গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

ঘনাদার চিংড়ি বৃত্তান্ত

ঘনাদার চিংড়ি বৃত্তান্ত

হয়তো! হ্যাঁ, বাক্যটা ঘনাদার মুখ থেকেই উচ্চারিত হল। কিন্তু কেমন যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় ওই শব্দটুকু মুখ দিয়ে বার করেই গুম হয়ে গেলেন ঘনাদা।

কী হয়তো? কেন হয়তো? এমন অনেক প্রশ্নই তখন মনের মধ্যে তো বটেই, জিহ্বাগ্রেও যে এসেছিল, তা অস্বীকার করব না। কিন্তু ঘনাদার মুখ-চোখে একটা

অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যের ছায়া দেখে তা উচ্চারণ করতে আর সাহস করিনি।

ঘনাদার মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব বুঝব, এত বড় ধুরন্ধর আমরা কেউ নই, তবু মনে হচ্ছিল একটা কী বিষয়ে তিনি যেন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে মনঃস্থির করতে পারছিলেন না।

তাঁর মনে যে অস্থিরতাটা, সেটা এক হিসেবে না আর হ্যাঁ-এর দ্বন্দ্বও হতে পারে।

হয়তো বলে তিনি যে একটা সম্ভাবনার আভাস দিচ্ছিলেন, সেটা আমাদের কাছে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি প্রকাশ করবেন কি না, এই নিয়েই তাঁর মনে বেশ প্রবল দ্বিধা ছিল বলে মনে হয়।

শেষ পর্যন্ত এ-দ্বিধার মীমাংসায় না-এর উপরে হ্যাঁ-ই যে জয়ী হল, এ আমাদের ভাগ্য।

হ্যাঁ। মনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠে ঘনাদা তাঁর হয়তোকে বিস্তারিত করে বললেন, হয়তো সে ঠিক খবরই পাঠিয়েছিল। কিন্তু–

কিন্তুর পর যে দীর্ঘ নীরবতা, সেটা প্রায় যন্ত্রণায় পৌঁছে দিয়ে ঘনাদা তাঁর বক্তব্যটা পেশ করলেন। বললেন, কিন্তু কানুড়ি থেকে ফাং-এ অনুবাদ করাতেই হয়তো ভুল হয়েছে। আর, তারপর হাউসায় তার কানগুলো ধান হয়ে সব এমন বরবাদ করে দিয়েছে যে, আমি সোজার বদলে উলটো খবরই পেয়েছি।

মুখটা তাঁর পক্ষে যতখানি সম্ভব করুণ করে ঘনাদা চুপ করলেন। কিন্তু আমরা যে তখন একেবারে অকূল পাথারে! ঘনাদার প্রথম হয়তোর গরেই যেটুকু ফাঁপরে পড়েছিলাম, ফাং হাউসা কানুড়ির জালে জড়িয়ে তা যে একেবারে গোলক ধাঁধার ফাঁদ হয়ে উঠল।

কী বলছেন ঘনাদা? মানে, বলতে চাইছেন কী? সোজাসুজি সে-কথা যে জিজ্ঞেস করব, তার উপায় নেই। কারণ অমন বেয়াদপিতে উত্তর যা মিলবে, তাতে নখ কাটাতে গিয়ে আঙুল কাটিয়ে ফেলার ঝক্কি নেওয়া হবে।

তার চেয়ে ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করাই ভাল। নিজের পাকানো জট ঘনাদা সময়মত নিজেই কি আর খুলবেন না?

সেই ধৈর্য ধরেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অবুঝ গৌরটার জন্য তা থাকা আর হল কই?

কী হাং ফাং করছেন? ঘনাদাকে সে একটু গরম গলাতেই জিজ্ঞেস করে বসল, হিং টিং ছটের মতো মন্তর-টন্তর নাকি?

না, মন্তর-টন্তর নয়? ঘনাদার গলার ঝাঁঝটুকু আর লুকনো নেই এবার, কিন্তু ওগুলো কী, বোঝাতে গেলে একটু ভূগোলের পরীক্ষা আগে নিতে হবে।

ভূগোলের পরীক্ষা? সভয়ে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, কী পরীক্ষা, ঘনাদা?

না, এমন কিছু পরীক্ষা নয়, ঘনাদা আশ্বাস দিয়ে বললেন, শুধু ক-টা অতি সোজা প্রশ্নের জবাব। যেমন, কোন দেশে একসঙ্গে আবলুস, সেগুন, মেহগনির সঙ্গে প্রচুর তাল-তমাল যেমন পাওয়া যায়, তেমনই প্রচুর পাওয়া যায় অভ্র, ম্যাঙ্গানিজ, টিন, বক্সাইড থেকে হিরে আর সোনা?

একটু থেমে আমাদের মুখের ভাবটা লক্ষ করে ঘনাদা এবার বললেন, এ সব যদি একটু কঠিন প্রশ্ন মনে হয় তা হলে একটা মাত্র অতি সোজা প্রশ্ন করছি। যার উত্তর জানলে দেশটার নাম বলতে কিছুমাত্র অসুবিধে হবে না। প্রশ্ন হল এই, কোন দেশে এই শতাব্দীর গোড়ায় ১৯০৯ আর ১৯২২-এ দু-দুবার এক আগ্নেয়গিরি থেকে দারুণ অগ্নদগার হয়েছে?

কী জবাব দেব এ সব প্রশ্নের?

ভ্যাবাচাকা ভাবটা কোনওরকমে লুকোবার চেষ্টা করে মাথা চুলকোবার অভিনয়ই করছিলাম, তারই মধ্যে শুনুন, ঘনাদা বলে গৌর হঠাৎ মুখ খোলায় সত্যিই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম।

ঘনাদা এমনিতেই খুব ভাল মেজাজে আছেন বলে মনে হচ্ছে না। তার ওপর বেয়াড়া কিছু বলে গৌর যদি তাঁকে গরম করে দেয় তা হলে অন্তত আজকের দিনের মতো আমাদের বাহাত্তর নম্বরের মজলিশ একেবারে মাটি।

কিন্তু ভয় যা করছিলাম, উলটোটাই তার হল।

জাতে পাগল হলেও গৌর যে তালে ঠিক তা বোঝা গেল তার পরের কথায়! বেয়াড়া কিছুর বদলে, গরম হওয়ার বদলে ঘনাদা তাতে গলে একেবারে জল।

কী এমন বললে গৌর, যাতে খোঁচানো সাপও ফণা তুলতে ভুলে যায়? কী সে মন্তর?

না, হাত কচলানো খোশামুদি গোছের কিছু নয়। বরং তাতে ফোঁস করার ঝাঁঝই একটু আছে বলা যায়। কিন্তু কাজ হল ওই ফোঁসানির সুরেই।

মিষ্টি সুরে-টুরে নয়, গৌর ঘনাদার ওপর অভিমানেই নালিশ জানিয়ে বললে, অত ভূগোলের পরীক্ষা যদি দিতে হয়, তা হলে পি. আর. এস., পিএইচ. ডি ডিগ্রির পিছনেই তো ছুটলে পারি! তার বদলে এই বাহাত্তর নম্বরে আপনার মুখ চয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকব কেন? মোড়ের দোকানে এক চেঙারি হিঙের কচুরির অর্ডার দিয়ে এসেছি। বনোয়ারি তা নিয়ে নীচের গেটের মুখেই বোধহয় পৌঁছে। গেছে। রামভুজের সেগুলো প্লেটে-প্লেটে সাজিয়ে পাঠাতে যা দেরি। কিন্তু এখন আর কী হবে তাতে, সব ঘাস লাগবে মুখে—হ্যাঁ, ঘাস।

গৌর চুপ করল এমন একটা হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে আমাদেরই দুচোখের পাতাগুলো কেমন যেন একটু ভিজে ভিজে হয়েছে মনে হল।

ঘনাদারও তা-ই হল কি না জানি না। কিন্তু তাঁর গলায় এবার যে সুরটা শোনা গেল, সেটা স্পষ্টই সান্ত্বনার।

আহা! হিঙের কচুরি ঘাস হতে যাবে কেন? তিনি আশ্বাস দিলেন, এই আমাদের মোড়ের জহর হালুইকরের হিঙের কচুরি তো? ও আজ বিকেলে আনিয়ে কাল সকালে মুখে দিলেও মুচমুচে থাকে। তবে

ঘনাদার হিঙের কচুরির কৌলীন্য-বিচার আর হল না। বিরাট ট্রে-র ওপর কচুরি-সাজানো প্লেট নিয়ে বোয়ারি তখন আড্ডাঘরের দরজা দিয়ে ঢুকল। সে ঢাকার আগেই তার ট্রের ওপরকার প্লেটে সাজানো কচুরির গন্ধেই অবশ্য আড্ডাঘর মাত হয়ে গেছে।

 

২.

