদার হাতে একটি নতুন ঝকঝকে মেটে সিঁদুরের রঙের কুড়ি টাকার নোট!

তা কুড়ি টাকার নোট ঘনাদার হাতে একটা থাকতে পারে না?নতুন কী রকম নোট বেরিয়েছে দেখাবার জন্য শিশিরই হয়তো সেটা তাঁর হাতে দিয়েছে।

না। এবারও হল না।

ঘনাদা নিজের পকেট থেকেই নোটটা বার করেছেন আর বার করে রামভুজকেই ডেকে পাঠিয়ে তাকে হুকুম দিচ্ছেন।

কী হুকুম?

অতি সাদাসিধে ক-টা ফরমাশ। বলছেন, তুমি বিরিয়ানি পোলাওই বানাও রামভুজ, আর চিংড়ির মালাইকারি, নিউমার্কেটে গেলে এই বিকেলেই একেবারে পয়লা নম্বর গলদা চিংড়ি পাবে। দামের পরোয়া কোরো না। এ কুড়ি টাকায় না হয় আরও যা লাগে নিয়ে যাও–

ঘনাদা পকেট থেকে অকাতরে আর-একটা কুড়িটাকার নোট বার করে আগেরটার সঙ্গে রামভুজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। না হয় আসবার সময় একটা ট্যাক্সি নিয়েই এস। ট্রাম-বাসের যা অবস্থা।

যেন দম দেওয়া পুতুলের মতো হাঁ করা মুখে ঘনাদার হাত থেকে টাকা নিয়ে চলে যেতে গিয়ে রামভুজকে আবার দাঁড়াতে হল।

ঘনাদা ডেকেছেন।

হ্যাঁ, শোনো, রামভুজ। সোনাই যখন হল তখন সোহাগাটা বাকি থাকে কেন? সেমুই পায়েসের ব্যবস্থাও কোরো। কিসমিস বাদাম পেস্তা—কিছুর যেন খামতি না হয়। পেস্তার আজকাল আবার সোনার চেয়ে পায়া ভারী। বাজারে সরেস পেস্তা পাওয়াই ভার। যা দাম চায় দিয়ে নিয়ে আসবে। বুঝেছ?

হাঁ, হুজুর বলে যেরকম চেহারা করে রামভুজ বেরিয়ে গেল তাতে সরিষার বেল দুটো পাকা তেল নিয়ে ফিরলে খুব আশ্চর্য হব না।

বিবরণ যা দিলাম তা কি স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে?

না, স্বপ্ন নয়, একেবারে নির্ভেজাল সত্য।

বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে সত্যিই পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে। ঘনাদা নিজের পকেট থেকে টাকা বার করে ভুরিভোজের বাজার করতে পাঠিয়েছেন আর তারপর যা করেছেন তা মাথায় চরকি-পাক লাগাবার মতো।

টাকার পকেট নয়, অন্য পকেট থেকে সিগারেটের একটা আস্ত টিন বার করে এয়ারটাইট ঢাকনা খুলতে খুলতে বলেছেন, হিটা শুনতে পেলে?

গোড়াতেই যে বিশেষণগুলো দিয়ে এ গল্প শুরু এবার সেগুলো লাগসই মনে হচ্ছে কি না?

কার চোখ কতখানি ছানাবড়া হতে পারে তার নমুনা দেখিয়ে আমরা এবার একেবারে বোবা বনে গেছি।

শিশিরই সকলের মহড়া নিয়ে ঘনাদার বেপরোয়া বদান্যতায় তাঁর ওপর প্রথম। দরদ দেখালে।

দমকা এত বাজে খরচ কিন্তু না করলেও পারতেন। সব ভূত-ভোজন বই তো কিছু নয়।

ভুতেরাও শিশিরের সঙ্গে জুড়ি গাইতে দেরি করলে না।

ঠিক, ঠিক, শিবু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললে, বিরিয়ানি হচ্ছিল হচ্ছিল, তার ওপর ওই সেমুই পায়েসের কী দরকার ছিল?

আর পায়েসই না হয় হল, তাতে আবার পেস্তা কেন? গৌর তার চরম আপত্তির কারণ জানালে, কাজু কুচি কুচি করে দিলে সোয়াদ কিছু কম হত?

ঘনাদার ওই তো দোষ! আমি ঘনাদার আখের ভেবে চিন্তিত হয়ে উঠলাম, পয়সার মায়া করতে কোনওদিন শিখলেন না। দু হাতে এমন করে খরচ করলে কুবেরের ভাঁড়ারেও যে টান পড়ে। না, হঠাৎ যেন সংকল্প স্থির করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করলাম, রামভুজ এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি বোধহয়। তাকে ফিরিয়েই আনি।

থাক, থাক। শিবু, শিশির, গৌর—-তিনজনেই শশব্যস্ত হয়ে আমাকে থামালে, ঘনাদাকে মিছি মিছি কষ্ট দিয়ে লাভ কী? ওঁর চিরকেলে খরচের হাত আমরা একদিন সামলে আর কত বাঁচাব!

বেশ, তোমরা বলছ যখন তখন বসছি।—-আমি যেন নেহাত অনিচ্ছাভরে আবার বসলাম—কিন্তু উনি দিলদরিয়া বলে ওঁর মাথায় এমন করে হাত বুলিয়ে এতগুলো টাকা খসানো কি উচিত হল? আজই বোধহয় ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনেছেন।

ব্যাঙ্ক শুনে একটু কাশির ছোঁয়াচ লাগবার উপক্রম হয়েছিল। ঘনাদার মৃদু হাসির সঙ্গে মাথা নাড়াতেই তা থেমে গেল।

না, ব্যাঙ্ক থেকে তোলবার দরকার হয়নি।—ঘনাদা হেসে আমাদের আশ্বস্ত করলেন—ওই তোমাদের উতাদো কার্লসের চিঠিটা আজ এল কিনা!

হুর্তাদো কার্লসের চিঠি!—একটু অবাক হবার পরই তামাদের স্মরণশক্তি আবার যেন ফিরে পেয়েছি—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজ কী একটা চিঠি যেন সকালে এসেছিল বটে।

ব্ৰেজিলের কনসালেট থেকে পিন বই-এ পাঠিয়েছিল, না?—শিশির

আমাদের সমর্থন চাইলে।

ডাকে এলে তবু স্ট্যাম্পগুলো পেতাম। আমরা আবার বলাবলি করলাম। গৌর ঘটনাটা সঠিক ভাবে স্মরণ করল।

তা সেটা বুঝি এই উদো বুধো কী নাম বললেন, হুতাদো না কী, তারই চিঠি? সে-ই ব্রেজিল থেকে লিখেছে? উত্তরটা ঘনাদার কাছেই চাইলাম—কিন্তু ব্রেজিল থেকে লেখা চিঠি সোজা ডাকে না এসে কনসালেটের মারফত এল কেন?

কেন এল তা বুঝিস না? শিবু আমায় ধমকালে, ঘনাদার কাছে কি কেমন আছো, ভাল আছি গোছের চিঠি আসে? আসে সব অত্যন্ত গোপন জরুরি চিঠি। ডাকে মারা কি চুরি যাবার ভয়েই সেগুলো সরকারি জিম্মায় পাঠানো হয়। বুঝলি?

বুঝতেই হল সসম্ভমে। জিজ্ঞেস করতেও হল ঘনাদাকে-সেইরকম দামি চিঠি বুঝি? খুব গোলমেলে আন্তর্জাতিক ফ্যাসাদ-ট্যাসাদ বোধহয়?

না। ঘনাদা যেন আমাদের হতাশ করতে পেরে খুশি—দামি চিঠি হলেও কোনও ফ্যাসাদ-ট্যাসাদের ব্যাপারে লেখা নয়। বরং ফ্যাসাদ কেটে যাবার তারিখটা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানাবার।

ওঃ! কৃতজ্ঞতা জানাবার চিঠি!—গৌরের গলায় একটু যেন সংশয়ের খোঁচা– সে চিঠিও এমব্যাসি মারফত পাঠিয়েছে পাছে মারা যায় বলে!