বনোয়ারি তাঁর হাতেই প্রথম যে-প্লেটটা তুলে দিল, তার ডবল সাইজের কচুরির তাক যে প্লেটের ওপর প্যাগোড়ার মতো, তা বোধহয় আর বলতে হবে না।

সেদিকে চেয়ে অন্তরের খুশিটা অকপট উচ্ছাসে প্রকাশ করেই ঘনাদা বললেন, হিঙের কচুরি কী হে, এ তো রাধাচুরি! মানে রাধাবল্লভী আর কচুরির দ্বন্দ্বসমাস। তা বড় বেশি দিলে যে! এত কি আর এ বয়সে শেষ করতে পারব?

খুব পারবেন, খুব পারবেন, সবাই আমরা জোর গলায় আশ্বাস দিলাম, বয়স আপনার আর কী, চল্লিশই তো পার হয়নি।

চল্লিশ–! বলো কী হে! ঘনাদা বিষম খাওয়াটা কোনওরকমে সামলে বললেন, আমার চল্লিশ—।

মানে! চটপট বাধা দিয়ে বললাম, চল্লিশে পৌঁছে ঠেকে গেছে আর কী! পার হতে তো পারছে না। তাই বলছি–

তাই আর কিছু বলতে হল না। যে কারণেই হোক, ঘনাদা একটু বেশিরকম খুশি হয়ে তাঁর প্লেটের রাধাচুরি প্যাগোডার ওপর চুড়ো হিসেবে আরও দুটো শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে শিশিরের এগিয়ে ও জ্বালিয়ে দেওয়া সিগারেটটায় ক-টা সুখটান দিয়ে যেন ধাতস্থ হয়ে, প্রায় মেজাজের অসীম প্রসন্নতার পরিচয় দিয়ে নিজে থেকেই গোড়ায় ধরা প্রসঙ্গটা স্মরণ করে বললেন, হ্যাঁ, ভূগোল শেখায় তোমাদের আপত্তি জানাচ্ছিলে, না? কিন্তু ভূগোলের প্রশ্ন কেন তুলেছিলাম জানো? তুলেছিলাম, যা বলতে যাচ্ছি, ভূগোল কিছুটা না-জানা থাকলে তার রহস্যটাই ঠিক বোঝানো যাবে না। ভূগোলের ক-টা সোজা প্রশ্ন মাত্র তোমাদের করেছি। প্রশ্ন আর-দুটো বেশি করলে হয়তো উত্তরটার আভাস তোমরাও পেতে। এই যেমন ক-টা প্রশ্ন করেছি তার ওপর যদি জানতে চাইতাম, কোন দেশে কোথায় গোরিলাও যেমন, সিংহও তেমনই পাওয়া যায়, তা হলে তোমরা চটপট উত্তর দিতে–আফ্রিকা। কিন্তু আফ্রিকা তো একটা বিরাট মহাদেশ। শুধু আফ্রিকা বললেই তো হবে না, আফ্রিকার কোথায় বোঝানো যাবে না। সুতরাং শুধু আফ্রিকা বললেই হবে না, আফ্রিকার কোথায়, সেটা সঠিক জানা চাই।

সঠিক জায়গাটা এখনও হয়তো ধরতে পারোনি বলেই বলে দিচ্ছি জায়গাটা। আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে এমন একটা অঞ্চল, যার বর্ণনা দেওয়া খুবই শক্ত। গাছপালা আর ধাতু-সম্পদের কথা আগে আমার প্রশ্নে যা বলেছি, তাতেই বোঝা যাবে যে, জায়গাটার বৈচিত্র্যের শেষ নেই। দেড়শো থেকে দুশো ফুট উঁচু গাছের ঘন জঙ্গল যেমন আছে, তেমনই আছে শুধু কাঁটাঝোপের বিস্তীর্ণ আধা-মরু অঞ্চল। একদিকে গোরিলা শিম্পাঞ্জিদের যেমন দেখা মেলে, তেমনই দেখা যায় উটপাখির পাল।

আর বেশি বর্ণনা দিতে গেলে রাত কেটে যাবে। তাই জায়গাটার নামটা বলেই ফেলি। নাম হল ক্যামেরুনস। বর্ণনা আগে যেটুকু দিয়েছি, তার ওপরে বলতে পারি যে, যেমন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে তেমনই ইতিহাসের চমক দেওয়া কিছু ঘটনার বিশেষত্বে আফ্রিকার এই উত্তর-পশ্চিম কোণের ভূখণ্ডটির একটা নিজস্ব মূল্য আছে।

ক্যামেরুনসের উত্তর-পশ্চিমে পোর্তুগিজরা প্রায় চারশো বছর আগে সমুদ্রকূলে যেখানে নামে, সেখানকার একটি নদীকে তারা চিংড়ির নদী নাম দিয়েছিল। ১৯১৯-এর এক শীতের মরসুমে একদিন সেখানে এক বুনো চেহারার সাহেবকে নিয়ে এই কাহিনী শুরু করতে হয়। সাহেবের চেহারাটা বুনো হলেও পোশাক-আশাক চাল-চলন সব একেবারে বাদশাহি মেজাজের। মাথায় ঝাঁকড়া চুলের একটা বোঝা, আর মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফের জঙ্গল বাদে মানুষটার সবকিছুই ভদ্র, ফিটফাট আর মানানসই। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল আর মাথায় জট পাকানো চুলের ঝোপ। সেটা তাঁর মুখের কোনও কাটা ঘায়ের দাগ টাগ ঢাকা দেওয়ার ফিকির হতে পারে।

মানুষটা চিংড়ি নদীর ধারে একটা বড় গঞ্জের পাশে একটা মস্ত বাহারি তাঁবু পেতে সেখানে ডেরা বেঁধেছেন। এর মধ্যে ওখানকার কাফরি গাঁয়ের সর্দারকে নিজের তাঁবুতে নেমন্তন্ন করে খানাপিনায় আপ্যায়িত করেছেন বারকয়েক।

তাঁর মতলবও কিছু লুকোবার নেই। এখানে এসে ডেরা বাঁধবার পরেই তিনি এ-তল্লাটের যে দুই যমজ ঘটোৎকচের মতো দৈত্যাকার বান্টুকে তাঁর কাজে লাগিয়েছেন, তারাই সাহেবের পরিচয় দিয়ে শতমুখে তাঁর প্রশংসা করে তাঁর এ মুলুকে আসার উদ্দেশ্য সকলকে জানিয়েছে।

তাদের কাছে জানা গিয়েছে, সাহেবের নিজের দেশ হল বিলেত। নাম তাঁর ড. লক। অজানা দেশে পাড়ি দিয়ে সেখানকার অজানা সব রহস্য খুঁজে বার করে তার যতটা সম্ভব খবরাখবর বার করাই তাঁর কাজ। এ কাজে ড. লক দুনিয়ার অনেক জায়গায় বহু বিপদের ঝক্কি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর মাথা ও মুখের বুনো চেহারার আসল কারণ এমনই এক দারুণ আচমকা বিপদে পড়া। সে বিপদে তাঁর মুখের ও মাথার চামড়া অনেকখানি পুড়ে সাদা হয়ে যায়। কোনওরকমে শেষ পর্যন্ত। প্রাণে বাঁচলেও বীভৎস চেহারার লজ্জায় তিনি আর পোড়া মুখ কাউকে না দেখাবার জন্য মুখে ও মাথায় অমন জঙ্গল বানিয়ে রেখেছেন।