না, মারা যাবার ভয়ে নয়।—ঘনাদা আমাদের সংশোধন করলেন—আমার টাকা ভাঙাবার হ্যাঙ্গামা বাঁচাবার জন্য।

টাকা ভাঙাবার হ্যাঙ্গামা!—আমরা যতখানি সম্ভব হাঁদা সেজে হাঁ করে করে রইলাম ঘনাদার দিকে তাকিয়ে।

ঘনাদা ব্যাখ্যা দিয়ে সে হাঁ বোজাবার ব্যবস্থা করলেন—এ তারিখটায় একটু উৎসব করবার জন্য উর্তাদো কিছু টাকা পাঠিয়েছে কিনা! ব্রেজিলের কারেন্সি ভাঙাতে পাছে অসুবিধা হয় তাই এখানকার এমব্যাসিকেই ভারতীয় মুদ্রায় বদল করে সে টাকা আমার কাছে তার চিঠিটার সঙ্গে পৌঁছে দিতে লিখেছে।

খুব বুঝদার বন্ধু তো আপনার ওই হুর্তাদো!—আমরা তারিফ করে তারপর আমাদের আশাটা জানিয়েছি—সব দিক ভেবে তার মুশকিল আসানের তারিখ স্মরণ করে উৎসব করতে মোটা কিছু আপনাকে পাঠিয়েছে নিশ্চয়?

হ্যাঁ, পঞ্চাশ টাকা তো দেখছি, বলেছেন ঘনাদা খুশি মুখে বেশ একটু গর্বভরেই।

পঞ্চাশ টাকা?-ছি-ছি-ছি-টা স্পষ্ট না উচ্চারণ করলেও আমার গলার স্বরে আর মুখের চেহারায় গোপন থাকেনি।

পঞ্চাশ?—শিবুর যেন অপমানে গলাটা বুজে এসেছে!

মাত্র পাঁচ দশে পঞ্চাশ সেই ব্রেজিল থেকে?—শিশিরের গলায় ধিক্কার।

ওই টাকা ভাঙাবার হ্যাঙ্গামা বাঁচাতে আবার এমব্যাসির মারফত পাঠানো? আর গৌরের গলায় বিদ্রুপ।

ঘনাদাকে একটু দিশাহারা করা গেছে কি? আহ্লাদে গদগদ মুখটা একটু চুন?

না, তা আর পারা গেল কই!

ঘনাদার মুখে তখন একটু ক্ষমা আর প্রশ্রয়ের হাসি।

আমাদের সব আক্রমণের বাণ ভোঁতা করে দিয়ে করুণাভরে বললেন, পঞ্চাশ টাকার বেশি পাঠাবে উর্তাদো! ওই পঞ্চাশই যে পাঠিয়েছে, তাই বলতে গেলে তার পাঁজরার ক-টা হাড় খুলে দিয়ে। মানুষটা ভাল হলে কী হয়, হাড়কঞ্জুস যে।

নিজেই সে কথা সে জানে। ঠিক এই তারিখে সে রাত্রে আমার কাছে নিজের এই মজ্জাগত দোষ নিয়ে কী তার আফশোস!

কেন আমি ক-টা টাকা বাঁচাতে একটা মোটর বোট ভাড়া করলাম না, দাস! সে তখন ড়ুকরে উঠে বলছে, কাজ হাসিলের আশা তো ছেড়েই দিলাম, তার আগে প্রাণগুলোই নির্ঘাত যে দিতে হবে বেঘোরে!

তা অবস্থাটা উর্তাদো কিছু বাড়িয়ে বলেনি।

ঝড়ের রাতে দক্ষিণ আটলান্টিকের অকূল সমুদ্রে একটা ওলটানো ভেলা ধরে কোনওরকমে আমি আর উর্তাদো তখনও ভেসে আছি। এক-একটা পাহাড়-প্রমাণ ঢেউ যেন একেবারে পাতালে পৌঁছে দেবার জন্য থেকে থেকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে আসছে। কী ভাগ্যি যে শনগাদা মানে যে ভেলা আমরা আঁকড়ে ধরে আছি। তা কখনও ডোবে না। কিন্তু ঢেউয়ের প্রচণ্ড ঘায়ে সে ভেলার শোলার মতো হালকা কাঠগুলোর, কাঠের গজাল-ঠোকা বাঁধন আলগা যদি না-ও হয়ে যায়, আমাদের হাতই তো অবশ অসাড় হয়ে খুলে আসতে পারে।

এক একটা বড় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাবার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য দু-একটা কথা ওই ভাবে আমাদের হচ্ছিল। তাও দুজনেই ভেলার একদিকে একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে ভাসছিলাম বলেই ঝড়ের গর্জন আর ঢেউয়ের কল্লোল ছাপিয়ে কথাগুলো কিছুটা কানে যাচ্ছিল।

একটু ফাঁক পেলেউ উর্তাদো তখন ওইরকম নিজেকে ধিক্কার দিয়ে আর্তনাদ করছে।

কয়েকবার শোনবার পর ধমক দিয়ে বললাম, একটু চুপ করে দমটা বাঁচাও তো! তুমি কঞ্জুস ঠিকই, কিন্তু মোটর বোট-এর বদলে শনগাদা নিয়ে পাড়ি আমি ইচ্ছে করেই দিয়েছি। শক্ত করে যদি শেষ পর্যন্ত ধরে থাকতে পারো তা হলে এই শনগাদাই বাঁচাবে, এটুকু বলতে পারি।

একদমে এতগুলো কথা অবশ্য বলিনি। বার চারেক বড় ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে ভাগ-ভাগ করে উর্তাদোকে এ আশ্বাস দিতে হয়েছে।

আশ্বাস পাকনা-পাক উর্তাদো চুপ হয়ে গেছে তারপর। পুবের আকাশ লাল হয়ে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় থেমে গিয়ে ঢেউগুলো শান্ত হয়ে এসেছে।

ঝড় থেকে বাঁচলেও উর্তাদের তখন আর-এক কাঁদুনি শুরু।

সভয়ে চারিদিকে একবার চেয়ে দেখে বলেছে, আমাদের অবস্থাটা এখন কী তা বুঝতে পারছ, দাস?

খুব বুঝতে পারছি। মাথার এনামেল করা টুপিটা এক হাতে খুলে তা থেকে একটা বড়ি বার করে উর্তাদোর মুখে একরকম জোর করেই পুরে দিয়ে বলেছি, যে দিকে চাই, কূল নেই কোথাও একটা ওলটানো শনগাদা ধরে ভাসছি। মাথায় একটা টুপিই শুধু ভরসা।

এখনও তুমি ঠাট্টা করতে পারছ! উর্তাদো প্রায় ককিয়ে উঠল।

ঠাট্টা নয়, উর্তাদো! গম্ভীর হয়েই তাকে বললাম এবার, সত্যিই, মাথার এই টুপি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা। যা ধরে এখনও টিকে আছি সেই শনগাদা নিয়ে। ব্রেজিলের এই উত্তর-পুবের রাক্ষুসে সমুদ্রের সঙ্গে মাছের জন্য যারা লড়ে সেই দুর্ধর্ষ শনগাদেইরোদের শেষ সহায় এই টপি। কোমরে বাঁধা ছোরা আর মাথার এই টপির জোরে তারা শনগাদার এই খুদে ভেলায় সমুদ্রের যে কোনও কুটিকে তুড়ি দিয়ে অগ্রাহ্য করে।

কিন্তু টুপি থেকে তুমি আমার মুখে দিলে কী? উর্তাদো সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলে।