এখন এই চিংড়ি নদীর মোহনায় তাঁর আস্তানা পাতবার কারণ কিন্তু তাঁর সেই অজানা দেশের রহস্য জানবার নেশা। এই ক্যামেরুনসের ভেতরে এক জায়গায় যে এক দারুণ আগ্নেয়গিরি আছে, তা সবাই জানে! মাঝে মাঝে বহু বছর অন্তর সেই আগ্নেয়গিরি খেপে উঠে আগুন উগরে তুলে ছড়ালেও তার সঠিক হদিস সভ্য জগতের কেউ এখনও জানে না। ড. লক সেই রহস্য সন্ধানের অভিযানে যাবার জন্য পথের দিশারি হবার মতো একজন ও অঞ্চলের সেথো চান। তাঁর দুই যমজ ঘটোৎকচের মতো পাহারাদারকে তিনি সেই খোঁজেই লাগিয়ে রেখেছেন। এই যমজ দানবকে পাহারাদারের কাজে নেওয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে। ড. লকের কে একজন নাকি পরম শত্রু তাঁর সুনামের হিংসায় বহুকাল থেকে তাঁর পেছনে লুকিয়ে লেগে থেকে হয় তাঁর আবিষ্কারের গৌরব চুরি করে নিজের বলে প্রচার করতে, নয় সেটা সম্ভব না হলে তাঁর বড় রকমের কোনও ক্ষতি করবার চেষ্টা করে আসছে। তার বিরুদ্ধে পাহারা দেবার জন্যই ড. লক এবার একজন নয়, গোধা আর লোধা নামে দুই যমজ ঘটোৎকচ ভাইকে নিজের কাজে লাগিয়েছেন।

গোধা আর লোধা শুধু শরীরের ক্ষমতাতেই দুর্দান্ত দানব নয়, তারা কাজের লোকও বটে।

লকসাহেব চিংড়ি নদীর ধারে দিন-পাঁচেক তাঁবু ফেলবার পরেই তারা একজনকে জোগাড় করে আনে গঞ্জের এক বাজার থেকে।

তাকে দেখে ড. লক হেসেই খুন।

আরে এ কাকে এনেছিস? হাসতে হাসতে ড. লক জিজ্ঞেস করেন গোধা-লোধাদের, এ চিমসে শুটকোটা তো তোদের চিংড়ি নদীর সত্যিকারের একটা কুচোচিংড়ি।

ড. লকের কথায় লজ্জা পেলেও লোধা-গোধা নিজেদের একটু কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করে বলে, আজ্ঞে, আপনি মিছে ঠাট্টা করছেন কেন? ও চিমসে চিংড়ি হলে আমাদের লোকসানটা কী? ওকে তো আর কুস্তি লড়তে হবে না। শুধু আমাদের পথ দেখিয়ে যেখানে যেতে চান সেখানে নিয়ে যাবে।

লোধা-গোধার যুক্তিটা যে ঠিক, ড. লককে এবার তা স্বীকার করতে হয়। তিনি তাই হাসি থামিয়ে একটু ভাবনার সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু ওকে যা ঠাট্টা-অপমান করলাম, এর জন্য ও আর আমার কাজ করতে চাইবে কি?

খুব চাইবে, খুব চাইবে। আশ্বাস দিয়ে বলে লোধা-গাধা, দেখতে পাচ্ছেন না, কেমন অবাক হয়ে হাঁ করে তাঁবুর সব জিনিসপত্র দেখছে? ও আমাদের কথা কিছু বুঝেছে কি যে, ঠাট্টা অপমানে রাগ করবে?

কিছু বোঝেনি মানে? ড. লক বেশ ভয় পেয়েই জানতে চান, ও কি বদ্ধ কালা-টালা নাকি? তা হলে–

না, না, কালা হবে কেন? লোধা-গোধা এবার বুঝিয়ে দেয় ড. লককে, আমরা তে। বান্টুতে কথা বলেছি, ও তার কী বুঝবে?

বুঝবে না কী রকম? ড. লককে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়, ও কি বান্টু জানে না?

এক বর্ণও না, লোধা-গোধা জানায়, বান্টু কেন, ওর নিজের ভাষা কানুড়ি ছাড়া হাউসা, ফুলানি, ফাং—কিছুই জানে না।

ঠিক, ঠিক, ড. লক খুশি-মুখে এবার বলেন, নিজের ভাষা ছাড়া আর কিছু জানে।

না, এমন লোকই আমাদের সবচেয়ে দরকার। আজই ওকে কাজে নাও।

তাই নেওয়া হল সেই দিনই। কাজে নেবার সময় নামটা নিয়ে শুধু একটু গোল বেধেছিল।

খাতায় লেখার জন্য তো বটেই, তাকে ডাকবার জন্যও একটা নাম তো দরকার। কিন্তু নিজের কোনও নামই সে বলতে পারে না। সে যেখানে থাকে সেখানে গোনাগুনতি ক-টা তার মতো জংলির মধ্যে ডাকাডাকির কোনও দরকারই নাকি হয় না। হলেও তারা এই ওই বলে ডেকেই তাদের কাজ সারে।

কিন্তু সেখানকার নিয়ম এখানে চলে না। নাম তো একটা দরকার। শেষে জংলিটা নিজেই বললে, এই কামর্দে মানে চিংড়ি নদীর মোহনাতেই যখন সে প্রথম কাজ পেয়েছে তখন তার নাম চিংড়িই রাখা হোক।

ড. লক খুশি হয়ে বলেছেন, ঠিক ঠিক। ওর যা চিমসে কুচোচিংড়ির মতো চেহারা, তাতে ওই নামই ওর ভাল।মানুষটা জংলি হলেও তার মাথাটা একেবারে নিরেট নয় দেখেও তিনি খুশি হয়েছেন।

চিংড়িটাকে প্রথমে তার কাজ বুঝিয়ে দেওয়া একটু শক্ত হয়েছে। বুদ্ধিশুদ্ধি নিরেট হলেও লোকটা একেবারে জংলি। সাহেবসুবো তো দূরের কথা, সাধারণ একটু ভাল অবস্থার গৃহস্থ বান্টু কি হাউসাদের ঘরদোরের খবরও জানে না।

ড. লকের তাঁবুতে বেশি কিছু দামি ও বিদেশি আসবাব না থাকলেও, তাঁর কাজের জন্য যা দরকার সেরকম কিছু যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম ছিল। তাঁর তাঁবু ঝাড়পোঁছ করবার সময় ড. লক সেগুলো সম্বন্ধে তাকে হুঁশিয়ার হওয়ার নির্দেশ দিতে বলেছিলেন তাঁর খাস-পাহারাদার লোধা আর গোধাকে। তাই দিতে গিয়ে প্রায় কেলেঙ্কারি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

জরিপ-টরিপের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি ছাড়া ড. লক তাঁর কাজের সুবিধের জন্য একটা টেপরেকর্ডার তাঁর সঙ্গে রেখেছিলেন। তিনি যে-ধরনের অভিযানে এসেছেন, তার প্রাত্যহিক বিবরণ রাখা একান্ত দরকার। একালে সে-বিবরণ হাতে লেখার তো কথাই আসে না। টাইপ করার জন্য সঙ্গে টাইপরাইটার রাখাও একটা বাড়তি বেয়াড়া বোঝা বওয়া। ড. লক তাই একটা ছোট টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিয়েছিলেন, যাতে তাঁর অভিযানের প্রতিদিনের বিবরণ তিনি মুখে বলে টেপ-এ ধরে রাখতেন।

সেই যন্ত্রটা নিয়েই গণ্ডগোল বেধেছিল প্রথমে। সাফসুফ করার সময় ও যন্ত্রে হাত

দিতে বলার জন্য রেকর্ডারটা একটু চালিয়ে দেখাতে যেতেই হাউমাউ করে চিৎকার করে পড়ি কি মরি অবস্থায় চিংড়ি তো তাঁবুর বাইরে দে ছুট। সে তখন এই ভুতুড়ে তাঁবুর কাজ ছেড়ে দিতে চায়। লোধা-গোধাকে তারপর অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে তাঁবুতে ফেরাতে হয়েছে।

এরপর আর বিশেষ গোলমাল-টোলমাল হয়নি। যে কাজের জন্য তাকে নেওয়া, সে কাজে চিংড়ি বাহাদুরিই দেখিয়েছে দিন কয়েকের মধ্যে। ক্যামেরুনসের এই অঞ্চল প্রায় অজানা জঙ্গল-পাহাড়, আবার আধা মরুর দেশ। বুনো মোষ, হাতি, গণ্ডার, সিংহ থেকে হিংস্র জংলি আদিবাসীদের এড়িয়ে সেখানে প্রতি পদে প্রাণ হাতে নিয়ে টহল দিতে হয়। এ কাজে চিংড়ি কিন্তু দারুণ বাহাদুর। ড. লক ক্যামেরুনসের ভিতরের দিকে চাড় হ্রদের কাছে এক আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি অঞ্চলেই যেতে চান। প্রায় চোদ্দো হাজার ফুট উঁচু সেই আগ্নেয়গিরি নয়, তার কাছাকাছি নিশ নামে এক হ্রদই তাঁর লক্ষ্য।

পদে পদে যেখানে বিপদ, সেই সম্পূর্ণ অজানা, অতি দুর্গম দেশে চিংড়ি কিন্তু কোনও অদ্ভুত ক্ষমতায় যে সবচেয়ে নিরাপদে আর তাড়াতাড়ি লক্ষ্যের দিকে পৌঁছচ্ছে, বোঝা গেল।

এদিক দিয়ে পুরোপুরি খুশি হবার কারণ থাকলেও, লক তখন কিন্তু দারুণ ভয় আর দুর্ভাবনায় পড়েছেন। তাঁর যে দুশমনের ভয়ে লোধা-গোধার মতো দুই যমজ ঘটোৎকচকে তিনি পাহারায় নিয়েছেন, তার হাত থেকে তিনি যে রেহাই পাননি, তা তিনি এই অভিযানে চিংড়ি নদীর মোহনা থেকে রওনা হবার কদিন পরেই টের পেলেন।

সে দুশমন যে তাঁর সঙ্গেই আছে তার প্রথম প্রমাণ যা পাওয়া গেল তা খানিকটা যেন ঠাট্টার মতো ব্যাপার। অভিযানের বিবরণ টেপরেকর্ডারে তুলে রাখলেও পথের হদিস ধরে রাখবার জন্য ড, লক খুব সংক্ষেপে একটা মানচিত্রের খসড়া লিখে আর এঁকে রাখতেন। সেই খসড়া ম্যাপের উপর একদিন হঠাৎ কিছু হিজিবিজি কাটা দেখা গেল।

সেই হিজিবিজি কাটাকুটিতে ভাবনার খুব বেশি কিছু ছিল না। চিংড়ি হয়তো তাঁবুর ঝাড়পোঁছ করবার সময় অসাবধানে বা জংলি খেয়ালে তাতে অমন দাগ কেটে থাকতে পারে, কিন্তু সেই হিজিবিজির পাশে স্পষ্ট অক্ষরে যা লেখা, সেটাই তো অবিশ্বাস্য একটা রহস্য।

হিজিবিজির আশেপাশে গোটা-গোটা হরফে স্প্যানিশে লেখা—ট কোয়ে তাল আমিগো?

ড. লক স্প্যানিশ না জানলেও ও ক-টা কথার মানে জানেন। ও কথাগুলোর মানে হল, কেমন আছ বন্ধু?

এই অজানা বিদেশে এক গোপন অভিযানে এতদূর আসবার পরে তাঁর দুই যমজ দানব আর এক জংলি নফরের পাহারা দেওয়া তাঁবুতে ঢুকে একাজ কার পক্ষে কেমন করে সম্ভব হতে পারে?

সম্পূর্ণ ভৌতিক ছাড়া ব্যাপারটার তো আর কোনও ব্যাখ্যা হয় না।

অত্যন্ত অস্থির হলেও ব্যাপারটা নিয়ে হইচই না করে ড. লক রহস্যটা বুঝবার জন্য কিছুদিন নিঃশব্দে সজাগ থাকবেন বলে ঠিক করলেন।

কিন্তু তার ফল যা হল, তাতেই তাঁর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম।

 

৩.

গল্প বলতে বলতে চুপ করে গেলেন ঘনাদা। কী হল? কেন আর তিনি মুখ। খুলছেন না? কেন যে খুলছেন না, শেষ পর্যন্ত শিশিরই সেটা বুঝতে পেরে এগিয়ে দিল তার সিগারেটের টিন। ঘনাদা তার থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ফের শুরু করলেন তাঁর গল্প।

যেমন তাঁর নিয়ম, তেমনই সেদিন সকালের খাওয়া-দাওয়ার পর ড. লক তাঁর টেপরেকর্ডারটা নিয়ে তাঁর অভিযানের আগের দিনের বিবরণ রেকর্ড করবার ব্যবস্থা করছিলেন।

কিন্তু যন্ত্রটা দেখেই তো তাঁর চক্ষুস্থির।

তাঁর আগে কেউ যে সেটা ব্যবহার করেছে, তার স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়েছে।

সেটা নিয়ে যে নাড়াচাড়া করা হয়েছে তা লুকোবার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। যেখানে যন্ত্রটা থাকে, তার বদলে টেবিলের অন্য একধারে অগোছালো কাগজপত্রের মধ্যে এমনভাবে সেটা ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে ওখানে যে অন্য কারও হাত পড়েছে, তা বুঝতে কোনও কষ্ট না হয়।

এরপর যন্ত্রটা চালাতে যা শোনা গেল, তাতে ভাবনায়, আতঙ্কে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। স্পষ্ট জার্মান ভাষায় সেখান থেকে তখন শোনা যাচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে আছি, ড. লক। আর লক, তোমার আসল নাম যে স্কুল, তা আমার জানা।

টেপরেকর্ডারের কথা ওইটুকুতেই শেষ হয়েছে। কিন্তু যেটুকু ওখানে আছে তাই শুনেই ড. লক তখন চোখে অন্ধকার দেখছেন বলা চলে। প্রথমত, নিজের ঠিক মতো হুঁশ আছে কি না সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল। সত্যিই, নেহাত স্বপ্নে ছাড়া এরকম ব্যাপার ঘটা কি সম্ভব? মনের সংশয় কাটাবার জন্য টেপরেকর্ডারটা একবারের জায়গায় ড. লক বারবার, অন্তত দশবার, চালিয়ে দেখলেন।

না, তাঁর মনের ভুল নয়। সত্যিই কে একজন স্পষ্ট চলিত জার্মান ভাষায় ওই ক-টা কথা সেখানে রেকর্ড করিয়ে রেখেছে।

কিন্তু কার দ্বারা, কেমন করে তা সম্ভব? এ কাজ যে করেছে, তার তো এই অভিযানের সঙ্গেই থাকা দরকার। যে দুর্গম অজানা সব অঞ্চলের ভিতর দিয়ে চিংড়ি তাঁদের নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কারওর পক্ষে অজান্তে তাঁর দলের রাস্তা ধরেই লুকিয়ে সঙ্গে থাকা প্রায় অসম্ভব।

আর তা-ও যদি সম্ভব হয়, তা হলেও তাঁবুর ভেতর কখন কীভাবে ঢুকে সে এ কাজ করবে? তাঁবুর মধ্যে তিনি নিজে অধিকাংশ সময় থাকেনই। আর তা ছাড়া লোধা-গোধা দুজনেই সারাক্ষণ থাকে কড়া পাহারায়। চিংড়ির কথা ধরবারই নয়। তবু অকেও বাদ না দিয়ে ড. লক লোধা-গোধার সঙ্গে তাকে ডেকে অত্যন্ত কড়া ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।

লোধা-গোধা দুজনেই তো ড. লকের জেরা শুনে একেবারে হতভম্ব। এই সফরে তাদের সঙ্গে লুকিয়ে আসা কেমন করে সম্ভব?