দিলাম একটা ভয়-ভাবনা কাটাবার বড়ি।

আমার কথাটা শেষ না হতেই উর্তাদো আবার কাতরে উঠল—তোমার ওটা জাদুর টুপি বুঝলাম। সব ও থেকে তুমি বার করতে পারো, কিন্তু ওষুধের বড়িতে কি সত্যকার ভয় কাটবে? চারিদিকে একবার চেয়ে দেখো। সমুদ্র ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, কিন্তু তেকোনা ফলার মতো হাঙরের ডানাগুলো দেখতে পাচ্ছ? জল কেটে আমাদের দিকেই পাক দিতে দিতে ক্রমশ এগোচ্ছে।

উর্তাদো ভুল কিছু বলেনি। ডানা দেখেই বোঝা যায়, সত্যিই দুটো বাঘ-হাঙর তখন আমাদেরই তাক করে কাছাকাছি চক্কর দিচ্ছে।

কিন্তু হাঙরের ডানা শুধু নয়, আরও কিছু আমি তখন দেখেছি। উর্তাদোকে সেই কথাই জানালাম। বললাম, তোমার ভয় নেই, উর্তাদো। ভেলা উলটে তুফানের সমুদ্র থেকে বেঁচেছ, এ বিপদ থেকেও বাঁচবে। হাঙরেরা অন্তত তোমায় আমায় ছুঁতেও পারবে না।

ছুঁতেও পারবে না? উর্তাদো ভয়ে হতাশায় খিঁচিয়ে উঠল আমাকে, হাঙর দুটো আমাদের পাক দিতে দিতে কত কাছে এসে পড়েছে, দেখেছ?

দেখেছি! তাকে সাহস দিয়ে বললাম, সেই সঙ্গে সমুদ্রের শুশুক ওই পরপয়সগুলোকে দেখেছ কি! সমুদ্রের ওই সেপাইরা যখন এসে পড়েছে তখন আর ভাবনা নেই। সমুদ্রের প্রাণী হয়ে মানুষের ওপর কেন যে ওদের এত দরদ সেটা একটা রহস্য, কিন্তু ওরা কাছে থাকলে কোনও হাঙরের সাধ্যও হবে না আমাদের ছুঁতে।

যা বলেছি বেদবাক্যের মতো চোখের সামনে তা ফলতে দেখা গেল এবার। কোথা থেকে একটা শুশুক এসে গুতো দিলে একটা হাঙরের পেটে। তারপরেই আরেকটা। অন্য হাঙরটারও শুশুকদের গুঁতোয় সেই দুরবস্থা। একটা দুটো নয়, এক পাল পরপয়স তখন এসে হাঙর তাড়াবার দায় নিয়েছে। দেখতে দেখতে নাস্তানাবুদ হয়ে হাঙর দুটো চম্পট দিলে। শুশুকের পাল আমাদের সঙ্গেই রইল যেন পাহারা দিতে।

মাথামোটা দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পুবের প্রায় সবটা জুড়ে ব্রেজিল। ব্রেজিলের উত্তর-পুবে আটলান্টিক সাগর। সাধারণ মানচিত্রে দেখলে সে সমুদ্রে আফ্রিকার কূল পর্যন্ত গোনাগুনতি কটা দ্বীপের ফুটকি ছাড়া আর কিছু দেখা যাবে না। ম্যাপে দাগ ফেলবার যোগ্য না হলেও ছোট ছোট দ্বীপও সমুদ্রে কিছু আছে। ব্রেজিলেরই একটি নেহাত নগণ্য বন্দর কাবেদেলা থেকে মাইল পঞ্চাশ দূরের অমনই একটি অতি ছোট দ্বীপের সেদিন যেন কপাল ফিরে গেছে।

সাধারণত যে দ্বীপে বছরের পর বছর ছাগল ভেড়া আর তাদের ক-জন রাখাল ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না সে দ্বীপের মাঝখানে সে দিন সরকারি তাঁবু পড়েছে। সিয়ারার জেলা সদর থেকে বহু অফিসার এসেছে নিলাম ডাকতে। সাত বছর বাদে বাদে এ সব দ্বীপ আগের মালিক এসে আবার না চাইলে নিলাম ডেকে ইজারা দেওয়া হয়।