আর যদিও লুকিয়ে-চুরিয়ে কেউ তাদের কাছাকাছি আসতে পেরে থাকে, এ তাঁবুর ভিতরে ঢুকে সাহেবের যন্ত্রপাতি ছোঁবার সময় সুযোগ সে পাবে কী করে?

লোধা-গোধার কাছে এর চেয়ে এ রহস্যের হদিস পাবার মতো উত্তর ড. লক আশা করেননি। তবু তাদের তিনি হয়রান করে মেরেছেন। সম্ভব-অসম্ভব হাজার রকম প্রশ্ন করে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়েই বিদায় দিতে হয়েছে তাদের।

লোধা-গোধার পর এ ব্যাপারে হদিস পেতে জংলি চিংড়িকে ডাকার কোনও মানে হয় না।

তবু কোনও দিকে ত্রুটি রাখবেন না বলে ড. লক লোধা-গোধাকে দিয়ে তাকেও ডাকিয়ে পাঠিয়ে তাদের দিয়ে চিংড়ির ভাষা কানুড়িতে তাকে জেরার ব্যবস্থা করেছেন। সে-জেরায় প্রথম প্রশ্নের উত্তরে চিংড়ির কথা শুনে কিন্তু তিনি থ। লকের হুকুমে লোধা-গোধা চিংড়িকে কানুড়িতে জিজ্ঞেস করেছিল, সে এ তাঁবুতে কাজ। করবার সময় আর কাউকে কখনও দেখেছে কি না।

চিংড়ি তাতে যা উত্তর দিয়েছে তা শুনে একেবারে থ হয়ে লোধা-গোধা সেটা অনুবাদ করে লক সাহেবকে বুঝিয়ে দিতেই গেছে ভুলে।

লক তাদের হতভম্ব ভাব দেখে ধমক দিয়ে ওঠার পর তারা থতমত খেয়ে চিংড়ি যা বলেছে তা জানিয়েছে।

চিংড়ি যা জানিয়েছে তাতে তাদের হতভম্ব হবারই কথা অবশ্য। চিংড়ি বলেছে, সে নাকি তাঁবুতে রোজই আর-একজনকে দ্যাখে।

রোজই আর-একজনকে দ্যাখে? কখন? লক লোধা-গোধাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছেন।

কখন আবার? চিংড়ি জানিয়েছে, যতক্ষণ সে এ তাঁবুতে থাকে, সারাক্ষণই।

সারাক্ষণই? লোধা-গোধার মারফত কথাটা শুনে কী মনে করবেন ভেবে না পেয়ে লক রাগে দাঁত খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, কোথায়? এ তাঁবুর কোথায়, কোনখানে?

লোধা-গোধার কাছে প্রশ্নটা শুনে নির্বিকারভাবে চিংড়ি যা দেখিয়ে দিয়েছে, তাতে হাসবেন, না জ্বলে উঠবেন ড. লক তা ঠিক করতে পারেননি।

চিংড়ি যা দেখিয়ে দিয়েছে সেটা তাঁবুর এক ধারে লকের চুল আঁচড়ানো, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম রাখার জন্য টেবিলের ওপর ঝোলানো একটা আয়না।

জংলিটাকে তখনকার মতো হাসতে হাসতে তাঁবু থেকে দূর করে দিলেও ব্যাপারটা নিয়ে লকের দুর্ভাবনা ক্রমশ চরমে উঠেছে।

চিংড়ির দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে তখন তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে গেছেন।

কাঁটাঝোপের আধা-মরু পাথুরে ডাঙা পার হয়ে যেতে যেতে মাঝে মাঝে ছোটখাটো হ্রদ আর শুকনো গভীর খাদ তাঁদের পথে পড়েছে। দূরে একটা আকাশ-ছোঁয়া যে পাহাড়ের চূড়া তাঁদের চোখে পড়েছে, সেটা ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরি ছাড়া আর কিছু নয় বলে বুঝেছেন লক।

কিন্তু এই সময়ে এমন কিছু হয়েছে যাতে তাঁর মাথা ঠাণ্ডা রাখাই শক্ত হয়ে পড়েছে। ব্যাপার যা ঘটেছে তা লকের টেপরেকর্ডারটা সম্পর্কেই।

প্রথম সেখানে অজানা ভুতুড়ে কণ্ঠ শোনার পর বেশ কিছুদিন আর কিছু হয়নি। ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরি দেখার পরই একদিন সকালে টেপরেকর্ডারে আবার সেই ভুতুড়ে গলা হঠাৎ সোচ্চার হয়ে উঠেছে, শোনো, শোনো ব্রুল, টেপরকেডার থেকে পরিষ্কার জার্মান ভাষায় শোনা গেছে, যেখানে তুমি চেয়েছিলে সেখানে তুমি প্রায় পৌঁছে গেছ বললেই হয়। আর একদিন কি একবেলা গেলেই নিয়ল হ্রদের কাছাকাছি। তুমি পৌঁছে যাবে। কিন্তু নিয়ল হ্রদ কি ক্যামেরুনের আগ্নেয়গিরি তো সত্যিই তোমার লক্ষ্য নয়। তোমার আসল লক্ষ্য, এই অঞ্চলের অসংখ্য সব অজানা গুহা-গহুর। এমন অদ্ভুত সন্ধানে কেন তুমি এসেছ, তা যে আমি জানি, তা বুঝতে পেরেছ কি? না পেরে থাকলে দুনিয়ার সবাই যা জানে সেই পুরনো ইতিহাস তোমায় একটু স্মরণ করিয়ে দেব। একটা দিন শুধু ধৈর্য ধরো।

টেপরেকর্ডার ওইখানেই চুপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ধৈর্য ধরবেন কী—রাগে, ভয়ে, দুর্ভাবনায় প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন ড. লক! টেপরেকর্ডারের কথায় যাঁর আসল নাম লক নয়, বুল!

ভেতরে ভেতরে খেপে গেলেও ব্রুল এবার চেঁচামেচি করে লোধা-গোধা কি চিংড়িকে ডাকাডাকি করেননি। তার বদলে, ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা দিয়ে টেপরেকর্ডারের সঙ্গে এমন কটা বৈদ্যুতিক তার লাগানো কলের ফাঁদ পেতে রেখেছেন যে, রেকর্ডারে কেউ হাত দিলেই একটা হঠাৎ ঝিলিক দেওয়া আলোয় গুপ্ত একটা ক্যামেরায় তার ছবি উঠে যাবে।

ছবি ঠিকই উঠল। তবে তা ব্রুলের নিজেরই ছবি। রেকর্ডারের সঙ্গে ক্যামেরার গুপ্ত সংযোগের কৌশলটা করে রেখে ব্লুল সেদিন কাছাকাছি অঞ্চলের একটু ভাসা-ভাসা জরিপের কাজ করেছেন, সেখানকার গুহা-গহ্বর, ছোটখাটো পাহাড়-টিবি-হ্রদ ছকে রাখবার জন্য। এ কাজে লোধা-গোধা আর চিংড়ি তাঁবুর পাহারা ঠিকই রেখেছে, আর তাঁকে তাঁর দরকারমত সাহায্য করেছে।

সন্ধেবেলায় ক্লান্ত হয়ে তাঁবুতে ফিরে প্রথমেই টেপরেকর্ডারের দিকে গিয়ে তাঁর ক্যামেরার ফাঁদ কী রকম কাজ করেছে দেখার ইচ্ছে হলেও তিনি নিজের ওপর রাশ টেনে রেখেছেন।

তারপর লোধা-গোধা আর চিংড়ি তাঁবুতে তাদের কাজ সেরে চলে যাবার পর অতি সাবধানে রেকর্ডারের কাছে গিয়ে সেটা চালাবার সুইচ টিপতেই আচমকা সেই অদ্ভুত ব্যাপার।

তাঁর নিজের পাতা ক্যামেরার ফাঁদে হঠাৎ আলোর ঝিলিকে তাঁর নিজেরই ফ্ল্যাশ ছাব উঠে গেছে।

আর সেইসঙ্গে চালু হওয়া টেপরেকর্ডারের অজানা ভুতুড়ে গলায় শোনা গেছে, বড় দুঃখিত ব্ৰল, তোমার পাতা ফাঁদে তোমাকেই কাবু হতে হল। কিন্তু এখন বাজে কাজে আর কথায় নষ্ট করবার সময় নেই। আসল কথা যা তোমায় বলতে চাই, তার জন্য দুনিয়ার সকলের যা জানা নেই, সেই পুরনো ইতিহাসটা তোমায় নতুন করে একটু আগে শুনিয়ে দিতে হবে। আজ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমের এই অঞ্চলটা জার্মানদের অধিকারে ছিল। এখনকার জার্মানি নয়, আগেকার জার্মানি। প্রথম মহাযুদ্ধ হবার পর কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের অধীন জার্মান সাম্রাজ্যের অনেক কিছুর মধ্যে এইসব জায়গার অধিকারও ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের হাতে চলে গেছে।

পৃথিবীর নানা দেশ জয় করে সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যাপারে ইংরেজরাই ছিল ইউরোপের আর-সব দেশের চেয়ে এগিয়ে। তখনও উড়োজাহাজের দিন শুরু হয়নি। পৃথিবীর সমুদ্রে সমুদ্রে যার যত বেশি রণতরীর প্রাধান্য, তার সাম্রাজ্যও তত বিরাট। সেঁদিক দিয়ে ইংল্যান্ডের পৃথিবীজোড়া সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যেত না বলে ছিল ইংরেজদের গর্ব।

ইংরেজদের পরে এ বিষয়ে দ্বিতীয় বৃহৎ বিশ্বসাম্রাজ্য ছিল ফরাসিদের। এই দুই জাতের পরে এদিকে দৃষ্টি দেয় বলে জার্মানির সাম্রাজ্য ছিল অনেক ছোট। কিন্তু পৃথিবীর যেটুকু জায়গা তারা অধিকার করেছিল, নানা দিকে তার উন্নতি বিধানের চেয়ে সেগুলি থেকে যতখানি সম্ভব সম্পদ সংগ্রহ করার ব্যাপারে তারা ছিল বুঝি সব দেশের চেয়ে অগ্রসর। এই অঞ্চলটাতেও তারা অনেক দিক দিয়ে অনেক কিছু বড় কাজ শুরু করেছিল। মহাযুদ্ধে হারের দুঃখ যেমন, তেমনই এইসব অধিকার হারাবার অপমান আর জ্বালা জার্মানদের অনেকেই ভুলতে পারেনি। আগের জার্মান সাম্রাজ্য লোপ পেলেও আবার নতুন করে পৃথিবী জয় করবার স্বপ্ন শুধু নয়, সে স্বপ্ন সফল করার সাধ্য-সাধনের জন্য যারা গোপনে গোপনে তৈরি হচ্ছে, তাদের নেতার নাম অ্যাডলফ হিটলার। হিটলার এখনও একটা জঙ্গি দলের সর্দার মাত্র। দেশপ্রেমের নামে পৃথিবীর আর সব দেশকে পায়ের তলায় চেপে শুধু হিংসা-ঘৃণা-স্বার্থপরতাই যেখানে মানুষের ধর্ম, বিশ্বের সঙ্গে শুধু প্রভু আর ক্রীতদাসের সম্বন্ধে বাঁধা এমন এক দানবীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাই গড়ে তুলতে চাইছে সে।

এই শতাব্দীর গোড়া থেকেই ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় জার্মানি যে বিজ্ঞানে কিছুটা বেশি অগ্রসর, তার প্রমাণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আকাশযান হিসেবে তার জেপেলিন তৈরি, সুদূর জার্মানি থেকে প্যারিসে গোলাবর্ষণ ইত্যাদির মতো ব্যাপারেই কিছুটা পাওয়া গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গেলেও সেই বিজ্ঞান-উদ্ভাবন দিয়েই হিটলারের দল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তা জিতবার স্বপ্ন দেখছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যুদ্ধে-নামা ইউরোপের সব দেশই পয়জন গ্যাস অর্থাৎ বিষবাষ্প ব্যবহার করার কথা ভেবেছিল। নানারকম বিষবাষ্প উৎপাদন করে তা জমা করে একটু-একটু ব্যবহারের পর বিষবাষ্প যে আর ব্যবহার করা হয়নি, তার কারণ, ঢিলের বদলে পাটকেল খাবার ভয়। তখন যারা বিষবাষ্প তৈরি করেছিল, সেসব দেশই তারপর সে সব গ্যাস সাবধানে নানা জায়গায় জমা করে লুকিয়ে রাখে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কাজে না লাগালেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তা যে ব্যবহার হবে না, সেকথা কে বলতে পারে! হিটলারের জার্মানি তাই অস্ত্র হিসেবে বিষবাষ্প জমা করে রাখতে চায়। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধে হেরে তার হাত-পা অনেক দিক দিয়ে বাঁধা। পয়জন গ্যাস বানাতে গেলে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দাদের চোখে তা ধরা পড়বারই কথা। পড়লে সব মতলব ভেস্তে যাবে। এ সংকট কাটাবার উপায় বার করবার জন্যই ড. লক নাম নিয়ে তোমার মতো গুপ্ত নাৎসির আসরে নামা। জার্মানি বিষবাষ্প খোলাখুলি, এমনকী লুকিয়েও, তৈরি করতে গেলে বিপদ আছে। তা থাক, বিষবাষ্প উৎপাদনের বদলে কোনও অজানা জায়গায় মজুত গ্যাস জোগাড় করবার ব্যবস্থা করলে তো সেভাবে ধরা পড়বার ভয় নেই।

কোথায় কোন অজানা জায়গায় সেরকম মজুত লুকনো গ্যাসের সঞ্চয় আছে? কোথায় আছে, তা আর কেউ না জানুক, জানে ব্লুল নামে এক জার্মান ভবঘুরে আধা-বৈজ্ঞানিক। দুর্গম অজানা সব দেশে টহল দিয়ে নানারকম অদ্ভুত খবর সংগ্রহই যার নেশা।

সেই ব্রুল প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির হার হওয়ার পর যুদ্ধের সময় জার্মানির হয়ে গুপ্তচরগিরি করার অপরাধে মিত্রশক্তির গোয়েন্দা-পুলিশের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে নানা জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল।

জার্মানিতে হিটলারের অধীনে নতুন নাৎসি দল গড়ে ওঠে, আবার জার্মানির বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু হবার পর। আগের যুদ্ধের মজুত করা পয়জন-গ্যাস কাজে লাগতে পারে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রুলের মনে পড়ে আগেকার এক আবিষ্কারের কথা। সে নতুন করে তা খুঁজে বার করবার কথা ভাবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে তার ভবঘুরে টহলদারির সময় সে ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরির চারধারে ছোট ছোট হ্রদ অঞ্চলে অনেক অনেক গুপ্ত হ্রদের গহুর দেখেছিল, যার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে বিষবাষ্প বেরিয়ে আশপাশের জংলিদের বসতিতে মড়ক লাগাত। সে তখনই বুঝেছিল যে এইসব গুপ্ত হ্রদের গহ্বরের তলায় এমন প্রচুর বিষবাষ্পের সঞ্চয় আছে যা বাইরে ছাড়া পেলে সারা দেশে মড়ক বাধিয়ে দিতে পারে। জার্মানির হারের পর সেখানকার অনেক পুরনো পাপী নাম ভাঁড়িয়ে যথাসম্ভব চেহারা পালটে ভিন দেশে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছিল। সে চেষ্টায় সফল তারা সবাই হয়নি। আসল পাপীরা অধিকাংশই ধরা পড়ে। তাদের উচিত শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। শুধু পাকা শয়তানদের তালিকা দেওয়া খাতায় তোমার নাম ছিল না বলে নয়, জার্মানির ভাগ্যের আকাশ যে অন্ধকার হয়ে আসছে, তা একটু আগে থাকতে বুঝে ইউরোপ ছেড়ে এই আফ্রিকায় এসে লুকোবার জন্যও তুমি এ যাত্রায় বেঁচে গেছ।