সেই নিলাম ডাকার দিন সকালেই আমি ঘুরতে ঘুরতে ভুল করেই যেন সরকারি তাঁবুর সামনে এসে পড়েছি।

প্রথমেই সেখানে দেখা হয়েছে উর্তাদোরই এক জ্ঞাতিভাই দে দিয়স-এর সঙ্গে।

দে দিয়স আমায় দেখে হয়তো অবাক। কিন্তু বাইরে তা বুঝতে দিলে না, বরং টিটকিরি দিয়ে বললে, কী দাস, তোমায় একলা দেখছি যে? লেজুড়টি মানে আমার ভাই উর্তাদোকে কোথায় রেখে এলে?

যেখানে রাখলে সুবিধে হয় সেখানে! যেন নিজের রসিকতায় এক গাল হেসে বললাম, এ সব কাজে সঙ্গী না রাখাই ভাল নয় কি? তুমিও তো একলা এসেছ। দেখছি।

তা না এসে কী করি, বলো? দে দিয়স আগের সুরটা পালটে যেন আন্তরিকতার সঙ্গে বললে, হাজার হলেও আমাদের পরিবারের সম্পত্তি তো ছিল। উর্তাদোর যখন গরজ নেই তখন আমাকেই ডেকে নিতে হয়।

তোমার এ দ্বীপটার ওপর লোভ কিন্তু আগেও যেন ছিল দিয়স! সন্দেহটা মুখে ফুটতে দিয়েই বললাম, উর্তাদো একবার আমায় বলেছিল মনে হচ্ছে।

বলেছিল? দে দিয়সের চোখদুটো যেন ছুরির ফলা হয়ে উঠল, তা লোভ থাকলে হয়েছেটা কী? লোভ আছে বলেই তো ডেকে নেব আজ!

ও! তাই তুমি এখানে! আমি যেন অনেক দেরিতে বুঝে আমার ভুলটা স্বীকার করলাম, আমি ভেবেছিলাম, তোমার ভায়ের হয়েই বুঝি আবার দ্বীপটার ইজারা চেয়ে নিতে এসেছ! একটু থেমে তারপর বললাম, কিন্তু ধরো, উর্তাদো যদি নিলামের ডাকের আগে এসে পড়ে?

এসে পড়বে উর্তাদো? দে দিয়স একেবারে খোলাখুলিই মুখ বাঁকিয়ে বললে, এলে তার ভূতটাই আসবে, তাকে জ্যান্ত আর আসতে হবে না।

হ্যাঁ, আসা শক্ত বটে! আমি মুখটা হতাশ করে স্বীকার করলাম, দ্বীপটার চারিধারে তোমার দু-দুটো মেশিনগান বসানো-লঞ্চ পাহারা দিয়ে ঘুরছে দেখে এলাম বটে। এ দ্বীপে যে বোট আসবে, গুলিতে ঝাঁঝরা করে ড়ুবিয়ে দেবে।

আমার কথা শুনতে শুনতে দে দিয়সের চোখদুটো হঠাৎ ছোট হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে মুখটাও ছোটলোকের মতো। আমাকে যেন চোখের সড়কিতে ফুটো করার চেষ্টায় বললে, তুই! তুই কী করে এলি এখানে?

ভূত হয়ে ছাড়া আর কী করে আসব বলো! তার দিকে চেয়ে একটু ভুতুড়ে হাসি হাসলাম।

ভূতই তোকে বানিয়ে ছাড়ব! আমার গলাটা এক হাতে টিপে ধরে বিড়ালছানার মতো শূন্যে ঝুলিয়ে ধরে দে দিয়স বললে, সত্যি করে বল, কেমন করে এসেছিস।

বলব কেন শুধু! ঝোলানো অবস্থাতেই মাথার শনগাদেইরো টুপিটা খুলে তা থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে দে দিয়সের হাতে দিয়ে বললাম, সব তো লিখে এনেছি। তুমি চোরাচালানের একটা বড় ঘাঁটি বানাবার জন্য এ দ্বীপটার ইজারা চাও, আর উর্তাদো চায় পশুপালনের একটা গবেষণা-কেন্দ্র বসাতে। তার উদ্দেশ্যটাই ভাল মনে হল বলে তাকে সঙ্গে করে আনলাম।