এই জংলা প্রবাসে কখনও খেয়ালি ভবঘুরে, কখনও টহলদার খ্রিস্টান সাধু সেজে তুমি ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে নিয়ল হ্রদের আশেপাশে গুপ্ত সব বিষবাষ্পের যেমন সন্ধান পেয়েছ, তেমনই জার্মানিতে কে এক অ্যাডলফ হিটলারের অধীনে জার্মানিকে আবার বিশ্বজয়ী করে তুলবার জন্য এক নাৎসি দলের অভ্যুত্থানের কথাও শুনেছ।

এরপর লুকিয়ে বার কয়েক ইউরোপ গিয়ে হিটলারের চেলা-চামুণ্ডার সঙ্গে যোগাযোগ করে তুমি তোমার আবিষ্কার করা পয়জন-গ্যাসের সঞ্চয়ের কথা জানিয়ে তার সঠিক-হদিস-জরিপ করে-দেওয়া মানচিত্র প্রস্তুত করে রাখবার জন্য আবার এই ক্যামেরুনসে রিও দে কামার্দে মানে চিংড়ি নদীর মোহনায় এসে নিয়ল হ্রদের অঞ্চলে যাবার সবচেয়ে সোজা আর নিরাপদ রাস্তা দেখাতে এই জংলি চিংড়িকে কাজে লাগিয়েছ।

ঘনাদা যে ফের মুখ বন্ধ করেছেন, তার কারণ অবশ্য আর কিছু নয়, ইতিমধ্যে আর-এক প্রস্ত চা এসে গিয়েছিল। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে, শিশিরের টিন থেকে সিগারেট ধরিয়ে, তিনি আবার গল্পের খেই ধরলেন।

দাঁতে দাঁত চেপে টেপরেকর্ডারের কথা শুনতে শুনতে ব্লুল হঠাৎ চমকে উঠে টের পায়, যে কথাগুলো সে শুনেছে, সেগুলো টেপরেকর্ডার থেকে নয়, তাঁবুর মধ্যে এইমাত্র ঢোকা সেই জংলি চিংড়িটার মুখ দিয়েই বার হচ্ছে।

জংলিটা কয়েক সেকেন্ড আগে যেরকম বেপরোয়াভাবে তাঁবুর ভেতর এসে টেপরেকর্ডারটা বন্ধ করে দিয়ে নিজেই কথা বলতে শুরু করেছিল তাতে হতভম্ব বিহ্বল হয়ে বুল তো তখন প্রায় তোতলা।

তু-তু-তু, মানে আপ-আপ-আপ, মানে আপনি, বলে আড়ষ্ট জিভটায় সাড় ফেরাবার চেষ্টায় তার মুখটা তখন লাল হয়ে উঠেছে।

থাক, থাক! বলে বেশ একটু ঠাণ্ডা গলায় তাকে থামিয়ে চিংড়ি বললে, আমার মতো জংলির মুখে সামান্য একটু জার্মান শুনে তুই থেকে অমন আপনি-তে উঠতে হবে না। তার বদলে শির-ভেঁড়া সন্ন্যাস-রোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে একটু ঠাণ্ডা হয়ে আমার কথাগুলো শোনো।

কিন্তু ব্রুল তখন রাগে অপমানে একেবারে আগ্নেয়গিরির ক্রেটার। তুই, তুই, বলে মুখ দিয়ে যেন লাভা ওগরাতে ওগরাতে তাঁবুর ভেতর হঠাৎ যমজ ঘটোৎকচের এক ভাই গোধাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বললে, কী করিস তোরা? কী জন্যে এত টাকা দিয়ে তোদের পাহারায় রেখেছি? কী বলে ওই চিংড়িটার মতো শয়তানকে আমাদের কাজে নিয়েছিস? আমি তোদের সকলকে গুলি করে মারব। হ্যাঁ, গুলি করে। তার আগে এই চিমসে চিংড়ি চামচিকেটাকে তাঁবু থেকে বার করে নিয়ে বার করে নিয়ে, হ্যাঁ, ওই নিয়ল হ্রদের ধারে একটা বিষাক্ত গ্যাসের গহ্বরে, হ্যাঁ, ওই গহ্বরেই ফেলে দিয়ে আয়।

ব্লুল সাহেবের এ-মূর্তি গোধা কখনও দ্যাখেনি। সে একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলে, গর্তে ফেলে দেব? ওই বিষাক্ত গ্যাসের গহূরে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা-ই ফেলবি, ব্রুল গর্জন করে উঠল, ছোটখাটো নয়, সবচেয়ে গভীর যে গহ্বর, সেইটাতে। কী করেছে এই চিমসে চিংড়িটা তা জানিস? জানিস ও কে?

কিন্তু সে সব কথা শোনার জন্য গোধা আর তখন সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। চিংড়িকে দু হাতে শূন্যে তুলে ধরে সে তখন তাঁবু থেকে ছুটে বেরিয়ে গেছে।

তারপর কতক্ষণ বা আর পাঁচ, বড়জোর সাত মিনিট-কী করবে ঠিক করতে

পেরে ব্রুল তখন তার তাঁবুর ভেতর খাঁচায় ভরা বাঘের মতো এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করছে।

সেলাম সাহেব! তার অস্থির পায়চারির মধ্যে ডাকটা শুনে বুল চমকে ফিরে তাকিয়ে অবাক।

তাকে তাঁবুর দরজার পর্দা সরিয়ে ডাকছে লোধা কি গোধা নয়, ডাকছে চিমসে চিংড়িটা।

অ্যাঁ, তুই! ব্রুলের গলায় বিস্ময়ের সঙ্গে বেশ একটু ভয় মেশানো-গোধা কোথায় গেল?

কোথাও যায়নি, চিংড়ি যেন আশ্বাস দিয়ে বোঝাল, তবে একটু ভাল ব্যান্ডেজ বাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর আপাতত একটু টিংচার আয়োডিন।

টিংচার আয়োডিন? ঝুল যেন রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠল, এমন অবস্থা হয়েছে যে, টিংচার আয়োডিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা দরকার? লোধা, লোধা, লোধা কোথায়?

না, না, তার তেমন কিছু হয়নি, চিংড়ি আশ্বাস দিলে, সেই তো দাদা গোর্ধকে বয়ে আনছে। তেমন জখম হলে কি পারত?

জখম হয়েও সে-ই দাদাকে বয়ে নিয়ে আসছে? বুলের গলায় যেন রাগ-দুঃখ-মেশানো আর্তনাদ ঠেলে উঠছে, এখন আমি কী করব বলতে পারো কেউ?

আমি পারি, চিংড়ি সান্ত্বনা দিয়ে বললে। তাতে ব্রুল আবার জ্বলে উঠল। হঠাৎ একটা ড্রয়ার থেকে তার রিভলভারটা বার করে চিংড়ির দিকে সেটা উঁচিয়ে ধরে সে গর্জন করে বললে, তোকে আমি গুলি করে মারব। যা তোর নাম, সে-ই চিংড়ি কি ইদুরের মতো।

রিভলভারের সামনে দাঁড়িয়েও চিংড়ি কি নির্বিকার? না। রীতিমত যেন ভয় পেয়ে সে বললে, থামো, থামো, ব্রুল, হুট করে এমন যা-তা করে ফেললা না। ও রিভলভারে আমাকে মারলে কী হবে তা একটু ভেবে দেখেছ? আমায় গুলি করে মারা মানে তোমার কী ভয়ানক বিপদ?

তোকে মারলে আমার বিপদ? ব্লুল জ্বলে উঠে বললে, তোর মতো একটা ছুঁচোকে মারলে–

থামো, থামো। চিংড়ি যেন কাতর মিনতি করে বললে, নেহাত যদি মারতেই চাও তো আমার পরিচয়টা তার আগে একবার ঠিক করে জেনে যাও। আমায় একবার বলছ ইঁদুর, তারপরে আবার চিংড়ি, তারপর আবার বললে ছুঁচো। আমি তোমার চোখে ঠিক কোনটা সেইটা মরার আগে-আগে জেনে যেতে চাই। সেই সঙ্গে এটুকু শুধু নিবেদন করতে চাই যে, চিংড়ি, ইঁদুর ছুঁচোকে কেউ গুলি করে মারে না। তাদের—

তু-তুই—, রাগে প্রায় তোতলা হয়ে ব্রুল গর্জন করে বলবার চেষ্টা করলে, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে রসিকতা করছিস? এত বড় তোর সাহস? ভাবছিস, তোকে আমি গুলি করে মারতে পারি না? তোর মতো একটা ছুঁচো, একটা চামচিকে—

থামো, থামো, চিংড়ি এবার ঠাণ্ডা গলায় ঝুলকে যেন শান্ত করতে চাইলে, ছুঁচো, চামচিকে, ইঁদুর, চিংড়ি—যা-ই আমি হই না কেন, আমায় গুলি করে নিশ্চয়ই তুমি মারতে পারো, কিন্তু মারলে কী হবে তা একটু ভেবে দেখেছ?

কী ভেবে দেখব? ব্লুল চিৎকার করে বললে, তোকে মারলে কোন আইনে কে। আমাকে এখানে ধরবে? তোকে এই রিভলভারের গুলিতে বাঁঝরা করে লাশটা শুধু ওই একটা বিষাক্ত গ্যাসের পাতাল-গুহায় ফেলে দেব।

হ্যাঁ, তা দিতে পারো, চিংড়ি যেন তা স্বীকার করে নিয়ে বললে, কিন্তু তারপর?

তারপর মানে? ব্লুল দাঁত খিঁচিয়ে বললে, তারপর আবার কী?

তারপরেই যত গণ্ডগোল, যেন দুঃখের সঙ্গে জানালে চিংড়ি।

তারপরে গণ্ডগোল? তোর মতো একটা–তোর মতো একটা—

ব্রুলকে তার তোতলামির মধ্যে থামিয়ে দিয়ে চিংড়ি বললে, হ্যাঁ, আমার মতো ছুঁচো, ইঁদুর, চামচিকে, চিংড়ি, যা-ই বললা, তাকে মারার পর কত গণ্ডগোল শুরু, তা বুঝতে পারছ না? শোনো, বুঝিয়ে বলি। আমার মতো একটা ইঁদুর, চামচিকে, চিংড়ি যা-ই বলো, তাকে তোমার রিভলভারে ঝাঁঝরা করে একটা বিষাক্ত গ্যাসের পাতাল-গুহায় না হয় ফেলে দিলে। কিন্তু তারপর তুমি নিজেই যে একেবারে অথই গাজায় পড়বে, তা বুঝতে পারছ কি?

তোকে পাতাল-গুহায় ফেলে আমি অথই গাড্ডায় পড়ব?কথাগুলো রাগে গর্জন করে বলবার চেষ্টা করলেও ব্রুল তার হতভম্ব ভাবটা ঠিক লুকোতে তখন পারছে না। সে-ভাবটা যথাসাধ্য চাপা দিয়ে তবু দাঁত খিঁচিয়েই বললে, কেন? তুই ভূত হয়ে আমায় গাড্ডায় ঠেলে দিবি?

না না, ভূত হতে হবে কেন আমাকে? চিংড়ি বোঝাবার চেষ্টা করলে, আমি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে কোনও পাতাল-গুহায় তলিয়ে গেলে তোমার কী অবস্থা হবে তা একটুও বুঝতে পারছ না? বুঝতে পারছ না যে, আমি না থাকলে তুমি তোমার ওই লোধা-গোধাকে নিয়েও কী অসহায়! ভুলে যাচ্ছ কেন যে, এই অজানা মরু-পাহাড়-জঙ্গলের দেশে আমি পথ দেখিয়ে তোমাদের নিয়ে এসেছি। আমি না থাকলে সারা জীবন খুঁজে খুঁজেও এখান থেকে উদ্ধার পাবার পথের হদিস পাবে না। সুতরাং আমার লাশ যদি বিষাক্ত গ্যাসের পাতাল-গুহায় পড়ে থাকে, তা হলে তোমার লাশও এখানকার মরু-পাহাড়-জঙ্গলে কোথাও রোদে-বৃষ্টিতে শুকোবে কি পচবে, কিংবা এখানকার সিংহ-চিতা-নেকড়ের মতো হিংস্র প্রাণীদের পেটেও যেতে পারবে। তাই বলছি, আমায় মারার মতো অমন ভুল করার চেষ্টাও কোরো না।

একটু থেমে চিংড়ি আবার বললে, গুলি করেও কোনও লাভ নেই অবশ্য। তোমার ওই রিভলভার আমি আগে দেখিনি মনে করেছ? এর মধ্যে আমায় মারবার মতো একটি গুলিও আমি রেখেছি? সুতরাং শান্ত হয়ে আমার কথা শোনেনা। শোনো, দেশকে ভালবাসো বলে নাৎসিদের দলে একসময় ভিড়েছিলে বটে, কিন্তু নীচ নোংরা কাজ কখনও করোনি। তা ছাড়া এককালে খ্রিস্টান সাধু হয়ে আফ্রিকার এই ক্যামেরুনস অঞ্চলের হতভাগ্য অধিবাসীদের মধ্যে থেকে তাদের সেবায় জীবন কাটিয়ে তাদের উন্নতির জন্য যা দরকার, তা করবার ইচ্ছে তোমার ছিল। আজ আবার সেই সুযোগই তোমার এসেছে। এই আগ্নেয়গিরির অজানা অঞ্চলে অসংখ্য বিষাক্ত গ্যাসের পাতাল-গুহা আছে। সেই সব গোপন গুহা থেকে বিষাক্ত গ্যাস মাঝে মাঝে বেরিয়ে আদিবাসীদের সব বসতি ধ্বংস করে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। তাদের রক্ষা করবার ব্রত নিয়ে তুমি এই অঞ্চলে নিশ্চয়ই একটি মঠ গড়ে তুলতে পারো। সেই মঠ ধর্মের জন্যও যেমন, বিজ্ঞানের গবেষণাতেও তেমনই তন্ময় হয়ে থাকবে। অন্য সব কাজের মধ্যে এখানকার বিষবাষ্প জমানো গুপ্ত গুহার খবর রাখাই হবে তোমার মঠের প্রধান দায়িত্ব। এখানে সেরকম কিছু বেয়াড়া ব্যাপারের আভাস পেলেই তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো তোমার জংলি আদিবাসী ভক্তদের দিয়েই রাজধানীতে না পারো অন্য কোনও ব্যবসার ঘাঁটিতে খবর পাঠাবে। সময়ে খবর পেলে এ বিষবাষ্পের সর্বনাশা ক্ষতি হয়তো ঠেকানো যাবে।

চিংড়ির কথা শুনে ব্রুল সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওই নিয়ল হ্রদের কাছেই তার মঠ স্থাপনা করেছিল। অন্তত করেছিল বলেই আমার ধারণা। গুপ্ত সব গুহা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে যে ভয়ংকর সর্বনাশ এবার হয়ে গেল, তার আভাস পেয়ে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কুল তা জানাবার জন্য তার আদিবাসী দূতকে নানা জায়গায় পাঠিয়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই ফাং থেকে ফুলানি থেকে হাউসায় কথা চালাচালি করায় কোথাও না-কোথাও ভুল হওয়ার জন্যই সে-খবর আমাদের সভ্য জগতে পৌছয়নি। কিংবা—

কিংবা কী ঘনাদা, আমরা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

কিংবা–ঘনাদা একটু ধীরে ধীরে বললেন, সেই চিংড়ির সঠিক পরিচয় জানার কৌতূহলটা তার কাছে এত বড় হয়েছে যে, সেই সন্ধানে বেরিয়ে আর তার আফ্রিকায় ফিরে মঠ গড়া হয়নি।

সত্যিই দুঃখের কথা, সহানুভূতি জানিয়ে আমরা বললাম, কিন্তু ওই চিংড়ি সত্যিই কে বলুন তো, ঘনাদা?

বনোয়ারির হাতে খাবারের প্লেট সাজানো ট্রে তখন এসে পড়েছে। ঘনাদার কাছে। কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।