তুই নিজে শুধু আসিসনি, উর্তাদোকেও সঙ্গে করে এনেছিস? দে দিয়স রাগে। আমার গলাটা যেন নিংড়োবার মতো করে প্রাণপণে চেপে ধরল।

কাতুকুতু লাগছে। ছাড়ো! বলে এবার তার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে মাটিতে নেমে বললাম, তোমার যা এখন অবস্থা কাগজের লেখা মগজেই ঢুকবে না। কীসে কেমন করে উর্তাদোকে নিয়ে এলাম চলো দেখিয়ে দিই।

চুলের মুঠিটা একটু আলতো করে ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তাই দেখালাম। দেখাতে দেখাতে বুঝিয়েও দিলাম সব। যা বোঝালাম তার মোদ্দা কথাটা হল এই—

শনগাদা নামে ওই ভেলা পোর্তুগিজরা কলম্বাসের পর প্রথম ব্রেজিলে এসে ডাঙায় নামবার সময় দেখেছিল। মাঝারি একটা টেবিলের মাপের কটা হালকা গুঁড়ি-জোড়া-দেওয়া একটা ভেলায় বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো অতি মিহি কাপড়ের ঢাউস পাল খাটিয়ে ওদেশের জেলেদের বারদরিয়ায় পাড়ি দেওয়ার সাহস দেখে তারা অবাক।

পুরুষানুক্রমে সে বিদ্যা আর সাহস এখনও এ অঞ্চলের জেলেদের আছে। তারা এই যন্ত্রের যুগেও মাছ ধরার জন্য ওই বিপজ্জনক ভেলাই পছন্দ করে।

উর্তাদোকে নিলামের ডাকের দিন তার দ্বীপে নামতেই না দিয়ে তার মালিকানা ফাঁকি দিয়ে নেবার একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝে মোটর লঞ্চ স্টিমারের বদলে ওই ভেলাই আমি বাহন হিসেবে ঠিক করি। ভেলায় আসার জন্যই দে দিয়সের পাহারাদার বোট দুটো আমাদের হদিস পায়নি।

দে দিয়সের সব শয়তানি ফন্দিও ব্যর্থ হয়েছে তাইতো যে তারিখে দ্বীপটার ইজারা আবার পেয়েছিল তারই মান রাখতে উৎসব করবার জন্য উর্তাদোর টাকা ্পাঠানো। কম হোক বেশি হোক, ভালবেসে যখন পাঠিয়েছে তখন খরচ করো প্রাণ খুলে!

ঘনাদা গোটা সিগারেটের টিনটা শিশিরের হাতেই তুলে দিলেন।

কিন্তু ওই আপনার হুয়ার্তো–শিবু যা বলতে যাচ্ছিল তা আর বলা হল না।

বানানে এইচ থাকলেও উচ্চারণটা হুর্তাদো নয়, উর্তাদো! বলে শিবুকে থামিয়ে ঘনাদা টিনটা ভুলেই যেন ফেলে উঠে পড়লেন।

তারপর ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে আর একবার পিছু ফিরে শেষ রাত্রের মারটি ছেড়ে গেলেন।

ও, উর্তাদো নামটা আবার ব্রেজিলেরও নয় পেরুর। মিউনিখ অলিম্পিকের কুস্তি লড়নেওয়ালাদের তালিকা খুঁজলেই দেখতে পেতে।

ঘনাদা সামনে থাকলে আমরা অধোবদনই হতাম। তার বদলে পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম একটু অপ্রস্তুতের মতো হেসে।

কিন্তু অপ্রস্তুত বা কেন? অত ফন্দি-ফিকির, অত মুসাবিদা, শিশিরের ওই পঞ্চাশটা টাকা নেহাত ভেস্মে ঘি ঢালা হযেছে কি?